উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

তেঁতুল গাছে ডাক্তার

তেঁতুল গাছে ডাক্তার

বিধানবাবুর গলায় ট্যাংরামাছের কাঁটা আটকে গেল। বড়মামা যখন গেলেন তখন হাঁ করে ভদ্রলোক দাওয়ায় বসে আছেন। স্ত্রী আর পুত্রবধূ দু’পাশে দাঁড়িয়ে হাতপাখা নাড়ছেন প্রাণপণে। বড়মামা গিয়েই ধমক দিয়ে দুজনকে সরিয়ে দিলেন।

বিধানবাবুর নারকেল-তেলের ব্যবসা। প্রচুর পয়সা। তেমনি মেজাজ। সকলকেই ধমকে কথা বলেন। একমাত্র বড়মামাকেই ভয় করেন। বিধানবাবু বোয়ালের মতো হাঁ করে আছেন। বড়মামা টর্চ ফেললেন। যেন কুয়োর মধ্যে আলো নেমে গেল। তারপর পাশে পড়ে থাকা বেতের মোড়ায় বসে বললেন, ‘মানুষের কী ভাগ্য! সেলুনওলা সুকুমার লটারিতে সাড়ে চার লাখ টাকা পেয়ে গেল।’

বিধানবাবুর চোখ ছানাবড়ার মতো। বড়মামার কথা শুনে আঁক করে একবার আওয়াজ করে পর পর তিনবার ঢোঁক গিললেন। সাপে ব্যাঙ গিললে যেমন হয়, গলার কাছে তিনবার ঢেউ খেলে গেল।

বড়মামা বললেন, ‘কী বুঝলেন?’

‘সাড়ে চার লাখ! ওরে বাবারে!’

‘এখন কেমন লাগছে?’

‘নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে ডাক্তার, আমার পোড়া বরাতে একটা পাঁচটাকাও উঠল না!’

‘গলার কাঁটার কী খবর?’

‘কাঁটা? কী কাঁটা?’

বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের কাজ শেষ। গলার কাঁটা তিন ঢোকে সরে গেছে।

সেই বিধানবাবু আন্দামান থেকে বড়মামাকে একটা সুন্দর কোকো কাঠের ছড়ি এনে দিয়েছেন।

হঠাৎ বড়মামার আজ কী খেয়াল হল, আমাকে বললেন, ‘ছড়িটা নামা।’

আলনায় ঝুলছিল একা একা। নামিয়ে আনলুম। বড়মামার কুকুর লাকি টেস্ট করতে চাইল। বিশেষ সুবিধে করতে না পেরে আমাকে ধমকাতে লাগল।

‘আজ ছড়ি নিয়ে মর্নিং ওয়াক হবে?’

‘ইয়েস।’

‘কেন, কোমরে ব্যথা হয়েছে?’

‘আজ্ঞে না। এ কোমর সে কোমর নয়। আজ একটু স্টাইলে বেড়াব। সায়েবদের মতো, ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে।’

চুড়িদার পাজামা, ফিনফিনে পাঞ্জাবি। হাতে ছড়ি। সাঁই সাঁই করে হাঁটছেন বড়মামা। পথের ধারের মানুষ অবাক হয়ে দেখছে। হাঁটার মতো হাঁটা। পেছনে পেছনে আমি প্রায় ছুটছি। বেশিরভাগ কুকুর ভয়ে সরে যাচ্ছে। দু-একটা অসন্তুষ্ট হয়ে গোঁ গোঁ করছে।

আজকে বড়মামার চোখমুখের চেহারাই অন্যরকম। জ্বল জ্বল করছে। এই সময় অনেকেই বেড়াতে আসেন। বেড়াতে বেড়াতেই ডাক্তারি করতে হয়। কারুর লো-প্রেশার, কারুর প্রেশার হাই। কারুর হার্ট মাছের মতন খাবি খায়, কারুর হাই সুগার। ঘুরতে ফিরতে চিকিৎসা। করলার রস খান। নুন বন্ধ করুন। তেল-ঘি ছেড়ে দিন।

আজ আর রুগিরা বড়মামাকে ধরতেই পারছেন না। তিনি বুলেটের মতো ঠিকরে বেড়াচ্ছেন।

গাছের ডালে হঠাৎ একটা কোকিল ডেকে উঠল। অসময়ের কোকিল। চক্কর মারতে মারতে বড়মামা থেমে পড়লেন।

‘আহা-শুনছিস।’

‘কোকিল। অসময়ের কোকিল।’

‘কী মিঠে তান!’

বটতলার বেদীতে আসন নিলেন। মুখে একটা অন্যভাব।

‘পাখি প্রকৃতির জীব।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘পাখি সাধক।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে কাক ছাড়া।’

‘ঠিক। কাক পাখির মধ্যে পড়ে না। যেমন তিমি মাছের মধ্যে পড়ে না।’

‘যদিও তিমি-মাছ বলে।’

‘তিমি কেন মাছ নয়?’

‘ডিম হয় না, বাচ্চা হয়।’

‘একশোর মধ্যে একশো। কিছু একটা করতে হবে।’

‘ইট কি গুলতি মারা চলবে না।’

‘রাইট! খাঁচায় বন্দী করা চলবে না।’

‘আপনার কথা কে শুনবে বড়মামা?’

‘শোনাতে হবে রে পাগলা। পৃথিবীর সব কাজ ধীরে ধীরে হয়েছে। প্রথমে চাই প্রচার। তারপর চাই সংগঠন। চাই জনমত।’

‘আপনার বাহুবল নেই।’

‘ঠিক। আমার ঢাল নেই, তলোয়ার-রাইফেল নেই। কিন্তু বৎস আমার মনোবল আছে। সেই বলে আমি পৃথিবীর সমস্ত খাঁচার পাখিকে আকাশে উড়িয়ে দেব।’

‘পৃথিবী যে অনেক বড় বড়মামা!’

‘সো হোয়াট! আমি ছোট করে নোব। নে ওঠ আমার ভেতরটা ছটফট করছে খাঁচার পাখির মতো।’

‘চায়ের জন্যে?’

‘নারে মুখ্যু। ছটফট করছে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। অ্যাকশন! অ্যাকশন!’

ফেরার পথে ছড়ি বড়মামার কাঁধে। ভীষণ উত্তেজিত। লম্বালম্বা পা ফেলছেন যেন রণপা পরে হাঁটছেন। এক জায়গায় একগাদা মুরগী ছাই গাদায় খাবার খুঁজছে! ফুলকো ফুলকো এক ঝাঁক বাচ্চা।

‘বড়মামা মুরগী কী পাখির মধ্যে পড়ে?’

‘না। জেনে রাখ, পাখির সংজ্ঞা হল, যাহা আকাশে ওড়ে তাহাই পাখি। যেমন পরান-পাখি। আমাদের প্রাণও একরকম পাখি। দেহ-খাঁচায় অবিরত ছটফট করছে।’

‘ঠিক বলেছেন, কেবল কী খাই, কী খাই করে। আর যেই পড়তে বসব অমনি ‘বই-এর পাতা থেকে আকাশের দিকে উড়ে যায়।’

‘ও হল তোমার মন। আমি বলছি প্রাণের কথা। আমাদের দেহে দুটো পাখি। এক হল প্রাণপাখি। খুব দামী, বড়দরের পাখি। আর ছোটদরের পাখি হল মন পাখি। অনেকটা বদরি, মুনিয়া কি টুনটুনির মতো। ভীষণ ছটফটে। এ সব বোঝার বয়স তোমার হয়নি।’

বাড়ির গেটের সামনে এসে গেছি। বাগানে বকুল তলার বাঁধানো বেদীতে বড়মামা ধপাস করে বসে পড়লেন। বেশ হাঁপাচ্ছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে জিগ্যেস করলেন, ‘এত জোরে জোরে হাঁটলুম কেন?’

‘তা তো জানি না।’

কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে রইলেন। তারপর চোখ খুলে বললেন ‘পাখি!’

‘পাখি তো হয়ে গেছে।’

‘কী হয়ে গেছে? কিছুই হয়নি। এইবার হবে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম।’

কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘দেখে আয় তো মেজো কোথায়?’

সারা বাড়ি একবার চক্কর মেরে এলুম। মেজোমামা বাথরুমে। তারস্বরে চিৎকার চলেছে, যদা যদা হি ধর্মস্য…বেদীতে বড়মামা। আমাকে দেখে চাপাগলায় জিগ্যেস করলেন—

‘কোথায়…কোথায়? বৈশ অধৈর্য হয়ে পড়েছেন।

‘বাথরুমে যদা যদা হি’…

‘তার মানে ঘণ্টাখানেকের ধাক্কা।’

‘কখন ঢুকেছেন তাতো জানি না।’

‘ধ্যার বোকা। যদা যদা তো ধরতাই। নে, ওঠ পা টিপে টিপে।’

‘কোথায় বড়মামা?’

‘প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন নয়। মামানুসর।’

গীতা আর নিজের প্রতিভা মিলে তৈরি, মামাকে অনুসরণ মামানুসর।

পেছন পেছন দোতলার বারান্দায়। দক্ষিণে মেজোমামার ঘর। পা টিপে টিপে চলেছি আমরা চোরের মতো। বেশ ভয় ভয় করছে। মেজোমামার ঘরের সামনে বিশাল খাঁচা। মুনিয়া আর বদরিতে মিলে গোটা দশেক হবে। কিচিরমিচির করছে। বড়মামা খাঁচার সামনে দাঁড়ালেন।

‘তোর সেই গল্পটা মনে আছে?’

‘কোনটা?’ ‘হাজী মহম্মদ মহসীন।’

‘হ্যাঁ, নিজে মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে তারপর বিধবার ছেলেকে মিষ্টি ছাড়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। আজ আমিও তাই করব। আমি আর এক মহসীন। জগৎবাসীকে, ওহে তোমরা পাখি মুক্ত করে আকাশে উড়িয়ে দাও বলার আগে আমি এদের মুক্ত করে দোব।’

‘বড়মামা, ও কাজ করবেন না। মেজোমামার পাখি, মাসিমার আদরে মানুষ। মাসিমা আপনাকে শেষ করে দেবেন।’

‘রাখ তোর মাসিমা। জগাই-মাধাই কলসির কানা মেরে শ্রীচৈতন্যকে থামতে পেরেছিল? পারেনি মানিক। ধর্মের জয়।’

খাঁচার দরজা খুলে নাটক করার মতো করে বললেন, ‘যাও বিহঙ্গ। অনন্ত নীল আকাশ হাতছানি দিয়ে ডাকছে।’

অত সুন্দর করে বললেন, কিন্তু একটিও বিহঙ্গ খাঁচার দরজা গলে বেরিয়ে এল না।

বড়মামা রেগে গিয়ে বললেন, ‘সব ব্যাটাকে বাতে ধরেছে!’

‘বড়মামা, দরজা বন্ধ করে দিন। যে কোনও মুহূর্তে মাসিমা এসে পড়বেন। আর মেজোমামা জানতে পারলে দক্ষযজ্ঞ হবে।

আমার কোনও কথাতেই বড়মামার কান নেই। পাখিদের বললেন, ‘যাও বিহঙ্গ, মুক্ত আকাশে মেল স্বাধীন ডানা।’

তেমনি পাখি। বোকার মতো খাঁচাতেই নাচতে লাগল। খোলা দরজা নজরেই আসছে না।

বড়মামা বললেন, ‘ঠিক আমাদের অবস্থা। স্বাধীন করে দিলেও স্বাধীনতার সুযোগ নিতে পারছে না। অপ্রস্তুত মন।’

‘ছেড়ে দিন বড়মামা।’

‘হ্যাঁ, ছেড়ে তো দোবই।’

খাঁচার ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা একটা করে পাখি বের করে আকাশে ওড়াতে লাগলেন। এক একটাকে নীল আকাশের দিকে ছুঁড়ছেন আর বলছেন, ‘যাও যাও, তুমি মুক্ত, তুমি স্বাধীন।’

প্রথম পাখিটা ওড়ার চেষ্টা করে নীচের উঠোনে পড়ে গেল। একটা বসে ছাদের কার্নিশে। কেউই বেশিদূর উড়তে পারেনি। একটু উড়েই যে যেখানে পেরেছে বসে পড়েছে। শেষ পাখিটাকে বড়মামা কিছুতেই বের করতে পারছেন না। ‘স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এত বড় বিদ্রোহ। এ ব্যাটা নিশ্চয় বাঙালি পাখি। মুক্ত জীবনের চেয়ে বন্ধ জীবনই বেশি ভালোবাসে।’ পাখি আঙুলে এক একবার ঠোক্কর মারছে আর বড়মামা রেগেমেগে জ্ঞানের কথা বলছেন।

কোনও রকমে বের করেছেন খাঁচা থেকে, আকাশে ওড়াতে যাবেন, এমন সময় মাসিমা। হাতে চায়ের কাপ।

‘এই নাও তোমার চা। দুধ ছাড়া, চিনি ছাড়া। একী একী কী করছ?’ পাখিটাকে উড়িয়ে দিয়ে বড়মামা যেন স্কুলে আবৃত্তি কম্পিটিশনে কবিতা পড়ছেন—

 ‘স্বাধীনতা-হীনতায়

 কে বাঁচিতে চায় রে

 কে বাঁচিয়ে চায়।’

পাখি এক চক্কর উড়ে সাঁ করে মেজোমামার ঘরে। মাসিমা, আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘মেজদা, সর্বনাশ হয়ে গেল!’ মেজোমামার শুরু আর শেষ এক। ‘যদা যদা হি’ চলছিল, থেমে গেল। বেরিয়ে এলেন পিঠে ধবধবে সাদা ভিজে তোয়ালে। চুলে মুক্তার দানার মতো কয়েক বিন্দু জল। সারা গায়ে বিলিতি সাবানের ভুরভুরে গন্ধ।

মাসিমা হাঁউপাঁউ করে বললেন, ‘যদা যদা করছ, ওদিকে ধর্মে কী গ্লানি দেখ। সব পাখি গন।’

‘তার মানে?’

‘ইনি সব ধরে ধরে উড়িয়ে দিলেন।’

‘সে আবার কী? এতকাল টাকা ওড়াচ্ছিলেন। টাকা থেকে পাখিতে চলে এলেন! মাথাফাতা খারাপ হয়ে গেল নাকি? তুমি ওড়ালে না উড়ে গেল? এই তো আমি দানাপানি দিয়ে খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেলুম।’

বড়মামা বীরের মতো হাসতে হাসতে বললেন, ‘একদিন উড়বে, সাধের ময়না।’

‘তুমি কি আরম্ভ করেছ। সব পাখি উড়িয়ে দিলে?’

‘আমি ত্রাতা। সব বন্দী পাখির স্বাধীনতা আমি ফিরিয়ে দেবো।’

‘তুমি উন্মাদ।’

‘শ্রীচৈতন্য, বুদ্ধ, শ্রীরামকৃষ্ণকে সবাই তাই ভেবেছিল প্রথমে।’

মেজোমামার ঘরে একটা ঝটাপটির শব্দ হল। বড়মামার পেয়ারের কুকুর লাকি কী একটা মুখে করে ঘর থেকে বেরিয়েই নেচে নেচে বড়মামার ঘরের দিকে চলে গেল। মাসিমা এক ঝলক দেখেই, ‘যাঃ সর্বনাশ হয়ে গেল, সর্বনাশ হয়ে গেল, বলে পেছন পেছন ছুটলেন।

মেজোমামা বললেন, ‘ব্যাপারটা কী? আবার আমার চটি? তিন জোড়া চিবিয়ে শেষ করেছে।’

মাসিমা ছুটন্ত অবস্থায় বললেন, ‘চটি নয়, চটি নয়, পাখি।’

‘অ্যাঁ, পাখি!’ মেজোমামাও ছুটলেন। কুকুর আবার বেড়াল হল কবে থেকে?’

বড়মামার বীরভাব কেটে গেল। মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।

‘হ্যাঁরে সত্যিই পাখি লাকি ধরেছে?’

‘না বড়মামা, লাকি পাখি ধরেছে।’

‘তুই দেখলি?’

‘হ্যাঁ।’

‘ইডিয়েট।’

‘কে বড়মামা? আমি?’

‘না, তুই না, আমি। আর একবার প্রমাণিত হল, স্বাধীনতা দেওয়া যায় না। স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। লড়াই করে, বিপ্লব করে ছিনিয়ে আনতে হয়। চল চল দেখি পাখিটাকে বাঁচানো যায় কিনা।’

বড়মামার ঘরে খাটের তলায় লাকি। মুখে পাখি। মাসিমা আর মেজোমামা উঁকি মেরে দেখছেন। তলা থেকে একটা গোঁ গোঁ শব্দ আসছে। ডানার ঝটপটানি। ঘরে ঢুকেই বড়মামা একটা হুঙ্কার ছাড়লেন ‘লাকি!!’ দরজা-জানলা কেঁপে উঠল। বেরিয়ে এসো। কাম আউট।

লাকি বেরিয়ে এল গুটি গুটি। মুখে সেই পাখি। কী সুন্দর কচি কলাপাতার মতো গায়ের রং। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললুম। অমন সুন্দর একটা পাখি চোখের সামনে মারা যাবে? আমার কান্না শুনে লাকি ঘাঁউ করে উঠল। লাকি কান্না সহ্য করতে পারে না। ভীষণ বিরক্ত হয়। ডাকামাত্রই পাখিটা মুখ থেকে খসে পড়ে গেল। ঝট পটিয়ে ওড়ার চেষ্টা করল পারল না। ঠিকরে মুখ থুবড়ে পড়ল গিয়ে ঘরের কোণে।

পাখির চারপাশে গোল হয়ে আমরা। ছোট্ট পাখি নিঃশ্বাস ফেলেছে জোরে জোরে। ছোট্ট বুক ওঠানামা করছে হাপরের মতো। এবার মাসিমাও কেঁদে ফেললেন। মেজোমামাও ফোঁস ফোঁস করছেন। এমনকী লাকিও কেঁদে ফেলেছে। ওর কান্নার শব্দ আমি বুঝি। খাবার না পেলে হ্যাংলা ঠিক এইরকম কুঁ কুঁ করে কাঁদে।

বড়মামা ধরা ধরা গলায় বললেন ‘আমি ক্ষমা চাইছি। বন্দী পাখির বেদনায় কাতর হয়ে স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলুম। ভুল করে ফেলেছি আমি। স্বাধীনতা দুর্বলের জিনিস নয়, সবলের। তোরা শুধু দেখ ওর জীবন আমি ফিরিয়ে দেব।’

মাসিমা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘তুমি আর কী করবে বড়দা? তুমি তো আর ভগবান নও। ওর গলায় ফুটো করে দিয়েছে।’

‘ভগবানের কাছে শক্তি ধার করে আমি ওর ফুটো মেরামত করব। তোরা পরে আমাকে গালাগাল দিস। এখন শুধু প্রার্থনা কর!’

বড়মামার ডাক্তারি শুরু হল। বড় একটা প্লাস্টিকের গামলায় তুলোর বিছানা। বিছানায় পাখি। দু’পাশে ডানা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ডানার তলায় নরম তুলতুলে শরীরে সরু ছুঁচ দিয়ে পুট করে একটা ইনজেকশন দিলেন। ছোট্ট ফুটো দুটোর মুখে কী একটা লাগালেন। রক্ত বন্ধ হয়েছে। বড়মামা বললেন, ‘কুসি, বিছানায় আমার মশারিটা ফেল। পাখি এখন বিশ্রাম করবে। লম্বা ঘুম। লাকি তুমি বাইরে যাও।’

বারান্দায় সভা বসেছে।

বড়মামা বললেন, ‘মেজো, খাঁচায় কটা পাখি ছিল?’

‘এখন আর তা জেনে লাভ কী?’

‘রাগারাগি নয়। হাতে হাত মেলাও ব্রাদার। সব কটাকে ধরতে হবে। ধরে খাঁচায় পুরতে হবে। নইলে তোমার অপদার্থ পাখিরা বেড়ালের পেটে যাবে।’

‘দায়ী তুমি।’

‘অবশ্যই। বিচার পরে হবে। আগে কাজ। চল পাখি ধরতে বেরোই। সেই ছোট খাঁচাটা কোথায়?’

‘পাখি ধরবে তুমি? পাখি ধরা অত সহজ?’

‘বেশ। আমি আমার দলবলকে ডাকছি।’

উঠে গিয়ে ফোনের ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন।

মেজোমামা বললেন, ‘ও তোমার হাসপাতালের চেলাচামুণ্ডার কাজ নয়।’

‘হাসপাতালে করছি না বৎস। ফোন করছি অনামিকা সংঘে। যে ক্লাবের আমি প্রেসিডেন্ট। এখুনি দু-ডজন ছেলে আসবে। শুরু হবে চিরুনি অভিযান?’ মেজোমামা উঠে চলে গেলেন।

বড়মামা আমাকে বললেন, ‘বুঝলে, চ্যালেঞ্জ করে গেল। ঠিক হ্যায় মেজো। তোমার চ্যালেঞ্জ আমি নিলুম। ডু অর ডাই। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।’

এক ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি জমজমাট। বিভিন্ন মাপের, মেজাজের, বয়সের দু-ডজন সৈনিক বড়মামার ভাষায়। মাসিমার ভাষায় ভূতপ্রেত! মহাদেবের চেলা।

নেতা অতনু বললে, ‘পাখি ধরতে হবে। কী পাখি? ডাকপাখি? বক? হরিয়াল? তাহলে গোটা দুই বন্দুক নিয়ে আসি।’

বড়মামার হাত উঠল বুদ্ধদেবের ভঙ্গিতে। ‘অতনু, আমি ধরতে বলছি, মারতে বলিনি। ভালো করে শুনে নাও। খাঁচার পাখি। আমাদের পোষা পাখি।’

‘পোষা বলছেন কী করে? পোষা পাখি পালায় না।’

‘পালাবে কেন? আমি ধরে ধরে উড়িয়ে দিয়েছি।’

‘তাহলে আবার ধরবেন কেন?’

‘সে আমার ইচ্ছে।’

‘বেশ, আপনার ইচ্ছে। তা কী জাতীয় পাখি?’

‘বদরি, মুনিয়া।’

‘কোথায় তারা আছে?’

‘আশেপাশেই আছে। কারুর বাড়ির ছাদে। গাছের ডালে। ঘুলঘুলিতে।’

‘অসম্ভব। ও আমরা ধরব কী করে?’

‘অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে তবে না তুমি অতনু।’

‘বেশ। চব্বিশটা খাঁচা কেনার দাম দিন।’

‘এগারোটা পাখির জন্য চব্বিশটা খাঁচা তোমার মাথা…’

‘না মাথা খারাপ নয়। চব্বিশটা ছেলে চব্বিশটা দিকে যাবে। পাখি একটা হলেও চব্বিশটা খাঁচা লাগত। হিসেব মেলাতে হলে আরও তেরোটা পাখি কিনে উড়িয়ে দিন। ওয়ান পাখি পার খাঁচা। মাছের জন্যে যেমন ছিপ, পাখির জন্যে তেমনি খাঁচা।’

‘অনেক পড়ে যাচ্ছে অতনু।’

‘তাতো যাবেই সুধাংশুদা। খাঁচার পাখিকে খাঁচায় ফেরাতে চান। সেরকম বুঝলে নতুন পাখি কিনুন।’

‘না না। সে তো পরের পাখি। আমরা চাই ঘরের পাখি।’

‘তাহলে শ-তিনেক টাকা ছাড়ুন। যত দেরি করবেন, তত দেরি হয়ে যাবে!’

বড়মামার কম্পাউন্ডার সুধন্যকাকু পাশে বসেছিলেন। বয়স্ক মানুষ। এক মাথা এলোমেলো কাঁচাপাকা চুল। তিনি বললেন ‘খাঁচা কী হবে? বড় ঠোঙাতেই কাজ হয়ে যাবে। শুধু শুধু পয়সা নষ্ট এই বাজারে। আর তা না হলে প্লাস্টিকের থলে।’

‘কী যে বলেন!’ অতনু বিরক্ত হল। একি আপনার ওষুধের পুরিয়া? যে কাজের যা। কথায় বলে খাঁচার পাখি। পাখির খাঁচা। খাঁচার পাখি খাঁচা ছাড়া ফিরবে না।’

অনেক বচসার পর তিনশো টাকা নিয়ে দলবল বেরিয়ে গেল। সুধন্যকাকু মাসিমাকে বললেন, ‘এঃ বড়বাবু বাজে পাল্লায় পড়ে গেলেন। একেই বলে খাল কেটে কুমীর আনা!’

মেজোমামা ঠিকই বলেছিলেন। জল অনেক দূর গড়াল। খাঁচা কেনার টাকা নিয়ে পাখি ধরার দল হাওয়া হয়ে গেল। বড়মামা সন্ধানে বেরিয়ে বেপাত্তা। একটা বাজল, দুটো বাজল। মাসিমা ঘরবার করছেন। খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠল। রোগীরা অপেক্ষায় থেকে থেকে চলে গেল। সুধন্যকাকু সাইকেলে সারা পাড়া চক্কর মেরে এসে, এক গেলাস গ্লুকোজ গোলা জল খেয়ে খালি ডিসপেনসারিতে রোগীদের পেট টেপা বেঞ্চে চিৎপাত। চারটে বাজল। সাড়ে চারটের সময় মেজোমামা কলেজ থেকে এসে গেলেন। মশারির ভেতর আহত পাখি মশগুল হয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘরের মেঝেতে লাকি ধনুকের মতো পড়ে আছে। ছাদের ঠাকুরঘরে দুটো মুনিয়া ঢুকেছিল। মাসিমা আবার খাঁচায় ভরে দিয়েছেন।

মেজোমামা বললেন, ‘এই বড়দার জন্যে আমাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। এমন একটা দিন নেই যেদিন কোনও না কোনও একটা কাণ্ড ঘটায়নি। একা রামে রক্ষে নেই, তায় সুগ্রীব দোসর।’

সুগ্রীব মানে আমি। আমার কী দোষ? কী বলব। তর্ক করে লাভ নেই। মেজোমামা বললেন, ‘চল হে, বড়বাবুকে খুঁজে আনি। পাখির শোকে সন্ন্যাসী।’

মেজোমামার হাতে টর্চ। একটু পরেই সন্ধে হবে। আর হবে লোডশেডিং। ভূতুড়ে অন্ধকার। আলো আসতে রাত দশটা তো বটেই।

উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, ব্যায়লা পাড়া, ধামাপাড়া, ঘোরা হয়ে গেল। খেলার মাঠ থেকে ছেলেরা চলে গেল। পথঘাট নির্জন হয়ে আসছে। মন্দিরে শাঁখ ঘণ্টা কাঁসর বাজতে শুরু করেছে। বৃদ্ধেরা রক ছেড়ে উঠে গেছেন। কোথাও পাত্তা নেই। না বড়মামার না পাখি ধরা দলের।

মেজোমামা রেগে বললেন, ‘ওরা সব সিঙ্গাপুর চলে গেছে।’

‘কেন মেজোমামা?’

‘যে জায়গার পাখি, সেই জায়গা থেকে ধরে আনতে গেছে। মনে নেই, সেই একবার চা কিনতে দার্জিলিং চলে গিয়েছিল? প্ল্যান করেছিল গোমুখ থেকে গঙ্গাজল আনবে। তোমার বড়মামা সব পারে। ডেনজারাস লোক।’

কথায় কথায় আমরা সাঁই বাগানের কাছে এসে গেছি। বহুকালের পুরনো বাগান। ভেতরে একটা দীঘি আছে। এক সময় পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। এখন জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়ে গেছে। বেওয়ারিশ বাগান। দিনের বেলা দীঘিতে সব নাইতে আসে। কেউ কেউ ছিপ নিয়ে বসে। সন্ধের দিকে বড় কেউ একটা আসে না। ভয় পায়। বাগান না বলে জঙ্গল বলাই ভালো।

মেজোমামা বললেন, ‘এই সেই সাঁই বাগান। এক সময় কী ছিল আজ কী হয়েছে?’

কথা শেষ হবার আগেই ভেতরের ঝোপঝাড় দুলে উঠল। সাদামতো কী একটা জিনিস ঝোপঝাড় ভেঙে তীরবেগে ছুটে আসছে আমাদের দিকে! ভয়ে মেজোমামার কোমর জড়িয়ে ধরেছি, ‘মেজোমামা বাইসন!’

বড়মামা শিখিয়েছিলেন, ‘ভয় পেলেই চোখ বুজিয়ে ফেলবি।’ সে শিক্ষা ভুলিনি। ধড়াস করে একটা শব্দ হল। মানুষের গলা। চোখ খুললুম। রাস্তায় মুখ থুবড়ে কে একজন পড়ে আছে। গোঁ গোঁ শব্দ করছে। সন্ধের ঝাপসা আলোয় চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মেজোমামা টর্চ ফেললেন। চেনা গেল আমাদের রামুদা। গঙ্গার ধারের বটতলায় ইটালিয়ান সেলুন যাঁর। মাঝে মাঝে আমাদের চুল ছাঁটেন।

মেজোমামা ডাকলেন, ‘রামু, রামু!’

রামুদা বললেন, ‘ওরে বাবারে। আর করব না। আমায় ধরো না।’ টর্চের আলো না সরিয়ে মেজোমামা বললেন ‘কে ধরবে?’

‘ভূত।’

‘আমরা মানুষ। মুকুজ্যে বাড়ির শান্তি।’

রামদা পিট পিট করে তাকালেন।

‘কোথায় তোমার ভূত?’

রামুদা উঠে বসলেন, ‘ওই যে ওখানে। তেঁতুল গাছে।’

‘কী করতে গিয়েছিলে ওখানে?’

‘ছাগল খুঁজতে।’

‘ভূত দেখেছ?’

‘না, গলা শুনলুম। শুধু গাছের ওপর থেকে বললে, ব্যাটা রামু আমাকে নামা।’

‘তোমার নাম ধরে ডেকেছে?’

‘হ্যাঁ—স্পষ্ট—তিনবার।’

‘ব্যাটা বলেছে?’

‘হ্যাঁ মেজোবাবু, ব্যাটা বলেছে। আর আমি বাঁচব না। ভূতে ডাকলে আর বাঁচে না মানুষ।’

‘তোর মাথা! চলো দেখি কোন গাছ?’

‘মেজোবাবু, আমি আর নাই বা গেলুম। গরীব মানুষ।’

‘চলো! আমার গলায় পৈতে আছে, ভূতে কিছু করতে পারবে না।’

অঘোর কত্তা। বুড়ো পয়সা দিত না বলে ভোঁতা খুর দিয়ে দাড়ি চেচে চেচে খুব ফটকিরি বুইলে দিতুম। সেই অঘোর কত্তা তেঁতুল গাছে বাসা বেঁধেছে।’

‘তোমার মুণ্ডু। ভূত কি পাখি? চলো আমার সঙ্গে।’ পাঁচিল টপকে বাগানে। আজ আর আমায় কেউ বাঁচাতে পারবে না। মৃত্যুই লেখা আছে কপালে! শীতের ভোরে গঙ্গা স্নান করা গলায় রামুদা রামনাম করছে।

তেঁতুলতলায় আসতেই মগডাল নড়ে উঠল। বড়মামার ট্রেনিংয়ে। চোখ বুজিয়ে ফেলেছি ঘাড় মটকাক—আমি দেখছি না!

গাছের ওপর থেকে ক্ষীণগলায় কে বললেন, ‘কে আছো?’

মেজোমামা হেঁকে বললেন, ‘কে? বড়দা?’

গাছ বললে, ‘কে? মেজো?’

‘ওখানে কী করছ তুমি?’

‘পাখি ধরতে ডালে ডালে উঠেছি ভাই। আর নামতে পারছিনে!’

‘বেশ করেছ। ওইখানেই থেকে যাও। পাকলে আপনিই খসে পড়বে।’

‘ভাইরে! একি রাগারাগির সময়? আমাকে নামা ভাই।’

‘নামা ভাই!’ মেজোমামা রেগে উঠলেন, ‘নামাবো কী করে? নিজে নিজে নেমে এসো।’

‘সে আমি পারব না। পারলে অনেক আগেই নেমে পড়তুম।’

‘আমরা কীভাবে নামব? এ কী সহজ কাজ?’

‘ফায়ার ব্রিগেডে খবর দে ভাই। আর পারছি না। সারাটা দুপুর শালিকে ঠুকরে ঠুকরে মাথার ঘিলু বের করে দিয়েছে। এখন মশা আর লাল পিঁপড়েতে ছিঁড়ছে! এইবার সত্যি সত্যিই আমি ধুম করে পড়ে যাব।’

ফোন করার পনেরো মিনিটের মধ্যে দমকলের ঘণ্টা শোনা গেল। দমকল আসছে। পেছন পেছন ছুটে আসছে সারা পাড়া—’আগুন লেগেছে! আগুন!’

দমকলের অফিসার গাড়ি থেকে নেমেই জিগ্যেস করলেন ‘কোথায় সেই পাগল?’

আমি বলতে যাচ্ছিলুম, পাগল নয়, বড়মামা। মেজোমামা আমার মুখ চেপে ধরলেন। বললেন, ‘তেঁতুল গাছের মাথায় চড়ে বসে আছে।’

এ মশাই সেই পাগলটা। কাল হাওড়া ব্রিজের মাথায় চড়ে পাক্কা সাড়ে চার ঘণ্টা আমাদের নাচিয়ে মেরেছে।’

মেজোমামা বললেন, ‘এ সে নয়, অন্য আরেকটা!’

‘সে আমরা দেখলেই চিনতে পারবো?’

দমকল ছুটল সাঁই বাগানের দিকে। পেছন পেছন ছুটছে সারা পাড়ার লোক। বাচ্চারা চেল্লাচ্ছে, ‘দমকল আসছে, দমকল।’

বড়মামা নামলেন। পাড়ার লোক চিনতে পেরেছে, ‘আরে, এ যে আমাদের ডাক্তারবাবু গো!’ হইহই ব্যাপার। সার্চলাইটের আলোয় সাঁইবাগানের উৎসব লেগে গেছে। ঘুম ভাঙা হনুমানেরা হুপহাপ করছে। পিঁপড়ের কামড়ে আর লজ্জায় লাল বড়মামা বাড়ি ঢুকেই বললেন, ‘এ তোদের ষড়যন্ত্র।’

মেজোমামা বললেন, ‘তার মানে? এই ভজঘট করে নামানোটা ষড়যন্ত্র হল?’

‘অবশ্যই হল। তোরা ঘণ্টা বাজাতে দিলি কেন? কেন তোরা নীরবে, নিঃশব্দে আমাকে নামালি না? সারা পাড়ার লোক কেন জানবে আমি গাছের মাথায় আটকে গিয়েছিলুম? জানিস আমাকে প্র্যাকটিস করে খেতে হয়।’

পরের দিন সকালে আরও মজা—কে যেন খবরটা সংবাদপত্রে ছেড়ে দিয়েছে—

‘তেঁতুল গাছে ডাক্তার’

শাপের বর হল। বড়মামার পসার বেড়ে গেল। চেম্বারে রোগী ধরে না। তবে উলটো পসার। কেউ নিজেকে দেখাতে আসেননি। সবাই ডাক্তারকে দেখতে এসেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *