আট
‘সব কথা আমাকে খুলে বলো।’
‘না, তা হয় না, লিলি।
‘কেন হয় না? তুমি আমাকে আপন বলে মনে করো না?’
লিলির এই অভিযোগে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল শফি। তারপর বলল, ‘শুতে যাও, লিলি, অনেক রাত হলো।’
‘হোক। যতক্ষণ তুমি সব খুলে না বলবে ততক্ষণ এ ঘর থেকে এক পা নড়ব না।’
‘লিলি।’
‘না, না।’
চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল লিলি, ‘আমি যাব না। তুমি কত আমাকে কষ্ট দিতে পারো আমি দেখতে চাই।’
দীর্ঘশ্বাস পড়ল শফির। আস্তে আস্তে বলল, ‘আমার জটিল জীবনের সাথে কেন নিজেকে যুক্ত করতে চাইছ, লিলি? তুমি সুন্দর, তুমি পবিত্র। প্রার্থনা করি আরও সুন্দর হোক তোমার জীন। সমৃদ্ধ হোক। আমার অভিশপ্ত জীবনের সাথে নিজেকে জড়িত কোরো না।’
লিলি জবাব দিল না। টেবিলের ওপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
তখন রাত এগারোটা। শফির ঘরে আলো জ্বলছে। দীর্ঘ বারান্দায় সারি সারি চন্দ্রমল্লিকা আর পারশিয়ান গোলাপের টব। ঘরের উজ্জ্বল আলোর এক টুকরো গিয়ে পড়েছে উঠোনের সবুজ ঘাসে। জামান ফিরছিল বারান্দা দিয়ে নিজের ঘরে। সে বাইরে থেকে এইমাত্র ফিরছে। হঠাৎ সে শফির মৃদুস্বর শুনতে পেল। সব কথা বোঝা গেল না। শুধু একটা কথা সে শুনল…’কুয়াশা’। জামান রুদ্ধশ্বাসে জানালার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। সজাগ হয়ে কান পাতল।
লিলি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘কেন তুমি এই ভার নিতে গেলে?’
‘আমি নিইনি, লিলি। ভাগ্যই আমার হয়ে এই ভার নিয়েছে। সারাজীবন যার কাছ থেকে উপকার পেয়েছি তার কথা কিছুতেই ফেরাতে পারলাম না। হয়তো পারবও না।’
‘কিন্তু তাই বলে একটা খুনে ডাকাতকে তুমি সাহায্য করবে!’
‘লিলি,’ শফি তেমনি মৃদুকণ্ঠে ডাক দিল। বলল, ‘রাত অনেক হলো, ঘরে যাও।’
‘তুমি প্রতিজ্ঞা করো কুয়াশার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবে না। তুমি আমার হাত ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো…’
শফি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘আমি সর্বক্ষণ বিবেকের দংশন অনুভব করছি, লিলি। এ যেন এক শাঁখের করাত। আসতেও কাটে, যেতেও কাটে! আমি কিছুই স্থির করতে পারছি না।’
‘কিন্তু কুয়াশার কাছ থেকে সরে তোমাকে আসতেই হবে…’
‘আমি আসতে চাই। কিন্তু…’
‘কোন কিন্তু তোমার শুনব না। …আমার সহজ যুক্তি-যে উপকার করে তার ঋণ শোধ করা তোমার ধর্ম, কিন্তু যে খুনে ডাকাত, উপকারী হলেও তাকে সাহায্য করা ঘোরতর অন্যায়। তার সংস্রব ত্যাগ করাই মনুষ্যত্ব।’
ব্যাকুল হয়ে উঠল শফি। বলল, ‘লিলি…প্লিজ, ব্যাপারটা ওভাবে নিয়ো না। সব কথা যদি বলতে পারতাম তাহলে কীসে আমার দ্বিধা তা বুঝতে পারতে। তুমি এ প্রসঙ্গ আর ভুলেও কখনও তুলো না। আমি যা বললাম তার কিছুমাত্র যেন তৃতীয় কারও কানে না যায়। তাহলে আমার অনিবার্য মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। তোমাকে কথা দিচ্ছি এ ব্যাপারে একটা ফয়সালা শিগগিরই আমি করব। কুয়াশার কাছে জীবন ভিক্ষা চাইব আমি। বলব আমি অক্ষম, আমি দুর্বল। আমাকে তোমার কাজ থেকে অব্যাহতি দাও। তুমি কিছুদিন অপেক্ষা করো, লিলি। আমি দু’একদিনের মধ্যেই কুয়াশার সঙ্গে দেখা করতে যাব।’
লিলি বোধহয় এবার ঘর ছেড়ে উঠবে। জামান সাবধানে সরে এল জানালার নিচে থেকে। নিজের ঘরে গিয়ে কাপড় ছাড়ল। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল চুপচাপ। তার বুক জ্বলতে লাগল দারুণ উত্তেজনায়।
লিলির সঙ্গে শফির বিয়ে হোক, সবারই এই ইচ্ছা। শফি ভাল ছেলে। ভাল চাকরি করে। শিক্ষিত, ভদ্র, স্বাস্থ্যবান। জামানের সে বাল্যবন্ধু। ছোটবেলায় মা টিফিনবক্সে দু’জনার খাবার দিতেন। জামানকে বার বার বলে দিতেন…এই ভাগটা আমার শফির। তুই যেন সবটা খেয়ে নিস না, রাক্ষস। আমার শফিকে দিস।
মায়ের সেই আদরের শফির তাহলে এই পরিণতি! হীন দস্যু কুয়াশার সঙ্গে তার গোপন আঁতাত? ছোটবেলা থেকে শফি যে রহস্যময় লোকটার কথা বলত সে-ই তাহলে কুয়াশা!
ভাবতে গিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলল জামান। শফির কথাটা তার বেলায়ও কী নিদারুণভাবে সত্য! শাঁখের করাতের নিচে জামানের গলাও পড়েছে। এদিকে শফিকে এই মুহূর্তে সহ্য করতে পারছে না। অন্যদিকে লিলির কথা ভেবে শফির কোন ক্ষতি করতে মন চাইছে না। শফি যদি কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে সেই ক্ষতির বেদনা লাগবে লিলিরও হৃদয়ে। সারাজীবন লিলি অসুখী হয়ে থাকবে। তাহলে? কী করবে জামান?
সিগারেটটা সে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে। ঘর ছেড়ে বারান্দায় এল। লিলি দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘ভাইয়া, অত রাত করেছ কেন? খেতে চলো।’
‘আমি খেয়ে এসেছি বাইরে থেকে। তোর খাওয়া না হয়ে থাকলে খেয়ে নে।
জামানের গলার স্বর একটু যেন রূঢ় শোনায়। লিলি একটু আহত হয়ে তাকাল তার দিকে। কিছু না বলে ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
নিঃশ্বাস চাপে জামান। না, লিলিকে আঘাত দিয়ে নিজেও সে স্বস্তি পাবে না। শান্তি পাবে না। শফিকে যে করে হোক রক্ষা করতে হবে। কিন্তু কুয়াশার সঙ্গে কোন আপস নেই।
কুয়াশাকে ক্ষমা করবে না সে কোন অবস্থায়ই। কুয়াশাকে নিজের হাতে নিষ্ঠুরতম উপায়ে হত্যা করার জন্যে তার শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু সর্বদা চঞ্চল হয়ে আছে।
জামান ঠিক করল শফির উপর চোখ রাখতে হবে।