তৃষ্ণা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
প্যাট মেনডোনসা! এই ঘরে তুমি এসেছ আমি বুঝতে পারছি। আমি আর খুঁজব না, আমার ক্ষমতা ফুরিয়েছে— তুমি যা চাও তাই হবে। কিন্তু তোমাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, তাই ভয় হচ্ছে। তুমি সামনে এসে দাঁড়াও, তোমার কাকে ভয়?
ঘরে যে কটি প্রাণী ছিল সকলে চমকে উঠেছিল। এমনকী অমন নামজাদা ডাক্তারও। রোগের ঘোরে অনেকে অনেক রকম প্রলাপ বকে, সেটা অসংলগ্ন হয়, জড়তা থাকে। কিন্তু এ যেন কেউ সবরকমভাবে হার মেনে ক্লান্ত বিষণ্ণ থমথমে গলায় স্পষ্ট করে শেষ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল। অনেকের কানে সেটা নিজের মৃত্যু ঘোষণার মতো লাগল।
অসুখের ঘোরে রোগী আগেও অনেকবার ভুল বকেছে, বিকারগ্রস্ত দুই চোখ টান করে অনেকবার ঘরের চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখেছে। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর এমন স্পষ্ট হয়ে কানে লেগে থাকেনি কারও, সেই চাউনি এত স্পষ্ট স্বচ্ছ মনে হয়নি। তাতে নিজেকে আগলে রাখার ব্যাকুলতা ছিল, সেই দৃষ্টিতে অব্যক্ত দুর্বোধ্য যাতনা ছিল। অভিজ্ঞ চিকিৎসক ইনজেকশন আর ঘুমের ওষুধ দিয়ে তখন রোগীকে ঘুম পাড়িয়েছেন। আজ ছ—দিন ধরেই তাই করছেন। দেহগত লক্ষণ তিনি সুবিধের দেখছেন না। অথচ আরও দুজন সতীর্থ চিকিৎসকের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেও সঠিক রোগের হদিশ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। এক একবার ভেবেছেন হাসপাতালে এনে ফেলা দরকার। আবার মনে হয়েছে এই অবনতির লক্ষণ মোটামুটি স্নায়বিক প্রতিক্রিয়ার দরুণ। ধরাছোঁয়ার মধ্যে কোনো রোগ যখন দেখা যাচ্ছে না, তখন তেমন ভয়ের কিছু নেই বোধহয়। স্নায়ু সেরকম বিকল হয়ে দেহের অন্যান্য লক্ষণও তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
তিনি শুনেছেন রোগীর প্রকৃতি ভাবপ্রবণ। এর উপর বড়ো রকমের মানসিক বিপর্যয়ের যে কারণ ঘটেছে তাও শুনেছেন। তিনি বিশ্বাস করেননি, সম্ভব অসম্ভবের চিন্তাও তাঁর মাথায় আসেনি। সুস্থ বাসনার একটা বিকৃত প্রকাশ ছাড়া আর কিছু ভাবেননি তিনি। শোনা যায় না। কিন্তু চ্যাটার্জীর মনে হল সে বলছে, প্যাট মেনডোনসা… প্যাট মেনডোনসা…!
ঘরের মধ্যে সব থেকে বেশি অস্বস্তি বোধ করছে চ্যাটার্জী। এই দুদিনে অনেকবার যে কথা মনে হয়েছে কোটটার দিকে চেয়েও আবার সেই কথাই মনে হল। দিয়ে যখন দিয়েই ছিল, এই কোটটা নরিস আর ফিরিয়ে না আনলেই পারত। এই আনাটাই যেন ভুল হয়েছে। কী ভুল, কেন ভুল চ্যাটার্জীও জানে না। অথচ তার সামনেই তো ওটা ফিরিয়ে এনেছে নরিস, চ্যাটার্জী নির্বাক দাঁড়িয়েছিল— অস্বস্তি বোধ করেছিল, কিন্তু বাধা দেবার কথা মনে হয়নি।
ডাক্তার আবার ঔষধ খাওয়ালেন, ইনজেকশন দিলেন।
বাইরে এসে এক বন্ধু ভেবেচিন্তে চ্যাটার্জীকে বলল, দেখো, এক কাজ করো, উৎসবের পরদিন পর্যন্ত তোমারও মাথা খুব সাফ ছিল না বুঝতে পারছি, তোমাদের কাগজে প্যাট মেনডোনসার নামে একটা বিজ্ঞাপন দাও—ফিলিপ নরিসের এই অবস্থা জানিয়ে অতি অবশ্য তার সঙ্গে এসে দেখা করতে লেখো—এই বোম্বাই শহরে প্যাট মেনডোনসা হয়তো দুই বেরুবে, কোথায় কার সঙ্গে লটঘট বাঁধিয়ে রেখেছে কে জানে—বিজ্ঞাপন চোখে পড়লে যে আসবার ঠিক এসে হাজির হবে ‘খন দেখে নিও। তোমরা যে ঠিকানায় গেছিলে সেটা একটা যোগাযোগ হতে পারে আর তার আগের রাত থেকে ফিলিপেরও মাথার গোলমাল ঘটে থাকতে পারে—সে তো বেসামাল কথাবার্তাই বলছিল তখন, কেউ কি এক বর্ণও বিশ্বাস করেছে!
করেনি সত্যি। চ্যাটার্জী নিজেই করেনি। কিন্তু তারপরে যা সে দেখেছে অবিশ্বাস করবে কি করে। তবু নিজেরই তার বার বার ধাঁধাঁ লাগছে, ধোঁকা লাগছে। ফিলিপের না—হয় মাথার গন্ডগোল হয়েছিল, কিন্তু তারও কি হয়েছিল? বন্ধুর কথামতো কাগজে বিজ্ঞাপন যে রাতের কথা শুনেছেন সেই রাতে ছোকরা যে প্রকৃতিস্থ ছিল না তাতেও ডাক্তারের কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। আজকালকার রোমান্স সর্বস্ব দুর্বলচিত্ত অতি আধুনিক ছেলেছোকরাদের জানতে বাকি নেই তাঁর। যে কাররেই হোক বড়ো রকমের একটা ধাক্কা খেয়েছে, সেটা সামলে ভালো কোনো মানসিক চিকিৎসকের হাতে ছেড়ে দিতে পারলেই দায়িত্ব শেষ হতে পারে ভাবছিলেন তিনি।
কিন্তু লক্ষণ দেখে ভিতরে ভিতরে তিনিও শঙ্কা বোধ করছেন এখন।
রোগীর এই শেষ কথা শুনে আর তার এই চাউনি দেখে সব থেকে বেশি চমকে উঠেছিল খবরের কাগজের চ্যাটার্জী। বন্ধুদের মধ্যে আরও দুই একজন অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। চ্যাটার্জীর কাছ থেকেই তারাও ঘটনার কিছু কিছু আভাস জেনে ছিল। আর সাতদিন আগে উৎসবের সেই রাত্রি শেষে একটা মজার প্রহসনে তারা জর্জরিত করেছে নরিসকে, হাতে পেয়েও ছেড়ে দিলি? সঙ্গে ঢুকলি না। তোর মতো হাঁদা প্রেমিককে কলা দেখাবে না তো কি, কোটের শোক করতে করতে এখন বাড়ি গিয়ে ঘুমোগে যা—।
ঠাট্টা যারা করছিল, ফিলিপ নরিসের অন্তরঙ্গ বন্ধু খবরের কাগজের চ্যাটার্জীও তাদের একজন।
ফিলিপ নরিসের এই কণ্ঠস্বর শুনে আর এই চাউনি দেখে ঘরের অনেকেই নিজেদের অজ্ঞাতে দরজার দিকে তাকালো। মনে হল, এই কথার পর, এই আত্মসমর্পণের পর দ্বার প্রান্তে বুঝি সত্যই কোনো রমণীর নাটকীয় আবির্ভাব ঘটবে। তা ঘটল না। রোগীর দৃষ্টি ধরে চ্যাটার্জীর চোখ যেদিকে ফিরল ঘরের সেখানটায় আলনা! আলনার হ্যাঙ্গারে গরম কোট ঝুলছে একটা। ফিলিপ নরিস সেদিকেই চেয়ে আছে, বিকারের চাউনি জানে, কিন্তু বড়ো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। যেন সেদিকে চেয়ে সত্যিই কাউকে দেখেছে সে, ঠোঁট দুটো নড়ছে। বিড় বিড় করে বলছে কিছু। একটা দিয়েই দেখবে? পর মুহূর্তে কি আবার মনে পড়েছে। না ভুল কিছু হয়নি যারা জানে না তাদের এ—রকম ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু চ্যাটার্জী ভাববে কী করে? এ যদি ভুল হয় তা হলে তার এই মুহূর্তের অস্তিত্বও ঠিক কিনা সন্দেহ।
থাক, এ নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশও আর কিছু থাকল না। ডাক্তারের ওষুধ আর ইনজেকশনে—ফিলিপ নরিস চোখ বুজেছে। সেই চোখ মেলে আর তাকায়নি। তার সেই রাতের ঘুম আর ভাঙেনি। কখন শেষ নিশ্বাস ফেলেছে নার্সও টের পায়নি। বন্ধুরাও পরদিন এসে তাকে মৃত দেখেছে।
* * *
এবারে আগের ঘটনাটুকু যোগ করলেও কাহিনি সম্পূর্ণ হবে কিনা বলা শক্ত।
ঘটনাস্থল বোম্বাইয়ের এক মস্ত নামজাদা ইঙ্গ—ভারতীয় ধাঁচের ক্লাব। নামজাদা ক্লাব না বলে নামজাদা সংস্থা বললেই বোধকরি ঠিক হবে। অনিবার্য কারণে নাম অনুক্ত থাক। এই ক্লাব বা ক্লাবের নিজস্ব প্রাসাদ সৌধ সেখানকার সকলেই চেনেন। মেম্বাররা সর্ব ভারতীয় এবং কিছুটা সর্বদেশীয়। তবে একক সংখ্যার বিচারে গোয়ান মেয়ে পুরুষের সংখ্যাই বোধ করি বেশি। এই গোয়ানদের মধ্যে আবার জাতের রেষারেষি আছে। গোঁড়া ব্রাহ্মণ—ক্রিশ্চিয়ান গোয়ানদের মাথা উঁচু—সামাজিক ব্যাপারে অধস্তন গোয়ানদের সঙ্গে সচরাচর তারা আপস করে না। কিন্তু এই ক্লাব অনেকটা শ্রীক্ষেত্রের মতো। এখানে জাত বর্ণের খোঁজ বড়ো পড়ে না।
এখানে প্রবেশের প্রধান ছাড়পত্র আর্থিক সংগতি। যার টাকা আছে আর তারুণ্যের পিপাসা আছে। তার কাছে ক্লাবের দ্বার অবারিত। বহু লক্ষপতি বা ক্রোড়পতি প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ এই সংস্থার পৃষ্ঠপোষক। নবীন সভ্য—সভ্যাদের টাকার জোরের থেকে দিল—এর জোর বেশি। টাকার থেকেও তাদের বড়ো মূলধন আনন্দ আহরণের উৎসাহ আর উদ্দীপনার ফলেই সাধারণ সংস্থার মুরুব্বীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে যায়। এখানে ইচ্ছার বেগই প্রধান। এখানে এসে হিসেবের খাতায় পাতা খোলে না।
চ্যাটার্জী এখানে ভিড়তে পেরেছে টাকার জোরে নয়, তার কাগজের জোরে। আর কিছুটা তার সুপটু যোগাযোগের ফলে। সুমার্জিত কৌশলে সব—জান্তার আসরে যে নামতে পারে, দুনিয়া উলটে—পালটে গেলেও খুব একটা কিছু যায় আসে না এমনি নির্লিপ্ত মাধুর্যে যে অবকাশ যাপন করতে পারে—এখানে তারই কদর বেশি, সেই হিসেবে চ্যাটার্জী প্রিয়পাত্র এখানকার। ফিলিপ নরিসের বিশেষ গুণ হল সে টাকা যা রোজগার করে তার থেকে বেশি খরচ করতে জানে। নিজের গতিবিধি আচার—আচরণ সরল, সংযত—অথচ বন্ধুবান্ধব তার বেশিরভাগই বেপরোয়া, সদা মুখর। কারও টাকার দরকার হলে অসংকোচে হাত পাতো ফিলিপ নরিসের কাছে, হাতে থাকলে সে তক্ষুনি দিয়ে দেবে। না থাকলে, আর টাকার প্রয়োজন যার সে প্রিয় পাত্র হলে, ধার করে এনে দেবে। দিয়ে অনুগ্রহ করবে না, নিজেই অনুগৃহীত হবে। ব্যাঙ্কে মোটামুটি ভালোই চাকরি করে, ব্যাচিলার, তাই ভালো হোটেলে আলাদা একখানা ঘর নিয়ে থাকার সংগতি আছে।
তাহলে ফিলিপ নরিস ক্লাবের প্রথম সারির কেউ নয়। অর্থাৎ চ্যাটার্জীর মতো নিজের গৌরবে প্রতিষ্ঠিত নয়। সকল সভ্য বা সভ্যরা ভালো করে চেনেও না তাকে। তার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির দরুন সভার আলো উজ্জ্বল না স্তিমিত হয় না। তার মতো সদাদামাটা সভ্য—সংখ্যা শতকের ওপর। দু—দশজনের কাছে, যেটুকু খাতির সে পায় তাও চ্যাটার্জীর সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতার দরুন। এই জন্যই চ্যাটার্জীর প্রতি সদা কৃতজ্ঞ সে। কৃতজ্ঞতার আরও কারণ আছে, চ্যাটার্জীর সক্রিয় সহযোগিতায় তার কাগজে নরিসের দুই একটা আমেগমুখর প্রবন্ধও ছাপা হয়েছে। তিরিশ টাকা দক্ষিণা পেলে আনন্দাতিশয্যে ষাট টাকা খরচ করে বসেছে সে, তবু চ্যাটার্জীর ঋণ শোধ হয়েছে ভাবেনি।
গুণমুগ্ধ দুই একটি ভক্ত সকলেই পছন্দ করে। চ্যাটার্জীরও ভালো লাগে ফিলিপ নরিসকে।
ক্লাবের বার্ষিক উৎসবের রাত সেটা। গোটা প্রাসাদ আলোয় আলোয় একাকার! দু—মাস আগে থেকেই এই একটা রাতের প্রতীক্ষা করে থাকে সকলে। এই রাতের উৎসবে কত হাজার টাকা খরচ হয় সে—প্রসঙ্গ অবান্তর! সভ্য এবং অতিথি—অভ্যাগতদের গাড়ির ভিড়ে প্রাসাদসৌধের সামনের দুটো বড়োবড়ো রাস্তার অনেকটাই আটকে থাকে।
সমস্ত রাতের উৎসব—খাওয়া—দাওয়া নাচগানের ঢালা ব্যবস্থা। যে সময়ের ঘটনা, বোম্বাই শহর তখন ‘ড্রাই’ নয়, অতএব বহুরকম রঙিন পানীয়ের ব্যবহারেও ত্রুটি ছিল না কিছু। রাত বারোটার পরে ডান্স হলে যখন নাচের ডাক পড়ল, নিজের নিজের দুটো পায়ের ওপর তখন অনেকেরই খুব আস্থা নেই।
…. সেই মেয়েটির দিকে আবার চোখ পড়ল ফিলিপ নরিসের—এই নিয়ে বার কয়েক চোখ গেল তার দিকে। খুব রূপসী না হলেও সুশ্রী। বছর পঁচিশ ছাব্বিশ হবে বয়স। এই উৎসবে এই বয়সের সঙ্গীহীন মেয়ে বড়ো দেখা যায় না। ডান্স হলের দরজার ওধারে দেয়াল ঘেঁষে কেমন যেন বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একা। সকলেই যে নাচছে তা নয়, কিন্তু ওই মেয়েটির মতো একা কাউকে মনে হল না নরিসের। মুখখানা মিষ্টি কিন্তু বড়ো শুকনো—এক ধরনের বিষণ্ণ ঘুম—জড়ানো চোখ—মুখ, চাউনি। এই পরিবেশে মেয়েটির পরিচিত নয় খুব—মনে হল সেই থেকে সে যেন কাউকে খুঁজছে। অন্যমনস্কের মতো নাচ দেখছে এক একবার আবার শ্রান্ত দৃষ্টিটা এদিক ওদিক ফিরিয়ে আগন্তুকদের মুখ দেখে নিচ্ছে।
এখানে বিশেষ করে এই সময়ে কারও দিকে কারও চোখ নেই। সকলেই যে যার সঙ্গী—সঙ্গিনী বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত। এই রাতের মতো রাতে সঙ্গী বা সঙ্গিনী থাকার কথা নয় ফিলিপ নরিসেরও। সে নাচতে একটু আধটু জানে বটে কিন্তু এগিয়ে এসে কাউকে ডেকে নিতে জানে না। সে মদও সচরাচর খায় না, তবে আজ সামান্য খেয়েছে আর তাতেই বেশ একটু আমেজের মতো লাগছে। ভালো লাগছে। একটু আনন্দ করার ইচ্ছে তার মধ্যেও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে! কিছু সহজাত সংকোচে কারও দিকে এগোতেও পারছে না। আর এগোবেই বা কার দিকে, সকলেই ব্যস্থ, আনন্দমগ্ন!
মেয়েটির বিষণ্ণ ঠান্ডা দৃষ্টিটা ফিলিপ নরিসের মুখের উপরেও আটকালো দু—একবার। লোকটিও তাকে দেখছে মনে হতেই দৃষ্টিটা চট করে সরে গেলনা মুখ থেকে।
ফিলিপ নরিস উঠে মেয়েটির কাছে এল একসময়! সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কারও অতিথি এখানে?
সামনে এসে মেয়েটির চোখমুখ আরও নিষ্প্রভ। বিষণ্ণ মনে হল নরিসের। কেমন এক ধরনের আত্মবিস্মৃত জড়তার ভাব। মুখ তুলে তার দিকে তাকাল মেয়েটি। কয়েক মুহূর্ত চেয়েই রইল! তারপর আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। অস্ফুট শ্রান্ত স্বরে বলল, না…আমি কেমন করে যেন এসে পড়েছি।
সঙ্গে সঙ্গে ফিলিপ নরিস উদার হয়ে উঠল, বলল, বেশ করেছেন, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মাদাম, দয়া করে নিজেকে আপনি আমার অতিথি ভাবুন। আগে কী খাবেন বলুন? মেয়েটি নিঃশব্দে চেয়েই আছে তেমনি। অথচ নরিসের মনে হল সে যেন কিছু স্মরণ করতে চেষ্টা করছে। বলল, না কিছু খাব না। একটু থেমে আবার বলল, দেখো, আমি সেই থেকে একজনকে খুঁজছি, পাচ্ছি না…ভাবলাম এখানে থাকতেও পারে। তুমি কি বলতে পারবে….
হঠাৎ ‘তুমি’ শুনে নরিস রীতিমতো অবাক। অথচ মেয়েটি যে খেয়াল না করেই বলেছে তাতেও ভুল নেই। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, এখানকার মেম্বার? কী নাম?
নরিস বিস্মিত। কী নাম তাও চট করে মনে করতে পারছে না, স্মরণের চেষ্টা। বেশি মাত্রায় মদটদ খেয়েছে কিনা নরিসের সেই সন্দেহ হল একবার। না, তাহলে টের পেত। মনে পড়েছে। মনে পড়ার দরুনই যেন মেয়েটির শ্রান্ত মুখখানা উজ্জ্বল দেখালো একটু। অস্ফুটস্বরে বলল, ডিসুজা…মার্টিন ডিসুজা….চেনো?
নরিস মাথা নাড়ল, চেনে না।
মেয়েটির বিষণ্ণ মুখখানা বড়ো অদ্ভুত লাগছে নরিসের। রাজ্যের অন্যমনস্কতার দরুন সে যেন খুব কাছে নেই। একটা লোকের সন্ধানে এখানে এসে পড়েছে তাও কম আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। কোথায় থাকে ডিসুজা, কী করে তাও স্মরণ করতে পারল না। নরিসের কেমন মনে হল, মেয়েটি যে কারণেই হোক বড়ো অসুখী, তাই খুব প্রকৃতিস্থ নয়। কিছু মানসিক রোগ থাকাও বিচিত্র নয়। যার নাম করছে তার কাছ থেকেই হয়তো বা বড়োরকমের কোনো আঘাত পেয়েছে।
নরিস বলল, দেখো এটা আনন্দের হাট, এই আনন্দের টানেই তুমি এসে পড়েছ—বি চিয়ারফুল অ্যান্ড হ্যাপি, আমাকে তোমার বন্ধু ভেবে নাও, নাচবে একটু?
ঠোঁটের ফাঁকে হাসির আভাস ফুটল একটু। ঘুম জড়ানো ভাবটা কাটিয়ে উঠছে যেন। দেখছেই তাকে। এত কী দেখছে নরিস ভেবে পেল না। তার মুখের দিকে চেয়ে যেন বিস্মরণের ধাপগুলো উত্তীর্ণ হতে চেষ্টা করছে।
মাথা নাড়ল। নাচবে।
ডান্স হল। তারা আস্তে আস্তে নাচছে! বাহু স্পর্শ করে নরিসের মনে হয়েছে মেয়েটি বড়ো দুর্বল, হয়তো অনেকটা পথ পার হয়ে নিজের অগোচরে এখানে চলে এসেছে। সহৃদয় সুরে বলল, আগে কিছু খেয়ে নাও না, এই উৎসব সমস্ত রাত ধরে চলবে।
তার চোখের আত্মবিস্মৃত দৃষ্টি এখন আরও একটু বদলেছে। নাচের ফাঁকে নরিসের মুখখানাই দেখছে ঘুরে ফিরে, এই চোখ ঈষৎ প্রসন্ন। মেয়েটির তাকে পছন্দ হয়েছে বোঝা যায়। মাথা নেড়ে জানালো খাবার ইচ্ছে নেই। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কী?
নরিস…ফিলিপ নরিস। তোমার?
প্যাট মেনডোনসা। …তুমি খুব ভালো …ডিসুজার মতোই দরদি….তুমি কি ব্রাহ্মিণ ক্রিশ্চিয়ান?
নরিস হঠাৎ এ প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝল না। —না, কেন বলো তো?
নয় শুনে প্যাট মেনডোনসার চোখে মুখে খুশির আভাস। জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল একটু বাদে বলল, আমার কেমন শীত শীত করছে।
নরিস কী করতে পারে। আধঘণ্টার আলাপে মেয়েটির প্রতি মায়া অনুভব করছে কেন জানে না। আর কোনো মেয়ের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কখনো আসেনি বলেও হতে পারে। এ যেন এরই মধ্যে তাঁর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর একটু কাছে টেনে আনল, নাচের গতি বাড়িয়ে দিল। সঙ্গী এত সদয় বলেই যেন প্যাট মেনডোনসা কৃতজ্ঞ, সে কাছে ঘেঁসে এসেছে, মন্থর পায়ে নাচছে, আর প্রসন্ন চোখে দেখছে তাকে।
বিশ্রামের জন্য দুজনে একটা নিরিবিলি কোণে গিয়ে বসল একটু। আর তখন প্যাট মেনডোনসা অস্ফুট ক্লান্ত সুরে বলল, আমার ভয়ানক শীত করছে। আমি আর থাকতে পারছি না…
জামার ওপর তার কাঁধে হাত রেখে নরিস বিচলিত হল একটু। গাটা সত্যি বড়ো বেশি ঠান্ডা। আবারে আগের মতোই শ্রান্ত আর ক্লান্ত মনে হল তাকে। তাড়াতাড়ি উঠে নরিস নিজের দামি গরম কোটটা নিয়ে এসে তার গায়ে পরিয়ে দিল। বলল, তোমাকে খুব সুস্থ লাগছে না, আর রাত না করে তুমি একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে যাও, বাড়ি কোথায়?
বান্দ্রা ………….।
বেশি দূর নয় তা হলে। প্যাট মেনডোনসার গায়ে তার নিজের কোটের পকেট হাতড়ে এক টুকরো কাগজ আর কলম বার করল। পলকে কি ভেবে সে দুটো তার দিকেই বাড়িয়ে দিল। —তোমার বাড়ির ঠিকানা লিখে দাও, কাল সকালে গিয়ে আমি কোটটা নিয়ে আসব’খন।
এ—রকম বিদায়টা যেন খুব পছন্দ নয় মেয়েটির, মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে নাম, বাড়ির নম্বর আর ঠিকানা লিখে দিল। কাগজটা নিজের পকেটে রেখে নরিস বলল, চলো তোমাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে আসি।
দোতলার সিঁড়ির কাছে আসার আগেই সামনের লম্বা প্যাসেজের দিকে চোখে পড়তে মেনডোনসা দাঁড়াল। —ও দিকটা কী?
বাথ…
অস্ফুট স্বরে বলল, আমি যাব, দেখিয়ে দাও—
প্যাসেজ ধরে পায়ে পায়ে খানিকটা এগিয়ে নরিস দাঁড়াল। প্যাট মেনডোনসা হালফ্যাশানের মস্ত বাথরুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল, গভীর ক্লান্ত দুটো চোখ আবার নরিসের মুখে এসে আটকালো। মাথা নেড়ে ডাকল তাকে।
ঈষৎ বিস্মিত মুখে সে কাছে আসতে বলল, তুমিও এসো।
হঠাৎ হতভম্ব বিমূঢ় নরিস। বলে কী! এ কার পাল্লায় পড়ল সে। তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে উঠল, না না কিছু ভয় নেই, তুমি যাও, আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি।
রমণীর নিষ্পলক দুই চোখ তার মুখের থেকে নড়ছে না। এই মুখে আর চোখে একটা কঠিন ছায়া পড়ছে। শান্ত ঠান্ডা গলায় আবার বলল, তুমিও এসো।
প্রায় আদেশের মতো শোনালো। নরিস ঘাবড়েই গেল। কপালে ঘাম দেখা দিল। এ কি সাংঘাতিক মেয়ে। ভয় নেই, সংকোচ নেই—নাকি এও মানসিক রোগ কিছু। বিস্ময়ে সংবরণ করে এবারে জোর করেই মাথা ঝাঁকাল মরিস, বলল, আঃ! কেউ এসে পড়লে কী ভাববে। বলছি তুমি যাও, আমি এখানে দাড়াচ্ছি—
প্যাট মেনডোনসা চেয়েই আছে। চেয়েই আছে। তারপর আস্তে আস্তে বাথরুমের দরজা খুলল সে। ভিতরে ঢুকল। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল নরিসের। … ভালোয় ভালোয় এখন ট্যাক্সিতে উঠলে হয়।
জানালায় ঠেস দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে। অদ্ভুত মেয়েটার কথাই ভাবছে।
হঠাৎ সচকিত। একটা আস্ত সিগারেট শেষ হয়ে গেল, আর একটা কখন ধরিয়েছে এবং আধাআধি শেষ করেছে খেয়াল নেই—অথচ প্যাট মেনডোনসা এখনও বেরোয়নি। বাথরুমের দরজা বন্ধ।
দ্বিতীয় সিগারেট শেষ হল। নরিস পায়চারি করছে। কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই।
তারপর আরও আধঘণ্টা কেটে গেল। নরিস বিলক্ষণ ঘাবড়েছে। দরজা ঠেলেছে, দরজায় মৃদু আঘাত করেছে, ডেকেছে—কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপর একটা করে মিনিট গেছে আর নরিসের ভয় বেড়েছে। গোড়া থেকেই কেমন লাগছিল মেয়েটাকে—ভিতরে অজ্ঞান—টজ্ঞান হয়ে গেল, না কি কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসল!
ঘড়ি দেখল! সাড়ে তিনটে বেজে গেছে রাত্রি। তার মানে এক ঘণ্টার ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে প্যাসেজে! বিমূঢ় নরিস কী করবে দিশা পেল না। জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিল কয়েকবার। মজবুত দরজা একটু কাঁপল শুধু।
নরিস দৌড়লো হঠাৎ। আধভাঙা আসর থেকে চ্যাটার্জীকে খুঁজে বার করল। চ্যাটার্জী প্রকৃতিস্থই আছে বটে, কিন্তু নিজের হাত পায়ের ওপর দখল খুব নেই। তাকে একরকম টানতে টানতেই নিয়ে এল নরিস। চ্যাটার্জী পিছু পিছু আর দুই একজন উৎসুক বন্ধুও এল। খুব সংক্ষেপে ব্যাপারটা শুনে তারাও অবাক। খানিকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাক্কি করল তারাও।
শেষে কেয়ারটেকারের তলব পড়ল। বেগতিক দেখে কেয়ারটেকার পুলিশে ফোন করল। পুলিশ এসে ভাঙল যখন তখন প্রায় সকাল।
ভিতরে কেউ নেই।
এক সঙ্গে বহু জোড়া বিস্মিত দৃষ্টির ঘায়ে নরিস বিভ্রান্ত, বিমূঢ়। বাহ্যচেতনা লোপ পাবার উপক্রম তার।
সুরার ঝোঁকে দুই একজন ঠাট্টা করল, নরিসের প্রেয়সী বাথরুমের জানালা দিয়ে নিশ্চয় পাখি হয়ে উড়ে পালিয়ে গেছে। নইলে ভিতর থেকে উধাও হবার আর কোনো পথ নেই।
কেয়ারটেকার বা পুলিশের লোকেরও ধারণা হল, নরিস বেসামাল হয়েছিল হয়তো, ভিতরে যে ঢুকেছিল সে কখন বেরিয়ে চলে গেছে খেয়াল করেনি—আর বাইরে থেকে দরজার হ্যান্ডেল টানাহেঁচড়ার ফলে হোক বা অন্যকোনো অস্বাভাবিক কারণে হোক ভিতরের ল্যাচ আটকে গেছে। বাইরে থেকে টানাহেঁচড়া করে বা কোনোরকম অস্বাভাবিক কারণে এই দরজার ল্যাচ আটকে যেতে পারে কিন—এই দিনের এই সময়ে তা নিয়ে গবেষণা করার মতো ধৈর্য কারও নেই।
চ্যাটার্জী হতভম্ব নরিসকে একদিকে টেনে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করল, রাত্তিরে কতটা খেয়েছিলে?
নরিস সত্যি কথাই বলল, কিন্তু চ্যাটার্জীর সংশয় গেল না।
বলল অভ্যেস নেই—ওইটুকুতেই গন্ডগোল হয়েছে।
তাকে বিশ্বাস করানোর ঝোঁকে পকেট থেকে চিরকুট বার করল নরিস, ওই দ্যাখো, আমার কোট গায়ে দিয়ে গেছে, নিজের হাতে নাম বাড়ির ঠিকানা লিখে দিয়েছে—
চ্যাটার্জী দেখল। রাতের ধকলে তার মাথাও খুব পরিষ্কার নয়। তবু একমাত্র সংগত মন্তব্যই করল সে। বলল, তাহলে তুমি যখন জানালার দিকে ফিরে সিগারেট খাচ্ছিলে তখনই বেরিয়ে চলে গেছে সে, তুমি টের পাওনি। নিশ্চয় তোমার মতলব ভালো মনে হয়নি তার তাই—
নরিস তখন আদ্যেপান্ত ব্যাপারটাই বলল তাকে। মতলব যে কার ভালো ছিল না তাও গোপন করল না। শুনে চ্যাটার্জী হা করে চেয়ে রইল তার দিকে—বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পেল না।
এদিকে চ্যাটার্জীর ওই শেষের যুক্তিই সম্ভবপর মনে হয়েছে নরিসের। সে যখন জানালার দিকে ফিরে সিগারেট টানতে টানতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, মেয়েটা তার অলক্ষ্যে তখনই চলে গিয়ে থাকবে। এ ছাড়া কী আর হাতে পারে! তার অনভ্যস্ত জঠরে ওই সামান্য সুরাই হয়তো কিছুটা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল তাকে। আর, মেয়েটা যে রুষ্ট হয়েছিল সে তো বোঝাই গেছে—তাই কোনোরকম বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়েই চলে গেছে।
ঘণ্টা তিনেক নরিসের ঘরেই ঘুমালো চ্যাটার্জী, তারপর নরিস ঠেলে তুলল তাকে। তাকে নিয়ে সে প্যাট মেনডোনসার বাড়ি যাবে কোট আনতে।
ঘুম তাড়িয়ে নরিসের সঙ্গ নিল চ্যাটার্জী। যে মেয়ে ওভাবে নিজেকে এগিয়ে দিতে চেয়েছিল, তাকে একবার দেখার কৌতূহলও ছিল। চিরকুটের নম্বর মিলিয়ে বান্দ্রার বাড়ির ঠিকানায় এসে দাঁড়াল তারা। কড়া নাড়তে এক বৃদ্ধা দরজা খুলে দিলেন।
নরিস প্যাট মেনডোনসার খোঁজ করতে বৃদ্ধটি খানিক চেয়ে রইলেন মুখের দিকে। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কে?
নরিস জানালো তারা কে এবং কেন এসেছে। গতরাতের ফাংশনে শীত করছিল বলে প্যাট মেনডোনসা তার কোট গায়ে দিয়ে বাড়ি ফিরেছে, সেই কোটটা ফেরত নিতে এসেছে তারা। নাম—ঠিকানা লেখা চিরকুটটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল নরিস।
বৃদ্ধা দেখলেন। গম্ভীর। বললেন আচ্ছা, আপনারা বসুন একটু—
ভিতরে চলে গেলেন তিনি। একটু বাদে বাঁধানো একটা ফোটো হাতে ফিরলেন। সেটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, দেখুন তো এর মধ্যে কেউ কাল আপনার কোট নিয়ে এসেছিল কি না।
বৃদ্ধের ব্যবহারে এরা দুজনেই মনে মনে বিস্মিত। সামনে আট দশটি নারী পুরুষের বড়ো গ্রুপ ফোটো একটা। সেটার দিকে একনজর তাকিয়ে আঙুল দিয়ে প্যাট মেনডোনসাকে দেখিয়ে দিল নরিস। বলল, ইনি—
দু—চোখ টান করে বৃদ্ধা নরিসের দিকে চেয়ে রইলেন খানিক। নরিস জিজ্ঞাসা করল, ইনি কি এ বাড়িতে থাকেন না?
থাকত। এখন থাকে না। আমার এই মেয়ে দু—বছর আগে মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।
নরিস আর তার সঙ্গে চ্যাটার্জীও কি সত্যি শুনছে, নাকি এখনও রাতের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে! সত্যিই কোথায় তারা?
চেতনারহিতের মতো আরও একটু খবর শুনল। বৃদ্ধ জানালেন, বাড়ির সব থেকে সেরা মেয়ে ছিল এই প্যাট মেনডোনসা—মার্টিন ডিসুজা নামে এক ছেলেকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল। সকলে ধরেও নিয়েছিল বিয়ে হবে। কিন্তু ডিসুজার বাপ মা—র বড়ো গর্ব তারা ব্রাহ্মিণ ক্রিশ্চিয়ান—বিয়ে হতে দিল না। বিয়ে হবে না শুনে মেয়েটার মাথাই বিগড়ে গিয়েছিল, নিজে গাড়ি চালিয়ে ফিরছিল ডিসুজার বাড়ি থেকে—দাদারে সাংঘাতিক অ্যাকসিডেন্ট হল—তক্ষুনি শেষ। অ্যাকসিডেন্টের খবরটা কাগজে বেরিয়েছিল।
অনেকক্ষণ রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাটাল নরিস। চ্যাটার্জী ঠেলে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারল না! মুখে কথা নেই। কেমন যেন হয়ে গেছে। খানিক বাদে ফুল কিনল এক গোছা, চ্যাটার্জীকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল :
সমাধি ক্ষেত্র। নিঃশব্দে খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছে দুজনে। বেশি খুঁজতে হল না। হঠাৎ একদিক চোখ পড়তে নিস্পন্দ কাঠ দুজনেই। ওই ছোটো সমাধি একটা। সমাধির ওপর ক্রস। ক্রস—এ ঝুলছে নরিসের সেই কোট। সমাধির গায়ে নামের হরফ—প্যাট মেনডোনসা।
নির্বাক স্তব্ধ দুজনেই। অভিভূতের মত কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সমাধির সামনে হুঁশ নেই।
নরিস ফুল দিল। ক্রস—এর উপর থেকে কোটটা হাতে তুলে নিল। বলল, চলো—
ফিলিপ নরিসের হাতে কোটটা দেখে কি এক অজ্ঞাত অস্বস্তি বোধ করছিল চ্যাটার্জী। কিন্তু বলা হয়নি, ওটা থাক।