থান্ডারবল
জেমস বন্ডের জীবনে মাঝে মাঝে এমন একটা সময় আসে যখন তার কাছে সবকিছুই একেবারে অর্থহীন বলে মনে হয়। আজ ছিল সেই রকমই একটা খারাপ দিন।
প্রথমত, সে নিজের কাছে নিজেই খুব লজ্জা পাচ্ছিল। শরীর তার দারুণ খারাপ লাগছিল। সেই সাথে আবার মাথাব্যথা আর দেহের গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা। খুব বেশি সিগারেট আর মদ খাওয়ার ফলে কাশির সাথে সাথে তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ধোয়ার মত একগাদা কালো কালো ফুটকি। গত রাতে সেই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে এগারো নম্বর গেলাস শেষ করার পর স্বভাবতঃই বন্ড নিজের মস্তিষ্কের করুণ অবস্থাটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। তা সত্ত্বেও সে রাজী হয়ে গেল, আর এক বাজি তাস খেলতে–একশো পাউন্ড পাঁচ পাউন্ড হিসেবে! এর ওপর আবার মদের ঝোঁকে শেষ দানটায় রি-ডাবল দিয়ে দিল, আর খেলল একটা গাধার মত।
নিজের ফ্ল্যাটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গালের কাটাটায় ওষুধ লাগাচ্ছিল বন্ড। আয়নার নিজের বিষণ্ণ চেহারা দেখে তার নিজেকে ঘেন্না করতে ইচ্ছে হল। এসব কিছুর আসল কারণ হল এই যে, বন্ডকে গত এক মাস ধরে স্রেফ অফিসে বসে কলম পেশার কাজ করতে হচ্ছে। তার ওপর তার সেক্রেটারী পড়ল জ্বরে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বন্ড ওষুধের বড়ি দুটো গিলে ফেলল। এমন সময় শোবার ঘরের টেলিফোনটা হঠাৎ দারুণ জোরে বাজতে শুরু করল।
***
জেমস বন্ড লন্ডনের রাস্তা ধরে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে সদর দপ্তরে এসে পৌছোল। লিফটে উঠে নতলায় গিয়ে উপস্থিত হল, গুপ্তচর বিভাগের বড় কর্তার সামনে। অফিসে সবাই যাকে M বলে জানে।–সুপ্রভাত, জেমস্। এত সকালে তোমাকে ডেকে আনলাম বলে কিছু মনে করো না। M-এর গলা অন্তরঙ্গ ও সদয় শোনাচ্ছে–বড় কোন উত্তেজক খবর জানাবার সময়ের মত উত্তেজিত নয় মোটেই। বন্ড খুব সন্দিগ্ধভাবে আন্দাজ করতে চেষ্টা করল যে কাজটা কি হতে পারে।
M ডেস্ক থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে পড়তে জানতে চাইল বন্ড কেমন আছে? বন্ড নিজের অধীরতাকে চাপা দিয়ে বলল, আমি একেবারেই ভাল আছি। মাথাব্যথা তো সকলেরই হয়ে থাকে মাঝেসাঝে। অল্পস্বল্প অসুস্থতাও। গোটাদুয়েক অ্যাসপিরিন খেয়ে নিলেই আবার সব ঠিকঠাক। M খুব রাগতস্বরে বললেন, খুব ভুল করেছ জেম্স। ওষুধ অসুস্থতার লক্ষণগুলো চাপা দিতে পারে, কিন্তু সারাতে পারে না। এই সব চাপাচুপির ফলে অসুখ হয়ে। ওঠে মারাত্মক। M অধীরভাবে বলল, হতে পারে হয়তো তুমি রুটি বেশি খাও না কিন্তু ভাল ভাল খাবার যেমন কাঁচা সজি, বাদাম, ফল, দই ইত্যাদি অবশ্যই খাওয়া দরকার। M একটা ট্রে সামনে টেনে নিয়ে বোধহয় ইঙ্গিত করলেন যে, আর বিশেষ কিছু বলার নেই। মিস মানিপেনী তোমার রিজার্ভেশন করে রেখেছে। দু সপ্তাহেই তুমি শ্রাভল্যান্ডে ভাল প্রাকৃতিক চিকিৎসালয়ে গিয়ে একেবারে সেরে আসবে। জোশুয়া ওয়েন ওখানে একটা প্রাকৃতিক চিকিৎসালয় পরিচালনা করেন। ভদ্রলোক এ লাইনে বেশ বিখ্যাত। চমৎকার মানুষ। তিনি তোমাকে দেখাশোনা করবেন। আর তোমার কাজকর্মের কথা একেবারে ভুলে যাও। 007-কে আমি সে সব দেখার ভার দিয়েছি।
বন্ড নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারল না। শুধু কোন রকমে স্যারকে বলল, যাওয়াটা কি খুব জরুরী! M একটুকরো হাসি হেসে বললেন, দরকার নয়, অবশ্যম্ভাবী। অবশ্য যদি তুমি ডাব ও (০০) বিভাগে থাকতে চাও। যে অফিসার সম্পূর্ণ সুস্থ নয় তাকে এতবড়ো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে থাকতে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বললেন, এই পর্যন্তই 007, তারপর বেরিয়ে গেলেন।
দরজার ঠিক পাশে একটা ডেস্কের ওদিকে বসে ছিল M-এর প্রাইভেট সেক্রেটারী মিস মানিপেনী। সে খুব মিষ্টি করে বন্ডের দিকে তাকাল। তারপর হেসে বলল, তোমার জন্য চিকিৎসালয়ে চমৎকার একটা ঘর পাওয়া গেছে, ম্যানেজার লোকটি খুবই ভাল। তিনি বলেছেন, তোমার ঘরটা ভারী সুন্দর ঠিক তরকারী বাগানের ওপরে। মিস মানিপেনীর যথেষ্ট দুর্বলতা আছে বন্ডের ওপর। প্রায় সে বন্ডের স্বপ্ন দেখে। লোকটার অবস্থা দেখে তার দয়া হল। ফিসফিস করে বলল, সত্যি বলতে কি, কর্তার এ একটা নতুন হুজুগ। বেশিদিন টিকবে বলে মনে হয় না। তোমার ভাগ্য খারাপ যে এর মধ্যেই তুমি ফেঁসে গেলে। কর্তার মাথায় এক একবার এক একরকম পোকা ঢোকে। গত মাসে কর্তা কোমরের বাতে কাবু হয়ে পড়েছিলেন। তার এক বন্ধু দেখে শুনে জ্ঞান দিল যে মানুষের শরীর মোটর গাড়ির মত। মাঝে মাঝে মেরামত করতে হয়। তিনি নাকি এক প্রাকৃতিক চিকিৎসালয়ে মাঝে মাঝে যান আর একেবারে ঝরঝরে হয়ে বেরিয়ে আসেন। সেখানের খরচ সপ্তাহে কুড়ি পাউন্ড। সেখানে দশ দিন থাকার পর জায়গাটা সম্বন্ধে দারুণ গদাদ হয়ে ফিরে এলেন। এই গতকাল আমাকে ডেকে নিয়ে প্রাকৃতিক চিকিৎসা সম্বন্ধে প্রচুর উপদেশ দিলেন। এই হল ব্যাপার। তবে এটাও মানতে হবে যে কর্তার এমন চমৎকার স্বাস্থ্য আমি জীবনে দেখিনি। বন্ড বলল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এত লোক থাকতে আমাকেই কেন ঠেলে পাঠানো হচ্ছে পাগলা গারদে।
মিস মানিপেনী এবার বন্ড-এর কাছে জানতে চাইল যে, সত্যিই সে অতো মদ আর সিগারেট খায় কিনা। কেননা এটা সত্যিই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। বন্ড অতিকষ্টে নিজেকে সামলাল, তারপর বলল, আমার মতে তেষ্টায় মরার চেয়ে মদ খেয়ে মরা অনেক ভাল। আর সিগারেটের কথা যদি বল তবে বলতে হয় যে হাত দুটো নিয়ে কি-ই বা করব।
বন্ড ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল। মিস মানিপেনী মধুর হেসে বলল, দু সপ্তাহ পরে শুধুমাত্র লেবুর রস আর বাদাম খেয়ে তোমার শক্তি কোথায় থাকে দেখা যাবে।
বন্ড কোন কথা না বলে দুম করে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
শ্রাবল্যান্ডস
জেমস্ বন্ড তার স্যুটকেসটাকে ট্যাক্সির পেছনে ঢুকিয়ে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল। ড্রাইভারটি এক চালাকচতুর তরুণ, মুখে ব্রনের দাগ। বন্ড আসার পর সে গাড়ির সেলফ স্টার্টারে চাপ দিল।
বন্ড প্রশ্ন করল, শ্রাবল্যান্ডস্ কতদূর হবে?
একটা ট্রাফিক আইল্যান্ড ঘুরে বাঁক নিতে গিয়ে ছেলেটি পাকা হাতে দ্রুতগতির মধ্যেই গীয়ার বদলালো, আবার বাক শেষ হতে আবার গীয়ার যথাস্থানে নিয়ে এল। বন্ড মনে মনে ভাবল ছোকরা তেমন খারাপ নয়। ছেলেটির আচরণে এবার আগ্রহের ছোঁয়া লাগল। ছেলেটি বলল, ব্রাইটনে রেসের দিন অনেক জনকে নিয়েই গাড়ি করে যাওয়া যাবে। ব্রাইটনের রাস্তায় অনেক টাকা পাওয়া যাবে।
বন্ড বলে, তবে ব্রাইটনে অন্য ধরনের লোকও যায়। তোমাকে যাতে বোকা বানিয়ে ঠকিয়ে নিতে না পারে তার জন্য যথেষ্ট সাবধান থেকো। ব্রাইটনে পাকা বদমাইসের ক টা দল আছে।
ছেলেটা হঠাৎ বুঝতে পারল যে বক্ত তার সাথে খুব অন্তরঙ্গভাবে কথা বলছে। সে নতুন আগ্রহের সাথে পাশে বসা বন্ডের আপাদমস্তক ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিল। ছেলেটি জানতে চাইল যে, বন্ড ঐরকম একটা বাজে জায়গায় যাচ্ছে কেন? রন্ড হেসে বলল, উপায় নেই। আমার ডাক্তার মনে করে যে ওখানে আমার উপকার হবে। তাই আগামী চৌদ্দটা দিন ওখানেই কাটাতে হবে।
গাড়ি ব্রাইটন রোড ছেড়ে পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরল। গায়ের শান্ত রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল। ছেলেটি বলতে লাগল, এদিকে লোকদের মতে ওটা পাগলের আড্ডা, ও-নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কারণ ওখানে যারা আসে সবাই বড়লোক অথচ পয়সা খরচ করতে নারাজ। অবশ্য চায়ের দোকানগুলোর রোজগার বেশ ভালই বেড়েছে। আর একটা ব্যাপার আছে, ছেলেটা বেশ রাগের সাথেই বলল, শ্রাবল্যান্ড-এ থাকা খাওয়ার খরচা নিয়ে সপ্তাহে কুড়ি পাউন্ড। এর বদলে যদি তিন বেলা পেট পুরে খেতে দিত তাহলে আমার কিছু বলার ছিল না। ছেলেটি আরো বলল, চিকিৎসার শেষে যখন আমি বুড়োগুলোকে ফেরত নিয়ে যাই তখন কারো কারো চেহারা অনেক বদলে যায়। ভাবছি আমি ভর্তি হয়ে দেখব একবার।
ছেলেটি বন্ড-এর দিকে একবার তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করল, হয়েছে কি আমাদের ওয়াশিংটনে একটা খুব চালাকচতুর মেয়ে থাকে। হানি বী নামে একটা চায়ের দোকানে কাজ করে। আমাদের সকলের মাথা একেবারে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এক এক বারের জন্য নিত এক পাউন্ড। নানারকম ফ্রেঞ্চ কায়দা জানত। বেশ ভালই চলছিল বৃন্দাবন। তারপর শ্রাবল্যান্ডস পর্যন্ত মেয়েটার নাম ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটির নাম পলিগ্রেস। কাছাকাছি একটা পুরোনো খনি আছে, সেখানেই পলির সাথে আমাদের কাজকারবার চলতো। কয়েকটা বুড়ো বজ্জাত পলিকে একবার গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় ঐ খনিতে। কিন্তু আসল মুশকিল হল তারা পলিকে পাঁচ দশ পাউন্ড ভাড়া দিতে লাগল। ফলে পলির দর বেড়ে গেল। একমাস আগে চায়ের দোকানের চাকরিটা ছেড়ে দিল। তারপর দুশো পাউন্ড দিয়ে একটা গাড়ি কিনে। ঘুরে বেড়াতে লাগল। বন্ড শুনে বলল, সত্যিই খুব বাজে ব্যাপার।
ছেলেটি বন্ডকে বলল, শ্রাবল্যান্ডে খাবার দেয় অল্প কিন্তু সেই সাথে থাকে প্রচুর বিশ্রাম। ওখানে মদ একেবারেই বারণ। এতে রোগীর রক্তস্রোত একেবারে পরিষ্কার করে। মানব দেহের বিভিন্ন যন্ত্রগুলোকে মেজেঘষে ততকে করে দেয়।
বন্ড হাসতে হাসতে বলল, যাক জায়গাটাতে ভালো কিছু আছে তাহলে।
গাড়িটা ডান দিকে ঘুরে কিছু দূর চলার পর একটা ভারী ঝুলবারান্দার তলায় গাড়ি থামাল। সামনেই নোটিশ টাঙ্গানো ভিতরে ধূমপান নিষিদ্ধ। আপনার সিগারেট এখানে জমা দিয়ে যান।
বন্ড ট্যাক্সী থেকে নেমে ভাড়া ঢুকিয়ে দিয়ে দশ শিলিং বকশিশ দিল ছেলেটিকে। ছেলেটি যাবার আগে বলে গেল, যদি কোন দিন এখান থেকে পালাতে চান তাহলে আমাকে খবর দেবেন।
বন্ড একটা ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। বাড়ির ভেতরটা বেশ গরম ও শান্ত। রিসেপশন ডেস্ক-এ বসে ছিল ধবধবে সাদা পোশাক পরা একটি ফুটফুটে মেয়ে। সে বন্ডকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল। সে বন্ডকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে গেল যে, এক ঘণ্টার মধ্যে বড় সাহেব দেখা করবেন।
ঘরটা খুব সুন্দর আসবাবপত্রে ভর্তি। বিছানার পাশে খুব সুন্দর ফুলদানী মেরি গোল্ড ফুল। আর একটা বই– প্রাকৃতিক চিকিৎসার ব্যাখ্যা। জানালার নিচে ফলমূলের বাগানের সারি সারি অচেনা গাছ আর মাঝখানের একটা সূর্যঘড়ি ঝলমল করে উঠল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। এক নারীকণ্ঠ শোনা গেল, পাঁচ মিনিটের মধ্যে বন্ড পরামর্শ কক্ষ নং A-তে মিঃ ওয়েনের সাথে দেখা করলে তিনি খুশি হবেন।
পরামর্শকক্ষে ঢুকলে শ্রাবল্যান্ডস -এর বড় সাহেব মিঃ জোশুয়া ওয়েন বন্ডের সাথে করমর্দন করলেন। ভদ্রলোকের হাসিটুকু খুব আন্তরিক। প্রথমে বন্ডের প্যান্ট ছাড়া সব জামা-কাপড় খুলতে বললেন। তারপর তার ওজন রক্তের চাপ ইত্যাদি পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, মিঃ বন্ড আপনার দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। রক্তের চাপ একটু বেশি। মেরুদণ্ডের ওপরদিকের জোড়গুলোতে একটা চোট লেগেছে। আপনার মাথাব্যথার কারণ বোধহয় এইটাই। আর কোমরের নিচের একটা হাড় ধাক্কা লেগে অল্প সরে গেছে। মিঃ ওয়েন একটা ছাপানো ফর্ম টেনে নিয়ে চিন্তান্বিতভাবে ফর্মে লেখা বিভিন্ন আইটেম্ -এ একে একে দাগ দিতে লাগলেন। এক সপ্তাহ ধরে নির্দিষ্ট অল্প খাদ্য। ঠাণ্ডা আর গরম পানিতে গোসল। আর এছাড়াও সম্পূর্ণ বিশ্রাম। মিঃ ওয়েন বন্ডকে বললেন যে আধঘন্টার মধ্যেই তার চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে।
বন্ড সাদা রঙের করিডোর দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে এল। আশেপাশের ঘরে অনেকে বসে ছিল। বেশির ভাগই মহিলা। তারা বিশ্রী ঢোলা ড্রেসিং গাউন পরে বসে ছিলেন। বন্ড মনে মনে ভাবছিল এই যমের অরুচি জায়গাটা থেকে নিজের চাকরিটা না খুইয়ে কিভাবে পালানো যায়। অন্যমনস্কভাবে চলতে চলতে একটি সাদা পোশাক পরা মেয়ের সাথে বন্ডের প্রায় ধাক্কা লেগে গেল। এবং হঠাৎ ম রঙের বেল্টলি গাড়ি তীব্রবেগে ঘুরে এসে পড়ল মেয়েটির ওপর। সাথে সাথেই বন্ড মেয়েটিকে ধরে নিল। বন্ডের ডান হাতে তখনও এক সুপুষ্ট স্তনের স্পর্শ লেগে আছে।
মেয়েটি বন্ডকে ধন্যবাদ জানাল, ততক্ষণে গাড়ির ড্রাইভারের আসন থেকে একজন ভদ্রলোক খুব নির্বিকারভাবে বেরিয়ে এসে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আশা করি আপনি ঠিক আছেন। বলেই তিনি মেয়েটিকে চিনতে পারলেন, কেমন আছ প্যাট্রিশিয়া?
ভদ্রলোক অসামান্য পুরুষ। তার সুগঠিত দেহ দেখে মনে হয় যে তার গায়ে দক্ষিণ আমেরিকান রক্ত আছে। সব মিলিয়ে বন্ড আন্দাজ করল, ইনি একটি অনিক্যকান্তি লম্পট। জীবনে যে কটি মেয়েকে ইনি কামনা করেছেন, বোধহয় তাদের প্রত্যেককেই করায়ত্ত করতে পেরেছেন। এটাই সম্ভবত তার জীবিকা, আর জীবিকার উপার্জনটাও প্রচুর।
মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়েছে। খুব রাগের সাথে সে বলল, আপনার সত্যিই সাবধান হওয়া উচিত, কাউন্ট লি। এই ভদ্রলোক না থাকলে, মেয়েটি বন্ডের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, আমি খুবই দুঃখিত। আমার একটা তাড়া ছিল। ওয়েন সাহেবের সাথে দেখা করার কথা ছিল আমার। কিন্তু আমি দেরি করে ফেলেছি। প্যারিসে দু সপ্তাহ কাটবার পর আমার একটু চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
মেয়েটি বলল, এবার আমাকে পালাতে হচ্ছে। ভীষণ দেরি হয়ে গেছে। গাড়িটা যে রাস্তা দিয়ে গেল, সেটা ধরেই দুজনে এগোতে লাগল। বন্ড মেয়েটিকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল, তুমি কি কাজ কর? মেয়েটি জানাল যে সে তিন বছর যাবত শ্রাবল্যান্ডস্-এ কাজ করছে। বউ এখানে কি কাজ করছে, কবে এসেছে–সব কিছুই সে জেনে নিল। মেয়েটির চেহারা অ্যাথলেটের মত। বন্ড ভাবলো মেয়েটি নিশ্চয় টেনিস খেলে বা স্কেটিং করে। ঠিক এই ধরনের স্বচ্ছন্দ, আটসাট চেহারার উপর বন্ডের চিরকালের লোভ। পোশাকের ভেতর দিয়ে তার স্তন ও নিতম্বের চড়াই উত্রাই এত প্রকট হয়ে উঠেছে যে, স্পষ্ট বোঝা যায় এই সাদা সাজের তলায় অল্পই জামা-কাপড় পরেছে সে।
বন্ড প্রশ্ন করল, এখানে তার একঘেয়ে লাগে কিনা। কাজ-কর্ম না থাকলে সে কি করে? মেয়েটি বুঝল যে বন্ড আরেকটু অগ্রসর হতে চাইছে। সে একটু মুচকি হাসি ও একঝলক আনন্দিত দৃষ্টির সাথে তা মেনে নিল। বলল, আমার একটা ছোট্ট গাড়ি আছে। গাঁয়ের রাস্তায় গাড়ি চড়ে প্রায়ই ঘুরে বেড়াই। আর হেঁটে বেড়াবার জন্যও কয়েকটা চমৎকার রাস্তা আছে। তাছাড়া এখানে হরদম নতুন নতুন রোগী আসে। তাদের অনেকেই খুব মজার লোক। এই যে গাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে দেখলেন এর নাম কাউন্ট লি। ইনি প্রতি বছর এখানে আসেন। ম্যাকাও নামে একটা জায়গায় ওঁর কি যেন ব্যবসা আছে। ওটা তো হংকং-এর কাছে তাই না?
ওরা বিরাট বাড়িটার প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছল। গরম হলঘরটার ভেতর ঢুকে মেয়েটি বলল, এবার আমি দৌড় লাগাচ্ছি। আপনাকে আর একবার ধন্যবাদ। আশা করি এখানে থাকতে আপনার ভালোই লাগবে। হাসতে হাসতে সে চিকিৎসকের কামরাগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। যতক্ষণ দেখা গেল বন্ড একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তার গুরু নিতম্বের আন্দোলনের দিকে।
এই বাড়ির নিচেও একটা তলা আছে যেখানে নানারকম চিকিত্সা হয়। বন্ড সেখানেই নেমে গেল। চারদিকে শুধু সাদা রঙ আর জীবাণুনাশক ঔষধের হালকা গন্ধ। একটা দরজার ওপর লেখা পুরুষদের চিকিৎসা কক্ষ। দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে একজন মালিশওয়ালা অন্তরঙ্গভাবে অভ্যর্থনা জানাল বউকে। বন্ড জামাকাপড় খুলে ফেলে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে মালিশওয়ালার পেছন পেছন একটা লম্বা ঘরে এসে ঢুকলো।
লম্বা ঘরটা প্ল্যাস্টিকের পর্দার সাহায্যে অনেকগুলো কামরায় বিভক্ত। কোনরকমে তোয়ালেটা খুলে অন্য টেবিলটার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে মালিশওয়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করল। মালিশ শুরু হল। বন্ড এবারে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। এবারে সে মাথা নাড়াতে পারে। সে খুব সহজভাবে ডানদিকে তাকালো। কাউন্টের মুখ বন্ডের বিপরীত দিকে ফেরানো। যে জায়গায় ঘড়িটা থাকে, সেখানে চামড়ার ওপর লাল উল্কিতে আঁকা একটা চিহ্ন। বন্ড ঠিক করল যে তার গুপ্তচর বিভাগের নথিপত্র ঘেঁটে একটু খোঁজ নিতে হবে। দেখা যাক এই যারা হাতঘড়ির আড়ালে গুপ্ত পরিচয় চিহ্ন বয়ে বেড়ায় তাদের সম্বন্ধে কিছু জানা যায় কি না।
.
বন্ডের চিকিত্সা
বন্ডের শরীর নিয়ে চিকিৎসা শুরু হল। এক ঘণ্টা দলাইমলাই করার পর তার মনে হল যেন শরীরটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। কোন রকমে সে কাপড়-চোপড় পরে নিল, M-কে অভিশাপ দিল এই অত্যাচারের জন্য। তারপরে উঠে এল অত্যন্ত দুর্বল ভাবে। সামনের বড় বসবার ঘরটায় ঢোকবার মুখে দুটো টেলিফোনের খুপরি রয়েছে। সেখান থেকে ও সেই নম্বরে ডাক দিল, ওর সরকারী অফিসে বাইরে থেকে একমাত্র যে নম্বরে ডাকা যায়। সে জানে যে, এরকম সমস্ত ডাক সদর দপ্তরে আড়ি পেতে শোনা হয়। সে যখন রেকর্ডস-এর দপ্তর চাইল তখন টেলিফোনের আওয়াজ শুনেই বুঝল, লোকে আড়ি পেতেছে। সে নিজের নম্বরটা (007) দিয়ে প্রশ্ন করল, তার জিজ্ঞাস্য ব্যক্তি হচ্ছে খুব সুন্দর, প্রাচ্য জাতীয় এবং ওর দেহে পর্তুগীজ রক্ত থাকতে পারে, বলে তার খবরটা সে দিল। দশ মিনিট বাদে Records Section-এর বড়কর্তা তাকে ফোনে ডেকে কথা বললেন।
উনি বললেন, ঐ চিহ্নটা হচ্ছে একটা Tong চিহ্ন। এর নাম হচ্ছে, লাল বজ্রের Tong। চীনেম্যান ছাড়া এই দলের সভ্য সাধারণত দেখা যায় না। এটা সম্পূর্ণ অপরাধীদের দল। আমাদের Station H একবার এদের সাথে লড়তে বাধ্য হয়েছিল। এদেরকে হংকং-এ পাওয়া যায় কিন্তু এদের আসল মাটি হচ্ছে ম্যাকাও। গোড়ায় ব্যাপারটা ভালোই চলছিল। কিন্তু তার পরে ব্যাপরটা কেঁচে গেল।
সমস্ত ব্যাপারটা হল লুকোচুরির ব্যাপার। পরে বোঝা গেল রেডল্যান্ডের সাথে এদের একটা যোগাযোগ আছে। তারপর থেকে এরা মাঝে মাঝে বে-আইনী মাদকদ্রব্য চালান করে শোনা গেছে এবং প্রথম শ্রেণীর দাসব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছে তাও জানা গেছে। এদের সম্পর্কে যদি কোন খবর যোগাড় করতে পার–পরে কাজে আসবে।
বন্ড ধন্যবাদ জানিয়ে বলল আমি এই প্রথম এই সব লাল বজ্বের Tong -দের নাম শুনলাম। যদি কিছু ঘটে আমি সংবাদ দেব।
বউ খুব চিন্তিত মনে ফোনটা নামিয়ে রাখল। সে টেলিফোনের খুপরী থেকে বেরিয়ে এল। পাশের খুপরীর একটু আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দেখল তার দিকে পেছন করে কাউন্ট লি তক্ষুনি ফোন তুলে ধরেছেন। কতক্ষণ সে সেখানে ছিল? সে কি বভের সব কথাগুলো শুনেছে।
বউ নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো। এখন সাড়ে সাতটা। হেঁটে চলে গেল খাবার ঘরে যেখানে এখন খাবার দেওয়া হচ্ছে। সেখানে একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখে সে নিজের নাম বলল। সেই মহিলা সব শুনে মনে করে শাক-সজির ঝোল এনে দিলেন এবং কঠোরভাবে বললেন, পরে এইটুকুও পাবেন না। যখন চিকিৎসা শুরু হবে তখন আপনাকে নিয়মের মধ্য থাকতে হবে।
বন্ড একটা তিক্ত হাসি হেসে টেবিলের এক কোণে বসে খেতে লাগল। তারপর একটু পরে নিজের ঘরের দিকে রওনা হল।
এই ভাবে দু দিন খাবার পর বন্ড অসহ্য বোধ করতে লাগল। সব সময় খানিকটা মাথা ধরা চোখ হলদে হয়ে এসেছে। তাকে যে মালিশ করে সে বলল, চিন্তার কোন কারণ নেই। শরীর থেকে বিষগুলি বেরিয়ে যাচ্ছে। বন্ড এখন এত অবসন্ন যে আর কোন তর্ক করল না।
তৃতীয় দিনে বন্ডকে হাড় মালিশ করার জন্য ঘরে পাঠানো হল। এটা হাসপাতালের একটা নতুন দিক। সে যখন ঘরে ঢুকল তখন দেখল কোন পুরুষ মানুষ নেই। তার বদলে দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের দেখা সেই মেয়েটি, প্যাট্রিশিয়া।
বন্ড অবাক হয়ে বলল, আরে তুমি কি এ কাজ করো নাকি? মেয়েটি কিছু না বলে শুধু একটু হেসে জানাল যে, এই ধরনের কাজ যারা করে তাদের শতকরা কুড়ি ভাগই মেয়ে। কাপড় খুলুন। শুধু প্যান্ট পরে থাকবেন। তারপর বলল মুখ নিচু করে খাটে শুয়ে পড়তে। তারপর মেয়েটি দুটো শক্ত হাতে পরিষ্কারভাবে সে বন্ডের গ্রন্থিগুলো মুচড়ে মুচড়ে ঠিক করতে শুরু করল।
বন্ড শিগগীর বুঝতে পারল যে মেয়েটি যথেষ্ট শক্তিশালী। বন্ড একটা সুন্দর মেয়ে এবং একজন অর্ধ উলঙ্গ পুরুষের মধ্যে এইরকম নৈর্ব্যক্তিক সম্পর্কে খানিকটা বিরক্তই হয়ে উঠল। কাজকর্ম হয়ে যাবার পরে প্যাট্রিশিয়া ওকে দাঁড়াতে বলল এবং বন্ডের দুই হাত নিজের গলার পেছনে মুঠি করে ধরতে বলল। সামান্য দূরত্ব থেকেও তার চোখ খালি নিজের কাজের কথা ভাবছে। হঠাৎ সে একটা ঝাঁকুনি দিল, বোধহয় বডের শিরদাঁড়াটাকে ঠিক করার জন্য। এবার বন্ড সত্যি সত্যিই চটে গেল। যখন বন্ড এক ঝটকায় তাকে সামনে টেনে এনে জড়িয়ে চুমু খেল, প্যাট্রিশিয়ার চোখ আগুনের মত জ্বলে উঠল, গাল লাল হয়ে গেল। বন্ড হেসে বলল, ঠিক আছে, আমাকে এটা করতেই হত। তুমি যদি ডাক্তার হতে চাও তাহলে এত সুন্দর ঠোঁট তোমার থাকা উচিত নয়।
প্যাটিশিয়া বলল, গতবার এ কাণ্ড যখন ঘটেছিল, তখন সেই ব্যক্তিটিকে পরের ট্রেনেই রওনা হতে হয়েছিল। বন্ড তার দিকে ফিরে বলল, যদি তাই হয় তবে এদিকে এসো, আর একবার তোমাকে চুমু খেয়ে নিই। প্যাট্রিশিয়া বন্ডকে জানাল কোন কথা না বলে চুপ করে থাকতে। কেননা আধঘন্টার মত তাকে ট্রাকশন দেওয়া হবে। বন্ডও মেয়েটিকে জানালো ছুটির দিনে একসাথে বেড়াতে যাওয়ার কথা।
প্যাট্রিসিয়া দরজা খুলে ধরতে বন্ড বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে কাউন্টলি-এর সাথে ধাক্কা খেল। লি তো তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে প্যাট্রিশিয়ার কাছে হেসে বললেন, মার খেতে এলাম। আশা করি আজকে তোমার গায়ের জোর খুব বেশি নেই। প্যাট্রিশিয়া গম্ভীর মুখে বলল, তৈরি হয়ে নিন। আমি বন্ড সাহেবকে অন্য চিকিৎসার ঘরে পৌঁছে দিয়ে এখুনি আসছি। সে বন্ডকে সাথে নিয়ে বারান্দা দিয়ে হনহন করে এগিয়ে গিয়ে একটা ছোট ঘরের দরজা খুলল সেখানে নানারকম ডাক্তারী যন্ত্রপাতি এবং একটি বিছানা রয়েছে। ঘরের চেহারা দেখে বন্ড ঘাবড়ে গেল। একটা বৈদ্যুতিক মোটর লাগানো আছে বিছানার তলায়। কতগুলি দন্ড খাড়া করা আছে আর তাদের সাথে মোটা মোটা চামড়ার বেল্ট লাগানো।
প্যাট্রিশিয়া বলল, এটা শিরদাঁড়া সোজা করার যন্ত্র। আপনার শিরদাঁড়াটায় একটু গণ্ডগোল আছে সেটা সোজা করতে এটার সাহায্য নেব। আপনি শুয়ে পড় ন।
বন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুয়ে পড়ল। বন্ডের বুকে চামড়ার বেল্টগুলো প্যাট্রিশিয়া লাগিয়ে দিল। তারপর কি সব যন্ত্রের মধ্যে কতগুলি সুইচ টিপে দিল। বৈদ্যুতিক মোচড় চলতে শুরু করল। বন্ড অনুভব করল অনুভূতিটা বিচিত্র হলেও কষ্টকর নয়। বন্ড এ যন্ত্রের টানা ছাড়ার ছলে আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এলো।
বোধহয় পাঁচ মিনিট পরে সামান্য হাওয়ার ঝাঁপটায় বন্ড চোখ খুলল। তার চোখের সামনে একটা পুরুষের হাত। হাত দিয়ে যত্রর গতিবেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বন্ড প্রথমে ঘটনাটা বুঝতে পারেনি তারপর বুঝে চিৎকার করল কিন্তু ততক্ষণে যন্ত্র তার দেহ নিয়ে তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছে। বন্ড-এর সমস্ত শরীর ব্যথায় ভরে গেছে। একটা ধোয়ার পর্দার আড়াল থেকে সে দেখতে পেল সেই লোকটির হাত আস্তে যন্ত্রের সুইচ থেকে নেমে এল। হাতটা তার চোখের সামনে দিয়ে সরে গেল। হাতের কব্জিতে সেই মারাত্মক লাল সাঙ্কেতিক উল্কি আঁকা আছে।
তার কানের কাছে একটা গলা শুনতে পেল। সেই গলা বলল, বন্ধুবর, আর আমাকে ঘাটাতে এসো না। কথাটা মনে রেখো।
লোকটা বোধহয় চলে গেল। ভীষণ যন্ত্রণায় বন্ড চিৎকার করার চেষ্টা করল। তার সারা দেহ দিয়ে ঘাম বের হচ্ছে। সে ছটফট করার চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল।
.
চা এবং অবসাদ
কোন সুন্দর স্মৃতি আমরা অনেক দিন ধরে মনে রাখতে পারি। কিন্তু যন্ত্রণাটা ঠিক কি রকম লেগেছিল তা পরে আর মনে করা যায় না। বন্ড শুয়ে শুয়ে নিজের দেহের অনুভূতিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছিল।
কতকগুলো গলার মৃদু আওয়াজ শোনা গেল।
প্যাট্রিশিয়ার গলা, ঐ ট্রাকশন যন্ত্রের আওয়াজটা শুনে আমি অন্য একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আওয়াজ শুনে গিয়ে দেখি সাংঘাতিক ব্যাপার ইন্ডিকেটর ২০০-র দাগ পর্যন্ত চলে গেছে। আমি কোনরকমে হাতল টেনে নামিয়ে ওর গায়ের বাঁধন খুলে দিই। আর চটপট কোরামিন এনে ভদ্রলোকের শিরায় একটা ইনজেকশন দিয়ে দিলাম। ওর নাড়ী তখন ভীষণ দুর্বল। এরপর আমি আপনাকে ফোন করি। মিঃ ওয়েনের গলা–ব্যাপারটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। আমার মনে হয় এই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই যন্ত্রের হাতলটা নেড়েচেড়ে কোন কায়দা করতে গিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের মারা যাওয়াটা অসভব ছিল না।
একটা হাত বন্ডের কব্জিতে চাপ দিয়ে নাড়ী দেখছিল। বন্ডের মাথার ভিতর কেমন এলোমেলো লাগছিল। তার হঠাৎ ভীষণ রাগ হল M-এর ওপর। তার দোষেই এই পুরো বাজে ব্যাপারটা হল। মিঃ ওয়ানের গলা আবার শোনা গেল–হাড়টাড় কিছু ভাঙেনি, তবে অনেক জায়গা ছড়ে গেছে, আর জোর শক পেয়েছেন। প্যাট্রিশিয়া তোমাকে এর সম্পূর্ণ ভার দেওয়া হল। এর এখন দরকার বিশ্রাম, উত্তাপ এবং এফ্লুয়েজ। তুমি বুঝতে…?
বন্ডের যখন আবার জ্ঞান ফিরে এল সে দেখল বিছানার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে, আর সমস্ত শরীরে এক অদ্ভুত অনুভূতি। দেহের নিচে উষ্ণ বৈদ্যুতিক চাদর, আর তার পিঠ দু দুটো Sun Lamp-এর আলোয় ক্রমশঃ গরম হয়ে উঠছে। এবং দুটি নরম হাত তার ঘাড় থেকে হাঁটু পর্যন্ত এক বিচিত্র কায়দায় মালিশ করছে। বন্ডের এত আরাম লাগছিল যে বলার নয়।
প্যাট্রিশিয়া তার সামনে এসে ভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে ধরল। বরফের টুংটাং শব্দের সাথে চুমুক দিতে দিতে মনে মনে বিবেচনা করল, এই মেয়েটি সত্যিই চমৎকার। একে বিয়ে করলে মন্দ হয় না। ও আমাকে সারাদিন ধরে এফ্লয়েজ দেবে আর মাঝে মাঝে এই রকম করে কড়া এক গ্লাস করে মদ। দিনগুলো ভালই কাটবে।
বন্ড ভাল হয়ে ওঠাতে প্যাট্রিশিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছিল। সে বন্ডকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি হাতলটা টেনে ফেলেছিলেন আমাদের এখানে এমনটি হয়নি। আপনি আমাদের খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। বন্ড তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিকই ধরেছ। আমি নড়েচড়ে একটু ভালোভাবে শোবার চেষ্টা করছিলাম হাতটা সরাতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল শক্ত কিছুর সাথে জোরে ধাক্কা লাগল। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। প্যাট্রিশিয়া আর
একবার গ্লাস ভর্তি করে বন্ডের দিকে এগিয়ে দিল। বন্ড গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, এখন আর একটু এয়েজ হলে। মন্দ হয় না। আর, ভাল কথা, আমাকে বিয়ে করবে? আজ পর্যন্ত তোমাকেই দেখলাম একমাত্র মেয়ে যে একজন পুরুষকে ঠিকঠাক ম্যানেজ করতে পারে। প্যাট্রিশিয়া হেসে উঠে বলল, ইয়ার্কি পরে হবে, এখন শুয়ে পড় ন। দেখি, আপনার পিঠে মালিশ দরকার।
দুদিন পরের কথা। বন্ড আবার প্রাকৃতিক চিকিৎসালয়ের সেই ঝিমধরা পরিবেশে ফিরে এসেছে। বন্ডের সবচেয়ে ভাল লাগে দৈনিক চায়ের দোকানে খাওয়াটা। আজ তার কাছে তিন কাপ চা পুরো আধ বোতল শ্যাম্পেনের মতন লোভনীয় ও শক্তিদায়ক।
চিকিৎসার ফাঁকে ফাঁকে অভ্যস্ত গুপ্তচর সুলভ রীতিতে বন্ড কাউন্ট লি-এর বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করতে লাগল। বন্ড জানতে পারল, কাউন্ট পৃথিবীর সর্বত্র ঘোরাফেরা করে। কাউন্ট লি অতি স্বাস্থ্যবান লোক কিন্তু কোমর সরু রাখার। ব্যাপারে বেশি নজর দেন। তাই প্রত্যহ টার্কিশ বাথ নেন। বন্ড শ্রাবল্যান্ড-এ তার শেষ দিনের জন্য সমস্ত প্ল্যানটি ঘড়ির কাঁটা ধরে সাজিয়ে রাখল। সেইদিন সকাল ঠিক দশটার সময় বন্ড মিঃ ওয়েন-এর সাথে দেখা করল। মিঃ ওয়েন তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখে খুশি হল। বন্ড একতলায় নেমে এল শেষ মালিশ নেওয়ার জন্য। সে মালিশ নিতে নিতে তার শিকারের পায়ের আওয়াজ শোনবার জন্য কান খাড়া করে থাকল। সে একটা সপ্তাহ ধরে মালিশওয়ালাদের দৈনিক রুটিন লক্ষ্য করছিল। সে জানত এরা প্রত্যেকে লাঞ্চের ছুটির কয়েক মিনিট আগেই কাজকর্ম শেষ করে পালায়। মালিশঘর পুরো খালি। এবার শুধু কাউন্ট লি আর জেমস বন্ড। সে টার্কিশ বাথ-এর ঘরটাতে ঢুকল। বক্সের একটা দিক খুলে রোগীরা ঢোকে, তার পর সেটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভেতরে ছাদের ফুটো দিয়ে মাথাটুকু বের করে রেখে বসবার ব্যবস্থা আছে। ট্রাকের ভেতরের দেওয়ালে সারি সারি ইলেকট্রিক বালব। এদের সবটুকু উত্তাপ গিয়ে লাগে রোগীর সর্বাঙ্গে। বন্ড খুব শান্তভাবে সুইচটা বেশ খানিকটা ঘুরিয়ে দিল। কাউন্ট টার্কিশ বাথের ভিতরে। সাংঘাতিক গরমে চিৎকার করে উঠলেন। বহু যন্ত্রের ডায়ালের দিকে একবার তাকাল, ১২০ ডিগ্রী ফারেনহাইট। বন্ডের ইচ্ছা ওকে একটু ভালমত শিক্ষা দেওয়াই, খতম করা নয়। বন্ড সুইচ ঘুরিয়ে ১৮০-তে তুলে দিল। কাউন্ট লি এবার মরিয়া গলায় চিৎকার করে উঠলেন। বন্ড বলে উঠল–আমার মনে হয় এইরকম গরমে আধঘণ্টা থাকলে আপনার অনেক উপকার হবে। এতক্ষণে কাউন্টের কাছে পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়েছে। তাঁর চাপা গলায় ঘৃণা ও ক্রোধ গোপন করার চেষ্টা– তোমাকে দশ হাজার পাউন্ড দেব ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেল, ঠিক আছে…পঞ্চাশ। বন্ড বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করল তার পর দ্রুত করিডোর দিয়ে বেরিয়ে গেল। বন্ড নিজেকে সান্ত্বনা দিল–খুব খারাপ কাজ সে কিছুই করেনি।
***
জেমস্ বন্ড ঠিকই আন্দাজ করেছিল শ্রাবল্যান্ড-এর বিচিত্র পরিবেশে এই দুর্দান্ত দুই পুরুষের ছেলেমানুষি ঝগড়ার ঢেউ বন্ডের সম্পূর্ণ অজান্তে গিয়ে আঘাত করল একটা বিশাল অথচ নিখুঁত ষড়যন্ত্রে সাজানো সময়-ব্যবস্থাকে, যে ষড়যন্ত্র আর কিছুদিন পরেই সমগ্র পাশ্চাত্ত্যজগতের শক্ত ভীত ধরে নাড়া দিয়েছিল।
.
প্রেতাত্মা সংঘ
বুলেভার্ড হাউসমান হচ্ছে প্যারিসের একটি লম্বা রাস্তার নাম। রাস্তাটা যেমন লম্বা তেমনই বর্ণহীন। কিন্তু এটাই বোধহয় প্যারিসের সবচেয়ে সুগঠিত পথ। এর দুধারে বড় বড় সব সেকেলে বাড়ি। একটু এগিয়ে গেলে দেখা যাবে, একটি বিরাট বাড়ির গায়ে চক্চকে পিতলের ফলকে লেখা আছে FIRCO । কথাটি কতগুলি ফরাসী শব্দের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত। প্রাকৃতিক চিকিৎসালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার দুদিন পরে সেদিন বন্ড মনের আনন্দে স্প্যাগেটি আর কিয়ান্তী খেল এবং প্যাট্রিশিয়ার সাথে একটি উত্তপ্ত সন্ধ্যা কাটাল, তার ঠিক আগের রাতে সাতটার সময় FIRCO -এর সব ক জন ট্রাস্টিকে এক বিশেষ জরুরী বৈঠকে ডাকা হল।
ঘড়িতে সাতটা বাজবার আগেই এই প্রতিষ্ঠানের মোট কুড়িজন বড়কর্তার সকলে চারতলার একটি নির্দিষ্ট ঘরে একত্রিত হলেন। উপস্থিত একুশজন ব্যক্তি প্রত্যেকে এক-একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা দ্বারা পরিচিত। এই সংখ্যাগুলি ১ থেকে ২১-এর মধ্যে।
পৃথিবীতে এক ধরনের মানুষ আছেন যাদের চেহারায় যেমন থাকে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, তেমনি থাকে এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণীশক্তি। বর্তমান মিটিং-এর সভাপতি এই দুর্লভ জগতের মানুষ। অপরিচিত কোন লোক যদি রাস্তায় এঁকে দেখত, তাহলে তার দৃষ্টিতেও সম্ভ্রম জাগাত সন্দেহ নেই। এঁর নাম আর্নস্ট স্রাভো ব্লোফেল্ড। জন্মেছিলেন ১৯৮০ সালে পোল্যান্ডের এক প্রান্তে। এঁর বাবা পোলিশ, মা গ্রীক। বোফেল্ড ইতিমধ্যে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটি চমৎকার সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, পৃথিবীর সব বড় বড় শক্তিধরদের শক্তির মূলে। রয়েছে দ্রুত এবং নিখুঁত সংবাদ আদান-প্রদান ব্যবস্থা। জার্মানী যখন পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে তোড়জোড় শুরু করল তখন ব্লোফেল্ড তাঁর এই ধারণাটি কাজে লাগাবেন বলে ঠিক করলেন। তার হাত দিয়ে যে সব জরুরী টেলিগ্রাম ইত্যাদি। যাওয়া-আসা করছিল, তার কাছে সেগুলোর মূল্য হয়তো কিছুই নয়, কিন্তু শত্রুপক্ষের কাছে এ খবরগুলো অমূল্য। সুতরাং তিনি পাকা হাতে এই সমস্ত চিঠিপত্রের নকল সংগ্রহ করতে লাগলেন। বিভিন্ন দূতাবাস এবং অস্ত্রাগারের বড়কর্তাদের নামে এই সব জরুরী চিঠিগুলো যেত। ব্লোফেল্ড সুকৌশলে এই সব ছোট অথচ ক্ষমতাশালী লোকদের নাম সংগ্রহ করলেন। এগুলি তাঁর পরে কাজে লাগবে। তারপর ব্লোফেন্ড তার গুপ্ত সংবাদের দু একটি নমুনা ঈষৎ বাকা রাস্তা দিয়ে জার্মান রাষ্ট্রদূতের হাতে পৌঁছে দিলেন। এগুলি পেয়ে জার্মানরা তৎক্ষণাৎ তার গুরুত্ব বুঝে ফেলল।
ব্লোফেল্ড বাছা বাছা সব গুপ্ত খবর পাচার করতে লাগলেন এবং তার হাতে মোটা অংকের টাকাও পোঁছতে লাগল। সমস্ত টাকাই তিনি আমেরিকান ডলারে নিতেন। নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে বোধহয় ব্লোফেন্ডের এক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করত। প্রতিটি দেশের সাথে তার গুপ্ত কারবার চলত অন্য দুটি দেশের অজান্তে। এরকম বেশিদিন চলতে পারে না, তিনি বুঝতে পারলেন। তাঁর গুপ্তকথা ফাঁস হয়ে যেতে পারে। তার হাতে প্রচুর টাকা প্রায় দু লক্ষ ডলারের মত। টাকাগুলো গুছিয়ে নিয়ে পৃথিবীর কোন নিরাপদ প্রান্তে সরে পড়তে হবে। ব্লোফেল্ড তার পলায়ন পর্বটি খুব সুন্দরভাবে। সমাধা করলেন। তিনি তাঁর সমস্ত টাকা দিয়ে কোম্পানীর কাগজ কিনে সেগুলিকে জুরিখের একটি ভাল ব্যাংকের সেফ ডিপোজিট ভল্ট-এ স্থানান্তরিত করলেন। এই ব্যবস্থাটুকুর জন্য তার এক বন্ধুকে হাজার ডলার ঘুষ দিতে হল। তিনি দু হাজার ডলারের বিনিময়ে এক ক্যানাডিয়ান নাবিকের জাল পাসপোর্ট জোগাড় করে নৌপথে সুইডেন রওনা হয়ে। পড়লেন। সেখানে কিছুদিন বিশ্রাম করে তাঁর আসল পোলিশ পাসপোর্ট নিয়ে তুরস্কে গিয়ে পৌঁছলেন। জুরিখ থেকে তাঁর সমস্ত টাকা এনে ইস্তাম্বুলের অটোম্যান ব্যাংকে জমা করলেন, এবং পোল্যান্ডের পতনের অপেক্ষায় থাকলেন। পোল্যান্ড খুব অল্প দিনের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করল জার্মানীর কাছে। সাথে সাথে উদ্বাস্তু হিসাবে তুরস্কের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন। কিছু টাকা হাত বদল হল এবং তিনি অনুমতি পেয়ে গেলেন।
এখানে ব্লোফেল্ড বেশ জমিয়ে বসলেন এবং শীঘ্রই Rahi, নামক একটি গুপ্তচক্রের সৃষ্টি করলেন। তাঁকে আর একটি কাজ করতে হত। যুদ্ধের গতি লক্ষ্য করে যে পক্ষের বিজয় সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতেন, তাঁদেরই কেবল সংবাদ বিক্রি করতেন। উত্তর আফ্রিকায় রোমেলের বিরাট পরাজয়ের পর, ব্লোফেল্ড খোলাখুলিভাবে মিত্রপক্ষকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। ফলে মহাযুদ্ধের শেষে আকাশছোঁয়া খ্যাতি-প্রতিপত্তির সাথে তার ভাগ্যে জুটল ব্রিটিশ, আমেরিকান ও ফরাসীদের কাছ থেকে অজস্র সম্মান ও বিভিন্ন উচ্চস্তরের পদক। তারপর ব্লোফেল্ড তাঁর ব্যাংকে জমানো পাঁচ লক্ষ ডলার সাথে নিয়ে একটি জাল সুইডিশ পাসপোর্টের সাহায্যে দক্ষিণ আমেরিকায় সরে পড়লেন। সেই আনন্ট স্রাভো ব্লোফেল্ড আজ প্যারিসের এক প্রাসাদের নিঃশব্দ কক্ষে কুড়িজন সহকর্মীর সামনে দাঁড়িয়ে। তার কালো চোখের গভীর। দৃষ্টিতে এক আশ্চর্য নির্লিপ্ততা আছে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে এক বিরাট আত্মবিশ্বাস। কারণ দীর্ঘ সংঘাতপূর্ণ জীবনে কখনো কোন বড় কাজে তিনি ব্যর্থ হননি। তিনি কখনো জীবনে মদ স্পর্শ করেননি এবং কোন মেয়ের সাথে একশয্যায় রাত্রিযাপন করেননি।
টেবিলের চারপাশ ঘিরে যে কুড়িজন ব্যক্তি ধৈর্যের সাথে ব্লোফিল্ডের কথা বলবার অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের সকলের দৃষ্টি কঠিন, সতর্ক ও শিকারীসুলভ। অবশ্য অন্য দুজন বৈজ্ঞানিকের চোখ স্বপ্ন ও সুদূরপ্রসারী।
আঠারজনের প্রত্যেকেই ষড়যন্ত্র ও সর্বাপেক্ষা জটিল ধরনের গুপ্ত সংবাদের আদান-প্রদানে বিশেষজ্ঞ। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, বহুদিন যাবত পাকা অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও কোন দেশের পুলিশ বাহিনী অথবা ইন্টারপোলের খাতায় কারো নামে একটি আঁচড় পর্যন্ত পড়েনি। লোকের চোখে তাঁদের পরিচয় বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসাবে। তাঁরা যে গুপ্ত প্রতিষ্ঠানের সদস্য সেই প্রতিষ্ঠানের নাম SPECTRE-The Special Executive for Counter Intelligence, Terrorism, Revenge and Extortion, অর্থাৎ প্রতিগুপ্তচর বৃত্তি, সন্ত্রাসবাদ, প্রতিহিংসা ও অত্যাচারে বিশেষ কার্যনির্বাহক সংস্থা।
FIRCO নামক এক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের আড়ালে এর কাজ চলে। SPECTRE -এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর্নস্ট স্ত্রাভ ব্লোফেল্ড।
.
সুগন্ধি নিঃশ্বাস
ব্লোফেল্ড উপস্থিত সকলের মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন একজোড়া চোখ অস্বস্তির সাথে তার দৃষ্টিকে এড়িয়ে গেল। তিনি আস্তে করে নিজের দুটি হাত টেবিলের নিচে নামিয়ে আনলেন। একটি হাত রইল উরুর ওপর এবং অন্যটি তার পকেট থেকে বের করে আনলো একটি পাতলা সোনার টিউব। ব্লোফেল্ড টিউবের ঢাকনা খুলে একটি সুগন্ধি ট্যাবলেট বার করে মুখে পুরলেন। এটা তার এক ধরনের বাতিক। যখনই তিনি কিছু অপ্রিয় কথা বলতে যান তখনই নিজের নিঃশ্বাসকে সুগন্ধি করে নেন। ব্লোফেল্ড এবারে বলতে শুরু করলেন– আমাদের আগামী বড় কাজ অর্থাৎ Plan Omega সম্বন্ধে রিপোর্ট পেশ করবার আছে। আমাদের হিসাব মত আজ পর্যন্ত সংস্থার আয়ের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মোটামুটি পনেরো লক্ষ্য পাউন্ড স্টার্লিং। আমাদের হিসাব অনুসারে এই উপার্জনের শতকরা দশ ভাগের কিছু অংশ সংস্থার মূলধনের সাথে যোগ করা হয়েছে এবং বাকি অংশ জমা হয়েছে বিভিন্ন খরচপত্রের জন্য। আমি নিয়েছি শতকরা দশ ভাগ এবং বাকিটা আপনাদের কুড়িজনের মধ্যে সমান করে ভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক সদস্যের লাভের পরিমাণ প্রায় ষাট হাজার পাউন্ড।
আমার মনে হয় বছরে কুড়ি হাজার পাউন্ড মোটেই যথেষ্ট নয়। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে Plan Omega আমাদের প্রত্যেককে প্রচুর অর্থ এনে দেবে, এবং যদি আমরা ইচ্ছা করি তবে ঐ কাজটির শেষে আমাদের বর্তমান প্রতিষ্ঠান উঠিয়ে দিয়ে যে যার নিজের কাজে মন দিতে পারি। কুড়ি জোড়া চোখ একসাথে সভাপতির চোখের ওপর স্থির হল। এরা প্রত্যেকেই খুশি হয়েছেন।
ব্লোফেল্ড আবার বলতে শুরু করলেন–আপনারা জানেন, আমাদের আগের বড় কাজটি মাসখানেক আগে শেষ হয়েছে। এর থেকে পুরো ১০ লক্ষ ডলার লাভ হয়েছে। এটি সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার আছে। তিনি নরম গলায় বললেন ৭ নং আপনি একবার উঠে দাঁড়ান। কিন্তু আসলে তার নজর ছিল ৭ নং এর পাশে বসা ১২ নং অর্থাৎ পিয়ের বোরদ-এর প্রতিক্রিয়ার ওপর। আপনাদের বোধহয় মনে আছে ঐ কাজটি ছিল লাস ভেগাস-এর এক হোটেলওয়ালার সপ্তদশী কন্যাকে অপহরণ করা। মেয়েটিকে নিখুঁত ভাবে চুরি করে কর্সিকায় নিয়ে যাওয়া যায়। আমরা দশ লক্ষ ডলার মুক্তিপণ দাবী করি, মেয়েটির বাবা এতে রাজী হন। প্রেতাত্মা সংঘ মেয়েটিকে পুরো অক্ষত দেহে তার বাবা মার কাছে ফিরিয়ে দেবার ভার নিয়েছিল কিন্তু জানা গেছে যে কর্সিকায় বন্দী থাকাকালীন মেয়েটির ওপর বলাৎকার করা হয়েছিল। সুতরাং মেয়েটিকে আমরা অক্ষত অবস্থায় তার বাবা মার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। তিনি আরো বললেন–আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ সব সময় থাকা দরকার। একজন সদস্যের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ গোটা কাঠামোকে দুর্বল করে দেওয়া। এসব ক্ষেত্রে আমি কি ব্যবস্থা অবলম্বন করি আপনারা ভালোভাবেই জানেন। আমি ইতিমধ্যেই মেয়েটির বাবার কাছে একটি চিঠি মারফত ক্ষমা প্রার্থনা করে পাঁচ লক্ষ ডলার ক্ষতিপূরণস্বরূপ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। এ ব্যাপারে আসল অপরাধীকে আমি খুঁজে বার করেছি। তার উপযুক্ত শাস্তি ও স্থির হয়ে গেছে।
ব্লোফেল্ড-এর ডান হাত টেবিলের নিচে চলে গেল। বোতামটা খুঁজে নিয়ে তিনি সুইচ টেনে দিলেন। ১২ নং-এর সমস্ত মুখ ঘেমে উঠেছে। নীল আকাশ থেকে যেন সহসা নেমে এল মৃত্যু, ভয়ঙ্কর মৃত্যু। ৩,০০০ ভোল্ট বিদ্যুতের লৌহ মুটি পিয়ের বোরদ-এর সমস্ত দেহকে টেনে ধনুকের মত বাঁকিয়ে দিল। চোখ দুটো একবার জ্বলজ্বল করে উঠে নিভে গেল। ব্লোফেল্ড সুইচ টেনে ১২ নং চেয়ারের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুৎস্রোত বন্ধ করলেন। সব শেষ।
ব্লোফেল্ড তাকালেন ৭নং-এর দিকে। বললেন, আপনি বসতে পারেন। আপনার আচরণে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। ১২ নং-এর মনোযোগ বিভ্রান্ত করার দরকার ছিল। কারণ তিনি জানতেন তার ওপরে সন্দেহ পড়েছে। তার দৃষ্টি এইভাবে না সরালে হয়ত অবাঞ্ছিত গোলযোগের সৃষ্টি হত। উপবিষ্ট সকলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। বিচারের ক্ষেত্রে ব্লোফেল্ড নিজের ক্ষমতার পূর্ণ প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেন না।
ব্লোফেন্ড এবার কাজের কথায় এলেন, আমাদের জার্মান বিভাগের কর্মী সাব অপারেটর G একটি মারাত্মক ভুল কাজ করে ফেলেছে। যার ফলে আমাদের প্ল্যানের পুরো সময় ব্যবস্থাকে আমি বদলে ফেলতে বাধ্য হচ্ছি। লোকটি রক্ত ব দলের সদস্য। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তার যথেষ্ট দক্ষতা আছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই গোঁয়ার লোকটি অন্তত আমাদের কোন কাজে আসবে না। প্ল্যান ওমেগা কে এই কারণে সাত দিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই পরিবর্তন একটু বিরক্তিকর হলেও বিপজ্জনক নয়। নতুন নির্দেশ ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়ে গেছে। পাইলট পেটাশীকে এক শিশি ইনফ্লুয়েঞ্জার জীবাণু দেওয়া হয়েছে। এটা খেলে সে অন্তত এক সপ্তাহের জন্য শয্যাশায়ী হয়ে পড়বে। সুতরাং তার আগামী পরশু যে আকাশে ওঠার কথা ছিল সেটা এক সপ্তাহ পিছিয়ে যাবে। এর মধ্যে ও সুস্থ হয়ে উঠবে এবং পেটাশীর ফ্লাইটের সঠিক তারিখ ও সময় আমাদের জানাবে। ব্লোফেল্ড বলে চললেন, অন্যান্য সব কাজ ঠিক ঠিক এগিয়ে চলেছে। ১ নং গর্ভগৃহ এলাকায় গুপ্তধন অনুসন্ধানের নাম করে বেশ জমিয়ে বসেছেন। আপনারা প্ল্যানমাফিক গর্ভগৃহ এলাকায় গিয়ে পৌঁছবেন। সকলে মিলে ১ নম্বরকে এই গুপ্তধন খোঁজার ব্যাপারে টাকা জোগাচ্ছেন–এই পরিচয়েই আপনারা ১ নং-এর জাহাজে গিয়ে উঠবেন। পানির নিচে সাঁতার কাটার জন্য আপনাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। পানির তলায় কাজ করবার সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব কড়া হওয়া চাই।
সিসিলীয় বিভাগের ফিডেলিও সিয়াক্কা শান্ত ও সতর্ক গলায় বললেন, বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে যে টাকা দাবী করা। করা হয়েছে তার সমমূল্যের সোনার বার প্যাকেটে করে প্লেন থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেওয়া হবে। প্যারাসুটের সাহায্যে সোনার প্যাকেটগুলোর ওপর ফসফরাসের প্রলেপ লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে রাতের বেলায় প্যাকেটগুলো উদ্ধার করা সহজ হবে।
ব্লোফেন্ড কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমাদের পরবর্তী কাজ হবে ঐ সোনা ঠিকমত পাচার করা। সাব অপারেটর ২০১-কে এ কাজের ভার দেওয়া হয়েছে। মারকিউরিয়াল জাহাজ এই সোনা বোঝাই করে ক্যাটানিয়া থেকে রওনা হবে এবং সুয়েজ খাল পেরিয়ে গোয়া অভিমুখে চলতে থাকবে। সুইস ফ্রাঁ ডলার এবং বলিভার–এই তিন রকম মুদ্রায় ব্যবহৃত নোটে টাকা গুনে নিয়ে মারকিউরিয়্যাল রওনা হবে গোঁয়ার দিকে। পথে এই টাকা আমাদের অংশ অনুযায়ী যথানিয়মে ভাগ করা হবে। পৌঁছবার পরে টাকাটা চার্টার্ড প্লেনে করে চলে আসবে জুরিখে। সেখানে বাইশটি বিভিন্ন সুইস ব্যাংকের ডিপোজিট ভল্টে এই অর্থের এক এক অংশ জমা করা হবে। ঐ ভল্টগুলোর চাবি এই মিটিং-এর শেষে সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। সকলে একে একে সমর্থন জানালেন। ব্লোফেল্ড বললেন, কর্মক্ষেত্রে ১ নম্বর-ই হবেন সর্বাধিনায়ক। তাঁর প্রতিটি আদেশ আপনারা আমার নিজের আদেশ বলে পালন করবেন। সকলেই একবাক্যে তাঁকে সমর্থন জানালেন।
.
প্রস্তুত হও
দিন দশেক আগে শ্রাবল্যান্ড থেকে ফেরার পর বন্ডের মন মেজাজ দারুণ ভাল আছে। তার শক্তি ও কর্মক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বন্ড অফিসে আসছে তাড়াতাড়ি আর বাড়ি ফিরছে দেরি করে। এতে মুশকিল হয়েছে বন্ডের সেক্রেটারী লোলিয়া পসনবি র। সুন্দরী মেয়েটির ব্যক্তিগত দেখা-সাক্ষাৎ, ঘোরাঘুরি সব বন্ধ হবার জোগাড়। শেষ পর্যন্ত লোলিয়া হতাশ হয়ে প্রিয় বান্ধবী মিস্ মানিপেনীর কাছে পরামর্শ চাইল। মিস্ মানিপেনী লোলিয়ার সৌভাগ্যকে বিলক্ষণ হিংসে করত। কিন্তু তবু তাকে যথেষ্ট সান্ত্বনা দিল।
সকাল বেলায় বড়সাহেবের ফোন পেয়ে বন্ড নিজের গাড়িতে চেপে সদরদপ্তরে পৌঁছে গেল। কার্পেট ঢাকা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বন্ড অনুভব করল সমস্ত অফিসে একটা থমথমে ভাব। M-এর ঘরের দরজার ওপরে একটা লাল রঙের বাতি জ্বলে উঠল। বন্ড গিয়ে ঢুকল সেই ঘরে । M ঘাড় ফিরিয়ে বন্ডকে দেখলেন। বললেন, বসে পড় 007। তারপর কয়েকটি ফুলস্ক্যাপ সাইজ ফটোস্ট্যাটু বন্ডের সামনে টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে সেগুলো পড়ে দেখতে বললেন।
খামের ওপর লেখা ব্যক্তিগত এবং অত্যন্ত জরুরী। তার নিচে প্রধানমন্ত্রীর নাম ও ঠিকানা। ডাকঘরের ছাপ রয়েছে ব্রাইটনের। খামের উল্টোদিকের ছবিতে একগাদা আঙুলের ছাপছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। খামের ভেতরের চিঠির সেই ফটোস্ট্যাটটা তুলে নিল বন্ড।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয়, আপনি বোধহয় জানেন গতকাল অর্থাৎ ২রা জুন রাত ১০টা নাগাদ দুটি পারমাণবিক অস্ত্র বহনকারী একটি ব্রিটিশ বিমানের ট্রেনিং ফ্লাইট শেষ করে ফিরে আসার কথা ছিল, কিন্তু সে বিমানটি এখনও ফেরেনি। বসকোম্ব ডাউন বিমান ক্ষেত্রে অবস্থিত ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর (RAF) ৫নং পরীক্ষামূলক স্কোয়াড্রনের একটি ভিলিয়া, ভিকেটার বিমান এটি। বিমানটি এক NATO ট্রেনিং ফ্লাইট-এ ছিল। আরোহী ছিলেন পাঁচজন কর্মী এবং একজন পর্যবেক্ষক। মোটামুটি ৪০,০০০ ফুট উঁচু দিয়ে দশ ঘণ্টা ওড়বার পক্ষে যথেষ্ট তেল এই বিমানে ছিল। কর্মী পাঁচজন এবং পর্যবেক্ষক সকলেই মারা গেছেন। আপনি তাদের আত্মীয়দের সেই মত জানিয়ে দিতে পারেন।
বিমান এবং বোমাদুটির অবস্থানের বিস্তৃত সংবাদ, যার সাহায্যে আপনারা সেগুলি উদ্ধার করতে পারবেন, আমরা। আপনাকে জানাতে পারি। এর বিনিময়ে আমাদের চাই দশ কোটি পাউন্ড। কি করে টাকা আমাদের কাছে পৌঁছতে হবে তার বিস্তৃত নির্দেশ সাথের কাগজটিতে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত টাকাটা সমমূল্যের সোনার বাট-এ দিতে হবে। সোনার বাটগুলোর সংখ্যা হবে ঠিক এক হাজার। এছাড়াও আরো দুটি শর্ত আছে। প্রথমত, এই সোনা আপনাদের যেখানে পৌঁছতে বলা হয়েছে সেখান থেকে সেগুলো উদ্ধার করা এবং যথাস্থানে চালান দেওয়ার ব্যাপারে আপনারা আমাদের কোন রকম বাধা দেবেন না। দ্বিতীয়ত, আপনার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত একটি ঘোষণাপত্র আমাদের কাছে পাঠাতে হবে। ঘোষণাপত্রে লেখা থাকবে, আপনারা এই SPECTRE সংস্থা এবং এর প্রতিটি সদস্যকে এ ব্যাপারে সবরকম দায়িত্ব থেকে রেহাই দিচ্ছেন। শর্তগুলো মেনে নেওয়ার শেষ সময় হচ্ছে ৩রা জুন থেকে ১০ই জুন। সতর্কিকরণের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আপনাদের সম্মতি না পেলে আমরা যে কোন একটি বড় পাশ্চাত্য শহরের ওপর এটম বোমা ফেলব এবং এই বিরাট প্রাণহানির দায়িত্ব পড়বে পুরো আপনাদের ওপর।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয়, এটাই আমাদের প্রথম ও শেষ চিঠি। ইতি– SPECTRE ।
(The Special Executive for Counter Intelligence, Terrorism, Revenge and Extortion)
বন্ড চিঠিটা ভাল করে পড়ে ফটোস্ট্যাটটি অন্যগুলোর উপর নামিয়ে রাখল। পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করে, সিগারেট ধরাল। বুক ভর্তি ধোঁয়া টেনে আবার বের করে দিল।
.
বাঘের শত্রু মোষে খায়
বন্ড বলল, কোন সূত্র পাওয়া গেছে স্যার?
অতি অল্প কিছুই পাওয়া যায়নি বলতে গেলে। এই SPECTRE দলের নাম জীবনেও শুনিনি। তবে এটা আমরা জানতাম যে, ইউরোপে একটা স্বাধীন গুপ্তচক্র বেশ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, প্লেনটি আয়ারল্যান্ডের পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত একেবারে ঠিকঠাক উড়ছিল। হঠাৎ নিয়মভঙ্গ করে ৪০,০০০ ফুট উচ্চতা থেকে নেমে আসে ৩০,০০০ ফুট এবং আটলান্টিকের ওপর দিয়ে চলাচলকারী অজস্ত্র এরোপ্লেনের ভীড়ে হারিয়ে যায়।
বন্ড বলল, আমেরিকায় DEW লাইনে কিছু ধরা পড়েনি?
খোঁজ চলছে তবে একটা ছোট সূত্র পাওয়া গেছে।
বন্ড জানতে চাইল। SPECTRE-এর লোকেরা কি করে বোমা ফাটাবে?
M দুই হাত প্রসারিত করে বললেন, একটা এটম বোমা এর ডগাটা সাধারণত TNT বিস্ফোরকে ভর্তি আর ল্যাজে থাকে পুটোনিয়াম। এই দুই এর মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। বোমা ফাটাতে এই ফাঁকা জায়গায় এক ধরনের Detonator লাগিয়ে দিতে হয়। বোমার ডগাটার প্যাঁচ খুলে যথাস্থানে একটা Detonator লাগিয়ে ডগার TNT-র সাথে একটা টাইম ফিউজ লাগানো দরকার, যাতে কোন প্লেন থেকে না ফেলেই TNT-কে বিস্ফোরিত করা যায়। এই করলেই বোমা তৈরি।
বন্ড একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবল পুরো ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য, কিন্তু তবু তা ঘটতে চলেছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের গুপ্তচর বিভাগ এরকম একটা ঘটনা আশংকা করছেন। বিশেষজ্ঞদের অনুমান যদি ঠিক হয় তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমরা হয়ে পড়বো আরো অসহায়। এটম বোমা তৈরির কোন রহস্যই বুঝি তার বাকি নেই। SPECTRE-কে যদি থামানো না যায় তবে এ সংবাদ নিশ্চয়ই বেরিয়ে পড়বে। আর প্রতিটি অপরাধী বৈজ্ঞানিক চেষ্টা শুরু করবে কি করে কয়েকটা এটম বোমা তৈরি করা যায়। তাদের সময় মত থামানো যদি সম্ভব না হয় তাহলে প্রত্যেকের টাকার দাবী মিটিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। বন্ড এম কে তার মতামত জানাল।
সারা পৃথিবীতে আমাদের স্বপক্ষের প্রতিটি দেশের গুপ্তচর বিভাগ কাজে নেমে পড়েছে। এই কাজের নাম দেওয়া হয়েছে, অপারেশন থান্ডারবল। এরোপ্লেন, জাহাজ, সাবমেরিন, আর যে কোনও পরিমাণের টাকা–সমস্ত কিছু আমাদের প্রয়োজনের অপেক্ষায় তৈরি আছে। মন্ত্রিসভা ইতিমধ্যেই একটা বিশেষ যুদ্ধবিভাগ সৃষ্টি করছেন। প্রতিটি খুচরো সংবাদ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এখানে। আমরা অনুমান করছি যে এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট আতঙ্কের সৃষ্টি হবে। কিন্তু সে আতঙ্ক কেবল ঐ বোমাসুদ্ধ প্লেনটি হারাবার জন্য চিঠির রহস্য একেবারে গোপন থাকবে।
বন্ড একটা সিগারেট ধরিয়ে M-কে বলল, তার ভূমিকাটা এখানে কোথায়? M বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে এই সব কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি 007। এসব কথা কাউকে না বলার কথা ছিল।
আমার মতে এ ব্যাপারের একমাত্র সূত্র হচ্ছে ঐ DEw অপারেটরের রিপোর্ট। সূত্রটা খুব নির্ভরযোগ্য নয়–অন্য কেউ এটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি তবু আমি আপাতত এটাকে মেনে নিয়েছি।
শেষ পর্যন্ত আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে প্রথম এবং দ্বিতীয় দুটি বোমারই লক্ষ্যস্থল ইউরোপের চেয়ে আমেরিকায় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ আমেরিকানরা এটম বোমা সম্বন্ধে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভীতু। তাছাড়া প্রথম বোমাটির লক্ষ্যবস্তু অর্থাৎ দশ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি ইউরোপের চেয়ে আমেরিকায় অনেক বেশি এবং SPECTRE এক ইউরোপীয় দল। সুতরাং ইউরোপের মধ্যে এরকম বীভৎস ধ্বংসলীলা চালাবার মতলব তাদের মাথায় নাও থাকতে পারে। মনে হয় ওরা যদি বোমা ফাটায় তবে আমেরিকাতে ফাটাতে চেষ্টা করবে। বলা বাহুল্য, এজন্য প্লেন সুদ্ধ বোমাগুলোকে আমেরিকার কাছাকাছি কোথাও পাচার করবার চেষ্টাই স্বাভাবিক। স্বভাবতঃই ওরা চাইছে, যে ওসব ফাটাফাটি না করে যত শীঘ্র সম্ভব টাকা হাতিয়ে নিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা হোক। এটাই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা। আমাদের হাতে সময় রয়েছে আর পৌনে সাত দিন। আমি তোমার ওপরে অনেকটা নির্ভর করছি-একথা বলে M বন্ডের দিকে ঘুরে তাকাল। যদি তোমার কিছু বলার না থাকে তাহলে রাত বারোটা পর্যন্ত প্রতিটি নিউইয়র্কগামী প্লেনে তোমার জায়গা বুক করা আছে। রওনা হয়ে পড়ো। নিউইয়র্ক থেকে BOAC-র প্লেন ধরে বাহামার দিকে পাড়ি দেবে। তোমার পরিচয় একজন ধনী যুবক, বাহামা দ্বীপপুঞ্জে মনের মত সম্পত্তি খরিদ করবার চেষ্টায় যাচ্ছ। এই ছদ্ম পরিচয়ে তুমি যে কোনও জায়গায় যত ইচ্ছে খোঁজখবর নিতে পারবে–কেউ সন্দেহ করবে না। ওখানকার রাজ্যপাল জানেন যে তুমি আসছ। তার অধীনে খুব তৈরি এক পুলিশ বাহিনী আছে। আর CIA-ও বোধহয় ভাল একজন লোককে ওখানে পাঠাবে। তার সাথে থাকবে আধুনিক বেতার যোগাযোগ যন্ত্র। তোমার পাওয়া প্রত্যেকটি তথ্য ও খুঁটিনাটি আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে জানানো চাই।
ঠিক আছে, স্যার, বন্ড বলল এবং দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। বন্ডকে বের হতে দেখে কিছু দূরে ভক্সওয়াগন গাড়িতে বসা একজন লোক শার্টের ভিতর দিয়ে একটা লম্বা নল-ওয়ালা ০.৪৫ পিস্তল খাপ থেকে বার করল। কাউন্টলি জানতেন না, বন্ড যেখান থেকে বেরোল, সেই বিরাট বাড়িটা কিসের। তিনি সোজাসুজি শ্রাবল্যান্ডের রিসেপশনিস্টের কাছ থেকে বন্ডের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করেছেন। এবং ব্রাইটনের হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া মাত্র সতর্কভাবে বন্ডের পিছু নিয়েছেন। এই গাড়িটা তিনি ভাড়া করেছেন একটা ভুয়া নামের সাহায্যে। বন্ডকে শেষ করে সোজা লন্ডন এয়ারপোর্টে গিয়ে পরবর্তী ইউরোপগামী প্লেনে উঠে পড়বেন। কাউন্ট লিপ আশাবাদী মানুষ। অতি নির্মম প্রতিহিংসাপরায়ণ তিনি। তিনি বিবেচনা করে দেখেছেন যে SPECTRE যদি এই খুনের কথা জানতেও পারে তাদের অসন্তুষ্ট হওয়ার কোন কারণ নেই।
বন্ড নিজের বেন্টলিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। রাস্তার বিপরীত দিকে ভত্সওয়াগনের প্রায় একশ গজ পেছনে SPECTRE-এর ৬নং গগলস জোড়া চোখের ওপর নামিয়ে তার বিরাট ট্রায়াম্ফ মোটর সাইকেল স্টার্ট করে রাস্তার নেমে এলেন। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়ির ভিড় কাটিয়ে সাব অপারেটর G, অর্থাৎ কাউন্ট লিপের গাড়ির পেছনের চাকার দশ গজের মধ্যে এসে পড়লেন সহজেই। তিনি বুঝতে পারছিলেন না, সামনের বেন্টলি গাড়িতে কে আছে আর কেনই বা তাকে অনুসরণ করছে। অবশ্য তার কাজ হচ্ছে শুধু ঐ ভওয়াগনের চালককে খুন করা। ছনম্বর তাঁর কাঁধ থেকে ঝোলানো চামড়ার থলের ভেতর হাত ঢোকালেন, বার করে আনলেন একটা ভারী হাতবোমা।
সাব অপারেটর G-ও অপেক্ষা করছিলেন ভীড় হালকা হওয়ার জন্য। আস্তে আস্তে সামনের গাড়ির সংখ্যা কমে এল। বেন্টলির চালকের আসনে বসা বন্ডকে দেখা যাচ্ছে। কাউন্ট শেষ বারের মত সামনের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে পিস্তল তুলে নিলেন। ঠিক এক চুলের জন্য কাউন্টের প্রথম গুলিটা বন্ডের চোয়ালের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এক সহজাত প্রবৃত্তির বশেই হয়ত সজোরে ব্রেক কষে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল বন্ড। সে ভালভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে নিয়ে ঘাড় তুলল।
প্রায় সাথে সাথে গুলির শব্দের বদলে শোনা গেল এক বিস্ফোরণের আওয়াজ। হৈচৈ আর প্রবল আর্তনাদ।
বেল্টলির সামনে বাঁ দিকে কাৎ হয়ে পড়ে আছে ভওয়াগনটা। প্রায় সমস্ত ছাদ গেছে উড়ে। দূর থেকে ভেসে এল পুলিশের গাড়ির সাইরেনের আওয়াজ। বন্ড ভীড় ঠেলে দ্রুতপদে সদরদপ্তরে ফিরে চলল।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হতে বন্ডকে দুটো নিউইয়র্কগামী প্লেনের আশা ত্যাগ করতে হল। পুলিশ আগুন নিভিয়ে মানুষটার, যন্ত্রপাতির এবং বোমার খোলের যে কটা টুকরো অবশিষ্ট ছিল তা মর্গে পাঠিয়ে দিয়েছে। অবশ্য সেই মোটর সাইকেল আরোহীর কথা মনে করতে পারলেন অনেকেই। বোমা ছুঁড়েই স্রেফ উড়ে বেরিয়ে গিয়েছে বেকার স্ট্রীটের দিকে।
বন্ড কোন সাহায্য করতে পারল না। ভক্সওয়াগনের ছাদটা ছিল খুব নিচু। ফলে চালককে সে একেবারেই দেখতে পায়নি।
গুপ্তচর বিভাগ পুলিশী রিপোর্টের একটা কপি চেয়ে রাখল। M নির্দেশ দিলেন যে, সেটি যেন থান্ডারবল যুদ্ধ বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি অল্প সময়ের জন্য আবার বন্ডের সাথে দেখা করলেন।
বন্ড যখন দপ্তর থেকে বাইরে এল তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাড়ি ফিরে গোসল করে সে নিজের জিনিসপত্র একটা বড় স্যুটকেসের মধ্যে ভালো করে গুছিয়ে নিল তারপর গিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। খাওয়া-দাওয়া সেরে সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল–অস্ত্রগুলো দেখে নিতে হবে।
.
মরণ আর মরণ
SPECTRE-এর দিক থেকে দেখতে গেলে প্ল্যান ওমেগা ব্লোফেল্ড যেরকমটা আশা করেছিলেন, ঠিক সেইভাবে এগিয়ে চলেছে। প্ল্যানের প্রথম থেকে তৃতীয় অংক পর্যন্ত নিখুঁতভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে। জোসেফ পেটাশী অর্থাৎ মরহুম মিঃ জোসেফ পেটাশীকে সুচিন্তিতভাবে এ কাজের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। অতি অল্প যে ক জন বাছাই করা ইটালিয়ান পাইলটকে জার্মান বিমানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, এ তাদের একজন। পেটাশীর দলের বিমানগুলিতে ছিল নতুন হেক্সোজেন বিস্ফোরক ভর্তি নব-আবিষ্কৃত জার্মান প্রেশার মাইন।
সে সময় মিত্রশক্তি বাহিনী ইটালীর মেরুদণ্ড বেয়ে স্রোতের মত উঠতে শুরু করেছে। পেটাশী নিজের ভবিষ্যৎ আঁচ করতে পেরেছিল এবং চটপট কাজেও লেগে পড়ল সেই মত। একদিন যথারীতি বিমানে চেপে টহল দেওয়ার সময়, সে খুব যত্নের সাথে তার সঙ্গী পাইলট এবং নেভিগেটরের মাথার পেছনে একটি করে গুলি চালিয়ে খতম করে দিল। তারপর সেই বিরাট প্লেনকে ঠিক সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বারি বন্দরে এনে নামাল। স্বভাবতঃই এই দুঃসাহসিক বীরত্বের জন্য পেটাশী আমেরিকান ও ব্রিটিশ উভয় পক্ষ থেকে সম্মান পদকে ভূষিত হল। এর ওপর মিত্রপক্ষকে একটা আস্ত প্রেশার মাইন উপহার দেওয়ার জন্য বিশেষ তহবিল থেকে নগদ পুরস্কার পেল ১০,০০০ পাউন্ড। NATO-র অগ্রবর্তী আক্রমণকারী বিমানবাহিনীর কাজে নির্বাচিত ছয় জন ইটালিয়ানের মধ্যে স্থান পেল পেটাশী। তার এক আশ্চর্য মোহ আছে দামী ও চটকদার সব জিনিসপত্রের ওপর। এটা তার চিরকালের অভ্যেস। সে চাইছিল বিমানবাহিনীর সংস্পর্শ থেকে অনেক দূরে সরে যেতে। এর অর্থ হচ্ছে অন্য কোন দেশে, অন্য কোন নাম। নিয়ে থাকতে হবে তাকে। কিন্তু এর জন্য তার চাই একটা পাসপোর্ট, অজস্র টাকা, আর সঠিক ব্যবস্থা। ব্যবস্থাটা হঠাৎ হয়ে গেল। সে ঠিক যে রকম বন্দোবস্তের জন্য লালায়িত ছিল তা একদিন ফন্ডা নামক একজন ইটালিয়ানের আকারে এসে উপস্থিত হল তার সামনে। ফন্ডা ছিল SPECTRE-এর তদানীন্তন ৪ নম্বর। ফন্ডার ফেলা টোপ পেটাশী। উদগ্র লালসার সাথে গিলে নিল। পুরো পরিকল্পনাটা পরীক্ষামূলকভাবে সাজানো। পেটাশীর কাজ হবে ট্রেনিং কোর্সের সময় ভিন্ডিকেটার বিমানটাতে চড়ে পড়া আর প্লেনটাকে লোপাট করে নির্দিষ্ট এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া। পেটাশীকে জানানো হল তারা কিউবার এক বিপ্লবী দল। এই কাজের বিনিময়ে পেটাশী পাবে দশলাখ ডলার। ২রা জুন রাত আটটার সময় ভিন্ডিকেটার যখন সগর্জনে রানওয়ে বেয়ে আকাশে উঠল, পেটাশীর মনের অবস্থা তখন উত্তেজিত, কিন্তু নিশ্চিন্ত। সে মনে মনে ভাবল পূর্ব-পশ্চিমের বিমানপথ থেকে উত্তর দক্ষিণ বিমান পথ ধরে বাহামার দিকে ঘুরে যাবার সময় বেশ একটু কায়দা করতে হবে। আসল কাজ হচ্ছে প্লেন ল্যান্ড করানো। সে সময় খুব শক্ত নার্ভের প্রয়োজন। কিন্তু দশ লাখ ডলারের জন্য নার্ভদের সহজেই শক্ত হতে বলা চলে। সে বায়ুর গতিবেগ ও প্লেনের উচ্চতা পরীক্ষা করল। শেষে মানচিত্র রাখবার ধাতব তাকটার দিকে পেছন করে দাঁড়াল। তার ডান হাত চলে গেল পকেটের ভেতর। স্পর্শের সাহায্যে রিলীজ ভাটা খুঁজে নিয়ে সে গুণে গুণে তিনটে প্যাঁচ ঘুরিয়ে দিল। টিউবের সরুমুখ খুলে গেল। পেটাশী আস্তে করে পকেট থেকে সেটা বের করে তাকের অজস্র লগ আর চার্টের পেছনে ফেলে দিল।
পেটাশী ফুর্তির সাথে হাসল। সে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। অক্সিজেনের মুখোশটা পরে নিয়ে রেগুলেটর ঘুরিয়ে ১০০ পার্সেন্ট অক্সিজেনে তুলে দিল–রক্তের বিষটুকু তুলে ফেলার জন্য। তারপর আরাম করে বসে দেখতে লাগল। তিন-চার মিনিটের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল মর্মান্তিক সংগ্রাম একটু হাওয়ার জন্য। সহপাইলট আর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার একসাথে তাদের টুল থেকে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে।
পেটাশী হাতে রবারের গ্লাস্ পরে অক্সিজেনের মুখোশ মুখের ওপর জোরে চেপে ধরে এগিয়ে গেল। সায়ানাইডের টিউবটা তুলে নিল। পঁাচ ঘুরিয়ে বন্ধ করল টিউবের মুখ। তারপর মৃতদেহগুলি সরিয়ে এক শিশি কৃস্টাল ছড়িয়ে দিল। অক্সিজেনের মুখোশ পরেই কন্ট্রোলরুমে গিয়ে বসল। প্লেনটাকে ৩২,০০০ ফুটে নামিয়ে আনল, তারপর ঢুকে পড়ল। বিমানপথের মধ্যে। নিশ্চিন্ত হয়ে পেটাশী বসল পাইলটের আসনে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ভিন্ডিকেটার আকাশে ওঠার পর চার ঘণ্টা কেটে গেছে। আমেরিকার উপকূল বোধহয় দেখা দিয়েছে। সে নিজের সিটে ফিরে এল কন্ট্রোলে হাত রেখে প্লেনটাকে মোচড় দিয়ে বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দিল। এবার সে উড়ছে দক্ষিণ দিকে। এটা হচ্ছে শেষ পর্যায়। এবার সে প্লেনটাকে ল্যান্ড করানোর ব্যাপারে মাথা ঘামাতে শুরু করবে। সে পকেট থেকে নোটবুক বের করে নিজের অবস্থান, গতিবেগ ও রাস্তা দেখে নিল। গ্রীনউইচের সময় এখন রাত তিনটে, নাসাউ-এর সময় রাত ন টা। মেঘের পর্দার আড়াল থেকে চাঁদটা বেরিয়ে আসছে।
পেটাশী ব্রেক দিয়ে গতিবেগ কমাতে লাগল। তার চোখ অল্টিমিটারের দিকে আর নিচের ঝকঝকে সমুদ্রের দিকে। চাঁদের আলোয় সমস্ত সমুদ্রের পানি স্নিগ্ধ আলোয় ঝলমল করছে। এবার সে এসে পড়ল এক অন্ধকার দ্বীপের ওপর।
লাল আলোটা একেবারে নাক বরাবর সামনে। প্লেনটা শূন্যে ছোট্ট একটা লাফ দিল। আবার ধাক্কা, ব্যাস! পেটাশী সত্যিই প্লেনটাকে নামাতে পেরেছে। প্লেনটা খুব আস্তে আস্তে পানির ভিতর তলিয়ে যাচ্ছিল। জরুরী অবস্থায় বেরোবার জন্য প্লেনের বাঁ দিকে একটা ছোট দরজা আছে। সেই দরজা খুলে সে বাইরে বেরিয়ে এল।
ইতিমধ্যেই একটা জলি বোট এসে পড়েছে প্লেনের পিছন দিকে। তাতে ছ জন লোক। একটি লোক পেটাশীর দিকে এগিয়ে এল। একটা লম্বা ছোরা তার অনাবৃত থুতনির দিকে ঢুকিয়ে দিল। পেটাশী বোধহয় কিছুই বুঝতে পারল না–শুধু ক্ষণিকের বিস্ময়, সুতীব্র যন্ত্রণা, তারপর অজস্র উজ্জ্বল আলোর বিস্ফোরণ। পেটাশীর মৃতদেহটা নিয়ে লোকটা পানির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
হত্যাকারী এবার হেঁটে গিয়ে জলি বোটে উঠল। এবার সবাই মিলে অজস্র ফেনায় ঢাকা পানির মধ্যে ডুব দিল। শেষ লোকটি ডুব দেওয়ার পর বোটের মেকানিক একটা আন্ডার ওয়াটার সার্চলাইট-এর মুখ নিচের দিকে নামিয়ে দিয়ে ডুবুরিদের জন্য দড়ি ছাড়তে লাগলেন। খানিক পরে সার্চলাইটটা জ্বালিয়ে দিতেই ডুবন্ত প্লেনটার চারদিকে ভরে গেল উজ্জ্বল আলোর কুয়াশা। মেকানিক বোট থামিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন।
.
ডিস্কো ভোলান্তে
রাত্রি শেষ হতে আর আধঘণ্টা দেরি। প্রেতাত্মা সংঘের ১ নম্বর বেতার যন্ত্রের ঘরে ঢুকলেন। বেতারে ২ নম্বরকে ধরে দিতে বললেন অপারেটরকে।
কিছুক্ষণ পর–শুনতে পাচ্ছি। আমি ২ নম্বর। একটা গম্ভীর স্বর শোনা গেল। কাজ সফল হয়েছে। এখন সওয়া দশটা। পরের পর্যায় পৌনে এগারটার মধ্যে শেষ হবে। কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। ধন্যবাদ। আর কিছু শোনা গেল না। ১ নম্বর হেঁটে গিয়ে নামলেন ইয়েটের খোলের দিকে। সেখানে দ্বিতীয় ডুবুরি দলের চারজন বসে ধূমপান করছিল। তাদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের নামবার আর বোধহয় বেশি দেরি নেই। ধীরে-সুস্থে কাজ কর। ১ নম্বর লোহার। সিঁড়ি বেয়ে ইয়েটের খোল থেকে ডেকের ওপর উঠে এলেন। দু শ গজ দূরে ফাঁকা সমুদ্রের ওপর ছোউ জলি বোটটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সার্চলাইটের আলোয় সমুদ্রগর্ভের কিছুটা অংশ সোনার মত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সার্চ লাইটের কারেন্ট দিচ্ছে একটা ছোট জেনারেটর। এখান থেকে সবচেয়ে কাছের দ্বীপটির দূরত্ব পাঁচ মাইল। প্ল্যান ওমেগা এগিয়ে চলেছে নিঃশব্দে এবং দ্রুতগতিতে।
১ নম্বরের আসল নাম এমিলিক ওলার্গো। এক বিশাল ও অসাধারণ সুপুরুষ। তার চেহারায় এমন এক জান্তব আকর্ষণ আছে যা, যে কোন মেয়ের মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। তিনি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ। তার রক্তের মধ্যে রয়েছে লুণ্ঠনের বীজ। তার প্রকৃতি অন্যরকম। তার প্রতিটি কাজের পেছনে থাকে এক অপরূপ সূক্ষ্মতা এবং এক অতি শীতল মস্তিষ্ক, যার সাহায্যে প্রতি ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর শিকারদের প্রতি হিংসা অনায়াসে এড়াতে পেরেছেন। প্রেতাত্মা সংঘের পক্ষে এবং প্ল্যান ওমেগা র সর্বাধিনায়ক হওয়ার পক্ষে তিনি ছিলেন এক আদর্শ দস্যু।
একজন নাবিক দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। বলল, ওদের সিগন্যাল পাওয়া গেছে। রথ আর স্লেজ রওনা হয়েছে।
ধন্যবাদ। কোন বড় কাজের উত্তাপ এবং উত্তেজনার মধ্যেও লার্গো এক প্রশান্তির সৃষ্টি করতে পারতেন। দূর থেকে দেখা গেল পানির নিচে থেকে জোনাকীর মত ছোট একটা আলো তবৃত করে জলি বোটের দিকে এগিয়ে আসছে। কল্পনার চোখে লার্গো সমুদ্রের অনেক তলায় কর্মরত আটজন ডুবুরির প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালন দেখতে পাচ্ছিলেন। এই প্ল্যান ওমেগা র পেছনে যে কতবড় একটা প্রচেষ্টা ও উদ্ভাবনীশক্তি কাজ করছে, তা ভেবে লার্গো আর একবার বিস্মিত হলেন।
জলি বোটের কাছে পানির ওপর একটা ছোট আলোর ঝলক দেখা গেল। ডুবুরীরা একে একে ভেসে উঠছে…তাদের ঘুমের কাঁচের আবরণীতে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে ঝিলিক দিচ্ছে। তারা একে একে মই বেয়ে ওপরে উঠে এল। ইয়টের ক্যাপ্টেন লার্গোর পাশে এসে দাঁড়ালেন। লার্গো প্রশ্ন করলেন ওদের প্রত্যেককে এক গ্লাস করে হুইস্কি দাও। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আবার ডুব দিতে হবে। কোসে-কে বল আমার সাথে দেখা করতে।
পদার্থবিদ কোৎসের চোখে চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। লাগো জানতে চাইলেন কোন সমস্যা আছে কি না? কোৎসে জানালেন–সব কিছুই হাতের কাছে আছে, কোন সমস্যা নেই। আমি গিয়ে কাজটা শেষ করে ফেলছি। লাগো তাকিয়ে তাকিয়ে কোসেকে অস্থিরভাবে ডেক বেয়ে নেমে যেতে দেখলেন। তিনি ইয়টের ককপিট ব্রিজে গিয়ে ঢুকলেন। ক্যাপ্টেন সেখানে অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসেছিলেন। লার্গো বললেন, ঠিক আছে রওনা দাও। ক্যাপ্টেন তার পাশের অজস্র বোতামের মধ্যে স্টার্ট লেখা বোতামটি টিপে দিলেন। ইয়ট চলতে শুরু করল। স্পীডোমিটারের কাঁটা ৪০ নট-এ। বিশাল ইয়ট উজ্জ্বল নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের পানি ছুঁয়ে যেন উড়ে চলল। এই ইয়টের নাম ডিস্কো ভোলান্তে। জলযানটির ওজন ১০০ টন এবং সর্বোচ্চ গতিবেগ ৫০ নট। এই ডিস্কোর খ্যাতিতেই লার্গো অল্পদিনের মধ্যেই এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় লক্ষপতি হয়ে উঠলেন। আর ডুবুরি ভর্তি ইয়েটে করে তার সব রহস্যময় সমুদ্রযাত্রা অনেক গরম গুজবের সৃষ্টি করল। সকলেই জানল যে, লার্গো একটা গুরুতুপূর্ণ গুপ্তধনের সন্ধা কাজ চালাচ্ছেন। জলদস্যুদের একটা গুপ্ত মানচিত্র পাওয়া গেছে। এক স্পেনদেশীয় জাহাজ অনেকদিন ধরে এখানকার সমুদ্রগর্ভে পড়ে আছে, প্রবালের আস্তরণের তলায়। লার্গো নাকি এখন অপেক্ষা করছেন তার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য।
সত্যিই তাই হল। দুদিন আগে দেখা গেল সেই শেয়ার হোল্ডারটা একে একে নাসাউ এসে পৌঁছচ্ছেন নানান দিক। থেকে। তাদের মোট সংখ্যা উনিশ। আর সেই দিন সন্ধ্যাবেলা সব ক জন অতিথি ওঠবার পর ডিস্কো র ইঞ্জিনের মৃদু গর্জন শুরু হল। ঠিক যখন রাত্রি নামবো নামবো করছে, চমৎকার ঘন নীল আর সাদা রঙের ইয়েটটা পানি কেটে বন্দর থেকে রওনা হল। খোলা সমুদ্রে পড়বার পর ইঞ্জিনের আওয়াজ গভীর গর্জনের রূপ নিল। সেই আওয়াজ দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সরতে সরতে শেষে আর শোনা গেল না। সত্যিই ঐ দিকটাকে গুপ্তধনের আড়ৎ বলা চলে। স্থানীয় বিখ্যাত কয়েকটা গুপ্তধন ও-এলাকায় লুকানো আছে বলে সকলে ধারণা। প্রতিবছর এইসব বা ডোবা জাহাজের ধনরত্নের অনুসন্ধান চলে। ১৯৫০ সালে নাসাউ-এর দুই ব্যবসায়ীর পাওয়া ৭২ পাউন্ড ওজনের সোনার বাটের কথা সকলেই। জানে। ওটা নাসাউ ডেভেলপমেন্ট বোর্ডকে উপহার দেওয়া হয়।
দক্ষিণ দিকে অনেকটা চলবার পর সমস্ত আলো নিভিয়ে ডিস্কো একটা বিরাট চক্র কেটে পশ্চিম দিকে ঘুরে গেল। এসে পৌঁছল এই প্লেন নামবার জায়গাটাতে, যেখান থেকে এখন সে রওনা হচ্ছে। এখান থেকে নাসাউ ১০০ মাইল।
ডিস্কো বেশ জোরে আসছিল। শেষে গতি কমিয়ে আস্তে এই দ্বীপের কাছাকাছি এসে থামল, এই ছোট প্রবাল দ্বীপটির নাম ডগ আইল্যান্ড। ডিস্কো র খোলের মধ্যে লার্গো এবং আরো চারজন ডুবুরি পানির তলার দরজাটা খোলবার অপেক্ষায় বসেছিল। সমুদ্রের পানি যেন ফেটে পড়ে ঢুকল খোলের ভেতর। ডুবে গেল পাঁচজন লোক। তারপর তারা সীট ছেড়ে ভোলা পানির দরজা দিয়ে নিচে ডুব দিল । চাঁদের আলোর কুয়াশাভরা সমুদ্রের ভেতর দিয়ে তারা সাঁতার কেটে চলল। একটু পরেই প্রবাল দ্বীপের গা দেখা দিল। সমুদ্রের ভেতরের দ্বীপের তলার দিকটা পানির ঢেউয়ে এমন ক্ষয়ে গেছে যে পুরো দ্বীপটাকে নিচ থেকে একটা বিশাল ব্যাঙের ছাতার মত দেখাচ্ছে। লার্গো তার পায়ে আটকানো সাঁতার কাটবার পাখনা জোড়া নামিয়ে একটা ধাপের ওপরে ব্যালেন্স রেখে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে তার আশেপাশের জায়গায় টর্চ ফেলতে লাগলেন। তারপর একটি ফাটলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। পানির তলার এই গুহা প্রায় দশ গজ লম্বা। লার্গো দলের সবাইকে পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। এখান থেকে একটা সরু ফাটল সোজা ওপরে দ্বীপের মাটি পর্যন্ত উঠে গেছে। গুহার দেওয়ালে, পানির আয়ত্তের ঊর্ধ্বে, লার্গোর লোকেরা হাতুড়ি মেরে খোটা বসিয়ে বসিয়ে চটপট দুটো দোলনা বানিয়ে ফেলল এটম বোমা দুটোর জন্য। এবার বোমা দুটোকে লোহার বারে তৈরি দোলনায় রেখে স্ট্র্যাপ এটে দিল। লার্গো ফলাফল পরীক্ষা করে খুশি হলেন। পানিকেটে শান্তভাবে ইয়টে ফিরে এল পাঁচজন। অপরূপ সুন্দর ইয়টটা মসৃণভাবে পানি কেটে উড়ে চলল।
লার্গো ডুবুরির সাজসরঞ্জাম খুলে রেখে নিজের সিংহ কটিতে তোয়ালে জড়িয়ে বেতার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে ব্লোফেল্ডকে তৃতীয় পর্যায়ের সফলতার খবরটি পৌঁছে দিলেন। লাগো মনে মনে। ভাবলেন কাজের বার আনা ভাগ মেরে এনেছি। স্বয়ং শয়তান ছাড়া কেউ আমাদের থামাতে পারবে না। এবার লার্গো নিজের ঘরে ঢুকে তাঁর প্রিয় পানীয়ের গ্লাসটি খুব আরামের সাথে শেষ করে ফেললেন।
.
ডোমিনো
স্যাফায়ার ব্লুরঙের MG টু-সীটারটির আরোহিণী পার্লামেন্ট স্ট্রীটের ঢাল দিয়ে বন্দুকের গুলির মত নেমে এসে বে স্টীটের সংযোগস্থলে প্রশংসনীয়ভাবে গাড়ির গীয়ার তৃতীয় থেকে দ্বিতীয়ে টেনে আনল। তারপর সেকেন্ড গীয়ারে রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে থামল নাসাউ-এর বিরাট দোকান দি পাইপ অফ পীস -এর সামনে। প্রায় কুড়ি গজ দুরে দাঁড়িয়ে বন্ড মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিল। মেয়েটি দোকানের মধ্যে ঢুকে যেতেই বন্ডও পা চালিয়ে দোকানে ঢুকে পড়ল। মেয়েটি ততক্ষণে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে দোকানদারের এক সহকারীর সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছে। আরে আমি তো আপনাকে বলছিই যে আমার সিনিয়র সার্ভিস সিগারেট চাই না। সিগারেটের নেশা কাটানোর মত কোন সিগারেট থাকলে দিন আমাকে। সহকারীটির ছিটগ্রস্ত টুরিস্ট সামলানোর অভ্যেস ছিল।
পাশ থেকে বন্ড স্থির ভাবে মেয়েটিকে বলল, ধূমপান কমাবার ইচ্ছা থাকলে আপনি দুরকম সিগারেটের মধ্যে থেকে বেছে নিতে পারেন।
মেয়েটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, আপনি কে?
আমার নাম জেমস বন্ড। সিগারেটের নেশা ছাড়ার ব্যাপারে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ। আমি প্রায়ই এ কাজ করে থাকি।
মেয়েটি বন্ডের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল। এ লোকটিকে এর আগে নাসাউ-এ দেখেনি। এই গরমের মধ্যেও ভদ্রলোককে বেশ ঠাণ্ডা আর পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। মেয়েটি বুঝতে পারল বন্ড আলাপ জমাবার চেষ্টা করছে। ভদ্রলোকের চেহারা বেশ উত্তেজক ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ। খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, ঠিক আছে বলে যান।
সিগারেট ছাড়বার একমাত্র উপায় হচ্ছে ছেড়ে দেওয়া এবং আবার না ধরা। আর যদি আপনি দু এক সপ্তাহের জন্য অভ্যেসটা ছেড়ে দেওয়ার ভান করতে চান তাহলে কম সিগারেট খেয়ে লাভ নেই। বন্ড সহকারীটাকে বলল, এক কার্টন। ফিল্টারওয়ালা কিং সাইজ ডিউক সিগারেট। কার্টনটা হাতে পেয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিল।
কিন্তু আপনি–মানে, আপনি কেন আবার– কিন্তু বন্ড ইতিমধ্যেই কার্টনটার এবং নিজের জন্যে এক প্যাকেট চেস্টার ফিল্ডের দাম চুকিয়ে দিয়েছে। ওরা বাইরে বেরিয়ে এল। সাংঘাতিক গরম বাইরে। বন্ড বলল, সিগারেটের কথা উঠলেই পানীয়ের কথা এসে পড়ে। আপনি ড্রিংক করাটা ছাড়বার চেষ্টা করছেন না কি?
মেয়েটি বিচিত্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল–আপনি বড় চটপট এগোচ্ছেন মিঃ…বন্ড। ঠিক আছে, চলুন! তবে শহরের বাইরে কোথাও। চলুন আমার গাড়িতেই যাওয়া যাক্।
বন্ড মেয়েটি সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানে। আজ সকালে যে শ খানেক ইমিগ্রেশন ফর্ম সে উল্টেপাল্টে দেখেছে তার মধ্যে একটি হল এই মেয়েটির নাম–ডোমিনেটা ভিতালি। ছ মাস আগে ডিস্কো ভোলান্তে চেপে তার আবির্ভাব হয়েছিল নামাউ-এ। মেয়েটি যে লাগোর রক্ষিতা সেটা বুঝতে কারোর বাকি ছিল না।
পুলিশ কমিশনার হার্লিং এবং ইমিগ্রেশন ও কাস্টম্স-এর অধিকর্তা পিটম্যান এই মেয়েটিকে এক কথায় ইটালিয়ান বেশ্যা বলে অভিহিত করেছিলেন। বন্ড বুঝল মেয়েটি অবশ্যই স্বেচ্ছাচারী তবে তার ব্যক্তিত্ব আছে। আর একটা নির্দিষ্ট চরিত্রও আছে। বন্ড দেখল মেয়েটি গাড়ি চালাচ্ছে একেবারে পুরুষ মানুষের মত।
MG গাড়িটা শার্লি স্ট্রীট থেকে ইস্টার্ন রোডে চলতে লাগল উপকূল বেয়ে। একটা তীব্র গতি মোটর বোট সশব্দে উপকূলের কাছে এসে পড়ল। তার পেছনে একটা মেয়ে ওয়াটার স্কী-তে চড়ে ঢেউগুলোর ওপর দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় এঁকেবেঁকে উড়ে আসছে। একটা চমৎকার উজ্জ্বল দিন। বন্ডের মন ক্ষণেকের জন্য উধাও হয়ে যেতে চাইল।
বাঁ দিকে একটা রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটি এক ঝোঁপ ক্যাসুয়ারিনার ছায়ায় গাড়ি পার্ক করে রাখল। তারপর দুজনে গাড়ি থেকে বেরিয়ে রেস্তোরাঁয় দরজা আর এক ডাইনিং হল পার হয়ে এসে পৌঁছল ভাঙা পাথরের জেটির ওপর তৈরি এক ছোট্ট বারান্দায়। তারা ঠিক পানির ধারে একটা ঠাণ্ডা টেবিল বেছে নিয়ে বসল।
বন্ড ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক মধ্যাহ্ন। আপনি কড়া পানীয় নেবেন না হালকা?
মেয়েটি বলল, হালকা। তারপর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আরাম করে বসে বন্ডকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কবে এসেছেন? আপনাকে তো দেখিনি এদিকে। আজ সকালেই পৌঁছেছি আমি। নিউইয়র্ক থেকে এসেছি। একটা সম্পত্তির খোঁজে এসেছি। আপনি এখানে কতদিন আছেন?
প্রায় ছ মাস। আমি একটা ইয়টে চড়ে এসেছি। ডিস্কো ভোলান্তে। পানীয় এসে পড়ল। মেয়েটি আঙুল দিয়ে থিতিয়ে পড়া খয়েরী উরস্টার সস্টাকে মিশিয়ে নিয়ে আধ গেলাস খেয়ে ফেলল। মেয়েটি বন্ডকে বলল, আপনাকে কিন্তু একবার এসে ইয়েটটা দেখে যেতে হবে। ওঁর নাম লার্গো, উনি এখানে এসেছেন কি-সব গুপ্তধনের খোঁজে। এবার বন্ডের আগ্রহ দেখাবার পালা। নিশ্চয়ই দেখা করব তার সাথে। ব্যাপার কি, বলুন তো? সত্যি সত্যি কিছু আছে নাকি?
এ বিষয়ে উনি ভীষণ চাপা। সম্ভবত একটা ম্যাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু আমাকে সেটা দেখতে দেওয়া হয় না। আর যখনই উনি নৌকো চেপে খোঁজাখুঁজি বা অন্য কিছু করতে যান, আমাকে তীরেই থেকে যেতে হয়। এই অভিযানে অনেকে টাকা যোগাচ্ছেন, শেয়ার হোল্ডারের মত। তারা সম্প্রতি এসে পৌঁছেছেন। আমাদের যখন সপ্তাহখানেকের মধ্যেই চলে যাওয়ার কথা, আমি আন্দাজ করছি যে সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আর আসল অভিযান যে কোন মুহূর্তে শুরু হবে।
মেয়েটি মনোযোগের সাথে হাতঘড়ি দেখল। ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে দাঁড়াল। বন্ড রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গাড়ি পর্যন্ত সাথে এল। বন্ড সাহস করে আর একটু এগোবার চেষ্টা করল। বলল, আজ রাতে ক্যাসিনোতে বোধহয় তোমার সাথে দেখা হবে ডোমিনেটা?
বোধহয়। মেয়েটি বন্ডের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসল, তারপর হাত নাড়ল। বন্ড লক্ষ্য করল মোড়ের মাথায় পৌঁছে গাড়িটা একটু থামল তারপর সোজা ডানদিকে নাসাউ এর দিকে ঘুরে গেল।
.
CIA-এর লোকটি
ট্যাক্সিতে চেপে ইস্টারফিল্ড রোড ধরে দ্বীপের উল্টোদিকে বিমান ঘাঁটির দিকে রওনা হল বন্ড। CIA-এর লোকটির পৌঁছার কথা ১-১৫-তে, প্যান অ্যামেরিকান বিমানে। নাম, লার্কিন, এফ. লার্কিন। লন্ডনে CIA-র সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী সেকশন A মারফত পাঠানো নির্দেশ অনুযায়ী এই যন্ত্রগুলো লোকটা নিয়ে আসবে। CIA র লোকদের জন্য তৈরি সর্বাধুনিক একটি বেতার প্রেরক ও গ্রাহক যন্ত্র, যার সাহায্যে তারা লন্ডন এবং ওয়াশিংটনের অফিসের সাথে টেলিগ্রাফ অফিসের সাহায্য ছাড়াই চটপট যোগাযোগ করতে পারবে, এবং কয়েকটি নতুন ধরনের পোর্টেবল, গাইগার কাউন্টার, যা পানির তলায়ও ব্যবহার করা চলে। বন্ডের মতে, CIA-র একটা খুব বড় গুণ হচ্ছে তাদের আশ্চর্য যন্ত্রপাতিগুলো।
নিউ প্রভিডেন্স নামক যে দ্বীপটিতে নাসাউ শহর অবস্থিত, তা একটি বৃক্ষ বালিয়াড়ি বিশেষ এবং তার পাড় বেয়ে আছে পৃথিবীর কয়েকটি শ্রেষ্ঠ সমুদ্রসৈকত। সমুদ্রতটের ওপর ইতস্তত আছে লক্ষপতিদের সুন্দর বাগান। পশ্চিম কোণে একটা লোনা পানির হ্রদ আছে। বিমান ঘাঁটির পথে যেতে যেতে বন্ড এই সকাল বেলাটাকে পর্যবেক্ষণ করছিল।
আজ সকাল সাতটায় বন্ড নাসাউ পৌঁছলে এখানকার রাজ্যপাল ADC তার সাথে দেখা করেন। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হল রয়্যাল বাহামিয়ান হোটেলে। হোটেলটা বিরাট এবং সেকেলে। শাওয়ারের তলায় গোসল সেরে নিয়ে চমৎকার সমুদ্রতটের দিকে ভোলা ব্যালকনিতে বসে প্রাতঃরাশ শেষ করল বন্ড। তারপর নটার সময় গিয়ে পৌঁছল গভর্নমেন্ট হাউসে,–যেখানে পুলিশ কমিশনার ইমিগ্রেশন ও কাস্টম্স্-এর বড়কর্তা এবং সহকারী রাজ্যপালের সাথে তার একটা বৈঠক হবার কথা। এখানকার অবস্থাটা বন্ড যা অনুমান করেছিল ঠিক তাই।
সহকারী রাজ্যপাল রোডিক, চক্চকে পাঁশনে পরা সতর্ক চেহারার এক ভদ্রলোক, বন্ডকে সমস্ত পরিস্থিতিটা একেবারে পানির মত বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন দেখুন মিঃ বন্ড, আমরা এ ব্যাপারে সবরকম সম্ভাবনার সব দিক থেকে ভীষণ খুঁটিয়ে বিচার করে দেখছি। আমাদের মত চার ইঞ্জিনওয়ালা অতবড় একটা প্লেন আমাদের উপনিবেশের এলাকার মধ্যে লুকিয়ে রাখা সম্ভব, এরকম ধারণা করবার পিছনে কোন যুক্তি নেই। এত বড় একটা প্লেন নামাবার মত বিমান বন্দর এ অঞ্চলে একটাই আর সেটি হচ্ছে নাসাউ। বাইরের প্রতিটি বড় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন যে, এ বিষয়ে। তাঁদের কিছু জানা নেই।
বন্ড বাধা দিয়ে বলেছিল, আচ্ছা, ঐ রাডার স্ক্রীনের ওপর কি ২৪ ঘণ্টা নজর রাখা হয়?
পুলিশ কমিশনার ভদ্রলোক বললেন, স্যার, কমান্ডারের এ কথাটি কিন্তু ভাববার মত। বিমানবন্দরের বড়কর্তা স্বীকার করেছেন যে, রাতের দিকে যখন কোন প্লেন আসার কথা থাকে না, তখন কাজকর্ম একটু শিথিল হয়ে পড়ে। তার লোকজনের সংখ্যা বেশি নয়, আর তারাও আবার সব স্থানীয় লোক। তাছাড়া আবহাওয়া স্টেশনের রাডার যন্ত্রটা ছোট, আওতা নেহাৎ কম। এটা ব্যবহার করা হয় প্রধানত জাহাজ চলাচলে সাহায্য করবার জন্যই।
সহকারী রাজ্যপাল রাডার যন্ত্র বা নাসাউ-এর লোকদের কার্যদক্ষতার আলোচনায় মোটেই জড়িয়ে পড়তে চাইছিলেন না। বলরেন, এটা অবশ্যই ভাববার কথা। আর কম্যান্ডার বন্ড তো নিজেই সব তদন্ত করবেন।
বন্ড জানতে চাইলেন, তিনি যাদের খুঁজছেন তারা হচ্ছে একদল লোক। দশ জনেরও হতে পারে আবার বিশ-ত্রিশ জনেরও হওয়ার সম্ভব। তারা সবসময় জোট বেঁধে থাকবে। এইরকম কোন দলবল আপাতত আছে কিনা?
মিঃ পিটম্যান?
তা স্যার এরকম দলতো এখানে অজস্র আসে। আমাদের টুরিস্ট বোর্ড অবশ্য এদের আসাটা খুবই পছন্দ করে। মিঃ পিটম্যান প্রশস্ত হেসে বললেন, তা আমাদের দ্বীপের বাৎসরিক গুপ্তধন অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
পুলিশ কমিশনার একটু সংশয়ের সুরে বললেন, তবে একটা কথা স্যার। এই অনুসন্ধানকারী দলের সত্যিই এক ইয়ট আছে। আর এই ব্যাপারে শেয়ারহোল্ডাররাও সম্প্রতি এসে পৌঁছেছেন বলে শুনেছি। কম্যান্ডার বন্ডের অনুমানের সাথে এগুলো সব মিলে যাচ্ছে। বন্ড এই ছোট্ট সূত্রটুকু সাগ্রহে আঁকড়ে ধরে কাস্টমস্ বিল্ডিং আর কমিশনারের অফিসে এ নিয়ে আরো দুটো ঘণ্টা তত্ত্ব-তালাশ চালিয়েছে। তারপর বেড়াবার উদ্দেশ্যে শহরে ঢুকেছে, যদি লার্গোর দলের কাউকে দেখা যায়। আর এখন বন্ড ট্যাক্সি বন্দরে এসে পৌঁছল। সে ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে প্রবেশদ্বারের লাগোয়া লম্বা নিচু হলঘরটাতে ঢুকে পড়ল। ঠিক তক্ষুণি লার্কিনের প্লেনের এসে পৌঁছানোর কথা ঘোষণা করা হচ্ছে।
হঠাৎ পেছন থেকে এক শান্ত স্বর শোনা গেল 007? নম্বর ০০০-এর সাথে আলাপ করুণ। বন্ড চমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল সেই অদ্বিতীয় ফেলিস্ লিটার। CIA-র লিটার বন্ডের জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর কয়েকটা অ্যাডভেঞ্চারে তার সঙ্গী হয়েছে।
প্রবেশ দ্বারে পৌঁছে লিটার তার একগাদা মালপত্র বন্ডের ট্যাক্সিতে চাপিয়ে ড্রাইভারকে বলে দিল সেগুলো বাহামিয়ানে পৌঁছে দিতে।
দুই বন্ধু গাড়িতে চেপে বসল। বিমান বন্দর ছাড়িয়ে এলে বন্ড বলল, শেষবার যখন তোকে দেখি, তুই পিংকার্টন ডিটেকটিভ এজেন্সিতে কাজ করছিলি। এর মধ্যে আবার জড়ালি কি করে?
টেনে আনা হয়েছে। স্রেফ টেনে এনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হয় প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে যখন জরুরী নির্দেশ এল এই থান্ডারবলের ব্যাপারে তখন বোধহয় আমাদের বুড়ো কর্তা মানে অ্যালেন ডালেমের হাতে বিশেষ লোকজন ছিল না। সুতরাং আমাকে আর আরো জন বিশেক লোককে টেনে আনল। ওরা আমাকে সব খবরাখবর দিয়ে চলে আসতে বলল নাসাউতে। এবং তোর সাথেই কাজ করতে হবে। তুই যে সব যন্ত্রপাতি চেয়ে পাঠিয়েছিলি সে সব নিয়ে রওনা হয়ে পড়লাম।
এবারে বন্ড লিটারকে পুরো ইতিহাস বলতে শুরু করে দিল। আগের দিন সকালে এম এর অফিসে ঢোকার পর থেকে একটাও খুঁটিনাটি বাদ দিল না। বন্ড বেশ লজ্জার সাথেই শ্রাবল্যান্ডে তার চিকিৎসার বিবরণ দিল। লিটার বিলক্ষণ উপভোগ করল সেটা। তারপর সব শুনে বলল, বাস্তব জীবনে এটম বোমা সুদ্ধ প্লেনও হারায় না। কি সেই রকম হয়েছে, তুই ঝিমিয়ে পড়ছিস জেমস? আমরা দুজন যে সব কেসে জড়িয়ে পড়েছি এ পর্যন্ত, তার বিবরণ আজ কটা লোক বিশ্বাস করবে?
বন্ড এবার খুব আন্তরিকভাবে বলল, শোন্ ফেলি আমি এক কাজ করি। তোর গল্পের মধ্যে ভাববার জিনিস আছে তাই আজ রাত্রে তোর আনা ঐ যন্ত্রটার সাহায্যে M-কে জানাব। দেখা যাক্ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড-এর থেকে কিছু সুবিধা করতে পারে কিনা। সেই ক্লিনিক্ আর ব্রাইটনের যে হাসপাতালে কাউন্ট ছিল–এই জায়গায় অনুসন্ধান চালালে বেশ কিছু খবর পাওয়া যাবে। তবে মোটর বাইকের সেই লোকটিকে কোনদিন ধরতে পারব কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
রয়্যাল বাহামিয়ান হোটেলের তলায় গাড়ি থামাল তারা। লিটার গিয়ে হোটেলের খাতায় নাম সই করল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে তারা দুটো ডাবল ড্রাই মার্টিনি অন্ দ্য রকস্ এবং মেনু আনতে পাঠাল। আধঘণ্টা পর তাদের লাঞ্চ এসে গেল। খাওয়া দাওয়ার শেষে তারা ঠিক করল ডিস্কা ভোলান্তে ইয়টটা ঘুরে দেখে আসবে। বন্ড টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এরপর আমরা ঠিক করতে পারব যে, ঐ লোকগুলোর অনুসন্ধানের লক্ষ্য কি? স্প্যানীশ গুপ্তধন না ১০,০০,০০,০০০ পাউন্ড! পরের কাজ হল সদর দপ্তরে রিপোর্ট পাঠানো। প্যাকিং কেসগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে বন্ড বলল, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ওপর তলার দুটো ঘর পাওয়া গেছে। কমিশনার ভদ্রলোক খুব সমর্থ। আমাদের সাহায্য করতে আগ্রহী। সেই একটা ঘরে রেডিও সেটটা বসিয়ে আজ সন্ধ্যাবেলাতেই বেতার অফিসের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। আজ রাতে একটা পার্টি আছে ক্যাসিনোতে, তাতে দেখতে হবে যে লার্গোর দলের কাউকে আমরা চিনতে পারি কিনা। আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে ইয়টটার মধ্যে দুটো বোমা লুকানো আছে কিনা দেখা। লিটার প্যাকিং কেসগুলোর কাছে গিয়ে একটাকে বেছে নিয়ে খুলে ফেলল। সে যখন ফিরে এল তখন তার কাঁধে ঝুলছে চামড়ার খাপে ভরা একটা রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা। সামনের ঢাকা খুলে দিয়ে বলল, সত্যিকারের লেন্সটেন্স সব কিছু আছে কিন্তু এই ভুয়া ক্যামেরাটার ভেতরেই যত কিছু যন্ত্রপাতি–ধাতব ভাল আছে, সার্কিট আছে, কতগুলো ব্যাটারি আছে। চমৎকার এক গাউগার কাউন্টার। এবার ঘড়িটা দেখ। শুধু তফাৎ হচ্ছে যে ঘড়ির কলকজা এর পেটের অল্পই জায়গা জুড়ে আছে, আর এর সেকেন্ডের কাটাটা হচ্ছে আমাদের তেজস্ক্রিয়তা মাপবার মিটার। এই তারগুলো দিয়ে মূল যন্ত্রটার সাথে জোড়া।
লীটার বলল, কোনরকমে আমরা যদি লুকানো বোমা দুটোর ধারে কাছে পৌঁছতে পারি, এই সেকেন্ডের কাঁটাটা ববন্ করে ঘুরতে শুরু করবে। আমাদের অত সূক্ষ্ম যন্ত্রের দরকার নেই। এবার চল, একটা বোট ভাড়া করে সামুদ্রিক ডালকুত্তাটিকে দেখে আসা যাক্।
.
আমার নাম লার্গো
যে বোটটি তারা ভাড়া করল সেটা হোটেলেরই লঞ্চ। ভাড়া ঘণ্টায় ২০ ডলার। বন্দর থেকে তারা পশ্চিমমুখে ছুটল, উপকূল বেয়ে আরো পাঁচ মাইল। শেষ পর্যন্ত তারা ওল্ড কোর্ট পয়েন্ট ঘুরে এসে পড়ল যেখানে সাদা আর ঘন নীল রঙের ইয়টটা প্রবাল প্রাচীরের ঠিক বাইরে ঘন পানিতে এক জোড়া নোঙর ফেলে ভাসছিল।
বন্ড বলল, ইয়টটা ইটালিয়ান। এ ধরনের জাহাজকে অ্যালিসকাফোস বলে। এর পাটাতনের নিচে একটা হাইড্রোফেল আছে। বোটম্যান বলে উঠল, বে স্ট্রীটে শোনা যাচ্ছে যে, এরা কয়েকদিনের মধ্যেই গুপ্তধনের অভিযানে বেরিয়ে পড়েছেন। গুপ্তধনের সব অংশীদাররা কয়েকদিন আগে এসে গেছেন।
ইয়টের কালো পার্টহোল থেকে তাদের এগিয়ে আসার ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছিল। বন্ড দেখতে পেল একজন নাবিক হ্যাঁচের ভেতর দিয়ে ব্রিজের ওপর এসে একটা মাউথপীসে কি-সব বলল। বন্ডের বোট এসে লাগাতেই সে বলে উঠল, আপনাদের প্রয়োজনটা দয়া করে জানাবেন, কারোর সাথে দেখা করার কথা আছে কি? বন্ড জবাব দিল, আমরা নিউইয়র্ক থেকে আসছি। লার্গোর সম্পত্তি পামীরা সম্বন্ধে কিছু খোঁজখবর আছে। নাবিকটি ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। ফিরে এল, সাদা প্যান্ট আর হাতকাটা জামা পরা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। পুলিশী বিবরণের স্মৃতি থেকে বন্ড এঁকে চিনতে পারল। ইনিই হলেন এমিলি লার্গো। মিঃ লার্কিন, আমার অ্যাটর্নি, নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন। আমি আসলে ইংরেজ কিন্তু আমেরিকায় আমার সম্পত্তি আছে। সবাই করমর্দন করল। বন্ড আরো বলল, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, মিঃ লার্গো, কিন্তু পামীরা সম্বন্ধে আমার কিছু জানবার আছে যে, সম্পত্তিটা আপনি, বোধহয়, মিঃ ব্রাইস-এর কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন।
লার্গো হেসে বললেন, ঠিক আছে, আগে আপনারা ভেতরে এসে বসুন। তারপর লার্গো টনিকের কয়েকটা বোতল টেবিলে নামিয়ে রাখার পর তারা এক সাথে জমিয়ে বসল। লাগো বলল, আপনারা পামীর সম্বন্ধে কি যেন বলছিলেন?
বন্ড বলল, আমি জানি আপনি একটা সম্পত্তির লীজ নিয়েছেন আর অল্পদিনের মধ্যে বাড়িটা ছেড়ে দিচ্ছেন। যতদূর শুনেছি, তাতে মনে হয় এই ইংরেজ মিঃ ব্রাইস। ভদ্রলোক, ঠিক দরে পেলে বিক্রি করতে পারে। বন্ড বেশ লজ্জিত মুখে বলল, আমি আপনার কাছ থেকে অনুমতি চাইছি যদি আমরা নৌকায় চড়ে ঐ জায়গাটা একবার দেখে আসতে পারি। অবশ্য যখন আপনি সেখানে থাকবেন না। আপনার যেমন সুবিধা হবে।
লার্গোর দাঁতগুলো প্রীতির আলোয় ঝলমল করে উঠল। তিনি বললেন, আরে নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। যখন আপনার খুশি। লার্গোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বন্ড ও লিটার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল। বন্ড বলে উঠল, আপনার হাতে যদি সময় থাকে মিঃ লার্গো, আমার খুব ইচ্ছা এই ইয়টটা একবার ঘুরে দেখি।
লার্গো বললেন, আসুন। মিনিট কয়েকের বেশি লাগবে না। স্বচ্ছন্দে ও এক্সপার্টের মত কথা বলতে বলতে লার্গো তাদের ডানদিকের প্যাসেজে নিয়ে গেলেন। তারা ব্রীজের ঢাকা জায়গাটাতে উঠে এল। সেখানে সংক্ষেপে ইয়ট পরিচালনা ব্যাখ্যা করে তাদের সরু ডেকের উপর নিয়ে এলেন। তারপর বললেন, আশা করি একদিন আপনি আর মিঃ লার্কিন এটায় চড়ে একটু বেড়াবার জন্য আসবেন। আরো কিছু সৌজন্য বিনিময়ের পর তারা সিঁড়ি বেয়ে অপেক্ষমান লঞ্চে নেমে এল এবং রওনা হল। মিঃ লার্গো শেষবার হাত নেড়ে হ্যাঁচের ভেতর দিয়ে ব্রীজের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
তারা বসল লঞ্চের পেছনদিকে, বোটম্যান থেকে অনেকটা দূরে। লিটার মাথা নেড়ে বলল, একেবারে কিছুই নেই। ইঞ্জিনঘর আর বেতার ঘরের আশেপাশে যৎসামান্য তেজস্ক্রিয়তা ধরা পড়ল, কিন্তু সেটা খুবই স্বাভাবিক। তারপর একজন অংশীদারকে দেখতে না-পাওয়াটা বিচিত্র। আর একটা জিনিস, লার্গো ধূমপান করলেন না, আর সারা জাহাজে এতটুকু তামাকের গন্ধ ছিল না। এটা খুব অদ্ভুত। ডিস্কো প্রায় চল্লিশ ফিট গভীর পানিতে নোঙর করা ছিল। ধরা যাক তার ঠিক তলায়, বালির মধ্যে বোমা দুটো পোঁতা আছে। লার্গো এক শক্তিশালী চেহারার জলদস্যুর মত লোক, হয়ত মেয়েদের সঙ্গে শয়তানীও করে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কি ছাই প্রমাণ আছে? তবে ওদের সবাইকার জন্য একটা জরুরী তার করেছি গভর্নমেন্ট হাউসে। আজ সন্ধ্যাতেই জবাব এসে যাওয়া উচিত। বন্ড বলল, আমাদের বেতার যন্ত্র চালু কর, আর আমি তেলের জেটির খোঁজটা নিয়ে আসি। তারপর সেই ডোমিনা মেয়েটার সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা ঠিক করে নিয়ে লার্গোর তীরবর্তী ঘাটি ঐ পামীরাটা একঝলক দেখে আসি, চল। তারপর ক্যাসিনোতে গিয়ে লার্গোর পুরো দলটা একবার পরিদর্শন করতে হবে।
হোটেলের গভর্নমেন্ট হাউসের এক পত্রবাহক বন্ডের জন্য অপেক্ষা করছিল। বন্ডের সই-করা রসিদ নিল। এটা রাজ্যপালের ব্যক্তিগত একটা তার, আসছে কলোনিয়াল অফিস থেকে। তারের প্রথমে লেখা Profound, এবং তারপর, তোমার ১১টা ৭ মিঃ সময়ের রিপোর্টে উল্লিখিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে রেকর্ডস-এ কিছুই নেই। সব কটা স্টেশন থেকে অপারেশন থান্ডারবল সম্বন্ধে নেতিমূলক রিপোর্ট আসছে। তুমি কিছু পেয়েছ কি? চিঠির তলায় প্রেরকের নাম PRISM অর্থাৎ M এ চিঠির অনুমোদন করেছেন।
বন্ড লিটারকে তারটা দিল। লিটার পড়ে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হল তো? আমরা ভুল রাস্তায় চলেছি। আমি বরং ওয়াশিংটনে একটা পোস্টকার্ড ছেড়ে দিই, আমার হাতে গোটা দুয়েক WAVES পাঠিয়ে দেবার জন্য। আমাদের হাতে প্রচুর ফাঁকা সময় থাকবে।
.
টোকো মদ
শেষ পর্যন্ত বন্ডের সন্ধ্যাবেলার প্রোগ্রামের প্রথম অর্ধেক ভেস্তে গেল। টেলিফোনে ডোমিনো ভিতালি বলল যে, সেদিন সন্ধ্যাবেলা তারা পামীরার বাড়িটা দেখতে গেলে অসুবিধে হবে। রাতে ক্যাসিনোতে দেখা হতে পারে। কিন্তু ডিস্কো জায়গা বদল করাতে তার প্ল্যানটাকে বদলাতে হল সুবিধার জন্য। এই বন্দরে দাঁড়ালে জাহাজটাকে খুঁটিয়ে পরখ করতে আসা সোজা হবে। বন্ড ঠিক করল জাহাজের খোল সম্পর্কে আরো বেশি, খাঁটি খবর না পাওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামাবে না। বন্ড M-এর কাছে একটি রিপোর্ট লিখে ফেলল। বন্ড কল্পনায় দেখতে পেল হোয়াইট হাউস। নানা কথা ভাবতে ভাবতে বন্ড কপালের ঘাম মুছল। সে চটপট তার রিপোর্টটা লন্ডনে পাঠিয়ে দিল। তারপর খোঁজ করল তার কোন খবর বা নির্দেশ আছে কিনা। নেই শুনে বেতার সংযোগ কেটে দিল। বন্ড চলল নিচে কমিশনারের ঘরে। হার্লিং গা থেকে কোট খুলে রেখে তার ডেস্কে বসে ছিলেন। বন্ড তাকে বলল, রেকর্ডস-এর খাতায় লার্গোর দলের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি, আর সে লার্গোর সঙ্গে দেখা করে গাইগার কাউন্টার নিয়ে ডিস্কো র ওপর ঘুরে এসেছে। সেখানেও কিছু পাওয়া যায়নি। সে বলল যে, ডিস্কো কতটা তেল নিতে পারে, তেলের ট্যাংক ঠিক কোথায় থাকে, তা সে জানতে চায়। কমিশনার বললেন, ও জাহাজটা ৫০০ গ্যালন পর্যন্ত ডিজেল নিতে পারে। ঠিক ঐ পরিমাণ তেল নিয়েছে ২রা জুন বিকেলে। বোঝা গেল যে, লার্গোর সেই লম্বা লম্বা ট্যাংক, ব্যালাস্টের ঝামেলা ইত্যাদির গল্প একেবারে বাজে। অবশ্য এমন হতে পারে তিনি গুপ্তধন খোঁজার কোনও গোপনীয় সরঞ্জাম অতিথিদের চোখের আড়ালে রাখতে চেয়েছিলেন। বন্ড মনস্থির করে ফেলল, জাহাজের খোলটা একবার দেখা চাই। সে তার ধারণাটা মোটামুটি জানাল কমিশনারকে।
কমিশনার বললেন, বন্দরের কাছে ডোবা মালপত্র উদ্ধারের জন্য কুড়ি জন লোকের এক আলাদা বাহিনী আছে, সেই বাহিনীর কনস্টেবল্ স্যান্টোসকে দেব আপনার সঙ্গে। চমৎকার ছেলে। আপনার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে সে বরং আপনার সুবিধেমত জায়গায় গিয়ে দেখা করবে। এবার আপনার প্ল্যানের পুরোটা আমাকে বলুন দেখি… ।
হোটেলে ফিরে এসে বন্ড শাওয়ারে গোসল সেরে নিল। এবারে খেয়েদেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিতে পারলে তবে তার মাথাটা ঠাণ্ডা হবে।
সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম এসে গেল। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। লিটার ফোন করছে। সে সেই জলপাই দেওয়া মার্টিনিটা খেতে চায়। এখন ন টা বাজে।
পাইন-অ্যাপল রুম বার-এর একটা কোণের টেবিলে লিটারের সঙ্গে দেখা হল বন্ড-এর, ওরা দুজনেই সাদা ডিনার জ্যাকেট পরে ছিল। বন্ড যে সত্যিই একজন অর্থবান সম্পত্তি সন্ধানী, সেটা সকলকে জানাবার জন্য একটা গাঢ় লাল কোমর বন্ধ লাগিয়েছে। দুটো ড্রাই মার্টিনির অর্ডার দিল লিটার, তারপর তেতো গলায় বন্ডকে বলল, এবার শুধু দেখে যা।
মার্টিনি দুটো এল। তাদের দিকে তাকিয়ে লিটার ওয়েটারকে বলল বারম্যানকে ডেকে দিতে। একমুখ বিরক্তি নিয়ে বারম্যান এসে দাঁড়াল। লিটার বলল তাকে, বন্ধুবর আমি মার্টিনি চেয়েছিলাম, মদে ভেজানো জলপাই চাইনি। বলে ককটেল স্টিক দিয়ে গেলাস থেকে জলপাইটা তুলে নিল। বারো আনা মদ ভর্তি গেলাস সঙ্গে সঙ্গে খালি হয়ে গেল।
এখানে এক বোতল জিনের দাম দু ডলার। ধরা যাক পাইকারী দর এক ডলার ষাট সেন্ট। তুমি এক গ্লাস মার্টিনির দাম নিচ্ছ আশি সেন্ট, দু গেলাসের এক ডলার ষাট। পুরো এক বোতল জিনের দাম। আর তোমার হাতে থাকছে আটাশ মাত্রার চব্বিশ মাত্রা। মানে এক বোতল জিনে তুমি পরিষ্কার একুশ ডলার লাভ করছ। বারম্যানের মুখে ধারাবাহিকভাবে ফুটে উঠেছিল প্রথমে রাগ তারপর ভয়ের থমথমে ভাব।
লীটার বলল, যেদিন আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে পিংকার্টন গোয়েন্দা সংস্থায় ঢুকি সে দিন থেকেই আমার চোখ খুলে গেছে। এইসব হোটেল-রেস্তোরাঁয় যে পরিমাণ জোচ্চুরি চলে, পৃথিবীর অন্য সমস্ত অপরাধ এক করলেও তার ধারে-কাছে পৌঁছবে না। এ নিয়ে ভাবলেই ইচ্ছে করে এক-একটাকে ধরে কিলাই। ড্রিংক দুটো এল। স্বাদে ও পরিমাণে চমৎকার। লিটার ঠাণ্ডা হল এবং আরেক রাউন্ডের অর্ডার দিল। বন্ড বলে উঠল, কোথায় যেন ষড়যন্ত্র পেকে উঠেছে। আমি সেই তেলের কথাটা পরখ করতে গিয়ে দেখি লার্গো নির্জলা মিথ্যে কথা বলেছিল। বন্ড পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সব কথা খুলে বলল। মনে হচ্ছে আজ রাতে আমি লাগো সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারব। সত্যিই যদি কিছু পাই তবে কাল একটা প্লেনে চেপে আমরা সমুদ্রের যতটা এলাকা পারি সার্চ করে আসব। পানির নিচে বেমালুম লুকিয়ে রাখার পক্ষে সেই ভিন্ডিকেটর বিমানটা বড় বড়। তোর পাইলটের লাইসেন্সটা এখন আছে তো?
নিশ্চয়ই, কাঁধ ঝাঁকালো লিটার। তোর সঙ্গে যাব। তবে আমার মত এসব আমাদের পেন্টাগনের বড় কর্তাদের আর একটু কাপ্তেনি ছাড়া কিছু নয়। তবে আমি যে সংকেতের কথা বলছিলাম সেটা এই অপারেশন থান্ডারবল -এ লিপ্ত প্রতিটি লোকের জন্য এক বিজ্ঞপ্তি । তবে যতটা বোকামি মনে হচ্ছে ততটা নয়। স্যাবার প্লেনগুলো সাবমেরিন ধ্বংসের মহড়া দিতে এদিকে আসছে সঙ্গে আমার ডেপৃথু চার্জ আছে। ওদের সর্বদাই তৈরি থাকতেই হয়।
বন্ড কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে, তোদের রাষ্ট্রপতি তাঁর নাসাউ-এ পাঠানো লোকটির চেয়ে একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বোধহয় আমাদের দুই দেশের সেনাপতিরা আটলান্টিকের দু ধারে তাদের সৈন্যসামন্ত সুবিধেমত সাজিয়ে ফেলেছেন। যাই হোক, নাসাউ ক্যাসিনো যদি প্রেতাত্মা সংঘের প্রথম লক্ষ্যস্থল হয়, তবে কাছাকাছি সৈন্য সামন্ত জোগাড় করে রাখতে ক্ষতি নেই।
লীটার বলল, আমাকে যে কটা টার্গেটের কথা বলা হয়েছে, তা হল কেপ ক্যানাভেরাল, পেনুসাঁকোলার নৌ-ঘাঁটি, আর দ্বিতীয় বোমাটাও যদি নেহাৎ এদেশেই ফাটায়, তাহলে তাদের লক্ষ্য হবে মিয়ামী…ট্যাম্প হলেও হতে পারে। প্রেতাত্মা সংঘ পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের কোন এক সম্পত্তির কথাটা বলছিল। আমার মনে হয় এটা ওরা কোনও এক বড় কারখানার কথা বলছে–মন দিয়ে বিবেচনা করতে হলে আমি বলব হয় কেপ ক্যানাভেরাল, নয় এই গ্র্যান্ড বাহামার রকেট ঘাঁটি। তবে একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না যে, ওরা যদি ঐ বোমা দুটো পেয়েই থাকে, তাদের লক্ষ্যস্থলে ফাটাবে কি করে? সাবমেরিনের সাহায্যে করা যায়–স্রেফ একটা টর্পেডো টিউবের ভেতর দিয়ে বোমাটাকে সমুদ্রতটের কাছাকাছি ফেলে দেওয়া। কিংবা, একটা ডিঙ্গিতে করে ভাসিয়ে দিলেও হয়। শুধু TNT আর পুটোনিয়ামের মধ্যে ঠিক জায়গায় একটা ফিউজ লাগিয়ে দিতে হবে। আর বোমার মাথায় আর একটা ফিউজ থাকে যেটাতে জোর ধাক্কা লাগলে বোমা ফাটে। সেই ফিউজ সরিয়ে নিয়ে সেই জায়গায় অন্য ফিউজ লাগিয়ে দিতে হবে। যাতে বোমা বসিয়ে দিয়ে শ খানেক দূরে পালিয়ে যাওয়ার সময় থাকে।
লীটার অবহেলাভরে বলল, চল, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া যাক। তারপর আমরা ক্যাসিনোতে গিয়ে দেখতে চাই, কোন শয়তান বৈজ্ঞানিক জুয়ার টেবিলে লার্গোর পাশ আলো করে বসে আছে।
.
তাসের রাজা
নাসাউ ক্যাসিনো হল পৃথিবীর সমস্ত ব্রিটিশ এলাকার একমাত্র আইনসঙ্গত জুয়ার আড্ডা। প্রতি বছর এই ক্যাসিনো এক ক্যানাডিয়ান জুয়াখেলার সংস্থাকে লীজ দেওয়া হয়। এবং সমস্ত শীতকালে তাদের লাভ এক লক্ষ ডলারের কাছাকাছি বলে আন্দাজ করা হয়। এখানে পরিচ্ছন্ন নাচবার ও খাবার ঘর আছে। এর থেকে যা লাভ হয়, পরিচালকদের তা সত্যিই প্রাপ্য। রাজ্যপালের দেহরক্ষী বন্ড ও লিটারকে দুটো মেম্বারশিপ কার্ড পৌঁছে দিয়েছিল। ক্যাসিনোতে ঢুকে প্রথমে কফি এবং মদ খাওয়ার পর ওরা আলাদা হয়ে বিভিন্ন জুয়ার টেবিলের দিকে চলল।
লার্গো শ্যমা দ্য ফেরার তাঁর সামনে এক স্কুপ ডলারের চাকতি, আর আধ ডজন হাজার ডলার মূল্যের হলদে বড় চাকতি। ডোমিনো ভিতালি তার পেছনে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেতে খেতে খেলা দেখছিল। বন্ড দূর থেকে খানিকক্ষণ খেলা দেখল। স্কোয়্যারকাট নেকলাইন দেওয়া কালো পোশাকও গলায় সরু চেন দেওয়া একটা হীরে পরা ডোমিনোকে খুব বিষণ্ণ, ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। লার্গোর ভাগ্য সম্বন্ধে সকলেই নার্ভাস হয়ে পড়েছে দেখে তার সাহস বেড়ে গেল।
এই যে বন্ধুবর মিঃ বন্ড, লার্গো হাত বাড়িয়ে বললেন, এইবার টেবিলে অঢেল টাকা আসছে, আমার বোধহয় অন্য কাউকে ব্যাংকটা দিয়ে দেওয়া উচিত। এই ইংরেজরা রেলগাড়ির ব্যাপার বোঝে ভাল। কিন্তু তবু তিনি সুন্দরভাবে হাসলেন, হারতে যদি হয়, তবে মিঃ বন্ডের কাছেই হারা ভাল।
বিশাল বাদামী থাবাটা তাসের জুতো কে এক নরম থাবড়া মারল। জিভের মত একটা তাস বেরিয়ে এল। সেটা নিয়ে লার্গো টেবিলের মোটা কাপড়ের ওপর দিয়ে বন্ডের দিকে এগিয়ে দিলেন। নিজের জন্য আরেকটা বার করলেন, এবং তারপর দুজনের জন্য অন্য আরও দুটো তাস বের হল। বন্ড নিজের প্রথম তাসটা তুলেই সেটা টেবিলের মাঝখানে চিৎ করে ফেলে দিল। নওলা, রুইতনের নওলা। বন্ড পাশে লার্গোর দিকে তাকাল। বলল, শুরুটা চমৎকার হল–এতই চমৎকার যে আমার অন্য তাস-টাও দেখিয়ে দিচ্ছি। বলে সে সহজভাবে সেটাকে নওলার পাশে ছুঁড়ে দিল। তাসটা মাঝপথে ডিগবাজি খেয়ে আগেরটার পাশে চিৎ হয়ে পড়ল। এক অপূর্ব দশ, ইস্কাপনের দশ। বন্ডের মোট পয়েন্ট হল নয়, সবচেয়ে বেশি যা হতে পারে। নেহাৎ যদি লার্গোর দুটো তাসের সমষ্টিও নয় বা উনিশ পয়েন্ট হয়, বন্ড জিতে গেছে। বন্ড তাস দেখিয়ে দেওয়াতে তার আরেকটা তাস তোলার উপায় রইল না। লার্গো এক পয়েন্টের জন্য হেরে গেছেন–দুজনের হাতই চমৎকার, এ ধরনের হার সবচেয়ে কষ্টকর।
বন্ড জিতল। সুতরাং এবার সেই ব্যাংকার। Croupier সাহেব আটশো ডলারের চাকতি বন্ডের দিকে সরিয়ে দিলেন।
খুশির হাসি হেসে লার্গো বললেন, আর একবার চেষ্টা করা যাক। আপনি যা জিতেছেন রাখুন, আর আমি আপনার ডানদিকের মিঃ স্নোকে পার্টনার নিয়ে বাজি ধরছি। ঠিক আছে, মিঃ স্নো? মিঃ স্নো, একজন শক্ত চেহারার ইউরোপ্রিয়ান, রাজি হলেন। বন্ডের মনে পড়ল, ইনি লার্গোর গুপ্তধনের অন্যতম অংশীদার। বন্ড আটশো ডলার বাজি রাখল, আর বিরুদ্ধে তারা চারশো ডলার করে রাখলেন। আবার বন্ড জিতল। তার পয়েন্ট ছয়, বিপক্ষের পাঁচ। লার্গো দুঃখের ভঙ্গিতে বললেন, এবার সত্যিই আমরা ভাগ্যের লিখন বুঝতে পেরেছি। মিঃ স্নো বন্ডের দিকে তার জেতা ১৬০০ ডলার ঠেলে দিলেন। লার্গো গগমে গলায় বলে উঠলেন, বন্ধুবর আমার তাসের ওপরে কু দৃষ্টি দিতে চাইছেন। আমাদের দেশে ও-জিনিস ঘায়েল করবার একটা চমৎকার কায়দা আছে। ভীড়ের মধ্যে সকলের কাছে এটা এক মজার ব্যাপার ছাড়া কিছুই মনে হল না।
বন্ড সরলভাবে হাসল, বলল চলে আসুন, আপনার প্রেতের সঙ্গে আমার প্রেতের লড়াই হোক। লার্গোর মুখে সংশয় ফুটে উঠল। তিনি জুতোটাকে জোর থাবড়া মেরে বললেন, ঠিক আছে বন্ধুবর। তিনবারের খেলায় কে জেতে দেখা যাক। এইবার তিন নম্বর খেলা।
টেবিল নিস্তব্ধ। খেলা শেষ । অনুত্তেজিত ভঙ্গিতে বন্ড তার তাস ফেলে দিয়ে বলল, আমার মনে হয়, আমার বদলে তাসের কু-দৃষ্টিটাকে ঘায়েল করা উচিত ছিল আপনার। টেবিলের চারপাশে অনেক মন্তব্যের গুঞ্জন শোনা গেল। এবার নিজের মুখের বিকৃতি সামলাতে লাগ্লোকে রীতিমত চেষ্টা করতে হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামলে নিলেন। বন্ড বলল, খেলার জন্য ধন্যবাদ।
ডোমিনো ঘরটার সবচেয়ে দূরের কোণে রাখা একটা টেবিলের দিকে চলল। তার পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বন্ড এই প্রথম লক্ষ্য করল যে, মেয়েটা অল্প একটু খোঁড়াচ্ছে। বন্ড মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, আজ সাঁতার কাটতে গিয়ে কি তোমার পায়ে লেগেছে? সে গম্ভীর হয়ে বলল, না, আমার একটা পা অন্যটার চেয়ে এক ইঞ্চি ছোট; আপনার খারাপ লাগছে?
না। বেশ সুন্দর লাগছে, তোমাকে কেমন বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে। তাছাড়া আমার মনে হয়, তোমাকে খুব যত্নে মানুষ করা হয়েছিল, যাকে বলে, পায়ে কখনো মাটি লাগতে দেওয়া হয়নি। তারপর হঠাৎ তোমাকে টেনে এনে ফেলে দেওয়া হল প্রায় রাস্তার ওপর। তোমার হাতে ছিল নারীর চিরন্তন অস্ত্র আর তা খুব ঠাণ্ডা মাথায় ব্যবহার করেছ তুমি। মনে হয়, তোমার নিজের দেহকে কাজে লাগাতে হয়েছে তোমাকে। এটা খুব চমৎকার কাজ দেয়, কিন্তু সে ক্ষেত্রে তোমার কোমল প্রবৃত্তিগুলোকে অবহেলা করতেই হবে। এখন তুমি যা চেয়েছিলে তা সবই পেয়েছ। বন্ড ডোমিনার হাত স্পর্শ করল। তারপর বলল, তুমি অপরূপ সুন্দরী, যৌন আকর্ষণে ভরা, উত্তেজক, স্বাধীন, স্বেচ্ছাচারী, মেজাজী এবং নিষ্ঠুর।
মেয়েটি বন্ডকে বলল, আপনি আমাকে নিষ্ঠুর বললেন কেন? ধর, আমি জুয়া খেলতে বসে লার্গোর মত খারাপভাবে হারছি, তখন যদি একটি মেয়ে অর্থাৎ আমার প্রেমিকা, আমার পাশে বসে সব কিছু দেখেও একটা উৎসাহের কথা না বলে, তাহলে আমি তাকে নিষ্ঠুরই বলব। প্রেমাস্পদের সামনে ব্যর্থ হওয়া পুরুষেরা পছন্দ করে না।
মেয়েটি অধৈর্যভাবে বলে উঠল, আমাকে প্রায়ই এরকম পাশে বসে ওর কায়দা দেখতে হয়। আমি চাইছিলাম যে আপনি জিতুন। আমি ভান করতে পারি না। আমি আপনাকে বলেছিলাম ও আমার অভিভাবক, সেটা মিথ্যে কথা। আমি ওর রক্ষিতা। আমি একটা গিল্টি করা খাঁচায় আটকানো পাখি। এই খাঁচায় আমার আর স্পৃহা নেই। দেহের বাইরেটা অনায়াসে কেনা যায় কিন্তু মনটা নয়। ও মেয়েদের দরকারের জন্য ব্যবহার করে, প্রেম করার জন্য নয়। আমার আর ভাল লাগছে না।
বন্ড লক্ষ্য করল মেয়েটার চেহারা একেবারে পালটে গিয়েছে। খুব নরম দেখাচ্ছে তাকে। সে তার জীবনের কথা বলতে শুরু করল, সে ছিল এক পালতোলা জাহাজের নাবিক। সারা পৃথিবী যে ঘুরে বেড়াল। অনেক মেয়ে পেয়েছিল সে জীবনে। তারপর বাষ্পীয় জাহাজ চলাচল শুরু হল। থাকে ঐ রকম একটা জাহাজে। একদিন আমার সেই স্বপ্নের মানুষটি অপরূপ এক সোনালি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এল। সে তার জমানো টাকা দিয়ে ব্রিস্টলে একটা মদের বার খুলল। আমাকে ইটালী ফেরত যেতে হল। একদিন লম্বা সিল্কের টুপি পরা আর ফ্রক কোট পরা এক ভদ্রলোক হীরোর বার এ ঢুকলেন। মেয়েটি প্যাকেটের পাশে দিকের লেখাটা দেখাল, জন প্লেয়ার অ্যান্ড সন্স। আগন্তুকেরা ছিলেন সেই জন প্লেয়ার ও তার দুই ছেলে। তারা কাপড়ে আঁকা ছবি দুটোর খুব প্রশংসা করে, ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে, সিগারেটের প্যাকেটে ছাপবার ব্যবস্থা করে দিলেন। এর জন্য তারা একশ পাউন্ড দিতে রাজি আছে। হীরোর তাতে কোন আপত্তি ছিল না, আর তাছাড়া তার ঠিক একশ পাউন্ডেরই দরকার ছিল বিয়ের জন্য। ডোমিনার দৃষ্টি অনেক দূরে চলে গেল। হীরো একটি জলপরী একেছিল। আমার মনে হয় হীরো তার জলপরী মুছে যাওয়াতে একটু দুঃখিত। হয়েছিল। হীরো যখন বুড়ো হয়ে পড়ল, বোঝা গেল সে আর বেশিদিন বাঁচবে না, মিঃ প্লেয়ার লাইফবয়ের সামনে। হীরোর ছবিটার এক প্রতিলিপি আঁকালেন তখনকার দিনের একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীকে দিয়ে। তিনি হীরাকে কথা দিলেন যে, এ ছবিটাও থাকবে প্রত্যেক প্লেয়ার্স সিগারেটের প্যাকেটে, তবে ভেতরদিকে। হীরোর মৃত্যুর ঠিক আগে মিঃ প্লেয়ার নতুন ছবিটা উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন।
এবার মেয়েটি তার ক্রমশঃ স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে আসছিল। আমি মনে করি এটা নেহাৎ একটা রূপকথা।
বন্ড একটা সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোয়া ছেড়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, তোমার পারিবারিক নাম কি পেটাশী?
ও হ্যাঁ। ভিতালী নামটা আমি স্টেজে ব্যবহার করতাম। ভাল শোনায় বলে আমার নামটা বদলে নিয়েছি। ইটালীতে ফিরে এসে আমি ভিতালী নামটাই ব্যবহার করেছি।
তোমার ভাইয়ের কি হল? তার চরিত্রে অনেক গন্ডগোল আছে। কিন্তু চমৎকার পাইলট সে। শেষবার শুনেছিলাম সে প্যারিসে কি এক উঁচু পদ পেয়েছে।
ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি তাকে অন্য সব কিছুর চেয়ে ভালবাসি।
বন্ড সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে ঘসে নিভিয়ে ফেলল। বিল আনতে পাঠালো। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, সব বুঝলাম।
.
মৃত্যুভরা কালো পানি
পুলিশ জেটির তলায় কালো পানিতে মরচে ধরা লোহার খুঁটিগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। দ্বাদশীর চাঁদের আলোয় ফুটে ওঠা লোহার বড় ফ্রেমটার ডোরাকাটা ছায়ায় দাঁড়িয়ে কস্টেবল স্যান্টোস আকোয়ালাং-এর সিলিন্ডারটা বন্ডের পিঠে তুলে দিলেন, এবং বন্ড তার দড়িদড়াগুলো ভাল করে কোমরে জড়িয়ে নিল, যাতে লিটারের দেওয়া পানির নিচে গাইগার কাউন্টারের স্ট্র্যাপে টান না পড়ে।
স্যান্টোস এক বিশালদেহী মিশ্রবর্ণের মানুষ, পরনে এখন শুধু সাঁতার কাটবার প্যান্ট। তার বুকের মাংসপেশী দুটো বড় বড় থালার মত দেখাচ্ছে। বন্ড বলল, এত রাতে পানির নিচে আমি কি কি দেখতে পারি? বড় কোন মাছ থাকবে এদিকে?
স্যাটোস হেসে বলল, বন্দরের ধারে-কাছে যারা থাকে তাদেরকেই দেখবেন স্যার। দু একটা ব্যারাকুডাও চোখে পড়তে পারে। কিংবা হাঙর। চাঁদ আর ডিস্কোর ডেকের আলোকে আপনি সবকিছু দেখতে পাবেন। বারো থেকে পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না আপনার।
বন্ড কোমরের ছোরাটা একবার পরখ করে মাউথপীসে মুখ রাখল। অক্সিজেনের সাপ্লাই খুলে দিয়ে পানিতে নেমে গেল বালির ওপর দিয়ে। কাদায় ঢাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থাকে থাকে নিচে নামতে লাগল, সেই সঙ্গে বন্ডও। প্রায় চল্লিশ ফিট যাবার পর সে দেখল, সমুদ্রের তলা থেকে সে মাত্র কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে যাচ্ছে। বন্ডের মনে হল, সে যেন চাঁদের মাটির ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। বন্ডের সাঁতার কাটার ছন্দ ক্রমশঃ স্বাভাবিক হয়ে এল। চাঁদকে ডান কাঁধের দিকে রেখে সঠিক রাস্তায় এগোতে বন্ডের মন ডোমিনোর উদ্দেশ্যে উধাও হয়ে গেল। হঠাৎ বন্ড এর তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে সহসা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সংকেত বেজে উঠল বিপদ! বিপদ!
তার শরীর শক্ত হয়ে গেল। তার হাত চলে গেল ছোরার দিকে আর মাথা ঘুরে গেল ডানদিকে। কুড়ি পাউন্ডের ব্যারাকুড়া হচ্ছে সমুদ্রের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাছ। এই মাছটি চলছিল বন্ডের থেকে প্রায় দশ গজ দূরে, সমান্তরালভাবে। বিরাট মুখটা আধ ইঞ্চি হাঁ করা। বন্ড হঠাৎ ছোরা হাতে বিশাল মাছটাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করল। দানব ব্যারাকুডাটা অলসভাবে বারকয়েক ল্যাজের পাখনা নেড়ে সরে গেল, আর বন্ড আবার নিজের রাস্তা ধরতেই সে ঘুরে গিয়ে বন্ডের পিছু নিল। ছোট ছোট রূপালী মাছেদের এক মস্ত ঝাঁক দেখা দিল সামনে। মাঝসমুদ্রে এমনভাবে ভাসছিল, যেন তাদের কাঁচের বোতলে পুরে রাখা হয়েছে। দুটি সমান্তরাল দেহ তাদের কাছাকাছি এসে পড়তেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে দুই শত্রুর জন্য রাস্তা করে দিল, এবং তারা চলে যেতেই আবার ঘন হয়ে এল। পানির ওপর এসে পড়া জ্যোৎস্না টুকরো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছিল। বন্ড ধীরে ধীরে সেদিকে উঠতে লাগল। বাঁ দিকে অনেক দূরে একজোড়া বড় স্ক্রু চাঁদের আলোয় চকচক করছে। হ্যাঁ, সত্যিই একটা দরজা আছে। সে গাইগার কাউন্টারের সুইচ টিপে সেটাকে চেপে ধরল ইস্পাতের। ওপর। বাঁ হাতের কব্জিতে বাঁধা মিটারের কাঁটার দিকে লক্ষ্য করে দেখল, খুবই অল্প বিচলিত হয়েছে।
প্রায় একই সঙ্গে বন্ড কানের পাশে ঠং আওয়াজ শুনল, আর তার কাঁধে লাগল জোর ধাক্কা। সঙ্গে সঙ্গে বন্ড খোল থেকে ছিটকে সরে এল। তার নিচে একটা তীক্ষ্ণ বর্শা কাঁপতে কাঁপতে তলিয়ে যাচ্ছে। বন্ড ঘুরল…একটা লোক, গায়ে কালো রবারের স্যুট চাঁদের আলোয় বর্মের মত ঝকঝক করছে। স্থির থাকবার জন্য জোরে পা দিয়ে পানিতে ঘাই মারতে মারতে সে তার গ্যাস (CO,) বন্দুকের নলে আর একটা বর্শা ঢোকাবার চেষ্টা করছে। পাখনা ঝাঁপটা মেরে বন্ড তীরের মত লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। লোকটা চট করে লোডিং লীভার টেনে বন্দুক উঁচিয়ে ধরল। বন্ড বুঝল দেরি হয়ে গেছে। শিকার এখনও ছ স্ট্রোক দূরে। সুতরাং সে হঠাৎ থেকে গিয়ে, মাথা নিচু করে নিচের দিকে ডুব মারল। বন্ড নিচ থেকে লোকটিকে আক্রমণ করল। গ্যাস বন্দুকের নিঃশব্দ বিস্ফোরণের ঢেউ অনুভব করল সে, আর তার পায়ে কি যেন লাগল। বন্ড নিচ থেকে লোকটিকে ছোরা দিয়ে ছোবল মারল। পুরো ঢুকে গেল ফলাটা। বন্ড হাতে রবারের স্পর্শ পেল। তারপর বন্দুকের কুঁদোটা তার কানের পেছনে আঘাত হানল, আর একটা সাদা হাত নেমে এল তার মুখ থেকে মাউথপীস খুলে নেওয়ার জন্য। বন্ড পাগলের মত ছোরা চালাতে লাগল। ছোরার তলাটা কি যেন চিরে দিল। সাদা হাতটা বন্ডের কাঁচের মুখোশ ছেড়ে দিল, কিন্তু বন্ড আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। আবার বন্দুকের কুঁদোটা তার মাথায় সজোরে এসে লাগল।
সমস্ত পানি এখন কালো ধোঁয়ায় ভরে উঠেছে। বন্ড আস্তে আস্তে দেখল কালো ধোয়াটা বের হচ্ছে লোকটার দেহ। থেকে। পেটের ভেতর থেকে রক্ত! বন্ডের হাত-পা সীসের মত ভারী হয়ে আসছে। বন্ড কোনরকমে বুকের ওপর হাত জোড় করে বাধা দেবার চেষ্টা করল উঁচু হয়ে ওঠা বন্দুকের নলটাকে। আর ঠিক তক্ষুনি লোকটার দেহ বন্ডের দিকে ছিটকে এল, যেন কেউ তার পিছনে জোর ধাক্কা দিল। হাত দুটো বন্ডের দিকে খুলে গেল অদ্ভুত এক আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে, আর বন্দুকটা দুজনের মাঝখানে পড়ে আস্তে আস্তে ডুবে অদৃশ্য হয়ে গেল। লোকটার পিঠ থেকে একগাদা কালো রক্ত সমুদ্রে ছিটকে পড়ল।
এতক্ষণে বন্ড সেই ব্যারাকুড়াকে দেখতে পেল লোকটার কয়েক গজ পেছনে। তার দাঁত থেকে কয়েক টুকরো কালো রবার ঝুলছে। এবার বাঘের মত চোখ দুটো ঠাণ্ডা দৃষ্টি ফেলল, প্রথম বন্ডের ওপর, তারপর মৃতদেহটার ওপর। তারপর সর্বদেহ কাঁপিয়ে বিদ্যুতের মত ঝাঁপ দিল।
খানিক দূর যাওয়ার পর একটা রূপালী ডিমের মত আকারের জিনিস তার বাঁ দিকে পানির ওপর এসে পড়ল আর ডিগবাজি খেতে খেতে ডুবে গেল। আরো কিছুটা এগোতে কয়েকটা জলবোমা ফাটার ঢেউ এসে তার গায়ে লাগল। বোমাগুলো ফেলা হচ্ছিল জাহাজের চারপাশের রক্তের দাগ লক্ষ্য করে।
সামুদ্রিক ঘাসের ওপর দিয়ে বন্ড ভেসে চলল। তার মাথা ভীষণ ব্যথা করছে। হঠাৎ সামনের এক আলোড়ন তাকে সজাগ করে দিল। একটা দানবাকৃতি মাছ, ব্যারাকুড়া, সামনের দিকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মাছটা যেন পাগল হয়ে গেছে।
সমুদ্রের তলায় পড়ে থাকা গাড়ির টায়ার, বোতল, টিন পেরিয়ে জেটি দেখা দিল। বালির সিঁড়ি পেরিয়ে অল্প পানিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বন্ড। তার মাথা ঝুঁকে পড়ল।
.
রক্তচক্ষু সুড়ঙ্গ
জামা-কাপড় পরতে পরতে বন্ড কস্টে স্যান্টোসের মন্তব্যগুলো এড়িয়ে গেল। সে বলেছিল যে, একটু আগে পানির নিচে কয়েকটা বিস্ফোরণ হয়ে গেল। সমুদ্রের পানি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল। ইয়টের ডেকে অনেক জন লোক বেরিয়ে এসে হৈ-চৈ করছিল।
বন্ড সাবধানে হেঁটে গিয়ে পাশের রাস্তায় পার্ক করে রাখা লিটারের ফোর্ড গাড়িতে উঠল। হোটেলে পৌঁছে সে ফোন করল লিটারকে, তার অভিজ্ঞতা ও আবিষ্কারের কথা বর্ণনা করল লিটারের কাছে। লিটার বলল, তোর রিপোর্টের একটা কপি আমি CIA-কে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপর মান্টাকে ডেকে বলছি সোজা এখানে চলে আসতে। লিটার বলল, সে আজ ঘুরে ঘুরে ক্যাসিনোতে ঐ অংশীদার আর গুপ্তধন শিকারীদের পর্যবেক্ষণ করছিল। জীবনে কখনো এতগুলো অপরাধীকে এক জায়গায় দেখেনি। কাউকেই চিনতে পারছিল না, যতক্ষণ-না এক টাক মাথা ঘন ভুরু, পুরু কাঁচের চশমা পরা বেঁটেখাটো লোক চোখে পড়ল। লোকটাকে দেখেই মনে হল কোথায় যেন দেখেছে। বন্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, এ হচ্ছে সেই লোকটা যার নাম কোৎসে। পাঁচ বছর আগে পশ্চিম জার্মানীতে চলে এসে পূর্ব জার্মানীর অনেক তথ্য ফাঁস করে দেয়। বদলে মোটা বকশিশ পেয়ে সুইজারল্যান্ডে গা ঢাকা দেয়।
তাদের গাড়ি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে এসে পড়েছিল। বাড়িটার শুধু একতলায় আলো জ্বলছিল। ঘরে ঢুকে লিটারের দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাস ফেলিক্স, এইটাই হল মোক্ষম প্রমাণ। এবার কি করা যায়?
তুই আজকে যা দেখেছিস, তার ওপর আমরা পুরো দলটাকে সন্দেহের অজুহাতে গ্রেফতার করতে পারি। কোন অসুবিধা নেই।
কিসের সন্দেহ লার্গো তার উকিলকে ডেকে এনে পাঁচ মিনিটে ছাড়া পেয়ে যাবে। আমাদের হাতে এখন কোন। প্রমাণ নেই যা লার্গো উড়িয়ে দিতে পারে না। আমাদের রিপোর্ট পাঠাতে হবে সাবধানে, মাপা কথায়। লার্গোর সমস্ত প্ল্যান ঠিক ঠিক চলছে। এখন লাগোর যা কাজ বাকি তা হল, একটা বোমা গুপ্তস্থান থেকে তুলে এনে এক নম্বর লক্ষ্যস্থলের দিকে রওনা হওয়া–আগামী ত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে। যতক্ষণ না সে তার ইয়টে বোমা তুলছে ততক্ষণ কিছু করার নেই। সুতরাং কাল আমরা আমাদের সী প্লেনটা নিয়ে একশ মাইলের মধ্যে চারদিকে সমস্ত জায়গা পর্যবেক্ষণ করে আসব।
***
ছ ঘণ্টা পরে, ভোরের স্বচ্ছ আলোয় তারা দুজনে দাঁড়িয়ে ছিল উইন্ডসর ফিল্ড বিমান ঘাঁটিতে। আর গ্রাউন্ড ক্রুরা তাদের ছোট গ্রুম্যান অ্যাম্ ফিবিয়ান প্লেনটাকে জীপের সাহায্যে হাজার থেকে আনছিল। তারা দুজন প্লেনে চাপবার পর লিটার ইঞ্জিন চালু করেছে, এমন সময় দেখা গেল মোটর সাইকেলে চেপে এক ডেস্প্যাচ রাইডার অনির্দিষ্টভাবে তাদের দিকেই ছুটে আসছে। লিটার ব্রেক ছেড়ে দিয়ে দ্রুতবেগে রানওয়ের ওপর প্লেন চালিয়ে দিল। তার যন্ত্রে ক্রুদ্ধ চেঁচামেচি শোনা গেল। তারা সমুদ্রের এক হাজার ফিট ওপর দিয়ে উড়ছিল। তারা পঞ্চাশ মাইল লম্বা চমৎকার সমুদ্রতট বেয়ে পূর্বদিকে এগোতে লাগল। লিটার বলল, ঐ যে লাল-সাদা ডোরাকাটা দেখা যাচ্ছে, ওটা একটা অ্যাটলাস বা টাইটান আন্তমহাদেশিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICMB)। অন্য দুটো নল নিশ্চয়ই মাতাদোর, মার্ক বা থান্ডার বার্ড-এর জন্য। ঐ কামানের মত জিনিসটা হল ক্যামেরাট্রাকার। ওই চাকীর মত রিফ্লেক্টার দুটো হচ্ছে রাডার স্ক্রীন।
তাদের মাথার ওপর রেডিওটা ঘড়ঘড় করে উঠল। ধাতব স্বর শোনা গেল NIAKOI, NIAKOI আপনারা নিষিদ্ধ এলাকায় এসে পড়েছেন। অবিলম্বে দক্ষিণ দিকে ঘুরে যান। এটা গ্র্যান্ড বাহামা রকেট ঘাঁটি।
লীটার প্লেনটাকে দক্ষিণ দিকে ঘুরিয়ে নিল। এই জায়গাটা নাসাউ থেকে মাত্র শ খানেক মাইল। ডিস্কোর পক্ষে এখানে বোমা বসিয়ে যাওয়া কিছুই নয়। বহু দূরবীন দিয়ে দেখল রকেটের তলা থেকে ধোয়ার কুন্ডলী বেরোচ্ছে। তারপর বেরিয়ে এল মেঘের মত বাম্প, ধোঁয়া আর তীব্র একঝলক সাদা আলো, সেটা ক্রমশ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। মিনিট পনেরো পরে একছড়া মালার মত এক দ্বীপমালা দেখা দিল। এখানকার পানি খুব। অগভীর। প্লেন লুকোবার পক্ষে আদর্শ জায়গা। তারা একশ ফিট উচ্চতায় নেমে এসে একেবেঁকে চলতে লাগল। দ্বীপগুলোর ওপর দিয়ে। প্লেনটা উড়ে গেল উত্তর বিকিনির দিকে। এখানে কয়েকটা বাড়ি আর হোটেল আছে। একটি সুগঠিত কেবিন ক্রুজারের ছাদে একটি মেয়ে নগ্ন হয়ে সূর্যস্নান করছিল। সে ঝটপট গায়ের ওপর একটা তোয়ালে টেনে নিল। যেখানে পানি আবার নীল হয়ে এল, তার ওপর দিয়ে তারা সাবধানে উড়ে গেল। নিষ্প্রাণ স্বরে বলল লিটার, ব্যাস, আর কিছু দেখার নেই। সে প্লেনের মুখ নিচের দিকে নামাল। বন্ড হেলান দিয়ে বসল। লিটারের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, এ জায়গাটাই হবে। সব ঠিক আছে, নিচে বিরাট একটা ক্যামোফ্লেজ করা তেরপল। তুই দ্যাখ একবার। ডিস্কোর অপারেটর যদি এখন নিজের কাজে থাকে, তবে সে নিশ্চয় পুলিশের ওয়েভলেংথের ওপর কড়া নজর রাখছে। সুতরাং নেমে একবার দেখা যাক, বোমাগুলো এর মধ্যেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে কিনা। লিটারের মুখ উত্তেজনায় চক্ করছে। দড়াম করে বন্ডের পিঠ থাবড়ে বলে উঠল সে, পেয়ে গেছি! শালার প্লেনটাকে খুঁজে পেয়ে গেছি। বন্ড তার ওয়াথার PPK পিস্তলটা বের করল। চল্লিশ ফিট গভীর পানিতে তিন তিনটে হাঙর কি যেন করছিল। সে অপেক্ষা করতে লাগল পিস্তল হাতে, কতক্ষণে হাঙর দুটো আবার ঘুরে আসে। বন্ড ট্রিগার টানল। হাঙরের বিশাল বাদামী শরীর মন্থর গতিতে পাক খেতে লাগল পানির ওপর। সূর্যের আলোয় তার পেটটা সাদা দেখাল। তারপর সম্ভবতঃ তার মৃতদেহটা আপনাআপনি, এলোমেলো ভেসে চলল। বন্ড পিস্তলটা লিটারের হাতে দিল। বলল, আমি নিচে নামছি। তুই লক্ষ্য রাখিস। লিটার স্টার্টারের বোম টিপে প্লেন আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনল। বন্ড পীটের ধারে এগিয়ে এসে ঝাঁপ দিল। পানির ভিতর দিয়ে সাঁতার কেটে সে নিচে নামতে লাগল। নিচে পৌঁছে বন্ড তেরপলের একটা কোণের দিকে এগিয়ে চলল, যে কোণটা হাঙ্গরের গুতোয় আলগা হয়ে গেছে। তারপর ওয়াটার প্রুফ টর্চটা জ্বেলে, অন্য হাতে ছুরি বাগিয়ে ঢুকে পড়ল তেরপলের ভিতর। তার টর্চ ঝলসে উঠল প্লেনটার পালিশ করা ডানার নিচের অংশে। আর তারপর একটি কংকালের অবশিষ্টাংশের ওপর, যার ভেতর কিলবিল করছে অজস্র কাঁকড়া, চিংড়ী, সামুদ্রিক মাছ এর জন্য অবশ্য বন্ড তৈরি ছিল। জঘন্য কাজটা শেষ করার জন্য সে হাঁটু গেড়ে বসল।
বেশিক্ষণ লাগল না। পরিচয় চাতিটা আর সেই বীভৎস কব্জি থেকে হাতঘড়ি খুলে নিল সে। চাকতির ওপর টর্চ ফেলে দেখল, সেখানে লেখা আছে–জোসেফ পেটাশী। নং ১৫৩২। তারপর এগিয়ে গেল সে প্লেনটার দিকে। খোলা সেফটি হ্যাঁ বেয়ে প্লেনের ভেতর ঢুকল বন্ড। ভেতরে টর্চের আলোয় পদ্মরাগ মণির মত ঝকঝক করে উঠল চারদিকের অজস্র লাল লাল চোখ। সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে অক্টোপাস আর অক্টোপাস। সংখ্যায় প্রায় একশো। বন্ড টর্চের আলোয় তার অনুসন্ধান শুরু করল। খুঁজে পেল লাল ডোরাকাটা। সায়ানাইডের…হাতল নাগালের মধ্যে।
.
নারী খাদক
ফেরার পথে নাসাউ-এর কাছে এসে বন্ড লিটারকে বলল যে, পামীরের পাশে ডিস্কোকে একবার দেখে যাওয়া যাক। বন্ড ভাবছিল কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে ইয়টটাকে।
বন্ড তার দূরবীন ফোকাস করল। দেখল কিসের যেন দাগ এবং দাগগুলো সমান্তরাল। কোন একটা জিনিস, ভারী জিনিস চালান আর সমুদ্রের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সে বলল, শিগগীর পালাও ফেলিক্স। প্লেনটা তীর বেগে অনেকটা এগিয়ে যেতে সে আবার বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না কিসের দাগ ওগুলো। কিন্তু আমি যা ভাবছি, তাই যদি হয়, তাহলে ওরা নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ ও দাগ মুছে ফেলত।
উইন্ডসর ফিল্ড পৌঁছতে পৌঁছতে একটা বেগে গেল। গত আধঘন্টা ধরে এখানকার কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বেতারে তাদের খোঁজা হচ্ছিল। সুতরাং প্লেন থেকে নেমেই এয়ার পোর্টের কম্যান্ডান্ট এর রুদ্রমূর্তির সম্মুখীন হতে হল তাদের। সৌভাগ্যবশত তক্ষুনি রাজ্যপালের ADC ভদ্রলোক এসে পড়ে দুজনকে উদ্ধার করলেন। তারপর বন্ডের হাতে একটা খাম দিলেন, যার মধ্যে ওদের দুজনের জন্য আসা সংকেতবার্তা আছে।
তারা যেমনটি আশা করেছিল, বার্তার প্রথমেই যোগাযোগ কেটে দেওয়ার জন্য তাদেরকে যাচ্ছেতাই করা হয়েছে। এবং নতুন খবর পাঠাতে বলা হয়েছে। ইন্টারপোল এবং ইটালিয়ান পুলিশ মারফত খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জোসেফ পেটাশী সত্যিই ডোমিনেটা ভিতারীর ভাই। ডোমিনেটার আত্মকাহিনীর বাকি অংশও অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। একই সূত্র থেকে জানা গেছে এমিলিও লার্গো একজন পুরোদস্তুর অ্যাভেঞ্চারার। তাঁর প্রতি সন্দেহের অবকাশ থাকলেও খাতা কলমে তার নামে কোন কলংকের ছাপ এ পর্যন্ত পড়েনি। তার টাকা কোথা থেকে আসে তা সম্পূর্ণ অজানা। ডিস্কোর দাম মেটানো হয়েছে সুইস ফ্রা-তে। ডিস্কোর খোলের ভেতরে একটা বিশেষ ঘরের অস্তিত্ব আছে। অংশীদারদের সম্পর্কে আরো খোঁজ নিয়েও কিছু জানা যায়নি। তবে প্রেতাত্মা সংঘে এঁদের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনাও বেশ মিলে যাচ্ছে। থান্ডারবল মন্ত্রণালয় আরো প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত লার্গোকে নির্দোষ মনে করতে বাধ্য। বর্তমান প্ল্যান হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী অনুসন্ধান যথারীতি চালিয়ে যাওয়া। শুধু বাহামাকে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া। এই গুরুত্বের খাতিরে ব্রিগেডিয়ার ফেয়ারচাইল্ড CB, DSO, রীয়ার অ্যাডমিরাল কার্লসন কে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় রাষ্ট্রপতির বোয়িং 707, কলাম্বাইন বিমানে নাসাউ পৌঁছেছেন, ভবিষ্যতে কর্মপন্থার যুক্ত কর্তৃত্বভার গ্রহণ করার জন্য। মিঃ বন্ড ও মিঃ লিটারের পূর্ণ সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে, আর উক্ত অফিসাররা যতক্ষণ না এসে পড়েন, তারা যেন ঘন্টায় ঘন্টায় বেতারযোগে পূর্ণ রিপোর্ট পাঠায় লন্ডনে এবং ওয়াশিংটনে তার একটা করে কপি। রিপোর্টে উভয়ের সই থাকা চাই।
বার্তা পড়া শেষ হলে লিটার বলল, আমি কোন রকমে ওদের সর্বশেষ খবরটুকু জানিয়ে বলে দিচ্ছি যে, এই জরুরী অবস্থার উদ্ভবের জন্য আমরা আপাততঃ যোগাযোগ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছি। তারপর আমি তোর তরফ থেকে একবার পামীরা ঘুরে আসব। গিয়ে দেখব ঐ দাগগুলো কিসের।
বন্ড ভেবে দেখল তারা তখন নাসাউ-এর শহরতলীতে পৌঁছে গেছে। সমুদ্রের ধারে লক্ষ্যপতিদের অট্টালিকার পেছনে লুকানো বস্তির কুঁড়েঘরগুলোর ভেতর দিয়ে চলেছে তারা। বন্ড বলল, আমি রাজি ফেলিক্স। মাল্টার সাহায্যে আমরাই ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নিতে পারব। আসল কাজ হল জেনে নেওয়া যে, কখন বোমাদুটো ডিস্কো তে ওঠে। ভিতালি মেয়েটার পক্ষে কাজটা বিপজ্জনক কিন্তু আমি তাকে রাজি করাতে চেষ্টা করব। আমাকে হোটেলে নামিয়ে দে কাজ শুরু করি। সাড়ে চারটের সময় আবার দেখা হবে। বন্ড প্রায় দৌড়ে হোটেলের লবি পেরিয়ে গেল। ঘরে এসে সে পুলিশ কমিশনারকে ফোন করল। শুনল যে, ভোরের প্রথম আলোয় ডিস্কো তেল ভরবার জেটিতে এসে সবকটি তেলের ট্যাংক ভরে নিয়েছে। তারপর আবার পামীরার পাশে যথাস্থানে গিয়ে নোঙর করেছে। কমিশনার প্লেনটার ওপর নজর রাখতে বলেন কিন্তু প্লেনটা উড়ে গেল খুব নিচু দিয়ে প্রায় ৩০০ ফিট উচ্চতায়। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৫০ মাইল যাবার পর দ্বীপের জটলার মধ্যে প্লেনটা হারিয়ে যায়। এছাড়া আর কোন বড় খবর নেই।
বন্ড পামীরায় ডোমিনোকে ফোন করল। মেয়েটি জানাল, আজ সন্ধ্যায় সব মালপত্র প্যাক করে জাহাজে উঠে পড়তে বলা হয়েছে আমাকে। এমিলিও বলল আজ রাতেই গুপ্তধন অভিযান। তোমার সঙ্গে ভাল করে আলাপই হল না। আমার ইচ্ছা তুমি আজ দুপুরে সাঁতার কাটতে এসো। মেয়েটি বন্ডকে জায়গার নিখুঁত বর্ণনা দিল।
বন্ড মেয়েটার সম্বন্ধে উত্তেজিত বোধ করলেও তার মনে পড়ছিল আজ বিকালে মেয়েটাকে কি বিপদের মধ্যেই না পাঠাচ্ছে। বন্ড তার সাঁতার কাটার ছোট প্যান্টটা একটা তোয়ালেতে জড়িয়ে নিল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লিফটে চড়ে নেমে এল নিচে।
বন্ড যখন ক্যাসুয়ারিনার ফাঁক দিয়ে চলে যাওয়া বালির রাস্তাটা খুঁজে পেয়ে সমুদ্রতটের কাছে গাড়ি পার্ক করে রাখল, তখন তার মনে হচ্ছে কোনরকমে একবার পানিতে গিয়ে পড়লে হয়–আর সহজে উঠবে না। বন্ড জামাকাপড় ছেড়ে আবার রোদ্দুরে বেরিয়ে এল। মেয়েটার কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না। বন্ড এগিয়ে গিয়ে ঠাণ্ডা পানির মধ্যে ঝাঁপ দিল। কয়েক মিনিট পর কেন যেন একবার চোখ খুলল বন্ড। দেখল শান্ত উপসাগরের মাঝ দিয়ে ছোট ছোট বুদ্বুদের একটি সারি তার দিকে এগিয়ে আসছে সেটা নীল থেকে সবুজ পানিতে এসে পড়বার পর বন্ড দেখতে পেল জাপানী পাখার মত ছড়িয়ে পড়া একরাশ কালো চুল। মেয়েটি কম পানিতে এসে থামল। তারপর বলে উঠল, ওখানে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতে হবে না। এসে আমাকে বাঁচাও।
বন্ড উঠে পড়ে কয়েক পা হেঁটে মেয়েটির কাছে দাঁড়াল। মেয়েটি বলল, আমার পায়ে সী-এগ-এর কাঁটা ফুটে গেছে। যেমন করে পার বের কর। আগে অ্যাকোয়ালাংটা খুলে নাও। এত ওজন নিয়ে দাঁড়াতে পারছি না। মেয়েটি হাঁটতে পারছিল না। বন্ড দু হাত বাড়িয়ে দিল। নিচু হয়ে একটা হাত হাঁটুর নিচে, অন্যটা বগলের তলায় গিয়ে তাকে ধরে নিল। ডোমিনো দু হাতে বন্ডের গলা জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ সে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। উজ্জ্বল চোখ দুটো আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বন্ড মাথা নিচু করে আধখোলা অপেক্ষমান ঠোঁট দুটো জোরে চুমু খেল।
নরম ঠোঁট দুটো তার দুটো ঠোঁট চেপে ধরল, তারপর আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নিল। বন্ড মেয়েটির ডান যুকে হাতটা চেপে রেখে তট বেয়ে উঠে গেল ক্যাসুরিনার ছায়ার মধ্যে। সেখানে তাকে নরম বালির মধ্যে নামিয়ে রাখল। বিকিনির উদ্ধত অর্ধচন্দ্রাকতি অধোবাস যেন বন্ডের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আঁটোসাঁটো কাঁচুলিতে আবদ্ধ গর্বিত স্তন দুটি যেন আরো একজোড়া চোখ। বন্ড দেখল তার সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে পড়েছে। বন্ড মেয়েটির পায়ের তলাটা তুলে নিয়ে যেখানে কাঁটা ফুটেছে সেই জায়গাটা মুখের মধ্যে নিয়ে চুষে চুষে কাঁটাটা বের করে ফেলল। ছোট দুটো ফুটোতে বিন্দু বিন্দু রক্ত জমে উঠেছে। মেয়েটি ঘুরে চিৎ হয়ে শুলো। মেয়েটি একহাতে চোখের পানি মুছে বন্ডের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, জানো, তুমিই প্রথম মানুষ যে আমাকে কাঁদাতে পেরেছে। দু হাত বাড়িয়ে দিল সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে।
বন্ড নিচু হয়ে তুলে নিল তাকে। বয়ে নিয়ে গেল চালাঘরের দরজা পর্যন্ত। বন্ড পুরুষদের ঘরেই ঢুকল। ডোমিনো দু হাতে বন্ডের গলা জড়িয়ে রইল, যতক্ষণ না বন্ড তার কাঁচুলির একমাত্র বোতাম খুলে দিল আর আলগা করে দিল তার অধোবাসের দড়িটা।
.
চুম্বনের শেষে
বন্ড একটা কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে সেই অপরূপ ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটির মুখের ব্যক্তিত্বের রেখাগুলো প্রেমের স্পর্শে মুছে গেছে। মুখটাকে কেমন কোমল, মিষ্টি আর বিক্ষত দেখাচ্ছে।
বন্ড বলল, আমি দুঃখিত। এটা করা উচিত হয়নি।
শুনে মেয়েটা খুব মজা পেল। দু গালের টোল দুটো আরো গম্ভীর হল। বন্ড ঝুঁকে পড়ে তাকে চুমু খেল। তাকে টেনে তুলে জড়িয়ে ধরল। বন্ড বলল, এবার পানিতে নামা যাক। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটল। তারপর পানিতে ঝাঁপ দিল। আবার তীরে ফিরে এসে দেখল মেয়েটা ইতিমধ্যেই বেরিয়ে এসে জামা-কাপড় পরছে। বাইরে এসে বন্ড দুঃখের সঙ্গে মেয়েটিকে জানাল তার ভাইয়ের খবর। বন্ড পকেট থেকে পেটাশীর পরিচয় চাকতিটা বের করে নিঃশব্দে ডোমিনোর হাতে তুলে দিল। মেয়েটি চাকতিটা হাতে নিয়ে শুধু তাকিয়ে রইল। জানতে চাইল কি হয়েছিল। বস্তু বলল, সে এক বিশ্রী গল্প। তোমার বন্ধু লার্গো এর সঙ্গে জড়িত আছে। আমি আসলে এক ধরনের পুলিশম্যান। আমি এসেছি আমার সরকারের তরফ থেকে এই ষড়যন্ত্রের রহস্য ভেদ করতে। এ কথাটা আমি তোমাকে জানালাম। আর বাকিটুকু বলব, কারণ এতে তোমার সাহায্য না পেলে শত শত সম্ভবত হাজার হাজার লোক মারা পড়বে। বন্ড ডোমিনোকে প্রথম থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে সমস্ত কেসটার বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করে গেল। তারপর বলল, সুতরাং বুঝতে পারছ যতক্ষণ না বোমা দুটো ডিস্কোতে তোলা হচ্ছে আমাদের কিছুই করার নেই। যতক্ষণ বোমা দুটো হাতের বাইরে আছে, আমাদের শংকা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বন্ড তার কাছে যে গাইগার কাউন্টারটা ছিল সেটা মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল এটাই তোমাকে বলে দেবে জাহাজে বোমা আছে কিনা। যদি বোঝ যে সত্যিই বোমা আছে তবে তোমার কেবিনের পোর্টহোল দিয়ে একটা আলো দেখিয়ো। আমাদের লোকেরা কড়া নজর রাখছে জাহাজটার ওপর। বন্ড তাকে যন্ত্রটার ব্যবহার দেখিয়ে দিল। তেজস্ক্রিয়তা ধরা পড়লে একটা ক্লিক ক্লিক্ আওয়াজ করতে থাকবে।
জাহাজের যে কোন জায়গা থেকে তুমি বোমার উপস্থিতি বুঝতে পারবে। মেয়েটা এতক্ষণ ধরে শুনছিল সব। এবার তাকে একটু অন্যমনস্ক মনে হল। হাত বাড়িয়ে এবারে সে বন্ডের বাহু স্পর্শ করল, জানতে চাইল আবার কবে তাদের দেখা হবে।
বন্ড এতক্ষণ এই প্রশ্নটার জন্যই শংকিত ছিল। গাইগার কাউন্টার সমেত জাহাজে পাঠিয়ে সে মেয়েটাকে জোড়া বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। সে লার্গোর হাতে ধরা পড়তে পারে সেক্ষেত্রে মৃত্যু অবধারিত। বিষয়টা চিন্তা করে নিয়ে বন্ড বলল, তুমি যেখানেই থাক না কেন, আমি তোমাকে খুঁজে বার করব। মেয়েটা হাত ঘড়ি দেখল। বলল, সাড়ে চারটে। এবার আমাকে যেতে হবে। তুমি আমার সঙ্গে এসো না। কয়েক মিনিট পরে বন্ড MG-র ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পেল।
বন্ড রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে চলল। তারপর কমিশনারের সঙ্গে বেতার যোগাযোগ করল। কমিশনার তাকে লিটারের কাছ থেকে দুটো খবর দিলেন। লিটারের পামীরা অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। মান্টা আর কুড়ি মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছাচ্ছে। বন্ড যেন প্রিন্স জর্জ জেটিতে লিটারের সঙ্গে দেখা করে।
মান্টার কিন্তু সাধারণ সাবমেরিনদের মত চমঙ্কার ছিপছিপে চেহারা নয়, বরং একটা ভোতা কুৎসিত চেহারা। এটা জর্জ ওয়াশিংটন শ্রেণীর ডুবোজাহাজ, ওজন প্রায় ৪০০০ টন, দাম দশ কোটি ডলারের মত।
মিসাইলের গতি এবং লক্ষ্যস্থলের সব তথ্য ওর ভিতরেই অটোমেটিক ভাবে পুরে দেওয়া হয়। তারপর প্রধান গানার। স্রেফ একটা বোম টিপে দেন। এরকম সাবমেরিন এখনই আমাদের ছ টা আছে। আরো তৈরি হচ্ছে।
বন্ড শুকনো মন্তব্য করল, এটাকেও ধ্বংস করবার উপায় বার হবে নিশ্চয়ই। মান্টার সামনে ছ টা টর্পেডোটিউব আছে। তবে কম্যান্ডারকে দিয়ে সেগুলো ছোঁড়াটা শক্ত হবে।
বিশাল সাবৃমেরিনটা এসে জেটির সঙ্গে আস্তে ধাক্কা খেল। পুলিশ কর্ডন দিয়ে আটকে রাখা জনতা হৈ হৈ করে উঠল। লিটার বলল, চল, তাহলে যাওয়া যাক্।
.
সিদ্ধান্ত
সাবমেরিনের ভেতরে আশ্চর্যরকম বেশি জায়গা। কোন ভিড়ভাট্টা নেই। বছর আটাশের এক যুবক রক্ষী অফিসারের পেছন পেছন দু তলা নিচে নেমে এল তারা। চমৎকার ঠাণ্ডা হাওয়া। সিঁড়ির নিচে নেমে এসে তিনি বাদিকে ঘুরে একটা দরজায় টোকা মারলেন। দরজার ওপর লেখা–কম্যান্ডার পি. পেডারসেন, যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনী।
ক্যাপ্টেন ভদ্রলোককে দেখে মনে হয় চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। চোখের দৃষ্টি ধূর্ত, কিন্তু সরস। দাঁড়িয়ে উঠে ওদের দুজনের সঙ্গে করমর্দন করলেন এবং সামনের চেয়ার দুটোয় বসতে ইঙ্গিত করলেন। ক্যাপ্টেন লিটারের দিকে তাকালেন–ব্যাপারটা কি বলুন তো? কোরিয়ার যুদ্ধের পর আর এমন টপ সিক্রেট আর অত্যন্ত জরুরী র বন্যা দেখেনি। আপনাদের বলতে বাধা নেই। শেষ বার্তাটা পেয়েছি আমাদের নৌবাহিনীর সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে। ব্যক্তিগত নির্দেশ, তাতে বলা হয়েছে, আমি যেন নিজেকে আপনার অথবা আপনি নিহত বা আহত হলে কম্যান্ডার বন্ডের অধীনস্ত বলে মনে করি, যতক্ষণ না আজ সন্ধ্যা সাতটায় অ্যাডমিরাল কার্লসন এসে পড়েন। আমি কেবল জানি যে এইসব বার্তায় অপারেশন থান্ডারবল ছাপ মারা আছে।
বন্ডের ক্যাপ্টেন পেডারসেনকে বড় ভাল লাগল। দশ মিনিট পর কম্যান্ডার পেডারসেন আবার হেলান দিয়ে বসলেন। পাইপটা নিয়ে তাতে তামাক ভরতে লাগলেন অন্যমনস্কভাবে। তারপর বললেন, আমাদের সামনে একটা বিরাট সমস্যা, আপনারা সম্ভবত অনুমান করছেন যে, লার্গো প্লেন নিয়ে গুপ্তস্থান থেকে বোমা দুটো নিয়ে আসতে গেছে। যদি তার কাছে বোমা থাকে, সেক্ষেত্রে ঐ মেয়েটি আপনাদের খবর দেবে। তখন আমরা এগিয়ে গিয়ে জাহাজটাকে আটক করব। বা ডুবিয়ে দেব। কিন্তু কোন কারণে মেয়েটি যদি আমাদের জানাতে না পারে তখন আমরা কি করব?
বন্ড শান্ত কণ্ঠে বলল, তখন আমরা ওর পিছু নেব, যতক্ষণ না প্রেতাত্মা সংঘের দেওয়া সময় শেষ হয়। সময় শেষ হলে আমরা সমস্ত সমস্যাটাকে আমাদের গভর্নমেন্টের হাতে তুলে দিতে পারি। এখন আমাদের কাজ হবে একজন গোয়েন্দার মত, যে একজন সন্দেহজনক লোকের ওপর নজর রাখছে। সে অনুমান করছে যে, লোকটি খুনের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে।
আসলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে লার্গোই আসল শয়তান, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা রওনা হয়ে পড়বে অকুস্থলের দিকে। সেইজন্যই আপনাকে তড়িঘড়ি করে ডেকে এনেছি। এটা শতকরা একশো ভাগ ঠিক যে, এটম বোমা যথাস্থানে বসাতে হলে রাত্রিবেলাই সবচেয়ে সুবিধে আর এটাই হচ্ছে লার্গোর হাতে শেষ রাত্রি। বন্ড বলল, রাতে ডিস্কোয় আলো জ্বলবে না। প্লেন থেকে তাকে খুঁজে বার করা শক্ত কাজ হবে। আমরা প্লেনগুলোকে আমেরিকার উপকূলের ওপর নজর রাখতেও বলতে পারি।
কড়িকাঠের PA সিস্টেমের ভিতর থেকে আওয়াজ শোনা গেল–রক্ষী অফিসার বলছি ক্যাপ্টেনের প্রতি। একজন পুলিশ অফিসার কম্যান্ডার বন্ডের জন্য জরুরী সংবাদ নিয়ে এসেছেন। সংবাদটা হল–প্লেন ৫-৩০-এ ফিরে এসেছে। তাকে জাহাজে তুলে নেওয়া হয়েছে। ৫-৫৫-তে ডিস্কো রওনা হয়ে পড়েছে, পুরোদমে উত্তর-পশ্চিম দিকে। মেয়েটা জাহাজে ওঠবার পর আর ডেকে বেরিয়ে আসেনি। বন্ড বার্তাটা সই করল, তারপর ক্যাপ্টেনের দিকে এগিয়ে দিল। তিনি সই করলেন, লিটারও করল। চিঠিটা খামে পুরে বন্ড কর্পোরালের হাতে দিল। তিনি চটপট মুখে পুরে ভারী বুটজোড়ার আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেলেন।
দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই ক্যাপ্টেন ইন্টারকমের সুইচ টিপে আদেশ দিলেন পানির ওপর ভেসে উঠে উত্তরদিকে রওনা হতে, দশ নট বেগে। তারপর সুইচ অফ করে দিলেন।
বন্ড অন্যমনস্কভাবে বার্তার কথা সাজাচ্ছিল, আর উদ্বিগ্নভাবে চিন্তা করছিল কমিশনারের চিঠির তাৎপর্য এবং ডোমিনোর সম্বন্ধে। জটিল পরিস্থিতি। লার্গো হয়ত তার গুপ্তধন অভিযানে চলেছেন অথবা চলেছেন বোমা বসাবার জন্য টাইম ফিউজ ঠিকমত লাগাবার জন্য, যাতে প্রেতাত্মা সংঘের দেওয়া সময়রেখা পার হবার কয়েক ঘণ্টা পরে বিস্ফোরণ হয়। কারণ, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা শেষ মুহূর্তে টাকা দিতে রাজী হলেও বোমাটাকে উদ্ধার করতে হবে।
নাসাউ থেকে পশ্চিম দিকে, বেরী আইল্যান্ড চ্যানেল হয়ে নর্থ-ওয়েস্ট লাইটের পথটা এই সম্ভাবনার সঙ্গেই মিলে যাচ্ছে। বিমিনির দক্ষিণে ডোবা প্লেনটা, মিয়ামী এবং আমেরিকার উপকূলের অন্যান্য সমস্ত সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু ঐ পশ্চিম দিকে তারপর নর্থ-ওয়েস্ট প্রভিডেন্স চ্যানেলে ফিরে এসে সোজা গ্রান্ড বাহামার মিসাইল স্টেশনের দিকে গেলেই হল।
একটা ভীষণ অস্বস্তি আর ভয় বন্ডকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সে মনে মনে মানতে বাধ্য হল যে–সে, লিটার এবং মান্টা এক অদ্ভুত জুয়াখেলায় জড়িয়ে পড়েছে। যদি বোমা দুটো জাহাজে থাকা আর যদি ডিস্কো সত্যিই গ্র্যান্ড বাহামার মিসাইল স্টেশনের দিকে চলে, তবে নর্থ-ওয়েস্ট চ্যানেল দিয়ে মান্টা সম্ভবত তাকে ধরে ফেলতে পারবে।
কিন্তু এই জুয়াখেলায় সবরকম বিরূপ সম্ভাবনা সত্ত্বেও তারা জিততে পারে, তবু…ডোমিনো কেন সংকেত জানাল? কি হয়েছে তার?
.
খুব নরম হাতে, খুব আস্তে…
ঘন নীল আয়নার মত সমুদ্রের বুকে তরঙ্গ তুলে একটা কালো টর্পোেের মত ছুটে চলেছে ডিস্কো। যদিও প্রত্যেকটি পটোহোলের ওপর শাটার টানা আছে সমস্ত ঘরে একমাত্র আলো হচ্ছে ছাদ থেকে ঝুলন্ত একটি জাহাজী লণ্ঠন। লাগো বসেছিলেন টেবিলের মাথায়। কেবিনে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সমস্ত মুখ ঘামে চকচক করছে। তিনি বলতে শুরু করলেন, আপনাদের জানাতে চাই যে আমরা একটু জরুরী অবস্থার মধ্যে পড়েছি। আধ ঘণ্টা আগে ১৭ নং, ডেকের এক কোণে মিস্ ভিতালিকে একটা ক্যামেরা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখেন। ১৭ নং সন্ধিগ্ধ হয়ে আমাকে ঘটনাটা জানান। আমি নিচে নেমে মেয়েটিকে তার কেবিনে নিয়ে যাই। সে আমার সঙ্গে খুব ধ্বস্তাধ্বস্তি করল। তারপর ক্যামেরাটা আদায় করতে আমি বল প্রয়োগ করতে বাধ্য হই। ক্যামেরা নিয়ে আমি সেটাকে পরীক্ষা করে দেখেছি।
একটু থেমে লার্গো শান্তকণ্ঠে বললেন, ক্যামেরাটা ভুয়া। তার ভেতরে লুকানো ছিল একটা গাইগার কাউন্টার। কাউন্টারের কাঁটা স্বভাবতঃই ৫০০ মিলি রন্টজেন-এ উঠে গিয়েছিল। মেয়েটির জ্ঞান ফিরিয়ে এনে তাকে প্রশ্ন করেছি আমি। সে কোন কথা বলতে অস্বীকার করেছে। যথাসময়ে আমি তাকে কথা বলতে বাধ্য করব আর তারপর তাকে শেষ করে ফেলা হবে।
লার্গো চুপ করলেন। টেবিলের চারদিক থেকে ক্রুদ্ধ বিরক্ত সব আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। ২ নম্বর এ বিষয়ে বললেন, কাজ চালিয়ে যেতে। বললেন, সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য গাইগার কাউন্টার খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের। পৃথিবীর প্রতিটি গুপ্তচর বিভাগ আমাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। নাসাউ-এর কোন ভারপ্রাপ্ত বিভাগ হয়ত পুলিশ বন্দরের সব জাহাজের তেজস্ক্রিয়তা মাপবার আদেশ দিয়েছেন। রেডিও অপারেটরকে আমি নাসাউ ও উপকূলের মধ্যে কোন অস্বাভাবিক বেতারবার্তা বিনিময় হচ্ছে কিনা দেখবার জন্য কান খাড়া রাখতে বলেছি। ৫নং মাথা নেড়ে বললেন, চিন্তার কোন কারণ নেই। বিদ্যুতের কয়েকটা ব্যবহার আমি জানি। মানবদেহ তা সহ্য করতে পারে না। মেয়েটির কাছ থেকে সমস্ত কথাই আমাদের আদায় করতে হবে। কার্গো টেবিলের চারপাশে ছায়াময় রক্তিম মুখগুলোর দিকে তাকালেন তারপর বললেন, এখন মধ্যরাত্রি। রাত তিনটের সময় আমরা নোঙর করব। তারপর সাঁতার-দল রওনা হবে আধমাইল দূরে বোমা বসানোর জায়গাটার দিকে। আমাদের যে পনেরো জন এই দলে থাকবেন তাঁরা যথারীতি তারের মত ছড়িয়ে সাঁতার কাটবেন, আর দলের মাঝখানে থাকবে বোমাবাহী রথ এবং স্নেড়। পথপ্রদর্শকের প্রধান কর্তব্য হবে হাঙ্গর ও ব্যারাকুড়া সম্পর্কে সাবধান থাকা। কেউ যদি বন্দুক চালান, তিনি আগে পার্শ্ববর্তীকে তা জানিয়ে দেবেন, যদি সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
ষড়যন্ত্রের গোড়ার দিকে, কয়েক মাস আগে প্যারিসে, ব্রোফেন্ড লাগোকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, দলের কোন সদস্যের কাছ থেকে যদি বিপদ আসে তাহলে তা ঐ দুজন রাশিয়ানের কাছ থেকে আসার সম্ভাবনা বেশি। এরা হলেন ১০ এবং ১১ নং। SMERSH-এর প্রাক্তন সদস্য। ব্লোফেন্ড বলেছিলেন, এই দুজনের রক্তের মধ্যে ষড়যন্ত্রের বীজ রয়েছে। আর ষড়যন্ত্রের চিরসঙ্গী হল সন্দেহপ্রবণতা। এরা দুজনে সবসময় ভাববে, তাদের বিরুদ্ধে আলাদা কোন মতলব আঁটা হচ্ছে কি না। ওরা সঙ্গীদের বিরুদ্ধে নালিশ করবার চেস্টা করবে। কিন্তু মনে রাখবেন যদি ওরা দলের মধ্যে অবিশ্বাসের বীজ বপন করতে চেষ্টা করে, তবে আপনাকে দ্রুত ও নির্দয়ভাবে দমন করতেই হবে।
সমস্ত অধিবেশন নিস্তব্ধ। উপস্থিত সকলেই গুপ্তচর অথবা ষড়যন্ত্রকারী। তারা বিদ্রোহের গন্ধ পেলেন, আঁচ করলেন অবিশ্বস্ততার কালো ছায়া এগিয়ে আসছে। ১০নং বলে গেলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সময় আসবে যখন আমরা পনেরো জন থাকব ঐ ওখানে তিনি কেবিনের দেওয়ালের দিকে হাত দেখালেন, অন্ধকারের জেতর জাহাজ থেকে আধঘণ্টা সাঁতারের রাস্তা। আর পাঁচজন সদস্য ও ছ জন সাব এজেন্ট থাকবেন এই জাহাজেই। আমার মতে প্রত্যেকটি জাতীয় দলের একজন করে জাহাজে থেকে দলের বাকি সদস্যের স্বার্থরক্ষা করা উচিত। এর ফলে সাঁতারুর সংখ্যা দশ এ নেমে আসবে কিন্তু যারা এই বিপজ্জনক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন তারা অনেক বেশি উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে পারবেন।
খুব ভদ্র, নিরুত্তাপ কণ্ঠে কথা বললেন কার্গো, আপনার প্রস্তাবের একটা সংক্ষিপ্ত ও সোজা উত্তর আমার জানা আছে, ১০ নম্বর। তার বিশাল থাবা থেকে বেরিয়ে আসা রিভলবারের ছোট্ট নলটার ওপর একবার লাল আলো খেলে গেল। পরপর তিনটা গুলি করলেন তিনি। ১০ নং দুর্বলভারে দু হাত সামনে তুলে ধরলেন তারপর চেয়ার শুদ্ধ হুড়মুড় করে উল্টে পড়লেন পেছন দিকে। চারদিক নিস্তব্ধ।
সবাই চলে যাবার পর পার্গো উঠে দাঁড়ালেন। বরফের টুকরো ভর্তি একটা লাল রঙের রবারের থলি হাতে নিলেন। তারপর দরজা খুলে হেঁটে গিয়ে ঢুকলেন ডোৱিলো ভিতালির কেবিন। দরজায় খিল লাগিয়ে দিলেন। এ ঘরেও ছাদ থেকে ঝুলছে একটা লাল রঙের বাতি। তার তলায় বড় বাংক্টার ওপর মেয়েটি শুয়ে, তার গোড়ালি আর কব্জি লোহার খাটের চারকোণে দড়ি দিয়ে বাঁধা। মেয়েটা তাকে লক্ষ্য করছিল।
লার্গো বললেন, প্রিয়ে, তোমার শরীরকে আমি অনেক উপভোগ করেছি, আনন্দও পেয়েছি প্রচুর। পরিবর্তে, তুমি যদি না বল তোমাকে ঐ যন্ত্রটা দিয়েছে তাহলে আমি তোমাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিতে বাধ্য হব। কাজটা আমি করব এই সামান্য দুই অস্ত্রের সাহায্যে। উত্তাপের জন্য এই সিগার আর ঠাণ্ডার জন্য বরফের টুকরো। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এই দুটো ব্যবহার করলে তখন চীৎকার করা ছাড়া তোমার আর কোন পথ থাকবে না। এখন বল কোনটা তুমি চাও?
মেয়েটির গলা ঘৃণার আগুনে ভয়ঙ্কর শোনা, আমার ভাইকে তুমি খুন করেছ, এখন আমাকে খুন করতে চলেছ। তোমাকে সময় ঘনিয়ে এসেছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, তুমি আমার চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি কষ্ট পেয়ে মর।
লার্গো ঝুঁকে পড়ে মেয়েটির কাঁধের শার্ট ও ব্রেসিয়ারের ফিতে একসঙ্গে চেপে ধরলেন। তারপর খুব আস্তে কিন্তু ভীষণ জোরের সঙ্গে হাত নিচের দিকে টেনে আনতে লাগলেন শরীরের সমস্ত দৈর্ঘ্য বেয়ে। শেষে দু হাতের দুটুকরো ছেঁড়া কাপড় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিলেন মেয়েটির দেহ। কি যেন ভাবতে ভাবতে সেটাকে ভাল করে দেখলেন, তারপর চেস্ট অফ ডুয়ার্সের ওপর থেকে সিগার আর বরফের পাত্রটা নিয়ে এলেন। লার্গো সিগারটায় একটা টান দিলেন, ছাই ঝেড়ে ফেললেন। তারপর ঝুঁকে পড়লেন সামনের দিকে।
.
পিছু পিছু আসে
আকার আক্রমণ কেন্দ্রে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। কম্যান্ডার পেডারসন ইকোসাউন্ডার পরিচালকের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং মাঝে মাঝে পেছন দিকে বসা বন্ড ও লিটারের প্রতি কথা বলছিলেন। তারা দুজনে বসেছিল যন্ত্রপাতি থেকে অনেক দূরে দুটো ক্যানভাসের চেয়ারে। ক্যাপ্টেন আনন্দের হাসি হেসে বললেন, আর চার ঘণ্টার পথ। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমরা গ্র্যান্ড বাহামার কাছে পৌঁছে যাব। যদি পর্দায় দেখা যায় ছোট্ট একটা দ্বীপ দল ছেড়ে বেরিয়ে এসে জোরে উত্তর দিকে ছুটেছে আমাদের সমান্তরাল পথে, তবেই বুঝবো সেটা আমাদের। ডিস্কো। যতক্ষণ না বেরী দ্বীপপুঞ্জের এলাকা থেকে বেরিয়ে পড়তে পারছি সেই দ্বীপগুলোই সমস্ত পর্দা জুড়ে থাকবে। যতক্ষণ না জাহাজটা লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি পৌঁছচ্ছে, বিশেষ কিছু করার নেই। বন্ড এবং লিটার ক্যাপ্টেনের পিছন পিছন একটা প্যাসেজ বেয়ে গিয়ে মেস হলে পৌঁছল। একটা আলোকিত খাবারঘর, ক্রীম রঙের দেওয়াল আর গোলাপী ও সবুজ প্যানেল। তারা একটা ফমিকা ঢাকা টেবিল ঘিরে বসল। একজন স্টুয়ার্ড মেনু নিয়ে এল। বন্ড পোচ করা ডিম, কড়া টোস্ট আর কফির সুর্ডার দিল। এখন তার মাথার মধ্যে শুধু চিন্তা আর চাপা উত্তেজনা। খেতে খেতে তারা আলোচনা করতে থাকল গ্রান্ড বাহামার কাছে ডিস্কোকে ধরতে পারলে তাদের কি করা উচিত। বন্ড বলল, লোকগুলোকে ঘায়েল করবার একটাই সুযোগ আছে। যদি আমরা তাড়াহুড়ো করি ডিস্কো চটপট কয়েকশ গজ সরে গিয়ে ৰােমা দুটোকে কোন গভীর গহ্বরের ভিতর ফেলে দিতে পারে। তাদের এবং বোমা দুটোকে বাগে আনবার সবচেয়ে উপযুক্ত ক্ষণ হবে যখন তারা জাহাজ থেকে লক্ষ্যস্থলের দিকে পানির তলায় সাঁতার কেটে এগিয়ে যাবে। তাদের ডররির দল দিয়ে ঘায়েল করতে হবে। দ্বিতীয় বোমাটি যদি জাহাজেও থাকে, কিছু এসে যাবে না। সেই শুদ্ধ। ডিস্কো কে ডুবিয়ে দিতে পারি আমরা। ক্যাপ্টেন মাইক্রোফোনে তার লোকজনদের সঙ্গে কিছু কথা বলার জন্য উঠে গেলেন।
বন্ড এক ডিউটি অফিসারের বাংকে ঘুমিয়ে ছিল। আলার্ম বেল-এর গর্জনে তার ঘুম ভেঙে গেল। সে আক্রমণ কেন্দ্রের দিকে চলল। লিটার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল সেখানে। ক্যাপ্টেন তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে আপনারা ঠিকই অনুমান করেছিলেন। সে জাহাজটাকে পেয়েছি। পাঁচ মাইলের সামনে আর একটু ডান দিকে ঘেঁষে। প্রায় ত্রিশ নট বেগে চলেছে।
বন্ড পেরিস্কোপে চোখ লাগাল। এক মিনিট পরেই দেখতে পেল দিক চক্ৰবালে একটা ছোট সাদা ছোপ। গ্রান্ড বাহামার পশ্চিম প্রান্তের দিকে চলেছে, হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই।
ক্যাপ্টেন একটু হেসে বললেন, অস্ত্রশস্ত্র বিভাগে সার্জেন্টটি হাতিয়ার জোগাড়ের চেষ্টায় আছেন। তিনি এক ডজন ছোরা সংগ্রহ করেছেন নাবিকদের কাছ থেকে, অবশ্য সহজে তারা তাদের সম্পত্তি ছাড়েনি। তারপর সেগুলোকে শান দিয়ে তীরের ফলার মত সূচ্যগ্র করে তুলেছেন। সেগুলোকে আঁটার মত জুড়ে তৈরি হয়েছে বারটা বর্শা।…ঠিক আছে তাহলে। আবার দেখা হবে। যা দরকার হয় জানাবেন। তিনি আবার প্লটের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। বন্ড ও লিটার চলল ইঞ্জিন মেরামতের ঘরটাতে। পথে তাদের রি-অ্যাকটর রুমের ভেতর দিয়ে যেতে হল। রি-অ্যাক্টর আসলে একটা নিয়ন্ত্রিত অ্যাটমিক বোমার মত। মেরামতের ঘরটাতে, অজস্র যন্ত্রপাতির মধ্যে লেদ মেশিনের সাহায্যে বর্শার ফলা তৈরির কাজ চলছে। কয়েকজন সাঁতারু ইতিমধ্যেই বর্শা হাতে পেয়ে গেছে। বন্ড একটা বর্শা পরীক্ষা করে দেখল মারাত্মক অস্ত্র।
কিছুক্ষণের মধ্যে চকচকে কালো স্যুটগুলো দেওয়াল থেকে বিশাল সব বাদুড়ের চামড়ার মত ঝুলতে থাকল। বন্ড দলের সবাইকে ডেকে বলল, বন্ধুগণ, আমরা পানির নিচে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে যোগ দিতে চলেছি। হয়ত অনেকেই মারা পড়বে। আমরা সাঁতার কাটব দশ ফিট পানির নিচে। যথেষ্ট আলো থাকবে। ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুতে থাকব আমি ১ নম্বর, আমার পরেই থাকবেন ২ নম্বর মিঃ পীটার এবং পেটি অফিসার ফার্লো, ৩ নং। প্রত্যেকে তার সামনের জনকে অনুসরণ করবে, ফলে কারো হারানোর সম্ভাবনা থাকবে না। সবচেয়ে বড় কথা, শান্ত থেকো। আমাদের আক্রমণটা খুব আকস্মিক হওয়া দরকার। শত্রুপক্ষের হাতে গ্যাস বন্দুক থাকবে, যার পাল্লা প্রায় বিশ ফিট। গুলি চালাবার সঙ্গে সঙ্গে বর্শা বাগিয়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়বে। শরীরের প্রায় যে কোন অংশে এই বর্শার চোট লাগাতে পারলেই শত্রু ঘায়েল। পেটি অফিসার ফার্লোর কাছে একটা সিগন্যাল ফ্লেয়ার আছে। আক্রমণ শুরু হলেই সেটা তিনি সমুদ্রের বুকে ফাটিয়ে দেবেন। তৎক্ষণাৎ ক্যাপ্টেন সাবমেরিন নিয়ে ভেসে উঠবেন আর একটা ডিঙ্গিতে চেপে এক দল সশস্ত্র লোক ও সাবমেরিনের চিকিৎসক আমাদের সাহায্যের জন্য রওনা হয়ে পড়বেন। এবার, তোমাদের কোন প্রশ্ন আছে।
সাবমেরিন থেকে বেরিয়ে আমরা কি করব? বন্ড বলল, চেষ্টা করবে যাতে সমুদ্রের বুকে খুব কম আলোড়ন ওঠে। চটপট দশ ফিট গভীরে নেমে গিয়ে দলে নিজের জায়গা ঠিক করে নেবে।
হঠাৎ লাউডস্পীকারে গগ করে উঠল, ডুবুরির দল পানিতে বেরোনোর দরজায় চলে এস। সরঞ্জাম সব পরে নাও। কম্যান্ডার বন্ড একবার আক্রমণ কেন্দ্রে আসবেন দয়া করে।
ইঞ্জিনের গর্জন ক্রমশ মৃদু হতে হতে হঠাৎ থেমে গেল। সান্টা বসে পড়ল সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপর। একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি লাগল।
.
উলঙ্গ সংগ্রাম
এক দমকা কম্প্রেসড এয়ার এসকেপ হ্যাচ পেরিয়ে ওপর দিকে ঠেলে দিল। তার অনেক ওপরে সমুদ্রের বুকটাকে দেখাচ্ছিল যেন একটা রূপার থালা হাওয়ার ঝাঁপটায় নাচছে, ফুলে উঠছে। যে হাওয়াটা তাকে ঠেলে দিয়েছিল সেটা বেলুনের মত ফেটে পড়ল। কানে তীব্র ব্যথা অনুভব করল।
এবার এসকেপ হ্যাচ থেকে এক গাদা রূপালি বুদুদের বিস্ফোরণের সঙ্গে মান্টা তার দিকে লিটারের কালো দেহটা ছুঁড়ে দিল। বন্ড রাস্তা থেকে সরে গিয়ে ভেসে উঠল পানির ওপর। নিষ্প্রদীপ ডিস্কো তার বাঁদিকে এক মাইল দূরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজটায় কোন কাজকর্মের লক্ষণ দেখা গেল না।
বন্ডের কাঁধে টোকা পড়ল। লিটার। কাঁচের মুখোশের ভেতর থেকে হাসল সে। বন্ড মাথা নেড়ে সাঁতরাতে শুরু করল। আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে চলল, একটা হাত পাশে আর একটা হাতে বর্শাটা বুকের ওপর ধরা। তার পেছনে সবাই ত্রিভুজের আকারে ঘন হয়ে এল। বন্ড অন্যদের হাত তুলে আস্তে চলবার নির্দেশ দিল। আস্তে আস্তে সামনে এগোল সে, তার দিক চিহ্ন, একটা পাথরের চূড়ার মাথায় রুপালি ঢেউ ভাঙার দিকে চোখ খোেলা রেখে। সে রাস্তা থেকে পুরো কুড়ি ফিট সরে এসেছে। বন্ড পাথরটার দিকে ঘুরে গেল। সে বারবার খুঁজতে লাগল–কোন অস্বাভাবিক আলোড়ন দেখা যাচ্ছে কি-না, কিছু নড়ছে কি-না? একশ গজ দূরে, প্রবালের চাঙড়ের মধ্যে কাঁচের মুখোশ পরা একটা সাদা মাথা সহসা ভেসে উঠল, চারদিক দেখে নিয়ে তক্ষুনি আবার ডুবে গেল।
বন্ডের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। সে অনুভব করল, তার রোমাঞ্চিত হৃৎপিন্ড রবার স্যুটের ভেতরটাকে হাতুড়ির মত ঘা দিচ্ছে। সোজা নিচে ডুব দিল সে। পেছনের মুখোশগুলো তার দিকে ফেরা, তার সংকেতের জন্য অপেক্ষা করছে। বন্ড বারকয়েক বুড়ো আঙুলটাকে ওপর দিকে উঁচু করে দেখাল। প্রত্যুত্তর হিসাবে তার কাছাকাছি মুখোশগুলোর ভেতর হাসির ঝলক দেখতে পেল সে। বন্ড তার বর্শাটাকে আক্রমণের ভঙ্গিতে ধরে নিচু প্রবাল স্কুপের ওপর দিয়ে সামনে এগিয়ে চলল।
এখন শুধু গতি আর উঁচু-নিচু প্রবাল স্যুপের ভেতর দিয়ে সঠিক পরিচালনার দরকার। বারোটা ছুটন্ত শরীরের ঢেউ এর ধাক্কায় যেন জেগে উঠল সব প্রবাল প্রাচীরগুলো। পঞ্চাশ গজ যাবার পর বন্ড সকলকে আক্রমণের জন্য সারি বাঁধতে সংকেত করল। হঠাৎ সামনে একটা সাদা চামড়ার ঝলক দেখা গেল। বন্ড বাহুর সাহায্যে আক্রমণের সংকেত দিল। তারপর বর্শা বাগিয়ে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বন্ড দেখল লাগোর লোকদের দৃষ্টি সামনের দিকে। এখনো তারা বুঝতে পারেনি, প্রবালের ফাঁকা দিয়ে অনেকগুলো কালো কালো দেহ তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু বন্ড লাগোর দলের একেবারে সামনের লোকটির কাছাকাছি এসে পড়তেই চাঁদের আলো তার কালো ছায়া ফেলল নিচের সাদা রঙের বালির ওপর। সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক লোক চমকে পাশের দিকে তাকাল। আর বন্ড একটা প্রবাল স্তূপে পায়ের ধাক্কা মেরে, তীরের মত সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
সামনের লোকটি আত্মরক্ষার কোন সুযোগই পেল না। বন্ডের বর্শা তার শরীরের একপাশে ঢুকে গেল। সে ছিটকে পড়ল পরের লোকটির ওপর। বন্ড এলোপাথাড়ি বর্শা চালাতে লাগল। এবার শত্রুদের অর্ধনগ্ন দেহগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের জেট-প্যাকেটের গতি বাড়িয়ে দিয়ে। বন্ড তাদের দিকে আক্রমণ চালাল। একটা বল্পম বন্ডের পেটের ওপর দিয়ে রবারের স্যুট ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। বন্ড একটা জ্বালা আর ভেজা ভেজা স্পর্শ অনুভব করল। বুঝতে পারল না রক্ত, না সমুদ্রের পানি। একটা ছুটে-আসা বল্লমের ফলাকে পাশ কাটাল সে। চারদিকে পানি জুড়ে সংগ্রাম শুরু হল– রক্ত আর রক্ত। বন্ড প্রবাল স্কুপের আড়ালে লুকিয়ে আস্তে আস্তে সেদিকে সাঁতার কাটতে লাগল। দেখল একটা লোক বন্দুক তুলে লিটারের দিকে লক্ষ্য স্থির করছে। লিটার প্রাণপণে লার্গোর দলের আর একটা লোকের সঙ্গে লড়াই করছে। সে লোকটা দুহাতে লিটারের গলা চেপে ধরেছিল কিন্তু লিটার হাতের হুকটা দিয়ে তার পিঠ চিরে দিল।
বন্ড ছ ফিট দূর থেকে বর্শা ছুঁড়ল। ঠিক বন্দুক হুঁড়বার আগে বর্শাটা তীরবেগে আততায়ীর হাতে বিধে গেল। কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বভকে বন্দুকের এক বাড়ি মারল। চোখের কোণে বন্ড দেখতে পেল তার বর্শাটা ভেসে উঠে যাচ্ছে অপরদিকে। বন্ড কোনরকমে শত্রুর মুখের কাঁচের মুখোশটা টেনে খুলে দিল।
এবার সে প্রবালের অরণ্যের ভেতর দিয়ে আবার লার্গোর খোঁজে চলল। মাঝে মাঝে কয়েকটা দ্বৈত সংগ্রাম চোখে পড়ল তার। সমুদ্রের তলায় প্রবালের ঢিবির মধ্যে যুদ্ধের নানান নিদর্শন ছড়িয়ে পড়ে আছে। লার্গোর চিহ্নমাত্রও নেই। রক্তমেশা পানির ভিতর দিয়ে খুবই কম চাঁদের আলো এসে পড়ছে বালির বুকে। যুদ্ধ প্রায় বারোটা বিভিন্ন লড়াইয়ে বিভক্ত। বন্ড যুদ্ধের গতি মোটেই আন্দাজ করতে পারল না।
কিন্তু পরমুহূর্তেই যা দেখল তাতে সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলতে দেরি হল না। কুয়াশার আড়াল থেকে চকচকে টর্পোেের মত বৈদ্যুতিক রথটা বন্ডের ডানদিকে যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে এসে পড়ল। তার ওপর চেপে বসেছিলেন লার্গো, মোটরবাইক আরোহীর মত সামনের পার্সপেক্স কাঁচের শীন্ডের পেছনে অল্প একটু ঝুঁকে। তার বাঁ হাতে দুটো মান্টার তৈরি বর্শা। ডান হাতে জয়স্টিক ধরে রথ পরিচালনা করছেন। লার্গো গতি কমিয়ে আস্তে ভেসে তাদের সামনে এসে থামলেন। একজন প্রহরী রথের হাল ধরে সেটাকে ব্লেডের কাছে টেনে আনতে লাগল।
এবার বন্ড বুঝতে পারল যে, এরা পালাবার চেষ্টা করছে। লার্গো এই বোমাটাকে রথের সাহায্যে টেনে নিয়ে গিয়ে প্রবাল প্রাচীরের ওধারে অতলস্পর্শী গহ্বরে ফেলে দেবেন। এভাবে প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করবেন। বন্ড প্রবালের ঢিবির ওপরে সজোরে পায়ের ধাক্কা মেরে ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনের দিকে। লার্গো শেষ মুহূর্তে ঘুরে গিয়ে তার ডান হাতের বর্শা দিয়ে বন্ডের বর্শার আঘাত ঠেকালেন। বন্ড আবার ঝাঁপ দিল লার্গোর মুখ থেকে হাওয়ার নলটা খুলে নেবার চেষ্টায়। লার্গো দুহাত দিয়ে ঠেকালেন। তারা অন্ধের মত উভয়ে উভয়কে আঁচড়াতে লাগল, দুজনেই প্রাণপণে কামড়ে রয়েছে তাদের মুখের মাউথ পীসটাকে–যার ওপর নির্ভর করছে তাদের জীবন-মরণ। লার্গো রথের সিটটাকে দুহাটুর মধ্যে খুব ভাল করে চেপে ধরে আছেন। আর বন্ড ঝুলছে এক হাতে লার্গোর সাঁতারের সরঞ্জামগুলো চেপে ধরে। বারবার লাগোর কনুইটা এসে তার মুখে আঘাত হানতে লাগল। একই সঙ্গে বন্ড তার অন্য হাতটা দিয়ে লাগোর কিডনী লক্ষ্য করে ঘুসি চালাতে লাগল। লাগোর শরীরের অন্য সব অংশ তার নাগালের বাইরে।
চওড়া প্রণালীটা যেখানে খোলা সাগরের সঙ্গে মিশেছে, সেখান থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে পানির বুকে মাথা তুলল রথটা, আর পাগলের মত এঁকেবেঁকে ছুটল। বন্ডের অর্ধেক শরীর পানির ভেতর। এক্ষুনি লার্গো ঘুরে বসে দুহাতে তাকে চেপে ধরবেন। বন্ড লার্গোর অ্যাকোয়ালং ছেড়ে দিয়ে রথের পেছন দিকটা দুপায়ের মধ্যে ধরে পেছনে সরতে লাগল, যতক্ষণ না রথের হালটা তার পিঠে এসে লাগে। এবার সে দু পায়ের মধ্যে হাত গলিয়ে সজোরে রথের হালটাকে চেপে ধরল, এবং নিজেকে রথের ওপর থেকে পেছন দিকে ছুঁড়ে দিল। বন্ড হালের ব্লেডটাকে এক হ্যাঁচকা টান মেরে ডানদিকে অনেকটা বেঁকিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিল। লার্গো ভারসাম্য হারিয়ে রথের ওপর থেকে ছিটকে পড়লেন। তার চোখ দুটো এখন বন্ডকেই খুঁজছে। বউ তার সমস্ত শক্তি এক করে নিচে ডুব দিল। সে প্রবালের অরণ্যে লুকিয়ে পড়ল। অলস গতিতে লার্গো তার পিছু নিলেন। গায়ে রবারের স্যুটের আবরণ থাকায় বন্ড সরু গলিটা দিয়েই চলতে লাগল। মাথার ওপর একটা কালো ছায়া তাকে অনুসরণ করে চলেছে। বন্ড ওপর দিকে তাকিয়ে দেখল মাউথপীসের চারদিকে একসারি দাঁত ঝকঝক করে উঠল। লার্গো বুঝতে পেরেছেন যে বন্ড তার হাতের মুঠোয়, বন্ড তার আড়ষ্ট আঙুলগুলো খেলিয়ে সাড় আনতে চেষ্টা করল।
বন্ডের পেছনে তাকাবার উপায় নেই। সে থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল। এছাড়া কিছুই করবার নেই। লার্গো তাঁর বিশাল হাত দুটো সামনে প্রসারিত করে এগিয়ে এসে বন্ডের থেকে দশ পা দূরে থামলেন। তার চোখের দৃষ্টি পাশের এক প্রবাল তূপের দিকে ঘুরে গেল। ডান হাত বাড়িয়ে এক হ্যাঁচকা টানে কি যেন খুলে নিলেন। হাতটা বেরিয়ে আসতে দেখা গেল সে হাতে আরো আটটা কিলবিলে কালো আঙুল। লার্গো বাচ্চা অক্টোপাসটাকে তার সামনে ধরে রাখলেন। বন্ড ঝুঁকে পড়ে একটা শ্যাওলা ঢাকা পাথরের টুকরো হাতে তুলে নিল।
বন্ড এক পা এগোলেন, তারপর আরেক পা। বন্ড একটু ঝুঁকে পায়ে পায়ে পিছু হটল। হঠাৎ বন্ড দেখতে পেল লার্গোর পেছনে স্বচ্ছ পানির মধ্যে কি যেন নড়ছে। লার্গো বন্ডের দিকে ঝাঁপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্ডও পাথরের টুকরোটা হাতে ধরে ঝাঁপ দিল লার্গোর তল পেট লক্ষ্য করে। কিন্তু লার্গো প্রস্তুত ছিলেন। তাঁর হাঁটু সজোরে আঘাত করল বন্ডের মাথায় আর একই সঙ্গে ডানহাত নামিয়ে চট করে বন্ডের মুখোশের ওপর অক্টোপাসটাকে ছেড়ে দিলেন। তারপর দুই হাত দিয়ে বন্ডের গলা চেপে ধরে একটা বাচ্চা ছেলের মত তাকে টেনে শূন্যে তুললেন। বন্ড আর কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। সে বুঝতে পারল যে সে শেষ হয়ে এসেছে। বন্ড আস্তে আস্তে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। কিন্তু তার গলা চেপে ধরা হাত দুটো কোথায় গেল? কেন ডুবছে সে? তার চোখ দুটো এতক্ষণ তীব্র যন্ত্রণায় বুজে ছিল। চোখ। খুলল বন্ড। অক্টোপাসটা নেমে এসেছিল তার বুকের ওপর। এবার সেটা তাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে প্রবালের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। লাগো…লাগো পড়ে আছেন তার সামনে বালির ওপর। আর তার গলা থেকে বীভৎসভাবে বেরিয়ে আছে একটা বল্লমের অর্ধেক অংশ। তার পেছনে দাঁড়িয়ে একটা সাদা দেহ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল, আর হাতের গ্যাস বন্দুকে আর একটা বল্লম ভরছিল। উজ্জ্বল সমুদ্রের মধ্যে তার দীর্ঘ কেশ উড়ছিল চারপাশে। ডোমিনো!
কোন রকমে উঠে দাঁড়াল বন্ড। তার মুখের অক্সিজেনের টিউব আলগা হয়ে মুখে পানি ঢুকতে লাগল। একটা হাত তার হাত চেপে ধরল। সে দেখতে পেল মেয়েটার সাঁতারের পোশাকের ফাঁকে ফাঁকে অজস্র রক্তের ছোপ। ক্রমশ তার সীসের মত ভারী পা দুটো আবার পাখনা নাড়তে লাগল। তারা দুজন ওপর দিকে উঠেছে। দুটো দেহ একসঙ্গে পানির ওপর ভেসে উঠল। তারপর উপুড় হয়ে ভাসতে লাগল ছোট ছোট ঢেউয়ের মধ্যে। ভোরের হালকা রঙ ক্রমশ গোলাপি হয়ে এল। একটা সুন্দর দিনের প্রতিশ্রুতি!
.
শান্ত হোন, মিঃ বন্ড!
ফেলিক্স লিটার সাদা, অ্যান্টিসেপটিকের গন্ধে ভরা ঘরটায় ঢুকে পড়ে খুব সতর্কভাবে ভেতর থেকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। বন্ডকে ওষুধ খাইয়ে প্রায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। লিটার বন্ডকে জিজ্ঞেস করল, সে কেমন আছে। তারপর কিছু দরকারী কথা তাকে শোনাল–মনে হচ্ছে প্রেতাত্মা সংঘ সত্যিই এক ভীষণ ডাকাতের দল SMERSH, মাফিয়া, গেস্টাপো, ইত্যাদি সব দলের লোক আছে এতে। দুটো বোমাই উদ্ধার করা গেছে। ওদের যে নেতা ব্লোফেল্ড সে পালিয়েছে। তোর জন্য M-এর কাছে থেকে একতাড়া সংকেত এসে পড়ে আছে। আজ সন্ধ্যায় CIA আর তোদের দপ্তর থেকে কয়েকজন বড়কর্তা এসে কাজের ভার নিচ্ছেন। তাদের আমরা সব কাজ বুঝিয়ে দেব, তারপর আমাদের দুই গভর্নমেন্ট মারামারি করে ঠিক করুক–প্রেতাত্মা সংঘের লোকদের কি শাস্তি দেবে। তোকে লর্ড করবে না ডিউক উপাধি দেবে, আমাকে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসাবে দাঁড়াতে রাজি করাবে কি না–এইসব ছোটখাটো ব্যাপারগুলো। আমরা স্রেফ পালিয়ে গিয়ে ছুটি উপভোগ করব। মেয়েটাকে সঙ্গে নিবি নাকি? আসলে ঐ মেয়েটারই। একটা মেডেল পাওয়া উচিত। ওরা মেয়েটাকে গাইগার কাউন্টার সমেত ধরে ফেলেছিল। মেয়েটা কিছুই ফাঁস করেনি। তারপর কিভাবে যেন সে পোর্টহোল দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল লাগোকে খতম করার জন্য। করলও তাই। আর সেই সঙ্গে তোর প্রাণ বাঁচাল! লিটার কান খাড়া করে কি যেন শুনল। তারপর এক লাফে দরজার কাছে সরে গেল। বলল, এই রে, ডাক্তারটা করিডোর দিয়ে আসছে। তারপর চটপট সরে পড়ল।
বন্ড শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। ভেতরে ক্রমশ ভীষণ রাগ আর ভয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কেন তাকে কেউ মেয়েটার কথা বলছে না? বন্ড এক ঝটকায় সোজা হয়ে উঠে বসল। তারপর চিৎকার করে বলে উঠল, মেয়েটা কোথায় আছে কেমন আছে?
ডাঃ স্ট্রেঞ্জেল নাসাউ-এর একজন উঁচুদরের ডাক্তার। তিনি বন্ডের দিকে ফিরে বললেন, মিস্ ভিতালি অবিলম্বে সুস্থ হয়ে উঠবেন। তিনি জোর শক্ পেয়েছিলেন। এখন তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন। ডাক্তার আবার বললেন, আপনারও এখন বিশ্রামের দরকার। ছ ঘণ্টা অন্তর একটা করে ঘুমের ওষুধ খাবেন। আর ভাল করে ঘুমোবেন। অল্প দিনের মধ্যেই ভাল হয়ে উঠবেন। কিন্তু অবশ্যই আপনাকে শান্ত হয়ে থাকতে হবে, মিঃ বন্ড!
বন্ড চিৎকার করে বলল, শান্ত হব! চুলোয় যান আপনি! কি জানেন আপনি শান্ত হবার? আমাকে বলুন মেয়েটার কি হয়েছে! কোথায় আছে সে? কত নম্বর ঘরে?
ডাঃ স্ট্রেঞ্জেল সদয় কণ্ঠে বললেন, দ্রমহিলার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। তার সর্বাঙ্গে অজস্র পোড়ার দাগ। তিনি এখনো খুব যন্ত্রণায় আছেন। তাঁকে রাখা হয়েছে পাশের ঘরটাতে ৪ নং কামরায়। আপনি তাঁকে দেখতে পারেন কিন্তু মিনিট খানেকের বেশি নয়।
ডাক্তার দরজাটা খুলে ধরলেন।
ছোট্ট একটা ঘর। জানালার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া আলো বিছানাটার ওপর লম্বা লম্বা ডোরার মত ছায়া ফেলেছে। বন্ড টলতে টলতে বিছানা পর্যন্ত এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তার পাশে। বালিশের ওপর ছোট মাথাটা তার দিকে ফিরল। একটা হাত বেরিয়ে তার চুল মুঠো করে ধরে কাছে টেনে আনার চেষ্টা করল। ভাঙা ভাঙা গলায় মেয়েটি বলল, তুমি এখানেই থাকবে। তুমি আমার কাছ ছেড়ে কোথাও যাবে না!
কিন্তু কোন জবাব এল না। মেয়েটি বুঝতে পারল বন্ডের দেহটা ক্রমশঃ পড়ে যাচ্ছে। চুল ছেড়ে দিতেই ধুপ করে বিছানার পাশে কার্পেটের ওপর পড়ে গেল। পরমুহূর্তেই বন্ড ঘুমিয়ে পড়ল নিজের বাহুর ওপর মাথা রেখে।
মেয়েটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেই মুখটার দিকে। তারপর নিজের বালিশটাকে টেনে আনল বিছানার ধারে, ঘুমন্ত মানুষটার ঠিক ওপরে, মাথা রাখল তার ওপর, যাতে যখন ইচ্ছে চোখ খুললেই বন্ডকে দেখতে পায়। তারপর চোখ বন্ধ করল।