তিন
সকালবেলায় চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে একটা বিশিষ্ট ইংরেজি দৈনিকের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন মি. সিম্পসন। তৃতীয় পৃষ্ঠার দিকেই তাঁর আগ্রহ বেশি। প্রায় মাস দুই ধরে এই দৈনিকটির তৃতীয় পৃষ্ঠায় বিচিত্র ধরনের খুন আর রাহাজানির খবর ছাপা হচ্ছে নিয়মিত।
তৃতীয় পৃষ্ঠা ওল্টালেন মি. সিম্পসন। সেদিনও একটা চাঞ্চল্যকর সংবাদ ছিল। সংবাদটা বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায়:
‘বগুড়া, বারো ফেব্রুয়ারী। গতকাল রাত্রিবেলা পল্টন রোডে বিখ্যাত চৌধুরী বাড়িতে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে। চৌধুরী বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি যিনি, তাঁহার বয়স একশত পঁচিশ বৎসর। গত বৎসর সরকারি রিপোর্টে তাঁহাকেই দেশের প্রবীণতম ব্যক্তি বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছিল। এই প্রবীণতম ব্যক্তিটির নাম ইব্রাহিম চৌধুরী। ইনি এই বয়সেও নিয়মিত শরীর চর্চা করিতেন। অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী ইব্রাহিম চৌধুরী স্বাস্থ্য সৌন্দর্যে অনেক যুবকেরও ঈর্ষার পাত্র ছিলেন। এই বয়সেও তাঁহার দুই পাটি দাঁত অটুট রহিয়াছে। দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রহিয়াছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ গতকল্য রাত্রিবেলা ইব্রাহিম চৌধুরী তাঁহার শয়ন কক্ষ হইতে নিখোঁজ হইয়াছেন। কে বা কাহারা জানালার শিক গলাইয়া ঘরে ঢুকিয়া জনাব চৌধুরীকে অপহরণ করিয়াছে। এই ঘটনায় শহরব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে। গত কয়েক মাস ধরিয়া এইরূপ ঘটনা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রত্যহই ঘটিয়া চলিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয় এইভাবে যাহাদের অপহরণ করা হইতেছে তাহারা প্রায় সকলেই বৃদ্ধ ব্যক্তি। অপহরণকারীরা বৃদ্ধ ব্যক্তিদের কী উদ্দেশ্যে অপহরণ করে তাহা বোঝা না গেলেও একথা স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে যে টাকা আদায়ের ফন্দি হিসাবে এইসব অপহরণ কার্য সংঘটিত হয় না। অপহরণকারীরা এই পর্যন্ত কোথাও তাহাদের শিকার গুম করিয়া টাকা দাবি করে নাই। আশঙ্কার বিষয় অপহরণকারীরা অপহরণকৃত ব্যক্তিদের বেশ কয়েকজনকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যাও করিয়াছে। হত্যা করিয়া মৃত ব্যক্তির লাশ তাহারা প্রকাশ্যে ফেলিয়া দেয়। তদন্তে দেখা গিয়াছে প্রতিটি লাশেই রহিয়াছে অসংখ্য ক্ষত আর কাটাচেরার দাগ। কিছুদিন পূর্বে গুলশান এলাকায় অনুরূপ অবস্থায় এক মহিলার লাশ পাওয়া গিয়াছিল। পুলিস এই ব্যাপারে তদন্ত করিতেছে বলিয়া বিশ্বাস করি। কিন্তু তাহাদের তদন্তে এই বিচিত্র ডাকাতি আর খুনের রহস্য এতটুকু উদ্ঘাটিত হয় নাই। পুলিস বিভাগের অক্ষম কর্তাদের পক্ষে এই প্রকার পরাজয় অবশ্য নতুন ব্যাপার নহে। কিন্তু যাহারা শান্তিপ্রিয় আর নিরীহ নাগরিক তাহারা এই বিচিত্র ডাকাতি লক্ষ করিয়া ভবিষ্যৎ বিপদের আশঙ্কায় ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছেন। অপহরণকারীদের পরবর্তী শিকার কে তাহা কে বলিবে? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে তাহাদের যথাযথ কর্তব্য পালন করিবেন এখন পর্যন্ত আমরা সেই আশাই পোষণ করিতেছি।’
মি. সিম্পসন বার দুই খবরটার উপর চোখ বুলান। তাঁর চোখ-মুখ চিন্তাকীর্ণ হয়ে ওঠে। এই বিচিত্র ব্যাপারে পুলিস বিভাগ থেকে স্পেশালভাবে তাঁকে নিয়োগ করা হয়েছে। প্রত্যেক জেলার সংশ্লিষ্ট পুলিস কর্মীরা তাঁর কঠোর নির্দেশে এই বিচিত্র ব্যাপারে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রক্ষা করছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই অন্তহীন রহস্যের কিছুমাত্র কিনারা করা সম্ভব হয়নি।
মি. সিম্পসন চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরান।
তাঁর চিন্তাকীর্ণ মুখে ফুটে ওঠে স্থির গাম্ভীর্য। তিনি টেলিফোনের কাছে এগিয়ে যান। একটা নাম্বার ঘুরিয়ে সহকারী তরিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
‘হ্যালো, তরিক…..’
‘ইয়েস, স্যর…’
‘তোমাকে যা বলেছিলাম, করেছ?’
‘করেছি, স্যর। বলেন তো এখনই রিপোর্টটা আপনার কাছে পাঠিয়ে দিই।’ সিম্পসন বলেন, ‘রিপোর্টটা নিয়ে তুমি নিজেই চলে এসো। ওকে?’
‘ইয়েস, স্যর।’
কিছুক্ষণ পর তরিক হোসেন একটা ফাইল নিয়ে ঘরে ঢোকে। ফাইল থেকে পিন-আপ করা সেন্সাস অফিসের কয়েক শীট কাগজ সে এগিয়ে দেয় মি. সিম্পসনের হাতে। গভীর মনোযোগের সাথে রিপোর্টটা দেখতে থাকেন মি. সিম্পসন।
কয়েকটা নাম তিনি রিপোর্ট থেকে টুকে নেন আলাদা কাগজে। ডেথ রেকর্ড মিলিয়ে দেখা গেল তিন বছরে তেত্রিশজন প্রবীণ মানুষের ভেতর বাইশজনের মৃত্যু হয়েছে, এগারোজন এখনও জীবিত। বাইশজনের মধ্যে বিশজনেরই অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বাকি দু’জনের একজন হাঁপানীতে আর একজন ক্যান্সারে মারা গিয়েছে।
দুটো নাম লাল কালিতে দাগ দিলেন মি. সিম্পসন। এক. হাজী মুহিবুল্লা, ১০৮ ডেঙ্গু খাঁ লেন, ওয়ারী, ঢাকা। দুই. জন প্যাট্রিস…পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তিটি দেশী খৃষ্টান, চাকমা উপজাতির ভূতপূর্ব সর্দার।
এই সময় ক্রিং ক্রিং শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। মি. সিম্পসন গিয়ে টেলিফোন ধরেন। তাঁর চোখ-মুখ অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর হয়ে ওঠে। তাঁর গলা চিরে বেরিয়ে আসে একটা কাতর ধ্বনি।
মি. সিম্পসন শুধু বললেন, ‘এ আমি জানতাম, মি. আহমদ!’
টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে এসে গুম হয়ে বসেন মি. সিম্পসন। তরিক হোসেন চিন্তাকীর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ এসেছে।
মি. সিম্পসন আস্তে আস্তে সহজ হয়ে ওঠেন। বলেন, ‘পাহাড়তলীর সি. আই. ট্র্যাঙ্ককল করেছিল, তরিক। যা ভেবেছিলাম, তা-ই। মি. প্যাট্রিক্সকে কাল ভোর রাতে অপহরণ করা হয়েছে।’
‘বলেন কী, স্যর…’
মি. সিম্পসন ম্লান হেসে বলেন, ‘খবরটা এখনও সংবাদপত্র অফিসের লোকদের কানে যায়নি। নেক্স্ট্ ভিকটিম ইজ প্রবেবলি. হাজী মুহিবুল্লা। এসব কার কীর্তি আমি বুঝেছি, তরিক।’
‘কার, স্যর?’
‘কুয়াশা।’
‘কুয়াশা!’
মি. সিম্পসন উত্তর না দিয়ে নতুন একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করেন। নীরবে ধূমপান করতে থাকেন।