তোজো

তোজো

নবুর বড় ভয়। বেজায় গরিব এখানকার লোকরা; খেতে পায় না, পরতে পায় না, মাটি দিয়ে, উলু-ঘাস দিয়ে উল্টোনো ঝুড়ির মতো কীসব বানায়, অনেকে তাকেই বলে ঘর। যাদের কুঁড়ে-ঘর আছে, তারা তো বড়লোক, গ্রামের মাতব্বর। হবে না গরিব? শুকনো খরা মাটি, কত কষ্টে ফসল ফলাতে হয়। তার ওপর একেক বছর বৃষ্টি হয় না; সব রোদে পুড়ে খাক হয়ে যায়। আবার মাঝে মাঝে এদিকে খরা, কিন্তু পুন্নি নদীর উৎস যেখানে পাহাড়ের ওপরে, সেখানে মেঘ জমে বৃষ্টি পড়ে; নদীতে ঢল নামে। মানুষ গোরু ভেসে যায়। এখানকার লোকে ভালো হবে কী করে? দিন-রাত রামুদা এই কথা বলে। যারা রাতে দরজা বন্ধ করে শোয়, নবুর ফুটবল-মাঠের বন্ধুরা তাদের ওপর হাড়ে চটা। বলে, “টাকার গরম দেখাচ্ছ বুঝি? আমাদের কিচ্ছু নেই, তাই দরজা খুলে শুতেও ভয় নেই। তোমরা কবাট দাও, হুড়কো আঁটো, চেষ্টা করেও কেউ ঢুকতে পারে না।— তাই রাতে পথের মধ্যে একা পেলেই ধরে। খেলার মাঠ থেকে কক্ষনো একলা ফিরো না। আমাদের চাচা-মামারা জানতে পারলে—” এই বলে তারা মুখ বন্ধ করে। নবু ভয়েই আধ-মরা। সব দিন সঙ্গী কোথায় পাবে? কলকাতার বাড়িতে যারা কাজ করত, তাদের ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাইকে। বাবার অসুখ করেছে, কাজ করতে পারে না, খালি খালি শুয়ে-বসে থাকে। মা রান্না করে। দাদুর বুড়ো চাকর বিশুকাকা এখানকার বাড়ি আগলায়। সে গ্রামের হাটে গিয়ে কেনাকাটা করে দেয় আর বুড়ো হাড় নিয়ে টিলার ওপর ওঠা-নামা করতে হয় বলে গজর-গজর করে। বনের মধ্যে কুঁড়ে ঘরে থাকে শিবু, সে কুয়ো থেকে ঠান্ডা মিষ্টি জল তুলে দেয় আর রান্নার কাঠ জোগায়। ওরা কাঠুরে। ওর ছেলে নটে মাঝে মাঝে নবুর সঙ্গে খেলার মাঠ থেকে ফেরে। ওর নবুর সমান বয়স, কিন্তু কী সাহস।

শিবু বলে, “আমাদের আবার কীসের ভয় দাদা? ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। খেতে পায় না লোকে, দুটো পয়সার আশায় চুরি-ডাকাতি করে। আমাদের কাঁচকলাটাও নেই, তাই ভয়টাও নেই।”

যারা টিলার ওপর থাকে, তাদের খেলার মাঠ থেকে ফিরতে একটু দেরি হবেই। কলকাতায় সারারাত আলো জ্বলত, লোকে কথা বলত, গির্জার ঘড়িতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় জানান দিত, সেখানে ভয়টা কীসের? বুনো জন্তুটন্তু নেই। এখানে হুতোম প্যাঁচা ডাকে বড় বড় বাদুর ওড়ে, চামচিকে ক্কিচ-ক্কিচ করে, ওরা ছোট ছেলেদের চোখ খুবলে নেয়। তাছাড়া চোর-বাটপাড় ডাকাত আছেই, বনের মধ্যে কাপালিক আছে— তারা ছোট ছেলে বলি দেয়— নবুর ভয়ের আর শেষ নেই। ভূতের ভয়, অন্ধকারের ভয়। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ঘোর অন্ধকার। পথে আলো নেই; পথ-ই নেই বলতে গেলে। গ্রামে আলো জ্বলে না। সেখানকার লোক বড় গরিব, তেল কেনার পয়সা নেই। আলো থাকতে থাকতে, মাঠ ঘাট থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে, যে যার শুয়ে পড়ে। মেয়েরা সব দিন রাঁধাবাড়াও করে না, অত চাল কোথায় পাবে? বুনো শাক-কন্দ সেদ্ধ দিয়ে আমড়া পাতা, তেঁতুল পাতা, কঁচালঙ্কা দিয়ে মেখে খায়। বলে, রান্না ভাত খায় স্বর্গের লোকেরা। তবে বুনো খরগোশ মারে, পাখি মারে, মাছ ধরে। কোনোরকমে বেঁচে থাকে। আনন্দও করে।

তাই বলে কি ওদেরও ভয় নেই? হায়না হুণ্ডারের ভয় আছে; বড় বড় খ্যাঁক-শেয়াল আসে। রাতে খ্যাক খ্যাক খ্যাক খ্যাক করে দল বেঁধে এসে হাঁস, মুরগি, শূয়োর-ছানা নিয়ে পালায়। ছোট ছেলেমেয়ে পেলে, তাও নাকি বাদ দেয় না। ওরা কুঁড়ে বাঁধে ভেতর দিকে মুখ করে, বাইরে দিকে যাওয়া আসার জন্য ছোট ছোট ঘুলঘুলি রাখে। গোল করে পর পর ঘর বানায়, মধ্যিখানের খোলা জায়গায় সারারাত ধুনি জ্বালে; পালা করে পাহারা দেয়; সবাই মিলে শুকনো কাঠ জোগায়। তবে আজকাল বুনো জানোয়ারের উপদ্রব কমে গেছে, কিন্তু তার চেয়েও শতগুণে ভয়ংকর মানুষেরা আছে। নবু সব্বাইকে ভয় করে।

খেলার মাঠের ছেলেরা নবুকে কাপ্তেন করে দিল। ওর বাবা ওদের একটা পুরনো কিন্তু ভালো ফুটবল দিয়েছিলেন, তাই। বাবা নামকরা প্লেয়ার ছিলেন। ভয়ংকর সাহস ছিল। তারপর পেটে বল লেগে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে এখন দু-বছর কোনো কাজ করতে পারেন না। কলকাতার বাড়িটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে, তাই দিয়ে ওদের চলে। টিলার ওপরে, সবচেয়ে উঁচুতে এই বাড়িটা দাদু বানিয়েছিলেন। এখানকার শুকনো বিশুদ্ধ হাওয়ায় নাকি ভাঙা স্বাস্থ্য জোড়া লাগে, জ্যাঠামশায় বলেছেন।

ঐ কাপ্তেন হওয়াই ওর কাল হয়েছে। ওর বন্ধু শম্ভু থাকে টিলা যেখানে উঠতে আরম্ভ করেছে, ঠিক সেইখানে। সেখানে অনেকগুলো বাড়ি। স্কুলের হেডমাস্টারের, ডাক্তারবাবুর, শম্ভুদের। সেখানে কোনও ভয় নেই। কিন্তু তার পরেই এঁকেবেঁকে পথ উঠে গেছে। তবে দু-ধারে ঘন বন। টিলার পেছনে হাতিয়া পাহাড়। টিলার ওপর দিয়ে হাতিয়া পাহাড়ে যাবার রাস্তা আছে। সে বড় ভয়ানক জায়গা।

শম্ভুদের চাকর রামুদা বলে, “খরার সময় বড় খারাপ নবুদাদা, চাঁদার পয়সাগুলো পকেটে নিয়ে চললে ঝিন্‌-ঝিন্ করে বাজে, সবাই টের পায়। খেতে না পেলে মানুষরাও নেকড়ে-বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। তা ছাড়া খরার সময় হাতিয়ার বন খালি করে হরিণরা দলে দলে নীচে নেমে আসে, গ্রামের লোকদের শস্যের ক্ষেত নষ্ট করতে। সবাই আসে টিলার পথ দিয়ে। তাই লোভে লোভে হায়না হুন্ডারও নেমে আসে। খুব সাবধানে পথ চল, দাদা, দুয়ের মধ্যে মানুষরাই বেশি হিংস্র।”

ভয়ে নবুর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়। কিন্তু কী আর করা। শম্ভু বলে, “তুমি আমাদের বাড়িতে বসে পড়াশুনো করতে তো পার। রাতে রামুদা কাজ সেরে তোমাকে পৌঁছে দেবে।” রামুদা ফোঁস করে ওঠে, “রাতে ঐ গলায়-দড়েদের বনের পাশ দিয়ে একা ফিরতে আমি পারব না। জীবনবাবু তো অর্ধেক বাড়ি ভাড়া দিতে চায়, তোমার মা-বাবাকে নেমে আসতে বল না।”

নবু আস্তে আস্তে বলল, “টিলার ওপরে পরিষ্কার শুকনো হাওয়ায় থাকলে বাবার শরীর ভালো হবে। ঠিক আছে, এইটুকু তো পথ, আমি একলাই চলে যাব।”

রামুদা বলল, “তা যেতে পার। তবে মাঝপথের ঐ বড় অশ্বত্থ গাছে কিছু দেখলে ফিরে এস।” নবু দু-হাতে দু-কান চেপে ধরে ছুটে রওনা দিচ্ছিল, শম্ভু ওর হাত ধরে টেনে বলল, “কোনো ভয় নেই রে। একবার ‘তোজো’ বলে ডাক দিস, কোনো ভূত কিংবা মানুষ তোর কিছু করতে পারবে না।”

নবু বেজায় অবাক হয়ে বলল, “তোজো? তোজো কে?”

শম্ভু বলল, “বড়দের বলা বারণ, শেষটা যদি ধরিয়ে দেয়। তোজো একটা কুকুর। বাছুরের মতো বড়, ভীষণ হিংস্র, একেবারে বুনো হয়ে গেছে, বাঘের মতো ভয়ংকর।”

নবুর হতভম্ব মুখ দেখে শম্ভু ব্যস্ত হয়ে উঠল, “ভয় কীসের? ও ছোটদের কিচ্ছু করে না, ভয়ংকর ভালোবাসে। দাদা বলে যে, বনের মধ্যে নিশ্চয় ওর মালিক লুকিয়ে আছে। হয়তো পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউ তাকে দেখেনি। হাত-পা ভেঙে পঙ্গু হয়েও থাকতে পারে। তুই আবার যেন কারো কাছে বলিসনে। তাহলে ওকে পাগলা কুকুর বলে গুলি করে মেরে ফেলে দেবে আর মালিককে ধরে নিয়ে ফাঁসি দেবে। কে জানে হয়তো সে মরেই গেছে।”

নবু বলল, “তোজো যদি তেড়ে আসে?”

শম্ভু হাসতে লাগল, “না, না, তোর যত ভয়। ডাকলেই বন থেকে বেরিয়ে এসে, হাতের তেলোয় মুখ গুঁজে, মুখের দিকে চেয়ে, ল্যাজ নাড়ে। কিন্তু বড়দের দেখলে গলার মধ্যে মেঘের মতো গুড়-গুড় করে। বড় কেউ বোধ হয় ওর মালিকের খুব ক্ষতি করেছিল। তাই বড়দের দেখতে পারে না। তোর কোনো ভয় নেই।”

“ওর নাম জানলে কী করে?”

“গলায় একটা কলার আছে, তাতে লেখা আছে। ‘তোজো’ বলে ডাকলেই আসে। টিলার সব ছেলেমেয়েরা ওকে চেনে।”

নবুর বুক থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। ও কুকুর ভালোবাসে। বাবার বল লাগবার আগে কলকাতায় ওদের মস্ত কুকুর ছিল। ল্যাব্রাডর। তার নাম টাইগার। জ্যাঠা বাবার গাড়িটা আর টাইগারকে নাকি বেচে দেবেন। কলকাতার বাড়ি ভাড়া দিয়ে, ওরা এখানে চলে এসেছে। নবু এখানকার মিশনারী স্কুলে ভরতি হয়েছে। সবাই সেখানে পড়ে। স্কুল ছুটি হলে স্কুলের কাছে খেলার মাঠে খেলে। মাসে দশ পয়সা ক্লাবের চাঁদা। গরিবদের দিতে হয় না। বন্ধুরা সবাই নিচে থাকে। টিলার ওপর নবুরা একা।

এ-বাড়িটা দাদুর বাবা করেছিলেন। বাগানের এক কোণে তাঁর সমাধি আছে। তাতে মরা মানুষ নেই। খালি একটা ছোট্ট শ্বেত-পাথরের কৌটোয় এক মুঠো ছাই। এত বড় মরা মানুষটাকে পুড়িয়ে ফেললে সে একমুঠো ছাই হয়ে যায়।

টাইগার নবুর খাটের পাশে মাটিতে শুত। কিন্তু মা-বাবা শুতে গেলে হাঁচড়-পাঁচড় করে ওর খাটে এসে উঠত। বেড়াল দেখলে নবুর গা শিরশির করে, কিন্তু কুকুর বড় ভালোবাসে। তোজোর মুনিব যদি সত্যি মরে গিয়ে থাকে, তা হলে তোজো নবুদের বাড়িতে থাকবে না কেন? বেশ পাহারা দেবে। নবু নিজে তার যত্ন করবে, স্নান করাবে। বুকটা টিপ-টিপ করতে লাগল।

শম্ভুকে নবু জিজ্ঞাসা করল, “সব ছেলেপুলেই ওকে দেখতে পায়? কই, আমি তো দেখিনি।”

“না ডাকলে আসে না। মিছিমিছি ডাকলেও আসে না। ভয় পেয়ে ডাকলে তবে আসে।”

নবু তো হাঁ। ও তো সব সময়ই ভয় পায়। এমনকী রাতের অন্ধকারে তালগাছের পাতা খসার সময় যে একটা বিশ্রী প্যাঁ-শ করে শব্দ হয়, তাতেও ওর ভয় করে। তোজো সঙ্গে থাকলে আর করবে না। কিন্তু তোজোর কলারটা যদি ছিঁড়ে পড়ে যায়, তাহলে কী হবে? এখানে তো প্রত্যেক মঙ্গলবার কলার ছাড়া কুকুরদের রাস্তায় দেখলে মেরে ফেলা হয়। তাদের মধ্যে যদি পাগলা কুকুর থাকে, তাই। তোজোকে নতুন কলার কিনে দেবার পয়সা কোথায় পাবে? অবিশ্যি টাইগারের পুরনো কলারটা নবু লুকিয়ে নিয়ে এসেছে। সেটা নিশ্চয় তোজোর গলায় হবে।

তার পর থেকে নবু রোজ স্কুলে যাবার সময়, বনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিত, যদি তোজোকে দেখতে পায়। ডাকেনি কখনো; সে-রকম ভয় তো পায়নি, মিছিমিছি ডাকবে কেন? বনে ঢুকতে সাহস হত না। বড্ড নির্জন। গাছের তলা দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ, বাতাস বইলে গাছের পাতার মধ্যে ঝরঝর শব্দ, যেন উঁচু থেকে জল পড়ছে। কেমন ছায়ার মধ্যে কুচি কুচি রোদ। সব মিলে যেন ডাকে “এসো, এসো, এসো।” যায়নি কখনো। স্কুলের দেরিও হয়ে যাবে, আবার কেমন গা শিরশির করে। সে কি ভয়, না ফুর্তি, নিজেই ভেবে পেত না।

ফেরার সময় এক্কেবারে অন্য রকম। বাপরে কী অন্ধকার বন! ঝিন্-ঝিন্ করে কী সব ডাকে। অনেক দূরে যেন কুচি-কুচি কীসের আলো নড়েচড়ে। জোনাকির চেয়ে বড়। সেদিকে তাকাতে ভয় করত। বিশুকাকার বৌ বলে পরীদের দিকে দেখতে নেই। অমনি ভুলিয়ে নে যাবে আর ফিরতে পারবে না। সারাজীবন খালি বনের মধ্যে ঘুরবে, বেরুবার পথ পাবে না, ফিরে ফিরে এক-ই জায়গায় এসে পড়বে আর বাড়ির লোকদের মুখ দেখতে পাবে না। আজকাল তত ভয় লাগে না। তোজো যদি ঐ বনে থাকে, ডাকলেই কাছে আসে, তবে আর ভয় কীসের? কুকুররা মানুষদের বন্ধু। প্রাণ দিয়ে তাদের রক্ষা করে। টাইগার একবার— নাঃ, টাইগারের কথা ভাবলেই গলায় ব্যথা করে।

সেদিন বড্ড সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। বিশুকাকা স্টেশন থেকে কটা মাগুর মাছ কিনে দিল, বাবার জন্য। ওকে ওষুধ আনতে যেতে হবে, দেরি হবে। একটা ছোট্ট চুপড়িতে মাছ নিয়ে নবু টিলায় চড়তে লাগল। টিলার নিচে শম্ভুদের গেটের কাছে বিদায় নেবার সময় রামুদাদা একবার বলল, “হ্যাঁ দাদা, মাছ নিয়ে সন্ধ্যেবেলা একা গাছতলা দিয়ে যাবে, সেটা কি ঠিক হবে? মাছটা বরং রেখে দাও, ভোরে দিয়ে আসব।”

নবু বলল, “না, বাবা রাতে মাগুর-মাছের স্টু খাবে। তাতে গায়ে জোর হয়। আমিও একটু খাই। মা খায় না, মেয়েমানুষ কি না। ওদের জোর দিয়ে কী দরকার?” জোর করে হাসল নবু। ভেতরে ভেতরে ভয় করছিল। ভয় করলে ওর গা-বমি করত, পেট কামড়াত।

আরো কী বলতে যাচ্ছিল রামুদা, শম্ভু চটে গেল, “ভিতরে যাও তো, রামুদা, তুমি ভারি ইয়ে। এক দৌড়ে চলে যা রে নবু, কিচ্ছু হবে না।”

তাই করল নবু। তাড়াতাড়ি টিলায় উঠতে লাগল। মুখ বন্ধ করে, নাক দিয়ে নিশ্বাস নিতে হয় আর নিশ্বাসের তালে তালে পা ফেলতে হয়। তাহলে হাঁপ ধরে না।

ঝপ্‌ করে অন্ধকার। দু-পাশে বন আর মাথার ওপর ঘন কালো মেঘ। নিচে থেকে এতটা বোঝেনি নবু। পা চালিয়ে চলল। হঠাৎ সামনে কীসের ছায়া। সামনের দিকটা উঁচু, পেছনটা নিচু। মস্ত বড় হায়না নাকি? মাছের গন্ধ পেয়েছে বোধ হয়। গলা থেকে একটা চাপা খ্যাক খ্যাক শব্দ করতে করতে একটু করে এগিয়ে আসছে!

নবু ফিসফিস করে বলল, তোজো, তোজো, তোজো। অমনি বাঁ হাতের তেলোর মধ্যে নরম ঠাণ্ডা এ কার নাক? টাইগার আসবে কোত্থেকে? তাকে তো জ্যাঠা বেচে দিয়েছে এতদিনে। নবুর কান্না এল। তোজো, তোজো, তুই সত্যি এসেছিস? সামনের জানোয়ারটাও থমকে দাঁড়াল। কোথা থেকে মেঘের চাপা গর্জনের মতো শব্দ হতেই এক লাফে বনের মধ্যে হাওয়া। কখন হাতের তেলো থেকে ঠাণ্ডা নাকটা সরে গেল কিচ্ছু টের পায়নি নবু। ওই কি তোজো? নাকি নবু এমনি ভেবেছিল?

মা মাছ নিয়ে বলল, “অত হাঁপাচ্ছিস কেন? কিছু হয়েছে?”

“না। না, কিছু হয়নি। তাড়াতাড়ি উঠে এসেছি কি না।”

সেদিন থেকে ভয় ভেঙে গেল নবুর। রোজ ছুটতে ছুটতে ওপরে চলে আসত। কোনোদিকে তাকাত না। জানত বনের মধ্যে তোজো আছে। ডাকলেই আসবে।

এমনি করে দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। বাবা তখন অনেক ভালো। বারান্দায় এসে আরাম-চেয়ারে বসে বই পড়ে। নবুকে পড়ার কথা, খেলার কথা জিজ্ঞাসা করে। মাঝে মাঝে হাসে। ওখানেও চাঁদা তুলে পুজো হত। ক্লাবের ছেলেরা যে যা পারে সংগ্রহ করে কাপ্তেনের কাছে দিল। নবু এত পয়সা নিয়ে কী করবে ভেবে পেল না। শম্ভু বলল, “আজ রাতটা তোর কাছে রাখ, কাল সতীশবাবুর কাছে জমা দিয়ে দিস। উনিই তো পুজো কমিটির সেক্রেটারি।”

সঙ্গে সঙ্গে রামুদা বলল, “সাবধানে যেও বাপু। কালু মাস্টারের ডাকাতের দল ধরা পড়েছে বটে, কিন্তু কালু নিজে দুজন স্যাঙাৎ নিয়ে ঐ বনে লুকিয়ে আছে।”

শম্ভু বলল, “চোপ্‌।”

রামুদা চটে গেল, “চোপ্‌ তো কচ্ছি। কিন্তু গাঁয়ে ওই রকম গুজব। ওর মামার বাড়ি তো এখেনে। লুকিয়ে খাবার দিচ্ছে তারা। কিন্তু থাকার জায়গা কোথায় পাবে? নবুর আবার পকেটে পয়সা ঝিন্‌-ঝিন কচ্ছে!” নবু কিছু না বলে, পকেটে হাত দিয়ে পয়সার ঝিন্‌ ঝিন্‌ বন্ধ করে রওনা দিল।

তিন ভাগ পৌঁছে গেছিল নিরাপদে। তারপর যেখানে বন সবচেয়ে ঘন, সেখানে তিনটে লোক বেরিয়ে এসে পথ আগলাল। একজনের কপালে ফেট্টি বাঁধা, তাতে রক্তের দাগ। সকলে কী রকম রোগা, কালো ঘেমো, চকচকে চোখ। দেখেই ভয় করে। ঠোঁট নেই, শুধু একটা লাইনের মতো। যার মাথায় ফেট্টি বাঁধা, অন্য দুজন তাকে ধরে রেখেছিল।

“এ্যাই দাঁড়া!”

নবু দাঁড়িয়ে গেল।

“কোথায় যাচ্ছিস?”

“বাড়িতে।”

“কোথায় বাড়ি?”

“টিলার মাথায়।”

“কে আছে সেখানে?”

“মা-বাবা।”

“চাকরটা নেই?”

“না, সে ওষুধ আনতে গেছে।”

“তবে আর কী! তোকে বাড়ি যেতে হবে না। এখানে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখব। আমরা যাব তোর বদলে।”

নবুর ঠোঁট কাপতে লাগল, “তা হলে আমার বাবা তোমাদের…”

“তোর বাবা!” বলে সে যে কী বিশ্রী করে হাসল ওরা, শুনে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। “তোর বাবা তো ঘাটের মড়া। ভালোয় ভালোয় থাকতে দেয় তো ভালো। তা না হলে—”

নবু হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, “তোজো!” গলাটা কীরকম বিশ্রী ভাঙা ভাঙা শোনাল। সঙ্গে সঙ্গে বনের মধ্যে একটা হুড়মুড় শব্দ আর তারার আলোয় নবু দেখল, এই প্রকাণ্ড একটা কুকুর ছুটে এসে সেই লোকটার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেও তক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কপালে ফেট্টি-বাঁধা লোকটা আর অন্য লোকটা বিকট চিৎকার করতে করতে টিলার পথ ধরে দুদ্দাড় দৌড় দিয়ে একেবারে থানার দরজায় আছড়ে পড়েছিল।

নবু চেয়ে দেখল কেউ কোথাও নেই। ঐ লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর সে একা; হাতে মাছের চুপড়ি। তোজো কখন চলে গেছে। কিন্তু তারার আলোয় তাকে স্পষ্ট দেখেছিল নবু— বড়, কিন্তু অবিকল টাইগারের মতো দেখতে।

বাড়িতে গিয়ে জ্বর হয়েছিল নবুর। তারপর যখন ভালো হয়ে উঠল, দেখল জ্যাঠা এসেছেন। তাঁর সঙ্গে ও কি টাইগার নাকি? নবু ভুলে তাকে তোজো! তোজো! বলে ডেকে, গলা জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। টাইগারকে জ্যাঠা বেচে দেননি। বাবা নাকি ভালো হয়ে গেছেন। অ্যানুয়েল পরীক্ষার পর সবাই কলকাতায় ফিরে যাবে। নবুর মুখে তোজো শুনে জ্যাঠা বেজায় অবাক হয়ে বাবাকে বললেন, “শুনলি বটু, ‘তোজো’ বলে ডাকছে। আরে, তোজো যে আমার বাবার কুকুর ছিল। এই টিলার ওপরেই ঠ্যাঙাড়ের হাত থেকে বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিল!— ও কী হল?”

নবু গায়ের জোরে টাইগারকে জাপ্টে ধরে বলল, “না, না, এই তোজো! তোজো ছাড়া কেউ নয়।”

জ্যাঠা হেসে বললেন, “মনে আছে রে বটু, বাবা বলতেন তোজো বড়দের দেখতে পারত না, আর সব ছোটরা ওকে কী অসম্ভব রকম ভালোবাসত। ও মরে গেলে নাকি গাঁ সুদ্ধু ছেলেমেয়েরা সাত দিন কেঁদেছিল। ভাত খায়নি।”

নবু টাইগারের নাকে নাক লাগিয়ে ডাকল “তোজো!” আর টাইগার ওর হাতের তেলোয় নাকটা গুঁজে ল্যাজ নাড়তে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *