দক্ষযজ্ঞ
এক
আগরওয়াল টাইটেল দেখলেই বুঝে নিতে হবে বড়লোক। বিজয় আগরওয়াল বিপুল বড়লোক। ঘাবড়ে দেওয়ার মতো বড়লোক। বড়লোকদের একটা পরিচিত ইতিহাস থাকতেই হবে। প্রথমে তাঁরা বিশ্রী রকমের গরিব অবস্থায় জীবন শুরু করেন। তারপর নানারকমের কাণ্ডকারখানা করে একদিন কোটিপতি হয়ে যান। কেউ আর তখন তাঁকে ঠেকাতে পারে না।
একটা টিনের চালায় বিজয় আগরওয়াল গোলদারি দোকান দিয়েছিলেন। একপাশে গম ভাঙানোর কল। তখন তাঁর বাবা জীবিত। খটখটে, খড়খড়ে মধ্যবয়সি একজন মানুষ। অসম্ভব পরিশ্রমী। বড় বড় গমের বস্তা নিজেই পিঠে করে দোকানের ভেতর নিয়ে চলেছেন। বাঙালিবাবুরা ভাবতেই পারবেন না। একদিকে কলে গম ভেঙে দিচ্ছে, আবার পরক্ষণেই দোকানের টাটে বসে ডাল ওজন করছেন। পেছন দিকে গোয়াল। বিরাট একটা মোষ। প্রচুর দুধ। পাড়ার চায়ের দোকানে দুধ সাপ্লাই করেন। সেও একটা আয়। বিজয় সেই সময় দেশে। বড় হচ্ছে। যেই একটু শক্তপোক্ত হল, চলে এল বাবাকে সাহায্য করতে। মোষের সংখ্যা বেড়ে গেল। দোকানের পাশে আর একটা দোকান হল। মাটির গণেশ থেকে শ্বেতপাথরের গণেশ।
এইরকম সব হতেই থাকল আর বিজয় বড় হতে লাগল। শুধু বড় নয় বড়লোক। ছোটখাটো ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে কলকারখানা শুরু করে দিল। বিজয়ের বাবা বেশ বুড়ো হয়েই মারা গেলেন। দেখে গেলেন ছেলে শিল্পপতি হয়েছে। এই বিজয় আগরওয়ালের ডাক্তার আমার বড়মামা। অনেক রকমের অসুখের মালিক। সুগার, হার্ট, পেট, কোমর, হাঁটু। বাইরে থেকে বোঝায় উপায় নেই। চমৎকার দেখতে। হিরো। ইচ্ছে করলে সিনেমায় নামতে পারতেন।
মানুষের বয়েস তো বাড়বেই। ও কিছু করার নেই। সহপাঠী বন্ধু প্রতাপ আমাকে একদিন আমতলায় বসে বলেছিল,
আমি বড় হয়ে ‘বয়স-বিজ্ঞানী’ হব।’
‘সেটা কী?’
‘জেরিয়েট্রিসিয়ান।’
আমাদের পাশে চুমকি বসেছিল। তার ধান্দা আম। দুম করে উলটে পড়ে গেল। প্রতাপ মাঝে মাঝেই এইরকম শক্ত শক্ত কী সব বলে। সাতদিন আগে বলেছিল অ্যাস্ট্রোনট হবে। তার আগে বলেছিল, অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হবে। তারও আগে—অরনিথোলজিস্ট। বাঘ যেমন জঙ্গলে থাকে চুমকি সেইরকম আমবাগানে। আর আমবাগানে এলেই প্রতাপ তার ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। প্রতাপ ভবিষ্যতে কী হবে সে সম্পর্কে চুমকির স্পষ্ট ধারণা হল তুই হবি বীর হনুমান। একটাই সুবিধে প্রতাপের শরীরে রাগ নেই। বড় বড় চোখে সকলের দিকে তাকায়। কোনও কিছুই গায়ে মাখে না। সাইকেলে সারা পাড় ঘুরে বেড়ায়। কারুর বিপদে সবার আগে প্রতাপই ছুটে যায়। প্রতাপের আর এক নাম মুশকিল আসান। বাবা প্রতাপের এই গুণের জন্য বিজয়বাবু তাকে খুব ভালোবাসেন। বলেছেন, আমার ছেলেপুলে নেই, তুমিই আমার ছেলে। প্রতাপদের সাবেক আমলের বাড়িটা নড়বড় করছে। একপাশটা বটগাছের কন্ট্রোলে। পেছনে জমিটা ছোটখাটো অরণ্য। সাপ-খোপের আড্ডা। প্রতাপের যখন বোটানিস্ট হওয়ার ইচ্ছে করে তখনই অরণ্যে গিয়ে রিসার্চ করে। একবার গোখরো সাপ ফণা তুলেছিল, প্রতাপ সাপটাকে স্ট্রেট মুখের উপর বলে দিয়েছিল, আমার সঙ্গে ইয়ারকি মারতে এসো না। এই ঘটনার পর প্রতার দিনকতক বলতে লাগল, আমি টক্সিকোলজিস্ট হব। পৃথিবীর বিষ নিয়ে গবেষণা করব। ‘ব্ল্যাকউইডোর’ কলোনি তৈরি করব। ভয়ঙ্কর বিষাক্ত মাকড়সা।
বিজয়বাবু প্রতাপ বলতে পারেন না। বলেন, পরতাপ? পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘বিজয়ের উচ্চারণটাই ঠিক, পরের তাপ, অর্থাৎ পরতাপ যে হরণ করে।’ বিজয়বাবু বললেন, ‘পরতাপ তোমাদের বাড়িটা এবার আমি সারাই করিয়ে দেব।’ প্রতাপ বলল, ‘কক্ষনো নয়। আপনি যেমন লড়াই করে বড় হয়েছেন, আমিও সেইরকম হব। আমি ফুটপাথে গামছা আর কাটা কাপড় বিক্রি করব।’
পুজোর সময় নতুন জামা-প্যান্ট হয়। নিজের জন্যে দুটো জামা, দুটো প্যান্ট রেখে বাকি সব বিলিয়ে দেয়। এই নিয়ে বাড়িতে রাগারাগি। প্রতাপ বলে, ‘কী আশ্চর্য! আমাকে তোমরা যখন দিয়েছ, তখন ওসব আমার জিনিস, আমি এখন যাকে খুশি তাকে দিতে পারি।’ প্রতাপের খুব ইচ্ছে মাঝারি উচ্চতার একটা পাহাড় কিনবে উত্তর ভারতে। চূড়ায় একটা শক্তিশালী টেলিস্কোপ বসাবে। সারা রাত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। বিলিতি ম্যাগাজিনে পড়েছে, রাতের আকাশে অনেক কিছু ঘুরে বেড়ায়। অনেক কিছু নেমে আসে মাটিতে। সত্যি সত্যি পুষ্পবৃষ্টি হয়। চুমকি সঙ্গে সঙ্গে বললে, ‘তা হয়, তবে কি এক গেলাস সিদ্ধি খেতে হবে তার আগে। বিজয়া দশমীর দিন রাতে কাকিমা খেয়েছিল, তারপর দেখল কি, হাত-পা ছড়িয়ে মহাদেব দুম করে আকাশ থেকে টিনের চালে এসে পড়লেন। তারপর বাবা, বাবা বলে সারা রাত কান্না।’
প্রতাপ তো রাগতে জানে না। হাসতে হাসতে বললে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোকে এসব বিশ্বাস করতে হবে না। আমিও করি না। আমি বইয়ে পড়েছি। যেদিন দেখব সেদিন বিশ্বাস করব।’ চুমকি বললে, ‘তোমাকে রাগাচ্ছিলুম। জানো তো, আকাশে মুখ দেখা যায়, যিশুর মুখ, শ্রীকৃষ্ণের মুখ। আমি নিজে দেখেছি। বেতলার জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছিলুম। গভীর রাতে আকাশের গায়ে। সেই থেকে লোভ বেড়ে গেছে। রাত্তিরে সময় পেলেই আকাশ দেখি। পাহাড়টা তাড়াতাড়ি কিনে ফ্যালো।’
প্রতাপ কোথা থেকে শুনে এসেছে বিলেতে মানুষের বয়েস বাড়লেও চেহারায় বয়েস বোঝা যাবে না। কায়দা বেরিয়ে গেছে। পাখির ডাক শুনতে শুনতে রোজ ষোলোটা কাঁচালঙ্কা খেতে হবে। বেশিরভাগ কথা গানের সুরে বলতে পারলে ভালো হয়। আয়নায় কখনও মুখ দেখবে না। বিজয়বাবু ছাতু খান আচার আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে। আয়নায় মুখ দেখেন না। টেলিফোনে কথা বলেন গানের সুরে।
তা, সে যে যা করছে করুক। চুমকি কচি কলাপাতায় মুড়ে বাড়ি থেকে তেঁতুলের টক-মিষ্টি-ঝাল আচার এনেছে। প্রতার জিগ্যেস করলে, ‘নিশ্চয়ই চোরাই মাল!’
‘আচার সব সময় চোরাই। আচার তৈরি হয় চুরি করার জন্যেই।’ ভাগাভাগি হল। সমান তিন ভাগ। আচারের সঙ্গে কাবলি ছোলা ভাজা। বললুম, ‘জিনিসটা ধরে রাখ। ছুট্টে একটা জিনিস আনি।’
ভুজাওয়ালার দোকানে ছোলা ভাজছে। একদম গরম। ফাটা ফাটা। এসে দেখলুম প্রতাপ আচার পাহারা দিচ্ছে। চুমকি বাগানের শেষ মাথায় আম খুঁজছে। আমাকে দেখে ছুটতে ছুটতে এলে।
‘আমগুলো তোমাদের চেয়েও অসভ্য। পড়তে শেখেনি।’
‘নিরক্ষর।’
‘কাল থেকে প্রথমভাগ পড়া। অ-এ অজগর আসছে তেড়ে। আ-এ আমটি খাব পেড়ে।
প্রতাপ বললে, ‘ফ্যানটাসটিক। আচারটা কে বানিয়েছে রে?’
সুইস করে শব্দ করে চুমকি বললে, ‘ঠাম্মা!’
‘রোজ দুপুরে পারবি ম্যানেজ করতে?’
‘দেখি।’
হনহন করে হরিদা আসছে। সবসময় ব্যস্ত। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। হরিদার পেছন পেছন আসছে বিরাট বাঘা। তেল চুকচুকে পালিশ করা বাদামি রং। বেশ একটু আদুরে আদুরে ভাব। হরিদা রোজ সাবান মাখিয়ে চান করায়। বাঘার আলাদা তোয়ালে, পাউডার, চিরুনি, শ্যাম্পু, থালা, বাটি। আলাদা আয়না। বাঘা মুখ দেখে। বাঘার একটাই ভাষা—ঘেউ। বেশ অহঙ্কারী। অন্য কোনও কুকুরের সঙ্গে মেশে না। জানলার ধারে ছোট খাটে বাঘার বিছানা, বালিশ, মশারি। প্রথম প্রথম বেড়ালের ওপর প্রচণ্ড বিদ্বেষ ছিল। হরিদা একদিন এইরকম উপদেশ দিল—দ্যাখ বাঘা, বেড়াল হল মা ষষ্ঠীর জীব। স্বভাব চরিত্রের ছোটখাটো দোষ থাকতেই পারে। সে তোমারও আছে, আমারও আছে। দেখো, বন্ধুত্ব একটা বড় কথা। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কে ক’দিন বাঁচে! আজ আছে কাল নেই।
হরিদা মিলিটারি মেজাজে বললে, ‘বাঃ বাঃ, লেখা নেই পড়া নেই, কেমন সব বসে আছে? ভগবান! তুমি দেখো। এই যে, চলো সব বড়দা ডাকছে। নীচে নেমে বসে আছে। একটু পরেই কে যেন আসবে! কি খাচ্ছিস রে তোরা?’ চুমকির একটা চোখ আধবোজা, আচারের আমেজ। বললে, ‘খাবে একটু? এই নাও, চেটে চেটে, টকাস টকাস শব্দ করে খাও।’
হরিদা মোহিত, ‘বাঃ বাঃ। মুখটা ছেড়ে গেল। কত দিন পরে তেঁতুলের আচার!’
‘আর একটু চলবে?’
‘চালালেই চলবে।’
বাঘা ভুকভুক করে দুবার শব্দ করল। জিভটা ঝুলছে সামনে।
মাঝে মাঝে ভেতরে গুটিয়ে নিয়ে ঢোঁক গিলছে।
হরিদা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললে, ‘পরেরবার মানুষ হয়ে জন্মাবি, তখন এদের সঙ্গে বসে দুপুরবেলায় এইসব বাজে-বাজে জিনিস খাবি।’
চুমকি বললে, ‘বাঃ ভাই! আমার ভাগের আদ্দেকটা চেটেপুটে খেয়ে বলে কিনা বাজে জিনিস!’
দুই
বড়মামা নীচের উঠোনের ঢালাও রকে বসে আছেন। মাসিমা এটাকে বলেন আলস্যের পীঠস্থান। যে-কোনও মানুষের জীবন নষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট। প্রথমে বসলে, আড় হলে, শুয়ে পড়লে, ঘুম। কিছু দূরেই রান্নাঘর। মাসিমার এলাকা। সেখানে তাঁর বাহিনীর ওঠাবসা, কাটাছেঁড়া, ঘ্যাঁসঘেঁসে, ছ্যাঁ-ছোক। রকম রকম সুন্দর গন্ধ।
ফুল ড্রেস পরে বড়মামা বসে আছেন। গলার দুপাশে স্টেথিসকোপ দুলছে। পাশে পড়ে আছে ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র। পাটকরা সাদা তোয়ালে। দেখতে টেরিফিক সুন্দর। যখন আমেরিকার হলিউডে ছিলেন তখন একজন চিত্রপরিচালক চেপে ধরেছিলেন—’টার্জেন অ্যান্ড দি এপম্যান’ সিনেমার নামভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। রিফিউজ, নো, নো, নো। শুনে মেজোমামা বলেছিলেন, গুলন্দাজ! ঘটনাটা আসলে এইরকম সিনেমাটার নাম—’দি এপম্যান অ্যান্ড টার্জেন’, এইবার নামভূমিকাটা কি বুঝে নাও। বড়মামা বললেন, ‘কোথায় থাকিস তোরা? আজ এত বড় একটা দিন!’
‘রক্ষাকালী পুজো তো রাত্তিরে!’
‘ওরে! রক্ষাকালী নয় রে! আজ এই বাড়িতে কে আসবে জানিস?’
আমরা তো কিছুই জানি না। বোকার মতো দাঁড়িয়ে।
‘কী খাচ্ছিস কি, এই অড টাইমে!’
চুমকি বললে, ‘তেঁতুলের আচার। ওই আচার খাবার এইটাই সময়। পড়নি? ভর দুপুর বেলা ভূতে মারে ঢেলা। তখন এই ট্যাকাস ট্যাকাস।’
‘আমাকে একটু দিবি না!’
‘বড়দের খেতে নেই। হ্যাংলার মতো চাইছ যখন তখন আর কি করি! যা সেজেগুজে বসে আছ, খাবে কী করে?’
‘ভীষণ লোভ হচ্ছে রে। জিভে জল এসে গেছে।’
‘দাঁড়াও। ব্যবস্থা করছি। চুমকি আমার নাম। সহজে হারব না।’ হাত ধুয়ে ছুটতে ছুটতে এল। বড়মামার কোলে তোয়ালে পাতা হল। পাশে বসে বললে, ‘চোখ বন্ধ করো। নাও আমার আঙুলটা চোষো। কামড়াবে না কিন্তু। মা বলে তোমার মতো দুষ্টু ভূ-ভারতে আর নেই।’
‘তোর মায়ের মাথা খারাপ।’
‘মা-ও তাই বলে, তোমার মাথাটা সবার আগে দেখানো দরকার।’ অনেকেই জানে না, এর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। চুমকির মায়ের সঙ্গে বড়মামারই বিয়ে হবে সেই কোন ছেলেবেলা থেকেই ঠিক করা ছিল। বড়মামা বড় হয়ে ঠিক করলে, বিয়ে করবেন না। হয়ে গেল। সেই না আর হ্যাঁ হল না। মেজোমামা মাঝে মাঝে ডাকেন—এই যে ডক্টর গ্যাণ্ডার। বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে বলেন—ইয়েস প্রফেসর প্যানথার।’
চুমকি বললে, ‘অনেকক্ষণ আচার আঙুল খেয়েছ, এইবার বলো, কী কাজ!’
বড়মামা ধড়মড় করে উঠলেন। জানা গেল, বিজয়বাবু একটা বিলিতি গরু উপহার পাঠাচ্ছেন—ইংলিশ কাউ। অ্যারাইভাল টাইম বিকেল ছ’টা। সেই সায়েব গরুকে বরণ করে নিতে হবে। চুমকির ওপর আদেশ হয়েছে—’সেজেগুজে এক্ষুনি আয়। আসার সময় তোদের কুরুক্ষেত্র শাঁকটা অবশ্যই আনবি।’
প্রতাপ মালা পরাবে। চুমকি বাজাবে। আমি ফুল ছড়াব। তারপর গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে। চার পায়েই ব্লাড-প্রেশার মাপা হবে। হার্ট-লাংস পরীক্ষা করা হবে। এসব করবে হরিদা। এরপর হবে গো ভোজন। বিলিতি গরু কি ঘাস খায়? প্রশ্ন। সঙ্গে সঙ্গে এক্সপার্টকে ফোন। ইয়েস, খায়। দুনিয়ার সব গরুই এক। বড়মামার ব্যাখ্যা—সেম হাম্বা, সেম খানা, সেম খ্যাস।’
এতক্ষণ মাসিমা ঘটনাস্থলে ছিলেন না। চটি ফটফট করে বাইরে থেকে এলেন। কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ। গায়ের রং আর চশমার সোনার ফ্রেমের রং এক হয়ে মিশে গেছে। পাড়ার বহুপ্রাচীন হিতকারী সমিতির মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি হয়েছেন। কতরকমের সমস্যা।
মাসিমা থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন, ‘কি হচ্ছে এখানে? সার্কাস?’
বড়মামা বললেন, ‘মা আসছেন মা। আজ এই গৃহ পবিত্র হবে। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, শ্যামলী, ধবলী, নতুন ধান্যে হবে নবান্ন।’
চুমকি যোগ করলে, ‘বিলেত থেকে মেম মা আসছে। এই দ্যাখো পোঁ-পোঁ করে শাঁক বাজাব, ওই দ্যাখো মালা।’
হঠাৎ দোতলার চওড়া বারান্দা থেকে ফেটে পড়ল ভীষণ কণ্ঠস্বর, দুপদাপ পায়ের শব্দ : ‘কে-রে, দে-রে, সতী দে আমার/সতি, সত্যি, কোথা সতী!’ আর একটি কণ্ঠস্বর :
পালাও পালাও, এল এল এল সবে
ব্রহ্মদৈত্য, ভৈরব, বেতাল,
ভূত প্রেত দৈত্য দানো
হর! হর! হর! ঝ্যাং
মাসিমা হাঁ হয়ে গেছেন। ওপর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওখানে কী হচ্ছে?’
‘দক্ষযজ্ঞ।’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’
মেজোমামাকে দেখতে পাওয়া গেল। কাঁধে একটা ল্যাতপ্যাতে পাশ বালিশ হাতে একটা ত্রিশূল :
কোথা গেলে, কি দোষে ত্যাজিলে
প্রাণপ্রিয়ে কেন কর অভিমান?
আয় সতি, আয় রে হৃদয়ে!
বারান্দা থেকে মুখ ঝুলিয়ে বললেন, ‘বড়দা, তোমার পাশ বালিশটার কি ভাগ্য দ্যাখো, আমার কাঁধে সতী হয়েছে। উদ্ধার পেয়ে যাবে। সুদর্শন চক্র একান্ন টুকরো হবে। একান্ন সতীপীঠ।’
মাসিমাকে ডেকে বললেন, ‘ওপরে আয় না, শিব এইবার নৃত্য করবেন। হর, হর, ব্যোম, ব্যোম।’
‘ধা, ধা, ধিন ধা, ধ্যাৎ ধ্যাৎ, ত্যাৎ ত্যাৎ, তেরিকা।’
বড়মামা মাসিমাকে বললেন, ‘শাসনের অভাবে ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেল।’
ব্যাপারটা হল, দুর্গাপুজোর পর হয় যাত্রা, না হয় নাটক, একটু কিছু হবেই। এবছর হবে গিরিশচন্দ্রের দক্ষযজ্ঞ। মেজোমামাকে দেওয়া হয়েছে মহাদেবের ভূমিকা। ভুঁড়ি ছাড়া মহাদেব ভাবাই যায় না। নাটকের ডিরেকটার প্রিন্স কাকাতুয়া। ছদ্মনাম। নাম করতে হলে নামের বাহার থাকা চাই। সিনেমার লাইনে সত্যজিৎ বিশ্বসেরা। প্রিনস নাটকের জগতে এক নম্বর হতে চাইছেন।
তিনটে ভুঁড়ি মাপা হয়েছিল, মেজোমামা ফার্স্ট। অভিনয় কেমন করবেন, সে পরের কথা। বাঘছাল প্রিন্ট ভেলভেটের কাপড়। গলায় দড়ির সাপ। তামাটে রঙের জটা। সর্বাঙ্গে পাউডার। কপালে ত্রিনয়ন। হাতে ত্রিশূল। স্টেজ জুড়ে নৃত্য। ডায়ালগ বিশেষ কিছু নেই, কেবল, সতী দে, সতী দে, আমার সতী দে। ড্যানস ডিরেকটার পল্টুদা সাবধান করে দিয়েছেন, ‘মেজদা, আর যাই করুন, পড়ে যাবেন না। মনে রাখবেন, পালার নাম দক্ষযজ্ঞ। মহাদেব পতন নয়। আপনার পা-দুটো গদার মতো, ফ্রিলি খেলে না। ইনকেস যদি পড়ে যান, এই ডায়ালগটা দিয়ে ম্যানেজ করবেন, ‘সতী! আমি তোমার পতি, পড়ে আছি ভূতলে, কী হবে আর এই পরান ধরে রেখে! ওঃ হো, হো হো হো।’ আমরা তখন স্টেজ অন্ধকার করে নীল আলোর ফ্ল্যাশ চালাব। স্টেজটা ভূত-প্রেতে ভরে যাবে। ভূত হওয়ার জন্যে অনেকে চাঁদা দিয়েছে। রঙের খরচ, ভূতের ড্রেসের টাকা ভূতেরাই দেবে।’
মেজোমামা বললেন, ‘পড়ে যাওয়াটাই তো ভালো!’
‘চেষ্টা করবেন দাঁড়িয়ে থাকতে। না পারলে কী করা যাবে!’
ওপরে দক্ষযজ্ঞ। নীচে ইংলিশ কাউ। এই দুই পর্বের মাঝখানে মাসিমা।
বড়মামা বললেন, ‘আমার ইচ্ছে করছে ওপরে একটা আধলা ইট নিক্ষেপ করি!’
মাসিমা বললেন, ‘সেটা তোমারই মাথায় নেমে আসবে—গ্র্যাভিটি।’
চুমকি বললে, ‘শাঁখে একটা ফুঁ মেরে দেখব। ফার্স্ট ফুঁটা মিস করে।’
‘একদম না। তখন বাজাবি। জাস্ট ইন টাইম।’
মাসিমা সব সময় শান্ত। একপাশে গুছিয়ে বসে জিগ্যেস করলেন, ‘গরুটা থাকবে কোথায়?’
বড়মামা বললেন, ‘ঘোড়া হলে চাবুকের অভাব হয় না।’
‘এটা ঘোড়া নয় গরু।’
‘কোথায় থাকবে, তোমরাই সেটা ঠিক করবে। গরু তো আমার একার নয়। পরিবারের সকলের। পারিবারিক সম্পত্তি। আমরা যেমন তোর সদাব্রতে স্থান পেয়েছি, স্নেহ-ভালোবাসায় জর্জরিত হচ্ছি, গরুটাও সেইরকম তোর কোলে স্থান পাবে। মা মা বলে ডাকবে।’
মাসিমা শুনলেন? গম্ভীর মুখ। একটাও কথা বললেন না।
বড়মামা বললেন, ‘আমাদের ঠাকুরদার আমলে এই বাড়িতে পঞ্চাশটা গরু ছিল। গোবরের পাহাড়। তাল তাল গোবর।’
মাসিমা বললেন, ‘তাঁর ঠাকুরদা রাখাল ছিলেন। পাঁচশো গরু চরাতেন।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্য, ত্রেতা, এই দুটো বিরাট কাল দ্বাপরে এসে কি দেখল রাখাল ভগবান বাঁশি বাজাচ্ছেন, আর শুধু গরু। গরু আর গরু।’ মেজোমামা তাঁর রিহার্সালের দল নিয়ে নীচে নেমে এলেন।
‘প্রবলেমটা কি?’
‘বিলিতি গরু আসছে নিউজার্সি থেকে।’
‘নিউজার্সি আবার বিলেত হল কবে? বিলেত হল ইংল্যান্ড। যাক খুব আশার কথা। ওরা বলছিল, স্টান্ডার্ড মহাদেবের ভুঁড়ির সাইজের চেয়ে আমারটা এখনও এক ইঞ্চি কম আছে। তাহলে আজ থেকেই ক্ষীর খাওয়া শুরু করি। জার্সি তেইশ কেজির কম ছাড়বে না। পাঁচ কেজি আমি পেতেই পারি। আমি শুধু পরিবারের গর্ব নই, আমি দেশ-গৌরব।’
বড়মামা খুব শান্ত গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘কী কারণে?’
‘অনেক অনেক কারণ। শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। নিজের ঢাক নিজে পেটাতে চাই না বন্ধু। বিনয়ই আমার ধর্ম। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, আমার পরিচয়েই তোমার পরিচয় হবে। দক্ষযজ্ঞ থেকে বেরিয়ে আসবে এ অদ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল মহাদেব। ঈর্ষা কোরো না ভাই। ডাক্তারি একটা বিদ্যে। সে যে কেউ হতে পারে। রুগি-মারা-বিদ্যে। প্রতিভা সম্পূর্ণ আলাদা একটা জিনিস। গিফট অফ গড। হিংসা খুব খারাপ জিনিস। ভুসভুস করে চুল উঠতে শুরু করেছে। টাক দেখা দিয়েছে।’
‘তুই টাকের কি জানিস? একে বলে, জ্ঞানীর টাক—উইজডাম বল্ডনেস। কত কমের টাক আছে জানিস? জ্ঞানীর টাক, ধার্মিকের টাক, টাকার টাক, রাজনীতির টাক, মামলাবাজের টাক, ভোগীর টাক শয়তানের টাক। নির্বোধের চুল, ডাকাতের চুল, যাত্রার দলের অধিকারীর চুল। তুই একটা দিশি গরু। তোর গোয়ালে থাকা উচিত।’
‘তুমি একটা ষণ্ড।’
‘মহাদেবের বাহন।’
‘দ্যাটস রাইট! আমার বাহন।’
‘আমি রিয়েল মহাদেবের রিয়েল ষণ্ড—নন্দী বুল। একবার গুঁতিয়ে দিলে ওই ধামা পেট ফেঁসে যাবে।’
‘তোর দুধ আমার চাই না।’
‘আমি নর্দমায় ঢালব, তবু তোকে দেব না, না, না, না।’
‘আমি একটা পাটনাই গরু কিনব।’
‘তিন সের দুধ। ছিড়িক ছিড়িক।’
‘জার্সির জল নয়, বৃন্দাবনের ক্ষীর।’
প্রিনস বললে, ‘রেকর্ড হচ্ছে। খাঁটি, এক নম্বর দক্ষযজ্ঞ। সেদিন বাজানো হবে।’
মাসিমা বললেন, ‘এটা তো দক্ষযজ্ঞের বাড়ি। সারাদিন চলছে।’ ধরর, ঝরঝর শব্দে পেল্লায় একটা গাড়ি সামনের মাঠে এসে দাঁড়াল। বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘ওরে, বাজা বাজা, শাঁক বাজা। ওরে মেজো কোথায় গেলি রে! তোর মা এসেছে মা। বাজা বাজা, বাজনা বাজা।’
পাড়ার বিশিষ্ট মানুষ পি. সি. সরকার, কোনও এক রাজ এস্টেটের দেওয়ান ছিলেন তাঁর ঠাকুরদা। সেই থেকে তাঁদের বিরাট বেঢপ বাড়িটাকে সবাই ‘দেওয়ান মহল’ বলে। এখন সব ভাগাভাগি হয়ে গেছে। বড়মামা সরকার বাড়ির ডাক্তার। মাঝে মাঝে সরকার বাড়ি থেকে নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত উপহার আসে। ‘অ্যান্টিক’।
হইহই শুনে সরকারবাবু এসেছেন। ইভনিংওয়াকের পোশাক। হাতে বার্নিশ করা ছড়ি। বেশ ফুটফুটে দেখতে। পাকা গোঁফ। ডান গালে একটা আঁচিল। জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যাপারটা কী ভাই?’
কে বললে, ‘গরু’।
বয়েস হয়েছে। কানে কম শোনেন।
বললেন, ‘সরু? কি সরু? কাপড়?’
‘সরু নয় গরু।’
গাড়ির পেছনের ডালাটা খোলা হয়েছে। ভেতরে সেই মস্ত গরু। সরকারমশাই বললেন, ‘তাই বলো? গরু। জার্সি। এ তো রাখা মুশকিল। প্রচুর যত্ন চাই। খরচ আছে। এসব হাঙ্গামা কে সামলাবে? ডাক্তার! এ খেয়াল তোমার হল কেন?’
‘ওই যে আগরওয়াল পাঠিয়েছে।’
‘কে পাঠিয়েছে?’
চিৎকার করে বলতে হল, ‘আগরওয়াল।’
গরুর সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা বললেন, ‘গরু নামতে চাইছে না।’
আর একবার বললেন, ‘খিঁচো।’
বড়মামা মেজোমামাকে বললেন, ‘তোর গলাটা খুব মিষ্টি। আদর করে ডাক না, সোহাগী এসো এসো।’
সরকার মশাই যতই হোক দেওয়ানের রক্ত শরীরে। অনেক কিছু জানেন। মাসিমাকে খুব ভালোবাসেন। নিজের মেয়ের মতো। মাসিমার কাছে সরে এসে বললেন, ‘অতি উত্তম ডাক্তার, কিন্তু আবেগে চলে। এখন আইন হয়েছে, লোকালয়ে গরু রাখা যাবে না।’
এদিকে গরু নামছে না। খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। মেজোমামা অনেকক্ষণ ধরে হর হর মহাদেব করছেন। ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
বড়মামা হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, ‘গাড়িটার কত দাম?’
‘কেন, কী করবেন?’
‘আমার তো একটা গোয়ালের দরকার। এটা যখন ওর পছন্দ হয়েছে, এটাকেই গোয়াল করা যেতে পারে।’
কে একজন বললে, ‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
গরুর দলে পল্টুদা ছিল। ভালো ছেলে কাজের ছেলে। আগরওয়াল গ্রুপে কাজ করে। ক’মাস আগে বিয়ে করেছে। মাসিমা একটা বেনারসি দিয়েছেন। পল্টুদা মাসিমাকে বললে, ‘দিদি, এ গরুটার ডিফেকট আছে। কোনও দিন দুধ দেবে না।’
‘দাদাকে তো চেনো। একটা ব্যবস্থা করো ভাই।’
পল্টুদার অন্যরূপ বেরল। এবার লিডার। বেশ জোর গলায় বললে, ‘বড়দা, এ গরু এখানকার নয়। তাই নামছে না।’ এইবার গাড়িওয়ালাদের বললে, ‘ওঠাও, চলো।’
গাড়ি স্টার্ট নিল। চলে যাচ্ছে। বড়মামা ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। চুমকি দু-হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘কেঁদো না, কেঁদো না। আমি বড় হয়ে তোমাকে এর চেয়েও একটা ভালো গরু কিনে দেব।’
মেজোমামারও খুব দুঃখ হয়েছে বড়দার জন্যে। আসলে দুটো মানুষই তো ভীষণ ভালো। মেজোমামা বলছেন, ‘বড়, আমি সোনপুরের মেলা থেকে তোকে গরু আনিয়ে দেব। আমার ছাত্র রাজেশ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে।’
একটা সাদা অ্যামবাসডার ঘচ করে থামল। ডক্টর বোস।
‘মুখার্জি! তুমি এখনও বসে আছ? তুমিই আজকের প্রধান বক্তা।’
‘কোথায়?’
‘সে কী? ভুলে মেরে দিয়েছ! আই. এম. এতে তুমি জন্ডিসের ওপর বলবে। চলো চলো।’
তিন
পুজো তো এসে গেল। কিছু করার নেই। প্রতাপের মনটা খুব খারাপ। প্রতাপের মা খুব অসুস্থ। বড়মামা খুব চেষ্টা করছেন। কি যে ছাই হয়েছে। প্রতাপ বলেই রেখেছে, মা যদি মারা যায়, আমি হিমালয়ে চলে যাব। তার তো এক-একদিন এক-একরকম হতে ইচ্ছে করে, শেষ ইচ্ছেটা ছিল পাইলট হবে। চুমকিকে সেদিন বোঝাচ্ছিল, আমার বাবা সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। কোথায় আছেন কেউ জানে না। তার মানে আমার রক্তেও সন্ন্যাসীর বীজ। আমগাছের ছেলে আমগাছ হবে। বাঘের ছেলে বাঘ। তা হলে আমাকে সন্ন্যাসী হতেই হবে।
‘কী ভাবে হবি?’
‘খুব সহজ। প্রথমে হরিদ্বারে যাব। সেখান থেকে হৃষীকেশ। গঙ্গার ধারে ঝুপড়িতে সার সার সাধু।’
‘দোকানে না কি?’
‘দূর বোকা। সাধুরা সব চোখ বুজিয়ে দম বন্ধ করে বসে আছেন।’
‘তার মানে মরে গেছেন।’
‘ধূর! একে বলে কুম্ভক। আলো দেখছেন, গান শুনছেন।’
‘সে তো চোখ চেয়ে রেডিয়ো শুনলেই হয়।’
‘তোকে বোঝাতে পারব না রে। সে আলাদা আলো, আলাদা গান।’
‘তুই তো বাড়িতেই চোখ বুজিয়ে, দম বন্ধ করে বসে থাকতে পারিস।’
‘বাড়িতে খুব ঝামেলা রে।’
‘আমাদের বাড়িতে চলে আয়। ছাদের ঘরে বসে থাকবি।
‘ভগবান হৃষীকেশ পর্যন্ত আসেন। মাঝে মাঝে কাশীতে যান। তার নীচে আর নামেন না। আমি যদি না-ই থাকি কার কি এসে যায়?’
‘ধ্যাৎ! তুই খুব অসভ্য। তোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তুই একটা ছুঁচো, বেজি, ভাম, বিটকেল।’
প্রতাপের চুল খামচে ধরে মাথাটাকে ঝাঁকাচ্ছে আর বলছে, ‘তোকে আমি মেরেই ফেলব। গর্ত করে পুঁতে দেব। চুরি করে তোকে তেঁতুলের আচার খাইয়ে এই আমার ফল হল। তুই একটা গাধা, বনমানুষ, উদবেড়াল, ভুঁড়ো শেয়াল, ঝাকড়দা মাকড়দা। সাধু হবি সাধু! তোকে আমি কচুকাটা করব। বুকে বসে দাড়ি ছিঁড়ব। আজই তোর শেষ দিন। কিল, চড়। শেষে প্রতাপ চিৎ, বুকের ওপর চুমকি। ‘একটা একটা করে তোর দাঁত খুলে নেব।’
হরিদা ছুটে এসেছে। ‘করিস কী, করিস কী?’
চুমকি তীরবেগে ছুটল। সেই একেবারে ঝিলের ধারে। কাশফুলের মাথা দুলিয়ে বাতাসের হাত ধরে নাচ। চশমা চোখে শালিক। পানকৌড়ির চুপুক চুপুক ডুব।
প্রতাপের ভয়। খেয়ালি মেয়ে কখন কী করে বসে। সেও ছুটে এসেছে—’শোন না, আমি সাধু হব না।’
‘তাহলে কি হবে? ছাগল, রামছাগল।’
‘আমি মরুভূমির উটচালক হব।’
‘উটের পিঠে আমি। পানিফল খাবি? ওই দেখ জলে ভাসছে।’
এই ঝিলটা সরকারবাবুদের। শঙ্করের বাবা ইজারা নিয়েছেন। মানুষটার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। মাঠে-ঘাটে আখড়ায় নেচে নেচে বাউল গান গায়। প্রতাপ তাকে গুরু করেছে। প্রতাপ সাধু না হয়ে বাউলও হতে পারে। শঙ্করের নৌকা ঝিলের মাঝখানে। মাছ ধরেছে। এদের দেখে চেঁচাচ্ছে—’আসবি? শরতের মেঘের ছায়া জলে কেমন পড়েছে দ্যাখ। আকাশের তলায় আকাশ।’
পুজোর আনন্দে প্রতাপ নেই। আমি আর চুমকি ঠিক করেছি, নতুন জামাকাপড় পরব না। ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখব না। মৃত্যুকে ভীষণ ভয় করে। প্রতাপের মা যে-ঘরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন—একতলার ঘর। মাঠের দিকে খোলা জানলা। সেই জানলায় গিয়ে আমরা দুজনে দাঁড়াই। চোখ বুজিয়ে খুব প্রার্থনা করি—জগতের মা প্রতাপের মাকে ভালো করে দাও না। একটা কথাও কি শুনতে নেই!
জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরেটায় কিছু ইটপাটকেল পড়ে আছে। আগাছা জন্মেছে। চুমকির পায়ের পাতার ওপর দিয়ে আস্ত একটা সাপ চলে গেল, যেন বেড়াতে বেরিয়েছে।
চুমকির তো ভয়ডর নেই। বললে, ‘কী রকম অসভ্যের মতো চলে গেল। কামড়াতেও ভুলে গেছে শয়তানটা।’
‘কামড়ালে তো মরে যেতিস।’
‘আমি তো মরতেই চাই। আমি মরলে মাসিমা বেঁচে উঠত।’
‘আবার তুই মরলে আমাকে মরতে হত।’
‘থাক, ন্যাকা ন্যাকা কথা আর বলিস না। তোদের সবক’টাকেই আমার চেনা হয়ে গেছে। একজন বলছে সন্ন্যাসী হবে। তোর বড়মামা আমার মাকে কেন বিয়ে করল না। আমার মাকে কেন অপমান করল। বিয়ে করলে তো আমার বাবা হত। মামা হয়ে বসে রইল। স্বার্থপর লেপার্ড।’
‘তা তুই আমার সঙ্গে কেন ঝগড়া করছিস? আমি কি জানি?’
‘চুপ! মামার ভাগনে মামার মতোই হবে। স্বার্থপর ওরাংওটাং।’
‘কাঁদছিস কেন?’
‘বেশ করেছি। গায়ে হাত দিবি না। কামড়ে দেব।’
বড়মামা খুব চেষ্টা করছেন। রোজই স্পেশালিস্টরা আসছেন। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার চুমকির মা, যাঁকে আমি মাইমা বলছি, সে সব সময় বড়মামার পাশে, হেলপিং হ্যান্ড। ‘সুধা, হট ওয়াটার ব্যাগ। পায়ের তলায় পাউডার ঘষো। স্যালাইনটা একবার দ্যাখ, টেমপারেচার?’ যাক বাবা, দুজনের ভাব হয়ে গেছে। মাসিমা নিয়েছেন রান্নাঘরের দায়িত্ব। আমি বেশ বুঝেছি—চুমকি তার বাবার চেয়ে আমার বড়মামাকে বেশি পছন্দ করে।
পুজো যেমন হয় সেইরকমই হল। ঢাকঢোল। ঘোষপাড়ায় জমিদার বাড়ির সানাই ঘরে সানাই যেমন বাজে, সেইরকমই বাজল রকম রকম সুরে। কলাবউরা নাচতে নাচতে চান সেরে এলেন নদী থেকে। ঢাকঢোল, চণ্ডীপাঠ, অঞ্জলি। মায়েদের সিঁদুর মাখা মুখ। নতুন শাড়ি। জামাপ্যান্ট। নারকোল ছাপা। কিছু বাকি রইল না। ঝিলের ধারে শীত এসে গেছে। চুমকি বললে, ‘যাঃ পুজো চলে গেল।’ প্রত্যেক বছর পুজোয় হাত ভর্তি কাচের চুড়ি পরে। মেলায় ফকিরকাকু চুড়ির দোকান দেয়। বাপরে! সে যেন রঙের ঝিলিক, স্বপ্নের পাহাড়। চুমকিকে ভীষণ ভালোবাসে। দুজনের কত ঝগড়া। এবারে কত ডাকল। চুমকি গেল; কিন্তু চুড়ি পরল না। ফকিরকাকু আপেল, আঙুর ব্যাগে ভরে চুমকির হাতে দিয়ে বললে, ‘দিদিমণি মাকে দিয়ে এসো। আমি নামাজের সময় আল্লাকে বলব, দোয়া দোয়া।’ ফৈজাবাদের ফকিরকাকু বাংলার অনেক মায়ের এক মায়ের জন্যে প্রার্থনা করছে।
চার
উঃ, বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পর পাড়াটায় থাকা যায় না। মা যেন সব নিয়ে চলে গেছেন। শীতকালের পাখিরা উড়ে এসে ঝিলের জলে ডানা মেলে ভাসছে। পাড়ার হাঁসেরা খুব বকাবকি করছে। মাঝে মাঝে এক-একটা রুপোলি মাছ, কীসের আনন্দে কে জানে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠছে। প্রতাপকে দেখে এলুম, কলতলায় বসে মায়ের জামাকাপড় কাচছে। খুব রোগা হয়ে গেছে। কোনওভাবেই তার কিছু করা যাচ্ছে না।
কাল বারোয়ারিতলায় সেই পালা হবে দক্ষযজ্ঞ। দারুণ একটা স্টেজ হচ্ছে। সারাক্ষণ ঠকাস ঠকাস শব্দ। আলো আর শব্দের খুব খেলা হবে। পিলে চমকানো শব্দ হবে। মেঘের তর্জনগর্জন। ভূত-প্রেত আসবে অনেক। মেজোমামার কোমরে বাঘছাল থাকবে কি না—এই ভয়। একটা হাফ-প্যান্ট তলায় রাখবেন। নিজে নিজেই রিহার্সাল চালাচ্ছেন। একপাতার একটা ডায়ালগ আছে। সতী দে, সতী দে। কাঁধে তুলবেন সতীকে। তুলোর পুতুল—মানুষের মাপে। দশমহাবিদ্যা বেডিং স্টোরস তৈরি করে দিয়েছে। ল্যাত ল্যাতে। সমস্যা দেখা দিয়েছে—মহাদেবের কাঁধে সতী উপুড় হয়ে থাকবে? না, চিৎ হয়ে। সে যা হয় হবে। পণ্ডিতমশাই ভালো বলেছেন, ‘কাঁধে একটি কলদীকাণ্ড স্থাপন করিতে পারো। কদলীই তো সতী। খণ্ড খণ্ড করিতে সুবিধা হইবে।’
এই নাটকের সুদূর ভবিষ্যৎ। আমেরিকা থেকে আমন্ত্রণ আসতে পারে। বঙ্গ সম্মেলনে মঞ্চস্থ হবে। শোনা যাচ্ছে। একটা চোঙা লাগানো গাড়ি। কান ফাটানো চিৎকার—হ্যালো, হ্যালো, দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ। নট ও নাট্যকার শিরিস চন্দ্রের—আর একটা গলা। গালাগাল, শিরিস নয়, গিরিশ। ছাড় তো, আমাকে দে। বন্ধুগণ, আজ রাত্রি নয় ঘটিকায়। বারোয়ারি তলা প্রাঙ্গণে মঞ্চস্থ হবে অবিস্মরণীয় পালা—গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘দক্ষযজ্ঞ’। নাম ভূমিকায় যাত্রাখ্যাত জলদবরণ। মহাদেবের ভূমিকায় অধ্যাপক সুধাকান্ত। সতীর ভূমিকায় মীরাট প্রবাসী অভিনেত্রী অনিন্দিতা, অনিন্দিতা, অনিন্দিতা। সুর ও সঙ্গীত আয়োজনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন—প্রিন্স কাকাতুয়া। দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ। গান,
নাচে বাহু তুলে, ভোলা ভাবে ভুলে
বব বম বব বম্ গালে বাজে।
হ্যালো, হ্যালো বন্ধুগণ—দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ। বিশেষ আকর্ষণ, যুগান্তকারী আমেরিকান সুদর্শন চক্র চোখের সামনে সতীদেহ খণ্ড খণ্ড করবে। সব শেষে দশমহাবিদ্যার পূজা। বাচ্চা ও কোলের বাচ্চাদের প্রবেশ নিষেধ। যাঁদের বুকে পেসমেকার বসানো আছে, তাঁরা অনুগ্রহ করে পেছনের সংরক্ষিত আসনে বসবেন। সঙ্গে জলের বোতল, খাবারের প্যাকেট আনলে বাজেয়াপ্ত করা হবে। সমগ্র অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনায়—আগরওয়াল ইন্টারন্যাশনাল। ছাতের জলপড়া বন্ধ করতে লাগান—আগরওয়াল ম্যাজিক কোট। আলসারে খান আগরওয়াল ছাতু। দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ।
সতী তোর আনন্দ মূরতি
নয়নের ভাতি মোর; সত্যি, সত্যি
বাংলার ঘরে ঘরে আগরওয়াল গুঁড়ো মশলা, ফোল্ডিং ছাতা। দক্ষযজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞ।
চুমকি বললে, ‘মানে ইচ্ছে হচ্ছে—গলাটা টিপে দি।’
‘ওদিকে কান দিচ্ছিস কেন?’
‘কান ধরে টানছে যে।’
পেপার পাল্পের তৈরি বিশাল একটা শিবলিঙ্গ চলেছে মঞ্চের দিকে। পেছনে বিজয় আগরওয়াল সঙ্গে আরও কয়েকজন। বড়মামার চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
বড়মামা বললেন, ‘হাঁটু কি বলছে?’
‘হাঁটলে ঠিক আছে, বসলেই বিপদ।’
‘দেখছি কী করা যায়?’
‘আরে, আমি জানি আমার দোস্ত আছে।’
আগরওয়াল বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ।
‘কী হল?’
‘সতীকে তিন জায়গায় ফুটো করে দিয়েছে।’
‘কে সতী?’
‘ওই যে মেজদার কাঁধের সতী।’
‘ও সব জিনিস ওর কাঁধে দিতে আছে। কী দিয়ে ফুটো করল? স্টিচ করতে হবে। পুলিশ কেস না হয়ে যায়!’
‘মেজদা করেননি। ধেড়ে ইঁদুরে করেছে।’
‘আমি বারবার সকলকে বলি, মশারি ফেলে শোও। সবার আগে টেট ভ্যাক দিতে হবে। তারপর অ্যান্টি র্যাবিজ।’
অনেক কষ্টে বড়মামাকে বোঝানো গেল। মাসিমার কাজ বাড়ল—সতীদেহের তিন জায়গায় তাপ্পি মারতে হবে। মেজোমামা কাঁধে ফেলে বললেন, ‘সুন্দর ফিট করেছে।’
‘করবেই তো স্যার। কাঁধের মাপ নিয়ে করেছে যে।’
‘আর একটু ভারী হলে ভালো হত!’
‘সে জলে ভেজালেই হবে।’
‘ইঁদুরটা ভেতরে ঢুকে নেই তো! কি যেন একটা নড়ছে!’
‘ও তাপ্পি মেরে দিলেই তুলোর মধ্যে ঘুমিয়ে পবে।’
‘ধ্যুৎ মশাই। ইঁদুরের দাঁতের ধার জানেন?’
বড়মামা বললেন, ‘একটা ফুল বডি এক্স-রে করালেই তো হয়।’
বেলা পড়ে এল। আঃ, কি আলো লাগিয়েছে। জ্বলছে নিবছে। চাকা ঘুরছে। মাইকে হর হর ব্যোম ব্যোম, ভোলেবাবা পার করে গা। স্টেজটা একেবারে জম্পেশ। পেছনে বিশাল শিবলিঙ্গ নাটকে শিবপূজার সিন আছে। বাদ্য বাজানোর দল এসে গেছে। নানা রকমের শব্দ। চ্যাঁক চো, গুড়ুগুড়ু। শেষবেলা ভারি ভালো একটা খবর এল। খবরটা নিয়ে এলেন সুধা মাইমা। এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলেন। খবরটা এল, প্রতাপের মা হঠাৎ বিছানায় উঠে বসেছেন। হাসি মুখে সকলের সঙ্গে পরিষ্কার কথা বলছেন। জ্বর নেই। চুমুক দিয়ে এক কাপ ফলের রস খেয়েছেন। চিরুনি দিয়ে প্রতাপের চুল আঁচড়ে দিয়েছেন।
বড়মামা বললেন, ‘মিরাক্যাল। এ ভগবানের খেলা।’
সুধা মাইমা আমাকে নিয়ে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কোথায় কী আছে। মাঝে মাঝে বলছেন, ‘দারুণ বাড়ি। প্যালেস, প্যালেস!’ মাসিমা প্যান্ডেলে। সতী রিপেয়ার করতে গেছেন। সুধা মাইমা জিগ্যেস করলেন, ‘বড়মামার ঘর কোনটা?’
‘এইটা।’
‘বাঃ, পুব দিকে একটা বারান্দা আছে। ঝিলটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।’ দরজাটা বন্ধ করে বড়মামার বালিশে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলেন।
‘কী রকম দেখাচ্ছে রে আমাকে?’
‘ঠিক মাইমার মতো।’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘চল, চল। অনেক কাজ পড়ে আছে।’ বালিশের যে জায়গায় মাথা রেখেছিলেন, সেই জায়গাটা দেবে রইল। ব্যাপারটা কী হল বুঝতে পারলুম না।
পাঁচ
একেবারে সামনের সারিতে আসন। প্রথমে বড়মামা, তারপর মাসিমা, সুধা, মাইমা, চুমকি, আমি আর হরিদা। প্রতাপ এল না। চারজনকে খুব খাতির করে বসানো হয়েছে। বেশ গম্ভীর গম্ভীর মুখ। হতে পারে। কম বড়লোক। টাকা ওঁদের কাছে বাসের টিকিট। ‘ডলার-টলার দ্যান রুপি’। চারজনেই আগরওয়ালার গেস্ট। আমেরিকায় এঁরা ‘ফেমাস ফোর’ নামে পরিচিত।
সুধা মাইমার একটা হাত মাসিমার হাতে। আঙুলে আঙুলে জড়ানো। চুমকি বললে, ‘হরিদার সাজটা তুই একবার দ্যাখ। পাঞ্জাবিতে একটাও বোতাম নেই।’
‘ওসব গ্রাহ্যই করে না। হরিদার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।’
‘আংটিটা আঙুল থেকে খুলে পাতকোয় পড়ে গেল। বললে, ‘বাঁচা গেল! কানে তুলো লাগিয়েছে কেন?’
‘আতর! হাতে ছোট্ট একটা থলি দেখছিস?’
‘হ্যাঁ রে। কী আছে রে?’
‘একটা, একটা করে পঞ্চাশটা টাকা। মেজোমামা যখন ‘ক্ল্যাপ’ পাবেন। তখন ওই থলিটা ছুড়ে দেবেন। সেকালের জমিদারদের মতো।’
মেজোমামার সাজ কমপ্লিট। ধবধবে সাদা মহাদেব। পিঙ্গল জটাজাল। সভাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বড়মামাকে প্রণাম করলেন। সত্যিই চেনা যাচ্ছে না। হরিদা বললে, ‘যাও, কর্তার নাম করে ফাটিয়ে দাও ভোলা মহেশ্বর।’
ড্রপসিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আগরওয়াল মাইক্রোফোনে বলছেন, ‘এই সেই বিখ্যাত নাটক। গিরিশচন্দ্র ঘোষ স্টার থিয়েটারে নামিয়েছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ দেখেছিলেন। এ নাটক নয়—ইতিহাস। আজ আমাদের শিবপূজার রাত। বলুন, বলুন,জয় বাবা বিশ্বনাথ।’
চতুর্দিকে ডুগুডুগু ডমরু বেজে উঠল। গম্ভীর গলায়, ব্যোম, ব্যোম। পরদা ধীরে ধীরে দুপাশে সরে গেল। বাগান। তপস্বিনী ধ্যানে বসে আছেন। মহামায়ার আবির্ভাবে। ধোঁয়ার কুণ্ডলি।
মহামায়া।। বর নে রে, পূর্ণ মনষ্কাম তোর।
তপস্বিনী।। মা, মা আমার কোথা ছিলে ভুলে।
শুরু হল আলো আর শব্দের খেলা। চুমকি ফিসফিস করে বললে, ‘বুঝলি, মহামায়া সতীকে ভর করলেন, মহাদেবকে প্যাঁচে ফেলার জন্যে। ওই শোন কী বলছেন?
মায়াপাশে বাঁধিবে মহেশে
এ বেশে এ লীলা মম।
হঠাৎ স্টেজের ওপর একটা কুকুর। হরিদার ভোলা। কী কাণ্ড! ডায়ালগ বন্ধ।
হরিদার হাঁক, ‘চলে আয় ভোলা, মাকে প্রণাম করে নেমে আয়, নেমে আয়। মায়াপাশে হোস না আবদ্ধ। আমরা মুক্ত। কেহ নাহি পারিবে তোরে বাঁধিতে।’
পটাপট তালি আর তালি। ‘এনকোর, এনকোর। আর একটু হোক।’
হরিদা উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে,
‘আর নাহি হবে রে এখন
রাত্রি শেষে তৈরি হবে নতুন পালা
পশু আর মানুষের প্রেম বন্ধন।’
আবার ক্ল্যাপ। প্যান্ডেল মুখর। ভোলা এক লাফে নেমে এসে হরিদার পায়ের কাছে শুয়ে পড়ল। হরিদা হিরো। আবার শুরু হল আসল পালা। বেশ জমে উঠেছে। দক্ষ ঘুরে গেছেন। মহাদেব ঢুকেছেন। কী দেখাচ্ছে। সবাই হাঁ হয়ে গেছে। মহাদেব আর সতী মুখোমুখি। নীল আলোর ঘুরপাক।
মহাদেব।। আছে কি জগতে শক্তি সতী,
মহাশক্তি বিরোধিতে?
সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধানো চড়া আলোয় স্টেজ ঝলসে উঠল।
ওঁ ওঁ ওঁ। চাপা মেঘ গর্জনের শব্দ। সাঁ সাঁ সাঁ।
সতী।। বিশ্বনাথ, বিশ্বনাথ।
মেজোমামার কি অভিনয়, একেবারে অন্য মানুষ—
মহাদেব।। তুরীয় তোমার লীলা/সতী, তুমি অন্তরে বাহিরে।
বড়মামা হঠাৎ বললেন, ‘ও কী? উইংসের পাশে।
‘কই?’
‘ওই তো, ওই তো! দেখতে পাচ্ছিস না তোরা? ওই তো প্রতাপের মা, কি সুন্দর সেজেছে!’
বড়মামা উঠে পড়লেন। বেরিয়ে যাচ্ছেন। পেছন, পেছন আমরা। ঘরের সমস্ত জানালা খোলা। মাঠের দিকে জানলার বাইরে হুহু আকাশ। শরতের বাতাসে শিউলির গন্ধ। মৃদু আলো। মায়ের পাশে ক্লান্ত প্রতাপ ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথার বালিশে প্রতাপের মায়ের মুখটি যেন পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। চোখদুটো খোলা। কিছু একটা দেখছেন, ভালো কিছু, ভীষণ আনন্দের কিছু।
বড়মামা চাপা স্বরে বললেন, ‘চলে গেছে। প্রতাপকে আমি জাগাতে পারব না, তোমরা যা পারো করো।
খাটের পাশে এক সার মানুষ অবাক হয়ে দেখছে—নিদ্রা আর চিরনিদ্রা।
খোলা জানলায় শেষ শরতের আকাশ। শিউলি আর ফুটবে না।