থিসিস ১.৬

ছয়

মাটির নিচে এক প্রাসাদোপম অট্টালিকা। বিভিন্ন কক্ষে আলো- বাতাসের নিখুঁত ব্যবস্থা। প্রত্যেক কক্ষেই একটি করে বৈদ্যুতিক ঘণ্টা। অট্টালিকাটি তিন ভাগে বিভক্ত। একটি ভাগে গবেষণা কেন্দ্র, দ্বিতীয় ভাগটি রহস্যময় অট্টালিকার অধিবাসীদের বিশ্রামস্থল। অট্টালিকার তৃতীয় অংশ বাকি দুটি অংশ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। অধিবাসীদের সকলেই জানে অট্টালিকার তৃতীয় অংশে এই বিপুল গবেষণা কেন্দ্রের যিনি পরিচালক তিনি বাস করেন। তাঁর বিষয়ে অধিবাসীদের আর প্রায় কিছুই জানা নেই।

তখন বেলা দ্বিপ্রহর। গবেষণা কেন্দ্রের বৈদ্যুতিক ঘড়ির কাঁটা অবিরাম গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন কক্ষে গবেষকরা তাদের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।

গবেষণা কেন্দ্রের একটি বৃহৎ কক্ষের দুগ্ধফেননিভ শয্যায় এক বৃদ্ধ। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বার বার বৃদ্ধ ঠোঁট কামড়াচ্ছিল আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল।

এই সময় মুখোশধারী এক ব্যক্তি ঘরে ঢুকল। পেছনে আর এক ব্যক্তি। মুখোশ নেই। চ্যাপ্টা মুখ। পাতলা ধূসর রঙের দাড়ি। চোখ দুটি ভাবলেশহীন। দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ দেহ।

বৃদ্ধ মুখোশধারীকে দেখে উঠে বসে বিছানা থেকে। আক্রোশ ফেটে পড়ছে তার চোখ দুটি থেকে। চেঁচিয়ে বলল, ‘শয়তানের দল, কেন আমাকে এভাবে চুরি করে এনেছ? তোমাদের মতলবটা কী?’

মুখোশধারী স্থির শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘চিৎকার করবেন না, চৌধুরী সাহেব। চিৎকারে কোন ফল হবে না। আপনি এখন পাঁচশো ফিট মাটির তলায় আছেন। আপনার চিৎকার কেউ শুনতে পাবে না।’

‘কিন্তু কেন? কেন আমাকে এভাবে আমার শান্তির সংসার থেকে ছিনিয়ে এনেছ? কী আমার অপরাধ?’

মুখোশধারী বলল, ‘আপনাকে ছিনিয়ে আনার উদ্দেশ্য একটা নিশ্চয়ই আছে। তা কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি জানতে পারবেন।’

বৃদ্ধ ইব্রাহিম চৌধুরী রাগে, দুঃখে কেঁদে ফেলে। বলে, ‘দোহাই, বাবা। আমাকে তুমি দয়া করে ছেড়ে দাও। আমাকে এভাবে আর কষ্ট দিয়ো না।’

মুখোশধারী কোন উত্তর দিল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে পড়ছিল বহুদিন আগের আর এক বৃদ্ধের মরণ- চিৎকারের কথা। বৃদ্ধ চিৎকার করে বলেছিল, ‘মেরে ফেলো। পায়ে পড়ি। আমায় মেরে ফেলো!’ সেই বৃদ্ধ ছিল তারই জনক! মুখোশধারী মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সে নিজেকে সামলে নেয়। পেছনের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, ‘মান্নান, ডক্টর ক্লিন্সবার্গ তৈরি আছেন?

মান্নান বলল, ‘তিনি তাঁর ঘরে অপেক্ষা করছেন।’

‘ওঁকে নিয়ে যাও।’

মান্নান এগিয়ে যায় বৃদ্ধের দিকে। বৃদ্ধ ইব্রাহিম চৌধুরী চিৎকার করতে থাকে। মান্নানের চোখ-মুখ নির্লিপ্ত, কঠোর। সে সুইচবোর্ডের 05 সুইচটা টিপে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা সুদ্ধ ইব্রাহিম চৌধুরী তলিয়ে যায় নিচে।

মুখোশধারী বলে, ‘তুমি এবারে যাও, মান্নান।’ মান্নান মাথা নুইয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায়।

মুখোশধারী একা। সে ঘর থেকে বেরিয়ে সরু বারান্দায় নামল। দীর্ঘ বারান্দাটি উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। দু’পাশে নানা আয়তনের কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই ভিতর থেকে বন্ধ।

মুখোশধারী হাঁটতে লাগল। দীর্ঘ বারান্দা পার হয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি। নিচে বাঁ দিক জুড়ে হলঘর। মুখোশধারী সিঁড়ি বেয়ে অন্ধকারে উঠে গেল। কোথায় গেল বোঝা গেল না।

ডক্টর ক্লিন্সবার্গ তাঁর ঘরে বসে যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করছিলেন। সামনের টেবিলে কৃত্রিম উপায়ে অজ্ঞান করা ইব্রাহিম চৌধুরীর দেহ শায়িত। একটা লম্বা কাঁচের শেলফের উপর লেখা আছে Immortal Cell. শেলফের ধূসর রঙের টিউবের ভেতর খানিকটা তরল পদার্থ। একপাশে ইংরেজিতে লেখা Deoxyribonucleic Acid.

ড. ক্লিন্‌সবার্গ যন্ত্রপাতি ঠিক করেন। তাকে দু’জন সার্জন আর দু’জন নার্স সাহায্য করছে। সারা ঘরে বিরাজ করছে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। এই সময় ঘরের দেয়ালের পাশে একটা গোলাকৃতি বাল্ব লাল হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তকালের জন্যে তীব্র হিস্ হিস্ একটা শব্দ শোনা গেল। ড. ক্লিন্‌সবার্গ, সার্জন ও নার্স দুটি বিনীত ভদ্রতায় নিঃশব্দে সামান্য মাথা নোয়ান।

লাল বাল্বটি জ্বলে ওঠার অর্থ দেয়ালের ভিতর গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের দুটি অদৃশ্য চোখ সক্রিয়।

ড. ক্লিন্‌সবার্গ ও সার্জন দুটি উঠে দাঁড়ান। প্রথমে পেট পর্যন্ত চিরে ইব্রাহিম চৌধুরীর ফুসফুস টেনে বার করা হলো। ড. ক্লিন্সবার্গ একটা যন্ত্রের সাহায্যে ফুসফুসের রক্তচাপ আর ক্রিয়াশক্তি টুকে নেন। তাঁর নির্লিপ্ত চোখজোড়ায় কেন যেন এক টুকরো উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। নিপুণ হাতে ছুরি চালিয়ে এরপর তিনি হাত, তলপেট আর ঘাড়ের পেছনকার কিছু মাসল, চামড়া আর সেল কেটে নেন। ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়া হলো অনুরূপ সামর্থ্যের মাসল, চামড়া আর সেল। এরপর ড. ক্লিসবার্গ যন্ত্রচালিতের ন্যায় ইব্রাহিম চৌধুরীর শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে শরীরের DNA পরীক্ষা করেন। যথাসময় শরীরের ক্ষতস্থানগুলো সেলাই করে ওষুধ দিয়ে বেঁধে দেয়া হলো। ড. ক্লিন্সবার্গ একটা কাঁচের জার থেকে বেরিয়ে আসা রবার টিউব সংযুক্ত করেন ইব্রাহিম চৌধুরীর গায়ে।

সেদিনকার মত তাঁর কাজ শেষ হয়। ড. ক্লিন্সবার্গ এগিয়ে যান ঘরের এককোণে রাখা একখানা বেতারযন্ত্রের দিকে। দেয়ালের গোল লাল বাল্বটা তখনও জ্বলছে। ড. ক্লিন্সবার্গ আস্তে আস্তে সেই বেতারযন্ত্রের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, ‘Examination is over. 20% cells are dead. Enormous vigours in tissues found. Full reports will be sent three hours later. ‘

লাল বাল্বটা মুহূর্তকাল পরেই নিভে যায়। তীব্র হিস্ হিস্ শব্দটা একবার উঠেই মিলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *