এগারো
রহস্যপুরীর গোলকধাঁধায় নতুন করে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠল জামানের মনে। এই পাতাল থেকে বেরোবার কোন উপায় হয়তো নেই। কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে হলেও কুয়াশার গর্বিত শির কি ধুলায় লুটিয়ে দিতে পারা যায় না?
জামানের সময় কাট লাগল এই দুঃসহ অস্থিরতার ভিতর। এই পাতালপুরীতে কখন দিন আসে, কখন রাত নামে কিছু বোঝার উপায় নেই। পাতালপুরীর সর্বত্র হলুদ আলো জ্বলছে। এখানে সময়ের চেহারা একই রকম। জামান উপাদেয় খাবার খেল। দুগ্ধফেননিভ শয্যায় ঘুমাল। শুয়ে বসে কাটাল অনেক সময়। তারপর মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘুরতে বেরোল সে পাতালপুরীর অলিতে গলিতে
প্রাসাদের কয়েকটা কক্ষ পার হয়ে সামনে পা দেবে অমনি দেয়ালে বেজে উঠল লাউড স্পীকার। কে একজন বলল, ‘ওদিকে যাবেন না।’
জামান বলল, ‘কেন?’
লাউড স্পীকারে শোনা গেল, ‘ওটা হচ্ছে শাস্তি-ঘর। এই ঘরের ভিতর ভুল করে সেদিন আপনি ঢুকে পড়েছিলেন। মূর্ছিত অবস্থায় আপনাকে ওই ঘর থেকেই টেনে আনা হয়েছিল।’
জামানের মনে পড়ল সেদিনের কথা। ঘরে ঢুকেই সে ফিসফিস কথা, হাসি আর কান্নার শব্দ শুনেছিল। শব্দটা একবার বাড়ে একবার কমে… একসময় আচমকা ঝড়ের মত প্রবল হয়ে দাঁড়ায় আর একবার থেমে যায় মুহূর্তেই। সুস্থ ও শক্তিশালী যে কোন মানুষকেই মিনিট দুয়েকের ভিতর পাগল করে দেবার পক্ষে ওই শব্দটা যথেষ্ট।
সে বাঁ পাশে ঘুরে হাঁটতে লাগল। কুয়াশা শক্তিশালী সন্দেহ নেই। প্রতি দেয়ালে সে C-CTV ক্যামেরা সংযুক্ত করেছে, যার সাহায্যে প্রাসাদের প্রতিটি প্রাণীর গতিবিধি লক্ষ করা যায়। প্রতি দেয়ালে রয়েছে লাউড স্পীকার।
কুয়াশা পরিকল্পনায় কোন ভুল নেই।
সে হাঁটতে হাঁটতে প্রাসাদের বাইরে এসে দাঁড়াল। জায়গাটা উঠানের মত। উঠানের অপর পারে একটা দোতলা বাড়ির একাংশ দেখা যায়। উঠানে শুয়ে আছে তিনজন দৈত্যাকৃতি মানুষ, দৈর্ঘ্যে তারা হবে আট থেকে দশ ফিট। দু’জন শ্বেতাঙ্গ যন্ত্র দিয়ে তাদের শরীর পরীক্ষা করছে।
জামান অসঙ্কোচে এসে দাঁড়াল শ্বেতাঙ্গ দুটির সামনে। প্রথমে ওরা হকচকিয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে ওদের বুকপকেটে রাখা ঘড়ির এলার্ম বেজে উঠল মৃদু শব্দে। একমুহূর্ত বেজেই থেমে গেল শব্দটা। জামান বুঝল শব্দটা আসলে একরকমের সঙ্কেত।
শ্বেতাঙ্গ দু’জনই পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপর অপেক্ষাকৃত বয়স্ক লোকটি ফিরে দাঁড়ায় জামানের দিকে। পরিষ্কার গলায় বলে, ‘তুমি আমাদের কাজের ব্যাপারে কিছু জানতে চাও?’
‘হ্যাঁ। তোমরা কী করছ এসব?’
শ্বেতাঙ্গটি বলে, ‘আমরা মানব শরীরের স্পাইনাল কর্ডের ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছি। আমাদের এমন কিছু সংখ্যক লোকের দরকার যাদের দৈর্ঘ্য বারো থেকে চোদ্দ ফিট। মেরুদণ্ডের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে ইতিমধ্যেই আমরা আশানুরূপ ফল পেয়েছি। যে তিনজন দৈত্যাকৃতি মানুষকে তুমি দেখতে পাচ্ছ ওরা প্রত্যেকেই দৈর্ঘ্যে ছিল মাত্র পাঁচ ফিট এক ইঞ্চি। উপযুক্ত ব্যবস্থায় এদের দৈহিক উচ্চতা বাড়িয়ে আট ফিটের ওপর আনা হয়েছে।
হঠাৎ তিনজন দৈত্যাকৃতি মানুষ করুণ আর্তনাদ করে উঠল। ওদের নগ্ন পিঠের উপর চালানো হয়েছে একটা করে সাঁড়াশি ধরনের লোহার তৈরি যন্ত্র। আর্তনাদ শুনে দ্বিতীয় শ্বেতাঙ্গটি ধমকে উঠল। ধমকে কাজ হলো বটে। আর্তনাদের শব্দটা থেমে গেল। কিন্তু জামান লক্ষ করল হতভাগ্য দৈত্যাকৃতি মানুষগুলোর চোখ- মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত আর রক্তিম হয়ে উঠেছে। তিনজনের ভিতর একজনের বয়স এগারোর বেশি নয়। তার মুখ যন্ত্রণায় হাঁ করা, চোখ অর্ধেক বোজা… চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
এই দৃশ্য আর দেখতে পারছিল না জামান। সে শ্বেতাঙ্গ দু’জনকে শুষ্ক ধন্যবাদ জানিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল।
উঠান পার হয়ে ছোট দোতলা বাড়িটাতে ঢুকল জামান। কেউ কোথাও নেই। ঘরের ভিতর হলুদ আলো জ্বলছে।
অদৃশ্য দুটি চোখ সর্বদাই অনুসরণ করছে জামান জানত। সে বলল, ‘এই বাড়ির রহস্য জানতে চাই।’
লাউড স্পীকার চালু হলো। টুকটুক শব্দ উঠল প্রথমে। তারপর পরিচিত কণ্ঠস্বরটি বলল, ‘এই বাড়ির নাম হচ্ছে মাস্ক স্টোর। এই বাড়ির যিনি পরিচালক তিনি পৃথিবী-বিখ্যাত একজন রসায়নবিজ্ঞানী। তাঁর অধীনে পৃথিবী-বিখ্যাত আরও পঞ্চাশজন বিজ্ঞানী কাজ করছেন।’
‘কী কাজ করছেন? ‘
অ্যামপ্লিফায়ারে সামান্য হাসির আভাস পাওয়া যায়। লোকটা বলে, ‘কাজের কথা জিজ্ঞেস করছেন? দোতলায় উঠে যান। নিজেই বুঝতে পারবেন।’
জামান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। ঢুকতেই যে ঘর পাওয়া গেল সে ঘর ড্রইংরুম হিসাবে ব্যবহৃত হয় বোঝা গেল। দেয়ালের গায়ে অনেকগুলো বড় বড় কাচের আয়না। লাউড স্পীকার বেজে উঠল, ‘ডান পাশের সোফায় বসুন।’
জামান বসল। দেয়াল আয়নায় তার ছবি ভেসে উঠল।
বহুদিন পর নিজের প্রতিমূর্তি দেখল জামান আর ‘আমি তাহলে বেঁচে আছি’ এই অনুভূতি তীব্রভাবে খেলে গেল তার শরীরের শিরা-উপশিরায়। মায়ের কথা, ঘর-বাড়ির কথা, লিলির কথা মনে পড়ল। এই বন্দি জীবন কদ্দিন চলবে কে জানে? কুয়াশার দয়া- ভিক্ষা প্রাণ গেলেও করবে না জামান।
জামান আয়নায় নিজের মূর্তি দেখল আর কীভাবে কুয়াশার পাতালপুরী থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ভাবল। ঠিক এই সময় খাবার ট্রে নিয়ে যে লোকটা ঘরে ঢুকল তাকে দেখে লাফিয়ে উঠল জামান, ‘আরে, হায়দার, তুই এখানে কেন?’
হায়দার জামানদের বাড়ির পুরানো চাকর। ছোটবেলা থেকে কোলে-পিঠে করে জামানকে মানুষ করেছে হায়দার। জামান অবাক হয়ে সম্মুখে দাঁড়ানো হায়দারকে দেখতে লাগল। অবিকল এক চেহারা। এক ভঙ্গি। নিজের ভুল সে বুঝতে পারল। ঠিক এই সময় তার বিস্ময়কে চরমে পৌঁছিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকল একটা লোক,
অবিকল জামানের মত দেখতে। আয়নায় ছায়া পড়ল, জামান তার চেহারার সঙ্গে নকল জামানের প্রতিমূর্তি মিলিয়ে দেখল। এতটুকু খুঁত তার চোখে ধরা পড়ল না।
হায়দার ট্রে ভর্তি খাবার .নামিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে সরে পড়েছিল। নকল জামানও কয়েক মিনিট পুতুলের মত দাঁড়িয়ে স্থির গম্ভীরভাবে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
লাউড স্পীকার বেজে উঠল দেয়ালে, ‘এই বাড়িতে কি কাজ হয় বুঝেছেন? দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর গলার স্বর বাদে একটা চেহারার সব কিছু বদলে দেবার খুব সহজ উপায় আবিষ্কার করেছেন বৈজ্ঞানিকেরা। ধরুন, আপনি শরীরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ প্রাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানের মত। গলার স্বরও অনেকটা সেই রকম। এই অবস্থায় আমরা আপনাকে আট ঘণ্টার ভিতর অবিকল শহীদ খান বানিয়ে দিতে পারি, বুঝলেন?’
ক্রোধে জামান দাঁতে দাঁত ঘষল। কুয়াশা একটা ধাড়ী শয়তান। শয়তানের কারখানায় সে এসে পড়েছে। মাস্ক স্টোর ছেড়ে সে বাইরে এল। তার হাত নিশপিশ করছিল। শরীরের ভিতর জ্বলে উঠছিল রাগের বহ্নিশিখা। Kuasha must be killed. সভ্য পৃথিবী থেকে কুয়াশাকে উৎখাত করতেই হবে। নতুবা পৃথিবীকে ভয়াবহ অপরাধের রাজত্বে পরিণত করবে কুয়াশা। সে ক্ষমতা তার আছে। যে কোন সম্রাটের চেয়েও শক্তিশালী আর ক্ষমতাবান ও।
হাঁটতে হাঁটতে সে অপেক্ষাকৃত অন্ধকার একটা স্থানে এসে পৌঁছল। মাথার উপর রুক্ষ পাথরের ছাদ। এখানে-ওখানে ভাঙা পাথর। বহুদূর থেকে একটা অস্পষ্ট জল পড়ার শব্দ আসছে। জামান জিজ্ঞেস করল, ‘কীসের শব্দ পাচ্ছি?’
কোন জবাব এল না। জামান আবার জিজ্ঞেস করল। কোন জবাব এল না এবারও। কী ভেবে হঠাৎ চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল জামানের। এটা তাহলে কুয়াশার C-CTV ক্যামেরার বাইরের জগৎ? অদৃশ্য দুটি চোখে আর তার গতিবিধি ধরা পড়বে না। জামান প্রায় উন্মাদের মত ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে একটা পাথরে লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ক্লান্ত, অবসন্ন লাগল শরীর। সে চোখ বুজে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎ আসা উত্তেজনা তার কেটে গেল। সে মনে মনে পাতালপুরীর একটা ম্যাপ আঁকল। জল পড়ার শব্দ আসছে পাতালপুরীর প্রবেশপথ থেকে। চওড়া কাঁধওয়ালা বেঁটে লোকটা সেই প্রবেশপথ পাহারা দেয়। প্রবেশপথের পরেই যে এলাকা সেই এলাকায় কুয়াশার C-CTV ক্যামেরা নেই। এখানে কুয়াশার শাস্তি-ঘর, মাস্ক রুম, গবেষণাগার প্রাসাদ আর চত্বর। তাহলে কুয়াশার নিভৃত কক্ষ কোথায় যেখানে কুয়াশা বাস করে?
জামান উঠে দাঁড়ায়। হঠাৎ তার চোখ পড়ল বাঁ পাশে। সে সন্দেহে, বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করতে যাচ্ছিল। একটা দীর্ঘকায় মূর্তি ছুটে এসে মুখ চেপে ধরল জামানের। ইংরেজিতে বলল, ‘চুপ, কথা বোলো না…কাছেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের হত্যাকারী। সে আমাকে এতক্ষণ খুঁজেছে।’
জামান চাপা গলায় শুধু বলল, ‘কিন্তু আপনি!’
লোকটি ফিসফিস করে বলল, ‘বলছি…চলো, পাথরের আড়ালে গিয়ে বলছি।’