তেত্রিশটা কামান নিয়ে বসে আছি

তেত্রিশটা কামান নিয়ে বসে আছি

এবারের বিশ্বকাপের প্রথম খেলা বাংলাদেশের। এই খেলা কীভাবে দেখা হবে, তা নিয়ে প্রথম আলোতে একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখা ব্যাকফায়ার করল। আমার সঙ্গে খেলা দেখার জন্যে পরিচিত-অপরিচিত লোকজন টেলিফোন করা শুরু করল। আমার সঙ্গে খেলা দেখতে হলে তো লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার প্রয়োজন নেই। বাধ্য হয়ে ভেন্যু পাল্টালাম। নিজের বাসা ছেড়ে প্রকাশক-বন্ধু আলমগীর রহমানের বাসায় উপস্থিত হলাম। আমি, শাওন এবং পুত্র নিষাদ। তিনজনের গায়েই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের জার্সি (জার্সি কিনতে পাওয়া যাচ্ছে)।

আলমগীর রহমান বললেন, আপনারা তিনজন? আর কেউ আসবে না তোর আপনি তো দলবল ছাড়া চলেন না। আমি এত মানুষকে জায়গা দিতে পারব না।

আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, আমরা তিনজনই।

আড়াইটা থেকে খেলা শুরু। দুপুর দুইটার মধ্যে আলমগীরের বসার ঘরে ভিড় জমে গেল। আমার বন্ধুবান্ধব সবাই উপস্থিত। অপরিচিত কিছু লোকজনও আছে। সবার গায়েই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের জার্সি। যারা জার্সি ছাড়া উপস্থিত হয়েছে, তারা ব্যাপার দেখে ছুটে গেল জার্সি কিনে আনতে। উৎসাহ-উত্তেজনায় সবাই ঝলমল করছে। কত আলোচনা, কত হিসাব-নিকাশ।

খেলা শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশ কেমন খেলবে–এই বিষয়ে আলোচনা সভা। এই সভায় প্রত্যেকেই মতামত দেবে।

বন্ধু-আর্কিটেক্ট করিম বলল, গো-হারা হারবে। ইন্ডিয়ার সামনে দাঁড়াতেই পারবে। করিম একজন ক্রিকেটবোদ্ধা। ক্রিকেটবোদ্ধারা খেলোয়াড়দের চেয়েও অনেক ভালো ক্রিকেট বোঝে। ক্রিকেট কমেনটেটরদের চেয়েও এরা জ্ঞানী হয়ে থাকে।

অন্যপ্রকাশ্যে কমল বলল, বাংলাদেশ হারবে, তবে হার্ড কনটেস্ট হবে। কমল ক্রিকেটবোদ্ধা প্লাস ক্রিকেট-রেকর্ড বিশেষজ্ঞ। কবে কোন খেলায় কে শূন্য রানে আউট হয়েছে, কমল বলে দেবে।

করিম বলল, কোনো কনটেস্টই হবে না। ইন্ডিয়া আগে ব্যাট করলে সাড়ে তিন শ’ রান করবে। রানের হিমালয় পর্বত দেখে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা চুপসে যাবে। দুই শ’ রানে অলআউট।

আমি মন খারাপ করে দেখলাম, ক্রিকেট-বিজ্ঞজনেরা ইন্ডিয়া জিতবে বলে দিচ্ছেন, আর আমরা যারা ক্রিকেট কিছুই বুঝি না–যেমন আমি এবং আমার চার বছর বয়সী পুত্র–বলছি, বাংলাদেশ জিতবে।

পুত্র নিষাদের চেয়ে আমি তিন কাঠি ওপরে। আমি বললাম, বাংলাদেশ ইন্ডিয়াকে বাংলাধোলাই দিয়ে দেবে। দশ উইকেটে জিতবে। দশ উইকেটে জেতা মানে বাংলাধোলাই।

করিম বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি ক্রিকেট বোঝে না, কেন কমেন্ট করো? প্লিজ, স্টপ।

.

টস হয়ে গেছে। বাংলাদেশ টসে জিতেও নিল ফিল্ডিং।

করিম মাথায় হাত দিয়ে বলল, সাকিব, তুই করলি কী! নিজের পায়ে নিজে ইলেকট্রিক করাত চালালি। ইন্ডিয়ার যেমন ব্যাটিং লাইন, ওরা করবে চার শ’ রান। তোরা তো দেড় শ’ও করতে পারবি না।

আলমগীর রহমান বললেন, করিমের সঙ্গে আমি এক শ’ ভাগ একমত। সাকিবের ভুল ডিসিশনের জন্যে আমরা হারলাম। পুলাপান ক্যাপ্টেন হয়ে গেলে যা

ওদের কথাবার্তা শুনে আমিও ওদের বাতাসে পাল তুললাম। ক্রিকেট অনেকটা মানসিক খেলা। বিশাল রানের পাহাড় দেখে যেকোনো দলই ফুটা বেলুনের মতো চুপসে যাবে।

শাওন বলল ভিন্ন কথা। সে বলল, দলের ক্যাপ্টেন কোনো কিছু না ভেবেই ফিল্ডিং নেবেন, তা হয় না। নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্ত তাঁর একার না। সবাই মিলেই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হয়েছে। আমার মন বলছে, আমরা এবারও ভারতকে হারাব।

করিম বলল, ইন্ডিয়া হারলে আমি কান কেটে ফেলব। ক্রিকেট বোঝে না এমন কারও সঙ্গে খেলা দেখাই ঠিকনা।

.

করিমকে কান কাটতে হলো না। ইন্ডিয়া জিতল।

আমি বললাম, ইন্ডিয়া যেমন জিতেছে, আমরাও জিতেছি। তিন শ’ সত্তর রানের বিপরীতে দুই শ’ তিরাশি রান মানেই বিজয়। বিশাল বিজয়।

ক্রিকেট খেলা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্যের সঙ্গে কেউ একমত হয় না। প্রথমবার সবাই একমত হলো। সবাই (অক্ষতকর্ণ করিমসহ) বলল, বাংলাদেশ হারে নি।

বাংলাদেশের বিজয় উপলক্ষে আমরা আমার সোনার বাংলা গান গাইলাম। এগারোটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আইসক্রিম কেক কাটা হলো।

এগারোটা মোমবাতি প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ল, অনেক দিন ধরেই আমি ‘এগারো’ রহস্য সমাধানের চেষ্টা করছি, পারছি না। ক্রিকেট এগারোজন কেন খেলে? বারোজন না কেন বা দশজন না কেন? ফুটবলেও এগারোজন, হকিতেও এগারো। এই এগারো কবে শুরু হলো, বা কেন শুরু হলো। একইঅবে আমার মাথায় আরেকটি প্রশ্ন, আমরা তেত্রিশবার তোপধ্বনি করি কেন? বত্রিশবার কেন করি না, বা চৌত্রিশবার কেন করি না?

এখন বলি এগারো এবং তেত্রিশ এই লেখায় হঠাৎ কেন আনলাম। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে জিতবে এবং আমরা তেত্রিশবার তোপধ্বনি করব। এই ভেবেই তেত্রিশ তোপধ্বনি প্রসঙ্গ। হ্যালো, বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা! আমরা কিন্তু তেত্রিশটা কামান নিয়ে বসে আছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *