তেত্রিশ নম্বর ঘর – দিব্যেন্দু পালিত
সেদিন দিনটাই ছিল গোলমেলে৷ কোনো এক রবিবার৷ পরের দিন সকাল নটায় এক বড়সড় সরকারি আমলার সঙ্গে জরুরি মিটিং৷ রাতের প্লেনে গেলেই হত, কিন্তু কলকাতা থেকে দিল্লি যাবার ফ্লাইট প্রায়ই দেরি করে বলে ভোরের ফ্লাইটেই যাব ঠিক করেছিলাম৷ আর কিছু না হোক, তাতে হাতে থাকত পুরো একটি দিন, সময়টা কাজে লাগানো যেত অন্যভাবে—তারপর ধীরেসুস্থে পরের দিন যাওয়া যেত মিটিংয়ে৷
কিন্তু গোড়াতেই হয়ে গেল গণ্ডগোল৷ ভোর চারটেয় অ্যালার্ম দেওয়া ছিল ঘড়িতে৷ ঘুম যখন ভাঙল দেখি সাড়ে পাঁচটা৷ তার মানে অ্যালার্ম বাজেনি৷ ডিসেম্বরের ভোর সাড়ে পাঁচটায়, অন্ধকার ও কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে চারদিক—সেটা সান্ত্বনার বিষয় নয় কোনো ছটা পনেরোর ফ্লাইট কাঁটায় কাঁটায় উড়ে যাবে ঠিকই৷ ফাঁকা রাস্তায় তীব্র গতিতে ট্যাক্সি ছুটলেও আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে কম করেও আধঘণ্টা লাগবে৷ যাই হোক এইসব ভাবনা ও উৎকণ্ঠা নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখলুম যা ভয় পেয়েছিলাম তাই, চেক-ইন কাউন্টার ফাঁকা৷ একজন অফিসার বললেন, দশ মিনিট আগে এলেও উপায় ছিল৷ প্লেন টেকঅফের জন্যে রওনা হয়ে গেছে, মিনিট খানেকের মধ্যেই উড়ে যাবে আকাশে৷
টিকিটটা যাতে বাতিল না হয়ে যায় এবং সিট পাওয়া যায় সন্ধ্যার ফ্লাইটে, সেই ব্যবস্থা করে ফিরতে হল অগত্যা৷ তবু ভাবনা গেল না৷ আর কিছু নয়, হোটেল বুক করা আছে সকাল থেকে, অন্তত সেখানে জানিয়ে দেওয়া দরকার যাতে বুকিংটা ক্যানসেল না করে৷ ছোটখাটো কোম্পানি আমাদের, দিল্লিতে ব্রাঞ্চ নেই কোনো৷ ওখানকার কাজকর্ম দেখার জন্যে আছে একজন সংযোগ অফিসার, নাম সদাশিব রায়৷ দিনতিনেক আগে ফোনে কথা বলার সময় সদাশিব বলেছিল, দিল্লিতে এখন কোনো হোটেলে জায়গা পাওয়া মুশকিল—একে ট্যুরিস্টদের মরশুম, তার ওপর একই সঙ্গে চলেছে ট্রেড ফেয়ার আর কমনওয়েলথ কনফারেন্স৷ যাই হোক লোধি এস্টেটের কাছাকাছি একটা মাঝারি হোটেলে আমার জন্যে রুম বুক করে সদাশিব বলল পালাম এয়ারপোর্টে আসবে৷
ফ্লাইট মিস করে ঘণ্টা দেড়েক পরে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুধুই মনে হতে লাগল, হয়রানি আমার চেয়ে বেশি সদাশিবের—ফ্লাইট ল্যান্ড করার সময় হয়ে এল প্রায় বেচারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে এয়ারপোর্টে পৌঁছে অপেক্ষা করছে আমার জন্যে! তখনি ঠিক করে নিলুম, আরো কিছুক্ষণ পরে, অর্থাৎ সদাশিবকে বাড়িতে ফেরার সময় দিয়ে, ট্রাঙ্ক করব দিল্লিতে, উদ্দেশ্য দুটো৷ এক, ব্যাপারটা বিস্তারিত জানানো এবং হোটেল বুকিংটা যাতে ক্যানসেল না হয় তা দেখা৷ অবশ্য ক্যানসেল হলেই যে রাস্তায় ঘুরতে হবে তার কোনো মানে নেই৷ সদাশিব ওর বাড়িতেই উঠতে বলেছিল৷ তাছাড়া দিল্লিতে থাকেন আমার এক জেঠতুতো দাদা এবং মাসিও৷ ঠিকানা জানা আছে, তেমন তেমন দরকার হলে এই দুটো জায়গার যে কোনো একটাতে ওঠা যেতে পারে স্বচ্ছন্দে৷ তবে কিনা অফিসের কাজে গিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠা আমার ঠিক পছন্দ হয় না৷
ট্রাঙ্ককল করতে গিয়েই পড়লুম ঝামেলায়৷ বলেছি না, দিনটাই ছিল গোলমেলে— হঠাৎ একেকটা দিন যেমন হয় আর কি, নিজের ইচ্ছে, পছন্দ ও প্রয়োজনমতো যা করতে যাওয়া যায় তাতেই পড়ে বাগড়া৷ ঘণ্টা তিনেক ট্রাঙ্ক লাইনে সদাশিবকে পাবার অপেক্ষা করে যখন আবার তাগাদা দিলুম, ওদিক থেকে ট্রাঙ্ক অপারেটর মিষ্টি গলায় জানিয়ে দিল, লাইন পাওয়া যাচ্ছে না—দিল্লির সমস্ত লাইন ‘ডাউন’৷
যে-কোনো সিজনড এয়ার ট্র্যাভেলারই এক আধবার ফ্লাইট মিস করার অভিজ্ঞতায় ভুগেছেন—কলকাতার রাস্তার ভয়াবহ জ্যাম যে-কোনো দিনই যে-কারুর সামনে ঘটিয়ে তুলতে পারে এই পরিস্থিতি৷ আর টেলিফোনের লাইন না পাওয়া নিয়েও অত হা-হুতাশ করার মানে হয় না কোনো—না পাওয়াটাই বরং অনেক বেশি স্বাভাবিক৷
দিনটা যে গোলমেলে তার আর একটি প্রমাণও পেয়ে গেলুম৷ সকালে আমার দেরিতে পৌঁছনোর জন্যে এক মিনিটও অপেক্ষা করেনি ফ্লাইট৷ কিন্তু সন্ধ্যায়, রিপোর্টিং টাইমের আধঘণ্টা আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছে শুনলুম, বোম্বের ফ্লাইট আসছে দু’ঘণ্টারও বেশি দেরিতে—সেই এয়ারক্র্যাফটই কলকাতায় যাত্রী নামিয়ে ও তুলে দিল্লি যাবে সুতরাং নির্দিষ্ট সময়ের অন্তত আড়াই তিন ঘণ্টার পরে ছাড়বে দিল্লির ফ্লাইট৷
হতাশ বোধ করলেও হাল ছাড়লুম না আমি৷ বুকশপ থেকে নিক কার্টারের একটা সস্তা থ্রিলার কিনে জুত হয়ে বসলুম লাউঞ্জে৷ তখনি ভাবলুম, সদাশিব নিতান্তই বোকা লোক নয়৷ কাজটা কত জরুরি বুঝলে এটাও বুঝতে পারবে কোনো কারণে সকালে না যেতে পারলেও রাত্রে ঠিকই পৌঁছে যাব৷
অবশেষে সত্যি সত্যিই যখন প্লেন থেকে দিল্লিতে নামলুম, রাত তখন প্রায় দেড়টা৷ প্লেন ল্যান্ড করার পরই হোস্টেসের ঘোষণা শুনে বুঝেছিলাম জব্বর শীত পাব বাইরে৷ বাইরে আসতেই টের পেলুম শীত কাকে বলে৷ হঠাৎই যেন কেউ একটা বরফের মুখোশ এঁটে দিল মুখে৷ অবশ হয়ে আসছে চামড়া, হাত-পা৷ অবশ্য একেবারেই যে প্রস্তুত ছিলাম না তা নয়৷ গলা-উঁচু পুলোভারটা কানের কাছে টানাটানি করে যতটা সম্ভব ঢেকে ফেললুম ঘাড়ের পিছনটা৷ কনকন করে উঠল স্যুটকেস-ধরা বাঁ হাতের আঙুলগুলো৷ এমনিতে ব্যস্ত দিল্লি এয়ারপোর্ট সম্ভবত ঘুমিয়ে ছিল এতক্ষণ এই মাত্র এসে পৌঁছনো কলকাতার যাত্রীদের তাড়াহুড়ো ও খাপছাড়া কথাবার্তার শব্দে জেগে উঠতে না উঠতেই শান্ত হয়ে গেল আবার৷
এত রাতে, এই প্রচণ্ড শীতের মধ্যে নির্দিষ্ট খবর না পেয়েও সদাশিব অপেক্ষা করবে আমার জন্যে এমন আশা করিনি৷ তবু এয়ারপোর্টের বাইরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলুম কিছুক্ষণ৷ আশপাশে দাঁড়ানো যাত্রীদের ভিড় কমতে লাগল ক্রমশ৷ মনঃস্থির করে নিলুম আমি৷ এত রাতে খবর না দিয়ে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়া উচিত হবে না৷ হোটেলেই যাব৷ যতই ভিড় থাকুক, রাত কাটাবার জায়গা পাব না এমন হতে পারে না৷ একান্তই যদি কোনো কারণে বুকিং ক্যানসেল হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে হোটেল থেকেই বরং ফোন করা যাবে সদাশিবকে৷
এইসব ভেবে স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে উঠে বসলুম একটা ট্যাক্সিতে৷ হোটেলের নাম বলতে মাফলারে কান-মাথা-মুখ-ঢাকা বেঁটেখাটো চেহারার ড্রাইভারটি একবার তাকাল আমার দিকে৷ তারপর আর কিছু না বলে কুয়াশার ভিতর দিয়ে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলল ট্যাক্সিটা৷
অল্প গা-ছমছম করলেও ভয় কেটে গেল যখন মিনিট কুড়ি-পঁচিশের মধ্যেই আমাকে হোটেলের সামনে পৌঁছে দিল ট্যাক্সিওলা৷ কিছু বাড়তি সমেত ভাড়া মেটাতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হল আমার, সকাল থেকে যতগুলি যাত্রার মধ্যে ছুটোছুটি করতে হয়েছে আমাকে তার মধ্যে এই ট্যাক্সি চড়ার ব্যাপারটাই ছিল সবচেয়ে নিরাপদ৷ এমনও হতে পারে, ভাবলুম, ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরোবার পরই শুরু হয়ে গেছে আর একটা দিন৷ গতকালের দিনটি গোলমেলে ছিল বলে আজকের দিনটাও যে একই রকম হবে তার মানে নেই কোনো৷ বোধ হয় ফাঁড়া কেটে গেল৷ এখন হোটেলে একটা রুম পেলেই হল৷ একবার ঘরের মধ্যে ঢুকতে পারলেই বিছানায় ছুঁড়ে দেওয়া নিজেকে৷ তারপর ঘুম৷ ভাবতে ভাবতেই শরীর কাঁপিয়ে উঠে এল লম্বা এক হাই৷
সদাশিবের ঠিক-করা হোটেলটা যে মাঝারি ধরনের তা আগেই বলেছি৷ পাঁচ-তারা হোটেলের রমরমা নেই এখানে৷ যেটুকু না জ্বাললেই নয়, তার বেশি আলো নেই কোথাও৷ আলো অন্ধকারে নিঃশব্দ পড়ে আছে লরি—একটিও লোক নেই সেখানে৷ শুধু লম্বা একটি সোফায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত কম্বলে ঢেকে ঘুমোচ্ছে একটি লোক৷ ঢাকা বলেই মুখ চোখ দেখা যায় না৷ এইসব দেখতে দেখতেই রিসেপশন কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলুম আমি৷
কাউন্টারের ভিতর দিকে চেয়ারে বসে গল্প করছিল দুটি যুবক৷ আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল৷
‘ইয়েস স্যার, হোয়াট ক্যান উই ডু ফর ইউ?’
যে কথা বলল, ‘দুজনের মধ্যে সেই যুবকটি বেশ লম্বা ও স্বাস্থ্যবান৷ অন্য জন বেঁটে ও রোগা—হাতের মুঠোয় আড়াল করে ধরা সিগারেট৷ গাল ভাঙা ও চোখের নীচে ক্লান্তির ছায়া৷ এক পলক দু’জনকেই দেখে নিয়ে নিজের পরিচয় দিলুম আমি৷ বললুম, ‘বুকিং আছে আমার নামে—একটা রুম চাই—’
লম্বা যুবকটি বলল, ‘দুঃখিত৷ কোনো রুম খালি নেই৷’
‘তা কি করে হবে!’ চিন্তিত গলায় বললুম আমি, ‘আমার নামে বুকিং কনফার্ম করা আছে!’
‘কনফার্ম করা আছে!’ যুবকটি অবাক চোখে তাকাল আমার দিকে৷ তারপর কাউন্টারের পিছনে র্যা কের ওপর রাখা বড় মাপের বুকিং রেজিস্টারটা টেনে নিয়ে ওলটাতে লাগল৷ খানিক পরে বলল, ‘আপনার বুকিং ছিল গতকাল সকালে৷ না আসার জন্য ক্যানসেল হয়ে গেছে৷ উই হ্যাড নো ফারদার ইনফরমেশন!’
‘ক্যানসেল হয়ে গেছে!’ দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলুম নিশ্চিত শুকিয়ে গেছে আমার মুখ৷ বললুম, ‘ফ্লাইট মিস করেছিলুম বলেই আসতে পারিনি৷ অন্তত রাতটা কাটানোর জন্যে কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন না আপনারা!’
‘রুম খালি থাকলে নিশ্চয়ই করতাম, স্যার৷ উই আর হিয়ার টু হেল্প ইউ!’
বাঁধা বুলি৷ প্রত্যাখ্যানেও মিশে আছে সৌজন্যের হাসি৷ আমার রাগ হল, সঙ্গে ছেঁকে ধরল এক ধরনের অসহায়তা৷ কী করব বুঝতে পারছি না৷ একটা ট্যাক্সি পেলে অবশ্য চলে যাওয়া যায় জেঠতুতো দাদা কিংবা মাসির বাড়ি৷ একটা চাণক্যপুরী এবং অন্যটা চিত্তরঞ্জন পার্কে—জায়গাগুলোও কম দূর নয় এখান থেকে৷ ট্যাক্সি অবশ্য ফোন করলেই পাওয়া যায় দিল্লিতে৷ কিন্তু এত রাত্রে? না, সদাশিবের ওখানেও যাওয়া যায় না৷ ভাবতে ভাবতেই আমি তাকালুম লবির দিকে৷ ওইখানেই শুয়ে বসে রাতটুকু কাটিয়ে দেওয়া যায় কিনা ভাবলুম৷ বন্ধ কাচের দরজা দিয়ে বাইরে তাকালেই কুয়াশার দেয়াল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না৷ এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল৷ লম্বা যুবকটি রিসিভারে কান লাগিয়ে কি শুনল যেন, তারপর বলল, ‘সরি, উই আর ফুললি বুকড!’
মনঃস্থির করতে না পেরে আমি বললুম, ‘একটা ট্যাক্সি পাওয়া যেতে পারে?’
‘দেখছি৷’ লম্বা যুবকটি বলল, ‘আপনি বসুন লবিতে—’
আমি লবিতে গিয়ে বসলুম৷ এতক্ষণে কানে এল ঘুমন্ত লোকটির মৃদু নাক ডাকার শব্দ৷ কান পর্যন্ত ঢাকা পুলোভারের নীচে ঘামতে লাগলুম আমি৷
ইতিমধ্যে কাউন্টারের বেঁটে যুবকটির সঙ্গে লম্বা যুবকটি নিজেদের—সম্ভবত পাঞ্জাবী ভাষায় কী বলাবলি করল বুঝতে পারিনি৷ লম্বা যুবকটি হঠাৎ আমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘সকাল আটটার আগে ছেড়ে দিলে এখন আপনাকে একটা ঘর দিতে পারি—’
‘ও-কে!’ আমি উঠে দাঁড়ালুম, ‘সকাল হলে আমি অন্য হোটেল খুঁজে নিতে পারি—’
‘এখানেও কোনো গেস্ট চলে যেতে পারে, তখন আপনাকে অন্য রুম দেওয়া যাবে৷ তবে আটটার মধ্যে বম্বে থেকে আসবে একজন৷ তার জন্যে একটা রুম কনফার্ম করা আছে—’
তখনকার যা অবস্থা তাতে যে কোনো শর্তেই আমি রাজী৷ পিছনের কী-হোলের গায়ে লাগানো হুক থেকে একটি চাবি নিয়ে বেঁটে যুবকটির হাতে দিল লম্বা যুবকটি! বেঁটে যুবকটি কাউন্টারের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আসুন আমার সঙ্গে—’
ঘরটা দোতলায়৷ নাম্বার তেত্রিশ৷ যুবকটি দরজায় চাবি লাগিয়ে তালা খুলে আলো জ্বাললো৷ তারপর আমার হাতে চাবিটি দিয়ে ‘গুড নাইট’ বলে চলে গেল৷ দেখলুম সিঁড়ির বাঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে বেঁটে ও রোগা একটা চেহারা৷ যেমনই ব্যবহার করুক, শেষ পর্যন্ত আমার জন্যে একটা ব্যবস্থা করে দেবার জন্য যুবক দু’টির প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলুম আমি৷
ঘরটা খারাপ নয়৷ ভিতরে ঢুকে বন্ধ করে দিলুম দরজাটা৷ স্যুটকেসটা নামিয়ে রাখলুম লাগেজ বক্সের ওপর৷ ঘুম পাচ্ছে৷ অবশ্যই ঘুম ছাড়া আর কোনো কাজ নেই এখন৷
তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে গেলুম টয়লেটে৷ ব্র্যাকেটে ঝুলছে একটা ব্যবহার করা তোয়ালে, সাবানটাও ব্যবহৃত৷ বাথ-টবের মাথা থেকে অগত্যা টেনে নিতে হল ভাঁজ করা তোয়ালেটা৷ তেষ্টা পেয়েছিল৷ টয়লেট থেকে বেরিয়ে ফ্লাস্ক থেকে গ্লাসে জল ঢালতে গিয়ে দেখি সেটাও ভর্তি নয় পুরোপুরি৷ তখন মনে হল হয়তো কিছুক্ষণ আগেও এই তেত্রিশ নাম্বার ঘরে আর কেউ ছিল৷ চলে যাবার পর বিছানা ইত্যাদি পরিপাটি করে রাখা হলেও—যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করা হয়নি ঘরটা—নতুন আগন্তুকের জন্যে নতুন জিনিসপত্রও দেওয়া হয়নি৷ রিসেপশনের যুবকটি অবশ্য বলেছিল সকালে কেউ আসবে বম্বে থেকে৷ তার জন্যেই আলাদা করে রাখা আছে ঘরটি৷ হয়তো সকালেই পরিষ্কার করত৷ আমি তো উটকো লোক৷ ঘরটা যে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল এটাই ভাগ্যের ব্যাপার৷
বেড স্যুইচ জ্বেলে নিবিয়ে দিলুম বড় আলোটা৷ তখনি চোখে পড়ল, কাচের জানলার পর্দা টানা নেই৷ এগিয়ে গিয়ে পর্দা টানার আগে কাচে মুখ চেপে বাইরেটা দেখে নিলুম আমি৷ অন্ধকারে ঘন গাছ-গাছালি নিয়ে থমকে আছে লোধি গার্ডেনস—দৃষ্টি ছড়ানো যায় না৷ রিল-দেওয়া পর্দাটা টানতে টানতে গভীর ক্লান্তিতে হাই উঠে এল আবার৷ বিছানায় এসে চাদর জড়ানো কম্বলের ভিতর শরীরটা সেঁধিয়ে দিলুম আমি৷ ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, যেভাবে শুরু হয়েছিল দিনটি—শেষ অন্তত সেভাবে হয়নি৷ তিনটে বাজে প্রায়৷ শীতের দিল্লিতে সাড়ে সাতটার আগে সকাল হয় না৷ তার মানে ঘণ্টা চারেক অন্তত ঘুমোতে পারব নিশ্চিন্তে৷ হাত বাড়িয়ে বেড স্যুইচ টিপতেই অন্ধকার ছেয়ে গেল ঘরে৷ মনে হল ঘুম আসছে৷ হু হু করে সারা শরীরে ঘুমের আবির্ভাব টের পেলুম আমি৷
কতক্ষণ জানি না—ঘুম না তন্দ্রা, কোন ঘোরে ছিলুম তাও বুঝতে পারলুম না ঠিকঠাক৷
উঠে বসলুম বিছানায়৷ না, ভুল হয়নি৷ আমার ঘরের টয়লেটে ঘটাং করে ফ্লাশ টানার শব্দ পেয়েছিলুম, তারই জেরে এখনো পাচ্ছি কমোডে জল গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ৷ অদ্ভুত তো!
শব্দটায় ধাতস্থ হতে যেটুকু সময় লাগে৷ তারই আগেই বেড-স্যুইচ টিপে আলো জ্বাললুম আমি৷ উঠে গিয়ে টয়লেটের দরজা খুলতে চোখে পড়ল না কিছুই৷ ঝিরঝিরে শব্দটাও মিলিয়ে গেছে তখন৷ বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, রাতের নৈঃশব্দ্যে দূরের শব্দ অনেক সময় কাছে চলে আসে—পাশের ঘরের ফ্লাশ টানার শব্দটাকেই ঘুমের ঘোরে ভুল করেছি৷ মাঝ থেকে ঘুমটা ভেঙে গেল!
আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লুম আবার৷ এবং ঘুমিয়েও পড়লুম৷
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলুম জানি না, আচ্ছন্নতার মধ্যেই মনে হল জানলার পর্দাটা বেশ জোর দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল কেউ—ঘড়ঘড় শব্দ হল রিলের৷ মনে হলেও গা করলুম না তেমন ঘুমের আগ্রহে পাশ ফিরলুম৷ শীতে জড়িয়ে আসছে সারা শরীর৷
কিন্তু ওইভাবে কিছুক্ষণ আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে পড়ে থাকতে থাকতেই টের পেলুম, সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ মিশে যাচ্ছে আমার নিঃশ্বাসে৷ অস্বস্তি বেশি হওয়ায় পরিষ্কার ঘুম থেকে জেগে উঠলুম আমি৷ আর তখনি বিস্ময় আর আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে এল আমার৷ বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখলুম, জানলার পর্দাটা সত্যিই সরানো আর রাইটিং টেবিলের সংলগ্ন চেয়ারটিতে বসে জানলার দিকে মুখ করে সিগারেট টানছে কেউ৷ অন্ধকার বলেই আদল স্পষ্ট হয় না৷ কিন্তু লাল জ্বলজ্বলে একটুকরো সিগারেটের আগুন চোখে পড়ছে ঠিকই৷ পোড়া সিগারেটের গন্ধ ক্রমশ আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে৷
সম্ভবত চেঁচিয়ে উঠতে চেয়েছিলুম আমি, গলা দিয়ে শব্দ বেরুলো না কোনো৷ আতঙ্কের শেষ অবস্থায় পৌঁছে বেড স্যুইচটা টিপে আলো জ্বালতে পারলুম শুধু৷ আশ্চর্য! সব ঠিকঠাক আছে৷ জানলার পর্দাটা যেমন টানা ছিল তেমনই টানা—চেয়ারটা চেয়ারের জায়গায়৷ সিগারেটের ধোঁয়ারও নামগন্ধ নেই কোনো৷
ঘামছিলুম৷ সেই অবস্থাতেই মনঃস্থির করে ফেললুম, আর ঘুমোবার দরকার নেই৷ আলোটা জ্বলুক৷ অন্তত ভোর না হওয়া পর্যন্ত এই ভাবেই জেগে থাকতে হবে আমাকে৷ ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটে৷ শব্দহীন চারদিকে ঘুমের নিশ্চিন্তি৷ শুধু আমিই জেগে আছি৷
ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে সদাশিবকে ফোন করে বললুম সব৷ সদাশিব বলল, ‘কী আশ্চর্য! ওই তেত্রিশ নম্বর ঘরটাই দিয়েছিল আপনাকে!’
‘কেন?’
সদাশিব বলল, ‘পরশু রাত্রে ওই ঘরে মোহিনী চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক আত্মহত্যা করেছেন৷ আজকের কাগজেই আছে খবরটা—’
আমি কিছু বলতে পারলুম না৷ তাহলে কি ভূতের সঙ্গেই রাতটা কেটে গেল আমার!