তেজি বউ
সুমতির একটা মস্ত দোষ ছিল—তেজ। দেখিতে শুনিতে ভালোই মেয়েটা, কাজেকর্মেও কম পটু নয়, দরকার হইলে মুখ বুজিয়া উদয়াস্ত খাটিয়া যাইতে পারে, স্নেহ মমতা করার ক্ষমতাটাও সাধারণ বাঙালি মেয়ের চেয়ে তার কোনো অংশে কম নয়, খারাপ কেবল তার অস্বাভাবিক তেজটা। কারো এতটুকু অন্যায় সে সহিতে পারে না, তুচ্ছ অপরাধ মার্জনা করে অপরাধীকে অপরাধের তুলনায় তিন গুণ শাস্তি দিয়া, কারো কাছে মাথা নিচু করিতে তার মাথা কাটা যায়। হুকুম দিবার অধিকার যার আছে তার কথা সবই সে শোনে—যতক্ষণ কথাগুলো হুকুম না হয়। যত জোর হুকুম, তত বড় অবাধ্য সুমতি।
সবচেয়ে বিপদের কথা, কোনো বিষয়ে কারো বাড়াবাড়ি সুমতি সহ্য করিতে পারে না—গায়ে পড়িয়া তেজ দেখায়। বাঙালি ঘরের বউ, তার গায়ে পড়িয়া তেজ দেখানোর মানেই গুরুজনকে অপমান করা, সমবয়সীদের সঙ্গে ঝগড়া করা আর ছোটদের মারিয়া গাল দিয়া ভূত ছাড়াইয়া দেওয়া।
দুঃখের বিষয়, সংসারে বাড়াবাড়ি করার বাড়াবাড়িটাই স্বাভাবিক। এমন মানুষ কে আছে যে জীবনে অনেক বিষয়ে বঞ্চিত হয় না? অনেক বিষয়ে বঞ্চিত হওয়াটা কয়েকটা বিষয়ের বাড়াবাড়ি দিয়া পরিপূরণ করার চেষ্টা না করাটা রীতিমতো সাধনা-সাপেক্ষ। সংসারের লোক সাধনার ধার ধারে বা ইচ্ছা করিলেই ধারিতে পারে এরকম একটা ধারণা সাধু মহাত্মারা পোষণ করেন বটে, কিন্তু কথাটা সত্য নয়।
সুমতির তাই পদে পদে বিপদ। বিবাহের আগে গুরুজনদের মান না রাখিয়া, সমবয়সীদের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া আর ছোটদের বকিয়া মারিয়া ক্রমাগত হাঙ্গামার সৃষ্টি করা যদি বা চলে, বিবাহের পর শ্বশুরবাড়িতে এসব চলিবে কেন? প্রথম বছর দুই সুমতি প্রাণপণে তেজটা দমন করিয়া রাখিয়াছিল— দু-এক বার সকলকে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ করার বেশি ভয়ানক কিছু করে নাই। অবস্থা বিপাকের কৃত্রিম সংযম আর প্রকৃতিগত স্বাভাবিক তেজের লড়াইয়ে সংযমটা ক্ষয় পাইতে পাইতে নিঃশেষ হইয়া আসায় এখন সে পড়িয়াছে মুশকিলে। শাশুড়িকে একদিন বেলুনি নিয়া মারিতে উঠাইয়া ছাড়িয়াছে, প্রথমবার বলিয়া শাশুড়ি মারিতে উঠিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন, একেবারে মারিয়া বসেন নাই। কিন্তু কতকাল না মারিয়া থাকিতে পারিবেন? একে মেয়েমানুষ, তায় শাশুড়ি-ধৈর্যের সীমা তার স্বভাবতই সংকীর্ণ।
এতখানি তেজ সুমতি কোথা হইতে পাইল বলা কঠিন। তার বাবা সদানন্দ অতি নিরীহ গোবেচারি মানুষ, —কখন মানুষকে চটাইয়া বসেন এই ভয়েই সর্বদা শশব্যস্ত। মা চিররুগ্ণ রোগে ভুগিয়া ভুগিয়া মেজাজটা তার বিগড়াইয়া গিয়াছে বটে, বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ রাগিয়া কাঁদিয়া মাথা-কপাল কুটিয়া যখন তখন অনর্থ বাধান বটে, কিন্তু সেটা তেজের লক্ষণ নয়। মানুষটা আসলে ভয়ানক ভীরু। বড় ভাই দুজনে কুড়ি-বাইশ বছর বয়স হইতে কেরানি, তাদের তেজ থাকার প্রশ্নই ওঠে না। বোনেরা সব অতিরিক্ত লজ্জাশরম আর ভাবপ্রবণতায় ঠাসা,—চার জনেই অমানুষিক সহিষ্ণুতার বর্মে গা ঢাকা দিয়া স্বামীপুত্রের জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়া দিয়াছে।
এদের মধ্যে সুমতির আবির্ভাব প্রকৃতির কোন নিয়মে ঘটিল বলা যায় না কোন নিয়মের ব্যতিক্রমে ঘটিল তাও বলা যায় না। আগাগোড়া সবটাই দুর্বোধ্য রহস্যে ঢাকা। লজ্জাশরম ও ভাবপ্রবণতা কিছু কম হওয়া আশ্চর্য নয়, প্রকৃতিতে কিছু অসহিষ্ণুতার আমদানিও বোধগম্য ব্যাপার, কিন্তু স্বামীপুত্রের জন্য জীবন উৎসর্গ করার মধ্যে এতখানি তেজ বজায় রাখা যেমন খাপছাড়া তেমনই অবিশ্বাস্য।
পুত্র সুমতির মোটে একটি, এখনো দু বছর পূর্ণ হয় নাই। আর একটি যে কয়েক মাসের মধ্যে আসিয়া পড়িবে, আসিয়া পড়িবার আগে সে পুত্র অথবা কন্যা তা নির্ণয় করা অসম্ভব। তবে সুমতি আশা করে এটিও পুত্রই হইবে, দুটি পুত্রের পর একটি কন্যা হইলে মা হওয়ার আনন্দে একদিন সে কী পরিমাণ গর্বই না মিশাইতে পারিবে!
এসব ভবিষ্যতের কথা, আপাতত প্রথমটির মতো দ্বিতীয়টিকেও বাপের বাড়িতে গিয়া ভূমিষ্ঠ করার সাধটা সুমতির অত্যন্ত প্রবল হইয়া ওঠায় একটা ভারি গোলমালের সৃষ্টি হইল।
শাশুড়ি ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না, বাপের বাড়ি যেতে হবে না। এই না সেদিন এলে বাপের বাড়ি থেকে?
সুমতি যুক্তি দিয়া বলিল, সে তো গিয়েছিলাম ছোড়দার বিয়েতে তাও তো সাতটা দিনও থাকতে পেলাম না।
মেজাজটা শাশুড়ির ভালো ছিল না। সকালে খোকাকে দুধ খাওয়ানোর সময় খোকা ভয়ানক চিৎকার জুড়িয়া দেওয়ায় শাশুড়ি বিশেষ কোনো অসন্তোষ বা বিরক্তি বোধ না করিয়াও নিছক শাশুড়িত্ব খাটানোর জন্যই একবার বলিয়াছিলেন, না কাঁদিয়ে দুধটুকু পর্যন্ত খাওয়াতে পার না বাছা!
আগে হইলে সুমতি চুপ করিয়া থাকিত, আজকাল সংযম ক্ষয় হইয়া আসায় মুখ তুলিয়া বলিয়া বসিয়াছিল, দুধ খাওয়াবার সময় ছেলেপিলে একটু কাঁদে।
কাঁদে না তোমার মাথা—বড় তো মুখ হয়েছে তোমার বউমা আজকাল?
মুখ হওয়া হওয়ি কী, যা বলেছি মিথ্যে তো বলি নি।
আমি মিথ্যে বলেছি? আমি মিথ্যে বলি? তুমি আমায় মিথ্যেবাদী বললে!
রাগে শাশুড়ির কণ্ঠ ক্ষণকালের জন্য রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল, আরো জোরালো আওয়াজ বাহির হইবার জন্য। কিন্তু সুমতির অপূর্বদৃষ্ট মুখভঙ্গি, তীব্রদৃষ্টি আর চালচলন দেখিয়া আওয়াজটা আর বাহির হইতে পারে নাই। ছেলেকে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করিয়া সুমতি ধীর স্থির শান্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, ছেলেকে শান্ত করিয়া শাশুড়ির দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিয়াছিল, আপনাকে মিথ্যেবাদী বলি নি, বলেছি দুধ খাওয়াবার সময় ছেলেপিলে একটু কাঁদে। কান্না থামিয়ে দিলাম, না কাঁদিয়ে খাওয়ান তো দুধ?
প্রথমটা থতমত খাইয়া শাশুড়ি অবশ্য বলিয়াছিলেন, তোমার হুকুমে নাকি? এবং তারপর একটা প্রচণ্ড হইচই বাধাইয়া দিয়াছিলেন যে মোহনলাল সুমতিকে বকিয়া আর কিছু রাখে নাই।
স্বামীর অন্যায় বকুনিতে সুমতি অভিমান করিয়া সারা দিন কিছু খায় নাই, তবু শাশুড়ির মেজাজটা খারাপ হইয়া আছে। মোহনলালের বকুনি শুনিতে শুনিতে সুমতি যদি অন্তত একবারও ফোঁস করিয়া উঠিত, শাশুড়ির হয়তো মেজাজটা এত খারাপ হইয়া থাকিত না। অকারণে শাশুড়িকে তেজ দেখাইয়া স্বামীর বকুনি বউ চুপচাপ হজম করিলে শাশুড়ির সেটা ভালো লাগে না, মেজাজ বিগড়াইয়া থাকে।
ফের মুখের ওপর কথা বলছ? বললাম বাপের বাড়ি যেতে হবে না, বাস্ ফুরিয়া গেল, অত কথা কীসের? মোটে সাত দিনের জন্যে গিয়েছিলাম! সাত দিনের জন্যে যে যেতে দিয়েছিলাম এই তোমার চোদ্দপুরুষের ভাগ্যি, তা জেনে রেখ।
সুমতির নাসারন্ধ্র স্ফুরিত হইয়া উঠিল।
গুরুজনের কি চোদ্দোপুরুষ তুলে কথা বলা উচিত মা?
শাশুড়ির মেজাজ আরো খারাপ হইয়া গেল।
গুরুজন। গুরুজন বলে কী মান্যিই কর! আর বকতে পারি না বাছা তোমার সঙ্গে, বলে দিলাম যেতে পাবে না—পাবে না, পাবে না, পাবে না।
রাত্রে সুমতি পেট ভরিয়া খাইয়া ঘরে গেল। মোহনলাল আশা করিতেছিল সে একটু কাঁদিবে। গা ঘেঁষিয়া বসিয়া শাশুড়ির ছেলেমানুষিতে উত্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমা করার ভঙ্গিতে একটু হাসিয়া সুমতি বলিল, কী অন্যায় দ্যাখো তো মার! এসময় বাপের বাড়ি না গেলে চলে? আমায় নেবার জন্য বাবা চিঠি লিখেছেন, মা পষ্ট বলে দিলেন যেতে দেবেন না। কালকেই চিঠির জবাব লেখা হবে—সকালে মাকে তুমি একটু বুঝিয়ে বোলো, কেমন?
সুমতি একটু কাঁদিলে, বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হইয়া পায়ে না পড়ুক অন্তত বুকে মুখ লুকাইয়া আত্মসমর্পণ করিলে, মোহনলাল তা করিত। বুঝাইয়া বলা কেন, স্পষ্ট করিয়াই বলিত যে বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দেওয়া হোক। সুমতির তেজ দেখিয়া সে রাগ করিয়া বলিল, আমি বলতে টলতে পারব না।
পারবে না? বেশ।
বেশ মানে। তোমার যখন ইচ্ছা হবে তখনই বাপের বাড়ি যেতে দিতে হবে নাকি?
সুমতি সরিয়া সোজা হইয়া বসিয়া বলিল, যখন ইচ্ছা বাপের বাড়ি আবার কবে গেলাম?
সুতরাং মোহনলাল রাগ করিয়া বলিল, বাপের বাড়ি যাওয়া না যাওয়ার মালিক তুমি নাকি? যখন পাঠানো হবে যাবে, যখন পাঠানো হবে না যাবে না। অত মেজাজ দেখাচ্ছ কীসের? বাড়ির বউ না তুমি?
বউ না হলে এমন অদৃষ্ট হয়। যেতে দেবে না?
না।
কেন দেবে না?
আমার খুশি!
এতক্ষণ সুমতি তেজটা চাপিয়া রাখিয়াছিল, আর পারিল না। নাসারন্ধ্র স্ফুরিত হইতে লাগিল।
হাড়িমুচিরাও তোমাদের মতো বউয়ের ওপর খুশি খাটায় না, তাদেরও দয়ামায়া আছে। তোমরা ভদ্দরলোক কিনা-
ঘুমন্ত খোকার পাশে আছড়াইয়া পড়িয়া চোখ বুজিয়া সে অসমাপ্ত কথাটা শেষ করিল অন্য কথা দিয়া, প্রতিজ্ঞা করার মতো করিয়া।
আমি যাবই এবার।
মোহনলাল রাগে আগুন হইয়া বলিল, মা যদিবা যেতে দেন, আমি দেব না। তোমার মতো বেয়াদব নচ্ছার মাগিকে ধরে চাবকানো উচিত।
সুমতি চোখ মেলিয়া বলিল, এক মাসের মধ্যে যদি আমি বাপের বাড়ি না যাই, চাবুক কেন আমায় ধরে তুমি জুতিয়ো
এত কাণ্ড ঘটিবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। শাশুড়ির কাছে একটু নম্র হইয়া থাকিলে আর মাথা নিচু করিয়া আবদার ধরিলে প্রথমটা অরাজি হইলেও শেষ পর্যন্ত শাশুড়ি রাজি হইয়া যাইতেন। মোহনলালের কাছে একটু কাঁদিলেই কাজটা হইয়া যাইত। অপরপক্ষে, শাশুড়ি একটু মিষ্টিমুখে যদি বলিতেন যে এবার সুমতির বাপের বাড়ি না যাওয়াই ভালো, সুমতি ক্ষুণ্ণ হোক, রাগ করুক, বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য মরিয়া হইয়া উঠিত না। এমনকি শাশুড়ির সঙ্গে কলহ করিয়া ঘরে যাওয়ার পর মোহনলাল যদি শুধু বলিত, মা যখন মানা করেছেন, এবার বাপের বাড়ি নাইবা গেলে?—সুমতি হয়তো ফোঁস ফোঁস করিয়া একটু কাঁদিয়া বলিত, আচ্ছা। বাপের বাড়ি যাওয়ার সমস্যার চমৎকার মীমাংসা হইয়া যাইত। সুমতির তেজের জন্য সব গোলমাল হইয়া গেল।
এখান হইতে কর্তৃপক্ষের চিঠি গেল, এবার বউমাকে পাঠানো হইবে না, পাঠানো সম্ভব নয়, অনেক কারণ আছে। সুমতি নিজে বাবার কাছে লিখিয়া দিল, যত শীঘ্র সম্ভব কাহাকেও পাঠাইয়া যেন তাহাকে লইয়া যাওয়া হয়।
সদানন্দ অনেক বুঝাইয়া মেয়ের কাছে লম্বা চিঠি লিখিলেন। কেউ যখন তাকে পাঠাইতে ইচ্ছুক নন, তাকে নেওয়ার জন্য বাড়াবাড়ি করা উচিত?
এ চিঠির এমন একটা জবাব সুমতি লিখিয়া দিল যে ভদ্রলোক স্বয়ং তিন দিনের ছুটি নিয়া মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আসিয়া হাজির হইলেন। বুক তখন তার টিপটিপ করিতেছে, মুখ শুকাইয়া গিয়াছে। মেয়েকে নেওয়ার জন্য প্রায় সজল চোখে কত যে কাকুতিমিনতি করিলেন, অন্ত হয় না। কিন্তু সুমতির শাশুড়ি গোঁ ছাড়িলেন না, ঘাড় নাড়িয়া কেবলই বলিতে লাগিলেন, না বেয়াই না, এবার বউমাকে পাঠাতে পারব না।
কাকুতিমিনতিতে মন গলার বদলে শেষ পর্যন্ত শাশুড়িকে রাগিয়া উঠিবার উপক্রম করিতে দেখিয়া ভয়ে ভয়ে সদানন্দ চুপ করিয়া গেলেন। সদানন্দ নিজে আসিয়া এভাবে বলিলে অন্য অবস্থায় শাশুড়ির মন হয়তো গলিয়া যাইত, বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়া প্রথমবার সুমতির সঙ্গে যে ঝগড়া হইয়াছিল তাও হয়তো তিনি আর মনে রাখিতেন না, কিন্তু ইতিমধ্যে সুমতি আরো অনেকবার তেজ দেখাইয়া বসিয়াছে। যেমন তেমন তেজ নয়, গা পুড়িয়া জ্বালা করার মতো তেজ।
সুমতি বলিল, আমি তোমার সঙ্গেই চলে যাব বাবা, আমায় নিয়ে চল।
সদানন্দ মেয়েকে বুঝাইলেন। এরকম অবস্থায় যত রকম উপায়ে মেয়েকে বোঝানো সম্ভব, তার একটাও বাদ দিলেন না। কিন্তু এ তো বোঝার কথা নয়, কথাটা তেজের। সুমতির মুখে সেই এককথা, আমি তোমার সঙ্গে যাব, আমায় নিয়ে চল।
শেষে সদানন্দের মতো নিরীহ গোবেচারি মানুষটা পর্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিলেন, এরা পাঠাবে না, তবু তুই যাবি কী রকম? আমি নিয়ে যেতে পারব না। এদের বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করতে পারিস, আমায় চিঠি লিখিস, এসে নিয়ে যাব। যাবার জন্য এত পাগলামিই বা কেন তোর? পরে না হয় যাস?
সদানন্দ ফিরিয়া গেলেন। এবার নিজের তেজের আগুনে সুমতি নিজেই পুড়িতে লাগিল। শারীরিক অবস্থাটা তার এতখানি মানসিক তেজ সহ্য করিবার মতো ছিল না, এ অবস্থায় মনটা যত শান্ত আর নিস্তেজ থাকে ততই ভালো। হাত- পাগুলো দেখিতে দেখিতে কাঠির মতো সরু হইয়া গেল, শুষ্ক শীর্ণ মুখে কেবল জ্বলজ্বল করিতে লাগিল দুটি চোখ। কথা কমিয়া গেল, খাওয়া কমিয়া গেল, আলস্য কমিয়া গেল—নিজের মনে নীরবে যতটা পারে কাজে অকাজে আত্মনিয়োগ করিয়া আর যতটা পারে কোনো কাজ না করিয়া সে ছটফট করিতে লাগিল। তারপর সে এক মাস সময়ের মধ্যে বাপের বাড়ি না যাইতে পারিলে চাবুকের বদলে স্বামীর জুতা খাইতে রাজি হইয়াছিল, সেই সময়টা প্রায় কাবার হইয়া আসায়, একদিন শেষরাত্রে কিছু টাকা আঁচলে বাঁধিয়া একাই বাপের বাড়ি রওনা হইয়া গেল।
এ একটা মফস্বলের শহর। বাপের বাড়িটাও মফস্বলের একটা শহরেই। কিন্তু সোজাসুজি যোগ না থাকায় কলিকাতা হইয়া যাইতে একটু সময় লাগে।
সুমতির আরো অনেক বেশি সময় লাগিল। কারণ কলিকাতায় পৌঁছাইয়া বাপের বাড়ি যাওয়ার বদলে তাকে যাইতে হইল মেয়েদের একটা হাসপাতালে। খবর পাইয়া সদানন্দও আসিলেন, মোহনলালও আসিল এবং মোহনলাল বিনা বাক্যব্যয়ে মেয়েকে বাপের বাড়ি লইয়া যাইবার অনুমতিও সদানন্দকে দিয়া দিল। কিন্তু হাসপাতালের ডাক্তার একমাস তাকে বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে দিলেন না।
একমাস পরে বাপের বাড়ি গিয়া তিন মাস পরে অনেকটা সুস্থ হইয়া সুমতি স্বামীগৃহে আসিল। আর কোনো পরিবর্তন হোক না হোক, সুমতির একটা পরিবর্তন স্পষ্টভাবেই ধরা পড়িয়া গেল। দেখা গেল, তার সবটুকু তেজ কপূরের মতো উবিয়া গিয়াছে।