1 of 2

দক্ষিণান্ত – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

দক্ষিণান্ত – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

গাড়ির ভেতরে অন্ধকার দুলছে। একটা বিরাট কালো পেন্ডুলাম যেন। সকালবেলা মোগলসরাইয়ের আগে স্টপেজ নেই আর। চাকায়-চাকায় বেড়ে-চলা স্পিডের অস্থিরতা। কত মাইল জোরে ছুটতে পারে এই ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিনগুলো? পঞ্চাশ—ষাট—সত্তর?

গাড়ি—অন্ধকার—সময়। একসঙ্গে ছুটে চলেছে। মোগলসরাইয়ে পৌঁছবার আগে অনেকগুলো নক্ষত্র ঝরে যাবে। আর অনেক মাইল। আর এলোমেলো সহস্র স্বপ্নের ভিড় ঠেলে চেতনার সীমান্তে এসে চোখ মেলে তাকাবে ঊর্মিলা। কিন্তু তার আগেই সাপের জিভের মতো ধারালো টর্চের আলো এসে পড়ল ঊর্মিলার চোখে।

ঊর্মিলা জাগল না। তরল ঘুমের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম অনুভূতির মতো হয়তো মনে হল যেমন হয়—পাশ কাটিয়ে যাওয়া কোনও স্টেশনের ইলেকট্রিকের আলোই বুঝি কাচের জানলা দিয়ে। ঘুমের মধ্যে আচমকা খানিক তপ্ত রোদের স্বপ্নই দেখল হয়তো বা।

কিন্তু টর্চ যে জ্বেলেছিল সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল পাথর হয়ে। সেই যে কেঁপে উঠেই টর্চটা নিভে গিয়েছিল, তারপরে তার অবশ আঙুল আর টর্চের বোতামটাকে খুঁজে পেল না। চলন্ত গাড়ির বেপথু অন্ধকারে আশ্চর্য দৃঢ়তায় সে দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। একটা পাহাড়ী নদীর স্রোতের উলটো মুখে প্রাণপণে জল ঠেলে যেমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়—ঠিক সেইরকম।

গাড়ি—অন্ধকার—সময়। সব একসঙ্গে ছুটে চলেছে। বাইরে নয়, তার মনের মধ্যেই। এইবারে তার দুটো পা বেয়ে একটা তীক্ষ্ন হিমার্ততা উঠে আসতে লাগল ওপর দিকে। একবারের জন্য মনে হল, যে-পথ দিয়ে সে এসেছে, সেই পথ দিয়েই সে ছিটকে চলে যায় বাইরে। কিন্তু হাতের কাছে হঠাৎ কখনও একশিশি প্রাণঘাতী বিষ পেলে যেমন অকারণে, অর্থহীন কৌতূহলে সেটাকে পরখ করে দেখতে ইচ্ছে করে—তেমনি একটা বিষাক্ত মাদকতায় সে অভিভূত হয়ে রইল খানিকক্ষণ।

তারপর : তারপর সেই ঠান্ডা সর্পিল অনুভূতিটা যখন তার বুকের কাছে উঠে আসতে লাগল, যখন একটা নিষ্ঠুর বরফের মুঠি দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইল তার হৃৎপিণ্ড, তখন—।

তখন আর থাকতে পারল না। দু-পা পিছনে সরে এসে খুট করে সুইচটা টেনে দিল সে।

উজ্জ্বল খরধার আলোয় ভরে গেল কামরা। একটা নিঃশব্দ আর্তনাদ তুলে অন্ধকারটা যেন ঝাঁপ দিয়ে পড়ল চাকার তলায়।

আর সচকিতে উঠে বসল ঊর্মিলা। সন্ত্রস্তভাবে পায়ের দিকে টেনে দিল শাড়িটা। চোখের সামনে বিভীষিকার মতো ফুটে উঠল একা গাড়িতে আর-একটি অপরিচিত মানুষ। মুখের ওপর নিচু করে নামানো কালো একটা ফেলট হ্যাটের ছায়া পড়েছে। ছাইরঙা টাউজারের পকেটে একটা হাত পুরে দিয়ে, আর একটা হাত সুইচের ওপর রেখে প্রেতমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সে।

আর্তস্বরে প্রাণান্তিক একটা চিৎকার করে উঠল ঊর্মিলা—হাত বাড়াতে গেল মাথার কাছে অ্যালার্ম সিগন্যালের দিকে। সেই মুহূর্তেই ধীরাজ ডাকল, ঊর্মিলা!

চমকে উঠেই নিঃসাড় হাতখানা খসে পড়ল ঊর্মিলার পাশে। কাঠের পুতুলের মতো চোখ মেলে তাকিয়ে রইল সে। ততক্ষণে মাথা থেকে ফেলট হ্যাটটা সরিয়েছে ধীরাজ। সেই লালচে রঙের কোঁকড়ানো চুল, একটা মোটর দুর্ঘটনার স্মারক ডান চোখের ওপরের সেই কাটা দাগটা। চারবছর পরে হলেও ভুল হওয়ার কারণ নেই বিন্দুমাত্র।

তুমি!

নিঃশব্দে হাসল ধীরাজ। আর-একটা নির্ভুল প্রমাণ হিসেবে ঝিলিক দিয়ে উঠল বাঁধানো দাঁতের দুটো রূপালি ক্লিপ।

দেখাটা খুব নাটকীয়ভাবে হল, তাই না?—মুখের ওপরে হাসিটা জাগিয়ে রেখেই এগিয়ে এল ধীরাজ—বসে পড়ল ঊর্মিলার কাছে। একবারে গা ঘেঁষে বসল না—একটা সৌজন্য-সঙ্গত দূরত্ব বজায় রাখল মাঝখানে। আবার স্তব্ধতা। ছুটন্ত টেনের সঙ্গে-সঙ্গে দুজনের মনে অজস্র কথা কল্লোলিত হয়ে ওঠার স্তব্ধতা। বিস্ময়ের ঝড়টা ভেঙে পড়বার আগে থমথমে কঠিন স্তব্ধতা।

তুমি—তুমি!—এবার গোঙানির মতো মনে হল ঊর্মিলার গলা।

নিজের কথাগুলোকে নিয়ে আলতোভাবে খেলা করবার ভঙ্গিতে ধীরাজ বলল, অনেক দিন পরে দেখা হল, ঊর্মি। বড় ভালো লাগছে তোমাকে। একটু মোটা হয়েছ—আরও সুন্দর হয়েছ দেখতে।

আস্তে-আস্তে বিহ্বলতার ছায়াটা সরে যেতে লাগল ঊর্মিলার মুখ থেকে। তার জায়গায় কয়েকটা তীক্ষ্ন যন্ত্রণার রেখা ফুটে উঠতে লাগল।

আমার সুন্দর হওয়া না-হওয়ায় কী আসে যায়?—মৃদু কণ্ঠে ঊর্মিলা বলল, আমি তো তোমায় বাঁধতে পারিনি। আজ এ-গাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ থাকলেই তুমি খুশি হতে।

হঠাৎ হা-হা করে একটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ধীরাজ।

তুমি কি মনে করো, ঊর্মি—এই যোগাযোগটা নেহাত কাকতালীয়? মোটেই না। গয়া স্টেশনে ট্রেনে উঠতে গিয়েই এই কামরায় তোমায় দেখতে পেলাম। কী করব ভাবতে-ভাবতে গাড়িটা দিল ছেড়ে। খানিকক্ষণ ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে থেকে দরজার হাতল ঘোরালাম। লক করা ছিল না—চলে এলাম ভেতরে।

তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না ঊর্মিলা। প্রশ্ন করল না, জানলার সূক্ষ্ম জালের ভেতর দিয়ে কী উপায়ে অন্ধকার কামরায় তাকে দেখতে পেল ধীরাজ। বলতে চাইল না, ঘুমোনোর আগে নিজের হাতেই সে শক্ত করে লক করেছিল দরজাটা।

এ ভারি অন্যায়, ঊর্মি।—ধীরাজের গলায় অনুযোগের রেশ : এতবড় একটা লেডিজ কম্পার্টমেন্টে তুমি একা। দরজা লক না করে ঘুমোতে আছে এভাবে? পথেঘাটে কতরকম বিপদ ঘটে আজকাল।

তুমি আসবে বলেই দরজা খুলে রেখেছিলাম।

আমাকে ঠাট্টা করছ, ঊর্মি?—ধীরাজ ব্যথিত হল অবশ্য সে-দাবি তোমার আছে। তোমার সম্পর্কে যে-অন্যায় আমার হয়েছে তার দায়িত্ব আমি অস্বীকার করছি না। তাহলেও এরকম অসাবধান হয়ে চলাফেরা করাটা—।

কিছুক্ষণ ধীরাজের মুখের দিকে অদ্ভুত বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল ঊর্মিলা। তারপর বলল পৃথিবীতে সব বিপদ থেকে আমাকে রক্ষা করার ভার ছিল তোমারই। সে-ভার তুমি যখন বইতে চাও না, তখন কোনও বিপদকেই আমার ঠেকানোর সাধ্য নেই। চারদিকের দেওয়াল যার ভাঙা, একটা দরজা লক করা না-করায় তার কতটুকু আসে যায়?

কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল ধীরাজ। মলিন জুতোটা ঠুকতে লাগল মেঝের ওপর।

তোমার কাছে ক্ষমা চাইব না, ঊর্মি। সে-জোর নেই। কিন্তু তোমার তো উপায় ছিল।

কী উপায়?

হিন্দুমতে বিয়ে করে তোমাকে জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনে জড়াইনি আমি! সিভিল ম্যারেজ হয়েছিল আমাদের। আদালতে একটা দরখাস্ত করে দিলেই তুমি মুক্তি পেতে আমার কাছ থেকে।

মুক্তি!—এতক্ষণে হাসল ঊর্মিলা। মৃদুরেখ—নীরক্ত।

দূরে থাকলেও আমি তোমার খবর নিয়েছি বরাবর। আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি কেন তুমি এখনও ঊর্মিলা মুখার্জি থেকে আমার অপরাধকে বয়ে চলেছ। কেন তুমি ফিরে যাওনি কুমারী ঊর্মিলা মল্লিকের মর্যাদায়?—একটা অনুতপ্ত জিজ্ঞাসায় এসে থমকে গেল ধীরাজ।

জানলার জালের ওপর চোখ রেখে বাইরের তরঙ্গিত অন্ধকারে কী দেখতে চাইল ঊর্মিলাই জানে। স্বগতোক্তির মতো বলল, পদবি বদলালেই কি সব বদলায় বলে তোমার ধারণা?

মন?—নিজের অজান্তেই ধীরাজ উচ্চারণ করল শব্দটা।

ঊর্মিলা আবার ধীরাজের দিকে ফিরিয়ে আনল দৃষ্টি—বিদ্যুৎ ঠিকরে পড়ল তা থেকে।

তুমি তার অস্তিত্ব মানো কি না জানি না। কিন্তু ওটা অনেকের থাকে।

তাহলে—ধীরাজ প্রায় গুঙিয়ে উঠল এবার তাহলে আজও তুমি আমাকে ভালোবাসো, ঊর্মিলা?

ঊর্মিলা জবাব দিল না।

প্রায় আর্তস্বরে ধীরাজ বলল, কিন্তু এর তো কোনও প্রয়োজন ছিল না। আমাকে মনে রাখার মতো কিছুই তোমাকে আমি দিয়ে আসিনি। বিয়ের একমাস না কাটতেই যখন আমার চোখের নেশাও কাটল, তারপর দেড় বছরের বিবাহিত জীবনে একটি দিনও তোমার সুখের স্মৃতি নয়! বাবার চেকবইয়ের পাতা জাল করে টাকা চুরি করেছি—স্বীকারোক্তির স্বর্গীয় অনুতাপে উদ্বুদ্ধ গলাটাও একবারের জন্য ধরে এল ধীরাজের : বন্ধুর স্ত্রীকে ভুলিয়ে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছি—।

থাক—থাক।—যন্ত্রণায় বিকৃত মুখে ধীরাজকে থামিয়ে দিল ঊর্মিলা : থাক ওসব।

ধীরাজ চুপ করল। তা-ই বটে। এসব কথা নতুন করে মনে করিয়ে দিয়ে লাভ নেই আর। স্বীকারোক্তিটা আত্মপ্রসাদের রূপ নিচ্ছে যেন। অপরাধের তালিকা পেশ করতে গিয়ে যেন নিজের গৌরব প্রচার করছে সে। নতুন করে অস্ত্রোপচার করছে ঊর্মিলার শুকিয়ে আসা ক্ষতের ওপরে।

কিন্তু এরকম বিয়ে তো অনেকেই নাকচ করে, ঊর্মি।—ধীরাজ আবার সূত্র ধরল সন্তর্পণে।

সবাই করে না।—অল্প-অল্প কাঁপতে লাগল ঊর্মিলার ঠোঁট। হঠাৎ হাতের পিঠে সে চোখের থেকে আড়াল করে ধরল আলোটা। বড্ড বেশি জোরালো—বড্ড বেশি জ্বালা করছে চোখে। ঝরঝরিয়ে জল নেমে আসবে কি না কে জানে।

প্রেম অনেকের জীবনে ঋতুতে-ঋতুতে আসে—বারে-বারে ফুল ফোটায়।—চোখের জলটাকে কিছুতেই ঝরতে না-দেওয়ার প্রতিজ্ঞায়, ঠোঁটে একটা প্রাণপণ চাপ দিয়ে ঊর্মিলা শেষ করল কেউ-কেউ দেউলে হয়ে যায় একবারেই।

অনুভূতি-কল্লোলিত স্তব্ধতায় আবার নীরব হয়ে বসে রইল দুজন। গাড়ির চাকায় ছিটকে সরে যেতে লাগল দেশ-কাল—দু-একটি তারা ঝরে যেতে লাগল কৃষ্ণপক্ষের কালো আকাশে। একটা ব্রিজ গুমগুম করে গুমরে চলল পায়ের নীচে। শোন? তাই হবে হয়তো।

কী করা উচিত এর পরে? ধীরাজ ভাবতে লাগল। রক্তের মধ্যে একটা উদ্বেলিত আবেগ ঠেলে উঠতে চাইছে। কতদিন পরে আজ সে নতুন করে দেখল ঊর্মিলার মুখ! পাঁচবছর আগেকার একরাশ নীল বিকেল, রোমাঞ্চিত সন্ধ্যা, কথা বলা না-বলা রাত্রি—সব একসঙ্গে দীপিত হয়ে উঠল ঊর্মিলার মুখে।

এখনই একটা আশ্চর্য মুহূর্ত সৃষ্টি করতে পারে ধীরাজ। আবার পুরোনো দিনগুলোর মতো ঊর্মিলাকে বুকে টেনে নিতে পারে—ক্ষমা চাইতে পারে, বলতে পারে : সব শোধবোধ হয়ে গেছে। এসো, আবার শুরু করা যাক নতুন পালা। ক্লান্ত, আমিও ক্লান্ত। অনেক অন্ধকার পার হয়েছি—হাতড়ে ফিরেছি অনেক চোরাগলির আনাচে-কানাচে। দেখেছি, দাঁড়ানোর জায়গা কোথাও নেই—কোথাও নেই আশ্বাসের একান্ত আশ্রয়। আজ আবার তুমি নতুন করে আমার হাত ধরো, ঊর্মিলা! মুক্ত করো আমাকে—আমাকে উত্তীর্ণ করো—।

কিন্তু সে-সাহস কোথায় ধীরাজের? তিনবছরের বিচ্ছেদ যে-প্রেমকে জাগিয়ে রেখেছে, একটা মুহূর্তের ছোঁওয়া তাকে ঘৃণার মধ্যে রূপান্তরিত করে দেবে হয়তো। না—সাহস নেই ধীরাজের।

আকস্মিকভাবে প্রসঙ্গ বদলে ফেলল ঊর্মিলা। যেন মুক্তি পেতে চাইল অসহ্য স্নায়বিক পীড়ন থেকে।

চা খাবে একটু?

চা!—ধীরাজ নড়ে বসল।

আছে আমার ফ্লাস্কে। হয়ে যাবে দুজনের।

দাও।—অন্য প্রসঙ্গে সরে যেতে পেরে ধীরাজও যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ভালো হল—এই-ই ভালো হল। পুরোনো দিনগুলো জীর্ণ হয়ে যাক কবরের ভেতরে। তার ওপরে মাথা তুলুক এলোমেলো আগাছার সারি। কোনও একদিন পরিচয় ছিল—আজ দেখা হয়ে গেল আকস্মিকভাবে। যেটুকু ধীরাজের পক্ষ থেকে বলার একটা নৈতিক কর্তব্য ছিল, তা বলা হয়ে গেছে; উত্তরে যা বলার ছিল, তাও বলেছে ঊর্মিলা। এর পরে চা খাওয়া যাক সহজভাবে। সকালবেলায় যখন মোগলসরাইতে ট্রেন পৌঁছবে, তখন বিদায়-সম্ভাষণ জানানো যাবে সৌজন্য-সঙ্গত স্মিত হাসিতে। হয়তো এমনও বলা যাবে : দুজনে একসঙ্গে কিছুটা সময় নেহাত মন্দ কাটল না। কী বলো?

বার্থের তলা থেকে ফ্লাস্কটা টেনে আনল ঊর্মিলা। একটা বেতের ঝুড়ি থেকে বের করল চায়ের পেয়ালা আর প্লাস্টিকের গ্লাস। ছুটন্ত টেনের দোলার ভেতরে যথাসম্ভব সাবধানে চা ঢালল গ্লাসে আর পেয়ালায়। তারপর পেয়ালাটা ধীরাজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, কিছু খাবে?

না, থাক।

থাকবে কেন?—কোমল গলায় ঊর্মিলা বলল, অনেক খাবার আছে টিফিন কেরিয়ারে।

না, না—এই অসময়ে কিছু খেতে পারব না।

চায়ের গ্লাসটা তুলে নিয়ে নিজের জায়গায় উঠে বসল ঊর্মিলা। হাসল একটু। এতক্ষণ পরে তার হাসিটা স্বচ্ছ হয়ে আসছে।

ভুলে গেছ সব? ট্রেনে উঠলেই তোমার খিদে পেত। দিন হোক, রাত হোক—যে-স্টেশনে যা পেতে তাই কিনে খাওয়ার অভ্যেস ছিল তোমার। পুরি, মিঠাই, গরম দুধ থেকে চিনেবাদাম পর্যন্ত।

কথাটা বলেই আবার বিবর্ণ হয়ে গেল ঊর্মিলা। ঘুরেফিরে সমস্ত আলোচনা আবার সেই ব্যথার জায়গাটায় এসে কেন্দ্রিত হচ্ছে। মুহূর্তে সেটা লক্ষ করল ধীরাজ। গুমোট মেঘটাকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য হেসে উঠল হা-হা করে।

বাস্তবিক, কী পেটুকই যে ছিলাম! কিন্তু এখন ওসব বদ অভ্যেস ছেড়ে গেছে, ঊর্মি। বয়েস বাড়ছে তো! অসময়ে খেলে আজকাল আর সহ্য হয় না।

বয়েস বাড়ছে! তা বটে। সেই আশাতেই তো দিন কাটাচ্ছে ঊর্মিলা। আরও কয়েকবছর পার হয়ে যাবে। পাক ধরবে মাথার চুলে, আজকের বেদনা নুন-ঝালের স্বাদের মতো আবসরিক রোমন্থনে পরিণত হয়ে যাবে। সেদিন ঊর্মিলার মনে হবে না—কী হতে পারত, কী হয়ে গেছে সে! সেদিন নিশ্চিত হয়ে ভাবা যাবে—যা হওয়ার তা হয়েই গেছে, এখন শান্ত নির্লিপ্তিতে নিজেকে ভাটার মুখে ভাসিয়ে দেওয়ার পালা।

তাই হোক। বয়েস বাড়ুক ঊর্মিলারও। সেই নির্লিপ্তির নিরাসক্তিতে সে-ও সমাহিত হোক।

কোথায় চলেছ তুমি?—ঊর্মিলাই প্রশ্ন করল।

জবাব দেওয়ার আগে নিজেকে একবার সামলে নিল ধীরাজ। তারপর বলল, মোগলসরাই।

ওখানেই থাকো?—জিজ্ঞাসাটা অর্থহীন জেনেও ঊর্মিলা রোধ করতে পারল না।

গয়াতে থাকি। ডেরি-অন-শোন, মির্জাপুরেও কখনও-কখনও।—ধীরাজ হাসতে চাইল : সে যাক। তুমি?

কলকাতাতেই আছি।—চায়ের গ্লাসটা নামাল ঊর্মিলা, অত্যন্ত বিস্বাদ মনে হল চা-টাকে একটা কলেজে ডেমনস্ট্রেটারের চাকরি নিয়েছি।

তবু ভালো।—চাপা উত্তেজনায় ঠোঁটের একটা কোণ বেঁকে এল ধীরাজের : আমার বাবার অন্ন তোমাকে মুখে দিতে হয় না। আমার অপরাধে সে-অন্ন দিনের পর দিন বিষ হয়ে উঠত তোমার মুখে।

জানলার জালের মধ্যে দিয়ে ঊর্মিলা আবার তাকাল বাইরের দিকে। রাত্রির রং ধূসর হয়ে আসছে। আরও—আরও নক্ষত্র ঝরে গেছে। ঝরে গেছে আরও সময়।

কোথায় চলেছ?—ধীরাজই জের টানল।

দেরাদুন। বাবা আজকাল ওখানেই বদলি হয়েছেন।

এই গরমে দেরাদুন!—হৃদ্যতার আমেজ আনল ধীরাজ।

কাছেই মুসৌরি।—অদ্ভুত দৃষ্টিতে ধীরাজের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ঊর্মিলা : তা ছাড়া তুমি জানো, আমি পাঞ্জাবের মেয়ে।

মনে ছিল না।—ধীরাজ সপ্রতিভ হতে চাইল।

আবার নীরবতা। আবেগচঞ্চল নয়, কথামুখর নয়। সব কথা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার—সব অনুভূতি নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার নীরবতা। বিস্ময়, অনুতাপ, আবেগের পালা শেষ হয়ে গেছে। চা খাওয়া, দুটো-একটা ভদ্রতাসুলভ বাক্য-বিনিময়—তাও ফুরিয়ে গেল। তারপর?

আর থাকা যায় না—আর বসা যায় না ঊর্মিলার কাছে। এইবার পালানো দরকার—যেমন করে এসে উঠেছিল এই গাড়িতে, তেমনি করে বিনা নোটিশে আবার নিজস্ব কক্ষপথে ছিটকে পড়া। এই ট্রেন যখন দেরাদুনে পৌঁছবে, তখন এই রাত্রিটিকে ঊর্মিলার অতীত দিনগুলির মধ্যে বিলীন করে দেওয়া দরকার।

হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল ধীরাজ। ট্রেনটা পাংচুয়াল। আর দশমিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে মোগলসরাই। টুকরো-টুকরো কথা নিয়ে নৈঃশব্দ্যকে জুড়তে-জুড়তে কী করে পার হয়ে গেল এই দীর্ঘ সময়টা!

এবারে মরিয়া হয়ে ধীরাজ জিগ্যেস করল, তুমি ভালো আছ তো?

হ্যাঁ, ভালোই আছি।—ঊর্মিলার জবাব। একটা লোহার প্রাচীর পড়ল এইবার। দশমিনিট ধরে অসহ্য অস্বস্তিতে, একটার পর একটা মুহূর্ত গুনে যেতে হবে এরপরে। বুকের ওপরে চেপে ধরা একটা পাথরের মতো এই নীরবতা নিশ্বাস বন্ধ করে আনবে। মোগলসরাই পৌঁছনোর আগেই বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়বে নাকি ধীরাজ?

না, একটা উপায় আছে এখনও। পকেট থেকে আধপোড়া একটা চুরুট বের করে আনল সে। তারের জালটায় চোখ রেখে দুর্ভেদ্য তন্ময়তার আড়ালে হারিয়ে রইল ঊর্মিলা।

স্টেশন মোগলসরাই। আরক্ত সকাল। কুলি আর যাত্রীর কোলাহল।

এই স্টেশনে নিশ্চয় নতুন যাত্রী উঠবে কামরায়। যদি না-ও ওঠে—একটা সুদীর্ঘ দিন পড়ে রইল সামনে। অন্তত ধীরাজ আর ফিরে আসবে না। ফিরে আসবে না আর-একটা মর্মচ্ছেদী দুঃসহ রাত।

 ট্রেনটা থেমে এল আস্তে-আস্তে। তারের জালটা তুলে দিল ঊর্মিলা। বাইরে থেকে একঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে পড়ল ফ্যানের বাতাসে জ্বালা-ধরা ঊর্মিলার মুখে-চোখে।

ধীরাজ উঠে দাঁড়াল। কালো ফেলট হ্যাটটা পরে নিল মাথায়।

আসি তবে।

এসো।—অন্যমনস্ক জবাব এল ঊর্মিলার।

একবার কী ভাবল ধীরাজ—কী একটা বলতেও চাইল। আর কখনও বোধহয় দেখা হবে না—এমনি কিছু হয়তো এগিয়েও এল ঠোঁটের কোনায়। কিন্তু কী হবে বলে? কী লাভ?

অবসাদ-জর্জর আড়ষ্ট পায়ে ধীরাজ এগিয়ে গেল দরজার কাছে। নিরুদ্যম হাতে হাতলটা ঘোরাল।

চকিতের জন্য মনে হল : কেমন হয় ঊর্মিলার সঙ্গে দেরাদুন পর্যন্ত চলে গেলে? আগের চাইতে আরও সুন্দর হয়েছে—আবার যেন সে নতুন করে আবিষ্কার করেছে তাকে। বলা যায় না—কিছুই বলা যায় না। সব বদলে যেতে পারে, মন বদলে যেতে পারে, আবার ভালো লাগতে পারে ঊর্মিলাকে—।

কিন্তু কী মানে হয় এসব পাগলামির? ধীরাজ নিজেকে সংযত করে নিল। একটা আকস্মিক প্রেরণায় লাফিয়ে পড়ল নীচের প্ল্যাটফর্মে। তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল সামনের দিকে।

শোনো!

একটা তীক্ষ্ন অস্বাভাবিক চিৎকারে ফিরে চাইল ধীরাজ। ঊর্মিলা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার গোড়ায়! একটা অপরিচিত তীব্র দ্যুতিতে জ্বলছে ঊর্মিলার চোখ।

আমাকে ডাকছ?—ধীরাজ থেমে দাঁড়াল। দু-পা এগিয়ে এল মন্ত্রবন্দির মতো।

ঊর্মিলা অস্বাভাবিক গলায় বলল : টয়লেটের জানলা ভেঙে ঢুকেছিলে, পকেটে নিশ্চয়ই ছোরা কিংবা রিভলবার ছিল। আমার কাছ থেকেই বা পাওনাটা না নিয়ে ফিরে যাচ্ছ কেন?

বজ্রাহতের মতো কেঁপে উঠল ধীরাজ—একটা অব্যক্ত শব্দও করল হয়তো। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই ঊর্মিলার গলার হারছড়া এসে পড়ল তার পায়ের কাছে। ধীরাজ ছুটে পালানোর আগেই তার দিকে ছুটে এল আর-একজোড়া ভারি কঙ্কণ—একটা গিয়ে লাগল ডান চোখের কাটা দাগটার ওপরে। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল ধীরাজ—খানিকটা গরম রক্ত উছলে পড়ল চোখে।

দরজার পাশ থেকে তখন সরে গেছে ঊর্মিলা—এসে লুটিয়ে পড়েছে বার্থের ওপরে। এইবারে প্রাণভরে কাঁদতে পারছে ঊর্মিলা। এতক্ষণ পরে।

মাসিক রহস্য পত্রিকা

মার্চ-এপ্রিল, ১৯৫৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *