ত্রিপুরা
বায়নগর
কালের খেলনার মতো আমার সেই ছোট্ট গ্রামটির কথা আজ মনে পড়ে। মনে পড়ে কাঞ্চনফুল আর সোনালতায় মাটির পৃথিবীর সে অপরূপ হাসি– সোনালু গাছের ফলে (আঞ্চলিক ভাষায় বানরের লাঠি) ঘুঙুরের বোলের মতো মিঠে আওয়াজ আজও যেন স্পষ্ট শুনতে পাই। শ্রাবণের থমথমে আকাশের দিগন্তে মেঘের তম্বুরা যেন কোন খেয়ালি দেবতার বিদ্যুৎ-আঙুলের ছোঁয়ায় গুরু গুরু মন্ত্রে কাঁপছে–টিনের চালায় চালায় বৃষ্টির নূপুর বাজছে ঝমঝম করে; ধ্বনিবর্ণময় বর্ষার সে কী অপরূপ ঘনঘটা! আবছা আলো-আঁধারে চূর্ণবৃষ্টির ধূসর চাদর মুড়ি দিয়ে বিশ্বচরাচর যেন মনের কাছে আসত ঘন হয়ে। মনে পড়ে ক্ষান্তবর্ষণ শ্যামলী মৃত্তিকার বর্ণাঢ্য রূপশৃঙ্গার : কচি পাতার ফাঁকে-ফাঁকে সোনালি রোদের খিলখিল হাসি, বৃষ্টি-ধোয়া কনক চাঁপার উজ্জ্বল হরিৎ আভা। দুপুরের তীক্ষ্ণ রোদে উদার উন্মুক্ত আকাশ যেন গুণীর কণ্ঠের গভীর-গম্ভীর কোনো উদাত্ত রাগিণীর মতো দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত টানা। বৈরাগীর একতারার মতো মেঠো পথ চলে গিয়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তে ব্যাকুল বাউল-উতলা বাতাসে ফসলের গান; তৃণশীর্ষে সূর্যের গুঞ্জন।
আরতির ধূপছায়ার মধ্য দিয়ে দেখা ঝাপসা দেবী প্রতিমার মতো আজও চোখে ভাসছে আমার সেই ছোট্ট গ্রামটি–তার মধ্যে দেখেছি রূপকথার খুঁটেকুড়নি মায়ের নির্বাক বেদনার প্রতিমূর্তি। কালের একতারায় তাঁর অশ্রুর অশ্রুত রাগিণী যেন ডানা-ভাঙা পাখির মতো আজ কেঁদে কেঁদে ফিরছে।
গ্রামের নাম বায়নগর। ত্রিপুরা জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম। শোনা যায়, আসলে এর নাম ছিল নাকি ‘রায়নগর’। এ গাঁয়ের জমিদার ছিলেন রায়েরা। রায়বংশের শেষপুরুষ অঘোর রায়ের প্রতাপ ছিল দোর্দন্ড। পাকা সবরি কলার মত গায়ের রং, উন্নত ঋজু নাসা আর ভোজালির মতো একজোড়া তীক্ষ্ণ গোঁফ ছিল রায়ের। অঘোর রায় যেমন ছিলেন বাঘের মতো ভয়ানক তেমন তাঁর রাগও ছিল প্রচন্ড। আকস্মিক উত্তেজনার বশে একদিন তিনি এমন একটি কান্ড করে বসেন যার ফলে তাঁকে শেষপর্যন্ত এ গ্রাম ছেড়ে যেতে হয়।
ঘটনাটি সম্পর্কে জনশ্রুতি এরকম। বাড়ির লাগোয়া একফালি জমিতে তিনি নানা দূরদেশ থেকে প্রচুর অর্থব্যয় করে নানারকম বাহারি ফুলের চারা এনে লাগিয়েছিলেন। ফুল আর ফুলকপির চাষে ছিল তাঁর সমান আগ্রহ, সমান অধ্যবসায়। একদিন ভিন গাঁয়ের এক জমিদারনন্দনের সদ্য ক্রীত টাট্ট ঘোড়াটি মালির সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে বাগানে ঢুকে পড়ে। খবর শুনেই তো অঘোর রায়ের ব্রহ্মরন্ধ্রে বারুদ জ্বলে উঠল–দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দুর্গাপুজোর সময় যে খঙ্গ দিয়ে মহিষ বলি দেওয়া হত তাই নিয়ে ঝড়ের মতো ছুটলেন তিনি বাগানের দিকে। পেছনে পেছন ছুটল তাঁর স্ত্রী, পাইক, বরকন্দাজ আর সব। খঙ্গের শানিত চোখ দুটি রক্তের তৃষ্ণায় ধকধক করে জ্বলছে, আর জ্বলছে অঘোর রায়ের ভাঁটার মতো দুটি চোখ। বাগানে ঢুকেই তিনি একলাফে গিয়ে ঘোড়াটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অশ্বদেহ দ্বিখন্ডিত করে সেই প্রচন্ড খড়ের কিয়দংশ মাটিতে ঢুকে গেল। রাজগন্ধার উজ্জ্বল লাল রক্তের ছোপ–সবুজ ফুল শাখায় বীভৎস ক্ষতের মতো রক্তের চাপ–অন্তঃপুরিকাদের অস্ফুট আর্তনাদ আর পাইক বরকন্দাজের শোরগোল সে এক বিকট দৃশ্য। কাঁপতে কাঁপতে অঘোর রায় হলেন ধরাশায়ী। তার পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। জমিদারে জমিদারে এ নিয়ে শুরু হলে প্রচন্ড বৈরিতা। মামলা-মোকদ্দমা আর ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে বিপর্যস্ত হয়ে অঘোর রায় হলেন দেশত্যাগী। তারপর কালক্রমে রায়নগর রূপান্তরিত হল বায়নঘরে।
গ্রামটি মুসলমানপ্রধান–দু-দিকে মালীগাঁ আর থৈরকোলাতে হিন্দু প্রায় একজনও নেই। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে জীবনযাত্রার আদান-প্রদানের তাগিদে এমন একটি সহজ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল যে, কেউ কাউকে পর মনে করত না। গ্রামসুবাদে বয়ঃকনিষ্ঠরা পরস্পর পরস্পরকে দাদা, পুতি (কাকা), ঠাকুরভাই প্রভৃতি বলে ডাকত। এর আসল কারণটা প্রধানত অর্থনৈতিক। জীবিকার ক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠ ছিল যে, জীবনেও তার প্রভাব আসতে বাধ্য। গ্রামের হিন্দুদের মধ্যে যারা কৃতী পুরুষ তাঁরা প্রায় সবাই থাকতেন বিদেশে। এঁদের জোতজমি চাষবাসের ভার ছিল মুসলমান প্রধানিয়াদের হাতে। তাঁরা হাল-লাঙল দিয়ে জমি চষতেন, ফসল তুলতেন। যাঁরা বাড়িতে থাকতেন তাঁদের অর্ধেক ফসল দিয়ে দিতেন। এমনও হয়েছে যে, জমির মালিক হয়তো চিঠি লিখেছেন–তাঁর প্রাপ্য ফসলের মূল্য মনিঅর্ডার করে পাঠাতে। মুসলমান বর্গাদার প্রধানিয়ারা কড়াক্রান্তি হিসেব করে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন–কোথাও একবিন্দু ফাঁকি বা কারচুপি ছিল না। যেন মনে হত অলক্ষ্যে কোনো অদৃশ্য চক্ষু তাঁদের কারবার সব দেখছে–এমনি ধর্মভীরু আর নিরীহ ছিলেন তাঁরা। একটা নিশ্চিত বিশ্বাসের শক্ত জমিতে ছিল তাঁদের জীবনের ভিত, সদাসন্তুষ্ট কঠোর পরিশ্রমী আর নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দেখেছি হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে কী অমায়িক আর প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করতে। আমার কাকা ছিলেন ডাক্তার। বাড়িতেই প্র্যাকটিস করতেন। সন্ধ্যাবেলায় তাঁর বৈঠকখানায় এসে জুটতেন একে একে হাজি বাড়ির বড়ো হাজি, উত্তরপাড়ার আকবর আলি, পাঞ্জৎ আলি, মুনশি গ্রামের প্রধানিয়ারা। গাছপিঁড়িতে বসে যেতেন এঁরা–মাটির মালসাতে (দেশে বলে ‘আইল্যা’) তুষের আগুন জিইয়ে রাখা হত টিকে ধরাবার জন্যে। গভীর রাত্রি পর্যন্ত চলত বৈঠক, আর চলত ছিলিমের পর ছিলিম তামাক। যুদ্ধের সময়টা এখানে ভিড় হত বেশি। সবাই যেন শুনতে চায় আশার বাণী, আশ্বাসের বাণী- সবাই যেন প্রাণপণে বিশ্বাস করতে চায় এ দুর্দিনের অন্ত আছে। ডাক্তার কাকার কাছে তাই অনেকে ছুটে আসত, তাঁর কাছ থেকে সমর্থনের বাণী শুনবার জন্যে। কেউ খেতে পাচ্ছে না–রোগে ওষুধ নেই, পথ্য নেই, ডাক্তারকাকা তাঁকে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বলিষ্ঠদেহ মুসলমান চাষিদের দেহে বুভুক্ষা আর অনাহারের ছাপ ব্যাণ্ডেজ খোলা পোড়া ঘায়ের মতো মুখে শুকনো হাসি–যেমন করুণ তেমনি বীভৎস। রাজনৈতিক আধি আর ঝোড়ো হাওয়ার অন্তরালে একটি সহজ সরল জীবনের সমতল ভূমিতে সবাই হাতে হাত মিলিয়ে চলত এখানে। আমাদের বাড়ির কিছুদূরেই ছিল হাজিবাড়ি। এ বংশের কোন পুরুষ কবে একবার মক্কা গিয়ে ‘হজ’ করে এসেছিলেন, তাই থেকে এরা সবাই হাজি’। বড়ো হাজির কথা আজ মনে পড়ে। মেহেদি রঙের দাড়ি আর চোখদুটিতে ছিল একটা সরল বিশ্বাসের ছাপ, চোখ এমন করে হাসতে জানে–একথা এর আগে আমার জানা ছিল না। শেষরাত্রে তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের ‘আজান আমাদের পাতলা ঘুমের আস্তরণ ভেদ করে কানে এসে বাজত। আমাদের ভালো কোনো খবর পেলে এই মুসলমান বৃদ্ধটি সত্যি সত্যি খুশি হতেন–প্রাণখোলা হাসির ছটায় মেহেদি রঙের দাড়িতে একটা আলোর ঝিলিক ঠিকরে পড়ত যেন।
টুকরো-টুকরো কত ছবি আজ মনে পড়ে! মনে পড়ে স্বরূপদাস সাধুর কথা। একটা জীর্ণ আলখাল্লা গায়ে-হাতে খঞ্জনি আর কাঁধে শতচ্ছিন্ন ভিক্ষার ঝুলি। কিন্তু মুখে নিশ্চিত প্রত্যয়ের কী অপূর্ব প্রশান্তি এক পা ঊর্ধ্বে খঞ্জনি বাজিয়ে সে গাইত, ।
এতদিন পরে ঘরে এলি রে রামধন,
মা বলে ডাকে না ভরত,
মুখ দেখে না শত্রুঘন-ন-ন।
তখন অনুতপ্তা কৈকেয়ীর মর্মজ্বালা যেন যুগযুগান্ত পেরিয়ে আমাদের মনের ভেতর ছুঁয়ে যেত। বাড়ির সবাই এসে জড়ো হয়েছে উঠোনে, স্বরূপদাস খঞ্জনি বাজিয়ে নেচে-নেচে গান গাইছে। বাড়ির কুকুরটা পর্যন্ত অবাক হয়ে দেখছে–মাঝে-মাঝে কান খাড়া করে বোধহয় গানও শুনছে। সকলে ফরমাশ করে যাচ্ছেন–স্বরূপদাস অক্লান্তভাবে গান গেয়ে চলেছে কখনো-বা দেহতত্ত্ব, কখনো-বা শ্যামাসংগীত, কখনো-বা কৃষ্ণ-রাধিকার বিরহ-মিলন-কথা। যাওয়ার সময় কয়েক মুঠো চাল, কারও দেওয়া কিছুটা ডাল এবং আনাজ ঝুলিতে পুরে গুনগুন করে চলে যেত স্বরূপদাস।
আমাদের গ্রামে সংকীর্তনের রেওয়াজ ছিল খুব বেশি। প্রতিসন্ধ্যাতেই কীর্তন হত। রমণী পালের হাত ছিল মৃদঙ্গের বোল ফোঁটাতে ওস্তাদ। সরু লিকলিকে চোহারা–চুলগুলি বড়ো বড়ো। কীর্তনের সময় মৃদঙ্গটি কাঁধে ঝুলিয়ে সে যেভাবে লাফাতে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাতে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। বড়ো-বড়ো চুলগুলি একবার এপাশে আর একবার ওপাশে কাত হয়ে পড়ছে, এক একবার এক-একটি প্রচন্ড লাফ দিয়ে সে যাচ্ছে ডান দিক। থেকে বাঁ-দিকে আর মৃদঙ্গের বোলে আওয়াজ উঠছে যেন গম্ভীর ওঙ্কারধ্বনির মতো। একবার জ্বরগায়ে অষ্টপ্রহর সংকীর্তনে মৃদঙ্গ বাজাতে গিয়ে রমণী পাল মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল অস্নাত, অভুক্ত অবস্থায়। কিন্তু তবু সে মৃদঙ্গ ছাড়েনি। কিন্তু আজ–আজ সে রমণী পালের। কাঁধে আর মৃদঙ্গ নেই-শান-বাঁধানো শহর কলকাতার পথে-পথে সে আজ ফিরি করে ফিরছে।
এক সময় আমাদের গ্রামে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালাকীর্তনের ঢেউ আসে। প্রথম পালাকীর্তনের অনুষ্ঠান হয় আমাদের বাড়িতে। উত্তরপাড়ার বংশী, খগেশ, নীরু, আবু–এসব ছেলেরা এতে অংশগ্রহণ করে। বলা বাহুল্য, সেদিন উত্তেজনা ছিল প্রচুর–আয়োজন ছিল না। সাজপোশাকের কোনো বালাই ছিল না। খগেশ নিমাই সন্ন্যাসের পালায় শ্রীরাধার ভূমিকায় অভিনয় করে। শুক-শারি এসে গাইছে,
ওঠ-ওঠ রাইশ
শীভোর হল অমানিশি
ও হরি! শ্রীমতী রাধিকা প্যান্ট পরেই সলজ্জ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে শুক-শারির প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। কিন্তু সমস্ত দর্শকসমাজ এমনি অভিভূত হয়ে ছিল যে, এতে তাদের বিন্দুমাত্র রসবোধের ব্যাঘাত ঘটেনি।
শচীমাতার বিলাপে হিন্দু-মুসলমান সকলের চোখ সজল হয়ে ওঠে। ভোর হতেই পালা শেষ হয়ে বের হল প্রভাতফেরি। কাঁপা-কাঁপা, টানা-টানা সুরে সে কী গান–আমাদের বাড়ির দ্বাররক্ষী ছিল দুটো বড়ো তেঁতুল গাছও তল্লাটে এত প্রকান্ড গাছ আর ছিল না। তার চিকনচিকন পাতার ঝালর ছিঁড়ে সূর্যের আঁকাবাঁকা আলো এসে পড়ছে; আলো আর সুরে কী নেশাই না সেদিন লেগেছিল।
আমাদের গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দক্ষিণে সাঁচার। সেখানকার রথযাত্রা’ আমাদের অঞ্চলে বিখ্যাত। প্রতিবছরই আমাদের বাড়ির নৌকা করে আমরা সবাই রথযাত্রায় যেতাম। সকাল সকাল খেয়ে-দেয়ে আমরা রওনা দিতাম। আশপাশে আরও কত নৌকা–কত দূরদেশ থেকে, কত ভিন গাঁ থেকে এরা আসছে। নৌকার ছইয়ের ওপর কারও কারও দেখছি জ্বালানি কাঠ বাঁধা–অর্থাৎ ২। ৩ দিন আগে থেকেই তারা রওনা দিয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় বাজার বা গঞ্জে নৌকা ভিড়িয়ে তারা আহারপর্ব সমাধা করে।
জগন্নাথদেব দর্শন ও রথের রশি ছোঁয়া নিয়ে ধর্মভীরু যাত্রীদের সে কী উন্মত্ত উন্মাদনা! কারও জামা ছিঁড়ে গেছে, রথের রশির কাদায় সর্বাঙ্গ চিত্রবিচিত্র হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেদিকে কারও লক্ষ নেই–মুখে শুধু ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনি। অদূরে অপেক্ষমান মেয়েরা হুলুধ্বনি দিচ্ছেন, ক্রমাগত শঙ্খ-কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজ, নারীকন্ঠের হুলুধ্বনি জনতার জয়ধ্বনি মিলে মিশে একটি বিরাট শব্দস্তম্ভ রচনা করেছে যেন–চারিদিকে মানুষের কেবল মাথার সমুদ্র তার মধ্য দিয়ে চলেছে জগন্নাথের রথ। বিকেলের সূর্য তার ওপর আবির ছড়িয়ে দিচ্ছে মুঠোমুঠো। সে-দৃশ্য কি কখনো ভুলতে পারি?
রথযাত্রা শেষে যাত্রীদের বাড়ি ফেরার পালা। সন্ধ্যার অন্ধকার এসেছে ঘন হয়ে। নৌকায় নৌকায় সবাই ফিরছে–আর চারিদিকে খোঁজাখুঁজি চলছে যারা এখনও ফেরেনিঃ মাঝি তাদের হাঁক দিচ্ছে সন্ধ্যার শান্ত আবহাওয়ায় কাঁপা কাঁপা ঢেউ তুলে সে-ডাক আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা কেউ সদ্য ক্রীত মেলার বাঁশিতে তুলেছে বিচিত্র বেসুরো আওয়াজ–কেউ ধরেছে গান।
এমনি কত কথা–কত ছবি আজ মনে পড়ে। কত কথা বলব আর কত ছবি আঁকব? বুকের পাঁজর খুলে দিতে কী ব্যথা তা কি কেউ কখনো বলে বোঝাতে পারে? হয়তো এমন দিন আসবে, যেদিন স্বরূপদাসের সেই গান–সেই গান গেয়ে কেউ আমাদের জন্যে এগিয়ে এসে বলবে,
এতদিন পরে ঘরে এলি রে রামধন,
মা বলে ডাকে না ভরত, মুখ দেখে না শত্রুঘন–
সেদিন কতদূরে?
.
চান্দিসকরা
বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে : আমাদের কপালে যা আছে তাই ঘটবে, কিন্তু তুমি এ অবস্থায় কিছুতেই গ্রামে এসো না।
চিঠি পড়ে মনটা কেঁদে উঠল। আমার বাড়ি, আমার গ্রাম, আজ তার দ্বার আমার কাছে রুদ্ধ। যে পথের ধূলি মিশে রয়েছে আমার অস্তিত্বের সঙ্গে, যে গ্রামের জল-কাদা, আলো বাতাস গায়ে মেখে জীবনের পথে এক এক পা করে এগিয়ে এসেছি–আজ সে-গ্রামে ফিরে যাওয়া আমার নিষেধ, সেখানে আমি নিরাপদ নই!
চিঠিখানা চোখের সামনে পড়ে রয়েছে। উর্দু আর ইংরেজিতে লেখা টিকিটের মাঝখানে পাকিস্তানি ‘ন্যায়পরায়ণতার’ তুলাদন্ড আঁকা–তার ওপরে জ্বলজ্বল করছে আমার গ্রামের ডাকঘরের ছাপ। এই ডাকঘরের ওপর কী বিরাট আকর্ষণ ছিল। ডাক আসবার একঘণ্টা আগে গিয়ে ডাকঘরে বসে থাকতাম-কলকাতা থেকে খবরের কাগজ আসবে, বিভিন্ন জায়গা থেকে বন্ধুদের চিঠি আসবে–সারাদিনের একঘেয়েমির ভেতর এটা ছিল মস্তবড়ো সান্ত্বনা। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে রোজ বেলা দশটা-এগারোটার সময় ঝুনঝুন করে ঘণ্টা বাজিয়ে চলে যেত ডাক-হরকরা। ছেলেবেলায় সেই ঘণ্টার প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। যেখানেই থাকতাম, হরকরার ঘণ্টা শুনলেই ছুটে এসে দাঁড়াতাম রাস্তার পাশে। দেখতাম হাঁটুর ওপরে লুঙ্গি পরে, একটা খাকি শার্ট গায়ে দিয়ে ধুলোমাখা খালি পায়ে, ডাকের ঝোলা কাঁধে নিয়ে ছুটে চলেছে হরকরা। কোনো কোনোদিন আমাদেরই পুকুরের শান-বাঁধানো ঘাটের পাশে, বকুল গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ত। ঘাটের একটা সিঁড়িতে ঝোলা রেখে নেমে যেত জলের মধ্যে, মুখ-হাত ধুয়ে মাথায় জল দিয়ে আবার রওনা হত– কাঁধের ঝোলা থেকে শব্দ আসত, ঝুনঝুন, ঝুনঝুন। ভট্টাচার্য বাড়ির কাছ থেকেই ডাকঘরের রাস্তা গেছে বেঁকে–তারপর হরকরাকে আর দেখা যেত না। কিন্তু তার ঘণ্টার অনুরণন তখনও বাজত আমার কানে। আজও তেমনি করেই হয়তো হরকরা ছুটে চলেছে। তার ঘণ্টা বাজিয়ে–এ-চিঠিখানাও সে-ই বহন করে এনেছে। কিন্তু তার সেই ঘণ্টা শোনবার জন্যে আমি আর সেখানে নেই!
সপ্তাহে দু-বার করে আমাদের যে বিরাট হাট বসে তার মালিক আমরা। হাটের খাজনা আদায় করবার ভার পাঁচজন ইজারাদারের ওপর–তারা সকলেই মুসলমান। প্রতি হাটবারে কয়েক সহস্র লোক জড়ো হয় বেচা-কেনার জন্যে। ছেলেবেলায় আমাদের হাটে যাওয়া বারণ ছিল–পাছে হারিয়ে যাই এই ভয়ে। হাটে যাবার একটা বড়ড়া পথ ছিল আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। সে পথের ধারে আমাদের পুকুর আর তার বাঁধানো ঘাট, সেই ঘাটে গিয়ে বসে থাকতুম। কত লোক হাটে যেত সে-পথ দিয়ে কেউ তরকারি নিয়ে, কেউ মনোহারি জিনিস নিয়ে, কেউ হাঁস-মুরগি নিয়ে, কেউ কাঠ-বাঁশ নিয়ে–এমনি কত সব দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওরা যেত। কুমোরপাড়া, তাঁতিপাড়া, কামারপাড়া ইত্যাদি অঞ্চলের শ্রমজীবী লোকেরা যেত তাদের নিজ নিজ জিনিস নিয়ে। বসে বসে আমরা দেখতুম। শেষবেলার দিকে ছুটত জেলেরা। দূর গাঙে ওরা চলে যেত মাছ ধরতে, তাই হাটে যেতে তাদের দেরি হত। মাছের ভারে নুয়ে পড়ত তাদের ইস্পাতের মতো দেহ, ঘামে নেয়ে উঠত প্রতিটি লোমকূপ। দৌড়ে দৌড়ে যেত ওরা–জেলেদের আস্তে হাঁটতে কখনো আমি দেখিনি। হাটের পথে যেতে যেতে কত কথা ওরা কইত–তার ভেতর রাজনীতি ছিল না, অর্থনীতি ছিল না, ঘরের কথা, দৈনন্দিন জীবনের ছোটোখাটো সুখ-দুঃখের কথা, আশা নিরাশার কথা–এ নিয়েই মন তাদের ভরে থাকত।
আগেই বলেছি আমাদের পুকুরের বাঁধানো ঘাটের দু-ধারে মস্তবড়ো দুটো বকুলগাছ। বকুল ফুল পড়ে ঘাটের চাতাল সকাল-সন্ধ্যায় সাদা হয়ে থাকত। তার মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত বাড়ির অন্দরমহল পর্যন্ত। ঘাটের যে সিঁড়িগুলো জল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তাতে বসে গ্রামের ব্রাহ্মণরা আহ্নিক করত দু-বেলা। আর ওপরের বিস্তৃত চাতালে মুসলমানরা পড়ত নামাজ। হাটবারে ঘাটটাকে বিশেষ করে ঝাড় দিয়ে রাখা হত–কারণ সেদিন কয়েকশো লোক আমাদের ঘাটে আসত নামাজ পড়তে। এক সারিতে ৪০। ৫০ জন দাঁড়িয়ে যেত। সারিতে দাঁড়ানো এতগুলো লোকের একই সঙ্গে ওঠা-বসার ভেতর কেমন একটা ছন্দের দোলন ছিল, যা আমার খুব ভালো লাগত। প্রতিদিন এমনি দৃশ্য দেখতে দেখতে তার ছাপ চিরতরে পড়ে গেছে মনের পর্দায়, সারাজীবন গ্রামছাড়া থাকলেও আমি তা ভুলব না। আজও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই হয়নি, আজও তারা একইভাবে আল্লার উপাসনা করছে আমাদের ঘাটে কিন্তু পাশে বসে আহ্নিক করবার মতো কেউ হয়তো আর নেই!
হাটবারে যে দুটো লোককে সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ত তারা হচ্ছে আমিরউদ্দিন আর মাখখু মিয়া। ওরা ছিল আমাদের হাটের ইজারাদার। হাট ভেঙে যাবার পর আমাদের জন্যে চিনেবাদাম, ছোলাভাজা ইত্যাদি খাবার নিয়ে রাত্রিবেলায় ওরা আসত। শীতের সময় পেতাম বড়ো বড়ো কুল। বহু বছর আগে বড়দার সঙ্গে আমিরউদ্দিন এসেছিল কলকাতায়। কলকাতার মতো শহর যে পৃথিবীতে থাকতে পারে এ ছিল ওর কল্পনার বাইরে। শেয়ালদা থেকে পথে নেমে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইল, বুঝতে পারল না সত্যি মাটির পৃথিবী, না রূপকথার স্বপ্নপুরী! কিন্তু তার পরের রাত্রিতেই আমিরউদ্দিন যা কান্ড করলে, তা ভেবে কতদিন আমরা হেসেছি। তখন রাত বারোটা কি একটা হবে–হঠাৎ ঝুপঝুপ করে করে বৃষ্টি নামল। তার আগের কয়েক মাস ভয়ানক খরা যাচ্ছিল–এতে ফসলেরও ক্ষতি হয়েছিল প্রচুর। বৃষ্টির আওয়াজ কানে আসতেই আমিরউদ্দিন ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। দাদাকে ডেকে বললে, বাবু, কাইলই আঁই বাড়ি যামুগই। খোদার দোয়ায় বৃষ্টি অইল, খ্যাতে লাঙল ফেলাইতে না পাইল্লে, এ-খন্দে আর চাইল ঘরে তুইলতে পাইতাম না উবাস মরুম। আরে ইস্টিশনে নিয়া কাইল সকালেই গাড়িত তুলি দি আইয়েন, বাবু। অনেক বোঝানো সত্ত্বেও আর একদিনের জন্যেও কলকাতায় থাকতে রাজি হল না আমিরউদ্দিন। মাঠের ডাক এসেছিল তার জীবনে, লিকলিকে ধানের শিষের সোনালি স্বপ্নের কাছে কলকাতার ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে গেল।
সেদিন আমিরউদ্দিনের বোকামি দেখে হেসেছিলাম–আজ বুঝতে পারছি গ্রামের আকর্ষণ গ্রামের ছেলের কাছে প্রবল, কত গভীর। দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের স্বপ্ন কোনোদিন কি ভুলতে পারব? ধান কাটা সারা হবার পর শুরু হত আমাদের ঘুড়ি ওড়ানোর পালা। কত ধুলো গায়ে মেখেছি, দৌড়তে গিয়ে কতবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছি–কত রক্ত মাঠের ধূলির সঙ্গে মিশে রয়েছে। সেই মাঠ পেরিয়ে দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যেতাম মনুমিয়ার বাড়ি। মনুমিয়া আখের চাষ করত, তার ওপর ছিল আমাদের লোভ!
রেজ্জাক মিয়ার খেজুরের রসও কি আমাদের কম প্রিয় ছিল! রাত্রে রস পড়ে হাঁড়ি ভরতি হয়ে থাকত সকালে সে-রস বিক্রির জন্যে পাঠানো হত গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে। আমাদের বাড়িতেও খেজুরের রস কেনা হত পায়েস বানাবার জন্যে। আমাদের মন কিন্তু তাতে ভরত না। রেজ্জাক মিয়া ভোরবেলা যখন গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামাত, আমরা গিয়ে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাদের লোলুপ দৃষ্টি দেখে রেজ্জাক মিয়া কিছু রস আমাদের মধ্যেই বিলিয়ে দিত।
ঘটা করে দুর্গাপুজো হত আমাদের বাড়িতে। পুজোর কটা দিন লোকজনের ভিড়ে সারাবাড়ি গমগম করত। পুজো উপলক্ষ্যে একদিন স্থানীয় বিশিষ্ট মুসলমান ভদ্রলোকদের
নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হত। পুজোর প্রসাদ তাঁরা খেতেন না, তাই তাঁদের জন্যে বন্দোবস্ত করা হত আলাদা খাবারের। পুজোমন্ডপের পাশেই আমাদের বৈঠকখানা ঘর। বিরাট আলোর ঝাড়ের তলায় পরিষ্কার চাদর আর তাকিয়া দিয়ে ফরাস পাতা হত। সকলে বসতেন সেখানে। আমরা ভয়ে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকতাম না–আশপাশে ঘুরঘুর করে বেড়াতাম। আশরাফউদ্দিন, সোনা মিয়া, কালা মিয়া প্রভৃতি সকলেই হলেন গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি। বহুকাল থেকেই আমাদের বাড়ির সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা এঁদের। আমাদের পূর্বপুরুষের সম্পর্কে কত গল্প শুনেছি এঁদের মুখ থেকে। পুজোর সময় জিনিসপত্র জোগাড় করে দেবার ভার থাকত এঁদের ওপর–কোন জিনিস কত পরিমাণ প্রয়োজন এঁরা সব জানতেন। এঁরা সকলেই চাষি–কিন্তু গুরুজনদের মতোই এঁদের আমরা সমীহ করে চলতাম। ভালোবেসে এঁরা আমাদের কচি মন জয় করেছিলেন।
এমনি কত শত সাধারণ দৈনন্দিন স্মৃতি আজ ভিড় করে দাঁড়িয়েছে মনের দ্বারে। ছেড়ে আসা গ্রামের ফেলে-আসা দিনগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছে আমার অন্তরলোকে। এদের কোনোটিই বিশেষ ঘটনা নয়–অতিসহজ-সরল, সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি কান্নার কথা। একদিন এর তেমন কোনো মূল্যই হয়তো আমার কাছে ছিল না, কিন্তু আজ তাকে হারিয়েছি, তাই সে হয়ে উঠেছে অমূল্য। একই গ্রামবাসী হিসেবে যুগ যুগ ধরে আমরা হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করে এসেছি–শুধু ধর্মবিশ্বাস ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও চিন্তাধারার ভেতর আর কোনো তফাতই ছিল না। দেশে যখন সমৃদ্ধি এসেছে, হিন্দু-মুসলমানের জন্যে সমানভাবেই এসেছে। যখন বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারীর তান্ডব শুরু হয়েছে, তখনও হিন্দু-মুসলমানের জীবনে সমানভাবেই পড়েছে তার অভিশাপ। কিন্তু কোন এক অশুভ মুহূর্তে ঘোষণা করা হল : হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের শত্রু, এদের ভেতর কখনোই মিল হওয়া সম্ভব নয়। মুসলমান প্রতিবেশী নতুন চোখে তাকাল হিন্দু-প্রতিবেশীর দিকে। বললে, তুমি আমার শত্রু–এতদিন যে আমরা পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করে এসেছি, তা মিথ্যে– এতদিন যে বন্ধুর মতো, ভাইয়ের মতো ব্যবহার করেছি, তাও মিথ্যে –শত শত বছর ধরে তোমাতে আমাতে যে আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা কখনো সত্যি নয়! যে শত্রুতা হিন্দু-মুসলমানের ভেতর কোনোদিন ছিল না, দিনের পর দিন ধরে বিষাক্ত প্রচারের ফলে সে-শত্রুতা সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র একটি দুষ্ট রাজনৈতিক চক্রান্ত সফল করবার জন্যে।
সফল হয়েছে সে-চক্রান্ত। মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, ছল চাতুরির দ্বারা দেশকে করা হয়েছে দ্বিখন্ডিত। হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক ঐক্য, রাজনৈতিক ঐক্য, ভাব-ভাষা, চিন্তা-কল্পনা-সুখ দুঃখ হাসি-কান্নার ঐক্য নির্মমভাবে হার মানল ধর্মবিশ্বাসের অনৈক্যের কাছে। একটা জাতির জীবনে এর চেয়ে বড়ো অভিশাপ আর বোধহয় হতে পারে না। লক্ষ লক্ষ মুসলমানের লক্ষ লক্ষ প্রতিবেশী আমরা আজ হলাম ঘরছাড়া, দেশছাড়া!
কিন্তু এই ভৌগোলিক অস্ত্রোপচার আমাদের মনের নিবিড় ঐক্যকেও কি স্পর্শ করতে পেরেছে? না–পারেনি। কলকাতার নিষ্ঠুর নির্মম পরিবেশের মধ্যে মনের শান্তি কোনোদিন আমাদের আসবে না, আসতে পারে না। কলকাতার আকাশ-বাতাস, আলো-আঁধার, জল মাটি, গাছপালার সঙ্গে আমার গ্রামের প্রকৃতির তফাত, বৈজ্ঞানিকের চোখে হয়তো নেই, কিন্তু যে আলোতে প্রথম আমি চোখ মেলেছি, যে মাটি আমাকে বক্ষে ধরেছে, যে বাতাস ঘোষণা করেছে আমার জন্মবার্তা–তাকে আমি কেমন করে ভুলব, তার স্পর্শ যে আমার অস্তিত্বের অণুতে-অণুতে মিশে রয়েছে। আমার গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি জলবিন্দু, প্রতিটি লতাগুল্মের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আমার অন্তরের বাঁধন-একটা কলমের আঁচড়ে সে সবই কি মিথ্যে হয়ে গেল!
আমরা বাস্তুহারা, শরণার্থী–ভারতের দুয়ারে ভিক্ষাপ্রার্থী : এই আমাদের একমাত্র পরিচয় আজ। এই পরিচয়ের রক্তাক্ত টিকা ললাটে এঁকে কলকাতার পাষাণ-দুর্গের নিষ্ঠুর বন্ধনের মাঝখানে বসে আমি আজ অশান্ত মনে চেয়ে রয়েছি আমার ছেড়ে-আসা গ্রামের দিকে।
রঘুনন্দন পাহাড়ের গা ঘেঁষে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত যে বিরাট ট্রাংক রোড চলে গেছে, তারই একধারে ত্রিপুরা জেলার দক্ষিণ প্রান্তে, কুমিল্লা সদরের অন্তর্গত আমার গ্রাম। নাম তার চান্দিসকরা। শুনেছি এককালে আমাদের গ্রামের নাম ছিল ‘চন্দ্র-হাস্য-করা, চান্দিসকরা তার সংক্ষিপ্ত রূপ। চান্দিসকরার আকাশ জুড়ে আজও চাঁদ হাসছে, প্রকৃতির সাজ বদল ঋতুতে ঋতুতে যথানিয়মেই চলেছে,বকুল ফুল পড়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে আমাদের বাঁধানো ঘাট, চাঁপা-টগর-রজনীগন্ধা-হাসুহানা-ডুইচাঁপার গন্ধে ভোরের বাতাস আজও চঞ্চল হয়ে উঠছে, আম-কাঁঠাল-জাম-জামরুলের ভারে গাছগুলো নুয়ে পড়ছে,-মাছের তান্ডবে অশান্ত হয়ে উঠছে দিঘির কালো জল, কালবৈশাখীর প্রলয় নাচন শুরু হয়ে গেছে আকাশে-বাতাসে– মুসলমান চাষিরা দিন গুনছে মেঘের আশায়, কবে বৃষ্টি হবে, কবে খেতে লাঙল পড়বে : এসব আমি আজ দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাঁতি-পাড়ার তাঁত আজ আর চলছে না, কুমোরের চাকা ঘুরছে না, কামারের লোহা জ্বলছে না, ছুতোরের বাটালি আজ নিস্তব্ধ! পৈতৃক ভিটা, পৈতৃক পেশার মায়া ত্যাগ করে তারা আজ দলে দলে হারিয়ে যাচ্ছে পূর্ববঙ্গের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভিড়ের ভেতর। আমিও তাদেরই সগোত্র–চলতে চলতে ভাবছি : উলটো রথের পালা আসবে কবে?
.
বালিয়া
নিশুতি রাত…কৃষ্ণাচতুর্দশীর সূচীভেদ্য অন্ধকারের মধ্য দিয়ে অতিসন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে। আমাদের নৌকাখানি। নৌকার ছই-এর-দু-দিকই আবৃত… সম্মুখভাগে বসে আপন মনে গান গাইছে প্রতিবেশী কাসেম ভুইঞা..পেছন থেকে লগি দিয়ে নৌকা বেয়ে চলেছে যামিনী টিপরা। ছই-এর ভেতরে আমরা চারটি প্রাণী। সারাদিনের দারুণ অশান্তি আর উত্তেজনায় অবসন্ন! সর্বোপরি বর্তমানে জীবন পর্যন্ত সংশয়। কোনোক্রমে শহরে গিয়ে পৌঁছোতে না পারলে রাত্রিশেষে নররূপী পশুদের হামলা অবশ্যম্ভাবী–দিনের বেলায় গ্রামের মেয়েদের, বুড়োদের এবং শিশুদের শহরের নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ অঞ্চলে আমরা শুধু ছিলাম রাত্রির অবস্থা দেখে তারপর একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব বলে। কিন্তু গোধূলির ধূলি উড়বার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ, লুণ্ঠন ও জখমের সংবাদ এল-প্রান্তীয় বড়ো সড়ক ধরে মশালের সাহায্যে হামলাকারীর দল হই-হল্লা করতে করতে এগিয়ে চলেছে,–কোথাও-বা সারি সারি নৌকার সাহায্যে ওরা অন্তর্বর্তী বিল জলা প্রভৃতি পার হয়ে একের পর এক বাড়িতে হানা দিচ্ছে। এসব দৃশ্য আমাদের বাড়ির পূর্ব দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়েই দেখা গেল। অবশেষে ওপাড়ার রহমন খাঁ এসে যখন জানাল রাত্রিতে আমাদের বাড়ি আক্রমণের প্ল্যান হয়েছে এবং চারদিকের আবহাওয়া বাগে এনে সর্বশেষে গ্রাম-কেন্দ্রের এই শক্ত ঘাঁটিটিকে বিপর্যস্ত করাই তাদের অভিপ্রায়–তখন আমাদের সম্মুখে নিরস্ত্রভাবে নিশ্চিত মৃত্যুবরণ কিংবা আত্মরক্ষার জন্যে আত্মগোপন এ দুটির একটি পথ শুধু খোলা রইল। রহমান জানাল, আমাদের বাড়িতে সম্প্রতি যে কয়েকটি বড়ো বড়ো বাক্স-প্যাঁটরা আমদানি করা হয়েছে তাতে বহু অস্ত্রশস্ত্র ছিল বলে ওদের বিশ্বাস,–তাই শক্তি পুরোদস্তুর সংগ্রহ করে তবেই ওরা এখানটায় হানা দেবে এবং সেটা এ রাত্রেই! কিন্তু ওদের বিশ্বাস বা সাময়িক ভয়ের কারণ যাই হোক, শূন্য বাক্স-প্যাঁটরা এবং নিছক বাঁশের লাঠির ওপর ভরসা করে আমরা চারিটি প্রাণী সহস্রাধিক ক্ষিপ্ত পশুর সম্মুখীন হবার সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। রাত্রিও প্রায় শেষ–অগত্যা কৌশলে পথের সুরক্ষিত ঘাঁটি পার হয়ে শহরে গিয়ে প্রাণ বাঁচানার পন্থাই সাব্যস্ত হল। প্রতিবেশী কাসেম খাঁর মস্তিষ্কের সুস্থিরতার কোনো প্রমাণই কোনোদিন পাইনি। আজ হঠাৎ এরকম দুঃসময়ে সে-ই অগ্রণী হয়ে এসে আমাদের নিরাপদে ঘাঁটি পার করে দেবার দায়িত্ব নিয়ে সত্যি অবাক করে দিল।
নৌকাঘাট ছেড়ে মাইলটাক দূরে ওদের ঘাঁটি। খালের এপারে-ওপারে ছাউনি ফেলে শিবির তৈরি করা হয়েছে। যেন একটি কাফেরও বিনাক্লেশে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে। দুপুরের দিকটায় এদের হাতেই ঘোষেদের বাড়ির নৌকাবোঝাই যাবতীয় মালপত্র লুষ্ঠিত হয়েছে, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে নৌকার যাত্রীদের যৎপরোনাস্তি লাঞ্ছনা করা হয়েছে।
কে যায়?–মেজাজি স্বরে প্রশ্ন আসে একটা ছাউনির মুখ থেকে।
আমি কাসেম ভূঁইঞা।–কে রে? ইসমাইল নিহি?-কাসেম গান থামিয়ে ওদের প্রশ্নের জবাব দেয় এবং নিতান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে প্রতি-প্রশ্ন করে।
আরে এত রাত্রে যাচ কই?–কাসেমের উত্তর : কই আর যামু,–যাই–রাইত পোয়াইলেই ত প্যাটের চিন্তা,–তার ব্যবস্থার লাইগ্যা।
কাসেমের ব্যাবসা দুধ বিক্রি। গৃহস্থ বাড়ির দুধ দাদন দিয়ে দীর্ঘকালীন বন্দোবস্ত নেয়, প্রত্যহ ভোরে তাই বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে শহরের মিষ্টির দোকানগুলিতে সে চালান দেয়। কাসেমের জবাবে ওরা সন্তুষ্ট হল, তাই আমাদের নৌকাও অবাধে বেরিয়ে এল সামনের দিকে।
এমনি করে সর্বনাশা ছেচল্লিশের এক নিশীথ রাত্রে মহাঅপরাধীর মতো নিজের পরমপ্রিয় পুণ্যতীর্থ জন্মভূমি, জন্মগ্রাম থেকে নিঃশব্দে বিদায় নিয়ে এলাম।… তারপর বছরের পর বছর কেটে গেছে–কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও সে-মাটির কথা ভুলতে পারিনি। আজন্ম যার আলো হাওয়া আমার জীবনকে বর্ধিত করেছে, যার মাঠ-ঘাট-বাট-বন অনুক্ষণ প্রভাবিত করেছে আমার মন, জ্ঞানোন্মেষের পর থেকে যাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অসংখ্য ঘটনা স্মৃতির ভান্ডার করেছে সমৃদ্ধ, মুহূর্তের তরেও তাকে ভুলি কী করে? আজও প্রতিমুহূর্তেই তাই শুধু পিছু-ডাক।
পূর্ববঙ্গের ভয়ংকর নদী মেঘনা। তারই পূর্বপারে অবস্থিত সুবৃহৎ রেল ও স্টিমার জংশন, বাণিজ্যবহুল বন্দর চাঁদপুর। আসামের কুলিধর্মঘটকে কেন্দ্র করে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের নেতৃত্বে চাঁদপুরের ঐতিহাসিক আন্দোলন, জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও সংগঠনকর্মে উৎসর্গীকৃত প্রাণ ভারতের প্রবীণতম, সর্বজনশ্রদ্ধেয় জননেতাদের অন্যতম হরদয়াল নাগের কর্মসাধনা চাঁদপুরের পরিচয়কে ভারতের দূরতম প্রান্ত অবধি প্রসারিত করেছে। নতুন বাজার, খেয়া পার হলেই কয়েকটি পাটের কল, তার গা ঘেঁষে এঁকে বেঁকে রাস্তা চলেছে দক্ষিণমুখী, খানিকটা নীচু জমির হাঁটাপথ ছাড়িয়েই জেলা বোর্ডের বড়ো সড়ক সোজা চলে গেছে পূর্বে ও দক্ষিণে…এমনি চলতে চলতে শহরের কোলাহল যখন নিঃশেষে বিলীন হয়ে যায় যখন প্রায় দু-ক্রোশ পথ পড়ে গেছে পেছনে, সামনে তখন ছায়ায় ঢাকা, পূর্বে ও পশ্চিমে, উত্তরে ও দক্ষিণে বৃক্ষরাজির আবেষ্টনীর মধ্যে ছায়াছবির মতো চোখে পড়ে একটি গ্রাম–’বালিয়া’ : লৌকিক নাম ‘বাইলা। আধুনিক সভ্যতা নিয়ে গর্ব করবার মতো কিছুই তার নেই, কিন্তু প্রকৃতির অফুরন্ত, অজস্র আশীর্বাদ যে তাকে অনুক্ষণ ঘিরে রেখেছে, গ্রামের সীমানায় পা। দিতেই যেকোনো পথিকের তা চোখে পড়ে। গ্রামটির প্রবীণতার সাক্ষ্য আর প্রতিক্ষণের জাগ্রত প্রহরীরূপেই যেন দাঁড়িয়ে আছে একটি সুউচ্চ তালগাছ আর তার পাশে জোড়া আমগাছ-গ্রামের ঠিক হৃদপিন্ডের ওপর,-সেনদের বাড়ির একেবারে সামনেটায়। জমিদার হিসেবে নয়, শিক্ষায় ও সামাজিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠ হয়েই এই বাড়ি দূরাতীত থেকে সসম্মান দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে প্রতিবেশী গ্রামগুলোর।
আমাদের বাড়ি বরাবর গ্রামের সমুখে সুবিস্তীর্ণ প্রান্তর, কোথাও উঁচু গাছপালা সূর্যদেবের আত্মপ্রকাশের পথকে অবরুদ্ধ করে রাখেনি। তাই প্রভাতের স্নিগ্ধতা আর সূর্যালোক মিলিয়ে যে দুর্লভ মাধুর্য প্রকৃতিদেবী দু-হাতে বিলাতে শুরু করেন, তার সম্মোহনে দলে দলে ছেলে মেয়ে ভিড় জমায় সেই আমগাছের তলায়; গাছের নবোদগত আম্রমুকুলে ঢিল ছোড়ে কেউ, কেউ বা অদূরে খালের হাঁটুজলে নেমে হাতমুখ প্রক্ষালন করতে থাকে।
চাঁদপুর জংশনে মেঘনা থেকে যে শাখা-নদীটি শহরটিকে দু-ভাগে ভাগ করে দিয়ে এগিয়ে গেছে সম্মুখপানে,–প্রায় সহস্র গজ পরেই তার রূপান্তর ঘটেছে প্রকান্ড খালে, ক্রমে আরও সংকীর্ণ হয়ে এই খাল বাণিজ্যবাহী জলপথরূপে শহরের সঙ্গে সহস্রাধিক গ্রামকে সংযুক্ত করে নোয়াখালির প্রান্তসীমায় গিয়ে মিশেছে। বর্ষায় তাই বাড়ির সম্মুখ দিয়ে সারি সারি চলমান নৌকার মজা দেখতে সকাল সন্ধ্যায় ছোটোদের ভিড় জমে, বড়োদের মধ্যে যাঁরা বিদেশবাসী, গাঁয়ে এসেছেন ছুটি-ছাটা উপলক্ষ্যে, খালের পাড়ে এখানে সেখানে দু-জন চারজন করে দল বেঁধে পলিটিক্স চর্চা করছেন তাঁরা। জিন্না বড়ো পলিটিশিয়ান কি গান্ধি বড়ো, সূর্য সেন-অনন্ত সিং-এর আমলই ছিল ভালো কিংবা সত্যাগ্রহই এনে দেবে বাঞ্ছিত স্বাধীনতা, পড়য়া হাল পটিশিয়ানদের মধ্যে তাই নিয়ে চলে অফুরন্ত বাক-বিনিময়।
…এই মাঝি, নৌকা থামাও। হঠাৎ হরিমোহন পরামানিক খালের পাড় দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একরকম খালের জলে নেমেই একটা নৌকার ছই শক্ত হাতে টেনে ধরে।
কী অইল বাবু?–ছই-এর ওপর থেকে সশঙ্ক হয়ে প্রশ্ন করে মাল্লা আর পেছন থেকে মাঝি একই সঙ্গে।
কী অইল? মাঠের মধ্য দিয়া পাল তুইল্যা যাইতেছ, জানো না পাল তুইল্যা গেলে হেই জমিতে আর কোনোদিন ফসল অয়না?
ও হো,–এই নামা-নামা, পাল নামা।–মাঝির নিজেরও হয়তো চাষবাস আছে, তাই শস্যক্ষতির আশঙ্কাটা তার মনে সহজেই প্রবল নাড়া দেয়।
বর্ষার নতুন জলে খালে মাছ ধরার কী আনন্দ! পুঁটি, ট্যাংরা, বাতাসি আর কাজলী-বজরীর ঝাঁকিজালের ফাঁকিতে না পড়ে উপায় কী? জোছনা রাতে চাঁদা মাছগুলো চাঁদের আলোকে ঝিকমিক করে ওঠে জালের ফাঁকে ফাঁকে। অমাবস্যায় পাকা ধরুয়াদের হাত যেন অবলীলাক্রমেই অন্ধকারের মধ্যে জাল থেকে রকমারি মাছগুলোকে খুলে নেয়-কাঁটার ঘা লাগে না। প্রায় প্রত্যহ সন্ধ্যায় কালবৈশাখীর দৌরাত্ম্য। তারই মধ্যে বেপরোয়া হয়ে মাছ ধরা চলে,–মাঝে মাঝে কেবল কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে একজন অপরজনের অবস্থিতি জেনে নেয়।
সন্ধ্যা হতে-না-হতেই পাড়ায় পাড়ায় শিশুদের কাঁসর-ঘণ্টাধ্বনি আর অবিশ্রান্ত কলরব মুখরিত করে তোলে গ্রাম। মাঝে মাঝে খোল-করতাল নিয়ে দল বেঁধে এপাড়া থেকে ওপাড়া, এবাড়ি থেকে ওবাড়ি। আমাদের গ্রাম-পরিবেশের এ ছিল এক আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
মাঝে মাঝে পালা সংকীর্তনের আসর জমে উঠত আমাদের বাড়িতে কিংবা আমাদের জ্ঞাতিবাড়ি পশ্চিমের বাড়িতে। গাইয়ে–’বাইলার দল’! আমাদের গ্রাম ও প্রতিবেশী গ্রামের প্রায় দু-ডজন কীর্তনীয়া আর কীর্তন-রসিক নিয়ে গড়া এইদল। বছর পাঁচ পুরোদস্তুর ট্রেনিং দিয়ে এরা সত্যিকারের একটা ভালো দল খাড়া করেছে।–’রাধার বিচ্ছেদ’ ‘নিমাই-সন্ন্যাস, ‘মানভঞ্জন’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘নৌকাবিলাস’–প্রতিটি পালাগানের যেমন মর্মস্পর্শী রচনা, তেমনই তার সুর।
পুবের হিস্যার সোনাদার বার্ষিক শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সন্ধ্যায় পালাকীর্তনের ব্যবস্থা। ত্রিপল টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে বিরাট উঠোনের ওপর। বসবার ঠাঁই শতরঞ্চি আর মাদুর ইতিমধ্যেই শ্রোতৃসমাগমে ভরে গেছে। তা ছাড়া একপাশে গাছপিঁড়িতে অত্যন্ত আগ্রহভরে বসে আছেন আমাদের অশীতিপর বৃদ্ধ প্রতিবেশী ও প্রজা মেহেরুল্লা খাঁ এবং তাঁর আশপাশে ইসমাইল শেখ, হরমোহন খাঁ, হামির ভুইঞা, ইয়াসিন গাজি, কলন্তর খাঁ, রহমান এবং আরও বহু মুসলমান। ফরমায়েশ হল, ‘নিমাই সন্ন্যাস’ হোক!
দলপতি জগদীশ চন্দ আর রমেশ নাহা, মূল গায়েন হরিচরণ মহানন্দ, বায়েন (খোল বাজিয়ে) বিভূতিদা, ওরফে বিভূতি পাগলা, দোহারদের মধ্যে প্রধান অনন্ত আর শিশির কাকা–কালু, ব্রজেন্দ্ৰকাকা, ছোট্টকাকা এঁরা দ্বিতীয় পঙক্তির। আর একজন আছেন চিত্তদা। তিনি ক্ষীণদৃষ্টি, সত্যি কোনোদিন কোনো গান গেয়েছেন কি না সঠিক কেউ বলতে পারে না। তাহলেও কথা এবং সুরের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখভঙ্গি অব্যর্থরূপে প্রমাণ করে তাঁর কীর্তনপ্রিয়তার কথা। আসলে কীর্তনপ্রিয়তাও তত বড়ো কথা নয়, যত বড়ো কথা হচ্ছে দলের লিষ্টিতে নাম রাখা! তবে চিত্তদা কিন্তু গল্পরসিক। শুধু রসিক নন, গল্পস্রষ্টা! বারোহাত কাঁকুড়ের তেরোহাত বিচি আর তিলকে তাল করার অসংখ্য গল্প মুহূর্তে বানিয়ে গানের ফাঁকে ফাঁকে আসর জমাতে তাঁর জুড়ি নেই! হরিচরণ হাতের করতালসহ হাত দুটি তুলে সভ্যগণ’ সমীপে নমস্কার জানিয়ে শুরু করে,
বাছা নিমাইরে,–বাছা নিমাই,
কোথায় গেলি রে,
দুঃখিনী মায়েরে ফেলে!
কণ্ঠ যেমন তীক্ষ্ণ, তেমনি মধুর। প্রধান দোহার অনন্তও মোটেই ‘ফ্যালনা’ নয়। ওদিকে বায়েন বিভূতি পাগলা এ তল্লাটের ওস্তাদ খোল বাজিয়ে। তাঁর খোল সত্যিই কথা কয়–আর এই খোল সহরতে তার নৃত্যের অপূর্ব ভঙ্গিমা বাইলার দলের প্রধান আকর্ষণ। উপযুক্ত সঙ্গতের মধ্যে গান সহজেই জমে ওঠে। দ্রুততালে তখন গানের অপর একটি কলি গাওয়া হচ্ছে,
নিমাই তোরে কোলে লব,
সব দুঃখ পাশরিব,
বড়ো আশা করেছিলাম মনে–
নিমাই রে!
গান শুনতে শুনতে পুত্রশোকে শোকাতুরা দক্ষিণহিস্যার মণিদি সুরের মূর্ঘনায় মূৰ্ছিতা হয়ে পড়ে! তাঁকে নিয়ে উদব্যস্ত হয়ে ওঠেন মেয়েরা। গান চলতেই থাকে। গায়েন, বায়েন, দোহার, শ্রোতা কেউ যে তখন আর এ জগতে নেই! অদ্ভুত অপূর্ব রসানুভূতি– আজও যার রোমাঞ্চ জাগে দেহে ও মনে।
সেনদের বাড়ির দোলউৎসব সুবিখ্যাত। সর্বজনীনতার মাধুর্য দিয়ে মন্ডিত এ উৎসবের প্রতিটি অঙ্গ। গ্রামের সবাই, এমনকী আশপাশের গ্রামেরও বহু ছেলে-বুড়ো বর্ষঘুরে আসতেই এ উৎসবের প্রত্যাশায় দিন গুনে চলে। পুজোর আনন্দ, আবিরের ছড়াছড়ি তো আছেই–তা ছাড়াও অষ্টপ্রহর সংকীর্তনান্তে মহোৎসবের খিচুড়ি আর লাবড়া! সেদিন সারদা পিসি এসে ধরে পড়লেন উদ্যোক্তাদের–তাঁর গুরুঠাকুর এসেছেন, মহোৎসবের পর তাঁকে দিয়ে শ্রীশ্রীগীতা পাঠ করাতে হবে। অতিউত্তম প্রস্তাব, মুহূর্তে পশ্চিম হিস্যার বাঁধানো বারান্দায় একটা বেদির মতো তৈরি করে দেওয়া হল, তার ওপরে বসলেন পন্ডিত কমলাকান্ত কাব্যতীর্থ। সুপুষ্ট বলিষ্ঠ দেহ, গৌরকান্তি, মুখাবয়বে জ্ঞান-গভীরতার ছাপ সুস্পষ্ট। মেয়েদের মঙ্গলশঙ্খধ্বনির পর তাঁর গুরুগম্ভীর কণ্ঠ থেকে ধ্যানমন্ত্র উচ্চারিত হতে থাকে,
মূকং করোতি বাঁচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম
যকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দ মাধবম।
তারপর বেছে বেছে কয়েকটি শ্লোক পাঠ আর বাংলায় তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন পন্ডিতমশায়। শ্রোতৃবৃন্দ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে অমৃতময়ী শ্রীভগবানবাণী-সারগর্ভ জীবনদর্শনের মধুর ব্যাখ্যান। হঠাৎ টিপরার ‘জুম’ সর্দার কৈলাস সভায় ছুটে এসে ডুকরে কেঁদে ওঠে –’আমার জোয়ান মর্দ ছেলেটি তিন দিনের জ্বরে মারা গেল!’ সভাস্থল থেকে একটা তীব্র বেদনার ধ্বনি উত্থিত হয়। বিভূতিদা, যামিনীকাকা ও আমরা জনকয়েক মিলে কৈলাসকে সান্ত্বনা দিতে দিতে নিয়ে যাই স্থানান্তরে, কেউ কেউ লেগে যায় শ্যামমোহনের সৎকারের ব্যবস্থায়।
এ অঞ্চলে অনেক টিপরার বাস। চেহারায় টিপরাদের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজাদের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে, তাই ওরা ত্রিপুরার আদিম অধিবাসী বলে দাবি করে। ফরসা রং ছাড়া কালো রং একজনেরও নেই ওদের মধ্যে, অদ্ভুত শক্ত বাঁধন দেহের, যেন লোহা পিটিয়ে গড়া হয়েছে। যতদূর জানা যায়, আমাদের পূর্বপুরুষগণ এদের প্রজাস্বত্ব দিয়ে এনেছিলেন গ্রামরক্ষী ও বিশ্বাসী অনুচররূপে। এদের সকলের পদবিই ‘সিং’-কৈলাস সিং, মিষ্ট সিং, যামিনী সিং, রমণী সিং, কামিনী সিং, এমনি সব নাম। মেয়েরাও পুরুষদের মতো সমান পরিশ্রমী ও বিনয়ী। সাধারণত ওরা কয়েকটি পরিবার দল বেঁধে একজায়গায় ছোটো ছোটো কুঁড়ের মধ্যে বাস করে। এই বাস-ব্যবস্থাকেই বলা হয় ‘জুম’। প্রায় প্রত্যহই বিকেলের দিকে আমরা বেড়াতে যেতাম কোনো-না কোনো জুমে। টিপরাদের সঙ্গে আলাপে অফুরন্ত আনন্দ পেতাম। ওদের সরলতা, সৎসাহস, আতিথেয়তার কথা আজ বড়ো বেশি করে মনে পড়ে।
এগ্রামে অধিকাংশই টিনের ঘর। পাকা ঘর শুধু একটি–আমার খুল্লতাত তার মালিক। দোতলা দালান, দক্ষিণ খোলা, অবিশ্রান্ত হাওয়ার আনাগোনা, তারই লোভে সন্ধ্যার দিকে ছেলে-বুড়ো জমায়েত হয় কাকার শান-বাঁধানো বারান্দায়। আজগুবি গল্পে জমে ওঠে ভরা বৈঠক। প্রধান গল্পকার এবাড়ির অর্ধশতাব্দীর পুরাতন ভৃত্য সুধন্য। এমনি সময় যথারীতি ডাক পড়ে কবিয়াল গৌরাঙ্গের–বৃদ্ধ দীনদয়ালের বড়ো ছেলের। গৌরাঙ্গ আমাদের দু-বাড়ির কোনো-না-কোনো হিস্যার কাজে আছেই, যদিও কেবল খোরাকি দিয়েও কোনো এক হিস্যা তাকে একনাগাড়ে দীর্ঘদিন রাখতে নারাজ। গৌরাঙ্গের পৈটিক দাবিটা বড়ো মাত্রাতিরিক্ত, ওদিকে কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। তবু তার সরল নির্বুদ্ধিতার জন্যেই সবাই তাকে ভালোবাসত। তাই বেকার হতে হয়নি তাকে কোনোদিন। গৌরাঙ্গ নিজেকে কবির দলে সরকার (কবিয়াল) বলতে গর্ববোধ করে। কোন কোন বিখ্যাত কবির দলে সে শাকরেদি করেছে তার ইতিহাসও সে নির্ভুল বলে দিতে পারে। আমরা অবশ্য জানতাম, কবি অক্ষয় সরকারের দলে থেকে ফুটফরমাশ খেটেছিল ও মাসখানেক, ব্যস, ওই পর্যন্তই তার শাকরেদি!
অমৃত হালে বিভূতি বায়েনের সাকরেদ হয়েছে। আমাদের পরামর্শমতো সে খোলে চাঁটি মারতেই গৌরাঙ্গ শুরু করে,
রামগুণাগুণ বাদ্য বাজে
গোবর্ধনের বাড়ি হে,
(আমরা দোহাররা : রামগুণাগুণ বাদ্য বাজে…)
গোবর্ধনে অম্বল খায়
হাপপুর হুপপুর হে।
মুহূর্তে দারুণ হাসির রোল পড়ে যায় ‘অম্বল’ খাওয়ার দাপটে!
আশ্বিন মাসের শেষ। দুপুরে বাড়ির বৈঠকখানার সামনে একটা বড়ো আমগাছতলায় মাদুর পেতে বসে একদিন গল্প করছিলাম আমরা জনকয়েক মিলে। এমনি সময় চন্ডীপুর (নোয়াখালি) থেকে হরেনকাকা এমন একটা সংবাদ এনে হাজির করলেন যা দুঃস্বপ্নেরও অতীত বলে বোধ হল। তিনি জানালেন, ওই অঞ্চলে দলে দলে ক্ষিপ্ত মুসলমান কয়েকটি বাড়িতে হানা দিয়ে সমস্ত ঘর অগ্নিদগ্ধ করেছে, লুণ্ঠন করেছে জিনিসপত্র, গোরুবাছুর পর্যন্ত। দুটি রোমহর্ষক হত্যাকান্ডের সংবাদও দিলেন তিনি, আর বললেন সর্বত্র এই আগুন ছড়াবার জন্যে সভাসমিতিতে প্রচারও চলছে। চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে-না-হতেই খবর পেলাম পাশের গ্রামে অগ্নিকান্ড আর লুঠতরাজের। বেলাবেলি মেয়েদের, বুড়োদের আর শিশুদের সরিয়ে দেওয়া হল নিরাপদ স্থানে–শহরের আইন-শৃঙ্খলার মধ্যে। রাত্রিশেষে দশসহস্রাধিক মানুষের গ্রামকে শ্মশানপুরীর নিস্তব্ধতার মধ্যে নিঃশেষে শূন্য করে দিয়ে আমরা তরুণরাও জন্মভূমি, জন্মগ্রাম থেকে বিদায় নিলাম। শত শতাব্দীর ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল যে ইতিহাস, বর্বরতার হিংস্র অভিযান তাকে চুরমার করে দিল নিমেষে। ইতিহাসের এই ছিন্নসূত্র আবার কোনোদিন জোড়া লাগবে কি না কে জানে!
.
কালীকচ্ছ
গ্রাম-প্রাণ আমাদের বাংলাদেশ। অসংখ্য গ্রাম পূর্ব বাংলায়। আমরা ছেড়ে এসেছি সেসব গ্রাম। সেসব ছেড়ে-আসা গ্রামের মধ্যে কালীকচ্ছ একটি নাম–সে অন্যতমা, সে অনন্যা সে আমার গ্রাম-জননী। পূর্ববাংলার আর সব গ্রামের মতোই জল-বাতাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমার কালীকচ্ছ মহিমাময়ী। আর সবাইয়ের মতো আমারও দেহ-মনে শিহরন জাগে বহুস্মৃতি-বিজড়িত সেই জন্মগ্রামের কথা ভাবতে। মায়ের মতো করে সেই গ্রামই যে আমায় শিখিয়েছিল সংগ্রামময় এই পৃথিবীতে সংগ্রামী হয়ে বেঁচে থাকতে। আজ তাই তার অভাব মনকে পীড়িত করে, করে তোলে বিষাদ-ভারাক্রান্ত। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি বড়ো কর্মকেন্দ্র ছিল কালীকচ্ছ। মুক্তিযুদ্ধের সেই ইতিহাসে কালীকচ্ছের অবদান বড়ো কম নয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ ভারত ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় সংযোজনায় সাময়িকভাবে হলেও সে আজ বঞ্চিত।
আজ থেকে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার কথা। সেই ছোটোবেলার কত স্মৃতিই না আজ হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। আমাদের বাড়িকে বলা হত রামপ্রসাদের রামের পুরী। সাতমহল বাড়ি। তাতে ছিল জঙ্গলাকীর্ণ একটা পুরোনো মন্দির। শেয়াল শিকার করতে গিয়ে একদিন একটা কুকুর নিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম সেই মন্দিরে। কিন্তু শেয়াল ধরা পড়েনি সেখানে। তাহলেও সেই মন্দিরে পাওয়া গেল একটি সুরক্ষিত বাক্স। খুব খুশি মনেই সেই বাক্স নিয়ে আমি ফিরে এলাম। প্রাণের ভয়ে যে মন্দিরের ধারে কাছেও যায় না কেউ সেখানে যাওয়ার কথা বাড়িতে খুলে বলাও তো মুশকিল। ও মন্দির নাকি ছিন্নমস্তার। কোনো এক সন্ধ্যায় ওই মন্দির থেকে এক ছিন্নমস্তা মূর্তিকে বার হয়ে যেতে দেখে আমাদেরই এক প্রপিতামহী নাকি চিরতরে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। সেই থেকেই মানববর্জিত এই মন্দিরে অপদেবতার ভয়ে কেউ প্রবেশ করতে সাহস পায় না। সেই মন্দিরে বাক্সটি দেখে ভাবলাম হয়তো ওই দেবতারই ধনরত্ন রাখা আছে তাতে। সাগ্রহে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাক্সটি খুলেই বাবা কীরকম গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং এ নিয়ে বেশি হইচই করতে বারণ করে দিলেন।
বাক্সটিতে যা জিনিসপত্র ছিল তা নিয়ে দেখানো হল স্বগৃহে অন্তরিন প্রমথনাথ নন্দীকে। তিনি বললেন, ওগুলো তাজা কার্তুজ, গ্রামের বিপ্লবীদের সম্পত্তি। আমার বড়ো ভাই এনে ওইখানে রেখেছিলেন।
তখন প্রমথবাবু ও অন্যান্য কয়েকজন যুবকের গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখবার জন্যে গ্রামে গুপ্তচর ঘোরাফেরা করত। পুলিশ একবার খোঁজ পেলে হাজতে যেতে হবে সকলকেই। তাই বাক্সটি ফেলে দেওয়া হল পচা-ডোবার মধ্যে।
বিপ্লব আন্দোলনে আমাদের গ্রামের যুবকরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এসেছে প্রথম যুগ থেকেই। শ্রীঅরবিন্দ আমাদের গ্রামে পদার্পণ করেছিলেন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। পল্লি-মানুষের মনে বিপ্লব-বহ্নির ছোঁয়া লাগানো ছিল উদ্দেশ্য। বিপিনচন্দ্র পালও দু-বার আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন–কয়েকটি সভায় বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামেই জন্মেছিলেন মানিকতলা বোমা মামলার বিপ্লবী বীর উল্লাসকর দত্ত। ওই মামলা তখনও চলছে। ধরা পড়লেন আমাদের অশোক নন্দী। মামলায় জড়াবার আগেই মৃত্যু তাঁকে সরিয়ে নিলে। পরবর্তীকালে কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট হত্যার ব্যাপারেও আমাদের গ্রামের বহু যুবক-যুবতি ধৃত ও অন্তরিন হয়েছিল। এক পুলিশের চরকে গুলি করা হয় আমাদের গ্রামে। সে ছিল মুসলমান। গুলি করেছিল আমাদের গ্রামেরই বিরাজ দেব। এ মামলায় ও আর একটি মামলায় তার জেল হয়েছিল মোট ৪৫ বৎসরের। মুসলমান গুপ্তচরকে মারার জন্যে সেদিন মুসলমান বন্ধুরাই সাহায্য করেছিল হিন্দুদের।
গ্রামের সভা-সমিতি ও আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল মহেন্দ্র নন্দীর বাড়ি। মহেন্দ্র নন্দী ছিলেন অশোক নন্দীর পিতা ও উল্লাসকর দত্তের মামা। মহেন্দ্রবাবুকে মহাপুরুষ বলেই জানতাম। তিনি হোমিয়োপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। তাঁর ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়নি, এরকম বড়ড়া একটা শোনা যায়নি। তাঁর হাতের পরশ পেলেও নাকি রোগী সুস্থ হয়ে যেত। অনেক দূর দেশ থেকে দুরারোগ্য সব ব্যাধি নিয়ে বহু লোক আসত। কলকাতা থেকেও অনেকে ডেকে নিয়ে যেত তাঁকে। বিখ্যাত সেতারি আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর বড় ভাই আয়েতালি খাঁ ছিলেন মহেন্দ্রবাবুর শিষ্য।
মহেন্দ্রবাবু শুধু ডাক্তার ও স্বদেশি আন্দোলনের নেতাই ছিলেন না, স্বদেশি জিনিস প্রস্তুতের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রপথিক। এক ধরনের দেশলাইয়ের কল আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাঁর। ঝিনুক এবং নারকেলের মালার বোতাম তৈরির কলও আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। বাড়িতে তাঁর বিরাট কারখানায় দেশলাই, বোতাম ও তাঁতের কাপড় তৈরি হত। বহু বাঙালি তাঁর আবিষ্কৃত দেশলাইয়ের কল নিয়ে ব্যাবসা শুরু করেছিল।
মহেন্দ্রবাবু ছিলেন ব্রাহ্ম। মহেন্দ্রবাবুর বাবা আনন্দ নন্দী, কৈলাস নন্দী এবং আরও কয়েকজন একসঙ্গে ঢাকায় কেশবচন্দ্র সেনের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। দীক্ষাগ্রহণের পর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এসে বহুদিন আনন্দ নন্দীর বাড়িতে বাস করেছিলেন। আনন্দ নন্দী ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। তাঁর সম্বন্ধে অনেক কাহিনি এখনও কালীকচ্ছের ঘরে ঘরে প্রচলিত আছে।
এই সেদিন আমাদের মাস্টারমশাই বৃদ্ধ নিকুঞ্জবিহারী দত্ত বললেন যে, আনন্দ নন্দী সম্বন্ধে নানা কথা শুনে তাঁরা তিন বন্ধু মিলে একবার তাঁর কাছে গেলেন। উদ্দেশ্য, পরীক্ষায় পাশ করবেন কি না তাই জানা। তিনজনই তখন আই.এ. পরীক্ষা দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছেন। তাঁরা প্রশ্ন করবার আগেই আনন্দ নন্দী বললেন, ‘তোমরা যা জানতে এসেছ তা আমি একটু পরে বলব।’ বলে তিনি ধ্যানে বসলেন। ধ্যান শেষ হলে বললেন, তিনজনের মধ্যে নিকুঞ্জবাবু পাশ করবেন, একজন ফেল করবেন, তৃতীয় জন পরীক্ষাই দিতে পারবেন না। এই তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীই ফলে গিয়েছিল।
মৃত্যুশয্যায় আনন্দ নন্দীকে তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো চললে, আমার কী হবে? আনন্দ নন্দী জবাব দিলেন, তিন দিনের মধ্যে তুমিও আমার কাছে আসছ। মৃত্যুর পর আনন্দ নন্দীকে সমাধিস্থ করতে দিলেন না তাঁর স্ত্রী। বললেন, তিন দিন পর যেন তাঁদের উভয়কে একসঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়। নিজে বৈধব্যের বেশও পরলেন না। শান্ত মনে স্বামীর কাছে। যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগলেন। তিন দিনের দিন তিনি হঠাৎ প্রাণত্যাগ করলেন। সাড়ম্বরে তাঁদের উভয়কে সমাধিস্থ করা হল। দয়াময়ের নাম প্রচারের জন্যে সেই সমাধির ওপর মহেন্দ্রবাবু একটি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সেই মন্দিরে নিয়মিত উপাসনা হত সকালে-সন্ধ্যায়। কাঙালিভোজন হত প্রত্যহ।
ওই মন্দিরটি ছাড়া কালীকচ্ছে আরও একটি ব্রাহ্ম মন্দির ছিল। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্যারীনাথ নন্দী। এত অধিক সংখ্যক ব্রাহ্ম হয়তো কাছাকাছি অন্য কোনো গ্রামে ছিল না। আনন্দ নন্দীর পিতা রামদুলাল নন্দী ছিলেন দেওয়ান। তাঁর রচিত অনেক গান একসময় মুখে মুখে ফিরত। রামদুলাল নন্দী নিজের জন্যে এক বিরাট পাকাবাড়ি তৈরি করলেন। তাতে কোঠাই ছিল কুড়িটি। দুই পাশে দুই পুকুর। তাতে বাঁধানো ঘাট আর সামনে বিরাট নাটমন্দির। বাড়ি তৈরি সম্পূর্ণ হবার পরে তাঁর গুরুদেব এলেন বাড়ি দেখতে। বাড়ি দেখেই তিনি মুগ্ধ হয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এবং তা শুনে রামদুলাল গুরুদেবকে বাড়িটি দান করে দিলেন।
ত্রিপুরা জেলার সবচেয়ে বড়ড়া, সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু গ্রাম কালীকচ্ছ। চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরি ডুবেছিল যে কালীদহে সেই কালীদহের পলিমাটিতে গড়া এই মনোরম গ্রাম। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির জন্মভূমি এই কালীকচ্ছ। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রমেশচন্দ্র দত্ত, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তারিণী নন্দী, সুরেশচন্দ্র সিংহ, প্রকাশচন্দ্র সিংহ, এস. ডি. ও. হেমেন্দ্রনাথ নন্দী, কৃষি কলেজের অধ্যক্ষ ও বহু গ্রন্থের রচয়িতা দ্বিজদাস দত্ত, মেজর জেনারেল সত্যব্রত সিংহরায়, ব্যাঙ্ক ব্যাবসায়ে লব্ধপ্রতিষ্ঠ নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত এই গ্রামের সন্তান। ত্রিপুরা জেলা থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম বি.এ. পাশ করেছিলেন মৃণালবালা নন্দী। তাঁরও জন্ম কালীকচ্ছে। কুমিল্লা লেবার হাউসের প্রতিষ্ঠাতা পি. চক্রবর্তীও ছিলেন এই গ্রামেরই অধিবাসী।
কালীকচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব ছিল না। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল রসিক নন্দীর পাঠশালা। এই পাঠশালায় যার হাতেখড়ি হয়েছে সে যে জীবনে কখনো অঙ্কে ফেল করবে না, এ ধারাণা ছিল প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। আরও একটি বিষয় ছিল একরূপ নিশ্চিত। অভিভাবকরা জানতেন যে, পড়ায় যে-ছাত্রের গাফিলতি হবে, রসিক নন্দীর বেতের দাগ কেটে বসে যাবে তার পিঠের চামড়ায়। সংস্কৃতে উচ্চ-উপাধিধারী ছিলেন সুরেন্দ্র তর্কতীর্থ, নৃপেন্দ্র তর্কতীর্থ প্রমুখ পন্ডিতরা। এঁদের বাড়িতে টোল ছিল। বিভিন্ন জেলা থেকে ছাত্ররা এসে টোলে পড়াশোনা করত। উদাত্ত কণ্ঠের সংস্কৃত পাঠের সুরে মুখরিত হয়ে থাকত কালীকচ্ছের প্রভাতী আর সান্ধ্য আকাশ। আজ সে গ্রামকে ছেড়ে দিয়ে আসতে হল পাকিস্তানের কবলে। সেই বৃহৎ গ্রামের মধ্যে একটি বাড়িও ছিল না মুসলমানের। আশপাশে অবশ্য অনেক গ্রামই ছিল মুসলমানপ্রধান, তবে ভয়-ভাবনা আমাদের কোনোদিনই ছিল না তার জন্যে।
তারপর আমোদ-আহ্লাদের কথা। সে-কথা ভাবলেও আজ মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে উপেন্দ্রবাবুর যাত্রার দলের ‘বিজয় বসন্ত’ পালার কথা। সরাইল হাইস্কুলের কেরানি ছিলেন উপেন্দ্রবাবু। অবসর সময়ে যাত্রার দলের মহড়া হত তাঁর বাড়িতে। তাঁরই প্রচেষ্টায় যাত্রার দলটি গড়ে উঠেছিল। দলটির খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। খালি মাঠে শামিয়ানা খাঁটিয়ে শীতের রাতে আটটা-ন-টার সময় যাত্রা আরম্ভ হত। এখনও চোখে ভাসে কয়েকটি দৃশ্য।…বসন্তকে মারবার হুকুম দিলেন রাজা। জহ্লাদ এসে উপস্থিত হল। সে যখন সাড়ে ছ-ফুট লম্বা দশাসই চেহারা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াত, ভয়ে আমাদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যেত, লোমগুলো হয়ে উঠত খাড়া। আমাদের শিশুকালের সেই রোমাঞ্চকর স্মৃতি আজও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এই যাত্রার দলটিকে শ্রীহট্ট ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের লোকেরা টাকা দিয়ে নিয়ে যেত।
একবার দলটি মেঘনা নদীর বন্দর ভৈরব বাজারে গেল ‘বিজয় বসন্ত’ পালা অভিনয় কররার জন্যে। শীতের রাত। পালা এত জমে গেল যে, বিজয় ভুলে গেল সে অভিনয় করছে। বসন্তের বুকে সজোরে ছুরি বসিয়ে দিল। শেষপর্যন্ত ডাক্তারই ডাকতে হল রক্ত বন্ধ করার জন্যে। এই যাত্রা শোনার জন্যে আমরা সন্ধে না হতেই বাড়িতে কান্নাকাটি করে বাবা মার মত আদায় করে আসরে এসে বসতাম। একেবারে সামনের আসনে বসতে না পারলে কিছুতেই মন সন্তুষ্ট হত না। কিন্তু আমাদের চেয়েও সেয়ানা লোক ছিল। তারা এসে হঠাৎ ‘সাপ সাপ’ বলে চেঁচিয়ে উঠত। আমরা তখন সাপের ভয়ে পড়ি-কি-মরি করে দে-ছুট। তারা সেই সুযোগে এগিয়ে এসে সামনের আসনগুলি দখল করত। কখনো কখনো এ নিয়ে মারামারি পর্যন্ত লেগে যেত। সেদিন নিজের জায়গাটি পুনরুদ্ধার করতে পারলে স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধারের আনন্দ পাওয়া যেত।
এর ওপর ছিল পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা, গুটিদাঁড়া খেলার প্রতিযোগিতা। তেঁতুল কাঠের সার দিয়ে পিংপং-এর বলের মতো আকারের কালো কুচকুচে বল তৈরি হত। সেই বলটিকে মারবার জন্যে কাঁচা বাঁশ দিয়ে তৈরি হত দাঁড়া অর্থাৎ ব্যাট। ক্রিকেট খেলার সঙ্গে এর তুলনা চলে। রজনী ডাক্তার প্রচন্ড জোরে বল পিটাতেন, ক্রিকেটের ওভার বাউণ্ডারির চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হত তা।
গ্রামেই ছিল বাজার। গ্রামেই ছিল পোস্ট-অফিস। তা ছাড়া রক্ষাকালী, শ্মশানকালীর বাড়ি। রক্ষাকালীর বাড়ির পুজোয় মহিষ-বলির পর দড়ি কে নেবে তা নিয়ে লেগে যেত পাড়ায় পাড়ায় প্রতিযোগিতা। যে পাড়া দড়ি পাবে সে-ই জয়ী সাব্যস্ত হবে। দত্তবংশের দাতা গোপীনাথ দত্তের নাম না করলে কালীকচ্ছের কথা বলা শেষ হয় না। অবশ্য শেষ কোনো দিনই হবে না। জন্মভূমির কাহিনি কবে আর শেষ হয়? সে যাক– গোপীনাথ দত্তের কথাই বলি। গোপীনাথ পুকুর থেকে স্নান করে ফিরছেন। হঠাৎ এক ভিখারি এসে সামনে দাঁড়াল। গোপীনাথের কাছ থেকে সে কিছু চায়। দেবার মতো কিছুই ছিল না গোপীনাথের। কিছুক্ষণ ভাবলেন গোপীনাথ। তারপর গামছাটি পরে কাপড়টি দিয়ে দিলেন ভিখারিকে।