থুতু

থুতু 

গাই-ড্যাগরা উৎসব। 

ছোটনাগপুরে গোয়ালা-পল্লীর ঘরে ঘরে ঢাকের দামাদ্রিম ভেসে উঠছে। বাতাসে হাড়িয়া আর পচুইয়ের লম্পট সৌরভ। স্বাদেন্দ্রিয়ের তন্ত্রীগুলো আকস্মিক চাঙ্গা হোয়ে উঠে। আভীর যুবক-যুবতী শিশু-কিশোরদের প্রাণশক্তির পরিচয় চারিদিকে। রোজানা পৃথিবীর রং অকস্মাৎ বদলে গেছে। গোয়ালা- পল্লীর গৃহপালিত চরেন্দারা পর্যন্ত সচকিত। সাদা গোরুর রোঁয়ায় রোঁয়ায় রং-ছাপা কারিগরি। চোখে- লাগা রং আভীর-প্রভু দুনিয়ার সব-কিছুর উপর ছড়িয়ে দিয়ে যেন শান্ত হোতে চায়। আড্ডায় পুরোদমে হাড়িয়া চলে। গাভী-বলদও আজ তার শরীক। বাছুরের দল তাজা দুনিয়ার স্বাদ চোখে মাতাল; টু মারতে ছোট শিশুদের। হল্লার জন-সমুদ্রে এরাও যেন ফচকে বাতাস। 

ময়দান ভেঙে পড়েছে দর্শকের জনতায়। আদিমাতার পারম্পর্য–বাহী বন্য-উল্লাসের বন্যা-তুরঙ্গ আজ রাশ খুলেছে দিগ্বিদিকহীন। আসন্ন বৈকালের আকাশ মুখর হোয়ে উঠেছে পশু-মানুষ, বাদ্য যন্ত্রের মিলিত কীর্তনে। 

কতগুলো শূকর-ছানার চীৎকার আর্তনাদের মত ফেটে পড়ে। তার নিকট অন্যান্য কোলাহল যেন তিথিয়ে যায় এক-একবার। এই শূকর-নন্দনকে কেন্দ্র করেই উৎসব। কপালে সিন্দুরের রেখা, চিক্কণ লোমশ-দেহ শূকর-শাবক। মুখে দুধ-কলা আর হাড়িয়ার গন্ধ এখনও টাকা, গলায় শক্ত রশির বন্ধন। শূকরছানা প্রাণভয়ে অস্থির। দিগ্বিদিক ছুট মারে। দু-দিক থেকে শিংওয়ালা বলীবদ অথবা গাভী তালে তালে ঢু চালায়। রক্ত ঝরে শূকরের নরম শরীর ছিঁড়ে। দীর্ণ চীৎকারের সমতা রক্ষা করে ঢাকের আওয়াজ আর মাতাল গোয়ালাদের বিকট উল্লাস। এলোমেলো দৌড় চলে শূকর শাবকের। নেশায় চুর ষাঁড়ের শিং লক্ষ্য হারায় না একবারও। অবসন্ন আত্মরক্ষা অন্তিম মুহূর্তের স্তিমিত সংগ্রাম। শেষ ফুঁ। শূকর-নন্দন ভবনদী পার। জনতার ভেতর তখন হল্লা বেড়ে যায়। কার গোরু শেষ শৃঙ্গাঘাত করেছে? দৃষ্টি সবার সেদিকে জাগ্রত। গোরুর মালিককে কেন্দ্র করে আবার উল্লাসের হুল্লোড়। সমাজের নৈশ ভোজ-রক্ষার ভার যে তারই উপর পড়ে। প্রতিবেশীদের আনন্দ-আতিশয্য তাকে মাটি ছাড়া করে। সে তখন নৃত্যমান বন্ধুদের স্কন্ধে, হাত জোড় করে প্রণাম জানায়। 

হাড়িয়া-প্রসাদাৎ উন্মাদ শৃঙ্গমান জীবদল মাটি খোঁড়ে শিকারের অভাবে। শিকারের যোগান আসে একটু পরেই। অন্য শূকর শাবক। সারা মাঠ জুড়ে শূকর-হত্যার তাণ্ডর নেশা। মাংসাশী গৃধ্ন হিংস্রতায় গুহা-মানব যেন লক্ষ্য-ভ্রমে ছিন্ন-লাঙ্গুল কৃষ্ণ গোধিকার পশ্চাদ্ধাবন করছে গোধুলির অন্ধকারে। 

ফাদার জোহানেস বৈকালিক ভ্রমণ শেষে ডেরায় ফিরছেন। 

এই পথে জনতার ভিড়ে তিনিও একবার থামলেন। গাই-ড্যাগরা উৎসব তিনি নূতন দেখছেন না। পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে তাঁর ছোটনাগপুর অঞ্চলে। সত্তর-ঊর্ধ্ব বয়স। জীবনের সায়াহ্ন-কাল। ফাদার জোহানেসের শৈশব কেটেছিল হার্ডফোর্ডশায়ারের কাউন্টিতে। অক্সফোর্ডের স্মৃতি-রঞ্জিত যৌবনের উচ্ছল দিনগুলি। তারপরই জেস্যুট মিশনারী রূপে ভারতে প্রবাস-জীবন। পনর বছর হিন্দুস্তানের বহু অঞ্চল বদলানোর পর এইখানে তাঁর শ্রমণ-নেশার পরিসমাপ্তি ঘটে। বহু-ভাষাবিদ্, চিরকুমার ফাদার জোহানেস কর্তব্য-ভূমির তেপান্তরে আজও পরিব্রাজক। 

তাঁরই অক্লান্ত মেহনতে কয়েক হাজার কোল-খৃষ্টান এই অঞ্চলে। দুটো হাই-স্কুল, একটা টেকনিক্যাল ইনষ্টিট্যুট-তাঁরই অক্ষয় কীর্তি। এই এলাকায় ফাদার জোহানেসের পরিচয় তিনি স্বয়ং। যারা যীশু খৃষ্টের আলোকে ত্রাণ-প্রাপ্ত তারা নয় শুধু, অন্যান্য অখৃষ্টানদের অহেতুক ভক্তিও ফাদার জোহানেসের উদ্দেশে প্রতিদিন উৎসৃষ্ট। সেবা, ক্ষমা, মানবতার প্রতীক ফাদার জোহানেস। বিশ্বের কল্যাণ-কামী অহিংস সংস্কারকদের মুকুট-মণি তিনি। স্তুতিবাদের অনেক ঊর্ধ্বে তাঁর আসন। অবয়বে স্পষ্ট স্বাক্ষ্য মেলে। পরনে ঢিলে-ঢালা পালুন, সফেদ ক্যাসক, হাতে ছড়ি। দূর থেকে চেনা যায় ফাদার জোহানেস হাঁটছেন। পদক্ষেপের ভঙ্গী অসাধারণ। নিটোল আড়ং। মুখে একরাশ তুহিন-ধবল শ্মশ্রু-গুচ্ছ অপরূপ দেখায়। মহামানবের আদল যেন থমকে রয়েছে এই মুখে। তার উপর বড় মিষ্টভাষী তিনি। ধীরে ধীরে কথা বলেন। ওষ্ঠ তখন চঞ্চল না স্থির, স্পষ্ট বোঝা যায় না। চোখের দৃষ্টি সর্বদাই যেন সুদূর দিগন্ত-বিলাসী। সংলাপের সময় যখন চোখ ফেরান কারো দিকে, বেশী-ক্ষণ চাওয়া যায় না তাঁর মুখের উপর। ব্যক্তিত্বের এমন সম্মোহনী প্রভা বিরল 

যীশু খৃষ্টের সেবক ফাদার জোহানেস। উইলিয়াম জোহানেস। নামের শেষে লেখেন এস. জে–সার্ভেন্ট অফ জেসাস। 

—গুড ইভনিং, ফাদার। 

—গুড ইভনিং। 

ফাদার জোহানেস চেয়ে দেখেন, আগন্তুক তাঁরই বাবুর্চি মনসুর। 

—ইস তরফ, মনসুর? 

জিজ্ঞাসু-নেত্রে ফাদার জোহানেস প্রতীক্ষা করেন। 

—-গাই-ড্যাগরা দেখনে। 

শূকর-শাবকের আর্তনাদ-মুখর চীৎকার কোলাহল ভেদ করে ছিটকে পড়ে পাতলা জনতার এই পারে। আমনা ফাদার জোহানেস। কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার তিনি বলেন : মনসুর, জলদি ডেরা মে যাও, জলদি। মাই আতা। 

—গুড ইভনিং, ফাদার। 

—গুড ইভনিং। 

নূতন নমস্কার-দাতা কর্ণেলিয়াশ। একজন চাষী কোল-কভার্ট। 

—গুড ইভনিং, ফাদার। 

—গুড ইভনিং। 

জোসেফ পণ্টকার, আরো অসংখ্য পরিচিত মুখে সাদর আহ্বান : গুড ইভনিং, ফাদার। 

এই জনতা ঠেলে ফাদার জোহানেস ধীর-পদে এগিয়ে যান সম্মুখে। 

শূকর-ছানার প্রাণ-ভেদী ডাক গোধূলির বায়ু-কণ্ঠে। আরো কয়েক শ’ গজ দূরে পীচ ঢালা সড়ক। ওখানে উৎসব-কোলাহল মৃদু ঢেউ তোলে। সন্ধ্যা আসন্ন। ফাদার জোহানেস যষ্ঠির উপর ভর দিয়ে চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। 

কালো ‘কার’-বাঁধা ক্রস-চিহ্নটা সম্মুখে ঝক্‌ঝক্ করে সূর্যাস্তের আলোয়। 

নিরাশা-ক্লিষ্ট অদ্ভূত প্রেতায়িত ভাব ফাদার জোহানেসকে ঘিরে রাখে। 

শুধু আজকের সন্ধ্যা ব’লে নয়। বিগত দশ বছর এই অস্বোয়াস্তির জখমে মূহ্যমান তিনি। যৌবনের প্রাণ-শ্যামলিমার উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল। বিশ্ব ছেয়ে যাবে তাঁর যৌবন-স্বপ্নে। পৃথিবীর বুক থেকে জুলুম নিশ্চিহ্ন মুছে যাবে। মজলুমের হাহাশ্বাস, ফরিয়াদ থাকবে না মাটির দুনিয়ায়। সেই বিশ্বাসের ভিত ধূলিসাৎ হোয়ে গেছে। সামসনের মত থাকত তাঁর একখণ্ড করোটী-কঙ্কাল। গ্লানি-পঙ্কিলতা যদি দেহী মনুষ্যরূপে দাঁড়াত যোজন-যোজন-বিস্তৃত ব্যূহ রচনা করে, সব ধ্বংস করে ফেলতেন তিনি নিমেষের মধ্যে। যীশুখৃষ্টের উপর চরম নির্ভর, ঈমানের বজ্রকঠিন ভিত-আর কী প্রয়োজন আছে তাঁর সম্ভাবনা পথে? আজ প্রাত্যহিকতার চতুস্পার্শে ফাদার চেয়ে দেখেন। না, পৃথিবীর দেহ থেকে পবিত্রতার উত্তরীয় খসে গেছে। পঙ্কিলতার অভ্রভেদী পাহাড় সম্মুখে। কতটুকু তাঁর শক্তি! শুধু প্রাণের ঐশ্বর্যকিরণ এখানে তুচ্ছ। কোথা যেন ফাঁক থেকে যায়। যার অনটনে ইয়াজুজ-মাজুজের চারিপাশ ঘেরা পাতলা পাহাড় আবার রাত্রি-মধ্যে লক্ষ যোজন বিস্তীর্ণ প্রস্তরের বন্দীশালা রচনা করে। ফাদার জোহানেস নিজেই উপলব্ধি করেন, আজ তাঁর কাছে কর্তব্য যন্ত্রায়িত নিষ্ঠামাত্র। মুষড়ে যাওয়া প্রাণ আর দিগন্তের স্বপ্ন দেখে না। কর্তব্য-পালন তাঁর ত্রুটিহীন। নূতন কর্ম-পন্থার অভাব বোধ করেন ফাদার জোহানেস। কর্তব্য তাঁরই দীনতায় পঙ্গু। পুনরায় নূতন-রূপে জীবন-রচনা? সায়াহ্নকালে পৌঁছে প্রভাত-দিনের চলা- পথ খোঁজা স্রেফ মরীচিকার প্রলোভন। আর্ত-বেদনায় ফাদার পথ চলতে চলতে মাঝে মাঝে অসহায় দুর্বলতায় গমন-নিরস্ত হন। হৃৎস্পন্দন হয়ত এখনই থেমে যেতে পারে। অশ্রুসজল আল্লার আকাশ হাতছানি দিয়ে যায়। দোটানায় আবর্তিত জীবন-বেদের পাতাগুলো যদি বন্ধ হোয়ে যেত! ও লর্ড জেসাস! ফাদার জোহানেস ক্রস-চিহ্ন আঁকেন বুকে। তবু অস্বোয়াস্তির অগ্নি ধূ ধূ জ্বলে। ইন্‌ফিডেল-ইন্‌ফিডেল-বেঈমান-বেঈমান। সেইজন্য অবিশ্বাস। ধিক্কারের শর বিদ্রোহী মনের উপর বর্ষিত হয়। কিন্তু বাইরের নীচ সংকীর্ণ জগতের মুখোমুখি জবাব দেওয়ার অকুতোভয়তা তিনি সঞ্চয় করতে পারেন না। আজকাল আসন্ন বৈকালে তাই তাঁর ভ্রমণের দূরত্ব থামে উৎরাইয়ের পথে, গেঁহু ক্ষেতের কিনারায়, বুনো গাছপালার সান্নিধ্যে। সান্ত্বনার কলভাষ লেখা থাকে প্রকৃতির শ্যাম-স্পর্শে। 

শূকর-ছানার চীৎকার, উৎসবের কোলাহল আর শোনা যায় না। তবু ফাদার জোহানেস দ্রুতপদে হাঁটেন এক-একবার। তাঁর কানের পর্দায় ঝঞ্ঝনা উঠে। 

অন্ধকার পদক্ষেপে কুয়াশার প্রলেপ টানছে পাহাড়িয়া অঞ্চল। 

চরাট-শেষে একদল ভেড়া এলোমেলো পথের চারিদিকে ভিড় করে। আকাশের সাদা মেঘ মর্ত- লোকে স্নান-যাত্রী। মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছড়ি-হাতে ফাদার জোহানেস। শ্বেত শ্মশ্রু-গুচ্ছ, সফেদ পাতলুন আর ক্যাসক। বেতেলহামের প্রান্তরে যীশুখৃষ্ট যেন মেষ-পালের অরণ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। 

ভেড়ার পাল বস্তীর দিকে চলে গেলো। গীর্জার ঘণ্টা লঘু হাওয়ায় ভেসে আসে। গাঢ় অন্ধকারের যবনিকা তরুলতার কোলে। 

ফাদার জোহানেসের ক্লান্ত হৃদয় এখানে শান্তি পায় না। 

দ্রুতপদে তিনি গীর্জায় ঢুকে পড়লেন। আয়কোনের পাশে মোমবাতি জ্বালা। আরো কয়েকটি মোমবাতি সামাদানের উপর তিনি জ্বেলে দিলেন। উপরে যীশুখৃষ্টের চিত্র ঝলমল করছে অপূর্ব মহিমায়। ক্রস-চিহ্নে ঝোলানো মহামানবের অপরূপ মূর্তি। দুই কোমল তালুর উপর পেরেকের দুঃশাসন। কণ্টক- মুকুট-শোভিত শির, কপালে বিন্দু-বিন্দু ছোঁয়া রক্তের লাল দাগ। নির্বিকার ঔদার্যে মুখের আদল অবিকৃত। 

ফাদার জোহানেস অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকেন। অস্পষ্ট মৃদু-ভাষ তাঁর ওষ্ঠের সঞ্চালন- লীলায়। একান্ত ধ্যান-স্তিমিত গলায় তিনি ডাকেন : ও মার্সিফুল লর্ড জেসাস! 

দুই চোখে তাঁর অশ্রুর প্লাবন। যীশুখৃষ্টের শান্ত-সমাহিত মুখের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তিনি পিছু হেঁটে গীর্জার প্রাঙ্গণে থামেন। 

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। 

প্রাঙ্গণে কুমারী মেরী-মাতার ভাস্কর্যমূর্তি ছায়া ছড়ায় গ্যাসের আলোয়। 

প্রাঙ্গণের পশ্চিম প্রান্তেই তাঁর কোয়ার্টার। 

ফিকে গ্যাসের আলোর ওধারে থমথমে অন্ধকার। ফাদার জোহানেস আকাশের দিকে চোখ ফেরান একবার। মৌন গভীর শীতের কুয়াশা-সুপ্ত আকাশ। নিষ্প্রভ নক্ষত্ররা একে একে ফুটে উঠে, হার্ডফোর্ডশায়ারের আকাশে যেমন ফুটে উঠত। 

বুনো পতঙ্গের ডাক শুরু হোয়েছে কেয়ারীর নিস্তব্ধতায়। 

.

শীতের দিনে বৃষ্টি নেমেছে আকস্মিক। বাইরে বৃষ্টির ঝর্ঝর-সঙ্গীত। বাবুর্চিখানায় মনসুর হাত চালায়। তাড়াতাড়ি বাড়ী ফেরা দরকার আজ। 

মনসুর বাবুর্চির বয়স চব্বিশের বেশী নয়। কৃশ তনু। পরণে একটা পাজামা। খালি পা। গায়ে নীল রঙের হাফ শার্ট। শীতনিবারকরূপে গলায় রুমল বাঁধা। 

মনসুর যন্ত্রের মত কাজ করে। জুস্ তৈরীর পর ভেজিটেবেলের কাটলেট। রুটি এখনও বাকী। দিনে তবু মাঝে মাঝে ফাদার জোহানেস বাঙ্গালীর অন্ন গ্রহণ করেন। লেটুসের সালাদ ফাদার জোহানেসের প্রিয় খাবার। মনসুর তা জানে। নীল-সবুজ লেটুসের পাতাগুলো টেবিলের উপর রাখা। এখনও অনেক কাজ বাকী। 

মনসুর ঝঞ্ঝাটের ভয়ে সহকর্মীরূপে তার ভাগনেকে সঙ্গে আনে। 

—হাত চালাও, বাবা। হাত চালাও। 

আশেক রুটি বেলতে ব্যস্ত। 

—হাঁ, মামুজী। সংক্ষিপ্ত জবাব আসে। 

বছর বারো বয়সের ছেলে। রুগ্ন, কৃশ মুখ বিষাদ-ক্লিষ্ট। 

—হাত চালাও। 

মনসুর একটা বিড়ি ধরিয়ে কাটলেটভাজা কড়ার দিকে চেয়েছিল। কড়ার হাতল নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে গান ধরে : কেনারে সে লাগা দে মেরে নাইয়া। 

—আশেক, থোড়া পানি দো। 

রুটি–বেলা বন্ধ রেখে মামার কাছে সে গ্লাস এগিয়ে দিল। 

আশেক আবার রুটির কাজে ব্যস্ত থাকে। 

রাত্রির প্রহর এগিয়ে যায়। মনসুর চটপট কাজ সারে। 

আশেক হাতের কাজ সেরে একদিকে বসে থাকে ম্রিয়মান। চুল্লীর জ্বলন্ত কয়লার পাশে তবু উত্তাপ আছে। 

মনসুর বলে : ইধার মাৎ আও। কয়লা কা বু আচ্ছা নেহি। 

আশেক মামার কথা পালন করে। সে জানে, তার শরীর খুব খারাপ। 

গীর্জার ঘণ্টা বেজে গেল ঢংঢং। রাত্রি দশটা। মনসুর ব্যস্ত হয়। এখনও ফাদারের ঘণ্টার আওয়াজ এলো না কানে। অনধিকার প্রবেশে সে সাহসী হয় না। কতদূর বা ফাদারের ঘর। বাবুর্চিখানার পাশে একটা ছোট লন। বর্ষাকালে বৃষ্টির সময় যাতায়াতের সুবিধার জন্য উপরে টিনের চাল। পথটুকু পার হোলেই ফাদার জোহানেসের কোয়ার্টার। প্রথমে ড্রয়িং-রুম। ডান পাশে শোয়ার ঘর। আরো তিনটে কারা আছে অন্যান্য দিকে। অতিথিদের আস্তানা পড়ে এই সব ঘরে। 

আজ এত বিলম্ব। দশটার আগেই ফাদার জোহানেস ডিনার শেষ করেন। সুইচ টিপলেই বাবুর্চিখানায় ঘণ্টার আওয়াজ ছোটে। আজ কোন ঘণ্টার ডাক পড়ল না। 

বৃষ্টি থেমে গেছে। কৃষ্ণ-সপ্তমীর চাঁদ উঠেছে নীল আকাশ পূর্ণ ক’রে। 

মনসুর শশব্যস্ত। 

বেশীক্ষণ অপেক্ষা সে করতে পারে না। নিজেই তাই ফাদার জোহানেসের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।

অবাক হয় মনসুর। চারিদিক অন্ধকার। 

—ফাদার! 

কোন সাড়া মেলে না। এই বাড়ীর নাড়ী-নক্ষত্র মনসুর চেনে। যাজকের শোয়ার ঘর শূন্য চাঁদের ফিকে আলোয় দেখা যায়। 

বারান্দায় হয়ত ফাদার জোহানেসের থাকা সম্ভব। সেদিকও অন্ধকার। 

বারান্দার আলোর সুইচ টিপলো মনসুর। 

ফাদার জোহানেস উন্মাদের মত পায়চারি করছেন। তাঁর পাতলুন, ক্যাসক ভিজে গেছে। ভেজা জুতোর ছপছপ আওয়াজ হয় পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে। 

সারা বৃষ্টি গেছে ফাদার জোহানেসের উপর দিয়ে। দূরে মৌন আকাশের মহিমা। বিরল নক্ষত্রের আলো নিষ্প্রভ-দৃষ্টি। ফাদার জোহানেস দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে পায়চারি করছেন। 

—ফাদার! মনসুর ডাকে : ফাদার! 

উইলিয়াম জোহানেসের চমক ভাঙল। 

—ইয়েস, মাই বয়। 

মনসুর ভাবে, উন্মাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে নাকি। 

—আপকা পাতলুন, ফাদার। 

—ইয়েস, মাই বয়। 

তাঁর চমক যেন সম্পূর্ণ ভাঙছে না। হাতে বাইবেল গ্রন্থ। কোন পাতার দিকে দৃষ্টি আছে কিনা বোঝা শক্ত। ফাদার আর একবার বারান্দার অন্য কোণে গিয়ে থাম্‌লেন। 

মনসুর ডাকে : ফাদার। 

—ইয়েস, মাই বয়। 

দ্রুত পদক্ষেপে তিনি মনসুরের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। 

—আপ্‌কা খানা। 

মনসুরের কাঁধে হাত রেখে ফাদার জোহানেস বলেন : চলো। ইয়াদ নেহি থা। মাঁই আতা। 

মনসুর মনে মনে বিরক্ত হয়। তবু সে শ্রদ্ধা করে ফাদার জোহানেসকে। জন্মভূমির মায়া কাটিয়ে দেশ-দেশান্তরে এসে এই অমর প্রাণ শুধু মানুষের সেবায় আত্মোৎসর্গ করেছেন। মনসুর ভক্তি করে ফাদার জোহানেসকে। আত্ম-ভোলা মানুষের বন্ধু থাকে না। তাঁদের জন্য সঞ্চিত থাকে ভক্তির মণি-মাল্য। 

মনসুর বাবুর্চিখানায় ফিরে এলো। 

—আশেক, জলদি করো বেটা। 

আশেক তখন একটা টুলের উপর ঘুমে ঢুলছে। মনসুর চেয়ে দেখে একবার তার মুখের দিকে। তারপর আর ডাকে না। কচি-কিশোরের এমন বিষণ্ণ মুখ সে কোনদিন আর দেখেনি। 

লেটুসের সঙ্গে লঙ্কা কেটে দিচ্ছে মনসুর। বাবুর্চিখানার দরজার দিকে একটা আওয়াজ হোলো। কৌতূহলী দৃষ্টি ফিরিয়েছে মনসুর। হঠাৎ সে আবার শশব্যস্ত হয়। দরজার উপর ফাদার জোহানেস। নূতন পাতলুন আর ক্যাসক পরে এসেছেন। মনসুরের অসোয়াস্তি লাগে। স্কুলের ছেলে যেন ইনস্পেক্টর দেখেছে। ফাদার জোহানেস কোনদিন বাবুর্চিখানায় আসেন না। তাই মনসুর আরো বিব্রত। 

—মনসুর। 

—ইয়েস, ফাদার। 

ফাদার-সম্বোধনে যাজকেরা সন্তুষ্ট হন। মনসুর তাই এই ডাকে অভ্যস্ত। মনসুর কাজে ব্যস্ততা দেখায়। 

—সব ঠিক হ্যায়? 

—ইয়েস, ফাদার। 

মনসুর মুখ খোলা রাখে, কিন্তু হাতের অবসর দেয় না। 

আশেক এতক্ষণে জেগে উঠেছে। তার খোঁয়ারিতে ঝাঁকানি দিয়েছে ফাদারের উপস্থিতি। জড়সড় সে, অবোধ দৃষ্টি দিয়ে চারিদিকে তাকায়। 

—এ কোন্, মনসুর? 

—মেরা ভাজা, ফাদার। বহিন কা লাড়কা। 

ফাদার জোহানেস আশেকের কাছে এগিয়ে যান। সে চেয়ে থাকে দেবতুল্য সুন্দর মুখাবয়ব এই মানুষের দিকে। 

তার কচি হাত নিজের তালুর মধ্যে রেখে ফাদার জোহানেস বলেন : বড়ি ঠাণ্ডা হাত। 

সে জবাব দেয় না। মনসুরও নিজের কাজে ডুবে থাকে। 

—তোমারা আম্মা হ্যায়? 

আশেক মাথা দোলায় হাসিমুখে। 

—তোমারা আব্বা? 

আশেকের মুখের দীপ্তি হঠাৎ কে যেন নিভিয়ে দেয়। সে মুখ নিচু করে। 

মনসুর জবাব দিতে গিয়ে থামে। বিরক্ত হয়। তার পারিবারিক জীবনের সঙ্গে খামাখা পরিচয়ের এত উৎসাহ কেন ফাদারের! 

দু-বছর বয়সে আশেক পিতৃহীন। মা আবার নেকা করেছে। তার দ্বিতীয় পিতা জীবিত। 

আশেক চুপ করে থাকে। কিশোর সে। মনের অবচেতনায় যেন উলট-পালট শুরু হোয়েছে। মনসুর হঠাৎ বলে : চলিয়ে, ফাদার। 

হৃদ্যতার তাল কেটে দেয় মনসুর। 

—ইয়েস, মাই বয়। 

মনসুরের এক হাতে প্লেট, অন্য হাতে লেটুসের ডিশ। আঙুলের ডগায় কাঁটা-চামচ। সৰ্ববাহী হোতে চায় সে। 

ফাদার জোহানেস মৃদু হেসে বলেন : হাম কিয়াস্তে হ্যায়- 

কথা অসমাপ্ত রেখেই তিনি একটা শুরুয়ার ডিশ দু-হাতে ধ’রে ধীরে ধীরে অগ্রসর হন। আগে মনসুর, পেছনে ফাদার জোহানেস। প্লেটের শুরুয়া পাছে উছলে পড়ে, সেইজন্য চলি-চলি-পা হাসিমুখে তিনি অগ্রসর হন। সহযাত্রী বান্দা আর মনিব। 

আশেক অবাক-বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। 

একটু পরে ফিরে আসে মনসুর। 

—থোড়া দেরি, বাচ্চা। 

এক ঘণ্টার ভেতর ফাদারের নৈশ ভোজন সমাপ্ত। 

আবার লনের পথ মনসুর ও আশেক অতিক্রম করে। 

ফাদার জোহানেস মুখে চুরুট গুঁজে শান্ত বালকের মত চেয়ারে উপবিষ্ট।

—গুড নাইট, ফাদার। 

—গুড নাইট 

মনসুর, আশেক কোয়ার্টার ছেড়ে পীচঢালা সড়কে নামে। অকালের বৃষ্টি; শীতের নগ্ন হাওয়া হিহি করে ছুটে আসে। দাঁতকপাটি লাগে। 

মনসুর তার গলার রুমাল আশেকের মাথায় বেঁধে দিল। 

ফাদার জোহানেসের মূর্তি দেখা যায় চাঁদের আলোয়; বারান্দায় ওভারকোট গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন; মুখে চুরুটের আগুন, জোনাকির মত জ্বলছে এক একবার। মোরাবাদী পাহাড়। সন্ধ্যার পূর্বাভাস। বর্ণ-কেলির সূচনা আকাশের বন-বনান্তরে। গোধূলির জোয়ারে পাহাড়তলীর বনানী-শীর্ষের বন্ধুরতায় অপূর্ব সমতার ধ্যানাচ্ছন্ন মূর্ছনা। কুসুম-বন্ধ্যা পলাশ গাছের নিচে ফাদার জোহানেস উপবিষ্ট। 

তাঁর চোখ আকাশদিগন্তের অপর প্রান্তে অন্ধ-জনের মত দুঃসহ পুলক-উচ্ছল বেদনায় হামাগুড়ি- রত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পুরু যবনিকা যেন স্বচ্ছ হোয়ে আসে। রহস্যের কুয়াশালোক মিলিয়ে যাচ্ছে আলো, প্রখর আলোর প্রাণবাহী স্পর্শে। শীর্ষ-ধ্বনি-মুখর সায়ংবায়ুর মুখে সন্তরণ-চঞ্চল মেঘেদের নেকাব খসে পড়ে। 

বিস্ফারিত নেত্র, শূন্য-দৃষ্টি ফাদার জোহানেস চেয়ে আছেন আকাশের খণ্ড লালিমার দিকে। তাঁর সম্মুখে চিত্রপটের মত ঘটনা আর মানুষের মুখ ক্ষিপ্রবেগে অন্তর্হিত হয়; পলকে লুকায়, আবার নিমেষে পুনরুজ্জীবন লাভ করে। গাছপালা, তরু-লতা, কীট-পতঙ্গ দৈনন্দিনতার স্ববিরোধী ব্যঙ্গ অট্টহাসির স্বরূপ….অশৃঙ্খল বস্তু আর চিত্ত-স্রোতের ফেন-দুর্গ। ব্যাখ্যা-হীন একক স্বাতন্ত্রে সব-কিছু ভিড় করে। বিভিন্ন ফুল-তরুর ঝরা-কুসুম। একটি সূত্রের অভাবে সুন্দরের মাল্য-রচনার আকুলতায় বক্ষদেশ ঝঞ্ঝাদীর্ণ আশ্বিনের বন। ফাদার জোহানেস অনুভব করেন, যেন কার অন্বেষণ তৃষ্ণা তাঁর বুক ভরে দিয়ে যায়। আবার অসীম পরিপ্লাবী শূন্যতা পাঁজরে হাহাশ্বাস করে। 

অশ্রু-টলমল, অর্ধোন্মীলিত নয়ন-যুগল। ফাদার জোহানেস দুই বাহু প্রসারিত করলেন, কা’কে যেন বুকে বাঁধবেন দৃঢ় আলিঙ্গনে। 

ক্লান্ত পাখনার মন্থরতা ছড়িয়ে এক ঝাঁক গোরাই পাখী হাজারীবাগের দিকে উড়ে গেলো। 

.

সেদিন গীর্জার উপাসনা শেষে ফাদার জোহানেস সকালবেলা একটা বিলাতী সাপ্তাহিকের ছবি দেখছিলেন। 

—গুডমর্নিং, ফাদার। 

—গুডমর্নিং, মনসুর। মাই বয়। 

মনসুর ইতস্তত করে। ফাদার জোহানেসের চক্ষু সাপ্তাহিকের ছবির উপর। হার্ডফোর্ডশায়ারের বোমা-বিধ্বস্ত অঞ্চলের একটা বাড়ীর ছবি। পাশে স্প্লিন্টারে থুবড়ানো-মুখ মানুষের ফটো। মানুষের মুখ বলে চেনা দায়। ঘাড়ের এক পাশ থেকে নাকের ডগা পর্যন্ত ত্রিভুজ আকারে সার্জন বেশ ছুরি চালিয়েছে। শূকরের মুখের সঙ্গে মানুষের মুখের আদল এক হোয়ে গেছে। নাকের ডগাটা সূঁচলো, মুখ ছোট ছোট স্প্লিন্টারের ক্ষত-দাগ-ভরা। 

—ফাদার! 

—মাই বয়। 

মনসুর জবাব দিল : আপ্‌কো এক দফে মেরা ঘর যানে হোগা। 

—হোয়াই, কিউ? 

—মেরা বহিন সত বিমার। 

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ফাদার জোহানেস যে কোন বিশেষজ্ঞের চেয়ে কম পারদর্শী নন।

ছবির দিকে চোখ রেখে উঠে পড়লেন তিনি। 

পাশের কামরা থেকে ওষুধের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে ফাদার বললেন : চলো। 

আধ ঘণ্টার পথ তাঁরা হেঁটে এলেন। 

পালতে মাদারের বন-ঘেরা সরু পথের মাঝখানে একটা জীর্ণ কাঠের বেড়া। ছোট টাটি খুলে মনসুর ফাদার জোহানেসকে অভ্যর্থনা জানায় : আইয়ে। 

তিনি কোনদিন এদিকে আসেননি। তাই কৌতূহলের দৃষ্টি তাঁর চোখে। 

একটা ছোট আঙিনার পাশে কতগুলো খোলার ঘর। আঙিনার মাঝখানে একটা কলম করা ঝাঁকড়া পেয়ারার গাছ। একটু বুনো মনে হয় আবহাওয়া। 

খোলার ঘরগুলোর দরজার সামনে চটের পর্দা ঝুলছে। মনসুর ভেতরে চলে গেলো। 

একটু পরে সে ফিরে এলো একটা মোড়া হাতে।

–বইঠিয়ে, ফাদার। 

মনসুর আবার অন্দরে গেল। 

পেয়ারা গাছের ছায়ায় ফাদার জোহানেস বসে পড়লেন। 

মৃদু হাওয়ায় পেয়ারা-ডালে গুঞ্জরণ উঠছে 

মিনিট দশ পর চটের পর্দা তুলে মনসুর আবার ডাকে : ফাদার! আইয়ে। 

ফাদার জোহাসেন এগিয়ে যান পর্দার দিকে। 

রোগিনীর কামরা এক টেরে। গলি-পথ প্রায় তিন মিনিট হাঁটলেন ফাদার জোহানেস। 

ছোট ঘর। চারিদিকে তৈজসপত্রের আবর্জনা-স্তূপ। রোগিনী একটা মাদুরের উপর শুয়ে আছে। সমস্ত শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। 

মনসুর তার শীর্ণ হাত বের করে ফাদার জোহানেসের দিকে এগিয়ে দিল পরীক্ষার জন্য। 

রোগিনী আসন্ন প্রসবা। গৃহস্থালির কাজে ইঁদারা থেকে পানি তোলার সময় হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায়। তার ফলেই মুর্ছাহত। 

শীর্ণা একটি রমণীর লিকলিকে হাত ফাদার জোহানেসের তিন আঙুলের মাঝখানে। কয়েক মিনিট পরে তিনি বেরিয়ে এলেন। 

বদ্ধঘরে ফাদার জোহানেস ঘেমে উঠেছিলেন। ঘাম মুছে তিনি বললেন : মনসুর, ইস্কো হাসপাতাল ভেজনে হোগা। হাম সব ঠিক কর দেগা। 

—নেহি ফাদার। 

—কাহে নেহি? 

মনসুরের জবাব আসে : এ আওরতলোগ জায়েগা নেহি 

—নেহি জায়েগা? ফাদার জোহানেস করুণা-মিশ্রিত কণ্ঠে বলেন। 

—ঠাইরিয়ে, পুছকে আতা। 

মনসুর ফিরে এসে জবাব দিল, তার সিদ্ধান্তই ঠিক। হাসপাতালে মেয়েদের আব্রু থাকে না। বেপর্দা হোয়ে রোগিনী বাঁচতে রাজী নয়। 

ফাদার জোহাচনস্ ব্যাগ খুলে ওষুধ দিলেন। মুখ তাঁর গম্ভীর, বিষণ্ণ। 

মানুষ নামের উপর এত অজ্ঞতা আর গ্লানির প্রলেপ! ফাদার জোহানেস চঞ্চল হোয়ে পায়চারি শুরু করেন। পরে হঠাৎ ব্যাগ হাতে উঠে বলেন : মনসুর, মাই আতা। খবর দো পিছে। 

মনসুর তাঁকে এগিয়ে দিতে এলো। 

মনসুরের বাড়ীর পাশে পথের বাম দিকে বনের আড়ালে একটা মসজিদের মিনার দেখা যায়। মনসুর ফাদার জোহানেসকে বলে : ফাদার, হামরা মসজিদ থোড়া দেখিয়ে। 

ফাদার দ্বিরুক্তি করেন না। তিনি কয়েক পা এগিয়ে দেখেন, একটা ভাঙ্গা মসজিদ, সংস্কারের অভাবে মিনার ধ্বসে গেছে। এক দিকের উন্নত মিনারটার গায়েও ধ্বংস-চিহ্ন। মিনার আর দশ-বারো জন নামাজীর উপযুক্ত জায়গা কেবল মজবুত। দেওয়ালের গায়ে সামাদান রাখা তাক পর্যন্ত ফাটল-ধরা। 

মনসুর মজিদের প্রাচীন ইতিহাস বর্ণনা করে। বহু ওলি দরবেশের স্মৃতি এই মসজিদের সঙ্গে জড়িত ছিল। আজকাল জুম্মার নামাজ সবসময় হয় না। সাপের ভয়ে কেউ মসজিদে আসতে চায় না। একজন ইমাম সর্পাঘাতে মারা যান। বর্তমানে ইমাম আছেন। মসজিদে নিয়মিত মুসল্লী তিনি আর মনসুর। কালেভদ্রে দু-একজন নামাজীর সংখ্যা বাড়ে। 

প্রাচীনত্বের ধরারক্ষী অদ্ভুত নিস্তব্ধতা চারিদিকে বিরাজমান। অন্ধকার ঘর মৌন ফরিয়াদে মহাকালের প্রতীক্ষা করে। 

ফাদার জোহানেসের দেবোপম অনুভূতির পটে এক বিষাদক্লিষ্ট তিক্ততা আঁকা হোতে থাকে। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে পারেন না তিনি মসজিদের প্রাঙ্গণে। 

আবার সড়কের আহ্বান। 

মানসিক চাঞ্চল্য অতিব্যস্ততা রূপে ফাদার জোহানেসের প্রতি পদক্ষেপে ফুটে উঠে। 

.

মহাসংগ্রাম হিংস্র পাশবতায় দানবের প্রতিমূর্তি রূপে জেগে উঠেছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। আফ্রিকার উপকূলে মারণাস্ত্রের ঝঞ্ঝনা, বলকান-গ্রীসের নগরীতে রণতাণ্ডবের দামামা বাজছে। খারকভের তুহিন-প্রান্তরে আদমের সন্তানেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। সূর্য রশ্মির আস্বাদ গ্রহণে আর তারা জাগবে না। ফাদার জোহানেসের সম্মুখে হিংস্র-বর্বরতা, শ্বাপদ জিঘাংসার প্রতিচ্ছবি। গাইড্যাগরা উৎসবের নিমর্মতা তার পাশে প্রণয়-চুম্বন। 

স্প্লিন্টার-দীর্ণ মানুষ আর শূকরের মুখ একাকারে ভেসে উঠে ফাদার জোহানেসের চক্ষু-পটে। 

যুদ্ধের বিভীষিকার রূপ তিনি দেখেছেন সংবাদপত্রের চিত্রে। রণ-প্রান্তরের ভয়াবহতা ফাদার জোহানেসের কাছে তবু ছিল অপ্রত্যক্ষ। 

এই সর্বগ্রাসী রণ-চামুণ্ডার বুভুক্ষা শুধু মানুষের রক্তে প্রশমিত হয় না। আরো বহু কিছুর প্রয়োজন তার লেলিহান-গ্রাসের যুগ-কাঠে। 

ফাদার জোহানেস তার নির্মম বাস্তবতা কয়েকদিন থেকে উপলব্ধি করছেন। 

তাঁর টেকনিক্যাল ইনষ্টিট্যুটের গ্র্যান্ট সাত হাজার টাকা এক খোঁচায় কমে গেছে। বেতন-বৃদ্ধির অভাবে শিক্ষকেরা অন্যত্র জীবিকার সন্ধান দেখছেন, এমন নোটিস্ তিনি পেয়েছেন। কয়েকজন ইতিমধ্যে বিদায় গ্রহণ করেছেন। কিণ্ডারগার্টেনের শিক্ষক আর শিক্ষয়িত্রীদের বহু অভিযোগের দরখাস্ত এখনও টেবিলের ড্রয়ারে পড়ে আছে। 

সর্বগ্রাসী যুদ্ধ। তার লেলিহান শিখায় সব কিছু বলি দিতে হবে। ফাদার জোহানেস চক্ষে অন্ধকার দেখেন। 

এই সব প্রতিষ্ঠান তাঁর বহু পরিশ্রম আর একাগ্র নিষ্ঠা ও সাধনার ফল। সংস্কৃতির প্রাসাদ গড়বেন তিনি। আজ সব স্বপ্নই ধূলিসাৎ হোতে চলেছে। চারিদিকে হৃদয়হীন ক্রুর ব্যঙ্গ প্রতীক্ষা করে। 

তবু জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সহৃদয়। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন : একটা ফ্যান্সী ফেয়ার বা মেলার আয়োজন করুন। পনর দিনের লাইসেন্স স্বচ্ছন্দে পাবেন, ফাদার। 

ফাদার জোহানেস চার্চ কাউন্সিলের সঙ্গে পরামর্শ করেন সেই সম্পর্কে। এইমাত্র মিটিং-সমাপ্তির পর তিনি নিজের দপ্তরে ফিরেছেন। 

তাঁর ব্যক্তিগত আপত্তি থাকলেও অন্যান্য সদস্যরা এই পথই যুক্তিযুক্ত মনে করেন। তা ছাড়া অন্য উপায় নেই। বহুদিনের মমতা-জড়ানো প্রতিষ্ঠান সামান্য ভাবপ্রবণতার জন্য তিনি ভেঙে ফেলতে পারেন না। 

ফাদার জোহানেসের আজন্ম সংস্কার ও শিক্ষা বিচারকের মত তাঁর সম্মুখে দাঁড়ায়। অস্থিরচিত্তে দেবতুল্য যাজক-প্রবর শুধু পায়চারি করেন। 

দিস্ ওয়ার। দিস্ ওয়ার সেন্সলেস এণ্ড ব্রুটাল। অস্ফুট উচ্চারণ-মুখে ফাদার জোহানেস ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে ঘরে পায়চারি করেন। 

হঠাৎ তিনি বাবুর্চিখানার পথে নেমে পড়লেন। 

সটান এসে থামলেন মনসুরের পাশে। 

—মনসুর। 

—ইয়েস, ফাদার। 

ফাদার জোহানেস এখানেও পায়চারি করেন। 

—নাথিং, মাই বয়। 

তাঁর চোখ আবার আশেকের উপর পড়ে। তিনি তার সন্নিকট হওয়া মাত্র আশেক ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। 

ফাদার জোহানেস তার কচি হাত মুঠির মধ্যে রেখে বলেন : আঁখ মে আঁশু কাহে? 

আশেক কোন জবাব দেয় না। মনসুরের চোখ কড়ার দিকে। আশেকের ফুঁপানি বন্ধ হয় না।

–মনসুর, কিয়া হোয়া, মাই বয়? 

ফাদার জোহানেস জিজ্ঞাসা করেন। 

—ওসকা মা মর গেয়া। 

নির্লিপ্তকণ্ঠে মনসুর জবাব দিয়ে আবার কাজ শুরু করে। 

—তোমারা বহেন? 

মনসুর নিরুত্তর। আশেকের কান্না আর থামে না। 

ফাদার জোহানেস রুমাল বের ক’রে তার চোখ মুছে দিলেন।

—আও, বাচ্চা। 

 আশেকের হাত ধরে তিনি আবার কোয়ার্টারে ফিরে এলেন। 

ফাদার জোহানেস কেক বের করেন আলমারি থেকে। স্নেহবৎসলকণ্ঠে বলেন : লেও, মাই বয়।

আশেকের কান্না থামে। তার আড়ষ্ট হাত ঠোঁটের কাছে অতি সঙ্কোচে এগোয়। 

আশেক সম্মোহিতের মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। আবার সে বাবুর্চিখানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। 

—যাও, বাচ্চা, যাও। 

পেছনে ফাদার জোহানেসের নম্র মৃদু কণ্ঠের আওয়াজ পাষাণের কন্দরেও কোমলতার প্রপাত- গুঞ্জরণ টেনে আনে। 

.

বড় শীতার্ত এই ডিসেম্বর 

গীর্জার খোলা প্রাঙ্গণে প্রদর্শনী বসেছে। রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত ব্যাণ্ডের আওয়াজ জনতার কল্লোলের মধ্যে হেঁকে উঠে। 

দুটো পানওয়ালা দোকান খুলেছে। একটা মণিহারী ষ্টল, আরো নানা সামগ্রীর দোকান প্রদর্শনীর আকর্ষণ। কিন্তু এই মেলার সব চেয়ে বড় আকর্ষণ জুয়ার আসর। গীর্জা আর ইনষ্টিট্যুটের শিক্ষকেরা তত্ত্বাবধায়করূপে বিভিন্ন জায়গায় নিযুক্ত। 

জুয়ার প্রথম আসর। একটা টেবিলের মাঝখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে ইস্পাতের বারোটা খেলনা-ঘোড়া। এক টাকা প্রত্যেক দানের মূল্য। একজন মাঝবয়সী ইঙ্গ-ভারতীয় ভদ্রলোক হাঁকছে : আওর কোই? আব রেস সুরু হোগা। 

তারপর সে হাতল ঘোরায়। দানধারী উৎসুক জুয়াড়ী আর দর্শকেরা চেয়ে থাকে। ধীরে ধীরে স্প্রিংএর টানে পঙ্খীরাজেরা এগিয়ে যায়। এবার সাত নম্বর ঘোড়া বাজী মেরেছে। এক বাঙালী যুবক এগিয়ে এলো তার টিকিট নিয়ে। এক টাকায় ছ’ টাকা লাভ। 

তারপর আর একটা আসর। বেড়ার মধ্যে রবারের কৃত্রিম চৌবাচ্চা। জলে টইটুম্বর। একটা সাদা রবারের পাতিহাঁস ভাসছে। 

বিশাল বপু মাড়োয়ারী একজন রবারের বালা হাতে বসে আছে। এক এক বালার দাম চার আনা। বেড়ার ওপার থেকে বালা ছুঁড়তে হয়। পাতিহাঁসের গলায় যিনি মাল্য দিতে পারবেন, তাঁরই জন্য দশ টাকার চক্‌চকে কোরা নোট। 

ভিড় জমে আছে চতুস্পার্শে। কৌতূহলী দর্শক আর জুয়াড়ী মিশে গেছে এক সঙ্গে। 

আর একটা জুয়ার আসর। 

—হরতন কা দহলা, পান্-পাত্তা। আইয়ে বাবু আইয়ে, লুট লিজিয়ে। কুপনের ছক পেতে লুঙ্গীপরনে এক জোয়ান ছোকরা চীৎকার করছে। 

এখানেও রীতিমত ভিড়। 

নাগর-দোলায় ছেলেদের হুল্লোড় চলছে। 

এই টেরেও একটা জুয়ার আখড়া জমেছে। ছোট তীর ছুঁড়ে জুয়াড়ীরা একটা বোর্ড ক্ষত-বিক্ষত করছে। 

হাজার হাজার যাত্রীর মেলা। লেনদেনের কারবার চলছে জোর। 

গ্যাস আর বিদ্যুতের প্রখর আলোয় দিনের মত উজ্জ্বল চারিদিকের আবহাওয়া। 

ফাদার জোহানেস সন্ধ্যার পর একবার প্রদর্শনীর ভিড়ে বেরিয়েছিলেন। ব্যবস্থাপনার ত্রুটী তিনি পছন্দ করেন না। না, সব তাঁর প্রত্যাশামত ঠিক এখানে। 

পরদিন সকালে হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করলেন ফাদার জোহানেস। প্রায় দু-হাজার টাকা লাভ। জুয়োর আসরই উনিশ শো টাকা দিয়েছে। 

আয়রণ-চেষ্ট খুলে কাঁচা টাকা রাখলেন ফাদার জোহানেস। 

অস্থির চঞ্চলতা ঘিরে আসে তাঁর সর্বাঙ্গ জুড়ে। 

চার্চ-কাউন্সিলের একজন সভ্যের কথা তাঁর কানে প্রতিধ্বনি তোলে : ভাবাবেগের দ্বারা প্রতিষ্ঠান নষ্ট করবেন না, ফাদার জোহানেস। 

পরদিনের আয় তিন হাজার। কুপনের জুয়াড়ীরা আজ সব চেয়ে বেশী টাকা দিয়েছে। দু-পয়সা থেকে এই জুয়োর দান আরম্ভ হয়। গরীবের জুয়ো। 

ফাদার জোহানেস নিস্তব্ধ থাকেন। কোল চাষী, গরীব-মজুরেরা কুপনের আসর আজ মাত করে রেখেছিল। স্বচক্ষে তিনি দেখেছেন। 

প্রদর্শনীর আয় জোয়ারের মত আসছে। দশ হাজার টাকার গ্র্যান্ট কবে আদায় হোয়ে গেছে। তবু পরিতৃপ্তির নিশ্বাস নেই ফাদার জোহানেসের বুকে 

আর তিনদিন মাত্র বাকী। তারপর লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ। 

আজকাল অন্যান্য ষ্টলে লোক থাকে না, জুয়োর আড্ডা ভরপুর। হাজার রকমের জুয়াড়ী যেন ছিনেজোঁকের মত গীর্জার প্রাঙ্গণ জড়িয়ে ধরেছে। যদি ত্রাণের আলোকপ্রার্থী হোত তারা! 

একজন বাঙালী যুবককে জুয়োর আসরে সকলে চেনে। সে সর্বচর। জল থেকে আকাশ, আকাশ থেকে মাটি, সর্বত্র তার গতিবিধি। হাঁসের গলায় মালা পরানোর বহু অসাফল্যের পর সে উপস্থিত হয় তীর-ছোঁড়ায়। তীরন্দাজির পর কুপনের আড্ডায়। কুপনের পর ঘোড়ার টেবিল-দৌড়ের মাঠে 1 

অজস্র তার পকেটে টাকা। কোন জায়গায় এক শ’ টাকা ফতুর না হোয়ে সে উঠে না। বাজীর পর বাজী চালায়। হারের পালায় সে রুখে উঠে আরো বেশী দান ধরে। 

প্রবাসী বাঙালী। দেখলেই লোকটাকে চেনা যায়। মাথায় লম্বা সিঁথি। সোনাবাঁধানো দাঁত। পরনে ধুতি, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবী। একটু অনন্যসাধারণ চেহারা। বহুলোকের ভিড়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 

ফাদার জোহানেস প্রতিদিনই দেখছেন এই জুয়াড়ীর মুখ। 

কোয়ার্টারে ফেরার পথে এই মানুষটির মুখ বারবার ভেসে উঠলো ফাদার জোহানেসের সম্মুখে। ক্লান্ত দেহে নিজের ঘরে ফিরে এলেন তিনি। 

একটু পরে এলো মনসুর। 

—গুড ইভনিং, ফাদার। 

—গুড ইভনিং! 

মনসুর প্রতীক্ষা করে। 

—ইয়েস, মাই বয়। 

মনসুর একটা খাতা খুলে ধরে ফাদার জোহানেসের সম্মুখে। 

—মজেদ কা চান্দা। 

ফাদার জোহানেস উঠে পড়লেন। আয়রণ-চেষ্ট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করলেন তখনই। 

—টেক, মাই বয়। 

মনসুর দাঁড়িয়ে থাকে। প্রত্যাশা তার ভরে না। অঙ্গভঙ্গীতে তা স্পষ্ট। 

একটু পরে সে বলে : গুড ইভনিং, ফাদার। 

আর দাঁড়ায় না মনসুর। বাবুর্চিখানায় অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। শরীর তার আদৌ ভাল নয়। শুধু মনের জোরে সংসারের তাগিদে কাজ করে যাওয়া। 

ফাদার জোহানেসের নৈশ ভোজনের পর মনসুর সেদিন বাড়ীর পথে। সঙ্গে আশেক 

শীত পড়েছে জেঁকে। মনসুর তার রুমালটা আশেকের মাথায় যথারীতি বেঁধে দিয়েছে। তবু দুইজনে শীত-কম্পিত কলেবর। 

আশেক পথের নিস্তব্ধতা ভাঙে : মামুজা, ফাদার চান্দা দিয়া? 

—হাঁ। 

—কেনা রুপেয়া? 

মনসুর জবাব দিতে চায় না, তবু বলে : পাঁচ রুপেয়া। 

—বহুত আচ্ছা আদমী ফাদার। ফেরেশতা। 

মনসুরের মুখে কড়া কথা বেরিয়ে পড়ছিল। ফাদার জোহানেসের জন্যই সে চুপ করে গেল। গথিক স্থাপত্য-শিল্পের অপরূপ নিদর্শন গীর্জার মহিমময় ছায়া সম্মুখে। মনসুরের পাঁজর ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। 

হঠাৎ মনসুর আশেককে বলে : এই রুমাল দো। হামকো ঠাণ্ডা লাগতা। 

কানে ঢাকা রুমাল খুলে ফেলে আশেক। 

মাতুলের এই আকস্মিক বিরূপতায় আশেকের চোখের পানি উছলে পড়ে। 

পথ-চলার সাথে সাথে নিঃশব্দে সে কাঁদে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যায় না। 

প্রদর্শনীর ড্রাম দামাদ্রিম বেজে যায়। ব্যাণ্ডের আওয়াজে প্রদর্শনী শেষ হওয়ার কোন সূচনাই ধরা 

পড়ে না। তবু আর এক দিন মাত্র বাকী লাইসেন্সের মেয়াদ। 

জুয়ার আসর গুজার। পাতিহাঁসের চৌবাচ্চা রবারের মালায় এক আধ ঘণ্টার ভেতর পূর্ণ হোয়ে উঠে। তীরন্দাজের দল বোর্ডের হৃৎপিণ্ড টুকরো-টুকরো করে ফেলছে। ঘোড়দৌড়ের টেবিলে জীবন্ত 

পঙ্খীরাজ থাকলে এতদিন ভগ্ন হাঁটু মেলে জাবর কাটত শুধু। 

ফাদার জোহানেসের ইনষ্টিট্যুটের সৌভাগ্য। লর্ড জেসাসের অশেষ করুণা! 

বাঙালী ছোকরা জুয়াড়ীর কার্যতৎপরতায় আজ অক্লান্ত। দুপুর থেকে তার ভাগ্যান্বেষণের দুরভিযান শুরু হোয়েছে। 

কয়েক শ’ টাকা ষ্টিলের ঘোড়ার লাঙ্গুলে গোনাগারী দেওয়ার পর সে জুটল পাতিহাঁসের ক্ষুদ্র পুষ্করিণীতে। বহু টাকার মাল্য বৃথায় গেল। 

রাজনন্দিনীর মত পাতিহাঁস সাদা গলা বাড়িয়ে দিয়েছে। জুয়াড়ী রাজপুত্রের দল মালা ছোঁড়ে। ক্বচিৎ এক জনের নসীবের জৌলুষ খোলে। নিরাশ রাজপুত্রের দল হংসবতীর প্রেমে খোঁয়ার হোয়ে আবার কুপনের ছকে গিয়ে বসে। 

মুদ্রার উপর মুদ্রা স্তূপীকৃত হয়। 

এইদলের তত্ত্বাবধায়ক লুঙ্গিওয়ালা পাঞ্জাবী মুসলমান ভাই। পাকা জুয়াড়ী সে। হরতনের টেক্কার উপর এবার বেশী টাকা দান পড়েছিল। উঠল রুইতনের টেক্কা। 

আবার দান ধরে বাঙালী জুয়াড়ী ছোকরা। একটা নোট চেপে ধরে সে। কিছু আর থ’ পায় না।

তীরন্দাজির নেশা চাপল শেষে। সেখানেও ভাগ্যদেবী বিরূপ। প্রতিদিনের অভিমান আজও ভাঙে না।

শেষে আবার ঘোড়দৌড়ের টেবিল। 

নানা রঙের ঘোড়া পাশাপাশি হলুদ ঘোড়াটা বার বার বাজী মারে। আমাদের এই বন্ধু জুয়াড়ী হলুদের উপর দশটাকা বাজী ধরল। এবার বাজী মেরেছে নীল ঘোড়া। পরের দানে কালো ঘোড়ার দানে সে কুড়ি টাকা রাখল। হলুদ ঘোড়া এবার পয়লা নম্বর। 

আর কোথায় নড়ে না সে। ঘোড়ার রং পরিবর্তন করে যায় সে। ভাগ্যদেবীও সঙ্গে সঙ্গে রং পরিবর্তন করে। এক আধবার আড়চোখের চাউনি হানে, তা লোকসানের কাছে কিছু নয়। 

ব্যাণ্ড বাজছে থেকে থেকে। নাগরদোলা শান্ত। ছেলেদের হল্লা নেই। রাত্রি বেড়ে চলে অন্ধকারের পথে। 

ঘোড়ার টেবিলের মালিক ইঙ্গ-ভারতীয় লোকটির চোখে অদম্য উৎসাহ প্রতিভাত। গলায় নীল রঙের টাই সংযুক্ত করে সে হাঁকে : চান্স, ওয়ান মোর চান্স। 

বাঙালী যুবকটি একটা সবুজ ঘোড়ার উপর দশ টাকা ধরল। 

ভাগ্যদেবী এবার কৃষ্ণবসনা সুন্দরী। ঘোড়ার মালিক আবার হাঁকে : টেক্‌ চান্স। 

বাঙালী যুবকটি এক দান বসে রইল। আর হাত বাড়ায় না সে। এই প্রথম ব্যতিক্রম তার।

ইঙ্গ-ভারতীয়টি তাকে ভাল করে চেনে। তাই হেসে বলে : হ্যালো বাবু, কাম অন্। 

সে কোন জবাব দেয় না। চুল তার উস্কোখুস্কো আজ। চেয়ে থাকে সে টেবিলের দিকে। হাতল ঘোরাচ্ছে মালিক, এগিয়ে চলেছে মায়া-তুরঙ্গের দল। 

হলুদ ঘোড়া এবারও বাজী জিতেছে। 

আবার নূতন রেস শুরু হবে। টাকা পড়ছে নানা দিক থেকে 

যুবকটি এইবার একটা ফাউন্টেনপেন বের করে বললে : আমি কলমটা ধরলাম পাঁচ টাকার বদলে, এর দাম পঞ্চাশের কম নয়। তুমি কেটে নিয়ো সাহেব দান থেকে। 

গলার টাই সংযত করে সে জবাব দিল : নো। রূপেয়া রাখখো। 

—আওর রূপেয়া হ্যায় নেহি। 

যুবকটি পকেট উজাড় করে দেখায়। 

—নো। কলম ফিরতি লে লো। 

ইঙ্গ-ভারতীয় জিদে-রোখে এখন বেশ রাগান্বিত। 

জুয়াড়ী যুবক আবার অনুরোধ করে। 

—টেক মাই পেন। 

জুয়াড়ী এবার দৃঢ়কণ্ঠে বলে : নো। 

—তবে রে সোয়াইন, শুয়র কা বাচ্চা। 

এক ঝাপোটে ঘোড়াগুলো দূর করে দিয়ে সে ইঙ্গ-ভারতীয়ের টাই ধরে মারল এক থাপ্পড়। গড়িয়ে পড়ল খৃষ্টান-নন্দন টুল থেকে নিচে। 

হল্লা আর চাঞ্চল্য শুরু হোয়েছে জনতা-দর্শকের মধ্যে। 

ভিড় ঠেলে যুবকটি আবার এসে পড়ল হংসবতীর দেশে। সমস্ত বালা দিকে দিকে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে সে হংসবতীর গলা টিপে ঊর্ধ্বে নিক্ষেপ করল। পাখনা থাকলে উড়ে যেত তবু, ধপাস্ শব্দে হংসবতী পড়ল এক দর্শকের মাথায়। 

হংসবতীর মালিক এক ঘুষি খেয়ে সটান লম্বা। দৌড় মারে যুবকটি এদিক থেকে ওদিক। কুপনের পাঞ্জাবী হুক গুটানোর আগেই সে একটান মেরে হুকটা দু-হাতে ছিঁড়ে ফেল। 

উন্মত্ত মাতাল যেন প্রলয়ের স্বপ্ন দেখছে। পানের দোকানের সোডার বোতল জুয়াড়ী ছুঁড়তে লাগল। একটা বড় ডেলাইট চূর্ণ হোয়ে গেল নিমেষে। 

চারিদিকে শোর-শরাবত উঠেছে। লালপাগড়ী শুদ্ধ অবির্ভাব হোয়েছে। 

কুপনের মালিক পাঞ্জাবী ছোকরা। সে ছোড়নেওয়ালা নয়। পেছনে থেকে এক লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গে জুয়াড়ী হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল। তখনই পুলিশ তাকে বাগে আনে। উৎপীড়িতেরা এবার চড়কিল- ঘুষি চালায় এলোপাতাড়ি। 

—ছোড় দেও। সব জ্বালা দেগা। ছোড় দেও। 

চীৎকার করে সে পুলিশের হাতে। 

গীর্জার প্রাঙ্গণে মানুষের রক্তের ফোঁটা পড়েছে। কয়েকজন লোক জখম। জুয়াড়ীর মাথা কেটে রক্ত ঝরছে। ইঙ্গ-ভারতীয় ঘোড়াওয়ালা একটা ঘুষি মেরেছিল কপালে। 

পুলিশ জনতাকে শান্ত করে। জুয়াড়ীর সিল্কের পাঞ্জাবী ছিঁড়ে গেছে হেঁচকা টানে। পুলিশ তার গেঞ্জিও কষে ধরেছে। 

আরও লালপাগড়ীর অবতারণা দেখা গেল। 

কোয়ার্টারে বসেছিলেন ফাদার জোহানেস। হঠাৎ চেঁচামেচি-কলরবের আওয়াজ গেল তাঁর কানে। ছুটে এলেন তিনি প্রদর্শনীর প্রাঙ্গণে। ত্রস্ত জনতা কিছু সংবাদ দিতে পারে না। 

গীর্জার একজন কর্মচারীর কাছে সব বৃত্তান্ত পাওয়া গেল। পুলিশ তখন জুয়াড়ীকে টেনে-হেঁচড়ে গীর্জা-প্রাঙ্গণের ফটকের মুখে এনেছে। 

—ছোড় দেও, আগ লাগা দেগা। 

ফাদার জোহানেস এগিয়ে এলেন। তারই সম্মুখে অপরাধী ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। 

যুবকটির চোখ হঠাৎ ফাদার জোহানেসের উপর পড়ে। সে তখন চীৎকার করে : ফাদার, I have lost everything, my family-my boys! 

চুল উস্কোখুস্কো, চোখে আগুন-ঢালা। দীর্ণায়িত কণ্ঠ তার আর্তনাদে ফেটে পড়ে : ফাদার, আই হ্যাভ লষ্ট এভরিথিং, মাই ফ্যামিলি-মাই বয়েজ! 

.

আরও তিনটি ক্রিসমাস বিদায় নিয়েছে। 

ফাদার জোহানেসের কর্তব্যের জগত তেমনই স্থির। এই বয়সেও অক্লান্ত পরিশ্রমী তিনি। 

কয়েকমাস যাবৎ তাঁর শারীরিক অবস্থা অবনতির পথে। সামান্য পরিশ্রমে ক্লান্তি অবসাদ ছেয়ে আসে। পুরাতন হাড়ের লোভে ঘুষঘুষে জ্বর বাসা বেঁধেছে নির্বিবাদে। মানসিক নিষ্ঠাই আজ ফাদার জোহানেসের একমাত্র শক্তির উৎস। 

ফাদার জোহানেসের এক বন্ধু অতিথি সপরিবারে এখানে চার মাস অবস্থান করছেন। মিঃ জনষ্টন, মিসেস জনষ্টন, আরো দুইজন কিশোর জনষ্টন। 

তারাও সকলে পীড়িত। অটুট স্বাস্থ্যের উপর লাবণ্যের চুণকাম লাগাতে তাঁরা এখানে এসেছিলেন। প্রত্যাশা বিপরীত পথে। 

মিঃ জনষ্টন সাংসারিকতায় পটু। দুশ্চিন্তার অবধি নেই তাঁর। 

ফাদার জোহানেসের অজানিতেই তিনি একদিন আহার্যের অংশ ডাক্তারের কাছে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। 

ডাক্তারের রিপোর্টে তাঁরা স্তম্ভিত। কাটলেট আর জুসে থাইসিসের জীবানু-মাখা থুতু পাওয়া গেছে। তাদের শরীরেও জীবানুর বাসা বাঁধা বিচিত্র নয়। 

ফাদার জোহানেসের চঞ্চলতা আরো বেড়ে যায়। আজ রাত্রে ডিনার প্রস্তুতের পূর্বে ফাদার জোহানেস জনষ্টনের সঙ্গে ওৎ পেতেছিলেন বাবুর্চিখানার এক পাশে। অপরাধী ধরা পড়েছে। 

এইমাত্র তার পরিচয় জেনে তাঁরা ড্রয়িং রুমে ফিরে এসেছেন। 

ফাদার জোহানেসের ড্রয়িং-রুমে গোরস্তানের বিরানা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। একদিকের কোচে মিসেস জনষ্টন পুত্রদ্বয়-সহ বসে আছেন। পাশে মিঃ জনষ্টন। সকলের মুখে আতঙ্কের ক্লিষ্ট ছাপ। 

ফাদার জোহানেস কলিং বেল টিপলেন। মনসুর এলো। 

—গুড ইভনিং, ফাদার। 

ফাদার জোহানেস নিরুত্তর। জনষ্টনের হাতে একটা শক্ত মোটা ব্যাটন। তিনি পায়চারি করতে লাগলেন। 

বফাদার জোহানেস বল্লেন : মনসুর, তোমরা থাইসিস কা বিমারী হ্যায়? 

—দীক্ কা বিমারী? হাঁ, ফাদার। 

—হামকো কাহে নেহি বোলা? 

—নোকরি ছুট জায়েগা, ইসি-ওয়াস্তে। 

জনষ্টন এগিয়ে এলেন ব্যাটন হাতে : ইউ ব্রুট। 

ফাদার জোহানেস পাথরের মত স্তব্ধ হোয়ে বসে থাকেন। তারপর ধীরে ধীরে বলেন : তোম মেরা খানামে থুক্ দেতা? 

—কভি কভি, ফাদার। 

মনসুর নির্ভীককণ্ঠে জবাব দিচ্ছে। 

—কিঁউ এয়সা কাম করতা? 

—মেরা বহেন কো আপনে দেখা। বেগায়ের খানা মেরা দেশকা বহুৎ আদমী- মেরা মা- 

মনসুরের গলা বুজে আসে। হঠাৎ মিইয়ে যায় সে। বক্তব্যের প্রকাশ-স্রোত ঝড়ে স্তব্ধ যেন। 

—ষ্টপ, ষ্টপ, মনসুর। 

ফাদার জোহানেস উঠে পড়েন চেয়ার ছেড়ে। মানবতার আদর্শে বিশ্বাসী, প্রতিহিংসার ছায়া পড়ে না ফাদার জোহানেসের বুকে। 

জনষ্টন এইবার চেঁচিয়ে উঠলেন : ইউ শুয়ার কা বাচ্চা। 

ব্যাটন হাতে তেড়ে এলেন তিনি। 

—ষ্টপ, জনষ্টন। 

আপ্ত-পুরুষের বজ্রনাদী শব্দ ফাদার জোহানেসের কণ্ঠে।

–মনসুর, যাও। তোমারা ছুটি আজসে। 

—গুড নাইট, ফাদার। 

—গুড নাইট। 

কয়েক ঘণ্টায় এক জগ হোলিওয়াটার পান করেছেন ফাদার জোহানেস। পবিত্র হোক তাঁর অন্তর- আত্মা, পবিত্র হোক তাঁর জঠর পাকস্থলী, শিরা উপশিরা, ধমনী ঝিল্লীকোষ। 

আর এক গ্লাস হোলিওয়াটার পান করলেন তিনি। তারপর নিজের কক্ষে প্রবেশ করে চেয়ে রইলেন প্রাচীর গাত্রে শোভিত ক্রবিদ্ধ যীশুখৃষ্টের মহিমময় চিত্রের দিকে। ক্রচিহ্ন আঁকলেন বুকে তিনবার। 

অব্যক্ত কাত্রানি তবু ফাদার জোহানেসের বুকে। সূচীভেদ্য অন্ধকার বাইরের পৃথিবীতে। ঘরের জানালা উন্মুক্ত। নিষ্প্রভ তারকার ইশারা হারিয়ে যায় বাগানের ওপারে। দূরে পাহাড়তলীর বুকে বনানীর কালো কার্পেট। তারই পটভূমি জুড়ে গীর্জার উত্তুঙ্গ ক্রেষ্ট অসীমের ইঙ্গিত রেখে দূরে বিলীয়মান। জানালায় নিশ্চল প্রতিমার মত স্থির হোয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বৃদ্ধ শ্রমণকুল-তিলক। অরণ্যব্যাপী দাবানলের পূর্বে স্ফুলিঙ্গের জোনাকি দেখতে লাগলেন ফাদার জোহানেস রাত্রির স্তিমিত তরঙ্গে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *