ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ – জুলিয়ার এজাহার
কুমারটুলির মিত্রদিগের বাড়ীতে বড় জাঁকের পূজা। ঝাড়, লণ্ঠন, আয়না, তীরে পুরীর বিচিত্র শোভা সম্পাদিত হইয়াছে। চতুষ্কোণ উঠানের এককোণে একটা একমণ ওজনের মতিচূর, এককোণে গরুর গাড়ীর চাকার মত একখানা জিলাপী, আর এককোণে সুদর্শন চক্রের মত একখানা খাজা এবং অপরকোণে ধবলগিরির ন্যায় একটা প্রকাণ্ড ধবধবে মণ্ডা রচনারূপে বিলম্বিত রহিয়াছে। নগরবাসিগণ নবমীর বলিদান দেখিবার নিমিত্ত তথায় সমাগত হইয়াছে। বেলা দশটা বাজে, বলিদানের আর বড় দেরি নাই, অসংখ্য লোকের ‘মা, মা’ ধ্বনিতে গগন বিদীর্ণ হইতেছে, এমন সময়ে সংবাদ আসিল, “আহিরীটোলার ঘাটে চারিটি শব ভাসিয়া আসিয়াছে। নৌকাডুবি হইয়া তাহারা মারা পড়িয়াছে।” এইকথা শুনিবামাত্র হুজুগ্প্রিয় নাগরিকগণ পূজাবাড়ী পরিত্যাগপূর্ব্বক পিল পিল্ করিয়া ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইল। সকলে দেখিল, জামা-জোড়া পরা চারিজন মৃত মুসলমানকে ঘেরিয়া, দারোগা জমাদার এবং চারিজন চৌকীদার দাঁড়াইয়া আছে এবং একটি বৃদ্ধা মুসলমানী বক্ষে করাঘাত করিয়া উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিতেছে। ঘাটে মহাজনতা হইল, অনেকে মৃত মুসলমানদিগকে চিনিতে পারিল। প্রচার হইয়া পড়িল—বাইজী জুলিয়া কোথায় নাচিতে গিয়াছিল, ফিরিবার সময়ে নৌকাডুবি হইয়া সসম্প্রদায় মারা গিয়াছে; মৃত চারিজন মুসলমান, তাহারই সম্প্রদায় ভুক্ত।
বৃদ্ধা কাঁদিতেছে, অনেকে অনেক কথা কহিতেছে, কেহ জুলিয়ার রূপের, কেহ তাহার নৃত্যের, কেহ তাহার স্বর-লালিত্যের, কেহ বা তাহার সঙ্গীত নৈপুণ্যের প্রশংসা করিতেছে। এমন সময়ে একখানি নৌকা তরতর বেগে ঘাটে আসিয়া লাগিল এবং একটি পরমরূপবতী রমণী তরণী হইতে তীরে অবতীর্ণ হইল। “এই যে জুলিয়া, এই যে জুলিয়া,” এই কথা সকলের মুখ হইতে যুগপৎ বিনির্গত হইল, মহাকোলহল ও হুড়াহুড়ি হইয়া উঠিল।
“কৈ আমার জুলিয়া কৈ, মা আমার কৈ,” বলিয়া বৃদ্ধা ছুটিয়া গিয়া কন্যাকে বক্ষে ধারণ করিয়া শিরক্ষুম্বন করিল। কন্যা ও জননী উভয়ে উভয়ের বক্ষঃস্থল নয়নজলে প্লাবিত করিতে লাগিল। সে দৃশ্য দেখিয়া না কাঁদিয়া কেহই থাকিতে পারিল না।
জমাদার জুলিয়াকে জিজ্ঞাসিল, “কি প্রকারে তোমার প্রাণ রক্ষা হইল, নৌকা কোথায় ডুবিয়াছিল?”
জুলিয়া। ঈশ্বর আমায় রক্ষা করিয়াছেন। নৌকাডুবির কথা কি বলিতেছেন, বুঝিতে পারিলাম না।
দারোগা। তবে ঐ সকল ব্যক্তি কি জলমগ্ন হইয়া মরে নাই, আইস, দেখ দেখি, ইহাদিগকে তুমি চিনিতে পার?
জুলিয়া নিজ অনুচরদিগকে মৃত দেখিয়া, বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়া ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া রহিল, পরে বসনাঞ্চলে নয়ন মুছিয়া দৃঢ়স্বরে বলিল, “আমার বেশ বোধ হইতেছে, ইহারা নৌকাডুবি হইয়া মরে নাই। সয়তান ইহাদিগকে হত্যা করিয়া জলে ভাসাইয়া দিয়াছে। মা, এমন বাড়ীতেও তুমি আমায় মজুরা করিতে পাঠাইয়াছিলে, আমি বাঁচিয়া আসিব, এমন আশা আমার ছিল না।
বৃদ্ধা। অ্যাঁ একি! হাঁ মা—তোর সব গহনা কৈ?
জুলিয়া। গহনার জন্যেই ত মা, আমার এই বিপদ ঘটেছে।
বৃদ্ধা। অ্যাঁ! আমি যমের বাড়ীতে মেয়েকে আমার মজুরা করিতে পাঠাইয়াছিলাম; রাঘব সেন যে ডাকাত, তা আমি কেমন করিয়া জানিব?
দারোগা। গঙ্গাপুরের রাঘব সেন?
জুলিয়া। হাঁ।
দারোগা। রাঘব সেন ইহাদিগকে হত্যা করিয়াছে?
“আমার বড় কষ্ট হইতেছে, এখন আমি কিছু বলিতে পারিব না,” বলিয়া জুলিয়া গঙ্গা হইতে এক অঞ্জলি জল লইয়া পান করিল।
দারোগার আদেশ মত একজন চৌকীদার দুইখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া আনিল, একখানিতে জুলিয়া ও তাহার জননীকে তুলিয়া দিয়া, অপরখানিতে দারোগা ও জমাদার উঠিয়া বসিল। দুইজন চৌকীদার গাড়ীর পশ্চাদ্দেশে দণ্ডায়মান হইলে, দারোগা ডাকিয়া বলিল, “পাঁচী ধোপানীর গলি।” শকটদ্বয় দক্ষিণাভিমুখে চলিল, ঘাটের জনতা চারিদিকে বিকীর্ণ হইয়া গেল। দুইজন মাত্র চৌকীদার তথায় শবের নিকট দাঁড়াইয়া রহিল।
আরোহিগণ নানা প্রকার কৌতুক ও তামাসা দেখিতে দেখিতে পথ অতিবাহিত করিতে লাগিল। ক্রমে যানদ্বয় পূর্বোল্লিখিত ঠিকানায় একখানি দ্বিতল বাটীর সম্মুখে আসিলে দারোগা নন্দলাল রায় গাড়ী থামাইতে বলিলেন। সকলে গাড়ী হইতে নামিয়া, গাড়োয়ানকে ভাড়া চুকাইয়া দিয়া বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলেন।
বাড়ীটি ক্ষুদ্র, অথচ বেশ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। জুলিয়া জননী সহ উপরিতলে উঠিয়া গেল, একজন বেহারী চাকর নিম্নতলে একখানি আসন বিছাইয়া দিয়া, তামাক সাজিয়া একটা হুকা দারোগার হাতে ও অপর একটা চৌকীদারদিগকে দিল।
অর্দ্ধঘণ্টা পরে সকলে বিশ্রাম করিলে, দারোগা ডাকিয়া বলিল, “আপনাদিগের একবার নীচে আসিতে হইবে।”
জুলিয়া সুবর্ণমণ্ডিত একটা হুকায় তামাক খাইতে খাইতে বারাণ্ডায় আসিয়া বলিল, “আপনি উপরে আসুন।”
দারোগা মহাশয় দ্বিতলোপরি উঠিয়া গেলেন। “এই চৌকীতে বসুন,” বলিয়া জুলিয়া দারোগার অভ্যর্থনা করিল। দারোগা উপবেশন করিলে, জুলিয়া ও তাহার জননী নিকটে অপর দুইখানি চৌকীতে বসিল।
দারোগা জুলিয়াকে বলিলেন, “বোধ হয়, তুমি একটু সুস্থ হইয়াছ, এখন বল দেখি, ব্যাপারটা কি। তোমার গায়ে কত টাকার গহনা ছিল?”
বৃদ্ধা। বাবা! আমরা মায়ে-ঝিয়ে চিরকাল মজুরা করিয়া যাহা কিছু উপার্জ্জন করিয়াছি, সে সমস্তই এই বাড়ীটুকুতে আর সেই গহনাগুলিতে দিয়াছি। বাবা, তোমায় বলিব কি, তেমন গহনা অনেক বড় মানুষের ঘরেও নাই।
দারোগা। রাঘব সেন তোমার গহনা অপহরণ করিয়াছে?
জুলিয়া। সমস্ত কথা বলিতেছি, আপনি শুনুন। আমি কাল সকালে আন্দাজ বেলা আটটার সময়ে, রাঘব সেনের বাগানবাড়ীতে আমার সমস্ত গহনাগুলি খুলিয়া স্নান করিব বলিয়া, চুল এলাইতেছি, এমন সময়ে বাবুর একজন চাকর আসিয়া বলিল, ‘আপনি, আপনার কাপড়-চোপড় যাহা কিছু আছে, লইয়া আমার সঙ্গে চলুন। এ ঘরে কয়েকজন কলিকাতার বাবু আসিয়া থাকিবেন।’ আমি বলিলাম, ‘আমার লোকজন সব বাহিরে গিয়াছে, এ সব জিনিষপত্র লইয়া যাবে কে, এখন ত আমি যাইতে পারি না।’ সে উত্তর করিল, ‘আপনি কেবল ঐ বাক্সটি লইয়া আমার সঙ্গে আসুন, আপনাকে রাখিয়া আসিয়া, এ সব জিনিষপত্র আমি ক্রমে ক্রমে লইয়া যাইব।’ আমি আর কোন কথা না বলিয়া গহনার বাক্স মাত্র লইয়া, তাহার পিছনে পিছনে গেলাম। বাবুর প্রকাণ্ড বাগান, ঘুরিয়া ফিরিয়া, কতদূর গিয়া একটা ঝোপের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই নিৰ্জ্জন স্থানে রাঘব সেন একাকী একখানি পাথরের চৌকীতে বসিয়াছিল, আমরা উপস্থিত হইবামাত্র, সে কি ইসারা করিল, অমনি চাকর আমার মুখ চাপিয়া ধরিল, আর রাঘব সেন আমার বাক্সটি কাড়িয়া লইয়া, সেই ঝোপের ভিতর একটা চাপা কপাট তুলিয়া একটা সুড়ঙ্গ পথে প্রবেশ করিল। সেই চাকর আমাকেও তাহার মধ্যে লইয়া গেল। যেখানে আনিয়া আমাকে ছাড়িয়া দিল—সে অতি ভয়ঙ্কর স্থান—বোধ হইল, যেন আমি যমালয়ে আসিলাম। চাকর চলিয়া গেল, কেবল রাঘব সেন আর আমি সেইখানে রহিলাম। ভাবিতে লাগিলাম, কেন আমায় এখানে আনিল? কেন আমার গহনার বাক্স লইল? আমাকে কি মারিয়া ফেলিবে? আমার বড় ভয় হইল, আমি কাঁদিতে লাগিলাম। রাঘব সেন আমার পিঠে হাত বুলাইয়া জিজ্ঞাসিল, ‘তুমি কাঁদিতেছ কেন?’ আমি কাঁদিতে কাঁদিতে উত্তর করিলাম, ‘আমি বাড়ী যাইব, মায়ের জন্য আমার মন কেমন করিতেছে।’ রাঘব সেন বলিল, ‘তুমি বাড়ী গেলে, তোমার জন্য যে আমার প্রাণ কেমন-কেমন করিবে, প্রাণ থাকিতে তোমাকে আমি বিদায় দিতে পারিব না।’ আমি হতাশ হইয়া ‘আমায় ছাড়িয়া দাও,’ বলিয়া তাহার পায়ে জড়াইয়া কাঁদিতে লাগিলাম, এমন সময় বোধ হইল, বাহিরে যেন ঢাক-ঢোল বাজিতেছে। “এখন তুমি এইখানে থাক, আর এক সময় আসিয়া তোমার সঙ্গে দেখা করিব,” বলিয়া রাঘব সেন চলিয়া গেল। তখন আমার একটু ভরসা হইল, কাপড়খানা আঁটিয়া পরিয়া, আঁচলটা বেশ করিয়া কোমরে জড়াইয়া, পলাইবার পথ দেখিতে লাগিলাম; কিন্তু কোন দিকেই রাস্তা পাইলাম না। রাঘব সেন যে দিকে গিয়াছিল, সে দিকেও বাহিরে যাইবার পথ দেখিতে পাইলাম না। হতাশ ও হতবুদ্ধি হইয়া বসিয়া পড়িলাম, তখন ভয় ও দুর্ভাবনায়, আমার মনের মধ্যে যে কি ভয়ানক যন্ত্রণা হইতে লাগিল, তাহা বলিয়া জানাইতে পারি না। বিছা কামড়াইলে লোকে যেমন জ্বালায় অস্থির হয়, আমি সেইরূপ ছট্ফট্ করিতে লাগিলাম। এইরূপ অবস্থায় সমস্তদিন কাটিয়া গেল, একটু একটু যাহা কিছু দেখা যাইতেছিল, তাহাও ক্রমে অন্ধকারে মিশিয়া গেল। ক্রমে ঘোর অন্ধকার হইল, চারিদিকে কি যেন, একপ্রকার ভয়ঙ্কর শব্দ হইতে লাগিল। আমার অত্যন্ত ভয় হইল, আমি চক্ষু মুদিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া রহিলাম। ক্রমে আমার একটু তন্দ্রা আসিল। বোধ হইল, নিকটে যেন পায়ের শব্দ হইল; আমি শিহরিয়া উঠিলাম, চাহিয়া দেখিলাম, রাঘব সেন একাকী একটা প্রদীপ লইয়া আসিতেছে। আমি তাহাকে দেখিয়া পুনর্ব্বার চক্ষু মুদিলাম; রাঘব সেন আমার নিকটে আসিয়া আমার গায়ে হাত দিল। আমি সৰ্ব্বাঙ্গে কাপড় জড়াইয়া উঠিয়া বসিলাম। রাঘব সেন বলিল ‘দেখ জুলিয়া, তোমার অলঙ্কার গুলিতে আমার লোভ হইয়াছিল, তাই সেগুলি আমি লইয়াছি। তোমার প্রতি আমার মোহ জন্মিয়াছে, তাই তোমায় এখনও জীবিত রাখিয়াছি; নতুবা এতক্ষণ এইখানে তোমায় পুঁতিয়া ফেলিতাম। দয়া-ধর্ম্ম আমার নাই। তোমার অত্যন্ত অল্প বয়স, তুমি অত্যন্ত সুন্দরী, তোমার তুল্য সুমধুর কণ্ঠস্বর কেহ কখন শুনে নাই, তাই তোমায় হত্যা করিতে ইচ্ছা হইতেছে না। তোমাকে যাবজ্জীবন এইস্থানে থাকিতে হইবে। তুমি যাতে কোন কষ্ট না পাও, অবশ্য তাহার বন্দোবস্ত করিয়া দিব।’ এইকথা শুনিবামাত্র আমার মস্তকে যেন বজ্রাঘাত হইল। আমি কাঁদিতে লাগিলাম। এই সময় কাল মুষ্ক গেঁটে-গোঁটা একটা মন্েিস হাঁপাইতে হাঁপাইতে সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাঘব সেন তাহাকে দেখিয়া বলিল, “কিরে ক্ষুদে, কি হয়েছে?’ সে বলিল ‘রেসমের গুদামের চাবিটা চাই; ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয় আমায় পাঠাইয়া দিলেন; তিনি দেওয়ান গোবিন্দরামের বাড়ীতে আছেন।’ এইকথা শুনিয়া রাঘব সেন তাহার সহিত চলিয়া গেল। পুনর্ব্বার সেই যমালয় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইল। আমি অচেতন হইয়া পড়িলাম। পরে যখন আমার চৈতন্য হইল, দেখিলাম, গঙ্গাতীরে একটি স্ত্রীলোকের কোলে মাথা দিয়া শুইয়া আছি, তখন ভোর হইয়াছে, আমি চমকিয়া, উঠিয়া বসিলাম। সে স্ত্রীলোকটি বলিল, ‘ভয় কি!’ আমি তাঁহাকে কিছু বলিতে পারিলাম না, কেবল তাঁহার পায়ে মাথা রাখিয়া কাঁদিতে লাগিলাম, সেই কৃষ্ণবর্ণা আলুলায়িতকেশা প্রসন্নবদনা কামিনী একখানি নৌকায় আমায় তুলিয়া দিলেন, আমি কলিকাতায় আসিলাম।
বৃদ্ধা সজলনয়নে কন্যাকে জিজ্ঞাসিল, “হাঁ মা, তিনি কে? তুমি তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করিলে না?”
জুলিয়া। মা, সে সময়ে আমার কি বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছু ছিল?
দারোগা এই সকল কথা লিখিয়া লইয়া অনুচরগণসহ তথা হইতে চলিয়া গেল।