দুই
শফি বিকেল পর্যন্ত জামানের সঙ্গে থাকল। তারপর সে অস্থির হয়ে উঠল ফেরার জন্যে। লিলি বলল, ‘শফি ভাই, তুমি না হয় আমাদের এখান থেকেই কিছুদিন অফিস করো। তুমি কাছে থাকলে ভাইয়া একটু সুস্থির থাকবে।’
শফি প্রায় বলতে যাচ্ছিল সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায়। বলে, ‘না, লিলি, আমার পক্ষে রাতে এখানে থাকা সম্ভব হবে না। আমি বরং রোজই একবার করে আসব।’
কথাটা রূঢ় শোনাল। লিলি আর কিছু বলল না, পাশের ঘরে চলে গেল। জামানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শফি রাস্তায় নামল। বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে। গুলশানের আকাশে গোধূলির রঙ লেগেছে। গত রাতের কথা ভেবে মন তার চঞ্চল হয়ে উঠল।
গত রাতে সে তার ঘরে এসেছিল। তাকে চিনতে পারেনি শফি। অবশ্য অত অল্প সময়ে কাউকে চেনা সম্ভবও নয়। লোকটা ছিল আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা। সে চুপি চুপি ঘরের ভেতর ঢুকল। কী করে দরজা খুলল আল্লা মালুম। বই পড়ছিল শফি, মুখ তুলে তাকিয়ে কালো কাপড়ে ঢাকা মূর্তিটাকে দেখে সে চমকে উঠেছিল। লোকটা ধীর গলায় শফিকে চেঁচামেচি করতে নিষেধ করল। পকেট থেকে বের করল লম্বা একটা খাম। খামটা সে টেবিলের উপর রাখল। তারপর বলল, ‘শফি, যে তোমার উপকার করে, কখনও তার অনিষ্ট কোরো না। চলি, গুডনাইট।’
শফি কিছু বলার আগেই লোকটা ঘর ছেড়ে চলে গেল। লোকটা কে তার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল শফি। সে হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। সংবিৎ ফিরে আসার পর সে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। ভয়? না, ছোটবেলা থেকে রহস্যের সাথে তার পরিচয় আছে। তার জীবনই একটা রহস্য। ভয় সে সহজে পায় না।
গুলশানের আকাশে গোধূলির রঙ লেগেছে। বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায় শফি। গত রাতের ঘটনার কথা ভেবে মন তার চঞ্চল হয়ে উঠল। আজ রাতে তার জীবনের সবচেয়ে উপকারী বন্ধু তার ঘরে আসবে। খামের চিঠিতে সেই কথাই লেখা ছিল। শফি স্কুটারে চেপে বসে। ঢাকেশ্বরী কলোনি যাবে। স্কুটার উদ্দাম বেগে ছুটতে লাগল। শফি নিজের কথা ভাবল। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক ঠেলে।
পৃথিবীতে একমাত্র আপনজন ছিলেন মামা। বাবা-মা তার জ্ঞান হওয়ার আগেই মারা গিয়েছিলেন। মামা ছিলেন মুহুরী। শফিকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলা তাঁর জীবনের একমাত্র সাধ। পাছে সংসারের ঝামেলায় পড়ে যান এজন্যে তিনি বিয়ে করেননি। শফি ছিল তাঁর আদরের দুলাল। জীবনের স্বপ্ন। মামার স্নেহে, আদরে বড় হয়ে উঠেছিল শফি। মামার স্বপ্ন সফল করে তুলতেই হবে এ ছিল তার কঠোর প্রতিজ্ঞা। কত কষ্ট করেই না তাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে। তার পুরস্কারও সে যথাসময় পেল। ম্যাট্রিকে রেকর্ড মার্ক পেয়ে প্রথম হলো। মামার কী আনন্দ সেদিন। গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠেছিল। কিন্তু এই আনন্দ তাঁর স্থায়ী হয়নি। আই. এস. সি. পরীক্ষার ঠিক চার মাস আগে করোনারী থ্রম্বসিস হয়ে হঠাৎ মারা গেলেন মামা। ভেঙে গেল আশা-ভরসা। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল অসহায় শফির স্বপ্ন।
সেদিন ছিল রবিবার। আজও শফির স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন সন্ধ্যাবেলা পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে বহুদূরের নদী দেখছিল সে, আর নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছিল। আগামীকাল পরীক্ষার ফি জমা দেবার শেষ তারিখ। হাতে একটা পয়সা নেই। কোন সংস্থানও নেই। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব অবশ্য পরীক্ষার ফি’র টাকাটা পুওর ফাণ্ড থেকে দেবার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু এই রকম অভাব-অনটন আর দুশ্চিন্তার ভেতর কি পড়াশোনা হয়? মামা মারা যাবার পর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় তার মন ভেঙে গেছে। এই মন নিয়ে আর যাই হোক পড়াশোনা হয় না।
শফি উদাস চোখ মেলে দূরের অস্পষ্ট নদী আর আকাশের তারা দেখছিল। ঠিক এই সময় সে টের পেল কে একজন তার পাশে বসে আছে। শফি তার দিকে তাকাতেই লোকটা স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলেছিল, ‘শফি, খুব মন খারাপ তোমার?’
শফি বলেছিল, ‘তা হোক। আপনি কে?’
‘ফ্রেণ্ড। তোমার বন্ধু। কি, বিশ্বাস হয় না?’ লোকটা হেসেছিল, একটু।
অতীতের ঘটনা থেকে শফির মন ফিরে এল বাস্তবে। স্কুটার এসে থেমেছে বাসার কাছে। ভাড়া মিটিয়ে সে নেমে এল গাড়ি থেকে। না, সেই লোকটা সত্যি শফির বন্ধু। কে সেই লোক, কী তার পরিচয় কিছুই জানে না শফি। অন্ধকারে লোকটার চেহারাও ভাল করে দেখতে পারেনি। শুধু তার গলার ভরাট, গম্ভীর স্বর শুনেছিল। লোকটা বলেছিল, ‘আমি কে তা তোমার জানার কিছু প্রয়োজন নেই। আমি তোমার বন্ধু। তোমার মামার মতই একজন হিতৈষী। আমি চাই তুমি লেখাপড়া শিখে বড় হও। দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করো।’
শফি অবাক হয়ে গিয়েছিল সেদিন। লোকটা বলেছিল, ‘আমি সব ব্যবস্থা ঠিক করে তোমার কাছে এসেছি। তুমি হোস্টেলে থাকবে।
‘ন্যাশন্যাল ব্যাঙ্কে তোমার নামে চল্লিশ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। প্রতি মাসে যা তোমার প্রয়োজন তা নিজে সই করে ব্যাঙ্ক থেকে তুলবে। অলরাইট?’
রূপকথার গল্প মনে হয়েছিল শফির। সবটা ব্যাপার স্বপ্ন মনে হয়েছিল। কে এই লোক, কথা নেই বার্তা নেই তার নামে চল্লিশ হাজার টাকা রেখে দিয়েছে ব্যাঙ্কে? লোকটা চলে যাবার পর সব কিছু আজগুবি মনে হয়েছিল তার। উদ্ভট লেগেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক’টি পরীক্ষায় সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রতিবার পরীক্ষা পাসের পর এক টুকরো চিঠি আসত তার নামে, ‘কনগ্রাচুলেশন, শফি।’ প্রেরকের নাম ঠিকানা কিছুই থাকত না। শুধু লেখা থাকত বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে সে প্রথম হয়েছিল। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে কাজ জুটে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঠিক এই সময় সেই অজ্ঞাতনামা বন্ধুর চিঠি পেয়েছিল শফি। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘চাকরি নেয়া তোমার পক্ষে উচিত হবে না, শফি। তোমার নামে আরও কিছু টাকা জমা দেয়া হয়েছে ব্যাঙ্কে। তুমি কেমব্রিজ ইউনিভারসিটিতে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ ডিগ্রি নিয়ে এসো। আমার বিশ্বাস তোমার পড়াশোনা এই পর্যায়ে বন্ধ করা ঠিক নয়। ইতি-বন্ধু।’
জী বন্ধুর কথাই রক্ষা করেছিল শফি। Nuclear Physics পড়ার জন্যে সে বিলেতে গিয়েছিল এম. এস. সি. পাশ করার পর পরই। দু’বছর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। আরও দু’বছর গবেষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ফিরে এসে চাকরি নিয়েছে অ্যাটোমিক অ্যানার্জি কমিশনে। প্রায় দু’বছর চাকরি করেছে শফি। আশ্চর্য, দু’বছরের ভেতর একবারও সেই অজ্ঞাতনামা বন্ধুর কোন নির্দেশ পায়নি। ভেবেছিল অজ্ঞাতনামা সেই রহস্যময় বন্ধু বোধহয় এই বর্তমান অবস্থায়ই খুশি, ঠিক এই সময় চিঠি এল তার। লেখা, ‘শফি, গিভ আপ জব। চাকরি ছেড়ে দাও। এখানে তোমার ভবিষ্যৎ সঙ্কীর্ণ। ইতি-বন্ধু।’
আশ্চর্য হয়েছিল শফি। লোকটা কি জাদুমন্ত্র জানে? অ্যাটোমিক অ্যানার্জি কমিশনে সে যে তার সঠিক গবেষণার সুযোগ আর সরঞ্জামাদি পাচ্ছে না তা সেই রহস্যময় বন্ধু জানল কী করে? শফি একবারও ইতস্তত করেনি। চিঠি পাওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সে চাকরি ছেড়ে দিল। সবাই খুব অবাক হয়েছে। তাতে শফির কিছু যায় আসে না। যে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি তার জীবনকে চালিত করছে, তার ইচ্ছাই শফির কাছে সবচে’ মূল্যবান। শফি সেই রহস্যময় লোকটিরই হাতে তৈরি একটা ইচ্ছার মূর্তিমান রূপ মাত্ৰ।
ঘরে এল শফি। কাল যে লোকটি চিঠি নিয়ে এসেছিল সে তার উপকারী বন্ধু নয়। বন্ধু আজ রাতে আসবে।
শফি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল।
রাত তখন দুটোর কম নয়। ঢাকেশ্বরী কলোনি অন্ধকারে নিমজ্জিত। এখানে-ওখানে দু’একটা বাতি জ্বলছে। একটা ছায়ামূর্তি রাস্তার পাশের দেয়াল পার হয়ে কলোনির ভিতরে ঢুকল। একটা কুকুর ঘেউঘেউ করে উঠল কোথাও। মূর্তি ভ্রূক্ষেপ মাত্র করল না। সে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল। তারপর কলোনির তিন নম্বর বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
শফি শোবার ঘরে বসে বই পড়ছিল। রাত জাগা অভ্যাস আছে। তবু থেকে থেকে ঢুলুনি আসছিল তার। তন্দ্রা ভাবটা জোর করে কাটিয়ে মাথা তুলতেই চমকে উঠল সামনের দিকে তাকিয়ে।
দীর্ঘদেহ, বলিষ্ঠ এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মূর্তিটার মুখে কালো মুখোশ। চোখ দুটি মুক্ত। শফি দেখল মূর্তিটার দু’চোখে ঝরে পড়ছে অপরূপ এক উজ্জ্বলতা।
মূর্তি বলল, ‘শফি, আজ রাতে তোমার ঘরে যার আসার কথা আমি সেই ব্যক্তি।’
শফি নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। কোন কথা বলতে পারল না।
আগন্তুক বলল, ‘আসাদুজ্জামান বুঝি তোমার বন্ধু?”
জামানের সঙ্গে এই রহস্যময় ব্যক্তিটির তাহলে কোন একটা সম্পর্ক আছে, শফি ভাবল। এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। বলে, ‘আপনি বসুন। আপনার অপেক্ষায়ই আমি এতক্ষণ বসে ছিলাম।’
আগন্তুক গম্ভীর হয়ে রইল। শফি চেয়ার এগিয়ে দেয়। বিন্দুমাত্র ব্যস্ত না হয়ে স্থিরভাবে আগন্তুক বলল, ‘আমার সময় অল্প। তোমার সঙ্গে আমার গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে। তুমি বসো, শফি। শোনো।’