তেহেরানের স্বপ্ন

তেহেরানের স্বপ্ন

কটা বাজল?

মনীষা ঘুমিয়ে পড়েছিল, সেই ঘুমের মধ্যেই সে দেখতে পেল, বড়ো ঘড়ির কাঁটাটা এসে থামল পাঁচটার ঘরে, তারপর খ-র-র-র-র শব্দ, তারপর ঢং ঢং ঢং।

ধড়ফড় করে উঠে মনীষা ঘড়ি দেখতে ছুটে এল পাশের ঘরে। না, পাঁচটা বাজেনি, এখন তিনটে কুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে তার ভুরু কুঁচকে গেল। তিনটে কুড়ি! তাহলে টুম্পু এল না কেন? সে তো তিনটে পাঁচের মধ্যে রোজ এসে যায়।

মনীষা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তা দিয়ে অনেক রিকশা যাচ্ছে, তার মধ্যে বেশ কটিতেই স্কুল-ফেরত শিশুরা। ব্রিজের পাশ দিয়ে যে রিকশাটা বেঁকল, তার মধ্যে কি টুম্পু? না তো!

মনীষার কপালে এবার উদবেগের তিনটি রেখা। অথচ সে ঠিক ভয়ও পেতে চাইছে না। ভয় পেতেও ভয় করে। রিকশাওয়ালা অনেকদিনের চেনা। খুব বিশ্বাসী। সে কোনো গোলমাল করবে না। টুম্পুর স্কুল ছুটি হয় আড়াইটের সময়, প্রত্যেকদিন টুম্পু মোটামুটি আধঘন্টার মধ্যে ফিরে আসে।

যদি রিকশাওয়ালা আজ না গিয়ে থাকে? যদি তার অসুখ হয়? কিংবা অ্যাকসিডেন্ট?

তিনটে পঁয়ত্রিশ হবার পর মনীষা আর থাকতে পারল না। দ্রুত হাতে মাথায় চিরুনি চালাল, আটপৌরে শাড়িটাই ঠিক করে নিল একটু, তারপর হাতব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। দরজাটা বাইরে থেকে টানলেই তালা বন্ধ হয়ে যায়।

রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটছে, তখন মনীষার মুখ চোখ ঠিক কোনো পক্ষীমাতার মতন ব্যাকুল, তার বুক কাঁপছে। সামনে একটা ট্যাক্সি পেয়ে সে ঝট করে উঠে পড়ল। মাত্র মাইল খানেক দূরে স্কুল। তার গেট ফাঁকা। একটি ছাত্রীও নেই। দারোয়ান কিছু বলতে পারল না। না, দারোয়ান তো টুম্পুর কথা মনে করতে পারছে না। রোজ যেমন যায়, সেইরকমই গেছে নিশ্চয়ই। রিকশা না এলে নিশ্চয়ই সে দাঁড়িয়ে থাকত কিংবা কান্নাকাটি করত।

সেই ট্যাক্সি নিয়েই মনীষা ফিরে এল বাড়িতে। ভাড়া না দিয়ে ছুটে উঠে এল ওপরে। তারপর গম্ভীরভাবে নিশ্বাস ফেলল। বন্ধ দরজার সামনে বসে আছে টুম্পু, পা ছড়িয়ে, টপ টপ করে পড়ছে চোখের জল।

মনীষা এসে ছোঁ মেরে তাকে কোলে তুলে নিল। টুম্পু দাপাদাপি করে হেঁচকি তুলে কেঁদে কেঁদে বলল, তুমি দুষ্টু, তুমি চলে গিয়েছিলে…কেন? আমার খিদে পেয়েছে।

মনীষা চুমু দিয়ে তার কান্না মুছিয়ে দিয়ে বলল, তোমার এত দেরি হল কেন মামণি? আমি তো তোমাকেই খুঁজতে গিয়েছিলাম।

টুম্পু বলল, আমি আজ রিকশায় আসিনি। আমি মণিদীপার মায়ের সঙ্গে গাড়িতে এসেছি।

ব্যাগ খুলে চাবি বের করতে গিয়ে আর এক বিপত্তি। হুড়োহুড়িতে মনীষা চাবি নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল। এখন আর ঢোকা যাবে না।

এদিকে অধৈর্য ট্যাক্সিচালক নীচে হর্ন দিচ্ছে বারবার। টুম্পুকে কোলে নিয়ে মনীষা আবার নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। ট্যাক্সিতে উঠে বলল, শিগগির চলুন। যোধপুর যাব।

যে-কেউ দেখলে ভাববে, মনীষা বুঝি অন্য কারুর মেয়েকে চুরি করে পালাচ্ছে। ভুলো মন বলে মনীষা একটা চাবি রেখে গিয়েছে মায়ের কাছে। গত মাসেও এরকম একবার চাবি আনতে হয়েছিল। এখন যদি সে যোধপুর পার্কে গিয়ে দেখে মা বাড়ি নেই, সিনেমা দেখতে গেছেন কিংবা বেড়াতে গেছেন নিজের বাপের বাড়ি, তাহলেই সর্বনাশ। এদিকে পাঁচটার মধ্যে আসবে মনীষার ছেলে শান্তনু। সেও যদি এসে দেখে দরজা বন্ধ, তাহলে তুলকালাম কাণ্ড বাধাবে।

রাত্রে খাবার টেবিলে রজতের সঙ্গে এটাই হল প্রধান আলোচনার বিষয়। জানো আজ কী হয়েছিল—এই বলে চোখ বড়ো বড়ো করে শুরু করল মনীষা। রজত শুনে গেল নিঃশব্দে। খাওয়ার সময় তার বই পড়ার অভ্যেস। বই থেকে সে চোখ তুলল না।

মনীষার কথার মাঝপথে হো হো করে হেসে উঠল রজত। তারপর বলল, তোমরা মেয়েরা…সত্যি…সারাদিন কোনো কাজ নেই…তাই সামান্য ব্যাপার থেকেই…তুমি যদি আর মাত্র পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে, তাহলে এসব কিছুই ঘটত না।

মনীষা রেগে গিয়ে বলল, বাঃ, সাড়ে তিনটে বেজে গেল, তখনও টুম্পু আসছে না!

রজত বলল, এক কাজ করলেই তো পারো। দুপুরবেলা তুমিই তো রোজ টুম্পুকে আনতে যেতে পারো, শুধু শুধু না ঘুমিয়ে।

আমি আর কতক্ষণ ঘুমোই? বড়ো জোর একঘন্টা তাও রোজ হয় না।

আমরা সেসময় অফিসে কাজের চাপে পাগল হয়ে যাই, আর তোমরা দিব্যি ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে পাখা চালিয়ে—

রাধার মা ছুটি নিয়ে সেই যে দেশে গেল, এখনো এল না, আমাকে বেরুতে হলে দরজা বন্ধ করে বেরুতে হয়।

সেটা আর এমন কী শক্ত ব্যাপার! অবশ্য যদি রোজ রোজ চাবি নিতে ভুলে যাও আর ট্যাক্সি করে তোমার মায়ের কাছ থেকে চাবি আনতে যেতে হয়, তাহলে খরচ পোষাবে না।

ও, টাকা খরচটাই তোমার গায়ে লাগছে। ঠিক আছে, কাল থেকে আমি যাব, তাতে টুম্পুর জন্য তোমার রিকশা ভাড়াটাও বাঁচবে!

আমি সেকথা বলিনি। টুম্পুকে নিয়ে তুমি রিকশা করেই আসবে, অনেক মা-ই তো বাচ্চাদের আনতে যায়।

সত্যি, তুমি অনেক পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করো, আর আমি তোমার টাকা বাজে খরচ করে উড়িয়ে দিই।

আরে কী মুশকিল। এসব কথা উঠছে কেন! আমি কখন বললাম যে তুমি বাজে খরচ কর?

নিশ্চয়ই বলেছ। আমি আমার মায়ের বাড়িতে ট্যাক্সি করেও যেতে পারব না? ঠিক আছে, এবার থেকে হেঁটেই যাব।

শোনো মনীষা, খাওয়ার সময় মিছিমিছি ঝগড়া করলে খাওয়া হজম হয় না। একটু শান্তিতে বসে খাও।

তুমি খাও, যত ইচ্ছে শান্তিতে বসে খাও!

মনীষা নিজের থালা ঠেলে উঠে চলে গেল। রজত দুবার ডাকল। মনীষা, মনীষা! সাড়া না পেয়ে সে নিঃশব্দে আবার নিজের খাবারের থালায় মন দিল। ধীরে সুস্থে সব শেষ করে সে বাথরুমে হাত ধুতে এসে দেখল, মনীষা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

রজত বলল, কী যে ছেলেমানুষি করো। এই—কী হল?

রজত মনীষার কাঁধটা ছুঁতেই সে মুখ ফিরিয়ে শুকনো গলায় বলল, কিছু হয়নি! ছাড়ো!

বেশ কিছুক্ষণ পরে, রান্নাঘর গুছিয়ে মনীষা যখন শোবার ঘরে এল, রজত তখন ঘুমিয়ে পড়েছে।

মনীষার ঘুম ভাঙে সকাল ছটায়। ওই সময় ঠিকে ঝি আসে, দরজা খুলতে হয় মনীষাকেই। আগে রাঁধুনি ছিল তখন অসুবিধে ছিল না। কিন্তু রাঁধুনি দেশে পালিয়েছে, সে ফিরবে কিনা ঠিক নেই, এদিকে নতুন লোকও পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গিয়েছিল চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি ছেলে। কিন্তু বাড়িতে চবিবশ ঘন্টার জন্য পুরুষলোক রাখতে রজতের ঘোর আপত্তি। সে বলে , বিদেশে আজকাল কোনো বাড়িতেই ঠাকুর-চাকর থাকে না। আর তোমরা শিক্ষিত মেয়ে হয়েও বাড়ির রাঁধুনি কয়েকদিনের ছুটি নিলে রেগে যাও। আমরা যে অফিস থেকে এক মাসের ছুটি নিই?

অফিসের কাজে রজত একবার মাত্র আড়াই মাসের জন্য বিলেত গিয়েছিল। তারপর থেকে সে কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ দেয়।

রজত আরও বলে, একটা চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলে সারাদিন বসে বসে রান্না করছে—এই দৃশ্যটাই খারাপ। অমানবিক!

নারীবর্ষের জের টেনে মনীষা এই তর্ক করেছিল রজতের সঙ্গে।

সে যা-ই হোক, এখন সকালের চা করতে হচ্ছে মনীষাকেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে চা খাওয়ার আনন্দ সে আর পায় না।

রজত অফিসে বেরিয়ে যায় সাড়ে নটার সময়। সেই সময় সে টুম্পুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যায়। সুতরাং সকাল ছটা থেকে সাড়ে নটার মধ্যে এক মিনিট নিশ্বাস ফেলার সময় থাকে না মনীষার মনীষার, টুম্পুকে তৈরি করাও এক বিরাট ঝামেলা। কিছুতেই সে স্নান করতে চায় না। তাকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বাথরুমের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হয়।

বাবলু স্কুলে যায় সাড়ে দশটায়। সে রোজ হাঙ্গামা বাধায় খাওয়া নিয়ে। চোদ্দ বছর বয়েস ছেলের। এর মধ্যেই খাওয়া নিয়ে নানা রকম বাছ-বিচার। কোনো মাছই তার পছন্দ নয়। সে মাংস ভালোবাসে। কোন বাড়িতে রোজ রোজ মাংস রান্না হয়?

ঠিক সাড়ে দশটার সময় বাবলুর এক স্কুলের বন্ধু নীচতলা থেকে চেঁচিয়ে ডাকে, শান্তনু—শান্তনু!

অমনি অর্ধেক খাওয়া হলেও তা ফেলে রেখে উঠে পড়ে বাবলু। হাত ধুয়েই নীচের দিকে দৌড়ায়। রোজ রোজ যদি এরকম আধপেটা খেয়ে যায়, তাহলে কি আর স্বাস্থ্য ভালো হবে?

এরপর ফ্ল্যাট ফাঁকা। ঠিকে ঝি আজকাল আরেকবার এসে তরকারি কুটে বাসন মেজে দিয়ে যায়। মনীষা বাকি রান্না, বিকেলের জলখাবার এমনকি রাত্তিরেরও দু-একটা পদ রেঁধে রাখে। এতেই বেজে যায় একটা দেড়টা। স্নান করতে যাবার সময় একটু মুস্কিল। ওই সময় কেউ এলে দরজা খুলে দেওয়া যায় না। অথচ মনীষা স্নান করতে ঢুকলেই কেউ না কেউ আসবে। হয় মুরগিওয়ালা, নয়তো পোস্টম্যান অথবা পাশের বাড়ির কেউ। ঝনঝন করে কলিং বেল বাজতেই থাকে। বাথরুমের দরজা বন্ধ থাকলে বেলের আওয়াজ শোনা যায় না, তাই সে বাথরুমের দরজা খুলেই স্নান করে।

সবচেয়ে খারাপ লাগে একলা বসে খেতে। আগে টুম্পু থাকত, এখন সেও স্কুলে যায়। কী তীব্র নিঃসঙ্গ দুপুর। শুয়ে শুয়ে বই পড়তে গেলে ঘুম আসে। সেই ঘুম গাঢ় হবার আগেই টুম্পু আর বাবলু ফিরতে শুরু করে।

মনীষা সাইকোলজি নিয়ে এম. এসসি পাস করেছিল, আর কিছু কাজে লাগে না! শুধু স্কুল ফাইনাল পাস করলেই বা কী ক্ষতি ছিল। কেন খেটেখুটে এতখানি পড়াশোনা করতে গেল? বাড়ির রান্না আর ছেলেমেয়েকে স্নান করিয়ে খাইয়ে স্কুলে পাঠানোর জন্য এম. এসসি পাস করার দরকার হয় না।

প্রায়ই মনীষা বলে, সে একটা চাকরি করবে।

রজত জবাব দেয়, করো না, কে আপত্তি করেছে?

টুম্পু জন্মাবার আগে মনীষা কিছুদিন একটা স্কুলে পড়িয়েছিল। সেটা ছিল মর্নিং স্কুল। এখন তার পক্ষে মর্নিং স্কুলের কাজ করা সম্ভব নয়। বাড়িতে রান্নার লোক যদি থাকেও। ছেলেমেয়ে দুটোর পড়াশোনাও তো একটু দেখিয়ে দিতে হয়। রজত ও সব কিছু করবে না। দশটা পাঁচটার সুবিধে মতো চাকরি কে-ই বা দিচ্ছে মনীষাকে। রজত কিছু চেষ্টা করে না। তার মনে মনে খুব ইচ্ছে নয়, মনীষা চাকরি জগতে যাক। সে চায় মনীষা বাড়িতে থেকে ছেলেমেয়েদের মানুষ করুক। রজতের সম্প্রতি চাকরিতে উন্নতি হয়েছে। চাকরিতে উন্নতি মানেই অফিসের কাজে আরও বেশি আত্মবিক্রয়। সাড়ে নটায় বেরোয়। ফেরে সেই প্রায় সাড়ে নটায়। তখন সে ক্লান্ত হয়ে থাকে। প্রায়ই মনীষার সঙ্গে তার হুঁ হাঁ ছাড়া কোনো কথাই হয় না। চাকরিতে এবার উন্নতির পর থেকেই রজত ডিসপেপসিয়ায় ভুগছে।

সন্ধেবেলায় ছেলেমেয়েদের পড়তে বসায় মনীষা। বাবলুর জন্য একজন মাস্টারমশাই রাখতে হয়েছে, তিনি সপ্তাহে তিনদিন আসেন। বাবলুটার পড়াশোনাতে মাথা থাকলেও দারুণ ফাঁকিবাজ। মাস্টারমশাই যেসব দিন আসে না, সেসব দিন সে নিজের পড়ার বই ছুঁয়েও দেখে না। খালি গল্পের বই, তাই সব সময় নজর রাখতে হয় মনীষাকে।

ছেলে মেয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি! তারপর মনীষাকে প্রতীক্ষায় বসে থাকতে হয়, কখন রজত আসবে। এক একদিন রজতের ফিরতে সাড়ে দশটা এগারোটাও হয়ে যায়, মনীষা ঘুমোতে পারে না। কে দরজা খুলবে? তা ছাড়া সারাদিন খেটেখুটে বাড়ি ফেরার পর রজত তো আর নিজের খাবার নিজে নিয়ে খাবে না?

মনীষা প্রায় ভাবে, এই কি তার জীবন? শুধু ছেলেমেয়েদের মানুষ করা আর স্বামীর জন্যে প্রতীক্ষা করে বসে থাকা? আগেকার দিনে মেয়েরা এতেই সন্তুষ্ট থাকত। অবশ্য তখন ছিল একান্নবর্তী পরিবার, সারাদিন আরও অনেকের সঙ্গে গল্প, হাসি ঠাট্টা, না হোক ঝগড়াঝাঁটি কিছু একটা করে সময় কাটত। এখন মনীষা দিনের অধিকাংশ সময়ই নিঃসঙ্গ। মেয়েদের জীবনে কি আলাদা কিছু করবার নেই? সেদিন বেলা সাড়ে এগারোটায় দারুণ মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে এল মনীষা। হাতের ব্যাগটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে সে নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল। সে কি অনেক বদলে গেছে? কপালে কোঁচকানো দাগ দেখা যাচ্ছে? দু-এক প্যাকেট বিস্কুট আর কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে বেরিয়েছিল মনীষা। চেনা স্টেশনারি দোকান, একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বসেন সেখানে। আজ সেখানে বসেছিল একটি কুড়ি একুশ বছরের ছেলে। খুচরো পয়সা ফেরত দেবার সময় সেই ছেলেটি বললে, এই নিন মাসিমা!

মাসিমা?

মনীষা একেবারে চমকে উঠেছিল। দোকানদাররা তাকে দিদি বলে সব সময়। আজ সে হঠাৎ মাসিমা হয়ে গেল কী করে? সে কি বুড়ি হয়ে গেছে? বিরক্ত মুখে মনীষা বেরিয়ে এসেছিল দোকান থেকে।

কিন্তু এক একদিন পরপর দুর্ঘটনা ঘটে। পাড়ার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকটি ছেলে। সকলেরই মুখ চেনা। তার মধ্য থেকে দুটি ছেলে এগিয়ে এসে বলল, সামনের সোমবার সকালে কিন্তু আমরা সরস্বতী পুজোর চাঁদা আনতে যাব মাসিমা।

মনীষার মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। গত বছরেও এই ছেলেরা তাকে বৌদি বলেছিল। এক বছরের মধ্যে এদের চোখে সে মাসিমা হয়ে গেল? নাকি গত বছর অন্য ছেলেরা এসেছিল?

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনীষার মনে হল, সে সত্যিই বুড়ি হয়ে গেছে। তার বয়েস ঠিক তখন পঁয়তিরিশ। একসময় সুন্দরী হিসেবে তার নাম ছিল। স্কুলে তার সঙ্গেই পড়ত বন্দনা সেন, সে এখনও সিনেমায় নামকরা নায়িকা, এখনও সে কলেজের মেয়ে সাজে, মানিয়েও যায়। অথচ কলেজে সবাই বলত বন্দনা সেনের চেয়ে মনীষা মুখার্জি অনেক বেশি সুন্দরী। সেই বন্দনা এখনও যুবতি রয়েছে, আর মনীষা হয়ে গেল মাসিমা?

মন খারাপের জের রয়ে গেল বেশ কয়েকদিন। একদিন সকালে রজত দেখল রান্নাবান্না ছেড়ে মনীষা আয়নার সামনে বসে কাঁদছে।

রজত বলল, এ কী ব্যাপার! তুমি নাটক করছ নাকি?

রজত সবসময় আজকাল একটু খোঁচা দিয়ে কথা বলে। একসময় তাকে কত ভালোবাসত রজত। রাস্তা দিয়ে চলার সময় কেউ মনীষার গায়ে একটু ধাক্কা দিলে রেগে আগুন হয়ে মারতে যেত তাকে। মনীষার একটু অভিমান হলে রজত সেদিন অফিসেই যেত না।

মনীষা বলল, তুমি চাও আমি পাগল হয়ে যাই কিংবা মরে যাই?

রজত বলল, আমি এরকম অদ্ভুত জিনিস চাইতে যাব কেন? তুমি পাগল হলে বা মরে গেলে—দুটোতেই আমার দারুণ ঝামেলা।

তুমি শুধু নিজের ঝামেলার কথাই ভাবো, আর কিছুই ভাবো না!

লক্ষ্মীটি, সকালবেলাতেই এত রাগ কেন? কী হয়েছে খুলে বলো তো?

আমার দিকে একটু চেয়ে দেখার সময় নেই তোমার। তুমি দেখতে পাও না যে আমি বুড়ি হয়ে গেছি?

বুড়ি? কে বললে? এখনো রাস্তায় বেরুলে সবাই তোমার দিকে তাকায়।

মোটেই না। সেদিন একজন দোকানদার আমাকে মাসিমা বলেছে।

রজত হো হো করে হেসে উঠল।

মনীষা আরও রেগে গিয়ে বলল, তুমি হাসছ?

হাসব না? কোন দোকানদার তোমাকে মাসিমা বলেছে, সেইজন্য সকালবেলা আমি বকুনি খাব? সেইজন্য সকালবেলা তুমি পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে?

আমি সত্যিই তো বুড়ি হয়ে গেছি। আমার কপালে একটা দাগ পড়েছে।

কই আমি তো দেখতে পাচ্ছি না! শোন, পঁয়তিরিশ বছর বয়সে কি আর ষোল বছরের মতন চেহারা থাকে? সব বয়েসেরই একটা আলাদা সৌন্দর্য থাকে। আমিও কি আর আগের মতো যুবক আছি?

কিন্তু বন্দনা সেন, সে আমারই বয়েসি।

তুমিও সিনেমায় নামো। মেক-আপ টেক-আপ নিয়ে তোমার বয়েসও অনেক কম দেখাবে।

খানিকটা বাদে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে রজত বলল, মনি, আর একটা কাজ করতে পারো। তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে কারুর সঙ্গে প্রেম করা শুরু করে দাও! নতুন প্রেমে পড়লে বয়েস অনেক কমে যায়।

মনীষা বলল, তুমি কারুর সঙ্গে প্রেম করছ বুঝি।

আমার সময় কোথায়? সারাদিনই তো খেটেখুটে মরছি। সময় থাকলে নিশ্চয়ই প্রেম করতাম। দেখলে না মাথায় টাক পড়ে যাচ্ছে আমার? নতুন কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে টাক পড়ত না, ব্লাড কোলেস্টেরল হত না। প্রেমে পড়লে শুনেছি হার্ট অ্যাটাকও হয় না। তোমার তো সারাদিনে অঢেল সময়—কারুর সঙ্গে জমিয়ে ফেল। আমি দুপুরে বাড়ি থাকি না। তোমার অনেক সুবিধে। কথা দিচ্ছি, কোনোদিন হঠাৎ অসময়ে বাড়ি ফিরে তোমায় চমকে দেব না।

চুপ করো, বাজে কথা বলো না।

আমি সিরিয়াসলি বলছি!

আহা, এমনি এমনি বুঝি কারুর সঙ্গে প্রেম করা যায়? আমি কোথাও যাই? কারুর সঙ্গে মিশি? রাস্তায় গিয়ে লোককে ডেকে ডেকে বলব ওগো তোমরা কেউ আমার সঙ্গে প্রেম করবে? প্রেম করবে?

রজত আবার হাসতে হাসতে বলল, তাহলে মন্দ হয় না ব্যাপারটা!

অফিসে বেরুবার সময়ও রজত দেখল মনীষার মুখ থমথমে। ছেলেমেয়েদের লুকিয়ে সে মনীষাকে একবার জড়িয়ে ধরে বলল, মনি, আমার ওপর এত রেগে আছ কেন? এই যে আমি এত খাটছি, এ কি আমার নিজের জন্য? তোমার জন্য নয়? তুমি যা চাও, তাই দিয়েছি। তোমার কোনো অভাব রাখিনি। যাদবপুরে জমি কিনে রেখেছি, সামনের বছরে বাড়ি শুরু করব, তুমি যেমন চাও, ঠিক সেই রকম। তোমার সময় কাটে না, আগামী মাসে একটা টি ভি কিনছি।

নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মনীষা বলল, আমি ওসব কিছু চাই না। কিচ্ছু চাই না। আমাকে একটা নতুন জীবন দাও—

সেদিনই দুপুরে খেতে বসে, কাগজ পড়তে পড়তে চোখে পড়ল একটা খবর, বন্দনা সেন বিলেতে যাচ্ছে। আবার রাগ হয়ে গেল মনীষার। বন্দনা এই নিয়ে কতবার বিদেশে গেল? অথচ সে যেতে পারবে না। তার রূপ বা গুণ কোনোটাই কি কম ছিল?

শনিবার মনীষার দিদি জামাইবাবুদের বাড়িতে নেমন্তন্ন। কিন্তু রজত যেতে পারবে না। তার অফিসের কোন সাহেব আসছে, সেইজন্য তাকে যেতে হবে এয়ারপোর্টে। ফিরতে ফিরতে সেই রাত এগারোটা।

ছেলেমেয়েকে নিয়ে মনীষা একাই গেল। অনেক লোকজন এসেছে। তার মধ্যে একটি মেয়ে কী সুন্দরী! চবিবশ পঁচিশ বছর বয়েস, মুখ দিয়ে যেন একটা দীপ্তি বেরুচ্ছে। মনীষার দিদি হঠাৎ বলল, বিয়ের ঠিক আগে মনীষাকেও দেখতে এই রকম ছিল।

মনীষা বলল, যাঃ, মোটেই না। ও অনেক বেশি সুন্দরী।

গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মনীষা। ওই বয়েসটা তো সে আর কোনোদিন ফিরে পাবে না!

মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হল। ওর নাম দেবযানী। বয়েস অত কম নয়। মেয়েটি নিজেই বলল, ওর বয়েস আটাশ। বিয়ে হয়েছে দু-বছর আগে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই থাকে তেহেরানে।

মনীষার জামাইবাবু বললেন, ওর কাছে তেহেরানের অনেক গল্প শুনছিলাম। দারুণ ব্যাপার বুঝলে! স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে, মাইনে পায় ডলারে। ফ্রি এয়ার কন্ডিশানড বাংলো, ফ্রি গাড়ি—খরচই নেই। ওরা তো টাকা জমিয়ে একবার বিলেত-ফ্রান্স ঘুরে এল।

মনীষা জিজ্ঞেস করল, আপনারা দুজনেই ওখানে একসঙ্গে চাকরি পেয়েছেন?

দেবযানী বললেন, না, প্রথমে ও একলাই চাকরি নিয়ে গিয়েছিল। আমি একলা একলা সারাদিন থাকতাম। তাই ভাবলাম, বসে থেকে কী করব। একটা স্কুলে চাকরি নিয়ে নিলাম।

ওখানে বুঝি সহজেই চাকরি পাওয়া যায়?

হ্যাঁ। এখন তো আমাদের দেশ থেকে অনেকেই যাচ্ছে। ওরা ইন্ডিয়ানদের বেশ পছন্দ করে।

জামাইবাবু বললেন, বুঝলে না, পেট্রোলের টাকা, অঢেল টাকা। কী করে খরচ করবে ভেবে পায় না। বহু লোক নিয়ে যাবে এদেশ থেকে।

মনীষা জিজ্ঞেস করল, আমি চাকরি করতে পারি? আমার একটা এমএসসি ডিগ্রি আছে।

দেবযানী বেশ আগ্রহের সঙ্গে বললেন, তাহলে তো আপনি নিশ্চয়ই পাবেন। অন্তত স্কুলে তো পাবেনই!

কত মাইনে?

আমাদের টাকার হিসেবে প্রায় চবিবশশো টাকা। তাছাড়া বাড়ি ফ্রি। বছরে একবার যাতায়াতের ভাড়া।

জামাইবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তেহেরানে যাবে ভাবছ নাকি?

মনীষা মুচকি হেসে বলল, ভাবছি। গেলে মন্দ হয় না।

তোমার তিনটি ছেলেমেয়েকে কার কাছে রেখে যাবে?

তিনটি?

বাঃ, রজতও তোমার ছেলেরই মতন। তোমাকে ছাড়া নিজে কিছু করতে পারে না। গেঞ্জি আন্ডারওয়্যার কোথায় থাকে, তার খবরও রাখে না পর্যন্ত।

আহা-হা! তখন রাখবে। আমি এতদিন ছেলেমেয়ে দেখাশোনা করেছি, এবার কিছুদিন ও করুক।

দেবযানী বলল, ওখানে গেলে কিন্তু তিন বছরের কন্ট্রাক্টে যেতে হবে। তার আগে কাজ ছেড়ে দিলে টাকা ফেরত দিতে হয়।

জামাইবাবু হাসিঠাট্টা করে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেন।

পরদিন সকালে মনীষা রজতকে বললে, আমি যদি তেহেরান যাই, তোমার আপত্তি আছে?

রজত আকাশ থেকে পড়ল, তেহেরান? সেখানে তুমি হঠাৎ যাবে কেন? যাবেই-বা কী করে?

মনীষা হাসতে হাসতে বলল, চাকরি নিয়ে যাব। ইচ্ছে করলেই সেখানে চাকরি পেতে পারি।

তাই নাকি? ইচ্ছে করলেই পেতে পারো?

হ্যাঁ মাইনে কত জানো? চবিবশশো টাকা! ডলারে পেমেন্ট। ওই টাকা জমিয়ে বিলেত ফ্রান্স ঘুরে আসতে পারি। কি—যেতে দেবে?

দু-এক মুহূর্ত মাত্র চুপ করে থেকে রজত বললে, তোমার যদি ইচ্ছে হয় যাবে। তোমার কোনো ইচ্ছেতে আমি বাধা দিয়েছি?

মন থেকে বলছ?

নিশ্চয়ই!

ছেলেমেয়েদের কী হবে?

আমি দেখব ওদের।

হুঁ তুমি দেখবে ছেলেমেয়েদের। তোমার সময় কোথায়?

একজন বয়স্কা মহিলা রেখে দেবো, যে ওদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা দেখাশোনা করবে! একটু ভোর ভোর উঠে আমি ওদের পড়াব। চেষ্টা করব, অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে।

এখন ফেরো না কেন তাড়াতাড়ি?

এখন ফিরি না, কারণ ওদের দেখাশোনা করবার জন্য তুমিই তো আছ।

ছেলেমেয়েদের দেখাশোনাটাই বড়ো কথা? শুধু আমার জন্য বুঝি তাড়াতাড়ি ফিরতে পারো না?

সোনা, অফিসে যখন খুব কাজ থাকে, তখন কি আমি বলতে পারি যে আমার স্ত্রী বাড়িতে অপেক্ষা করছে, আমাকে চলে যেতে হবে? বিয়ের তেরো চোদ্দ বছর পর এ কথাটা বলা যায় না, ন্যাকামির মতো শোনায়। কিন্তু মা বাড়িতে নেই, ছেলেমেয়েরা একলা রয়েছে, এজন্য কাজ ফেলেও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যায়। দুদিন হয়তো একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যায়।

দুদিন হয়তো একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে, তারপর আড্ডায় মেতে আবার ভুলে যাবে।

না, ভুলে যাব না। তা ছাড়া, আমাদের চাকরিতে কিন্তু লোকের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াও একটা কাজ।

আমি যদি যাই, ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাব?

অসম্ভব! ওদের পড়াশোনা নেই? ছেলেটা ক্লাস এইটে উঠেছে, এখন একদিনও ওর পড়াশোনা নষ্ট করা উচিত নয়।

টুম্পু। টুম্পু যদি যায়? ও আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না।

টুম্পুকে নিয়ে যেতে পারো। ও ছোটো আছে।

তখনকার মতন কথাবার্তা সেইখানেই থেমে রইল। মনীষা অন্যদিনের মতন মেয়েকে স্নান করিয়ে রজতকে খাবার সাজিয়ে দিল। অন্যদিনের চেয়ে সেদিন একটু গম্ভীর মনে হল রজতকে। কথাবার্তা তার ঠিকঠাকই আছে, কিন্তু মুখে যেন একটা পাতলা ছায়া।

দুপুরবেলা কিছুতেই ঘুম এল না মনীষার। গুমোট গরম পড়েছে দুদিন ধরে। পাখার হাওয়াতে ঘাম শুকোয় না। …ইরান দেশটাও খুব গরম নিশ্চয়ই। হোক না গরম, এয়ারকন্ডিশানড বাড়ি…দেবযানী বলেছিল, ওখানকার স্কুল হয় সকাল আটটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত, এসময় ছুটি…ওদেশের খাবার-দাবার কেমন হয় সে জানে…মনীষা নিজেরটা নিজেই রান্না করে নেবে, দারুণ চাল পাওয়া যায়। দেবযানী বলেছিল দুধ, মাখন সব খুব সস্তা…টুম্পুর স্বাস্থ্যটা যদি ফেরে…তার পর এক ছুটিতে প্যারিসে ঘুরে আসা…ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল একবার প্যারিস যাওয়ার…

বিকেলবেলা বাবলু স্কুল থেকে ফেরার পর, তাকে জলখাবার দিয়ে মনীষা জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে বাবলু, আমি যদি তিন বছরের জন্যে বাইরে কোথাও যাই, তুই বাবার কাছে থাকতে পারবি?

একটু বাদে বাবলুর ফুটবল খেলার বন্ধুরা ডাকতে আসবে। তার আগে সে এইটুকু সময়ের জন্যই একটা গল্পের বই খুলে বসেছে। মায়ের কথাটার কোনো গুরুত্ব না দিয়েই সে বললে, হ্যাঁ পারব! তুমি কোথায় যাবে মা?

তেহেরান।

ও!

ও বললি যে? তুই জানিস তেহেরান কোথায়?

জানি। ইরানের রাজধানী।

আমি অতদূরে চলে গেলে তোর মন কেমন করবে না?

বাঃ—, মন কেমন করবে কেন? তুমি তো বললে তিন বছর পরে ফিরে আসবে। মনীষার মনটা একটু দমে গেল। বাবলু তার কথায় কোনো গুরুত্বই দিল না। একবার জানতে চাইলে না, মা কেন চলে যাবে! তার গল্পের বই আর বন্ধু-বান্ধবরাই এখন সব। অথচ মাত্র দু-বছর আগেও রাত্তিরে একটা না একটা গল্প না বললে বাবলু ঘুমোত না। ছেলেটা দূরে সরে যাচ্ছে, তিন বছর পর বাবলু আর তাকে চিনতে পারবে কিনা কে জানে!

মনীষা গাঢ় গলায় ডাকল, বাবলু।

এই ডাক শুনে বাবলু চমকে উঠে মুখ তুলে তাকাল।

মনীষা বুকের ভেতরকার বাষ্প চেপে রেখে বলল, বাবলু, তিন বছর পরেও যদি আমি ফিরে না আসি, যদি আমি মরে যাই, তোদের কোনো কষ্ট হবে না, না রে?

বাবলু বই ছেড়ে উঠে এসে মনীষার গলা জড়িয়ে ধরে বললে, মা তোমার কী হয়েছে? তোমার মন খারাপ হয়েছে?

যদি আমি মরে যাই?

ধ্যাৎ!

সেদিন রজত বাড়ি ফিরল রাত সাড়ে এগারোটার পর। অনেকখানি হুইস্কি খেয়েছে, চোখ লাল। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না।

মনীষা বলল, এই তোমার তাড়াতাড়ি ফেরার নমুনা? আজই কথা হল আর আজই তুমি দেরি করে ফিরলে?

রজত কড়া গলায় বললে, তাতে কী হয়েছে? তুমি তো আজই বাগদাদ না দার-এস-সালাম কোথায় যেন চলে যাওনি? আজ আমার দরকার ছিল তাই দেরি হয়েছে!

দরকার! রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত কারুর অফিসের দরকার থাকে? মুখে মদের গন্ধ! তোমাদের অফিসে কি আজকাল মদ্যপানও চলছে না কি !

রজত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, অফিসে বসে মদ খাব কেন? হোটেল হিন্দুস্থানে গিয়ে খেয়েছি, ক্যাবারে নাচ দেখেছি, কত বিল হয়েছিল জানো? চারশো দশ টাকা। তার ওপর চল্লিশ টাকা টিপস দিয়েছি। বিশ্বাস হচ্ছে না?

তোমার মতো মানুষের ওপর আমি ছেলের ভার দিয়ে যাব?

ছেলের জন্যে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না! সে আমি দেখব!

আজকাল বাড়ির কথা তুমি একটুও চিন্তা করো না। অফিসের কাজের নাম করে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বাইরে থাক, তারপর বাড়িতে এসে নির্লজ্জের মতন মাতলামি করছ।

বেশ করছি! হ্যাঁ, আমি নির্লজ্জই তো।

আমি, আমি…

এখন নাকি কান্না কেঁদো না। প্লিজ…

মনীষা বাথরুমে চলে গেল কাঁদতে। খানিক বাদে বেরিয়ে এসে দেখল রজত অঘোরে ঘুমোচ্ছে। গায়ের জামাটাও খোলে নি। উপুড় হয়ে মুখগুঁজে আছে বালিশে। মনীষা এসে বারান্দায় দাঁড়াল। রজতের জন্য সে এতক্ষণ না খেয়ে বসে ছিল। এখন আর তার খেতে ইচ্ছে করছে না। রজতকে এখন আর ডেকে লাভ নেই। বাইরের রাতটা ভারি সুন্দর। পাতলা ফিনফিনে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে আকাশে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস। মাত্র কয়েক বছর আগেও সে আর রজত রাতে খাওয়ার পর এই বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে অনেকক্ষণ গল্প করত। এখন গল্প তো দূরের কথা, সারাদিনে রজতের সঙ্গে দুটো-চারটের বেশি কথাই হয় না। রজত কত বদলে গেছে।

…তেহেরানের বাড়িটার রং কী হবে? সাদা? সাদা রঙই মনীষার পছন্দ। সাদা ছিমছাম, একতলা বাড়ি। সামনে একটা ছোটো বাগান থাকবে। নিজের হাতে যত্ন করবে মনীষা। ওই বাগান নিয়েই তার সময় কেটে যাবে। ওদেশে কী কী ফুলগাছ পাওয়া যাবে? গোলাপ ফুল নিশ্চয়ই আছে। গোলাপ তো ওই সব দেশ থেকেই এসেছে। বসরাই গোলাপ বিখ্যাত!

ওইসব মরুভূমির দেশের আকাশ অনেক পরিষ্কার হয়। জ্যোৎস্না অনেক গাঢ় হয়। এই রকম সময়, গোলাপ বাগানের মধ্যে জ্যোৎস্নার নীচে বসে থাকবে মনীষা একা। আঃ, শান্তি, শান্তি!

পরদিন মনীষার ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে। রজত আগেই উঠে পড়ে বসবার ঘরে কাগজ খুলে বসেছে। সামনে খালি চায়ের কাপ। নিজেই চা বানিয়ে নিয়েছে বোধহয়। মুখখানা গম্ভীর।

মনীষা আপন মনে নিজের কাজ করতে লাগল। বসবার ঘরে এল না একবারও। আজ ছুটির দিন, তাই ছেলেমেয়েদের জাগাল না।

রজত একবার ডাকল, মনি, শোন!

মনীষা কোনো সাড়া দিল না।

রজত আরও দু-তিন বার ডেকে সাড়া না পেয়ে চলে এল রান্নাঘরে।

মনীষা পিছনে না ফিরেই তার উপস্থিতি টের পেয়ে শুকনো গলায় বলল, টোস্ট আর ডিম সেদ্ধ দেওয়া হচ্ছে।

রজত বলল, ঠিক আছে, আমার কোনো তাড়া নেই। শোন, আমি ভাবছিলাম আজ দুপুরে রান্নাবান্না করার দরকার নেই। সবাই মিলে চল বাইরে গিয়ে কোথাও খেয়ে আসি।

মনীষা বলল, দরকার নেই। আমি বাড়িতেই রেঁধে নিতে পারব।

সে তো রোজই রাঁধছ। চল, আজ কোনো চিনা দোকানে খাই!

ঘুষ দিতে চাইছ?

ঘুষ?

আগের দিন বাড়ি ফিরে মাতলামি করে পরদিন চিনে খাবারের ঘুষ? তোমার যদি ইচ্ছে হয় আজ আবার হোটেল হিন্দুস্থানে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেও ওসব।

রজত একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বেশ গম্ভীরভাবেই বলল, কাল রাতে তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, সেজন্যে আমি দুঃখিত। কাল আমার মেজাজটা ভালো ছিল না।

এসব কথা বলার জন্য যতটা গলার আওয়াজ নরম করা উচিত, যতটা বিনীত হওয়া উচিত, রজতের কথায় তা নেই! সে যেন কথাগুলো বলছে দায়সারা ভাবে। মনীষার আরও রাগ হয়ে গেল।

রজত ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, সাড়ে চারশো টাকা খরচ করে হোটেল হিন্দুস্থানে গিয়ে মদ খাবার মতন দুর্মতি যে আমার হয়নি, সেটা তোমার বোঝা উচিত ছিল। টাকাটা দেবে কোম্পানি। একজন অপরিচিত পাঞ্জাবির সঙ্গে বীভৎস ক্যাবারে নাচ দেখবার মতন রুচি যে আমার নেই, আশা করি এটাও তুমি জানো। তবু আমাকে যেতে হয়েছিল। লোকটি একজন আর্মি অফিসার। আমাদের একটা জিনিসের কোয়ালিটি ও অ্যাপ্রুভ না করলে বারো লাখ টাকার একটা অর্ডার ক্যানসেলড হয়ে যেতে পারে। সেইজন্য কোম্পানি থেকে ওই লোকটিকে ঢালাও তোষামোদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই লোকটিই ক্যাবারে দেখতে চেয়েছিল, আমাকে ওর পাশে বসে সর্বক্ষণ দেঁতো হাসি হাসতে হয়েছে।

মনীষা মুখ ঘুরিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ও রকম চাকরি করা কেন? ছেড়ে দিতে পারো না? চাকরি করতে গেলে এরকম নোংরা কাজ করতে হবে?

এ দেশের সব কোম্পানি এক্সিকিউটিভদেরই নানা রকম নোংরা কাজ করতে হয়। সকলে এই কাজগুলোকে নোংরা মনে করে না অবশ্য।

ছেড়ে দাও ওই চাকরি?

মেয়েদের পক্ষে এইসব কথা বলা সোজা। তারা একবারও চিন্তা করে না, টাকাটা রোজগার হয় কীভাবে। অথচ টাকা না থাকলেই তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। যে মাসে একটু টাকা পয়সার অসুবিধে থাকে, সেই মাসটা একটু টেনেটুনে চালাতে বললে, অন্তত সাতবার শোনাবে, কত দরকারি জিনিস সে মাসে কেনা হল না। তোমার দিদি কিংবা কোনো মাসি কত বেশি টাকা খরচ করে, বলো না?

তুমি চাকরি ছেড়ে দাও, দরকার হলে আমরা গাছতলায় গিয়ে থাকব।

সেখানেও তোমার মোজাইক করা পরিষ্কার বাথরুমের দরকার হবে। তা ছাড়া আমরা গাছতলায় থাকবই বা কেন? আমরা নিজেদের বাড়িতে আর পাঁচজনের মতন ঠাট বজায় রেখেই থাকব। সেজন্যে কিছু মূল্য দিতেই হয়।

আমি কিন্তু তেহেরানে চলে যাবই।

আমি তো আপত্তি করিনি। আমি তোমার কোনো কাজে কখনও বাধা দিয়েছি। এখানে তোমার জীবন যদি একঘেয়ে লাগে, তুমি কিছুদিনের জন্য নিশ্চয়ই ঘুরে আসতে পারো।

অন্তত তিন বছর।

বেশ তো?

রজত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটু পরেই আবার ফিরে এল। মনীষার কাঁধে হাত রেখে শান্তভাবে বলল, একটা জিনিস কখনো ভুল করো না। আমি তোমায় ভালোবাসি।

দেবযানী মেয়েটি ফিরে গেছে ইরানে। সেখান থেকে সে মনে করে ফর্ম পাঠিয়ে দিয়েছে মনীষাকে। দুপুরবেলা রেজিস্টার্ড পোস্টে খামটা আসবার পর মনীষা বহুক্ষণ ধরে ফর্মগুলো পড়ে দেখল। বাবা রে বাবাঃ, কত রকম নিয়ম কানুন। বাবা, মা, ঠাকুর্দা, ঠাকুমা, দিদিমাদের কারুর কোনো অসুখ আছে কিনা তা পর্যন্ত জানাতে হবে। কিন্তু মাইনে বেশ ভালো। বছরে এগারো মাস কাজ। এক মাস পুরো ছুটি। সেই সময় দেশে ঘুরে যাবার ভাড়া দেবে ইরান সরকার।

…একবছর পর ফিরে এসেছে মনীষা। টুম্পুটার দারুণ স্বাস্থ্য হয়েছে। পাড়ার ছেলেরা তাকে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখেই বলল, বৌদি, কোথায় ছিলেন এতদিন? নীচতলায় ভাড়াটে বলল, মনীষাদি কী সুন্দর দেখতে হয়েছ তুমি! ঠিক যেন দশ বছর বয়েস কমে গেছে! মনীষার সঙ্গে প্রচুর জিনিসপত্তর। সকলের জন্য উপহার এনেছে নানা রকম। রজত হাসতে হাসতে বলল, তোমাকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। ঠিক যেন মনে হচ্ছে অন্য কাদের বউ। মনীষা লাজুকভাবে হেসে বলল, আহা হা, এক বছরে কেউ এতখানি বদলায় নাকি? তারপর সে আবার খুব উৎসাহের সঙ্গে বলল, জানো, আসবার আগে গ্রিস ঘুরে এলাম! এথেন্সে ছিলাম, আরও দু-একটা জায়গায় যেতাম, কিন্তু টুম্পুটা বাড়ি ফেরার জন্য কান্নাকাটি করল, অনেকদিন তোমাকে দেখেনি তো…

দরজায় শব্দ হল। টুম্পু এসে গেছে স্কুল থেকে। মনীষার মেজাজটা আজ খুব ভালো। টুম্পুর হাত থেকে বই খাতা নিয়ে সে বলল, টুম্পু শোন, তোমাকে আর এই স্কুলে পড়তে হবে না।

টুম্পু বলল, আমাকে বড়ো ইস্কুলে ভরতি করে দেবে? বড়ো হয়ে গেছি!

না। আমরা দূরে এক জায়গায় বেড়াতে চলে যাব। তুমি সেখানকার স্কুলে পড়বে।

কোথায় মা?

সে অনেক দূর। এরোপ্লেনে করে যেতে হবে। দাদা আর বাবা কিন্তু যাবে না।

শুধু তুমি আর আমি।

দাদাকে নিয়ে যেও না। দাদা দুষ্টু। বাবা যাবে!

না, বাবাও যাবে না।

টুম্পু একগাল হেসে ফেলে বলল, হ্যাঁ, আমি জানি বাবা যাবে। তুমি মিথ্যে কথা বলছ। বাবা না গেলে কে আমাদের নিয়ে যাবে?

কেন? আমি বুঝি নিয়ে যেতে পারি না?

পুরীতে যাবার সময় তুমি যে রেলের টিকিট হারিয়ে ফেললে?

ও মা! সেকথা তোর এখনো মনে আছে? তুই তো তখন অনেক ছোটো!

হ্যাঁ, মনে আছে। বাবা বকল তোমাকে সেইজন্য।

একবার টিকিট হারিয়ে ফেলেছি তো কী হয়েছে। এবার কিছু হারাবে না!

পরদিন সকালে রজতকে ফর্মগুলো দেখাল মনীষা। রজত প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলল, এখানে ছেলেমেয়েদের কথা কিছু লেখা নেই। যার চাকরি হবে, সে যাওয়ার ভাড়া পাবে। ছেলেমেয়েদের ভাড়া দেবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না!

মনীষা একটু দম নিয়ে বলল, এই রে, তাহলে টুম্পু যাবে কী করে?

রজত বলল, সেটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। সব ব্যবস্থা যদি হয়ে যায়, তাহলে টুম্পুর ভাড়া আমি জোগাড় করে দিতে পারব।

কত টাকা।

সে দেখা যাবে। কিন্তু তোমার পাসপোর্টও তো করিয়ে রাখা দরকার। হঠাৎ যদি সব ঠিক হয়ে যায় তাহলে পাসপোর্টের জন্য আটকে যেতে পারে। আমি পাসপোর্টের ফর্ম আনিয়ে দেব কালই।

খানিক বাদে মনীষা বলল, তুমি কাল রাতে ভয়ংকর কাশছিলে?

রজত বলল, কই না তো!

হ্যাঁ, ঘুমের মধ্যে কাশতে কাশতে একবার উঠে বসলে পর্যন্ত।

ও কিছু না।

তুমি একবার ডাক্তার দেখালে পারো!

সামান্য কাশির জন্য কেউ ডাক্তার দেখায়? তা ছাড়া এখন আমার সময়ও নেই। সিগারেটটা একটু কমিয়ে দিলেই হবে।

পাসপোর্টের ফর্মের কথা রজত নিজে বললেও সেটা আবার সে ভুলে গেল। দুদিনের মধ্যেও সে আর উচ্চবাচ্য করল না দেখে মনীষার একটু সন্দেহ হল, তা হলে কি রজত তার যাওয়াটা ঠিক চায় না? কিন্তু এদিকে মনীষার মনের ভাব এমন যেন তার তেহেরান যাওয়া একেবারে ঠিকঠাক হয়ে গেছে। সে এখন সাদা রঙের একতলা বাড়িটা যখন তখন দেখতে পায় চোখের সামনে। সে এমন কী সেই বাড়িটা তার মনের মতন করে সাজাতে শুরু করে দিয়েছে। মনে মনে।

তৃতীয় দিনে সে জিজ্ঞেস করল, তুমি সেই পাসপোর্টের ব্যাপারটা…তোমার যদি অসুবিধে থাকে, তাহলে আমিই না হয়—

রজত খুবই লজ্জিত হয়ে বলল, এই রে ছি ছি। আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আজই অফিসের একটা কাজ নিয়ে এমন দুশ্চিন্তায় রয়েছি কদিন ধরে…অন্য কোনো দিকে মনই দিতে পারছি না।

অফিসে থেকে কেন এত দুশ্চিন্তা করো! শরীর খারাপ হয়ে যাবে শেষে! মালিকরা টাকা দেয় বলে কি তোমাকে কিনে নিয়েছে নাকি?

চাকরি মানে তো অনেকটা তাই! তা ছাড়া, একটা ব্যাপার কী জানো, কোনো একটা কাজ হাতে নিয়ে সেটা ঠিকমতন শেষ করতে না পারলে শান্তি পাওয়া যায় না। পুরুষ মানুষের একটা চ্যালেঞ্জ। যাক গে, তোমার পাসপোর্টের ফর্ম আমি আজই আনিয়ে দেব।

আমি ফর্মটা ফিলাপ করেছি।

তাহলে ওটা পাঠিয়ে দাও, দেরি করছ কেন?

একটা জায়গায় বুঝতে পারছি না। তুমি একটু দেখে দেবে?

রজত ফর্মটা নিয়ে যেটুকু বাকি ছিল, সব ভরতি করে দিল। পাড়ার স্টুডিও থেকে এর মধ্যেই মনীষা পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলিয়ে এনেছে ছখানা। সেই কখানা ছবি দিতে হবে অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে। ছবিটা দেখে রজত বলল, তোমাকে একটা বাচ্চা মেয়ের মতন দেখাচ্ছে!

মনীষা বলল, যাঃ, বুড়ি হয়ে গেছি। দেখি, যদি ওখানে গিয়ে শরীরটা সারে।

খামের ওপর ঠিকানা লিখে রেখেছে মনীষা আগেই। এবার তার মধ্যে সব কাগজপত্র ভরে আঠা দিয়ে আটকে দিল। রজত বলল, দাও, আমি অফিস থেকে বেয়ারা পাঠিয়ে ওটা পোস্ট করে দেব এখন।

মনীষা বলল, রেজিস্ট্রি করে পাঠাতে হবে।

রজত বলল, তা তো নিশ্চয়ই। সে আমি ঠিক করে দেব এখন।

তুমি পাঠিয়ে দেবে? যাক।

কেন?

তুমি কেন কষ্ট করবে। আমি আজ একবার বেরুব, পোস্ট অফিস তো কাছেই, আমিই পোস্ট করে দেব এখন।

আমার আবার কষ্ট কী। বেয়ারা পাঠিয়ে দেব।

যাক। আমিই দেব এখন।

রজত কয়েক মুহূর্ত স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল মনীষার দিকে। গুপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

অফিস যাবার পথে ম্লান হয়ে রইল তার মুখ। মনীষা তাকে বিশ্বাস করে না। মনীষা বোধহয় ভেবেছে, রজত ঠিক মতন ওই খামটা না-ও পাঠাতে পারে।

মনীষা কিন্তু এসব বুঝল না। সে নিজের আনন্দে মশগুল হয়ে আছে। এই খামটা যেন তার নতুন জীবনে প্রবেশের চাবিকাঠি। এটা সে নিজের হাতে পাঠাবে, এই কথা ভেবেই উত্তেজিত হয়ে আছে।

সেদিন হঠাৎ সন্ধে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরে এল রজত। হাত মুখ ধুয়ে, জামা কাপড় ছেড়েই সে ছেলেকে ডেকে বলল, বাবলু, তোর ইংরেজি গ্রামার বইটা নিয়ে আয়।

বাবলু রীতিমত অবাক। বাবা কোনোদিন তাকে পড়ায় না। কিন্তু সেদিন রজত দারুণ তোড়জোড় করে পড়াতে বসল বাবলুকে। পড়াবার অভ্যাস নেই বলেই সে রেগে উঠতে লাগল প্রায়ই। রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে, ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে বাবলুর, রজত তবু নিষ্কৃতি দেবে না।

মনীষা বলল, আজ আর থাক। এবার ওঠো।

রজত বলল, ও গ্রামারে খুবই কাঁচা রয়েছে দেখছি! কিছুই জানে না।

মনীষা হেসে বলল, তুমি কি একদিনেই ওকে পণ্ডিত করে তুলবে নাকি?

এবার থেকে প্রায়ই ওকে নিয়ে বসব ঠিক করেছি।

তাহলে তো ভালোই হবে। ওর মাথা আছে, কিন্তু বড্ড ফাঁকি দেয়।

টুম্পু অভিমান করে রইল বাবার ওপর! বাবা কেন দাদাকে পড়াচ্ছে, আমাকে পড়াচ্ছে না? বাবা কি দাদাকে বেশি ভালোবাসে তার চেয়ে?

কয়েক মাস কেটে গেছে, মনীষা পাসপোর্ট নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছে। কিন্তু ইরান থেকে আর উত্তর আসে না। মনীষা আলাদা চিঠি লিখল সেই দেবযানী নামের মেয়েটিকে। দিন পনেরো বাদে উত্তর এল। দেবযানী এখন আর তেহেরানে নেই, তার স্বামী আরও ভালো চাকরি পেয়ে চলে এসেছে বাগদাদে। ওরা ঠিক খবর দিতে পারবে না। কিন্তু মনীষার তো হয়ে যাবার কথা। ওর চেনা একজন বড়ো অফিসারকে বলে এসেছিল মনীষার কথা।

একদিন মনীষা সকালবেলা ক্ষুণ্ণভাবে বলে ফেলল, তিনমাস হয়ে গেল। কোনো উত্তর এল না? দূর ছাই, ওরা বোধহয় আর ডাকবে না!

রজত অতি সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের সঙ্গে বলল, খামটা তো তুমি নিজেই পাঠিয়েছিলে রেজেস্ট্রি করে। পৌঁছেচে নিশ্চয়ই।

মনীষা ব্যঙ্গটা ধরতে পারল না। সে বলল, পৌঁছবে না কেন? ওরাই উত্তর দিচ্ছে না!

মনীষার মন খারাপ করা মুখের দিকে চেয়ে রজত একটু সান্ত্বনা দিয়ে বলে, আসবে, এখনো বেশি দেরি হয়নি, মোটে তো তিন চার মাস হল—

তারপর সে একটু মিনমিন করে বলে, শুনেছিলাম, আজকাল বাইরের সব চাকরিই মিনিষ্ট্রি অব এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্সের থ্রু দিয়ে আসতে হয় সেটাও কিছু অসুবিধে হবে না। ওরা কিছু লিখলে দিল্লি থেকে অনুমতি আনিয়ে নেওয়া যাবে। নিছক একটা নিয়ম রক্ষার ব্যাপার।

কিন্তু পরের মাসেও কোনো চিঠি এল না। এদিকে সেই গোলাপ বাগান ঘেরা একতলা বাড়িটা তেহেরান শহরে এখনো খালি পড়ে আছে। মনীষা তার জানলার পর্দার রং পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পায়।

রজতের অফিসের ব্যাগটায় মনীষা কখনো হাত দেয় না। অনেক দরকারি কাগজপত্র থাকে, মনীষার ভুলো মন, যদি কোনো কাগজ হারিয়ে যায়। সেইজন্য একদিন ব্যাগটা খাবার টেবল থেকে ঘরে নিয়ে রাখতে গিয়ে হঠাৎ খুলে গেল। পড়ে গেল কয়েকটা কাগজ। সেগুলো তুলতে গিয়ে ঠিক আসল কাগজটাই সে দেখে ফেলল। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন। রজতের ব্লাডপ্রেসার অনেক বেড়েছে। তার ব্লাড কোলেস্টেরল হয়েছে, হার্টের ই সি জি করাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া দেওয়া হয়েছে একগাদা ওষুধ।

মনীষা গালে হাত দিয়ে বসে রইল। রজত এসব কথা কিছুই বলেনি। এর একটাও ওষুধ নেই বাড়িতে। রজত এমনিতেই চাপা স্বভাবের, নিজের অসুখ বিসুখের কথা সে কখনো বলে না। কিন্তু এত বড়ো একটা ব্যাপার সে গোপন করে যাবে! রজত তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়।

এরপর একদিন রাত এগারোটা বেজে গেল, তবুও রজত ফিরল না। অফিসে বেরুবার সময় সে সামান্য একটু আভাস দিয়ে গিয়েছিল যে তার ফিরতে দেরি হতে পারে। কত দেরি? রজতের শরীর ভালো নেই, প্রায়ই রাতে সে খুব কাশে, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেই হাঁপিয়ে যায়। তবু অফিসের জন্য এত খাটুনি, এত রাত করা, হঠাৎ যদি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে? যাতে তার তেহেরান যাওয়ার ব্যাঘাত না হয়, তাই রজত তার অসুখের কথাটা গোপন করে গিয়েছিল।

বিছানায় কাঠ হয়ে শুয়ে রইল মনীষা। রাস্তায় যে-কোনো লোকের পায়ের শব্দ বা যে-কোনো গাড়ির আওয়াজ শুনলেই মনে হয়, ওই বুঝি রজত এলো! কিন্তু সে আসে না।

মনীষা অন্ধকারের মধ্যে চেয়ে থাকে—আস্তে আস্তে সেই অন্ধকারের মধ্যে ফুটে ওঠে একটা সাদা বাড়ি। ভেতরটা ঠান্ডা। বাইরের আকাশে প্রগাঢ় জ্যোৎস্না। গোলাপ বাগান ধুয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। সেই বাগানে একটি চেয়ার। ফাঁকা। এ বাড়িটার নাম মুক্তি। অনেক অনেক দূরে ওই বাড়ি, মনীষা ওখানে কোনোদিনও যাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *