তোরণ
কেতন উৎসব প্রায় এসে গেল। বর্ষা-ধোয়া আকাশটা রোদ মেখে তেল মাখানো নতুন তলোয়ারের মতোই ঝকঝক করছে, তোরণ-নগরীর উঁচু মিনারগুলোর মাথায় চলছে উৎসবের সাজ পরানোর তোড়জোড়। শহরের ওপরের দিকটা আজকাল ফলিকী আর বার্ক্ষীদের দখলে, মিনারের মাথায় নিশান বসানোর দায়িত্বটা তাদেরই।
বিশাল নিশানের দু-প্রান্ত ধরে এক মিনার থেকে অন্য মিনারের চূড়ায় অনায়াসে উড়ে যায় লম্বাটে ফলিকীদের ছোট ছোট দল, তাদের সরু পিঠে বাঁধা ধাতব গ্লাইডার থেকে ছিটকে যায় রোদের আলো। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরের পর ঝাঁপ-রশি ধরে হাওয়ায় দোল খেয়ে মিনারে থেকে মিনারে লাফিয়ে বেড়ায় তাদের খর্বকায় বার্ক্ষী সহকারীরা।
কোনও এক ঝাপসা হয়ে আসা অতীতে নিশান বসানোর কাজে হাত লাগিয়েছেন অল্লকপ্পও নিজেও। কিন্তু সেই সব পার হয়ে আসা বছরগুলোর ভারে শরীরটা আজ তাঁর ন্যুব্জ, লাঠিতে ভর না-করে তিনি হাঁটতে পারেন না, ঝাঁপ-রশিতে দোল খাওয়ার অভ্যাসকে সেই ঝাপসা অতীতেই ফেলে এসেছেন তিনি।
পেছনে পায়ের মৃদু শব্দ হয়। ঘাড় না ঘুরিয়েও অল্লকপ্প বুঝতে পারেন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে পান্থ গগ্গ।
তবু জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন অল্লকপ্প। মঠের উঁচু মিনার থেকে শহরের নিচের মঞ্জিলগুলো স্পষ্ট দেখা না গেলেও অল্লকপ্প জানেন সেখানেও আয়োজনের কমতি নেই। জলপথগুলোর দু-পাশ ছোট নিশানের মালায় সাজাচ্ছে বার্কিনী মাঝিরা, শহরের প্রতিটি আঙিনা আর চৌরাস্তা সামিয়ানা আর চাঁদোয়ায় মুড়ে নতুন রূপ দিচ্ছে বল্লুরী শিল্পীরা।
পোশাকের খসখসানিতে গগ্গর অস্থিরতাটা টের পান অল্লকপ্প।
‘থের অল্লকপ্প!’
একটা নিঃশ্বাস ফেললেন অল্লকপ্প। পান্থের শ্বেত অঙ্গবাস গায়ে উঠেছে প্রায় এক বছর আগে, কিন্তু তবু এখনও গগ্গর চঞ্চলতা কাটল না।
‘পান্থ গগ্গ, তিরন্দাজ যেমন কেবলমাত্র তার লক্ষ্যবস্তুতেই মনঃসংযোগ করে, তেমনই পান্থকেও শুধু পথের প্রতিই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে হয়! পান্থ সর্বদা তার মনকে পথের প্রতিই নিয়োজিত রাখবে।’
দার্শনিক তত্ত্বে এই মুহূর্তে গগ্গর রুচি আছে মনে হল না।
‘জানি থের অল্লকপ্প, কিন্তু ঐতিহাসিক চক্ষ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’
রোদমাখা আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে মন্থর গতিতে নিজের কাঠের আসনে এসে বসেন অল্লকপ্প। সিস্সকে শিক্ষাদানের তাগিদে অতিথিকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা অভদ্রতা হবে।
‘নিয়ে এসো।’
ঐতিহাসিক চক্ষের গাত্রবর্ণ ভোরের আকাশের মতো লালচে-নীল, সবুজ চোখ দুটি মরকত মণির মতো উজ্জ্বল!
‘আসুন! বসুন! ছায়াপথের এক প্রান্তে পড়ে আছি আমরা, মাঝে মধ্যে সেট্ঠিরা তাদের পসরা নিয়ে আসে বটে, কিন্তু আপনাদের মতো জ্ঞানীগুণীদের দেখা পাওয়াটা বিরল।’
মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করেন চক্ষ, ‘এক সেট্ঠির মুখেই আপনাদের কথা প্রথম শুনি। আপনাদের ইতিহাসটা অত্যন্ত—’
‘চিত্তাকর্ষক?’
মৃদু হেসে প্রশ্ন করেন অল্লকপ্প।
সায় দেন অল্লকপ্প, ‘মানলাম! কিন্তু সে ইতিহাস তো বহুকাল আগেই লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। জ্ঞানকোষাগারে গেলে তার সবটাই আপনি পেয়ে যাবেন।’
মাথা ঝোঁকান চক্ষ, ‘যথার্থ বলেছেন। কিন্তু ঘটনার দিনপঞ্জিটুকুতে ইতিহাস সমবায়ের আগ্রহ নেই। ইতিহাসের যে প্রবাহটি সভ্যতার দিকে সমাজকে ক্রমাগত
এগিয়ে নিয়ে চলে, তাকে আমরা বোঝার চেষ্টা করে থাকি।’
‘ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তা-ও, আপনি অতিথি, আপনার জন্য কী করতে পারি বলুন।’
হাত দুটো দু-পাশে ছড়িয়ে দেন চক্ষ, ‘এই শহর—আপনাদের এই তোরণ নগরী—এক কথায় অনন্য। ছায়াপথের দূর-দূরান্তেও এর তুলনা পাওয়া যায় না।’
‘ধন্যবাদ! এই শহর আর আমাদের সভ্যতা, দুটোই সমার্থক। একটা ছাড়া অন্যটাকে আমরা কল্পনাও করতে পারি না।’
ফের মাথা ঝোঁকান চক্ষ, ‘যথার্থ বলেছেন। সংঘাত থেকে শুরু হয়ে সভ্যতা অবধি আপনাদের যে যাত্রা, তার পেছনের সামাজিক প্রবাহটিকে বুঝতে চাওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য।’
ঈষৎ ভাঁজ পড়ে অল্লকপ্পের কপালে, ‘এবং সেই কারণেই আপনার আমার কাছে আসা?’
‘যথার্থ বলেছেন। তোরণ সভ্যতা পত্তনে সংঘ আর প্রথম পান্থের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তাই আপনার কাছে একটি অনুরোধ নিয়ে এসেছি।’
‘বলুন!’
‘ইতিহাসের নীরস তথ্যের পেছনে সুখ-দুঃখ আশা-নিরাশার যে স্রোত অলক্ষে বয়, তারই কথা আপনার মুখ থেকে সরাসরি শুনতে চাই।’
‘কিন্তু সময় যে নেই। প্রথম পান্থের নিব্বাণ সমাধিতে কেতন বসাতে কালই আমরা যাত্রা করছি! বিলম্ব করা তো সম্ভব নয়!’
হাত তুলে নিরস্ত করেন চক্ষ, ‘অবশ্যই! আপনাকে সে অনুরোধও করব না। বরং আপনার অনুমতি নিয়ে এই যাত্রায় আমি আপনাদের সঙ্গ নিতে চাই। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতটা তাহলে বুঝতে আমার অনেকটা সুবিধে হবে।’
যাত্রী
ডিমি ডিম ডিমিডি ডিমিডি ডিম। ডিমি ডিমি ডিম ডিম।
মাঝ-মঞ্জিলের সিঁড়ির একটা চওড়া চাতালে পান্থদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অল্লকপ্প। পেছনের কৃত্রিম জলপ্রপাতের আওয়াজ ছাপিয়ে ছড়িয়ে যায় দামামার গম্ভীর নিঃস্বন। সামনে ছড়ানো সোপান নেমে গেছে নিচের বিশাল চত্বরে, সেখানে তখন অসংখ্য নাগরিকের জমায়েত। দু-পাশে স্তরে স্তরে উঠে গেছে তোরণ নগরীর নানা মঞ্জিল, জলখিলেন, মিনার আর সেতুপথের জ্যামিতিক নকশা।
অল্লকপ্পর কয়েক ধাপ পেছনে দাঁড়ানো চক্ষ কৌতূহলী চোখে তাকান গগ্গর দিকে, ‘এটা কি আপনাদের ঐতিহ্যের অঙ্গ?’
‘বলতে পারেন। জনশ্রুতি বলে, প্রথম পান্থ এইভাবেই দামামা বাজিয়ে লোক জড়ো করে তাদের পথের কথা শোনাতেন।’
‘তখন তো নগরীর পত্তন হয়নি!’
‘না, তখন এটা ছিল বধ্যভূমি।’
‘বধ্যভূমি? ইতিহাস তো বলে যুদ্ধক্ষেত্র।’
চক্ষের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকান অল্লকপ্প, ‘একজনের কাছে যা যুদ্ধক্ষেত্র, বহুজনের কাছে যে তা বধ্যভূমি, এই সত্য কি আপনি জানেন না ঐতিহাসিক চক্ষ?’
নিরুত্তর থাকেন চক্ষ।
সামনের চওড়া সিঁড়ির দু-পাশে দুটি নিচু স্তম্ভের ওপর দুটি রক্তিম প্রস্তরমূর্তি। একটি কোনও পশুর অবয়ব, অন্যটি পাখির। চোখ তুলে সেই দিকে ইশারা করেন অল্লকপ্প, ‘এই কৃত্রিম গ্রহে পশুপাখি তেমন নেই। কিন্তু এই নগরের একটি ইট্ঠকও যখন গাঁথা হয়নি, তখন এই দুটি প্রাণী অতুল সংখ্যায় এখানে পাওয়া যেত।’
‘এই দুটি—?’
‘সিগ্গাল আর গিজ্ঝ। শবভোজী। তোরণ নগরী না থাকলে যে এদের প্রত্যাবর্তনে বিলম্ব হবে না, সেটা মনে রাখতেই এদের এই সিঁড়ির মাথায় স্থান দেওয়া।’
কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন চক্ষ। তবে কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে জমায়েত—নিশান হাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে এক দীর্ঘকায় বার্কিনী।
কয়েক পা সামনে এগিয়ে যান অল্লকপ্প, ‘অজ্ঝক্খ পসেন্দি।’
‘থের অল্লকপ্প।’
সসম্ভ্রমে মাথা ঝুঁকিয়ে অল্লকপ্পর হাতে নিশান তুলে দেন পসেন্দি। নিশান মাথার ওপর উঁচু করে তুলে ধরেন অল্লকপ্প। আর একবার তোরণ নগরীর মিনারে, অলিন্দে, মঞ্জিলে প্রতিধ্বনিত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে যায় জমায়েতের সোল্লাস চিৎকার।
নিশানটা গগ্গর হাতে তুলে দিয়ে, চক্ষর দিকে ফেরেন অল্লকপ্প, ‘এ-ও আমাদের ঐতিহ্য। নিশানটি প্রথম পান্থের সমাধিতে উড়িয়ে ফিরে এলে তবেই সূচনা হবে কেতন উৎসবের।’
নিশান হাতে সিঁড়ি দিয়ে চত্বরে নামে গগ্গ। পেছনে বাকি পান্থদের সঙ্গে নিয়ে অল্লকপ্প। দু-পাশে ভাগ হয়ে শোভাযাত্রাকে পথ করে দেয় জমায়েত।
অল্লকপ্পের সঙ্গে পায়ে পা মেলান চক্ষ, ‘খানিক আগে আপনি এই গ্রহটিকে কৃত্রিম বলে অভিহিত করলেন!’
দু-পাশে হাত ছড়িয়ে দেন অল্লকপ্প, ‘তোরণ নগরীর একপাশে উঁচু পাহাড়, একপাশে ঘন জঙ্গল। একদিকে ঊষর মরুভূমি, আর অন্যদিকে বিশাল সমুদ্র। প্রাকৃতিক নিয়মে এগুলো পাশাপাশি একসঙ্গে গড়ে উঠেছে বলে তো মনে হয় না!’
মাথা ঝোঁকান চক্ষ, ‘যথার্থ বলেছেন! কিন্তু তার মানে দাঁড়ায় যে এই মহাবিশ্বে এমনও শক্তিধর প্রজাতি আছে যারা সম্পূর্ণ একটি গ্রহ নির্মাণে সক্ষম।’
কয়েক মুহূর্ত দূরের আকাশে চোখ রেখে উত্তর দেন অল্লকপ্প, ‘অবশ্যই! যারা তোরণপথে তাদের ক্রীড়নকদের লক্ষ-হাজার আলোকবর্ষ নিমেষের মধ্যে পার করিয়ে এক জায়গায় এনে ফেলতে পারে, তাদের পক্ষে একটা গ্রহ সৃষ্টি করাটা অসম্ভব বলে তো মনে হয় না।’
শোভাযাত্রা পৌঁছায় নগরীর মূল ফটকে।
নগর ফৌজের পল্টনের সঙ্গে অপেক্ষা করেন অজ্ঝক্খ পসেন্দি।
কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ান অল্লকপ্প, ‘উপকূল, মরুভূমি, জঙ্গল, পাহাড়। এই প্রতিটি এলাকায় এক সময়ে একটি করে তোরণদ্বার ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সে পথেই এখানে পৌঁছান।’
দাঁড়িয়ে পড়েন চক্ষও, ‘তাঁদের আদি বাসস্থান সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই তো জানা যায় না।’
‘না। গ্রহের নামটুকু ছাড়া আমরা আর কিছু জানি না। সে গ্রহ ছায়াপথের কোন অংশে, কোন সৌরমণ্ডলে তার অবস্থান, আমাদের তার সবটুকুই অজানা।’
ভেসে আসে অজ্ঝক্খ পসেন্দির উচ্চকণ্ঠের হুকুম। ফটকের দু-পাশে সার বেঁধে কাওয়াজের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে পড়ে পল্টনের সিপাহিরা।
নগরের বাইরে পা রাখেন অল্লকপ্প, ‘তবে একটা ব্যাপার আমাদের অজানা নয়। আমাদের আদি বাসস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই গ্রহের ভৌগোলিক বিভাগগুলি তৈরি করা।’
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান চক্ষ, ‘ঠিক বুঝলাম না থের অল্লকপ্প!’
ফের উচ্চকণ্ঠে হুকুম দেন পসেন্দি। সিপাহিরা পা মেলায় পান্থদের মিছিলে। নগর পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলে শোভাযাত্রা। তার একবারে সামনে নিশান উঁচু করে হাঁটে পান্থ গগ্গ।
গগ্গর দিকে ইঙ্গিত করেন অল্লকপ্প, ‘পান্থ গগ্গর পূর্বপুরুষেরা তোরণদ্বার দিয়ে এসে পৌঁছান পুবের পাহাড়ে। কিংবদন্তি বলে তাঁদের আদি বাস ছিল ফলিক গ্রহের আকাশ ছোঁয়া পর্বতমালায়।’
গিরি
খাড়া দেওয়ালের মতো পাহাড়টা আকাশ ছুঁয়েছে। মাথা মোড়া তার মেঘের চাদরে। পাহাড়ের নিচে সবুজ সাগরের মতো দিগন্তছোঁয়া বনভূমি। তার বুকে শুয়ে আঁকাবাঁকা নদী, পুবের আকাশ লাল করে সদ্য জেগে ওঠা সূর্যের আলো পড়ে তার জলে। সবুজের অন্তরাল থেকে রঙিন পাখির ঝাঁক আকাশে লাফিয়ে উঠে সূর্যের স্বাদ নিয়েই ফের ঝাঁপ দেয় সবুজের বুকে। পাহাড়ের গায়ের মস্ত ফাটলটা বেয়ে নেমে আসা জলপ্রপাতটাও আছড়ে পড়ে জলকণায় রামধনুর রং ফুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় সেই সবুজেই।
আকাশ আর বন, এই দুইয়ের ঠিক মাঝখানে পাহাড়ের গায়ে গিরগিটির মতো ওপরে চড়তে থাকা কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধাদের অনাবৃত পিঠেও পড়ে সূর্যের আলো।
আলোর উষ্ণতাটুকু গায়ে মেখে শিখরের সন্ধানে পাহাড়ে চড়তে থাকেন তাদের দলপতি ইৎজ্লি। অর্ধেক নীল আর অর্ধেক হলুদ রঙে রাঙানো তাঁর মুখ। কামানো মাথায় বাম কানের ওপর দিয়ে নেমে এসেছে একটিমাত্র বেণী।
ইৎজ্লি সুয়াচ্চিক্, মুণ্ডিতমস্তক যোদ্ধা। বহু লড়াইয়ে বিজয়ের বিনিময়ে আদায় করে নিয়েছেন মস্তক মুণ্ডনের অধিকার।
পাহাড়ের গায়ে প্রতিটি খাঁজ, প্রতিটি ফোকর, প্রতিটি উঁচিয়ে থাকা পাথর সাবধানে নজরে রাখেন ইৎজ্লি। একটিমাত্র ভুলের মাশুল এখানে মৃত্যু।
কেবল হাত আর পায়ের কৌশলে পাহাড়ের দেওয়াল বেয়ে ওঠেন ইৎজ্লি। ডান দিকের একটা ছোট ফোকরে পায়ের আঙুলটুকু ঢুকিয়ে অল্প উঁচু করেন গোড়ালি, ডান হাত উঁচু করে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে চেপে ধরেন পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা একটুকরো পাথর। ফের পায়ে চাপ দিয়ে শরীরটা ঘুরিয়ে নেন, ডান দিকের কাঁধ আর কোমর ঠেকে পাহাড়ের গায়ে।
এরপর বাঁ-দিকের একটা ঢালু পাথরে বাঁ পা রেখে মুঠোয় আঁকড়ে ধরেন তার ওপর থেকে বেরিয়ে থাকা আর একটা বড় পাথর, তারপর পায়ে চাপ দিয়ে
বাঁ-দিকে ঘুরে কাঁধ ঠেকান পাহাড়ে।
ফের ডান দিক। তারপর আবার বাঁ-দিক। তারপর আবার ডান দিক।
ধীর ছন্দে ওপরে উঠতে থাকেন ইৎজ্লি। ক্রমে এসে পৌঁছান মেঘের চাদরে মোড়া পাহাড় চূড়ায়।
তাঁর পেছনে একে একে উঠে আসে কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধারাও। পাথরে বেঁধে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে ফেলা হয় দড়ি, নিচে থেকে টনে তোলা হয় যোদ্ধাদের অস্ত্র আর সরঞ্জাম।
কুয়াশা ঢাকা পাহাড় চূড়ায় সমরসজ্জা নিতে শুরু করে কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধারা। শরীরে ঢাকে ঈগলের পালক বসানো চামড়ার বর্মে। মাথায় চড়ায় শিরস্ত্রাণ, তার চেহারা যেন উচ্চরবের ঠিক মুহূর্তটিতে থমকে যাওয়া ঈগলের মাথা। ঈগল শিরস্ত্রাণের ফাঁক হওয়া দুটি চঞ্চুর মাঝখান থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধার রং-মাখা মুখ।
পিঠে আৎলাপাৎলিন বাঁধেন ইৎজ্লি। বেতের তৈরি একটা লম্বাটে কাঠামো, তার ওপর পাতলা চামড়ার আচ্ছাদন। বুক আর কাঁধের বাঁধনগুলো শক্ত করে কষে নিয়ে ইৎজ্লি একবার তাকান মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে। ওই মেঘের পেছনেই লুকিয়ে আছেন সূর্যদেব হুইৎজিলোপোৎশ্লি। পাহাড়ের চড়ার সময় পিঠে এসে পড়া তার উত্তাপটুকু যেন এখনও ইৎজ্লির শরীরে জড়িয়ে রয়েছে আশীর্বাদের মতো।
যোদ্ধাদের ওপর একবার চোখ বোলান ইৎজ্লি। সবারই প্রায় প্রস্তুতি শেষ, কেবল পিঠের আৎলাপাৎলিনের বাঁধনগুলো শেষবারের মতো পরীক্ষা করে নেয় সবাই।
‘হুইৎজিলিন্।’
তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সামনে এগিয়ে আসে একজন কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধা।
‘সুয়াচ্চিক্!’
‘সবাই তৈরি?’
‘সবাই তৈরি সুয়াচ্চিক্।’
মাটি থেকে সযত্নে তাঁর মাকুয়াহুইৎল্ তুলে নেন ইৎজ্লি। হাতল সমেত একটা লম্বা কাঠের পাটা, তারা কিনারায় সারি দিয়ে পরপর দাঁতের মতনই
বসানো কৃষ্ণ স্ফটিকের ক্ষুরধার চৌকোনা ফলা।
‘জমায়েত হও।’
শাঁখে ফুঁ দেয় হুইৎজিলিন্। সার বেঁধে দাঁড়ায় ঈগল শিরস্ত্রাণ আর পালক মোড়া বর্ম গায়ে যোদ্ধারা।
হঠাৎ সরে যায় মাথার ওপরের মেঘের আচ্ছাদন, নিচে এসে পড়ে সূর্যের একটি তির্যক রেখা।
একটা অস্ফুট জয়ধ্বনি তুলে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে দৌড়াতে আরম্ভ করেন ইৎজ্লি।
ঘন কুয়াশায় বেশি দূর নজর যায় না, কিন্তু খানিকটা দৌড়ানোর পরেই ইৎজ্লি বুঝতে পারেন সামনে ফুরিয়ে আসছে জমি, তার পরেই অতল খাদ।
তবুও গতি কমে না তাঁর, ছুটতে থাকেন সমান বেগে।
একটু বাদেই শেষ হয় যায় জমির সীমানা, পা দুটো তাঁর স্পর্শ করে বাতাস, মাটির টানে শরীরটা পড়তে আরম্ভ করে নিচের দিকে।
কয়েক মুহূর্ত পড়ার পর অভ্যস্ত ভঙ্গীতে পা দুটো টানটান করে পেছনের দিকে ছড়িয়ে দেন ইৎজ্লি। একই ভঙ্গীতে মাকুয়াহুইৎল্ ধরা হাতদুটো লম্বা করে বাড়িয়ে ধরেন সামনের দিকে।
কাঁধে-বুকে বাঁধা আৎলাপাৎলিনের ফিতেতে একটা ঝাঁকুনি লাগে, শ্লথ হয়ে আসে পতনের বেগ।
আৎলাপাৎলিনে ভর করে হাওয়ার স্রোতে ভাসতে থাকেন ইৎজ্লি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাক খেতে খেতে আকাশ ছেয়ে ফেলে বাকি কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধারাও।
হাতের মাকুয়াহুইৎল্ উঁচিয়ে নিচের দিকে ইঙ্গিত করেন ইৎজ্লি, ঝাঁপ দেন মেঘের মধ্যে।
অনুসরণ করে তাঁকে কুয়াহ্ৎলিরা।
তীব্র বেগে মেঘের আস্তরণ ভেদ করে নিচে নামেন ইৎজ্লি, শরীরের দু-পাশে বয়ে যায় বাতাস আর মেঘের বিনুনী।
খানিক বাদেই হঠাৎ ফুরিয়ে যায় মেঘের আস্তরণ, নজরে আসে সবুজ উপত্যকা, গ্রাম, ফসলের ক্ষেত।
আর এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রায় ব্যস্ত গ্রামবাসীরা।
এক ঝাঁক শিকারী পাখির মতোই তাদের ওপর আকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুয়াহ্ৎলিরা।
নীচ থেকে ভেসে আসে ভয়ার্ত চিৎকার আর আর্তনাদ। উড়ে আসে দু-একটা বিক্ষিপ্ত তির আর বর্শা।
ছোড়া অস্ত্রগুলো আনায়াস তাচ্ছিল্যে শরীর বাঁকিয়ে এড়িয়ে যান ইৎজ্লি।
বর্শা উঁচিয়ে তেড়ে আসে একজন। উড়ন্ত অবস্থাতেই তির্যক রেখায় নেমে আসে ইৎজ্লির মাকুয়াহুইৎল্, দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আক্রমণকারীর মাথা।
মাটি ছোঁয় ইৎজ্লির পা। গতি থামে না তাঁর, ছুটতে ছুটতেই দু-একটা দক্ষ টানে খুলে ফেলে দেন আৎলাপাৎলিন।
সামনে কুঠার হাতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে এক গ্রামবাসী। ইৎজ্লির মাকুয়াহুইৎলের কোপ কুঠারের মাথা উড়িয়ে দিয়ে নেমে আসে তার শরীরে।
গতি কমে না ইৎজ্লির।
ভয়ার্ত পশুর মতোই এদিক-সেদিক দৌড়ায় গ্রামবাসীরা।
ছুটতে থাকেন ইৎজ্লি, তাঁর মাকুয়াহুইৎলের আঘাত পড়তে থাকে মানুষের শরীরে।
চিৎকার করে আহতরা, মায়ের রক্তাক্ত দেহের পাশে বসে কাঁদে শিশু, গ্রামের ঘরে চালে আগুনের শিখার সঙ্গে মাথা তোলে ধোঁয়ার কুণ্ডলী, তার কটু কুবাসের সঙ্গে মেশে রক্তের লবণাক্ত গন্ধ।
ছুটতে থাকেন ইৎজ্লি।
যাত্রী
পাহাড়টা অনেক উঁচু। অজ্ঝক্খ পসেন্দি ডুলির বন্দোবস্ত করতে চেয়েছিলেন, তবে অল্লকপ্প রাজি হননি, বয়স আর শরীরের দোহাই দিয়ে যাত্রার ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ করাটা তাঁর ধাতে নেই। কিন্তু শত সদিচ্ছা থাকলেও বয়সের ধর্মকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। অতএব রাতটুকুর জন্য যাত্রা স্থগিত রাখা হয়েছে।
ফুরিয়ে এসেছে দিনের আলো আর উত্তাপ, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে হিমেল বাতাস। পান্থদের দু-একজন ব্যস্ত ধুনি জ্বালাতে।
একটা বিরাট পাথরের চাঁইয়ের নিচে চাদর বিছানো হয়েছে। অল্লকপ্পের পাশে এসে বসেন চক্ষ।
‘এতটা পথ পাড়ি না দিয়ে গন্তব্যে কি সরাসরি পৌঁছানো যেত না থের অল্লকপ্প?’
চক্ষের চোখে চোখ রেখে মৃদু হাসেন অল্লকপ্প।
‘গন্তব্যটুকু তো কেবল ক্ষণিকের মাত্র, ঐতিহাসিক চক্ষ। বাকি সবটাই তো পথ। এই পথে কখনও রোদ খেলা করে, আবার কখনও ছায়া পড়ে। কখনও বসন্ত আসে, কখনও-বা বর্ষা নামে পথে। পথে আপনাদের মতো বন্ধুদের সঙ্গে মোলাকাত হয়, চলে কুশল বিনিময়ের পালা। তারই মধ্যে আমরা হেঁটে যাই আপন মনে।’
ধুনির আগুন জ্বলে উঠেছে, তার লালচে আগুনের দিকে তাকান চক্ষ।
‘ফলিকের ইতিহাস আমি জানি না। জানা সম্ভবও না। তবে আপনার কাছে যা শুনলাম, তাতে ওই পাহাড়চূড়ার যোদ্ধারা যে অসমসাহসী ছিলেন বুঝতে অসুবিধে হয় না।’
ধুনির পাশ থেকে এগিয়ে আসে গগ্গ, চাদরের ওপরে নামিয়ে রাখে আখ্খোট ভরা রেকাবি।
চক্ষর ঠোঁটের কোনে একটা ব্যঙ্গের হাসির প্রলেপ লাগে।
‘পান্থ গগ্গ, আপনার কখনও হাতের আখ্খোটের থালার বদলে বীর পূর্বপুরুষদের
মতো অস্ত্র ধরতে সাধ যায় না?’
‘না!!’
গগ্গ নয়। অল্লকপ্প। উচ্চকণ্ঠে দেওয়া তাঁর উত্তরটা পাহাড়ের নীরবতায় ধনুকের টঙ্কারের মতো ছড়িয়ে পড়ে। হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে গগ্গ, দূর থেকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে অন্য পান্থরাও।
‘না ঐতিহাসিক চক্ষ, পান্থ গগ্গর মনে ওই ধরণের কোনও অভীপ্সা জাগে না। যাকে বীরত্ব বলছেন তার পেছনের অন্ধ গোঁড়ামিটুকু জানলে আপনি এই প্রশ্ন করতেন না। শুনবেন?’
একমুঠো আখ্খোট তুলে নেন চক্ষ, তির্যক দৃষ্টিতে তাকান গগ্গর দিকে। মুখে লেগে থাকে ব্যঙ্গের হাসিটুকু।
‘অবশ্যই থের অল্লকপ্প। অবশ্যই। আপনি বলতে থাকুন। পান্থ গগ্গর আদি বাসস্থানের বাকি ইতিহাসটুকুও শুনি।’
গিরি
পাহাড়ের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে তেনশ্তিৎলানের উঁচু পিরামিড মন্দির। যেন পাহাড়ের মাথায় আর এক পাহাড়ের আকাশ ছোঁয়ার প্রচেষ্টা। পাথরে বাঁধানো চওড়া পথ এগিয়ে গেছে মন্দিরের সিঁড়ি অবধি, তার দু-পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে পুণ্যার্থীরা।
ইৎজ্লির পেছনে পথ দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা বন্দীদের তাড়িয়ে নিয়ে চলে কুয়াহ্ৎলিরা। স্ত্রী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, কেউ বাদ নেই সে দলে। কেউ খোঁড়ায়, কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদে, কেউ বা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। থামলেই আছড়ায় কাঁটাবেতের চাবুক, তাই কুয়াহ্ৎলিদের ধমকে যন্ত্রচালিতের মতো হাঁটে সবাই।
মন্দিরের খানিক আগে একটা উঁচু তোরণ। যেন একটা কালো এবড়ো-খেবড়ো টোল খাওয়া কৃষ্ণ স্ফটিকের ফিতে জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে খিলেনের আকারে, তার অন্য পাশে দেখা যায় পিরামিডের শিখর।
তোরণের পাশ কাটিয়ে যোদ্ধা আর বন্দীদের নিয়ে এগিয়ে যান ইৎজ্লি, পা রাখেন মন্দিরের সিঁড়িতে।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে রক্তের স্রোত, দু-পাশে লাশের স্তূপ। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় হতে থাকে রক্তের ধারা, বাড়তে থাকে বন্দীদের কান্না, কুয়াহ্ৎলিদের শাসানি আর চাবুকের হিসহিস আওয়াজ।
সিঁড়িতে অপেক্ষা করে পাথরের নানান দেবমূর্তি। কোথাও পালকে সাজানো সর্পরূপী কোয়াৎজেল্কোয়াত্ল্ গ্রাস করেন যোদ্ধার দেহ, কোথাও শ্বাদন্ত আর কুঞ্চিত নাসিকা নিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকেন ত্লালক্, আবার কোথাও ঢাল আর হাতে বল্লমের গোছা হাতে কৃষ্ণ স্ফটিকের আয়নায় ভাঙা পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকেন তেজ্কাৎলিপকা।
রক্তকর্দমে পিছল একের পর এক সিঁড়ি মাড়িয়ে দেবতাদের পেছনে ফেলে ওপরে উঠতে থাকেন ইৎজ্লি।
সিঁড়ি শেষ হয় একটা ছড়ানো চাতালে। সেখানে সহকারী পুরোহিতদের সঙ্গে নিয়ে প্রতীক্ষা করেন তিজক্। ত্লাতোয়ানি তিজক্। সূর্যদেবের প্রতিভূ। একাধারে রাজা এবং প্রধান পুরোহিত।
মাথা নিচু করে সম্ভ্রম জানায় ইৎজ্লি। মাথার ওপরে দু-হাত তোলেন তিজক্।
‘অতীতে চার-চারজন দেবতা সূর্য হয়ে আকাশ থেকে আলো আর তাপ বিলিয়েছেন। প্রত্যেকবারই তাদের আকাশ থেকে হটিয়ে দিয়েছেন দেবতা তেজকাৎলিপকা, বিনাশ হয়েছে সৃষ্টির।’
চাতালে বন্দীদের টেনে তোলে কুয়াহ্ৎলিরা।
‘এবারের সূর্য হুইৎজিলোপোৎশ্লি। সারা রাত তেজকাৎলিপকার অনুচর তারাদের সঙ্গে লড়াই করে, হুইৎজিলোপোৎশ্লি উদয় হন পুবের আকাশকে তাঁর শরীরের রক্তে রাঙিয়ে। দিনের শেষে তেজকাৎলিপকার আক্রমণে আহত, রক্তাক্ত হয়ে ফের লড়াইয়ে মাতেন পশ্চিমের আকাশ থেকে।’
চাতালের মাঝখানে একটা লম্বা বেদি। একজন বন্দীকে তার ওপর লম্বা করে শোয়ায় পুরোহিতেরা, টেনে শক্ত করে চেপে ধরে থাকে হাত-পা।
‘সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিদিন রক্ত ঝরান হুইৎজিলোপোৎশ্লি। কিন্তু এত রক্ত তিনি পাবেন কোথায়?’
বেদিতে শুয়ে থাকা বন্দীর দিকে এগিয়ে আসেন ত্লাতোয়ানি তিজক্। বেদির পাশ থেকে তুলে নিয়ে মাথার ওপর তুলে ধরেন কৃষ্ণ স্ফটিকের ছোরা।
‘সৃষ্টি রক্ষার জন্য যে রক্ত ব্যয় করেন হুইৎজিলোপোৎশ্লি আমাদের দায়িত্ব তা পরিশোধ করা।’
ওপর থেকে ছোরা নেমে আসে বন্দীর শরীরে। তার লম্বা টানে চড়চড় করে কেটে যায় বন্দীর বুক।
বেদির ওপর ছোরা নামিয়ে রাখেন ত্লাতোয়ানি তিজক, বন্দীর শরীরের অভ্যন্তরে দু-হাত ঢুকিয়ে বের করে আনেন তার স্পন্দিত, রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড, মাথার ওপর তুলে আকাশের সূর্যকে নিবেদন করে মন্ত্রপাঠ করেন উচ্চকণ্ঠে।
‘সবার প্রথম দেবতা হুইৎজিলোপোৎশ্লি। পূর্বপুরুষের বস্ত্র পরিধান করে তাঁর গাথা আমি বিফলে গাই না। আমি উজ্জ্বল হই। আমি ভাস্বর হই।’
উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে নিচের ভিড়। একটা তেপায়া পাত্রের আগুনে ত্লাতোয়ানি আহুতি দেন হৃৎপিণ্ড, বীভৎস গন্ধে নাসারন্ধ্র তাড়িত করে কালো ধোঁয়া উঠে যায় নীল আকাশের দিকে।
লাশটাকে সিঁড়িতে ছুঁড়ে ফেলে পুরোহিতেরা, আর একজন বন্দীকে টেনে শোয়ায় বেদিতে।
রক্তস্রোতে চলতে থাকে ইৎজ্লির রক্তঋণ পরিশোধের পালা।
গর্বিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে্ন ঈগল কুয়াহ্ৎলি নেতা ইৎজ্লি, গুণতে থাকেন একের পর এক বলির সংখ্যা।
হঠাৎ ভয়ার্ত চিৎকার করে ওঠে সিঁড়ির নিচের পুণ্যার্থীর ভিড়।
থমকে যায় ত্লাতোয়ানির ছোরা, নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে পুরোহিতেরা, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে যোদ্ধারা।
এক ধূসর ঘন মেঘের আস্তরণে ঢেকে গেছে ঢেকে গেছে মন্দিরের নিচের তোরণ, তার মধ্যে দিয়ে আর নজরে আসে না অন্য দিকের কিছুই।
তোরণ ঘিরে পাক খায় মেঘের পুঞ্জ। তার অভ্যন্তরে ক্ষণে ক্ষণে ঝলসে ওঠে বিদ্যুতের অবগুণ্ঠিত দ্যুতি।
হতভম্ব হয়ে সেই তোরণঘেরা বিদ্যুৎমালা দেখতে থাকেন ইৎজ্লিও।
হঠাৎ বজ্রপাতের মতো শব্দে সবার কানে তালা লাগিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে ছিটকে যায় মেঘ।
যোদ্ধা, পুরোহিত, বন্দী, পুণ্যার্থী সবাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে তোরণের দিকে। কোন জাদুমন্ত্রে তার অপর পারে দেখা যায় অন্য আর-এক আকাশের বুকে অচেনা কোনও পাহাড়ের সারি।
ইৎজ্লির দিকে তাকান ত্লাতোয়ানি, হাতের ছোরা তুলে ইঙ্গিত করেন তোরণের দিকে, ‘সুয়াচ্চিক্, হুইৎজিলোপোৎশ্লির ডাক এসেছে। তারাদের দেশে তেজকাৎলিপকার অনুচরদের সঙ্গে লড়তে হবে আপনার কুয়াহ্ৎলিদের।’
মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানান ইৎজ্লি। মাথার ওপর মাকুয়াহুইৎল্ তুলে উল্লাসে ফেটে পড়ে কুয়াহ্ৎলিরা।
যাত্রী
পাহাড়ের মাথায় মেঘ তার আঙুলগুলো এখনও হালকা করে জড়িয়ে রেখেছে। তবে তার মধ্যেও পাথরের নুড়ি আর সামান্য দু-একটা আগাছার মাঝে ছড়িয়ে থাকা তোরণের ভাঙা টুকরোগুলো দেখতে অসুবিধে হয় না।
ওপরে ওঠার সরু পাকদণ্ডী দিয়ে সবার আগে উঠে এসেছেন চক্ষ আর অল্লকপ্প।
হাঁটু গেঁড়ে তোরণের পড়ে থাকা ভাঙা টুকরোগুলো খুঁটিয়ে দেখেন চক্ষ।
একটা বড় পাথরে বসে বিশ্রাম করেন অল্লকপ্প, তাঁর আশপাশে মাটিতে বসে থাকে পান্থরা। পাকদণ্ডী দিয়ে এক-এক করে ওপরে উঠে আসতে থাকে তোরণ নগরীর সিপাহিরা।
হঠাৎই একজন সিপাহির পা পিছলোয়। ভারসাম্য হারানো শরীরটা টলে যায় পাকদণ্ডীর ধারে খাদের দিকে।
কিন্তু কোনও অঘটন ঘটার আগেই তাকে পেছন থেকে ধরে ফেলে আরও দু-জন, টেনে দাঁড় করিয়ে দেয় পথের ওপর।
চোখ তুলে সেদিকে গগ্গর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অল্লকপ্প, ‘পান্থের পথও এমন দুর্গম। তলোয়ারের কিনারার মতো সরু এ পথে চলা অত্যন্ত কঠিন।’
একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ান চক্ষ। অল্লকপ্পের কাছে এগিয়ে এসে বাড়িয়ে ধরেন ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা, ‘তলোয়ারের কিনারার কথা কী বলছিলেন? এই তোরণের ভাঙা পাথরগুলোতেও দেখছি তেমন ধার।’
চক্ষের বাড়িয়ে ধরা আঙুলটাতে একটা হালকা রক্তের ধারা।
মৃদু হাসেন অল্লকপ্প, ‘আমাদের ইতিহাসটাই তো রণ-রক্তের ইতিহাস, ঐতিহাসিক চক্ষ। আমার পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন বার্ক্ষ গ্রহের অরণ্য থেকে। রক্ত ঝরাতে তাদেরও বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না।’
কান্তার
চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করে নদীর জল। নদীর পাশে উঁচু পাঁচিল-ঘেরা গ্রাম, মশালের লালচে আলো পড়ে তার মাটির দেওয়ালে।
পাঁচিলের ঘেরাটোপের ভেতরে অনেকগুলো বড় গাছ। জমি থেকে অনেক উঁচুতে, তাদের ছড়ানো ডালপালার আনাচে-কানাচে বাঁধা কুটির। গ্রামের বাসিন্দারা সেই সব নিরাপদ আশ্রয়ে ঘুমোয় নিশ্চিন্তে। নিচে নিভু নিভু ধুনির পাশে বসে ঘুমে ঢলে রাতের পাহারাদাররাও।
গায়ে চাঁদের আলো মেখে শুয়ে থাকে নির্জন ফসলের ক্ষেত। ভোরের আলো ফুটলে এখানে শুরু হবে মানুষের আনাগোনা, কিন্তু রাতটুকু আপাতত তার নিজের।
ফসলের ক্ষেতের পর শুরু হয়েছে জঙ্গলের সীমানা। গায়ে গায়ে লেগে থাকা নানান বিশাল গাছের এক দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর।
সেইরকমই একটা গাছের উঁচু ডালের ওপর দাঁড়িয়ে দূরের গ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকেন ওমোসেদে। তাঁর পরনের পালিশ করা কালো লৌহজালিকের বর্ম আর কালো শিরস্ত্রাণ তাঁর ঋজু শরীরটাকে লুকিয়ে রাখে গ্রামের পাঁচিলে টহল দিতে থাকা প্রহরীদের সতর্ক দৃষ্টি থেকে।
কোনও একটা অজানা পাখির শিসের শব্দ ভেসে আসে জঙ্গলের ভেতর থেকে। একবার। দুবার। তিনবার।
কান পেতে ডাকটা ঠিক কোন দিক থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করেন ওমোসেদে। তারপর তাঁরও ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসে একইরকম একটা ডাক।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর গাছের ডাল থেকে ডালে ক্ষিপ্রগতিতে লাফিয়ে লাফিয়ে একটা জমাটবাঁধা অন্ধকারের টুকরো এসে দাঁড়ায় তাঁর পাশে।
‘গুনদেমে!’
অন্ধকারে চেহারা দেখা না গেলেও ওমোসদে জানেন আগন্তুক কে।
‘ন্যুরবেসে। বলো।’
‘ইজেগ্বে ফেরত এসেছে মাতা। আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।’
‘চলো।’
গাছের ডাল আর লতা ধরে দুলে দুলে নিচে নামতে থাকেন ওমোসেদে, ন্’ননমিতনদের গুনদেমে।
গাছের নিচে ঝোপে ঘেরা একটায় জায়গায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে ন্’ননমিতন নারী যোদ্ধারা। জোনাকি চুপড়ির ম্লান নীলাভ আলোয় তাদের দেখায় প্রেতের মতো।
‘ইজেগ্বে!’
‘মাতা!’
ওমোসেদের ডাকে সাড়া দিয়ে দলে ছেড়ে সামনে এগিয়ে আসে ইজ্গেবে। পরনে কালো চামড়ার বর্ম, চুল বাঁধা কালো কাপড়ে, মুখের তারুণ্য ঢাকা কালির প্রলেপে।
‘বলো ইজেগ্বে।’
‘গ্রামের ফটক ভেতরে থেকে হুড়কো দিয়ে বন্ধ করা, দেওয়াল টপকে যাওয়া ছাড়া ভেতরে ঢোকার আর কোনও পথ নেই।’
‘পাহারা?’
‘পাঁচিলের ওপর জনা চারেক আছে মাত্র। দেওয়ালের গায়ে কাঁটালতা বিছানো আছে বটে, কিন্তু পাঁচিলে একবার চড়লে পাহারাদারদের কাবু করা কঠিন নয়।’
গাছের গায়ে হেলান দেওয়া নিজের লম্বা খাঁড়াটা তুলে নেন ওমোসেদে।
‘চলো। ন্যুরবেসে, পাহারাদারদের ভুলিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার।’
ঢাকা পড়ে জোনাকি চুপড়ি। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো ফসলের খেতের মধ্য দিয়ে গুঁড়ি মেরে দু-দলে ভাগ হয়ে এগতে থাকে ন্’ননমিতনরা। একদল ন্যুরবেসের পেছনে সরে যায় খেতের এক প্রান্তে, অন্য দলটি ওমোসেদের পেছনে এগতে থাকে গ্রামের পাঁচিলের দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দূরে এক জায়গায় খেতের মধ্য জ্বলে ওঠে আগুন। রক্ষীদের নজর টানার চেষ্টা ন্যুরবেসের।
সফল হয় কৌশল। পাঁচিলের এক কোনে ছুটে আসে রক্ষীরা, বোঝার চেষ্টা
করে কী হচ্ছে।
পাঁচিলের গায়ে এসে পৌঁছান ওমোসেদে বাকি ন্’ননমিতনদের নিয়ে। রক্ষীদের নজর তখন অন্যদিকে।
শরীরে আঘাতের পরোয়া না করে দু-তিনজন দেওয়ালে চড়তে আরম্ভ করে কাঁটালতা ধরেই। পঁচিলের ওপর চড়ে নিচে ঝুলিয়ে দেয় দড়ি, তার অন্য মাথা বেঁধে দেয় পাঁচিলে বসানো কাঠের খুঁটিতে।
দড়ি ধরে ওপরে উঠে আসেন ওমোসেদে, সঙ্গে বাকি ন্’ননমিতনরা।
টের পেয়ে ছুটে আসে রক্ষীরা। কিন্তু ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। তাদের মাথাগুলো প্রায় খেলাচ্ছলেই খাঁড়ার আঘাতে দেহ থেকে আলাদা করে ফেলে ন্’ননমিতনরা।
মশালের লালচে আলো পড়া রক্তে ভেজা দেওয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত খাঁড়াটা মাথার ওপর তোলেন ওমোসেদে। রাতের নিস্তব্ধ বাতাসে ছড়িয়ে দেন দানবিক রণহুঙ্কার।
‘উল্লে উল্লে উল্লে!’
‘উল্লে লে, উল্লে লে, উল্লে লে!’
প্রতিধ্বনি তোলে সমস্ত ন্’ননমিতনরা। পাঁচিল থেকে লাফিয়ে পড়ে ভেতরে। কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে খুলে ফেলে গ্রামের ফটক। বাকিরা চড়তে থাকে ভেতরের উঁচু গাছগুলোতে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাছের ওপরের থেকে ভেসে আসে নারী-পুরুষের আর্তনাদ আর কান্নার আওয়াজ। ভয়ার্ত গ্রামবাসীদের ন্’ননমিতনরা তাড়িয়ে নামায় গাছের ওপরের বাসস্থান থেকে, বর্শার খোঁচায় জড়ো করে দেওয়ালের পাশে।
পাঁচিলের ওপর থেকে চারদিক একবার দেখে নিয়ে দেওয়াল থেকে একটা মশাল তুলে মাথার ওপরে নাড়েন ওমোসেদে।
প্রত্যুত্তরে দূরের জঙ্গলের মধ্য জ্বলে ওঠে কয়েকটা মশাল।
পাঁচিল থেকে নেমে আসেন ওমোসেদে, তাকিয়ে থাকেন খোলা ফটকের দিকে।
কিছুক্ষণ বাদে ফটক দিয়ে গ্রামের ভেতর পা রাখে স্থূলকায় এক পুরুষ, অঙ্গে
তার রেশমের চাদর, কোমরে গোঁজা চাবুক।
বণিক হুফন।
ওমোসেদের সামনে এসে মাথা নিচু করে হুফন, ‘ওকোদ হু! অভিনন্দন মাতা।’
নীরবে হাতের খাঁড়া তুলে ওমোসেদে ইঙ্গিত করেন আটক করে রাখা গ্রামবাসীদের দিকে।
ফের মাথা ঝোঁকায় হুফন। মখমলের একটা ছোট থলি কোমর থেকে খুলে বাড়িয়ে ধরে দু-হাতে।
থলির মুখ অল্প খুলে ভেতরের স্বর্ণমুদ্রার চমকটা একবার যাচাই করে নেন ওমোসেদে।
হাততালি দেয় হুফন। ফটক দিয়ে ঢোকে আরও কয়েকজন, কাঁধে ফেলা তাদের বেতের পেটিকা। হুফনের ইঙ্গিতে এগিয়ে যায় বন্দী গ্রামবাসীদের দিকে।
তারপর পেটিকা থেকে বেড়ি আর শেকল বের করে তাদের পরাতে থাকে বাঁধন।
সূর্য ডোবার আগে অবধি যারা ছিল পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই বা বন্ধু, এই মুহূর্ত থেকে তাদের পরিচয় মাত্র একটি।
কান্নুমঅ। দাস।
পুবের দিগন্তে সবে লালচে আভা দেখা দিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে স্বর্ণমুদ্রার থলিটা কোমরে গোঁজেন ওমোসেদে।
যুদ্ধের ফসল তোলা শেষ।
উল্লে উল্লে উল্লে লে উল্লে লে।
যাত্রী
গহন অরণ্যের বুক নিবিড় নিস্তব্ধতায় মগ্ন হয়ে থাকে। দু-পাশের বিশাল আকারের গাছের মাঝে মেঠো পথে আলোছায়ার আল্পনার ওপর দিয়ে হেঁটে চলে তোরণ নগরীর কেতন মিছিল। জঙ্গল বার্ক্ষী সিপাহিদের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা, তাদের কেউ কেউ আবার পথ ছেড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গাছের ডাল থেকে ডালে।
গগ্গ আর অন্য পান্থদের সঙ্গে নিয়ে হাঁটেন থের অল্লকপ্প। পাতার মর্মর ধ্বনিতে মিশে যায় তাঁর উপদেশের অনুচ্চ স্বর।
‘কস্সক যেমন সেচের জল নিজের খেতে নিয়োজিত করে, উষুকার যেমন কাষ্ঠ দণ্ডকে বাণে পরিণত করে, তচ্ছ যেমন দারুখণ্ডকে আসবাবের রূপ দেয়, পান্থও তেমনই নিজের মনকে নির্মাণ করবে পথের জন্য।’
একা কিছুটা আগে এগিয়ে গিয়েছিলেন চক্ষ, এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন পথের ধারে। অল্লকপ্প কাছে আসতে পা মেলান তাঁর সঙ্গে। মাথা ঝাঁকিয়ে স্বাগত জানান অল্লকপ্প।
‘কেমন লাগছে ঐতিহাসিক চক্ষ?’
হাত ঘুরিয়ে জঙ্গলের চারপাশটা ইঙ্গিত করেন চক্ষ।
‘অভিনব! এই প্রেক্ষাপটে ইতিহাসটুকু আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। তবে একটা মন্তব্য না করে পারছি না থের অল্লকপ্প।’
সামান্য উঁচু হয় অল্লকপ্পর ভ্রূ।
‘বলুন!’
চোখ তুলে সামনে দু-জন সিপাহির দিকে নির্দেশ করেন চক্ষ। একজন বল্লুরী, অন্যজন বার্কিনী। দু-জনেই নারী।
‘আপনাদের সমাজে নারীর সমান অধিকার নেই বলছি না। কিন্তু এদের সঙ্গে কি ন্’ননমিতন যোদ্ধাদের তুলনা হয়? যতটুকু ইতিহাস শুনলাম, তাতে তো মনে হচ্ছে শৌর্য্যে তাঁরা পুরুষের চাইতে কোনও অংশে কম ছিলেন না।
কী বলেন পান্থ গগ্গ?’
প্রশ্নের আকস্মিকতায় হতচকিত গগ্গ অবাক দৃষ্টিতে নীরবে তাকিয়ে থাকে চক্ষর দিকে।
উত্তর দেন অল্লকপ্প।
‘ন্’ননমিতনদের জীবনদর্শনের কথা আপনাকে বলা হয়নি। পুরুষের সমাজে স্বীকৃতি আদায় করে নিতে ন্’ননমিতনদের হতে হত পুরুষদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি দুঃসাহসী আর দুর্মদ।’
একটা তির্যক হাসি রেখা ফুটে ওঠে চক্ষর ঠোঁটের কোনে।
‘সেটাই তো আমি বোঝাতে চাইছিলাম থের অল্লকপ্প।
চক্ষর চোখে চোখ রেখে হিমশীতল কণ্ঠে উত্তর দেন অল্লকপ্প্, ‘পরস্পর প্রতিযোগিতা শুরু হলে আর অনেক সময়েই থামতে চায় না ঐতিহাসিক চক্ষ। পাল্লা দিতে গিয়ে ন্’ননমিতনরা পুরুষদের চাইতে কেবল দুঃসাহসী আর দুর্মদ শুধু নয়, হয়ে উঠলেন তাদের থেকে কয়েকগুণ নির্মমও।
কান্তার
ছড়ানো প্রাঙ্গণের একদিক চলে কিশোরী থেকে যোদ্ধা তৈরির তালিম। দশ-বারো বছর বয়সের মেয়েরা কোথাও কাঁটালতা বিছানো দেওয়ালে চড়ে, কোথাও লতা ধরে লাফিয়ে ওঠে, আবার কোথাও কাঠের তলোয়ার হাতে আক্রমণ করে পরস্পরকে। সামান্য ভুল হলেই তাদের পিঠে আছড়ে পড়ে প্রশিক্ষকদের নির্দয় বেত।
প্রাঙ্গণের অন্যদিকে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ন্’ননমিতন যোদ্ধাদের পল্টন। তাদের কারও পিঠে বাঁধা মাস্কেট, কারও কোমর থেকে দোলে লম্বা খাঁড়া, কারও হাতে ধরা কুঠার।
এক পাশের একটা উঁচু গাছের ওপরের কুটিরের জানলা থেকে তাকিয়ে থাকেন ওমোসেদে। আজ তাঁর শরীর মোড়া লৌহজালিকে, মাথায় ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ, পশুচর্মের লোমশ কটিবন্ধ থেকে ঝোলে ভারী তলোয়ার, পা ঢাকা গোড়ালি অবধি উঁচু জুতোয়।
আজ বর্ষোৎসবের দ্বিতীয় দিনে উহন মুকানে কুচকাওয়াজ করবে ন্’ননমিতন ফৌজ।
‘গুন্দেমে!’
ন্যুরবেসে কখন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেননি ওমোসেদে।
‘সবাই প্রস্তত মাতা!’
‘চলো!’
গাছের ওপর থেকে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে মাপা ছন্দে নামেন ওমোসেদে। ন্যুরবেসে আর বাকি দেহরক্ষীরা এক ডাল থেকে আর এক ডাল ধরে নামতে থাকে দুলে দুলে।
সিঁড়ির প্রান্তে মাথায় ছাতা তুলে ধরে দুই দাসী। তলোয়ারের হাতলে হাত রেখে উহন মুকানের পথে পা রাখেন ওমোসেদে।
উৎসবের জন্য সাজানো হয়েছে পথ। অনেকটা উঁচুতে দু-পাশের গাছের
সঙ্গে আড়াআড়ি করে পথের ওপর দিয়ে একের পর এক বাঁধা হয়েছে খুঁটি। সেই সব খুঁটি থেকে পায়ে দড়ি বেঁধে উলটো হয়ে ঝোলে কবন্ধ লাশ, তাদের গলা থেকে রক্তের ধারা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে পথের ওপর। লাশের বেওয়ারিশ মুণ্ডগুলো গড়াগড়ি যায় পথের পাশে।
রক্তধারার নিচে পল্টন নিয়ে উহন মুকানের পথে হাঁটেন গুন্দেমে ওমোসদে।
উহন মুকানের ময়দান ঘিরে প্রজাদের বিশাল জমায়েত। ময়দানের এক প্রান্তে বিশাল সামিয়ানা। তার নিচে বসে সপার্ষদ রাজা ঘুগালা।
সামিয়ানা থেকে খানিকটা দূরেই নজরে আসে গাছের শাখা-প্রশাখা দিয়ে তৈরি এক বিচিত্র দর্শন তোরণ, যেন মাটি থকে উঠে এসে কোনও গাছ আবার মাথা নুইয়ে করে ফেরত গেছে মাটিতেই। তোরণের পেছনে পাতার অস্থায়ী কুটির, বর্ষোৎসবের কয়েকটি দিনের জন্য এটি কল্পিত পিতৃলোক। কুতোমেন।
তোরণপথে পিতৃলোকে অর্ঘ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্যই বর্ষোৎসবের আয়োজন।
ফৌজকে ময়দানের মাঝখানে রেখে সামিয়ানার সামনে এসে মাথা নিচু করেন ওমোসেদে। অস্থি করোটিতে সাজানো সিংহাসনে বসে থাকেন রাজা ঘুগালা। মাথায় রেশমের পাগড়ি, নিরাবরণ দেহে জড়ানো রেশমের চাদর, বুকের ওপর ঝোলে পুঁথির মালা।
‘জয় হোক! বর্ষোৎসবের শুভেচ্ছা প্রভু!’
‘স্বাগত গুনদেমে ওমোসেদে! বর্ষোৎসবের শুভেচ্ছা তোমাকেও। সব সম্পূর্ণ তো?
‘সব সম্পূর্ণ প্রভু।’
দু-হাতে স্বর্ণমুদ্রার ছোট থলিটা বাড়িয়ে ধরেন ওমোসেদে।
থলিটা তুলে নিয়ে পাশে রাখেন রাজা ঘুগালা।
‘ওকোদ হু! অভিনন্দন তোমাকে।’
নীরবে মাথা ঝোঁকান ওমোসেদে। সরে দাঁড়ান একপাশে।
সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান ঘুগালা, দু-হাত তুলে ধরেন মাথার ওপর, ‘পিতৃলোক কুতোমেনে পিতৃপুরুষদের রাজত্ব অক্ষুণ্ণ থাকলে, ধরাতলে আমরাও সুখে থাকব। তাঁদের নির্বিঘ্নে রাজত্ব করার জন্য প্রয়োজন খাদ্য, পানীয়—’
ফল, সব্জী, মাংস বোঝাই ঝুড়ি আর জলের পাত্র তোরণের সামনে নামিয়ে রেখে সরে যায় চার-পাঁচজন সিপাহি।
‘—আর দাস।’
উহান মুকানের এক প্রান্ত থেকে গলায় দড়ি বাঁধা একটা মানুষকে পশুর মতো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে সিপাহিরা। হাঁটু গেঁড়ে বসিয়ে দেয় তোরণের সামনে।
ন্’ননমিতনদের সারি থেকে এগিয়ে আসে এক কিশোরী যোদ্ধা। দু-হাতে উঁচিয়ে ধরা লম্বা খাঁড়া, ক্রুর দৃষ্টিতে উধাও কৈশোরের সারল্য।
নতজানু দাসের কাছে এসে খাঁড়া নিজের কাঁধের ওপর তুলে ধরে কিশোরী ন্’ননমিতন। গোড়ালিতে ভর দিয়ে ঘুরে যায় এক পাক।
পাকের বৃত্ত সম্পূর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাঁড়া তির্যক রেখায় নেমে আসে তার কাঁধের ওপর থেকে বন্দীর ঘাড়ে।
শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাথাটা গড়িয়ে যায় একপাশে, রক্তের ফোয়ারা ছড়িয়ে দেহটা ঢলে পড়ে মাটিতে।
বিজয়ীর ভঙ্গীতে কিশোরী খাঁড়া তুলে ধরে মুখের সামনে, জিব দিয়ে চেটে নেয় তার গায়ে লেগে থাকা রক্ত।
‘উল্লে উল্লে উল্লে লে!’
ন্’ননমিতন বাহিনী উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে সমস্বরে। কেউ কেউ সদর্পে মাস্কেট থেকে গুলি ছোড়ে আকাশে।
চলতে থাকে কুতোমেনে দাস পৌঁছে দেওয়ার পালা, জমতে থাকে নরমুণ্ডের স্তূপ, উহান মুকানের লাল মাটি আরও লাল হতে থাকে।
শেষ দাসটিও যখন কুতোমেনের উদ্দেশে যাত্রা করেছে, সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান ঘুগালা। দুই হাত বাড়িয়ে দেন মাথার ওপর, ‘কুতোমেনে আমাদের পিতৃপুরুষের রাজত্ব নির্বিঘ্ন হোক। সমুদ্রদেব হু আর যুদ্ধের দেবতা বো-র আশীর্বাদ বর্ষিত হোক—’
প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে তোরণের মাথা থেকে বিশাল আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠে মিলিয়ে যায় আকাশের বুকে। জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো ধকধক করে জ্বলতে থাকে তোরণ, তার অন্যদিকে পাতার কুটিরের বদলে নজরে আসে অন্য
আর এক অরণ্য, অন্য আর এক আকাশ।
‘কুতোমেন! কুতোমেন!’
ভয়ার্ত স্বরে বলা শব্দটা ছড়িয়ে যায় কণ্ঠ থেকে কণ্ঠে।
ওমোসেদের দিকে ফেরেন ঘুগালা, ‘গুন্দেমে, কেবল দাস নয়, কুতোমেনে আমাদের পিতৃপুরুষদের রাজত্ব রক্ষায় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যোদ্ধারও।’
নীরবে মাথা নিচু করেন ওমোসেদে।
‘উল্লে লে, উল্লে লে, উল্লে লে!’
উল্লাসে ফেটে পরে ন্’ননমিতন পল্টন।
যাত্রী
পান্থ পরিবৃত হয়ে একটা গাছের নিচে বসে থাকেন অল্লকপ্প। অরণ্য এখানে তার গভীরতার অনেকটাই হারিয়েছে। গাছগুলো মাথা তুলেছে পরস্পরের থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে, তাদের ঝুঁকে পড়া ডালে ফুলের মাঝে নজরে পড়ে পাখিদের দিন যাপনের ব্যস্ততা। রোদের আলো লুটিয়ে আছে মাটিতে, মৃদু বাতাস বয়ে আনে কোনও অজানা ফুলের সুবাস।
দু-পাশে হাতদুটো ছড়িয়ে দেন অল্লকপ্প।
‘এই সুগন্ধ বায়ুতে বয়ে আনছে। তবে টগর হোক, বা মল্লিকা, বা এই অজানা পুপ্পহ, মনে রেখো পুপ্পোগন্ধো বায়ুর বিপক্ষে বয় না। কিন্তু সৎকর্মের গন্ধ বায়ু বিপরীত হলেও, সর্বদিশা আমোদিত করে।’
সামনে গাছের মাঝে অনেকটা ফাঁকা জমিতে ঘাসের সবুজ গালিচা, তার ওপরে রংবেরঙের ফুলের নকশা। জমির দুই পাশে বর্শার মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তোরণের দুই প্রান্ত। ঘাসের ওপর ইতস্তত ছড়ানো কাঠকয়লার টুকরো নীরবে শোনায় মাঝের অংশটুকুর পরিণতির কথা।
একটুকরো কাঠকয়লা কুড়িয়ে নিয়ে আঙুলের ডগায় চাপ দেন চক্ষ। গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ে কাঠকয়লা, বাতাসের টানে উড়ে পড়ে দূরে।
মৃদু হেসে অল্লকপ্পর সামনে কয়লার কালো ছোপ লাগা আঙুলগুলো মেলে ধরেন চক্ষ।
‘বার্ক্ষের অরণ্যের রাত্রির মতোই কালো।’
কৌতুকের ছোঁয়া লাগে অল্লকপ্পর চোখেও। একটু দূরে মাথার শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলে চুলে ফুল গোঁজে এক তরুণী সিপাহি। মাথা তুলে ইঙ্গিত করেন সেদিকে।
‘তা বলতে পারেন। কিন্তু সিপাহি সুভদ্দার পূর্বপুরুষরা যেখানে থেকে এসেছিলেন, সেই বল্লুরের মরুভূমির বৈশিষ্ট্য ছিল রাত্রের জমাট অন্ধকার নয়, সূর্যালোকের প্রখর তীব্রতা।’
মরু
বিদ্রোহী নগর মাসিবিনার উঁচু প্রাচীরের সামনে লড়াই তুঙ্গে, ভেসে আসে তার আওয়াজ। যোদ্ধার চিৎকার, আহতের আর্তনাদ, ধনুকের টঙ্কার, উটের ডাক, ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ, অস্ত্রের ঠোকাঠুকি, সমস্ত মিলেমিশে এক তুমুল অট্টরোল হয়ে বিদীর্ণ করে আকাশ।
সে আকাশ থেকে তখন এক নির্দয় সূর্যের উত্তাপ হাতুড়ির মারের মতো আছড়ে পড়ছে মাটিতে, তাতিয়ে তুলছে মরুর বালিরাশি।
সূর্য আর বালির উত্তাপের সঙ্গমে নিশ্চল রথের ওপর দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকেন নেরগল-শর্রানি। পেছনে নিজেদের রথে হুকুমের অপেক্ষা করে তাঁর রব-উরাটেরা। প্রত্যেক রব-উরাটের রথের পেছনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের সিপাহিরা, তাদের বর্ম আর সূচাগ্র শিরস্ত্রাণ থেকে ছিটকে যায় সূর্যের চোখ ঝলসানো আলো।
রৌদ্রতপ্ত লৌহ-জালিকের বর্ম জ্বালা ধরিয়ে দেয় অঙ্গে, শিরস্ত্রাণের পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামে ঘামের ধারা, প্রতি নিঃশ্বাসে নাকে ঢোকে বালিকণা। কিন্তু সমস্ত অস্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে, নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দূর থেকে আস্শার ফৌজের লড়াই দেখেন আশারেডু পল্টনের রব-কিসির নেরগল-শর্রানি। হুকুমের অপেক্ষা করছেন তিনিও।
রথে সওয়ার আরও তিনজন। একপাশে মানুষপ্রমাণ লম্বা বেতের ঢাল নিয়ে দাঁড়িয়ে ঢালি। রথের আরোহীদের তির কিংবা পাথরের আঘাত থেকে বাঁচানোই তার দায়িত্ব। অন্যপাশে বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে রথ-রক্ষক, বিপক্ষের যোদ্ধাকে রথ থেকে দূরে রাখাটাই তার কাজ। একদম সামনে সারথি, রথের চারটে ঘোড়ার রাশ তার হাতে।
লড়াই থেকে নজর ফিরিয়ে চারপাশে একবার তাকান নেরগল-শর্রানি। যুদ্ধের উন্মাদনার রেশ পৌঁছায়নি পেছনের এই শিবির অবধি। দৈনন্দিন খুঁটিনাটি কাজে ব্যস্ত শিবির সহকারীরা। একদিকে হাকিমেরা ওষুধের জড়িবুটি বাটে, অন্যদিকে তাঁবু খুলে ফেলে উটের পিঠে মালপত্র চড়ায় দাসের দল, পাশে দাঁড়িয়ে নরম মাটির ফলকে শলাকার আঁচড়ে হিসেব লেখে জোব্বা গায়ে লিপিকার। তার থেকে খানিক দূরে হিসেব রাখে আর এক লিপিকার, তার পায়ের কাছে সিপাহিরা মাঝে মাঝেই এসে জমা করে যায় সদ্য মৃত মানুষের মাথা। তাদের পরিশ্রমের খতিয়ান। যুদ্ধের শেষে এর ভিত্তিতেই ধার্য হবে তাদের পারিশ্রমিক।
দু-দিন আগে এখানটা ছিল এক শ্যামল মরুদ্যান, ছোট জলাশয় ঘিরে ছিল খেজুর গাছের সারি। বহু মানুষ, ঘোড়া আর উটের পায়ের চাপে, সে জলাশয়ের স্বচ্ছ জল এখন কর্দামাক্ত, ঘোলাটে। একটা তির-বেঁধা উট নিজের রক্তে সে জল রাঙিয়ে তার মধ্য পড়ে আছে মুখ থুবড়ে।
আর খেজুর গাছগুলো রূপান্তরিত হয়েছে মূষল-যন্ত্রে।
সে যন্ত্রের দিকে চোখ রাখেন নেরগল-শর্রানি। আসন্ন লড়াইতে এটা তাঁর পল্টনের মূল হাতিয়ার।
একটা বিশাল আকারের কাঠের শকট। শকটের সামনে থেকে এগিয়ে আছে লম্বা কাঠের খুঁটি, তার মাথায় লোহার আস্তরণ। শকটের ঠিক ওপরে কাঠের তৈরি উঁচু মিনার, তার গায়ে ছোট ছোট ফোকর।
‘রব-কিসির!’
পেছনের রথ থেকে আঙুল তুলে দূরের লড়াইয়ের দিকে নির্দেশ করে রব-উরাটে শার্রু-এমুরান্নি।
লড়াইয়ের ময়দান থেকে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে আসে এক অশ্বারোহী, নেরগল-শর্রানির রথের কাছে এসে সজোরে লাগাম টেনে গতিরোধ করে বাহনের। মাথার চুল তার ঘামে লেপটে আছে কপালে, কাঁধ থেকে চুঁইয়ে পড়ে রক্ত।
‘রব-কিসির!’
অশ্বারোহীর এগিয়ে ধরা মাটির ফলকটা হাত বাড়িয়ে নেন নেরগল-শর্রানি। ফলকে আঁচড়ানো দু-তিন লাইন আঁকিবুঁকির নিচে আস্শার ফৌজের সেনাপতির সীলমোহর।
আক্রমণের হুকুম।
মাথার ওপর তলোয়ার তুলে দূরের প্রাকার দিকে ইঙ্গিত করেন নেরগল-শর্রানি।
‘আগে বঢ়ো এস্রাহাড্ডেন।’
লাগামে টান দেয় সারথি এস্রাহাড্ডেন, ছুটতে শুরু করে রথ। তাঁকে অনুসরণ করে ছুটতে থাকে শার্রু-এমুরান্নি আর অন্য রব উরাটেদের রথ, তাদের পেছনে দৌড়ায় পল্টনের সিপাহিরা। সিপাহিদের পেছনে জোড়া উটে টেনে নিয়ে আসে মুষল যন্ত্রের শকট।
আশারেডু পল্টন দৌড়াতে থাকে শত্রু প্রাকারের দিকে।
প্রাকারের কাছে সংঘর্ষ চরমে। ওপর থেকে বর্ষার ধারার মতো নেমে আসে তির আর পাথর, নীচে ঢালের আড়াল থেকে তার জবাব দেয় আস্শার তিরন্দাজেরা। চলে মই লাগিয়ে প্রাচীরে চড়া আর যোদ্ধা সমেত সেই মই ঠেলে ফেলে দেওয়ার মারণ প্রতিযোগিতা। নগরের কাঠের বিশাল ফটকটা বন্ধ, মাথায় ওপরে ঢালের আড়াল দিয়ে, তাতে দল বেঁধে ধাক্কা মারে আস্শার সিপাহিরা, তাদের বাধা দিতে ওপর থেকে বল্লম আর পাথর ছোড়ে নগর রক্ষীরা।
ফটকের দিকে যায় না আশারেডু পল্টন। মূল লড়াই থেকে খানিকটা সরে এসে প্রাচীরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে নেরগল-শর্রানির রথ।
এখানে মাটি ফেলে একটা ঢালু রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। জমি থেকে শুরু হয়ে সে রাস্তা ঠেকেছে গিয়ে প্রাচীরের মাঝ বরাবর। পেছনের তলোয়ারের কোপ আর সামনের তিরের বৃষ্টির মাঝখানে রাস্তা তৈরি করেছিল যে সব দাসেরা, তাদের দেহগুলো পড়ে সেই পথের দু-পাশে।
প্রাচীরের নিচের অংশের চাইতে ওপরের অংশ কম মজবুত, তাই দাসেদের জীবনের বিনিময়ে বিছানো হয়েছে এই নতুন পথ।
রথ থেকে লাফিয়ে নামে রব-উরাটেরা। কয়েক ভাগে হয়ে সামনে এগিয়ে যায় পল্টনের সিপাহিরা। একদল সামনে আর মাথার ওপরে ঢাল ধরে এগিয়ে যায় আগে, তাদের আড়াল থেকে তির ছুঁড়তে শুরু করে আর একদল।
মুষল-যন্ত্র থেকে উট খুলে দিয়ে, ঢালু পথ দিয়ে শকট ঠেলে তুলতে থাকে কিছু সিপাহি, শকটের পিঠের মিনারে চড়ে তার ফোকর দিয়ে তির ছোঁড়ে আরও কয়েকজন।
ঢালু পথ দিয়ে ওপর চড়ে শকট, তাকে জায়গা ছেড়ে দেয় সামনের যোদ্ধারা।
শকটের সামনে বসানো লম্বা খুঁটি ধাক্কা মারে প্রাচীরের গায়ে।
ওপর থেকে ছুটে আসে তির আর বল্লম, রক্তধারা বইয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে কিছু সিপাহি। সঙ্গে সঙ্গে তাদের জায়গা নেয় অন্যরা।
একবার, দু-বার। আবার। আবার। বারংবার শকটের মুষল আঘাত করতে থাকে প্রাচীর গাত্রে, কাঁপতে থাকে নগর প্রাকার।
তারপর হঠাৎই তার একাংশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে নগরের ভেতর।
উল্লাসে চিৎকার কর ওঠে আশারেডু পল্টন।
মাথার ওপর তলোয়ার তোলেন নেরগল-শর্রানি। সিপাহিদের পেছনে নিয়ে পথ বেয়ে ছুটতে থাকে পল্টনের রব-উরাটেরা, স্রোতের মতো প্রাচীরের ভাঙা অংশ দিয়ে আশারেডু পল্টন লাফিয়ে পড়তে থাকে নগরের ভেতর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নগরের মধ্যে জ্বলে ওঠে অগ্নিশিখা, যুদ্ধের আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে ওঠে নারী-পুরুষের ভয়ার্ত চিৎকার।
আচমকাই খুলে যায় নগরের ফটক, ছুটে বেরোয় আতঙ্কিত মানুষের দল। তাদের ওপর হিংস্র শ্বাপদের মতনই ঝাঁপিয়ে পড়ে আস্শার ফৌজ, শুরু হয় নির্মম হত্যালীলা।
সেদিকে একবার তাকিয়ে রথ থেকে নামেন নেরগল-শর্রানি। নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে ওপরে ওঠেন ঢালু পথ বেয়ে।
নগরের ভেতরে তাঁর আরও লড়াই বাকি।
যাত্রী
এই মরুভূমিতে সূর্য মাথার ওপরে চড়লে পথ চলা অসম্ভব। আপাতত তাই বিশ্রামের জন্য ছাউনি খাটানো হয়েছে, সূর্য ঢলে পড়লে ফের শুরু হবে যাত্রা। পান্থদের নিয়ে ছাউনির নিচে বসে থাকেন অল্লকপ্প। একটু দূরে হাঁটু দুটো দু-হাতের বেড়ের মধ্যে ধরে বসে থাকেন চক্ষ।
সূর্যের অবিরত উত্তাপে শব্দহীন শূন্যতায় লুটিয়ে থাকে ঊষর মরুভূমি। কেবল বালির ওপর দিয়ে বয়ে আসা তপ্ত বাতাস মাঝে-মধ্যে ঝিরঝির শব্দে ছাউনির ওপর ছড়িয়ে দেয় বালুকণা। চামড়ার থলে থেকে ছাউনির চারপাশে জল ছেটায় সিপাহিরা।
সীমাহীন বালুরাশির দিকে তাকিয়ে দেখে গগ্গ, ‘এখানে পথ কোথায় থের অল্লকপ্প? যেদিকে তাকাই সেখানেই তো কেবল বালি।’
‘যে জানে সে এর মাঝেও পথ খুঁজে পায় বইকী পান্থ গগ্গ!’
বাকি পান্থদের দিকে ফেরেন অল্লকপ্প, ‘পথের সন্ধান পুস্তক অধ্যয়নে পাওয়া যায় না, মেধা ব্যবহার করে পাওয়া যায় না, অন্যদের কাছে থেকে শুনেও পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র যারা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পথের সন্ধান করে চলে, সেই সন্ধানীদের কাছেই পথ নিজেকে প্রকাশিত করে। পথ—’
ভেসে আসে একটা ব্যঙ্গের হাসি। কথা থেমে যায় অল্লকপ্পর। অবাক দৃষ্টিতে তাকায় গগ্গ আর অন্য পান্থরা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে জল ছেটাতে থাকা সিপাহি সুভদ্দা।
ঐতিহাসিক চক্ষ। হাসিটা তাঁরই। ঠোঁটের কোনে তাঁর তখনও লেগে এক টুকরো অবজ্ঞা।
‘আপনারা এই পথের দর্শনে সরল ব্যাপারকে আরও জটিল করে তুলছেন না তো? পান্থ গগ্গ পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু মরুর এই বিশালতার বুকে পথ কি আরও বন্ধন এনে দেয় না?’
‘একটু বিশদে বলবেন ঐতিহাসিক চক্ষ?’ শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করেন অল্লকপ্প।
জলের থলি হাথে দাঁড়িয়ে থাকা সুভদ্দার দিকে তাকান চক্ষ, ‘পান্থ গগ্গ, পথের সন্ধান না করে সিপাহি সুভদ্দার আদিপুরুষদের কথা স্মরণ করুন। তাঁরা ছিলেন মরুঝড়ের মতনই স্বাধীন, তাঁদের রথচক্র পথের তোয়াক্কা না করে ছুটে যেতে যেখানে খুশি। পথ তাদের দিকনির্ণয় করে দিত না।’
বজায় থাকে অল্লকপ্পর কণ্ঠের শীতলতা, ‘না ঐতিহাসিক চক্ষ। পথ না থাকাটা স্বাধীনতার নয়, অনেক সময়ে যথেচ্ছাচারের সমার্থক হয়ে ওঠে। মানুষের প্রাণের সঙ্গে যথেচ্ছাচার।’
মরু
এই মরুদেশে পাথর দুষ্প্রাপ্য। ঊর নগরীর সমস্ত বাড়ি তাই মাটির। ব্যতিক্রম কেবল দুটি—রাজপ্রাসাদ আর আস্শার দেবতার জিক্ক্রাট মন্দির।
প্রাসাদের অলিন্দ থেকে নেমে এসেছে পাথরের চওড়া সিঁড়ি। তার দু-ধারে পাহারা দেয় পাথরের লামাস্সু মূর্তি। শরীর ষাঁড়ের, মানুষের মতো মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় লম্বা টুপি, পিঠে ডানা। সিঁড়ির নিচ থেকে থেকে ছড়ানো রাস্তা শুরু হয়ে থেমেছে দূরের আস্শারের মন্দিরের ধাপে ধাপে ওঠা জিক্ক্রাটের সামনে।
প্রভু আস্শার আর পৃথিবীতে তাঁর প্রধান ভৃত্যের মাঝের যাত্রাপথ।
জিক্ক্রাটের প্রবেশ পথে এক উঁচু তোরণ। রুক্ষ, কর্কশ চেহারা তার। যেন মরুভূমির বালি জমাট বেঁধে পথের দু-পাশ থেকে স্তম্ভ হয়ে উঠে এসে ধনুকের আকারে মিলেছে পথের অনেক ওপরে।
ভাগ্যবানেরা ওই তোরণপথেই যাত্রা করে বুউরুমু-র উদ্দেশে, যেখানে আস্শার নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেন ক্রুরকর্মা দেবতা হান্পি-র অনুচরদের সঙ্গে।
প্রাসাদের সিঁড়িতে সার বেঁধে দাঁড়ানো অমাত্যদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকেন নেরগল-শর্রানি, পথের দু-পাশে দাঁড়িয়ে থাকে নাগরিকরাও।
নাগরিক কোলাহল ছাপিয়ে বেজে ওঠে বিষাণ। ধীরপায়ে অলিন্দে এসে দাঁড়ান টিগ্লাথ-পিলেসার। পরনে রঙিন জোব্বা, লম্বা চুল আর আবক্ষ দাড়ি চকচক করে তেলের প্রসাধনে। হাতে তাঁর ধরা আস্শারের প্রতীক। লম্বা দণ্ডের মাথায় দু-পাশে ডানা লাগানো বৃত্ত, বৃত্তের নিচে পাখির পুচ্ছ, ভেতরে জ্যা-টানা ধনুক হাতে পুরুষ শরীরের উর্দ্ধাংশ। এর জোরেই শাসন করেন টিগ্লাথ-পিলেসার। ঊর নগরের অধীশ্বর দেবতা আস্শার স্বয়ং। তিনিই রাজা, শার্রুম। টিগ্লাথ-পিলেসার রাজা নন, ইশ্শিয়াক-আস্শার। আস্শারের প্রধান ভৃত্য।
আস্শার দণ্ড মাটিতে ঠোকেন টিগ্লাথ-পিলেসার।
‘শুল্মু। সুপ্রভাত।’
থেমে যায় কোলাহল, ছড়িয়ে পড়ে টিগ্লাথ-পিলেসারের উচ্চকণ্ঠ।
‘আমরা প্রভু আস্শারের ভৃত্য। এই জমি, আকাশ সমস্তই আস্শারের সম্পত্তি। যুদ্ধের সময় আস্শার আমাদের রথের চাকায় গতি আনেন, তিরে সওয়ার হয়ে শত্রু নিধন করেন। আস্শারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা আর্নু, পাপ। মাসিবিনার বিদ্রোহে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, আস্শারের নির্দেশে তাই তাদের আমরা শাস্তি দিয়েছি।’
আঙুল তুলে পথের ধারের একটা উঁচু বুরুজের দিকে নির্দেশ করেন টিগ্লাথ-পিলেসার। বুরুজের ওপরের আকাশে বাতাস কাটে শকুনের ঝাঁক।
‘কয়েকজনকে জীবন্ত কবর দিয়েছি বুরুজের ভেতর।’
বুরুজের মাথায় সারি বাঁধা লোহার শূল। তাতে গাঁথা মানুষের দেহ।
‘কয়েকজনকে শূলে চাপিয়েছি বুরুজের মাথায়।’
শূলে গাঁথা শরীরে থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে বুরুজের গায়ে জড়ানো রক্তাক্ত চামড়ার ওপর।
‘কয়েকজনের চামড়া জীবন্ত অবস্থায় ছাড়িয়ে নিয়ে, সেই চামড়ায় মুড়ে দিয়েছি বুরুজ।’
বুরুজের গা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে নিচের স্তূপাকার দেহাংশের ওপর।
‘আর বাকিদের ধীরে ধীরে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, উপড়ে নিয়েছি চোখ।’
সিঁড়িতে দাঁড়ানো নেরগল-শর্রানির দিকে তাকান টিগ্লাথ-পিলেসার।
‘আস্শারের যোদ্ধা নেরগল-শর্রানিকে মাসিবিনা দখলের জন্য অভিনন্দন জানাই। আশা করি আস্শার তাঁকে আবার তাঁর হয়ে লড়াইয়ের সুযোগ দেবেন।’
হয়তো বা টিগ্লাথ-পিলেসারের কথাতে সায় দিয়ে, আচমকাই শনশন আওয়াজ তুলে একটা ধুলোর ঝড় ওঠে তোরণ ঘিরে, তার আড়ালে হারিয়ে যায় তোরণ।
পাক খেতে খেতে ধুলোর কুণ্ডলী ছুঁয়ে ফেলে আকাশ, তারপরে সশব্দে আছড়ে পড়ে মাটিতে।
এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে ঊরের রাজপথে।
তোরণের ওপারে আস্শারের জিক্ক্রাট নয়, দেখা যায় অন্য এক জ্বলন্ত সূর্যের নিচে আর এক ঊষর মরুভূমি।
ফের নেরগল-শর্রানির দিকে তাকান টিগ্লাথ-পিলেসার, ‘রব-কিসির, হান্পির সঙ্গে লড়াইয়ে বুউরুমুতে আস্শারের প্রয়োজন আশারেডু পল্টনকে। প্রস্তুত হোন।’
মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানান নেরগল-শর্রানি। আস্শারের জয়ধ্বনিতে ঊরের নাগরিকেরা ভরিয়ে ফেলে আকাশ-বাতাস।
যাত্রী
মরুদ্যান বললে একে হয়তো খানিকটা বাড়িয়েই বলা হয়। একটা ছোট জলয়াশয় ঘিরে এলোমেলো দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা খেজুর গাছ। সে জলও ঘোলাটে। তবু এতটা মরুভূমি পেরিয়ে এসে সেই জলই চোখেমুখে ছেটায় পথশ্রান্ত সিপাহি আর পান্থরা।
একটা খেজুর গাছের সীমিত ছাওয়ায় বসে বিশ্রাম নেন অল্লকপ্প। তাঁর পাশে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকে গগ্গ, দৃষ্টি তার হারিয়ে গেছে কোন শূন্যতায়।
সামান্য দূরে বালির ওপর বেলে পাথরের দুটো খাটো স্তম্ভের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পাথরের ছোট-বড় নানান টুকরো জানান দেয় এখানে অতীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল কোনও তোরণ। তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন চক্ষ।
একটা রেকাবে পানপাত্র সাজিয়ে নিয়ে আসেন অজ্ঝক্খ পসেন্দি, ‘থের অল্লকপ্প, পান্থ গগ্গ। জল।’
জলের পাত্র তুলে নেন অল্লকপ্প, কিন্তু নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে নিজের মনের অতলে ডুবে থাকা গগ্গ।
তার কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দেন অল্লকপ্প, ‘জাগো পান্থ গগ্গ। জাগো! অলসতা ত্যাগ কর। পা রাখো সঠিক পথে।’
সম্বিত ফেরে গগ্গ-র, কুণ্ঠিত ভঙ্গীতে তুলে নেয় জলের পাত্র।
লম্বা পায়ে এগিয়ে এসে জলের পাত্র তুলে নেন চক্ষও, ‘থের অল্লকপ্প, বার্ক্ষের অধিবাসীদের মধ্যে কমনীয় অনুভূতির অভাব কি সেখানকার জলের স্বল্পতার জন্যই? কী মনে হয় আপনার?’
মাথা নাড়েন অল্লকপ্প, ‘না ঐতিহাসিক চক্ষ। কোনও প্রাকৃতিক বস্তুর প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির ওপর মানুষের অনুভূতি নির্ভরশীল নয়। অজ্ঝক্খ পসেন্দির পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বার্কিন গ্রহের জলপথের একচ্ছত্র অধিপতি। কিন্তু জলের আধিক্য তাঁদের নিষ্ঠুরতাকে কিছুমাত্র হ্রাস করতে পারেনি।’
পারাবার
বাতাস আর সমুদ্রের জল যেন ষড়যন্ত্র করে যুদ্ধে নেমেছে আকাশের সঙ্গে। ভালকিরিয়ার চিৎকারের মতো উন্মত্ত হাহাকারে ছুটে যায় বাতাস, তাকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রের পাহাড়প্রমাণ ঢেউ লাফিয়ে ছুঁতে চায় আকাশ। উত্তরে বজ্রের গর্জনে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে আকাশ, তার মেঘে ঢাকা বুকে ঝলসে ওঠে বিদ্যুতের তরবারি।
দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির সেই প্রলয়দোলার বুকে প্রাণপণ লড়াই করে দ্রেঙ্গর্দের ত্রিশ দাঁড়ের জাহাজটা।
লম্বা জাহাজের শেষ প্রান্তে পোড় খাওয়া নাবিকের সতর্ক দৃষ্টিতে উত্তাল সমুদ্রের দিকে নজর রাখেন হ্রলগ্। বজ্রমুষ্টিতে হাল ধরে প্রতিটি তরঙ্গ, প্রতিটি আবর্ত লক্ষ করতে থাকেন গভীর মনযোগ দিয়ে।
জাহাজের সামনের দিকটা সরীসৃপের গলার মতো লম্বা হয়ে ওপরের দিকে উঠে গিয়ে শেষ হয়েছে একটা ড্রাগনের মাথায়। সেই গলাটা দু-হাতে জড়িয়ে ধরে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে নিয়াল্, এই জাহাজের নজরদার। সামনে কোনও বিপদ দেখলে সাবধান করে দেওয়া তার দায়িত্ব।
জাহাজের মাঝখানে মাস্তুলে বাঁধা পশমের বিশাল চৌকো পালটা ফুলে উঠে ছিঁড়ে উড়ে যাবার উপক্রম করে। প্রাণপণে তার দড়ি টেনে তাকে উঠিয়ে নামিয়ে বাতাসের সঙ্গে লড়াই করে চলে কয়েকজন। জাহাজের পেছন থেকে চেঁচিয়ে তাদের নির্দেশ দেন হ্রলগ্।
জাহাজের দু-পাশে সরু পাটাতনে জাহাজের পেছনের দিকে মুখ করে বসা দ্রেঙ্গর্রা দাঁড় হাতে লড়াই করে চলে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে। তারাও অপেক্ষা করে থাকে হ্রলগের প্রতিটি নির্দেশের।
‘সামাল! সামাল!’ সমস্বরে চিৎকার ওঠে অনেকগুলো কণ্ঠে।
একটা বিশাল ঢেউ কোনাকুনি এসে আছড়ে পড়ে জাহাজের ডানদিকে। ঢেউয়ের নির্মম প্রহারে আর্তনাদ করে ওঠে জাহাজের পাটাতন, খটখট শব্দে কাঁপতে থাকে থাকে জাহাজের দু-পাশে বসানো কাঠের গোলাকার ঢালগুলো। সেই প্রবল জলোচ্ছ্বাসে জাহাজ হেলে যায় বাঁ-দিকে।
‘সামাল! সামাল!’ চেঁচিয়ে ওঠেন হ্রলগ্ও। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হালটা ঠেলে ধরেন বাঁ-দিকে।
‘সামাল! সামাল!’ চেঁচায় মাঝ জাহাজের দ্রেঙ্গর্রা। দড়াদড়ির টানাটানিতে তেরছা করে ঘোরায় পাল।
‘সামাল! সামাল!’ গলা মেলায় দাঁড় টানতে থাকা দ্রেঙ্গর্রা, বাঁদিকে থাকা দলটা বাড়িয়ে দেয় দাঁড় টানার বেগ। উৎকণ্ঠায় যেন রুদ্ধ হয়ে আসে সময়ের গতি।
কাঠ বাঁকার বিচিত্র আওয়াজে প্রতিবাদ জানিয়ে ধীর ধীরে সোজা হয় জাহাজ।
অবকাশের সময় নেই। ঝড়ের আওয়াজ ছাপিয়ে জাহাজের সামনে থেকে ভেসে আসে নজরদার নিয়ালের চিৎকার।
সামনের দিকে তাকান হ্রলগ্। সেখানে সমুদ্রের জল কেমন ফুলে উঠছে।
সামুদ্রিক ঝড়ের নাড়ি-নক্ষত্র জানেন হ্রলগ্। ওই ফুলে ওঠা অংশটা কিছুক্ষণের মধ্যে পরিণত হবে একটা পাহাড়-প্রমাণ ঢেউয়ে। তারপর সেটা যখন ভেঙে আছড়ে পড়বে, তার ধাক্কায় চুরমার হয়ে যাবে জাহাজ। কোনও চিহ্ন না রেখে মুহূর্তের মধ্যে অতলে তলিয়ে যাবে জাহাজের প্রতিটি মানুষ।
বাঁচার উপায় মাত্র একটিই। ঢেউ তার সম্পূর্ণ উচ্চতায় ওঠার আগে তাকে টপকে যাওয়া।
শক্ত হাতে হাল চেপে ধরেন হ্রলগ্, ‘জলদি! ব্রেগ্দা! ব্রেগ্দা!’
ভারী পালটাকে ঘুরিয়ে ঠিক বাতাসের পেছনে রাখে দ্রেঙ্গর্ মাল্লারা। প্রাণপণ শক্তিতে দাঁড় টানে দ্রেঙ্গর্ দাঁড়িরা, দুরন্ত গতিতে সামনের দিকে ছোটে জাহাজ।
তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঁচু হতে শুরু করে সমুদ্র।
জীবন বাজি রাখা এক প্রতিযোগিতায় বাতাসের আগে দৌড়ায় জাহাজ।
আরও উঁচু হয় সমুদ্র তরঙ্গ। যেন এক বিশাল পাহাড়ের গা বেয়ে আকাশের দিকে উঠতে থাকে জাহাজ। মাথার ওপরে দেখা যায় সে পাহাড়ের ফেনিল চূড়া।
যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে এই ক্ষণিকের জল-পর্বত, চিৎকার করেন হ্রলগ্, ‘ব্রেগ্দা! ব্রেগ্দা!’
শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে দাঁড় টানে দাঁড়িরা। জাহাজ তখন প্রায় খাড়া দাঁড়িয়ে জলের দেওয়ালের গায়ে।
জলের বিশাল একটা ঝাপটা বয়ে যায় জাহাজের ওপর দিয়ে। আর তারপরেই জল-প্রাচীরের মাথা টপকে যায় জাহাজ, কয়েকগুণ গতি বাড়িয়ে নামতে আরম্ভ করে নিচের দিকে।
‘সামাল! সামাল!’ দু-হাত আর শরীরের মাঝখানে শক্ত করে হাল চেপে ধরেন হ্রলগ্। মাল্লারা নামিয়ে ফেলে পাল। দাঁড়িরা জল থেকে তুলে নেয় দাঁড়।
দুরন্ত গতিতে জাহাজ এগিয়ে যায় সামনের দিকে, পেছনে সশব্দে আছড়ে জলের পাহাড়।
‘সামাল! সামাল!’ ফের মাস্তুলে চড়ে পাল, ফের টান পড়ে দাঁড়ে। ছুটতে থাকে জাহাজ।
বাতাসে ভর করে জাহাজ এসে পড়ে ঝড়ের সীমানার বাইরে। হাওয়ার প্রকোপ এখানে অনেক কম, তবে বৃষ্টি ঝরে মুষল ধারে।
কিন্তু না, এখনও বিশ্রামের অবকাশ আসেনি।
‘ফিয়ল্! ফিয়ল্! পাহাড়!’ সামনে থেকে ভেসে আসে নিয়ালের চিৎকার।
সমুদ্রে জল থেকে মাথা তুলেছে ছোট ছোট পাহাড়ের চূড়া। তাদের ওপর সবেগে আছড়ে পড়ে ঢেউ। ফেনিল সাদা জল ছিটকে ছড়িয়ে যায় বাতাসে।
এবার নিয়ালের দায়িত্ব।
তার নির্দেশমতো ডাইনে-বাঁয়ে হাল বেঁকাতে থাকেন হ্রলগ্। পাহাড়ের পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে এগোতে থাকে জাহাজ, ক্রমে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সামনে নজরে জমির সীমানার ঝাপসা চেহারা।
ফের দাঁড় পড়ে জলে, গতি পায় জাহাজ, ঢেউয়ের মাথায় চড়ে এসে আটকায় থিয়ট্টার বেলাভূমিতে।
দাঁড় জাহাজের মধ্যে তুলে রাখে দাঁড়িরা, মাস্তুল থেকে পাল নামিয়ে ফেলে মাল্লারা। জাহাজের প্রতিটি দ্রেঙ্গর্ মাথায় পরে নেয় নাক অবধি ঢাকা শিরস্ত্রাণ। এক হাতে তুলে নেয় রণকুঠার, জাহাজের গায়ে বসানো গোল ঢাল খুলে তুলে নেয় অন্য হাতে। জলে ভিজে স্বল্প আলোয় চকচক করে প্রত্যেকের পরনের লোহার বুটি দেওয়া চামড়ার বর্ম।
বেলাভূমি থেকে কালো পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে টিলার মাথা অবধি। হাতের কুঠার উঁচিয়ে সেদিকে নির্দেশ করেন হ্রলগ্, ‘দ্রেঙ্গর্!’
শিরস্ত্রাণের কোটর থেকে পঞ্চাশ জোড়া চোখ তাকায় তাঁর দিকে, ‘হিলমির্!’
‘রাজা এল্লা নিশ্চিন্তে শিবির ফেলেছে ওই পাহাড়ের মাথায়, এই ভেবে যে এই দুর্যোগে সে নিরাপদ। কিন্তু দ্রেঙ্গরের কাছে সমুদ্র রাজপথের সমান। চলো তাকে সে কথাটা মনে করাই।’
সিঁড়ি বেয়ে ছুটতে আরম্ভ করে দ্রেঙ্গর্রা।
পাহাড়ের মাথায় সৈন্য শিবিরে কোনও পাহারা নেই। বৃষ্টি বাঁচিয়ে ছাউনির নিচে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করে সবাই।
রণহুঙ্কার তুলে বুনো নেকড়ের মতো তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্রেঙ্গর্রা।
‘অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা। অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা। তোদের সবার মালিক অদিন্ন্।’
ডাইনে-বাঁয়ে পড়ে কুঠারের কোপ, ফিনকি দিয়ে ছিটকে ওঠে রক্ত। বৃষ্টির আওয়াজ চাপা পড়ে যায় আহতের আর্তনাদে।
অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা।
তলোয়ার তুলে একসঙ্গে দু-জন আক্রমণ করে হ্রলগ্কে। ঢাল সমেত বাঁ হাতটা মাথার ওপর তোলেন হ্রলগ্, একজনের তলোয়ারের ব্যর্থ আঘাত আছড়ে পড়ে ঢালের ওপর। দ্বিতীয়জনের আঘাতটা নিজের কুঠার দিয়ে আটকে তাকে পদাঘাতে দূরে ছিটকে দেন হ্রলগ্, তারপর মুহূর্তের মধ্যে কুঠারের গতি ফিরিয়ে নিয়ে প্রথমজনের মাথায় আঘাত করেই কুঠার ছুঁড়ে দেন দূরে। দ্বিতীয়জন তখনও টাল সামলে উঠতে পারেনি, হ্রলগের ছোড়া কুঠার আমূল গেঁথে যায় তার বুকে।
অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা।
শুয়ে থাকা শত্রুর দেহ থেকে কুঠার খুলে নেন হ্রলগ্। মাটির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বৃষ্টির স্বচ্ছ জলের ধারার সঙ্গে মিশতে থাকে রক্তের লাল।
অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা।
চলতে থাকা হানাহানি। বৃষ্টি ভেজা মাটি লাল থেকে হতে থাকে আরও গাঢ় লাল।
অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা।
যাত্রী
নীল আকাশের সাদা মেঘের ছায়া পড়ে হ্রদের নিস্তরঙ্গ জলে। অলস গতিতে সামনে ভেসে চলে যাত্রীদের নৌকোগুলো। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার শ্রান্তির পর সবাই খানিকটা বিশ্রামের মেজাজে। পেছনের নৌকোগুলো থেকে বাতাসে ভেসে আসে তাই সিপাহিদের হাসির আওয়াজ আর এলোমেলো কথার টুকরো।
সামনের নৌকাটায় অবশ্য কোনওরকম হালকা মেজাজ অনুপস্থিত। কারণ ঐতিহাসিক চক্ষ আর অজ্ঝক্খ পসেন্দি ছাড়া এতে সওয়ার শুধু পান্থরা। একটা রঙিন চাঁদোয়ার নিচে বসে তারা শোনে অল্লকপ্পর কথা।
নৌকো চলে তার নিজের স্বচ্ছন্দ গতিতে, পথও চিনে নিতে পারে আপনা-আপনিই, তবু হয়তো খানিকটা ঐতিহ্যের খাতিরেই নৌকোর শেষ প্রান্তে হালে হাত রেখে বসে থাকেন পসেন্দি।
চাঁদোয়ার বাইরের নরম রোদে আধশোয়া হয়ে চক্ষও শোনেন অল্লকপ্পকে। চোখ তাঁর অর্ধেক বোজা, ঠোঁটে খেলা করে একটা অদ্ভুত হাসি।
চাঁদোয়ার নিচ থেকে ভেসে আসে অল্লকপ্পর কণ্ঠস্বর, ‘নীতিবান ব্যক্তিরা প্রশংসাই করুন আর নিন্দাই করুন, সম্পদ অর্জিত হোক বা ব্যয়ই হোক, মৃত্যু আজই আসুক বা বহুকাল বাদে, পান্থ কখনও তার তাঁর পথ থেকে এক পদও বিচ্যুত হবেন না।’
চোখ খুলে একবার গগ্গর দিকে তাকান চক্ষ, ঠোঁটের হাসিটা তাঁর বেঁকে যায় আরও কিছুটা, ‘পথ যদি কেউ বেঁধে দেয়, তাহলে পথ চিনতে শেখার দায়টাই কি চলে যায় না পান্থ গগ্গ?’
‘বুঝলাম না ঐতিহাসিক চক্ষ,’ গগ্গর বদলে শীতল কণ্ঠে উত্তর দেন অল্লকপ্প।
পসেন্দির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান চক্ষ, ‘সঠিক পথে নৌকো চালানোর জন্য অজ্ঝক্খ পসেন্দির কোনও রকম প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই, নৌকো নিজেই নিজের পথ চিনে নেয়। কিন্তু অজ্ঝক্খর পূর্বপুরুষদের কথা চিন্তা করুন! সমুদ্রের স্রোত, আকাশের তারা, বাতাসের গতি, কত গভীর প্রাকৃতিক জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে তাঁরা অকুতোভয়ে সমুদ্রপথ পাড়ি দিতেন। চেনা পথের নিরাপদ আশ্রয়ে অতীতের সে বীর নাবিকদের জ্ঞান কি বিস্মৃতিতে হারিয়ে যায়নি?’
কণ্ঠের শীতলতা কাটে না অল্লকপ্পর, ‘যে জ্ঞান কেবল পরের পীড়নে ব্যবহার হয়, সে জ্ঞান হারিয়ে গেলেই কি ভালো নয় ঐতিহাসিক চক্ষ? বার্কিনী নাবিকেরা সমুদ্র ভ্রমণের বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন বটে, কিন্তু সে বিদ্যা তাঁদের করে তুলেছিল দুর্বিনীত, নির্মম আর অত্যাচারী।’
পারাবার
নীল আকাশের নিচে নীল সমুদ্র আজ শান্ত, নিস্তরঙ্গ। জনহীন পাথুরে দ্বীপটা ঘিরে আজ যেন উৎসবের মেলা। দ্বীপ ঘিরে নোঙর ফেলেছে কাতারে কাতারে জাহাজ। লড়াকু ল্যাংস্কিপ, দূরপাল্লার ক্নার্র্, সওদাগরী বির্ডিঙ্গ্র্, কোনও জাহাজ বাদ নেই। তাদের পশমের পালে লাল সাদার নানা জ্যামিতিক নকশা, গলুইয়ের সম্মুখভাগে মাথা উঁচু করে থাকে সিংহ, ঘোড়া, ড্রাগন আর নানান পশুপাখির প্রতিকৃতি।
হুল্লোড়ের আওয়াজ ওঠে দ্বীপে। চলছে বাজি ধরে তিরন্দাজির খেলা। ধনুকে টঙ্কার ওঠে, থক শব্দ করে বিঁধে যায় নিশানা খুঁজে পাওয়া তির, বিজয়ীর উল্লাসের সঙ্গে মেশে মুদ্রা হাতবদলের ঝমঝম। উৎসবের আমেজে আজ দ্বীপে।
সে উৎসবে আনন্দের জোগান দিয়ে পাথর রক্তে ভেজাতে থাকে চাঁদমারি হওয়া খুঁটিতে বাঁধা কয়েকটা হতভাগ্য মানুষ। থিয়োট্টা থেকে ধরে আনা যুদ্ধবন্দী।
উৎসবে মেতে থাকা মানুষগুলোর মাথার ওপর দিয়ে দ্বীপের অন্য দিকে তাকান হ্রলগ্।
দ্বীপ থেকে কিছুটা দূরে সমুদ্রের জল থেকে উঠে এসেছে প্রবালে গড়া এক বিশাল তোরণ, তার রুক্ষ্ম বর্ণময় আর্দ্রতায় জলজ গুল্মের সবুজ ছোঁয়া। যখন অসগার্দরের আইসির দেবতারা রাগনরকের যুদ্ধে মুখোমুখি হবেন ভানির দানবদের, যখন ফ্রয়া আর থর্র্ মোকাবিলা করবেন নেকড়ে ফেন্রির আর অগ্নিদানব সর্তরের সঙ্গে, তখন তাঁর পাঁচশো দুয়ারী দরবার ভাল্হলে বসে অদিন্ন্ যুদ্ধে যোগ দিতে ডাক দেবেন যোদ্ধাদের। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তখন ওই তোরণপথে পাড়ি দেবে তাঁর প্রিয় যোদ্ধারা।
একটা সোরগোল ওঠে দ্বীপে আর ভাসতে থাকা জাহাজগুলিতে। ভেসে আসছে একটা বিশাল জাহাজ। তার দু-পাশে ত্রিশ-ত্রিশ খানা দাঁড় ওঠে আর পড়ে নজর কাড়া ছন্দে।
রাজার জাহাজ।
জাহাজ থেকে পাটাতন পড়ে দ্বীপের পাথুরে জমিতে। ধীর পায়ে নেমে আসেন রাজা হারাল্ড। জহরত বসানো সৌখিন তলোয়ারের খাপে ঝলকায় রোদের আলো, মাথার একরাশ চুল এলোমেলো ওড়ে সমুদ্রের হাওয়ায়।
অভিবাদনের ভঙ্গীতে ডানহাতটা তোলেন হারাল্ড, ‘দ্রেঙ্গর্!’
থেমে যায় ভিড়ের শোরগোল।
‘দ্রেঙ্গর্, পাঁচ বছর আগে যুদ্ধে পরাজয়ের পর রাজা এল্লা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রতি বছর নিয়মিত আমাদের ওয়েরগিল্ড চোকাবে। কিন্তু এ বছর এল্লা কেবল ওয়েরগিল্ড দিতে অস্বীকারই করেনি, আমাদের দূত এগিলকে জলে চুবিয়ে মেরেছে।’
আহত, রক্তাক্ত একটা মানুষকে হিঁচড়ে নিয়ে এসে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে কয়েকজন।
‘এল্লা ভেবেছিল তার নিজের রাজত্বে সে নিরাপদ। কিন্তু তুফানে ভর করে তাকে তারই জমি থেকে তুলে নিয়ে এসেছেন হিলমির্ হ্রলগ্।’
উল্লাসে ফেটে পড়ে ভিড়।
‘অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা। অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা!!’
হাত তুলে নিরস্ত করেন হারাল্ড, ‘এ বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কী?’
‘রক্ত ঈগল! রক্ত ঈগল!’
সমস্বরে উত্তর দেয় ভিড়।
মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানান হারাল্ড, ‘রক্ত ঈগল!’
ফের উল্লাসে ফেটে পড়ে ভিড়। দু-চারজন মিলে এল্লাকে উপুড় করে চেপে ধরে মাটিতে।
‘ইভার্র্!’ ডাক দেন হারাল্ড।
বিশাল ছোরা হাতে এগিয়ে আসে একজন, হাঁটু গেঁড়ে বসে এল্লার শরীরের পাশে।
তারপর ছোরার টানে মেরুদণ্ডের জোড় থেকে এক-এক করে কাটতে আরম্ভ করে তার পাঁজর।
এল্লার মরণ চিৎকারের সঙ্গে মেশে ভিড়ের উল্লাস।
প্রতিটি পাঁজর মেরুদণ্ড থেকে আলাদা করা হয়ে গেলে এল্লার শরীরের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ইভার্র্ টেনে বের করে আনে তার ফুসফুস, ছড়িয়ে দেয় পিঠের ওপর।
এল্লার শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলিত হতে থাকে ফুসফুস। যেন পিঠের ওপর কোনও ঈগলের স্তিমিত গতিতে ওঠা নামা করতে থাকা রক্ত-লাল দুটি ডানা।
‘অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা। অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা!!’
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ছড়িয়ে যায় উল্লাস।
মৃদু হেসে হ্রলগের দিকে ফেরেন রাজা হারাল্ড, ‘হিলমির্, আপনার জন্যই আমরা এগিলের মৃত্যুর দাম চোকাতে পারলাম। প্রার্থনা করি অদিন্ন্ রাগ্নরকের লড়াইতে আপনাকে সামিল করুন।’
হ্রলগ্ প্রত্যুত্তর দেওয়ার সময় পান না। তার আগেই সশব্দ আলোড়ন তুলে সমুদ্রের বুক থেকে লাফিয়ে ওঠে বিশাল জলরাশি। তার নিচে ঢাকা পড়ে যায় তোরণ।
প্রকৃতির নিয়ম অগ্রাহ্য করে সে জলোচ্ছ্বাস স্তম্ভের আকারে তীব্র গতিতে পাক খেতে থাকে তোরণকে ঘিরে।
তারপর তুমুল শব্দে হঠাৎই আছড়ে পড়ে সমুদ্রের বুকে।
বিস্ময়ে হ্রলগ্ লক্ষ করেন তোরণের অপর পারে অন্য কোনও এক সূর্যের আলোর নিচে ছড়িয়ে রয়েছে অন্য আর এক সমুদ্রের দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি।
নিবিড় এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে দ্বীপের বুকে। বিস্ময়ে যেন বাকশক্তি লোপে পেয়েছে সবার।
কথা বলেন সর্বপ্রথম হারাল্ড, ‘অদিন্ন্ আমার প্রার্থনা শুনেছেন হিলমির্। অসগার্দারে ডাক পড়েছে আপনার।’
অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা চিৎকারে ফের ভারী হয়ে ওঠে বাতাস।
যাত্রী
ছোট রুক্ষ দ্বীপটায় সবুজের চিহ্ন বলতে কেবল পাথরের গায়ে বেড়ে ওঠা শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। দ্বীপের থেকে অল্প দূরে জলের বুক থেকে উঁচিয়ে থাকা দুটো প্রবালের স্তম্ভেও লেগেছে সে শ্যাওলার ছোপ। তোরণের কাঠামোর অবশিষ্ট আছে এইটুকুই। তার বাকি অংশটার কিছুটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে মাটিতে, দ্বীপের পাথর থেকে তাদের আলাদা করে চেনা দায়। তাদেরই কয়েকটা কুড়িয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন চক্ষ।
দ্বীপের একদিকে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে পান্থ আর সিপাহিরা, নৌকো থেকে নেমে ধীর পায়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ান অল্লকপ্প।
‘যে প্রবেশদ্বার দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই গ্রহে পদার্পণ করেছিলেন, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তার সব ক-টাই একে একে দর্শন করেছি আমরা। যাত্রাপথের শেষে কেবল একটাই কথা যেন সবাই মনে রাখি। পথ চলতে অন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন কেবল ভালোবাসার। পান্থ, নাগরিক, সিপাহি বা গহপতি, সকলেই যেন সকলকে সেই ভালোবাসা দেয়। এক পথিক যেন অন্য পথিককে পথ চলতে সাহায্য করে।’
হাতের প্রবালের টুকরোগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এগিয়ে আসেন চক্ষ।
‘এই চারটে তোরণদ্বার দিয়ে প্রথম অধিবাসীরা এই গ্রহে আসার পরই—’
চক্ষর মুখের কথা কেড়ে নেন অল্লকপ্প, ‘হ্যাঁ, শুরু হয় হানাহানি আর প্রাণের অপচয়।’
জয়গান
তোরণদ্বার দিয়ে তারার দেশের অচেনা পাহাড়ে পা রাখেন সুয়াচ্চিক্ ইৎজ্লি। পেছনে ধীর ইতস্তত পদক্ষেপে আসে কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধারা, তাদের বিস্ময়ের ঘোর লাগা দৃষ্টি সন্ধান করে তেজ্কাৎলিপকা আর হুইৎজিলোপোৎশ্লির দ্বৈরথের।
অল্প দূরে জঙ্গলের আলো-আঁধারির মাঝে তোরণপথ পার হয়ে আসা গুনদেমে ওমোসেদের ন্’ননমিতনরাও বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে দেখে তাদের কুতোমেনের রং আর রূপ, নিশ্বাসে টেনে নেয় তার ঘ্রাণ।
ঋজু পিঠ আর ঘাড় এক সরলরেখায় রেখে রব-কিসির নেরগল-শর্রানি-র পেছনে কুচকাওয়াজ করে তোরণ পার হয় আশারেডু পল্টন, পা রাখে মরভূমিতে। তাদের কঠিন দৃষ্টি বুউরমুতে খুঁজে ফেরে আস্শার আর হানপির লড়াইয়ের ময়দান।
হিলমির্ হ্রলগের পেছনে সাঁতরে তোরণ পেরিয়ে পাথুরে দ্বীপটাতে এসে ওঠে তাঁর দ্রেঙ্গর্ সঙ্গীরা। বুক ভরে টেনে নেয় অসগার্দারের বাতাস, কোমরে হাত রেখে খুঁজতে থেকে ভালহলের দিশা।
মাটিতে ছড়ানো পাথরের মধ্যে কিছু একটা চকচক করে। নিচু হয়ে কুড়িয়ে নেন কৌতূহলী ইৎজ্লি।
লম্বা হাতল লাগানো একটা লম্বাটে ধাতুর পাত, তার মসৃণ গাত্রবর্ণে খোদাই করা নানান সূক্ষ্ম কারুকাজ।
হাতের মুঠোয় হাতলটা ধরে জিনিসটা কী তা বোঝার চেষ্টা করছেন ইৎজ্লি, একটা মৃদু গুঞ্জন ওঠে পাতের মধ্যে, হাতের তালুতে একটা মৃদু কম্পন অনুভব করেন ইৎজ্লি।
আচমকাই পাতের দু-পাশ ঘিরে সারি দিয়ে মাথা তোলে নীলাভ দ্যুতির চৌকোনা দাঁত।
এক লহমায় ইৎজ্লির হাতে ধরা জিনিসটা পালটে হয়ে দাঁড়িয়েছে এক অদ্ভুত দর্শন মাকুয়াহুইৎল্। কৃষ্ণ স্ফটিকের বদলে যার দাঁতের আকারের ফলক
তৈরি জমাট বাঁধা শক্তিপুঞ্জ দিয়ে।
বিস্ময়ের অস্ফুট আওয়াজ ভেসে আসে আসপাশ থেকে, তোরণের চারপাশে ইতস্তত ছড়িয়ে ধাতব পাত কুড়িয়ে নিয়েছে কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধারা। তাদের মুঠোতে সেগুলোও এখন রূপ নিয়েছে অতিলৌকিক মাকুয়াহুইৎলের।
পরখ করা জন্য একটা বড় পাথরের চাঙড়ে তাঁর হাতের মাকুয়াহুইৎল্ দিয়ে আঘাত করেন ইৎজ্লি।
শক্তিপ্রয়োগের দরকার পড়ে না, হালকা চাপেই দু-টুকরো হয়ে যায় পাথর।
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকেন ইৎজ্লি। উল্লাসে ফেটে পড়ে কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধারা।
ঘাসের ওপর থেকে চকচকে কিছু একটা কুড়িয়ে নেন ওমোসেদেও। তলোয়ার নয়, কেবল তার হাতলটুকু শুধু। হাতের মুঠোয় মৃদু কম্পন, স্বল্প উষ্ণতা, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই হাতল থেকে নিঃশব্দে বেড়ে ওঠে নীলাভ দ্যুতিতে গড়া এক দীর্ঘ অসিফলক।
কবজির মোচড়ে একটা গাছের গুঁড়িতে আঘাত করেন ওমোসেদে। বিনা বাধায় কাণ্ড পার করে চলে যায় তলোয়ারের জ্যোতি ফলক।
কুড়িয়ে নেওয়া আলোক অসি মাথার ওপর তুলে উল্লেলে উল্লেলে ধ্বনিতে আকাশ কাঁপায় ন্’ননমিতনরাও।
ঊষর মরুপ্রান্তর তখন মুখরিত আস্শারের জয়ধ্বনিতে। নেরগল-শর্রানির সিপাহিদের কারও হাতে ঝলসায় আলোয় গড়া কৃপাণ, কেউ তুলে ধরে জ্যোতি ফলক বসানো বল্লম, কেউ বা মহড়া সাধে নীলাভ শক্তিপুঞ্জে গড়া ঢাল হাতে।
মুখরিত সমুদ্রের বাতাসও। আকাশের দিকে জ্যোতি প্রভায় গড়া কুঠার তুলে অদিন্নের নামে হুঙ্কার দেয় হ্রলগের দ্রেঙ্গর্রা।
‘সুয়াচ্চিক্!’
দু-হাতে একটা লম্বাটে ধাতুর পাত তুলে ধরে হুইৎজিলিন্, মাঝখানটা তার কোনাকুনি বাঁকানো, দু-প্রান্ত থেকে ঝোলে কয়েকটা বাঁধন। গড়ন দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না সেটা আৎলাপাৎলিন।
হুইৎজিলিনের হাত থেকে আৎলাপাৎলিনটা নেন ইৎজ্লি, বাঁধনের মধ্য হাত গলিয়ে শক্ত করে আটকান পিঠের সঙ্গে।
পিঠে একটা মৃদু কম্পন আর কিছুটা উষ্ণতার স্পর্শ অনুভব করেন ইৎজ্লি, লক্ষ করেন তাঁর পিঠের দু-পাশ থেকে বেরিয়ে আসা আৎলাপাৎলিনের দুই-প্রান্ত ঘিরে ফুটে উঠেছে এক নীলাভ জ্যোতির বলয়।
শরীরটা আচমকাই হালকা মনে হয় ইৎজ্লির, খেয়াল করেন তাঁর পা দুটো ভেসে উঠেছে মাটি থেকে। বহুকালের অভ্যেসে গড়া শরীরটাকে খানিকটা ঝাঁকুনি দিতেই ছিটকে ওপর দিকে উঠে যান ইৎজ্লি। হয়তো-বা হুইৎজিলোপোৎশ্লির আশীর্বাদেই ভাসতে থাকেন শূন্যে।
পাহাড়ের মাথা থেকে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল কুয়াহ্ৎলিদের সোল্লাস চিৎকার।
জঙ্গলের আলো-আঁধারিতে ন্যুরবেসে তখন গুনদেমে ওমোসেদের হাতে তুলে দিচ্ছে এক অদ্ভুতদর্শন মাস্কেট। চেহারা সবটুকু মাস্কেটের মতো হলেও ফাঁপা নলের বদলে তাতে বসানো কোনও ধাতুর নিরেট দণ্ড।
‘এ কীরকম মাস্কেট মাতা?’
কৌতূহলবশত মাস্কেট ওপরের দিকে তুলে ট্রিগার টেপেন ওমোসেদে।
মাস্কেটের ওপরের লম্বা দণ্ড ঘিরে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওঠে বিদ্যুৎ, একটা তীব্র নীল আলোক-কিরণ তার সামনে থেকে ছিটকে গিয়ে আঘাত করে সামনের গাছে।
নিমেষে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে গাছে।
জঙ্গলের পল্লব আচ্ছাদনের বাধা কাটিয়ে আকাশে উঠে যায় ন্’ননমিতনদের হর্ষধ্বনি।
মরুভূমির বালিতে দাঁড়িয়ে থাকা একটা রথের দিকে নেরগল-শর্রানির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁর রব-উরাটে শার্রু-এমুরান্নি। ঘোড়া নেই, উপরন্তু রথের চাকাও অনুপস্থিত।
‘প্রভু আস্শার আমাদের রথ দিয়েছেন, কিন্তু এ রথ চলবে কী করে রব-কিসির?’
পরীক্ষা করতে রথে চড়েন নেরগল-শর্রানি, রথের সামনে বসানো একটা ছোট ধাতব হাতলে হাত রাখেন কৌতূহলে। একটা মৃদু গুঞ্জন ওঠে রথে, অল্প ঝাঁকুনি দিয়ে নীলাভ দ্যুতিতে ভর করে রথ ভেসে ওঠে মাটি থেকে।
বিস্ময়ে ছিটকে সরে যায় শার্রু-এমুরান্নি।
হাতলটা সামান্য সামনের দিকে ঠেলেন নেরগল-শর্রানি, গুঞ্জনের আওয়াজে সামনের দিকে এগিয়ে যায় রথ।
বিস্ময়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আশারেডু পল্টনের সিপাহিরা। কিন্তু সে কয়েক মুহূর্তের জন্যই।
তারপর আকাশ ভরিয়ে ফেলে তারা আস্শারের জয়ধ্বনিতে।
দ্রেঙ্গর্দের নিয়ে দ্বীপের পাশে নোঙর করা জাহাজটায় চড়ে খুঁটিয়ে দেখেন হ্রলগ্। তাঁর চির পরিচিত ল্যাংস্কিপ, কিন্তু আশ্চর্য, তাতে পাল মাস্তুল নেই, দাঁড়ও না।
‘হিলমির্, এটা দেখুন!’ সামনে থেকে ভেসে আসে আসে নিয়ালের কণ্ঠস্বর।
এগিয়ে যান হ্রলগ্। জাহাজের সামনে রোদের আলোয় ঝকঝক করে কাঠামোর ওপর সোজা করে বসানো একটা ধাতুর চাকা।
দু-হাতে চাকাটা ধরে তার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করেন হ্রলগ্। একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হয় জাহাজের অবয়বে, কয়েকবার থরথর করে কেঁপে ওঠে জাহাজের পাটাতন, নীল আলোর দ্যুতি ঢেকে ফেলে জাহাজেরর দু-পাশ। তারপর ধীর গতিতে সমুদ্রপৃষ্ঠ ছেড়ে জাহাজ ভেসে ওঠে বাতাসে।
বিস্মিত হ্রলগ্ সজোরে চেপে ধরেন চাকা। বিদ্যুৎ গতিতে জাহাজ এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
টাল সামলাতে না পেরে হ্রলগ্ হেলে যান একদিকে, তাঁর হাতের চাপে ঘুরে যায় চাকা। বেঁকে যায় জাহাজের মুখ, সমান গতিতে সমুদ্র ছেড়ে দ্বীপের দিকে ছুটে যায় জাহাজ। আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে নিয়াল্, জাহাজ বুঝি আছড়ে পড়ল দ্বীপে।
কিন্তু না, ধাক্কা খায় না জাহাজ, বাতাসে ভর করেই উঠে পড়ে দ্বীপে।
চাকা থেকে হাত তুলে নেন হ্রলগ্, নীল আলোকপ্রভার শক্তিতে দ্বীপের মাটির ওপরে ভাসতে থাকে জাহাজ।
আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে দ্রেঙ্গর্দের কণ্ঠে অদিন্নের জয়ধ্বনি।
গিরি, কান্তার, মরু, পারাবার এমনই জয়ধ্বনির কলরবে প্রথম দিনটা ভরিয়ে রাখেন তোরণপথে আসা প্রথম পথিকরা।
তাঁরা যে হুইৎজিলোপোৎশ্লি, কিম্বা কুতোমেনের পিতৃপুরুষ, কিম্বা আস্শার, কিম্বা অদিন্ন্-এর প্রিয়জন, তাঁর আশীর্বাদধন্য যোদ্ধা, এই আনন্দে তাঁদের হৃদয় তখন উদ্বেল।
‘প্রথম দেবতা হুইৎজিলোপোৎশ্লি। পূর্বপুরুষের বস্ত্র পরনে তাঁর গাথা আমি গাই। আমি উজ্জ্বল হই। আমি ভাস্বর হই।’
‘উল্লে লে, উল্লে লে, উল্লে লে। কুতোমেন নিরাপদ হোক।’
‘আস্শার আমাদের রথে গতি আনুন। আস্শার আমাদের অস্ত্রে সওয়ার হয়ে শত্রু নিধন করুন। প্রভু আস্শারের জয় হোক।’
‘অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা। অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা!! যুদ্ধ শেষে পান করব আমরা ভাল্হলের মদিরা।’
‘হুইৎজিলোপোৎশ্লি!’
‘কুতোমেন!’
‘আস্শার!’
‘অদিন্ন!’
রণধারা
লড়াইয়ের ময়দান চিনে নিতে দেরি হয় না বেশি।
বিশাল প্রান্তরের চার কোণ থেকে চার প্রতিপক্ষ লক্ষ করে পরস্পরকে। কেউ দেখে তেজ্কাৎলিপকার দানবদের। কেউ দেখে কুতোমেন আক্রমণ করতে আসা শত্রু সৈন্য। কেউ দেখে হানপির অনুচরদের। কেউ দেখে রাগ্নরকের ময়দান।
ফৌজে ফৌজে থেমে যায় জয়গান। নেমে আসে এক অস্থির নীরবতা। নীল আকাশের নিচে নির্জন প্রান্তর যেন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে আসন্ন মহাসংগ্রামের।
একটা দমকা হাওয়া আচমকাই ধুলোর ঝড় তুলে পাক খেয়ে উঠে যায় ওপরে।
বাঁধ ভাঙে রুদ্ধ আক্রোশের। উন্মাদ কলরবে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রণোন্মত্ত চার পক্ষ।
আৎলাপাৎলিনে ভর করে আকাশে লাফিয়ে ওঠে কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধারা। শক্তিপুঞ্জের ফলা বসানো মাকুয়াহুইৎল্ দু-হাতে মাথার ওপর তুলে আছড়ে পড়তে চায় শত্রু ওপর। পায়ের পেছনে পা রেখে কাঁধে মাস্কেট বসিয়ে নীল শক্তি-কিরণে শত্রুর মর্মস্থান খুঁজে নিত চায় ন্’ননমিতন নিশানাবাজেরা। শক্তি-ফলক রচিত তলোয়ার হাতে লড়াই খোঁজে তাদের সহচরীরা। শক্তি-আভায় ভর করে রণপ্রাঙ্গণে ভেসে আসে আশারেডু রথ। শক্তিপুঞ্জ রচিত নীলাভ ঢাল তুলে রথের যোদ্ধাদের অঙ্গ রক্ষা করে ঢালীরা। রথের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ায় সিপাহিরা, তাদের হাতের বল্লমের অগ্রভাগ চমকায় শক্তির নীলাভ দ্যুতিতে। ভেসে আসে দ্রেঙ্গর্দের ল্যাংস্কিপও। তার নিচে ছড়িয়ে থাকা শক্তির নীল দ্যুতির সঙ্গে পাল্লা দেয় ওপরে দাঁড়ানো দ্রেঙ্গর্দের হাতে ধরা কুঠারের নীল শক্তি ফলার আভা।
নিচের ন্’ননমিতন মাস্কেট থেকে ছুটে আসে নীল শক্তির তির্যক রেখা।
হাওয়ায় শরীরটাকে মুচড়ে তার পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন ইৎজ্লি। তাঁর বদলে রেখা স্পর্শ করে পেছনের এক অসতর্ক কুয়াহ্ৎলিকে। নিমেষে আগুনের শিখা গ্রাস করে তাকে, শরীরটা ডিগবাজি খেতে খেতে আছড়ে পড়ে মাটিতে।
মাকুয়াহুইৎল্ ধরা হাতটা ডানদিকে লম্বা করে বাড়িয়ে দেন ইৎজ্লি। মাথাটা নিচের দিকে করে পা দুটো তুলে দেন আকাশের দিকে। শরীরটাকে বিদ্যুৎবেগে নিচের দিকে নামিয়ে এনে, মাটি স্পর্শ করার ঠিক আগের মুহূর্তে উড়িয়ে নিয়ে যান ওপর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে থাকা হাতের মাকুয়াহুইৎল্ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ন্’ননমিতন নিশানাবাজের মাথা।
‘প্রথম দেবতা হুইৎজিলোপোৎশ্লি। পূর্বপুরুষের বস্ত্র পরনে তাঁর গাথা আমি গাই। আমি উজ্জ্বল হই। আমি ভাস্বর হই।’
দ্রেঙ্গর্ ল্যাংস্কিপের পাশাপাশি ছোটে শক্তি প্রভায় ভাসা আশারেডু রথ। জাহাজের ওপর থেকে শরীরের আধখানা ঝুঁকিয়ে নেরগল-শর্রানির মাথা লক্ষ করে কুঠার চালায় এক দ্রেঙ্গর্। তাকে আটকাতে হাতের ঢাল তুলে ধরে নেরগল-শর্রানির অঙ্গরক্ষক, শক্তিপুঞ্জ রচিত নীল ঢালে আছড়ে পড়ে কুঠারের নীল শক্তির ফলা, চড়চড় শব্দে বিদ্যুতের চোখ ঝলসানো রেখা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বর্শার নীল শক্তি ফলকে গেঁথে দ্রেঙ্গর্কে জাহাজে থেকে মাটিতে আছড়ে ফেলে আর এক অঙ্গরক্ষক।
‘আস্শার আমাদের রথে গতি আনুন। আস্শার আমাদের অস্ত্রে সওয়ার হয়ে শত্রু নিধন করুন। প্রভু আস্শারের জয় হোক।’
জাহাজের মাঝখানে তখন আকাশ থেকে লাফিয়ে নামা এক কুয়াহ্ৎলি-র মাকুয়াহুইৎলের আঘাতে লুটিয়ে পড়েছে আর এক দ্রেঙ্গর্। ছুটে আসেন হ্রলগ্, দুরন্ত গতিতে ঘুরতে থাকা মাকুয়াহুইৎলের তলায় নিচু হয়ে গলিয়ে দেন শরীরটা। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতের কুঠারের নীল শক্তি-ফলক আমূল বিঁধিয়ে যায় কুয়াহ্ৎলির বুকে, রক্ত ছিটিয়ে পাটাতনে আছড়ে পড়ে তার দেহ।
‘অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা। অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা!! যুদ্ধ শেষে পান করব আমরা ভাল্হলের মদিরা’
ময়দানের আর-এক দিকে শরীরটা সামান্য বেঁকিয়ে আশারেডু সিপাহির বল্লমটা এড়ান ওমোসেদে। পাঁজরের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া বল্লমের দণ্ডটা বাঁ হাতে চেপে ধরে অন্য হাতের শক্তি-তলোয়ারের ফলা চালিয়ে দেন তার গলায়। অস্ত্র খসে যায় সিপাহির হাত থেকে, মাটিতে আছড়ে পড়ে তার শরীর। হাতে থেকে যাওয়া বল্লমটা উলটো করে ঘুরিয়ে ধরেন ওমোসেদে, মাথার ওপর উঁচু করে তুলে তার নীল ফলা সজোরে গেঁথে দেন লুটিয়ে থাকা সিপাহির দেহে।
‘উল্লে লে, উল্লে লে, উল্লে লে। কুতোমেন নিরাপদ হোক।’
হুইৎজিলোপোৎশ্লি! কুতোমেন! আস্শার! অদিন্ন! কুতোমেন! হুইৎজিলোপোৎশ্লি! অদিন্ন! আস্শার! হুইৎজিলোপোৎশ্লি! কুতোমেন! অদিন্ন! আস্শার!
নীল আকাশের নীচে নীল শক্তি-অস্ত্র ঝলসে উঠে ঝরাতে থাকে লাল রক্ত। পড়তে থাকে দেহ, ভিজতে থাকে মাটি।
যাত্রী
সবুজ ঘাসে ছাওয়া ছোট টিলাটার মাথায় গাছটার ডালগুলো নুয়ে পড়েছে নানা রঙের ফুলের ভারে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে উড়ে বেড়ায় রংবেরঙের প্রজাপতি। পাতার আড়াল থেকে সুরেলা কণ্ঠে ডেকে চলে কয়েকটা পাখি। হালকা বাতাস মাঝে মধ্যে ফুলের গন্ধ তুলে এনে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে।
গাছের ঝুঁকে পড়া ডালের ছাওয়ায় ঘাসের গালিচার ওপর প্রথম পান্থের নিব্বাণ সমাধি। চৌকো করে কাটা কয়েকটা নিরাবরণ পাথরের টুকরো জুড়ে গড়া সে সমাধির ওপর গাছে থেকে ঝরে পড়া ফুল বিছিয়ে দিয়েছে এক রঙিন চাদর।
সমাধির একপাশে নিশান হাতে দাঁড়িয়ে থাকে গগ্গ। সমাধি ঘিরে নতমস্তকে গান করে বাকি পান্থরা।
পান্থের পা দুটি যেন পুষ্প, ফল তার বিকশিত হৃদয়।
পথের শ্রান্তি মুছে দেয় তার অতীতের সমস্ত কলুষ।
হে পান্থ, তুমি চলতে থাকো, পথ চলতে থাকো।
বিশ্রামে পান্থের ভাগ্য থাকে নিশ্চল, উত্থানে হয় উদিত।
শয়নে পান্থের ভাগ্য থাকে নিদ্রায়, ভ্রমণে চলে সঙ্গে।
হে পান্থ, তুমি চলতে থাকো, পথ চলতে থাকো।
চলার পথে পান্থ খুঁজে পাও মধু, খুঁজে পাও তুমি সুমিষ্ট ফল।
সূর্যের সৌন্দর্য দেখ হে পান্থ, বিনা ক্লান্তিতে সে চলেই চলে পথ।
হে পান্থ, তুমি চলতে থাকো, পথ চলতে থাকো।
অল্লকপ্পর হাতে নিশান তুলে দেয় গগ্গ। নিশানটা সমাধির ধারে বসিয়ে দেন অল্লকপ্প।
দূরে দিগন্তের গায়ে ছায়ার মতো দেখা যায় তোরণ নগরীর উঁচু মিনার, বুরুজ আর জল খিলেনের অস্ফুট চেহারা। সেদিকে একবার দৃষ্টিপাত করে চক্ষ
এগিয়ে আসেন অল্লকপ্পর কাছে, ‘আমাদের যাত্রা তাহলে শেষ থের অল্লকপ্প?’
ঘাড় নাড়েন অল্লকপ্প, ‘হ্যাঁ। প্রায় শেষ, ঐতিহাসিক চক্ষ। নিব্বাণ সমাধিতে আমাদের প্রার্থনাটুকু সম্পূর্ণ করে আমরা কেতন নিয়ে ফিরে যাব তোরণ নগরীতে। নগর মাতবে কেতন উৎসবে।
‘সংঘাতের ইতিহাসের পরিক্রমার পর সভ্যতার উৎসব। ঠিক কি না থের অল্লকপ্প?’ ব্যঙ্গের হালকা ছোঁয়া চক্ষের কণ্ঠস্বরে।
ব্যঙ্গটুকু গায়ে মাখেন না অল্লকপ্প। হয়তো-বা যাত্রার এই অন্তিম পর্বের সাধনগম্ভীর সময়কে কোনও কারণেই তিক্ত করে ফেলতে চান না তিনি।
‘তা বলতে পারেন চক্ষ। আশা করি আমাদের সঙ্গে এই পরিক্রমায় যোগ দিয়ে আপনার ঐতিহাসিক অনুসন্ধান সফল হয়েছে।’
সম্মতিতে মাথা ঝোঁকান চক্ষ।
‘অবশ্যই থের অল্লকপ্প, অবশ্যই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমার অভব্যতা মার্জনা করবেন। আপনাদের সহযাত্রী হয়ে যে গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষা আমার অর্জন হল, তার জন্য ইতিহাস সমবায়ের পক্ষ থেকে আপনাকে আমার অনেক আগেই কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত ছিল।’
মাথা ঝোঁকান অল্লকপ্পও, ‘সঙ্গী হয়ে দীর্ঘ পথশ্রম আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ ঐতিহাসিক চক্ষ। আশা করি আমাদের এই ইতিহাস ঐতিহাসিক সমবায়ের জ্ঞানকোষাগারে তার যথাযথ জায়গা পাবে।’
বুকে হাত রাখেন চক্ষ, ‘নিশ্চয়ই থের অল্লকপ্প, নিশ্চয়ই পাবে। তবে সংঘাতের ইতিহাসটুকু জানা হয়েছে, এবার এই সংঘাত থেকে সভ্যতায় উত্তরণের কথা আপনার থেকে শোনার অপেক্ষায় রইলাম।’
দিগন্তের বুকে ফুটে থাকা তোরণ নগরীর আবছা চেহারাটার দিকে একবার তাকান অল্লকপ্প।
‘চিরাচরিত বিশ্বাস যখন আকাঙ্খিত ফল নিয়ে আসে না, তখন তার গাঁথনি হয়ে আসে আলগা। আনুগত্যও আর প্রশ্নহীন থাকে না। দ্বিধা যখন তার ডালপালা বিস্তার করে জায়গা করে নিয়েছে বহু মনে, প্রথম পান্থ তখন দেখালেন অন্য পথের দিশা।’
গিরি
একটা চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলক, তারপর তোরণ পেরিয়ে মাটিতে পা রাখে কুয়াহ্ৎলি যোদ্ধাদের নতুন পল্টন। দুর্বল কণ্ঠে তোলা হুইৎজিলোপোৎশ্লির জয়ধ্বনিটুকু মিলিয়ে যায় অচিরেই।
নবাগত যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে তাকান ইৎজ্লি। বেশিরভাগই কৈশোর পেরোয়নি, ভীত সন্ত্রস্ত চাহনি, ইতস্তত পদক্ষেপ আর হাতিয়ার বইবার ভঙ্গীমায় তালিমের অভাব সুস্পষ্ট।
বিরক্তিতে নজর সরিয়ে নেন ইৎজ্লি। এরা কুয়াহ্ৎলি! কোথায় গেল তাঁর যৌবনের সেই নির্ভীক যোদ্ধারা, আর তাদের সদর্প দেহভঙ্গী? এরা এসেছে হুইৎজিলোপোৎশ্লির হয়ে লড়তে? এরা?
হুইৎজিলোপোৎশ্লি!
নামটা মাথায় আসতেই ইৎজ্লির ভেতরে মাথা তুলতে থাকা রাগের ফণাটা নিমেষের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে আসে।
হুইৎজিলোপোৎশ্লি! কোন হুইৎজিলোপোৎশ্লি? এই অচেনা জগতের আকাশে প্রতিদিন যাঁর উদয় অস্ত হয়—তিনি, না ফেলে আসা ফলিকের পাহাড় চুড়োয় যাঁকে ইৎজ্লি প্রতিদিন যাঁকে দেখতেন—তিনি?
ফলিক! কবে এসেছিলেন তিনি ফলিক থেকে? নিজের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে দেখেন ইৎজ্লি। দিন-মাস-বছরের হিসেব তাঁর জানা নেই, কিন্তু হাতের বলিরেখাগুলো সাক্ষী দেয় সময় অনেক কেটে গেছে।
সামনের বন্দী আঙিনা থেকে ভেসে আসে অট্টহাসি আর ক্রুদ্ধ ধমকের আওয়াজ। পাথরের চত্বরে হেসে গড়িয়ে পড়ে পায়ে শেকল পড়া এক বন্দী, তাকে তর্জনী তুলে শাসায় এক কুয়াহ্ৎলি। অতি পরিচিত দৃশ্য। এর আগেও বহুবার দেখেছেন।
‘হুইৎজিলোপোৎশ্লি! হাঃ হাঃ!!’
কুয়াহ্ৎলির সপাট চড়ে লুটিয়ে পড়ে বন্দী, কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রক্ত,
তবুও হাসি থামে না তার। একসময়ে দুর্বোধ্য লাগলেও, বন্দীর হাসির ফাঁকে বলা কথাগুলো ইদানীং আর বুঝতে অসুবিধে হয় না ইৎজ্লির।
‘হুইৎজিলোপোৎশ্লি! হাঃ হাঃ! হুইৎজিলোপোৎশ্লি বলে কিছু নেই রে বুদ্ধু। হুইৎজিলোপোৎশ্লিও নেই, কুতোমেনও নেই। আমরা যেমন বেওকুফ হয়েছি, তোরাও তেমনি বেওকুফ হয়েছিস! হাঃ হাঃ!’
চোখ সরিয়ে নেন ইৎজ্লি, কিন্তু মনের কোথাও একটা বিঁধে থাকা সংশয়ের কাঁটাটাকে সরাতে পারেন না।
‘সুয়াচ্চিক!’
হুইৎজিলিন্ কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
নিজের অজান্তেই মাথার চুলে হাত রাখেন ইৎজ্লি। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে ম্লান হাসি, ‘সুয়াচ্চিক সম্বোধন আমাকে আর মানায় না হুইৎজিলিন্। মুণ্ডন করা বহু বছর হলে বন্ধ করে দিয়েছি।’
অপ্রস্তুত দেখায় হুইৎজিলিন্কে, ‘তবুও, আপনি আমাদের সুয়াচ্চিকই থাকবেন।’
একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলেন ইৎজ্লি, ‘যেতে দাও। বলো কী বলছিলে।’
‘সুয়াচ্চিক, আপনাকে জানিয়েছিলাম যে কুয়াহ্ৎলিদের মধ্যে কয়েকজন মাঝে মধ্যে দু-তিনদিনের জন্য উধাও হয়ে যায়।’
‘হ্যাঁ, বলেছিলে।’
‘আমি এদের পিছু নিয়েছিলাম সুয়াচ্চিক। এখান থেকে অনেক দূরে, একটা টিলার ওপরে একজন নানান কথা বলে। এরা সেখানে তার কথা শোনে, তারপর ফিরে আসে?’
‘একজন! কে একজন? কুয়াহ্ৎলি?’
মাথা নাড়ে হুইৎজিলিন্, ‘না সুয়াচ্চিক, কুয়াহ্ৎলি না। সবাই তাকে পান্থ বলে ডাকে।’
‘পান্থ! কীসের কথা বলে সেই পান্থ হুইৎজিলিন্? যুদ্ধের?’
‘না সুয়াচ্চিক! যুদ্ধের নয়। পথের কথা বলে।’
‘পথ! কোথাকার পথ?’
‘জীবনের পথ, সুয়াচ্চিক।’
অবাক চোখে তাকান ইৎজ্লি।
‘জীবনের পথ! তোমার কথার মানে কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না হুইৎজিলিন্।’
ফের অপ্রস্তুত দেখায় হুইৎজিলিন্কে, ‘সুয়াচ্চিক, আপনি যদি একবার সেখানে গিয়ে নিজের চোখে দেখেন তাহলে—!’
‘নিজের চোখে দেখব? কেন হুইৎজিলিন্? তুমি যা দেখেছে, শুনেছ, তা কি যথেষ্ট নয়? এই সব প্রলাপ শুনতে আমাকে যেতে হবে কেন?’
‘না সুয়াচ্চিক, যথেষ্ট নয়। পান্থকে শুনতে না চাইলেও আপনার একবার স্বচক্ষে দেখা দরকার। পান্থকে শুনতে কেবল আমাদের কুয়াহ্ৎলিরাই যায় না। তার দামামার ডাকে সাড়া দিয়ে আসে অন্যরাও।’
‘অন্যরা! কারা হুইৎজিলিন্?’
‘তেজ্কাৎলিপকার অনুচরেরা। যাদের সঙ্গে আমরা লড়াই করে চলেছি প্রতিনিয়ত।’
নির্বাক বিস্ময়ে হুইৎজিলিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন ইৎজ্লি।
কান্তার
তোরণ ঘিরে দ্যুতির বলয় ঝলসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় একটা অব্যক্ত ক্রুদ্ধ গর্জন।
মনের সবটুকে শক্তি দিয়ে দৃষ্টিকে তোরণের ওপরেই জোর করে আটকে রাখলেও, সে আওয়াজ গলানো সীসার মতনই এসে পড়তে থাকে ওমোসেদের কানে।
কারণ ও আওয়াজ ন্যুরবেসের।
লড়াইয়ে দুটো হাতই হারানোর পর থেকেই তোরণ আলো ছড়িয়ে সক্রিয় হয়ে উঠলে ওই রকমই চিৎকার করে ন্যুরবেসে। দু-একবার তোরণের মধ্যে দিয়ে পার হবার চেষ্টা করে চোট পেয়েছিল বলে আজকাল তোরণ চালু হলে তাকে বেঁধে রাখতে হয়।
তোরণের যাত্রাপথ একমুখী। আসা যায়, ফেরত যাওয়া যায় না। এই দিক থেকে তোরণপথে পা রাখলে তোরণের শক্তি শরীরকে ছিটকে ফেলে দেয়।
বিহ্বল পায়ে তোরণ পেরোয় নতুন যোদ্ধার দল। চিৎকারের শব্দ বৃদ্ধি পায় আরও কয়েক মাত্রা।
কুতোমেনের মাশুলদের পথ পার করিয়ে দিয়ে নিবে যায় তোরণের আলো। ন্যুরবেসসের চিৎকার পালটে যায় কাতর কান্নায়।
মনের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে আটকে রাখেন ওমোসেদে। তাঁর এককালের ছায়াসঙ্গী, অঙ্গরক্ষক, দুর্মদ যোদ্ধা ন্যুরবেসে আজ কেবল এক পঙ্গু, ভগ্নদেহ প্রৌঢ়া। কিন্তু তিনি ন্’ননমিতনদের গুন্দেমে, চোখে জল আনার বিলাসিতা তাঁকে মানায় না।
‘মাতা!’
প্রায় ছুটতে ছুটতেই এসে দাঁড়ায় ইজেগ্বে। তার পেছনে একটা শোরগোল ওঠে, ন্’ননমিতনরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে কয়েকজনকে, সঙ্গে হাঁটে কৌতূহলী ভিড়।
‘মাতা, আমাদের একজনকে শত্রুর হয় চরবৃত্তির করার সময়ে আমরা হাতেনাতে ধরেছি।’
চোখ তুলে ভিড়ের দিকে ইশারা করে ইজগ্বে। ভিড়ের মধ্যে থেকে এক ন্’ননমিতনকে টেনে এনে ওমোসেদের পায়ের কাছে নতজানু করে বসিয়ে দেয় অন্য ন্’ননমিতনরা।
বিস্মিত কণ্ঠে ওমোসেদে বলেন, ‘ইনোমাই।’
তোরণপথে এই দুনিয়ায় ওমোসদের সঙ্গেই পা রেখেছিল ইনোমাই। ওমোসদে তাকে চেনেন বহুকাল থেকে।
‘ইনোমাই, তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ? তুমি? কেন?’
ন্’ননমিতনদের প্রহারে ইনোমাইয়ের একটা চোখ ফুলে গেছে, মাথার চুল ভিজে গেছে রক্তে, তবু দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দেয় ওমোসেদের চোখে চোখ রেখেই, ‘কোনওরকম বিশ্বাসঘাতকতা আমি করিনি মাতা। আমি আজও সম্পূর্ণ অনুরক্ত!’
‘মিথ্যে কথা বলছে মাতা!’
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বাধা দেয় ইজেগ্বে। ভিড়ের মধ্যে থেকে ন্’ননমিতনরা আর একজনকে টেনে এনে বসিয়ে দেয় ওমোসেদের সামনে।
‘মরু দানব!’ ফের বিস্ময় ঝরে পড়ে ওমোসদের কণ্ঠে।
সায় দেয় ইজেগ্বে, ‘হ্যাঁ মাতা। জঙ্গলের সীমানা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকেই এদের দু-জনকে একসঙ্গে ধরেছি।’
কঠিন চোখে ওমোসেদে তাকান ইনোমাইয়ের দিকে, ‘তুমি আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছ ইনোমাই? কেন?’
‘বিশ্বাস করুন মাতা, আমি আপনার বিরুদ্ধে কিছু করার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমরা দু-জনে একসঙ্গে পান্থের সভা থেকে ফিরছিলাম কেবল। পথে ইজেগ্বের সিপাহির আমাদের আটকাল।’
‘পান্থ? কে পান্থ? তার কীসের সভা?’ বিস্মিত প্রশ্ন ওমোসেদের।
খানিক ইতস্তত করে ইনোমাই, ‘পান্থ কে জানি না মাতা। তাঁকে আমরা পান্থ বলেই জানি। টিলার মাথায় তাঁর দামামা বাজলে তার শব্দে আমরা ছুটে যাই। তারপর পান্থ আমাদের পথের কথা শোনান।’
‘পথ! কী পথ?’
‘এই জীবনের পথ।’
‘জীবনের পথ!’ ফের বিস্ময়ের ছোঁয়া লাগে ওমোসেদের কণ্ঠে।
‘হ্যাঁ। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আমরা যে পথে ধরে চলতে থাকি।’
আরও একবার বিস্মিত হবার পালা ওমোসেদের। ইনোমাই, নয় উত্তর এসেছে মরু দানবের কাছ থেকে। অশুদ্ধ ভাষা, অস্পষ্ট উচ্চারণ, তবু তার কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
‘তুমি আমদের ভাষা জানো?’
ঘাড় নাড়ে বন্দী, ‘পান্থর কাছে যারা আসে আমি তাদের সবার ভাষাই অল্পস্বল্প জানি।’
‘সবার মানে? আর কাদের ভাষা জানো তুমি?’
‘আপনাদের, যারা আকাশ পথে উড়ে আসে, যারা সমুদ্রের ধারে থাকে, সবাইকার।’
একটা ক্রুদ্ধ গর্জন করে, ইনোমাইয়ের গলায় শক্তি কৃপাণের ফলা চেপে ধরে ইজেগ্বে।
‘মনগড়া গল্প বানিয়ে আপনার চোখে ধুলো দিতে চাইছে মাতা। অনুমতি দিন, এই বিশ্বাসঘাতকের মাথাটা দেহ থেকে আলাদা করে দিই।’
হাত তুলে বাধা দেন ওমোসেদে, ‘দাঁড়াও ইজেগ্বে। সত্যি কি আছে পান্থ নামে কেউ, শত্রুতা ভুলে যার কথা সবাই একসঙ্গে শুনতে যায়? নাকি প্রাণ বাঁচাতে এরা গল্প ফাঁদছে? একবার নিজে সত্যিটা যাচাই করে দেখতে চাই। এদের বিচার তারপর হবে।’
মরু
‘রব-কিসির! সবাই আপনার অপেক্ষা করছে!’
রব-উরাটে শার্রু-এমুরান্নির ডাকে তাঁবুর ছায়ার আশ্রয় ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ান নেরগল-শর্রানি।
সূর্যের জ্বলন্ত উত্তাপের নিচে সার দিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পল্টনের সিপাহিরা, অন্য দিকে অপেক্ষা করে নেরগল-শর্রানির রব-উরাটেরা।
সারিবদ্ধ সৈন্যদের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলেন নেরগল-শর্রানি। যারা তাঁর সঙ্গে তোরণ পার হয়েছিল সেই সব সিপাহিদের মুখে ছাপ প্রৌঢ়ত্বের। যারা সবে এসেছে তাদের মুখে ছায়া কৈশোরের। মাসিবিনা বিজয়ী আশারেডু পল্টনের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র হয়ে মরুর বালুতে অপেক্ষা করে প্রভু আস্শারের কৃপাধন্য ফৌজ। তাদের সঙ্গ দেয় নিথর, নিস্তেজ তোরণ।
অন্যমনস্ক নেরগল-শর্রানির কানে আসে শার্রু-এমুরান্নির উচ্চকণ্ঠের হুকুম। পিছমোড়া করে বাঁধা দুই বন্দীকে হাঁটিয়ে নিয়ে এসে রব-উরাটেদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় সিপাহিরা।
একজন শত্রু সৈন্য। আস্শার বৈরি হান্পির সামুদ্রিক অনুচর। অন্যজন পল্টনের সিপাহি। নেরগল-শর্রানির অতি পরিচিত, অন্য কোনও এক দুনিয়ায় তাঁর রথচালক, এস্রাহাড্ডেন্।
কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন ফের মাসিবিনার লড়াইতে ফেরত চলে যান নেরগল-শর্রানি। দুরন্ত গতিতে ছোটে তাঁর রথ, সামনে এস্রাহাড্ডেন সবল মুঠিতে ধরে থাকে চার ঘোড়ার রাশ, দু-পাশে বাতাস ভরিয়ে ফেলে যুদ্ধের উন্মত্ত কোলাহল।
বিদ্রোহী মাসিবিনার বিরুদ্ধে লড়াই করা এস্রাহাড্ডেন আজ নিজেই অভিযুক্ত বিদ্রোহের দায়।
আর তাঁর দায় তাঁর একদা বিশ্বস্ত অনুচরের বিচার করা।
প্রভু আস্শারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু।
ফের অন্যমনস্ক নেরগল-শর্রানির কানে আসে শার্রু-এমুরান্নির কণ্ঠস্বর।
‘এস্রাহাড্ডেন, তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুমি রব-উরাটের নির্দেশ অমান্য করেছ, বন্দী শত্রু সৈন্যকে হত্যা করতে অস্বীকার করেছে। এবং এখানেই থামোনি, বাকি সিপাহিদেরও তোমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পরামর্শ দিয়েছে। তোমার কিছু বলার আছে?’
‘না। যা বললেন সব সত্যি।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর এস্রাহাড্ডেনের!
‘তুমি অপরাধ স্বীকার করছ?’ বিস্মিত প্রশ্ন নেরগল-শর্রানির।
‘যা করেছি তা স্বীকার করেছি। কিন্তু কোনও অপরাধ করিনি।’
‘অপরাধ করোনি? তুমি প্রভু আস্শারের কাজের বিরুদ্ধাচরণ করেছ, সেটা অপরাধ নয়?’
‘কোথায় প্রভু আস্শার? আমরা জানি আমরা এসেছি বুউরুমুতে, হান্পির অনুচরদের বিরুদ্ধে লড়তে। আর এই বন্দী জানে সে এসেছে অদিন্নের হয়ে ভাল্হলের সন্ধানে!’
‘তুমি এসব জানলে কোথায় এস্রাহাড্ডেন?’ বিস্ময়ের মাত্রা আরও কয়েক পর্দা চড়ে নেরগল-শর্রানির কণ্ঠে।
‘পান্থের সভায়!’
‘পান্থ! কে পান্থ?’
‘টিলার মাথায় যাঁর দামামা বাজে। যিনি পথের কথা বলেন।’
‘পথ? কীসের পথ?’
‘যে পথে চলতে চলতে আমাদের সঙ্গী হয় সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সেই পথ।’
সারিবদ্ধ সিপাহিদের মধ্যে কয়েকজনের চোখেমুখে অস্বস্তির ছাপ নজর এড়ায় না নেরগল-শর্রানির অভিজ্ঞ চোখের। কণ্ঠস্বর শীতল হয়ে আসে তাঁর, ‘এই পান্থের সভায় কি তুমি একাই যাও?’
‘না রব-কিসির, আমরা অনেকেই যাই। এই বন্দীও যেত। আপনিও আসতে পারেন।’
হুঙ্কার দিয়ে তাঁবুর গায়ে হেলান দেওয়া একটা বর্শা তুলে নেয় শার্রু-
এমুরান্নি। লম্বা পায়ে এস্রাহাড্ডেনের কাছে পৌঁছে তার গলায় চেপে ধরে অস্ত্রের নীলাভ শক্তি ফলক।
‘রব-কিসিরের সঙ্গে সম্মান দিয়ে কথা বল্ হারামজাদা।’
এস্রাহাড্ডেনের দিকে তাকান নেরগল-শর্রানি, ‘তুমি জানো, তোমার কাজের শাস্তি মৃত্যু?’
উত্তর দেয় না এস্রাহাড্ডেন, নেরগল-শর্রানির চোখে চোখ দাঁড়িয়ে থাকে নীরবে।
পাশ থেকে অস্পষ্ট উচ্চারণে হঠাৎ কথা বলে ওঠে বন্দী, ‘আমাকে হত্যা করলে যদি এস্রাহাড্ডেনের শাস্তি মকুব হয়, তাহলে তাই করুন।’
ক্রুদ্ধ গর্জন করে বর্শার উলটোদিক দিয়ে বন্দীর পেটে সজোরে আঘাত করে শার্রু-এমুরান্নি। একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে বন্দী ঝুঁকে পড়ে সামনে।
‘বিদ্রোহের উস্কানি আর শত্রুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র! হুকুম দিন রব-কিসির, জীবন্ত অবস্থায় এদের ছাল ছাড়িয়ে নিই।’
সার-বাঁধা সিপাহিদের সামনে দিয়ে একটা দমকা বাতাস হঠাৎ ছুটে যায় ধুলো উড়িয়ে। সেদিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকেন নেরগল-শর্রানি।
‘রব-কিসির!’
শার্রু-এমুরান্নির দিকে তাকান নেরগল-শর্রানি, ‘দিনকয়েক অপেক্ষা কর রব-উরাটে। আস্শারের সিপাহির প্রাণ বাঁচাতে, হান্পির অনুচর স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতে চাইছে যার শিক্ষায়, সেই পান্থের রহস্য আমাকে আগে বুঝে নিতে দাও।’
পারাবার
রোদের আলোয় ইস্পাতের মতো ঝকঝক করে নীল আকাশ। রোদের আলোয় হীরের কুঁচির মতো ঝকঝক করে সমুদ্রের ঢেউ।
উজ্জ্বল আকাশ আর উজ্জ্বল সমুদ্রের মাঝে মাথা তুলে থাকা দ্বীপের বুকের তোরণটা ঘিরে ধরেই ফের নিবে যায় এক উজ্জ্বল প্রভা। নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের ওপর দিয়ে বয়ে আসা অলস বাতাস জলজ উদ্ভিদের আঁশটে গন্ধের সঙ্গে বয়ে আনে ক্লান্ত স্বরে বলা কয়েকটা ‘অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা’ধ্বনি। দ্বীপ ছেড়ে এগিয়ে আসে দু-একটা নৌকা।
সমুদ্রতীরে বসে ডান হাতের আড়ালে রোদটাকে ঢেকে নৌকোর সওয়ারীদের দেখার চেষ্টা করেন হ্রলগ্। অন্য হাতটা তাঁর মুঠো করে খামচাতে থাকে সমুদ্রপাড়ের বালি। বাঁ পায়ের চুলকানিটা অসহ্য হয়ে উঠলেই কোনও কিছু একটা মুঠোতে আঁকড়ে ধরে রাখা হ্রলগের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে।
অস্তিত্বহীন পায়ের নিরাময় করা সম্ভব যখন নয়, তখন হাতটাকে কোনওভাবে ব্যস্ত রাখাটাই বাঞ্ছনীয়। মনটা তাতে অন্যদিকে থাকে। অথবা সেই কথাই হয়তো হ্রলগ্ বুঝিয়ে থাকেন নিজেকে।
কয়েক বছর হয়ে গেল শক্তি অস্ত্রের আঘাতে পা হারিয়েছেন হ্রলগ্। হাঁটুর নিচ থেকে সে পায়ের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মাঝে মধ্যেই সেই অস্তিত্বহীন পায়ে অসহ্য জ্বালার মধ্যে দিয়ে তাঁর মস্তিস্ক জানান দেয় যে, তাঁর শরীর সত্যটা মেনে নিতে পারেনি এখনও।
একটু দূরে বালির ওপর পড়ে থাকা তাঁর কাঠের পায়ের দিকে নজর দেয় হ্রলগ্। এখন তাঁর পথ চলার এটাই অবলম্বন। তিনি আর ক্ষিপ্রগতি দ্রেঙ্গর্ নন। একজন বিকলাঙ্গ অতীত যোদ্ধা মাত্র।
বহু-বহুকাল আগের এক বৃষ্টিভেজা দিনের কথা মনে পড়ে যায় হ্রলগের। দ্রেঙ্গর্দের পেছনে নিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে জলে ভেজা পাথরের সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছেন তিনি।
অতীত? নাকি কি স্বপ্ন? নাকি দুটোই?
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন হ্রলগ্। পেছনে ফেলে আসা অন্য এক জীবন, অন্য আর এক দুনিয়া।
‘হিলমির্!’
কখন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ইভার্র্।
‘হিলমির্, নতুন যারা এসেছে তাদের কী ব্যবস্থা?’
দ্বীপ থেকে আসা নৌকগুলো এসেছে তীরে। নৌকো থেকে নেমে জল ঠেলে এগিয়ে আসে একদল মানুষ। আকাশ আর সমুদ্রের উজ্জ্বল পটভূমিতে তাদের চেহারাগুলো দেখায় ছায়ামূর্তির মতো, আলাদা করে কাউকে চেনার উপায় নেই।
একসময়ে নবাগতদের নিজেই আপ্যায়ন করতেন হ্রলগ্, জানাতেন অদিন্নের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ। সে উৎসাহে তাঁর ভাটা পড়ে গেছে বহুদিন।
ক্লান্ত ভঙ্গীতে বাতাসে হাত নাড়েন হ্রলগ্, ‘যা প্রত্যেকবার হয়। নতুন তো কিছু করার নেই।’
এদের প্রত্যেকের ভবিতব্য একই। যুদ্ধের যাঁতাকলে পেষাই হওয়া।
‘হিলমির্—!’ কিছু বলতে চেয়েও ইতস্তত করে ইভার্র্।
‘বলো!’
‘হিলমির্, এই নিরন্তর অর্থহীন লড়াইয়ের বদলে, সোজাসুজি অদিন্নের ভাল্হল্ খুঁজে বের করলে হয় না?’
‘আমি কি চেষ্টা করিনি ভাবছ? বারে বারে এদিক-ওদিক লোক পাঠিয়েছি। কেউ ফিরে আসেনি। বছর কয়েক আগে ভালহলের খোঁজে নিয়ল্ নিজে বেরিয়ে পড়ে, ফেরত আসেনি সেও। আর কীভাবে—’
‘হিলমির্!’
ছেদ পড়ে হ্রলগের কথায়। হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসেছে এক নবীন দ্রেঙ্গর্।
‘হিলমির্, হারিয়ে যাওয়া এক দ্রেঙ্গর্ ফেরত এসেছে। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
‘কে?’
‘নাম বলছে নিয়ল্!’
সমস্ত অবসাদ এক নিমেষে কেটে যায় হ্রলগের। খুলে রাখা কাঠের পা টেনে নিয়ে পরতে থাকেন ব্যস্ত হাতে, ‘নিয়ে এসো। এক্ষুনি!’
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিস্মিত দ্রেঙ্গরের পেছনে এসে উপস্থিত হয় নিয়ল্।
নিয়লের হাতটা জড়িয়ে হ্রলগ্, ‘তোমার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম নিয়ল্। বলো, পেলে ভাল্হলের খোঁজ?’
ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়ে নিয়ল্, ‘না হিলমির্। চতুর্দিকে খুঁজেছি, কিন্তু ভাল্হলের কোনও সন্ধান পাইনি। আমার শেষ আশা ছিল কোথাও না পেলে অন্তত ওই উঁচু পাহাড় চূড়ায় ঠিক দেখা পাব ভাল্হলের। বহু পরিশ্রমে ওই অলঙ্ঘ্য পাহাড়ের মাথায় উঠলাম বটে, কিন্তু সেখানেও ভাল্হল নেই।’
‘ওই পাহাড়ের মাথাতেও না?’ হতাশার ছোঁয়া হ্রলগের কণ্ঠস্বরে।
মাথা নাড়ে নিয়ল্, ‘না, হিলমির্ ওই পাহাড়চূড়াতেও ভাল্হল্ নেই। ভালকিরিয়ার মতো যারা আকাশে থেকে যুদ্ধ করে, ওই পাহাড়ে তাদের বাস। পাহাড়ে ওঠার পর আমি বন্দী হলাম তাদের হাতে।’
‘ভানির দানব! ফেন্রিরের অনুচর!’
ফের মাথা নাড়ে নিয়ল্, ‘না হিলমির্। ওই পাহাড়ের বাসিন্দারা ফেন্রির কিংবা সর্তরের নাম শোনেনি। ওরা বলে ওরা লড়াই করছে হুইৎজিলোপোৎশ্লির হয়ে।’
‘হুইৎজিলোপোৎশ্লি! সে কে?’ বিস্মিত প্রশ্ন হ্রলগের।
‘ওদের দেবতা হিলমির্। ওরা আমাদের বলে দানব। বলে আমরা হুইৎজিলোপোৎশ্লির শত্রু তেজ্কাৎলিপকার অনুচর।’
হ্রলগের মনে হয় তাঁর চেনা দুনিয়াটা কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে! যেদিন লড়াইয়ে তাঁর পা খোয়া যায় সেদিনও বুঝি তাঁর মনের মধ্যে এমন সংশয়ের ঝড় ওঠেনি। কণ্ঠস্বরের কাঁপুনিটুকু যথাসম্ভব দমিয়ে রেখে ফের প্রশ্ন করেন তিনি।
‘পালালে কী করে?’
‘পালাইনি হিলমির্। ওদেরই একজন যোদ্ধা আমার বাঁধন খুলে অর্ধেক রাস্তা সঙ্গে করে পৌঁছে দিয়ে গেল।’
‘তোমার ছেড়ে দিল, আবার পৌঁছেও দিল?’ হ্রলগের বিস্ময়ের হওয়ার পালা যেন শেষ হতে চায় না।
‘হ্যাঁ, হিলমির্। সে যোদ্ধা পান্থের অনুগামী হয়েছে। সে আর যুদ্ধ করতে চায় না।’
‘পান্থ! কে এই পান্থ?’
‘পান্থ কে, তা কেউ জানে না হিলমির্! টিলার মাথায় তাঁরা দামামার আওয়াজে জড়ো হয় অনেকেই। পান্থ তাদের পথের কথা শোনান।’
‘কী পথ? কীসের পথ?’
‘যে পথ দিয়ে আমরা চলতে থাকি জীবনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, সেই পথ।’
ভ্রূ কোঁচকান হ্রলগ্, ‘তুমি কী বলছ, আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না নিয়াল্। তা ছাড়া তুমি এত কিছু জানলেই বা কী করে?’
স্বল্প অস্বস্তির ভাব ফুটে ওঠে নিয়ালের চোখেমুখে, ‘আমি আসার পথে সেই পান্থের সভায় গিয়েছিল হিলমির্—’ ফের কিছুটা ইতস্তত করে নিয়াল্, ‘আর হিলমির্। আপনারও বোধহয় একবার এই পান্থর কথা শোনা দরকার।’
পান্থ
টিলার ওপরের মশালের লাল স্তিমিত আলোয় দেখা যায় সামান্যই। শুধু বোঝা যায় টিলার চারপাশের জমায়েত ভিড় টিলার দিকে মুখ তুলে অপেক্ষা করে আছে অধীর আগ্রহে। টিলার ওপরে বাজতে থাকা দামামার আওয়াজ ছড়িয়ে যায় অন্ধকার প্রান্তরের এক দিক থেকে অন্য দিকে।
ভিড়ের মধ্যে মিশে অন্যদের সঙ্গে পান্থের প্রতীক্ষা করতে থাকেন ইৎজ্লিও।
থেমে যায় দামামার আওয়াজ। টিলার ওপরে উঠে দাঁড়ায় শ্বেতবস্ত্র পরনে কেউ একজন।
ভিড়ের মধে শুরু হয় মৃদু গুঞ্জন।
‘পান্থ! পান্থ!’
মাথার ওপর দু-হাত তোলেন টিলার ওপরে দাঁড়ানো পান্থ। থেমে যায় গুঞ্জন। অনুচ্চ স্বরে কিছু বলেন পান্থ, তবে তার কিছুই বুঝতে পারেন না ইৎজ্লি।
পান্থর পাশে উঠে দাঁড়ায় অন্য কেউ। তার শরীরের ভঙ্গী থেকে সে যে একজন কুয়াহ্ৎলি, সে কথা ইৎজ্লির বুঝতে অসুবিধে হয় না।
উচ্চকণ্ঠে ইৎজ্লির বোধগম্য ভাষায় পান্থের কথাগুলো শোনায় কুয়াহ্ৎলি।
‘বলদ যেমন তার ঠিক পেছনেই শকটকে টেনে নিয়ে আসে, পরের অনিষ্ট চিন্তাও তেমনি তার পেছনে নিয়ে আসে দুঃখকে।’
খানিক বাদে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো ওমোসেদেও এক ন্’ননমিতনের মুখ থেকে শোনেন পান্থের কথা।
‘ও আমাকে যুদ্ধে পরাস্ত করেছে, আমার প্রতি ওর আক্রোশ আছে—’
শোনেন নেরগল-শর্রানি।
‘আমার ধন-সম্পত্তি ও চুরি করে নিয়েছে।’
এক দ্রেঙ্গরের মুখে শোনেন হ্রলগ্ও।
‘এইভাবে যারা চিন্তা করে ক্রোধ কখনও তাদের ছেড়ে যায় না।’
যাত্রী
নিব্বাণ সমাধির দিকে একবার তাকান চক্ষ, ‘তাহলে এখান থেকেই তোরণ সভ্যতার প্রথম পদক্ষেপ ধরে নেওয়া যেতে পারে।’
মাথা ঝোঁকান থের অল্লকপ্প, ‘হ্যাঁ প্রথম এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
দূরে আকাশের গায়ে আগে আঁকা তোরণ নগরীর মিনারের সারির আবছায়া চেহারার দিকে চোখ ফেরান চক্ষ, ‘কিন্তু এরপরেও তো কাহিনি আরও আছে।’
সায় দেন অল্লকপ্প, ‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু তারা যে সবাই এক রঙ্গমঞ্চের নৃত্যপুত্তলী মাত্র, সে কথা তোরণ নাগরিকদের বুঝে ওঠার সূত্রপাত তো এখানেই। তারপর তো কেবল দেশ-কালের প্রহেলিকার আড়ালে লুকিয়ে থাকা গোপন প্রভুদের হাতে ধরে থাকা সুতোগুলো কেটে ফেলার ঘটনাক্রম মাত্র। সে সব কথা তো প্রচলিত ইতিহাসেই পাওয়া যায়, ঐতিহাসিক চক্ষ।’
মাথা নাড়েন চক্ষ, ‘হ্যাঁ, তা পাওয়া যায়। প্রথমেই তোরণ নগরীর আদি বাসিন্দারা শক্তি অস্ত্রের আঘাতে তোরণপথগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে।’
এবার থের অল্লকপ্প তাকিয়ে থাকেন নিব্বাণ সমাধির দিকে, ‘হ্যাঁ! অতীতের সঙ্গে জুড়ে থাকা সাঁকোগুলো ধ্বংস হবার পর শুরু হয় নতুন ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপনের পালা। এইখানে, এই টিলার ওপরে।’
নিশীথ
জনহীন অন্ধকার প্রান্তের টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকেন পান্থ। মশালের লালচে আলো পড়ে তাঁর শ্বেত বস্ত্রে। তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে চার যুযুধান পক্ষের চার দলপতি। ইৎজ্লি। ওমোসেদে। নেরগল্-শর্রাণি। হ্রলগ্।
আজ পান্থের কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না কারওই।
‘বৈর দিয়ে বৈর সমাপ্ত করা যায় না। অবৈর দিয়েই বৈরের সমাপ্তি ঘটে। জেনে রাখো এই চিরন্তন সত্য। অতীত থাকুক অতীতের জায়গায়। এই যুদ্ধের প্রান্তর হয়ে উঠুক ভবিষ্যৎ পথের তোরণ।’
চারটে হাত মিলে যায় একসঙ্গে। চারটে কণ্ঠে শোনা যায় একই উচ্চারণ।
‘তোরণ!’
একটা দমকা হাওয়ায় নিবে যায় মশাল। আরও গাঢ় হয়ে ওঠে অন্ধকার। কিন্তু তবু চারটে হাত বজ্রবন্ধনে আঁকড়ে থাকে পরস্পরকে।
হুঁশিয়ার
পান্থের নিব্বাণ সমাধির দিকে তাকিয়ে থাকেন অল্লকপ্প আর চক্ষ দু-জনেই। গাছ থেকে টুপটাপ করে সমাধির ওপর ঝরে পড়ে ফুল, এঁকেবেঁকে উড়ে বেড়ায় রঙিন প্রজাপতির দল।
‘তাহলে এখানেই—?’
ঘাড় নাড়েন অল্লকপ্প, ‘হ্যাঁ, পান্থের জীবন-দীপ নির্বাপিত হওয়ার পর, এখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।’
সহসা অল্লকপ্পের দিকে ফেরেন চক্ষ, ‘কিন্তু একটা কৌতূহল তো থেকেই গেল থের অল্লকপ্প!’
‘কীসের বিষয়ে ঐতিহাসিক চক্ষ?’ শান্ত স্বরে উত্তর দেন অল্লকপ্প। যদিও চক্ষের ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা ব্যঙ্গের হাসিটা তাঁর চোখ এড়ায় না।
‘পান্থের কথা তো গভীর ভাবে জানা হল না। তিনি কে ছিলেন, ফলিকী, বার্ক্ষী, বার্কিনী না বল্লুরী, তাঁর দর্শনের উৎপত্তিই বা কোথায়, এসব তো কিছুই বোঝা হল না।’
‘পান্থের বিষয়ে আমরা নিজেরাই এর থেকে বেশি কিছু যে জানি না ঐতিহাসিক চক্ষ। বা বলা ভালো জানতে চাই না। পান্থ পান্থই। তিনি ফলিকী, বার্ক্ষী, বার্কিনী বা বল্লুরী যাই হয়ে থাকুন, সে অতীত আমাদের কাছে অর্থহীন।’
চক্ষর মুখের ব্যঙ্গের হাসিটা আরও কুৎসিত হয়ে ওঠে, ‘কিন্তু তিনি যেই হোন, তাঁর দেহাস্থি অবশ্যই এই সমাধির নিচে পাওয়া যাবে?’
‘তা-ই তো জানি।’
গগ্গর দিকে ফেরেন চক্ষ, ‘পান্থের কাহিনিটি অতি চিত্তাকর্ষক পান্থ গগ্গ, কিন্তু ওটা কাহিনিই, ইতিহাস নয়।’
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গগ্গ। চক্ষের চোখেমুখে ক্রোধ আর ক্রুরতার ছাপ তার নজর এড়ায় না।
‘আসুন পান্থ গগ্গ, আপনাকে প্রমাণ দিই।’
চক্ষর হাতে কখন সবার অলক্ষে উঠে এসেছে একটা ক্ষুদ্র দণ্ড। সমাধির দিকে এবার সেটা বাড়িয়ে ধরেন তিনি। একটা সবুজ দ্যুতি আঙুল তোলে দণ্ডের মাথা থেকে। স্পর্শ করে সমাধি।
সশব্দ বিস্ফোরণে উড়ে যায় সমাধির পাথর। ছিটকে পড়ে থেঁতলানো ফুল আর ডানা ভাঙা প্রজাপতি।
বজ্রমুষ্টিতে গগ্গর কাঁধ ধরে তাকে সমাধির পাশে টেনে নিয়ে যান চক্ষ, ‘দেখুন পান্থ গগ্গ। প্রমাণ। পান্থের কোনও অস্তিত্ব নেই।’
পাথর উপড়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে একট ছোট গহ্বর। তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে ফুল আর প্রজাপতির ডানার টুকরো। এলিয়ে রয়েছে সমাধির ওপরের গাছের বিবর্ণ শেকড়।
কিন্তু পাথরের খালি করে দেওয়া সে শূন্য গহ্বরে বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই কোনও দেহাবশেষের!
‘প্রশ্ন করুন গগ্গ, থের অল্লকপ্পকে প্রশ্ন করুন। কোথায় পান্থ?’
হিংস্রতা ঝরে পড়ে চক্ষের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ থেকে।
হতভম্ব গগ্গ নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে অল্লকপ্পের দিকে।
একটা শান্ত হাসি ফুটে ওঠে অল্লকপ্পর মুখে, ‘আপনার মুখোশটা খোলার অপেক্ষায় ছিলাম ঐতিহাসিক চক্ষ। অবশ্য আপনি সত্যিই ঐতিহাসিক কি না, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।’
কেমন হকচকিয়ে যান চক্ষ, নীরবে তাকিয়ে থাকেন অল্লকপ্পর দিকে।
উত্তরীয়ের ভেতরে হাত ঢোকান অল্লকপ্প, ‘না চক্ষ। পান্থ ছিলেন। তবে তিনি একটা বিমূর্ত দর্শনের প্রতীক। তিনি ফলিকী, বার্ক্ষী, বার্কিনী, বল্লুরী এই সবকিছুই, আবার এই সবের ঊর্ধ্বে।’
‘হেঁয়ালি রাখুন। স্বীকার করুন, পান্থের ইতিহাস কেবল একটি কাহিনিমাত্র।’ গর্জে ওঠেন চক্ষ।
ঘাড় নাড়েন অল্লকপ্প, ‘হতে পারে কাহিনি, চক্ষ। কিন্তু এ কাহিনিরও প্রয়োজন আছে। এই কাহিনি ব্যবহার অগ্গির মতো। আপনাদের মতো পতঙ্গদের বারংবার ঝাঁপ দিতে প্রলুব্ধ করে। কাহিনির পেছনে সত্য একটা আছে বটে, কিন্তু দুঃখের বিষয়, আপনি সেটা নথিবদ্ধ করতে পারবেন না।’
উত্তরীয়ের ভেতর থেকে হাতটা টেনে বের করেন অল্লকপ্প। তাঁর হাতের মুঠো থেকে লাফিয়ে ওঠে শক্তি কৃপাণের নীলাভ ফলা।
চক্ষর বুকে আমূল বিঁধিয়ে দেন অল্লকপ্প তাঁর হাতের অস্ত্র। বিস্ময়ে দু-চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে চক্ষর, বুক থেকে তাঁর গড়িয়ে পড়ে রক্তের ধারা, কয়েক পা হেঁটে তিনি বসে পড়েন মাটিতে।
‘হ্যাঁ, চক্ষ। আপনাদের আমরা বলে থাকি সংশয়-রাক্ষস। বহু-বহুবার আপনারা নানা বেশে, নানা রূপে আমাদের মাঝে আসেন। উদ্দেশ্য একটাই। সংশয়ের বীজ পুঁতে আমাদের ফের সংঘাতের পথে ঠেলে দেওয়া।’
চক্ষের বুক থেকে অস্ত্র খুলে নেন অল্লকপ্প, মাটিতে ঢলে পড়েন চক্ষ।
‘আপনার প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণটা আপনি হয়তো শুনতে পাবেন না। তবু বলি। পান্থ কোনও ব্যক্তি নন, কোনও প্রচারক বা প্রবক্তা নন। নিরর্থক হানাহানির ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য তোরণ নগরীর প্রতিষ্ঠাতারা খুঁজে পেয়েছিল যে পথ, পান্থ তারই প্রতীক।’
গিরি
‘সুয়াচ্চিক, আপনাকে জানিয়েছিলাম যে কুয়াহ্ৎলিদের মধ্যে কয়েকজন মাঝে মধ্যে দু-তিনদিনের জন্য উধাও হয়ে যায়।’
‘হ্যাঁ, বলেছিলে।’
‘আমি এদের পিছু নিয়েছিলাম সুয়াচ্চিক। এখান থেকে অনেক দূরে, একটা টিলার ওপরে বসে এরা নিজেদের মধ্যে নানান কথাবার্তা বলে, তারপর ফিরে আসে।’
‘কীসের কথা বলে এরা নিজেদের মধ্যে হুইৎজিলিন্? লড়াইয়ের?’
‘না সুয়াচ্চিক! লড়াইয়ের নয়। পথের কথা বলে।
‘পথ! কোথাকার পথ?’
‘জীবনের পথ, সুয়াচ্চিক।’
অবাক চোখে তাকান ইৎজ্লি, ‘জীবনের পথ! তোমার কথার মানে কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না হুইৎজিলিন্।’
ফের অপ্রস্তুত দেখায় হুইৎজিলিন্কে, ‘সুয়াচ্চিক, আপনি যদি একবার সেখানে গিয়ে নিজের চোখে দেখেন তাহলে!’
‘নিজের চোখে দেখব? কেন হুইৎজিলিন্? তুমি যা দেখেছে, শুনেছ, তা কি যথেষ্ট নয়? আমাকে যেতে হবে কেন?’
‘না সুয়াচ্চিক, যথেষ্ট নয়। আপনার স্বচক্ষে একবার অবশ্যই দেখা দরকার। কারণ এই জমায়েতে কেবল আমাদের কুয়াহ্ৎলিরাই যায় না। আসে অন্যরাও।’
‘অন্যরা! অন্য কারা হুইৎজিলিন্?’
‘তেজ্কাৎলিপকার অনুচরেরা। যাদের সঙ্গে আমরা লড়াই করে চলেছি প্রতিনিয়ত।’
নির্বাক বিস্ময়ে হুইৎজিলিনের একবার তাকান ইৎজলি। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে দেখতে থাকেন নিজের বলিরেখা পড়া হাতদুটো।
কিছুক্ষণ পর ইৎজ্লি চোখ ফেরান আঙিনায় বাঁধা বন্দীর দিকে, ‘ওকে পায়ের
বেড়ি খুলে এখানে নিয়ে এস।’
বন্দীকে ইৎজ্লির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় হুইৎজিলিন।
‘তোমাকে আমি মুক্ত করে দেব। তবে—’ বিস্মিত বন্দীর মুখের দিকে তাকান ইৎজ্লি, ‘তবে একটা শর্তে। তোমাকে আমার একটা প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে।’
লম্বা সময়ের মানসিক দ্বন্দ্ব আর দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছেন ইৎজ্লি।
কান্তার
কঠিন চোখে ওমোসেদে তাকান ইনোমাইয়ের দিকে, ‘তুমি আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছ ইনোমাই? কেন?’
‘বিশ্বাস করুন মাতা, আমি আপনার বিরুদ্ধে কিছু করার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমরা দু-জনে একসঙ্গে সভা থেকে ফিরছিলাম কেবল। পথে ইজেগ্বের সিপাহির আমাদের আটকাল।’
‘কীসের সভা ইনোমাই?’ বিস্মিত প্রশ্ন ওমোসেদের।
খানিক ইতস্তত করে ইনোমাই, ‘টিলার মাথায় আমরা সবাই একসঙ্গে জড়ো হই। তারপর নিজেদের মধ্যে পথের কথা বলি।’
‘পথ! কী পথ?’
‘জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আমরা যে পথে ধরে চলতে থাকি, সেই পথ।’
আরও একবার বিস্মিত হবার পালা ওমোসেদের। ইনোমাই, নয় উত্তর এসেছে মরু দানবের কাছ থেকে। অশুদ্ধ ভাষা, অস্পষ্ট উচ্চারণ, তবু তার কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
‘তুমি আমদের ভাষা জানো?’
ঘাড় নাড়ে বন্দী, ‘সভায় যারা যারা আসে আমি তাদের সবার ভাষাই অল্পস্বল্প জানি।’
‘সবার মানে? আর কাদের ভাষা জানো তুমি?’
‘আপনাদের, যারা আকাশ পথে উড়ে আসে, যারা সমুদ্রের বুকে থাকে, সবাইকার।’
একটা ক্রুদ্ধ গর্জন করে, ইনোমাইয়ের গলায় শক্তি কৃপাণের নীল ফলা চেপে ধরে ইজেগ্বে।
‘মনগড়া গল্প বানিয়ে আপনার চোখে ধুলো দিতে চাইছে মাতা। অনুমতি দিন, এই বিশ্বাসঘাতকের মাথাটা দেহ থেকে আলাদা করে দিই।’
দূরে বসে থাকা ন্যুরবেসের দিকে তাকান ওমোসেদে। এতদিন কুতোমেনের
প্রতি তিনি তাঁর দায়িত্ব পালান করে এসেছেন বিনা প্রশ্নে। কিন্তু এই মুহূর্তে এক কল্পিত পিতৃলোকের থেকে আনুগত্যের বেশি প্রয়োজন তাঁর নিকটজনের।
‘দাঁড়াও ইজেগ্বে।’ হাত তুলে বাধা দেন ওমোসেদে।
এক পা পিছনে হটে আসে বিস্মিত ইজেগ্বে।
বন্দীর দিকে তাকান ওমোসেদে, ‘তোমাকে মুক্তি দিলাম। যেতে পারো তুমি। কিন্তু যাবার সময়ে তোমাকে সঙ্গে নিতে হবে ইনোমাইকে। আর ইনোমাই—’
‘মাতা—?’ এক পা সামনে এগিয়ে আসে ইনোমাই।
‘ইনোমাই, এই মরু-দানবদের কাছে তুমি আমার একটা প্রস্তাব নিয়ে যাবে। ইজেগ্বে, এদের দু-জনকে আমার শিবিরে নিয়ে এস।’
পেছন ফিরে হাঁটা দেন ওমোসদে। ন্যুরবেসের জন্য চোখের জল ফেলার বিলাসিতাটুকু অর্জন করার সুযোগ তাঁকে এনে দিয়েছে ইনোমাই। তাকে কাজে লাগাতে তিনি বিন্দুমাত্র চেষ্টার ত্রুটি রাখবেন না।
মরু
‘তুমি অপরাধ স্বীকার করছ?’ বিস্মিত প্রশ্ন নেরগল-শর্রানির।
‘যা করেছি তা স্বীকার করেছি। কিন্তু কোনও অপরাধ করিনি।’
‘অপরাধ করনি? তুমি প্রভু আস্শারের কাজের বিরুদ্ধাচরণ করেছ, সেটা অপরাধ নয়?’
‘কোথায় প্রভু আস্শার? আমরা জানি আমরা এসেছি বুউরুমুতে, হান্পির অনুচরদের বিরুদ্ধে লড়তে। আর এই বন্দী জানে সে এসেছে অদিন্নের হয়ে ভাল্হলের সন্ধানে!’
‘তুমি এসব জানলে কোথায় এস্রাহাড্ডেন?’ বিস্ময়ের মাত্রা আরও কয়েক পর্দা চড়ে নেরগল-শর্রানির কণ্ঠে।
‘সভায়!’
‘সভা? কীসের সভা?’
‘টিলার মাথায় দামামা বাজিয়ে যে সভা ডাকি আমরা। যে সভায় আমরা পথের কথা বলি।’
‘পথ? কীসের পথ?’
‘যে পথে চলতে চলতে আমাদের সঙ্গী হয় সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সেই পথ।’
সারিবদ্ধ সিপাহিদের মধ্যে কয়েকজনের চোখেমুখে অস্বস্তির ছাপ নজর এড়ায় না নেরগল-শর্রানির অভিজ্ঞ চোখের। কণ্ঠস্বর শীতল হয়ে আসে তাঁর, ‘এই সভায় কি তুমি একাই যাও?’
‘না রব-কিসির, আমরা অনেকেই যাই। এই বন্দীও যেত। আপনিও আসতে পারেন।’
হুঙ্কার দিয়ে তাঁবুর গায়ে হেলান দেওয়া একটা বর্শা তুলে নেয় শার্রু-এমুরান্নি। লম্বা পায়ে এস্রাহাড্ডেনে-র কাছে পৌঁছে তার গলায় চেপে ধরে বল্লমের নীলাভ শক্তি ফলক।
‘রব-কিসিরের সঙ্গে সম্মান দিয়ে কথা বল হারামজাদা।’
এস্রাহাড্ডেনে-র দিকে তাকান নেরগল-শর্রানি, ‘তুমি জানো, তোমার কাজের শাস্তি মৃত্যু?’
উত্তর দেয় না এস্রাহাড্ডেন, নেরগল-শর্রানির চোখে চোখ দাঁড়িয়ে থাকে নীরবে।
পাশ থেকে অস্পষ্ট উচ্চারণে হঠাৎ কথা বলে ওঠে বন্দী, ‘আমাকে হত্যা করলে যদি এস্রাহাড্ডেনের শাস্তি মকুব হয়, তাহলে তাই করুন।’
ক্রুদ্ধ গর্জন করে বর্শার উলটোদিক দিয়ে বন্দীর পেটে সজোরে আঘাত করে শার্রু-এমুরান্নি। একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে বন্দী ঝুঁকে পড়ে সামনে।
‘বিদ্রোহের উস্কানি আর শত্রুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র! হুকুম দিন রব-কিসির, জীবন্ত অবস্থায় এদের ছাল ছাড়িয়ে নিই।’
সার বাঁধা সিপাহিদের সামনে দিয়ে একটা দমকা বাতাস হঠাৎ ছুটে যায় ধুলো উড়িয়ে। সেদিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকেন নেরগল-শর্রানি।
‘রব-কিসির!’
শার্রু-এমুরান্নির দিকে তাকান নেরগল-শর্রানি, ‘বাতাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় কি রব-উরাটে?’
‘বুঝলাম না রব-কিসির!’ বিস্মিত উক্তি শার্রু-এমুরান্নির।
খানিক দূরে তখনও বালি উড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলেছে বাতাস। সেই দিকে ইঙ্গিত করেন নেরগল-শর্রানি।
‘মরুর ঝড় কাউকে রেয়াত করে না শার্রু-এমুরান্নি। শত্রু, বন্ধু, সিপাহি, রব-কিসির, কারও পরোয়া করে না। সমস্ত উড়িয়ে নিয়ে চলে যায় নিজের পথ ধরে।’
সামনের ফৌজের সারির দিকে ইঙ্গিত করেন তাকান নেরগল-শর্রানি, ‘আস্শারের সিপাহির প্রাণ বাঁচাতে, হান্পির অনুচর স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতে চাইছে। ঝড় আসবে টের পাচ্ছ না রব-উরাটে?’
বিস্মিত চোখে শার্রু-এমুরান্নি তাকিয়ে থাকে নেরগল-শর্রানির দিকে।
এস্রাহাড্ডেনের দিকে ফেরেন নেরগল-শর্রানি, ‘তোমার এই বন্ধুকে ফেরত নিয়ে যাও তার লোকেদের কাছে। আর সেই সঙ্গে নিয়ে যাও আমার একটা প্রস্তাব।’
পারাবার
‘না হিলমির্। ওই পাহাড়ের বাসিন্দারা ফেন্রির কিংবা সর্তরের নাম শোনেনি। ওরা বলে ওরা লড়াই করছে হুইৎজিলোপোৎশ্লির হয়ে।’
‘হুইৎজিলোপোৎশ্লি! সে কে?’ বিস্মিত প্রশ্ন হ্রলগের।
‘ওদের দেবতা হিলমির্। ওরা আমাদের বলে দানব। বলে হুইৎজিলোপোৎশ্লির শত্রু তেজ্কাৎলিপকার অনুচর।’
হ্রলগের মনে হয় তাঁর চেনা দুনিয়াটা কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে! যেদিন লড়াইয়ে তাঁর পা খোয়া যায় সেদিনও বুঝি তাঁর মনের মধ্যে এমন সংশয়ের ঝড় ওঠেনি। কণ্ঠস্বরের কাঁপুনিটুকু যথাসম্ভব দমিয়ে রেখে ফের প্রশ্ন করেন তিনি।
‘পালালে কী করে?’
‘পালাইনি হিলমির্। ওদেরই একজন যোদ্ধা আমার বাঁধন খুলে অর্ধেক রাস্তা সঙ্গে করে পৌঁছে দিয়ে গেল।’
‘তোমার ছেড়ে দিল, আবার পৌঁছেও দিল?’ হ্রলগের বিস্ময়ের পালা যেন শেষ হতে চায় না।
‘হ্যাঁ, হিলমির্। সে যোদ্ধা আর যুদ্ধ করতে চায় না।’
‘যুদ্ধ করতে চায় না! কিন্তু কেন?’
‘তা জানি না হিলমির্! কিন্তু একটা টিলার মাথায় দামামার আওয়াজ তুলে এরা জড়ো হয় অনেকেই। তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলে তারা পথ সম্বন্ধে।’
‘কী পথ? কীসের পথ?’
‘যে পথ দিয়ে আমার চলতে থাকি জীবনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, সেই পথ।’
ভ্রূ কোঁচকান হ্রলগ্, ‘তুমি কী বলছ, আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না নিয়াল্। তা ছাড়া তুমি এত কিছু জানলেই বা কী করে?
স্বল্প অস্বস্তির ভাব ফুটে ওঠে ন্যিয়ালের চোখেমুখে, ‘আমি আসার পথে সেই সভায় গিয়েছিলাম হিলমির্—’ ফের কিছুটা ইতস্তত করে নিয়াল্। ‘আর হিলমির্। আপনারও বোধহয় এখানে একবার যাওয়া দরকার।’
খানিক দূরে নবাগত দ্রেঙ্গর্দের কুচকাওয়াজ করায় ইভার্র্, বাতাসে ভেসে আসে তার ‘অদিন্ন্ আ ইদ্র্ আলা’ চিৎকার।
আশৈশব শুনে আসা রণহুঙ্কার প্লাবন তোলে না হ্রলগের রক্তে। বরং একটা তীব্র বিবমিষায় আচ্ছন্ন হয়ে আসে তাঁর শরীর। হাঁটুর নিচে অস্তিত্বহীন পায়ের জ্বালাটা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
সমুদ্রের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্প্রভ তোরণের দিকে তাকিয়ে থাকেন হ্রলগ্। একমুখী ওই পথ তাঁদের নিয়ে এসেছে এই অবধিই। ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করে নিতে হবে তাঁদের নিজেদেরই।
‘হিলমির্! আপনি ওই সভায় যাবেন হিলমির্?’
নিয়ালের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে তোরণ থেকে নজর ফেরান হ্রলগ্। ‘না নিয়াল্। আমি যাব না। কিন্তু তোমাকে আর একবার যেতে হবে।’
‘কোথায় হিলমির্? ওই সভায়?’
ঘাড় নাড়েন হ্রলগ্, ‘না নিয়াল্, সভায় না। যেখানে তুমি বন্দী ছিলে, সেই পাহাড়ের দেশে। তুমি তাদের কাছে আমার একটা প্রস্তাব নিয়ে যাবে।’
পান্থ
জনহীন অন্ধকার প্রান্তরে টিলার ওপরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে চার যুযুধান পক্ষের চার দলপতি।
ইৎজ্লি। ওমোসেদে। নেরগল্-শর্রাণি। হ্রলগ্।
মশালের লালচে আলো পড়ে তাঁদের শ্বেত নিশানে।
আজ পরস্পরকে বুঝতে অসুবিধে হয় না কারওই।
‘বৈর দিয়ে আমরা আমাদের বৈর সমাপ্ত করতে পারব না।’
‘না, কেবল অবৈর দিয়েই আমরা ছেদ টানতে পারব বৈরের।’
‘অতীত থাকুক অতীতের জায়গায়।’
‘এই যুদ্ধের প্রান্তর হয়ে উঠুক ভবিষ্যৎ পথের তোরণ।’
চারটে হাত মিলে যায় একসঙ্গে। চারটে কণ্ঠে শোনা যায় একই উচ্চারণ।
‘তোরণ!’
একটা দমকা হাওয়ায় নিবে যায় মশাল। আরও গাঢ় হয়ে ওঠে অন্ধকার।
কিন্তু তবু চারটে হাত বজ্রবন্ধনে আঁকড়ে থাকে পরস্পরকে।
চার হাতের মুঠোয় চারটে বীজ। ব্রহ্মাণ্ডের চার অজানা কোণ থেকে অযত্নে বয়ে আনা চার সম্ভাবনার আশার অঙ্কুর।
যাত্রী
টিলার ওপর দলবল নিয়ে পান্থের সমাধিকে নতুন করে গড়ে তোলেন অজ্ঝক্খ পসেন্দি। তাঁর সিপাহিরা সরিয়ে ফেলেছে চক্ষের দেহ, পরিষ্কার করে দিয়েছে ঘাসের গালিচা। কিছুক্ষণ আগের উন্মত্ততা মুছে ফেলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে পান্থের নিব্বাণ সমাধিস্থল।
‘থের অল্লকপ্প, তাহলে পান্থ বলে কেউ ছিল না?’
‘পান্থ নামে কেউ একজন ছিল না গগ্গ। পান্থ কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়। কোনও দৈবপুরুষ নয়। কোনও দ্রষ্টা নয়। প্রশ্নহীন আনুগত্যের দাসত্ব শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা আর প্রতিকারের চেষ্টার প্রতীকের নামই পান্থ। পান্থ আমরা সবাই।’
টিলার ওপরের গাছটার দিকে ইঙ্গিত করেন অল্লকপ্পদ, ‘ভালো করে দেখো পান্থ গগ্গ। কী দেখছ?’
কয়েক কদম এগিয়ে গাছটাকে খুঁটিয়ে দেখে গগ্গ, ‘থের, আমি এটাকে একটাই গাছ মনে করেছিলাম। কিন্তু দেখছি চার-চারটে আলাদা গাছে পরস্পরের সঙ্গে এমন ভাবে জুড়ে রয়েছে যে একটাই মনে হয়।’
গগ্গের বিস্মিত মুখের দিকে তাকান অল্লকপ্প, ‘হ্যাঁ, পান্থ গগ্গ। চারটি আলাদা তরু, তাদের পন্নের চেহারা আলাদা, আলাদা তাদের পুপ্পের বর্ণ। কিন্তু এই চারটিই একে অপরের মধ্যে মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। আমাদের আগে যে পান্থরা এসেছিলেন, তাঁদের স্মৃতির চিহ্ন এইটিই। ওই পাথরের সমাধিটি কেবল—’
একটা হালকা হাসি খেলে যায় অল্লকপ্পর ঠোঁটে, ‘কেবল আমাদের এককালের প্রভুদের চোখে ধুলো দেবার কাজে লাগে। এসো, আমাদের পূর্বসুরীদের বিদায় জানিয়ে যাই।’
গাছের চারপাশ ঘিরে দাঁড়ায় পান্থরা। গান গায় নতমস্তকে।
যিনি শরীর, মন, কিংবা বাক্য দ্বারা কোনও অন্যায় করেন না, যিনি সতত সংযত,
পান্থ বলি তাঁকেই।
সমস্ত শৃংখল ভঙ্গ করে করে যিনি ভয়হীন, সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে যিনি মুক্ত,
পান্থ বলি তাঁকেই।
যিনি ছিন্ন করেছেন ঘৃণার বন্ধন, নিগড় চূর্ণ করে অজ্ঞতাকে করেছেন জয়,
পান্থ বলি তাঁকেই।
প্রগাঢ় যাঁর জ্ঞান, গভীর যাঁর বোধ, ন্যায় আর অন্যায়ের পার্থক্য চিনে চলেন যিনি পথ,
পান্থ বলি তাঁকেই।
কেতন
অবশেষে শুভারম্ভ হতে চলেছে কেতন উৎসবের। আকাশটা রোদ মেখে হাসছে আজ সকালে থেকেই। তোরণ-নগরীর উঁচু মিনারগুলোর মাথায় ফলিকী আর বার্ক্ষীরা পরিয়ে দিয়েছে উৎসবের সাজ। শহরের নিচের মঞ্জিলগুলোতেও আয়োজনের কমতি নেই। জলপথগুলোর দু-পাশ ছোট নিশানের মালায় সাজিয়ে দিয়েছে বার্কিনী মাঝিরা, শহরের প্রতিটি আঙিনা আর চৌরাস্তা সামিয়ানা আর চাঁদোয়ায় মুড়ে নতুন রূপ দিয়েছে বল্লুরী শিল্পীরা।
মাঝ-মঞ্জিলের একটা চওড়া চাতালে পান্থদের নিয়ে কেতন হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন অল্লকপ্প। পেছনের কৃত্রিম জলপ্রপাতের আওয়াজ মেশে দামামার গম্ভীর নিঃস্বন। সামনে ছড়ানো চওড়া সোপান আর তার নিচের বিশাল চত্বরে অসংখ্য নাগরিকের উন্মুখ জমায়েত। দু-পাশে স্তরে স্তরে উঠে যাওয়া তোরণ নগরীর নানা মঞ্জিল, জলখিলেন, মিনার, আর সেতুপথের জ্যামিতিক নকশাও যেন তাদের সঙ্গে উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করে উৎসব আরম্ভের।
সহসা উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে জমায়েত—সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসেন অজ্ঝক্খ পসেন্দি।
নিশান হাতে কয়েক পা সামনে এগিয়ে যান অল্লকপ্প, ‘অজ্ঝক্খ পসেন্দি।’
‘থের অল্লকপ্প।’
সসম্ভ্রমে মাথা ঝুঁকিয়ে অল্লকপ্পর হাত থেকে নিশান তুলে নেন পসেন্দি, উঁচু করে তুলে ধরেন মাথার ওপর। তোরণ নগরীর মিনারে, অলিন্দে, মঞ্জিলে প্রতিধ্বনিত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে যায় নাগরিকদের সোল্লাস চিৎকার।
দু-হাত উঁচু করে তুলে ধরেন অল্লকপ্প। থেমে যায় ভিড়ের উল্লাস। ছড়িয়ে যায় দামামার শব্দ। পান্থ, নাগরিক, সিপাহি, গহপতি, সবাই গলা মেলায় পরস্পরের সঙ্গে।
এসো মিলি একসঙ্গে, এক সুরে হোক কথা, একই তানে মিলে যাক মন।
এক সমিতিতে একই হয়ে যাক মন্ত্রণা, একই উদ্দেশ্যে করি একই প্রার্থনা।
এক সঙ্কল্পে এক হোক হৃদয়, একই ভাবনায় এসো বাঁধি একের ঐক্যে।
শেষ হয় গান। থেমে যায় দামামার শব্দ। জলের শব্দের সঙ্গে মেশে অল্লকপ্পের কণ্ঠস্বর,
‘আমরা কেবল ফলিকী, বার্ক্ষী, বার্কিনী কিংবা বল্লুরী নই। আমরা তোরণের নাগরিক। এই তোরণ নগর কেবল শহর নয়, এ আমাদের ভবিষ্যতের দ্বারপথ। পান্থ, গহপতি, সিপাহি, আমরা সকলেই সেই একই পথের পথিক। সে পথ গেছে—’
একটা মৃদু গর্জন ওঠে শহরের পেছন থেকে।
‘সে পথ গেছে, আমাদের যারা তাদের ক্রীড়ানক বানিয়ে রেখেছিল তাদের সিংহাসন অবধি। সেই সিংহাসনে একদিন শোভা পাবে আমাদের বিজয় কেতন।’
বেড়ে যায় গর্জনের আওয়াজ। তোরণ নগরীর মঞ্জিল, জলখিলেন, মিনার, আর সেতুপথের পেছনের আকাশে লাফিয়ে ওঠে এক অর্ধনির্মিত বিশাল আকারের মহাকাশ-পোত।
আকাশে ভাসতে থাকা বিশালদেহী যানের যন্ত্রপিঞ্জরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন অল্লকপ্প, ‘তোরণের মতনই আমরা তিলে তিলে নির্মাণ করব কেতনকে। মহাবিশ্বের তোরণে আমাদের বিজয় কেতন।’
যান্ত্রিক গর্জনে মেশে নাগরিক উল্লাসের অট্টরোল।
সে তুমুল নিনাদ তোরণের মাটি থেকে উঠে যায় মহাকাশ ছাপিয়ে। তার বিদ্রোহের বার্তা মহাবিশ্বের কোনও অজানা কোনের ক্রুর দেবতাদের ললাটে এঁকে দেয় সংশয়ের রেখা।
প্রথম প্রকাশ: শারদাঞ্জলি, ২০১৮
.
অনুপ্রেরণা:
১। দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার। —নজরুল
২। রণধারা বাহি জয়গান গাহি/ উন্মাদ কলরবে/ ভেদি মরুপথ গিরিপর্বত/ যারা এসেছিল সবে/ তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে/ কেহ নহে নহে দূর। —রবীন্দ্রনাথ
৩। আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন। —নজরুল
ঋণস্বীকার: রবীন্দ্রনাথ, ধম্মপাদ, ঋগ্বেদ, নীতিশতকম্, কঠোপনিষদ, মুণ্ডক উপনিষদ ও আরণ্যক ব্রাহ্মণ।
.
***
পরিশিষ্ট – শব্দার্থ
ব্যবহার | ভাষা সূত্র | শব্দ | অর্থ |
তোরণ | পালি | সিস্স | শিষ্য |
নিব্বাণ | নির্বাণ | ||
ইট্ঠক | ইট | ||
সেট্ঠি | শ্রেষ্ঠী | ||
অজ্ঝক্খ | অধ্যক্ষ | ||
পসেন্দি | প্রসেনজিত | ||
সুভদ্দা | সুভদ্রা | ||
সিগ্গাল | শৃগাল | ||
গিজ্ঝ | গৃধ | ||
আখ্খোট | আখরোট | ||
কস্সক | কৃষক | ||
উষুকার | বাণ নির্মাতা | ||
তচ্ছ | সূত্রধার, ছুতার | ||
পুপ্প, পুপ্পহ | পুষ্প, ফুল | ||
পুপ্পোগন্ধো | পুষ্প গন্ধ | ||
অগ্গি | অগ্নি | ||
পন্ন | পর্ণ, গাছের পাতা | ||
গহপতি | গৃহস্থ | ||
গিরি | নাহুত্ল্ | আৎলাপাৎলিন | ডানা |
মাকুয়াহুইৎল্ | আজটেক যুদ্ধাস্ত্র; Macuahuitl | ||
কুয়াহৎলি | ঈগল পল্টনের যোদ্ধা; Cuāuhtli | ||
কান্তার | ডাহোমি | গুন্দেমে | নারী ফৌজের পদাধিকারী |
ন্’ননমিতন | নারী ফৌজ; আক্ষরিক অর্থে ‘আমাদের মাতা’ | ||
ওকোদ-হু | ‘অভিনন্দন জানাই তোমাকে’ | ||
কান্নুমঅ | ক্রীতদাস | ||
উহন-মুকন | ফটকের সামনের উঠোন | ||
কুতোমেন | পিতৃলোক | ||
মরু | প্রাচীন অ্যাসিরীয় | রব-উরাটে | সেনা অফিসার |
রব-কিসির | পদস্থ সেনা অফিসার/ ক্যাপ্টেন | ||
শুলমু | সুপ্রভাত | ||
আর্নু | পাপ | ||
শার্রুম | রাজা | ||
ইশ্শিয়াক-আস্শার | আস্শার দেবের প্র্ধান প্রতিনিধি | ||
পারাবার | প্রাচীন নর্স | ভালকিরিয়া | মানবদেহী পক্ষযুক্ত দানবী; Valkyrie |
অদিন্ন্ | নর্স দেবরাজ; ওডিন | ||
ভাল্হল্ | ওডিনের দরবার গৃহ; ভালহাল্লা | ||
ব্রেগ্দা | তাড়াতাড়ি | ||
ফিয়ল্ | পাহাড় | ||
দ্রেঙ্গর্ | সাহসী | ||
ওয়েরগিল্ড | যুদ্ধে পরাজিতের প্রদেয় কর | ||
হিলমির্ | গোষ্ঠিপতি; Chief |
ঋণ স্বীকার:
পান্থ দর্শন
কাহিনির পান্থদের দর্শনের ধারাটি কিছু মূল সূত্রের উপর আধারিত
১। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া। দুর্গম পথস্তত্কবয়ো বদন্তি।।
—কঠোপনিষদ (১.৩.১৪)
২। আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত ॥
কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে,
খুশি রই আপন মনে—বাতাস বহে সুমন্দ ॥
—রবীন্দ্রনাথ
৩। পথ চলিতে আর-কিছুর আবশ্যক নাই, কেবল প্রেমের আবশ্যক। সকলে যেন সকলকে সেই প্রেম দেয়। পথিক যেন পথিককে পথ চলিতে সাহায্য করে।
(রবীন্দ্রনাথ/ পথপ্রান্তে)
৪। নেত্তিকা হি উদকং নয়ন্তি উসুকারা তেজনং নময়ন্তি তচ্ছকা দারুং নময়ন্তি পণ্ডিতা আত্মনং দময়ন্তি। (ধম্মপাদ ৮০)
৫। পুপ্পগন্ধো পটিবাতম ন এতি চন্দনম টগর মল্লিকা বা ন পটিবাতম এতি সতম্ গন্ধো চ পটিবাতম এতি সপ্পুরিসো সব্বাদিসা পবাতি। (ধম্মপাদ ৫৪)
৬। নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্য ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন। যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বাম্।। (মুণ্ডক উপনিষদ ৩.২.৩)
৭। উত্তিট্ঠে নপ্পমজ্জ্যেয় সুচারিতাম চরে ধম্মচারি অস্মিম লোকে পরমাহি চ সুখম সেতি। (ধম্মপাদ ১৬৮)
৮। নিন্দন্তি নীতিনিপুণা যদি বা স্তুবন্তু লক্ষ্মীঃ সমাবিশতু গচ্ছতু বা যথেষ্টম। অদৈব বা মরণমস্তু যুগান্তরে বা ন্যাযাৎ পথঃ প্রবচলন্তি না ধীরাঃ।। (নীতিশতকম্ ৭৫)
৯। পুষ্পিণ্যৌ চরত জঙ্ঘে ভূষ্ণুরাত্মা ফলগ্রহিঃ। শেরেস্য সর্বে পাপ্মানঃ শ্রমেন প্রাপথে হতাঃ।। চরৈবেতি (আরণ্যক ব্রাহ্মণ ৭.১৫.২)
১০। আস্তে ভগো আসীনস্যোর্ধ্বস্তিষ্ঠতি তিষ্ঠতঃ। শেতে নিপদ্যমানস্য চরাতি চরত ভগঃ।। চরৈবেতি (আরণ্যক ব্রাহ্মণ ৭.১৫.৩)
১১। চরন্বৈ মধু বিন্দতি চরন্ত্স্বাদুমুদুম্বরম্। সূর্্যস্য পশ্য শ্রেমাণং যো ন তন্দ্রয়তে চরন।। চরৈবেতি (আরণ্যক ব্রাহ্মণ ৭.১৫.৫)
১২। যস্স কায়েনা বাচায় মনসা নত্তি দুক্কতাম ঠানেহি সম্বুতম তম অহম ব্রাহ্মণম ব্রূমি। (ধম্মপাদ ৩৯১)
১৩। সব্বসংযোজনম চেত্বা যো বে ন পরিতস্সতি সঙ্গাতিগম বিসম্যুত্তম তম অহম ব্রাহ্মণম ব্রূমি। (ধম্মপাদ ৩৯৭)
১৪। নন্দিম বরত্তম সহনুক্কমম্ সান্দামাম চেত্বা উখ্কিত্তম পালিঘম বুদ্ধম তম অহম ব্রাহ্মণম ব্রূমি। (ধম্মপাদ ৩৯৮)
১৫। গম্ভীরাপঞঞ্ম মেধাবীম মগ্গামগ্গম কোবিদম উত্তমত্থম তম অহম ব্রাহ্মণম ব্রূমি। (ধম্মপাদ ৪০৩)
১৬। সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে।।
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বো হাবিষা জুহোমি।।
সমানী ব আকূ্তিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ।
সমানমস্ত্ত বো মনো যথা বঃ সুসহাসতি।। (ঋগ্বেদ ১০.১৯১)
১৭। ধম্মা মনোপুব্বাঙ্গমা মনোসেট্ঠা মনোময়া চে পাদুট্ঠেনা মনসা ভাসতি বা করোতি বা ততো দুখ্খম নং আন্বেতি বহতো পদম চক্কম ইব। (ধম্মপাদ ১)
১৮। মম্ অক্কোচ্ছি মম্ অবধি মম্ অজিনি মে অহাসি যে তম্ উপনয়হন্তি তেসম্ বেরম্ ন সম্মতি। (ধম্মপাদ ২)
১৯। ইধ বেরেন বেরানি কুদাচনম ন হি সম্মন্তি অবেরেন চ সম্মন্তি এস সনন্তনো ধম্মো। (ধম্মপাদ ৫)