তেপান্তর
আকাশে একবার মেঘ ডাকতেই আমার বুকটাও গুড়গুড় করে উঠল৷ রবি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে? এরপর যে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে কিছুই দেখতে পাব না৷
অনেকদিন থেকেই রবি আমাকে বলছিল, একদিন সে আমাকে একটা প্রজাপতির দেশ দেখাবে৷ একবার সে নৌকোয় করে যেতে-যেতে তিন বাঁকের চরে হাজার হাজার প্রজাপতি দেখেছে, ছোট, বড়, মাঝারি নানারকমের, এক একটা প্রজাপতি নাকি ঘুড়ির মতন প্রকাণ্ড৷ তিন বাঁকের চরে অনেক সূর্যমুখী ফুল ফোটে, অনেকে বলে, সেখানে জলকন্যাদের দেখা যায় মাঝে-মাঝে, প্রজাপতিরা তাদের ঢেকে রাখে৷
আমি তো গেছি কলকাতা শহর থেকে, আমি নৌকো চালাতে জানি না৷ সাঁতার জানি মোটামুটি, তাও কোনওদিন নদীতে সাঁতার দিইনি৷ কে আমাকে তিন বাঁকের চরে নিয়ে যাবে?
বাবা চাকরিতে বদলি হয়ে বিদেশে চলে গেছেন, তাই আমরা চলে এসেছি গ্রামের বাড়িতে৷ ভর্তি হয়েছি এখানকার ইস্কুলের ক্লাস এইটে৷ আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুর্দান্ত ছেলে এই রবি৷ সে তরতর করে খেজুরগাছে উঠতে পারে, গাছের ডগা থেকে লাফিয়ে পড়ে পুকুরে, একবার সে খালি হাতে একটা সাপের ল্যাজ ধরে বোঁ-বোঁ করে মাথার ওপর ঘুরিয়েছিল৷
আমার কাছে একটা মাউথ অর্গান ছিল৷ রবি আমাকে বলেছিল, ‘‘তোর ওই বাজনাটা আমাকে দিবি? তার বদলে তোকে আমি এমন প্রজাপতির দেশ দেখাব, যা তুই জন্মে দেখিসনি৷’’
নদীর মাঝখানের চরে সূর্যমুখী ফুলের বাগান, সেখানে কখনও কখনও উঠে আসে জলকন্যারা, তাদের ঘিরে থাকে হাজার-হাজার প্রজাপতি৷ এরকম জায়গা কি সত্যিই কোথাও আছে? রবির কথাটা অবিশ্বাস করাও যায় না৷ মাঝে-মাঝেই আমি সেই প্রজাপতির দেশের স্বপ্ন দেখি৷
একদিন স্কুল ছুটি হয়ে গেল ফার্স্ট পিরিয়ডে৷ হেডমাস্টারমশাই গভর্নমেন্টের কাছ থেকে কী যেন একটা প্রাইজ পেয়েছেন, সেই জন্য৷ আমি একা-একা বাড়ি ফিরে আসছি, হঠাৎ পেছন থেকে রবি আমার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘‘এই নিলু, আজ যাবি?’’
রাস্তার ধারেই একটা খাল, সেখানে একটা নৌকো বাঁধা৷ রবি সেই নৌকোর কাছে আমাকে নিয়ে গেল৷
আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘‘নৌকো কে চালাবে?’’
রবি ঠোঁট উলটে বলল, ‘‘আমি চালাব৷ নৌকো চালানো কী এমন একটা ব্যাপার?’’
আমি নৌকোয় উঠতে যেতেই রবি বলল, ‘‘বই-খাতাগুলো দে৷ ওগুলো নিয়ে যাবার দরকার নেই৷ দৈবের কথা তো বলা যায় না৷ সাঁতার জানিস তো?’’
আমি জোরে-জোরে মাথা নেড়ে বললুম, ‘‘হ্যাঁ জানি৷’’
রবি এত সাহসী, তার কাছে আমি ভিতু সাজব কেন? আর কেউ জানতে পারবে না, আমরা দু’জনে নৌকো করে প্রজাপতির দেশ দেখে আসব৷
খাল দিয়ে খানিকটা যাবার পরেই নদী৷ এই নদীর নাম কলাবতী৷ তারপর এক বাঁক ঘুরলেই অন্য নদী, তার নাম চাঁপাই৷ কলাবতীর চেয়ে চাঁপাই অনেক বড়, এদিকে কোনও বাড়ি-ঘর নেই৷ দু’দিকে শুধু ধু ধু মাঠ৷ সেই মাঠের ওপর থেকে হাতির পালের মতন ধেয়ে আসছে কালো-কালো মেঘ৷
একসময় চড়াত করে বিদ্যুৎ খেলে গেল আকাশে৷ জুঁইফুলের মতন একফোঁটা-দু’ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে মাঝে-মাঝে৷ এর মধ্যেই কালো হয়ে এল আকাশ৷
নৌকোটা এখন যাচ্ছে বেশ জোরে৷ রবি এক হাতে বৈঠা বাইছে৷ এক-একবার সে বৈঠাটা তুলে নিলেও নৌকো চলছে ঠিকই৷
আমার ভয়-ভয় করছে, কিন্তু সে-কথা তো রবিকে বলা যায় না৷ আমি বললুম, ‘‘যদি খুব বৃষ্টি নামে, তখন কি প্রজাপতিদের দেখা যাবে?’’
রবি উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল৷
আমি বললুম, ‘‘রবি, আজ ফিরে গেলে হয় না?’’
রবি বলল, ‘‘হুঁ!’’
তারপরই আবার বিদ্যুৎ-চমকের সঙ্গে বাজের শব্দ৷ ঝড় উঠল শনশন করে৷ নৌকোটা ভীষণভাবে দুলছে৷
আমি চিৎকার করে বললুম, ‘‘রবি, এবার ফিরে চল৷’’
রবি বলল, ‘‘নৌকো ঘোরাতে পারছি না৷ ভীষণ স্রোত৷’’
কাছাকাছি আর কোনও নৌকো কিংবা মানুষজনও দেখা যাচ্ছে না৷ কারও কাছে যে সাহায্য চাইব, তারও উপায় নেই৷ তা হলে এখন কী হবে!
রবি প্রাণপণে ঘোরাবার চেষ্টা করতেই একটা বড় ঢেউয়ের মাথায় লাফিয়ে উঠল নৌকোটা৷ আমি বুঝলুম, নৌকোটা উলটে যাচ্ছে, আমাদের আর কিছুই করার নেই৷
রবি চেঁচিয়ে বলল, ‘‘লাফিয়ে পড় নিলু৷’’
আমাকে আর লাফাতে হল না, ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে গেলুম একদিকে৷ কয়েকবার হাবুডুবু খাবার পর বুঝতে পারলুম, আমি ডুবে যাচ্ছি, একটু পরেই আমি মরে যাব৷ বাড়ির কেউ জানতেও পারবে না৷
তারপরেই মনে পড়ল, আমি কেন ডুবে যাব? আমি তো সাঁতার জানি৷ নদীর ঢেউতে কখনও সাঁতার কাটিনি বটে, কিন্তু কলকাতায় দেশবন্ধু পার্কের পুকুরে সাঁতরেছি৷
প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়তেই আমি আবার ভেসে উঠলুম৷
তারপর একবার ডুবে একবার ভেসে, আবার ডুবে, আবার ভেসে একসময় আমার মাথা কিসে যেন ধাক্কা খেল৷ মুখ তুলে দেখি যে, একটা গাছ৷ আমি নদীর এক পাড়ে পৌঁছে গেছি৷
ওপরে উঠে দাঁড়াবার পর মনে পড়ল, রবি কোথায়? এতক্ষণ নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য এমন ব্যস্ত ছিলুম যে, রবির কথা বিশেষ চিন্তা করিনি৷ রবি আমার চেয়ে অনেক ভালো সাঁতার জানে, তার তো আগেই পৌঁছে যাওয়ার কথা৷
কিন্তু রবিকে কোথাও দেখা গেল না৷ নৌকোটাও তলিয়ে গেছে নদীতে৷
আমাদের নৌকোটা ছিল নদীর প্রায় মাঝামাঝি৷ রবি আর আমি ছিটকে পড়েছি দু’দিকে৷ তা হলে কি আমি নদীর একপাড়ে এসে পৌঁছেছি, রবি চলে গেছে অন্য পাড়ে?
নদীর ওপার বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেছে৷
আমি যেখানে উঠেছি, সেখানে একটা বড় বটগাছ, তার কাছাকাছি অনেক ছোট-ছোট গাছের ঝোপ৷ হঠাৎ একটা ঝোপের মধ্যে ঝটাপট শব্দ হল৷ ওখানে কোনও মানুষ আছে নাকি!
আমি এগিয়ে গিয়ে সেই ঝোপে উঁকি মারবার আগেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল একটি সাক্ষাৎ যমদূত৷ একটি বিরাট লম্বা কুমির৷ আমি কোনওদিন এত কাছ থেকে কুমির দেখিনি৷ কুমিরের চোখ যে এত ভয়ঙ্কর হয়, তা জানতুম না৷ সেই চোখের দিকে তাকালে যেন চুম্বকে টেনে ধরে, পালাবার কথাও মনে পড়ে না৷
কুমিরটার মুখের মধ্যে অন্য একটা জন্তু রয়েছে৷ সেটা কুকুর না শেয়াল তা ঠিক বোঝা গেল না৷ জন্তুটা ছটফট করছে এখনও৷ কুমিরটা জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পলক, বোধহয় ভাবল, মুখের খাবারটা ফেলে দিয়ে আমাকে ধরবে কি না৷ তারপর মন ঠিক করে সে সরসর করে নেমে গেল নদীর জলে৷
এই নদীতে কুমির আছে? রবি তো সে-কথা একবারও বলেনি আমাকে৷ কুমির থাকলে আর সে-নদীতে সাঁতার জানা কিংবা না-জানা একই কথা৷ এতক্ষণ আমায় যে কুমিরে খেয়ে ফেলেনি সেই তো আমার সাত পুরুষের ভাগ্য৷
কুমিরটা জলে নেমে যেতেই আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মারলুম৷
কোথায় যাচ্ছি, কোনদিকে যাচ্ছি, কিছুই জানি না৷ খালি মনে হচ্ছে, কুমিরটা জলে নেমে ওর শিকারটা রেখে এসে আবার আমায় তাড়া করবে৷
একবার এক জায়গায় আছাড় খেয়ে পড়ে গেলুম৷ চট করে পেছনে তাকিয়ে দেখি, না, কুমির-টুমির কিছু আসছে না৷
বৃষ্টি অনেকটা কমে এসেছে৷ সামনে ধু ধু মাঠ৷ কোথাও একটা বড় গাছও নেই, বাড়ি-ঘর তো দূরের কথা৷ রবির কথা শুনে আমি কী বিপদে পড়লুম, আর কি কোনওদিন বাড়ি ফিরতে পারব?
কোথায় বলেছিল সূর্যমুখী ফুলের বাগান, জলকন্যা আর প্রজাপতি দেখাবে, তার বদলে সপসপে ভিজে গায়ে আমি কুমিরের তাড়া খেয়ে হাঁপাচ্ছি৷ এক্ষুনি আর দৌড়োবার ক্ষমতাও নেই৷
এই অবস্থাতেও মনে পড়ল, ভাগ্যিস বই-খাতাগুলো সঙ্গে আনিনি৷ আনলে সব নষ্ট হয়ে যেত৷ রবি সেগুলো রেখে এসেছে একটা দোকানে৷ রবি কি জানত হঠাৎ নৌকো ডুবে যেতে পারে? চাঁপাই নদীতে যে কুমির আছে তাও কি জানত রবি?
নদীর দিকে ফিরে যাবার আমার একদম সাহস নেই৷ সামনে তেপান্তরের মাঠ, তার মধ্যেই বা কোনদিকে যাব৷
খানিকক্ষণ জিরোবার পর হাঁটতে লাগলুম আস্তে-আস্তে৷ আস্তে-আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছে৷ আকাশের যা অবস্থা, আবার বৃষ্টি হতে পারে৷ এই মাঠের মধ্যে আমাকে একা-একা থাকতে হবে নাকি?
হঠাৎ থপথপ শুনে আমি ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠলুম৷ এখানে আবার কী?
তাকিয়ে দেখি, একটা মস্ত বড় কোলাব্যাং৷
ব্যাং দেখে ভয় পাবার কিছু নেই ঠিকই৷ কিন্তু যেখানে ব্যাং থাকে, সেখানেই নাকি সাপ থাকে? চারদিকে তাকিয়ে দেখলুম, না, সাপ-টাপ দেখা যাচ্ছে না৷
ব্যাংটা তার ড্যাবডেবে চোখ মেলে আমাকে দেখছে৷ আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে সে মস্ত-মস্ত চারখানা লাফ মেরে অনেকটা দূরে চলে গেল৷ কিন্তু পালাল না৷ সেখানে থেমে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল আমাকে৷
আমার মনে হল, ব্যাংটা যেন আমাকে ডাকছে৷
যাঃ, তা কি হতে পারে? ব্যাং কেন মানুষকে ডাকবে? মানুষ দেখলে তো তার ভয় পাবার কথা৷
কিন্তু এই তেপান্তরের মাঠের মধ্যে আমি একেবারে একা৷ ব্যাংটাই আর একমাত্র জ্যান্ত প্রাণী৷ ব্যাংটা দূরে চলে গেলে আর কেউ থাকবে না৷
ব্যাংটা যেভাবে লাফিয়েছিল, আমিও ঠিক সেইভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে ওর পেছনে এসে দাঁড়ালুম৷ ব্যাংটা দু’বার ক্রোঁক-ক্রোঁক শব্দ করল৷ ঠিক যেন খুশি হয়েছে৷
আবার সে লাফ মারল কয়েকটা৷ আমিও চললুম ওর সঙ্গে-সঙ্গে৷
খানিকটা যাবার পর দেখি সামনে একটা ডোবা৷ বেশ জল জমে আছে৷ তখন ভাবলুম, ব্যাং তো জল ভালোবাসে! সে নিশ্চয়ই এই ডোবায় নেমে যাবে৷
ব্যাংটা কিন্তু ডোবায় নামল না৷ ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় দেখে আরও দু’বার ক্রোঁক-ক্রোঁক করে ডেকে লাফাতে লাগল, আমি বুঝতে পারলুম, ব্যাংটা এলোমেলো লাফাচ্ছে না, ঠিক একটা দিকেই সে যাচ্ছে৷ কোনদিকে যাচ্ছে সে, আমাকে কোনও বিপদে ফেলে দেবে না তো!
হঠাৎ মেঘ ফুঁড়ে খানিকটা সূর্যের আলো ফুটেছে৷ লাল রঙের আলো৷ তার মানে সন্ধে হতে দেরি নেই৷
ক্রোঁক করার বদলে ব্যাংটা একবার কোঁয়াক করে বেশ জোরে ডেকে উঠল৷ এবারে দেখি সামনে একটা ইঁদুর৷ বেশ বড়সড় চেহারা, মাঠের ধেড়ে ইঁদুর যাকে বলে৷ অত বড় ইঁদুর দেখলে আমার ভয় লাগে৷ যদিও জানি, ইঁদুর কখনও তেড়ে এসে মানুষকে কামড়ায় না৷
ব্যাংটা এখানে ডাকাডাকি আর লাফালাফি করছে কেন? ইঁদুর দেখে ভয় পেয়েছে? ইঁদুরে কি ব্যাং খায়? ইঁদুরটা যদি কোলাব্যাংটাকে তেড়ে আসে, তা হলে আমি ব্যাংটাকেই সাহায্য করব, কারণ এইটুকু সময়ের মধ্যে ও আমার বন্ধু হয়ে গেছে৷
কিন্তু ইঁদুর আর ব্যাঙের লড়াই হল না৷ ব্যাংটা দু’বার আমার দিকে তাকিয়ে টপ করে একটা গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল৷ যাঃ, ব্যাংটা কেটে পড়ল এইভাবে৷
বাকি রইল ইঁদুরটা৷ সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ বোঝার চেষ্টা করছে আমি তার শত্রু কি না৷ আমার বয়ে গেছে একটা ইঁদুরের সঙ্গে শত্রুতা করতে৷
ইঁদুরটা ঠিক ব্যাংটার মতোই হঠাৎ খানিকটা দৌড়ে গিয়ে আবার থেমে মুখ ফিরিয়ে তাকাল আমার দিকে৷ ইঁদুরটাও আমায় ডাকছে নাকি?
আমি চারদিক তাকিয়ে দেখি, এখনও ধু ধু করছে তেপান্তরের মাঠ৷ কোথাও আলো নেই৷ আমি কোনদিকে যাব? একটু বাদেই একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাবে৷
আমি ইঁদুরটার দিকেই দৌড়োলুম৷
ইঁদুরটা চিক-চিক করে কয়েকবার ডেকে আবার ছুটতে শুরু করল, আমিও তার পেছনে পেছনে, দেখাই যাক কী হয়৷
ব্যাঙের চেয়ে ইঁদুর অনেক জোরে যেতে পারে, ইঁদুরের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে আমি হাঁপিয়ে থেমে যেতেই সেও থেমে যাচ্ছে৷ চিক-চিক চিক-চিক করে ডাকছে৷
খানিকবাদেই আমরা পৌঁছে গেলুম একটা নদীর ধারে৷ এ-নদীটা চাঁপাইয়ের চেয়ে ছোট নদী, তবে কি এটা কলাবতী? কিংবা অন্য কোনও নদী? এখানেও কুমির আছে?
একটুখানি দম নিয়ে মুখ তুলে দেখি একটা পাল-তোলা নৌকো যাচ্ছে, নৌকোর ছইয়ের মধ্যে দুলছে লণ্ঠন৷
আমি চিৎকার করে উঠলুম, ‘‘ও মাঝি, ওগো তোমরা নৌকোয় কে আছ, আমাকে তুলে নাও, আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি৷’’
দু’তিনবার ডাকতেই নৌকোটা মুখ ফেরাল৷ আমার বুক আনন্দে ধকধক করতে লাগল৷ তবে কি শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাব?
নৌকোটা তীরের কাছাকাছি আসার পর একজন জিজ্ঞেস করল, ‘‘কে গো, কে ডাকছিলে?’’
আমি দু’হাত তুলে বললুম, ‘‘আমি৷ এই যে আমি৷’’
একটা টর্চের আলো এসে পড়ল আমার মুখে৷ তারপর নৌকোটা আরও কাছে চলে এল৷ আমি দৌড়ে গিয়ে এক লাফে উঠে পড়লুম সে-নৌকোয়৷ তারপরই অজ্ঞান৷
জ্ঞান ফিরল খানিকটা বাদেই৷ দেখি যে সেই নৌকোয় রয়েছেন আমার ছোটকাকার বন্ধু রমেনকাকু৷ তিনি খুব চিন্তিতভাবে বললেন, ‘‘কী রে নিলু, তোর কী হয়েছে? তুই এখানে কী করে এলি?’’
আমি লজ্জায় আস্তে-আস্তে বললুম আমার আর রবির অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনি৷
নৌকোর একজন মাঝি বলল, চাঁপাই নদী বড় বাজে নদী৷ দুটো-চারটে কুমির খুব উৎপাত করছে৷ তবে নদীর ওধারে গেলে ভয় ছিল না৷ সেখানে মানুষজন থাকে৷ এধারে তেপান্তরের মাঠ৷ বড় ভয়ের জায়গা৷ ওখানে রাত্তিরে আলেয়া ভূত বেরোয়৷ লোকে অন্ধকারে ওই মাঠের মধ্যে গেলে আর দিক খুঁজে পায় না৷ এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত মারা যায়৷
রমেনকাকু জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুই ওই তেপান্তরের মাঠে পড়েছিলি৷ খুব জোর বেঁচে গেছিস, নিলু৷ তোকে কে পথ দেখিয়ে এই নদীর ঘাটে নিয়ে এল?’’
আমি চুপ করে রইলুম৷ এর কী উত্তর দেব? যারা আমাকে পথ দেখিয়েছে, তাদের নাম বললে কেউ বিশ্বাস করবে?
—