থ্যালিস (আনু. ৬২৪–৫৬৫ খ্রি. পূ.) – বিজ্ঞানশাস্ত্রের আদিপুরুষ
হিরোডোটাসের লেখা ইতিহাসের বর্ণনা থেকে জানা যায় ৬ষ্ঠ-৭ম খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইজিয়ান সাগরের পূর্বতীরে বিজ্ঞান এবং দর্শনশাস্ত্রের প্রথম উন্মেষ ঘটেছিল। বর্তমান তুরস্কের পশ্চিম তীরে প্রাচীন মাইলেটাস নগরীতে সেই সময়ে যে মহান মানুষটির জন্ম হয়েছিল, তিনিই বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রের আদি জনক বলে খ্যাত মহাজ্ঞানী থ্যালিস (Thales)।
থ্যালিসের জন্ম ৬২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তাঁর পিতার নাম ছিল ইক্সামিয়েস। তিনি ছিলেন মাইলেটাসের ক্যারিয়ান গোত্রের অদিবাসী। তাঁর মায়ের নাম জানা যায়নি। তিঁনি ছিলেন একজন গ্রিক রমণী।
এই সময় মাইলেটাস ছিল মূলত গ্রিকদের অধিকারে। এইসময় বহু গ্রিক এখানে এসে স্থাপন করেছিল নতুন বসতি। এখানে থাকতে থাকতেই গ্রিকদের সাথে স্থানীয় ক্যারিয়ানদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শুরু হয় তাদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের পালা।
বহু গ্রিক যুবক ক্যারিয়ান মেয়ে বিয়ে করে গড়ে তোলে মাইলেটাসে স্থায়ী নিবাস। তেমনি বহু ক্যারিয়ানও বৈবাহিক সূত্রে নিজেদের ঘরে গ্রিক মেয়ে নিয়ে আসে। থ্যালিসের মাও ছিলেন তেমনি একজন গ্রিক রমণী, যিনি আদিবাসী ক্যারিয়ান যুবক ইক্সামিয়েসের সাথে ঘর বেঁধেছিলেন প্রেম করে।
তাঁর জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে আজ আর বিশেষ কিছুই জানার উপায় নেই। শুধু এতটুকু জানা যায় যে, থ্যালিস প্রথম জীবনে শিক্ষালাভের জন্য গিয়েছিলেন তখনকার মিশরে। সেসময় মিশর ছিল শিক্ষাদীক্ষায় খুবই উন্নত। তিনি পড়াশোনার জন্য ব্যাবিলন পর্যন্ত গিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
মিশরে এসেই থ্যালিস গণিতশাস্ত্র, বিশেষ করে জ্যামিতিক রেখা, কোণ, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্ত ইত্যাদি আঁকেন। জ্যামিতির এই মূল সূত্রগুলো কিন্তু তাঁদের অবদান। তাঁর এসব সূত্র অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে পিথাগোরাসসহ অন্যান্য দার্শনিক ও বিজ্ঞানী একে আরও উন্নত করলেও এসবের আদি সূত্র থ্যালিসই প্রথম আবিষ্কার করেন। একটি সমকোণী ত্রিভুজের ভূমিসংলগ্ন দুটি কোণ পরস্পর সমান। দুটো সরল রেখা যদি পরস্পর ছেদ করে, তা হলে যে-কোণ উৎপন্ন হয়, তার বিপরীত কোণগুলি পরস্পর সমান। কোনো বৃত্তের ব্যাসের ওপর যদি লম্ব আঁকা হয়, তা হলে তার বিপরীত কোণগুলি হবে সমান কোণ। একটি ত্রিভুজের তিনিট কোণ হলো দুই সমকোণের সমান— এসবই থ্যালিসের আবিষ্কার। তিনি শুধু একটি ত্রিভুজের সাহায্যে অঙ্ক কষে, কোনো গজ-ফিতে ছাড়াই কোনো বস্তুর দূরত্ব মাপার কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন।
তিনি শুধু অঙ্কশাস্ত্রবিদই ছিলেন না। ছিলেন বহু গুণের আধার। একাধারে প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ।
বিজ্ঞানী থ্যালিসের লিখিত কোনো গ্রন্থেরই সন্ধান পাওয়া যায়নি। পণ্ডিতরা মনে করেন, হয়তো তিনি লিখিত কিছু রেখেও যাননি। কারণ, তাঁর সময়ে লেখার বা লিখিত কিছু গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার প্রথারই কানো প্রচলন ছিল না।
অবশ্য তাঁর জন্মের একশো বছর আগেই গ্রিকরা এখানে ফিনিশিয়ান বর্ণমালার প্রচলন করলেও তার বহুল ব্যবহার তখনও সেখানে শুরু হয়নি। আর এজন্যেই থ্যালিসের কোনো সূত্র লিখিত অবস্থায় পাওয়া যায়নি।
তিনি তাঁর জ্যামিতিক সূত্র, বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং দর্শনশাস্ত্রের তত্ত্বসমূহ মুখে মুখেই তাঁর ছাত্র বা শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন। ছাত্ররা এসব সূত্র মুখস্থ করে রাখত। পরে তারা আবার সেগুলো মুখসস্থ বলতে অন্যদের কাছে। এভাবেই থ্যালিসের সূত্র ও দার্শনিক তত্ত্বসমূহ সাধারণ তথ্য হিসেবে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচারিত ও প্রচলিত হতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে। পরে ঐতিহাসিক হিরোডোটাস তাঁর এসব তথ্য ও বিজ্ঞানের নানা সূত্রকে নতুন করে প্রকাশ করেন। থ্যালিসের সূত্র ও তত্ত্ব হিরোডোটাসের গ্রন্থে প্রথম লিপিবদ্ধ করা হয়। তাই থ্যালিসকে জানার প্রধান মাধ্যম হলেন হিরোডোটাস।
মহাজ্ঞানী থ্যালিসের দার্শনিক মতবাদ ছিল বিস্ময়কর। তিনি মনে করতেন, বিশ্বের পদার্থসমূহের মূল উপাদান হলো একটি। তিনি বলেছেন, বস্তুজগতের আদি উপাদান হল জল বা পানি। তার থেকেই বিশ্বের যাবতীয় বস্তুর জন্ম। জলই রূপান্তরিত হয়ে নানা বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। তিনি অবশ্য কোন্ যুক্তিতে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তবে এ সম্পর্কে পরবর্তীকালে অ্যারিস্টটল বলেছেন, উদ্ভিদ এবং যাবতীয় প্রাণীর প্রাণ সংরক্ষণে জলের অপরিহার্যতার কথা চিন্তা করেই হয়তো থ্যালিস জলকে সমস্ত বস্তুর মূল উপাদান বলে মনে করেছিলেন।
থ্যালিস মনে করতেন, জলই বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুতে রূপান্তরিত হয়। এ ধরনের চিন্তার পেছনে কিছুটা পটভূমিও আছে। হোমারের সময় গ্রিকরা ওশেনিয়া বলে এক দেবতার পূজা করত। তখন ওশেনিয়া বলতে বোঝাত নদী। পরে এর অর্থ দাঁড়ায় মহাসমুদ্র। মহাসমুদ্রের বিশালতায় তারা মুগ্ধ হয়ে যেত।
সেকালে গ্রিসের ভূভাগ বা মাটি তেমন উর্বর ছিল না। তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের বেলাতেও সমুদ্রের ওপরই নির্ভর করত। বস্তুত তাদের জীবন ছিল সমুদ্রনির্ভর। সমুদ্র মানেই তো জল আর জল। ফলে থ্যালিসের চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় জল বা পানি।
বিজ্ঞানী থ্যালিসের মতবাদ এখনকারকালে অপরিণত এবং ভ্রান্ত বলে মনে হতে পারে। তবু আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে সভ্যতার প্রায় আদিযুগে বস্তুজগৎ সম্পর্কে এ ধরনের ভাবনা কম কথা ছিল না। মূলত বস্তুজগতের বহুত্বের মধ্যে একত্বের সন্ধানের সেটাই ছিল প্রথম প্রচেষ্টা।
এই বিশ্বজগৎ, ঈশ্বর এবং দৈবশক্তি সম্পর্কেও তিনি তাঁর মত ব্যক্ত করেছিলেন। সেকালে সবাই ভাবত পৃথিবীর মানুষের কার্যকলাপের সাথে দেবতারাও জড়িত, মানুষের ভাগ্য দেবতার হাতে। যেমন, হোমারের ইলিয়াড এবং অডিসিতে বর্ণিত ট্রয়ের যুদ্ধে দেবতাদের সক্রিয় অংশ গ্রহণের ঘটনা থেকেই তার প্রমাণ মেলে।
অথচ থ্যালিস বলতেন, পৃথিবীর মানুষের সাথে স্বর্গের দেবতাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমন কি তিনি স্বর্গের তথাকথিত দেবতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলতেন, বিশ্বসৃষ্টি এবং তার যাবতীয় কার্যক্রম প্রাকৃতিকভাবেই সাধিত হচ্ছে। এর মধ্যে দেবতাদের কোনো হাত নেই। সেই আদি যুগে এ ধরনের চিন্তা কতখানি বিস্ময়কর, আজ সেটা ভাবাও যায় না।
জ্যোতিষশাস্ত্রেও তিনি ছিলেন আশ্চর্য রকমের পারদর্শী। চন্দ্র-সূর্যের পরিক্রমণের ব্যাপারটিও তিনি গণনা করতে পারতেন প্রায় নিখুঁতভাবে। তাঁর একটি জ্যোতিষ-গণনা হুবহু ফলে গিয়েছিল ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তার আগেই তিনি মন্তব্য করেছিলেন, শিগিরই সূর্য রাত্রির মধ্যে ডুবে যাবে এবং চন্দ্র এসে সম্মুখে দাঁড়াবে।
তাঁর এই গণনা মতেই ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পূর্ব-ইউরোপে একটি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিল এবং দ্বিপ্রহরের সময় সূর্য ঢেকে গিয়েছিল। সেই অন্ধকারে চাঁদের আলো দেখা ফুটে উঠেছিল। সেই বছর যে সূর্যগ্রহণ হবে সেটা তিনি আগথেকেই গণনা করে বলেছিলেন।
এদিকে দার্শনিক থ্যালিসের এই ভবিষ্যদ্ববাণী সত্যে পরিণত হওয়ায় সারা দেশ জুড়ে হইচই পড়ে যায়। রাতারাতি তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
এই সূর্যগ্রহণের সময় ঘটেছিল আরও একটা মজার কাণ্ড। এই সময় লিডিয়ার রাজা অ্যালাইয়্যান্টস এবং মেডেসদের মধ্যে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে চলছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সূর্যগ্রহণ হওয়ার পর দুটো বিবদমান রাজশক্তিই গেল ঘাবড়ে। তারা মনে করল, এই রাত্রির অন্ধকারে সূর্যের হারিয়ে যাওয়া হয়তো পৃথিবীর মানুষের অসৎকর্মের জন্য দেবতাদের হুঁশিয়ারি স্বরূপ কোনো ঘটনা তাদের বিবাদ আর পাপের জন্যই এমন আলৌকিক ঘটনা ঘটছে। এই ভয়ে দুপক্ষই ঘাবড়ে গেল। ফলে তারা শত্রুতা ভুলে গিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সন্ধিবন্ধনে আবদ্ধ হলো। শত্রুতা পরিণত হলো মিত্রতায়।
দুষ্টলোকেরা সেকালে প্রচার করত, দর্শনচর্চা করে পেটের ভাত হয় না। থ্যালিস এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে সেবার মাইলেটাস শহরের সমস্ত জলপাই কিনে গুদামজাত করেন। পরে জলপাইয়ের অভাবে তার দাম খুব চড়ে যায়। তখন তিনি চড়া দামে মাল বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। এটা ছিল তাঁর জেদ।
ঘর-সংসার সম্পর্কে চিরকুমার থ্যালিস ছিলেন একেবারেই উদাসীন। অল্পবয়সে যখন তাঁর মা তাঁকে বিয়ের কথা বলেছিলেন, তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, এখনও বিয়ে করার সময় হয়নি। আবার যখন শেষ বয়সে মা তাঁকে বিয়ে করার জন্য অনুরোধ করলেন, তখন তিনি উত্তর দিলেন, এখন আর বিয়ে করার সময় নেই।
এই মহাজ্ঞানী থ্যালিসের আরও বহু আশ্চর্য আবিষ্কার আছে। বস্তুর ঘর্ষণের দ্বারা যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, সেটা থ্যালিসই প্রথম আবিষ্কার করেন। তাঁর এই আবিষ্কারকে এতদিন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেজন্যই থ্যালিসের মৃত্যুর দু হাজার বছর পর মানুষ প্রথম তড়িৎশক্তির সন্ধান পায়। তিনি চৌম্বকশক্তির ওপরেও গবেষণা করেছিলেন।
এই মহান দার্শনিকের মৃত্যু হয় ৫৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। কিন্তু আজও বিজ্ঞান আর দর্শনের জনক বলে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।