তোমার জ্যোতিষ্ক তারে যে পথ দেখায়
একটু ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে আলোকপাতের জন্য এবার একবার পিছন ফিরে তাকানো যাক। যাওয়া যাক উপনিষদেরও আগের সময়ে। সম্ভবত সময়টা যিশুর জন্মের চার হাজার বছর আগে। সেই সময়ে ভারতের ঋষি তাঁর ধ্যানের মধ্যে প্রশ্ন করলেন— এই মহাবিশ্ব এল কোথা থেকে? সৃষ্টির আগে কেমন ছিল বিশ্বসত্তা?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে ঋগ্বেদ। এই প্রশ্নের উত্তর ঘিরেই গড়ে উঠেছে সনাতন ভারতের বেদবিদ্যা। বেদবিদ্যাকে দু’ভাবে ভাগ করা যায়। পরাবিদ্যা আর অপরাবিদ্যা। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্বজ্ঞান হল পরাবিদ্যা। বিস্ময় লাগে ভাবতে, ভারতের এই অতি প্রাচীন পরাবিদ্যা প্রায় ছ’হাজার বছর আগে বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে যে ধারণাটি প্রকাশ করেছিল তার সঙ্গে আজকের বিজ্ঞানের বিগব্যাং থিয়োরির কতখানি সাদৃশ্য!
বিজ্ঞান বলছে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে। সৃষ্টি হয়েছিল একটি ছোট্ট কোষ থেকে। এমন এক কোষ যার চেয়ে ছোট আর কিছুই হতে পারে না। এই কোষটিই যেন স্বইচ্ছায় খুলে দিয়েছিল তার ভিতর থেকে সমস্ত নিহিত সম্ভাবনা। সেই প্রথম উন্মোচনের মুহূর্তটিই ‘বিগ ব্যাং’। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ওই কোষটির মধ্যেই ছিল ‘নিত্যকালের উৎসব, বিশ্বের দীপালিকা, নির্বাণহীন আলোকদীপ্ত তোমার ইচ্ছাখানি।’
প্রায় ছ’হাজার বছর আগে বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে বেদ কী বলেছিল? এই মহাসৃষ্টি কোথা থেকে আবির্ভূত হল?— ঋষি তাঁর ধ্যানের মধ্যে অত বছর আগে কী উত্তর পেয়েছিলেন তাঁর এই প্রশ্নের।
বেদ বলছে, মহাবিশ্ব নিজ ইচ্ছায় জাত হল। মহাবিশ্ব তাই ‘আত্মজন্মা’। মহাবিশ্ব জন্মাবার সময়ে কী ছিল? বেদের উত্তর, তখন মৃত্যুও ছিল না অমরত্বও ছিল না, তখন জন্ম ছিল না, ক্ষয় ছিল না, রাত্রি ছিল না, দিন ছিল না। শুধু ছিল এক ক্ষুদ্রতম কোষ যার নাম ‘দহর’। এই ‘দহর’-এর মধ্যে ছিল প্রাণন ক্রিয়া। সেই ক্ষুদ্রতম কোষ ‘দহর’ হঠাৎ কর্মরূপ ইচ্ছা করল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড গতিতে সেই ‘দহর’-এর প্রাণশক্তি বেড়ে গেল। সেই ‘দহর’ প্রবলভাবে গতিসম্পন্ন হল এবং বাড়তে লাগল। ‘দহর’-এর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হল মহাশূন্য। এই বৃদ্ধি ক্ষণস্থায়ী নয়। অনন্তকাল ধরে এই বৃদ্ধি চলছে, চলবে।১ যে-আদিসত্তা এইভাবে সারা ভুবনে ব্যাপ্ত হয়ে প্রসারিত হয়ে চলেছে, সেই আদিসত্তা ব্রহ্ম। একদা এই আদিসত্তা বিন্দুবৎ ক্ষুদ্ররূপে অধিষ্ঠিত ছিল। তারপর স্বইচ্ছায় তার প্রকাশ ঘটল বহুরূপে। এই বহু রূপই বিশ্বজগৎ, যার প্রতি কণায় কণায় বিদ্যমান আদিসত্তা।
জগৎ সত্য কারণ, উপনিষদ বলছে, এক অখণ্ড আলোকপ্লাবনের মধ্যে সমস্ত জগৎ এক হয়ে বিরাজ করছে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
‘একান্ত অন্ধকার বলে কিছুই নেই। যাদের আমরা দেখতে পাইনে তাদেরও আলো আছে। নক্ষত্রলোকের বাহিরের নিবিড় আকাশেও অনবরত নানাবিধ কিরণ বিকীর্ণ হচ্ছে।’
মহাবিশ্বের অন্ধকারেও যে আলো আছে সে কীসের আলো? রবীন্দ্রনাথের একটি গানে অসীম সৌন্দর্যে ধরা দিয়েছে এই ঔপনিষদিক উপলব্ধি।
সোনার ঘটে সূর্য তারা নিচ্ছে তুলে আলোক ধারা,
অনন্ত প্রাণ ছড়িয়ে পড়ে গগনে।
অখণ্ড আলোকস্রোতে ভাসমান এই জগৎকে মিথ্যা বলে, মায়া বলে ত্যাগ করতে কি প্রাণ চায়? আমাদের বোধ বুদ্ধি জ্ঞান কোনও কিছুই এই জগৎকে মিথ্যা বলতে রাজি হয় না।
উপনিষদ আমাদের আলো দেখায়— সত্যের আলো। ভারতবর্ষের প্রাচীন ধ্যান অন্ধকারের মধ্যেও খুঁজে পেয়েছিল আলো। উপনিষদ বলতে পেরেছিল, আঁধারের মধ্যে জ্বলছে সত্যের দীপ্তি। চৈতন্যের উদ্বোধনে অন্ধকারই হয়ে ওঠে আলো— এই হল ঋষিবাণী। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ’— নিয়ে চলো আঁধার থেকে আলোয়, তমসা দূর হয়ে ফুটে উঠুক জ্যোতি, আমরা হয়ে উঠি অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রী।
কেন এত আলো এই ভুবনে? সে কি এই ভুবন মায়া বলে? মিথ্যা বলে? এই ভুবনে এত আলো কারণ সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আবৃত হয়ে আছে অখণ্ড চৈতন্যের নিরবচ্ছিন্ন বুননে। যে-ভুবনে অখণ্ড চৈতন্য বিরাজমান, যে-ভুবনে এত আলো সেই ভুবন মিথ্যা হবে কী করে? এই বোধ ঔপনিষদিক। বিশ্বভুবনকে তাই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সৃষ্টির আলোকতীর্থ।’ যে-জ্যোতির মধ্যে সুপ্ত আছে মহাকাল।
এই জগতের সঙ্গে একাত্মবোধ করেছেন উপনিষদের ঋষি। উপনিষদের মন্ত্র প্রকাশ করেছে সেই একাত্মবোধ। আমরা কি বলতে পারি উপনিষদ মিথ্যার সঙ্গে একাত্মবোধ করেছে?
উপনিষদের ঋষির মতো রবীন্দ্রনাথও নিজেকে ভাবতে পেরেছেন আলোর সন্তান, অমৃতের পুত্র। এ-জগৎ মিথ্যা হলে সেই মিথ্যার সঙ্গে একাত্মবোধের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেতেন না, নিজেকে ভাবতে পারতেন না অমৃতের সন্তান।
রবীন্দ্রনাথ ভাবছেন, যেন সৃষ্টির আদি যুগেও তিনি মিশে ছিলেন এই জগতের প্রাণপ্রবাহের সঙ্গে। বিশ্বের অন্তরে চেতনাপ্রবাহের সঙ্গে মিশে আছে যুগ যুগ ধরে তাঁর নিজস্ব চেতনা— বিশ্বের সঙ্গে তিনি গ্রথিত চেতনার অখণ্ড সূত্রে। তিনি লিখছেন—
‘এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়েছিলুম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত— আমি কত দূরদূরান্তের কত দেশদেশান্তরের জলস্থল পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম, তখন শরত্সূর্যালোকে আমার সর্বাঙ্গে যে একটি আনন্দরস একটি জীবনশক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত অর্দ্ধচেতন এবং অত্যন্ত একান্তভাবে সঞ্চারিত হতে থাকত তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে। আমার এই যে মনের ভাব এ যে প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত পুলকিত সূর্যসনাথা আদি পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং ঘাসের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে— সমস্ত শস্যক্ষেত্র রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থরথর করে কাঁপচে।’ (ছিন্নপত্র)
উপনিষদে দীক্ষিত, প্রাণিত রবীন্দ্রনাথ জগৎকে তো কোনওভাবেই মিথ্যা বলে ত্যাগ করেননি। বরং বিশ্বব্যাপী অখণ্ড চৈতন্যের সূত্র ধরেই যেন তাঁর মনে পড়ল আদিম ভুবনের কথা, মনে পড়ল পৃথিবীর আদিমকালেও তিনি মিশে ছিলেন বিশ্বের প্রাণের উৎসে। পৃথিবীর অন্তরে যে আদি রসধারা তার সঙ্গেও যেন এক হয়ে ছিলেন তিনি। তিনি নিজেও অনন্তের মধ্যে প্রবাহিত। বিশ্বের অন্তরে যে প্রাণের বীজ নিহিত আছে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতো আমাদেরও যোগসূত্র কখনও ছিন্ন হয় না। জড় পৃথিবীর সঙ্গেই আমাদের প্রাণের উৎস লীন হয়ে রয়েছে— এ-কথা সমর্থন করে বিজ্ঞান। সেই লীনতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যেন নিজেও ছিলেন অব্যক্ত, অর্ধচেতন জীবনীশক্তি হয়ে— এই অনুভব রবীন্দ্রনাথের গহন বিশ্ববোধের কেন্দ্রে। যদি তিনি কখনও অস্পষ্টভাবেও এই ভাবনাকে মনের মধ্যে আশ্রয় দিতেন যে জগৎ মিথ্যা, মায়া, তা হলে সেই জগতের সঙ্গে তাঁর নিগূঢ় সম্পর্কের কথা এমনভাবে লিখতে পারতেন কি? আরও একটি চিঠিতে লিখছেন তিনি জগতের সঙ্গে, তার প্রাণ উৎসের সঙ্গে বহু যুগের গভীর সম্পর্কের উপলব্ধ সত্যের কথা—
‘বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে মাথা তুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করচেন, তখন আমি এই পৃথিবীর নতুন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলুম।… তখন আমি এই পৃথিবীতে আমার সমস্ত সর্বাঙ্গ দিয়ে প্রথম সূর্যালোক পান করেছি: নবশিশুর মতো একটা অন্ধ জীবনের পুলকে নীলাম্বরতলে আন্দোলিত হয়ে উঠেছিলুম, এই আমার মাটির মাতাকে আমার সমস্ত শিকড় দিয়ে জড়িয়ে এর স্তন্যরস পান করেছিলুম।’
যে-জগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের শিকড় প্রসারিত যুগযুগান্তরে, যে-জগতের প্রাণের উৎসের সঙ্গে তাঁর কত জন্মের নাড়ির সম্পর্ক, যে-জগতের প্রাণরস তিনি সেই আদিকাল থেকেই যেন পান করছেন জননীর স্তন্যদুগ্ধের মতো— সেই জগৎকে মায়া বা মিথ্যা বলে ত্যাগ করা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে কোনওদিনই সম্ভব হয়নি। বরং তাঁর গানে গানে জগৎ সম্পর্কে তাঁর প্রাণের যে-কথা বারবার উৎসারিত হয়ে উঠেছে, তা হল, ‘জগত জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে, সে গান কবে গভীর রবে বাজিবে হিয়া-মাঝে।’ এই জগৎ একই ব্রহ্মের বহুপ্রকাশ, এ কথা যেন আমরা কখনও ভুলে না যাই। এ-জগতের সমস্ত কিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত রয়েছে সৃষ্টির উৎস, সেই আদিসত্তা— এ-কথা যেন আমরা আমাদের মধ্যে সহজভাবে অনুভব করতে পারি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে বললেন এই কথাই— ‘রয়েছ তুমি এ-কথা কবে জীবনমাঝে সহজ হবে,/ আপনি কবে তোমারি নাম ধ্বনিবে সব কাজে।’ আর একটি গানে উপনিষদের প্রাণের কথা, তাঁর নিজের বিশ্ববোধের কোরকটি তুলে ধরলেন রবীন্দ্রনাথ—
জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।
ধন্য হল, ধন্য হল মানবজীবন॥
রবীন্দ্রনাথ যে-জগৎকে সত্য বলে গ্রহণ করলেন, বলতে পারলেন চোখে যদি সত্যের আলো জ্বলে ওঠে তা হলে জগৎকে আর কোনওভাবেই মিথ্যা বলা যায় না, সেই জগৎকে সত্য বলে গ্রহণ করতে আমাদের বাধা কোথায়? তবু ব্রহ্মকে আমরা দ্বিধাহীনভাবে সত্য বলেও জগৎকে সত্য বলতে প্রাণের দ্বিধা আমরা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারি না। তার কারণ শংকরাচার্যের এই প্রচার— ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা! যদি একবার সংস্কারের আঁধার সরে যায় চোখ থেকে তা হলে আমরাও রবীন্দ্রনাথের প্রাণের গানের সঙ্গে সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত ভালবাসার সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে পারব—
আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো।
আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো॥
সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা,
যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো॥
এ জগৎ সেই এক, অদ্বিতীয় আদিসত্তা ব্রহ্মের প্রকাশ— এই সত্যটুকু কত সহজে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে দিলেন আমাদের কাছে—
তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ।
তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান।
তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে,
হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো॥
ডারউইনের বৈজ্ঞানিক এবং উপনিষদের দার্শনিক বোধ বিশ্বপ্রাণপ্রবাহের যে-নিরবচ্ছিন্নতার, যে-অখণ্ডতার কথা আমাদের বলছে, সেই বাণী আবার অনুরণিত রবীন্দ্রনাথের ‘বসুন্ধরা’ কবিতায়—
তোমার মৃত্তিকা-সনে…
আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে
অশ্রান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ
সবিতৃমণ্ডল, অসংখ্য রজনীদিন
যুগযুগান্তর ধরি আমার মাঝারে
উঠিয়াছে তৃণ তব, পুষ্প ভারে ভারে
ফুটিয়াছে, বর্ষণ করেছে তরুরাজি
পত্রফুলফল গন্ধরেণু।
জগৎকে ত্যাগ করার কথা নয়, জগতের সঙ্গে মিশে থাকার কথা আরও একবার এইভাবে বললেন রবীন্দ্রনাথ। উপনিষদের ঋষির মতোই তিনিও অনুভব করেন এই সত্য যে বিশ্বব্যাপী চৈতন্যস্রোতের সঙ্গে তাঁর আত্মার কোনও ভেদ নেই। মহাসৃষ্টির যে আদিউৎস মহাবিশ্বের সর্বত্র বিরাজ করছে সেই আদিজ্যোতির মধ্যে তিনিও যুগে যুগে অভিষিক্ত। মহাবিশ্বের আদিসত্তার সঙ্গে অভিন্নতাবোধ থেকে উপনিষদ বলছে, ‘আনন্দরূপম অমৃতম’। এই আদিজ্যোতি বা উৎসই আমাদের সকলের ভিতর সদা সন্নিবিষ্ট। জগৎকে মিথ্যা বা মায়া না বলে যদি এই আদিউৎস বা জ্যোতির সঙ্গে আমরা উপলব্ধি করতে পারি আমাদের নিবিড় ও নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ, তা হলে আমরা স্বাদ পাব মৃত্যুর মধ্যে অমৃতের, অন্ধকারের মধ্যেও আলোর, দুঃখের মধ্যেও আনন্দের, বিচ্ছেদের মধ্যেও মিলনের। এ-বিশ্বাস উপনিষদ থেকে নেমে এসেছে রবীন্দ্রনাথে। তিনি লিখলেন—
আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই,
জানি আমি তার সাথে আমার আত্মার ভেদ নাই।
হয়তো এক ধরনের অহংবোধ থেকেই এই জগৎকে মিথ্যা বলা সম্ভব। জগৎ প্রজ্ঞাবানদের জন্যে নয়, জগৎ জ্ঞানীদের জন্যে নয়— জন্য সাধারণ মানুষের জন্যে যারা জগতের মায়ায় ভুলে থাকে— এইরকম ভাবনা থেকেই হয়তো জগৎকে মিথ্যা জ্ঞানে শংকরের ত্যাগের দর্শন গড়ে উঠেছিল। সে কথা আমরা বলেছি আগেই। সেই অহংবোধ থেকেই মুক্তি চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বেরোতে চেয়েছেন ‘আমির আবরণ’ থেকে। ‘আমার আবরণ’ স্খলিত হয়ে গেলে জেগে ওঠে চৈতন্যের শুভজ্যোতি— একমাত্র যার মধ্যেই সম্ভব উৎসের সঙ্গে একাত্মবোধ। জীবনসত্যের এই উপলব্ধি জগৎকে মিথ্যাজ্ঞানে ত্যাগ করে সম্ভব নয়।
এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক;
চৈতন্যের শুভ্রজ্যোতি
ভেদ করি কুহেলিকা
সত্যের অমৃত রূপ করুক প্রকাশ।
সর্বমানুষের মাঝে
এক চিরমানবের আনন্দকিরণ
চিত্তে মোর হোক বিকিরিত॥
এখানে প্রসংগত মনে পড়ছে আইনস্টাইনের স্বপ্নের কথা। আইনস্টাইনও ভেবেছিলেন, যেন উপনিষদের প্রতিধ্বনি করেই, মহাবিশ্বে সমস্ত বলক্ষেত্রই এক। এদের পার্থক্য শুধুই আপাত। কিন্তু আসলে এরা আলাদা নয়। অর্থাৎ মহাবিশ্ব জুড়ে প্রকৃতির যে লীলা চলছে আপাতভাবে তার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে পৃথক পৃথক বলক্ষেত্র, কিন্তু তাদের সবার একই উৎস। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘দ্যুলোকের ভূলোকের সম্মিলিত মন্ত্রণার বলে’ (জন্মদিন ২৫) যেন সম্ভব হয়েছে পৃথক পৃথক বলক্ষেত্রের এই একই উৎস। আইনস্টাইন বিজ্ঞানের ভাষায় বলছেন, এমন একটি ইউনিফায়েড ফিল্ড থিয়োরি থাকা উচিত যার দ্বারা ক্ষেত্রগুলির একতাসাধন সম্ভব হবে। রবীন্দ্রনাথ যেন ইউনিফায়েড ফিল্ডকেই বলছেন, ‘দ্যুলোকের ভূলোকের সম্মিলিত মন্ত্রণার বলে।’ রবীন্দ্রনাথের মতো আইনস্টাইনও প্রত্যয়ী এমন এক মহাবিশ্বে যাকে সহজে বোঝা যায়, যার বোধগম্যতা কোনও জটিলতার দ্বারা বিঘ্নিত নয়। যার সুন্দর সহজতা মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো, অনুভব করার মতো। সহজ করে বিশ্বকে দেখার, বোঝার, অনুভব করার কথা নানাভাবে ভঙ্গিতে ব্যঞ্জনায় রবীন্দ্রনাথও বলেছেন। বিশ্বের এই নিহিত সহজতায় এতটাই বিশ্বাস করতেন আইনস্টাইনও যে তিনি জীবনের শেষ তিরিশটা বছর কাটালেন এমনই এক সহজভাবে বোধগম্য মহাবিশ্বের সন্ধানে। মহাবিশ্বের সহজতার সূত্রের আভাস পেয়েছিলেন আইনস্টাইন। সে-জগৎ দূরের নয় উপনিষদের ধ্যানের জগৎ আর রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির জগৎ থেকে।
ভাবতে অবাক লাগে, উপনিষদ এবং রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভাবনায় কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে এই একবদ্ধ আদিক্ষেত্রের ভাবনা। বিজ্ঞানে এই ভাবনাটির ক্রমিক উন্মোচন ঘটছে যুক্তি ও প্রমাণযোগ্য আবিষ্কারের পথে। আর উপনিষদ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে ধ্যান ও উপলব্ধির আলোয়।
উপনিষদের মূল বক্তব্য কী? বিশ্বসত্তা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের মধ্যেই। বিশ্ব হল সৃষ্টি। আর ব্রহ্ম হল স্রষ্টা। এই সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক এতই নিবিড় যে এরা পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মহাবিশ্বের মধ্যে সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছে এই আদিসত্তা, এই উৎস বা স্রষ্টা। এই উৎসই ধারণ করছে জগৎকে, আবার একই সঙ্গে সবকিছুর অন্তরে অধিষ্ঠিতও রয়েছে। উপনিষদ এই কথাটি জোরের সঙ্গে বলেছে যে ব্রহ্ম শুধু মহাবিশ্বের স্রষ্টাই নয়, ব্রহ্ম এই বিশ্বজগতের উপাদানও। আমি যদি একটি মাটির বাটি তৈরি করি, সেই মাটির বাটির স্রষ্টা আমি আর উপাদান মাটি। কিন্তু ব্রহ্মের সৃষ্ট জগতে ব্রহ্মই উপাদান। মহাজগতে সৃষ্টি ও স্রষ্টা পরস্পরে মিশ্রিত। ব্রহ্মই তাই বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে যোগসূত্ররূপে বিরাজমান। অপার বিস্ময় জাগে মনে, যখন ভাবি কোন আদি যুগে প্রাচীন ভারতের ঋষিরা ভাবতে পেরেছিলেন এমন একটি বিজ্ঞানসমর্থিত সত্য!
কিন্তু সেই আদিযুগে ভারতবর্ষের প্রাচীন ঋষিরা কেমন করে বুঝতে পারলেন, বলতে পারলেন মহাবিশ্বের নিয়ামক শক্তি মহাবিশ্বের মধ্যেই সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছে? উপনিষদ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছে, নিয়ামক শক্তি হিসেবে ব্রহ্ম জগতে দুইভাবে কাজ করছে। এক, ব্রহ্মের শক্তিতে ও চালনায় সমগ্র বিশ্ব বিধৃত ও নিয়ন্ত্রিত। দুই, ব্রহ্মই বিরাজমান বিভিন্ন জীবের মধ্যে তাদের অজানিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে। দেহ পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তন হয় বাইরের আকার। কিন্তু চরম সত্য হল, এই অন্তর্নিহিত নিয়ামক সত্তা, যাকে ব্রহ্ম বলা হচ্ছে উপনিষদে, সেই সত্তা নিত্য ও মৃত্যুহীন অর্থাৎ অমৃত।
বিজ্ঞানের আবিষ্কারের আর উপনিষদের ধ্যানের আলোয় আমরা আজ বুঝতে পেরেছি মহাবিশ্বের যে আপাত জটিলতা, যাকে বলা হয় যেন মহাসৃষ্টির ছলনা, তা নিতান্তই উপরের রূপ। মহাবিশ্বের অন্তরে প্রবেশ করলে আমরা বুঝতে পারি বিভিন্ন রূপে একই আদিউৎসের প্রকাশ ঘটেছে— মহাবিশ্বের এই হৃদয়সত্যে কোথাও নেই মিথ্যা, কোথাও নেই মায়ার ছলনা।
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর আটদিন আগে, ১৯৪১-এর ৩০ জুলাই তাই লিখলেন জগতের সব আপাত বিচিত্র ‘ছলনাজাল’ পেরিয়ে তাঁর অন্তরের সুন্দর সহজ সত্যরূপের কথা।
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী!
কিন্তু যখন চোখের সামনে থেকে আড়াল সরে যায় জগতের ভিতরের সহজ সুন্দর রূপটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। তাঁর জীবনের শেষ লেখাতেও রবীন্দ্রনাথ বলে গেলেন:
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।
চিরদিনের জন্যে জ্ঞান হারাবার আগে রবীন্দ্রনাথ আবার জগৎ সম্পর্কে বলে গেলেন তাঁর একটি জীবনবিশ্বাসের কথা:
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
…
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
বিজ্ঞানের আলোয়, উপনিষদের দীক্ষায়, রবীন্দ্রনাথের প্রণোদনায় এই জগৎকে এবার যেন আমরা মনে প্রাণে সত্য বলে গ্রহণ করতে পারি।
১. আহমেব বাত ইব প্র বাম্যারমাণা ভুবনানি বিশ্বা।
পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যৈতবতী মহিনা সং বভূব॥
অর্থাৎ আমিই সকল ভুবন নির্মাণ করতে করতে বায়ুর ন্যায় বহমান হই। আমার মহিমা এমনই বিপুল যে তা ক্রমাগত বাড়ছে, দ্যুলোককেও পেরিয়ে যাচ্ছে।