তোমার সঙ্গে বিষম রঙ্গে

তোমার সঙ্গে বিষম রঙ্গে

সিস্ট অপারেশন করিয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর অন্তরা খেয়াল করল যে অনিরুদ্ধ পালটাচ্ছে। রাত করে বাড়ি ফেরা নেই, মুখে মদের গন্ধ নেই, নেই আরও অনেক কিছু। বদলে ওর যত্ন নেওয়া আছে, হাতে করে বাজার থেকে ফল নিয়ে আসা আছে, ওর মুখের সামনে সকালের চায়ের কাপটি হাতে দাঁড়ানো আছে। এক কথায় অন্তরার যেন সুন্দর একটি সংসার আছে, যে-সংসারে পুরনো অনিরুদ্ধ নেই।

এর মধ্যে শুধু একদিনই অনিরুদ্ধর দেরি হয়েছিল, ওর বন্ধু কিংশুকের বিয়ের রিসেপশনে গিয়েছিল সেদিন। অন্তরারও নেমন্তন্ন ছিল। কিন্তু দিন দশেক অন্তত বেশি জার্নির ধকল নিতে চাইছিল না ও। যদিও ডাক্তারি বারণ তেমন কিছু নেই, তবু…

ড. বক্সির নার্সিংহোমে দেড়দিন মতো ছিল ও। সন্ধেবেলা ছেড়ে দেবে, বিকেলবেলা ঝেঁপে কান্না এল ওর। অনিরুদ্ধ ওর সামনে বসে তখন। মাথায় হাত বুলোল, গালেও, কিন্তু অন্তরার কান্না আর থামে না।

আমার নির্ঘাত মেয়ে হত জানো, নইলে আমি অত সুন্দরী হয়েছিলাম কেন?

তুমি সুন্দরীই আছ অন্তরা, অনিরুদ্ধ বলল।

আমার চোখ-মুখ কীরকম গ্লেজ দিত তোমার মনে আছে?

সমস্ত মনে আছে। কিন্তু ওই বিষয়টা আর ভেবো না সোনা।

ভাবব না বললেই, না ভেবে থাকা যায়? সেই যে একটা ঠান্ডা টেবিলে আমাকে শুইয়ে দিয়েছিল আর ওয়াশ করিয়ে দিচ্ছিল আমার ভিতরটা। যেন কোনও চিহ্নমাত্র না থাকে, একটা টিস্যুও যেন লেগে থাকতে না পারে আমার শরীরের সঙ্গে…

পুরোটার জন্য আমিই দায়ী, অনিরুদ্ধ বলল।

দায়ী আমার ভাগ্য, অন্তরা চোখ মুছল।

তোমার ভাগ্য অন্যরকম হতে পারত, হল না আমার জন্য। আমি খারাপ, কিন্তু বরাবর এত খারাপ ছিলাম না জানো…

অন্তরা অনিরুদ্ধকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি ভাল-মন্দ মিশিয়ে। আর মানুষের তো সেরকমই হওয়ার কথা।

না না, আমাকে সান্ত্বনা দিয়ো না।

আমি সান্ত্বনা দিলেও দিতে পারি কিন্তু সংস্থিতা তো দেবে না। ও সেদিন বলছিল, মানুষ অত স্পেসিফিক, অত নির্দিষ্ট হবে কেন? মানুষ তো আর কুকুর নয়!

আবার কুকুর? অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল।

ওর খুব মনে ধরেছে জানো তোমার ওই রেডিয়ো স্টেশনের থিমটা। ও বলছিল, যে-কুকুর বাড়ির ছেলেটা লাথি মারলেও কুঁইকুঁই করে শুধু কিংবা বাড়ির মেয়েটার আদর খাবার জন্য পায়ে মুখ ঘষে দিনরাত, সে-ই আবার অচেনা কাউকে দেখলে, কুকুরের দৃষ্টিতে সন্দেহজনক কাউকে দেখলে, একেবারে টুঁটি কামড়ে ধরার জন্য ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। কী আশ্চর্য তাই না? কোথাও চূড়ান্ত বিনয়ী আবার কোথাও নিখাদ আগ্রাসী।

ভাল ভেবেছে তো তোমার বন্ধু, অনিরুদ্ধ তারিফের গলায় বলল।

কিন্তু তুমি এরকম নও। তুমি বউয়ের কাছে লাগাতার মিথ্যে বলছ, বউকে টাইট দিয়ে দিচ্ছ যখন-তখন আবার একদম অপরিচিত কারও জন্য হয়তো অনেক কিছু করলে, মানে এক কথায় তুমি আনপ্রেডিকটেবল, তোমার সম্বন্ধে আগে থেকে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।

ও, আমার নিন্দে করবে বলে এত ভূমিকা? অনিরুদ্ধ হালকা গলায় বলল।

অন্তরা সিরিয়াস গলায় বলল, নিন্দে করছি না তোমার।

প্রশংসা করছ? অনিরুদ্ধ ভুরু নাচাল।

হ্যাঁ, প্রশংসাই। এই যে ডাক্তার বক্সি, দু’সপ্তাহে একদিন সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে ফ্রি সার্ভিস দেন, ওর কি প্রশংসা করব?

নিশ্চয়ই করবে, অনিরুদ্ধ বলল।

না, করব না। কারণ ওর পুণ্যের কোটা ওই অতটুকু। ওর দাতব্য দাতব্যের জায়গায়, পেশা পেশার জায়গায়। আমাদের যতই অসুবিধে হোক, আমাদের কিন্তু পাঁচ টাকাও ছাড় দেবে না!

কোথাও তো দিচ্ছে অন্তরা!

হ্যাঁ, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দিচ্ছে। স্পেসিফিক, দরদি নয়।

অনিরুদ্ধ চাপা গলায় বলল, ঠিক আছে, এবার চুপ করো। ডাক্তারের নার্সিংহোমে থেকে ডাক্তারের এত সমালোচনা করা যায় না।

অন্তরা বলল, কেন যায় না? ভগবানের পৃথিবীতে থেকে যদি রাতদিন ভগবানের সমালোচনা করা যায়, তা হলে আমি যেটা করছি সেটা কেন করা যায় না?

অনিরুদ্ধ হাসল। একসময় এই ডাক্তারেরই আটশো টাকা ভিজিট নিয়ে ও প্রশ্ন তুলেছিল বলে কত রেগে গিয়েছিল অন্তরা। আর আজ ও নিজেই… অবশ্য হতেই পারে। অন্তরা তো আর স্পেসিফিক নয়।

অন্তরা আন্দাজ করতে পারছিল অনিরুদ্ধ কী ভাবছে। কিন্তু ও সেই ভাবনাটার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলল না। আসলে সবসময় সব কথা নির্দিষ্ট করে বলতে ইচ্ছে করে না।

কিন্তু এক-এক সময় কথা না বললে জল মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। কিংশুকের রিসেপশন থেকে অনিরুদ্ধ ওর জন্য খাবারের প্যাকেট নিয়ে এসেছে দেখে অন্তরা জিজ্ঞেস করল, কিংশুক যে-মেয়েটাকে বিয়ে করল তার সঙ্গে তোমার কী ঝামেলা হয়েছিল?

কোনও ঝামেলা হয়নি। আমি তনুশ্রীকে ফাঁসিয়েছিলাম, অনিরুদ্ধ শান্ত গলায় বলল।

ফাঁসিয়েছিলে কেন?

প্রমিতদার নজর পড়েছিল মেয়েটার ওপর।

সে নজর কার ওপর পড়েনি? অন্তরা শুধোল।

অনিরুদ্ধ বলতে যাচ্ছিল, তোমার ওপরই পড়েনি। কিন্তু এই কথাটা কোন আগ্নেয়গিরির ঘুম ভাঙিয়ে দেবে ঠাহর না পেয়ে বলল, তনুশ্রীর ওপর একটু বেশি পড়েছিল।

তুমি সাপ্লাই দেওয়ার ব্রত নিয়েছিলে?

বলতে পারো। প্রমিতদার গুড-বুকে নিজের নামটা পাকাপাকিভাবে লেখানোর একটা নেশা পেয়ে বসেছিল তখন।

পারলে?

পারিনি। কিন্তু না পেরে খুশিও হয়েছিলাম ভিতরে কোথাও, তনুশ্রীকে আমি বোনের মতো ভালবাসতাম।

তোমার সঙ্গে আজ কথা বলল?

একটু আড়ষ্টভাবে বলল, কিন্তু বলল। হয়তো তনুশ্রীও বুঝে থাকবে পাকেচক্রে মানুষ যা করে বসে সেটাই মানুষের একমাত্র পরিচয় নয়। খুনিও অনুতপ্ত হয়, কুকুরও শিকল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কাঁদে।

সেদিনের মতো চুপ করে গিয়েছিল অন্তরা কিন্তু আজ দুপুরের ফোনটার পর থেকে একটা চাবুক আছড়ে পড়ছে, একটা বেহালার ছড় কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর ভিতরে। ক্রমাগত। অনিরুদ্ধ বাড়ি ফেরামাত্র ও কিছুই বলল না। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর খুব সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল, আমার কাল অফিসে জয়েন করার কথা। আমি কি জয়েন করব?

অনিরুদ্ধ একটু যেন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কালই করবে? আর দু’-একটা দিন…

অন্তরা বলল, আমি সাতদিন ছুটি নিয়েছিলাম, দুটো রবিবার আর একটা ন্যাশনাল হলিডে মিলিয়ে দশদিন। কালই আমাকে জয়েন করতে হবে, যদি আমি ঠিক করি যে চাকরিটা ছেড়ে দেব।

বেটার কিছু পেয়েছ?

পাইনি। তবে মুম্বই গেলে হয়তো পেতেও পারি।

মুম্বই? অনিরুদ্ধ আঁতকে উঠল।

কেন সায়ন্তন তোমাকে অফার দেয়নি?

ও অফার দিলেই হবে? ও এখান থেকে প্রেমে দাগা খেয়ে পালিয়েছে বলে…

অন্তরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি তো জীবনে দাগা খেয়েছ অনিরুদ্ধ। তুমি কেন পালাবে না?

আমি মুম্বইতে গিয়ে কাজ করতে পারব না অন্তরা। আমি ইংরেজি জানি না, আমি কীভাবে ওখানে কাজ করব?

সায়ন্তনের ফোনটা আজ আমি ধরেছিলাম অনি। ও তোমাকে দিয়ে ইংরেজির মাস্টারি করাতে চাইছে না। ও চাইছে তুমি ইস্টার্ন জোনের খবরগুলো ওকে জোগাড় করে দাও…

ও চাইছে আমি রূপমতীকে ওর জন্য আবার জোগাড় করে দিই। অন্তত টাইম-টু-টাইম মেয়েটার খবর ওকে সাপ্লাই দিই।

যাই চেয়ে থাকুক ও তো একটা ব্রেক দিচ্ছে তোমাকে! তুমি একবার ঘুরেই এসো না। সায়ন্তন তো বলল, মাসে সাত দিনের বেশি তোমাকে মুম্বইতে থাকতেও হবে না।

আমি পারব না, সাত দিন কেন সাত ঘণ্টাও থাকতে পারব না মুম্বইতে।

কিন্তু এখানে লাথি-ঝাঁটা খেতে পারবে। কুঁড়ের হদ্দ কোথাকার! অন্তরা ঘৃণায় মুখ বেঁকাল।

অনিরুদ্ধ উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে বলল, কুঁড়েমি নয় অন্তরা। আমি মদের ঘোরে একটা লোককে বহুদিনের চেনা বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলাম।

তো? অন্তরা বলল।

অনিরুদ্ধ সোফার নীচে ডাঁই হয়ে থাকা খবরের কাগজগুলোর মধ্যে থেকে একটা তুলে এনে অন্তরার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, লোকটা আমায় মদ খাইয়েছিল, কে জানে কেন খাইয়েছিল। আর আমি লোকটার কথামতো মোবাইলের দোকানের ছেলেটাকে বলেছিলাম আমি ওকে চিনি। বহুদিন ধরে চিনি।

অন্তরা খবরটায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে বলল, তোমার কথায় লোকটা সিমকার্ড পেয়ে গেল?

সেটা আমার খেয়াল নেই। ছ’-সাত পেগ হয়ে গিয়েছিল তখন, অনিরুদ্ধ অসহায় গলায় বলল।

তা হলে ফালতু কেন ব্যাপারটাকে চড়তে দিচ্ছ মাথায়? অন্তরা বিরক্ত গলায় বলল।

ফালতু নয় অন্তরা, কাগজে পরিষ্কার লিখেছে ওই দোকানটা থেকেও মুম্বই সন্ত্রাসে ব্যবহৃত সিমকার্ড কেনা হয়েছিল।

আরও তো অনেক জায়গা থেকে কেনা হয়েছিল। তুমি ওই একটা নিয়েই পড়েছ কেন?

আরও তো অনেক বাচ্চা মারা যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে, তুমি তোমারটা নিয়েই পড়ে আছ কেন?

কী বললে তুমি? অন্তরা ফুঁসে উঠল।

ঠিকই বললাম অন্তরা। কতটা রক্ত পড়েছিল প্রমিত ব্যানার্জির ফ্ল্যাটের বাথরুমে? তার জন্য কতদিন ধরে বিষময় হয়ে আছে আমাদের জীবন? আর একবার ভেবে দ্যাখো তো তার চেয়ে কত লক্ষ গুণ রক্ত মুম্বইয়ে ঝরেছে? ওই লোকটা হয়তো সত্যিই পুলওভার বেচেছিল আমায় কোনওদিন, হয়তো ও নিছক পরিচয় সূত্রেই আমায় মদ খাইয়েছিল সেদিন, কিন্তু যদি তা না হয়? যদি ওই লোকটা টেররিস্ট কিংবা টেররিস্টদের এজেন্ট হয়ে থাকে তা হলে? তা হলে আমি মদে ডুবে কাকে সার্টিফিকেট দিয়ে এলাম অন্তরা? ওই থইথই রক্তে ভাসতে থাকা শহরটার ভিতর থেকে আমি কীভাবে টাকা খুঁটে আনব, সায়ন্তন হাজার বললেও কীভাবে আনব, সে-রক্ত ঝরানোর পিছনে যদি আমারও অবদান থেকে থাকে?

অন্তরা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল অনিরুদ্ধকে। বলল, তুমি এ সমস্ত কথা আর কাউকে বোলো না অনি, নিছক সন্দেহের বশে অনেক হ্যারাস হতে হবে।

আমি জানি। আমি পুলিশকে বলব না, মিলিটারিকে বলব না, মদ ছেড়ে দিয়েছি তাই মদের ঠেকের বন্ধুদেরও বলার প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু অন্তরা, অন্তত তোমাকে তো বলব? অনিরুদ্ধ ডুকরে কেঁদে উঠল। অন্তরা জোরে, আরও জোরে আঁকড়ে ধরল ওকে।

দিন চারেক পরের এক রাত্রে অন্তরা আধশোওয়া হয়ে অফিসের কাগজপত্র দেখছে, অনিরুদ্ধ ওদের ফ্ল্যাটের একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে বলল, কাল থেকে দুধটা আবার চালু করতে বোলো তো।

অন্তরা ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল, কত করে লিটার জানো তো?

অনিরুদ্ধ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলল, জেনেই বলছি। ‘ভৌ’ চালু হচ্ছে।

অন্তরা এক ঝটকায় উঠে বসল, চালু হচ্ছে? সুনামি সায়ন্তন ফিরে এসেছে?

না, সায়ন্তন আর ব্যাপারটার মধ্যে নেই।

তা হলে?

ফাইনানসাররা নিজেদের একজন লোককে টপে বসাচ্ছে। সে অবাঙালি। অবশ্য তার নীচেই যে-লোকটা থাকবে সে বাঙালি।

তুমি? তুমি সেটা?

না, অন্তরা সেই লোকটা আমি নই। সেই লোকটার নাম প্রমিত ব্যানার্জি।

প্রমিত ব্যানার্জি? তুমি আবার তার এঁটো পাত চাটতে ছুটেছ?

না, বরং সেই আমায় বসে খাওয়ার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছে।

বাজে কথা রাখো অনিরুদ্ধ। কাল তুমি একটা কল্পিত অপরাধবোধে ছটফটাচ্ছিলে আর আজ ওই ক্রিমিনালটার সঙ্গে জেনেশুনে হাত মেলাচ্ছ? সায়ন্তনের প্রস্তাবটা উড়িয়ে দিলে শুধু এই কারণে? আবারও প্রমিত ব্যানার্জির তাঁবেদারি করবে বলে?

প্রমিত ব্যানার্জি আর সেই প্রমিত ব্যানার্জি নেই অন্তরা। সেও নখদন্তহীন হয়েছে। পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির দায়ে ও এখন প্রায় সব জায়গা থেকে বিতাড়িত। ‘ভৌ’ ওর কাছেও বেঁচে থাকার, ভেসে ওঠার একটা শেষ সুযোগ।

আমি প্রমিত ব্যানার্জির ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড নই অনিরুদ্ধ।

আমিও নই। আমি শুধু তোমাকে বোঝাতে চাইছি রোববারের দুপুরে যারা না-চিবোনো মাংসের হাড় পোষা কুকুরের দিকে ছুড়ে দেয়, তারা কুকুরকে দয়া দেখায় না। সেই লোকগুলো আসলে লুকিয়ে রাখতে চায় যে তাদের চিবোবার শক্তি নেই। প্রমিতও আজ তাদের দলে। ও জানে যে ওই ভুতোরিয়া, রামলিঙ্গ ইত্যাদিরা ওকে কতটা চাপে রাখবে। ও বোঝে যে ও সায়ন্তনের চেয়ে অভিজ্ঞ হলেও সায়ন্তনের মতো আপ-টু-ডেট নয়। তাই ও আমার শরণাপন্ন হয়েছে।

শরণাপন্ন? অন্তরা ঠাট্টার গলায় বলল।

হ্যাঁ, শরণাপন্ন। আর আমি ও আমার কী কী ক্ষতি করেছে তা সম্যক মনে রেখেও ওর সঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছি, কারণ আমিও ওর ক্ষতি করেছি অন্তরা। আমি ওকে পরনির্ভরশীল করে তুলেছি। এমনই নির্ভরশীল যে, নিজের পকেটে পিস্তল থাকলেও লোকটা যে-কোনও আক্রমণের মুখে পড়লে ওর পোষা অ্যালসেশিয়ানের দিকে তাকাবে। তাকাবে আর ভয়ে কাঁপবে। কারণ ও জানে না, অ্যালসেশিয়ানটা ওকে বাঁচাতে ঝাঁপাবে কিনা।

তুমি নিজে সব জানো, তাই না? অন্তরা বলল।

অনিরুদ্ধ বিছানায় এসে বসল। ডান হাত দিয়ে অন্তরাকে বেড় দিয়ে বলল, কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু না। শুধু জানি আমার যে-সিমকার্ডটা খোয়া গেছে সেটা আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

কোত্থেকে?

তোমার ভিতর থেকে, আমার ভিতর থেকে, আমাদের দু’জনের ভিতর থেকে।

অন্তরা কী একটা বলতে যাচ্ছিল, লোডশেডিং হয়ে গেল হঠাৎ করে। ও একটুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, ছাড়ো, মোমবাতি জ্বালাই।

অনিরুদ্ধ ওকে শক্ত করে জাপটে ধরে বলল, দরকার নেই, অন্ধকারেই খুঁজতে সুবিধে। অন্তরা আস্তে আস্তে শরীরটা ছেড়ে দিল অনিরুদ্ধর আলিঙ্গনে আর অনিরুদ্ধ ওকে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল ওর পাশে।

অন্তরা বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, আবারও খুঁজলে পাওয়া যাবে?

অনিরুদ্ধ ওর ভেঙে যাওয়া খোঁপার থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি শ্যামবাজার থেকে বাগবাজারের দিকে যেতে কোন দোকানটার সামনে বাস থেকে নামতে মনে আছে?

অন্তরা যেন স্মৃতির অতল খুঁড়ে বলল, একটা বিরাট উনুনে সারাক্ষণ দুধ ফুটত আর কিছুক্ষণ পরপরই একটা লোক মগে করে জল ঢালত কড়ায়। ওদের একটা মাপ ছিল, একটা বড় ভাঁড় মানে এক পোয়া পাত্তি।

জীবনের থেকেও আমরা কতটুকু বেঁচে থাকা নিয়ে নিতে পারি অন্তরা? ওই এক পোয়া পাত্তি, তার বেশি নয়। কিন্তু জীবন এক আশ্চর্য বস্তু। যতবার কেউ তাকে জ্বাল দিয়ে দিয়ে শুকিয়ে ফেলবে ততবার সে নিজেতে নিজে জল মিশিয়ে ফিরিয়ে আনবে নাব্যতা, যাতে ভাসতে পারি, ভেসে থাকতে পারি।

অন্তরা অনিরুদ্ধর মুখের ওপর নিজের মুখ নামিয়ে এনে বলল, ঘন হবে, তরল হবে; তরল হবে, ঘন হবে…

অনিরুদ্ধ অন্তরাকে নিজের ওপর টেনে নিয়ে বলল, হতেই থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *