তেরো ডাইনির মজলিশ

তেরো ডাইনির মজলিশ

বাড়িটা পুরোনো। এ পাড়ার সব বাড়িই তো পুরোনো দেখছি। গেট ঠেলতেই সেটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে উঠল। ও ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই কোথাও। পায়ের জুতো জোড়াও মচমচ করছে না আর। কয়েক ঘণ্টা থেকেই করছে না। সেনসাস-এর কাজে নামলে জুতোর মচমচানি বেশি দিন থাকে না।

সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠলাম— হয়রান হয়ে গেছি সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে। বেল টিপলাম— হয়রান হয়ে গেছি বেল টিপে টিপে। ভিতরে পায়ের শব্দ— হয়রান হয়ে গেছি পায়ের শব্দ শুনে শুনে।

তবু, চাঙ্গা করে তুললাম নিজেকে।

‘ওই আসছে’— ভাবলাম আমি, ‘আর একটা নাক আসছে ওই।’

সত্যি বলছি— নাক গুনে গুনে একান্তই হয়রান হয়ে গেছি আমি।

কথাটা বুঝলেন তো? সারাদিন হাঁটুন। দরজায় দরজায় বেল টিপুন। বগলে করে নিয়ে চলুন ভারী পোর্টফোলিয়ো একটা। একই একঘেয়ে প্রশ্ন করে যান বার বার বহুবার। এর বদলে কী পাচ্ছেন? নাক প্রতি চার সেন্ট। উন্নতি? অষ্টরম্ভা। চার সেন্ট তো চিরকালই চার সেন্ট।

আজকের নাক গুনতি কোনোমতে শেষ করলেন যদি, দিনের শেষে পেয়ে গেলেন নতুন একটা নাকের লিস্ট। কালকের জন্য। ফি-নাক চার সেন্ট। বড়ো নাক, ছোটো নাক। থ্যাবড়া নাক, বাঁকানো নাক। লাল, সাদা, নীল নাক। দেখতে দেখতে এমন হাল দাঁড়াবে যে, নাকের কথা মনে হলেই মাথায় খুন চাপবে। দরজা ঈষৎ ফাঁক করে আবারও নাক বেরুবে তখন, ইচ্ছে হবে সেই নাকে ঘুসি মেরে পথে বেরিয়ে পড়তে।

ঘুসির কথা পরে, এখন আছি দাঁড়িয়ে। নাকটা বেরুক তো! চাঙ্গা করে তুলেছি নিজেকে। দরজা খুলল।

বেরুল সরু ধারালো চঞ্চু একটা। তার পিছনে মামুলি মুখ একখানা, তার সঙ্গে গিন্নি গিন্নি ধাঁচের আটপৌরে এক দেহ। নাকটা হাওয়া শুঁকল এক বার, দোনোমনাভাবে এধার-ওধার খানিকটা, তারপর বলল, ‘কী?’

‘আমি আসছি মার্কিন সরকারের তরফ থেকে মাদাম। সেনসাস নিচ্ছি।’

‘ওঃ, সেনসাসের লোক!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ভিতরে এসে দুই-একটা কথা জেনে নিই যদি—’

ঠিক এই আলাপই প্রতি দরজায় করছি সারদিন। হয়রান!

‘আসুন’—

আঁধার আঁধার হলঘর একটা। তার ভিতর দিয়ে আঁধার আঁধার বসবার ঘর একখানা। টেবিলের উপরে পোর্টফোলিয়ো নামিয়ে রাখছি, তক্ষুনি একটা ল্যাম্প জ্বলে উঠল। আমি ব্যাগ খুলে ফর্ম বার করলাম।

গিন্নি লক্ষ করছে আমাকে। মুখে ভাবলেশ নেই তার। সব গিন্নিরই এইরকম দেখেছি! এনসাইক্লোপিডিয়া বেচতেই আসুক কেউ, কিংবা বিল আদায় করতেই আসুক, এক চোখ গিন্নিরা রান্নার স্টোভের উপরে রেখেছেই।

যাক, পঁয়ত্রিশটা প্রশ্ন পেরুতে হবে আমাকে। তাই দস্তুর। ‘নারী-পুরুষ’ ব্র্যাকেট পূরণ করলাম, ‘জাতীয়তা’ ব্র্যাকেটও। ঠিকানাটিও লিখে নিলাম। তারপর জিজ্ঞাসা শুরু হল, ‘নাম?’

‘লিজা রোজিনি’

‘বিবাহিতা? না—?’

‘বিয়ে করিনি।’

‘বয়স?’

‘চার-শো সাত।’

‘ব—য়—স?’

‘চার—শো—সাত।’

‘অ্যাঁ? কী বললেন?’

‘চা-র—শো—সাত।’

বাঃ! বেশ! তা বে-শ! সারাদিন খাটুনি, তারপর বেলা-শেষে পড়ে গেলাম এক পাগলির পাল্লায়। ওর ভাবলেশশূন্য মুখখানার দিকে তাকালাম একবার। যাকগে, চটপট সেরে নিই। চটপট!

‘কাজকর্ম কী করা হয়?’

‘ডাইনিগিরি।’

‘কী-ই-ই?’

‘বলছি তো আমি ডাইনি—’

চার সেন্ট-এর বদলে এ-ঝামেলা পোষায় না। ভাবখানা দেখাচ্ছি যেন জবাবটা টুকে নিলাম, তারপর চলে গেলাম পরের প্রশ্নে—

‘কাজটি কার অধীনে?’

‘নিজের জন্যই কাজ করি, তবে কত্তার অধীনে অবশ্যি।’

‘কত্তা?’

‘শয়তান মার্কট্রিস। শয়তান গো!’

দশ সেন্ট-এর বদলেও পোষায় না এ-ঝামেলা। লিজা রোজিনি, অবিবাহিতা, বয়স চার-শো সাত বছর, পেশায় ডাইনি, কাজ করে শয়তানের আফিসে। না, না, পঞ্চাশ সেন্টেও যথেষ্ট মজুরি নয় এ-হাঙ্গামার।

‘ধন্যবাদ। আর কিছু নয়। চলি এবার—’

স্ত্রীলোকটি গা করল না মোটেই। আমি কাগজখানা ভাঁজ করলাম, পোর্টফোলিয়োতে ঠেসে ভরে নিলাম, টুপিটা তুলে নিলাম, ঘুরে দাঁড়ালাম, দরজার দিকে পা বাড়িয়ে দিলাম।

দরজাটা লোপাট!

কী করব বলুন? সত্যিই লোপাট দরজাটা।

এক মিনিট আগেও ছিল দরজাটা। মামুলি একখানা বসার ঘরে অতিমামুলি একান্ত সাধারণ একটা দরজা। একদিকে ছিল একখানা হাতলওয়ালা চেয়ার। আর একদিকে ছিল ছোট্ট টেবিল একখানা।

তা দেখুন, চেয়ারও রয়েছে, টেবিলও রয়েছে। কেবল দরজাটাই নেই দুইয়ের মাঝখানে।

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম অন্য এক দিকে। দরজা হয়তো ওদিকে হতে পারে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। না, তবু দরজা দেখতে পাচ্ছি না। ঘরখানার কোনো দিকেই নেই দরজা।

ঠিক আছে! এইরকমটাই হবে তো! সারাদিন টো-টো করে রোদ্দুরে ঘোরা কারু ধাতেই সয় না। সয় না যে, তার প্রথম লক্ষণ ওই নাক নিয়ে মাথা ঘামান। দ্বিতীয় লক্ষণ প্রশ্নের জবাব ঠিকঠিক কানে না-পৌঁছানো। এই মহিলার কথাই ধরুন। উনি হয়তো বলেছেন কেরানি, আমি শুনেছি ডাইনি।

শেষ পর্যন্ত এই তৃতীয় লক্ষণ। একেবারে চরম। দরজা খুঁজে না-পাওয়া।

তা বেশ! আমি স্ত্রীলোকটির দিকে ফিরে দাঁড়ালাম আবার।

‘মাদাম! দয়া করে বেরুবার পথটা একটু দেখিয়ে দেবেন? আমি কেমন যেন ঠাহর পাচ্ছি না—’

‘বেরুবার পথ তো নেই এখান থেকে!’

মজা আর কী! মহিলাটি তামাশা করছে নাকি, অ্যাঁ?

‘কিন্তু ঢুকেছি যখন—’

‘ঢুকেছেন যখন, বসুনই-না একটু! আমার জোর বরাত যে আপনি এসে পড়েছেন—’

ডাইনির মুখে এই কথা? ‘এসে পড়েছেন?’ দূর ছাই, কী বলছি! ডাইনি তো এ সত্যিই নয়! ডাইনি আবার আছে নাকি কোথাও? না নেই।

না, ডাইনি নেই। কিন্তু মুশকিল হল এইখানে যে দরজাও নেই।

‘এসো, একটু চা খাও আমার সঙ্গে—’

‘না, না, দেরি হয়ে যাবে আমার—’

‘চা তো তৈরি! বসো ভালোমানুষের ছেলে, বসো। উনুন থেকে তুলে আনি চা—’

এতক্ষণ উনুন চোখে পড়েনি আমার, আগুনও না। কিন্তু জ্বলছে আগুন, তা ঠিক, আর তাতে বসানো আছে চায়ের পাত্র। সে কুঁজো হল পাত্রটা তুলে আনবার জন্য। অমনি তার ছায়া পড়ল দেওয়ালে।

বাপ! কী কালো! আর কী মস্ত ওই ছায়াটা! দেয়ালের এধার থেকে ওধার হামা দিয়ে দিয়ে এগুচ্ছে যেন।

লিজা রোজিনির দিকে আবারও তাকাচ্ছি। এখনও তাকে গিন্নিবান্নি মেয়েছেলের মতো দেখাচ্ছে। কালো চুল। আঁচড়ানো চুল। মাঝখানে সিঁথি। একহারা চেহারা, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েনি এখনও।

বয়স? চার-শো সাত বছর? অ্যা?

মরুক গে! ও চিন্তা থাকুক। মুখখানা ওর একান্ত মামুলি। নাক, চোখ, ঠোঁটে ঠোঁট এঁটে বসেছে। চোখের উপর পাতা আর নীচের পাতার মাঝখানে সরু ফাঁক একটু, এমন সরু যেন ছুরি দিয়ে চিরে বার করা হয়েছে। এ ছাড়া মুখখানার আর সবই মামুলি।

মামুলিই বটে, কিন্তু অমন চিমসে মুখের মতন দেখায় কেন? ওই আগুনটার জন্যই হয়তো নেচে নেচে উঠছে আভাটা, আর তার লালচে আভায় ভারি যেন একটা শেয়ালপানা ধূর্তামি ফুটছে মুখখানায়।

নাঃ, ডাইনি-টাইনি নয়, পাগলাটে। ডাইনি নেই। ছিল না কোনোদিন।

তবে কথা এই, ভয় করছে, কেমন যেন।

ও হাসছে আমার দিকে চেয়ে একখানা থাবা, থুড়ি— হাত আর কী! এক হাত বাড়িয়ে পেয়ালাটা ও এগিয়ে দিলবাদামি রং চায়ের, ধোঁয়া উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। চা। ডাইনির হাতের চা। খেয়ে নাও, তারপর—

ধুত্তোর! খেয়ে নাও। আবোল-তাবোল ভেবো না অমন— স্রেফ বোকামি এসব। আচ্ছা, দরজাটা তাহলে কোন দিকে? ঘরটা আঁধার লাগছে। আগুনটা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। রীতিমতো লাল ও আগুনটা। কিছুই পষ্ট মালুম হতে দেয় না। তা ছাড়া গরমও তেমনি এখানটা। নাও, চা-টুকু খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ো।

ওর হাতেও একটা পেয়ালা। বিষ নয় তাহলে। হাঃ হাঃ! কিছু মিশিয়েটিশিয়ে দেয়নি। আচ্ছা কীসব মেশায় ডাইনিরা, অ্যাঁ? শেকড়-বাকড় বোধ হয়। আর ম্যাকবেথ নাটকে যা-সব পড়েছ, তাও নিশ্চয়। হাঃ হাঃ। সেকালের লোক বিশ্বাস করত ওসব। পাগল ছিল তারা।

তাহলে খেয়ে নিই চা-টুকু। তারপর বেরিয়ে পড়ি।

‘বেশি লোক আসে না এখানে—’ কথাগুলো বেশ মোলায়েম শোনায়। টেবিলের ওধারে ও বসে আছে। বুঝতে পারছি আমাকেই ও দেখছে। আমি হাসি ফোটাবার চেষ্টা করলাম মুখে।

‘আগে আসত। এখন মন্দা যাচ্ছে কাজ কারবার—’

‘কারবার?’

‘আহা! ডাইনিগিরি! জাদু! জাদু! এখন নাকি ওতে আর কাজ হয় না। আরে, লোকে বিশ্বাস করবে না তো কাজ হবে কী? বড়ো বড়ো কথা ছেড়েই দিই, এই যে সামান্য জিনিস— বশীকরণ— ওতেও নাকি কারও কোনো দরকার নেই এখন। কতকাল যে মায়াপুতুল গড়ে দেবার ফরমায়েশি পাইনি।’

‘মায়াপুতুল?’

‘ওই যে মোমের পুতুল গো! ঠিক মানুষের আকারে গড়া। শত্তুরের মরণ যদি চাও, তার নাম করে ওই পুতুলে পিন ফুটিয়ে দাও। ব্যাস, খতম! আজকাল আর তেমন হিংসাই করতে জানে না লোকে। ডাইনির নজর পড়ুক শত্তুরের উপরে, এ আর চায় না কেউ। কতকাল যে মানুষ মারিনি! খুবই মন্দা চলছে কারবারে।’

ঠিক ঠিক! তা মন্দা যখন, গুটিয়ে ফেললেই হয় তো! আফিসে তালা ঝুলিয়ে দিলে ক্ষতি কী? কত কারবারই তো ফেল হচ্ছে!

তবে হ্যাঁ, রোজগেরে মেয়ে ছিল একসময়। মুষড়ে পড়েছে, ব্যাবসাতে ভাটির টান লাগতেই।

কিন্তু হাতটা আমার কাঁপছে যে? পেয়ালাটা পড়ে যেত আর একটু হলে।

‘এত সব জাদু জানতাম! কিন্তু চা তো খাচ্ছ না?’

ফাঁসির আসামিকে ভরপেট খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল। খাও, খাও! কাজ দেবে!

‘খেয়ে নাও চা—’

খেতে যে হবেই, তা আমার মনই বলছে আমাকে। না-খেলে কেমন করে প্রমাণ হবে যে, মেয়েমানুষটা পাগলা?

ডাইনি-টাইনি নেই। দ্যাখো-না, আমি এক চুমুকে খেয়ে ফেলছি ওর চা, খেলে হয় কী, শুনি?

কিন্তু আমার হাত? ও হাত একান্তই চাইছে না যে চা আমি খাই। রীতিমতো কসরত করে করে আমি হাতকে বাধ্য করলাম পেয়ালাটা মুখে পৌঁছে দিতে।

আমি চুমুক দিচ্ছি, ও তাকিয়ে আছে।

তেতো, বিস্বাদ, কিন্তু গরম। গিলতে কই কোনো কষ্ট তো হল না!

না, কষ্ট হয়েছে বলতে পারিনে, তবে কটু স্বাদটা যাচ্ছে না মুখ থেকে।

লিজা বলছে, ‘তুমি আমার অবাক করেছ, ভালোমানুষের ছেলে। আমার পেশাটা নিয়ে একটা কথাও তো কইলে না তুমি! রোজই যে একটা করে ডাইনির দেখা পাচ্ছ তুমি, তা তো আর নয়!’

রোজই যে ডাইনির দেখা পাই না, তাও কি আবার বলে দিতে হবে?

আমি বললাম, ‘অনেক কথাই কইবার আর শুনবার ছিল। আর একসময় এসে— এখন কিন্তু লিস্টিতে এক গাদা নাম বাকি রয়েছে আমার। উঠতেই হবে এবার। চায়ের জন্য ধন্যবাদ—’

কথা কইছি, আর দোরটা খুঁজছি চারদিকে তাকিয়ে। আগুনের আভা লালের জাল বুনেছে ঘরটা জুড়ে, কিন্তু জাল শুধু ঘরেই নয়— আমার এই মাথাটার মধ্যেও সেই লালের জাল যেন। শিখা তুলে নাচছে সেই লাল। চা-টা গরম ছিল খু-উ-ব। সেই গরম এখন ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে আমার মাথায়। ঘরের ভিতর লাল জালে কালো ছায়ার ফোকর। মাথার মধ্যেও তাই। কালো কালো ছায়া। লাল আর কালোতে পাশাপাশি চিকিমিকি। মাথার ভিতর, চোখের সামনে। তারই জন্য দোরটা দেখতে পাচ্ছি না।

কিন্তু দোরটা থাকবেই তো! আছেই নিশ্চয়। ওই লাল-কালো জালের কোনো একটা ফোকরের ভিতর আছেই তা। আছে নিশ্চয় কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না।

ওকে কিন্তু পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একটা হাসি তার মুখে। কীরকম হাসি বলব ওকে? নিষ্ঠুর হাসি? ব্যঙ্গ হাসি? যে হাসিই হোক, ওরই দরুন একটা বুড়ুটে ছাপ পড়েছে ওর মুখে। যদিও চামড়ায় কোঁচকানি নেই এতটুকু, ওই হাসিটাই ওকে তেরকেলে বুড়িতে পরিণত করেছে। মড়ার খুলির দাঁতে যেরকম হাসি লেগে থাকে, সেইরকমটাই।

হ্যাঁ, ওকে ঠিকই দেখেছি, দেখছি না শুধু দরজাটা।

বললাম, ‘এবার যেতে হবেই—’

নিজের কানেই ঠেকল— যেন আমার কথা আমার নয়, যেন অনেক দূর থেকে অন্য কেউ কথা কয়ে উঠেছে। অনেক কিছুই দূরে সরে গিয়েছে, দেখছি। কাছে ঘনিয়ে এসেছে শুধু লিজার দুটো চোখ। আর সেই চোখ থেকে বেরুচ্ছে লাল আলো আর কালো ছায়া।

উঠে দাঁড়িয়েছি।

অর্থাৎ উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি মাত্র।

একবার এক সরাইখানায় নয় বোতল ভদকা খেয়েছিলাম একাসনে বসে। যখন বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠলাম, সঙ্গেসঙ্গে দেখলাম, আমি মেঝেতে সটান শুয়ে আছি।

আজ খেয়েছি এক পেয়ালা চা শুধু। খেয়ে যখন উঠে দাঁড়িয়েছি—

দেখলাম আমি উঠেই যাচ্ছি। ভাসছি হাওয়ায়। পা আর মেঝে ছুঁয়ে নেই। দাঁড়িয়ে আছে হাওয়ার ওপরে। নিরেট হাওয়া। লাল আলো আর কালো ছায়া দিয়ে গড়া। সারা অঙ্গে শিরায় শিরায় কী যেন চিনচিন করে চলেছে। ছোটো ছোটো সুচ যেন বিঁধে রয়েছে গায়ে। বাতাসেই হাত-পা নাড়াছি আমি—

‘এক্ষুনি যেয়ো না গো’— বলল লিজা।

আমি যে কী অবস্থায় আছি, তা যেন ও দেখেইনি। অন্তত ওর গলার স্বর শুনে মনে হয় না যে দেখেছে। তবু, বুঝেছে ঠিকই। তা নইলে হাসে কেন ওভাবে? বলল, ‘এক্ষুনি যেয়ো না তুমি। তোমার এক জায়গায় নিয়ে যাব আমি—’

‘নিয়ে যাবে?’

‘মানে— এক জায়গায় আমার যেতে হবে কিনা!’

‘নেমন্তন্ন?’ ভাঙি তো মচকাই না। সদা সপ্রতিভ মুখে উত্তরটি যুগিয়েই আছে। কোথায় কী অবস্থায় আছি, তা যেন ধর্তব্যের মধ্যেই আনি না!

হাসি তার মুখে লেগেই আছে। একটা হাই তুলল, কী যেন ভাবছে, ‘তা— নেমন্তন্ন বলতে পারো একরকম। মেয়েছেলের একা নেমন্তন্নে যাওয়া ভদ্রোচিত নয় ঠিক, কী বলো? তাই সঙ্গে নিতে চাই তোমায়।’

কী ভদ্রোচিত, কী নয়, ডাইনিরাও মানে তাহলে! তা না-হয় মানুক কিন্তু হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এ আলোচনা— আমি নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছি, তা নইলে এসব কথায় কান দিতাম না কক্ষনো।

লিজা বলছে, ‘কথাটা কী জানো, কতকগুলো নিয়ম আমাদের মেনে চলতে হয়। ডিনারের টেবিলে তোমরা প্রাণান্তেও তেরোজন একসাথে বসবে না। আমরা কিন্তু মজলিশে বসবই না, তেরোজন না-হলে। মজলিশ মানেই তেরোজন। না-হলে উনি চটে যাবেন।’

‘উনি?’

‘শয়তান! মার্কট্রিস শয়তান।’ আবার সেই হাসি। এখন ওর এক-একটা হাসির ঝিলিক যেন চাবুকের এক-একটা ঘায়ের মতো আমার বুকের ভিতর কেটে কেটে বসে যাচ্ছে।

কথা ওর শেষ হয়নি। কী বলছে এবার? ‘আজ তাই আমাদের মজলিশে তোমায় আসতেই হচ্ছে, এই রাতেই। মেগই আমার সাথি হয় বরাবর। তা আজ সে আসবে না কিনা, তারই বদলি—’

‘ডাইনির মজলিশ?’

‘হ্যাঁ, ডাইনিরই মজলিশ বটে। পাহাড়ের মাথায় বসে। যেতে হবে অনেকটা, তুমি তৈরি হয়ে নাও।’

‘উঁহু, আমি যাচ্ছি না—’

আপত্তিটা যেন আমার নিজেরই কানে হাস্যকর শোনাল। মা-বাপ তিন বছরের খোকাকে বলছে, ‘শুতে যাও বাবা।’ খোকা বলছে, ‘যাব না।’— তেমনিই হাস্যকর। যে লোক হাওয়ায় ভাসছে হাঁইফাঁই করতে করতে, তার আপত্তির কতটুকু দাম?

‘ম্যাগিট! ভালোমানুষের ছেলেকে বানিয়ে ফ্যালো।’

বানানো? সে আবার কী? কসাইয়েরা জন্তুগুলোকে বানায়, মানে জবাই করে। এটা নিশ্চয় সে-রকম বানানো নয়—

দরজা নেই, তবু ম্যাগিটের উদয় হল ঘরের ভিতর।

ম্যাগিট যে সত্যি সত্যি কী, হঠাৎ বুঝতে পারলাম না। ছোট্ট ভেড়ার লোমের মতো লোম গায়ে, বেজির মতো দেহ— মানুষের মতো হাত। মুখ একখানা আছে, কিন্তু সে মুখ মানুষের মুখ নয়, যদিও তাতে চোখ-কান-নাক-মুখ কোনো কিছুরই অভাব নেই।

কিন্তু ম্যাগিটের আসল বৈশিষ্ট্য এসবের কোনো কিছুতে নয়। ওর চেহারার ভিতর যা সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা হল একটা নির্ভেজাল অকল্যাণের ছাপ। ওর সর্বাঙ্গ থেকে ভকভক করে বেরুচ্ছে একটা পাপের ধোঁয়া। মুখে ওর দেঁতো হাসি লেপটে রয়েছে একটা। সে হাসি যেন বলতে চাইছে, ‘যুগ যুগান্তের অভিজ্ঞতা কারও যদি থাকে তো আছে আমার। যে অভিজ্ঞতা মানুষ বা পশু কারও থাকার কথা নয়।’

‘কী বলছ লিজা ঠাকরুন?’ মেজের উপর দিয়ে সড়সড় করে চলে আসতে আসতে ম্যাগিট জানতে চাইল যে-স্বরে, তা ক্ষীণ হলেও মগজে ঢুকে যায় সুচের মতো।

সব ডাইনিকেই এক-একটা হুকুমবরদার দেয় শয়তান, ম্যাগিট হল লিজার সেই হুকুমবরদার। মজলিশে কালো বাইবেল যখন সই করে ডাইনিরা, তখনই পায় এই উপহার, ইতর প্রাণীর দেহধারী ক্ষুদে পিশাচ এক-একটা।

ম্যাগিট আমার গা বেয়ে উঠল। লিজা একটা বোতল থেকে বার করল খানিকটা হলদে মলম। ম্যাগিট তাই নিয়ে তোফা করে মালিশ লাগাল আমার বুকে-পিঠে-গলায়। মলম যেখানে লাগে, সেখানটা জ্বলে যেতে চায় যেন।

‘ওই হল উড়ক্কু মলম, এবার চলো যাই’— বলল লিজা।

ওর গায়ে আর তখন কাপড়চোপড় নেই। মাথার কালো চুল এলিয়ে দিয়েছে ও, আঙ্গরাখার মতন তাইতেই ঢাকা পড়েছে দেহ।

আমি তো আগে থেকেই হাওয়ায় ভাসছি। লিজাও ভাসতে ভাসতে আমার পাশে এল। তারপর ধরল আমার হাত। চিনচিন করে কীসের যেন ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে লাগল আমার সারা দেহে। উঠছি এবার। ছাদে একটা দরজা না? ভাসতে ভাসতে বেরিয়ে গেলাম। অন্ধকার। কালো রাত্রি! ভেসে চলেছি। ও ধরে আছে আমায়।

উঠে যাচ্ছি সেই কালোর ভিতরে। ওর নিরাবরণ সাদা দেহ বেঁকে বেঁকে উড়ছে অর্ধচন্দ্র যেমন দুই শিং বাগিয়ে আকাশে ওড়ে।

উড়ছি! উড়ছি! হঠাৎ এক সময়ে সাঁ করে নামতে শুরু করেছি আমরা। আর জ্বলছে না গায়ের চামড়া। দু-পাশ দিয়ে হাওয়া ছুটছে ঝড়ের বেগে। নীচে জ্বলছে শহরের লক্ষ আলো। ছোটো ছোটো আলো, রাত্রির বিশাল অন্ধকারকে ঠেকিয়ে রাখবার জন্য জ্বালা হয় যাদের। বিশাল আঁধার। যেখানে নেকড়েরা গর্জায়, প্যাঁচার ঘুৎকার ওঠে ভূত-ভূতুম! যেখানে মড়াদের বাস, আবার তারাও ঘোরে-ফেরে, যাদের অনেক আগেই মরার কথা ছিল। পাহারা দেবার জন্য আলো। ভয়কে ঠেকিয়ে রাখবার জন্য আলো।

কতক্ষণ উড়েছি, কতদূর উড়ে গিয়েছি, মালুম নেই। কীভাবে নেমে পড়েছি, তাও জানি না। একটা কালো পাহাড়। গম্বুজের মতো তার উপরদিকটা, তারই চূড়ায় একটা আগুন। কয়েকটা মূর্তি গুঁড়ি মেরে রয়েছে, ছায়া-ঢাকা গিরিসানুতে সাদা দেখাচ্ছে তাদের। আবার উপরের আগুন থেকে আলো এসে পড়ছে যেই, তখন ওদের দেখাচ্ছে কালো।

মূর্তিগুলোর পায়ের কাছে ম্যাগিটের মতো লোমশ প্রাণী অনেকগুলো। মূর্তির সংখ্যা এক— দুই— তিন— চার—

এগারো।

তার উপর লিজা আর আমি। ঠিক! তেরোই বটে। ডাইনির মজলিশে তেরোজন চাই-ই। তার উপরে আর একজনও আছে অবশ্য, বলির পশুটা। একটা কালো ছাগল। আগুনের সামনে পাথর একখানা। লিজা ছাগলটাকে সেইখানে নিয়ে গেল। আর একটা ডাইনি ছুরি বসাল। আরও একজন রক্তটা ধরল গামলায়। গামলা ভরে উঠল যখন, সবাই খেল সেই রক্ত।

হাঁ তো! বলছি তো যে সবাই খেল!— সব্বাই!

তারপর ঢাক বাজতে লাগল কোথায়, নাচ শুরু হল। আমিও নাচছি। লোমশ প্রাণীগুলো খালি গামলার ভিতরটা চাটছে, আর কী যে কথা কইছে কিচির মিচির, ঢাকের বাদ্যি আর নাচিয়েদের চিল্লানিতে শোনা যাচ্ছে না তা।

এক ডাইনি বলল, ‘লিজা, একটা নতুন লোক এনেছিস যে?’

‘মেগ আজ আসতে পারেনি, তারই বদল’— উত্তর দিল লিজা।

চিল্লানি তুঙ্গে উঠছে, আগুন আকাশ ছোঁবার জন্য লাফিয়ে উঠছে। কাকে যেন ডাকছে আর ডাকছে, ক্রমাগতই ডেকে চলেছে ডাইনিরা!

সেই একজন— কেউ এলেন।

কোথাও মাটি ফুঁড়ে আগুন উঠল না, কোথাও আকাশ থেকে বিদ্যুৎ চমকাল না। নাটুকেপনা মোটেই নয়। সে-সব যা, তা ওই ডাইনিরা করেছে। নতুন কী আর! অসভ্য দেশে বর্বরেরা তাদের পাথরের বিগ্রহ ঘিরে ওইরকমই করে।

ইনি যে এলেন, একেবারেই ঘরোয়া কায়দায়। একটা পাথরের পিছন থেকে এক পা এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন মজলিশের সামনে, বগলে মোটা একখানা খাতা। ঠিক যেন হিসাবপরীক্ষক এসে ব্যাঙ্কে ঢুকলেন।

তবে ব্যাঙ্কের হিসাবপরীক্ষকেরা কালো নয় এই মার্কিন মুলুকে। ইনি কালো। দস্তুরমতো। চোখের তারা পর্যন্ত। হাতের নখ পর্যন্ত। ওঁর গায়ে কী একটা কালো আঙ্গরাখাও আছে নাকি? ঠিক বুঝতে পারছি না।

উনি এলেন, এরা নিশ্চুপ। উনি খাতা খুললেন, এরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরল। সবাই কিছু না-কিছু বলছে বিড়বিড় করে। আমি পাহাড়ে হেলান দিয়ে আছি।

লিজা রোজিনি কী বলছে ওঁকে, আঙুল দেখাচ্ছে আমার দিকে। আমার দিকে উনি ফিরে তাকালেন না। কিন্তু আমি জানি, উনি দেখছেন আমাকে। তিনি হাসেননি, মাথা নাড়েননি, কোনো ইশারাও করেননি। কিন্তু আমার কেমন মনে হল— উনি হেসেছেন, মাথাও নেড়েছেন, ইশারাও করেছেন আমাকে।

কী সব হুকুম দিচ্ছেন উনি। কার কী বলার আছে, শুনছেন।

কারবার সংক্রান্ত মিটিং এটা। শয়তান কোম্পানির ডিরেক্টর বোর্ড। কোথায় কার আত্মা কেনা-বেচা হয়েছে, অমুকের তমুক মহাপাপ খাতায় লেখা হয়েছে কিনা, এইসব আলোচনা। কালো মূর্তি লিখেই চলেছেন ওই মস্ত খাতায়। আমার ভয় পাবার মতো কিছু দেখছি না। কালো মূর্তির সব কাজই একান্ত মামুলি, নিছক গদ্য।

এইবার একটা ঘটনা ঘটল। একটা চিৎকার ডাইনিদের গলা থেকে।

‘মেগ! মেগ এসেছে যে!’

যে ডাইনির আসার কথা ছিল না, সেই মেগ।

সব ডাইনি দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে ওর পানে।

উনি কথা কইলেন এইবার। সে স্বরের বর্ণনা দেওয়া যায় না। আগ্নেয়গিরির উদরে যে গুরুগুরু গর্জন ওঠে অগ্ন্যুৎপাতের আগে, তার সঙ্গে তুলনা দেব? নাঃ, ওর কাছেও তা পৌঁছোয় না।

‘মজলিশে আজ চৌদ্দো জন।’

এইবার কাঁপছি। আমি একা নই, ডাইনিরাও কাঁপছে। লিজা ঘুরপাক খেতে লাগল, যেন তার মাথায় ডান্ডার ঘা মেরেছে কেউ। তারপর আমার ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এল ওঁর সামনে—

‘আমি জানতাম, মেগ আসছে না—’

‘চৌদ্দো জন! চৌ-দ্দ!’ এতক্ষণ রাগের একটা আভাস কথায়।

‘কিন্তু আমি—’

‘আইন একটা আছে আমাদের তা ভাঙলে আছে সাজা—’

‘দয়া—’

ওঁর কাছে দয়া? আমি নিজের চোখেই দেখলাম। উনি লিজার ডান হাতটা ধরলেন। লিজা বাঁ-হাতে নিজের গলাটা চেপে ধরল। তারপর লিজা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল, তারপর ছটফটানি শেষ হয়ে গেল তার।

ওঁর কালো চোখের কালো তারা আমার উপরে নিবদ্ধ এইবার।

‘তেরো জন চাই-ই। বেশিও না, কমও না। ওই হল আইন। কাজেই লিজার স্থান তোমার হল। সই করো।’

‘আমি?’ ওর চেয়ে বেশি আর কিছু মুখে এল না আমার।

এলেও লাভ ছিল না। ওঁর সঙ্গে তর্ক চলে না।

এক ডাইনি গামলাটা এগিয়ে ধরেছে। আর এক ডাইনি হাত ধরল আমার। উনি খাতা খুলে ধরেছেন আমার সমুখে।

ম্যাগিট তরতর করে আমার গা বেয়ে উঠে এল গলার কাছে, কুটকুট করে কামড়ে দিল গলায়। সরু ধারার রক্ত ঝরে পড়ল গামলায়। একটা সরু কাঠি ওই রক্তে ডুবিয়ে দিল একজন। কাঠিটা আমার হাতে গুঁজে দিল।

কালো মূর্তি বলছেন, ‘করো সই’—

ও-হুকুম অমান্য করা চলে না। আমার আঙুল নড়ছে, আমি সই করছি।

তারপর ওঁর হাত, কালো একখানা হাত এগিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরল। একটা প্লাবন চলে গেল আমার উপর দিয়ে। লাল-কালোয় ঝঞ্ঝায় গর্জনে মেশানো একটা দুর্বার তরঙ্গ।

মাটিতে ওটা কী পড়ে আছে গো? লিজা রোজিনি তো নয়! দেহটা যেন চেনা-চেনা লাগছে? আমার না কি? এ্যাঁ? আমারই না কি?

‘খ্রিস্ট ধর্মে যা দীক্ষা হয়েছিল তোমার’— বলছেন উনি— ‘তা এই বাতিল করে দিলাম আমি।’

ম্যাগিট কানে কানে বলল, ‘ওড়ো এইবার’—

লিজা রোজিনির বাড়িতেই আমি ঘুমোলাম সে-রাত্তিরে। মনে জানি, ঘুম ভাঙলেই দেখব, রাতের দুঃস্বপ্ন কেটে গেছে।

ঘুম ভাঙল। আয়নায় মুখ দেখে চমকে উঠলাম।

আয়নার ভিতরে লিজা রোজিনি। ডাইনি লিজা। দেহের ভিতরটা আমি, বাইরেটা লিজা।

ম্যাগিট কিচিরমিচির করছে আমার পায়ের কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *