তৃতীয় পুস্তক [১৭২৮-১৭৩১] রুশো ১৭২৮-১৭৩২ = ১৬ বছরের যুবক

তৃতীয় পুস্তক [১৭২৮-১৭৩১] রুশো ১৭২৮-১৭৩২ = ১৬ বছরের যুবক

মাদাম দ্য ভারসিলিস ভবনে একদিন যেভাবে এসেছিলাম তাকে সেভাবেই রেখে আমি আমার প্রাক্তন মনিহানীর কাছে ফিরে গিয়ে পাঁচ কিংবা ছয় সপ্তাহ ছিলাম। এই সময়টার কথা আমার এখনও তীব্রভাবে মনে পড়ে। আমার তেমন কোনও কাজ ছিল না। আমার স্বাস্থ্য বেশ ভালই ছিল। হাসি খুশিতে ভরা ছিলাম আমি। আমার এই স্বাস্থ্য, যৌবন আর কর্মশূন্যতা আমার চরিত্রকে আবার অস্থির করে তুলল।

মন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কোনও দিকে আমার খেয়াল থাকত না। এক স্বরাচ্ছন্নতা আমাকে পেয়ে বসল। কী একটা অজানা সুখের খোঁজে আমি অসহায় বোধ করতে লাগলাম। আমি কী চাই তা আমি জানতাম না। কান্নায় আমার মন ভরে উঠত। আমার মনের অবস্থা কাউকে খুলে বলা যায় না। আমি কী চাই, তা আমি জানতাম না তবু মনে হতো আমার চারপাশের সমবয়সীরা যেন আমার চাইতে পাকা ছিল। ওরা জানত ব্যাপারটা কী। মনে হতো ওরা যেন আমার না পাওয়া জিনিসের আনন্দ পুরো ভোতা করেছে। আমার মনের এমন অনুভূতিতে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তপ্ত হয়ে উঠত। আমার কামনার তীব্রতা বৃদ্ধি পেত। অথচ আমি বুঝতে পারতাম না, আমার এমন তপ্ত কামনা দিয়ে কী করব। এই কামনার তৃপ্তি আমার কেমন করে ঘটবে। কামনার কল্পনাতেই যেন আমি একটা তৃপ্তি বোধ করতাম। আমার তপ্ত দেহের কল্পনাতে আমার মনে কেবল মেয়েদের এবং যুবতীদের ছবি ভেসে উঠত। কিন্তু যৌন সম্পর্ক কাকে বলে তা তখনও আমার উপলব্ধিতে আসেনি। মেয়েদের নিয়ে কী করতে হয় তারও কোনও অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। একদিকে উদগ্র কামনা, অপরদিকে তার কোনও ব্যবহারের অজ্ঞতা আমার মনে একটা অদ্ভুত অবস্থা তৈরি করত। অথচ আমার দেহের মধ্যে একটা অসম্ভব অস্বস্তিকর ভাবের সৃষ্টি হতো। এর ভাল দিক একটা অবশ্য ছিল যে, আমার কামনার কোনও বাহ্যিক বা দৈহিক প্রকাশ তখনও ঘটেনি। আমার শরীর নিয়ে আমার যা কিছু কর্ম তা আমার কল্পনাতেই মাত্র সীমাবদ্ধ ছিল। এমন মানসিক যাতনা থেকে আবার মুক্তির কোনও উপায় আমার জানা ছিল না। আমার কেবল ইচ্ছা হতো, কিছুটা সময় যদি আমি মাদামসেল গোটনের মতো একটি মহিলাকে নিজের কাছে একান্ত করে পেতে পারতাম। কিন্তু তখন আমার শৈশবের সেই সময়টা ছিল না যখন এমন কামনার একটা স্বাভাবিক প্রকাশ ঘটে। একদিকে আমার মধ্যে একটা বিবেকের দংশন, অপরদিকে এমন চিন্তায় আমার নিজের মধ্যেই একটা লজ্জাবোধ আমার অবস্থাকে অসহনীয় করে তুলছিল। এর ফলে আমার স্বভাবসুলভ সঙ্কোচ এত বৃদ্ধি পেতে লাগল যে আমি যেন আর তাকে আমার শক্তির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে সক্ষম হচ্ছিলাম না। অথচ সেই সময়েও যেমন, তেমনি অপর সময়েও আমি কারোর নিকট কোনও কুপ্রস্তাব প্রকাশ করতে পারিনি। কেবল হয়তো এমন হয়েছে, কোনও একটি মেয়ের অদ্ভুত কোনও ভঙ্গি বা ব্যবহার আমাকেও কিছুটা উত্তেজিত করে তুলত। অবশ্য এও আমি বুঝতাম মেয়েটা ওর ভঙ্গি দিয়ে কী করতে চায়, তা মেয়েটাও জানত না। ফলে আমার প্রকাশের মধ্যেও মেয়েটা কোনও কিছুর আভাস পেত না। আমরা দুজনেই একেবারে নিষ্কর্মই থাকতাম। অবশ্য আমি জানতাম, মেয়েটার যে সঙ্কোচবোধ ছিল তা নয়। আমি যা চাইতাম, ওর কাছ থেকে আমি তা পেতাম। কিন্তু আমি নির্দিষ্ট করে কিছুই চাইতে পারিনি।

অথচ আমার অস্থিরতা এমন নিদারুণ হয়ে উঠল যে আমার কামনার অতৃপ্তি আমাকে নানা প্রকার অস্বাভাবিক আচরণে অদম্য করে তুলল। আমি অস্থির হয়ে নানা অলিগলি দিয়ে ঘুরতে লাগলাম। এসব গলিতে কোনও মেয়েকে দেখলে এমন কিছু করতে ইচ্ছা হতো, যার বিনিময়ে মেয়েটাও হয়তো কিছু করত। অথচ ওরা আমার আচরণে কোনও অশ্লীলতার প্রকাশ দেখত না। আমি উত্তেজিত হলেও অশ্লীল আচরণের কথা আমি চিন্তা করতে পারতাম না। এমন অবস্থায় আমার আচরণের কথা বর্ণনার অতীত। এ কথা ঠিক, আর এক পা এগুলেই আমার ইঙ্গিত কামনা আমি লাভ করতে পারতাম। আর এটাও নিশ্চিত, যে-মেয়েগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো তারা আমার যে কোনও আচরণকেই গ্রহণ করত। অথচ এ জন্য আমার যে সাহস প্রয়োজন ছিল, সে সাহস আমার ছিল না। আমার এই মূর্খতার পরিণামে এমন হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যা হাস্যকর হলেও তেমন অগ্রাহ্য ছিল না।

একদিন আমি একটা খালি উঠোনের পাশে একটা কূয়োর ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই ইঁদারাটা থেকে মেয়েগুলো জল তুলে নিত। এই জায়গাটির মুখে নিচে নামার কয়েকটা ধাপও ছিল। নামতে গিয়ে আমি বুঝতে চাইলাম নিচের এই ধাপ কোথায় নেমেছে। কিন্তু অন্ধকার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে আমি বুঝলাম, এ পথ দিয়ে বের হবার কোনও উপায় নেই। কেবল এটা বুঝলাম, এই গলিতে আমাকে কেউ যদি দেখে ফেলে তবে আমারও লুকিয়ে পড়তে কোনও অসুবিধা হবে না। এতে আমার যেন একটু সাহস বাড়ল। আর তখন যে মেয়েগুলো জলের জন্য আসছিল তাদের সামনে আমি এমন অঙ্গভঙ্গি করলাম যা ওই অবস্থায়ও আমার কাছে একেবারেই হাস্যকর বলে বোধ হচ্ছিল। আমার এমন আচরণে ওদের মধ্যে যারা একটু ভদ্র ছিল তারা আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল না। আর যারা একটু উদ্ধত ছিল তারা আমার আচরণে হেসেই আকুল হলো। কেউ কেউ আমার আচরণে অপমানিত বোধ করে চিৎকার করে উঠল। আমি ভয়ে পালাবার চেষ্টা করলাম। কেউ যেন আমার পেছনে আসতে লাগল। হঠাৎ একটা পুরুষের গলাও আমি শুনতে পেলাম। অথচ কোনও পুরুষকে তার আগে এই গলিতে দেখিনি। আমি তাই ভয় পেয়ে গেলাম। আমি অসহায় বোধ করে সেই অন্ধকারে যেন ঝাঁপ দিলাম। অন্ধকারটাকেই আমি সহায় মনে করছিলাম। কিন্তু তার মধ্যে একটা আলোর রেখা দেখে আমি দস্তুর মতো ভীত হয়ে উঠলাম। কিন্তু আর একটু এগুতে আমি একটা দেয়ালে ধাক্কা খেলাম। ফলে আমি আর এগুতে না পেরে আমার ভাগ্যের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। মুহূর্তের মধ্যে আমি দেখলাম একটা ইয়া মোছওয়ালা লোক আমাকে জাপটে ধরল। লোকটার মাথায় একটা হ্যাট ছিল। হাতে একটা তলোয়ারও ছিল। লোকটাকে চার-পাঁচটা বৃদ্ধ মেয়েলোক পথ দেখিয়ে নিচ্ছিল। এদের প্রত্যেকের হাতে হাতলওয়ালা একটা ঝাড়ু ছিল। এগুলোর মধ্যে আমি সেইটাকে দেখতে পেলাম যে আমাকে ধরে ফেলেছিল। এবার ও আমার মুখোমুখি দাঁড়াল।

যার হাতে একটা তলোয়ার ছিল সে এবার আমার হাতটাতে ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে উঠল; তুই এখানে কী করছিস? আমার কোনও জবাব ছিল না। আমি লোকটাকে কী বলব। তখন হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি এল, আমি একটা কাহিনী ফাঁদলাম। কাতরভাবে লোকটাকে বললাম, আমার বয়স কম, বাচ্চা মানুষ। আমাকে দয়া করুন। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। আপনি আমাকে বাঁচান। বাড়িতে গেলে বাড়ির লোক আমাকে পাগল বলে বেঁধে রাখবে। কিন্তু আমি পাগল নই। আমি বুঝতে পারছিনে আমি কী করব। আপনি আমাকে একটু দয়া করুন। আমি আশা করিনি যে, লোকটা আমাকে দয়া করবে। তবু আমি দেখলাম, লোকটা একটু নরম হলো। বললাম, আমি ভাল ঘরের ছেলে। আমি বললাম আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না। আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমি আপনার দয়ার কথা জীবনে ভুলবো না। আমার কাছে যথার্থই অপ্রত্যাশিত ছিল। এবং আমাকে একটা বকুনি দিয়ে লোকটা আর কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করে ছেড়ে দিল। যে মেয়েটা আমাকে প্রথম দেখেছিল, আর যে বুড়ো মেয়েলোকগুলো এই লোকটাকে পথ দেখিয়ে এগুচ্ছিল ওরা এমনভাবে মুক্তি পাওয়াতে বিস্মিত হয়ে গেল। ওরা ভাবেনি আমি এত সহজে ছাড়া পাব। আর তখন আমি বুঝলাম এই বিরাট বপুর লোকটি সেদিন আমার কী উপকারটাই না করেছিল। মেয়েগুলি আমার বিরুদ্ধে নানা কথা বলতে লাগল। কিন্তু লোকটি তার হাত বা হাতের তলোয়ার দিয়ে কোনও বাধা দিল না। ফলে আমার সাহস বৃদ্ধি পেল, আমি এই দঙ্গলের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হলাম।

এর কয়েকদিন পরের কথা বলছি। আমি একটা রাস্তায় একজন যুবক পাদ্রীর সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ সেই মোছওয়ালা লোকটারও দেখা পেলাম। লোকটা আমাকে চিনল। কিন্তু সে কেবল ঠাট্টার সুরে বলল : কী বাহাদুর! হ্যাঁ, বাহাদুর বটে, আর তুই বেটা ভীতুও বটে। তবে এমন বাহাদুরি করতে এমন জায়গাতে তুই আর আসিসনে। সেদিন বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিস। সে আর কিছু বলল না। আমি আর মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম না। আমি নিজের মনে তাকে তার দয়ার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে সটকে পড়লাম। আমি বুঝলাম সেদিনকার মেয়েগুলো আমাকে অত সহজেই ছেড়ে দেয়ার জন্য এই লোকটিকে বোকা ছাড়া আর কিছু ভাবেনি। যাই হোক, এই লোকটি দেখতে যতই খারাপ হোক, লোকটি আমার জন্য সেদিন যথার্থই ভাল ছিল। আর তাই জীবনে যতবার লোকটির কথা আমার মনে হয়েছে ততবারই আমি তার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি। কারণ সেদিনের সে ঘটনাটা এত হাস্যকর ছিল আর যে কেউ হলে সে হাসিঠাট্টা মশকরা করে আমাকে হেনস্তার একশেষ করে ছাড়ত। তবে আমার সেদিনকার কাণ্ড থেকে আমার একটা বড় শিক্ষা হয়েছিল। যে ভয়ানক বিপদে আমি পড়েছিলাম, তা থেকে আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। তাই পরে বহুদিন যাবৎ অমন মূর্খামি আর আমি করিনি। মাদাম দ্যা ভারসেলিস-এর সঙ্গে পরিচয় এবং তার আশ্রয়ে থাকার ভাগ্যে আমি ওই স্থানের আরও কিছু লোকের পরিচয় লাভ করেছিলাম। তাদের সেই পরিচয় দিয়ে আমি এই সময়ে জীবনে একটু স্থিতি লাভের চেষ্টা করেছি। তারা আমার সাহায্যে আসতে পারে, এমন কথা আমি ভেবেছি। এই সময়ে আমি মাভোর্দে মশিয়ে গেইম নামের এক শিক্ষকের পরিচয় লাভ করেছিলাম। ইনি কোতে দ্যা ম্যালারিদের শিশুদের শিক্ষা দানে নিযুক্ত ছিলেন। এই লোকটির বয়স ছিল তখন বেশ কম। যুবকের মতো। তার চরিত্রে একটা বুদ্ধিমত্তা, সম্মানবোধ এবং সততার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। আমার তখন যে সাহায্যের প্রয়োজন ছিল এবং যে চিন্তা থেকে আমি তার কাছে গিয়েছিলাম, সে ব্যাপারে সে যে আমাকে সাহায্য করতে পেরেছিল, তা নয়। কিন্তু আমি তার কাছে সেদিন যা লাভ করেছিলাম, তার মূল্য ছিল অনেক বেশি। আর সেই সাহায্যের কথা আমি আমার জীবনে বিস্মৃত হতে পারিনি। জীবনে নৈতিকতাবোধ কাকে বলে তার একটা শিক্ষা পেয়েছিলাম তার কাছ থেকে। জীবনে যুক্তি কাকে বলব, যথার্থ যুক্তি বোধ কী তার শিক্ষাও আমি লাভ করেছিলাম। আমি ছিলাম জীবনবোধের ক্ষেত্রে একটা পেণ্ডুলামের মতো : এই উঁচু তো এই নিচু; এই বীরপুরুষ, তো তারপরেই কাপুরুষের অধম। মশিয়ে গেইম যেন আমাকে আমার সঠিক জায়গাটিতে বসিয়ে দিলেন। আমার আসল চরিত্রটিকে তিনি ধরিয়ে দিলেন। আমাকে হতাশায় যেমন ডুবিয়ে দিলেন না, তেমনি বিরাট করেও তুললেন না। আমার চরিত্রে উত্তম যা কিছু ছিল তিনি তাকে স্বীকার করেন। আমার চোখে তা ধরিয়ে দিলেন। কিন্তু এও বললেন : তোমার এ গুণ তোমার সামনে বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে। তিনি বললেন : তোমার যা আছে তাই দিয়েই যে তুমি জীবনে বড় হবে এমন নও। একে বাদ দিয়েও তুমি বড় হতে পারবে। তিনি মানুষের জীবনের একটা সত্যিকার চিত্র যেন আমার সামনে তুলে ধরলেন। এভাবে আমার জীবনকে আর কখনও আমি দেখিনি। তিনি বললেন, একটা প্রতিকূল অবস্থায়ও তুমি সুখ লাভ করতে পার, কিন্তু তার জন্য তোমার প্রয়োজন হচ্ছে দূরদৃষ্টির : তুমি কী যথার্থভাবে চাও তা তোমাকে উপলব্ধি করতে হবে। বাইরের আড়ম্বরের প্রতি আমার যে মোহ ছিল, কোতে দ্যা মেলারদি আমার সেই মোহের ওপর যথার্থই আঘাত হানলেন। তিনি বললেন : যারা অপরকে শাসন করে সুখ লাভ করার কথা ভাবে, তারা নিজেরাও অপরের দ্বারা কম শাসিত নয়। শাসক শাসিতের চাইতে আদৌ সুখী নয়। তারা নিজেকে জ্ঞানী ভাবলেও শাসিতের চাইতে জ্ঞানী নয়। তার একটা কথা আমি জীবনে ভুলিনিঃ এক মানুষ যদি অপর মানুষের মনকে দেখতে পারত তাহলে তার আকাশচুম্বী আশঙ্কারও শেষ হতো। এই অনুভূতি আমার জীবনকে এক অমোঘ সত্য দ্বারা সমৃদ্ধ করে তুলেছে। এই বোধ আমার মনে যে কোনও প্রতিকূল অবস্থায় অতৃপ্তি আর অস্থিরতার বদলে আমার মনে যথার্থ তৃপ্তির সৃষ্টি করেছে। ইনিই আমাকে জীবনে সম্মান আর মর্যাদাবোধ বলতে কী বুঝায় তা বুঝিয়েছেন। আমি যেখানে পূর্বে যে কোনও আড়ম্বরের কামনায় স্ফীত হয়ে উঠতাম সেখানে এখন আমি যেকোনও অবস্থায় আত্মতৃপ্তির বোধে যেন সম্বুদ্ধ হয়ে উঠতে সক্ষম হলাম। মশিয়ে গেইম আমাকে এই অনুধাবনে উপকৃত করলেন যে সমাজে তুমি যথার্থ সততার সাহস খুব কমই পাবে। তুমি যত উঁচুতে উঠতে চাইবে, তোমার তত নিচে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তিনি বলতেন কোনও কাজই ছোট নয়। যাকে তুমি ছোট মনে করছ, তাকে সুসম্পন্ন করতে তোমাকে তোমার বড় কাজের চাইতে কম পরিশ্রম করতে হবে না। তিনি বলতেন, অপরের অন্তঃসারশূন্য প্রশংসা বা স্তুতির চাইতে তোমার সঙ্গী আর সাথীদের কাছ থেকে তুমি যে সহানুভূতি লাভ করবে তার মূল্য অনেক বেশি।

.

মানুষের কর্তব্যকে যদি তুমি বুঝতে চাও তবে তোমাকে তার নীতিবোধের শেকড়ে যেতে হবে। তাছাড়া তখন আমার যে অবস্থা হয়েছিল, যে চিন্তার ফলেই তখনকার সংকটে আমার পতন ঘটেছিল তার বিশ্লেষণে আমাদের উভয়কে ধর্মের আলোচনায় না গিয়ে উপায় রইল না। আমি এখন বুঝতে পারছি, সেদিনকার ‘স্যাভোয়ের ধর্মযাজকের বোধের মূল ছিল এই মশিয়ে গেইম। তিনি যে সবকথাই খুলে বলতেন, তা নয়। তার প্রজ্ঞাই তাকে বুঝিয়ে দিত আমার মতো বালকের কাছে তার কী বলা উচিত এবং কী বলা উচিত নয়। আমার বাড়িতে প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গেও যেমন, তেমনি অপর সব প্রসঙ্গেই তিনি তার প্রজ্ঞা এবং পরিমিতি বোধকেই প্রকাশ করতেন। বিষয়টার বিশারদের মধ্যে আর না গিয়ে আমি বরং আজ এই বলব যে, তার প্রজ্ঞাকে আমি প্রথমে অনুধাবন করতে না পারলেও তার জ্ঞান ক্রমান্বয়ে আমাকে এমন আলোকিত করে তুলছিল যে, ন্যায় বলি কিংবা ধর্ম; তার শিক্ষাদাতার মধ্যে যদি যথার্থ সদিচ্ছা এবং সহানুভূতির অভাব থাকে তবে তার দ্বারা তুমি কখন অনুপ্রাণিত বোধ করতে পারবে না।

.

[এখানে জীবিকাহীন রুশোর জীবনের একটা ঘটনার কথা বলা আবশ্যক। কোতে দ্যা রোকো নামের এক ভদ্রলোক কোঁতে দ্য কুভনের বাড়িতে রুশোর জীবিকার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এই গৃহেই কাউন্টের একটি পৌত্রী; মাদামসেল দ্য ব্রিলের সুনজরে পড়েছিল রুশো।]

.

যুবতী মাদাম সেল দ্য ব্রিল প্রায় আমার বয়সেরই ছিল। সুগঠিত ছিল তার দেহ। দেখতে ভারী সুন্দর ছিল। সতেজ রঙের এক যুবতী। তাকে বলা যায়, দীর্ঘকেশের একটি শ্যামাঙ্গী যুবতী। তার চরিত্রে একটি ভদ্রতার প্রকাশ ছিল। এমন প্রকাশ নিজেদের সৌন্দর্য সচেতন নারীর মধ্যে খুব কমই থাকে। তার এই আকর্ষণকে আমি কখনও রোধ করতে পারিনি। তার বয়োসোচিত পরিধানের বস্ত্র যেন তার সৌন্দর্যকে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তুলত। সে বস্ত্রের স্বল্পতা তার বক্ষদেশ বা স্কন্ধকে তেমন আবৃত করে রাখতে পারত না। অবশ্য এ কথা সত্য যে আমার মতো একটা গৃহ-ভত্যের এসব দিকে দৃষ্টি দেয়ার কোনও অধিকার ছিল না। হ্যাঁ, আমার উচিত ছিল না। কিন্তু আমি নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারিনি। কিন্তু কেবল আমি নই। ওর দিকে আরও অনেকেই তো এমনভাবে তাকাত। এই গৃহের অন্য কর্মচারীরা ওর সম্পর্কে এমন সব স্থূল মন্তব্য করত, যা শুনে আমি ব্যথিত বোধ করতাম। তাই বলে আমি এত অভিভূত হয়ে পড়িনি যে আমি ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার অবস্থানকে আমি ভুলে যাইনি। তাই আমি নিজের অবস্থাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করিনি। এবং আমার কামনাকে যদৃচ্ছা অবারিতও করিনি। হ্যাঁ, মাদামসেল দ্য ব্রিলকে আমার দেখতে ইচ্ছা হতো। ওর কথার মধ্যে বুদ্ধির প্রকাশ থাকত। আর ওর এমন কথা আমার শুনতে ভাল লাগত। ওর কথার মধ্যে একটা বিনম্র সংকোচ ছিল। আমার কামনা ছিল, আমি যেন ওর একটু সেবা করতে পারি। কিন্তু আমি সতর্ক ছিলাম, আমি যেন আমার অধিকারকে অতিক্রম না করি। খাওয়ার টেবিলে মেয়েটির যে কোনও অসুবিধার দিকে আমি দৃষ্টি রাখতাম। ওর বসার চেয়ারটা কেউ সরিয়ে দিলে আমি আগ্রহের সঙ্গে সেটি আবার ঠিক করে দিতাম। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতাম যেন ও কী চাইতে পারে, তা আমি বুঝতে পারি। আমি নজর রাখতাম ওর খাবার প্লেটটি কখন সরিয়ে দিতে হবে। ও যদি কেবলমাত্র একটু ইঙ্গিত দিত তাহলে ওর জন্য করার অসাধ্য আমার কিছুই থাকত না। আমার মন চাইত, ও আমার দিকে একটু চোখ তুলে তাকাক, একটা কোনও কথা বলুক, আমাকে একটা কিছু করতে বলুক। কিন্তু না, তেমন কোনও ভাগ্য আমার হয়নি। ওর কাছে আমি যেন অস্তিত্বহীন একটা পদার্থ মাত্র ছিলাম। তবে একটা দিনের কথা আমার মনে পড়ছে। ওর একটি ভাই ছিল। এ ভাই আমার সঙ্গে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কথা বলত। ওরই এই ভাইটা একদিন আমাকে আক্রমণ করে একটা কথা বলল, আমি ওর কথার জবাব দিলাম। এবং সে জবাবের মধ্যে যেমন একটা ভদ্রতা, তেমনি একটা বুদ্ধির প্রকাশ ছিল। দেখলাম মেয়েটির চোখেও তা ধরা পড়েছে। আর মেয়েটি তখন চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। অবশ্য মেয়েটির দৃষ্টি মুহূর্তের দৃষ্টি। তবু মেয়েটির দৃষ্টি, মুহূর্তের দৃষ্টি আমাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিল। পরের দিনও ওর একটু চকিত দৃষ্টি লাভ আমার ভাগ্যে ঘটেছিল। এদিন এই ভাগ্যকে ব্যবহারে আমি ব্যর্থ হইনি। এদিনই খাওয়ার ঘরে একটা বড় ভোজের আয়োজন ছিল। আর এদিনই আমি দেখলাম বাবুর্চিদের একজন তার চাপরাস ঝুলিয়ে মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়াল। আলাপ আলোচনায় কী একটা ফরাসি বাক্যের উচ্চারণ ঘটেছিল। কিন্তু তার উচ্চারণটা ঠিক হয়নি। এই সময়ে একজন পুরাতন ভৃত্য উচ্চারণটা সংশোধন করতে এগুল। এই সময়ে আমার দিকে তাকিয়ে সে একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল। আমার দিকে তার চোখ পড়তে দেখল যে আমার ঠোঁটে যেন একটু হাসি ফুটে উঠেছে। তাতে সে যেন একটু রাগত হল। বলল : তবে তুই বল। আমি বললাম, যে অক্ষরটির উচ্চারণ নিয়ে কথা হচ্ছে, সে উচ্চারণটি ভুল নয়। অবশ্য শব্দটা একটি পুরনো শব্দ। সে দিক থেকে শব্দটি তেমন ভুল নয়। বুৎপত্তিগতভাবে বলা যায় : মেরে ফেলার ভয় দেখানো আর মেরে ফেলা এক নয়। অনেকেই হয়তো ভয় দেখায়। আবার হয়তো কেউ আঘাতও করে তবু যাকে সে আঘাত করেছে, তাকে সে মেরে ফেলেছে এমন বোঝাবে না। আমার এমন কথায় উপস্থিত সকলে আমার দিকে ফিরে তাকাল। তারপরে যেন নিজেদেরকে দেখল। কিন্তু একটি শব্দও উচ্চারণ করল না। আমার জীবনে আমার প্রতি এমন বিস্মিত দৃষ্টির সাক্ষাৎ যথার্থই আমি আগে কোনওদিন পাইনি। কিন্তু আমাকে যা সেই মুহূর্তে আনন্দিত করেছিল সে মাদামসেল দ্য বেইল-এর মুখের প্রসন্ন সেই প্রকাশটি যাতে আমার মনে হয়েছিল, মাদামসেল আমার জবাবটিতে খুশি হয়েছিলেন। অবজ্ঞার ভঙ্গি নিয়ে যে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, সে এবার আমার দিকে আবার ফিরে তাকাল। এ প্রায় তার প্রথম দৃষ্টির মতোই ছিল। তারপর সে তার দাদুর দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে বলছে, এবার জবাব দাও। ওর যা প্রাপ্য তাই ওকে দাও। এখন কেন এত সঙ্কোচ। মেয়েটির এমন ভঙ্গিতে তার দাদু এবার হাসিমুখে আমার প্রতি যথার্থই স্নেহময় হয়ে উঠলেন। তিনি এত উদারভাবে, প্রাণভরে আমাকে প্রশংসা করলেন যে উপস্থিত সকলে এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। এই ঘটনাটির আয়ু যে খুব বেশি ছিল, এমন নয়। তবু মুহূর্তটি আমার জন্য অতুলনীয়ভাবে আনন্দময় হয়ে উঠল। এমন মুহূর্ত খুব কম আসে। মুহূর্তটি যেমন স্বাভাবিক ছিল তেমনি সে যেন আমার ওপর ভাগ্যের বর্ষিত সকল যন্ত্রণার একটা উপশম ঘটিয়ে দিল। এর কয়েক মিনিট পরে মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে যেন বলল : দে, আমাকে কিছু খেতে দে। পান করার একটু জল দে। একথা তো আমার বলার অপেক্ষা রাখে না যে মাদামসেলের হুকুমটি পালন করতে আমি বিন্দুমাত্র বিলম্ব করিনি। কিন্তু মাদামসেলের এমন বদান্যতায় আমি এত অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম এবং তার গ্লাসটিতে আমি এতখানি জল ঢেলে দিয়েছিলাম যে সে জল গ্লাস উপচে যেমন তার প্লেটে পড়েছিল, তেমনি তার পা দু’খানিতেও পড়েছিল। ওর ভাই কাছেই ছিল। সে আমাকে বলল, তুই এত কাঁপছিস কেন? ওর ভাইয়ের এমন প্রশ্ন যে আমাকে তেমন আশ্বস্ত করতে পেরেছিল, তা নয়। কিন্তু দেখলাম মাদামসেল দ্য ব্রিল নিজেও যেন লজ্জায় একটু রক্তিম হলো। তার চোখের তারায় তার যেন আভা প্রকাশ পেল।

আমার এ রোমান্সেরও এখানে শেষ। এ থেকে বোঝা যাবে মাদাম বাসিলের বেলায়ও যেমন, এখানেও আমার রোমান্সের কোনও ফলদায়ক পরিণাম ঘটেনি। মাদাম দ্য ব্রিলের ঘরের দিকে এরপর বৃথাই আমি উঁকি দিয়েছি। তার ঘরের মেয়ের কাছ থেকেও আমি কোনও প্রশংসার ইঙ্গিত পাইনি। সে ঘরের মধ্যে যাতায়াত করত। কিন্তু আমি তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পেতাম না। আমার বোকামির শেষ ছিল না। একদিন একটা ঘটনা ঘটল। মাদাম ব্রিলের হাত থেকে তার দস্তানাটা পড়ে গিয়েছিল। আমি এমন বোকা আর ভীতু ছিলাম যে, আমার যেখানে উচিত ছিল মাদামের দস্তানাটি তুলে চুম্বন করা, সেখানে আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমি ঠায়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। দস্তানাটি পরে একটা চাকরানি তুলে দিয়েছিল। আমার তখন এই বাদিটারই গলা টিপে ধরতে ইচ্ছা করছিল। আমার ভয়ার্ত ভারে আর শেষ রইল না। আমি দেখলাম আমি যেন বুঝতেই পারছিলাম না, আমি কী করলে মাদাম ব্রিল আমার ওপর একটু খুশি হবেন। মাদাম এখন আর আমাকে কোনও কাজের হুকুমও দিলেন না। তাছাড়া আমি কিছু করতে চাইলেও তিনি খুশি হন না। দু’বার এমন হল যে আমাকে তার পাশের ঘরে দেখতে পেয়ে তিনি বেশ একটু ঠাণ্ডা গলায় বললেন : কিরে তোর কোনও কাজ নেই? ফলে আমি তার পাশের ঘরে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। এতে আমার প্রথমে একটু দুঃখ হলো। কিন্তু ঘরের অন্যান্য কাজে এই ঘটনার কথা আমি ভুলে গেলাম।

মেয়েটির সৎ পিতা সেখানে ছিলেন। তিনি আমাকে দেখতে পেয়ে আমার প্রতি মাদাম ব্রিলের আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। যে ভোজপর্বের কথা আমি বলেছি তারপরের দিন ইনি আমার সঙ্গে প্রায় আধ ঘণ্টা সুন্দরভাবে আলাপ করলেন। তিনি অবশ্য বয়স্ক এবং প্রায় বৃদ্ধ ছিলেন এবং মাদাম দ্য ভারসেলিসের মতো তেমন বিশেষ কোনও গুণ ছিল না, তবু তার মনটা বেশ ভাল ছিল। ফলে তার সঙ্গে আমার কথা বলতে বা তার কাছে থাকতে আমার কোনও কষ্টবোধ হয়নি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটি বেশ ভাল হয়ে উঠল। তিনি বললেন, তুই বয়স্ক আমার ছেলেটাকে দেখাশুনা কর। তার ছেলে ছিল আবে দা গুভন। আমার প্রতি তার একটু সহানুভূতিও ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছিল। আমি ভাবলাম তার ছেলেটির একটু সেবা যত্ন করলে আমার উপকারই হবে এবং আমার চরিত্রে যা নাই, একটু স্বাভাবিক হওয়ার ক্ষেত্রে তার কাছ থেকে আমি তা লাভ করতে পারব। পরের দিন সকালেই আমি সেই আবের কাছে গেলাম। দেখলাম সে আমাকে ভত্যের মতো ভাবল না। সে আমাকে ধরে তার পাশে আগুনের চুলার কাছে বসাল। সে আমাকে নানা ব্যাপারে প্রশ্ন করল এবং দেখল যে, আমি নানা বিষয়ে জানার ভাব করলেও কোনও বিষয়েই আমার জ্ঞান গভীর নয়। সে যখন দেখল যে আমি ল্যাটিন তেমন জানিইনে, তখন সে আমাকে ল্যাটিন শেখাতে শুরু করল। সে বলল, আমি যেন রোজ সকালে তার কাছে যাই। আমি তাই শুরু করলাম। আমি তারপর দিন থেকেই তার কাছে যেতে লাগলাম। এই ভাবে সেদিনের কথা স্মরণ করে আমি বলতে পারি যে ঘটনাক্রমে আমি যেমন আমার অবস্থানের নিচে ছিলাম, তেমনি তার উপরেও উঠে গেলাম। এই গৃহে এবার আমি কেবল ভৃত্য নয়, আমি দস্তুর মতো এই গৃহে একটি ছাত্র হয়েও দাঁড়ালাম। আমি ভত্য রইলাম বটে, তবু আমি একজন শিক্ষক লাভ করলাম যিনি আমার নয়, রাজকুমারদেরই শিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত ছিলেন।

সকালের অনেকটা সময়ই আমি তার সঙ্গে কাটাতাম। তিনি আমাকে দিয়ে চাকরের কোনও কাজ করাতেন না। তিনি শ্রুতিলিপি দিতেন। আমি তা শুনে লিখতাম। সেই লেখা নকল করে দিতাম। এ প্রায় তার সেক্রেটারি বা সচিবের মতো কাজ করা। এতে আমারই উপকার হতে লাগল। ল্যাটিন শেখার চাইতেও বেশি। এভাবে আমি আসল ইটালিয়ান ভাষাই রপ্ত করতে লাগলাম কেবল তাই নয়, আমি যেন একটা সাহিত্যপ্রীতি এবং সাহিত্যজ্ঞানও লাভ করতে লাগলাম। এইভাবে যে সুযোগ আমি আমার পূর্বের অবস্থান লা ট্ৰিব্যুসে পাইনি, সে সুযোগ এখানে লাভ করতে পারলাম। বেশ কিছু উত্তম বইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটতে লাগল। পরবর্তী সময়ে আমি নিজে যখন সাহিত্যের কাজ করতে শুরু করি, তখন এই বাসার এই সুযোগটা আমার খুবই উপকারে এসেছিল।

আমার জীবনের এই পর্যায়টি আমার জীবনে বিশেষ উপকারের পর্যায়ই ছিল। এই পর্যায়ে কোনও রোমাঞ্চের পেছনে না ছুটে এমন কাজের সুযোগ পেলাম যে কাজে আমি আবার দক্ষতার কিছু পরিচয় দেখাতে সক্ষম হলাম। ‘আছে’ বা মঠাধ্যক্ষ আমার ব্যাপারে খুবই খুশি হয়ে উঠলেন। তিনি সবাইকে এবং তার পিতাকেও আমার কথা প্রশংসার সঙ্গে বলতে লাগলেন। তার বাবা আমার প্রতি এমন স্নেহপরায়ণ হয়ে উঠলেন যে একদিন বললেন তিনি কঁতে দা ফ্যাব্রিসকে আমার কথা বলেছেন এবং কঁতে দা ফ্যাব্রিস রাজার কাছে আমার কথা বলেছেন। দেখলাম, মাদাম দ্য ব্রিল যে আমার ওপরে একটু বিরক্তি বোধ করেছিলেন, তার সে ভাবটিও বেশ দূর হয়ে গেছে। মোটকথা এই বাড়িতে আমার সম্মান বেশ বেড়ে গেল। এবং আমার এমন অবস্থায় বাড়ির অপর চাকরদের মনে আমার প্রতি ঈর্ষার সঞ্চার হলো। তারা যখন দেখল বাড়ির কর্তার ছেলেই আমার ব্যাপারে সব নির্দেশ সবাইকে দিচ্ছে, তখন তাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এখন থেকে আর আমি ওদের মতো একটা সামান্য চাকর নই।

আমি পরে ভেবে দেখেছি যে এ সময়ে আমার সম্পর্কে যা একটু আলোচনা আমার কানে এসেছিল তাতে আমি বুঝতে পারছিলাম আমার ওপর কোনও এক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। রাষ্ট্রদূত জাতীয় কোনও দায়িত্ব- যা একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির ওপরই মাত্র অর্পণ করা যায়। সেঁতে দ্যা গুভনের এই পরিকল্পনাটি দস্তুরমতো তার মহত্ত্বেরই পরিচায়ক ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে এমন পরিকল্পনার পরিণাম বা এর পরিধি কোনওটাকেই বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না। আর আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার মুখতা এটা বুঝতে একেবারেই অক্ষম ছিল যে এই ঘটনাটার মধ্যে যে কোনও মেয়ে জড়িত, সেটা আমার ভাগ্যের জন্য যেমন নিরাপদ, তেমন সম্মানজনক। সব কিছুই ভালমতো এগুচ্ছিল। আমি যেন হঠাৎ সকলেরই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে গেলাম। আমার শিক্ষানবিসির সময়ও শেষ হয়ে গেল। সবাই মনে করতে লাগল এই ছেলেটার ভাগ্য খুলে যাচ্ছে। অথচ যে দায়িত্ব আমাকে দেয়া হচ্ছিল তাতে পৌঁছার রাস্তা আমার জন্য এটা নয়। আমি তাতে পৌঁছেছিলাম বটে, কিন্তু এই পথ দিয়ে নয়। সে পথটা ছিল ভিন্নতর। এবার আমি আমার চরিত্রের সেই বৈশিষ্ট্যের কথা বলব যেটি ছিল সব কিছুরই মূলে। এ বিষয়ে বেশি রহস্য না করে আমার পাঠকদের কাছে আমি এবার ব্যাপারটা খুলেই বলি।

.

[রুশোর জীবনের এই পর্যায়ের একটা ঘটনার কথা বলা প্রয়োজন। রুশো এই সময়ে একটা মাস্তান, বদমায়েশের খপ্পরে পড়ে। লোকটার নাম ছিল বাকল। রুশো কারোর নিষেধ না শুনে লোকটার সঙ্গে ভবঘুরের মতো সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্স ভ্রমণে বেরোয়। কিন্তু এই যাত্রাতে রুশো যখন এ্যামনেসিতে মাদাম দা ওয়ারেনস্ এর বাড়িতে পৌঁছে তখনি সে মাস্তান বাকল-এর কজা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।]

.

মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর গৃহের যখন আমি নিকটবর্তী হলাম তখন আমার বুকে রীতিমতো কম্পন ধরে গেল। আমার পা দুটো কাঁপছিল। আমার চোখের সামনে সব যেন অন্ধকার বোধ হলো। আমি যেন না কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম, না কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম। পুরনো কাউকে যেন আমি চিনতে পারছিলাম না। আমার নিজেকে স্থির করতে বারবারই আমি থেমে পড়ছিলাম।

নিজেকে স্থির করতে দস্তুরমতো আমার অনেকটাই সময় লাগছিল। কিন্তু আমার এমন অবস্থা কেন হলো? আমি কি চাচ্ছিলাম, কেউ আমার কাছে আসুক, কেউ আমাকে একটু সাহায্য করুক? আমি কি তখন ভয়ানক ক্ষুধার্ত ছিলাম? ক্ষুধার্ত অবস্থায় কারোর কি এমন দশা ঘটে? না আমার বয়সী কারোর কি ক্ষুধার্ত অবস্থায় এমন ঘটে? না আমার বয়সী কারোর ক্ষুধার জন্যই এমন অবস্থা হয়, এটা আমি বলতে পারিনে। না, আমার জীবনে এরকম ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। কোনও অভাব অনটনের কারণে আমি আত্মহারা হয়ে যাব এমন আমি ভাবতে পারিনে। আমার জীবনে নানা উত্থান পতন ঘটেছে। আমার জীবন কখনও মসৃণ ছিল না। আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন আমি আগেও ছিলাম। তবু দারিদ্র্য কিংবা সম্পদ কোনও ক্ষেত্রেই আমার অন্তর্দৃষ্টির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। প্রয়োজনে আমি ভিক্ষা করেছি, দরকার হলে অপর যে কারোর মতো আমি চুরিও করেছি; কিন্তু তার জন্যে মনে কোনও মনস্তাপের সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘশ্বাস আমি জীবনে কম ফেলিনি, চোখের জল আমার কারোর চাইতে কম পড়েনি। কিন্তু দারিদ্র্যে আমি নিপতিত কিংবা দারিদ্র্যের আশঙ্কা আমার মনে দীর্ঘশ্বাসের সৃষ্টি করেনি, চোখেও অশ্রুর কারণ ঘটায়নি। ভাগ্যের সঙ্গে মোকাবেলা, আমার এই প্রথম নয়। ভাগ্যের ওপর আমার দোষারোপ নয়। তাই কোনও কিছুর অভাব আমার মনে শূন্যতার সৃষ্টি করেনি। বরং আমি বলব যখন জীবনে আমার কোনও কিছুর অভাব ঘটেনি, আমার মনে, তখনি যেন একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আমার তখনি মনে হয়েছে, কেন আমি সবচাইতে একটা দুঃখী মানুষ।

মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর ঘরে ঢুকতেই তার দর্শন পেয়েই আমার বুকে বল ফিরে এল। তার দৃষ্টিতে আমি স্থির হতে পারলাম। তিনি যখন কথা বললেন, তখন তার কণ্ঠের স্বর আমাকে উদ্বেলিত করে তুলল। আমি তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লাম। আমি নিঃসঙ্কোচে তার হাত চুম্বন করলাম। আমার সম্পর্কে তিনি কিছু আগে শুনেছিলেন কিনা, তা জানিনে। কিন্তু তার উচ্চারিত কোনও শব্দে আমার প্রতি তার কোনও অসন্তোষ বা স্নেহশূন্যতার ভাব ছিল না। কিরে তুই আবার ফিরে এসেছিস! তার কণ্ঠে আমাকে আদর করার ভাব ছিল। আমি জানতাম এমন কষ্টের যাত্রায় তুই দুঃখ পাবি। যাই হোক, সাংঘাতিক কিছু খারাপ যে ঘটেনি, তাতে আমি খুশি হয়েছি। এখন বল : তোর কী হয়েছিল?

আমি তখন তাকে আমার কাহিনী বললাম। খুব লম্বা কাহিনী নয়। সব যে বলেছি তা নয়। তবে তেমন কিছু আমি লুকাইনি। আবার কিছু বাড়িয়েও বলিনি।

এখন প্রশ্ন হলো, আমি ঘুমাব কোথায়? আমার শোবার ব্যবস্থা কি হবে? মাদাম তার দাসীর সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলেন। আমি সে আলাপ শুনলাম বটে। কিন্তু কোনও কথা বলার আমি সাহস পেলাম না। তারপরে যখন শুনলাম এই ঘরেই আমি যোব, তখন যেন আমার কানকেই আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি দেখলাম আমার যা একটু কাপড়-চোপড়ের ব্যাগ ছিল তা মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর কোচের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার আনন্দের সীমা রইল না যে এ ব্যবস্থা কোনও সাময়িক ব্যবস্থা নয়। এটাই আমার জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা। আমি যখন নিজের মনে অন্য কথা ভাবছিলাম, আমি তখন শুনতে পেলাম মাদাম দা ওয়ারেনস বলছেন : ‘যে যা বলে বলুক। ঈশ্বর যখন ওকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে, আমি তখন ওকে পরিত্যাগ করব না।’

এভাবে মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর গৃহেই আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। অবশ্য আমার খুশির দিনের শুরু এখান থেকেই নয়। তবু এই শুরুটি যে আমার সুখের দিনকে প্রশস্ত করেছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে একজনের হৃদয়ের এমন স্পর্শ লাভ করায় আমার যে কোনও কৃতিত্ব ছিল, এমন নয়। এ যথার্থই ভাগ্যের ব্যাপার। একে আমি শুধু ঘটনাক্রমের ফল বলতে পারি। ঘটনা যদি এমনভাবে না ঘটত তাহলে আমার মতো চেতনা-সম্পন্ন কিশোরের পক্ষে তার নিজের অস্তিত্বকেই আবিষ্কার করা সম্ভব হতো না। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় পর্যন্ত এই ছিল আমার মনের অবস্থা। মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর সঙ্গে পুনরায় যদি এই সাক্ষাৎ না ঘটত কিংবা তার নিকট থেকে যে স্নেহপূর্ণ ঘনিষ্ঠতার অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছিলাম তা যদি আমি না পেতাম, তাহলে আমার নিজের অস্তিত্বকেই আমি জানতাম না। আমি তাই আজও বলছি, কেবল তথাকথিত ভালবাসা লাভ করে না বলে, সে তা জানে না। আমার আর একটা অনুভূতির কথা মনে হচ্ছে। এ অনুভূতি আমার যতটা না দেহজ ছিল তার চাইতে অনেক বেশি মনোগত এবং আনন্দজনক ছিল। হা এর সঙ্গে যে ভালবাসার যোগ না আছে, তা নয়। তবু এ ভালবাসা থেকে পৃথক কিছু। আবার এটাকে আমি কেবল বন্ধুত্ব বলেও আখ্যায়িত করতে পারিনে। হ্যাঁ, এর একটা-ইন্দ্রিয়গত দিকও ছিল। আমি জানি এমন অনুভূতি কেবল দু’টি মানব এবং মানবীর মধ্যে ঘটতে পারে। দু’টি পুরুষ বা দুটি মেয়ের মধ্যে ঘটতে পারে না। হ্যাঁ, আমি তার বন্ধু ছিলাম। একজন কিশোর কি আর একজন হৃদয়পূর্ণ মহিলার বন্ধু হতে পারে না? এবং যে বন্ধুত্বের অনুভূতি আমি মাদাম দ্যা ওয়ারেনস এর নৈকট্যে লাভ করেছি, তেমন অনুভূতি আমার কোনও পুরুষ বন্ধুর ঘনিষ্ঠতায় লাভ করতে পারতাম না। ব্যাপারটা অবশ্যই একটু রহস্যজনক। এর যা একটু স্পষ্টতা তা কেবল আমার কাহিনীর পরবর্তী বিবরণীতেই প্রকাশ পেতে পারে। যে অনুভূতিকে আমরা কেবল এমন অনুভূতির প্রকাশ বা ফল দ্বারাই উপলব্ধি করতে পারি। অন্য কোনও উপায়ে নয়।

মাদাম দ্য ওয়ারেনস একটি পুরনো বাড়িতে বাস করতেন। তার নিজের ঘরটি বেশ বড় ছিল। ঘরটির সঙ্গে একটি ড্রয়িং রুমও ছিল। মাদাম তার এই ড্রয়িং রুমটিতেই আমার থাকার ব্যবস্থা করলেন। এই ড্রয়িং রুমের পাশেই একটি যাতায়াতের পথ ছিল। একটি উপরে। ওখানে দাঁড়িয়ে আমি চারদিকের বাতাস, আর সবুজের দৃশ্য উপভোগ করতে পারতাম। এখানেই মাদামের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। আমার মতো কিশোরের পক্ষে এমন দৃশ্য দেখার ভাগ্য একটা দুর্লভ ভাগ্য ছিল। আমার বসিতে বাসের পরে এমন ভাগ্য আর ঘটেনি। এর আগে আমার সেই জীবনে চারপাশের উঁচু দেয়ালগুলো দেখা ছাড়া আর কিছুই আমার চোখে পড়ত না। এবার যে সৌভাগ্য আমার ঘটল তাতে আমার আনন্দ আর আবেগের কোনও শেষ ছিল না। চারদিকের প্রকৃতির এমন দৃশ্য দেখতে পারাটা আমার মাতৃসুলভ মাদামেরই অপার দয়া বলে আমি বোধ করলাম। আমার মনে হল তিনি আমার জন্যই এই সমস্ত ব্যবস্থার আয়োজন করেছেন। তারই পাশের ঘরে বাসের এই সুযোগকে আমার অন্তরের সমস্ত আনন্দ দিয়ে আমি গ্রহণ করলাম। চারদিকের সব কিছুরই মধ্যে আমি মাদামের অস্তিত্বকে অনুভব করতাম। বসন্তের বাতাস আর তার নিজের সৌন্দর্যের মধ্যে কোনও ভেদ ছিল না। দুটোই আমার চোখে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমার হৃদয়ের প্রকাশ এতদিন যেখানে সংকুচিত হয়েছিল এখন সে এমন বন্ধনহীন মুক্তিতে প্রসারিত হয়ে প্রকাশের সুযোগ যেন লাভ করল। ফল ফলারীর বাগানের মধ্যে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস অবারিত হলো। আমার এই জীবনের প্রথম দিনটিতেই আমাদের দুজনের মধ্যে যে আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা ঘটেছিল মাদামের সমগ্র জীবনেই তার প্রকাশ অব্যাহত ছিল। তিনি আমাকে সস্নেহে সম্বোধন করতেন বাচ্চা বলে। আমি তাকে শ্রদ্ধাভরে মামো’ বা ‘মা’ বলে ডাকতাম। পরবর্তী সময়ে আমাদের ঘনিষ্ঠতা যতই বৃদ্ধি পায় আমাদের পারস্পরিক এই সম্বোধনের কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমি নিজে মনে করি এই দু’টি সম্বোধনের মধ্যেই আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের সারল্য, সততা এবং অন্তরঙ্গতা প্রকাশিত হতো। আমার দিক থেকে আমি বলব, এমন মা আমি জীবনে লাভ করিনিঃ এমন মমতা আর স্নেহময় জননী। আমার মনে হতো তিনি আমার কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই কামনা করতেন না। আমাদের এ সম্পর্কে ইন্দ্ৰিয়জ কিছুর যদি কোনও প্রকাশ ঘটত তাতেও তার চরিত্রে কোনও ব্যতিক্রম ঘটত না। তার এমন আচরণে আমি আরও আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়তাম। আমার কাছে তিনি এক অত্যাশ্চর্য আদরের মা মণি হয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠতেন। আমি আদর শব্দটি ব্যবহার করেছি। হ্যাঁ, আমার মা মণি আমাকে চুম্বন করেছেন। এমন চুম্বন তো মা ই তার সন্তানকে করতে পারে। আর কে পারে? আর যেমন তিনি, তেমনি আমি এই স্নেহ আর আদরের অপর কোনও অর্থের কথা চিন্তা করতে পারিনি। পাঠক হয়তো বলবেন, তবু পরিশেষে ব্যাপারটা তো ওখানে থাকেনি। আমি তা স্বীকার করি। তবু বলব পাঠককে : একটু ধৈর্য ধরুন। একটু অপেক্ষা করুন। এক চোটেই কি আমার জীবনের এই পর্যায়ের কথা আপনাকে বলতে পারি? আমাকে বলতে দিন।

আমাদের দু’জনার প্রথম মিলন যেদিন ঘটেছিল সেটিই ছিল আমাদের সর্বোত্তম আবেগের মিলন : মাদাম আমার জীবনের সেই আবেগটিকে কোনওদিন বিস্মৃত হতে দেননি। অথচ মিলনের সেই মুহূর্তটি আমাদের দুজনার জন্যই ছিল অপ্রত্যাশিত। আমার নিজের দৃষ্টি কখনও তার অন্তর্বাসকে ভেদ করতে পারেনি। আমার তেমন কোনও ইচ্ছা জাগেনি। তেমন হলে আমার দৃষ্টিতেই তা প্রকাশ পেত। মাদাম সামনে এলে আমার মনে কোনও কামনার ইচ্ছা জাগত না। আমি তার সামনে যেন একটা অদ্ভুত আনন্দ এবং প্রশান্তিতে ডুবে যেতাম। এমন আনন্দ এবং প্রশান্তির কোনও বিশ্লেষণ চলে না। আমি নিজেও জানতাম না, কী বোধে আমি উদ্বুদ্ধ হচ্ছি। যদি জীবনের কথা বলি তবে আমি বলব, এমন প্রশান্তিতে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি বোধ না করে আমার সমগ্র জীবনটা আমি কাটাতে পারতাম। জীবনে এমন মানুষকে আমি আর লাভ করিনি। আমাদের দুজনার মধ্যে কখনও কথার কোন অভাব ঘটেনি। কথার অভাবে আমরা দুজনের কেউ কখনও বিন্দুমাত্র তিবোধ করিনি। আমাদের দুজনার আলাপ যত না কোন বিশেষ বিষয়ে নিবদ্ধ থাকত তার অধিক কেবল আমাদের মধ্যে কাহিনীর খৈ ফুটত। কারোর কোনও আগমন না ঘটলে আমাদের দুজনের আলাপ কখনও শেষ হতো না। আর একটু কথা বলি, এমন করে আমাকে আহ্বানের তার কোনও প্রয়োজন পড়ত না। কথার জন্য আহ্বান নয়, কথা বন্ধ কখন হবে তারই কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। তার নিজের পরিকল্পনার কথা ভাবতে ভাবতে তিনি অনেক সময়ে একটা যেন গভীর চিন্তায় ডুবে যেতেন। তথাপি আমি শব্দহীন হয়ে যেতাম। আমার কথা বন্ধ করে একা আমি তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখতাম। আর সেই মুহূর্তটি আমার নিজেকে মনে হতো এই জগতের যেন সর্বশ্রেষ্ঠ একজন সুখী মানুষ। আমার হৃদয়ের কথার আকাঙ্ক্ষাকে আমি প্রকাশ করতাম না। তবু হঠাৎ যদি কোনও ঘটনায় আমার অন্তরের কামনায় বাধা ঘটত তখন যেন আমি উন্মাদ প্রায় হয়ে যেতাম। কেউ যদি হঠাৎ মাদামের ঘরে আসত, সে পুরুষ কিংবা মহিলা যে হোক না কেন, অপর কারোর উপস্থিতি সহ্য করতে না পেরে আমি মাদামের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম। পাশের ঘরে বসে আমি কেবল মিনিট বা মুহূর্তকে গণনা করতাম, আর ভাবতাম এই অবাঞ্ছিত দুর্বত্তদের অস্তিত্বের শেষ কখন ঘটবে। আমি অস্থির হতাম। মাদামের সঙ্গে ওদের এমন কী কথা থাকতে পারে। এমন অসহ্য আলাপ?

মাদামের প্রতি আকর্ষণের চরম বোধ আমার মধ্যে তখনি জাগত যখন তিনি আমার দৃষ্টির মধ্যে থাকতেন না। তারপরে তাকে দেখা মাত্রই আমার মনে একটা তৃপ্তিবোধের সৃষ্টি হতো। কিন্তু তাকে দেখতে না পেলে আমার অস্থিরতা দুরারোধ্য হয়ে দাঁড়াত। তার সঙ্গলাভের স্পৃহা আমার মধ্যে এমন আবেগের সৃষ্টি করত যে আমার চোখে জল জমে উঠত। আমার জীবনের সেই ঘটনার কথা আমি কখনও বিস্মৃত হতে পারব না। সেদিনটা ছিল কোনও একটা বড় পর্বের দিন। উৎসবের দিন। মাদামকে যেতে হয়েছিল সান্ধ্যপ্রার্থনার মজলিসে। আমি তার সঙ্গহীনতাকে সইতে না পেরে ঘরের বাইরে রাস্তায় হাঁটতে বেরুলাম। আমার অন্তর তখনও তার অবয়বটিতে পূর্ণ ছিল। আমি চাচ্ছিলাম যেন আমি আমার সারাটা জীবন তার বুকের কাছটিতে থেকে কাটাতে পারি। অবশ্য আমি বুঝতাম আমার এমন কল্পনা একটা পাগলের কল্পনা বৈ আর কিছু নয়, এবং যে শান্তি আর সুখের আমি কামনা করছি তার ক্ষণকালের ছাড়া দীর্ঘকালের হতেই পারে না। এমন চিন্তায় আমার মন বিমর্ষতায় ভরে উঠত। অবশ্য তাই বলে আমার মনে কোনও হতাশার অভাব আসত না। এবং যতই অসাধ্য হোক না কেন আমার মন নানা ইচ্ছা পূরণে পূর্ণ হয়ে উঠত। আমার এমন একাকিত্বের মধ্যে দূরের কোনও ঘণ্টাধ্বনি, কাছের পাখ পাখালীর গুঞ্জন, দিনের আলো, চারদিকের বন বনানীর দৃশ্য, চারদিকের ঘরবাড়ি। এসব কিছুই এমন সময়ে আমার মনে এমন একটা অবর্ণনীয় ভাবের সৃষ্টি করত যে আমার মনে হতো আমি যেনএকটা স্বর্গীয় সুখের সন্ধান পেয়েছি : এর মধ্যে ইন্দ্রিয়জ কোনও কিছুরই আমি কল্পনা করতে পারতাম না। এই ঘটনার দিনের এই ভাবটিকে আমি জীবনে বিস্মৃত হতে পারিনি। আমার বোধকে যেটা সেদিন আচ্ছন্ন করেছিল। তার একটা অত্যদ্ভুত ব্যাপার এমনি ছিল যে, এই দিনটির কথা স্মৃতিতে এলে আমি যথার্থই যেন সেই স্বর্গ-কল্পনায় স্বর্গীয় বোধে ফিরে যেতাম। আর তাতে আমি এক অনাবিল আনন্দ বোধ করতাম। এমন যদি আমি কল্পনা করতে পারি যে একটি লোকের মনের স্বপ্ন যথার্থই বাস্তবে রূপায়িত হতে সে দেখতে পেল, তখন তার যা অবস্থা হবে আমার জীবনেও যেন সেদিন সেই অবস্থাটির উদ্ভব ঘটেছিল। একথা ঠিক যে আমার স্বপ্ন এবং কল্পনা অবশ্যই অবাস্তব ছিল। আমি কল্পনা করেছিলাম যেন আমি আমার সমগ্র জীবনই এমনি কল্পিত স্বর্গরাজ্যে বাস করতে পারব। অথচ বাস্তবে তার অস্তিত্ব ঘটেছিল মাত্র মুহূর্তের জন্য। আর এখানেই আমাকে হতভাগ্য বলে বোধ হয়। আমার কল্পিত সেই শেষহীন স্বর্গীয় জীবন মাত্র মুহূর্তের জন্যই স্থায়ী হয়েছিল : তার অধিক নয়। সেটি ছিল আমার স্বর্গীয় কল্পনা। এবং সেটি ভাঙতে অধিক সময় লাগেনি। এটা সত্য। এবং এটাই বাস্তব।

যে সব প্রীতিভরা দুষ্টুমি আমি মামার সঙ্গে সে সময়ে করেছি, তার কোনও স্মৃতি আমাকে কোনওদিন কষ্ট দেবে, এমন কথা বুঝলে আমি সে কাজ করতাম না। মামা যে শয্যায় একবার শয়ন করেছেন, সে শয্যাকে আমি প্রীতিভরে কতবার যে চুম্বন করেছি। কেবল শয্যা নয় যে কিছুকে তিনি স্পর্শ করেছেন : সে ঘরের যে কোনও আসবাব, এমন কি যে মেঝেতে তিনি পদচারণা করেছেন সবই ছিল আমার অপার আকর্ষণের বিষয়। আপনারা একে আধিক্য বলেন, আমি স্বীকার করব আমার ভালবাসার প্রকাশে আধিক্য ছিল। একদিন খাওয়ার টেবিলে মামা যখন একটু কি যেন মুখে পুরেছেন, অমনি আমি চীৎকার করে উঠলাম : মাম্মি আমি যে একটা চুল দেখতে পেলাম, তোমার খাবারের মধ্যে। আমার চীৎকার শুনে মামা তার মুখের খাবার বের করে টেবিলের প্লেটের ওপর রাখলেন? আর আমি খপ করে তার মুখের খাবারটা আমার মুখে পুরে খেয়ে ফেললাম! কেবলএকটা কথায় আমি বলতে আমাদের দুজনার প্রেম-প্রীতির মধ্যে একটি মাত্র ব্যাপার ঘটেছিল যা আমি স্মরণ না করে পারছিনে। এ ব্যাপারটাই আমার চিন্তার একেবারে বাইরে ছিল।

ইতালি থেকে আমি ফিরে এলাম বটে, কিন্তু যে আমি ইতালিতে গিয়েছিলাম সে আমি নই। কেবল যে আমার নৈতিক কৌমার্য নিয়েই ফিরে এলাম তাই নয়। আমার দৈহিক কৌমার্য সেদিনও অটুট ছিল। হ্যাঁ, আমার বয়স বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা আমি বুঝতে পারছিলাম। আমার অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তারপর এর দৈহিক এমন একটা প্রকাশ ঘটল যাতে আমি একেবারে আতঙ্কিত বোধ করলাম। আমার এমন ভীতির বোধই সাক্ষ্য দিল যে আমার কৌমার্য সেদিনও কত অটুট ছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে আমি বুঝলাম এতে ভীত হওয়ার কিছু নেই। এ প্রাকৃতিক প্রয়োজন এবং তার প্রশান্তির একটা প্রকাশ। এটাতে কিছু নেই। বরঞ্চ প্রকৃতির এমন চাহিদা অস্বীকার করলে আমার রুমের তরুণদের জীবনেরও বিপদ ঘটতে পারে। এটাকে যদি পাপ বলি পাপ। তবে এমন পাপের মধ্যেই নিহিত থাকত একটা প্রশান্তির ভাব। এমন ঘটনার স্মৃতিও আমাকে নানা কল্পনায় উত্তেজিত করে তুলত। নিষ্কৃতির এমন সুযোগ পেয়ে আমি এর ব্যবহারে কখনও নিবৃত্ত হইনি। ফলে আমার স্বাস্থ্যের হানি ঘটতে লাগল। অবশ্য ক্রমান্বয়ে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টাও করছিলাম। এর কারণ ছিল আমার স্নেহময়ী মামার কোনও ক্ষতির কথাই আমি চিন্তা করতে পারতাম না। তার সঙ্গে আমার এই বন্ধনের ঘোর অত সহজে কাটেনি। আমি সর্বক্ষণ তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। তিনি যে শয্যায় শায়িত হয়েছেন, তিনি ঘরে না থাকলে আমি তাতে শয়ন করেছি। উত্তেজনার এমন সুলভ উপায়ের কথা আর চিন্তা করা যায় না। যে পাঠকরা আমাকে এ পর্যন্ত পাঠ করেছেন তাদের মনের ভাবের প্রকাশ ঘটেছে এমন ভাষায় যে ব্যাটা মরেছে! কিন্তু ব্যাপারটা তা ছিল না। যা আমাকে নষ্ট করতে পারত, মামার সঙ্গে আমার সম্পর্ককে, আসলে তাইই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল! মামার সঙ্গে আমি আছি, এর চাইতে আনন্দের আর কী আছে? তিনি আমার সম্মুখে উপস্থিত থাকুন আর না থাকুন, আমি তাকে আমার জন্য এক অপার স্নেহ এবং মমতার পাত্রী বলে দেখতাম। এমন চিন্তায় তিনি আমার জননীবৎ ছিলেন, আমার ভগ্নীবৎ ছিলেন, তিনি আমার এক আনন্দবন্ধ বন্ধুবৎ ছিলেন। এর অধিক আর কিছু আমি চিন্তা করতে পারতাম না। এইভাবেই আমি তাকে দেখতাম। সবসময়েই একই রূপে, একই স্নেহের মমতার পাত্রী হিসেবে আমি দেখতাম। আমার অন্তরের মধ্যে তার জায়গাতে অপর কারোর স্থান ছিল না। তিনি তখন ছিলেন আমার জীবনের একমাত্র নারী। এবং যে মমতা দিয়ে তিনি আমাকে সর্বদা আবৃত করে রাখতেন সেখানে অপর কোনও চিন্তার, অন্য কোনও ইন্দ্রিয়গত অনুভূতির জায়গা ছিল না। ফলে আমি আমার অনুভূতির ক্ষেত্রে কোনও বিচ্যুতির শিকার হইনি। যেন তার মাতৃস্নেহের বর্ম সবদিক দিয়ে আমাকে রক্ষা করেছে। এককথায় আমি দেহমনে পুত-পবিত্র ছিলাম। এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ আমার প্রতি আমার মাম্মার পূত-পবিত্র ভালবাসা। আমার এমন অনুভূতির কোনও প্রকাশ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তেমন প্রকাশে অক্ষম। পাঠকদের কেউ যদি আমার অন্তরটিকে বুঝতে পারেন, তাহলে তার পক্ষেই সম্ভব হবে সহানুভূতির দৃষ্টিতে সেদিনের আমাকে অনুভব করা। আমার নিজের জন্য এতটুকু আমি বলতে পারি এ পর্যন্ত বিবৃত আমার কাহিনী যদি আপনাদের নিষ্পাপ বলে বোধ হয় তাহলে আমি বলতে পারি আমাদের পরবর্তী সম্পর্কও ঠিক এর চাইতেও মহৎ আরও পূত পবিত্র ছিল।

.

[রুশোর বিবরণে দেখা যায় রুশো তার মাদাম দা ওয়ারেনস-এর সাংসারিক কার্যাদিতে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে সাহায্য করছে। এই সুরেই রুশো তার কাহিনীটি বলে চলেছে।]

.

মাদাম দ্যা ওয়ারেনস যে রুমটিতে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সে রুমটিতে বেশ কিছু বই এবং পত্র-পত্রিকা ছিল। আমার পড়ার বাতিক আগের মতো উদগ্র না থাকলেও এই ঘরে আমি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বই পাঠের সুযোগ পেয়েছিলাম। এগুলির মধ্যে ছিল : ‘দি স্পেকটেটর’ ‘পুফেনডর্ফ’ ‘সেইন্ট এভারমণ্ড’ ‘দা হেনরিএড’। পড়ার আগের বাতিক না থাকলেও কিন্তু হাতে কোনও কাজ না থাকলে আমি ঘরের এই বইগুলি পড়তাম। এর মধ্যে “দি স্পেকটেটর’-এর আমি রীতিমতো ভক্ত হয়ে পড়লাম। এই পত্রিকাটি আমার বেশ উপকারে এসেছিল। সেই যে এরে দ্যা গুভনের কথা বলেছিলাম তার কথা ছিল : বই পড়বে, কিন্তু গোগ্রাসে গিলবে না। চিন্তা করে পড়বা। তার এই উপদেশটি আমার ভাল লেগেছিল। ফলে আমার পড়ার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা এসেছিল। …

আমার মাদাম আর আমি; আমরা দুজনে মিলে লা ব্রুইয়ার পাঠ করেছি। লা ইয়ারকে মাদাম লা রচেফুলভ-এর চাইতে বেশি পছন্দ করতেন। রচেফুলভ অবশ্য একটু গম্ভীর ধরনের লেখক ছিলেন। তবু আমার মতো তরুণদের পক্ষে তাকে পাঠ করতে কোনও অসুবিধা হতো না। মাদাম যখন আমাকে নানা প্রকার উপদেশ দিতে চাইতেন তখন অনেক সময়ে তিনি অনেক জ্ঞানগর্ভ সমস্যায় ডুবে যেতেন। আমি তখন তা থেকে বাঁচার জন্য তার হাত বা মুখে চুম্বন এঁকে দিতাম। আর তাতে তার ক্লান্তিকর উপদেশ মালা থেকে আমি যেন কিছুটা মুক্তিও অর্জন করে নিতে পারতাম। …

কিন্তু আমার চরিত্রের দুটো বিপরীত বৈশিষ্ট্যকে আমি তখনও বুঝতে পারিনি। একদিকে আমার মধ্যে ছিল একটা মনভরা আবেগ, আর একটা ছিল আমার মধ্যে নানা দুর্বোধ্য ভাবের উদয়। এসব ভাবের মাথামুণ্ড আমি সহজে বুঝতে পারতাম না। আমার মনে হচ্ছে আসলে আমি একটা ব্যক্তিই নই। আমার হৃদয়াবেগ আর আমার মন : এ দুয়ের সহাবস্থান আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হতো। আবেগটা যেন কোনও কোনও সময়ে হঠাৎ বিদ্যুৎ বেগে আমার অস্তিত্বকে দখল করে ফেলত। কিন্তু আবেগ তো একটা মানুষের বুদ্ধিকে কোনও সংকটে আলোকিত করতে পারে না। আবেগ আপ্লুত মুহূর্তে আমি যেন কী এক অনুভূতির মধ্যে ডুবে যেতাম যেখান থেকে আমি কী একটা বোধ করতাম কিন্তু কিছু বুঝতাম না। এমন সময়ে আমি নিজের অস্তিত্বের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণকেই হারিয়ে ফেলতাম। যে উপলব্ধির জন্য আমার স্থিরতার প্রয়োজন হতো, সে স্থিরতা তখন আমার মধ্যে থাকত না। এ নিয়ে চিন্তা করলে আমার কাছে এইটা বিস্ময়কর মনে হয় যে, আবেগে আপ্লুত হলেও তার ফলে আমি তেমন কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে বসতাম না। মুহূর্তের আবেগে আমি অস্বাভাবিক কিছু কখনও করেছি বলে আমি মনে করতে পারছিনে। আবেগ আপুত সময়েও আমি আর একজনের সঙ্গে স্বাভাবিক কথাও বলতে পারতাম। এ ব্যাপারে স্পেনীয়দের বেশ খ্যাতি আছে। আবেগের মধ্যেও দাবার চালে নাকি তারা বিশেষ ওস্তাদ। আমি স্যাভয়ের ডিউকে যখন পাঠ করেছি তখন এর একটা দৃষ্টান্ত পেয়েছিলাম। তার অভিযাত্রার এক মুহূর্তে একটা প্যারিসিয়ান ফেরিওয়ালার সাক্ষাৎ পেয়ে সে চীৎকার করে উঠেছিল : এবার তোকে পেয়েছি, এখন তুই যাবি কোথায়? এই দৃষ্টিতে আমি খুব আমোদিত হয়েছিলাম। এই গল্প পড়েও আমিও চীৎকার করে উঠেছিলাম : এবার তোমারে পাইছি রুশো, এখন তুমি যাইবা কোথায়?

একদিকে আমার এই চিন্তার জড়তা আবার আমার অনুভূতির তীব্রতা কেবল যে আমার আলাপের অবিচ্ছিন্ন অংশে পরিণত হয়ে গেল, তাই নয়। আমি যখন নিজের একাকিত্বের মধ্যে ডুবে যেতাম কিংবা কোনও কাজে ব্যস্তও হতাম তবু এই বোধ থেকে আমার মুক্তি ঘটত না। আমার মস্তিষ্কে আমার ভাবগুলো অবিশ্বাস্যভাবে আমাকে আলোড়িত করে তুলত। তখন যেন আমি নানা শব্দ শুনতে পেতাম। সে শব্দে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠতাম। আমার শরীরে কম্পন জাগত। আমি স্তব্ধ হয়ে যেতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে এ অবস্থাটা কেটেও যেত। আমার মাথাটা যেন আবার পরিষ্কার হয়ে উঠত। সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠত। কিন্তু এমন বোধের যাতায়াত সহজে ঘটত না। যখন আমি আক্রান্ত হতাম তখন আমি যথার্থই বিভ্রান্ত এবং অস্থির হয়ে পড়তাম। পাঠককে বলি, আপনি কখনও ইটালির অপেরা দেখেছেন? সেই মঞ্চে যখন দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটত, তখন অপেরার বিরাট মঞ্চে বেশ কিছুক্ষণ ধরে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হতো। যা কিছু সাজ-সজ্জা সব এলোমেলো হয়ে যায়। দৃশ্যের দড়িদড়ার সব টানাটানি শুরু হয়। তখন মনে হয় যেন সব শেষ হয়ে গেল। আর কিছুই হবে না। আবার কিন্তু আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হতে থাকে। এবং ক্রমে আবার একটি সুন্দর দৃশ্য যেন মঞ্চে ভেসে ওঠে। আমার মাথার মধ্যেও যেন এই রকম একটা কিছু ঘটে। আমি যখন কিছু লিখতে বসি তখন এরকমটাই যেন হয়। কেবল আমি যদি অস্থির না হতাম। একটু যদি অপেক্ষা করতে পারতাম, তাহলে আর কোনও লেখকই আমার সৃষ্টিকে অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হতো না। আমার কিছু লেখার ব্যাপারে এই হচ্ছে আমার বড় অসুবিধা। আমার পাণ্ডুলিপিতে নানা রকমের আচড় পড়ে। সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। আর হাতের লেখার যা অবস্থা দাঁড়ায় তা পড়ার ক্ষমতা আমারই থাকে না। আমার পাণ্ডুলিপির এমন অবস্থা আসলে আমার মনের অবস্থারই সাক্ষ্য। আমার এমন কোনও পাণ্ডুলিপি নাই যাকে ছাপার জন্য প্রেসে পাঠাবার আগে আমাকে চারবার এমন কি পাঁচবারও কপি করতে না হয়েছে। কলম হাতে নিয়েই আমি কখনও কিছু করতে পারিনি। কেবল যে চেয়ার টেবিলে কলম হাতে বসাই যথেষ্ট ছিল এমন নয়। আমার মধ্যে আমি কলম বাদেই লিখেছি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে লিখেছি। বিছানায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে লিখেছি : আমি ঘুমিয়েও লিখেছি। কাজেই পাঠকরা আমার দুরবস্থার কথা বুঝতে পারবেন। জীবনে দু’টা ছত্র আমি মুখস্থ করতে পারিনি। কত চিন্তা-ভাবনাকে যে আমি রাতের পর রাত মাথার মধ্যে কতবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেছি, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। আসলে আমার লেখার গুণই বলেন, আর দোষই বলেন : বিনা পরিশ্রমে এর কোনও কিছুরই তর তর করে জন্ম ঘটেনি। আবার আমার একাকিত্বও আমার কিছু লেখার একটা আকর্ষণ। কারোর সামনে আমি কখনও কিছু লিখতে পারিনি। আমার দিকে কেউ তাকিয়ে থাকলে তার পক্ষে আমি যে একটা ছত্রও লিখতে পারি এমন ভাবা তার পক্ষে সম্ভব হত না।

.

[যা হোক, শেষপর্যন্ত ধর্মযাজকরা স্থির করল : রুশোকে পাদ্রী বা ধর্ম যাজক উপাধিতে ভূষিত করা হবে। এবারে সে যে খুব খুশি হলো তা নয়। মনের বেদনা নিয়ে সে তার নির্ধারিত প্রশিক্ষণের মঠের উদ্দেশে যাত্রা করল। তার ধর্মাধ্যক্ষ হয়ে দাঁড়াল আবেগাতিয়ার।]

.

মশিয়ে গাতিয়ারের প্রতিকৃতিটি আমি কোনও দিন বিস্মৃত হতে পারিনি। কোনও ধনাঢ্য পরিবার থেকে সে আগত ছিল না। বয়সেও অধিক নয়। তার প্রতিকৃতিটি ছিল সুন্দর শুশ্রুমণ্ডিত একটি নিষ্পাপ সদৃশ ব্যক্তির প্রতিকৃতি। তার শুশ্রুতে কিছুটা লাল রঙের আভা ছিল। তিনি যে অঞ্চল থেকে এসেছিলেন তার বৈশিষ্ট্য তার প্রকৃতিতে স্পষ্টই ছিল। তার নিজের অঞ্চলের মানুষের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল বাহ্যত : গম্ভীর প্রকৃতির অভ্যন্তরে জ্ঞানের আলোর আভা। কিন্তু মশিয়ে গাতিয়ারের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল একজন হৃদয়বান, স্নেহপরায়ণ ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য। তার নীলাভ চোখ দুটির মধ্যে একটা সৌজন্য এবং বিষণ্ণতার মিশ্রণ কারোর দৃষ্টি এড়াতে পারত না। যে কেউ তার এমন বৈশিষ্ট্যে আকৃষ্ট বোধ না করে পারত না। তার আচরণ এবং বিষণ্ণতা থেকে যে কেউই বোধ করতে পারত যে লোকটির চরিত্রের মধ্যে যেন একটা আজন্মলালিত দুঃখবোধের ভাব ছিল।

এর কয়েক বছর পরে আমি জানতে পারলাম যে, একটি মঠের অধ্যক্ষ থাকাকালীন অবস্থায় সে একটি অল্প বয়স্ক মেয়ের প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তাদের এমন মিলনে মেয়েটির একটি সন্তানও হয়েছিল। এর ফলে তার মঠের মধ্যে তার বিরুদ্ধে বড় রকমের একটি কলঙ্কের ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিল। এ ব্যাপারে মঠগুলির শৃঙ্খলা ছিল ভয়ানক রকমের কঠোর। কোনও যাজকেরই কোনও মেয়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে কোনও সন্তানের জন্ম হওয়া ছিল মারাত্মক অপরাধের ব্যাপার। মশিয়ে গাতিয়ারের এই ভয়ানক অপরাধের জন্য তাকে বন্দি করে কারাগারে আবদ্ধ করা হলো। তাকে অসম্মানিত করে পদচ্যুত করা হলো। তিনি তার পদ আবার ফিরে পেয়েছিলেন কিনা, তা আর আমি জানতে পারিনি। তবে আমি যখন ‘এমিলি’৫ রচনা করি তখন বারংবার এই চরিত্রটি আমার মনে উঁকি দিতে থাকে। এই মশিয়ে গাতিয়ার এবং মশিয়ে গায়মি; এই দু’টি মর্যাদাবান চরিত্রের মিলনেই তৈরি হয়েছিল আমার এমিলির ‘স্যাভোয়ার্ত ভাইকার’। আমার এমন সৃষ্টিতে এঁদের দু’জনের কারোরই যে কোনও বিকৃত রূপের প্রকাশ ঘটেছিল, তা আমি মনে করিনে। আর তাতেই আমার আনন্দ।

এবার আমি নিশ্চিত হলাম; কোনও দায়িত্বপূর্ণ পদেরই আমি উপযুক্ত নই। মশিয়ে গাতিয়ার উপরস্থের নিকট আমার বিরুদ্ধে তেমন কোনও বিরূপ রিপোর্ট যে পেশ করেছিলেন, এমন নয়। তবু ওপর তলার অধ্যক্ষরা মনে করল ধর্মযাজক হওয়ার মতো উপযুক্ত কোনও লোক আমি নই। আর তাই আমি এ পর্যন্ত যতদূর এগিয়েছিলাম তার অধিকের জন্য তাদের কাছ থেকে কোনও সুপারিশ আমার ভাগ্যে ঘটল না।

তারা আমাকে মাদাম দ্য ওয়ারেনস-এর কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। তাদের অভিমত ছিল, ছেলেটার চরিত্র খারাপ নয় বটে, তুব এ ছেলে ধর্মযাজক হওয়ার উপযুক্ত নয়। এজন্যই আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ সত্ত্বেও মাদাম আমাকে তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করলেন না।

মাদাম আমাকে যে সব মূল্যবান সঙ্গীত গ্রন্থ বা রেকর্ড দিয়েছিলেন : তার সবই আমি তাকে ফেরত দিলাম। তার সেই সস্নেহ উপহার আমার দুর্লভ ভাগ্য স্বরূপ ছিল। সেই সঙ্গীতভাণ্ডার আমার অপরিমেয় উপকার সাধন করেছিল। যে মঠে আমি অধ্যয়নরত ছিলাম সেখানে আমার শিক্ষা অ্যালাকিউস এবং এ্যারেথুসা পর্যন্ত পৌঁছেছিল।৬ সঙ্গীতের প্রতি আমার আকর্ষণ আমার প্রতি মাদামের স্নেহের আধিক্যের অবশ্যই একটি উৎস ছিল। তিনি আমাকে একটি সঙ্গীতশিল্পীতে পরিণত করতে চাইলেন। তার গৃহে এর উপযুক্ত পরিবেশও ছিল। প্রায় প্রতি সপ্তাহে তার গৃহে একটি সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন হতো। এবং সেখানকার ধর্মীয় মঠের যিনি সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি প্রায়ই তার গৃহের এই সঙ্গীতমিলনীতে উপস্থিত থাকতেন। যে সঙ্গীত পরিচালকের কথা বললাম তার নাম ছিল লা মিতার। তিনি যথার্থই একজন ভাল সঙ্গীত রচয়িতা ছিলেন। তিনি এসেছিলেন প্যারিস থেকে। তিনি বেশ উৎফুল্ল ধরনের লোক ছিলেন। দেখতে তখনও তিনি সুন্দর এক যুবক ছিলেন। বুদ্ধি যে বেশি ছিল, তা নয়। তবু মোটামুটি একজন ভদ্রলোক তো বটে। মামা আমাকে তার সঙ্গে পরিচিত করে দিলেন! তাকে আমার বেশ পছন্দ হলো। তিনিও আমার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন না। তার কাছে সঙ্গীত শেখার জন্য আমার কত লাগবে তারও একটা আলোচনা হলো। মোট কথা এই সঙ্গীত শিক্ষকের বাড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। তাতে আমার কোনও অসুবিধা হলো না। শীতটা সেখানে আমার ভালই কাটল। কারণ মাদাম তথা আমার মামার বাসগৃহ থেকে তার বাড়ির দূরত্ব ছিল মাত্র বিশ গজের মতো। আমরা মামোর’ গৃহে কয়েক মিনিটে পৌঁছে যেতাম এবং প্রায়শই আমরা সকলে মিলিতভাবে আহার করতাম। এটা অবশ্য বুঝতে তেমন অসুবিধে হবে না যে, সঙ্গীত শিক্ষকের বাড়ির আবহাওয়াটা ধর্মীয় মঠের আবহাওয়ার চাইতে আমার জন্য বিশেষ আনন্দজনকই ছিল। তাই বলে আমার এই জীবনে যে কোনও নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলা ছিল না, তেমনও নয়। একটা কথা বলতে পারি, জন্মগতভাবে আমি যেমন আমার স্বাধীনতাকে ভাল বেসেছি, তেমন স্বাধীনতার কোনও অপব্যবহার আমার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য ছিল না। পুরো ছ’মাস আমি মামোর কাছে যাওয়া, গির্জার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া ছাড়া বাইরে কোথাও যাইনি। আর পেছনে তাকালে আমি বলতে পারি, এই সময়টার মতো মনের শান্তি আমি খুব কমই পেয়েছি। তাই এই সময়ের স্মৃতিটা আমার মনকে আজো ভরে তুলে। সব চাইতে আনন্দময় বলে বোধ হয়। নানা অবস্থাতেই আমি জীবন কাটিয়েছি। তবু এর মধ্যে এমন কিছু জীবনও আমি পেয়েছি যার স্মৃতি আমাকে যেন সাক্ষাৎ জীবনের মধ্যেই নিয়ে যায়। তাকে আমি অতীত বলে মনে করতে পারিনে। এর স্মৃতিতে কেবল সময়, পরিবেশ, নানা ব্যক্তি আমার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তাই নয়, পুরো রেশটার মধ্যেই যেন আমি প্রবেশ করি, তার আলো বাতাস, গাছপালা : সব কিছুর মধ্যে। এমন পরিবেশের সাক্ষাৎ স্মৃতি আমাকে বর্তমানেও উদ্বেল করে তোলে। যেমন ধরুন সেই সঙ্গীত শিক্ষকের গৃহের কথা : সেখানে যা কিছু ঘটেছিল, যে সঙ্গীত গীত হয়েছিল, সেখানকার সকল এবং প্রত্যেকটি বস্তু, যাজকদের পোশাকাদি, সঙ্গীত শিল্পীদের তাল নয়, তাদের মুখের আকার আকৃতি, বাড়ির একজন পঙ্গু মিস্ত্রী, একজন তরুণ সেই যাজক যিনি ভায়োলিনে বেশ সুন্দর সুর তুলতে পারতেন, সেই মশিয়ে লা মাইতার যখন তিনি তার এতক্ষণ ফেলে রাখা আলখিল্লাটা আবার গায়ে পরতেন, এবং যাজকের সেই সুন্দর লম্বা পোশাকটি যা গায়ে জড়িয়ে তিনি সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রাতে যোগ দিতেন উঠে দাঁড়াতেন, তাছাড়া মশিয়ে লা মায়তার যে কবিতাটি আমার ওপর তৈরী করেছিলেন তার আবৃত্তির জন্য আমি উঠে দাঁড়াতাম, এ সবের পরে সুন্দর যে ভোজের অনুষ্ঠান আমাদের জন্য অপেক্ষা করত : এই সব এবং আরও ঘটনার কিংবা ঘটনার ক্ষুদ্র একটি অংশ যখন বার বার আমার স্মৃতিতে ফিরে আসে তখন সে কেবল যে অতীতের স্মৃতি তা নয়, সে আমার যথার্থই বর্তমান অস্তিত্বেরই অনুভূত অংশ। আনেনসিতে আমি প্রায় এক বছর কাটিয়েছিলাম। এজন্য আমার কোনও দুঃখ ছিল না। সেখানকার সবাই আমাকে ভালবেসেছে। সেই যে তুরিন ছেড়ে এসেছিলাম তার পরে আমি আর তেমন কোন মূর্খতার পরিচয় দিইনি। আর তাছাড়া আমার দুষ্ট হওয়ার কোনও উপায়ই ছিল না। কেননা আমার ওপর তার স্নেহের আচ্ছাদন বিছিয়ে ছিলেন মাদাম দ্য ওয়ারেনস। আমার জননী স্বরূপা। তিনিই ছিলেন আমার পথপ্রদর্শক, আমার পরিচালক তার সে পরিচালনায় আমার জন্য তার কল্যাণ কামনা ছাড়া অপর কিছুরই স্পর্শ ছিল না। তার প্রতি আমার সকল অস্তিত্বের আকর্ষণই ছিল আমার একমাত্র আকর্ষণ। আর সে কারণেই বলছি, তার মধ্যে আমার কোনও মূর্খতা ছিল না। আমার অন্তরের মধ্যেই আমার সেই আকর্ষণের মহৎ যুক্তি ছিল। একথা ঠিক যে মামোর প্রতি আমার সর্বাত্মক আকর্ষণের কারণে আমার কোনও ক্ষমতাকেই আমি কোনও কাজে লাগাতে পারিনি। সঙ্গীত শেখার যে কথা আমি বলেছি, তার প্রতিও আমি কোনও দৃষ্টি দিতে পারিনি। আমি যে চেষ্টা করিনি তা নয়। সর্বান্তকরণে আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু মাদামের বাইরে আমি কিছু চিন্তা করতে পারিনি। আমি কেবল স্বপ্ন দেখতাম। এবং কোনও কিছুই সাধন না করতে পারার দীর্ঘশ্বাসই ছিল আমার তখনকার অস্তিত্ব আর কর্মের একমাত্র প্রকাশ। কিন্তু আমি কী করব? এমনতর ছিল আমার অসহায় বোধ। আমার মাথার মধ্যে ভাবের অভাব ছিল না। আর এমন ভাবের প্রত্যেকটির মধ্যে ছিল আমার মূর্খতার প্রকাশ। একবার কিন্তু একটা কাজের ভাব আমার মধ্যে ঢুকেই গেল : বলতে পারি মূর্খতার ভাব নয়। যথার্থ কাজের ভাব। কিন্তু তার কথা এখন থাকা মূর্খতার মধ্যেও যে সার্থকতার কিছু থাকে, আমি তার প্রমাণও তখন পেয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসের এক ভয়ানক শীতার্ত ঠাণ্ডায় আমরা যখন সবাই অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বসেছিলাম, তখন বাইরে রাস্তার দিকের দরজায় আমরা একটা শব্দ শুনতে পেলাম। বাসার পরিচারিকা পেরিন ওর হাতের বাতি ধরে বাইরে গেল। দরজা খুলে একটি যুবককে নিয়ে এল। যুবকটি উপরে এসে মশিয়ে ল মিতারকে বেশ সম্মানসূচক কথায় নিজের পরিচয় দিয়ে বলল; সে একজন ফরাসি সঙ্গীত শিল্পী। তার আর্থিক অবস্থা ভাল নয় বলে সে কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মঠে কাজ করতে চায়। মশিয়ে কো মিতার ওর মুখ থেকে ‘আমি একজন ফরাসি সঙ্গীত শিল্পী’ কথাটি শুনেই অসম্ভব আনন্দ বোধ করলেন। কেননা মশিয়ে লা মিতারও ফরাসি সাহিত্য শিল্পের জন্য বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি বেশ আনন্দের সঙ্গেই প্রায় ভবঘুরে এই যুবকটিকে তার গৃহে আশ্রয় দিলেন। যেদিন তরুণটি এসেছিল সঁশিয়ে লা মাইতার তাকে রাতে থাকতে জায়গা দিলেন। যুবকটি এমন আশ্রয় পেয়ে সে রাতে যথার্থই উপকৃত হয়েছিল। আমার সাথে তার কোনও কথা হয়নি। কিন্তু সে যখন আগুনের পাশে বসে আগুন পোহাচ্ছিল আমি তখন তাকে দেখছিলাম। এরপরে আমাদের খাবারও দেয়া হলো। লোকটির দিকে আমি দৃষ্টি রাখছিলাম। ওর দৈহিক গঠনে কিছুটা অস্বাভাবিকতা ছিল। ঘাড় এবং পিঠটা যেন একটু বাঁকা ছিল। তাই তাকে মনে হচ্ছিল যেন একটু কুঁজো। ওর গায়ের কালো কোটটা যেমন ময়লা ছিল তেমনি অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। গায়ের জামাটা কিন্তু দামি কাপড়ের ছিল। কিন্তু যত না পুরনো তার চাইতে অধিক ময়লা পায়ের মোজা এমন ছিল যে একটার মধ্যেই ও দুটো পা-ই ঢুকিয়ে দিতে পারত। বরফের হাত থেকে মাথা বাঁচাবার জন্য ও ওর বগলের নিচে একটা টুপিও ধরে রেখেছিল। এমন খাপছাড়া পোশাকেও কিন্তু লোকটার মধ্যে একটা মহত্ত্ব ছিল বলে আমার মনে হলো। তার ব্যবহার যাই হোক, এটা বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছিল না। তার কথা-বার্তা শুনে আমার তাকে বুদ্ধিমান বলেই বোধ হলো। কথার পাশে কথার জবাব দিতে সে আটকাচ্ছিল না। হয়তো-বা জবাবের দ্রুততা একটু বেশিই ছিল। সব মিলিয়ে আমার মনে হলো লোকটা শিক্ষিত, যদিও ওর মধ্যে নীতিবোধ তেমন না থাকতে পারে। অভাবী ছিল। তবু আচরণে ভিক্ষুক ভাবটা তত ছিল না। সে তার নাম বলল : ভেঞ্চার দা ভিলেনুভা। বলল সে প্যারিস থেকে আসছিল। কিন্তু আসতে আসতে পথ হারিয়ে ফেলেছে। তার কথার মধ্যে কিছু এলোমেলো ভাব ছিল। এতক্ষণ যদি-বা সে তার গানের কথা বলছিল, এখন বলল সে তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে থাকে আর এই আত্মীয় ফরাসি পার্লামেন্টের একজন সদস্য। এজন্য তাকে গ্রেনোবল যেতে হবে।

খাবার খেতে খেতে এই লোকটির আলাপ আবার সঙ্গীতে ফিরে এল। এ ব্যাপারে তার আলাপকে আমার বেশ ভাল লাগল। তার পরিচয়ের পরিধি বেশ ব্যাপক বলে মনে হলো। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এবং তাদের মূল্যবান গ্রন্থাদির কথাও সে বেশ সহজেই বলল। শিল্প সঙ্গীত জগতের বিভিন্ন নায়ক-নায়িকার কথাও সে উল্লেখ করল। এদের মধ্যে অভিজাত ব্যক্তিদেরও নাম ছিল। মনে হলো এদের অনেককে যথার্থই সে দেখেছে। কিন্তু দেখা গেল কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ের আলাপ উঠলে সে যেন আলাপটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাচ্ছে। হঠাৎ হয়তো এমন একটা কথা বলল যাতে সবাই হেসে উঠল। দিনটা ছিল শনিবার। পরের দিনই গির্জাতে একটা সঙ্গীতের জলসা ছিল। মশিয়ে লা মাইতার তাকে সঙ্গীতের জলসাটিতে যোগ দিতে বললেন। তাতে লোকটি আনন্দের সঙ্গেই রাজি হলো এবং কী বিষয়ে সে বাজাবে এ কথাতে সে ‘অলটো গীতের কথা উল্লেখ করল। কিন্তু তার পরেই কথাটা অন্যদিকে মোড় নিল। গির্জার জলসার আগে তাকে তার কনসার্টের অংশটি দেখান হলো। কিন্তু সেটিতে একটু চোখ বুলানোরও সে প্রয়োজন বোধ করল না। লোকটার এমন মাতব্বরী আচরণে লা’ মাইতার বিস্মিত হলেন। মাইতার একটু আস্তে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন : তুমি দেখবে, এ ব্যাটা আসলেই কিছু জানে না। আমি বললাম, মশিয়ে আমারও তাই মনে হচ্ছে। যাই হোক জলসার আগে সকলেই মিলে যখন মঠের দিকে যাত্রা করলাম তখন আমার মনের মধ্যে একটা উদ্বেগ বোধ করলাম। সঙ্গীত যখন শুরু হলো আমি যেন আমার হৃদস্পন্দন শুনতে পেলাম। কারণ লোকটাকে আমার উড়িয়ে দেবার ইচ্ছা হচ্ছিল না।

আমি দেখলাম, আমার অস্বস্তি বোধ করার কোনও কারণ নেই। ওর গাওয়া সঙ্গীতের দুটো অংশ খুবই সঠিক ছিল। তার মধ্যে ওর একটা সঙ্গীতবোধেরও প্রকাশ ঘটছিল। ওর গলাটা খুবই সুন্দর লাগছিল। সেদিন আমি ওর এই ক্ষমতার প্রকাশ দেখে যথার্থই বিস্মিত এবং আনন্দ বোধ করছিলাম।

.

[কিন্তু মাদাম দ্য ওয়ারেনস গানের ওই ছেলেটাকে তেমন পছন্দ করলেন না। তার ভয় ছিল ওটার প্রভাবে রুশোও খারাপ হয়ে যাবে। ফলে দেখা গেল ম লা’ মাইতারও সরে পড়তে চাইল। ও একদিন পালিয়ে গেল। আর রুশোও ওর সঙ্গ ছাড়ল না। দুজনের লিয়নস পর্যন্ত এক সঙ্গে গেল। কিন্তু রুশোও শেষে লা মাইতার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করল। সেদিন গানের সেই ছেলেটার মৃগী রোগের একটা আক্রমণ ঘটেছিল। রুশো সেই সুযোগে ওই লোকটা থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলল।]

.

যে সব ঘটনা আমি এ পর্যন্ত বর্ণনা করেছি, তার কোনও কোনও ঘটনা, কোনও কোনও স্মৃতি আমার মনের ভেতরে এখনও ভেসে ওঠে। আমার পরের অংশে এর কিছু বিবরণ আমি আমার পাঠকদের দেব। সেগুলো আমার পাঠকদের কাছে একেবারেই অজানা। এগুলো সাংঘাতিক রকমের বাড়াবাড়ি ঘটনা। আমার ভাগ্য ভাল যে আরও খারাপ কিছু আমার জীবনে ঘটেনি। তবে সঙ্গীতের ব্যাপারটায় আমি আর তাল সামলাতে পারলাম না। সঙ্গীতের বাতিক আপনাআপনিই একদিন শেষ হয়ে গেল। আমি আমার মূর্খতাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। একেবারে যে পেরেছিলাম, তেমন নয়। তবু আমার চরিত্রবিরোধীগুলোর অনেকগুলো আমি পরিত্যাগ করতে পেরেছিলাম। আমার জীবনের এই পর্যায়টার ব্যাপারে আমি এখনও কোনও স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি করতে পারিনি। এই পর্যায়ে আমাকে অনুপ্রাণিত করার তেমন কোনও ঘটনাই যেন ঘটেনি। ফলে এর কোনও স্পষ্ট স্মৃতিও আমার নেই। আমার নিত্য পরিবর্তনশীল ইচ্ছা-অনিচ্ছার মধ্যে নানা রকম ঘটনাই ঘটছিল। কেবলমাত্র স্মৃতির ওপর ভর করেই আমি আমার জীবনের এই পর্যায় সম্পর্কে বলছি। এ পর্যায়ের ওপর আমার কোনও দিনলিপি বা ডায়েরি বা লিখিত কোনও কিছুই ছিল না।

আমার জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছে যার স্মৃতি এত তীব্র এবং উজ্জ্বল যেন তা মাত্র গতকালই ঘটেছে। আগে নয়। কিন্তু আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে যার বর্ণনা কেবল অনুমানের ওপর ভর করেই আমাকে করতে হচ্ছে।

কাজেই এটা খুবই সম্ভব যে এমন ঘটনাও আমার মনে ভেসে উঠছে বলে মনে হচ্ছে, যা আসলে আদৌ ঘটেনি। এর পুনরাবৃত্তি যে না ঘটবে তেমনও আমি বলতে পারছিনে। অবশ্য সেগুলো তেমন মূল্যবানও কিছু নয়। হয়তো এগুলো আর তখন ঘটবে না যখন আমার দৃঢ় স্মৃতি আমি ফিরে পাব। তবে যেগুলো আমার স্মৃতিতে স্পষ্ট, সেগুলোর বর্ণনায় আমার মিথ্যাচার বা কল্পনা নেই। এ ব্যাপারে পাঠকরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

.

[এর পরবর্তী সময়ে রুশো যখন আবার এ্যানেসিতে ফিরে এল তখন সে দেখল মাদাম দ্য ওয়ারেনস প্যারিসে চলে গেছেন। তার নানা রহস্যজনক কর্মকাণ্ড ছিল। তার হদিস রুশো জানত না। তারই কোনওটির কারণে হয়তো রুশো এ্যানেসিতে ফিরে আসার পূর্বেই মাদাম দ্য ওয়ারেনস প্যারিসে চলে গিয়েছিলেন।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *