ত্রয়োদশ অধ্যায়—দেবীমাহাত্ম্য সম্পূর্ণ
ঋষি কহিলেন, হে রাজন! আপনার নিকট আমি এই উত্তম দেবী-মাহাত্ম্য বলিলাম। যিনি এই জগৎকে ধারণ করিয়া আছেন, তাঁহার প্রভাব এইরূপ। সেই ভগবতী বিষ্ণুমায়াই তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করিয়া থাকেন, তিনিই তোমাকে, এই বৈশ্যকে ও অন্যান্য বিবেকী ব্যক্তিগণকেও মোহিত করেন ও করিয়াছেন; এবং তাঁহার দ্বারাই ভবিষ্য ব্যক্তিগণ মোহিত হইবেন। হে মহারাজ! সেই ভগবতী পরমেশ্বরীরই শরণাপন্ন হউন। তাঁহার আরাধনা করিলেই মনুষ্যগণকে তিনি ভোগ, স্বর্গ এবং মুক্তি প্রদান করিয়া থাকেন। মার্কণ্ডেয় কহিলেন,—হে মহামুনে (মুনি ক্রৌষ্টুকি)! অতিশয় মমতা এবং রাজ্যাপহরণ জন্য নিতান্ত দুঃখিত সেই নরাধিপ সুরথ, ঋষির এই বাক্য শ্রবণান্তর কঠোরব্রত-সম্পন্ন মহাভাগ সেই ঋষিকে প্রণাম করিয়া তৎক্ষণাৎ তপস্যার নিমিত্ত গমন করিলেন। আর সেই বৈশ্যও ঐরূপে তপস্যার্থ গমন করিল। সেই রাজা এবং সেই বৈশ্য নদীপুলিনে (নদীতীরে) অবস্থান করিয়া ভগবতীর দর্শনার্থ উৎকৃষ্ট দেবীসূক্ত (ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৫তম সূক্ত, পরিশিষ্ট দেখুন) জপ করত তপস্যায় রত হইলেন। ১–৬
বৈশ্য এবং রাজা সেই পুলিনে (নদীতীরে) দেবীর মৃণ্ময়ী মূর্ত্তি গঠন করিয়া পুষ্প, ধূপ এবং হোমাদি দ্বারা পূজা করিলেন। তাঁহারা কখন নিরাহারে, কখন বা নিয়মিতাহারে তদ্গতচিত্ত এবং সমাহিত হইয়া নিজ নিজ দেহের রক্তযুক্ত বলি প্রদান করিলেন। এইরূপে সংযতচিত্ত হইয়া তিন বৎসর আরাধনা করিলে পর জগদ্ধাত্রী চণ্ডিকা পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাদের প্রত্যক্ষে (আবির্ভূতা হয়ে) বলিতে লাগিলেন,—“হে রাজন্! তুমি যাহা প্রার্থনা করিতেছ এবং হে কুলনন্দন বৈশ্য! তুমিও যাহা প্রার্থনা করিতেছ, তোমরা আমার নিকট হইতে তৎসমস্ত প্রাপ্ত হও, আমি পরিতোষ সহকারে তাহা প্রদান করিতেছি।” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, অনন্তর নৃপতি পরজন্মে অস্খলিতরাজ্য (যে রাজ্য চ্যুত হয় না, অর্থাৎ পরজন্মে রাজা যেন কখন রাজ্যচ্যুত না হন) এবং এই জন্মে বলপ্রকাশপূর্ব্বক শত্রু বধ করিয়া যাহাতে নিজ রাজ্য লাভ হয়, এইরূপ বর প্রার্থনা করিলেন। আর নির্ব্বিণ্ণচিত্ত (নির্ব্বেদপ্রাপ্ত অর্থাৎ সংসারের অসারত্ব উপলব্ধি করে বিরক্ত, উদাসীন ও আসক্তিহীন) প্রাজ্ঞ সেই বৈশ্যও “ইহা আমার” এবং “এই আমি” এইরূপ অভিমানমূলক সঙ্গবিচ্যুতিকারী জ্ঞান (মমতার কারণ যে আসক্তি, তার বিনাশ হতে পারে এমন জ্ঞান) প্রার্থনা করিলেন। ৭–১২
দেবী কহিলেন,—“হে নৃপতে! তুমি অল্প দিনের মধ্যেই শত্রুকূল নির্ম্মূল করিয়া নিজ রাজ্য প্রাপ্ত হইবে এবং তৎপরে তোমাকে আর রাজ্যভ্রষ্ট হইতে হইবে না। পশ্চাৎ মৃত্যুর পরে সূর্য্যদেব হইতে উৎপত্তি লাভ করিয়া (দেহাবসানের পরে পুনরায় জন্মগ্রহণ করে) পৃথিবীতে সাবর্ণি নামে বিখ্যাত মনু হইবে। হে বৈশ্যশ্রেষ্ঠ! তুমিও আমার নিকট যে বর প্রার্থনা করিলে, তোমার সিদ্ধির নিমিত্ত তাহা তোমাকে প্রদান করিতেছি; তোমার জ্ঞান হইবে।” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, দেবী তাঁহাদিগকে এইরূপে যথাভিলষিত (যেমন চেয়েছে তেমন) বর প্রদান করিয়া তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হইলেন। অন্তর্হিত হইবার পূর্ব্বে তাঁহারাও (রাজা ও বৈশ্য) ভক্তিপূর্ব্বক (দেবীর) স্তব করিয়াছিলেন। এইরূপে ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ সুরথ দেবীর নিকট হইতে বর প্রাপ্ত হইয়া সূর্য্যদেব হইতে উৎপত্তি লাভ করত পৃথিবীতে সাবর্ণি নামে মনু হইবেন। ১৩–১৭
ত্রয়োদশ অধ্যায় সমাপ্ত॥১৩॥
—