ত্রয়োদশ অধ্যায় – জেনারেল জিয়ার হত্যা পর্ব

১৩. জেনারেল জিয়ার হত্যাপর্ব

‘কাজটা এখনই করতে হবে। কিভাবে করবে, কি দিয়ে করবে, তা আমি জানি না ——।’

-মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর

.

‘ভাগ্যের লিখন, না যায় খন্ডন।’ ভাগ্যই জেনারেল জিয়াকে ঘটনার রাতে মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা রাজশাহীতে থাকতে দেয়নি। মরণের অমোঘ নির্দেশেই ছুট যান বন্দর নগরী চট্টগ্রামে।

১৯৮১ সাল। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া আর তাঁর স্ত্রী খালেদা (ডাক নাম পুতুল) বেলজিয়ামের রাজা বাদুইন এবং তাঁর সুন্দরী স্ত্রী, রাণী ফ্যাবিওলাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির পূর্ণ মর্যাদায় বাংলাদেশে স্বাগত জানান। এর আগে বহু রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী এদেশ সফরে এলেও বাস্তব জীবনের রাজা-রাণী এদেশে খুব কমই এসেছেন। সুতরাং তারা চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এলে, তাদেরকে পূর্ণ রাজকীয় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বেলজিয়ামের রাজা-রাণী বাংলাদেশে সফর শেষ করে ২৩ তারিখে তাঁরা ঢাকা ত্যাগ করেন। পরদিন জেনারেল জিয়ার জেদ্দা যাবার কথা। ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত শান্তি কমিটির ঐ সভায় ইরান-ইরাক যুদ্ধ নিয়ে একটা সমঝোতায় পৌছানোর উদ্দেশ্যে সংস্থার সদস্য ও সংশ্লিষ্টদের জেদ্দায় মিলিত হবার পরিকল্পনা ছিলো, কমিটির ২৫ তারিখে মিলিত হবার কথা। নির্ধারিত সময়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে, তেহরান আর বাগদাদ ইত্যাদি সফর সমাপন করে দেশে ফিরে আসতে তাঁর এক সপ্তাহের বেশী সময় লেগে যেতো। তাহলে ঐ ২৯ তারিখ বা তার পরেও তাকে দেশের বাইরে অবস্থান করতে হতো। কিন্তু জেদ্দার সম্মেলন অজানা কোন কারণে স্থগিত ঘোষিত হলে, জেনারেল জিয়া তাঁর বিদেশ সফর বাতিল করেন। তার পরিবর্তে তিনি রাজশাহী জেলা পরিদর্শনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সাদিকুর রহমান চৌধুরীকে ২৯ তারিখের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু ঐ সফরের পরিকল্পনাও তাকে বাতিল করতে হয়। চট্টগ্রামে তখন পরিস্থিতি খুবই খারাপ আকার ধারণ করে। তাঁর বিএনপি তখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ঐ দু’ভাগের মধ্যে বিরোধিতা চরমে পৌঁছে। একটি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন উপ-প্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিন আহমেদ আর একটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ডেপুটি স্পীকার সুলতান আহমেদ চৌধুরী। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে চলে যায়, যখন জিয়া অনুভব করলেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তাকেই সেখানে যাওয়া উচিত। ২৫শে মে জেনারেল জিয়া তাঁর মিলিটারী সেক্রেটারীকে তাঁর রাজশাহী সফরসূচী বাতিল করতে নির্দেশ দেন। এর পরিবর্তে ২৯ তারিখে তাঁর চট্টগ্রামে যাবার ব্যবস্থা করতে বলে দেন।

এ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিপাকে পড়ে। যেদিন জিয়া তাঁর চট্টগ্রাম যাবার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন, সেদিনই তনি চট্টগ্রামের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) মেজর জেনারেল এম, এ, মঞ্জুরকে ঢাকায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের কমান্ডান্ট হিসেবে বদলির আদেশ জারি করেন। জেনারেল মঞ্জুর একজন উচ্চাভিলাষী এবং বেয়াড়া গোছের জেনারেল হিসেবে সুপরিচিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বকনিষ্ঠ জেনারেল হলেও তার সামাজিক জীবনে এই প্রথমবারের মত সৈন্যদের কমান্ড করা থেকে দূরে সরানোর ব্যবস্থা করা হয়।

জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রামে জিওসি হিসেবে সাড়ে তিন বছর থাকার পরেও তার বদলিতে তিনি খুশী হতে পারেননি। তারপর ২৯ তারিখে জেনারেল জিয়া পতেঙ্গা বিমান বন্দরে আসলে সেখানে জেনারেল মঞ্জুরকে উপস্থিত থাকতে মানা করে দেয়া হয়। এ নির্দেশটি জেনারেল মঞ্জুরের কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত কাজ করে। স্থানীয় গ্যারিসন কমান্ডার হিসেবে প্রেসিডেন্টের আগমনে উপস্থিত থাকা প্রটোকল ডিউটি হলেও, প্রেসিডেন্টের ঐ সফরকে একটি রাজনৈতিক সফর বলে আখ্যা দিয়ে ঐ রাজনীতির সঙ্গে জিওসিকে না জড়ানোর উদ্দেশ্যেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে মঞ্জুরকে জানানো হয়। কিন্তু মঞ্জুর এ সিদ্ধান্তকে একটি অপমান বলে মনে করেন। আসলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত মনে করার কারণও ছিলো। অন্যান্য সামরিক কমান্ডাররা ঠিকই ঐ সময় উপস্থিত থাকছেন। নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এ্যাডমিরাল এম. এ. খান প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হয়ে আসছেন। আর বিমান বাহিনীর প্রধানও প্রেসিডেন্টকে সম্বর্ধনা জানানোর জন্যে পতেঙ্গা বিমান বন্দরে উপস্থিত থাকছেন। অথচ মঞ্জুরকে আসতে মানা করা হলো। এসব ব্যাপারে মঞ্জুর রেগে একেবারে আগুন হয়ে যান এবং তার এই ক্ষোভকে মনের ভেতর লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি। স্বয়ং জেনারেল এবং তার সহকারীরা ঢাকায় প্রেসিডেন্টের মিলিটারী সেক্রেটারীকে বারবার ঠেলিফোন করে পতেঙ্গা বিমান বন্দরে প্রেসিডেন্টের সম্বর্ধনা কমিটি থেকে তাকে বাদ দেয়ার কারণ জানতে চাওয়া হচ্ছিলো। শেষে বিরক্ত হয়ে মেজর জেনারেল সাদিকুর রহমান চৌধুরী মঞ্জুরকে বলেন : আপনি কি কিছুই বুঝতে পারছেন না? তিনি (জিয়া) যদি আপনাকে সেখানে দেখতে না চান, তাহলে ‘আপনি কেন যেতে চাচ্ছেন?’

মেজর জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরী তখন সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজিএফআই)। তিনি বারবার জেনারেল জিয়াকে অন্ততঃ ১লা জুন পর্যন্ত তাঁর চট্টগ্রাম সফর স্থগিত রাখার উপদেশ দেন। ঐ তারিখের মধ্যে জেনারেল মঞ্জুরকে ঢাকায় তার নতুন পদে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। আমার জানা মতে এনএসআই (ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স) এবং সেনাবাহনীর গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকও একই সুপারিশ করেছিলো। কিন্তু জিয়া তাদের সকল পরামর্শ উপেক্ষা করেন। তাঁর যাত্রার প্রাক্কালে ডিজিএফআই রাত্রটি চট্টগ্রামে না কাটিয়ে তাকে ঢাকায় ফিরে আসতে অনুরোধ জানান। কিন্তু সে অনুরোধও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। সম্ভবতঃ জিয়া মনে করেছিলেন যে, তিনি জেনারেল মঞ্জুরকে বশ করতে পারবেন এবং তিনি হয়তো ঐ মেজর জেনারেলকে তাঁর জীবনের প্রতি হুমকি হতে পারেন বলে মনে করেননি। এতবেশী সতর্ক আর সন্দেহপরায়ণ প্রেসিডেন্টের জন্যে এটা ছিলো একটি মারাত্মক ভুল। জীবন দিয়ে তাকে তাঁর সে ভুলের মাশুল দিতে হয়েছিলো।

জিয়া এবং মঞ্জুর অনেকদিন ধরেই সামরিক জীবনে পাশাপাশি কাজ করে এসেছেন। কিন্তু সম্মান আর সৌভাগ্য সব সময়ই জিয়াকে ঘিরে রেখেছিলো। অথচ, মঞ্জুরকে সব সময়ই তাঁর পেছনে থাকতে হয়েছে। মঞ্জুরের পিতা ছিলেন একজন স্বল্পবিত্ত কেরানী। তিনি তাঁর নিজ জেলা নোয়াখালী ছেড়ে ভারতে অবস্থিত পশ্চিবঙ্গের কৃষ্ণনগরে চলে আসেন। মঞ্জুর সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সেই তার মা মারা যান। তাঁর উচ্চভিলাষী স্ত্রী, তাঁর উপর যথেষ্ট প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলো। জিয়া হত্যার ব্যাপারে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিশন তদন্ত করে জানান যে, মঞ্জুরের ক্ষমতায় আরোহণের ব্যাপারে মিসেস মঞ্জুর ‘চালিকা শক্তি’ হিসেবে কাজ করেন।

মঞ্জুর সারগোদায় পাকিস্তান এয়ার ফোর্স কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে কাবুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে যোগদান করেন। সামরিক বিদ্যায় সেখানে তিনি মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হন। তার সামরিক ‘ক্যারিয়ার’-এর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্বের মাঝে কানাডার ‘ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজে’-এ যোগদান ও কৃতিত্বের সঙ্গে বেরিয়ে আসা উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অন্যান্য অনেক বাঙ্গালী অফিসারের মতো জেনারেল মঞ্জুরও পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়ে যান। কিন্তু তিনি সৌভাগ্যক্রমে তখন শিয়ালকোটে অবস্থান করছিলেন। শিয়ালকোট ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমারেখার একেবারে কাছাকাছি অবস্থিত। মঞ্জুর তাঁর স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে চেষ্টা চালান। প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বারে মঞ্জুর তাঁর পরিবার-পরিজন সঙ্গে নিয়ে কাশ্মীর বর্ডার দিয়ে জম্মুতে এসে উপস্থিত হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে যাদের নাম খোদিত হয়ে থাকবে, এমন দু’জন অফিসার তার সঙ্গে ছিলো। একজনের নাম লেঃ কর্নেল আবু তাহের। তিনি ১৯৭৫-এর নভেম্বরে সিপাহী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলেন। অন্যজনের নাম লেঃ কর্নেল জিয়াউদ্দিন। তিনি ছিলেন মাওবাদী সর্বহারা পার্টির কিংবদন্তীর নেতা। তিনজনের সকলেই তখন মেজর। মঞ্জুর তাদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী উদ্ধৃত মেজাজের লোক ছিলেন। একজন ভারতীয় সরকারের অফিসার মঞ্জুর এবং তার সঙ্গীদেরকে জম্মুতে অভ্যর্থনা জানায় এবং ট্রেনে তুলে প্রহরার মাধ্যমে তাদেরকে প্রথমে নয়া দিল্লী এবং পরে কলকাতায় নিয়ে যান। ট্রেনে থালায় করে তাদেরকে খাবার পরিবেশন করা হলে, মঞ্জুর যে বদমেজাজের পরিচয় দেন, ঐ অফিসার তার বর্ণনা দেয়। ভারতীয় অফিসারের ভাষায়, দু’রকমের ডাল, কিছু সবজি আর কয়েকটা ‘পুরি’ সমেত ‘নিরামিষ খানা’ তাদের জন্যে পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হলো। খাবারগুলো থালায় করে আনা হয়েছিলো। মঞ্জুর থালাগুলো হাতে নিলেন এবং চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমরা সামরিক অফিসার। ওসব আজেবাজে জিনিস না দিয়ে, উপযুক্ত খাবার পরিবেশন করতে হবে। আর, ঐ খাবারাদি ছুরি, কাঁটা চামচ ইত্যাদিসহ বাসনে দিতে হবে।’ সুতরাং পরের স্টেশনে গাড়ী নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত থেমে থাকতে বাধ্য হয়। যাতে করে রেলওয়ে ক্যাটারার কিছু মুরগীর তরকারী, বাসনপত্র এবং কাটলারীর বন্দোবস্ত করে নেয়।

আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করছি যে, আমি সে সময়ে মঞ্জুরের সঙ্গী আবু তাহের আর মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। তিন মেজর কলকাতায় পৌঁছালে, তাদেরকে মুজিবনগর সরকারের সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। মঞ্জুরকে দেয়া হয়েছিলো ৮ নং সেক্টরের (যশোর) দায়িত্ব। স্বাধীনতার পর অতি দ্রুতগতিতে পদোন্নতি পেয়ে মেজর থেকে ব্রিগেডিয়ার হলে, তাকে বাংলাদেশ হাই কমিশনারের সামরিক উপদেষ্টা করে নয়া দিল্লীতে পাঠানো হয়।

সিপাহী বিদ্রোহের পর আবু তাহের গ্রেফতার হলে, মঞ্জুর খ্যাতিমান হয়ে উঠতে থাকেন। ১৯৭৫-এর নভেম্বরে চীফ অব জেনারেল স্টাফ হবার জন্যে জিয়া তাকে ঢাকায় ডেকে পাঠান। ঐ সময় তাঁদের দু’জনের মধ্যে অত্যন্ত সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। জিয়া তাকে বিশ্বাসও করতেন অনেক বেশী। সেজন্যেই অত্যন্ত নাজুক পদটি দেয়ার জেন্যে জিয়া মঞ্জুরকে দিল্লী থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু এরপরও মঞ্জুর একটি উচ্চাভিলাষের বীজ তাঁর মনের এক কোণে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

১৯৭৭ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় সিপাহী বিদ্রোহের পরে, জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীতে বিরাট রদবদল/পুনর্গঠন করেন। চীফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে মঞ্জুর ঐ রদবদল/পুনর্গঠন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। কিন্তু তারপরে, ঊর্ধ্বতন সেনাবাহিনী কমান্ডে রদবদলের এ পর্যায়ে দেখতে পান যে, মঞ্জুর নিজেই অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। তাকে চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার এবং চট্টগ্রামস্থ ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) করে বদলি করা হয়। তাঁর বুঝতে বাকী রইলো না যে, তাকে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ঢাকাস্থ ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের কমান্ডান্ট করে তাকে ঢাকায় রাখার জন্যে তিনি জেনারেল জিয়াকে অনুরোধ করেন। কিন্তু জিয়া তাঁর অনুরোধ রাখেননি। তাতে মঞ্জুর খোলাখুলিভাবে জিয়ার প্রতি তার ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। জেনারেল জিয়া বিদায়ী চীফ অব জেনারেল স্টাফের সম্মানে এক বিদায়ী ভোজসভার আয়োজন করেন। ঐ ভোজসভায় মঞ্জুর ও তার স্ত্রী অনুপস্থিত থেকে তাঁর ক্ষোভের প্রকাশ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটান। (সাড়ে তিন বছর পরে জিয়া তাকে ঐ পদে নিয়োগ করলে, মঞ্জুর অত্যন্ত ক্ষেপে যান, যার ফলশ্রুতিতে জিয়ার মৃত্যু ঘটে।)

পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয়দের রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার সুযোগ নিয়ে মঞ্জুর ঐ এলাকায় এক ক্ষুদ্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন নতুন ইউনিট গঠন, অধিকতর অস্ত্রশস্ত্র যোগাড়করণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি ঐ এলাকায় ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে মেধাবী ও চৌকশ তরুণ অফিসারদের তাঁর অধীনে নিয়ে আসেন। এক সময়ে মঞ্জুর যুক্তিসঙ্গতভাবেই গর্ব করতে পারতেন যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশকে তিনি তাঁর প্রত্যক্ষ কমান্ডে রেখেছেন। তাছাড়া, ঐ সময়ে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে সুদক্ষ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্রিগেড কমান্ডার আর স্টাফ অফিসারেরা তাঁর অধীনে ছিলো। তাদের মধ্যে মঞ্জুরের সবচেয়ে বেশী বিশ্বাসভাজন অফিসার ছিলো দু’জন। একজন হচ্ছে লেঃ কর্ণেল মতিউর রহমান, জিএসও-১ বা, প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার। আর একজন হচ্ছে, লেঃ কর্ণেল মাহবুবুর রহমান। মাহবুব মঞ্জুরের ভাগ্নে এবং ২১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার। ওরা প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং ঢাকার পদস্থ সামরিক অফিসারদের অত্যন্ত অপছন্দ করতো। ওরা আবার উভয়েই মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ওরা ৬ নম্বর সেক্টর থেকে যুদ্ধ করেছে। তাদের ধারণা প্রেসিডেন্ট জিয়া আর উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাব্যক্তিদের কারণেই দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির করুণ অবস্থা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে তারা জেনারেল মঞ্জুরকে শ্রদ্ধা করতো এবং তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বাস করতো। ফারুক আর রশিদ যেমন দেশ স্বাধীনের পর মনে করতো দেশের জন্যে একটা পরিবর্তন দরকার, ঠিক তেমনি মতি আর মাহবুবও দেশের স্বার্থে জিয়া এবং তাঁর অধীনস্থ সামরিক অফিসারদের অপসারণ কামনা করছিলো। তারা এ ব্যাপারে জেনারেল মঞ্জুরের কাছ থেকে প্রচ্ছন্ন সমর্থনও পেয়েছিলো।

কখন তাদের মধ্যে বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিলো তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও, মতি আর মাহবুব স্পষ্টতঃই ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সক্রিয়ভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের আর এক সহযোদ্ধা, লেঃ কর্নেল দেলোয়ার হোসেন চট্টগ্রাম রেঞ্জে যোগ দিলে ষড়যন্ত্রটি আরো ত্বরান্বিত হয়। মাহবুব তখন দিঘীনালায়, মতি রাঙ্গামাটিতে এবং দেলোয়ার চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টস্থ অর্ডন্যান্স সার্ভিসের সহকারী পরিচালক। মতি চট্টগ্রামে দেলোয়ারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে একত্রে বসে ‘লাঞ্চ’ খাবার সময়ে দু’জনের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হয়। মতি তার সাথে বিএনপি সরকারের ব্যর্থতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সামাজিক ন্যায় বিচারের অভাব, দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। মতি জানায়, এ সকল ব্যাপারাদি নিয়ে জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গেও তার কথা হয়েছে। জেনারেল তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বলে জানানো হয়। মতি আরো জানায়, ‘সমমনা অফিসারদের এক সমন্বিত প্রচেষ্টায় এ সকল সমস্যার চিরতরে সমাধান প্রয়োজন।’ দেলোয়ার অর্ডন্যান্স অফিসার হিসেবে তার সীমাবদ্ধতার কথা জানালো, মতি রেগে গিয়ে বলে, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আসল ব্যাপার হচ্ছে তোমাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে।

মতি আর মাহবুব ৬৯ পদাতিক ব্রিগেড-এর ব্রিগেড মেজর এস, এম, খালিদকেও তাদের দলে ভিড়ায়। মঞ্জুরের পৃষ্ঠপোষকতায় এই চারজনেই বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়, যার পরিণতিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিহত হয়।

জুনিয়র অফিসারদের বুঝিয়ে দলে ভিড়ানোর জন্যে তারা প্রচারণা শুরু করে দেয়। মেজর থেকে আরম্ভ করে জেসিও এবং এনসিও পর্যন্ত অফিসারদের বুঝানোর দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর খালিদকে। মঞ্জুর, মতি আর মাহবুব নেন উপরস্থদের দায়িত্ব। মাহবুব লিফলেট ইত্যাদি প্রচারপত্র ছাপার জন্যে একটি ছোট প্রেস কেনার চিন্তা করে। কিন্তু দাম বেশী বলে সে তার ধারণাটি পরে বাদ দেয়। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি জেনারেল মঞ্জুরের সরকারী বাসভবন, ফ্ল্যাগ, স্টাফ হাউস সকল শ্রেণীর অফিসারের জন্যে খুলে দেন। বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু জুনিয়র অফিসার, এমনকি এনসিও পর্যন্ত আমন্ত্রণ পায়। ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল এবং কমান্ডিং অফিসারদের পক্ষকালের মধ্যে একবার করে তাস খেলা, চা খাওয়া কিংবা একটু-আধটু গল্প-সল্প করার জন্যে নিয়ে আসা হতো। এ ধরনের মাখামাখির উদ্দেশ্য ছিলো, যতদূর সম্ভব বেশী সংখ্যক অফিসারদেরকে প্রভাবান্বিত করে তাদের মতাদর্শ সকল দিকে ছড়িয়ে দিয়ে, বিপ্লবের মুহূর্তকে এগিয়ে নিয়ে আসা।

মঞ্জুর বেসামরিক লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে ‘টেন্ড সেন্টারস্’ নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন। জিয়াউর রহমান নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে দিয়ে এর গোড়াপত্তন করা হয়। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিলো জনগণকে ‘শিক্ষিত করে তোলা’ অর্থাৎ সমস্যাদির প্রতি তাদের চোখ খুলে দেয়া। জেনারেল মঞ্জুর হলেন এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এ সবকিছুই সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার নজরে ছিলো। কিন্তু মঞ্জুরও কম গেলেন না। তিনি গোয়েন্দা সংস্থার চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল আবু লায়েস চৌধুরীকে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঢুকতে বারণ করে দেন। তিনি নীরবে সেখানকার ডিভিশনাল ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এবং এর কমান্ডিং অফিসারকে তাঁর দলে ভিড়াতে সক্ষম হন।

জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রথম পরিকল্পনাটি করা হয় ১৯৮০ সালের ১৯শে ডিসেম্বর। সেই দিন বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমীতে একদল নতুন রিক্রুট অফিসারের ‘পাসিং আউট প্যারেড’ অনুষ্ঠিত হবে। জেনারেল জিয়াসহ বহু উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা এবং বেশ কিছু সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, জেনারেল মঞ্জুর জিওসি হিসেবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার (ইবিআরসি) মেসে এক নৈশভোজে অতিথিদের আপ্যায়ন করবেন। সেখানেই তাদের সকলকে গ্রেফতার করা হবে। বিকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, একটি দল সার্কিট হাউসে গিয়ে জেনারেল জিয়াকে গ্রেফতার করবে। আর একটি দল বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার মেসে গিয়ে সকল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করবে। পরে তাদের সকলকে প্যাডের গ্রাউন্ডে এনে হত্যা করা হবে। এই পরিকল্পনার জন্যে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিলো। এই রেজিমেণ্ট তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলো। মঞ্জুর এটিকে ১৮ই ডিসেম্বরের মধ্যে চট্টগ্রামে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেন। কিন্তু ঐ রেজিমেন্ট নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। কারণ ৬৫তম ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার, কর্নেল রশিদ এত অল্প সময়ের নোটিশে এর অপারেশনাল এরিয়া থেকে রেজিমেন্টকে উঠিয়ে নিতে রাজী হননি। সুতরাং, পুরো পরিকল্পনাটিই শেষে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু নির্ধারিত নৈশভোজের সময় একটি ব্যাপার নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ব্রিগেড মেজরসহ আরো কয়েকজন অফিসার নৈশভোজে তাদের পিস্তলসহ যোগ দেয়। প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে এভাবে অস্ত্র বহন করা বেআইনী। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা জানায় যে জিওসি’র নির্দেশে তারা অস্ত্রসহ অনুষ্ঠানে এসেছে। কারণ জিওসি মনে করেন, প্রেসিডেন্টের জীবনের উপর হামলা হতে পারে না। প্রটোকল ও নিরাপত্তা বিষয়ে এ ধরনের রীতি বহির্ভূত ও অমার্জনীয় কার্যকলাপে জিয়া খুব ক্ষেপে উঠেন। অবশ্য পরে তিনি অফিসারদের তাদের পিস্তল জমা রেখে নৈশভোজে যোগ দেয়ার অনুমতি প্রদান করেন।

১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ষড়যন্ত্রকারীরা দ্বিতীয়বার চেষ্টা চালায়। তখন ‘এক্সারসাইজ আয়রণশিল্ড’ নামে কক্সবাজারের জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতে একটি সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হবে। সেই মহড়ায় জেনারেল জিয়াসহ তিন বাহিনীর প্রধান, সকল ফরমেশন কমান্ডার, প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসাররা এবং বেসামরিক দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শাহ্ আজিজুর রহমান ও কয়েকজন মন্ত্রীবর্গের উপস্থিত থাকার কথা। ২৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে এই মহড়া পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। সে সময়ে ২৪ পদাতিক ডিভিশনকেও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হবে। এই সুযোগে নিজেদের মারাত্মক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ষড়যন্ত্রকারীরাও নিজেদের অস্ত্র সঙ্গে রাখার মওকা পেয়ে যাবে। কর্নেল মতি, কর্নেল মাহবুব আর মেজর খালিদ অন্যান্যদেরকে তাদের পরিকল্পনার কথা ব্যাখ্যা করে বলে যে, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, জেনারেল জিয়া আর উপরস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণকে লাঞ্চের সময় আটক করে ৬ দফা দাবী পেশ করা হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ঐ দাবীগুলো মেনে না নেবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে জিম্মী হিসেবে আটক রাখা হবে। দাবীগুলো হচ্ছে : (১) সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল এরশাদ, নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী, মেজর জেনারেল আমজাদ, মেজর জেনারেল আমিন এবং আরো কিছু ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারকে বরখাস্ত করতে হবে। (২) শাসনতন্ত্র বাতিল করে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করে দেশ চালাতে হবে। (৩) তিন বছর ধরে কোন নির্বাচন বা রাজনৈতিক কার্যকলাপ চলতে দেয়া যাবে না। (৪) সামরিক উচ্চতর পদে প্রমোশনের একমাত্র মাপকাঠি হবে যোগ্যতা। (৫) আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি সাধন। (৬) সকলের জন্যে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা দূর করতে হবে।

জেনারেল জিয়াকে হত্যার ব্যাপারে পরিকল্পনায় কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের ভেতরকার দলটির উদ্দেশ্য ছিলো প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং পদস্থ কর্তাব্যক্তিদেরকে হত্যা করা। আর তাঁর সঙ্গীদেরকে আটক করে দাবী আদায়ের ব্যাপারে সকলের সমর্থন থাকলেও তাঁদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে অনেক অফিসারই রাজী হয়নি। তারা সকলেই তখন জেনারেল মঞ্জুরের কাছ থেকে গুলি করার সংকেতের অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু জেনারেল তাদেরকে সে সংকেত প্রদান করেননি। সম্ভবতঃ তিনি শেষ মুহূর্তে তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ফেলেন। কারণ, ঐ রকম একটা ব্যাপক হত্যাকান্ড চালানো হলে জনমত তাঁর বিরুদ্ধে চলে যাবে বলে তিনি মনে করেন। তাছাড়া, এতে কোন কৃতিত্ব আছে বলে তিনি মনে করেননি।

জেনারেল জিয়াকে হত্যা করার তৃতীয় প্রচেষ্টাটি চালানো হয় ১০ই মে, ১৯৮১ সালে। অর্থাৎ তার মৃত্যুর মাত্র ২০ দিন আগে। মারকাস ফ্রান্ডার মতে, চট্টগ্রামে একটি ‘ড্রাইডক’ উদ্বোধনকালে যে সুইচ টিপে তিনি উদ্বোধনী ঘোষণা দেবেন তার ভেতরে বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া যায়। একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসার এমন কিছু একটা ঘটেছিলো বলে স্বীকার করলেও বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। কিংবা কাউকে সন্দেহ করা হয়েছিলো কি-না তাও জানানো হয়নি।

বিদেশে একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্সে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্যে কর্ণেল মতি ১৯৮১ সালের ২৫শে মে ঢাকায় আসে। দু’বছর ধরে মতি অন্যান্যদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকলেও পরপর কয়েকবার তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সে অনেকটা উদ্যমহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। চলে যাবার সম্ভাবনাও ছিলো তার অনেক বেশী। কিন্তু ভাগ্য আবারো জিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করলো। রাজধানীতে অবস্থানকালে মতি তার পুরনো বন্ধু লেঃ কর্নেল মাহফুজের সঙ্গে দেখা করতে যায়। মাহফুজ তখন জিয়ার প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার/সেক্রেটারী। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ওরা গাল-গল্পে মেতে উঠে। গাল-গল্পের এক পর্যায়ে মাহফুজ এমন এক গোপন তথ্য মতিকে জানিয়ে দেয় যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের ইতিহাসকে পাল্টে দেয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়া মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম থেকে বদলি করে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজের কমান্ডান্ট করে ঢাকায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এ ধরনের বদলির সংবাদ সাধারণতঃ তা কার্যকর করার পূর্ব পর্যন্ত গোপন রাখা হলেও মাহফুজ তা চুপিসারে মতির কানে তুলে দেয়। মাহফুজেরও খানিকটা ইচ্ছা ছিলো এ ব্যাপারে মঞ্জুরকে সতর্ক করার। খবরটি মতির মনে জেদ ধরিয়ে দেয় এবং কিছু একটা করার জন্যে সে মরিয়া হয়ে উঠে। যখন মাহফুজ মতিকে জানায় যে, ২৯ তারিখে জিয়া চট্টগ্রাম সফরে যাবেন বলে ঠিক করেছেন, ঠিক তখনই তাকে হত্যা করার তাঁর একটি পরিকল্পনা তার মাথায় চলে আসে।

পরে জিয়া হত্যা সংক্রান্ত সাক্ষ্য প্রমাণে জানা যায় যে, মতি আর মাহফুজ ঐ দিন জিয়া হত্যার পরিকল্পনা সংক্রান্ত একটি রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করে। মাহফুজের সহায়তায় মতি ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গভবন পরিদর্শন করে এবং সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরীক্ষা করে দেখে। বঙ্গভবনের ভেতরে হেলিকপ্টার অবতরণের ‘হেলিপ্যাড’ ও মতি পরিদর্শন করে। পরের দিন চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে মতি কর্নেল দেলোয়ার আর মেজর খালিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে। মতি তাদের জানায়, জেনারেল মঞ্জুরকে বদলি করা হয়েছে এবং জিয়া ২৯ তারিখে চট্টগ্রামে আসছে। মতি তাদেরকে বলে, জিয়া চট্টগ্রামে এলে তিনি এখানকার সার্কিট হাউসে উঠবেন। সার্কিট হাউসে হামলা চালিয়ে সেখান থেকে জিয়াকে গ্রেফতার করতে হবে। বন্দী অবস্থায় জিয়াকে হেলিকপ্টারে উঠিয়ে ঢাকায় বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এরশাদ, নবম ডিভিশনের জিওসি জেনারেল মীর শওকত আলী এবং অন্যান্য সকল প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসারদের সেখানে হাজির করা হবে। তারপর তাদের সকলকে সেখানে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে অথবা তাদের সকলকে হত্যা করা হবে। মতি খালিদকে জানায়, এ কাজের জন্যে আমাদের মাত্র তিরিশ জন অফিসার প্রয়োজন। আমি বেশ ভাল করেই বঙ্গভবন দেখে এসেছি। আমি বলছি, এটা করা সম্ভব। এ কাজে সহযোগিতা করতে পারে এমন ২০ জন অফিসারের নাম খালিদ এক নিঃশ্বাসে তার আঙ্গুলের উপর গুণে ফেলে। কিন্তু পরক্ষণেই তারা এ পরিককল্পনা বাদ দেয়। সে অন্যান্যদের বলে, ‘এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবে এটা সম্পন্ন করা সম্ভব নয়?’

তারা তিনজনে মিলে বিষয়টি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আলাপ-আলোচনা করে। তারা একটা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে না পারলেও অতি শিগগিরই কিছু একটা যে করতে হবে, সে ব্যাপারে তারা একমত পোষণ করে। তারা মনে করে, জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেলে, তাদের হাতে এ ধরনের সুযোগ আর নাও আসতে পারে। জিয়াকে হত্যা করতেই হবে। এবং ২৯ তারিখে জিয়া চট্টগ্রামে বেড়াতে এলেই তা সমাধা করতে হবে। আঘাত হানার ব্যাপারে ষড়যন্ত্রকারীদের একটা বড় সুযোগও ছিলো। তখন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নৈশকালীন প্রশিক্ষণ চলছে। কাজেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে হানাদার দল সার্কিট হাউসের দিকে গেলে তা কারুর নজরে পড়বে না। তখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১, ৬, ১১ ও ২১-এ চারটি ব্যাটালিয়ন ঐ এলাকায় অবস্থানরত ছিলো।

এ ছাড়াও ৬ ইস্ট বেঙ্গলকে ‘এক্সারসাইজ আয়রণশিল্ডে অংশগ্রহণ করার জন্যে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছিলো। আরো একটা সুবিধে ছিলো এ কারণে যে, ২৪ পদাতিক ডিভিশনে দু’জনকে বাদ দিয়ে বাকী সবাই ছিলো মুক্তিযোদ্ধা। পদাতিক ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসারগণ আর তাদের সহকর্মীগণও ছিলো মুক্তিযোদ্ধা। ষড়যন্ত্রকারীদের ধারণা ছিলো, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সর্বাত্মক সহযোগিতা পাবে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এ পরিকল্পনায় জড়িত করার মানসে মতি চালাকি করে একটি গুজব রটিয়ে দেয়। গুজবে বলা হয়, মতি ঢাকায় গিয়ে জানতে পেরেছে যে, চট্টগ্রামের সকল মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বিরুদ্ধে একটা মারাত্মক ষড়যন্ত্র চলছে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বাছাই করে, একে একে সবাইকে খতম করে দেয়া হবে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ গুজবকে সত্য বলে প্রমাণ করার জন্যে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের একটি লিস্ট দেখানো হয়। ঐ লিস্টে তারকা চিহ্নিত অফিসারদের খতম করা হবে বলে সে জানায়। শ্রোতাদের একজন ছিলো, ৬৫ পদাতিক ডিভিশনের ব্রিগেড মেজর আবদুল কাইয়ুম খান। সে এসব শুনে এতই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে যে, সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন করে সে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের আসন্ন চক্রান্তটি সম্বন্ধে জানিয়ে দেয়। ২৮ তারিখের মধ্যে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে গুজবটি সকলের মুখে মুখে উঠে যায়। জেনারেল মঞ্জুরকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছে জেনে গুজবটি সকলের মনে দাগ কাটে। এরপর তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে অন্যান্যদেরকে তাদের দলে ভিড়াতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি।

সেদিন পতেঙ্গা বিমান বন্দরে জেনারেল জিয়ার আগমন উপলক্ষে জেনারেল মঞ্জুরকে উপস্থিত থাকতে নিষেধ করা হয়েছে জানতে পেরে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে এক সাংঘাতিক উত্তেজনা দেখা দেয়। মতি দেরি না করে ঢাকায় প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিবকে টেলিফোন করে। ঘটনা সত্যি বলে জানতে পেরে ষড়যন্ত্রকারীরা ঘাবড়ে যায়। তারা মনে করে যে, নিশ্চয়ই তাদের চক্রান্ত ইতিমধ্যেই ফাঁস হয়ে গেছে। সুতরাং তাদের উপরে আঘাত আসার আগেই, তারা জিয়ার উপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়।

সম্ভবতঃ ২৯শে মে মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের জীবনে সবচেয়ে বেশী যন্ত্রণার দিন ছিলো। সেদিন সকালে প্রেসিডেন্ট জিয়া ঢাকা থেকে পতেঙ্গা বিমান বন্দরে এসে অবতরণ করেছেন। বিমান বাহিনীর প্রধান চট্টগ্রামের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেছেন। নৌবাহিনীর প্রধানও সেখানে আছেন। তিনি জিয়ার সঙ্গে একই বিমানে চড়ে এসেছেন। মঞ্জুরকে অভ্যর্থনা থেকে বাদ দিয়ে প্রকাশ্যভাবে কেবল অপমানই করা হয়নি, একই সঙ্গে তাকে অবিলম্বে ঢাকার কর্মস্থলে যোগদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্যেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। ১লা জুনের মধ্যেই তাকে ঢাকায় যোগদান করতে হবে। সেদিন থেকে তিনি একজন সম্মানিত কলেজ প্রিন্সিপ্যাল। তাছাড়া, আর কোন ক্ষমতাই তার হাতে থাকবে না। এই উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসারটির জন্যে এর চেয়ে বেশী অপমানজনক আর কী-ই বা হতে পারে?

জুম্মার নামাজ শেষে মঞ্জুর তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের তার অফিসে ডেকে পাঠান। লেঃ কর্নেল মাহবুব, লেঃ কর্নেল দেলোয়ার আর মেজর খালিদ হাজির হয়। ঘনিষ্ঠদের চতুর্থ সদস্য, লেঃ কর্নেল মতি বিশেষ কাজে রাঙ্গামাটি যাওয়ায় উপস্থিত হতে পারেনি। মঞ্জুর তার অনুপস্থিতিতে কিছুটা রাগান্বিত হয়ে উঠেন এবং বারবার তার অনুপস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইছিলেন। মতি খুব শিগগির ফিরে আসবে বলে জানানো হয়। নির্দেশব্যঞ্জক সুরে উপস্থিত সহযোগীদের মঞ্জুর বলেন, ‘এখনই কাজটা সম্পন্ন করতে হবে। কিভাবে করবে, কি দিয়ে করবে, তা আমি জানি না। কোন সৈন্য-সামন্ত কাজে লাগানো যাবে না। তোমাদের নির্দিষ্ট কয়েকজন সার্কিট হাউসে গিয়ে জিয়াকে উঠিয়ে আনবে। সকালে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো এবং দুর্বল পয়েন্টগুলো পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে’।

এইভাবেই প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর আদেশ ঘোষিত হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জেনারেল জিয়ার ইহ জগতের শেষ দিনটি ছিলো একেবারে সাদামাটা। বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে জেনারেল জিয়া নৌবাহিনীর প্রধান, রিয়ার এ্যাডমিরাল এম, এ, খান এবং বিএনপি’র কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্য নিয়ে ঢাকা থেকে পতেঙ্গা এসে পৌঁছান। বিএনপি নেতাদের মধ্যে ডঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সৈয়দ মহিবুল হাসান, ডঃ আমিনা রহমান, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবং রাজ্জাক চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। বিমান বন্দরে তাকে বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল ছদরুদ্দীন, নগরীর পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বিএনপি’র নেতৃবৃন্দ তাকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন।

ঔপনিবেশিক কায়দায় নির্মিত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পৌঁছালে জেনারেল জিয়াকে কিছু হাল্কা নাস্তা পরিবেশন করা হয়। নিরাপত্তা নিয়ম অনুযায়ী তাঁর নাস্তা প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত চিকিৎসক লেঃ কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম খেয়ে পরীক্ষা করে এবং তারপর তাকে তা খেতে দেয়া হয়।

জেনারেল জিয়া প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে সার্কিট হাউসের বারান্দায় বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালান। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে জুম্মার নামাজের জন্যে আলোচনা বন্ধ রাখা হয়। জিয়া পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে চকবাজারের চন্দনপুরা মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে উপস্থিত মুসল্লী ও জনগণের সাথে কুশল বিনিময় করেন এবং কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে কাটিয়ে সার্কিট হাউসে ফিরে যান। এখানে তিনি দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দুপুরের খাবার খান। তার খাবারের তালিকা ছিলো খুবই সাধারণ গোছের। কারণ, তিনি কখনো তৈলাক্ত ও বেশী মশলাযুক্ত খাবার পছন্দ করতেন না। খাবার শেষে তিনি ঘণ্টা দেড়েক বিশ্রাম নেন। বিকেল ৫টায় উঠে চা পান করে তিনি নীচতলার বৈঠকখানায় চলে আসেন। সেখানে তাঁর জন্যে ৪৫ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি অপেক্ষা করছিলেন। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কয়েকজন অধ্যাপক, বারের কিছু সদস্য, শহরের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লোক এবং কয়েকজন সাংবাদিক। তাদের সঙ্গে জিয়া প্রায় আড়াই ঘণ্টা কথাবার্তা বলেন। তারপরে তিনি তার আসল কাজে মনোনিবেশ করেন। স্থানীয় বিএনপি’র দুই বিবদমান অংশের বিরোধ নিরসনের জন্যে তিনি আলাদা আলাদাভাবে তাদের সঙ্গে রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যান। এর মাঝে তিনি চট্টগ্রামের কমিশনার সাইফুদ্দিন আহমেদ এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বদিউজ্জামানের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তারা জানায়, অন্ততঃ ৪০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের তৎপরতা চলছে। তাদের কেউ বেআইনী জমি দখল, বেআইনী অস্ত্রবহন আবার কেউবা শহরে সন্ত্রাস সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এদের সকলেই বিএনপি’র সদস্য বিধায় পুলিশ তাদের ধরতে চেয়েও থমকে দাঁড়াচ্ছে বলে তারা প্রেসিডেন্টকে জানান। জিয়া তাদেরকে তাঁর দল থেকে সরিয়ে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

প্রেমিডেন্টের ব্যক্তিগত ডাক্তার তাঁর খাবার পরখ করা শেষ করলে, রাত ১১টার একটু পরে তাকে রাতের খাবার পরিবেশন করা হয়। জীবনের শেষ খানা সেবন করে জিয়া তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় টেলিফোনে কথা বলেন। স্বামী-স্ত্রীর জীবনের শেষ কথোপকথন ১৫ মিনিট স্থায়ী হয়। জীবনের সব কাজ সাঙ্গ করে মধ্যরাতের খানিক পরে, জিয়া তাঁর জীবনের শেষ যামিনী যাপনের জন্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। জীবন বাতি নিভে যাবার মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগে জিয়া তাঁর নিজ হাতে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে ঘুমুতে গেলেন। বাইরে তখন তুমুল ঝড় আর বিদ্যুতের ঝলকানি। এর আগে অবশ্য তিনি সকাল পৌনে সাতটায় তাকে সকালের চা পরিবেশন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিশ্চিন্তে তিনি শুয়ে পড়লেন বিছানায়। অথচ, ঠিক সেই মুহূর্তেই জিয়াকে চিরনিদ্রায় শায়িত করার উদ্দেশ্যে চট্টলার ক্যান্টনমেন্টে ঘাতকের দল প্রস্তুতি নিচ্ছে।

জেনারেল মঞ্জুরের সংকেত পেয়ে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যেরা লেঃ কর্ণেল দেলোয়ার হোসেনের বাসভবনে অভিযান পরিকল্পনা’ তৈরী করার জন্যে মিলিত হন। তখন বিকেল ৬টা। লেঃ কর্ণেল মতিও রাঙ্গামাটি থেকে ফিরে এসেছে। উপস্থিত অন্যান্যরা হচ্ছে, লেঃ কর্ণেল মাহবুব, লেঃ কর্ণেল ফজলে হোসেন, মেজর খালিদ, মেজর লতিফুল আলম চৌধুরী এবং মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া। লেঃ কর্ণেল ফজলে হোসেনের মতে, তখন তারা দু’টি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে। প্রথমটি হচ্ছে, সার্কিট হাউস থেকে জেনারেল জিয়াকে উঠিয়ে আনা। তাকে ব্যবহার করে ভাইস প্রেসিডেন্ট সাত্তার, সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এরশাদ এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের এখানে এনে তাদেরকে হত্যা করা। বিকল্প হচ্ছে, যদি ঐটি ব্যর্থ হয়, তাহলে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হবে। মতি, মাহবুব এবং খালিদ জেনারেল জিয়াকে হত্যা করার চাইতে জিম্মী করার পক্ষপাতি ছিলো। কারণ এতে তারা তাদের কাজের জন্যে জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম হতে পারবে।

ভিন্ন ভিন্ন ঘাতকদলের নেতাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। ১১২ সিগন্যাল কোম্পানীর কমান্ডিং অফিসার মেজর মারুফ পরে এলে তাকে পরদিন ভোরবেলা নাগাদ ঢাকার সঙ্গে সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন করে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়। ষড়যন্ত্রকারী দল আগে থেকেই সার্কিট হাউসের ভেতর থেকে সহযোগিতা পাবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। দিনের বেলায় মতি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রেসিডেন্টের প্রধান স্টাফ অফিসার লেঃ কর্ণেল মাহফুজের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে তাকে জানায় যে, তারা আজ রাতেই প্রেসিডেন্টের জীবনের উপর হামলা চালাবে। তার পরিবর্তে মাহফুজও সম্ভব সকল প্রকার সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকার করে। নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের শয়নকক্ষে যে দু’জন গার্ড থাকে, মাহফুজ তাদের সরিয়ে দেয়। তাছাড়া, সে সরকারী প্রটোকল অফিসারের কাছ থেকে সার্কিট হাউসের কক্ষ বণ্টনের চার্টও সংগ্রহ করে এবং দিনের বেলায় ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের মেজর মুজিবুর রহমান এলে, তার মাধ্যমে চার্টটি হানাদার বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

জেনারেল মঞ্জুর আগে থেকেই কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন যেন, এ কাজ কোন সৈন্য ব্যবহার না করা হয়। মঞ্জুরের এ নির্দেশ সত্ত্বেও আঘাত হানার জন্যে সৈন্য যোগাড় করতে মেজর খালিদকে বলা হয়। সে তখন ব্রিগেড মেজর। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৈন্য যোগাড় করা তার পক্ষে যথেষ্ট কষ্টকর হয়ে পড়ে। রাত প্রায় ৯টায় সে ফাস্ট ইস্ট বেঙ্গলের সুবেদার আবুল হাশিমকে ডেকে পাঠিয়ে নির্দেশ দেয়, তাকে ঐ রাতেই কিছু অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য নিয়ে কালুরঘাটে যেতে হবে। খালিদ তাকে একটি টাকার তোড়া এগিয়ে দিয়ে সেগুলোকে সৈন্যদের বহন করার জন্যে ট্রাক ভাড়া করার কাজে ব্যবহার করতে বলে। সুবেদার হাশিম সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠে। টাকা নিতে অস্বীকার করে সে খালিদকে জিজ্ঞেস করে : ‘আমি সৈনিকদের এ টাকার ব্যাপারে কি বলবো?’ খালিদ : তোমার যা খুশী একটা বলে দিও—কিংবা বলে দিও যে, ‘প্যারেডে সময়ে সিনেমা দেখার শাস্তি হিসেবে তাদেরকে এখন কালুরঘাট যেতে হচ্ছে।’ এতে সুবেদার হাশিম আরো বেশী সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠে। খালিদ তার উপর চটে গেলে, হাশিম এমনভাবে বেরিয়ে যায় যেন সে মেজরের হুকুম তামিল করার জন্যেই ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু সে তার সৈন্যদের যার যার জায়গায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে সোজা তার বাসায় গিয়ে পালিয়ে থাকে।

আধা ঘণ্টা পরে মেজর খালিদ ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের মেজর মোহাম্মদ মোস্তফাকে কিছু সৈন্য সরবরাহের জন্যে অনুরোধ জানায়। মেজর মোস্তফা ঘটনাটি সঙ্গে সঙ্গে তার ব্রিগেড কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার মোহসিনউদ্দিন আহমদ-এর কানে তুলে এবং বলে, ‘মেজর খালিদ সার্কিট হাউস থেকে প্রেসিডেন্টকে উঠিয়ে আনার জন্যে ফাস্ট ইস্ট বেঙ্গলের কিছু ট্রুপ চাচ্ছে।’ ব্রিগেডিয়ার মোহসিনউদ্দিন বলে, ‘খালিদ পাগল বনেছে নাকি? এক্ষণই তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।’ ব্রিগেডিয়ার একজন সৈনিককেও ব্যারাক থেকে বেরুতে মানা করে। পরে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে বিগ্রেডিয়ার মোহসিনউদ্দিন জানায়, সে জিওসি, জেনারেল মঞ্জুরকে ব্যাপারটি জানাতে চাইলেও তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে তখন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা স্টাফ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থাকে না জানিয়েই চুপচাপ বসে থাকে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারে যে, এ কাজের জন্যে কোন সৈন্যই তারা পাচ্ছে না। আঘাত হানার জন্যে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবেই অফিসারদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। রাত দশটার দিকে লেঃ কর্নেল মাহবুব দু’জন অফিসারকে সার্কিট হাউসে পাঠিয়ে সেখানে কোন অস্বাভাবিক গতিবিধি চলছে কিনা তা রিপোর্ট করতে বলে। মেজর শওকত আলী এবং মেজর লতিফুল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম ক্লাবের দেয়ালে তাদের সশস্ত্র অবস্থান নেয়। সেখান থেকে সার্কিট হাউস পরিষ্কার দেখা যায়। অভিযান পরিপূর্ণভাবে শেষ না হাওয়া পর্যন্ত তারা সেখানেই অবস্থান করে।

রাত গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে ষড়যন্ত্রকারীরা সব কাজ তড়িঘড়ি করে সেরে নিতে সচেষ্ট হয়। রাত সাড়ে এগারোটায় মতি আর মাহবুব ২৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ডের অফিসে ১১ এবং ২৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল অফিসারকে ডাকা হয়। তাদের মধ্যে ৬ জন সেখানে উপস্থিত হয়। তারা হচ্ছে -মেজর মোমিন, মেজর গিয়াসউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মুনির, ক্যাপ্টেন জামিল, ক্যাপ্টেন মইনুল ইসলাম এবং ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। মতি দরজা তালাবন্ধ করে একখানা পবিত্র কোরআন শরীফ নিয়ে আসে। সে সমবেত অফিসারদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘ভদ্রমন্ডলী, এইটি একখানা পবিত্ৰ কোরআন শরীফ। আমরা যা কিছুই করতে যাচ্ছি, সবই আমাদের দেশ, জাতি আর ন্যায় বিচারের স্বার্থে করতে হচ্ছে। আপনারা যারা আমাদের সঙ্গে আছেন, এই পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে পশপথ করতে হবে যে, এ জন্যে যা কিছু করণীয় সবই আপনারা করতে রাজী আছেন। যারা আমাদের সঙ্গে থাকতে নারাজ, তারা রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। তবে, তাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ থাকবে, আপনারা অন্য কারো কাছে এ কথাটি দয়া করে জানাবেন না।’

কেউ এতে নারাজী হয়নি। সকলেই একে একে শপথ গ্রহণ করে নেয়। তারপর অস্ত্র, পোশাক ইত্যাদি নিয়ে তারা সকলেই সমরসাজে সজ্জিত হয়। তাদের সঙ্গে ছিলো সাব-মেশিনগান (এসএমজি) আর প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ।

৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফজলে হোসেনও তার হেড কোয়ার্টারে একই নাটকের অবতারণা করে। ফজলে লেঃ রফিকুল হাসান খানকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি যেখানে যেতে চাচ্ছি, তুমি কি আসার সঙ্গে সেখানে যাবে?’ রফিকুল জাব দেয় : স্যার, আপনার নির্দেশ পেলে অবশ্যই যাবো। তারপর ফজলে লাইনের অন্যান্য অফিসারদের ডেকে পাঠায়। তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়, মেজর দোস্ত মোহাম্মদ, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন আরেফীন এবং লেঃ মোসলেহউদ্দিন। ফজলে উপস্থিত অফিসারদের উদ্দেশ্যে বলে : ‘তোমরা জানো, দেশের অবস্থা খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীকে বহুলাংশে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আজ এবং কাল এই দু’দিন প্রেসিডেন্ট এখানে আছেন। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে আমাদের কিছু একটা করে নিতে হবে। আমরা মনস্থ করেছি, আজই আমরা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে তাকে বিষয়টা অবগত করাবো। তোমরা কে কে আমার সঙ্গে যেতে রাজী আছো? একবাক্যে সকেলই রাজী হয়ে গেলে ফজলে একখানা পবিত্র কোরআন শরীফ এনে তাদেরকে শপথ করিয়ে বলে, ‘আমাদের মিশন পুরোপুরিভাবে স্বার্থক/সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের কেউ আমার সঙ্গ ত্যাগ করতে পারবে না।’

৩০শে মে, রাত্র আড়াইটার দিকে ‘ঘাতকদল’ কালুরঘাটস্থ রেডিও ট্রান্সমিটারের কাছাকাছি তাদের নির্ধারিত মিলন স্থলে এসে হাজির হতে থাকে। এই সেই জায়গা যেখান থেকে ১৯৭১-এর মার্চ মাসে জেনারেল জিয়া খ্যাতির সিঁড়িতে পা রাখেন। তখন বিজলী, বজ্রপাতসহ প্রচন্ড বেগে বাতাস বইছিলো আর মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিলো। তিনজন সঙ্গী নিয়ে লেঃ কর্নেল মাহবুব তার সাদা টয়োটা গাড়িতে চড়ে আসে। এক ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে ১৮ জন অফিসার আর দু’জন জেসিও এসে জড়ো হয়। ঐ সময় সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে ফাস্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড, মেজর ফজলুল হক ৪০ জন সৈন্যের দু’টি প্লাটুন নিয়ে এসে হাজির হয়। মেজর খালিদ তাদের উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করলে তারা তাদের সঙ্গে যোগ দিতে জোর গলায় অস্বীকার করে। তাদেরকে পরে লেঃ মতিউর রহমানের অধীনে কালুরঘাট ব্রীজের অপর পাড়ে বান্দরবন সড়কে রেখে আসার নির্দেশ প্রদান করা হয়।

বিদ্রোহে যোগদানের ব্যাপারে সাধারণ সৈনিকদের অস্বীকৃতি জিয়া হত্যা ঘটনার একটি অসাধারণ দিক।

সৈনিকদের নৈশকালীন প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর ব্যবস্থা থাকায় সশস্ত্র লোকদের ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটি কারো নজরে পড়েনি। তাছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঐ সময়ে যথেষ্ট শিথিল ছিলো। চট্টগ্রামের স্থানীয় নিরাপত্তা ইউনিট তৎপর না থাকায় ব্যাপারটি সময় মতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসতে পারেনি। ঐ সময়েও জিয়ার ভাগ্য তাঁর বিপরীতে কাজ করছিলো।

ঘাতকদলের নেতৃত্ব দেয় লেঃ কর্নের মতিউর রহমান। তাদের সঙ্গে ছিলো ১১টি এসএমজি, তিনটি রকেট ল্যান্সার এবং তিনটি গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল। সে ঐ সবগুলো অস্ত্রে সঠিকভাবে গোলাবারুদ ভর্তি করা হয়েছে কিনা এবং ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, পরীক্ষা করে নেয়। ১৬ জন অফিসারকে একটি পিকআপে গাদাগাদি করে উঠানো হয়। ‘সার্কিট হাউস এবং থাকার ঘরের একটি নকশা দেখিয়ে মতি তাদেরকে পুরো অভিযান পরিকল্পনাটি বুঝিয়ে দেয়। তারপর সে একখানা পবিত্র কোরআন শরীফ দিয়ে তাদের সকলে শপথ নবায়ন করে নিয়ে সজোরে ঘোষণা করেঃ ‘আমরা আজ প্রেসিডেন্টকে হাতের মুঠোয় পাবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছি।’

ঘাতক বাহিনী তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ চালানোর কথা। পরিকল্পনা মতে, দু’টি দল সার্কিট হাউসে ঢুকে আক্রমণ পরিচালনা করবে এবং একটি দল সার্কিট হাউসের পেছনে আলমাস সিনেমা হলের কাছে অবস্থান নেবে। কেউ যদি সার্কিট হাউস থেকে পালাতে চেষ্টা করে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। প্রথম দলে কে কে থাকতে ইচ্ছুক জিজ্ঞেস করা হলে অনেকেই এতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। কিন্তু মতি তাদের মধ্যে থেকে মাত্র ছ’জনকে বাছাই করে নেয়। এই ছ’জন : মাহবুব, ফজলে, খালিদ, জামিল হক, আবদুস সাত্তার আর লেঃ রফিকুল হাসান খান। ফজলে এ দলের নেতৃত্ব দেবে এবং গাড়ী চালাবে মাহবুব। ৯ নম্বর কক্ষে প্রেসিডেন্ট জিয়ার উপর আঘাত হানার দায়িত্ব দেয়া হয় ফজলে আর ক্যাপ্টেন সাত্তারকে।

লেঃ কর্নেল মতি নিজে থাকলো দ্বিতীয় দলে। তার সঙ্গে থাকলো মেজর মোমিন, মেজর মোজাফফর, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন আর লেঃ মোসলেহউদ্দিন। প্রথম দলটিকে দ্বিতীয় দলটি পেছন থেকে সহায়তা করে। মেজর গিয়াসউদ্দিন আর ফজলুল হক, ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আর মুনিরকে নিয়ে গঠিত হয় তৃতীয় দলটি।

রাত্র সাড়ে তিনটার সামান্য কিছু পরে দল তিনটি কালুরঘাট থেকে প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে আস্তে আস্তে গাড়ী চালিয়ে সামনে এগোতে শুরু করে। যুবক লেফটেন্যান্ট রফিক প্রথম দলের পিকআপে বসে কম্পিত স্বরে ফজলেকে জিজ্ঞেস করে : ‘আপনারা কি প্রেসিডেন্টকে খুন করতে যাচ্ছেন? কর্নেল ফজলে তাকে জানায়, ‘না’ আমরা কেবলই তাকে তুলে আনতে যাচ্ছি।’ কথা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, শেষ মুহূর্তেও দলের অনেক সদস্য বিশ্বাস করতো যে, তারা প্রেসিডেন্টকে তুলে নিয়ে এসে জিম্মী করে রাখতে যাচ্ছে।

ঘাতকদল দু’টি বিনা বাধায় সার্কিট হাউসে ঢুকে পড়ে। লোহার তৈরী বিরাট বড় সদর দরজাটি অজ্ঞাত কারণে সে রাতে খুলে রাখা হয়েছিলো। পাহারারত চারজন প্রহরী ঘাতক বাহিনীকে বিনা প্রশ্নে ভেতরে যেতে পথ করে দিলো। এ সময় লেঃ কর্নেল ফজলে হোসেন তার হাতের রকেট ল্যান্সার থেকে পরপর দু’টি ফায়ার করে। গোলা দু’টি জিয়ার শয়নকক্ষের ঠিক নীচের দিকে বিরাট দু’টি গর্ত সৃষ্টি করে। সার্কিট হাউসে অবস্থানরত সকলকে ভয় পাইয়ে দিতে এবং ঘাতকদের অন্যান্য দলকে সংকেত দেয়ার জন্যেই ঐ প্রাথমিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সঙ্গে সঙ্গেই বাকী দলীয় সহযোগীরা গ্রেনেড, রকেট আর মেশিন গান থেকে গুলি চালাতে শুরু করে। এতে করে সমান্য দু’একজন প্রতিরোধ সৃষ্টিকারীকে একেবারে ধূলোয় মিলিয়ে দেয়া হয়। চট্টগ্রাম ক্লাবের দেয়ালে দর্শকের ভূমিকায় অবলোকনরত দুই মেজরের একজন পরে জানায়, সিনেমায় ছবিতে প্রদর্শিত কমান্ডো আক্রমণের মত সেদিনের হামলা পরিচালিত হয়েছিলো।

নিরাপত্তা রক্ষীদের মধ্যে পুলিশ কনস্টেবল দুলাল মিঞা পোর্টিকোতে প্রহরারত অবস্থায় মাথায় গুলি খেয়ে প্রথম প্রাণত্যাগ করে। পাহারারত বাকী ৪৪ সশস্ত্র পুলিশের কেউ কোন রকম প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেনি। তাদের কেউ কেউ ছুটে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালায়। ঘাতকদলের এলোপাথাড়ি গোলাগুলি আর ছোটাছুটির কারণে আরো ১২ জন পুলিশ আহত হয়।

ঐ সময় কর্তব্যরত প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরাও তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলো। যে দু’জন সৈন্য প্রেসিডেন্টের কক্ষের সামনে পাহারারত থাকার কথা, তাদের একজনকে নীচতলায় মৃত এবং অন্যজনকে তার কোয়ার্টারে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। নীচতলার সৈন্যেরা সম্ভবতঃ প্রেসিডেন্টের কক্ষের দিকে যেতে চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু এর আগেই তাদেরকে খতম করে দেয়া হয়।

আশ্চর্যজনকভাবে সার্কিট হাউসের নিরাপত্তা প্রহরীদের গুলিতে হানাদার দলের কেউ নিহত বা আহত হয়নি। তাদের দু’জন নিজেদের লোকদের গুলিতেই আহত হয়েছিলো। এর মধ্যে লেঃ কর্ণেল ফজলে হোসেন পেছনের দলের বেপরোয়া গুলিতে ঘোরতর আহত হয়ে অভিযান থেকে সরে পড়ে। ক্যাপ্টেন জামিলও ঠিক সেভাবেই আহত হয়েছিলো। কিন্তু যেভাবেই হোক, আহত শরীরে জামিল সার্কিট হাউসের দু’তলায় বেয়ে উঠে এবং নায়েক রফিকুদ্দিনকে গুলি করে আহত করে। প্রেসিডেন্টের প্রধান নিরাপত্তা অফিসার লেঃ কর্ণেল মইনুল আহসান এবং ক্যাপ্টেন আশরাফুল খান তখন দু’তলায় প্রেসিডেন্টের পেছনের কক্ষে ঘুমুচ্ছিলো। রকেটের আওয়াজে তারা জেগে উঠে। সঙ্গে সঙ্গেই তারা তাদের অস্ত্র হাতে প্রেসিডেন্টের জীবন রক্ষায় ছুটে আসছিল। তারা তাদের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পাবার আগেই আক্রমণকারীদের গুলিতে নিবেদিত প্রাণ এই দুই অফিসারের নিষ্প্রাণ দেহ বারান্দায় লুটিয়ে পড়ে।

পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পেছনের ঘাতকদলটি কর্নেল মতিসহ এই সময়ে দু’তলায় অন্যান্য আক্রমণকারীদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের ৯ নম্বর কক্ষ খুঁজতে শুরু করে। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে ঐ কক্ষের দরজা ভেঙ্গে ফেলতেই সে দেখে ঘরে অবস্থানরত ডঃ আমিনা রহমান। ফলে প্রেসিডেন্টের খোঁজে ওরা একি ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এ সময় উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘প্রেসিডেন্ট কোথায়? প্রেসিডেন্ট কোথায়?’ কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা বুঝতে পারে যে, প্রেসিডেন্ট ৪ নম্বর রুমে অবস্থান করছেন। রুমটি সিঁড়ির গোড়ায়। রুমের একটি দরজা সিঁড়ির দিকে আর একটি দরজা বারান্দার দিকে। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে বারান্দার দিকের দরজাটি ভাঙ্গতে চেষ্টা করে। হঠাৎ করে তাদের একজন চিৎকার করে বলতে থাকে :’প্রেসিডেন্ট বেরিয়ে আসছেন।’ এক মুহূর্ত পরেই আর একজন চিৎকার করে বলে উঠে : ‘এইতো প্রেসিডেণ্ট।’

সাদা পায়জামা পরা উস্কখুস্ক চুলে প্রেসিডেন্ট অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন। তাঁর হাত দু’টি সামনের দিকে সামান্য উঁচিয়ে প্রেসিডেন্ট দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন : ‘তোমরা কি চাও?’

প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে কাছে ছিলো মেজর মোজাফফর আর ক্যাপ্টেন মোসলেহউদ্দিন। মেজর মোজাফফর দৃশ্যতঃ ভয়ে কাঁপছিলো। মোসলেহউদ্দিন প্রেসিডেণ্টকে আশ্বস্ত করতে চাইছিলো। সে বলছিলো। স্যার, আপনি ঘাবড়াবেন না। এখানে ভয়ের কিছুই নেই, কি আশ্চর্য! ঐ দু’জন অফিসার তখনও মনে করছে, তারা প্রেসিডেন্টকে উঠিয়ে নিতে এসেছে, হত্যা করতে নয়। লেঃ কর্নেল মতিও কাছাকাছিই ছিলো। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি তার বিন্দুমাত্রও দয়ামায়া ছিলো না। সে প্রেসিডেন্টকে একটুও সুযোগ দিলো না। মোসলেহউদ্দিনের ঠোঁট থেকে জিয়ার প্রতি তার আশ্বাসের বাণী মিলিয়ে যাবার আগেই মতি তার এসএমজি থেকে গুলি চালিয়ে দেয়। ঝাকে ঝাকে গুলি এসে জিয়ার শরীরের ডানদিক একেবারে ঝাঁঝরা করে ফেলে। দরজার কাছেই জিয়া মুখ থুবড়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। রক্তের বন্যায় তার সমস্ত্র শরীর ভেসে যেতে থাকে। খুনের নেশায় ঘাতক মতি পাগল হয়ে উঠে। সে তার বন্দুকের নল দিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রাণহীন দেহ উল্টিয়ে নেয়। তারপর জিয়ার মুখমন্ডল আর বুকের উপর তার এসএমজির ট্রিগার টিপে রেখে ম্যাগজিন খালি করে তার খুনের নেশা মিটিয়ে দেয়। গুলির আঘাতে জিয়ার মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আমি কল্পনাও করতে পারছি না, কি ধরনের ক্ষোভ কর্ণেল মতি তার মনের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলো, যার বহিঃপ্রকাশ এতটা মর্মান্তিক আর নৃশংসরূপ নিয়েছিলো! জিয়াকে নৃশংসভাবে খুন করে খুনীরা ঝটপট সার্কিট হাউস ছেড়ে চলে যায়। দু’জন আহত সঙ্গীকেও তারা সঙ্গে নিয়ে যায়। পুরো নৃশংস হত্যাকান্ডটি ২০ মিনিটেরও কম সময়ে সম্পন্ন হয়েছিলো।

জীপে চড়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাবার পথে মেজর মোজাফ্ফর ক্ষোভে আর দুঃখে কাঁপতে কাঁপতে লেঃ মোসলেহউদ্দিনকে বলছিলো : ‘আমি জানতাম না, আমরা প্রেসিডেন্টকে খুন করতে যাচ্ছি। আমার ধারণা ছিলো, আমরা কেবলই প্রেসিডেন্টকে বের করে নিয়ে আসতে যাচ্ছি।’

জিয়ার ব্যক্তিগত ডাক্তার লেঃ কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম গুলি থেমে গেলে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। নিহত প্রেসিডেন্টের একটি পরিষ্কার বর্ণনা তার ভাষ্য থেকে ফুটে উঠে। তার ভাষায় : আমি দরজার সামনে প্রেসিডেন্টের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি। গুলির আঘাতে তাঁর সমস্ত শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তাঁর একটা চোখ সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে গেছে। ঘাড়ের মাংসগুলো কোথাও যেন উড়ে চলে গেছে। তাঁর বুকে, পেটে আর পায়ে অগণিত গুলির চিহ্ন ফুটে রয়েছে। গালিচাটি তাঁর শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা তাজা রক্তে ভেসে গেছে। তাঁর প্রিয় চশমা জোড়াটি অসহায়ভাবে সিঁড়ির কাছে পড়ে রয়েছে।

গোলাগুলি থেমে যাওয়া এবং আক্রমণকারীদের চলে যাওয়ার অনেক পরে ভীতসন্ত্রস্ত খরগোশের ন্যায় দু’তলায় অবস্থানরত অন্যান্যরা তাদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। সংকটময় মুহূর্তে জিয়াকে কেউ একটুখানি সাহায্য করতেও এগিয়ে আসেনি। তদন্তে নিয়োজিত বেসামরিক কমিশন বুঝতে পারে : ‘লেঃ কর্নেল মাহফুজ (প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত সেক্রেটারী) এবং ক্যাপ্টেন মাজহার (এডিসি) তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেনি। ঘাতকের দল চলে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পরে ওয়্যারলেস অপারেটর নায়েক আবুল বাশার তাদের দরজায় আঘাত করলে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এই দুই অফিসার তাদের ঘরের ভেতরে টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো এবং অনেকক্ষণ ধরে ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তাও করছিলো না।’

জিয়ার পাশের রুমেই ছিলো এডিসি, মাজহার। ব্যক্তিগতভাবে সে প্রেসিডেন্টের কাছে যাবার চেষ্টাটুকুও করেনি। তার পরিবর্তে সে তার ঘর থেকে প্রেসিডেন্টের ঘরে টেলিফোন করার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। জিয়া হত্যা তদন্ত কার্যে নিয়োজিত বেসামরিক তদন্ত কমিশন প্রেসিডেন্টের হত্যার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ দু’টি রুমের মাঝে একটি সংযোগকারী দরজা আছে। ঘটনার সময়ে ঐ দরজা দিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছানো সবচেয়ে সহজ ছিলো। হত্যাকারীরা যখন প্রেসিডেন্টের রুমর দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছিলো, তখন প্রেসিডেন্ট এডিসি’র রুমের ভেতর দিয়ে সরে পড়তে পারতেন। ঐ সময় প্রেসিডেন্টকে তার রুমে নিয়ে যাবার জন্যে এডিসি খুব সহজেই ব্যবস্থা করতে পারতো। কিন্তু আমরা এডিসি’র কাছ থেকে যা শুনলাম, তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। ঐ সংযোগকারী দরজা সম্বন্ধে নাকি তার জানাই ছিলো না।’

অন্যদিকে কর্নেল মাহফুজ এক নাটকীয় কাহিনীর অবতারণা করে। সে বলে যে, প্রেসিডেন্টের সাহায্যে এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে উর্দিপরা একজন সশস্ত্র লোক তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। তখন মাহফুজ সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তার ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়ে। গুলি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সে মেঝেতেই সটান হয়ে শুয়ে থাকে। তার কাহিনীর সমর্থনে সে তার শয়নকক্ষের দেয়ালে গুলির চিহ্নও দেখায়। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর বিশেষজ্ঞরা ঐগুলির চিহ্ন পরীক্ষা করে দেখতে পান যে, ঐ সকল গুলি রুমের বাইরে থেকে আসতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, মাহফুজ নিজেই তার বন্দুক থেকে গুলি করে ঐ চিহ্নগুলোর সৃষ্টি করে। এতে করেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে মাহফুজের জড়িত থাকার প্রথম সূত্র উদ্‌ঘাটিত হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে ভেঙ্গে পড়ে এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে তার জড়িত থাকার ঘটনা স্বীকার করে। পরে তাকে জিয়া হত্যার সঙ্গে জড়িত করে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।

৬০ বৎসর বয়স্ক ডঃ আমিনা রহমান অল্পের জন্যে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। হত্যাকারীরা প্রেসিডেন্টের রুম ভেবে তার রুমের দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়েছিলো। পরে তিনি যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়ে মাত্র ৪৫ মিনিট পর তার রুম থাকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু অন্য একটি ভিআইপি রুমে অবস্থানরত ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং মহিবুল হাসান ভয়ে কাঁপতে থাকেন এবং অনেক পরে তাদের ঘর থেকে বাইরে আসেন।

প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ অনেকক্ষণ ধরে বারান্দার মেঝেতে যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো ঠিক সেভাবেই পড়ে থাকে। একটা লোকও তাঁর ধারে কাছে পর্যন্ত আসেনি। জিয়ার ব্যক্তিগত ডাক্তার লেঃ কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে। কিন্তু মৃত দেহের সদগতির কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। ঐ সময় পর্যন্ত যারা সার্কিট হাউস পরিদর্শন করে, তারাও এ নিয়ে সামান্যতম মাথা ঘামানোর চেষ্টাটুকু করেনি। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, দেশের প্রেসিডেন্টের মরদেহ একটি খাটের উপর উঠানোর সম্মানটুকুও দেখাতে চাইলো না। একটা অবাঞ্ছিত বস্তার মতই তাঁর লাশ মেঝের কোণে পড়ে রইলো।

বিএনপি নেতা, মিজানুর রহমান চৌধুরীই কেবল সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে তাঁর নিজের বিছানার সাদা চাদরটি এনে নিহত প্রেসিডেন্টের উপর সযত্নে বিছিয়ে দিলেন। নৌবাহিনীর প্রধান এ্যাডমিরাল এম, এ, খান ৫টা ৩০ মিনিটে সার্কিট হাউসে আসে। নীচের বারান্দায় সে অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ ধরে কথাবার্তা বলে। কয়েকজন কর্মকর্তা সে সময় তাকে দু’তলায় প্রেসিডেন্টের লাশ দেখার জন্যে অনুরোধ করলেও সে তা রক্ষা করেনি। পরবর্তীতে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পরেও তার এ অপ্রত্যাশিত আচরণের হেতু পরিষ্কার করে জানা যায়নি।

চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিন আহমেদ ঐ সময় সেখানে উপস্থিত থাকলেও প্রেসিডেন্টের লাশের প্রতি তিনি উপযুক্ত সম্মান দেখাতে এবং তা সংরক্ষণের ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন। স্পষ্টতঃই আমার প্রশ্নে সাইফুদ্দিন বিব্রতবোধ করতে থাকেন। তিনি বলেন : ‘পূর্বের ঘটনা নিয়ে আমি এখন কিছু বলতে চাই না।’ যে কোন একটা জবাবের জন্যে তাকে চাপ দেয়া হলে, তিনি ছল-চাতুরির আশ্রয় নেয় এবং বলেন : ‘আমার কি করা উচিত, তা আমি তখন বুঝে উঠতে পারিনি। সার্কিট হাউসে আমি ঘণ্টা খানিকের মত ছিলাম। ঐ সময়ের উপস্থিতিতে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, সেনাবাহিনী এ হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে। তারা প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেছে এবং তাদের মর্জিমত পরের কাজগুলোও তারাই করবে বলে আমরা কিছু করতে সাহস পাইনি। আমরা অত্যন্ত অসহায় বোধ করছিলাম।

আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম : ‘প্রেসিডেন্টের লাশটি উদ্ধার করা হয়নি কেন? সাইফুদ্দিন : ‘কি করতে হবে, আমি তা বুঝতে পারিনি। এটা নিতান্তই পুলিশের কাজ। আইন অনুযায়ী, তারা লাশের জন্যে দায়ী।’

অবিশ্বাসের চোখে আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলে, সাইফুদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন : ‘লাশের উপর রাখা বিছানার চাদরটি উঠিয়ে প্রেসিডেন্টের মুখটি দেখার মত মানসিকতা আমার ছিলো না। ‘ চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের এ ছিলো যোগ্যতার বহর।

সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে সকল কর্মকর্তা আর নেতৃবৃন্দ সার্কিট হাউস ছেড়ে চলে যায়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ তখনও বারান্দার মেঝেতে একইভাবে পড়ে থাকে। সার্কিট হাউসে মাত্র দু’জন বেসামরিক অফিসারের তত্ত্বাবধানে প্রেসিডেন্টের লাশ রেখে তারা চলে যেতে পেরেছিলো। কমিশনার সাইফুদ্দিন যাবার সময়ে লেঃ কর্নেল মাহফুজ আর মাহতাব এবং এডিসি, ক্যাপ্টেন মাজহারকে তার সঙ্গে নিয়ে যায়। তার বাসায় নিয়ে তাদেরকে তার স্ত্রীর হাতে তৈরী করা নাস্তা পরিবেশন করে।

এক ঘণ্টা পরে তিজন বিদ্রোহী মেজর ১২ জন সিপাই নিয়ে সার্কিট হাউসে এসে পৌঁছায়। ঐ তিনজন হচ্ছে—মোজাফফর, শওকত আলী এবং রেজা। দু’টি জীপ আর একটি আর্মি ভ্যানে করে তারা পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এখানে আসে। গোপন কাগজপত্র এবং জিয়ার ব্যক্তিগত ডায়েরীটি খোঁজার জন্যে ওরা প্রেসিডেন্টের শয়নকক্ষ একেবারে তছনছ করে ফেলে। একটা পুরনো সুটকেসে বিদ্রোহীরা জিয়ার সকল ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ঢুকিয়ে নেয়। তারপর তারা তাঁর লাশ একটি সাদা বিছানার চাদরে মুড়ে ফেলে। কর্নেল আহসান আর ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশও তারা একইভাবে মুড়ে তিনটি লাশ একত্র করে ভ্যানে উঠিয়ে কবর দেয়ার জন্যে নিয়ে চলে যায়। তখন সকাল ৯টা ৩০ মিনিট।

প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করার খবর যখন মঞ্জুরের কাছে পৌঁছায়, তখন ভোর ৪টা ৪৫মিনিট। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেসামরিক পোশাকে নিজে গাড়ি চালিয়ে ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেড কোয়ার্টারে চলে আসেন। এসেই তিনি কয়েকটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে এবং বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিয়ার প্রতি অনুগত সৈন্যেরা যাতে চট্টগ্রামের দিকে আসতে না পারে, সে জন্যে তিনি ঐ রেজিমেন্টের ২টি কোম্পানীকে শুভপুর ব্রীজের গোড়ায় প্রতিরোধমূলক অবস্থান নিতে পাঠিয়ে দেন।

তারপর মঞ্জুর গাড়ী চালিয়ে তার ২৪তম ডিভিশন হেড কোয়ার্টারে চলে আসেন। সেখানে এসে তিনি সকল ব্রিগেড কমান্ডার, ডিভিশনাল স্টাফ অফিসার এবং কমান্ডান্টদের ডেকে পাঠান। তাদের উদ্দেশ্যে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন, কয়েকজন তরুণ অফিসারের হাতে দেশের প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন। তিনিও তাদের সঙ্গে আছেন। তিনি বলেন, প্রশাসন দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলো এবং সোনাবাহিনীতেও তা ঢুকে পড়েছিলো। জিয়াকে কয়েকবার এ নিয়ে সতর্ক করা হলেও তিনি কোন সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তারপর মঞ্জুর ঘোষণা করেন যে, দুর্নীতি উচ্ছেদ এবং দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে একটি ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’ গঠন করা হয়েছে। তিনি একখানা পবিত্র কোরআন শরীফ তুলে ধরে উপস্থিত সকলকে কোরআন শরীফ ছুঁয়ে তার প্রতি এবং বিপ্লবী কাউন্সিলের প্রতি সমর্থন এবং আনুগত্য জ্ঞাপনের শপথ নিতে নির্দেশ দেন।

জিয়া হত্যার উপর প্রকাশিত শ্বেতপত্রের মতে, উপস্থিত সকল অফিসারই কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলো। কিন্তু পরে মঞ্জুরের আসল রূপ প্রকাশ হয়ে গেলে, তাদের অনেকেই সরকার পক্ষে যোগ দেয়।

শ্বেতপত্রটি থেকে আরো জানা যায় যে, ৩০শে মে সকাল বেলায় আরো অনেক পদস্থ বেসামরিক, সামরিক ও পুলিশ অফিসারকে জিওসির অফিসে নিয়ে আসা হয়। এবং কোরআন শরীফ ছুঁইয়ে তাদেরকে মঞ্জুর এবং বিপ্লবী পরিষদের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের শপথ গ্রহণ করানো হয়। অন্যান্যের মধ্যে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিন, ডেপুটি কমিশনার জিয়াউদ্দিন চৌধুরী, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বদিউজ্জামান, বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম, বিডিআর-এর সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্ণেল আবদুল্লাহ আজাদ। মঞ্জুরের আর তার ঘোষিত বিপ্লবী পরিষদের উপর তাদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে।

এরপর মঞ্জুর চট্টগ্রাম রেডিও থেকে এক বেতার ভাষণে বিপ্লবের কারণ ব্যাখ্যা করে সেনাবাহিনীর সমর্থন লাভের প্রচেষ্টা চালান। সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে বেশ কিছু রদবদল ঘোষণার মাধ্যমে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে সেনাবাহিনীর সমর্থন লাভের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর প্রধান লেঃ জেনারেল হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের বরখাস্তের কথাও উল্লেখ করা হয়। মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীকে সেনাবাহিনী প্রধানের স্থলাভিষিক্ত হবার কথা উল্লেখ করা হয়। মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী আর মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেনকে মিলিটারী যোগাযোগ সিস্টেমের মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে তাদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলা হয়। বার্তার মতে, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হবে।

মঞ্জুর ‘সিগন্যাল’ পাঠিয়ে বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, ঢাকার ৪৬ পদাতিক ব্রিগেড, কুমিল্লার ৩৩ পদাতিক ডিভিশন, যশোরের ৫৫ পদাতিক ডিভিশন এবং বাংলাদেশ রাইফেলসের সমর্থন লাভের আবেদন জানান। তিনি বলেন যে, ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থ আর সংহতির প্রয়োজনে তাঁদের সহযোগিতার একান্ত প্রয়োজন।’ মঞ্জুরের সব আবেদনই ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।

বিপ্লবী পরিষদের কথা ঘোষণা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ‘বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করা হয়নি। মেজর খালিদ পরে জানায়, ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিষদ গঠন করার কথা ছিলো। ঢাকার সমর্থন পাবার পরই তা আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হতো বলে খালিদ মত প্রকাশ করে।

দেশের সরকার, সেনাবাহিনী আর বিমান বাহিনীর কেন্দ্রস্থল ঢাকায় রেখে, দেশের এক দূর প্রান্তে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চালানো, পাগলামি ছাড়া আর কি-ই বা হতে পারে। ঢাকায় কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজে মঞ্জুরের হঠাৎ বদলির খবর আর ঠিক ঐ মুহূর্তেই প্রেসিডেন্ট জিয়ার চট্টগ্রাম সফরের সুযোগ—এ দুটোই জিয়ার হত্যাকে ত্বরান্বিত করেছিলো। একটা হত্যা দিয়ে শুরু করে বিদ্রোহীরা একে অভ্যুত্থানে উন্নীত করতে চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার, তারা সেনাবাহিনীর মানসিকতা বুঝতে পারেনি।

এক ঘণ্টারও কিছু পরে প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যার খবর ঢাকায় টেলিফোনে জানানো হয়। ঐ সময়ে দুই শহরের মধ্যে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা অচল ছিলো। এডিসি, ক্যাপ্টেন মাজহার সম্ভবতঃ কিছুটা শোকাহত হয়ে পড়েছিলো। জরুরী যোগাযোগের জন্যে প্রদত্ত প্রেসিডেন্টের ‘রোভার’ ওয়্যারলেসটি সে তখন ব্যবহার করতে পারতো। অথচ তা না করে, সে কল বুক করে ঢাকার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা চালায়। ৫টা ৩০ মিনিটের সময় সে প্রেসিডেন্টের মিলিটারী সেক্রেটারী, মেজর জেনারেল সাদিকুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে সক্ষম হয়। প্রেসিডেন্টের মিলিটারী সেক্রেটারী জেনারেল সাদিক লেঃ কর্নেল মাহফুজের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে, পাশের রুম থেকে মাহফুজকে ডাকা হয়। মাহফুজ আসতে আসতে টেলিফোন লাইনটি কেটে যায়।

সঙ্গে সঙ্গেই মিলিটারী সেক্রেটারী বঙ্গভবন থেকে সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করেন। দশ মিনিট পর চীফ অব জেনারেল স্টাফ, মেজর জেনারেল নূর উদ্দিন খানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ঘটনাটি বলেন। তিনিও মুহূর্তের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রধান লেঃ জেনারেল এইচ, এম, এরশাদকে ঘটনাটি জানিয়ে দেন। ৬টা ২০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত সেনা সদর প্রকম্পিত হয়ে উঠে। জেনারেল এরশাদ সকল সিনিয়র অফিসারকে সেনা সদরে ডেকে পাঠান। বিদ্রোহে কে জড়িত? বিদ্রোহ কতটা ছড়িয়ে পড়েছে? অন্যান্য সেনানিবাসে বিদ্রোহীদের সমর্থন রয়েছে কি? ইত্যাদি খবরাদি তখনো তাদের কাছে জানা ছিলো না।

সন্দেহের মাত্রা আরো বেড়ে যায় যখন লেঃ কর্নেল মাহফুজ প্রেসিডেন্টের ওয়্যারলেসে মিলিটারী অপারেশনকে প্রেসিডেন্টের লাশ নিয়ে যাবার জন্যে হেলিকপ্টার পাঠাতে বলে। মাহফুজ যখন কথা বলে, তখন সময় সকাল ৭টা। মাহফুজ, প্রেসিডেন্টের লাশ নেয়ার জন্যে সেনাবাহিনীর প্রধান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টের মিলিটারী সেক্রেটারীকে হেলিকপ্টারে আসতে বলে হেলিকপ্টারকে সার্কিট হাউসে অবতরণ করতে জানিয়ে দেয়। আসলে, ২৫শে মে, কর্নেল মতির সঙ্গে ঢাকায় মাহফুজের যে আলোচনা হয়েছিলো সেই আলোচনা মাফিক তাদেরকে চট্টগ্রামে এনে জিম্মী করার চেষ্টা চালিয়েছিলো সে। কিন্তু, সেনাসদর তা আঁচ করতে পেরে মাহফুজের ঐ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।

৩০শে মে, জেনারেল এরশাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেশের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে চলার ব্যবস্থা তিনি নিশ্চিত করেন। প্রেসিডেন্টে তো নিহত হয়েছেন। এখন সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। শাসনতন্ত্রকে মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে জেনারেল এরশাদ, সেনাবাহিনী এবং দেশকে তাদের কর্তব্যের প্রতি একটা পরিষ্কার দিক নির্দেশ করলেন। সর্বত্রই তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাদৃত হয়। চট্টগ্রাম এলাকাতে ভুল পথে পরিচারিলত সৈন্য এবং অফিসাররাও তাদের ভুল বুঝতে পেরে তাদের বিদ্রোহের যবনিকা টানে।

ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার-এর কাছে যখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যার খবর জানানো হয়, তখন তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শায়িত আছেন। জেনারেল এরশাদ ঐ অবস্থায়ই তাকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করার অনুরোধ জানান। বিচারপতি সাত্তার তাঁর বার্ধক্যজনিত অক্ষমতার কারণ দর্শিয়ে ঐ দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। বিচারপতির ঐ ধরনের অস্বীকৃতি খুব সহজেই অনুমেয়। কারণ, হত্যা করেছে সেনাবাহিনী এবং স্পষ্টতঃই তা ক্ষমতায় আরোহণের জন্যে। সুতরাং এই সকল স্পর্শকাতর বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চাওয়া, একজন বিচারপতির জন্যে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর যুক্তিকে খন্ডন করে জেনারেল এরশাদ তাঁর পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিয়ে নিজে ব্যক্তিগতভাবে বিচারপতি সাত্তারকে প্রহরা দিয়ে বঙ্গভবনে নিয়ে আসেন এবং প্রধান বিচারপতিকে দিয়ে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে শপথ বাক্য পাঠ করান।

প্রথমেই সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন লাভের জন্যে প্রেসিডেন্ট সাত্তার ৯০ সেকেন্ডের একট বেতার ভাষণ প্রদান করেন। জিয়ার শাহাদত বরণ-এর কথা ঘোষণা করে নূতন প্রেসিডেন্ট দেশবাসীর প্রতি শান্তি, শৃঙ্খলা আর দেশপ্রেমের আহবান জানান। তিনি বলেন, সরকারী দপ্তর এবং মন্ত্রী পরিষদ স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছে। নিহত প্রেসিডেন্টের জন্যে তিনি সারাদেশে ৪০ দিনব্যাপী শোক দিবস পালনের সরকারী সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সান্ত্বনার জন্যে, ‘বাংলাদেশ তার সকল আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চুক্তিমালা মেনে চলবে বলে প্রেসিডেন্ট সাত্তার পুনরায় দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা দেন। তারপর তিনি বলেন, সরকারের তরফ থেকে শীঘ্রই আপনাদেরকে পরিস্থিতির পূর্ণ বিবরণ জানানো হবে।’

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক আহবান করা হয়। দেশে মার্শাল ল জারি করতে হবে—এ ধরনের সম্ভাবনা শীঘ্রই মানুষের মন থেকে উঠে যেতে থাকে। সশস্ত্র বাহিনীকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে চলতে দেখে বেসামরিক প্রশাসন আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়ে। সরকার ঐ অবস্থায় দেশে মার্শাল ল জারি না করে দেশব্যাপী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। জনসভা, মিছিল ইত্যাদি রহিত ঘোষণা করা হয়। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট তিন বাহিনীর প্রধানকে বিদ্রোহ দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। বিদ্রোহীদের অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশও দেয়া হয়।

বেসামরিক সরকার নব উদ্যম ও ক্ষমতার আস্থা নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে শুরু করে। অবশ্য সেনাবাহিনীর প্রধান, জেনারেল এরশাদ প্রকৃতপক্ষে বেশীরভাগ কাজই চালিয়ে নিচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম ছাড়া, দেশের অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই রয়ে গিয়েছিলো। ঐ সময়ে জেনারেল এরশাদ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে একটা শক্তিশালী বাহিনী চট্টগ্রামের দিকে পাঠিয়ে দেন, যাতে করে ঐ দিক থেকে কোন আক্রমণ পরিচালিত হলে, ওরা তা প্রতিহত করে দিতে পারে। তখনও সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে বিদ্রোহ নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধা কাজ করছিলো। এমন সময় অর্থাৎ প্রায় দুপুরের দিকে, জেনারেল মঞ্জুর, সেনা সদর দফতরে মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীকে টেলিফোন করেন। মঞ্জুর, জেনারেল শওকতকে বিপ্লবী পরিষদ এবং তাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য পরিবেশন করেন। তিনি চট্টগ্রামের দিকে কোন সৈন্য পাঠাতেও তাকে বারণ করেন।

চট্টগ্রাম থেকে মঞ্জুরের টেলিফোন পেয়ে জেনারেল এরশাদ তাঁর প্রয়োজনীয় তথ্য হাতে পেয়ে যান। তিনি বিদ্রোহের রূপরেখা আঁচ করতে পেরে জেনারেল এরশাদ রেডিও এবং টেলিভিশনে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন এবং একটা ক্ষুদ্র দুষ্কৃতকারী দলের প্ররোচনায়, সৈন্যদেরকে ভুলপথে পা বাড়াতে সাবধান করে দেন। ঐ দুষ্কৃতকারী দলের লোকেরা দেশের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানকে খুন করেছে বলে তিনি জানান। সেনাবাহিনীর প্রধান অনুগত সৈন্যদেরকে শুভপুর ব্রীজের কাছে সরকার পক্ষে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। ৩১শে মে, রোজ রোববার দুপুর পর্যন্ত সময় দিয়ে ঘোষণা করেন যে, যারা ঐ সময়ের মধ্যে সরকার পক্ষে যোগ দেবে তাদেরকে ‘সাধারণ ক্ষমার’ আওতায় ফেলা হবে। জেনারেল এরশাদ ইতিমধ্যেই মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং তার দলকে বিলম্ব না করে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ পাঠিয়ে দেন। অন্যথায়, তাদেরকে মারাত্মক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে বলে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন।

জেনারেল এরশাদের নির্দেশ ঢাকা রেডিও থেকে প্রথম দিন আধা ঘণ্টা পর পর এবং পরের দিন এক ঘণ্টা পর পর প্রচারিত হতে থাকে। এই প্রচারের ফলে, চট্টগ্রামে অবস্থিত সেনাবাহিনীতে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারা পরিষ্কার বুঝতে পারে যে, তারা দেশের এক কোণে পড়ে আছে এবং দেশের সরকার স্বাভাবিক কাজ-কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি, একটা আসন্ন আক্রমণের ভয়েও তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।

পরের দিন আর্মি চীফ, চট্টগ্রামে জেনারেল মঞ্জুরের উপর আরো চাপের সৃষ্টি করেন। প্রচুর পরিমাণে সৈন্য শুভপুর ব্রীজ অতিক্রম করে সরকার পক্ষে যোগদান করতে থাকলে, জেনারেল এরশাদ আত্মসমর্পণের সময়সীমা আরো কয়েক ঘণ্টা বাড়িয়ে দেন। ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতির সাংঘাতিক অবনতি ঘটে।

মঞ্জুর শনিবারের পুরো বিকেল এবং রোববারের সকাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে তার প্রতি সমর্থনের প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি চট্টগ্রামে অবস্থিত সেনাবাহিনীর প্রতিটি ইউনিট পরিদর্শন করে বিভিন্ন রকম গালভরা বুলি ছড়িয়ে তাদের সমর্থন লাভের প্রাণপণ চেষ্টা চালান। কিন্তু ইতিমধ্যেই জেনারেল এরশাদের বেতার ভাষণ শুনে মঞ্জুরের প্রতি তাদের মোহমুক্তি ঘটে যায়। মঞ্জুর তা বুঝতে পেরে ডেপুটি কমিশনারের অফিসে পদস্থ বেসামরিক অফিসার, ব্যাংক ম্যানেজার, সংবাদপত্রের সম্পাদক, বন্দর কমিশনার এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের এক বৈঠক আহবান করেন। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি দেড়ঘণ্টা ধরে বিপ্লব নিয়ে বক্তব্য রাখেন। পরে মঞ্জুর কুমিল্লাস্থ ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, মেজর জেনারেল সামাদকে হাতে লিখে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি গৃহযুদ্ধ এড়ানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করে দু-একটি ফাঁকা কথা বলার চেষ্টা করেন। এতে জেনারেল সামাদ অনুপ্রাণিত হতে না পেরে, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার ঐ চিঠিটি ঢাকায় সেনাবাহিনীর কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠিয়ে দেন।

অবস্থা বেগতিক দেখে জেনারেল মঞ্জুর ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের পরামর্শ গ্রহণের জন্যে তার অফিসে এক বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমীর কমান্ডান্ট, ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্ একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্যে ঢাকার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালানোর পরামর্শ দেয়। উপস্থিত অধিকাংশ অফিসারই এ প্রস্তাবে রাজী হয়। কিন্তু মতি আর দেলোয়ার তা মানতে রাজী হয়নি। দেলোয়ার চিৎকার করে বলে উঠে : কিসের আলাপ-আলোচনা? চলুন ঢাকার দিকে মার্চ করে এগিয়ে যাই।

মঞ্জুর নিজেই ব্রিগেডিয়ারের পরামর্শে একমত পোষণ করেন এবং ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহকেই সেনা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আলোচনা চালানোর কাজে নিয়োগ করেন। ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্ নির্দেশমত মেজর জেনারেল নূর উদ্দিন খানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে জেনারেল মঞ্জুরের একটি বাণী পাঠ করে শুনায়।

দু’ঘণ্টা পরে হান্নান শাহ্ জেনারেল নূর উদ্দিনের সঙ্গে আবারো যোগাযোগ স্থাপন করে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে মঞ্জুরের ৪ দফা দাবী পেশ করে। ঐ দাবীগুলো হচ্ছে : (১) দেশে মার্শাল ল জারি করতে হবে; (২) প্রধান বিচারপতিকে দেশের প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করতে হবে; (৩) জাতীয় সংসদ বাতিল ঘোষণা করতে হবে; (৪) বিপ্লবী পরিষদকে স্বীকৃতি দিতে হবে। মেজর জেনারেল নূর উদ্দিন খান অন্যদিক থেকে জানিয়ে ছিলেন যে, সরকার বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করতে রাজী নহেন। বিপ্লবী বিরোধী প্রচারণাও চলতে থাকবে বলে তিনি জানিয়ে দেন। লেঃ কর্নেল মতি এতে ক্ষেপে যায় এবং সরকারী সৈন্যের উপর গুলি চালাতে চেষ্টা করে। মঞ্জুর তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করেন।

মধ্যরাত পর্যন্ত টেলিফোনে আলোচনা চলতে থাকে। তখনও চীফ অব জেনারেল স্টাফ, মেজর জেনারেল নূর উদ্দিন খান বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের জন্যে বিদ্রোহীদের উপর চাপ দিতে থাকেন।

পরিশেষে, রাত একটায় (সোমবার) মঞ্জুর ব্যক্তিগতভাবে জেনারেল নূর উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। কথোপকথন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু এতে কি বেরিয়ে আসে, তা জানা না গেলেও টেলিফোনে আলাপরত অবস্থায় মঞ্জুরকে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত দেখায়। তিনি অত্যন্ত শান্তভাবে অফিসারদেরকে তাদের ব্রিগেডে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। তারপর মেজর মোজাফফর আর রেজাকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্রোহের নেতা তার গাড়ীতে ওঠেন এবং বাসার দিকে রওনা দেন। তিনি অচিরেই অফিসে ফিরে আসছেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। কোনদিনও তার আর ফিরে আসা হয়নি। সোমবার ভোর দু’টার মধ্যে (জিয়া হত্যার ৩৬ ঘণ্টা পর) বিদ্রোহের অবসান ঘটে এবং বিদ্রোহীরা পালিয়ে যেতে শুরু করে।

১লা জুন, সোমবারে দলে দলে মঞ্জুরের সাথীরা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালাতে শুরু করে। যাবার আগে মঞ্জুর মেজর খালিদকে জিজ্ঞেস করেন : ‘আমরা কি তোমার ভাবীকে সঙ্গে নিয়ে যাবো?’ খালিদ কর্কশ স্বরে উত্তর দেয় : ‘আমরা তো আমাদের জীবন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি মেয়েলোক আর ছেলেমেয়েরা আমাদের পলায়নের বাধার সৃষ্টি করবে।’ কিন্তু মঞ্জুরের স্ত্রী তার সঙ্গে যেতে জেদ ধরলে সে তার বেগম, দুই ছেলে আর দুই মেয়ে এবং বেগম মঞ্জুরের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মিসেস দেলোয়ার আর তার তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্জুর অজানার সন্ধানে ছুটে চলে। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, পলায়নকারী দলের সঙ্গে লেঃ কর্নেল দেলোয়ার যোগদান করেনি।

তারা উত্তরদিকে গাড়ী চালিয়ে হাটহাজারী থেকে ফটিকছড়ির দিকে যেতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ১১ জন অফিসার, দু’জন মহিলা আর ৭ জন ছেলেমেয়ে তাদের দলে যোগ দেয়। তিনটি জীপ আর একটি সামরিক পিকআপে করে তারা এগিয়ে চলে। পলায়নকারী অফিসাররা হচ্ছেন- জেনারেল মঞ্জুর, লেঃ কর্নেল মতি, মাহবুব, ফজলে, মেজর মোজাফফর, গিয়াস, রেজা, ইয়াজদানী,খালেদ, ক্যাপ্টেন মুনীর আর জামিল। মেজর রেজা, জেনারেল মঞ্জুরকে জিজ্ঞেস করে : ‘স্যার আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

মঞ্জুর : ‘গুইমারায় অবস্থানরত ২১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে।’ আসলে,মঞ্জুর কোনমতেই সেনাবাহিনীর ধারে-কাছেও যেতে চাচ্ছিলেন না। তিনি যাচ্ছিলেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বর্ডারের কাছে। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা গাড়ী চালালেই ভারতের সীমান্তে পৌছা যেতো। ইতিমধ্যে অবশ্য ওরা পার্বত্য অঞ্চলের, গভীর জঙ্গলে নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখতেও পারতো। কিন্তু তা আর হলো না।

আগের গাড়ীতে করে জেনারেল মঞ্জুর ও অন্যান্যরা দ্রুত বেগে ফটিকছড়ি থেকে মানিকছড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে যায়। পরের গাড়ীতে ছিলো মতি আর মাহবুব। দুর্বাগ্যবশতঃ ওরা ১২ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের একটি কলামের কাছে এসে পৌঁছায়। ঐটিতে মেজর মান্নান নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। ওরা তাদেরকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে, মেজর মান্নান তাদেরকে আটকে ফেলে। কথা বলাবলির এক পর্যায়ে কর্নেল মতি একটি স্টেনগান হাতে নিয়ে একেবারে কাছে থেকে মান্নানকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দেয়। মেজর মান্নান অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও নায়েক সুবেদার শামছুল আলম সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ান পাল্টা গুলি চালিয়ে দিলে মতি ও মাহবুব সেখানে নিহত হয়। ক্যাপ্টেন মুনীর বন্দী হয় এবং মেজর মোজাফফর যেভাবেই হোক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়ে জেনারেল মঞ্জুর তাঁর গাড়ীর গতি অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। মাইল দু’-এক যাবার পরই মঞ্জুর গাড়ী থেকে নেমে তার স্ত্রী ও সন্তানাদি, সেলোয়ারের স্ত্রী ও সন্তানাদি এবং মেজর গিয়াস আর রেজাকে সঙ্গে নিয়ে খামার উপজাতীয় এলাকার গ্রামের পথ ধরে পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকেন। প্রচন্ড খরা রোদের মধ্য দিয়ে সারা সকাল ও দুপুর পর্যন্ত তারা পায়ে হেঁটে চলতে থাকেন। মাঝেমধ্যে পানির জন্যে এবং একটুখানি বিশ্রামের জন্যে এখানে সেখানে তারা যাত্রা বিরতি করেন।

এশিয়া টি গার্ডেনে পৌঁছাতে বিকেল আড়াইটা বেজে যায়। তখন তারা অত্যন্ত ক্লান্ত এবং অবসন্ন। চা বাগানের এক কুলি, মনু মিঞার ঘরে মঞ্জুর আশ্রয় গ্রহণ করেন। সকলেই তখন পেটের ক্ষুধায় অস্থির। ক্ষুধার যন্ত্রণা নিবৃত্তির জন্যে জেনারেলসহ সকলেই ঐ কুলির ঘরে সামান্য কিছু খেয়ে নিতে বসে পড়েন। কিন্তু বিধি তাদের বাম। খাওয়া আর হলো না। বাড়ীর চতুর্দিক সশস্ত্র পুলিশ ঘিরে ফেলে। মঞ্জুরের হাতে তখনো একটি এসএমজি ছিলো। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে যুদ্ধ ছাড়াই জেনারেল মঞ্জুর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

পুলিশ জেনারেলের প্রতিবাদ সত্ত্বেও তাকে ক্যাপ্টেন এমদাদের হাতে সোপর্দ করে। ক্যাপ্টেন এমদাদ মঞ্জুরের হাত, পা আর চোখ বেঁধে তাকে ধাক্কিয়ে নিয়ে তার জীপে তুলে। সরকারী শ্বেতপত্রের মতে, ক্যাপ্টেন এমদাদ ভিআইপি হাউসের দিকে মঞ্জুরকে নিয়ে যাবার সময় একদল সশস্ত্র সৈন্য জেনারেলকে জোর করে গাড়ী থেকে নামিয়ে ফেলে এবং খুনী খুনী বলে চিৎকার করতে থাকে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্য থেকে একজনের মাত্র একটি গুলির আঘাতে জেনারেলের মাথায় এক বিরাট ছিদ্র হয়ে যায়। মঞ্জুরের দেহ হুমড়ি খেয়ে একটি ড্রেনে যেয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিহত হন।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, জেনারেল মঞ্জুর আর তার ভাগ্নে কর্নেল মাহবুবরে লাশ কেউ দাবী করেনি। সৈনিকদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে চট্টগ্রামে ক্যান্টনমেন্ট কবরস্থানের দু’টি চিহ্নবিহীন কবরে সমাহিত করা হয়।

১লা জুন, সোমবার সকালের মধ্যেই বিদ্রোহের অবসান ঘটে। তারপর থেকেই বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করে।

প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং তাঁর দুই সহকারী লেঃ কর্নেল আহসান আর ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ সার্কিট হাউস থেকে উঠিয়ে দু’দিন আগে মেজর মোজাফফ আর শওকত আলীর নেতৃত্বে কবর দেয়ার জন্যে নিয়ে যেতে দেখা যায়। চট্টগ্রাম থেকে ১৭ মাইল দূরে রাঙ্গুনিয়াস্থ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আশপাশে কোথাও তাদের কবর দেয়া হয়েছে বলে আন্দাজ করা হয়। কারণ, লাশসহ আর্মির গাড়িগুলো কাপ্তাই রোড ধরে ওদিকেই যেতে দেখা গেছে।

৩০শে মে, দেড়টার দিকে লাশ তিনটি নিয়ে কলেজের এলাকা দিয়ে এগিয়ে যাবার সময় মোহাম্মদ বশিরী নামে একজন ছাত্র দেখতে পায়। সেনাবাহিনীর গাড়ী যেতে দেখে তার সন্দেহ জাগে সে তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করেন। পাশের একটি বাজার থেকে তিনজন দিনমজুর নিয়ে নিকটবর্তী পাথরঘাটা গ্রামের দিকে যেতে দেখে। গ্রামের কাছে ছোট পাহাড়ের নীচে মজুরদেরকে দিয়ে তারা একটি গর্ত খুঁড়তে শুরু করে। বশিরী কাছে গিয়ে ব্যাপারটি ভাল করে দেখতে চেষ্টা করলে, সৈন্যেরা তাকে সেখান থেকে দূরে তাড়িয়ে দেয়। বশিরী পাশের একটা পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থেকে সবকিছু অবলোকন করে।

বশিরীর মতে, কবর খুঁড়ে সৈন্যেরা তিনটি লাশ একত্রে গাদাগাদি করে কবরের পাশে রাখে। তারপর নিহতদের জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্যে পাশের এক দরগা থেকে একজন ইমাম ডেকে নিয়ে আসে। প্রচারিত নিয়ম-কানুন পালন না করেই লাশগুলোকে তড়িঘড়ি করে কবরস্থ করে তারা। বশিরী দু’দিন ধরে এ সত্যটি গোপন রাখে। তারপর ১লা জুন যখন সে বিদ্রোহ দমনের খবর পায়, সে তখন দৌড়ে গিয়ে রাঙ্গুনিয়া পুলিশ স্টেশনে খবরটি জানিয়ে দেয়। বশিরী একজন সাব-ইন্সপেক্টর-এর নেতৃত্বে একদল পুলিশ নিয়ে সেখানে যায়। এবং কবর খুঁড়তে শুরু করে। তারা কবর খুঁড়ে আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করে যে, মাত্র একটি সাদা বিছানার চাদরে মোড়া তিনটি লাশ কবরে পড়ে আছে। তাদেরই একজন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান।

এর মধ্যেই মিলিটারী অফিসাররা সেখানে পৌছে যায়। তারা লাশগুলাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, চট্টগ্রামে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে।

জিয়ার লাশ ঢাকায় পাঠানোর জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত হয়। জিয়ার লাশের উপর ফর্মালিন, ইউক্যালিপটাশ, সিডার অয়েল আর আতর ঢালা হয়। তারপর কফিনের ভেতর তাজা চা পাতা দিয়ে লাশটি এর মধ্যে ঢুকানো হয়। জাতীয় পতাকা দিয়ে কফিনটি একটি হেলিকপ্টারে উঠিয়ে দেয়। কিন্তু ঝড়ো হাওয়ার জন্যে ফেনী থেকে হেলিকপ্টারটি ফিরে চট্টগ্রামে চলে আসে। তারপর বিমান বাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে করে লাশটি ঢাকায় পাঠানো হয়। পরের দিন পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জিয়ার লাশ চির শয়নে শায়িত করা হয়। সেদিন তার শেষকৃত্যে দশ লক্ষাধিক লোক শরীক হয়।

মরণকালে জিয়া তার স্ত্রী এবং দু’টি অল্প বয়সের ছেলে রেখে যান। জিয়া তাঁর সারাজীবনে কোনদিনও অসদুপায়ে টাকা-কড়ি বানানোর চিন্তা করেননি। কাজেই, তাঁর অকাল মৃত্যুতে তাঁর স্ত্রী ও দু’টি ছোট ছেলে আর্থিক অনটনে পড়া খুবই স্বাভাবিক। এই দিকগুলো চিন্তা করে ১৯৮১ সালের ১২ই জুন, এক মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে বিচারপতি সাত্তারের সরকার নিহত প্রেসিডেন্টের বিধবা স্ত্রী, খালেদা জিয়া এবং তাঁর পরিবারকে নিম্নে প্রদত্ত আর্থিক ও বৈষয়িক সুবিধাদি প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেন :

১। জরুরী ভিত্তিতে ১০ লক্ষ টাকার নগদ মঞ্জুরী।

২। এক টাকা নাম মাত্র মূল্যে ঢাকার অভিজাত এলাকায় একটি বিরাট আধুনিক বাংলো পূর্ণ মালিকানাসহ বরাদ্দ।

৩। ২৫ বৎসর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত দু’টি ছেলের দেশের ভেতরে এবং বাইরে লেখাপড়ার সকল খরচ সরকার বহন করবেন। এইসময়ে অবশ্য তারা মাসিক মাথাপিছু ১৫০০ টাকা করে ভাতা পেতে থাকবে।

৪। সরকার বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের দেশের ভেতরে এবং বাইরে সকল প্রকার চিকিৎসার পূর্ণ খরচ বহন করবেন।

৫। সরকার তাদের ব্যবহারের জন্যে একটি গাড়ী দেবেন এবং ঐ গাড়ীর জন্যে প্রয়োজনীয় একজন ড্রাইভার প্রদান করবেন এবং সমুদয় পেট্রোল খরচ বহন করবেন।

৬। তাদেরকে সরকার একটি টেলিফোন প্রদান করবেন, যার খরচ তাদেরকে বহন করতে হবে না।

৭। খালেদা জিয়ার বাড়ীতে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানি খরচ সরকার বহন করবেন। তার বাড়ীতে গার্ড প্রদানের ব্যবস্থাও সরকার গ্রহণ করবেন।

৮। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সেক্রেটারী এবং পাঁচজন গৃহভৃত্যের খরচ সরকার বহন করবেন।

সে যাই হোক সন্দেহ, শৃঙ্খলহীনতা বা খারাপ অফিসার এই ধরনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অন্ততঃ ৬০ জন সিনিয়র আর্মি অফিসারকে চাকুরীচ্যুত করা হয়। পূর্বের নজিরকে উপেক্ষা করে জেনারেল এরশাদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত সকল অফিসারকে বিচারের সম্মুখীন করেন। ঐ রকম ৩০ জন অফিসারকে সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। মেজর জেনারেল আব্দুর রহমান এবং আরো ৬ জন সিনিয়র অফিসার ঐ কোর্ট মার্শাল পরিচালনা করেন। এতে ১৩ জনকে ফাঁসি, ৭ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ৬ জনকে সাত থেকে দশ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং ৪ জনকে সসম্মানে খালাস দেয়া হয়।

এরপরে জিয়া হত্যার উপর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পাওয়া যায় ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু যে-কোন কারণেই হোক, ঐ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। এর পেছনে কিছু কারণ থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবে, এ রিপোর্ট প্রকাশিত না হবার কারণে বেশ কিছু সন্দেহজনক গুজব বাতাসে উড়ে বেড়াতে সক্ষম হয়। আর ঐসব গুজব ক্ষমতার সিঁড়িতে সম্ভাব্য নির্দোষ প্রতিযোগিদের সুখ্যাতিকে ম্লান করতে পেরেছিলো, এতে কোন সন্দেহ নেই। সব কথার পরেও আর একটা কথা থেকে যায়—তা হচ্ছে, দুরভিসন্ধির কথা। দুরভিসন্ধি আর হত্যা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। এক হত্যা আর এক হত্যাকে ত্বরান্বিত করেছে—দেশটাকে আবদ্ধ করেছে এক রক্তের ঋণে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *