তেরাখোলে এক রাত – দীপান্বিতা রায়

তেরাখোলে এক রাত – দীপান্বিতা রায়

এমন ঘোর বর্ষায় গোয়া বেড়াতে যাওয়া। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন যেই শুনেছে আঁতকে উঠেছে। কিন্তু রণিত আর দীপকের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। অনেক চেষ্টায় দুজনে যখন একসঙ্গে ছুটি পেয়েছে তখন যাবেই। আর ওসব বর্ষা-টর্ষা তাদের কাছে কোনও ব্যাপার নয়। দুজনেরই মতে দেখার যদি চোখ থাকে আর মনে যদি ফুর্তি থাকে তাহলে প্রকৃতিদেবী সঙ্গে থাকবেনই।

আসলে দীপক-রণিত এক কথায় অভিন্নহৃদয় বন্ধু। ভবানীপুরে মুক্তদলের কাছে একই গলিতে বাড়ি। পড়াশোনা, খেলাধুলো সবই একসঙ্গে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে রণিত এখন একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। দীপক ডক্টরেট করছে। গবেষণার পাশাপাশি অন্যান্য লেখালেখিও করে। পড়াশোনা কিংবা কাজের ফাঁকে পিঠে রুকস্যাক নিয়ে বছরে দু-একবার একসঙ্গে বেড়িয়ে পড়াটা অনেকদিনের অভ্যাস। কিন্তু গত একবছর ধরে কিছুতেই আর সুযোগ হচ্ছিল না। রণিতের নতুন চাকরি। ছুটি পাওয়া মুশকিল। দীপকের বাড়িতে নানা ঝামেলা চলছিল। তাই এতদিন পরে যখন দুজনের সময় মিলেছে তখন আর অপেক্ষা নয়। পাহাড় অনেক হয়েছে। এবার সমুদ্র। বর্ষায় গোয়া।

তবে দীপক আর রণিতের বেড়াতে যাওয়াটা ঠিক আম-ট্যুরিস্টের মতো নয়। নাম-ডাকওলা কোনো একটা জায়গায় তারা বেড়াতে যায় ঠিকই, কিন্তু তারপর খোঁজ চলে তার আশপাশের নাম-না-জানা কোনো সুন্দরীকে খুঁজে বের করার। এরকমভাবেই দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে ওরা খুঁজে পেয়েছিল চটকপুর। শিলং পাহাড়ের কাছে বড়াপানি।

এবারের বেড়ানোটাও যে আলাদা কিছু হবে না তেমন কথাবার্তা হয়ে গেছিল আগেই। খাণ্ডবী নদীর ধারে গোয়ার রাজধানী প্যানাজিস বা পানাজিতে হোটেল বুক করা ছিল। প্রথম দিনটা সেখানে উঠে ঘোরাঘুরির ফাঁকে চলছিল অচেনা জায়গার সন্ধান। খোঁজ মিলল দ্বিতীয় দিনেই। হোটেলের মালিকই খবর দিলেন কুলু নদীর মোহনায় আছে তেরাখোল দুর্গ। পানাজি থেকে গাড়িতে গেলে লাগবে ঘন্টা তিনেক। ছোটো ছোটো গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার রাস্তাটিও চমৎকার। মাঝে দু-একটা ছোটো নদী পড়বে। সব জায়গাতেই বার্জে চড়ে পেরোনর ব্যবস্থা। তবে মুশকিল একটাই। পোর্তুগিজদের তৈরি তেরাখোল দুর্গ এখন একটা হোটেল। ওটি ছাড়া ওখানে আর কোনো থাকার জায়গা নেই। তবে এখন বর্ষাকাল। তাই ট্যুরিস্ট কম। থাকার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর থাকতে যদি পাওয়া যায়, তাহলে পাহাড়, নদী, সমুদ্র, জঙ্গল সব মিলিয়ে তেরাখোল একেবারে জমজমাট।

শুনে থেকে তো দুই বন্ধুর আর তর সইছে না। হোটেলের মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ব্যবস্থা হল একটা মোটর সাইকেলের। দুজনেই দিব্যি বাইক চালাতে পারে। রাস্তাও যথেষ্ট ভালো। তাই ব্যাগ ঘাড়ে সকাল সকাল বেরিয়ে দুপুরে আগেই দুজনে পৌঁছে গেল তেরাখোল।

গোয়া আর মহারাষ্ট্রের সীমানার খুব কাছেই তেরাখোল। কুলু নামের একটা ছোট্ট নদী এসে মিলেছে আরব সাগরে। সেই মোহনার পাশেই পাহাড়ের মাথায় দুর্গটা। সমুদ্রের ধার থেকে উঠে গেছে খাড়া পাহাড়। আরব সাগরের ঢেউ যেন বারবার ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে চাইছে ওকে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ভেঙে যাচ্ছে সাদা ফেনায়। পাহাড়ের মাথায় ঠিক রাজার মুকুটের মতো বসে আছে তেরাখোল। কুলু নদীর ধারে বার্জের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দূর থেকে দুর্গটিকে দেখে দারুণ পছন্দ হয়ে গেল রণিত আর দুজনেরই।

ভাগ্য ভালো। হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে শোনা গেল একটিমাত্র ঘর খালি আছে। তবে সেটা সমুদ্রের দিকে নয়। পিছনের দিকে, মানে জঙ্গলের দিকে। তাই সই। চটপট সইসাবুদ সেরে দুজনে চলল ঘরের দিকে।

হোটেলের ভিতরটা ভারি অন্যরকম। দুর্গের স্বাভাবিক গঠন যতখানি সম্ভব না বদলে ব্যবস্থা হয়েছে অতিথিদের থাকার। তাই সরু সরু গলি, বাঁক, খাড়া সিঁড়ি, সবই আছে। আবার আধুনিক সুযোগ-সুবিধারও কোনো অভাব নেই। সব মিলিয়ে বেশ একটা রোমাঞ্চকরভাব। ঘর দেখেও দিব্যি পছন্দ হল। সমুদ্র দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু জানলা খুললেই চোখে পড়ে দুর্গ প্রাচীর, তার ওপাশে ঘন জঙ্গল। জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল যে ছেলেটি, সে অবশ্য বলল জঙ্গল গভীর হলেও হিংস্র জন্তুজানোয়ার কিছু নেই। ওপাশে মারাঠী গ্রাম আছে। সেখানকার লোকজন এই জঙ্গলের পথ দিয়েই যাতায়াত করে।

হাতমুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আকাশভেঙে নামল বৃষ্টি। একটা বেলা পুরো মাটি। বিকেল নাগাদ বৃষ্টি থামলে বেরোল দুজনে। পায়ে হেঁটে একটু ঘুরে আসার ইচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্রের ধারটা। পাহাড়ী পথের বাঁক বেয়ে কিছুদূর নামতেই দেখে পাথরের ওপর বসে আছে এক বুড়ো। পরনে তাপ্পিমারা জামা আর ঢোলা প্যান্ট। মাথায় টুপি। তাদের দুজনকে দেখেই সে মাথার টুপি নামিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, ‘আমাকে যদি পাঁচটা টাকা দাও, তাহলে আমি তোমাদের একটি সুন্দর গোয়ান কবিতা শোনাতে পারি।’ ‘আমরা কবিতা শুনতে ভালবাসি না’, গম্ভীর গলায় বলল রণিত। ‘দশ টাকা দিলে আমি একটা চমৎকার গোয়ান গান শোনাতে পারি।’ ‘আমাদের এখন গান শুনতে ইচ্ছে করছে না,’ ফের বলল রণিত। ‘কুড়িটা টাকা দিলে, আমি এই তেরাখোল ফোর্টের গল্পটা তোমাদের বলতে পারি। সেটা কিন্তু এখানকার খুব কম লোকই জানে।’ রণিত ফের কি একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু দীপকের ততক্ষণে মজা লেগেছে। সে হেসে ফেলে বলল, ‘ঠিক আছে গল্পটা আমরা শুনবো, কুড়িটা টাকাও দেবো। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প শুনতে হবে কী?’ ‘না না তা কেন?’ গম্ভীরভাবে বললে বুড়ো, ‘আমরা সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসতে পারি। সেখানে বসেই গল্প বলব।’

বুড়োর পিছন পিছন নামতে নামতে রণিত বলল, ‘কী যে করিস না তুই। এখন বসে বসে বুড়োর গাঁজাখুরি গল্প শুনতে হবে। কুড়িটা টাকাও গচ্চা।’ আর গল্প তো গল্পই।

‘শুনতে দোষ কী আছে? আর যে কোনো জায়গারই এইসব লোকমুখে চালু গল্পে অনেক রকম ইন্টারেস্টিং ব্যাপার থাকে।’ হাসতে হাসতে চলল দীপক।

সমুদ্রের ধারের বালিতে গিয়ে বসল তিনজন। মাথা থেকে টুপিটা খুলে পাশে রেখে বুড়ো শুরু করল, ‘সে অনেক বছর আগের কথা। গোয়াতে তখন পোর্তুগিজদের রাজত্ব। এই দুর্গের কেল্লাদারও ছিলেন একজদন পোর্তুগিজ। নাম রোবার্তো গঞ্জালেস। কেল্লাদারের চেহারা যেমন বিশাল, মানুষটিও তেমনি নিখুঁত, দুর্গের চাকর-বাকর, সিপাই-শান্ত্রী। সবাই তাকে যমের মতো ভয় করত। কথায় কথায় চড়-থাপ্পর মারতে, চাবুক চালাতে তার জুড়ি ছিল না। কেল্লাদারের অত্যাচার থেকে রেহাই পেত না আশপাশের গ্রামের লোকজনও। সৈন্যসামন্ত নিয়ে গ্রাম লুট করা ছিল তার কাছে খুবই আমোদের ব্যাপার।

এই কেল্লাতেই থাকত দামিনিক রোবার্তো। ফর্সা ছিপছিপে মানুষটির মনটি ছিল ভারি ভালো। কেল্লার চাকর-বাকর থেকে শুরু করে সিপাই-শান্ত্রী—সবাই ভালোবাসতো তাকে। আর সেজন্যই গঞ্জালেস দু-চক্ষে দেখতে পারতো না রোবার্তোকে। কিন্তু কিছু বলতেও সাহস পেতো না। কারণ রোবার্তো ছিল চিকিৎসক। নানারকম ওষুধ-বিষুধ জানতো সে। তখনকার দিনে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকতো। তাই কাটা-ছেঁড়া হতই। তা ছাড়া জঙ্গুলে জায়গা। অসুখ-বিসুখও হত নানারকম। কেল্লায় একজন ডক্তার থাকাটা জরুরি ছিল। তাই অপছন্দ করলেও রোবার্তোকে কেল্লা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারত না গঞ্জালেস।

রোবার্তো মাঝে মাঝেই জঙ্গল পেরিয়ে আশপাশের মারাঠী গ্রামেও ঘুরতে যেত। কাছেই কুণ্ডা নামের গ্রামে থাকত এক বুড়ো কবিরাজ। তার সঙ্গে দিব্যি ভাব ছিল রোবার্তোর। বুড়ো তাকে গাছ-গাছড়া থেকে নানারকম ওষুধ তৈরি করতে শেখায়। সেই কুণ্ডা গ্রামেরই ছেলে শিবাও ছিল রোবার্তোর খুব বন্ধু। দুজনে একসঙ্গে বেড়াত। তরোয়াল খেলত, লাঠি খেলত। শিবার বোন কুঙ্কু রোবার্তোর জন্য চমৎকার একখানা পাগড়ি বানিয়ে দিয়েছিল। সেটা পরে রোবার্তো যেদিন কেল্লায় ফিরল, সেদিন অন্যরা হাসি-তামাশা করলেও গঞ্জালেস কিন্তু রেগেছিল খুব। দেশি মানুষদের সঙ্গে এরকম ভাব-সাব গঞ্জালেস একটুও পছন্দ করত না। বিশেষত শিবা তো ছিল তার দু-চক্ষের বিষ।

তখন থেকেই সুযোগ খুঁজছিল গঞ্জালেস। একদিন রোবার্তো শহরে গেছে। ফিরতে তার রাত হবে। সেই সুযোগে নিজের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে গঞ্জালেস গিয়ে হানা দিল কুন্ডা গ্রামে। তাদের লুটপাট চালাতে দেখে তরোয়াল নিয়ে তেড়ে এল শিবা। গঞ্জালেসের সঙ্গীরা ছিল সংখ্যায় অনেক বেশি। তাই খুব সহজেই তারা শিবাকে বন্দি করে নিয়ে এল কেল্লায়। গঞ্জালেস জানিয়ে দিল পরদিন সকালে ফাঁসি হবে শিবার। সন্ধ্যায় কেল্লায় ফিরে সবকথা শুনে চমকে উঠলো রোবার্তো। গঞ্জালেসের কাছে গিয়ে শিবাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয়ও করলো। কিন্তু গঞ্জালেস সাফ জানিয়ে দিল শিবাকে ফাঁসি সে দেবেই।

রাত বাড়ছে। নিজের ঘরে ছটফট করছে রোবার্তো। কী করে বন্ধুকে বাঁচাবে সে…।

গল্পের মধ্যে এমনভাবে ডুবে গেছিল দুই বন্ধু; যে কখন একটা হাতির পালের মতো বিশাল মেঘের দল ঠিক মাথার ওপর এসে হাজির হয়েছে বুঝতেই পারেনি। বুড়ো কিন্তু ঠিক খেয়াল করেছে। টুক করে টুপিটা মাথায় পরে লাফ দিয়ে উঠে বললো, ‘তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হোটেলে ফেরো। নইলে এক্ষুনি ভিজে চুপ্পুড় হয়ে যাবে।’ ‘কিন্তু গল্পের শেষটা শোনা হল না তো?’ অবাক হয়ে বলল রণিত। ততক্ষণে পা চালিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে বুড়ো। থেমে পড়ে কীরকম একটু অদ্ভুত হেসে বললে, ‘তোমরাও তো দুই বন্ধুই আছ। আজ রাতে নিজেদের মত করে শেষটা ভাব। কাল সকালে আমি বরং শুনে দেখব গল্পের সঙ্গে মেলে কীনা।’

প্রায় ছুটতে ছুটতে হোটেলে ফিরতে না-ফিরতেই বৃষ্টি নামল মুষলধারে। বৃষ্টির মধ্যেই আস্তে আস্তে নিভে এল দিনের আলো। আর অন্ধকার একটু গাঢ় হতে বন্ধ হয়ে গেল বিদ্যুৎ সরবরাহ। হোটেলের অবশ্য নিজস্ব জেনারেটর আছে। সেটি চালু হতে কিছু কিছু আলো জ্বলল। তবে একটু পরেই ঘরে ঘরে হোটেলের বেয়ারারা গিয়ে বলে এল ‘এরকম বৃষ্টি-বাদলায় কারেন্ট চলে গেলে সাধারণত আর মাঝরাতে ফেরে না। কিন্তু সেক্ষেত্রে তো আর সারারাত জেনারেটর চালু রাখা যাবে না। তাই রাতের খাওয়া সেরে নিতে হবে তাড়াতাড়ি। সবাই খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলে জেনারেটর বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

হোটেলের ডাইনিং হলে সব অতিথিদের ডিনার হয়ে গেল রাত দশটার মধ্যেই। ঘরে ফিরে জুত করে বসল দীপক আর রণিত। জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার। মস্ত খোলা জানলার ওপাশে আরও নিশ্ছিদ্র অন্ধকার জঙ্গল। তবে গরম নেই মোটেই। বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায় কেমন একটা শীতশীত ভাব। হঠাৎ দীপক বলে উঠল, ‘আশ-পাশটা দেখে কেমন মনে হচ্ছে না, আমরা সেই গঞ্জালেস আর রোবার্তোর সময়ে ফিরে গেছি।’ ‘যা বলেছিস’, ‘হাসতে হাসতে বললে রণিত,’ মনে হচ্ছে যেন ওই জঙ্গলের ওপাশেই কুন্ডা গ্রাম। কুপি জ্বলছে। শিবা আর কুঙ্কু শোবার আয়োজন করছে। বুড়ো কিন্তু গল্প বলে ভালো।’ ‘আমার কিন্তু একটু অদ্ভুত লাগছিল। বুড়োর কথাবার্তায় কেমন যেন একটা রহস্যের ভাব আছে। যেন সব বলছে না। কিছু কথা চেপে রাখছে।’ দীন্যকর কথা শুনে রণিত বলল, ‘ওটা তো টাকা নেওয়ার কৌশল। কাল দেখবি শেষটা বলার জন্য আবার টাকা চাইবে। আর টাকা যখন দিতেই হবে তখন আমরা আর কষ্ট করে কেন ভাবব। তার থেকে চল এখন শুয়ে পড়ি। কাল ভোরে উঠে বেরোব।’

রাত তখন কটা জানা নেই। ঘুম ভেঙে গেল দীপকের। অভ্যাসমতো সময় দেখতে বালিশের পাশে মোবাইল হাতড়ে দেখে মোবাইল নেই। চমকে উঠে বসে দীপক। একী ঘরটা এরকম অন্যরকম হয়ে গেল কী করে? দুটো খাটের বদলে এখন একটা খাট। ঝালর লাগানো মশারি। কিন্তু রণিত কোথায় গেল? খাট থেকে তাড়াতাড়ি নামতেই সামনের আয়নায় চোখ পড়ল। একজন ছিপছিপে চেহারা পোর্তুগিজ যুবক। ফর্সা মুখে দারুণ উদ্বেগের ছাপ। পরনে ফ্রিল দেওয়া জামা আর পাতলুন। কিন্তু রণিত কোথায়? নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এল যুবক। দুর্গের সংকীর্ণ গলিপথ ধরে এসেছে। একটা ঘর থেকে প্রবল নাকা ডাকার আওয়াজ আসছে। হালকা হাতে সেই ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকল যুবক। খাটের ওপর একজন কেউ ঘুমোচ্ছে। অন্ধকারে একটু চোখ সইয়ে নিয়ে যুবক দেওয়ালে ঝোলানো আংটা থেকে সাবধানে খুলে নিল একটি বড়ো চাবি। ঘর থেকে বেরিয়ে গলি পথ ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে বেশ কয়েকটা বাঁক পেরিয়ে তারপর নামতে লাগল নীচে। সিঁড়ির একেবারে শেষপ্রান্তে লোহার দরজা। চাবি দিয়ে খুলে ভিতরে ঢুকতেই লাফিয়ে উঠল রণিত, ‘রোবার্তো? তুমি কী করে এলে?’ ‘চুপ কথা বোলো না। রক্ষীরা সব ঘুমোচ্ছে। এই সুযোগে তোমাকে পিছনের দরজা দিয়ে বার করে দেব।’ “কিন্তু তুমি? তোমার কী হবে? গঞ্জালেস ঠিক বুঝতে পারবে তুমিই আমাকে ছেড়ে দিয়েছো। তুমিও আমার সঙ্গে চল।’ ‘তা হয় না শিবা। এরা আমার জাতভাই। আমাকে এদের সঙ্গেই থাকতে হবে। কিন্তু তুমি আর দেরি কোরো না। কেউ জেগে গেলে তোমাকে আর বাঁচাতে পারব না।’ শিবা একটু ভাবলে, তারপর বললে, ‘তুমি শুধু ভোর হওয়া পর্যন্ত সাবধানে থেকো। সকাল হতেই আমি সব গ্রামের ছেলেদের নিয়ে আসব দুর্গ আক্রমণ করতে।’ দুজনে নিঃশব্দে উঠে এল ওপরে। খুব সাবধানে পাহারাদারদের নজর এড়িয়ে রোবার্তো শিবাকে নিয়ে এল জঙ্গলের দিকে দুর্গের খিড়কির দরজায়। কিন্তু দরজা খোলার সময় হাত ফসকে পড়ে গেল লোহার খিল। মুহূর্তে জেগে উঠল রক্ষীরা। ‘পালাও শিবা পালাও’ কোনোরকমে শিবাকে দরজার বাইরে ঠেলে দিয়ে বললে রোবার্তো। বিদ্যুৎগতিতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল শিবা। রক্ষীরা ছুটে এসে ধরে ফেলল রোবার্তোকে। খবর গেল গঞ্জালেসের কাছে।

‘কেন ছেড়ে দিয়েছ তুমি বন্দীকে?’ ক্রুর হেসে জানতে চাইল গঞ্জালেস। তার নিষ্ঠুর মুখের দিকে তাকিয়ে রোবার্তো বলল, ‘ও আমার বন্ধু। তুমি ওকে অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছিলে।’ ‘কেল্লাদারের আদেশ অমান্য করেছ তুমি। তোমার শাস্তি মৃত্যু। কাল সকালের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হবে রোবার্তোকে। হুকুম দিয়ে চলে গেল বিশালদেহী গঞ্জালেস।

ফাঁসিকাঠ তৈরি। হাত-পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে রোবার্তোকে। পূবের আকাশ আস্তে আস্তে লাল হচ্ছে। আর বেশিক্ষণ নয় বুঝতে পারছে দীপক। সূর্য উঠলেই গঞ্জালেসের হুকুম তামিল হবে। কিন্তু দুর্গের বাইরে কীসের অত গণ্ডগোল? কারা ভেঙে ফেলতে চাইছে মূল ফটক? রক্ষীরা দৌড়াদৌড়ি করছে কেন?

ধড়মড় করে উঠে বসল দীপক। সকাল হয়ে গেছে। সূর্যের আলোয় ঘর ভেসে যাচ্ছে। জানলার বাইরে বৃষ্টি ভেজা সবুজ বন। পাশের খাটে বসে কীরকম যেন অস্বাভাবিকভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে রণিত? ‘তুই কি কোনো স্বপ্ন দেখলি?’ ভাঙা গলায় জানতে চাইল দীপক। ‘হ্যাঁ’ একটু চুপ করে থেকে কেমন যেন নিশ্চিত গলায় রণিত ফের বলল ‘একই স্বপ্ন।’

বেলা বেড়েছে। আজই পানাজিতে ফিরছে দীপক আর রণিত। হোটেলের বিল চুকিয়ে বেড়িয়ে পড়ল দুজনে। রণিত বাইক চালাচ্ছে, পিছনে দীপক। বাঁক ঘুরতেই পাথরে বসা টুপি মাথায় বুড়ো। একটুও স্পিড না কমিয়ে বেরিয়ে গেল রণিত। টুপিটা মাথা থেকে খুলে বুড়ো শুধু একটু অদ্ভুত হাসলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *