পাঁচ
জামানের বাড়িতে গিয়ে উঠল শফি। জামান বাড়ি ছিল না। লিলিকে শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে সারাদিন সে ঘরে শুয়ে কাটিয়ে দিল। বিছানা থেকে উঠল একেবারে রাতের খাবারের সময়। ছোট চাচা শফির শরীর অসুস্থ দেখে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলেন খাবার পর। শফি নিষেধ করল। ছোট চাচা যত না অবাক হলেন তার চেয়ে বেশি অবাক আর মনঃক্ষুণ্ণ হলো লিলি। শফি এদের স্নেহ আর মমতায় কিছুটা বিব্রতবোধ করল। কিন্তু চেষ্টা সত্ত্বেও সহজ হতে পারল না। সে অপেক্ষা করল জামানের জন্যে। রাত এগারোটায়ও যখন জামান ফিরল না তখন সে শুতে গেল। তার ঘুম হলো না সারারাত। সকালের দিকে ভারি একটা তন্দ্রা নামল চোখে। বিছানা ছেড়ে উঠতে বেশ একটু দেরি হলো তার। চা খেয়ে যখন উঠল তখন বেলা ন’টা বেজে গেছে।
শফি সব ক’টা দৈনিক সংবাদপত্র নিয়ে নিজের ঘরে এল। উদগ্র আগ্রহে সংবাদপত্রের পাতা উল্টে গেল। দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ঈপ্সিত খবরটা দেখতে পেল। খবরটা, এরকম:
দেশব্যাপী বিচিত্র উপায়ে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি!
ঢাকা ২২ মার্চ। গতকল্য ঢাকায় দুইটি বৃহৎ ব্যাঙ্কে একই সময় এক বিচিত্র উপায়ে টাকা অপহরণ করা হইয়াছে। ব্যাঙ্ক দুইটির একটি দ্য কুমিল্লা কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক, অপরটি দ্য প্রভিনশিলে ব্যাঙ্ক। শুধু এই দুইটি ব্যাঙ্কেই নহে, দেশের বৃহত্তম বন্দর চাঁ জনবহুল নগরী খুলনা এবং উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম শহর রাজশাহীতেও একই সময় একইভাবে সম্ভবত একই দলের দ্বারা অনুরূপ লুণ্ঠন কার্য সম্পন্ন হইয়াছে। চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহীর ব্যাঙ্ক লুটের সংবাদ পাওয়া গিয়াছে গতকল্য দুপুর একটার বিশেষ ট্র্যাঙ্ককল যোগে। দেখা যায় সব কয়টি ক্ষেত্রে দুষ্কৃতিকারীরা একই পন্থা অবলম্বন করিয়াছিল। দ্য কুমিল্লা কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মি. শেখের সহিত আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির সাক্ষাৎকার হইতে জানা যায় যে, গতকল্য প্রদেশের বিখ্যাত ধনপতি সুখলাল মনোহারিয়ার একমাত্র পুত্র যদুপতি মনোহারিয়ার সেক্রেটারি সকাল ন’টা পনেরো মিনিটের সময় ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মি. শেখকে টেলিফোন করেন। টেলিফোনে সেক্রেটারির মাধ্যমে মি. যদুপতি জানান যে বিশেষ প্রয়োজনে দুই লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক হইতে তোলা দরকার বিধায় তিনি নিজেই ব্যাঙ্কে আসিতেছেন। মি. যদুপতি শেখের বিশেষ পরিচিত ব্যক্তি। স্বয়ং যদুপতি যেখানে ব্যাঙ্কে আসিতেছেন সেখানে টাকা তোলার ব্যাপারে মি. শেখের কোন সন্দেহই জাগে নাই। মি. শেখ টেলিফোন ছাড়িয়া দিয়া যদুপতির আগমন অপেক্ষায় নিজের ঘরে বসিয়া থাকেন। বেলা দশটায় যদুপতি মি. শেখের কক্ষে প্রবেশ করেন। যদুপতির কণ্ঠস্বর কিছু অচেনা ঠেকিতেছিল বটে কিন্তু চেহারায় ও আচার-আচরণে যদুপতি নামধারী দস্যু এমন নিখুঁত ছিল যে মি. শেখ একবারও অন্য কিছু সন্দেহ করিতে পারেন নাই। মি. শেখ স্থির বিশ্বাসে দুই লক্ষ টাকার চেক ভাঙাইয়া তাহা যদুপতির হাতে অর্পণ করেন। যাহা হউক, মি. শেখের কক্ষ ত্যাগ করিয়া যদুপতি নামধারী ব্যক্তি টাকাসহ দরজার দিকে আগাইয়া যায়। যদুপতি দামী মক্কেল বিধায় মি. শেখ দরজা পর্যন্ত যদুপতিকে আগাইয়া দিতে যান। দরজার পাশে দাঁড়াইয়া মি. শেখ ও যদুপতির মধ্যে ব্যবসা- সংক্রান্ত ব্যাপারে দু’একটা সাধারণ মন্তব্যের বিনিময় হইতেছিল, ঠিক সেইসময় ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার আলী আশরাফ এন্ট্রি বইয়ে চেক রাখিতে গিয়া ভয়ে বিস্ময়ে চিৎকার করিয়া উঠে। যদুপতির চেক শেষ বারের মত পরীক্ষা করিতে গিয়া ক্যাশিয়ার আলী আশরাফ যাহা দেখিয়াছে তাহা সত্যি বিস্ময়জনক। পরীক্ষা করিতে গিয়া দেখা গেল সইয়ের জায়গা হইতে যদুপতির সইটি বেমালুম উবিয়া গিয়াছে। প্রথমে নিজের চক্ষুকেও সে বিশ্বাস করিতে পারে নাই। ভালরকম পরীক্ষা করিয়া সে দেখিল সত্যি সত্যি চেকে কারও সই নাই। তখনও কাউন্টারের দরজার কাছে যদুপতি দাঁড়াইয়া মি. শেখের সঙ্গে কথা বলিতেছে। ক্যাশিয়ার আলী আশরাফ চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠে, ‘ওই লোকটাকে ছাড়বেন না, স্যর, ও একটা প্রতারক…যদুপতি নয়।’ ঠিক এই সময় কাউন্টারে দাঁড়ানো একটা লোক দুই দরজার বন্দুকধারী দুই সান্ত্রীকে চোখের নিমেষে গুলি করে এবং যদুপতি নামধারী প্রতারক আর সে ছুটিয়া বাহিরে চলিয়া যায়। বাহিরে অপেক্ষমাণ একটি অস্টিন গাড়িতে চড়িয়া দুষ্কৃতিকারীরা মতিঝিল এলাকা হইতে দ্রুতবেগে বাহির হইয়া আসে। তৎক্ষণাৎ পুলিসে খবর দেয়ায় কয়েকটা দ্রুতগামী পুলিসের গাড়ি মতিঝিল এলাকায় বিভিন্ন রাজপথে ছড়াইয়া পড়ে। ইহাদের মধ্যে পুলিস ইন্সপেক্টর মোবারক আলীর গাড়িটি বর্ণিত গাড়িটাকে নাজ সিনেমা হলের নিকটস্থ প্রদর্শনীয় কামানের কাছে দেখিতে পায়। তখন দুইটা গাড়ির দূরত্ব অনুমান চারশো গজ। অস্টিন গাড়িটি জনবহুল নওয়াবপুর রোডের ভিতর দিয়া আশ্চর্য কৌশলে কোন একটি গলির ধাঁধায় হারাইয়া যায়। ইহার পর কোথাও গাড়িটিকে দেখা যায় নাই।
দেশের তিনটি শহরেও একই পদ্ধতিতে জালিয়াতির কার্য সম্পন্ন হইয়াছে। একমাত্র কুমিল্লা ট্রেডিং ব্যাঙ্কেই দুষ্কৃতিকারী প্রায় ধরা পড়িতে পড়িতে বাঁচিয়া গিয়াছে। তাছাড়া আর সব কয়টি ক্ষেত্রে কোন সন্দেহ গজাইবার পূর্বেই দুষ্কৃতিকারীরা নির্বিঘ্নে টাকা লইয়া সরিয়া পড়িতে সমর্থ হইয়াছে। সব ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতিকারীরা ডিপোজিটারের নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের চোখে ধূলি দিতে সমর্থ হইয়াছে। ইহা অনুমান করা সহজ যে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা এই ব্যাঙ্ক-জালিয়াতির পিছনে কাজ করিয়াছে। এই বিচিত্র জালিয়াতিতে ছদ্মবেশ ও সই করার ব্যাপারে অত্যন্ত উন্নতমানের বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করা হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। সর্বমোট পাঁচ লক্ষ টাকা বিভিন্ন ব্যাঙ্ক হইতে অপহৃত হইয়াছে। এই ব্যাপারে জোর পুলিসী তদন্ত চলিতেছে।
সব ক’টি কাগজেই এই সংবাদ ফলাও করে ছাপা হয়েছে। সংবাদপত্রের উপর চোখ বুলিয়ে শফি যেন খানিকটা আশ্বস্ত হয়। কিন্তু তার বুকের অস্থিরতা আর উদ্বেগ এতটুকু কমেনি। জামান আর লিলির কথা ভাবলে নিজেকে তার হীন বিশ্বাসঘাতক বলে মনে হয়। নিজেকে সে কখনও ক্ষমা করতে পারে না। কুয়াশার হাতছানি শেষ পর্যন্ত তাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা ভাবতে পারে না শফি। যদি পারত তাহলে নিজেকে নিজে সে বাধা দিত। কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধের কাছে বিবেক হেরে গেছে। কুয়াশার ঋণ শোধ করতে গিয়ে অনেকদূর সে এগিয়ে গেছে। আর পেছনে ফেরা যায় না।
কিছুক্ষণ পর লিলি এল। বলল, ‘জামান ভাই তোমাকে ডাকছে।’
‘জামান ফিরেছে নাকি?’
‘হ্যাঁ, অনেক রাতে ফিরেছিল। এইমাত্র ঘুম ভেঙে উঠে তোমার কথা শুনেছে।’
‘আমি যাচ্ছি।’ শফি একটু ইতস্তত করে বলল।
লিলির কী যেন বলার ছিল। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার বাসন্তী রঙের শাড়ির আঁচল উড়তে লাগল বাতাসে। লিলির নিটোল চোখে-মুখে রক্তিম হয়ে উঠেছে কী এক গোপন ভাষার পরশ।
শফি বলল, ‘তুমি কিছু বলবে, লিলি?’
লিলি জবাব দিল না একথার।
শফি ডাকল, ‘লিলি।’
‘বলো।’
‘আমার ব্যবহারে তোমরা খুব ক্ষুব্ধ হয়েছ, না?’
লিলি হাসল। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল শফির দিকে। বলল, ‘যাক ওসব কথা। তুমি ভাইয়ার ঘরে যাও…আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।’
লিলি চলে যায়।
শফি একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করল। যা হয়েছে বেমালুম যদি ভুলে থাকা যেত। যা হবে তার পরিণাম সম্পর্কে মনে যদি কোনরকম চিন্তা না আসত!
জামান কাপড় পরছিল। গম্ভীর চোখ-মুখ। শফিকে দেখে একটু হাসল।
‘আয়…’
‘তুই কোথাও যাচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোথায়?’
‘ভদ্রলোকের নাম মি. সিম্পসন। শহীদ খানের কথা তোর নিশ্চয়ই মনে আছে; তিনিই আমাকে আই. বি. বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী মি. সিম্পসনের সাহায্য নিতে বলেছিলেন। ভদ্রলোক খুবই নির্ভরযোগ্য। তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি।’
ক্ষত-বিক্ষত শফির চোখ-মুখে নিদারুণ হতাশার ছায়া ফুটে ওঠে। তা লক্ষ করে জামান বিস্মিত হয়। ক’দিন থেকে শফির আচার-ব্যবহার অত্যন্ত সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। সে নাকি চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, অনেক রাতে বাসায় ফেরে…আর সর্বক্ষণ কী এক অস্থিরতায় ছটফট করে বেড়ায়। ব্যাপার কী?
কাপড় পরা শেষ হয়েছে জামানের। সে এগিয়ে আসে শফির কাছে। শফির কাঁধে একটা হাত রেখে বলে, ‘তোর কী হয়েছে, শফি?’
শফির একবার ইচ্ছে হলো ছেলেবেলার বন্ধু জামানকে সব কথা খুলে বলে। বিবেকের দংশন সে আর সহ্য করতে পারছে না। কুয়াশার গম্ভীর, ভয়াল অথচ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কণ্ঠস্বর সেই মুহূর্তে কানে বাজতে লাগল তার। নিজেকে সে সামলে নিল। বলল, ‘কিছু হয়নি তো।’
‘কিছু লুকোবার চেষ্টা করিসনে, দোস্ত। সব কথা আমাকে খুলে বল।’
শফি জোর করে হেসে বলল, ‘জামান, জীবন একটা রূঢ় বাস্তব। ইচ্ছে করলেই সব কিছু যদি করা যেত তাহলে আর কিছু দুঃখ থাকত না। আমাকে নিয়ে বৃথা চিন্তা করিসনে ভাই। আমি জন্ম-দুঃখী। দুঃখ আমার কপাল।’
জামান আর কথা বাড়াল না। কিন্তু তার মনে সন্দেহ জেগে উঠল। কী হয়েছে শফির? তার নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে হঠাৎ কী হলো?
সে প্রসঙ্গ বদলিয়ে বলল, ‘যাকগে, তোর ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করে তোর বিরক্তির কারণ হতে চাই না। তুই আমার সঙ্গে যাবি?’
‘কোথায়?’
‘মি. সিম্পসনের কাছে?’
শফি কী যেন ভাবল। তার মন বলল, এক পা বাড়িয়ে বসে আছ, শফি। সময় আছে, অবস্থার সঙ্গে তাল মেলাও। নতুবা দু’নৌকায় পা দিতে গিয়ে ডুবে মরবে।
শফি বলল, ‘যাব।’