দশ
যখন জামানের জ্ঞান ফিরল তখন দুগ্ধফেননিভ এক শয্যায় সে শায়িত, ঘরে আবছা নীল রঙের আলো জ্বলছে। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে কোমল হাতের বাজনার শব্দ।
সে উঠে বসল বিছানায়। কী হয়েছিল ভাবতে চেষ্টা করল। সব কথা, সব ঘটনা মনে পড়ল তার। কিন্তু সে কোথায় আছে বুঝতে পারল না হাজার চেষ্টা করেও।
প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে তার। ঘড়ি দেখে সময় নির্ধারণের চেষ্টা করল। দেখল ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে দশটার কাঁটায়। সে উঠে দাঁড়ায়। একপাশে তাকিয়ে দেখল পাশের দরজায় কালো জমিনের উপর সাদা অক্ষরে লেখা, ‘ডাইনিং হল’।
ক্ষুধা তার প্রচণ্ড ছিল বটে। কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় নয়, দরজার দিকে সে এগিয়ে গেল প্রচণ্ড কৌতূহলে। গিয়ে দেখল টেবিলে খানা তৈরি আছে। কয়েকটা বাটিতে নানারকম খাদ্য সুন্দরভাবে সাজানো। চমৎকার বালাম চালের গরম ভাত, মাংসের রোস্ট, কারী, মাছের কোপ্তা…
ডাইনিং হলের বাঁ দিকের দরজার আড়ালে পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে বেসিনের একাংশ দেখা যায়। উপরে ধোয়া তোয়ালে। জামান সম্মোহিতের মত বেসিনে মুখ ধুয়ে নিল। ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খেল পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে। খাওয়ার সময় তার বার বার মনে হচ্ছিল যেন পাশের ঘরে কেউ একজন অপেক্ষা করছে, এক্ষুণি এসে যেন বলবে, ভাল করে খেয়েছেন তো?
খেয়েদেয়ে আগের ঘরে ফিরে এল। দেখল শোবার খাটের শিয়রে রাখা তেপায়ার উপর কয়েক খিলি মিষ্টি পানের পাশে এক প্যাকেট চেস্টারফিল্ড সিগারেট। যন্ত্রচালিতের মত সিগারেটের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরাল সে। বসে বসে সিগারেট টানতে লাগল চুপচাপ।
সরোদের বাজনা আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কেন জানে না বহুকাল আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ল জামানের। তখন সবে সে ম্যাট্রিক ক্লাসের ছাত্র। পরীক্ষার আগে প্রায় রাতেই সে ঘুম থেকে উঠত। পড়াশোনা করত। রাত পুইয়ে গেলে সে নদীর ধারে যেত বেড়াতে। সেখানে দেখা হত এক শুভ্রকেশ বৃদ্ধ আর তার কিশোরী কন্যার সঙ্গে। মেয়েটি ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকত চুপ করে। মেয়েটিকে ঘিরে কতই না মিষ্টি স্বপ্ন দেখেছিল জামান।
সরোদের কোমল, মিষ্টি বাজনা শুনে কিশোর বেলার সেই অনুভূতি বুকের ভিতরে যেন আবার ফিরে এল। একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস চেপে ওসব ভাবাবেগ মন থেকে দূর করে দিতে চেষ্টা করল জামান। সে তার নিজের অবস্থা সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হওয়ার চেষ্টা করল। ভাবল এই প্রাসাদ, এই ঐশ্বর্য, আড়ম্বর, আর ভয়াবহ এইসব পরিকল্পনা-এসব কার? জামান কোথায় এসে পড়ল?
ঠিক তখন সরোদের বাজনাটা থেমে গেল। সারা ঘরে বিরাজ করতে লাগল দুঃসহ নিস্তব্ধতা।
একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর বেজে উঠল দেয়ালের কোথাও, ‘Please proceed west-ward. পশ্চিম দিকে অগ্রসর হও, জামান।’
চারদিকে তাকাল জামান, কেউ নেই। অবাক হওয়ার মনও তার আচ্ছন্ন হয়ে আছে। প্রায় যন্ত্রচালিতের ন্যায় সে অগ্রসর হলো পশ্চিম দিকে। প্রশস্ত, দীর্ঘ করিডর ধরে সে এগোল। চারদিকে হলুদ রঙের আচ্ছন্ন ফ্যাকাসে আলো। ঘর, বারান্দা, পর্দা, সিঁড়ি সব যেন হাজার হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে। করিডর পার হয়ে সে পৌঁছল প্রাসাদের শেষ প্রান্তে। বারান্দার বাঁ পাশে, উপরে ওঠার সিঁড়ি। সেই গভীর, গম্ভীর কণ্ঠস্বর আবার পিছন থেকে বলল, ‘Please, go upstairs. ওপরে উঠে যাও।’
জামান উপরে উঠল। উপরের দুই সারি নিস্তব্ধ ঘরের ভিতর টানা বারান্দা। বারান্দার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল এক মূর্তি।
জামান চেঁচিয়ে উঠল তাকে দেখে। দৌড়ে গেল তার দিকে। বলল, ‘শফি, তুই?’
শফি হাসল, ‘হ্যাঁ, তোর জন্যে অপেক্ষা করছি। ঘরের ভেতর আয়।’
ঘরের ভিতর সেই রকম আচ্ছন্ন নীল আলো জ্বলছে। চারদিকে জল-প্রপাত থেকে জল পড়ার মত মৃদু একটানা ঝুপ ঝুপ শব্দ। দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসল শফি আর জামান। শফির মুখটা আস্তে আস্তে কঠোর হয়ে উঠল। সে বলল, ‘তুই আমার পিছু নিয়েছিলি কেন, জামান?’
জামান অবাক হলো। এটা কি তাহলে শফির আসল চেহারা? সে উত্তেজনা প্রকাশ করল না। বলল, ‘আমি তোর পিছু নিয়েছিলাম এটা যখন জানিস তখন কেন পিছু নিয়েছিলাম আশা করি সেটাও জানিস।’
‘জানি। কুয়াশার সন্ধান নেয়ার জন্যে তুই আমার পিছু নিয়েছিলি। কুয়াশা তোর মাকে হত্যা করেছিল, তুই চাইছিস কুয়াশাকে হত্যা করতে।’
‘হ্যাঁ, এবং হত্যা করবই।’
জামান দাঁতে দাঁত ঘষল।
শফির কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল অসহিষ্ণুতা। বলল, ‘জামান, আমি তোকে সাবধান করে দিচ্ছি। এসব কথা আমার সুমুখে কখনও বলিস না।’
‘ও, তুই তাহলে কুয়াশার চেলা হয়েছিস, দীক্ষা নিয়েছিস খুনীটার কাছে? বাঃ, বাঃ।’ জামান তীব্র শ্লেষের হাসি হাসল, ‘একেই বলে চোরের বন্ধু বাটপার!”
শফি বলল, ‘তুই নির্বোধ, তাই একথাটা বলতে পারলি, জামান। যদি জানতিস, বোটের সেই চওড়া কাঁধওয়ালা লোকটা তোকে খুন করত, তুই রক্ষা পেয়েছিস শুধু কুয়াশার দয়ায় তাহলে একথা তুই বলতে পারতি না।’
জামান বলল, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি, বোটের সেই লোকটার কাছে আমি ধরা পড়েছিলাম। তারপর কুয়াশার অদৃশ্য নির্দেশেই আমাকে এই প্রাসাদে আসতে হয়েছে। কুয়াশা আমাকে ইচ্ছে করলে খতম করে দিতে পারত তা-ও আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু দয়া তো কখনও আমি চাইনি, শফি। যারা দয়া আর সাহায্যের কাঙাল সেই মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপের দলে তোর মত লোকেরা থাকতে পারে। আমি নই। তুই জেনে রাখিস, শফি, ‘আমি বেঁচে আছি শুধু কুয়াশার রক্তপাতের জন্যে।’
শফি হাসল। বলল, ‘বটে?’
জামান বিদ্রূপে কর্ণপাত না করে বলল, ‘শফি, আমার শক্তি কতটুকু তা আমি জানি না। জানতেও চাই না। তুই আমার বাল্যবন্ধু, তোর কাছে আমার অনুরোধ, তুই আমাকে সাহায্য কর।’
শফি বলল, ‘তোকে সাহায্য করা যে সম্ভব নয়, একথাটা জানাবার জন্যেই এই মুহূর্তে তোর মুখোমুখি হয়েছি, জামান। আমরা বন্ধু ছিলাম বটে, কিন্তু মানুষের কাছে বন্ধুত্বের মর্যাদা সব সময়ই একমাত্র সত্য নয়। আমি মহত্তর আদর্শে এখন উৎসর্গীকৃত। মানুষকে, অমর করার সাধনায় আমি কুয়াশাকে সাহায্য করব বলে স্থির করেছি।’
জামানের গলার স্বর কেঁপে ওঠে, ‘কিন্তু, লিলির এত বড় সর্বনাশটা তুই কেন করলি, শফি? লিলি যে তোর জন্যে অপেক্ষা করে আছে।’
‘জানি। লিলির জন্যে আমিও বাঁচতে চেয়েছিলাম। কুয়াশার কাছে এসেছিলাম মুক্তি-ভিক্ষা চাইতে। কিন্তু, জামান, দুর্বলতা আমার কেটে গেছে। সামান্য নারীর প্রেম আর আমাকে টলাতে পারবে না। ত্যাগের মন্ত্রে এখন দীক্ষা নিয়েছি। আমার কাছে সব কিছুর মূল্য ফুরিয়ে এখন সবচে’ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বিজ্ঞান সাধনা। আমার যতটুকু সাধ্য আছে তা দিয়ে মানুষের কল্যাণের পথ আমি সুগম করে যেতে চাই।’
জামান তিক্ত হাসল। বলল, ‘একদিনেই যথেষ্ট বক্তৃতা শিখেছিস, শফি। ঢের হয়েছে, আর না। তোদের মত নিমকহারামদের জন্যে আমাকে আরও কিছুদিন বাঁচতে হবে। ভাবিস না তোর নীচতা আমি ভুলে যাব।’
দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়। জামানের চোখে জ্বলছে জিঘাংসার আগুন। শফির চোখে-মুখে প্রতিজ্ঞার ছাপ। জামান তীব্র ঘৃণায় যেন পুড়িয়ে দিতে চাইল শফির অস্তিত্ব। শফি কঠোর হয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল সামনে।
লাউড স্পীকারের শব্দ বেজে উঠল ঘরের ভিতর। প্রথমে আস্তে, তার পরে স্বচ্ছন্দ ও সুস্থির ভঙ্গিতে একটা গভীর, মিষ্টি কণ্ঠস্বর বলল, ‘জামান, যাকে হত্যা করবে বলে পাতালপুরীতে ঢুকেছ, আমি সেই কুয়াশা বলছি। জানি তুমি আমাকে ঘৃণা করো। তোমার ধারণা তোমার মাকে আমি হত্যা করেছি। তোমার ধারণা ভুল, জামান…’
জামান চেঁচিয়ে উঠল তীব্র আক্রোশে, ‘You rascal! বাজে কথা বোলো না! সাহস থাকে সামনে এসে দাঁড়াও!’
কুয়াশার গলার স্বর তেমনি শান্ত। বলল, ‘হ্যাঁ, তোমার ধারণা ভুল। আমি আজ পর্যন্ত হত্যার জন্যে কাউকে হত্যা করিনি। কুয়াশা ক্রিমিনাল নয়, জামান, খুনী তো নয়ই।’
জামান তেমনি চেঁচিয়ে বলল, ‘তুমি আমার মাকে হত্যা করেছ! তুমি ক্রিমিন্যাল, তুমি একটা জঘন্য খুনী।’
গম্ভীর হয়ে উঠল কুয়াশার গলার স্বর, ‘জীব-বিজ্ঞানের রহস্য ভেদ করার জন্যে বৈজ্ঞানিক গিনিপিগের শরীর কাটাচেরা করেন, একে তুমি হত্যা বলো, জামান? আমার গবেষণার জন্যে প্রয়োজন ছিল বহু জীবন্ত মানুষের শরীর। আমার এই গবেষণা সফল হলে মানুষ মৃত্যুকে জয় করতে পারবে। মানুষকে অমর করার জন্যে আমার এই গবেষণাকে তুমি ক্রাইম বলো, জামান? তোমাদের সভ্য-জগৎ আমার এই সব কার্যাবলীকে অবশ্য ওই নামেই অভিহিত করেছে, আমার গবেষণাকে তারা বলে madness…পাগলামি, আমাকে বলে পাগল, ক্রিমিন্যাল। মানুষের কথায় কিছু যায় আসে না, জামান। নীতি আর আইন মানুষেরই তৈরি। মহৎ আদর্শের জন্যে মানুষ নীতি আর আইন বদলায়, কল্যাণের জন্যে আমিও তাই করেছি। পুরাতন আইন ভেঙে নিজেই নিজের আইন তৈরি করেছি। আমার আইন মানুষের বৃহত্তম কল্যাণের জন্যেই গড়া। Accidentally-আকস্মিকভাবে তোমার স্নেহময়ী মাকে আমার আইনের বলি হতে হয়েছে। একে আমি ত্যাগ বলব, জামান, বলব মহত্তর কল্যাণের জন্যে ক্ষুদ্রতর আত্মত্যাগ…একে হত্যা বলব না।’
জামান দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘শয়তান, তোমার দিন শেষ হয়ে এসেছে! অপেক্ষা করো।’
কুয়াশা একটু হাসে। বলে, ‘Accidentally তোমার মা যেমন আমার শিকার হয়েছেন, সেভাবে আমার নিজের হাতে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে আমার বাবাকেও। এজন্য আমার দুঃখ আছে, কিন্তু অনুশোচনা নেই।’
একটু থেমে কুয়াশা বলে, ‘তোমার দুঃখ গভীর তা আমি জানি, জামান। আমাকে ভুল বুঝো না। অবশ্য কিছু যায় আসে না ভুল বুঝলেও। আমার মহা-পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত আমার কাজ আমি করে যাবই। দুনিয়ার কোন শক্তিকে আমি পরোয়া করি না।’
জামান বলল, ‘মি. সিম্পসন সেজে তোমার শিষ্য বলেছিল অতি আত্মবিশ্বাস মানুষের মৃত্যু ডেকে আনে। কথাটা আমি বিশ্বাস করি। তোমার দিনও শিগগিরই ঘনিয়ে আসছে। আইন ভঙ্গ করার জন্যে আর নরহত্যার জন্যে সভ্য পৃথিবী তোমাকে শাস্তি দেবেই। মৃত্যুদণ্ড থেকে তোমার রেহাই নেই। যাক সে কথা, আমাকে তুমি বন্দি করেছ কেন?”
লাউড স্পীকারে কুয়াশার গম্ভীর কণ্ঠস্বর বেজে উঠল, ‘তোমার বন্দিত্ব তুমি নিজেই ডেকে এনেছ। এজন্য আমি দায়ী নই। আমি বরং তোমাকে রক্ষা করেছি।’
‘কিন্তু তোমার দয়া আমি চাইনি, কুয়াশা। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তোমার দয়াকেও ঘৃণা করি। তুমি বরং আমাকে হত্যা করো।’
‘মানুষকে আমি ভালবাসি, জামান। মানুষের দুর্বলতা ক্ষমা করার মত শক্তি আমার আছে। তোমার মাকে আমি হত্যা করেছি, আমার প্রতি তোমার ঘৃণা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমার এই পাতালপুরীতে কিছুদিন তুমি থাকো, স্বাধীনভাবে এখানে চলাফেরা করো। দেখবে যতখানি আমাকে তুমি ঘৃণা করো ততখানি ঘৃণা পাত্র আমি নই।’
কুয়াশার স্থির কণ্ঠস্বর বাজতে লাগল, ‘তুমি পাতালপুরীতে আপাতত বন্দি। কিন্তু এখানকার প্রতিটি মানুষ জানে তুমি আমার সম্মানিত অতিথি। এই পাতালপুরীর যেখানেই যাবে সেখানেই অতিথির সম্মান পাবে তুমি। এ পর্যন্ত এই সম্মান কুয়াশার কাছ থেকে আর কেউ পায়নি। তোমার যদ্দিন খুশি এখানে থাকতে পারো।’
জামান বলল, ‘মনে রেখো যে কয়েকটা মুহূর্ত এখানে থাকব সে ক’টি মুহূর্ত তোমার সর্বনাশ করার চেষ্টাই করব আমি। তোমার দেয়া সম্মান আমার কাছে মূল্যহীন।’
হাসির আওয়াজ বেজে ওঠে মাইক্রোফোনে। কুয়াশা বলে, ‘ক্ষতি করবে? দেখা যাক। শেষ কথা বলি, জামান। যেদিন তুমি ফিরে যেতে চাইবে সেইদিনই তোমাকে সম্মানের সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়া হবে বাড়ি। আচ্ছা, শুভ-সন্ধ্যা!’
লাউড স্পীকার স্তব্ধ হয়। জামান তাকিয়ে দেখল ইতিমধ্যে শফিও চলে গেছে ঘর ছেড়ে। ঘরের ভেতর সে একা।