ত্রিমূর্তি (চাচা-কাহিনী)

ত্রিমূর্তি (চাচা-কাহিনী)

বার্লিন শহরের উলান্ড স্ট্রিটের উপর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দুস্থান হৌস’ নামে একটি রেস্তোরাঁ জন্ম নেয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির যা স্বভাব, রেস্তোরাঁর সুদূরতম কোণে একটি আড্ডা বসে যায়। আড্ডার চক্রবর্তী ছিলেন চাচা বরিশালের খাজা বাঙাল মুসলমান আর চেলারা গোসাই, মুখুয্যে, সরকার, রায় এবং চ্যাংড়া গোলাম মৌলা, এই ক জন।

চাচার ন্যাওটা শিষ্য গোসাঁই বললেন, ‘যা বল, যা কও, চাচা না থাকলে আমাদের আড্ডাটা কীরকম যেন দড়কচ্চা মেরে যায়। তা বলুন, চাচা, দেশের– না, দ্যাশের– খবর কী? কী খেলেন, কী দেখলেন, বেবাক কথা খুলে কন।’

চাচা বরিশাল গিয়েছিলেন। তিন মাস পরে ফিরে এসেছেন। বললেন, ‘কী খেলুম? কই মাছ এক-একটা ইলিশ মাছের সাইজ; ইলিশ মাছ– এক-একটি তিমি মাছের সাইজ; আর তিমি মাছ– তা সে দেখিনি। তবে বোধহয়, তাবৎ বাকরগঞ্জ ডিসৃটিক্টাই তারই একটার পিঠের উপর ভাসছে। ওই যেরকম সিন্দবাদ তিমির পিঠটাকে চর ভেবে তারই পিঠের উপর রশুই চড়িয়েছিল।’

বাকি কথা শেষ হওয়ার পূর্বে সক্কলের দৃষ্টি চলে গেল দোরের দিকে। দুটি জর্মন চ্যাংড়া একটি চিংড়িকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকল। ভারতীয় রান্নার ঝালের দাপটে জর্মনরা সচরাচর হিন্দুস্থান হৌসে আসত না। পাড়ার জর্মনরা তো আমাদের লঙ্কা-ফোড়ন চড়লে পয়লা বিশ্বযুদ্ধের ডিসপোজেলের গ্যাস-মাস্ক পরত। তবে দু একজন যে একেবারেই আসত না তা নয়—‘ইন্ডিশে রাইস-কুরি’ অর্থাৎ ভারতীয় ঝোল-ভাতের খুশবাই জর্মনি-হাঙ্গেরি সর্বত্রই কিছু কিছু পাওয়া যায়।

আলতোভাবে ওদের ওপর একটা নজর বুলিয়ে নিয়ে আড্ডা পুনরায় চাচার দিকে তাকাল। চাচা বললেন, ‘খাইছে! আবার সেই ইটারনেল ট্রায়েঙ্গল!’

পাইকিরি বিয়ার খেকো সূয্যি রায় বলল, ‘চাচা হরবকতই ট্রায়েঙ্গল দেখেন। এ যেন ঘামের ফোঁটাতে কুমির দেখা। দ্য ত্রো নিয়ে কি কেউ কখনও বেরোয় না?’

রায়ের গ্রামসম্পর্কে ভাগ্নে, সতেরো বছরের চ্যাংড়া সদস্য লাজুক গোলাম মৌলা শুধাল, ‘মামু, দ্য ত্রো কারে কয়?’

রায় বললেন, ‘পই পই করে বলেছি ফরাসি শিখতে, তা শিখবি নি। ডি, ই দ্য; টি, আর, ও, পি জো-পি সাইলেন্ট। অর্থাৎ একজন অনাবশ্যক বেশি–One too many। এই মনে কর, তুই যদি তোর ফিয়াসেকে– একথাটাও বোঝাতে হবে নাকি?– নিয়ে বেরোস আর আমি খোদার-খামোখা তোদের সঙ্গে জুটে যাই, তবে আমি দ্য ত্রো। বুঝলি?’

গোলাম মৌলা মাথা নিচু করে সেই বার্লিনের শীতের বরাব্বর লজ্জায় ঘামতে লাগল।

আড্ডায় লটবর লেডি-কিলার পুলিন সরকার মৌলাকে ধমক দিয়ে বলল, তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন রে বুড়ব? লজ্জা পাবেন রায়, ডাণ্ডা-গুলি খেলার সময় গুলিকে ভয় দেখা নি ডাণ্ডাকে না ছোঁবার জন্য? তখন কী বলিস? ‘ভাগ্নে বউ দুয়ারে– কোনও কেটে ফালদি যা।’ বরঞ্চ সূয্যি রায় যদি তাঁর ম্যাডামকে নিয়ে বেরোন, আর তুই যদি সঙ্গে জুটে যাস, তবু কিন্তু তুই দ্য ত্রো নস্। রাধা কেষ্ট’র কী হন জানিস তো?’

গোলাম মৌলা এবারে লজ্জায় জল না হয়ে একেবারে পানি।

গোঁসাই বললেন, ‘চাচা, আপনি কিন্তু যেভাবে ঘন ঘন মাথা দোলাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে, আপনি একদম শোয়ার, এ হচ্ছে দুটো-হুঁলো-একটা-মেনীর ব্যাপার। তা কি কখনও হওয়া যায়?’

চাচা বললেন, ‘যায়, যায়, যায়। আকছারই যায়, অবশ্য প্র্যাকটিস্ থাকলে।’

 আজ্ঞা সমস্বরে বলল, ‘প্র্যাকটিস!’

 চাচা বললেন, ‘হ। এবারে দেশে যাবার সময় জাহাজে হয়েছে।’

 গল্পের গন্ধ পেয়ে আড্ডা আসন জমিয়ে বলল, ‘ছাড়ুন চাচা।’

চাচা বললেন, ‘এবার দেখি, জাহাজভর্তি ইহুদির পাল। জর্মনি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া থেকে ঝেঁটাই করে সবাই যাচ্ছে সাংহাই। সেখানে যেতে নাকি ভিসার প্রয়োজন হয় না। কী করে টের পেয়েছে, এবারে হিটলার দাবড়াতে আরম্ভ করলে নেবুকাডনাজারের বেবিলোনিয়ান ক্যাপটিভিটি নয়, এবারে স্রেফ কচুকাটার পালা। তাই সাংহাই হয়ে গেছে ওদের ল্যান্ড অব মিল্ক অ্যান্ড হানি, ননীমধুর দেশ।

আমার ডেক-চেয়ারটা ছিল নিচের তলা থেকে ওঠার সিঁড়ির মুখের কাছে। ডাইনে এক বুড়ো ইহুদি আর বাঁয়ে এক ফরাসি উকিল। ইহুদি ভিয়েনার লোক, মাতৃভাষা জর্মন, ফরাসি জানে না। আর ফরাসি উকিল জর্মন জানে না সে তো জানা কথা। ফরাসি ভাষা ছাড়া পৃথিবীতে যে অন্য ভাষা চালু আছে সে তত্ত্ব জাহাজে উঠে সে এই প্রথম আবিষ্কার করল। এতদিন তার বিশ্বাস ছিল, পৃথিবীর আর সর্বত্র ভাঙা-ভাঙা ফরাসি, পিজিন ফেঞ্চই চলে– বিদেশিরা প্যারিসে এলে যেরকম টুকিটাকি ফরাসি বলে ওইরকম আর কি।

তিনজনাতে তিনখানা বই পড়ার ভান করে এক-একবার সিঁড়ি দিয়ে উঠনে-ওলা নামনে-ওলা চিড়িয়াগুলোর দিকে তাকাই, তার পর বইয়ের দিকে নজর ফিরিয়ে আপন আপন সুচিন্তিত মন্তব্য প্রকাশ করি।

একটি মধ্যবয়স্কা উঠলেন। জর্মন ইহুদি বলল, ‘হালব-উনট-হালব’–অর্থাৎ ‘হাফাহাফি’। ফরাসি বলল, “অ’ প্যো আঁসিয়েন’–‘একটুখানি এনশেন্ট’। জর্মন আমাকে শুধাল, ‘ফ্রেঞ্চি, কী বলল?’ আমি অনুবাদ করলুম। জর্মন বলল, ‘চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। তা আর এমন কী বয়স- নিষট ভার–নয় কি?’ ফরাসি আমাকে শুধাল, ‘ক্যাস কিল দি—‘কী বলল ও?’’ উত্তর শুনে বলল, ‘মঁ দিয়ো– ইয়াল্লা– চল্লিশ আবার বয়স নয়! একটা কেথিড্রেলের পক্ষে অবশ্য নয়। কিন্তু মেয়েছেলে, ছোঃ!’

এমন সময় হঠাৎ একসঙ্গে তিনজনার তিনখানা বই ঠাস করে আপন আপন উরুতে পড়ে গেল। কোর্ট মার্শালের সময় যেরকম দশটা বন্দুক এক ঝটকায় গুলি ছোড়ে। কী ব্যাপার? দ্যাখ তো না দ্যাখ, সিঁড়ি দিয়ে উঠল এক তরুণী।

সে কী চেহারা! এরকম রমণী দেখেই ভারতচন্দ্রের মুণ্ডুটি ঘুরে যায় আর মানুষে-দেবতাতে ঘুলিয়ে ফেলে বলেছিলেন, ‘এ তো মেয়ে মেয়ে নয়, দেবতা নিশ্চয়।’

ইটালির গোলাপি মার্বেল দিয়ে কোঁদা মুখখানি, যেন কাজল দিয়ে আঁকা দুটি ভুরুর জোড়া পাখিটি গোলাপি আকাশে ডানা মেলেছে, চোখ দুটি সমুদ্রের ফেনার উপর বসানো দুটি উজ্জ্বল নীলমণি, নাকটি যেন নন্দলালের আঁকা সতী অপর্ণার আবক্ররেখা মুখের সৌন্দর্যকে দু ভাগে করে দিয়েছে, ঠোঁট দুটিতে লেগেছে গোলাপফুলের পাপড়িতে যেন প্রথম বসন্তের মৃদু পবনের ক্ষীণ শিহরণ।

চাচা বললেন, ‘তা সে যাক গে! আমার বয়েস হয়েছে। তোমাদের সামনে সব কথা। বলতে বাধো বাধো ঠেকে। কিন্তু সত্যি বলতে কী! অপূর্ব, অপূর্ব।’

দেখেই বোঝা যায়, ইহুদি প্রাচ্য-প্রতীচ্য উভয় সৌন্দর্যের অদ্ভুত সম্মেলন।

জর্মন এবং ফরাসি দু জনেই চুপ! আমো।

আর সঙ্গে সঙ্গে দুটি ছোকরা জাহাজের দু প্রান্ত থেকে চুম্বকে টানা লোহার মতো তার গায়ের দু দিকে যেন সেঁটে গেল। স্পষ্ট বোঝা গেল, এতক্ষণ ধরে দু জনাই তার পদধ্বনির প্রতীক্ষায় ছিল।

জাহাজে প্রথম দু একদিন ঠিক আঁচা যায় না, শেষ পর্যন্ত কার সঙ্গে কার পাকাপাকি দোস্তি হবে। কোন্ মঁসিয়ে কোন মাদৃমোয়াজেলের পাল্লায় পড়বেন, কোন হার কোন ফ্রাউ বা ফ্রলাইনের প্রেমে হাবুডুবু খাবেন, কোন মিসিস কোন মিস্টারের সঙ্গে রাত তেরোটা অবধি খোলা ডেকে গোপন প্রেমালাপ করবেন। এ তিনটির বেলা কিন্তু সবাই বুঝে গেল এটা ইটার্নেল ট্রায়েঙ্গল। আমি অবশ্য গোসাঁইয়ের মতো প্রথমটায় ভাবলুম, হার্মলেস ব্যাপারও হতে পারে।

মেয়েটা ফরাসিস, ছেলে দুটোর একটা মারাঠা, আরেকটা গুজরাতি বেনে! প্যারিস থেকেই নাকি রঙ্গরস আরম্ভ হয়েছে। বোম্বাই অবধি গড়াবে। উপস্থিত কিন্তু আমাদের তিনজনারই মনে প্রশ্ন জাগল, আখেরে জিতবে কে?

শুনেছি এহেন অবস্থায় দু জনাই স্পানিয়ার্ড হলে ডুয়েল লড়ে, ইতালীয় হলে একজন আত্মহত্যা করে, ইংরেজ হলে নাকি একে অন্যকে গম্ভীরভাবে স্টিফ বাও করে দু দিকে চলে যায়, ফরাসি হলে নাকি ভাগাভাগি করে নেয়।

প্রথম ধাক্কাতেই গুজরাতি, গেলেন হেরে। মারাঠা চালাকি করে ডবল পয়সা খর্চা করে দু খানি ডেক-চেয়ার ভাড়া করে রেখেছিল পাশাপাশি। বেনের মাথায় এ বুদ্ধিটা খেলল না কেন আমরা বুঝে উঠতে পারলুম না। মারাঠা নটবর সেই হুরীকে নিয়ে গেল জোড়া ডেক-চেয়ারের দিকে স্যর ওয়ালটার র‍্যালে যেরকম রমণী ইলিজাবেথকে কাদার উপর। আপন জোব্বা ফেলে দিয়ে হাত ধরে ওপারের পেভমেন্টে নিয়ে গিয়েছিলেন।

দু জনা লম্বা হলেন দুই ডেক-চেয়ারে। বেনেটা ক্যাবলাকান্তের মতো সামনে দাঁড়িয়ে খানিকটা কাঁই-কুঁই করে কেটে পড়ল।

আমার পাশের ফরাসি বলল ‘ইডিয়ট!’ জর্মন শুনে বলল, ‘নাইন, আখেরে জিতবে বেনে।’ ‘অ্যাঁপসিবল!’ ‘বেট?’ ‘বেট’ ‘পাঁচ শিলিঙ? ‘পাঁচ শিলিঙ’!

আড্ডার দিকে ভালো করে একবার তাকিয়ে নিয়ে চাচা বললেন, ‘বিশ্বাস কর আর না-ই কর, আস্তে আস্তে জাহাজের সবাই লেগে গেল এই বাজি ধরাধরিতে! বুকিরও অভাব হল না। আর সে বেট কী অদ্ভুত ফ্লাকচুয়েট করে। কোনওদিন ভোরে এসে দেখি জর্মনটা গুম্ হয়ে বসে আছে– যেন জাহাজ একটা কনসানস্ট্রেশন ক্যাম্প আর ফরাসিটা উল্লাসে ক্রিং ব্রিং করে পলকা নাচ নাচছে। ব্যাপার কী? পাক্কা খবর মিলেছে, আমাদের পরীটি কাল রাত দুটো অবধি মারাঠার সঙ্গে গুজুর-গুজুর করেছেন। বেনে মনের খেদে এগারোটাতেই কেবিন নেয়। ফরাসি এখন সক্কলের গায়ে পড়ে থ্রি টু ওয়ান অফার করছে। সে জিতলে পাবে কুল্লে এক শিলিং, হারলে দেবে তিন শিলিং। নাও, বোঝ ঠ্যালা! আর কোনওদিন বা খবর রটে, বেনের পো জাহাজের ক্যাম্বিসের চৌবাচ্চায় হুরীর সঙ্গে দু ঘণ্টা সাঁতার কেটেছে মারাঠা জলকে ভীষণ ডরায়। ব্যস, সেদিন বেনের স্টক স্কাই হাই!

ইতোমধ্যে একদিন বেনের বাজার যখন বড্ড ঢিলে যাচ্ছে তখন ঘটল এক নবীন কাণ্ড। হুরী ও মারাঠা তো বসত পাশাপাশি কিন্তু লাইনের সর্বশেষ নয় বলে হুরীর অন্য পাশে বসত এক অতিশয় গোবেচারি ভালো মানুষ নিগ্রো পাদ্রি। সে গিয়ে তার ডেক-চেয়ারের সঙ্গে বেনের ডেক-চেয়ারের বদলাবদলির প্রস্তাব করেছে। বেনে নাকি উল্লাসে ইয়াল্লা বলে আকাশ-ছোঁয়া লম্ফ মেরেছিল। বেটিঙের বাজার আবার স্টেডি হয়ে গেল।

ইতোমধ্যে প্রশ্ন উঠল, এ বেটিঙের শেষ ফৈসালা হবে কী প্রকারে? বহু বাক-বিতণ্ডার পর স্থির হল, যেদিন হুরী মারাঠা কিংবা বেনের সঙ্গে তার কেবিনে ঢুকবেন সেদিন হবে শেষ কৈলা। যার সঙ্গে ঢুকবেন তার হবে জিত।

দু একজন রুচিবাগীশ আপত্তি করেছিলেন কিন্তু ফরাসি উকিল হাত-পাত চোখ-মুখ নেড়ে বুঝিয়ে দিল, ‘C’est, c’est–, এটা, এটা হচ্ছে একটা লিগাল ডিসিশন, একটা আইনগত ন্যায্য হক্কের ফৈসালা। ঢলাঢলির কোনও কথাই হচ্ছে না।

রেসের বাজি তখন চরমে। কখনও বেনে, কখনও মারাঠা। সেই যে চতুখোর গল্প বলেছিল, পাখিকে গুলি মেরে সঙ্গে সঙ্গে শিকারি কুকুরকেও দিয়েছে লেলিয়ে। তখন বুলেটে কুকুরে কী রেস– ভি কুত্তা, কভি গুলি, কভি গুলি, কভি কুত্তা।

এমন সময় আদন বন্দর পেরিয়ে আমরা ঢুকলাম আরব সাগরে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আঠারো হাজার টনের জাহাজকে মারলে মৌসুমি হাওয়া তার বাইশ হাজারি টনের থাবড়া। জাহাজ উঠল নাগর-বেনাগর সবাইকে নিয়ে নাগরদোলায়। আর সঙ্গে সঙ্গে কী সি-সিকনেস! বমি আর বমি! প্রথম ধাক্কাতেই মারাঠা হল ঘায়েল। রেলিঙ ধরে পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি বের করার চেষ্টা দিয়ে টলতে টলতে চলে গেল কেবিনে। বেনের মুখে শুকনো হাসি, কিন্তু তিনিও আরাম বোধ করছেন না। পরদিন সমুদ্র ধরল রুদ্রতর মূর্তি। এবারে হুরী পড়ে রইলেন একা। তাঁর মুখও হরতালের মতো হলদে। তার পরের দিন ডেক প্রায় সাফ। নিতান্ত বরিশালের পানি-জলের প্রাণী বলে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কোনওগতিকে আমি টিকে আছি আর কি! খাবার সময় পেটে যা যায় সেসব রিটার্ন টিকিট নিয়ে মোকামে পৌঁছবার আগেই ফিরি-ফিরি করছে। হুরী নিতান্ত একা বলে ফরাসি বন্ধু তাকে আদর করে ডেকে এনে আমাদের পাশে বসাল।

সে রাত্রে জাহাজ থেলো ঝড়ের মোক্ষমতম থাবড়া। ফরাসি গায়েব। হুরী এই প্রথম ছুটে গিয়ে ধরল রেলিঙ। আমিও এই যাই কি তেই যাই। তবু ধরলুম গিয়ে তাকে। হুরী ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ‘কেবিন’। আমি ধরে ধরে কোনওগতিকে তাকে তার কেবিনের দিকে নিয়ে চললুম। দু জনাই টলটলায়মান। আমার কেবিনের সামনে পৌঁছতেই ঝড়ের আরেক ধাক্কায় খুলে গেল আমার কেবিনের দরজা। ছিটকে পড়লুম দু জনাই ভিতরে। কী আর করি? তাকে তুলে ধরে প্রথম বিছানায় শোয়ালুম। তার পর কেবিন-বয়কে ডেকে দু জনাতে মিলে তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেলুম তার কেবিনে। বাপস!

চাচা থামলেন। একদম থেমে গেলেন।

আড্ডার সবাই একবাক্যে শুধাল, ‘তার পর?’

 চাচা বললেন, ‘কচু, তার পর আর কী?’

 তবু সবাই শুধায়, ‘তার পর?’

চাচা বললেন, ‘এ তো বড় গেরো। তোরা কি ক্লাইমেকস বুঝিসনে? আচ্ছা, বলছি। ভোর হতেই বোম্বাই পৌঁছলুম। ডেকে যাওয়া মাত্রই সবাই আমাকে জাবড়ে ধরে কেউ বলে ফেলিসিতাসিয়ো মসিয়ো, কেউ বলে কনগ্রাচুলেশনস, কেউ বলে গ্রাতুলিয়েরে দুচ্ছাই, এসব কী? কিন্তু কেউ কিচ্ছুটি বুঝিয়ে বলে না।’

শেষটায় ফরাসি উকিলটা বলল, “আ মসিয়ো, কী কেরানিটাই না দেখালে। ওস্তাদের মার শেষ রাতে। মহারাষ্ট্র-গুজরাত দু জনাই হার মানল। জিতল বেঙ্গল। ভিতল্য বাঁগাল! লং লিভ বেঙ্গল!”

আমি যতই আপত্তি করি কেউ কোনও কথা শোনে না।

আর শুধু কি তাই? ব্যাটারা সবাই আপন আপন বাজির টাকা ফেরত পেল- বেনে কিংবা মারাঠা কেউ জেতেনি বলে। কিন্তু আমার দশ শিলিং স্রেফ, বেপরোয়া, মেরে দিল। বলে কি না, আমি যখন ঘোড়ায় চড়ে জিতেছি, আমার বাজি ধরার হক্ক নেই। টাকাটা নাকি তছরূপ হয়ে যায়।’

খানিকক্ষণ চুপ থেকে চাচা বললেন, ‘কিন্তু সেই থেকে আমার চোখ বলে দিতে পারে ইটার্নেল ট্রায়েঙ্গেল কোথায়।’

এমন সময় সেই দুই জর্মন ছোকরায় লেগে গেল মারামারি। সেটা থামাতে গিয়ে আড্ডা সেদিন ভঙ্গ হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *