তোমার আসা চাই
ঠিক এইভাবেই সিদ্ধার্থকে বলত নিনি। যেন জন্মদিনের পার্টিতে ওকে ইনভাইট করছে।
বিয়ের আগে যখনই রাস্তাঘাটে, মেট্রো রেলের কাউন্টারের সামনে, কিংবা সিনেমা হলে সিদ্ধার্থর সঙ্গে ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকত তখন এইভাবেই জোর দিয়ে বলত নিনি। অথচ ও নিজেই দেরি করে আসত—সবসময়। এ নিয়ে সিদ্ধার্থ কিছু বলতে গেলেই হাউমাউ করে বাধা দিয়ে বলত, ‘মেয়েদের ওরকম একটু দেরি হয়। পরে আসব না তো কি আগে এসে ভোম্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব!’
এখন অন্ধকারে বসে সেসব কথা মনে পড়ছিল আর চোখের কোণে জল আসছিল। আজ আসবে তো সিদ্ধার্থ? নাকি আসবে না?
ঘরের এককোণে ধূপ জ্বলছিল। অন্ধকারে উজ্জ্বল লাল ডগাগুলো গুনল নিনি। তেরোটা। সাগরিকা বলেছে, ‘তেরোটা ধূপ জ্বালালে ভালো হবে। বেশ স্পিরিট-ফ্রেন্ডলি অ্যাটমসফিয়ার তৈরি হবে।’
নিনির সামনে গোলটেবিল। টেবিলের ঠিক মাঝখানটিতে একটা লম্বা মোমবাতি। একপায়ে দাঁড়িয়ে জ্বলছে। সেই মলিন আলোয় কালচে টেবিলের কাঠ অল্পসল্প চকচক করছিল। সেখানে একটা সাদা কাগজ পাতা, তার ওপরে ধ্যাবড়া করে খানিকটা সিঁদুর মাখানো। আর সেই সিঁদুরের ওপরে ত্রিভুজের চেহারার সাজানো তিনটে কড়ি। কড়ির গায়ে মোমের আলো হাইলাইট তৈরি করছে।
নিনির বাঁ-পাশ থেকে সঙ্গীতা ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই, নড়িস না। কনসেনট্রেট কর। একমনে সিদ্ধার্থর কথা ভাব…।’
টেবিলটাকে ঘিরে বসে আছে ওরা চারজন।
নিনি, সাগরিকা, সঙ্গীতা আর সন্দীপন।
আজকের মেইন আইডিয়াটা সন্দীপনের। তাতে ওর বউ সঙ্গীতা, আর নিনির বেস্ট ফ্রেন্ড সাগরিকা উৎসাহের ইন্ধন জুগিয়েছে। নিনির একেবারেই মত ছিল না। কিন্তু তিনজনের চাপের কাছে ও শেষ পর্যন্ত হেরে গেছে।
সিদ্ধার্থ অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে আজ কতদিন? কুড়ি পেরিয়ে একুশদিন।
চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। রাত তখন বড়জোর এগারোটা। নিনিও ছাদে ছিল। আকাশের তারা উড়ে যাওয়া এরোপ্লেনের আলো দেখছিল। একইসঙ্গে ছুটে আসা বাতাসের আদর উপভোগ করছিল।
হঠাৎ কী যে হয়ে গেল! একটা আচমকা আর্ত চিৎকার: ‘নিনি—!’
চমকে ঘুরে তাকিয়েছিল। অন্ধকার পাঁচিলের ওপরে সিদ্ধার্থের সিলুয়েট আর দেখা যাচ্ছে না। সিগারেটের আগুনের বিন্দুটাও আর নেই।
ছুটে পাঁচিলের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়েছিল নিনি। অনেক নীচে, গুলি খাওয়া বেলে হাঁসের মতো, এলোমেলো হয়ে পড়ে পড়ে আছে সিদ্ধার্থ।
নিনির মাথাটা কেমন পাক খেয়ে গিয়েছিল। শুধু মনে আছে, ছাদে লুটিয়ে পড়ার আগে ও আকাশের তারা দেখতে পেয়েছিল।
সেইদিন থেকে সংসারে নিনি একা হয়ে গেল। বাবা চলে গেছেন সেই কোন ছোটবেলায়। মা-ও চলে গেছেন চারবছর আগে। ভাই-বোন কেউ ছিল না। তাই শুধু সিদ্ধার্থকে জড়িয়ে ও বেঁচে ছিল।
অন্ধকারে একটা খসখস আওয়াজ হল।
সঙ্গে-সঙ্গে সন্দীপনের চাপা গলা শোনা গেল, ‘কেউ কি এসেছেন?’
চাপা কাশির শব্দ শোনা গেল।
নিনির হাতের ওপরে সঙ্গীতার হাতের চাপ বেড়ে গেল। ডানদিকে বসা সাগরিকার শুধু হাতের চাপ বাড়ল না, হাতটা তিরতির করে কাঁপতেও লাগল।
‘কেউ কি এসেছেন?’ আবার সন্দীপন।
কাপড়ে কাপড়ে ঘষার শব্দ হল। অচেনা একটা গলা অস্পষ্টভাবে ‘হুঁ’ বলে উঠল।
নিনি ভয় পেয়ে গেল। যদিও প্ল্যানচেট-ফ্যানচেটে ওর এতটুকুও বিশ্বাস নেই। সে-কথা ও বারবার বলেছে। কিন্তু ওরা তিনজন শুনলে তো!
সন্দীপন একই প্রশ্ন তৃতীয়বার এবং চতুর্থবার করল, কিন্তু আর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
ঘরের চতুর্দিকে তাকাল নিনি। মোমের আলোর পরিধি পেরিয়ে ঘরের অন্ধকার আনাচেকানাচে ওর সন্ধানী চোখ ঘুরে বেড়াল। কোনও অস্বাভাবিক বাড়তি ছায়া কি নজরে পড়ছে?
সিদ্ধার্থর চলে যাওয়াটা খুব দুঃখের হলেও তার মধ্যে একটা সান্ত্বনার ছোঁয়া আছে। কয়েকদিন আগে ওকে খুশি রাখার চেষ্টা করতে-করতে সাগরিকা হঠাৎ বলে ফেলেছে, ‘শোন, সিদ্ধার্থর ব্যাপারটা খুব স্যাড মানছি—বাট এটা তো ঠিক যে, এখন তুমি ব্যাপক বড়লোক। লাইফে সেফটির জন্যে টাকা একটা মেজর ফ্যাক্টর। সিদ্ধার্থর সবকিছু তো তুই-ই পাবি। যে যাওয়ার সে গেছে—কিন্তু তোমার মুখের রুপোর চামচ কেউ কেড়ে নিতে পারবে না…।’
না, সাগরিকা কিছু ভুল বলেনি। সিদ্ধার্থর সাম্রাজ্য নেহাত ছোট ছিল না। কিন্তু বিয়ের পর থেকে নিনির কোনও স্বপ্নকে আমল দেয়নি ও। ওর কাছে জীবন বলতে ভালো থাকা-খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, গাড়ি, বাড়ি, হইহুল্লোড়, ফুর্তি—ব্যস।
অথচ নিনির আরও পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল, ছবি আঁকা শিখে বড় পেইন্টার হওয়ার সাধ ছিল। ও ভেবেছিল, আমেরিকার গিয়ে এই সাধগুলো ও পূরণ করবে, কিন্তু হয়নি। সিদ্ধার্থ ওর ইচ্ছেগুলোয় সায় দেয়নি। বরং ওর পেইন্টার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কখনও-সখনও বাজে ঠাট্টা করেছে। ওর সঙ্গে এ নিয়ে তর্কাতর্কিও করেছে নিনি। তারপর তর্ক থেকে ঝগড়া।
কিন্তু শুধু এই সমস্যাটুকু ছাড়া সিদ্ধার্থর আর কোনও সমস্যা ছিল না। হি ওয়াজ আ গুড হাজব্যান্ড।
হঠাৎই ফিসফিসে গলায় কে যেন টেনে-টেনে উচ্চারণ করল, ‘নি—নি—।’
নিনির গায়ে কাঁটা দিল। এই প্রথম ওর মনে হল ও যেন প্রাণ খুলে সিদ্ধার্থকে বলতে পারছে না, ‘তোমার আসা চাই!’ বরং যেন মনে হচ্ছে, এই অন্ধকার ঘরে ও যেন না আসে। ও যদি প্রেতলোকে এখন থেকে থাকে তা হলে সেখানেই থাক। কিন্তু সিদ্ধার্থ কি এখন নিনির কথা শুনবে? ও কি নিনির চিন্তা টের পাচ্ছে?
আবার পা টেনে চলার ঘষটানির শব্দ। এবং হালকা অস্পষ্ট গলায় কে যেন বলল, ‘নিনি। নিনি—আমি এসেছি।’
নিনির মনে হল, এই কাঁপা-কাঁপা ফিসফিসে স্বর যেন অন্য কোনও হিমশীতল জগৎ থেকে ভেসে আসছে।
কিন্তু এ অসম্ভব! নিনি ভালো করেই জানে ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই। ওরকম যা-কিছু শোনা যায় সবই মনের ভুল—দেখা কিংবা শোনার ভুল। এখনও যে-কথাগুলো শুনছে সবই হ্যালুসিনেশান।
‘নিনি…নিনি…আমি…আমি এসেছি…।’
সঙ্গে-সঙ্গে তীব্র ভয়ের চিৎকার।
মেয়েলি গলায় ওদেরই কেউ চিৎকার করেছে। মনে হল, চিৎকারটা নিনির ডানদিক থেকে এল।
চিৎকারের তীব্রতায় নিনি আঁতকে উঠল। সন্দীপন হঠাৎই জোরালো গলায় বলল, ‘কোনও ভয় নেই। কোনও ভয় নেই। আমি আলো জ্বালছি…।’
আলো জ্বলে উঠল।
সাগরিকা মুখে হাত চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সঙ্গীতা আর সন্দীপন ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
হঠাৎই সন্দীপন দু-হাতের একটা ভঙ্গি করে বলল, ‘ও. কে. বাবা! সরি। সরি এভরিবডি, সরি। ওইসব ভূতের আওয়াজ আমি করেছি। আর নিনির নাম ধরে ফিসফিস করে ভুতুড়ে কথাগুলো আমিই বলেছি। স্রেফ মজা করার জন্যে—আর নিনিকে আওয়াজ দেওয়ার জন্যে। ও সবসময় বলে ভূত বলে কিছু নেই।’ সাগরিকার মাথায় হাত বোলাল সন্দীপন: ‘সাগরিকা, কাম ডাউন লেডি। আই সেইড আই অ্যাম সরি…।’
নিনি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এতক্ষণ ওর কেমন যেন দম আটকে আসছিল।
শেষ পর্যন্ত বহু তোয়াজ করে সাগরিকাকে শান্ত করা গেল। সন্দীপন মজা করে এ-কথাও বলল, ‘আচ্ছা, এবার চুপ কর—তোকে একটা এক্সটা-লার্জ ক্যাডবেরি খাওয়াব।’
প্ল্যানচেট-পর্ব এভাবেই শেষ হল।
একটু পরে ওরা তিনজন চলে গেল। আড়াইহাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটে নিনি এখন একা। গেস্ট বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ও গোলটেবিলটার দিকে তাকাল। নিভিয়ে দেওয়া মোমবাতিটা একপায়ে দাঁড়িয়ে। ধূপকাঠিগুলো জ্বলে-জ্বলে শেষ হয়ে গেছে। সিঁদুর মাখানো কাগজ আর কড়িগুলো এখন কত নিরীহ দেখাচ্ছে।
সন্দীপনটা বরাবরই একটু ফাজিল। প্র্যাকটিক্যাল জোক করে অন্যকে হেনস্থা করে। তবে মানুষটা ভালো। হয়তো নিনির মন ভালো করার জন্যই ও এরকম একটা ভয়ের নাটক করেছে।
গেস্ট বেডরুমের আলো নিভিয়ে দিল নিনি। বাইরে বেরিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
লম্বা করে একটা শ্বাস ফেলল। এখন ও কত একা! কিন্তু একইসঙ্গে কত স্বাধীন!
গুনগুন করে দু-লাইন গান গাইল নিনি। অতীত এখন অতীত। এখন ওকে তাকাতে হবে ভবিষ্যতের দিকে। ওর ইচ্ছেগুলো এখন ইচ্ছেমতো ডানা মেলতে পারে।
হঠাৎই দরজায় নক করার শব্দ শুনতে পেল।
চমকে উঠল নিনি। আওয়াজ লক্ষ করে ফিরে তাকাল।
গেস্ট বেডরুমের দরজার ওপাশ থেকে কেউ আলতোভাবে নক করছে। ঠক-ঠক। ঠক-ঠক।
নিনির নার্ভ মোটেই কমজোরি নয়। ও একটুও ভয় পেল না। উলটে বন্ধ দরজাটার খুব কাছে এগিয়ে গেল।
দরজাটা খুলবে না কি?
আবার নক করার শব্দ।
তারপর ফিসফিসে গলায় কেউ ডেকে উঠল, ‘নিনি, আমি এসেছি—।’
সন্দীপন কি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থেকে মজা করছে?
অসম্ভব! কারণ, ওরা তিনজন অনেকক্ষণ আগে চলে গেছে। নিনি ওদের ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে। তারপর নিজের হাতে দরজা লক করেছে। এতে কোনও ভুল নেই, ভ্রান্তি নেই।
আবার ডাকল সে, ‘নিনি, দরজা…খোলো। আমি…আমি এসেছি…।’ যন্ত্রণায় কাতর একটা মানুষ হাঁপাতে-হাঁপাতে শ্বাস টেনে-টেনে কথা বলছে।
নিনি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
‘তুমি তো সবসময় বলতে, ”তোমার আসা চাই।” তাই আমি এসেছি। দরজা খোলো, নিনি—তোমার সঙ্গে কথা আছে…।’
নিনি একটু ভয় পেল এবার। উদভ্রান্ত চোখে চারপাশে তাকাল। কী করবে ভেবে পেল না।
নক করার শব্দ ক্রমশ জোরালো হতে লাগল। হতে-হতে সেটা ধাক্কায় বদলে গেল।
‘নিনি! নিনি!’
গলাটা এবার সিদ্ধার্থর মতো লাগছে না?
এখন নিনি কী করবে? চিৎকার করবে? অন্য ফ্ল্যাটের লোকজনদের ডাকবে?
‘কে? কে তুমি?’ নিনি মরিয়া হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
‘নিনি, তুমি দরজা না খুললে…আমি…দরজা…ভেঙে…।’
‘না! তুমি সিদ্ধার্থ নও! তুমি…তুমি…।’
‘হ্যাঁ, আমি সিদ্ধার্থ। আমি জানি…সেদিন রাতে…ছাদে স্মোক করার সময়…কে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আর তুমিও সেটা ভালো করে জানো, নিনি। আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ এ-কথা জানে না। এবার বিশ্বাস হল তো! নাউ বি আ গুড গার্ল…অ্যান্ড ওপেন দিস ড্যাম ডোর, উইল ইউ?’