থিম রহস্য

থিম রহস্য

এক

প্রোফেশনাল কাবাডি লিগে খেলানোর জন্য ইস্টবেঙ্গল ক্লাব একজন কোঙ্কনি প্লেয়ারকে নিয়ে আসছে৷ পুনের ওই প্লেয়ারের নাম ক্যামিনো কাম্বলি৷ কয়েক দিন ধরেই ভাবছিলাম, মুম্বইয়ে একবার ফোন করে কারমারকরের কাছ থেকে জেনে নেব, সে কী মাপের প্লেয়ার৷ বাল কারমারকর আমার বন্ধু৷ মুম্বইয়ের গ্লোবাল বলে একটা টিভি চ্যানেল আছে, তার রিপোর্টার৷ কাবাডি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সারা বিশ্বে ওর খুব সুনাম৷

বহু বছর ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হতে পারছে না বলে কলকাতার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ক্লাব গত বছর থেকে প্রোফেশনাল কাবাডি লিগে নাম লিখিয়েছে৷ কাবাডি সম্পর্কে বাঙালির এখন প্রচণ্ড আগ্রহ৷ ফুটবল ছেড়ে তাই আমরা কাবাডি লিখছি৷ প্রো লিগের খুঁটিনাটি রিপোর্ট করার জন্য আমাকে কারমারকরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়৷ আমার সঙ্গে ওর আলাপ কয়েক বছর আগে গুয়াহাটিতে সন্তাোষ ট্রফি চলার সময়৷ সেই সময় ওখানে বিহু ফেস্টিভ্যাল চলছিল৷ তখন কিন্তু কারমারকরের বেশি আগ্রহ লক্ষ করেছিলাম বিহু নিয়ে৷ ও আমায় বলেছিল, সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছে৷ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ফেস্টিভ্যাল নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে৷ ওর ইচ্ছে, ভবিষ্যতে কোনো একদিন এ নিয়ে বই লিখবে৷

অফিসে বসে কারমারকরের কথাই ভাবছি৷ এমন সময় মুম্বই থেকে ফোন, ‘মে আই স্পিক টু কালকেটু ন্যান্ডি প্লিজ?’

গলা শুনেই বুঝতে পারলাম কারমারকর৷ একেই বোধহয় বলে টেলিপ্যাথি৷ উচ্ছ্বাসে বলে উঠলাম, ‘ইয়েস, কালকেতু স্পিকিং৷ হাউ আর ইউ মাই ফ্রেন্ড? কাসা কায়?’

আমাকে মারাঠি বলতে দেখে ও ওদের ভাষাতেই উত্তর দিল, ‘কাংলা, ভালো আছি৷’

সাধারণত, মেল-এ প্রায়ই ওর সঙ্গে চ্যাট করি৷ আজ ওর কী এমন দরকার পড়ল যে, ফোন করল? তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলো, ফোন করলে কেন?’

কারমারকর বলল, ‘তুমি কি এখন খুব ব্যস্ত?’

সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে৷ এই সময়টায় আমাদের খবরের কাগজের পিক আওয়ার্স৷ কারমারকর ঠিকই আন্দাজ করেছে৷ এখন আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা৷ তবুও বললাম, ‘এত সঙ্কোচ করো না৷ বলো, আমাকে তোমার কী দরকার পড়ল?’

‘বন্ধু, তোমার কি মনে আছে, গতবার কাবাডি লিগের সময় প্রেস সেন্টারে আড্ডা মারতে মারতে তুমি একদিন বলেছিলে, তোমাদের ডুরগাপুজো ফেস্টিভ্যাল নাকি আমাদের গণেশ চতুর্থীর থেকেও বড়ো? তোমার কি মনে পড়ছে সে কথা?’

চট করে মনে পড়ে গেল৷ কলকাতার দুর্গোৎসবের জাঁকজমক নিয়ে ওকে আমি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অনেক কথা বলেছিলাম৷ বললাম, ‘হ্যাঁ, মনে আছে৷ তোমাকে এও বলেছিলাম, নিজের চোখে একবার এসে দেখে যাও৷ চার-পাঁচ দিন ধরে এমন বড়ো ফেস্টিভ্যাল বিশ্বের আর কোথাও হয় না৷’

‘রাইট ইউ আর৷ তোমার কথা তখন আমার বিশ্বাস হয়নি৷ কিন্তু তোমাদের ডুরগা ফেস্টিভ্যাল নিয়ে রিসেন্টলি এখানে একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখে আমার কৌতূহল হল৷ আমাদের চ্যানেল কর্তাদের কাছে আমি একটা প্রোপোজাল দিয়েছিলাম, তোমাদের ফেস্টিভ্যালে কতটা গ্র্যাঞ্জার হয়, সেটা আমাদের চ্যানেলে দেখানো হোক৷ সত্যিই, আমাদের গণেশ চতুর্থীর থেকে ওটা বড়ো ফেস্টিভ্যাল কী না? শুনে চ্যানেল কর্তারা রাজি হয়েছেন৷ তাই তিরিশজনের একটা টিম নিয়ে তোমাদের ডুরগা ফেস্টিভ্যাল কভার করার জন্য আমি এবার কালকুত্তায় যাচ্ছি৷ আমি এত এক্সাইটেড যে, তোমাকে ফোন করে ফেললাম৷’

শুনে আমিও লাফিয়ে উঠলাম, ‘এ তো খুব ভালো খবর৷ চলে এস৷’

‘ইন্টারনেটে দেখলাম, তোমাদের ফেস্টিভ্যাল এবার শুরু হচ্ছে অক্টোবর মাসের পনেরো তারিখে৷ আমরা তার এক সপ্তাহ আগেই কলকাতায় পৌঁছে যাব৷ তুমি কি আমায় আইডিয়া দিতে পারবে, কীভাবে ফেস্টিভ্যালটা কভার করা যায়?’

উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, নিশ্চয়ই আইডিয়া দিতে পারব৷ বড়ো বড়ো পুজো কমিটির অফিসিয়ালদের সঙ্গে আমার আলাপ আছে৷ কভার করতে তোমার কোনো অসুবিধে হবে না৷ এখানকার সিডিউল আর আইটেনারি তোমাকে আমি তৈরি করে দেব৷’

‘তা হলে তো খুব ভালো হয়৷ ইউ উইল বি পেইড ফর দিস৷ তোমাদের এই ফেস্টিভ্যাল কেন হয়, তা নিয়ে আমাকে একটা বড়ো লেখা পাঠাও৷ তা হলে হোমওয়ার্ক করতে আমার সুবিধে হবে৷ ইন্টারনেটে অবশ্য কিছু ইনফর্মেশন পেয়েছি৷ কিন্তু সেটা যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না৷’

বললাম, ‘আমি সব তথ্য তোমাকে পাঠিয়ে দেব৷ তুমি চিন্তা করো না৷’

‘আরেকটা রিকোয়েস্ট আছে৷ কলকাতায় গেলে মাদার টেরিজার চ্যারিটি অফ মিশনারিজ নিয়েও আমরা ডকুমেন্টারি বানাব৷ সে ব্যাপারেও কিন্তু তোমাকে হেল্প করতে হবে৷’

বললাম, ‘কোনো সমস্যা নেই৷ মাদার যোগিতার সঙ্গে আমি কথা বলে রাখব৷’

‘ওকে ফ্রেন্ড, থ্যাংকস৷’ বলে কারমারকর লাইন কেটে দিল৷

ওর ফোন পেয়ে মনটা আনন্দে ভরে গেল৷ আমার অনেক দিনের একটা ইচ্ছে পূরণ হল৷ দেখা হলেই প্রায়ই কারমারকর গর্ব করত ওদের গণেশ চতুর্থী নিয়ে৷ সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে নাকি বিরাট ধুমধাম হয়৷ পরে মুম্বই প্রবাসী অনেক বাঙালির মুখেও খুব প্রশংসা শুনেছি৷ মারাঠি সংস্কৃতির সঙ্গে সিদ্ধি বিনায়কের পুজো ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ ঠিক আমাদের দুর্গাপুজোর মতো৷ পরে দেখেছি, অনেক মিল আছে দুটো উৎসবের সঙ্গে৷ দুর্গাপুজোর মতোই গণেশ চতুর্থীর নির্দিষ্ট তারিখ থাকে না৷ তিথি অনুযায়ী হয়৷ সাধারণত আমাদের পুজোটা হয় অক্টোবর মাসে৷ ওদেরটা অগস্ট-সেপ্টেম্বরে৷ গণেশ পুজো চলে দশ দিন ধরে৷ দুর্গাপুজো আসলে পাঁচ দিনের৷ কিন্তু এখন উৎসবের মেয়াদ বেড়ে প্রায় দশ দিনের হয়ে গিয়েছে৷

কারমারকর বলেছিল, গণেশ চতুর্থীর প্রথম দিনে মারাঠিরা চাঁদের দিকে তাকান না৷ ভাদ্দর মাসের শুক্লা চতুর্থীর দিন বাহন ইঁদুরের পিঠ থেকে নাকি পড়ে গিয়েছিলেন গণেশ৷ সেটা দেখে আকাশ থেকে চাঁদ হেসেছিলেন৷ সেই কারণে নাকি চাঁদের ওপর মারাঠিদের রাগ৷ গণেশের মতো বিশাল বপুর এক দেবতার বাহন কী করে পুঁচকে ইঁদুর হল, তা নিয়েও কারমারকর লম্বা একটা কাহিনি শুনিয়েছিল৷ যাই হোক, গণেশ পুজো শুরু হয়েছিল ধর্মীয় কারণে৷ আগে ছত্রপতি শিবাজি এবং তারপর মহামান্য তিলক মারাঠিদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলার জন্য গণেশ পুজোর ব্যাপক প্রচলনে উৎসাহ দেন৷ এখন মহল্লায় মহল্লায় গান-বাজনা আর নাচের উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ সবথেকে বেশি জনসমাগম হয় দশম দিনে বিসর্জনের মিছিলে৷

ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ফুটবল কভার করতে গিয়ে শুনেছি, বিশ্বের সবথেকে বড়ো ফেস্টিভ্যাল হয় রিও ডি জেনেইরোতে৷ প্রায় দশ লাখ বিদেশি ওই সময় রিওতে হাজির হন৷ আজকাল চিনারাও ব্রাজিলীয়দের দেখাদেখি কার্নিভাল শুরু করেছে৷ ওঁরা যাই করুন, কেন জানি না, আমার মনে হত, ব্রাজিলের কার্নিভালের থেকে আমাদের দুর্গাপুজো উৎসব কোনো অংশে কম না৷ কার্নিভাল হল দেদার ফূর্তির জায়গা৷ রিওতে একজন বলেছিল, ‘কার্নিভালের সময় তোমার যদি কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়, আর সেই মেয়ের যদি সম্মতি থাকে, তা হলে তার সঙ্গে যত ইচ্ছে সম্পর্ক করতে পার৷’ তখনই বুঝেছিলাম, ইউরোপ, আমেরিকা থেকে বিদেশিরা কেন কার্নিভালে ছুটে যান?

মনে মনে ভাবলাম, কারমারকররা যদি ওদের চ্যানেলে দুর্গাপুজো দেখায়, তা হলে সারা বিশ্বে পাবলিসিটি হয়ে যাবে৷ কেননা, গ্লোবাল টিভির দর্শক সারা পৃথিবী জুড়ে৷ ভবিষ্যতে প্রচুর বিদেশি কলকাতায় আসতে পারেন৷ ঠিক করে রাখলাম, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কারমারকররা নির্বিঘ্নে পুজো কভার করতে পারে৷ উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার সেরা কুড়িটা পুজোয় ওদের নিয়ে যাব৷ পুজোর অভিনবত্ব, আড়ম্বর, শিল্প-বৈচিত্র্য, পরিবেশ দেখে যাতে ওরা চমকে যায়৷ বিসর্জনের পরদিন রেড রোডের মিছিলটাও ওদের কভার করতে বলব৷

দুর্গাপুজোর আর মাস তিনেক বাকি৷ আমাদের কাগজে দুর্গোৎসব নিয়ে খবর করে মেঘদূত৷ ওকে কারমারকরদের খবরটা দিলে এখনই ও কাগজে ছেপে দিতে চাইবে৷ কিন্তু তা হলে কাল থেকেই পুজো কমিটির কর্তা আর থিম আর্টিস্টরা আমার বাড়িতে এসে জ্বালাতন শুরু করবেন৷ সবাই চাইবেন, গ্লোবাল টিভিতে যেন তাঁদের পুজোটা দেখায়৷ এই পরিস্থিতিতে পড়তে আমি চাই না৷ কলকাতায় পুজো কমিটির একটা ফোরাম আছে৷ তার প্রেসিডেন্ট হলেন নির্মল মুখার্জি৷ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ নেই৷ কিন্তু চট করে মনে হল, নির্মলবাবুর সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নিলে ভালো হয়৷ উনি আমাকে বলে দিতে পারবেন, কলকাতার কোন কুড়িটা পুজোকে নেওয়া যেতে পারে৷ কারা কত বড়ো বাজেটের পুজো করছে, সেটা ওঁর নখদর্পণে৷

কারমারকরের ফোনটা ছেড়ে দেওয়ার পর মনে হল, এই যাঃ, কাবাডি প্লেয়ার ক্যামিনো কাম্বলি সম্পর্কে তো ওকে কিছু জিজ্ঞেস করা হল না৷ ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টাররা খুব আশা করে বসে আছেন, ক্যামিনো এলে আর কোনো চিন্তা নেই৷ প্রো কাবাডি লিগ হাতের মুঠোয় এসে যাবে৷ কার মুখে যেন শুনেছিলাম, ক্যামিনোর বাবা মারাঠি, কিন্তু মা ব্রাজিলীয়৷ পনেরো-ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত ও নাকি সাওপাওলোতে কাটিয়েছে৷ মনে মনে ঠিক করে রাখলাম, অফিসে গিয়েই কারমারকরের সঙ্গে একবার যোগাযোগ করতে হবে৷ ক্যামিনোর ফোন নম্বরটা যদি ওর কাছে পাওয়া যায়, তা হলে তো কথাই নেই৷ সরাসরি ক্যামিনোর ইন্টারভিউ নিয়ে লাল-হলুদ সাপোর্টারদের চমকে দেওয়া যাবে৷

দুই

ব্রেকফাস্ট করে অফিসে বেরোচ্ছি, এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল৷ দরজা খুলে দেখি, সম্রাট শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে৷ সম্রাট পাল দুর্গাপুজোর থিম আর্টিস্ট৷ দেখেই বুঝতে পারলাম, কোনো সমস্যায় পড়েছে৷ সাগ্রহে বললাম, ‘এসো, ভেতরে এসো৷ তোমাদের জন্য একটা ভালো খবর আছে৷’

ভালো খবর বলতে আমি কারমারকরদের টিভি কভারেজ বোঝাতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু সম্রাট সেটা জানতেও চাইল না৷ ঘরে ঢুকে সোফায় বসে ও বলল, ‘সরি কালকেতুদা, একটা বিপদে পড়ে আপনার কাছে ছুটে এলাম৷ না হলে হঠাৎ হাজির হতাম না৷’

উলটোদিকের সোফায় বসে বললাম, ‘ও নিয়ে ভেবো না৷ কী বলতে এসেছ, বলো৷ এবার কোন ক্লাবের কাজ ধরেছ?’

সম্রাট বলল, ‘ধরেছিলাম…সেন্ট্রাল ক্যালকাটায় ধাতুপট্টি সর্বজনীনের৷ ওদের গোল্ডেন জুবিলির পুজো৷ অর্গানাইজাররা দু-বছর ধরে আমার পিছনে ঘুরছিলেন৷ একটা ইউনিক থিম মাথায় এসেছিল৷ ওদের বললাম, আমার সঙ্গে টোটাল কন্ট্রাক্ট করতে হবে৷ ষাট লাখ টাকার বাজেট৷ আমার ফি, লেবার, মেটেরিয়াল সব ওই বাজেটের মধ্যে৷ আপনারা কি অ্যাফোর্ড করতে পারবেন? অর্গানাইজাররা রাজি হয়ে গেলেন৷ ওঁরা জানতেও চাননি, থিমটা কী? আমার ওপর ওঁদের এমন বিশ্বাস৷ মারাত্মক একটা ঝুঁকি নিয়েছিলাম৷ এখন পস্তাচ্ছি৷’

‘বাজেট নিয়ে কোনো প্রবলেম?’

‘না, না৷ বাজেট নয়৷ লেবার হাইজ্যাকিং৷’

‘কী বলছ তুমি?’

‘হ্যাঁ কালকেতুদা৷ আমার থিমটা ছিল ওড়িশার এক মন্দিরকে নিয়ে৷ গত বছর পুজোর পর আমি কালাহান্ডিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম৷ আপনি তো জানেনই, নতুন নতুন আইডিয়া পাওয়ার জন্য আমরা ভিন রাজ্যে ঘুরে বেড়াই৷ তা, কালাহান্ডিতে ওই যোগিনী মন্দিরটা দেখেই আমার মাথায় আইডিয়াটা আসে৷ দিন দশ-বারো ওখানে থেকে স্কেচ করে এনেছিলাম৷ লোকাল লেবারদের সঙ্গেও কথা বলে আসি৷ ঠিক ছিল, জুন মাসে ওদের দশজনকে কলকাতায় নিয়ে আসব৷ তারপর আমার স্টুডিয়োতে কাজ শুরু করে দেব৷ সেই অনুযায়ী, ওদের টাকা-পয়সা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম৷ ওরা রওনাও দিয়েছিল, কিন্তু আমার কাছে পৌঁছোয়নি৷’

শুনে চমকে উঠলাম৷ আরে, এসব হাইজ্যাকিংয়ের কেস তো তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে কলকাতার ফুটবল ময়দানে হত! মোহনবাগানের ঠিক করা প্লেয়ার গোপনে তুলে নিজেদের ডেরায় নিয়ে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল সই করাত৷ কখনও কখনও উলটোটাও হত৷ থিম পুজোর ময়দানেও এটা চালু হয়ে গেল নাকি? বললাম, ‘কী বলছ তুমি! মাঝপথে তোমার লেবারদের অন্য কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে? কীভাবে?’

সম্রাট বলল, ‘আমারই ভুল৷ আমার উচিত ছিল, ধাতুপট্টির কোনো কর্তাকে কালাহান্ডিতে পাঠিয়ে দেওয়া৷ যাতে লেবারদের সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারে৷ ওরা যে হাইজ্যাক করতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি৷ হাওড়া স্টেশনে আনতে গিয়ে দেখি, কামরা ফাঁকা৷ পরে জানতে পারলাম, চৈতালি সংঘের লোকেরা খড়্গপুর স্টেশন থেকে ওদের তুলে বাই রোড কলকাতায় নিয়ে এসেছে৷ এখন আটকে রেখেছে সার্পেন্টাইন লেনের এক বাড়িতে৷’

‘চৈতালি সংঘের পুজোটা কারা করে, জানো?’

‘ডাম্বেলদা বলে একজন৷ ভালো নামটা আমার মনে নেই৷ ভদ্রলোক প্রোমোটিংয়ের ব্যবসা করেন৷ পুজোয় প্রচুর টাকা ঢালেন৷ কিন্তু, ওঁর পিছনে আছেন রুলিং পার্টির এক মন্ত্রী৷ এবার ইলেকশনে জেতার পর থেকে তিনিই কোমর বেঁধে নেমেছেন, অন্য পুজোর সঙ্গে পাল্লা দেবেন৷ ডাম্বেলদা এবার আমার কাছে এসেছিলেন৷ কিন্তু, আমি বলে দিয়েছিলাম, ধাতুপট্টির সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে৷ দুটো পুজোর দায়িত্ব আমি নিতে পারব না৷ তখনই উনি আমাকে শাসিয়ে যান, ফল ভালো হবে না৷ ওঁর লোকেরা যে আমার লেবারদের হাইজ্যাক করবেন, তখন ভাবতেও পারিনি৷’

‘কোন ট্রেনে লেবাররা কালাহান্ডি থেকে আসছে, সেটা ডাম্বেলবাবুরা জানলেন কী করে?’

প্রশ্নটা করতেই মাথা নীচু করে ফেলল সম্রাট৷ কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে ও বলল, ‘বাদশার কাছ থেকে৷ ঘরের শত্রু বিভীষণ৷ এ ছাড়া আর কী-ই বা বলব!’

‘বাদশা…মানে তোমার ভাই!’

‘হ্যাঁ, কালকেতুদা৷ আমি যে থিমটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছিলাম, বাদশা সেটা জানত৷ আপনি তো জানেনই, আর্ট কলেজে ও ছিল আমার তিন বছরের জুনিয়র৷ বড়ো বাজেটের কোনো পুজোর ভার পেলে ওর সঙ্গে থিম নিয়ে আমি আলোচনা করতাম৷ একটা সময় মা যে কাজটা আমার জন্য করত, ভাইকে আমি সেই সুযোগটাই দিয়েছিলাম৷ পরপর কয়েক বছর আমি শারদ সম্মান পেয়ে যাওয়ার পর ওর মাথা ঘুরে গেল৷ ওর মনে হল, ওই বা কম কীসে? ও নিজে পুজোকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত৷ ইদানীং মিডিয়ার কাছে প্রকাশ্যেই বলত, আমার থিমগুলো আসলে ওর৷’

‘তোমার সঙ্গে সম্পর্কটা এত খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি?’

‘হ্যাঁ, কালকেতুদা৷ আমার সঙ্গে রোজ ঝগড়াও করত৷ মাসখানেক আগে বাদশা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল৷ এখন শুনছি, চৈতালি সংঘের কাজ করার দায়িত্বটা ও নিয়েছে৷ আমার ঠিক করা লেবারদের নিয়ে, ওই একই থিমের মন্দির ওখানে ও বানাবে৷ হাতে আর তিনটে মাসও বাকি নেই৷ ধাতুপট্টির অর্গানাইজাররা আমায় মারাত্মক চাপ দিচ্ছেন৷ আমি কী করব, বুঝতে পারছি না৷’

গুরুতর সমস্যা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ বললাম, ‘তোমার পক্ষে কি ফের কালাহান্ডিতে গিয়ে লেবার আনা সম্ভব?’

‘চেষ্টা করেছিলাম৷ কিন্তু, স্কিলড লোক পাওয়া যাচ্ছে না৷ সবাই কোনো না কোনো পুজোয় কাজে লেগে গিয়েছে৷ ভেবেছিলাম, ধাতুপট্টির কর্মকর্তাদের কাছে হাত তুলে দিই৷ বলি, আমার পক্ষে সম্ভব না৷ কিন্তু ওঁরা ছাড়বেন না৷ বড়ো স্পনসর ধরে ফেলেছেন৷ আমার নাম শুনেই স্পনসররা টাকা দিতে রাজি হয়েছেন৷ এই ভেবে যে প্রাইজ-ট্রাইজ পাবেন৷ ওদেরও প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে গিয়েছে৷’

‘মেঘদূতদার সঙ্গে একবার কথা বলে দ্যাখো তো?’

‘গেছিলাম কালকেতুদা৷ উনি খুব একটা ইন্টারেস্ট দেখালেন না৷ কেউ বোধহয় আমার নামে চুকলি করেছে৷ আমার শত্রুর তো অভাব নেই৷ আমি প্রতিবার প্রাইজ পাই বলে, আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা থিম আর্টিস্টরা অনেকে আমাকে পছন্দ করে না৷ কুমোরটুলির শিল্পীরাও আমার ওপর চটে আছে৷ আমি না ঘর কা, না ঘাট কা৷ আমি টোটাল কন্ট্রাক্টে কাজ করছি বলে, পুজোর কর্মকর্তারাও বলতে শুরু করেছেন, সম্রাট পালের বড্ড বাড় বেড়েছে৷’

‘কুমোরটুলির শিল্পীরা তোমার ওপর খুশি নন কেন?’

‘কী আর বলব৷ আপনি তো জানেন, আমি কুমোরটুলির ছেলে৷ ওখানে যে পুজোটা হয়, তার মূর্তি গড়ার দায়িত্বটা আমায় একবার নিতে বলেছিল৷ কিন্তু এত অল্প টাকা দিতে চেয়েছিল যে, আমি রাজি হইনি৷ কেন রাজি হব, বলুন? বাবাকে তো দেখেছি৷ এত বড়ো একজন মৃৎশিল্পী, অথচ সারা জীবন বস্তিতে জীবন কাটিয়ে গেলেন৷ শিল্পীসত্তার কোনো দামই পেলেন না৷ আমি ওই বোকামি করতে যাব কেন? আমি জানি, যদ্দিন অ্যাওয়ার্ড পাব, তদ্দিনই আমার দাম৷ পেন্টিং করে পেট চালানোর দিন নেই৷ তাই, পুজোর সময় যা পারো, আদায় করে নাও৷’

সম্রাট ঠিক কথাই বলছে৷ ও আমার কাছে এসেছে কেন, আমি সেটাই আন্দাজ করতে পারলাম না৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি তোমার অরিজিনাল থিম থেকে সরে আসছ কেন? আর্ট কলেজে তোমাদের জুনিয়র কিছু আর্টিস্টকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করতে পারবে না?’

‘কথাটা একবার ভেবেছিলাম৷ কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমার স্টুডিয়োটা বাদশার এক বন্ধু সুদীপের সার্পেন্টাইন লেনের বাড়িতে৷ পুরোনো আমলের বাড়ি৷ প্রচুর জায়গা৷ এ যাবৎ যা কাজ করার, ওখান থেকে করেছি৷ এবারও নিজের পয়সায় সব মেটেরিয়াল কিনে স্টুডিয়োতে ডাম্প করেছিলাম৷ প্রায় দশ-বারো লাখ টাকার মালপত্র৷ বাদশার সঙ্গে সম্পর্কটা আমার এত খারাপ হয়ে গিয়েছে যে, এখন সেইসব মেটিরিয়াল ওদের বাড়ি থেকে বের করেও আনতে পারব না৷ মালপত্র বের করে আনতে গেলে আমাকে মাসল পাওয়ার কাজে লাগাতে হবে৷ থানা-পুলিশ করতে হবে৷ আমি সেটা চাই না৷ সবদিক দিয়েই আমি ডুবে গিয়েছি৷’

বললাম, ‘তোমাকে আমি কী সাহায্য করতে পারি, বলো৷’

‘কালকেতুদা, গত দু-তিন দিন ধরে কারা যেন ফোনে আমাকে হুমকি দিচ্ছে৷ এক-এক দিন এক-এক জায়গার পাবলিক বুথ থেকে৷ বলছে, জানে মেরে দেবে৷ কাল রাতে আমার রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল৷ বললাম, সাহস থাকে তো সামনে আয়৷ মাথার ভেতরে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে৷ পুজো নিয়ে ভাবব, না কি ডেথ থ্রেট নিয়ে?’

‘কারা এই হুমকিটা দিচ্ছে বলে তোমার মনে হচ্ছে?’

‘আমার তো মনে হচ্ছে, চৈতালি সংঘের ওরা৷’

‘পুলিশের কাছে কমপ্লেন করেছ?’

‘আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায় গিয়েছিলাম৷ আমার সন্দেহের কথা সব খুলে বলতেই ওসি ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিলেন না৷ বললেন, এটা আপনার ফ্যামিলির প্রবলেম৷ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে মিটিয়ে নিন৷ কী দরকার ফ্যামিলির কেচ্ছা, পাবলিক করার৷ আপনার একটা সুনাম আছে৷ কেন সেটা নষ্ট করবেন?’

‘তা হলে এখন কী করবে বলে তুমি ভাবছ?’

‘কলকাতা থেকে অস্ট্রিয়ায় চলে যাব কিনা ভাবছি৷ জুলাই মাসে ওখানে ওয়ার্ল্ড বডি পেন্টিংয়ের কম্পিটিশন আছে৷ অনেক টাকার প্রাইজ৷ কিন্তু সমস্যা হল, মাসখানেক ওখানে থাকতে হবে৷’

‘তাহলে ধাতুপট্টির পুজোর কী হবে?’

‘সেই চিন্তায় রাতে আমার ঘুম হচ্ছে না কালকেতুদা৷ অস্ট্রিয়ায় কম্পিটিশনে হোল ওয়ার্ল্ডের আর্টিস্টরা যায়৷ কম্পিটিশনটা হল, নিজের শরীরে অভিনব কিছু আঁকতে হবে৷ প্রচুর টাকার প্রাইজ মানি৷ যদি জিতি, তাহলে ধাতুপট্টির অর্গানাইজাররা যে টাকাটা আমাকে অ্যাডভান্স দিয়েছেন, সেটা ফেরত দিতে পারব৷ কিন্তু, এখানে আমার খুব বদনাম হয়ে যাবে৷ এরপর থেকে কাজ পাব না৷ থিম আর্টিস্টদের ফোরামও আমার পিছনে লেগে যাবে৷’

বলতে বলতে চোখে জল এসে গেল সম্রাটের৷ ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম, ‘ভেঙে পড়ো না৷ ভেবে দেখি, তোমার জন্য কী করতে পারি৷’

তিন

সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার৷ থেকে থেকে ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে৷ বেলা দশটা বাজে৷ সকালে মেঘদূতের ফোন পেয়েছি, ‘কালকেতুদা, প্লিজ তুমি আরপুলি লেনে যেও৷ না হলে নির্মলদার কাছে আমার মুখ থাকবে না৷’

মেডিকেল কলেজের উলটোদিকে আরপুলি লেন সর্বজনীনের আজ খুঁটিপুজো৷ সেই সঙ্গে যোধপুর পার্কে ৮৩ পল্লিরও৷ কোনটায় যাব, ঠিক করতে পারছিলাম না৷ যোধপুর পার্কের উদ্যোক্তা হল আমাদের কাউন্সিলার কেতন দে৷ ছেলেটা সারা বছর নানা উপকারে আসে৷ অন্যদিকে, আরপুলি লেনের পুজোর আমন্ত্রণটা এসেছে মেঘদূতের মাধ্যমে৷ ওর কথাও ফেলতে পারছিলাম না৷ আরপুলি লেনে গেলে অন্তত নির্মলবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে৷ উনি ওখানকার প্রেসিডেন্ট৷ কারমারকরদের গ্লোবাল টিভির কভারেজ নিয়ে একটা আলোচনা করা যাবে ভেবে মেঘদূতকে আর না করতে পারিনি৷

আগে খুঁটিপুজো হত রথযাত্রার দিন৷ আজকাল কলকাতায় থিম পুজোর সংগঠকরা পয়লা বৈশাখ থেকেই সেটা শুরু করে দেন৷ সব ক্লাবই চায়, খুঁটিপুজোর দিন সেলেব্রিটি আনতে৷ পুজো কমিটিগুলোর ফোরামই তাই ঠিক করে দেয়, কোন রোববার কোন ক্লাবের খুঁটিপুজো হবে৷ যাতে সেলেবদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা না হয়৷ এ ব্যাপারে মেঘদূতও মাঝেমধ্যে মধ্যস্থতা করে৷ ফোরাম কর্তাদের কাছে আমাদের কাগজের মেঘদূত হল ‘ভগবান’৷ ওঁরা মনে করেন, থিম পুজোর আজ যে এত বাড়বাড়ন্ত, তার পিছনে মেঘদুত৷ কাগজে লিখে লিখে থিম পুজোর আকর্ষণ ও বাড়িয়ে দিয়েছে৷ কে যেন আমায় বলেছিল, পুজোর দিনগুলোতে ফ্যামিলি নিয়ে মেঘদূত কোথাও ঠাকুর দেখতে গেলে, ওর জন্য নাকি প্যান্ডেল খালি করে দেওয়া হয়৷ যত ভিড়ই থাকুক না কেন!

বেলা পৌনে এগারোটার সময় আরপুলি লেনে গিয়ে দেখি খুঁটিপুজোয় বিশাল আয়োজন৷ প্যান্ডেলের একপাশে গণেশ ঠাকুরের পুজো হচ্ছে৷ বিরাট একটা শালখুঁটি ফুল দিয়ে সাজানো৷ পুজো হয়ে গেলে সেই খুঁটি পোঁতা হবে৷ প্যান্ডেলের অন্য পাশে, সব জগতের সেলেব্রিটি এসে হাজির৷ বিশেষ করে টলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা৷ তাদের সঙ্গে রয়েছে মেঘদূতও৷ পাড়ার হাজারখানেক লোক খুঁটিপুজো দেখতে এসেছেন৷ ছোটো গলিটা ভিড়ে ভিড়াক্কার৷ মঞ্চের পিছনে সাদা বড়ো একটা পর্দা টাঙানো রয়েছে৷ অতীতে যতবার আরপুলি লেনের পুজো শারদ সম্মান পেয়েছে, তার ভিডিয়ো ক্লিপিংস দেখানো হচ্ছে৷ দেখে মনে হচ্ছিল, খুঁটিপুজোতেই যারা এরকম এলাহি আয়োজন করে, তারা পুজোর সময় কী করবে?

মাইক হাতে নিয়ে উদ্যোক্তাদের একজন সেলেব্রিটিদের মঞ্চে তুলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন৷ অল্প কথায় কিন্তু অত্যন্ত মার্জিত ভঙ্গিতে৷ ভদ্রলোককে আমি বহুবার মেঘদূতের টেবিলের সামনে বসে থাকতে দেখেছি৷

জিজ্ঞেস করলাম, ‘অ্যানাউন্সার ভদ্রলোক কে মেঘদূত?’

‘উনিই তো নির্মল মুখার্জি৷ ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের বড়ো অফিসার৷ পুজোপাগল লোক৷ ওঁর পাগলামি নিয়ে অনেক গল্প আছে৷’

‘কী রকম?’

‘পুজোর মাস তিনেক আগে থেকে নির্মলদা অফিসের কাজকর্ম্ম ডকে তুলে দেন৷ জানো, বিরাট প্রোমোশন পেয়েও ভদ্রলোক দিল্লিতে ট্রান্সফার নিতে চাননি৷ একটাই কারণ, উনি ভিন রাজ্যে চলে গেলে, পাড়ার পুজোর কী হবে? পাগলামির আরও গল্প শুনবে? বছর তিনেক আগে থিম পুজো করতে গিয়ে এঁদের প্রায় দশ লাখ টাকা ঘাটতি হয়েছিল৷ বাড়ির কাউকে কিছু না বলে, মেয়ের বিয়ের জন্য জমানো টাকা তুলে নির্মলদা সেই ঘাটতি মিটিয়ে ছিলেন৷’

‘সে কী! বাড়ির লোকেরা পরে জানতে পারেনি?’

‘জেনে আর কী করবে? ওঁর স্ত্রী তো জানেনই, পুজো ছাড়া নির্মলদা বাঁচতে পারবেন না৷ পরের বছর অবশ্য নির্মলদা টাকাটা ফেরত পেয়েছিলেন৷ পাত্রপক্ষ চেনাশুনো, তাই বিয়েটা পিছিয়ে গেলেও পাত্র হাতছাড়া হয়নি৷ এই যে দেখছ, টলিউডের এত সেলেব্রিটি এই গলির মধ্যে হাজিরা দিয়েছে, তা কার জন্য জানো? নির্মলদার জন্য৷ ওঁর একটা ফোনই কাফি৷ ব্যাম্বু ভিলায় ওঁর দাপট দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে৷’

মাইকে নির্মলবাবুর কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম, টালা থেকে টালিগঞ্জ…কলকাতার প্রায় সব কটা বড়ো পুজোর কর্তা আরপুলি লেনে এসেছেন৷ এক একজনকে মঞ্চে তুলে উনি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন৷ আর তাঁরা দু-একটা কথা বলে মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছেন৷ হঠাৎ বড়ো পর্দায় চোখ গেল৷ ক্যামেরা দর্শকদের দিকে৷ দেখলাম, পিছনের দিকের চেয়ারে সম্রাটের ভাই বাদশা বসে আছে৷ পাশে বসা সমবয়সি একটা মেয়ের সঙ্গে ও হেসে হেসে কথা বলছে৷ বাদশা এখানে? ও আরপুলি লেনের পুজোর থিম আর্টিস্ট নাকি? বলা যায় না৷ কলকাতায় থিম পুজোর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে৷ সেই তুলনায় আর্টিস্টের সংখ্যা কম৷ এক একজন দু-তিনটে করে পুজো ধরে৷

জিজ্ঞাসা করতেই মেঘদূত বলল, ‘না না, নির্মলদারা এবার প্রিয়তোষ সুতারকে দিয়ে কাজটা করাচ্ছেন৷ সম্রাট আর বাদশা গত বছর এঁদের সঙ্গে কাজ করেছিল৷ তাই হয়তো এবার ওদের ইনভাইট করেছে৷’

প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে পরিচয় পর্বের পালা চলল৷ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেখি, হাসিমুখে বাদশা আমার দিকে এগিয়ে আসছে৷ বোধহয় পর্দায় আমাকে চোখে পড়েছে৷ ও কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি একা? সম্রাট কই?’

মুহূর্তে ওর মুখের রং পালটে গেল৷ মুখটা যথাসম্ভব কঠিন করে বাদশা বলল, ‘জানি না৷ দাদার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই৷’

যেন কিছুই জানি না, এমনভাবে বললাম, ‘কী বলছ তুমি! কী এমন হল, তোমরা আলাদা হয়ে গেলে?’

‘দাদা আমাকে মারধর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কালকেতুদা৷ ইদানীং প্রচণ্ড ড্রিংক করছিল৷ ওকে শোধরাতে পারলাম না৷ আত্মসম্মান নিয়ে ওর সঙ্গে থাকা আর সম্ভব হল না৷ জানি, ও আপনার খুব প্রিয়পাত্র৷ আমার কথা আপনি বিশ্বাস করবেন না৷ তবুও বললাম৷’

সম্রাটের মতো ছেলে ভাইয়ের গায়ে হাত তুলেছে, সত্যিই এটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না৷ ভাইকে আর্ট কলেজে পড়ানোর জন্য ও কত কৃচ্ছসাধন করেছে, আমি জানি৷ তবুও জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের মা এখন কোথায় বাদশা?’

‘কসবার ফ্ল্যাটেই আছেন৷ দাদার মাথা চিবিয়ে খেয়েছেন৷ আমাকে তাড়িয়ে সব থেকে খুশি উনি৷’ বাদশা আরও বিষ ওগরাতে যাচ্ছিল৷ তখনই নির্মলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে এসে মেঘদূত আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল৷ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে মেঘদূতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাদশা অন্যদিকে সরে গেল৷

দু-চারটে কথা বলার পর টের পেলাম, নির্মলবাবু পাঁড় মোহনবাগান সাপোর্টার৷ ওঁর সঙ্গে ময়দানের গল্প করার ফাঁকে আমার কারমারকরের কথা মনে পড়ল৷ আসল কথাগুলো আগে জেনে নেওয়া দরকার৷ বললাম, ‘কলকাতায় এবার ক’টা বিগ বাজেটের পুজো হচ্ছে, আমাকে আইডিয়া দিতে পারেন? এই ধরুন, এক কোটি থেকে দেড় কোটি টাকার বাজেটের?’

নির্মলবাবু বললেন, ‘প্রায় পঁচিশটার মতো হবে৷ সত্যি কথা অবশ্য কেউ বলতে চায় না৷ ধরে নিন, যে ক্লাবের পুজোয় মিনিস্টার বা রুলিং পার্টির লিডার, এম এল এ বা লোকাল কাউন্সিলার আছে, তাদের বাজেট ওই রকমই হবে৷’

‘এত টাকা জোগাড় হয় কোত্থেকে?’

‘এই বছর পাঁচেক আগেও আমাদের খুব সুদিন ছিল ভাই৷ চিটফান্ডগুলো পুজোয় প্রচুর টাকা ঢালত৷ মিনিস্টার ছাড়াও আমাদের চলে যেত৷ কিন্তু যবে থেকে চিটফান্ড মালিকদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে, তবে থেকে আমাদের ভাঁড়ারে টান৷ ইদানীং মোবাইল ফোনের কোম্পানিগুলো আমাদের কিছু হেল্প করছে৷ কিন্তু সবার তো ওই রকম কর্পোরেটদের কাছে পৌঁছোনোর ক্ষমতা নেই৷ তাই সাধ থাকলেও, সাধ্য নেই৷ আমার ভাই…পাড়ার সাপোর্ট আছে৷ তাই টাকাটা উঠে যায়৷’

নির্মলবাবু কথাটা বললেন বটে, কিন্তু শুনে মনে মনে হাসলাম৷ ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, অনেক পয়সাওয়ালা লোকের নাড়া ওঁর কাছে বাঁধা৷ তাঁরা ওঁকে খুশি করার জন্য এগিয়ে আসবেনই৷ প্রশ্নটা সরাসরি করা উচিত হবে কিনা, বুঝতে পারছিলাম না৷ তবুও, করেই ফেললাম, ‘আপনার পুজোর বাজেট কত?’

‘এ বছর অনেক কমে গিয়েছে৷ আসলে কী জানেন, এ বছরই আমি রিটায়ার করছি৷ কোম্পানিগুলো তা জেনে গিয়েছে৷ গত বছরও যারা আমাকে খুশি করার জন্য মুখিয়ে থাকত, তারা বুঝে গিয়েছে, আমাকে এখন পাত্তা না দিলেও চলবে৷ এ বছর কোনোরকমে পুজোটা উতরে দেব৷ কিন্তু পরের বছর থেকে আমার পুজোর কী হবে, জানি না ভাই৷’

‘গতবার সম্রাট পাল আপনাদের কয়েকটা প্রাইজ এনে দিয়েছিল৷ এবার ওকে দিয়ে কাজটা করালেন না কেন?’

‘সত্যি কথা বলব? বাজেটে কুলোল না ভাই, ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্য৷ ভাগ্যিস ওকে দিয়ে আমাদের কাজটা করাইনি৷’

‘কেন এ কথা বলছেন?’

‘সম্রাট বিরাট একটা ঝামেলার মধ্যে পড়ে গিয়েছে৷ আমি ফোরামের প্রেসিডেন্ট৷ আমার কাছে পুজো সংক্রান্ত সব খবরই আসে৷ চৈতালির ডাম্বেল মুখার্জিকে চটিয়েছে, সম্রাট সমস্যায় তো পড়বেই৷ ডাম্বেলটা ভীষণ ভিন্ডিক্টিভ টাইপের৷ ও চায়নি, ধাতুপট্টি সর্বজনীনের থিম সম্রাট করুক৷ সম্রাটকে ও অনেক টাকা অফার করেছিল৷ কিন্তু ছেলেটা এত গোঁয়ার যে, ডাম্বেলের মুখের ওপর বলে দিয়েছে, ধাতুপট্টির খোকনবাবুকে কথা দিয়ে ফেলেছে৷ সেখান থেকে সরে আসবে না৷ আমি অবশ্য অন্য কথা শুনেছি৷ বছর চারেক আগে সম্রাট চৈতালি সংঘের হয়ে একবার কাজ করেছিল৷ কিন্তু যে টাকা দেবে বলে ডাম্বেল প্রমিস করেছিল, তার পুরোটা দেয়নি৷ সেই কারণেই সম্রাটের রাগ৷’

‘ডাম্বেলবাবুর সঙ্গে ধাতুপট্টির সংঘাতটা কী কারণে?’

‘পাশাপাশি পাড়ার পুজো যে৷ প্রত্যেক বছর আমাকে ওদের ঝামেলা মেটাতে হয়৷ খোকনবাবু আজ আমার কাছে কী কমপ্লেন করে গেলেন শুনবেন? ওঁদের পুজোটা হয় গলির ভেতরে৷ পুজোর সময় লোকে যাতে বড়ো রাস্তা থেকে গলিতে ঢুকতে না পারে, ডাম্বেল তার ব্যবস্থা করেছে৷’

এমন রেষারেষি হয় নাকি পুজো কমিটিগুলোর মধ্যে! জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে?’

‘চৈতালির মেন স্পনসর এবার একটা মোবাইল ফোনের কোম্পানি৷ ঠিক পুজোর আগে লাইন বসানোর জন্য সেই কোম্পানি ধাতুপট্টির রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করবে৷ ভাবুন, পুজোর সময় কে তাহলে ওই গলির ভেতর ঠাকুর দেখতে ঢুকবে? বৃষ্টি হলে তো আরও সর্বনাশ৷ গোদের উপর বিষফোঁড়া৷ ওদের থিম আর্টিস্ট সম্রাটেরও নাকি কোনো খোঁজ নেই৷ খোকনবাবু বললেন, ও নাকি কোথায় পালিয়ে গিয়েছে৷’

সম্রাট আমাকে বলেছিল বটে, অস্ট্রিয়ায় চলে যেতে পারে৷ সেটা অন্য কেউ জানে কি না, সেটা পরখ করার জন্য জানতে চাইলাম, ‘সম্রাট পালিয়ে গিয়েছে মানে?’

‘তাই তো খোকনবাবু বলে গেলেন৷ সম্রাট ওঁদের কাছ থেকে দশ লাখ টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছিল৷ এখনও একটা বাঁশ ফেলেনি৷ সপ্তাহখানেক ধরে ও কারও ফোন ধরছে না৷ ভাইয়ের সঙ্গে ইদানীং ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে৷ ভাই নাকি বলেছে, সম্রাটের কোনো খবর রাখে না৷ একই কথা বলেছে ওর মা৷ খোকনবাবু আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায় সম্রাটের নামে এফআইআর করে এসেছেন৷ ওকে পুলিশ এখন খুঁজছে৷’

শুনে আমি চমকে উঠলাম৷ সত্যিই, সম্রাট তা হলে বিপদের মধ্যে৷ নাহ, ওর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতেই হবে৷ একটা ভালো ছেলে…তার থেকেও ভালো শিল্পীকে…পুলিশ হ্যারাস করবে, এ হতে দেওয়া যায় না৷

চার

অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল আমার৷ দিন চারেক ধরে মনে কাঁটার মতো খচখচ করছে সম্রাটের কথা৷ ছেলেটা আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিল৷ কিন্তু ওর জন্য কিছুই করে উঠতে পারিনি৷ এই সম্রাট ছেলেটাকে আমি সাত-আট বছর ধরে চিনি৷ ওকে যখন প্রথম দেখি, তখন ওর বয়েস কুড়ি-একুশ৷ আলাপের দিনটার কথা এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে৷ সেবার দুর্গাপুজোর সময় কদমতলায় এক প্রতিমার উদ্বোধন করতে গিয়েছি৷ জায়গাটা পোস্তার কাছে৷ গলির ভেতর ছোট্ট বাজেটের পুজো৷

সত্যি, চমকে গেছিলাম মঞ্চসজ্জা দেখে৷ মাটির সরা দিয়ে পুরো প্যান্ডেল৷ মাটির সরায় সুন্দর আলপনা৷ প্রচণ্ড সাহস না থাকলে এইরকম মঞ্চসজ্জা করা সম্ভবই না৷ থিমটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছে? জিজ্ঞেস করতেই অর্গানাইজাররা ময়লা পাজামা পরা একটা ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল আমার সামনে৷ নাম সম্রাট পাল৷ এত অল্প বয়েস, এই আইডিয়াটা ওর মাথায় এল কী করে? ষষ্ঠীর দিন আমাদের কাগজে সম্রাটকে নিয়ে একটা আর্টিকেল লিখেছিলাম৷ সপ্তমীর দিন থেকে লোকের ভিড় ভেঙে পড়েছিল কদমতলায়৷ একটা লেখাতেই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল সম্রাট৷ সেবার শারদ সম্মানও পেয়েছিল কদমতলা সর্বজনীন৷

পাশেই দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে বড়ো বাজেটের একটা পুজো৷ উদ্যোক্তারা আমার কাছে এসে অনুযোগ করেছিলেন, ‘আমরা অত টাকা খরচ করে…রাজস্থানি পুতুল দিয়ে মঞ্চ সাজালাম৷ লোকে ধন্য ধন্য করে গেল৷ আর সেটা আপনার চোখে পড়ল না কালকেতুদা? ওই বাচ্চা ছেলেটার মধ্যে আপনি কী এমন দেখলেন যে, অত বড়ো একটা লেখা লিখে ফেললেন?’

কলকাতায় থিম পুজো নিয়ে সংগঠকদের মধ্যে তখন মারাত্মক রেষারেষি৷ তাই ওদের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম৷ সম্রাটের কথা মনেও ছিল না৷ কিন্তু সেবার কালীপুজোর আগের দিন হঠাৎ দেখি, ওর মা রীতা পালকে নিয়ে সম্রাট আমার বাড়িতে হাজির৷ সেদিনই ছেলেটার সঙ্গে ভালো করে আলাপ হয়েছিল৷ বংশ পরম্পরায় ওদের পেশা ঠাকুর বানানো৷ ও আর্ট কলেজের ছাত্র৷ টেক্সটাইল ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করে৷ সেদিন কথায় কথায় সম্রাট বলেছিল, ও আর্ট গ্যালারিতে এগজিবিশন করতে চাওয়া আর্টিস্ট হতে চায় না৷

থিম পুজোর আর্টিস্ট হতে চায়৷ যাতে হাজার হাজার মানুষ ওর আর্ট ওয়ার্ক দেখতে পারে৷ ও এমন নতুন কিছু করতে চায়, যাতে কলকাতায় হইচই পড়ে যায়৷

পরের বার কলকাতার চারটে বড়ো পুজোর অর্গানাইজার ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সম্রাটকে নেওয়ার জন্য৷ রাতারাতি ওর দর বেড়ে গিয়েছিল, পঞ্চাশ হাজার থেকে একেবারে পাঁচ লাখে৷ কলকাতায় বড়ো পুজোর পিছনে কোনো না কোনো ‘দাদা’ থাকেন৷ প্রত্যেকেই তাঁরা বেশ ক্ষমতাশালী৷ কোন পুজোর দায়িত্ব নেবে, সম্রাট সেই ডিসিশনটা নিতে পারছিল না৷ পুজোর দশমাস আগে ও আমার কাছে এসে পরামর্শ চেয়েছিল, ‘কালকেতুদা, আমায় বাঁচান৷’

শেষে ‘দাদাদের’ সঙ্গে কথা বলে মেঘদূত মধ্যস্থতা করে দিয়েছিল৷ সে বছর উত্তর আর দক্ষিণ কলকাতায় দুটো পুজোর থিমমেকার ছিল সম্রাট৷ বাকি দুজনের কাছে ওকে কথা দিতে হয়েছিল, পরের বছর করবে৷ এমনই নাম হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার৷ প্রতি বছর কোনো না কোনো অ্যাওয়ার্ড পাওয়ায় থিমমেকারদের সামনের সারিতে এসে গিয়েছে ও৷ স্বপন দিন্দা, প্রশান্ত পাল, প্রিয়তোষ সুতার, গোবর্ধন কুইল্যা, অমল সরকার, কুন্দন রাহাদের সঙ্গে ওর নামটাও এখন উচ্চরিত হয়৷ মাঝে এক বছর নিউ আলিপুরে কৃষ্টি সংঘের ঠাকুর দেখতে গিয়ে দেখি, সম্রাট রীতিমতো স্টার৷ দর্শকরা ওর কাছে অটোগ্রাফ নিচ্ছেন৷

সেলেব্রিটি হয়ে ওঠাটাই সম্রাটের পক্ষে এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ খুন হয়ে যাওয়ার হুমকিও পাচ্ছে৷ এই যে ওর হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়াটা খুব রহস্যজনক৷ আরে, ছেলেটা খুন হয়ে যায়নি তো? আজকাল টিভি খুললেই শুধু খুনখারাপির খবর৷ কত তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে লোকে খুন হয়ে যাচ্ছে৷ আর এটা তো পেশাদারি শত্রুতা৷ হয়তো সম্রাটের লাশ কোনো হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে৷ কেউ জানে না৷ কথাটা ভাবতেই মন চঞ্চল হয়ে উঠল৷ তখনই মনে পড়ল সুদীশের কথা৷ সুদীশ নাগ, আমার বন্ধু৷ লালবাজারের নামী অফিসার৷ বহুবার রহস্যভেদে ও আমার সাহায্য নিয়েছে৷ আমাকে সাহায্যও করেছে৷ আজকাল ফেলুদা, কিরীটী আর ব্যোমকেশদের দিন আর নেই৷ শুধু মগজাস্ত্র প্রয়োগ করে রহস্যের সমাধান করা একটু কঠিন৷ অনেক প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়৷ পুলিশের কেউ সঙ্গে থাকলে সেটা ভালো পাওয়া যায়৷ ফোন করে সুদীশকে সম্রাটের সমস্যার কথা জানালাম৷ শুনে ও বলল, ‘সবার আগে ছেলেটার ফোন নাম্বার দে৷ কল লিস্ট থেকে অনেক ইনফর্মেশন পাওয়া যায়৷ দাঁড়া, আমি লোক লাগিয়ে দিচ্ছি৷ ডাম্বেল-বারবেল সব ব্যাটার ঠিকুজি-কুষ্ঠি বের করে ফেলব৷’

সম্রাট কোথায়, খবরটা হয়তো ওর মা জানেন৷ আমি জানি, ছেলেটা এমন মাতৃভক্ত, মাকে না জানিয়ে ও কোথাও যাবে না৷ ওর কল লিস্ট ঘাঁটলে হয়তো একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে, শেষ মুহূর্তে কার কার সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল৷ আমার বাড়িতে যেদিন ও এসেছিল, সেদিন বলেছিল, গত বছর কুমোরটুলির বস্তি ছেড়ে ও কসবার এক ফ্ল্যাটে উঠে গিয়েছে৷ বোসপুকুরের কাছাকাছি কোথাও৷ সেটা আমার অফিস যাতায়াতের রাস্তায় পড়ে৷ খোঁজ করে ওদের অ্যাপার্টমেন্টে যেতেই সিকিওরিটি গার্ড বলল, ‘সম্রাট স্যারদের ফ্ল্যাট কয়েকদিন ধরে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে৷’

‘কবে থেকে ওঁরা নেই? সম্রাট আর ওর মা কি একসঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছেন?’

‘না৷ একদিন রাতে মোটর অ্যাক্সিডেন্ট করে সম্রাট স্যার বাড়ি ফিরে এলেন৷ তার পরদিন থেকে আর স্যারকে দেখিনি৷ গাড়িটা ওই তো গ্যারেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ দেখুন কী অবস্থা৷ ভাগ্যি ভালো সম্রাট স্যার প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন৷’

সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি, পিছনের দিকে অনেকটা তেবড়ে গিয়েছে৷ পিছন থেকে কেউ বোধহয় ধাক্কা মেরেছিল৷ গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সম্রাটের মাকে কবে থেকে দেখতে পাচ্ছ না?’

‘স্যার, মাঝে একদিন পুলিশ এসেছিল সম্রাট স্যারের খোঁজে৷ তারপর থেকে ম্যাডামও নেই৷’

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ড্রিংকস নিয়ে বসেছি৷ রাতের দিকে এই সময়টায় টিভির চ্যানেলগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি৷ বোঝার চেষ্টা করি, সারা দিনে কোনো খবর মিস করেছি কি না? টিভি খুলেছি, এমন সময় ফুল্লরা আমার স্ত্রী এসে বলল, ‘জানো, আজ মেট্রো রেলে সম্রাটের মায়ের সঙ্গে দেখা হল৷ ভদ্রমহিলার চেহারাটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে৷’

শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার সঙ্গে কথা বললেন?’

ফুল্লরা বলল, ‘খুব বেশি না৷ শ্যামবাজার থেকে উঠেছিলেন৷ উনি গিরিশ পার্ক স্টেশনে নেমে গেলেন৷ বললেন কদমতলায় যাবেন৷ উনি জানতে চাইছিলেন, তোমার সঙ্গে কোন সময় দেখা করতে এলে, নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারবেন? ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হল, খুব টেনশনে আছেন৷’

‘সম্রাটের কথা তুমি জিজ্ঞেস করোনি?’

‘করেছিলাম৷ কিন্তু উনি এড়িয়ে গেলেন৷ কেন, সম্রাটের কি কিছু হয়েছে?’

ড্রিংকসে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘একটা সমস্যায় পড়েছে৷ তবে মিটে যাবে৷’

শুনে ফুল্লরা কিচেনের দিকে চলে গেল৷ মনে মনে ওকে ধন্যবাদ জানালাম৷ যাক, সম্রাটের মা কোথায় আছেন, তার একটা অন্তত ইঙ্গিত পাওয়া গেল৷ উনি শ্যামবাজার থেকে মেট্রোতে উঠেছিলেন, তার মানে পুরোনো পাড়া কুমোরটুলির দিকেই কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন৷ আর গিরিশ পার্কে নেমে কদমতলায় গিয়েছেন৷ তার মানে ওখানকার পুজোর কাজ ধরেছেন৷ ওই কদমতলা থেকেই সম্রাটের উত্থান৷ ও একবার আমাকে বলেছিল, জীবনে যত রোজগারই করুক না কেন, কদমতলার মণ্ডপসজ্জা দরকার হলে বিনা পারিশ্রমিকে করে দেবে৷ হয়তো এখন নিজে করার সময় পায় না৷ মাকে দিয়ে করায়৷ ভদ্রমহিলা সাইট স্পেসিফিক ইন্সস্টলেশন আর্ট সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না৷ একসময় মাটির মূর্তি গড়ার কাজে স্বামীকে সাহায্য করতেন৷ কিন্তু ছেলের পাল্লায় পড়ে নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিখে গিয়েছেন৷

ড্রিংকসে চুমুক দিচ্ছি, এমন সময় টিভির দিকে নজর গেল৷ ব্রেকিং নিউজ৷ ‘তরুণ শিল্পীর রহস্যজনক মৃত্যু৷’

বারকয়েক এই হেডিংটাই পর্দায় ঘুরে ফিরে এল৷ দেখে বিরক্তি হতে লাগল৷ চ্যানেলগুলোর এই এক দোষ৷ যে কোনো খবরকে নাটকীয় করে তোলা৷ এর পরের হেডিং, ‘নামী থিম আর্টিস্টের রহস্যজনক মৃত্যু৷’ ফের কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা৷ তার পর পর্দায় ভেসে উঠল, ‘মৃত শিল্পীর নাম সম্রাট পাল৷’ ব্যস, তারপর বেশ কয়েক মিনিট নতুন আর কোনো খবর নেই৷ নিউজ রিডার মেয়েটা একই কথা বারবার বলে যাচ্ছে৷ সম্রাট কোথায় এবং কীভাবে মারা গিয়েছে, তার কোনো উল্লেখ নেই৷ সাংবাদিকতা করি বলে জানি, খবরের চ্যানেলগুলোর মধ্যে এখন মারাত্মক রেষারেষি৷ কে আগে কোন খবর দিয়ে ক্রেডিট নেবে, তা নিয়ে৷ ফলে, পুরো খবরটা জানার আগেই ওরা টেলিকাস্ট শুরু করে দেয়৷

খবরটা দেখে মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে৷ বিশ্বাসই করতে পারছি না, সম্রাট মারা গিয়েছে! ইস, ছেলেটা আমার কাছে প্রোটেকশন চাইতে এসেছিল, অথচ দিতে পারলাম না৷ অন্য চ্যানেল খবরটা পেয়েছে কিনা, দেখার জন্য রিমোট কন্ট্রোলের সুইচ টিপতে লাগলাম৷ বাংলা টাইম বলে একটা চ্যানেলের নিউজ রিডার বলছেন, ‘থিম অ্যার্টিস্ট সম্রাট পালের আত্মহত্যা৷ বেশ কিছুদিন ধরে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন৷ তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না৷ ইদানীং পরিবারের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না৷ জানিয়েছেন শিল্পীর ভাই বাদশা পাল৷’ এর পরই পর্দায় বাদশার কান্নাভেজা মুখ৷ বলতে লাগল, দাদা এবার ধাতুপট্টি সর্বজনীনের কাজ নিয়েছিল৷ কিন্তু থিম নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছিল না৷ ও খুব আশঙ্কার মধ্যে ছিল, এবার বোধহয় পুজোয় ওর থিম ক্লিক করবে না৷ ক্রমেই কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলছিল৷ দিন দশেক আগে বাড়ি থেকে ও বেরিয়ে যায়৷ তার পর আর ফিরে আসেনি৷’

স্বদেশ টাইম-এর রিপোর্টার প্রান্তিক ছেলেটাকে চিনি৷ ও প্রশ্ন করল, ‘পুলিশকে জানিয়েছিলেন?’

বাংলা বলল, ‘দরকার মনে করিনি৷ ভেবেছিলাম, থিম খোঁজার কারণে বোধহয় কোথাও গিয়েছে৷ আমি নিজেও থিম আর্টিস্ট৷ এবার সেন্ট্রাল ক্যালকাটার চৈতালি সংঘের কাজটা আমি করছি৷ এই সময়টায় আমিও খুব ব্যস্ত স্টুডিয়োতে৷ আমার স্টুডিয়োটা অনেক দূরে৷ শিয়ালদায় আমার এক বন্ধুর বাড়িতে৷’ শুনতে শুনতে রাগে আমার শরীর চিনচিন করতে লাগল৷ বাদশা আধা সত্যি কথা বলছে৷ সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম সুদীশকে৷ ও বলল, ‘তোকেই আমি ফোন করতে যাচ্ছিলাম৷ খবরটা পেয়েছিস?’

বললাম, ‘হ্যাঁ৷ সুইসাইড, না, মার্ডার?’

‘বলা মুশকিল৷ রাত ন’টায় জগন্নাথ ঘাটের কাছে চক্ররেলের লাইনে একটা ডেডবডি ডিসকভার করে লোকাল লোকজন৷ খানিকক্ষণ আগে পোস্তা থানার ওসি ফোন করে আমায় বলল, আপনি যে থিম আর্টিস্টের খোঁজ করছিলেন, তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে৷ রেল পুলিশ ওর পার্স থেকে যে আইডেন্টিটি কার্ড পেয়েছে, সেটা সম্রাটের৷ পোস্টমর্টেম করার পর বোঝা যাবে, ট্রেনে কাটা পড়েছিল কিনা?’

‘টিভিতে সম্রাটের ভাই হিন্টস দিল, সুইসাইড হতে পারে৷’

‘মনে হয় না৷ আমি এখন চক্ররেলের লাইনেই দাঁড়িয়ে আছি৷ স্টেশন থেকে প্লেস অফ অকারেন্স মাত্তর পাঁচ-ছয় মিটার দূরে…শোভাবাজারের দিকে৷ এখানে এসে আমার মনে হল, চলন্ত ট্রেনের সামনে সত্যিই যদি সম্রাট ঝাঁপ দিত, তা হলে ওর শরীরটা অনেক দূরে ছিটকে পড়ত৷ তা কিন্তু হয়নি৷ এমনও হতে পারে, ওকে খুন করে কেউ লাইনে ফেলে গিয়েছে৷ কিন্তু তাও কতটা সম্ভব, বুঝতে পারছি না৷ পুলিশের মুখে শুনলাম, ট্রেনের ধাক্কায় মাথাটা নাকি ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে৷ কাল দুপুরের দিকে তুই একবার লালবাজারে আসিস৷ এর মধ্যে সম্রাটের ফোনের কল লিস্ট পাওয়া যাবে৷ আমি ইনভেস্টিগেশন খানিকটা এগিয়ে রাখব৷’

ফোনের লাইন কেটে দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সম্রাটের লাশের সঙ্গে কি মোবাইল ফোন পাওয়া গিয়েছে?’

সুদীশ বলল, ‘পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম৷ ওরা বলল, না পায়নি৷ এমনও হতে পারে, লাশ প্রথম যাদের চোখে পড়েছিল, মানে রেললাইনের গায়ে ঝুপড়িবাসীদের কেউ পুলিশ ডাকার আগেই ফোন হাতিয়ে নিয়েছে৷ ওদের ডেকে পাঠিয়েছি৷ ওদের সঙ্গে কথা বলে, তারপর আমি বাড়ি ফিরব৷’ শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল৷ ফের আমি টিভির সামনে বসে পড়লাম৷ নতুন কোনো খবর যদি পাওয়া যায়৷ চ্যানেলের রিপোর্টাররা পারেও বটে৷ বাদশার ইন্টারভিউ দেখিয়েই যাচ্ছে৷ চ্যানেল সার্ফ করার সময় চোখে পড়ল, ধাতুপট্টি সর্বজনীনের প্রেসিডেন্ট খোকন চাকলাদার ইন্টারভিউ দিচ্ছেন৷ বলছেন, ‘সম্রাট আমাদের কাছ থেকে অনেক টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছিল৷ ও বলতেই পারত ডিপ্রেশনে ভুগছে৷ কাজটা করতে পারবে না৷ তা না করে, কেন সুইসাইড করতে গেল, ভাবতেই পারছি না৷ ইন ফ্যাক্ট, বেশ কিছুদিন ধরে ও যোগাযোগ করছে না দেখে আমরা অলরেডি মুম্বইয়ের একজন আর্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি৷ উনি সঞ্জয়লীলা বনশালির সেট ডিজাইন করেন৷’

টিভির খবর দেখছি আর আমার রাগের পারদ চড়ছে৷ চ্যানেলগুলো সম্রাটকে তা হলে মানসিক রোগী বানিয়ে ছাড়ল৷ তখনই ড্রয়িংরুমের শো কেস-এর দিকে আমার চোখ গেল৷ কাচের ঘেরাটোপে লিওনেল মেসির একটা ফূর্তি৷ ব্রাজিল ওয়ার্ল্ড কাপের আগে সম্রাট ওর হাতে বানানো গ্লাস ফাইবারের এই মূর্তিটা আমাকে উপহার দিয়েছিল৷ এত নিখুঁত যে, এই মূর্তিটা পেলে মেসি বোধহয় নিজের বাড়িতে যত্ন করে সাজিয়ে রাখত৷ মনে মনে জেদ চেপে গেল৷ নাহ, ছাড়ব না৷ সম্রাটের এই পরিণতির জন্য যারা দায়ী তাদের খুঁজে বের করবই৷

পাঁচ

দুর্গাপুজো নিয়ে বাল কারমারকর যে সব তথ্য চেয়েছিল, দিনকয়েক আগে তা মেল করে দিয়েছি৷ তখন ও জানিয়েছিল, পুরোটা পড়ে নিয়ে তার পর আমাকে বলবে, আরও কিছু ওর দরকার আছে কিনা৷ আজ সকালে মর্নিং ওয়াক সেরে ফিরে আসার পর মেল ওপেন করে দেখলাম, ও অনলাইন৷ কন্ট্যাক্ট করতেই চ্যাট শুরু করল ও৷ ‘গুড মর্নিং ফ্রেন্ড৷ থ্যাংক ইউ৷ তোমার তথ্যগুলি খুব ইন্টারেস্টিং৷ কিন্তু এই যে তুমি দাবি করেছ, ডুরগা ফেস্টিভ্যাল জাতীয় ফেস্টিভ্যালের মতো, সেটা কিন্তু ঠিক না৷ আসলে আমাদের জাতীয় ফেস্টিভ্যাল একটা নয়৷ সরকারের চোখে তিনটে জাতীয় ফেস্টিভ্যাল৷ গান্ধী জয়ন্তী, রিপাবলিক ডে আর ইন্ডিপেনডেন্টস ডে৷’

বললাম, ‘তাই না কি?’

‘হ্যাঁ৷ জানোই তো, আমাদের দেশে এত জাতি, ধর্ম, ভাষা, আলাদা করে কোনো একটাতে জাতীয় ফেস্টিভ্যাল ডিক্লেয়ার করলে সমস্যার সৃষ্টি হবে৷ তোমাদের ডুরগা ফেস্টিভ্যাল আছে, তামিলদের পোঙ্গল, মাললায়ীদের ওনাম, গুজরাতিদের নবরাত্রি, মারাঠিদের গণেশ চতুর্থী, অসমে বিহু, উত্তর ভারতে হোলি বা দেওয়ালি, মুসলিমদের ইদ, বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা, শিখদের লোহরি৷ কোনটাকে তুমি জাতীয় উৎসব বলবে, বলো?’

এ প্রসঙ্গে কথা না বাড়িয়ে বললাম, ‘ঠিকই বলছ৷ যাক এ কথা৷ দুর্গাপুজো নিয়ে তোমার কি আর তথ্য দরকার আছে?’

‘মনে হয় না৷ মুম্বইয়ে যে সব জায়গায় বাঙালিরা বিরাট বাজেটের ডুরগা ফেস্টিভ্যাল করেন, যেমন ধরো, শিবাজি পার্ক, বান্দ্রা, জুহু, লোখন্ডওয়ালায়, তাঁরাও আমাকে হেল্প করেছেন৷ আর তোমার পাঠানো কলকাতার পুজোর ভিডিয়ো ক্লিপিংস দেখে তো আমাদের চ্যানেলের সিইও ভীষণ এক্সাইটেড৷ ডুরগা ফেস্টিভ্যালের এক সপ্তাহ আগে আমরা কলকাতায় পৌঁছোচ্ছি৷ দেখো, আমাদের যাওয়ার ব্যাপারটা যেন খুব বেশি জানাজানি না হয়৷’

আমি খুব বেশি লোককে জানাইওনি৷ মিডিয়ার লোক বলে জানি, কেন ও গোপন রাখতে বলছে৷ খবরটা লিক হয়ে গেলে, ওদের রাইভাল চ্যানেলও টিম পাঠাবে৷ গ্লোবাল চ্যানেলের কভারেজ আর এক্সক্লুসিভ থাকবে না৷ তাই লিখলাম, ‘তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, দু-একজন ছাড়া কেউ জানে না৷’

ওদিক থেকে কারমারকর উত্তর দিল, ‘কেন এ কথা বলছি, জেনে রাখো৷ আমাদের জাজেস প্যানেলে বলিউডের নামকরা বাঙালি অ্যাক্টর, ডিরেক্টর আর সিঙ্গারও থাকবেন৷ এঁদের নামগুলো আগে থেকে লোকে জেনে গেলে প্যান্ডেলে প্যান্ডেমোনিয়াম হয়ে যাবে৷ যদিও আমাদের সঙ্গে তিরিশজন বাউন্সার থাকবে৷ তবুও, তুমি যদি পুলিশের সঙ্গে কথা বলে রাখো, তা হলে ভালো হয়৷ আমরা অবশ্য মাস দু-এক আগে তোমাদের পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দিয়েছি৷’

বললাম, ‘সে ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে৷’

‘গুড৷ বন্ধু, আর একটা কথা৷ আমাদের চ্যানেল গণেশ চতুর্থীর সময় সেরা কয়েকটা কমিটিকে পুরস্কার দেয়৷ আমাদের সিইও ডিসিশন নিয়েছেন, তোমাদের ফেস্টিভ্যালের সেরা তিনটে ক্লাব আর আলাদা করে সেরা একজন আর্টিস্টকে প্রাইজ দেবেন৷ যার মোট মূল্য এক কোটি টাকা৷ আমরা কলকাতায় গিয়ে এটা ডিক্লেয়ার করতে চাই৷ অল রাইট?’

এক কোটি টাকা! মাই গুডনেস৷ বললাম, ‘এটা সত্যিই ভালো ডিসিশন৷’

‘তা হলে সেভেন্থ অক্টোবর তোমার সঙ্গে আমার তাজ বেঙ্গল হোটেলে দেখা হচ্ছে৷ বাই৷’

ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ গ্লোবাল চ্যানেল অত আর্থিক পুরস্কার দেবে, এ কথা জানতে পারলে, কলকাতার পুজো কমিটির কর্তারা মারাত্মক লাফালাফি শুরু করবেন৷ ডুরিয়ান পেইন্টস, আমরা বাংলা সামান্য আর্থিক পুরস্কার দেয়৷ সেগুলো পাওয়ার জন্যই কত রেষারেষি! গ্লোবাল চ্যানেলের সঙ্গে আমি জড়িয়ে আছি, জানতে পারলে ফোরাম কর্তারা আমার জান হারাম করে দেবেন৷ পুরস্কার পাওয়ার জন্য আমাকে কতরকম টোপ দেবেন! ভাগ্যিস, কথায় কথায় মেঘদূতকে বলে ফেলিনি!

একমাত্র পুজো কমিটি ফোরামের প্রেসিডেন্ট নির্মলবাবু ছাড়া খবরটা আর কেউ জানেন না৷ শুনে উনি আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন, ‘মুম্বইয়ের টিভি দুর্গাপুজো কভার করতে আসছে, এ তো দারুণ ব্যাপার৷ বড়ো পুজোর পুরো লিস্টটা আপনাকে মুখে মুখেই বলে দিতে পারি৷ এই ধরুন না, নিউ আলিপুরের সুরুচি সংঘ, চেতলার অগ্রণী, রাসবিহারীতে বাদামতলা আষাঢ় সংঘ, যোধপুর পার্কের ৯৫ পল্লি, সেলিমপুর সর্বজনীন, নাকতলার উদয়ন সংঘ, বেহালার সৃষ্টি বা নতুন দল, হরিদেবপুরের বিবেকানন্দ ক্লাব, অজেয় সংহতি এই তো প্রায় দশটা পুজো হয়ে গেল৷ নর্থ কলকাতায় টালার প্রগতি, বাগবাজার সর্বজনীন, হাতিবাগান, কলেজ স্কোয়ার, সন্তাোষ মিত্র স্কোয়ার তো থাকবেই৷ আর কারা ভালো করবে, সেটা খোঁজ নিতে হবে৷’

‘লেকটাউনের শ্রীভূমির কথা তো বললেন না?’

‘হ্যাঁ, ওরা এবার মাকে এক কোটি টাকার হিরের গয়না পরাবে৷ লিস্টে ওদের নামটা থাকা উচিত৷ ওহ, হ্যাঁ মনে পড়ল, সেন্ট্রাল কলকাতার ধাতুপট্টির পুজোও কিন্তু লোক টানবে৷ ওরা বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একজন নামকরা আর্ট ডিরেক্টর ক্ষিতীশ রায়কে দিয়ে কাজটা করাচ্ছে৷ ওদের গোল্ডেন জুবিলির পুজো৷ তাই প্রচুর টাকাপয়সা নিয়ে নেমেছে৷ আরে, আপনি তো জানেন, ওই যে কাজটা সম্রাট পালের করার কথা ছিল৷ বেচারি কীভাবে মারা গেল৷’

নির্মলবাবুকে বলে দিয়েছিলাম, গ্লোবাল টিভির কথাটা যেন গোপন থাকে৷ উনি দায়িত্ববান মানুষ৷ আশা করছি, কাউকে খবরটা দেননি৷ মানুষটা ভালো৷ নিজের পুজো লিস্টে রাখতে পারতেন৷ কিন্তু রাখেননি৷ পুজোর আর দিন কুড়িও বাকি নেই৷ আমাদের কাগজে মেঘদূত যথারীতি বিভিন্ন পুজোর আড়ম্বর আর বৈচিত্র্য নিয়ে লিখতে শুরু করে দিয়েছে৷ অফিসে যাতায়াতের পথে দেখি, ওর টেবলের সামনে পুজো ফোরামের কর্তারা পাবলিসিটি পাওয়ার আশায় হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন৷ গতবারও সম্রাটকে বসে থাকতে দেখেছি৷ ওকে নিয়ে মেঘদূত বড়ো বড়ো লেখা লিখেছে৷ ইস, সম্রাট এবার কাজ করার সুযোগ পেলে গ্লোবাল টিভির প্রাইজটা ঠিক তুলে নিত৷

ছেলেটা মারা গিয়েছে কিনা, সে সম্পর্কে আমি আর সুদীশ নিশ্চিত হতে পারছি না৷ হ্যাঁ, চক্ররেলের লাইনে একটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা সম্রাটেরই কিনা, তা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ৷ অনেকগুলো কারণ৷ এক, ময়না তদন্তের রিপোর্ট৷ বডিতে বিষপ্রয়োগের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে৷ তার মানে, সুদীশ যা তখন আন্দাজ করেছিল, সেটাই ঠিক৷ ট্রেনের ধাক্কায় সম্রাটের মৃত্যু হয়নি৷ অথবা ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও আত্মহত্যা করেনি৷ আরও বড়ো তথ্য, ফরেন্সিক ডাক্তাররা বলেছেন, লাশটা মৃত্যুর একদিন পরে রেললাইনে পাওয়া যায়৷ সুদীশ আর আমি এ নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছি৷ যদি ধরেই নিই, বিষ খেয়ে সম্রাট আত্মহত্যা করেছে, তাহলে একটা দিন ওর লাশ কোথায় ছিল? কে ওকে রেললাইনে ফেলে রেখে গেল?

দুই, মর্গে লাশ দেখে সম্রাটের মা রীতা পাল মানতে চাননি, ওটা ছেলের৷ মুখটা এমন বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, সম্রাটকে চেনা যাচ্ছিল না৷ পুলিশ লাশের উপর থেকে চাদর সরিয়ে দেওয়ার পর রীতা পাল বলেছিলেন, ছেলের ডান হাতে একটা জড়ুল ছিল৷ লাশের হাতে সেটা নেই৷ অদ্ভুত ব্যাপার, বাদশা কিন্তু মর্গে গিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল৷ পোশাক দেখে ও দাবি করেছিল, লাশ সম্রাটেরই৷ ব্র্যান্ডেড জামাটা ও দাদাকে কিনে দিয়েছিল সাউথ সিটি মল থেকে৷ রীতা পাল সৎকারের জন্য লাশ নিতে চাননি৷ শেষ পর্যন্ত পুলিশ মৃতদেহ বাদশার হাতে তুলে দেয়৷

সন্দেহের তৃতীয় কারণ, সম্রাটের কল লিস্ট থেকে সুদীশ অনেকগুলো তথ্য আবিষ্কার করেছে৷ সত্যিই, বেশ কিছুদিন সম্রাট ইউরোপে ছিল৷ হিসেব করে দেখেছি, যেদিন ও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, তার এক সপ্তাহ পরেই ও অস্ট্রিয়ায় চলে যায়৷ সেখান থেকে মাকে রোজ ফোন করেছে৷ অস্ট্রিয়ার পোর্টচ্যাখ শহরে সম্রাট প্রায় তিন সপ্তাহ ছিল৷ ওখানেই ওয়ার্ল্ড বডি পেইন্টিং কম্পিটিশনটা হয়৷ আজকাল গুগল সার্চ করে অনেক তথ্য পাওয়া যায়৷ সুদীশ নেটে খোঁজ করে জেনেছে, ওয়ার্ল্ড বডি পেইন্টিংয়ে সম্রাট ফার্স্ট প্রাইজ পায়৷ তার মূল্য প্রায় এগারো লাখ টাকার মতো৷ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ইউরোপের নামী কাগজগুলোতে ওর ছবি ছাপা হয়েছিল৷ ভেবে খুব খারাপ লেগেছিল, ছেলেটা দেশের জন্য এত বড়ো একটা সম্মান নিয়ে এল, অথচ এখানকার মানুষ তা জানতেই পারল না৷

সম্রাট শেষ ফোনটা করেছিল ওর মাকে৷ আশ্চর্য, যেদিন রাতে ডেডবডি পাওয়া যায়, সেই কলটা সেদিন দুপুরের৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী, বিষপ্রয়োগের চবিবশ ঘণ্টা আগে যদি ওর মৃত্যুই হয়ে থাকে তাহলে ও মাকে পরদিন দুপুরে ফোন করল কী করে? সুদীশ বলেছিল, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায় কালকেতু৷ এই ছেলেটা মারা যায়নি৷ কোনো কারণে আত্মগোপন করে আছে৷’

বলেছিলাম, ‘তাই যদি হয়, তাহলে বাদশা কেন জোর দিয়ে বলল, লাশটা সম্রাটের?’

‘সেই কারণটাও জানতে হবে৷ নিশ্চয়ই কোনো স্বার্থ জড়িয়ে আছে৷ যাক গে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রীতা পাল জানেন, ওঁর ছেলে এখন কোথায়৷ উনি এখন কসবার বাড়িতে আছেন৷ ওঁর পিছনে ওয়াচার ফিট করেছিলাম৷ তারা এসে খবর দিল, ভদ্রমহিলা কদমতলায় থিম পুজোর দায়িত্ব নিয়েছেন৷ রোজ সেখানে যাতায়াত করছেন৷ তুই গিয়ে একবার কথা বলে দেখতে পারিস৷ আমার মনে হয়, তোকে উনি সত্যি কথাটা বলবেন৷’

‘একটা কাজ করা যায় না সুদীশ? রীতা পালের যদি ডিএনএ টেস্ট করা হয়, তা হলেই তো ধরা পড়ে যাবে, ডেডবডিটা সম্রাটের ছিল কি না৷’

সুদীশ বলেছিল, ‘তাহলে তো খুব ভালো হয়৷ তুই কায়দা করে ভদ্রমহিলাকে রাজি করা৷ ওঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিন্তু ডিএন-এর জন্য ব্লাড স্যাম্পেল নেওয়া যাবে না৷’

সুদীশের পরামর্শমতো রীতা পালের কাছে আমি গিয়েছিলাম৷ কসবার বাড়িতে যেদিন যাই, সেদিন প্রতিটি কথার ফাঁকে উনি হাহুতাশ করেছিলেন, ‘ছেলেটা আপনার ভরসায় ছিল কালকেতুবাবু৷ কিন্তু আপনি তো ওকে গুরুত্বই দিলেন না৷ যদি দিতেন, তা হলে বেচারা উধাও হয়ে যেত না৷’

শুনে খারাপই লাগছিল৷ জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার কাকে সন্দেহ হয়?’

‘কাকে আবার, বাদশাকে৷ কতবার বলেছি, ভাই তোর সর্বনাশ করে দেবে৷ তোকে ভাঙিয়ে অনেক ওপরে উঠে যাবে৷ ঠিক তাই হল৷ এবার ওর থিম চুরির কথা তো সম্রাট নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছে৷ ভাগ্যিস ছেলে এই ফ্ল্যাটটা আমার নামে কিনেছিল৷ না হলে শয়তানটা ফ্ল্যাট থেকে আমাকে বের করে দিত৷’

‘কিন্তু সম্রাটকে মেরে বাদশার কী লাভ?’

‘লাভ…ইনসিওরেন্সের টাকা৷ কম না কি? সম্রাট পাঁচ লাখ টাকার ইনসিওরেন্স করেছিল৷ নমিনি করেছিল ভাইকে৷ বারণ করেছিলাম৷ আমার কথা শুনল না৷ তখন ওর এমন ভাইপ্রীতি৷ সেই টাকা হাতানোর জন্য বাদশা এখন ঘুরঘুর করছে৷ বেসিক্যালি মতলববাজ৷ মাঝে মাঝে মনে হয়, ওকে পেটে না ধরলেই ভালো হত৷ আরে, ও এমনটা ছিল না কালকেতুবাবু৷ ওর একজন লাভার জুটেছে৷ সে ওর জীবনে আসার পর থেকেই ছেলেটা আমার বিগড়ে গেল৷ বড়োলোকের মেয়ে, আমার একেবারে পছন্দের নয়৷ এ নিয়ে ছেলের সঙ্গে প্রায়ই আমরা ঝগড়া হত৷’

রীতা পালের কথাবার্তার অসঙ্গতি খুঁজে পাচ্ছিলাম৷ বাদশার ঘাড়ে উনি সব দোষ চাপাচ্ছিলেন বটে, কিন্তু আমি মানতে পারছিলাম না৷ ফরেন্সিক ডাক্তারদের কথামতো যদি বিষপ্রয়োগে সম্রাটের মৃত্যু হয়ে থাকে তাহলে সেই সুযোগ বাদশা পাবে কোথায়? ও তো মাস দু-এক আগে কসবার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে৷ সেই সময় ইউরোপ থেকে ফিরে এসে সম্রাট কোথাও বাদশার সঙ্গে দেখা করেছিল কি না, তা অবশ্য আমরা জানি না৷ যাই হোক, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য রীতা পালকে আমি রাজি করিয়েছিলাম৷ ব্লাড স্যাম্পেল হায়দরাবাদের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে৷ রিপোর্ট আসতে হপ্তা দুয়েক সময় নেবে৷ অর্থাৎ ততদিনে পুজো এসে যাবে৷ আর তখনই আমরা নিশ্চিত হতে পারব, লাশটা সম্রাটের ছিল কি না?

এদিকে, সুদীশ অ্যাডভান্সড ট্রেনিং নিতে মাসখানেকের জন্য হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে গিয়েছে৷ পুজোর আগেই ওর ফেরার কথা৷ মোটামুটি আমরা একমত, সম্রাট কোথাও লুকিয়ে আছে৷ সুদীশ বলে গিয়েছে, ‘আমাদের কাজ হচ্ছে, রেললাইনে যে লাশটা পাওয়া গিয়েছিল, সেটা কার, খুঁজে বের করা৷ আমি বুদাপেস্ট থেকে ফিরে আসার আগে তুই খোঁজার চেষ্টা করিস৷ এ ব্যাপারে পুলিশের কোনো দরকার হলে পোস্তা থানার ওসি কমলেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ করিস৷ ও তোকে খুব সম্মান করে৷’

ডাম্বেলবাবুকে সুদীশ একপ্রস্থ রগড়ে গিয়েছে৷ পরে আমিও ওঁর সঙ্গে কথা বলেছি৷ থ্রেট কল নিয়ে কথা তুলতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘বিশ্বাস করুন কালকেতুবাবু৷ সম্রাটকে কারা খুনের হুমকি দিয়েছিল, আমি সত্যি জানি না৷ বাল-বাচ্চা নিয়ে সংসার করি৷ পাড়ায় আমার একটা সুনাম আছে৷ আমি কেন তুচ্ছ কারণে সম্রাটকে মেরে ফেলতে যাব৷ হ্যাঁ, ও যখন আমাকে রিফিউজ করে, তখন আমার ইগোতে লেগিয়েছিল৷ চৈতালি ক্লাবের ছেলেপেলেরাও খুব চটে গিয়েছিল৷ তাদের মধ্যে কেউ হয়তো ফোন করে ওদের সঙ্গে চ্যাংড়ামি মেরে থাকবে৷ সবাই তো ওর চেনা৷’

‘এ ধরনের চ্যাংড়ামি মারাটাও তো অপরাধ৷’

‘জানি৷ কিন্তু সম্রাট এত বুদ্ধিমান ছেলে হয়েও থ্রেট কল সিরিয়াসলি নিল কেন, কে জানে? আপনাকে একটা খবর দিই৷ আমার ক্লাবের একটা ছেলে কয়েকদিন আগে কদমতলার কর্তাদের ইনভিটেশন কার্ড দিতে গিয়েছিল৷ সে নাকি সম্রাটের মতো একজনকে জগন্নাথ ঘাটে স্নান করতে দেখেছে৷ যদি চান, সেই ছেলেটাকে আপনার কাছে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি৷’

ডাম্বেলবাবুর কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম৷ আমার আর সুদীশের ধারণাই ঠিক৷ সম্রাট কোথাও লুকিয়ে আছে৷ সেই জায়গাটা পোস্তা, নেবুতলা আর জগন্নাথ ঘাটের রেডিয়াসের মধ্যে৷ কিন্তু ওই অঞ্চলটা এত ঘিঞ্জি যে, কাউকে খুঁজে বের করা মুশকিল৷ ঠিক করে নিলাম, পোস্তা থানায় গিয়ে ওসি’র সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে৷ পারলে পুলিশের ওয়াচাররাই পারবে সম্রাটকে খুঁজে বের করে দিতে৷

ছয়

নবমীর দিন সকালে তাজ বেঙ্গল থেকে বাল কারমারকরের ফোন এল, ‘ফ্রেন্ড, বেলা বারোটার সময় কি তুমি একবার আমাদের টিমের সঙ্গে বেরোতে পারবে?’

ষষ্ঠীর দিন সকাল থেকে অষ্টমীর রাত পর্যন্ত গ্লোবাল টিভি টিমের সঙ্গে ঘুরেছি৷ নির্মলবাবু যে সব পুজোর লিস্ট দিয়েছিলেন, তার প্রত্যেকটাতে আমরা গিয়েছি৷ আর্ট-এর কাজ, আলোর ব্যবহার, পরিবেশ, দর্শকদের উন্মাদনা দেখে জাজেস প্যানেল অভিভূত৷ সুরুচি সংঘ আর নাকতলা উদয়ন সংঘে গিয়ে কারমারকর আমাকে বলেই ফেলল, ‘ফ্রেন্ড, তুমি যা বলেছিলে, সেটা ঠিক৷ তোমাদের ডুরগা ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে আমাদের গণেশ চতুর্থীর কোনো তুলনাই হয় না৷ আমাদের চ্যানেলে মাত্র একদিন টিজার দেখিয়েছি৷ তাতেই হোল ওয়ার্ল্ড থেকে মারাত্মক রেসপন্স৷’

গ্লোবাল টিভি টিমের সঙ্গে আসা বলিউডের জাজেস’রা সবাই কলকাতার৷ কেউ কেউ কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে মুম্বই চলে গিয়েছেন৷ তাঁদের অনেকেই আমাকে বললেন, ‘কলকাতার পুজোর এত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে? নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না ভাই৷ কী আর্টওয়ার্ক, কী কনসেপ্ট! কয়েকটা প্যান্ডেলে এত সুন্দর মূর্তি দেখলাম, ভাবতেই খারাপ লাগছে, সেগুলো বিসর্জন দেওয়া হবে৷’ একদিন ডিনার করার ফাঁকে বিখ্যাত ফিল্ম ডিরেক্টর অনুরাগ চ্যাটার্জি আমাকে বললেনও, ‘মিঃ নন্দী, কলকাতার দুর্গাপুজো নিয়ে বাংলার কি কেউ কোনো উপন্যাস লিখেছেন? লিখে থাকলে আমাকে বইটা পাঠাবেন? সেই গল্প নিয়ে আমি ফিল্ম বানাতে চাই৷ গণেশ চতুর্থী নিয়ে আমার একটা মারাঠি ছবি কিন্তু কান ফেস্টিভ্যালে জুরি পুরস্কার পেয়েছে৷’

এখন কাগজের অফিস পুজোর সময় বন্ধ থাকে৷ নবমীর সন্ধ্যায় ফুল্লরাকে নিয়ে ঠাকুর দেখব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম৷ আর কোনো কাজে নিজেকে জড়াব না৷ সকালে একটু পরেই সুদীশ আসবে৷ সম্রাটের কেসটা কোথায় দাঁড়িয়ে, তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য৷ কিন্তু তার মধ্যে কারমারকরের ওই ফোন৷ ওকে বললাম, ‘বেলা বারোটায় কোথায় যাবে? তোমরা তো লিস্ট অনুযায়ী শুটিং সেরেই ফেলেছ৷’

কারমারকর বলল, ‘আজকের ইংরেজি কাগজে দেখলাম, তোমাদের এখানে কদমতলা বলে একটা জায়গায় দারুণ থিমের পুজো হয়েছে৷ আমরা শুট করতে চাই৷ তুমি কি যেতে পারবে?’

কদমতলা নামটা শুনে আমার অনিচ্ছে দূর হয়ে গেল৷ বললাম, ‘নিশ্চয়ই যাব৷ ওখানকার অর্গানাইজারদের সবাইকে আমি চিনি৷’

কারমারকর বলল, ‘থ্যাংক ইউ, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি৷ তুমি তাজ বেঙ্গলে চলে এসো৷’

কারমারকরের গাড়ি আর সুদীশের জন্য অপেক্ষা করছি৷ এমন সময় নির্মলবাবুর ফোন, ‘কী মশাই, কোনো খবরটবর পেলেন? মুম্বইয়ের ওঁরা কাদের ফার্স্ট করলেন?’

বললাম, ‘এখনও ওরা ডিক্লেয়ার করেনি৷ আর তো মাত্র একটা দিন৷ একটু ওয়েট করুন না৷’

‘আরে মশাই, ফোরামের মেম্বাররা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে৷ সবার ধারণা, রেজাল্ট আপনি জানেন, কিন্তু বলছেন না৷ টোটাল প্রাইজ মানিটা তো কম নয়৷ কার কপালে কত নাচছে, বলুন তো?’

শুনে হাসি পেল৷ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবার একই প্রশ্ন৷ আবদারটা এমন লেভেলে গিয়েছে যে, কলকাতার নামকরা এক পুজোর কর্তা গত পরশুদিন ফোন করে আমাকে বললেন, ‘গ্লোবাল টিভির প্রাইজটা যদি আমাদের পাইয়ে দেন, তা হলে টেন পার্সেন্ট আপনার৷’ সঙ্গে সঙ্গে ফোন নামিয়ে রেখেছিলাম৷ অচেনা নম্বর দেখলে এখন আর ফোন ধরছি না৷ অষ্টমী পুজোর মধ্যেই অন্যান্য কম্পিটিশনের প্রাইজগুলো ডিক্লেয়ার করা হয়ে গিয়েছে৷

শুধু কারমারকরেরা ঠিক করেছে, দশমীর দিন সকালে অ্যানাউন্স করবে৷ সেই কারণে, তাজ বেঙ্গলের বলরুমে পুজো ফোরামের সব কর্তা ও মিডিয়ার লোকজনদের ওরা ডেকেছে৷ নির্মলবাবুকে এড়ানোর জন্যই বললাম, ‘আপনাকে কথা দিচ্ছি, রেজাল্ট জানার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকেই প্রথম খবরটা দেব৷ এখন ছাড়ি নির্মলবাবু৷ আমাকে কদমতলায় যেতে হবে৷’

গ্লোবাল টিভির টিমটা নিয়ে যখন আমরা কদমতলায় পৌঁছোলাম, তখন ঠিক বেলা একটা৷ আমরা মানে, সুদীশ আর আমি৷ কদমতলার পুজো হয় গলির অনেকটা ভিতরে৷ গাড়ি কালাকার স্ট্রিটের মোড়ে রেখে আমারা যখন প্যান্ডেলের কাছে পৌঁছেছি, তখন হঠাৎ ফুটপাতে একজন কুষ্ঠরোগীকে চোখে পড়ল৷ একটা ঠেলাগাড়ির নীচে বসে আছে৷ হাত-পায়ের আঙুলে ব্যান্ডেজ৷ সিনবোনে গ্যাদগ্যাদে ঘা৷ নাক আর কানেও ক্ষত৷ বড়বাজারের এই অঞ্চলটায় মাঝেমধ্যে কুষ্ঠরোগীরা ভিক্ষে করতে আসে৷ কোত্থেকে আসে কে জানে? লোকটা মাথায় কম্বল ঢেকে বসেছিল৷ আমি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কম্বলটা সরিয়ে দিল৷ তখনই ওর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল৷ দেখে মনে হল, কোথায় যেন ওই চোখ দুটো দেখেছি৷

কদমতলার প্যান্ডেলে ঢুকেই আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম৷ কী অসাধারণ আইডিয়া! দেড়শো বছর আগেকার পুরানো আমলের জমিদারবাড়ি৷ শরিকি ভাগাভাগিতে বাড়িতে এখন একটাই ঘর খালি পড়ে আছে৷ যা ধুলোমলিন, পরিত্যক্ত আসবাবে ভর্তি৷ এদিকে, বাড়ির মেয়ে দুর্গা বাপের বাড়িতে এসেছেন৷ তাঁকে থাকতে দেওয়ার ঘর নেই৷ ওই পরিত্যক্ত ঘরটা তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েছে৷ দিন পাঁচেক থাকতে হবে৷ তাই দুর্গা মায়ের সঙ্গে আসা সবাই ঘরটাকে বাসযোগ্য করার চেষ্টা করছেন৷

মইয়ের ওপর উঠে মহাদেব দেওয়ালে চুনকাম করতে ব্যস্ত৷ একপাশে রঙের পাত্র ধরে তাঁকে সাহায্য করছেন গণেশ৷ অন্যপাশে পরিত্যক্ত আসবাব সরিয়ে ঘর গোছাচ্ছেন কার্তিক৷ মা দুর্গা বিশ্রাম নিচ্ছেন পড়ার ভাঙা টেবিলে৷ মেঝেতে ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে, ভয়ে আলকাতরার ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে সরস্বতী৷ ডানদিকে বেতের মোড়ার উপর বসে পড়েছেন লক্ষ্মী৷ মহিষাসুর মেঝে ঝাঁট দিচ্ছে৷ বাড়ির উঠোনে সিংহ বসে ঝিমোচ্ছে৷ সিলিংয়ে একশো বছর আগেকার একটা চাঁদোয়া৷ দেখে আমার আরও ভালো লাগল, ঘরে পুরোনো আমলের একটা পিয়ানো রয়েছে…সরস্বতীর জন্য৷ একটা দেওয়াল-সিন্দুক, মা লক্ষ্মীর জন্য৷ অন্য দেওয়ালে একটা গাদা বন্দুক ঝুলছে, কার্তিকের জন্য৷

প্রচণ্ড সাহস না থাকলে এইরকম মঞ্চসজ্জা করা সম্ভবই না৷ থিমটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছে? জিজ্ঞেস করতেই অর্গানাইজার মাঝবয়েসি যে মহিলাকে ধরে আনলেন, তিনি সম্রাটের মা রীতা পাল৷ দেখে আমার মনে পড়ল, সুদীশ বলেছিল বটে, উনি এখানে থিম পুজোর কাজটা করছেন৷ আমাকে দেখে রীতা পাল একটু চমকে উঠলেন৷ বোধহয় আমাকে আশা করেননি৷ তার ওপর বলিউডের তারকাদের চোখের সামনে দেখে উনি কেমন যেন ঘাবড়ে গেলেন৷ কারমারকর জানতে চাইল, থিমটা কী?

দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে রীতা পাল বললেন, ‘আমাদের থিমটা আবাসন সমস্যা নিয়ে৷ এই উত্তর কলকাতার বাড়ি-ঘরের অবস্থা তো জানেন৷ সেভেন্টি পার্সেন্ট বাড়ি একশো-সোয়াশো বছরের পুরোনো৷ পরিবারগুলো বেড়ে গিয়ে ঘর অকুলান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে মা দুগ্গাকে সাজানো-গোছানো ঘর আমি দিতে পারলাম না৷ মাকে বললাম, তোমারই তো বাপের বাড়ি৷ ঘরটা নিজেরাই সাফসুতরো করে নাও৷’

কারমারকরকে থিমটা বুঝিয়ে বলতেই ও বিড়বিড় করে বলল, ‘ওয়ান্ডারফুল৷ ইট গো’জ উইথ দ্য মিথ৷’ তারপর ও ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ওর টেকনিক্যাল টিমটাকে নিয়ে শুটিংয়ের কাজে৷ সেই সুযোগে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে রীতা পালকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি আমার কাছে আসবেন বলেছিলেন৷ এলেন না কেন?’

রীতা পাল বললেন, ‘এখানে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম৷ তাই সময় পেলাম না৷ আপনারা কি সম্রাটের কোনো খবর পেলেন?’

ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, উনি জানেন সম্রাট কোথায়৷ কিন্তু আমাকে বাজিয়ে নিচ্ছেন৷ তাই বললাম, ‘এখনও কোনো খবর পাইনি৷ তবে আমরা নিশ্চিত, ও বেঁচে আছে৷ রেললাইন থেকে যে লাশটা পুলিশ পেয়েছিল, সেটা সম্রাটের নয়৷ আপনার ডিএনএ-র সঙ্গে ম্যাচ করেনি৷’

‘কালকেতুবাবু, পুলিশ কি ওকে এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছে?’

‘না৷ ওর এগেনস্টে যিনি পুলিশের কাছে এফআইআর করেছিলেন, সেই খোকনবাবু কমপ্লেন তুলে নিয়েছেন৷ সম্রাট না কি পুরো টাকাটা ওঁকে ফেরত দিয়েছে৷ আপনার সঙ্গে যদি ফোনে সম্রাটের কথা হয়, তাহলে ওকে বলবেন, পুলিশ ওকে হ্যারাস করবে না৷’

‘আমাকে বাঁচালেন৷ এবার একটা সত্যি কথা বলি৷ একটু আগে আমি বললাম বটে, এখানকার পুজোর থিমটা আমার৷ আসলে তা নয়৷ থিমটা বুবলু’র…মানে সম্রাটের৷ ইউরোপে যাওয়ার আগে আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিল৷ কাউকে জানাতে ও মানা করেছে৷ অলরেডি দুটো প্রাইজ পাওয়া হয়ে গিয়েছে৷ আরও বড়ো প্রাইজ ও পেত, যদি কালাহান্ডির যোগিনী মন্দিরটা ধাতুপট্টিতে করতে পারত৷ ভগবান আছেন, বুঝলেন৷ বুবলু’র থিম চুরি করেও, বাদশা কিন্তু কোনো প্রাইজ পায়নি৷’

রীতা পালের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার নজর গেল সুদীশের দিকে৷ এক কোণে দাঁড়িয়ে ও কথা বলছে একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে৷ চোখের ইশারায় ও আমাকে ডাকল৷ তারপর বলল, ‘এ হচ্ছে কমলেন্দু৷ পোস্তা থানার ওসি৷ এ কী বলছে শোন৷’

কমলেন্দু বলল, ‘সুদীশদা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সম্রাট পাল বলে আমরা যাকে ভাবছিলাম, রেললাইনে পাওয়া সেই লাশটা আসলে কার? আমাদের আইও গতকাল তাকে আইডেন্টিফাই করেছে৷ ছেলেটার নাম সুনীল শোনপুরি…দাগি ক্রিমিনাল৷ আমরা জানতে পেরেছি, ইউরোপ থেকে ফেরার পর সম্রাট পাল পাথুরেঘাটায় একটা বাড়িতে এক মাস ভাড়াটে হিসাবে লুকিয়ে ছিলেন৷ তখন শোনপুরি তালা ভেঙে ওঁর ঘরের সব হাপিশ করে দেয়৷ জামা-কাপড়, টাকাকড়ি, পার্স, এমনকী বিদেশ থেকে জিতে আনা ট্রফিও৷ তাই শোনপুরির লাশের পরনে সম্রাটবাবুর জামা আর প্যান্টের পকেটে পার্সটা পাওয়া গিয়েছিল৷’

‘লাশটা যে শোনপুরির, সেটা জানা গেল কী করে?’

‘অন্য একটা কেস ইনভেস্টিগেট করতে গিয়ে৷ গতকালই পোস্তার এক বস্তি থেকে তিনজন অ্যান্টি-সোশ্যালকে আমরা তুলে এনেছিলাম ড্রাগ ট্রাফিকিংয়ে যুক্ত থাকার জন্য৷ মারধর করার সময় ওদেরই একজন বলে দেয়, ওদের কিং পিন হচ্ছে বস্তিরই ডন শোনপুরি৷ নর্থ ক্যালকাটার স্কুলে স্কুলে সে ড্রাগ বিক্রি করত৷ তাকে কোথায় পাওয়া যাবে, জানতে চাওয়ায় ওরা বলে, চক্ররেলের ধারে কিছুদিন আগে যে লাশটা পাওয়া গিয়েছিল, সেটা শোনপুরির৷ টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল ওদের মধ্যে৷ মদের আড্ডায় বিষ মেশানো খাবার খাইয়ে ওরা শোনপুরিকে মেরে ফেলে৷ একদিন পর এলাকায় লোড শেডিংয়ের সুযোগে ডেডবডিটা ওরা রেল-লাইনে ফেলে আসে৷ মুখটা পাথর মেরে ওরা থেঁতলে দিয়েছিল৷ যাতে কেউ চিনতে না পারে৷ আমরা শোনপুরির ঘর থেকে সম্রাটবাবুর জিনিসগুলো উদ্ধার করেছি৷’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিদেশ থেকে ও যে ট্রফিটা এনেছিল, সেটা কোথায়?’

‘থানার মালখানায় পড়ে আছে৷ চাইলে উনি ফেরত পাবেন৷’

কারমারকরের শুট করা হয়ে গিয়েছে৷ সবাই মিলে বাইরে বেরোব, এমন সময় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল৷ প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, ছুটির পর অফিস খুললেই সম্রাটকে নিয়ে একটা খবর করব৷ মিডিয়া ওকে মানসিক রোগী বানিয়ে দিয়েছিল৷ তারপর সত্য উদঘাটনের দায় আর কেউ নেয়নি৷ আমাকে লিখে ওর পুরোনো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে দিতে হবে৷ বৃষ্টি থামার পর হাঁটতে হাঁটতে কালাকার স্ট্রিটের দিকে আসছি, এমন সময় ফের রাস্তায় কুষ্ঠরোগীটাকে চোখে পড়ল৷ ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম৷ একটু আগে ওর সিনবোনে পুঁজ আর রক্ত মেশানো ক্ষত দেখে গিয়েছিলাম৷ এখন তার চিহ্নমাত্র নেই৷ কুষ্ঠরোগীর চোখের দিকে তাকাতেই আমি মনে মনে হাসলাম৷ আমার সঙ্গে চালাকি!

সাত

তাজ বেঙ্গলের বলরুমে গ্লোবাল টিভির প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন চলছে৷ হলঘর কানায় কানায় ভর্তি৷ পুজো ফোরামের সাড়ে তিনশোজন সদস্য তো আছেনই, সেইসঙ্গে তাঁদের ক্লাবের লোকজনরাও৷ বলরুমে ঢুকেই আমি কারমারকরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারা প্রাইজ পেল? ও বলল, ‘দিল্লি থেকে আমাদের চ্যানেলের সিইও এসেছেন৷ উনি অ্যানাউন্স করবেন৷ তার আগে জানাজানি হয়ে গেলে প্যান্ডিমোনিয়াম হয়ে যাবে৷’

ভেবে দেখলাম, ও সত্যি কথাটাই বলেছে৷ এখন যদি রটে যায়, কারা প্রাইজ পেয়েছে, তা হলে ফোরামের অর্ধেক কর্তাই অসন্তুষ্ট হয়ে বলরুম ছেড়ে চলে যাবেন৷ ওঁদের মধ্যে এমন রেষারেষি৷ এমনিতেই ওঁরা বলরুম পর্যন্ত ঢাকিদের নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন৷ যাতে প্রাইজ জেতার পর ঢাক বাজিয়ে বিজয় উৎসব শুরু করতে পারেন৷ কিন্তু অন্য গেস্টদের অসুবিধে হবে বলে হোটেল সিকিউরিটি তাদের আটকেছে৷ সেই কারণে ফোরাম কর্তারা চটে আছেন৷ তাজ বেঙ্গলে ঢোকার সময় দেখেছি, চিড়িয়াখানার দিকটায় প্রায় শ’খানেক ঢাকি হাজির৷ ঢাকের শব্দে কান পাতা দায়!

বিরাট স্ক্রিনে পুরো অনুষ্ঠানটা দেখানো হচ্ছে৷ মুম্বইয়ের গণেশ চতুর্থীর বিসর্জনে কী হয়, তার ক্লিপিংস চলছে পর্দায়৷ মুগ্ধ হয়ে দেখছি৷ মিছিলে গণপতির বিশাল বিশাল মূর্তি৷ নাচ-গানের মাঝে সমবেত কণ্ঠে, ‘গণপতি বাপ্পা, মোরিয়া৷’ সেইসময় ফোন করে সুদীশ আমায় ডাকল, ‘চট করে বেরিয়ে আয়৷ সম্রাট তোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে৷ আমরা উলটোদিকের রেস্তরাঁয় বসে আছি৷’

নবমীর দিন সকালে কদমতলার রাস্তায় আমি ইচ্ছে করলেই সম্রাটের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম৷ কুষ্ঠরোগী সেজে ও রাস্তায় কেন বসেছিল, তা অবশ্য আমার মাথায় ঢোকেনি৷ ভাগ্যিস, অল্পসময়ের জন্য বৃষ্টিটা হয়েছিল৷ ওর পা থেকে রং করা পুঁজ আর ক্ষতের চিহ্ন বৃষ্টির জলে ধুয়ে গিয়েছিল৷ সেটা বোধহয় সম্রাট খেয়াল করেনি৷ আমাকে ও চকমা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু আমি চিনতে পেরেছিলাম ওর চোখ দুটো দেখে৷ ওর চোখ দুটো এমন যে, মনে হয় সবসময় কাজল পরে আছে৷ গাড়িতে ওঠার আগে সুদীশকে বলেছিলাম, ‘আমরা যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি সে বডি পেন্টিংয়ে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন৷ রাস্তায় কুষ্ঠরোগী সেজে বসে আছে৷ আগে ওকে তুলে থানায় নিয়ে যা৷ তারপর পারলে ওকে কসবার বাড়িতে পৌঁছে দিস৷’

দু-মিনিটের মধ্যে রেস্তরাঁয় গিয়ে দেখলাম, সুদীশ আর কমলেন্দুর মাঝে সম্রাট বসে আছে৷ পরনে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি৷ মাথা নেড়া, দাড়ি-গোঁফ কামানো৷ আমাকে দেখে উঠে এসে প্রণাম করে বলল, ‘আপনাকে ফাঁকি দেওয়া যে কতটা কঠিন, কাল তা বুঝতে পারলাম কালকেতুদা৷’

হেসে বললাম, ‘মাথা নেড়া করলে কেন, আগে সেটা বলো?’

‘বডি পেন্টিং কম্পিটিশনে সাজতে গিয়ে৷ এখানে ফিরে আসার পর চুল সামান্য গজিয়েছিল৷ কিন্তু দিনকয়েক আগে জগন্নাথ ঘাটে গিয়ে ফের কামিয়ে ফেললাম৷ ভাবছি, এখন থেকে নেড়াই থেকে যাব৷ আমার মাথায় পনিটেল মা একেবারেই পছন্দ করে না৷’

‘তোমার বন্ধুবান্ধবদের কারও সঙ্গে রিসেন্টলি দেখা হয়েছে?’

‘ইউরোপ থেকে ফেরার পর আর্টিস্টদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছিল৷ প্রত্যেকে আমাকে ভয় দেখিয়েছিল, পুজো অবধি লুকিয়ে থাক৷

বলেছিল, আমি যদি কালাহান্ডি মন্দিরের থিম চুরি নিয়ে কোনো কথা বলি, তাহলে পুজো কমিটি ফোরামের কোনো এক মাথা আমাকে ফলস কেস দিয়ে বিহাইন্ড দ্য বার করে দেবেন৷ তাই এ কটা দিন অ্যাবসকন্ড করেছিলাম৷ এখন বুঝতে পারছি, সেই লোকটা কে?’

‘তোমার লাশ পাওয়া গিয়েছে, খবরটা কখন পেয়েছিলে?’

‘আমি তখন কদমতলা ক্লাবের সেক্রেটারি রতনদার বাড়িতে৷ কেউ জানত না, রাত জেগে ওখানকার প্যান্ডেলে তখন কাজ করছি৷ টিভিতে বাদশার ইন্টারভিউও দেখেছি৷ ও বলেছে, লাশের পরনে যে জামাটা ছিল, সেটা নাকি ও আমাকে প্রেজেন্ট করেছিল৷ আটারলি লাই৷ ওই জামাটা মা আমাকে পয়লা বৈশাখে কিনে দিয়েছিল৷’

‘যে ছেলেটার লাশ পাওয়া গিয়েছে, সে তোমার জামা আর পার্সটা পেল কী করে? চুরি করেছিল?’

‘হ্যাঁ৷ ছেলেটার কথা কালই আমাকে সুদীশবাবু বললেন৷ ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল৷ কল্যাণী এক্সপ্রেস হাইওয়ের ধারে একটা পাব-এ৷ আমি তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷ আমার থাকার একটা জায়গা দরকার জেনে, ও বলেছিল, নর্থ ক্যালকাটায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়ার ব্যবস্থা করে দেবে৷ জায়গাটা কুমোরটুলির কাছে বুঝে আমি রাজিও হয়ে গিয়েছিলাম৷ দু-দিন পর শোনপুরি ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল৷ কিন্তু ও যে ড্রাগ প্যাডলার, আমি কয়েকদিন পরই জানতে পেরে যাই৷ মানুষকে বিশ্বাস করা উচিত নয় কালকেতুদা৷ সাবধান হওয়ার আগেই ও যে আমার সর্বস্ব চুরি করে নেবে, তখন ভাবতেও পারিনি৷’

‘একটা জিনিস বলো তো, কারা তোমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল?’ ‘বলে আর কী হবে কালকেতুদা? ওটা নিজের গায়ে থুতু ছেটানো হবে৷ ইউরোপে যাওয়ার আগে আমার উপর অ্যাটেম্পটও হয়েছিল৷ রাতে গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিলাম৷ বিজন সেতুর ওপর একটা গাড়ি পিছন থেকে প্রচণ্ড স্পিডে ধাক্কা মেরে চলে যায়৷ ব্রিজের ওপর থেকে নীচের রেললাইনে পড়ে যেতে পারতাম৷ কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট থাকায় আটকে যাই৷ তারপর আর কসবার ফ্ল্যাটে থাকাটা নিরাপদ মনে করিনি৷’ এমন সময় সুদীশের কাছে ফোন এল৷ দু-একটা কথা বলে লাইন কেটে দিয়ে সুদীশ বলল, ‘চল কালকেতু, বলরুমে যেতে হবে৷ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকেরা ডাকছে৷ সম্রাটকে ওখানে নিয়ে যেতে হবে৷’

বলরুমে ঢুকে দেখলাম, পুরস্কার বিতরণ শুরু হতে যাচ্ছে৷ এত ভিড় যে, সামনের দিকে যাওয়ার উপায় নেই৷ একেবারে পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম, মঞ্চে পাশাপাশি বসে আছেন রামকৃষ্ণ মিশনের সর্বানন্দ মহারাজ, নাখোদা মসজিদের আবদুল বুখারি আর কলকাতার আর্চবিশপ রিকার্ডো গোমস৷ তিন ধর্মের তিন প্রতিনিধিকে দেখে মনটা ভরে গেল৷ এঁরাই মনে হয়, প্রাইজ দিতে এসেছেন৷ নিশ্চয়ই ইভেন্ট ম্যানেজারের আইডিয়া৷ কলকাতাই পারে সর্বধর্ম সমন্বয় করতে৷

অ্যাঙ্কর বাল কারমারকর বলল, ‘এবার সব প্রতীক্ষার শেষ৷ কলকাতার সেরা তিনটে পুজো বেছে দিয়েছেন আমাদের সেলেব্রিটি বিচারকরা৷ দুঃখের কথা, বিচারকরা প্রত্যেকেই খুব ব্যস্ত মানুষ৷ তাই তাঁরা মুম্বইতে ফিরে গিয়েছেন৷ আমাদের বিচারকদের চোখে গ্লোবাল টিভির কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছে নিউ আলিপুরের সুরুচি সংঘ৷’ সঙ্গে সঙ্গে একদল উল্লাসধ্বনিতে বলরুম ফেটে পড়ল৷ ওদের হাতে পুরস্কারের তিরিশ লাখ টাকা আর ট্রফি তুলে দিলেন সর্বানন্দ মহারাজ৷

দ্বিতীয় হয়েছে লেক টাউনের শ্রীভূমি৷ যতটা উচ্ছ্বাস আশা করেছিলাম, শ্রীভূমির লোকেরা ততটা দেখাল না৷ পুরস্কারের পঁচিশ লাখ টাকা ‘নাখোদা মসজিদের আবদুল বুখারির হাত থেকে নিয়ে ওদের প্রতিনিধি বললেন, আমরা গর্বিত এই পুরস্কার পেয়ে৷ কিন্তু টাকাটা আমরা উৎসর্গ করছি বসিরহাটের এক মাদ্রাসার উন্নতিকল্পে৷’ শুনে হাততালিতে বলরুম ফেটে পড়ল৷ এরপর তৃতীয় সেরা হল আহিরীটোলা সর্বজনীন৷ আর্চ বিশপের হাত থেকে শুধু ট্রফিটা নিয়ে ওঁরা বললেন, ‘পুরস্কারের কুড়ি লাখ টাকা আমরা গাদিয়াড়ার এক পুরোনো গির্জার সংস্কারের জন্য দিয়ে দিচ্ছি৷’ সঙ্গে সঙ্গে আবার হাততালির ঝড়৷

এর পরই অপ্রত্যাশিত চমক৷ কারমারকর বলল, ‘সেরা থিম আর্টিস্ট হিসাবে আমরা বেছে নিয়েছি সম্রাট পালকে৷ কদমতলা সর্বজনীনে তাঁর থিম আমাদের নির্বাচকদের অবাক করে দিয়েছে৷ সম্রাট কয়েকমাস আগে অস্ট্রিয়া থেকে ওয়ার্ল্ড বডি পেন্টিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছেন৷ তাঁকে সেরা আর্টিস্টের প্রাইজটা দিতে পেরে আমরা গর্বিত৷ সম্রাট, প্লিজ আপনি মঞ্চে আসুন৷ ওঁকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য মঞ্চে আসতে বলছি পুজো কমিটি ফোরামের প্রেসিডেন্ট মিঃ নির্মল মুখার্জিকে৷’

ঘোষণাটা হওয়ার পরই দেখলাম, সম্রাট বেরিয়ে যাচ্ছে বলরুম থেকে৷ আমি আর সুদীশ পা চালিয়ে ওকে ধরে বললাম, ‘কী ব্যাপার, তুমি চলে যাচ্ছ যে?’

সম্রাট বলল, ‘নির্মলদার হাত থেকে প্রাইজ আমি নেব না কালকেতুদা৷ জানেন, ডেথ থ্রেট কলগুলো কে আমাকে দেওয়াচ্ছিল? ওই লোকটা৷ গতবার আমাকে দিয়ে কাজ করিয়েছিল৷ অর্ধেক টাকা দেয়নি৷ সেই রাগে এবার ওদের কাজটা আমি করিনি৷ তখনই উনি ঘনিষ্ঠ লোকজনকে বলেছিলেন, সম্রাট যাতে কোত্থাও কাজ না পায়, সেটা আমি দেখব৷ ভাইকে থিম চুরির কুপরামর্শটা উনিই দিয়েছিলেন৷ আমাদের পারিবারিক অশান্তির মূলে…৷ জানেন, ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড কে? নির্মলদার ছোটোমেয়ে শুভ্রা৷ আমি শুনেছি, ভাইকে উনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি৷ তবে কালাহান্ডির মন্দিরের থিমটা চৈতালি সংঘের হয়ে ভাইকে করে দিতে হবে৷ আরও শুনুন, মোটর অ্যাক্সিডেন্টে আমাকে মেরে ফেলার সুপারি দিয়েছিলেন উনিই৷ বিশ্বাস না হয়, সুদীশদাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন৷’

চমকে উঠে আমি সুদীশের দিকে তাকাতেই ও বলল, ‘সম্রাট ঠিকই বলেছে৷ যে গাড়িটা ওর গাড়িতে ধাক্কা মেরেছিল, সেটা কসবার একটা মোটর মেকানিকের গ্যারেজে পাওয়া গিয়েছে৷ তার ড্রাইভারকে কসবা থানার পুলিশ তুলে এনেছিল৷ থার্ড ডিগ্রি দেওয়ার পর সে স্বীকার করেছে, সুপারিটা দিয়েছিলেন নির্মল মুখার্জি৷ আজই নির্মলবাবুকে আমরা অ্যারেস্ট করব৷’

শুনে সম্রাট বলল, ‘এর পরও কালকেতুদা আপনি ভাবলেন কী করে, ওই লোকটার হাত থেকে আমি প্রাইজ নেব? কখখনও না৷ উনি যেমন পুজো কমিটি ফোরামের প্রেসিডেন্ট, আমিও তেমনই এবার থিম আর্টিস্ট ফোরামের প্রেসিডেন্ট হব৷ আর্টিস্টদের বলাই থাকবে, উনি যে পুজোর প্রেসিডেন্ট থাকবেন, সেই পুজোতে কোনো আর্টিস্ট কাজ করবেন না৷ আমিও দেখব, উনি পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকেন কী করে?’

ঝড়ের গতিতে কথাগুলো বলেই সম্রাট বলরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ মঞ্চের দিকে ফিরে আসতে আসতে কারমারকরের গলা শুনতে পেলাম৷ ‘সম্রাট পাল কোনো কারণে আসতে পারেননি৷ ওঁর হয়ে পুরস্কারের পঁচিশ লাখ টাকা আর ট্রফি নিচ্ছেন ওঁর মা রীতা পাল৷’

* উপন্যাসের সব চরিত্র, নাম ও ঘটনা লেখকের কল্পনাপ্রসূত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *