তৃতীয় পরিচ্ছেদ – প্রান্তরে
দেওয়ান গোবিন্দরাম উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, তাঁহার দেহের গঠন ও মুখকান্তি মনোহর, বিশেষতঃ তাঁহার দীর্ঘ পক্ষ্মবিশিষ্ট আয়ত চক্ষু দুইটি বড়ই সুন্দর। তাঁহার পায়ে দিল্লীর নাগরা জুতা, গায়ে মেরজাই, মাথায় একখানি উড়ানী বাঁধা ও হাতে এক গাছি লাঠী ছিল। তিনি ঢাকাই ধুতি মালকোচা করিয়া পরিয়া দৃঢ় পাদবিক্ষেপে গমন করিতেছিলেন; বস্তুতঃ ভয় কাহাকে বলে গোবিন্দরাম জানিতেন না। তিনি কোন বিপদকে বিপদ বলিয়াই গণ্য করিতেন না। কোন ঘটনাই তাঁহার মানসিক স্থৈর্য্য নষ্ট করিতে পারিত না। তিনি কি সম্পদে, কি বিপদে সকল অবস্থাতেই অবিচলিতভাবে কার্য্য করিতে পারিতেন। তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ভীমাকৃতি ভীমসদার একটি বাক্স বস্ত্রদ্বারা পৃষ্ঠদেশে বাঁধিয়া লইয়া সুবিশাল বক্ষে এক সুদীর্ঘ যষ্টি ন্যস্ত করিয়া মত্ত হস্তীর ন্যায় কালীপুরাভিমুখে গমন করিতেছিল। কালীপুরে দেওয়ানের শ্বশুরালয়। বালী হইতে কালীপুরে যাইতে হইলে প্রান্তর-পথ দিয়া যাইতে হয়। দেওয়ান ও ভীমসৰ্দ্দার ক্রমে ক্রমে গ্রাম পার হইয়া মাঠে আসিয়া পড়িলেন। মাঠে আসিয়া দেওয়ানের বড়ই আনন্দ হইল, অযুতনক্ষত্রখচিত অনন্ত নীলাকাশ, কৌমুদীরঞ্জিত বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র এবং নিৰ্ম্মল সুগন্ধ পবন হিল্লোলে তাঁহার চিত্ত প্রফুল্লতার সহায়তা করিতে লাগিল। তিনি একটি গান ধরিলেন,—
“ভুলিতে বল, সখী! কেমনে ভুলিব তায়?
যৌবনের ভালবাসা, জীবনে কি ভুলা যায়?
যুগযুগান্তর গেল, সে অনল না নিবিল,
সে দারুণ হৃদিজ্বালা, শুধু বুঝি মলে যায়।”
গোবিন্দরাম প্রথম যৌবনে কাহাকেও ভালবাসিয়াছিলেন কি না, তাহা আমরা জানি না, কিন্তু তিনি এই গীতটি বড়ই ভাবাবেশ সহকারে গান করিয়াছিলেন।
তিনি অন্তরস্থ ভাবের সহিত গায়িয়াছিলেন বলিয়াই গানটি শুনিতে যার-পর-নাই মধুর বোধ হইয়াছিল। তিনি গান করিতে করিতে যতদূর গিয়াছিলেন, ততদূর যেন সুধাবর্ষণ হইয়াছিল। সে স্বর- লহরীতে শ্রোতার শোক-সন্তাপ কোথায় ভাসিয়া গিয়াছিল, সে মধুর সঙ্গীতে মোহিত হইয়া সুকণ্ঠ বিহঙ্গমগণ তাঁহার গানের সহিত যোগদান করিয়াছিল এবং সকল স্বর-নিদান পবনদেব সে সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে বংশীবাদন করিয়াছিলেন। এ প্রকার অমিয়হিল্লোলে কাহার চিত্ত স্থির থাকে? কাহার মন আনন্দে উথলিয়া না উঠে? ভীমসর্দ্দার সেই অপূৰ্ব্ব গান শুনিতে শুনিতে মহানন্দে প্রভুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতেছিল। সে কোন বিপদেরই আশঙ্কা করে নাই, পার্থিব কোন চিন্তাই সে সময়ে তাহার হৃদয়ে স্থান প্রাপ্ত হয় নাই, তখন সে মর্ত্যে থাকিয়া স্বর্গসুখ অনুভব করিতেছিল। কিন্তু জগতে সুখ দুঃখ কিছুই চিরস্থায়ী নয়। অকস্মাৎ তাহার পায়ের কাছ দিয়া তড়িদ্বেগে কি যেন একটা সবেগে চলিয়া গেল। সে তৎক্ষণাৎ লম্ফ প্রদানে দেওয়ানের অগ্রবর্ত্তী হইয়া দাঁড়াইল।
দেওয়ান বলিলেন, “কিরে ভীমে! কি হয়েছে?”
ভীম বলিল, “শুনতে পাননি এই যে বন বন করে একটা পাড়া আমার পায়ের নীচে দিয়ে বেরিয়ে গেল। যা হোক মশাই, গতিক বড় ভাল নয়, ডাকাতেরা নিশ্চয়ই আমাদের পিছু নিয়েছে।”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “তোর ভয় হয়েছে নাকি?”
এই কথায় ভীমের কিছু লজ্জা বোধ হইল, সে স্পর্দ্ধা করিয়া ডাকিয়া বলিয়া উঠিল, “ওরে শালারা, যদি বাপের বেটা হোস, সামনে আয়।”
ডাকাইতেরা সম্মুখ ও পশ্চাৎ হইতে ভয়ঙ্কর নাদে চীৎকার করিয়া উঠিল।
“গোবিন্দরাম সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইয়া বলিলেন, দেখ ভীমে আমি যদি আহত হইয়া পড়ি, তাহলে তুই আর একদণ্ড বিলম্ব না করে উর্দ্ধশ্বাসে পালাবি, আর ঐ বাক্সটি আমার স্ত্রীকে গিয়া দিবি, দেখিস যেন নিমকহারামী করিস নি। আর বাক্সের মধ্য হতে দশখান মোহর তুই নিস।”
তাঁহার কথা শেষ হইতে-না-হইতে দুইজন দীর্ঘাকার পুরুষ তাঁহাদের সম্মুখীন হইল। তাহাদের একজনের হাতে বড় লাঠী ও অপরের হাতে তরবারী।
দেও। কে তোরা? কি চাস?
রতন। ঐ বাক্সটি চাই।
দেও। ছেলের হাতে পিটে নাকি?
রতন। মরবার এত সাধ কেন? (দেওয়ানকে যষ্টি প্রহার করিবার উপক্রম করিল।)
দেওয়ান লম্ফ প্রদানে সরিয়া গিয়া, যষ্টি দ্বারা অপর দস্যুর দক্ষিণহস্তে এরূপ প্রহার করিলেন যে, তাহার হস্তস্থিত তরবারী বেগে দূরে নিক্ষিপ্ত হইল। রত্নাপাখী পুনর্ব্বার দেওয়ানকে আক্রমণ করিল। দুইজনে তুমুল যুদ্ধ বাধিয়া উঠিল। ইত্যবসরে ভীমসদার ভূমি হইতে সেই তরবারীখানি আত্মস্মাৎ করিয়া রত্নার প্রতি ধাবমান হইল। দেওয়ানের সজোর আঘাতে মাধার দক্ষিণহস্ত ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল; সে বামহস্তে লাঠী ধরিল। ইতিমধ্যে আর দুইজন ডাকাইত আসিয়া উপস্থিত হইল। ডাকাইতেরা এখন চারি জন হইল; দেওয়ান ও ভীমসদার তাহাতেও ভীত না হইয়া পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক বিক্রমের সহিত লাঠী চালাইতে লাগিল। তুমুল সংগ্রাম চলিতে লাগিল। কেহই হটে না, কেহই কাহাকে পরাস্ত করিতে পারে না। অনেকক্ষণ যুদ্ধের পর, মাধা ডাকাইত দেওয়ান কর্তৃক আহত হইয়া ধরাশায়ী হইল। পরক্ষণেই রত্নাপাখীর প্রহারে বাত্যাহত তরুর ন্যায় দেওয়ানও ভূ-পতিত হইলেন। ভীমসদার প্রভুর পূর্ব্বাদেশানুসারে বায়ুবেগে পলায়ন করিল।
রত্নাপাখী, ভীমসদার পলায়ন করিয়াছে দেখিয়া বলিল, “কালা, তুই কাৎলা সাবাড় কর, মাল ঐ ব্যাটার কাছে, আমরা ঐ ব্যাটাকে ধরিগে।”
এই বলিয়া ঝোড়োকে সঙ্গে লইয়া ভীমসৰ্দ্দারের অনুধাবন করিল।
চন্দ্রমা অস্তগমন করিয়াছেন। আকাশ গাঢ় মেঘে আচ্ছন্ন। একটিও নক্ষত্র দেখা যাইতেছে না। চতুর্দ্দিকে ঘোর অন্ধকার—এক-একবার বিদ্যুৎ হানিতেছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়িতেছে। অতি নিকটের বস্তুও নয়নগোচর হয় না। এবপ্রকার ভয়ঙ্করী শব্বরী সময়ে দস্যুপতি রতন শৰ্ম্মার অনুচর মাধা প্রান্তর মধ্যে মৃতবৎ পড়িয়া আছে। রক্তে চতুষ্পার্শ্ব প্লাবিত হইতেছে। নিঃশব্দে একটা শৃগাল আসিয়া তাহার মুখাঘ্রাণ করিতে লাগিল। মাধা ভয়ে আৰ্ত্তনাদ করিয়া উঠিল।
কালা আহত ডাকাইতকে সরাইয়া ফেলিবার ভার লইয়া, একটি ভগ্ন সেতুর ধাপে বসিয়া গাঁজা খাইবার আয়োজন করিতেছিল। সে মাধার আর্তনাদ শুনিতে পাইয়া তাহার নিকটবৰ্ত্তী হইয়া বলিল, “মাধা, তুই যে এখনও বেঁচে আছিস! তামাক খাবি?”
মাধা অতি ক্ষীণস্বরে উত্তর করিল, “বড় যাতনা, ঐ শিয়ালটাকে আগে তাড়িয়ে দে।”
কালা। শিয়াল পালিয়েছে। গাঁজা খাবি?
মাধা। আমার কি আর উঠবার ক্ষমতা আছে, উঃ! বড় যাতনা! ভাই, আমার মাথাটা বেঁধে দে।
কালা। আচ্ছা, ঐ দেওয়ান শালার কাপড়খানা খুলে আনি।
কালা উঠিয়া দেওয়ানজীর শব খুঁজিতে গেল, কিন্তু দেওয়ানের কোন চিহ্নও দেখিতে না পাইয়া পুনর্ব্বার মাধার নিকটে আসিয়া তাহার পরিধেয় বস্ত্রের কিয়দংশ ছিঁড়িয়া, বিলের জলে ভিজাইয়া তাহার মাথায় বাঁধিয়া দিল এবং কোমর হইতে আপনার গামছা খুলিয়া, নুটি করিয়া তাহার উপাধান করিয়া দিল।
মাধা একটু সুস্থ হইয়া বলিল, “শালা দেওয়ান মরেছে?”
“আরে মলো যাঃ! শালাকে শিয়ালে টেনে নিয়ে গেল নাকি?” বলিয়া কালা চতুৰ্দ্দিকে দেওয়ানের অন্বেষণ করিতে লাগিল। রাস্তার ধারে, ঝোপে, জঙ্গলে, ধানবনে, নানা স্থানে অন্বেষণ করিল, কিন্তু কোথাও তাঁহার চিহ্ন পাইল না, হতাশ হইয়া ফিরিয়া আসিয়া মাধার কাছে শয়ন করিবার উপক্রম করিল, এমন সময়ে একব্যক্তি আসিয়া বলপূর্ব্বক তাহাকে ভূমিতে ফেলিয়া, তাহার বক্ষে জানু দিয়া চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “দুরাত্মা, এইবার কি হয়?“
কালার আর নড়িবার শক্তি নাই, সে অতি কষ্টে বলিল, “বাবা, আমি আপনার গোলাম, আমায় প্রাণে মারিবেন না, আপনি যখন যাহা বলিবেন, তাহাই করিব।’
আক্রমণকারী বলিল, “তুই ডাকাইত, তোর কথায় বিশ্বাস কি?’
কালা। হুজুর, বিশ্বাস করুন, আমি কখন নিমকহারামী করিব না।
সে ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ কালাকে ছাড়িয়া দিয়া বলিল, “আমি তোকে ছাড়িয়া দিলাম, কিন্তু তোর প্রতিজ্ঞা পালন কর। যাহা বলি শোন। “
কালা উঠিয়া জোড়হস্তে বলিল, “কি আজ্ঞা হয়, বলুন।”
সে ব্যক্তি বলিল, “এই আহত লোকটাকে কাঁধে নিয়ে আমার সঙ্গে আয়। ঐ যে মাঠের মাঝে আলো দেখা যাচ্ছে, ঐখানে যেতে হবে।”
আদেশ মত কালা মাধাকে স্কন্ধে লইল ও সেই আলোক লক্ষ্য করিয়া তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল।