তৃতীয় পরিচ্ছেদ – পূর্ব বাঙলায় কৃষক আন্দোলন

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – পূর্ব বাঙলায় কৃষক আন্দোলন 

১. ভূমি সংস্কার সম্পর্কে সারা ভারত কিষাণ সভার প্রস্তাব 

১৯৪৮ সালের ১৬ ও ১৭ই ফেব্রুয়ারী পশ্চিম বাঙলার বর্ধমান শহরে সারা ভারত কিষাণ কমিটির বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে ভূমি সংস্কার সম্পর্কে নিম্নলিখিত প্রস্তাব[১] গৃহীত হয় : 

“জমিদারী প্রথার ক্রমবর্ধমান চাপ এবং কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের মূল্যের মধ্যে পার্থক্যের জন্যে কৃষক সমাজ ও কৃষি শ্রমিকের দুর্দশা ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা দেশব্যাপী তীব্র খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং উত্তরোত্তর কৃষির অবনতি ঘটছে। অ-কৃষক জমিদারদের হাতে জমির কেন্দ্রীভবন গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। সারা দেশ বৎসরের পর বৎসর স্থায়ী খাদ্যসংকটের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করছে। কনট্রোল, রেশনিং, খাদ্যসংগ্রহ – সবকিছুই ধনী, পরগাছাসুলভ ও মুনাফাখোর জমিদারদের কুক্ষিগত থাকার ফলে ব্যর্থ হয়েছে। এই সংকটের সত্যিকার সমাধান সম্ভব একমাত্র এমন মৌলিক ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে যার মধ্যে ব্যবস্থা থাকবে : 

১. ক্ষতিপূরণ ছাড়াই সমস্ত প্রকার জমিদারী উচ্ছেদ করা এবং দরিদ্র মধ্যশ্রেণীর জমিদারদেরকে জীবিকা নির্বাহের এলাউন্স দেওয়া এবং বাজেয়াপ্তকরণের একটা সীমা নির্দিষ্ট করা যা নির্ধারিত হবে প্রাদেশিক কৃষক সমিতির দ্বারা। 

২. জমি যারা নিজেরা চাষ আবাদ করে তাদের মধ্যে জমি বিতরণ করা। 

৩. টাকা অথবা ফসলে সমস্ত প্রকার খাজনা ও অন্য ধরনের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার পরিবর্তে কৃষি আয়কর ব্যবস্থার প্রচলন করা। 

৪. সেচ ব্যবস্থার জাতীয়করণ এবং পানি, সার, বলদ, বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি পরিকল্পিতভাবে সরবরাহের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সাহায্য পরিকল্পনার অধীনে কৃষির উন্নতি সাধন; এবং 

৫. জমিদারদেরকে অপসারণের পর কৃষকদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সমবায় গঠনের মাধ্যমে বড়ো আকারের যন্ত্রপাতির সাহায্যে চাষাবাদকে উৎসাহ দান করা। 

এই ধরনের সংস্কারের সাথে সাথে দরকার বৃহৎ শিল্পগুলির জাতীয়করণ এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অল্প মূল্যে সরবরাহ এবং গ্রামের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার পরিপূর্ণ কর্মসংস্থানের জন্য সেগুলির পরিকল্পিত সম্প্রসারণ। 

কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সরকার কৃষকসমাজ ও কৃষি শ্রমিকদের প্রয়োজনের প্রতি পরিপূর্ণ নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছে। একদিকে যেমন কৃষক আন্দোলনকে দমন করার জন্যে সর্বপ্রকার নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং পুলিশকে বিশেষ ক্ষমতা দ্বারা সজ্জিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে সত্যিকার কৃষি সংস্কার প্রবর্তনের জন্য কিছুই করা হচ্ছে না। 

মাদ্রাজ ও বিহারে কংগ্রেস সরকার কৃষি সংস্কারের জন্য বিল তৈরী করেছে এবং আরও কয়েকটি প্রদেশে ঐ একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এই সমস্ত প্রস্তাবিত ব্যবস্থা কৃষকদের স্বার্থে নিয়োজিত হচ্ছে না, এগুলি কেবলমাত্র ধনী জমিদারদের স্বার্থেই নিয়োজিত থাকছে কারণ এর দ্বারা খোদ কৃষকের কাছে জমি হস্তান্তরের কেন্দ্রীয় সমস্যাটির কোন সমাধান হচ্ছে না। 

এই সমস্ত প্রস্তাবিত সরকারী ব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে সামন্ত জমিদারদেরকে পুঁজিপতি খামার মালিকে পরিণত হওয়ার এবং কোন না কোন উপায়ে মধ্য ও গরীব কৃষকদের জমি জবরদখল করে বড়ো আকারের খামার সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া। সরকার কায়েমী স্বার্থকে অন্যভাবে জিইয়ে রাখার জন্যে এইভাবে চেষ্টা করছে। 

কংগ্রেস সরকার কৃষি সংস্কারের যে সমস্ত পদক্ষেপ বিভিন্নভাবে প্রস্তাব করেছে সেগুলির সব কয়টিরই সাধারণ চরিত্র নিম্নরূপ: 

১. জমিদার উচ্ছেদ হচ্ছে না, জমিদারী ব্যবস্থার পরিবর্তে নূতন ধরনের জমিদারী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হচ্ছে যেমন, রাষ্ট্রীয় জমিদারী, রায়তওয়ারী ব্যবস্থা, সমবায় জমিদারী এবং ব্যাপক আকারের ব্যক্তিগত জমিদারী। 

২. বিপুল পরিমাণ জমির মালিক ব্যক্তিগত জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে না। অন্যদিকে খামারী জমি একত্রীকরণের নামে তাঁদেরকে নিজেদের জমি বাড়াতে উৎসাহ দান ও সহায়তা করা হচ্ছে। 

৩. গরীব কৃষক, জমির উপর স্বত্বহীন কৃষক, বর্গাদার ও কৃষি শ্রমিকদেরকে জমি দেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকার খোদ কৃষকদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদের জন্যে জমিদারদেরকে পুলিশ নিয়ে সাহায্য করছে। 

৪. কৃষকদের ভার লাঘব করার পরিবর্তে ক্ষতিপূরণের এক নূতন বোঝা জমিদারী স্বত্বের রাষ্ট্রীয়করণের উদ্দেশ্যে সমগ্র জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। 

উপরে উল্লিখিত ব্যবস্থাগুলির একমাত্র ফল হবে মুনাফাখোরদের হাতে জমি ও খাদ্য কেন্দ্রীভূত হওয়া এবং ব্যাপক আকারে কৃষক উচ্ছেদ। তার দ্বারা গ্রামীণ জীবন আরও বিপর্যন্ত এবং গ্রামে চোরাকারবার আরও জোরদার হবে। তার দ্বারা সকল স্তরের কৃষকরাই আঘাতপ্রাপ্ত হবে এবং ধনী জমিদাররা সহায়তা লাভ করবে। তার দ্বারা কৃষির উন্নতি হবে না, উপরন্তু মুনাফাখোর পরগাছাদের ও জমিদখলকারীদের হাত শক্তিশালী করে তাকে আরও জোরে গলাটিপে মারার ব্যবস্থা হবে। 

বিগত নির্বাচনে কংগ্রেস রাষ্ট্র ও খোদ কৃষকের মধ্যবর্তী স্বত্বাধিকারীদেরকে উচ্ছেদ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। কৃষকরা তখন বিশ্বাস করেছিলো যে কংগ্রেস সরকার কৃষকদেরকে জমি দিতে যাচ্ছে। কিন্তু এখন জমিদারী এলাকায় কংগ্রেস এমন ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে যার ফলে তথাকথিত মধ্যস্বত্বভোগীরা বিপুল পরিমাণ জমির মালিকে পরিণত হবে। স্বত্বহীন খোদ কৃষকরা পরিণত হবে ভূমিহীন কৃষকে। এই পরিবর্তনকে কার্যকর করার জন্য সমস্ত কৃষকসমাজকে ক্ষতিপূরণের ভার বহন করতে হবে। 

অন্যদিকে রায়তওয়ারী এলাকায় কোন সংস্কারই এখনো পর্যন্ত প্রস্তাবিত হয়নি। খোদ কৃষকদেরকে জমিদারদের দয়ার ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় ইউনিয়নের কৃষকদের ভাগ্য এই-ই হতে যাচ্ছে। 

পাকিস্তানে সরকার এখনো পর্যন্ত কোন সংস্কার ঘোষণা করেনি। সারা পাকিস্তানের কৃষি অর্থনীতিতে নির্দয় শোষণ, জমি দখল এবং বিশৃঙ্খলা চলছে। 

সারা ভারত কিষাণ কমিটি খোদ কৃষক, বর্গাকার ও কৃষি শ্রমিকদের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কিষাণ সভার মধ্যে নিজেদেরকে সংগঠিত করার এবং জমি, খাদ্য, উন্নতর জীবন ও কৃষির উন্নতির জন্য সংগ্রামকে জোরদার করার আহ্বান জানাচ্ছে। 

উপরে উল্লিখিত লক্ষ্যগুলিকে অর্জন করার জন্য এই সভা দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি ও জনগণের কছে আবেদন জানাচ্ছে। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ব্যতীত এগুলি সম্ভব নয়। সকল সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক মতাদর্শের কৃষকদেরকেই এই সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। উচ্ছেদ ও গ্রামীণ ঋণগ্রস্থতার বিরুদ্ধে এবং ফসলের ন্যায়সঙ্গত ভাগ, ফসলে ভূমি খাজনাকে টাকায় খাজনায় রূপান্তর, খাজনা হ্রাস ও কৃষিযোগ্য পতিত জমি গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কৃষকদেরকে সংগঠিত করার জন্য এই সভা প্রাদেশিক কিষাণ সভাগুলিকে নির্দেশ দিচ্ছে। 

খোদ কৃষকদেরকে জমি না দিয়ে জমিদারী রাষ্ট্রায়ত্ত করণের মাধ্যমে কৃষি সংস্কার সম্ভব হবে এই মর্মে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে যে ভুল ধারণার সৃষ্টি করছে তার বিরুদ্ধে এই কমিটি কৃষকদেরকে সাবধান করে দিচ্ছে। 

সত্যি অর্থে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ করতে হলে ‘জমিদারদের ব্যক্তিগত জমি বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং সেই সাথে স্বত্বহীন কৃষক, বর্গাদার ও ভূমিহীন কৃষকসহ যারা নিজেরা জমি চাষ করে তাঁদের মধ্যে জমি বিতরণ করতে হবে।” 

১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে সারা ভারত কৃষক সভা জমিদার বুর্জোয়া রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে কংগ্রেস ও লীগ নেতৃত্বে ভূমি সংস্কারের চরিত্র ও পরিণতি সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলো তা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো সেটা পূর্ব বাঙলা সরকারের ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইনের’ চরিত্র ও পরিণতির দিকে তাকালেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। জমিদারী ও সর্বপ্রকার ভূমি খাজনা ও কর উচ্ছেদের পরিবর্তে পূর্ব বাঙলায় রাষ্ট্র জমিদারে পরিণত হলো এবং পরবর্তী পর্যায়ে ভূমি খাজনার হার বহুলাংশে বৃদ্ধি করে সর্বস্তরের কৃষকদের ওপর খাজনার নির্যাতন অব্যাহত রাখলো। শুধু তাই নয়, এই আইনের মাধ্যমে ভূমি খাজনার সাথে সম্পর্কিত নানা ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রাও ১৯৫০ এর পর অনেক দিক দিয়ে বৃদ্ধি পেলো। 

জমিদারী উচ্ছেদের নামে ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ প্রণীত হওয়ার পূর্বে জমিদাররা দীর্ঘ দিন কৃষক আন্দোলনের ফলে অনেকখানি সংযত হতে এবং কৃষকদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিলো। কিন্তু জমিদারী সরকারী কর্তৃত্বাধীনে আসার পর সরকার ও সরকারী কর্মচারীরা নোতুনভাবে তাদের শোষণ ও নির্যাতনকে চালু করে। পূর্বে জমিদারদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্যে অথবা তাদের ওপর স্বাধীনভাবে চাপ সৃষ্টি করে অনেক সময় কৃষকরা খাজনা মাফ না হলেও খাজনা দাখিলের জন্যে সময় পেতো কিন্তু অস্থানীয় সরকারী কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সে রকম কোন সুযোগ কৃষকদের থাকলো না। এ ক্ষেত্রে যান্ত্রিকভাবে খাজনা আদায় শুরু হলো। কৃষকদের নামে বডি ওয়ারেন্ট, তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক, গবাদিপশু জবর দখল ইত্যাদি সমানে জারী থাকলো। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে জমিদার ও জমিদারদের কর্মচারীদের মতো সরকারী কর্মচারীরাও ঘুষের মাধ্যমে কৃষকদের থেকে নানা প্রকার বেআইনী আদায় শুরু করলো। 

বডি ওয়ারেন্ট, সম্পত্তি ক্রোক, হালের বলদ কেড়ে নেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার ও সরকারী কর্মচারীদের এই নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কৃষকরা এর পর পূর্বের থেকে অধিক হারে মহাজনের কাছে ঋণগ্রস্ত হতে শুরু করলো। ফলে যে জমি রক্ষার জন্য তাদেরকে মহাজনের দারস্থ হতে হচ্ছিলো তাদের সেই জমিই ঋণের দায়ে তাদের হাত থেকে মহাজনের হাতে উত্তরোত্তরভাবে চলে যেতে থাকলো। মোটামুটি এই হলো পূর্ব বাঙলায় তথাকথিত জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ব বাঙলার কৃষকদের সামগ্রিক সাধারণ অবস্থা। 

২. পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি 

১৯৪৮-এর ১৬ ও ১৭ই জানুয়ারী সারা ভারত কিষাণ কমিটির সভায় দেশ বিভাগের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় উপমহাদেশের দুই পৃথক রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে কৃষক সভাকে নতুনভাবে সংগঠিত করার প্রশ্ন আলোচিত হয় এবং এ বিষয়ে তাঁরা কতকগুলি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।[২] এই সিদ্ধান্তগুলি হলো: 

ক) দেশ বিভক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় কিষাণ সভাকে দুই অংশে বিভক্ত করা। ভারতীয় অংশে গঠিত কিষাণ সভার নাম হবে সারা ভারত কিষাণ সভা এবং পাকিস্তানে গঠিত কিষাণ সভার নাম হবে সারা পাকিস্তান কিষাণ সভা। 

(খ) এই দুই কিষাণ সভাই প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর সারা ভারত কিষাণ সভার সংবিধানটিকেই গ্রহণ করবে। 

(গ) সারা ভারত কিষাণ কমিটির সদস্যেরা ভারত ও পাকিস্তান যেখানে থাকবেন সেই হিসেবে দুই অংশের কমিটি তাঁদের দ্বারাই গঠিত হবে। 

(ঘ) কেন্দ্রীয় কিষাণ কাউন্সিলের যে সমস্ত সদস্যেরা ভারতে থাকবেন তাঁদেরকে নিয়েই নোতুন সারা ভারত কিষাণ সভার কেন্দ্রীয় কিষাণ কাউন্সিল গঠিত হবে। 

(ঙ) কিষাণ কমিটির যে সদস্যেরা পাকিস্তানে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা সুবিধামতো কোন স্থানে মিলিত হয়ে পাকিস্তানের জন্য নোতুন কেন্দ্রীয় কিষাণ কাউন্সিল গঠন করবেন। এর জন্য মনসুর হাবিবকে আহ্বায়ক মনোনীত করা হলো। 

(চ) এর পরবর্তী পর্যায় থেকে দুই দেশের কিষাণ সভা সম্পূর্ণ স্বাধীন দুটি সংগঠন হিসেবে কাজ করে যাবে। 

সারা ভারত কিষাণ কমিটির উপরোক্ত সিদ্ধান্তসমূহের পর সারা পাকিস্তান কিষাণ সভা গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভবপর হয়নি মূলতঃ ভৌগোলিক কারণে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে হাজার মাইলেরও বেশী দূরত্ব সে সময়ে সারা পাকিস্তান পর্যায়ে কৃষকসভা গঠনের ক্ষেত্রে ছিলো একটা দারুণ প্রতিবন্ধক। তাছাড়া পাকিস্তানের এই দুই অংশে কৃষক আন্দোলনের পরিস্থিতিও ছিলো অনেক স্বতন্ত্র। পূর্ব পাকিস্তানে তখন তে-ভাগা আন্দোলন শেষ হলেও কতকগুলি এলাকায় – যেমন সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা ও যশোরে ১৯৪৮ সালের প্রথম দিক থেকেই নোতুন আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। কিন্তু তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে সে ধরনের কোন কিষাণ আন্দোলনের অস্তিত্ব তখন ছিলো না। পরিস্থিতির এই পার্থক্যের জন্যে পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক সমিতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা তখন যেভাবে অনুভব হয়েছিলো এবং তা যতখানি জরুরী ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে তা ছিলো না। মোটকথা, কৃষক সভার বর্তমান বৈঠকের পর পূর্ব বাঙলায় যে কৃষক সমিতি গঠিত হয় তার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের কিষাণ সভার প্রকৃতপক্ষে কোন সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিলো না। কাজেই এই অংশের কৃষক সমিতি একটা প্রাদেশিক সংগঠন হলেও প্রকৃতপক্ষে তার সংগঠনগত সমস্ত কাজকর্মই স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতে থাকে। কৃষ্ণবিনোদ রায়কে সভাপতি এবং মনসুর হাবিবকে সম্পাদক নির্বাচিত করেও পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি পূর্বোক্ত বর্ধমান প্রস্তাব অনুযায়ী কৃষক আন্দোলনকে পূর্ব বাঙলায় সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। 

সারা ভারত কিষাণ সভার বর্ধমান বৈঠকে কংগ্রেস ও লীগ সরকার এবং কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে যে সমস্ত বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সেগুলি এই বৈঠকের প্রায় ছয় সপ্তাহ পরে (২৮শে ফেব্রুয়ারী) কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে গৃহীত সাধারণ সিদ্ধান্তসমূহের সাথে সাধারণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ।[৪] এর কারণ দ্বিতীয় কংগ্রেসে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো তার মোটামুটি লাইন ও কাঠামো ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই স্থিরীকৃত হয়। 

১৯৪২ সালের পর থেকে প্রধানতঃ কমিউনিস্ট পার্টির যুদ্ধ সংক্রান্ত নীতির[৫] কারণে অধ্যাপক রঙ্গ, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক প্রভৃতির মতো অ-কমিউনিস্ট ব্যক্তিরা কিষাণ সভা পরিত্যাগ করতে শুরু করেন এবং ১৯৪৫ সালে সারা ভারত কিষাণ সভার সভাপতি স্বামী সহজানন্দ কৃষক সভা থেকে পদত্যাগ করার পর কিষাণ সভা কমিউনিস্ট প্রভাবিত সংগঠন থেকে প্রায় পুরোপুরিভাবে কমিউনিস্টদের দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠনে পরিণত হয়।[৬] এজন্যে কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তসমূহ সারা ভারত কিষণ সভার ও পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সিদ্ধান্তসমূহ ও সাংগঠনিক কার্যকলাপকে পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দেশ বিভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তান উভয় অংশেই কমিউনিস্ট পার্টি সরকারী স্বাধীনতা উৎসবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করে এবং সরকারের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। কিন্তু এই আশ্বাস সত্ত্বেও উভয় অংশের সরকার নিজেদের উদ্যোগে তো নয়ই, উপরন্তু কমিউনিস্ট পার্টির উপর্যুপরি আহ্বান ও দাবী সত্ত্বেও সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দান করতে অস্বীকার করে। এর ফলে অসংখ্য রাজনৈতিক বন্দী, যার মধ্যে অধিকাংশই কমিউনিস্ট, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরও ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী থাকেন। 

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভবানী সেন, আব্দুল্লাহ রসুল প্রভৃতি কৃষক সমিতির নেতারা পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার কাছে একটি তথ্য সম্বলিত স্মারকলিপি[৭] পেশ করে একদিকে নিজেদের বিভিন্ন দাবী সরকারকে জানান এবং অন্যদিকে সরকারের সাথে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও রাজবন্দীদের মুক্তি হলো না। এই কারণে এবং আরও নানাভাবে উত্তরোত্তর সরকারের গণবিরোধী চরিত্র শ্রেণী সচেতন রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। যাঁরা এই সরকারের থেকে সামান্য কিছুও আশা করেছিলেন তাঁরাও হতাশাগ্রস্ত হলেন এবং তার ফলে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি রাজনৈতিক সংগ্রামকে নোতুনভাবে আবার সংগঠিত করতে সচেষ্ট হলো। 

পূর্ব বাঙলায় কৃষক সমিতি নোতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার পর ১৯৪৮ এর সেপ্টেম্বরে রংপুর জেলার লালমনিরহাট অঞ্চলে পূর্ব বাঙলার সমস্ত জেলা প্রতিনিধিদের একটা সম্মেলন হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি তৎকালীন নাজিমুদ্দীন সরকারের দ্বারা বেআইনী ঘোষিত না হলেও তাঁরা বাস্তবক্ষেত্রে এই দুই সংগঠনকে তখন বেআইনী সংগঠন হিসাবেই ধরে নিয়েছিলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের ওপর আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সাহায্যে ধরপাকড়সহ সব রকম নির্যাতন চালাতে শুরু করেছিলেন। এজন্যে এই সম্মেলন অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। [৮] 

তিন দিন স্থায়ী এই কৃষক প্রতিনিধি সম্মেলনে আন্দোলন সংক্রান্ত যে মূল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা হলো: 

(ক) নবাব জমিদারদের দ্বারা পরিচালিত মুসলিম লীগ সরকার স্বেচ্ছায় কখনো জমিদারী উচ্ছেদ করবে না। কাজেই কৃষিপ্রধান পূর্ব বাঙলায় সুকঠিন ও সুউচ্চ পর্যায়ের গণআন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমেই চিরস্থায়ী ভূমি ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করতে হবে।

(খ) সর্বাপেক্ষা সংগঠিত কৃষক অঞ্চলগুলি থেকে আন্দোলনের ঢেউ তুলতে হবে এবং তা একবার তুলতে পারলে পূর্ব বাঙলার সর্বত্র সেই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে।[৯] 

৩. পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষক সংগ্রাম 

১৯৪৮ এ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর থেকে ১৯৫০ এর প্রথম দিক পর্যন্ত পূর্ব বাঙলায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অনেক খণ্ড খণ্ড কৃষক সংগ্রাম ও বিদ্রোহ ঘটে। কিন্তু এই খণ্ড বিদ্রোহ ছাড়াও ময়মনসিংহ জেলার হাজং প্রধান এলাকায় কৃষক সংগ্রাম একটানাভাবে কয়েক বছর চলে এবং শুধু পূর্ব বাঙলোতই নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে, এই সংগ্রামের কথা ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পাক-ভারতের যে সমস্ত এলাকায় তখন বিপ্লবী সংগ্রাম দানা বাঁধে তার মধ্যে দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানাই ছিলো সব থেকে উল্লেখযাগ্যে এবং এই তেলেঙ্গানার পরই উল্লেখযাগ্যে ছিলো ময়মনসিংহের নেত্রকোনা মহকুমার সুসং দুর্গাপুরের হাজং প্রধান এলাকা। 

সেখানে মনি সিংহ এবং নগেন সরকারের নেতৃত্বে কৃষক বাহিনী এক বিস্তৃত এলাকা জুড়ে নিজেদেরকে খুব ভালভাবে সংগঠিত করে। এইভাবে তারা দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জোতদার, মহাজন এবং সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিরাধে আন্দোলন গঠন করতে এবং তাকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। ফলে তখন মনি সিংহের নাম পাকভারতীয় উপমহাদেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং হাজংদের সংগ্রাম অন্য এলাকার কৃষক শ্রমিকদেরকেও সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতে সাহায্য করে। 

হাজং কৃষকরা ছাড়াও সে সময় সিলেট এবং খুলনা, যশোর, রাজশাহী প্রভৃতি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলাতেও কৃষকরা সংগঠিতভাবে শোষক ও শাসকদের বিরুদ্ধে অনেক ছোটোখাট বিদ্রোহ করেন। তার মধ্যে একটির কথা এখানে উল্লেখ করা হলো। 

১৮ই অগাস্ট, ১৯৪৯ তারিখে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার এলাকার সানেশ্বরে কমিউনিস্ট পরিচালিত কৃষকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে[১]। এই সংঘর্ষের সময়ে কৃষকরা লাঠি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে পুলিশের গুলির সামনে এগিয়ে যান। পুলিশ এই কৃষকদের ওপর ৪২ রাউণ্ড গুলি ছোঁড়ে এবং তার ফলে ৬ জন কৃষক নিহত হন এবং ৩জন মহিলাসহ ৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।[২]

সিলেট জেলার এই অঞ্চলে সানেশ্বর নিহারী, উলুরী ইত্যাদি ছয় সাতটি গ্রামকে কমিউনিস্টরা একটি ঘাঁটি এলাকা হিসেবে গড়ে তোলেন। এই গ্রামগুলি বড়লিখা বিয়ানীবাজার থানা থেকে প্রায় সাত আট মাইল দূরে অবস্থিত। রাস্তাঘাটের সুবিধা না থাকায় গ্রামগুলি অন্য এলাকা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্নই বলা চলতো। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন দাস, নমশূদ্র গোত্রের লোক। এই এলাকায় সুরত পাল, তকত মুল্লা প্রভৃতি কয়েকজনের নেতৃত্বে প্রায়ই সভা সমিতি হতো এবং সেই সব সভা সমিতিতে কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা কাস্তে হাতুড়িওয়ালা লাল ঝাণ্ডা উড়তে দেখা যেতো।[৩] 

১৪ই অগাস্ট এই ধরনের একটি সভায় যখন তারা পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে লাল ঝাণ্ডা ওড়ায় তখন তা কিছুসংখ্যক মুসলমান গ্রামবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তারা বিয়ানীবাজার থানায় পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ গ্রামবাসীর মনোবেল এবং সংগঠিত শক্তির মোকাবেলা করতে না পেরে প্রথমে গ্রামে না ঢুকে বাইরে থেকেই ফিরে যায়।[৪] 

এরপর ১৬ই অগাস্ট বহুসংখ্যক সশস্ত্র পুলিসসহ সিলেটের ডি.এস.পি. এবং জেলা শাসক খান সাহেব আবদুল লতিফের সানেশ্বর রওয়ানা হওয়ার খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকার মুসলিম লীগ সমর্থক ও কর্মীরা অন্যান্য লোকজন এবং স্থানীয় আনসার বাহিনীকে সাথে নিয়ে তাদের সাথে সানেশ্বর বাজারে মিলিত হয়। সেখানে পৌঁছে তারা দেখে যে বাজারের পশ্চিম দিকের মাঠে কিছুসংখ্যক লোক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে দলে দলে আরও অনেক লোক লাঠি হাতে এগিয়ে এসে বাজারের কাছে সেই মাঠে এসে জড়ো হচ্ছে। গ্রামের পাশে যে ছোটে নদীটি ছিলো তার পাশেও অনেক লোককে দ্রুতগতিতে জমা হতে দেখা যায়। পশ্চিমের মাঠে কৃষকদের সংখ্যা অনেকখানি বৃদ্ধি পাওয়ার পর পুলিশ বাহিনী এবং মুসলিম লীগ সমর্থক জনতা আক্রমণের আশঙ্কা করে। এই অবস্থায় পুলিশের লোকজন রাইফেল হাতে কৃষকদের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে এবং বিদ্রোহী লাইন থেকে ঘন ঘন “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” ইত্যাদি ধ্বনি ওঠে[৫]।

এরপর ডি.এস.পি. নিজে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হাতের লাঠি ইত্যাদি ফেলে দিয়ে বিদ্রোহীদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। কিন্তু এর উত্তরে তারা পুলিশের কাছে তাদের রাইফেল ফেলে দেওয়ার দাবি জানান। এর পর ডি.এস.পি. কিছুটা পিছিয়ে এসে রাইফেলের দুটি ফাঁকা আওয়াজ করেন এবং তার পর বিদ্রোহীরা পুলিশের দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে আসেন। এই সময় পুলিশের অগ্রবর্তী দল থেকে প্রথম কৃষক বিদ্রোহীদের ওপর গুলি ছোড়া হয়।[৬] 

এরপর পুলিশের গুলি বর্ষণের মাত্রা বাড়ে এবং সামান্য সংঘর্ষের পর বিদ্রোহীরা অনেকেই নিহত এবং আহত হন। বিদ্রোহী বাহিনীও এই আক্রমণের ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং পুলিশ মুসলিম লীগ কর্মীদের সহায়তায় আহত ও পলায়মান অনেক কৃষককে ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার করে যাঁরা সেদিন গ্রেফতার হন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন মহিলাও ছিলেন। আহত এবং বন্দী কৃষকদেরকে এর পর বাহাদুরপুর আনসার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।[৭] 

এই ঘটনার পর ১৯শে আগস্ট স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতারা বাহাদুরপুর ক্যাম্পে হাজির হয়ে জেলা শাসক খান সাহেব আবদুল লতিফের সাথে আলাপ আলোচনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে “উদ্বুদ্ধ” করার ব্যবস্থা হয়।[৮] 

এ প্রসঙ্গে লাউতার স্থানীয় জমিদার শ্যামাপদর উদ্যোগ খুবই উল্লেখযাগ্যে। মুসলিম লীগ কর্মী ও পুলিশের সহযোগিতায় এই জমিদারটি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদেরকে আত্মসমর্পণ করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তার পর বহুসংখ্যক গ্রামবাসী ধীরে ধীরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। [৯] 

একই সাথে স্থানীয় মুসলিম লিগ কর্মীবৃন্দ এবং সামন্ত স্বার্থের খুঁটি উপরোক্ত হিন্দু জমিদার শ্যামাপদর উচ্চ প্রশংসা করে আরজদ আলী নামে উত্তর সিলেট মুসলিম লীগের একজন সহ-সভাপতি সানেশ্বরের ঘটনা সম্পর্কে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলে : 

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়াজেন যে এই ব্যাপারে মুসলিম লীগ ও জনসাধারণ যে কর্তব্য নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন তাহার ফল সুদূর প্রসারী বলিয়াই মনে হয়। শ্যামাপদবাবু যেভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া এই শান্তি কাজে সাহায্য করিয়াছেন তাহাও প্রশংসনীয়। [১০] 

সানেশ্বরের এই ঘটনার পরই স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ নিজেদের উদ্যোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং সেই তদন্তের রিপোর্ট সরাসরিভাবে সরকারের কাছে পেশ করা হয়। [১১] 

পূর্ব বাঙলার অন্যান্য যে সমস্ত এলাকায় এ ধরনের কৃষক বিদ্রোহ হয় সেগুলির মধ্যে উল্লেখযাগ্যে হলো খুলনা জেলার ধানিমুনিয়া, ডুমুরিয়া, যশোর জেলার নড়াইল থানার বড়ের দুর্গাপুর চাঁদপুর এবং সদর থানার এগারোখান ইউনিয়ন; এবং রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার নাচোল থানা। 

৪. পূর্ব বাঙলায় কৃষক আন্দোলনের এলাকা 

শকৃষক সমিতির লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধি সম্মেলনে আন্দোলন সংক্রান্ত যে দুটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তা সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে নির্ধারিত লাইনেরই অনুবর্তী। এক্ষেত্রে সুকঠিন ও সুউচ্চ’ গণআন্দোলনের অর্থ তাই সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম এবং সর্বাপেক্ষা সংগঠিত এলাকাগুলি থেকে আন্দোলনের ঢেউ তুললে তা অন্যান্য এলাকাতেও আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করবে এই প্রত্যাশার অর্থ দেশের জনগণকে, বিশেষতঃ কৃষক জনগণকে সামগ্রিকভাবে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে পরিচালনা করা যায় এই প্রত্যাশা। সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির এই নীতির ফলে নোতুন পরিস্থিতিতে সারা দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলনকে ধীরে ধীরে সংগঠিত না করে, কৃষক জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মানকে উচ্চতর পর্যায়ে তোলার জন্যে সুকঠিন আন্দোলন গঠনের প্রচেষ্টা না করে কৃষক সমিতি কতকগুলি নির্দিষ্ট এলাকায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে অন্যান্য এলাকার কৃষকদের মধ্যে সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রাম ছড়িয়ে দেওয়ার কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই নীতি ও কর্মসূচীর ফলে তৎকালীন কৃষক আন্দোলন কতকগুলি নির্দিষ্ট এলাকায় বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ হয়।

১৯৪৭ সাল থেকেই অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম হওয়ার পর থেকেই, পূর্ব বাঙলার সর্বত্র খাদ্য সংকট দেখা দেয় এবং ব্যাপক এলাকায় ১৯৪৯ সালের শেষ পর্যন্ত এবং পুনরায় ১৯৫১ সালে তা দুর্ভিক্ষের আকার পরিগ্রহ করে। কৃষক জনগণ দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মহামারী, খাজনার নির্যাতন ইত্যাদিতে জর্জরিত হতে থাকেন। সরকারী খাদ্য নীতির ফলে কর্ডন ও লেভীর অত্যাচারও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। বস্ত্র, কেরোসিন, ভোজ্য তেল ইত্যাদির দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্য বৃদ্ধি জনগণের সামগ্রিক অর্থনৈতিক জীবনকে চারিদিক থেকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এর ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই কৃষক জনগণ অতি দ্রুত মুসলিম লীগ সরকারের গণবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করেন এবং তাঁদের মধ্যে আন্দোলনের একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু উপরোক্ত সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি কোন গণআন্দোলন গঠন করতে উৎসাহী না হওয়ার ফলে জনগণের বিক্ষোভ কোন আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে না। জনগণের এই বিক্ষোভকে রাজনৈতিক ভাবে পরিচালনার মতো অন্য কোন রাজনৈতিক সংগঠনও তখন বিদ্যমান ছিলো না। কিন্তু __  সুযোগ তাঁরা পেতেন সেই সুযোগই যে জনগণ ব্যবহার করতে এগিয়ে আসতেন তার একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত ছিলো ১৯৪৯ সালের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল উপনির্বাচন।[১০ এই নির্বাচনে টাঙ্গাইলের জনগণ মুসলিম লীগের সমস্ত চাপ ও সংগঠিত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে বিরোধী প্রার্থী শামসুল হককে বিপুল ভোটাধিক্যে নির্বাচিত করেন।

কিন্তু মুসলিম লীগের স্বল্পকালীন শাসনের পরই জনগণের বিক্ষোভ ধীরে ধীরে এবং ক্রমাগত উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে উঠতে শুরু করলেও এবং মুসলিম লীগ সরকারকে উচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তা তাঁরা উত্তরোত্তর উপলব্ধি করলেও পাকিস্তানকে উৎখাত করার কোন চিন্তা সেই পর্যায়ে জনগণের একেবারেই ছিলো না। মুসলিম লীগ সরকার ও পাকিস্তানকে তাঁরা এক করে দেখতেন না, যদিও মুসলিম লীগ ক্রমাগত নিজেদেরকে সেইভাবে চিত্রিত করার চেষ্টাই করে যেতো। জনগণ সে সময়ে তাই মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সাড়া দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু পাকিস্তান উৎখাত করতে প্রস্তুত ছিলেন না।

কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি কিন্তু সে সময়ে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ এই ধ্বনি তুলে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্র উচ্ছেদ করারই আহ্বান বস্তুতঃপক্ষে জনগণের সামনে উপস্থিত করেছিলো। এই আহ্বান ব্যাপক জনগণের মধ্যে কোন সাড়া না জাগিয়ে উপরন্তু তাঁদেরকে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবাপন্ন করে তুলতেই সাহায্য করেছিলো। এবং জনগণের শত্রু মুসলিম লীগ সরকার সেই সুযোগকে অবহেলা না করে তাকে উপযুক্তভাবে ব্যবহারের দ্বারা কমিউনিস্টদেরকে হিন্দু ও ভারতের এজেন্ট হিসেবে চিত্রিত করে ব্যাপক জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে অনেকাংশে সফল হয়েছিলো। এই সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিলো এই যে, কৃষক সমিতি যে সমস্ত এলাকায় ১৯৪৮-৫০ সালে কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত ও পরিচালনা করেছিলো সেগুলি প্রধানতঃ ছিলো আদিবাসী, নমঃশূদ্র ও সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা। 

৫. সিলেটে জমিদারী ও নানকার প্রথা বিরোধী আন্দোলন 

সমগ্র আসাম প্রদেশ জুড়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত না হলেও কাছাড়ের একাংশ এবং সমগ্র সিলেট জেলা ছিলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্তর্গত। এই অঞ্চলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয় পরের দিকে। বন্দোবস্তের সময় এই অঞ্চল জঙ্গলাকীর্ণ ছিলো, সেজন্যে অনেক ছোট ছোট তালুকদারকে জমি সরাসরি সরকার বন্দোবস্ত দিয়েছিলো। এইসব তালুকদাররা ধনী ছিলো না, কিন্তু তাঁরা আবার কারো প্রজাও ছিলো না। 

এই সমস্ত তালুকদাররা ধনী না হলেও তাদের শোষণ ও অত্যাচার যথেষ্ট ছিলো। প্রত্যেক বৎসরই তারা নতুনভাবে প্রজা বন্দোবস্ত করতো। এই বাৎসরিক বন্দোবস্তের জন্যে বাড়ীতে স্বরোপিত গাছের ফলের ওপরও কৃষকদের কোন অধিকার থাকতো না। জমির ওপর সমস্ত কিছুতেই তালুকদার এবং অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ ভূস্বামীদের (জমিদার, মীরাসদার) অধিকারকে খর্ব করার কোন ব্যবস্থা এই প্রথায় ছিলো না। এজন্যে ভূস্বামীদের যে কোন ধরনের জমির ওপর কিছু করতে গেলেই তাদেরকে সালামী না দিয়ে তা সম্ভব ছিলো না। 

এ সব জমির খাজনা তুলনায় অল্প হলেও বে-আইনী আদায় এখানে প্রচুর ছিলো। জমির পরিমাণ অল্প এবং জমির চাহিদা বেশী থাকায় কৃষকদেরকে সব রকম হীন শর্ত এবং জোর জুলুম স্বীকার করে নিয়েই জমির ব্যবস্থা নিতে হতো। কৃষকদেরকে হাটবাজারের তোলা, ঘাটের তোলা (খুটগাড়ী) তো দিতেই হতো উপরন্তু যে জলমহলে পূর্বে অবাধে মাছ ধরার অধিকার তাদের ছিলো সেখানেও পরবর্তীকালে মাছ ধরতে গেলে জমিদারকে সালামী না দিয়ে তা সম্ভব হতো না। জমিদারের কাছারীতে প্রজাদের বসার ব্যবস্থা ছিলো মাটিতে।

এই অবস্থায় সিলেটে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন মূলতঃ প্রজাস্বত্ব নিয়েই শুরু হয়। পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সিলেট আসাম প্রদেশের অন্তর্গত ছিলো। আসামে সারা দেশ জুড়ে কোন কৃষক সংগঠন ছিলো না। কেবলমাত্র কাছাড় ও সিলেট জেলাতেই কৃষক সভার সংগঠন ছিলো এবং এই দুই জেলার কৃষক সভা একত্রে ‘সুরমা উপত্যকা কৃষক সভা’ এই নামে প্রাদেশিক কৃষক সভা হিসেবে সারা ভারত কৃষক সভার সাথে সংযুক্ত ছিলো।[১১] 

সুরমা উপত্যকা কৃষক সভার উদ্যোগে এই অঞ্চলে প্রথম প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন হয় ১৯৩৬ সালে বেহেলীতে। ১৯৩৭ সালে কোন সম্মেলন না হলেও ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রতি বৎসরই প্রাদেশিক সম্মেলন সিলেট ও কাছাড়ের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর দাসের বাজারে সিলেট জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের অক্টোবর মাসে। কৃষক সমিতি বে-আইনী প্রতিষ্ঠান ঘোষিত না হলেও কার্যক্ষেত্রে সরকার কৃষক সমিতিকে একটি বেআইনী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই মোটামুটি দেখতো। কাজেই পাকিস্তানোত্তর এই প্রথম জেলা সম্মেলন গোপনীয়তার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।[১২] 

সুরমা উপত্যকা কৃষক সভার নেতৃত্বে ১৯৩৭-৩৮ সাল থেকে সিলেট জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারী অত্যাচার বন্ধ এবং প্রজাস্বত্ব অর্জনের জন্যে ব্যাপক এবং অনেকক্ষেত্রে সশস্ত্র আন্দোলনও শুরু হয়। এই সব আন্দোলনের মধ্যে বংশীকুণ্ডা আন্দোলন, ভাটিপাড়া আন্দোলন, শাফেলা আন্দোলন, দাসের বাজার আন্দোলন, বৈঠাখালি আন্দোলন এবং হাজং ও নানকার আন্দোলন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এইসব আন্দোলনই মোটামুটিভাবে প্রজা উৎখাত, বেআইনী আদায়, শারীরিক নির্যাতন, কাছারীর অপমানজনক ব্যবহার, জমিদারের দাসত্ব ইত্যাদির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। 

ইংরেজ আমলেই কৃষক আন্দোলনের ফলে জমিদার, মীরাসদার, তালুকদারদের অত্যাচার এই সব অঞ্চলে কিছুটা কমে এলেও নির্যাতন একেবারে বন্ধ নয় নাই। ১৯৪৮ সাল থেকে প্রায় দুই বৎসর স্থায়ী যে কৃষক আন্দোলন সিলেট জেলায় শুরু হয় এই জেলার হাজং অঞ্চলের কৃষক এবং নানকার প্রজারাই ছিলেন তার মূল শক্তি। 

হাজং অঞ্চলের আন্দোলন: ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহকুমার উত্তর পশ্চিম সুসং- দুর্গাপুর থেকে শুরু করে সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার উত্তর পূর্বে ছাতক পর্যন্ত ছিলো আদিবাসী হাজং অধ্যুষিত এলাকা। কিন্তু ময়মনসিংহ জেলার হাজং এলাকার মতো সিলেট জেলার হাজং এলাকায় টঙ্ক প্রথা প্রচলিত না থাকায় সেখানকার হাজং আন্দোলনের মূল দাবীগুলি ছিলো কিছুটা স্বতন্ত্র। 

সিলেটের হাজং এলাকার ব্যাপক অংশ ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরের মহারাজার অন্তর্গত ছিলো। জমিদারী কাছারীর অত্যাচার, জমি থেকে উচ্ছেদ, কৃষকদের অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে হিসেবের গণ্ডগোল, নানাপ্রকার বেআইনী আদায় ইত্যাদিই ছিলো এই এলাকার কৃষক আন্দোলনের মূল সমস্যা। এই সব সমস্যাকে কেন্দ্র করে সিলেটের হাজং এলাকায় কৃষক আন্দোলনের নোতুন সূত্রপাত হয় ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণায় কিষাণ সভার সারা ভারত সম্মেলনের সময়। 

বিসরপাশার কাছারীর এলাকায় কালীচরণ (বৈষ্ণব) নামে এক কৃষকের ৭ হাল জমি ছিলো। নানাপ্রকার অন্যায় আদায়, হিসেবের গণ্ডগোল ও জোরজুলুমের ফলে কালীচরণের ৭ হাল জমির ৩ হাল জমিদারের হস্তগত হয়। নেত্রকোণা সম্মেলনের ঠিক পূর্বেই বিসরপাশা জমিদার কাছারীর বিরুদ্ধে খোদ জমিদারের কাছে নালিশ করতে কালীচরণ গৌরীপুর রওয়ানা হন। রওয়ানা হওয়ার পরই মধ্যপথে তার সাথে কৃষক সভার কর্মীদের দেখা হয়। জমিদারের কাছে আবেদন নিবেদন করা যে নিষ্ফল একথা তাঁকে বোঝানোর পর কালীচরণ কৃষক কর্মীদের সাথে নেত্রকোণায় যান এবং সেখান থেকে কৃষক নেতা মণি সিংহ-এর একটি চিঠি নিয়ে সুনামগঞ্জ উপস্থিত হন। কালীচরণকে আইনগত সাহায্য দেওয়া যায় কিনা সেটা বিবেচনার জন্যই মণি সিংহ সুনামগঞ্জ কৃষক সভাকে অনুরোধ জানান। সুনামগঞ্জ উত্তর কৃষক সভার সহ-সভাপতি চন্দ্রবিনোদ দাস নিজে উকিল ছিলেন এবং তিনি নিজেই কালীচরণের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। মামলায় শেষ পর্যন্ত কালীচরণের পক্ষেই রায় হয়। এদিকে কালীচরণের আচরণে রুষ্ট হয়ে জমিদার পক্ষ কালীচরণের জমি দখলের উদ্দেশ্যে লোক লস্কর হাতী ইত্যাদি নিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে স্থানীয় কৃষক সংগঠনের ও আন্দোলনের পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই কৃষকরা কৃষক সভার নেতৃত্বে জমিদার কর্তৃক এই জমি দখল প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন। কালীচরণের স্ত্রী বঁটি ও ঝাঁটা হাতে জমির আলে প্রতিরোধের জন্যে দাঁড়ান। তার পেছনেই থাকেন কৃষক সভার কর্মীরা এবং কালীচরণ ও গ্রামের অনেক সহানুভূতিশীল অধিবাসী। জমিদারের লোকজন এই প্রতিরোধ দেখে বিরত না হয়ে কালীচরণের স্ত্রীর ওপর আঘাত করার জন্যে হাতিকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে কৃষক সভার কর্মীরা সমবেতভাবে চোঙ্গার সাহায্যে জমিদারী নির্যাতন বিরোধী নানান শ্লোগান দিতে শুরু করেন এবং অন্যান্যরা তার সাথে যোগ দেন। এই চীৎকার কোলাহলে ভীত হয়ে হাতিগুলি পিছন ফিরে পলায়ন করে। এভাবেই সেদিন এই অঞ্চলে জমিদার কর্তৃক বেআইনী ও জবরদস্তিমূলক জমিদখল কৃষকদের দ্বারা সমষ্টিগতভাবে প্রতিরোধ হয়। এর ফলে স্থানীয় কৃষকদের কৃষক সভার প্রতি আস্থা এবং আন্দোলনের শক্তির প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। কৃষক সভার কাজও এর পর এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে শুরু হয়। কালীচরণের খাজনা জমিদারী কাছারীতে জমা না দিয়ে ডাক মারফত প্রেরিত হতে থাকে এবং কাছারীর নির্যাতন পূর্বের তুলনায় অনেকখানি কমে আসে।[১৩] 

এই এলাকায় কৃষক আন্দোলনের নেতা ছিলেন রবি দাস, লালা শরদিন্দু দে, অনিমা দাস, জ্ঞান দাস, প্রমোদ দাস, কালীচরণ (বৈষ্ণব) হাজং, ব্রজেন্দ্র হাজং, উনেশ্বর হাজং, আনীত গারো, যতীন্দ্র দাস ও কৃষ্ণলাল সরকার।[১৪] 

সিলেটের হাজং এলাকার একটি মূল সমস্যা ছিলো মহাজনদের কাছে কৃষকদের জমি বন্ধক। ১৯৪৬-৪৭ সালের দিকে কৃষক সভা এই সমস্যার প্রতি নজর দেয়। ঋণের দায়ে জমি বন্ধক এবং জমির ফসল দখলের কোন আইনগত ভিত্তি ছিলো না। কিন্তু এই বেআইনী জুলুমই জমিদাররা হাজং কৃষকদের ওপর করতো। এই জমি দখল এমন পর্যায়ে গিয়েছিলো যে অনেক সময় মাত্র দশ বিশ টাকা দেনার দায়েও কৃষকদের জমি মহাজনরা হস্তগত করে তার ওপর ফসলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতো। জমি দখলের এই ব্যবস্থা এই এলাকায় এমনই একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিলো যে, সরল হাজং কৃষকরা একেই স্বাভাবিক নিয়ম মনে করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কোন চিন্তা করতো না এবং তাকেই মেনে চলতো। এই অঞ্চলের মহাজনরা ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। 

মহাজন কর্তৃক জমি দখলের এই রীতি যে একটা বেআইনী জুলুম একথা হাজং কৃষকদের বোঝাতে কৃষক সভার কর্মীদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষক সভার কর্মীরা ধৈর্য সহকারে অগ্রসর হওয়ার ফলে বছর খানেকের মধ্যেই এ ব্যাপারে কৃষকদেরকে বোঝাতে তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন। এবং তার ফলে ১৯৪৭ সালের দিকেই সর্বপ্রথম এই অঞ্চলে হাজং কৃষকদের দ্বারা বন্ধকী জমি দখল শুরু হয়। এর পর অতি অল্পকালের মধ্যেই পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলার সীমায় মহিষখোলা থেকে পূর্বে বড়োছড়া (টাংওয়ার হাওড়ের উত্তর পাড়) পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে দশ-পনেরো মাইল ও প্রস্থে চার-পাঁচ মাইল এলাকা জুড়ে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।[১৫] 

ঠিক এই সময়েই দেশ বিভক্ত হয়ে সিলেট জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। দেশ বিভাগের পর ভারতীয় সীমান্ত বরাবর এই অঞ্চলে পাঁচ মাইল অন্তর পুলিশ ঘাঁটি স্থাপিত হয়। এই সুযোগে পুলিশ ঘঁটিকে হাত করে হিন্দু মহাজনরা বাইরে থেকে মুসলমান চাষীদেরকে এনে জমিতে বসিয়ে হাজংদেরকে জমি থেকে উৎখাত করতে চেষ্টা করে। 

এই ভাবে বহু জায়গায় তাঁরা হাজং কৃষকদের জমি দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এই সব নবাগত কৃষকদের সাথে পার্টি অনেক সভা এবং আলাপ-আলোচনা করে তাঁদেরকে বোঝাবার চেষ্টা করে কিন্তু তাতে কোন ফল হয় না। দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তখন মামলা মোকদ্দমারও সুযোগ সুবিধা তেমন না থাকায় স্থানীয় সংগ্রামের মাধ্যমেই কৃষক সমিতি এই জমি দখল প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রতিরোধ যে সশস্ত্র প্রতিরোধ ব্যতীত সফল হওয়া সম্ভব নয়, সে বিষয়েও কৃষক সমিতি নিশ্চিত হয়। এ জন্যে কৃষকদেরকে সংগঠিত করে তাঁরা কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। [১৬] 

কৃষক সমিতির নেতৃত্বে হাজং কৃষকরা সশস্ত্রভাবে নিজেদের জমি পুনর্দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে একথা জেনে দখলকারী মুসলমান কৃষকরা জমির বেআইনী দখল ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। এই প্রাথমিক সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে স্থানীয় হাজং কৃষকরা এবং কৃষক সমিতি সশস্ত্র বাহিনী রীতিমতো নোতুনভাবে গঠন করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। 

স্থানীয় হাজং গারো প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সম্পন্ন লোকদের কাছে শিকার, আত্মরক্ষা ইত্যাদির জন্যে কিছু সংখ্যক গাদা বন্দুক ছিলো। কৃষকবাহিনী সেগুলি জোরপূর্বক দখল করে নেওয়ার পর তাঁদের হাতে ৫০টি বন্দুক আসে যার মধ্যে একটি কার্তুজ বন্দুকও ছিলো। বাইরের আক্রমণ আশঙ্কা করে এর পর থেকে গ্রামগুলিতে সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ১৭ এইভাবে কৃষকবাহিনী গঠিত হওয়ার পর বাহিনীর মূল ঘাঁটি সীমান্তের ওপারে পার্শ্ববর্তী ভারতীয় এলাকার জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। যে এলাকায় ঘাঁটি স্থানান্তর হয়েছে সেখানকার অধিবাসীরা ছিলো খাসি পার্বত্য জাতি এবং এলাকাটি ছিলো পার্বত্য জাতীয় রাজা (সিম) এর রাজ্য। কৃষক বাহিনীর উপস্থিতিতে রাজা ভীতগ্রস্ত হয়ে উঠলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকে। কৃষকবাহিনীও তার সাথে কোন সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না। এর ফলে সীমান্তের ওপারে ঘাঁটি এলাকায় পরিস্থিতি শান্ত থাকে। সেখানকার স্থানীয় লোকদের মনে বিশ্বাস জন্মায় যে কৃষকবাহিনী গরীবদের বন্ধু এবং সেই হিসেবে তাঁরা বাহিনীকে সমর্থনও করে। ওপারের বর্ডার গার্ডরাও বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশেষ কোন আক্রমণাত্মক তৎপরতা না চালালেও কয়েকবার তাঁরা বাহিনীর লোকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু এই উত্তেজনা সত্ত্বেও বাহিনীর তরফ থেকে সে সবের কোন পাল্টা জবাব দেওয়া হতো না। একবার বর্ডার গার্ডের মুখোমুখি পড়ে বাহিনীর সদস্য যতীন্দ্রনাথ দাস ও লালা শরবিন্দু দে তাঁদের হাতে গ্রেফতার হন এবং সীমান্ত আক্রমণকারী হিসেবে তাঁদেরকে শিলং- এ চালান দেওয়া হয়। সেখানে কয়েকদিন সাজা খাটার পর তাঁরা ছাড়া পান এবং আবার ঘাঁটি এলাকায় ফিরে আসেন।[১৮] 

কৃষকবাহিনীকে এইভাবে সংগঠিত ও তৎপর হতে দেখে পূর্ব পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনীও নিজেদের সক্রিয়তা ও তৎপরতা বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন এলাকার হাজং গ্রামগুলিতে তারা তল্লাশী চালাতে থাকে কিন্তু বাহিনীর ভয়ে রাত্রিতে তারা নিজেদের ঘাঁটি ছেড়ে বাইরে বের হতে সাহস করতো না। তাদের যা কিছু তৎপরতা তা দিবাভাগেই সীমাবদ্ধ থাকতো। এই অবস্থাতে তাদের সাথে কৃষকবাহিনীর কয়েকটি সংঘর্ষ হয় কিন্তু বাহিনী এসব ক্ষেত্রে আত্মরক্ষামূলক কৌশল অবলম্বন করায় তাঁদের কোন ক্ষতি হয়নি অথবা কেউ এর ফলে হতাহত হয়নি।[১৯] 

কৃষকবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্থানীয় হাজং গারো এবং জমিদারের কর্মচারীদের মধ্যে কিছু কিছু দালালের সৃষ্টি হয়। তারা জমিদার ও পুলিশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কৃষক আন্দোলন ও কৃষকবাহিনীর বিরুদ্ধতা ও ক্ষতিসাধন করতে চেষ্টা করে। এই অবস্থায় কৃষকবাহিনী দালাল খতমের কর্মসূচী গ্রহণ করে। একজন গারো এবং বিসরপাশা কাছারীর একজন কর্মচারী ও একজন পাইক দালালীর কারণে কৃষকবাহিনীর হাতে খতম হয়। তাদের মৃতদেহ সীমান্তের অপর পারে ভারতীয় এলাকায় ফেলে আসা হয়। এই ধরনের একটি ঘটনায় বর্ডার গার্ডের গুলিবর্ষণের ফলে রবি দাস সামান্য আহত হন।[২০] 

সেসময় কৃষকবাহিনীকে দিনে বসতিপূর্ণ গ্রাম এলাকায় রাখা হতো না। তারা পাহাড়ি অঞ্চলে থাকতেন এবং রাত্রিকালে গ্রামাঞ্চলে নেমে আসতেন। স্থায়ী কৃষকদের ব্যাপক ও সহজ সহযোগিতায় এইভাবে পার্টি গ্রামের শাসন ব্যবস্থা চালাতো। পাটি গ্রাম্য আদালতের মাধ্যমে বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা করতো এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতো। [২১] 

তখন বস্তুতঃপক্ষে কৃষকসমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কোন পার্থক্য ছিলো না। কৃষক সমিতির মধ্যে কোন অকমিউনিস্টই এ পর্যায়ে না থাকার ফলে কমিউনিস্টদের দ্বারা তা সর্বতোভাবে পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হতো। কমিউনিস্টরাও মোটামুটিভাবে পার্টির নামেই সব কিছু পরিচালনা করতেন। হাজং কৃষকরা এই সময় ভয়ানক পার্টিভক্ত ছিলেন এবং পার্টির নির্দেশ মেনে চলার ক্ষেত্রে তাঁরা কোন গাফিলতী করতেন না। [২২] 

সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায় নিযুক্ত থাকার জন্যে পার্টি সিলেটের এই হাজং এলাকায় বাহিনীর জন্যে নিয়মিত রসদ সংগ্রহ করতো এবং অস্ত্রশস্ত্রের কারখানা স্থাপন করে নিজেরাই কিছু কিছু অস্ত্র তৈরী করতো। এই কারখানায় বোমা, বারুদ, পাইপ গান, পাইপ পিস্তল ইত্যাদি তৈরী করা হতো। নিয়মিত বাহিনীতে ১৫০ জনের মতো ছিলো কিন্তু তা ছাড়াও প্রত্যেক গ্রামের নিজস্ব অক্সিলিয়ারী বাহিনীও ছিলো। এদের হাতে বন্দুক ছিলো ৭০/৮০টি। এই সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন রবি দাম। [২৩] 

তৎকালীন সারা পূর্ব পাকিস্তান এবং বিশেষতঃ ময়মনসিংহের হাজং এলাকা ও সিলেটের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই হাজং এলাকাতেও সরকারের খাদ্য সংগ্রহের বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং এ ক্ষেত্রেও কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টি কৃষকদের সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একদিকে সরকারী কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারমূলক লেভী নির্ধারণ এবং অন্যদিকে লেভীর ধান জমা দেওয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে বর্ণনাতীত হয়রানিই এ সময় শুধু হাজং এলাকার কৃষকদেরকে নয়, সামগ্রিকভাবে কৃষক সমাজকে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এ সময়ে তাই কৃষকরা ব্যাপকভাবে ‘জান দিবো, তবু ধান দিবো না’ এই ধ্বনি তুলে নির্যাতনমূলক সরকারী লেভীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে অবতীর্ণ হন। এছাড়া জমিদার, জোতদার, মহাজনদেরকে ধান না দিয়ে তারা দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে অনেক ধান বিতরণের কর্মসূচী গ্রহণ করেন। এই কর্মসূচী অনুযায়ী দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে অনেক ধান বিতরণ করা হয়। এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন রবি দাম। 

এই ধান বিতরণের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ১৯৪৯ সালের ২৬শে মার্চ (১২ই চৈত্র, ১৩৬৫) রবি দাম পুলিশবাহিনীর হাতে নিহত হন। 

মোহনপুর গ্রামে ধান বিতরণের উদ্দেশ্যে সেখানে যাওয়ার জন্যে খবর আসায় রবি দাম, প্রমোদ দাস, কালীচরণ এবং উনেশ্বর একত্রে মোহনপুরের দিকে রওয়ানা হন। প্রমোদ দাসের শরীর অসুস্থ থাকায় গঙ্গানগর পর্যন্ত পৌঁছানোর পর তিনি সেদিনের মতো যাত্রা বন্ধ রেখে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু রবি দাম তাতে সম্মত না হয়ে বাকী দুজনকে সাথে নিয়ে মোহনপুরের দিকে অগ্রসর হন। এর পর প্রমোদ দাসও ফিরে না গিয়ে কিছুক্ষণ পর রওয়ানা হয়ে তাঁদের সাথে মোহনপুরে মিলিত হন। সেখানে কয়েকজন মাতব্বর তাঁদেরকে জানায় যে তারা গ্রামের সমস্ত লোক জড়ো করে আনার জন্যে যাচ্ছে এবং তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত তারা যেন অপেক্ষা করেন। 

এই সময় স্থানীয় কৃষক কর্মীরা তাঁদেরকে জানান যে গ্রামের পরিস্থিতি ভালো নয়, কারণ গ্রামের মোড়লদেরকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। এই কৃষক কর্মীরা আশঙ্কা করেন যে এই মোড়লরা রবি দাম ও অন্যান্যদের উপস্থিতির খবর দেওয়ার জন্যে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে গেছে। কৃষক কর্মীরা গ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে বারবার তাঁদেরকে বলার পর রবি দাম ও প্রমোদ দাস মোহনপুরের নিকট স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পের দিকে যান। পুলিশ ক্যাম্পে কোন রকম চাঞ্চল্যের পরিবর্তে সম্পূর্ণ নীরবতা লক্ষ্য করে তাঁরা দুজনেই সিদ্ধান্ত করেন যে পুলিশের থেকে তখনকার মতো কোন বিপদের আশঙ্কা নেই। তাঁরা আরও স্থির করেন যে মোহনপুরের কাজ শেষ করে ফিরে যাওয়ার পথে তাঁরা পুলিশ ক্যাম্পটি আক্রমণ করবেন।

কিন্তু পুলিশ ক্যাম্পের অবস্থা দেখে মোহনপুর ফিরে এলে কৃষক কর্মীরা আবার তাঁদেরকে সাবধান করে দিয়ে জানান যে, তখন পর্যন্ত গ্রামের মোড়লদেরকে গ্রামে পাওয়া যাচ্ছে না। এই খবর পাওয়ার পর প্রমোদ দাস রবি দামকে বলেন সেদিনের মতো তাড়াতাড়ি মোহনপুর পরিত্যাগ করে চলে যাওয়াই তাঁদের কর্তব্য, কারণ পুলিশ তাঁদেরকে আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু রবি দাম তাতে সম্মত না হয়ে বলেন যে নিকটস্থ পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশ তাঁদেরকে আক্রমণ করবে না। দুই জনে মতবিরোধ হওয়ায় প্রমোদ দাস বলেন যে, তাদের অন্য দুইজন সাথীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে তাঁদের মতামত নেওয়া হোক এবং সেই মতো কাজ করা হোক। সেই অনুযায়ী অন্য দুজনের মতামত চাওয়ায় জানা প্রমোদ দাসের সাথে একমত হন এবং বলেন যে সেদিনকার মতো মোহনপুর পরিত্যাগ করাই কর্তব্য এর পর প্রমোদ দাস রবি দামকে বলেন আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে তৎক্ষণাত এলাকা পরিত্যাগ করা দরকার কারণ যে কোন মুহূর্তে তাঁদের ওপর আক্রমণ শুরু হতে পারে। এই সব আলোচনা যেখানে হচ্ছিলো তার মাত্র কয়েকঘর পরই ছিলো মনীকান্ত নামে একজনের বাড়ী সেখানে তাঁদের চারজনেরই রাত্রে খাওয়ার কথা ছিলো। রবি দাম মনীকান্তের বাড়ী হয়ে যাওয়ার কথা বললে প্রমোদ দাস তাতে আপত্তি জানিয়ে বলেন যে সেদিক দিয়ে গেলে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত না করে রবি দাম মনীকান্তের বাড়ীর দিকে রওয়ানা হন এবং সেখানে গিয়ে তাঁকে জানান যে তার বাড়ী রাত্রে তাঁদের আর খাওয়া সম্ভব নয়, তাঁদেরকে তাড়াতাড়ি গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। মনীকান্ত কিন্তু তাঁদের খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, শেষ হয়ে গেছে একটু বিলম্ব করুন। এই কথার সাথে সাথেই পুলিশের গুলি তাঁদেরকে লক্ষ্য করে কিছুদূর থেকে বর্ষিত হতে থাকে। 

সে সময় কৃষক গেরিলাবাহিনীর লোকেরা প্রায় সব সময়েই সশস্ত্র অবস্থায় চলাফেরা করতেন এবং নেতারা যাতায়াতকালে সশস্ত্র গার্ডও তাঁদের সাথে থাকতো। এজন্যে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে রবি দাম এবং অন্যান্যদের মোহনপুর উপস্থিতির খবর পেয়ে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ না করে সতর্কভাবে গ্রামে তাঁদেরকে ঘেরাও করে। তাদের এই সতর্কতার জন্যেই তাঁরা পুলিশ ক্যাম্পে কোন রকম উত্তেজনা লক্ষ্য করেননি এবং সেখানকার শান্ত অবস্থার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। 

গুলি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই উনেশ্বর ও কালীচরণ দৌড় দিয়ে সেখান থেকে পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। এই অবস্থায় প্রমোদ দাস রবি দামকে বলেন যে তাঁদের উচিত তৎক্ষণাৎ অন্যদের মতো সেখান থেকে চলে যাওয়া। কিন্তু তিনি সে কথায় কর্ণপাত না করে বলেন, গুলি যাতে গায়ে না লাগে সেভাবে নিজেকে রক্ষা করো। প্রমোদ দাস আবার তাঁকে বলেন যে তিন দিক থেকে গুলি আসছে শুধু একদিক খোলা আছে, সেদিক দিয়েই আমরা পালায়ন করি। রবি দাম তাতে সম্মত না হয়ে বলেন, ঐ শয়তানদেরকে ধরতে হবে। এই কথার পর তিনি এবং প্রমোদ দাস দুজনেই মাটিতে শুয়ে বুকে হেঁটে পুলিশদেরকে ধরার জন্যে অগ্রসর হন এবং তাদের কাছাকাছি পৌঁছে, তাদেরকে ধরেও ফেলেন। পুলিশ হাবিলদারকে ধরে চীত করে ফেলে রবি দাম তাকে হত্যার জন্যে নিজের ছুরি বের করেন। এবং তার কণ্ঠনালিতে বসিয়ে দেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আর একজন পুলিশ রবি দামকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েকবার গুলি বর্ষণ করে এবং তিনি তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। 

এদিকে প্রমোদ দাস অন্য এক পুলিশের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে তার রাইফেল ছিনিয়ে নেন এবং চীৎকার করে রবি দামকে বলেন যে, আমি একটা রাইফেল কেড়ে নিয়েছি, চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে রবি দামের দেখা অথবা তাঁর কোন জবাব না পেয়ে অল্পক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি ভাবলেন যে অন্য দুজনের মতো তিনিও চলে গেছেন। কিন্তু অল্প কিছুদূর গিয়েই তিনি গ্রামের তিরিশ পঁয়ত্রিশ জন লোকের দ্বারা ঘেরাও হয়ে ধরা পড়েন। তারা তাকে লাঠি দিয়ে ভয়ানকভাবে প্রহার শুরু করে। অল্পক্ষণের মধ্যে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয় এবং তারাও তাকে আক্রমণ করে। প্রমোদ দাস একা কিছুক্ষণ তাদের সাথে হাতহাতি লড়াই করে শেষে তাদেকে বলেন, তোমরা আমাকে গ্রেফতার করো। তারা তাকে গ্রেফতার করার পরও তাদের মার না থামিয়ে প্রহার করতে করতে তাকে অজ্ঞান করে দেয়। এর পর তাকে মৃত মনে করে তারা পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পুলিশ ক্যাম্পে প্রমোদ দাসের জ্ঞান ফিরে আসার পর তিনি জল দাও জল দাও বলে চিৎকার করলে পুলিশরা বলে, শালা এখনো মরেনি, গুলি না করে দেখছি ভুল করেছি। গ্রামের 

অনেক লোকও তখন সেখানে জড়ো হয় এবং বলে যে তিনি কাইতকান্দার প্রমোদ। এর পর পুলিশ প্রমোদ দাস ও রবি দামকে একত্রে বেঁধে রাখে। পুলিশ একটু সরে গেলে প্রমোদ দাস রবি দামকে ঠেলা দিতে থাকেন কিন্তু বারবার ঠেলা দিয়ে কোন নড়চড় না দেখে এবং জবাব না পেয়ে তখন তিনি বুঝতে পারেন যে রবি দাম আর বেঁচে নেই। রাত্রি ভোর হলে তিনি দেখেন যে রবি দামের বাঁ চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে তা উল্টো দিক দিয়ে মস্তক ছেদ করে বের হয়ে গেছে। 

বেলা আটটার দিকে রবি দামের লাশসহ তাঁকে ধর্মপাশা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দারোগা প্রমোদ দাসকে দেখে বলে যে, এই দেশে সব শালারাই কমিউনিস্ট। শুধু তাই নয় পাঁচটি বছর নিশ্চিন্তে ভাত খেতে পাইনি – এই কথা বলে দারোগা প্রমোদ দাসকে বেদম প্রহার শুরু করে। প্রমোদ দাস তখন তাকে বলেন যে তিনি বন্দী তা না হলে তার মতো দারোগাকে সহজেই শায়েস্তা করতে পারতেন। এর পর দারোগা তাকে মাটিতে ফেলে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে এবং তার দাঁত ভেঙ্গে দেয়। এইভাবে অমানুষিক নির্যাতনের পর প্রমোদ দাসকে সুনামগঞ্জে চালান করা হয় এবং তারপর তিনি বিনা বিচারে বন্দী থাকেন। [২৪] 

রবি দামের মৃত্যু এবং অন্যান্যদের গ্রেফতারের ফলে এর পর এই এলাকায় আন্দোলন অনেকখানি স্তিমিত হয়ে আসে। 

নানকার আন্দোলন: দেশ বিভাগের পর সিলেট জেলায় প্রচলিত নানকার প্রথার মধ্যে সামন্তবাদের অবশেষসমূহ যে পরিমাণে বিদ্যমান ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কোন এলাকায় অন্য কোন প্রথার মধ্যে তেমনটি ছিলো না। এ অঞ্চলে মোগল আমলে প্রবর্তিত এক ধরনের এই ভূমিদাস (Serf) প্রথার মাধ্যমে সামন্ত ভূস্বামীরা এক শ্রেণীর কৃষকদের ওপর নিজেদের শোষণ ও নির্যাতনকে জারী রাখতো। 

‘নান’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো রুটি। রুটি অর্থাৎ খাদ্যের পরিবর্তে দৈহিক শ্রমই এই প্রথার দ্বারা বোঝায়। কিন্তু সাধারণ গৃহভৃত্যদের থেকে নানকারদের পার্থক্য এই যে, তাঁদের দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে ভূস্বামীদের বাড়ীতে তাঁদের খাওয়া-পরার কোন ব্যবস্থা থাকতো না। ভূস্বামী বা জমিদার তাঁদেরকে এক টুকরো জমি বরাদ্দ করেই এ ব্যাপারে তাঁদের ‘রুটির’ ব্যবস্থা করতো। জমিদার কর্তৃক নির্দেশিত এই ভূখণ্ডে নিজেদেরকে দৈহিক শ্রমের দ্বারা ফসল উৎপাদন করেই নানকারদেরকে নিজেদের খাদ্যের সংস্থান করতে হতো। এই সুযোগটুকু তাঁদেরকে দান করার পরিবর্তে জমিদারের বাড়ীতে জমিদারের অবাধ ইচ্ছানুযায়ী তাঁরা নিজেদের কায়িক শ্রম নিয়োগ করতে বাধ্য থাকতেন। 

“নানকারকে যে জমি বরাদ্দ করা হতো তার নাম হল ‘নান’ (রুটির জন্য) জমি। তাকে ‘খানে’ (খাবার জন্য) বাড়িও বলা হত। 

“এই ‘নান জমি’ বা ‘খানেবাড়ি’ ভোগ করার পরিবর্তে জমিদারের প্রয়োজনে নানকারকে অনির্দিষ্ট পরিমাণে তার শ্রমশক্তি ব্যয় করতে হতো। সামন্তবাদী হিসাবে শ্রমশক্তি মূল্যহীন বলেই তার কোন হিসাব-নিকাশের ব্যবস্থা ছিল না, জমিদারের ‘ডাকে হাঁকে’ (অর্থাৎ জমিদার ডাক দিলেই অথবা হাঁক দিলেই) নানকারদেরকে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে জমিদারের আদেশমতো কাজ করে দিতে সে বাধ্য। এই ধারার কাজে যে খাটুনী তার জন্যে কোন পৃথক মজুরী নানকারের প্রাপ্য নেই। বিনা মজুরীর এই খাটুনীকে বলা হতো ‘হদ’ বা ‘বেগারী’। এক দিকে জমি (‘নান জমি’ বা ‘খানে বাড়ি’) অন্যদিকে শারীরিক খাটুনী (হদ বা বেগারী), এছাড়া নানকার প্রথায় কোন প্রান্তেই কোন বস্তুর আদান-প্রদান ছিলো না। সামন্তবাদী ব্যবস্থায় উৎপন্ন ফসলের অংশে, অথবা পরবর্তীকালে নগদ অর্থে খাজনা পরিশোধের ভিতর দিয়ে যেখানে জমিদার প্রজা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হতো এখানে তেমন কোনো বস্তুর আদান প্রদানের ব্যবস্থা না থাকলেও নানাকারদের ‘প্রজা’ বলেই উল্লেখ করা হত। কোন কোনো স্থলে রায়তও বলা হত। কিন্তু প্রজাস্বত্বে বা রায়তী ব্যবস্থায় প্রজার স্বত্বাধিকার যেখানে যেটুকুই স্বীকৃত হোক, এখানে নানকাররা ছিলেন তার সব কিছুরই বাইরে। নামে প্রজা হলেও কাজে তাঁরা ভিন্ন বর্গের প্রজা। তাদের এই ভিন্ন বর্গটা বুঝবার প্রয়োজনে তাদের জন্য ‘প্রজা’ শব্দের সাথে নানকার জীবনের বিশেষাত্মক শব্দগুলি জুড়ে দেবার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো। এভাবে তাঁদেরকে বলা হতো ‘নানকার প্রজা’ ‘খানে বাড়ির প্রজা’, ‘হুদুয়া প্রজা’, ‘বেগার প্রজা’, ‘চাকরাণ প্রজা’ (চাকরীর অর্থে) প্রভৃতি উপরোক্ত শব্দগুলি সম অর্থবোধক ও নানকার প্রজারই প্রচলিত বিভিন্ন নাম।” 

“নানকাররা যে জমি-জমা চাষাবাদ করতেন তা জমিদারের খাস দখলির এলাকা বলে পরিগণিত হতো। তাই তার বিলি বন্দোবস্তে একমাত্র জমিদারের মর্জি ছাড়া আর কোন আইন বা প্রথাই কার্যকরী ছিল না। জমিদার তার মর্জি মাফিক এই জমি বিলি বন্দোবস্ত করতে ও যখন তখন তা হাত বদল করতে পারতো, নানকার প্রজাকে উচ্ছেদও করতে পারত। কোন আইন-আদালত তার বিরুদ্ধে কিছু বলবার অধিকারী ছিল না। তাই জমিদারের মর্জি যুগিয়ে চলাই ছিল নানকার প্রজার স্বগৃহে টিকে থাকার একমাত্র শর্ত।”[২৫] ভূস্বামী থেকে অনির্দিষ্ট পরিমাণ দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে প্রাপ্ত টুকরো জমি ও ভিটের ওপর নানকারদের কোন স্বত্ব তো থাকতোই না, এমনকি সেই জমির ওপর স্থায়ী কোন ফলের গাছ থাকলে তার ফলের ওপরও তাদের কোন অধিকার থাকতো না। অথচ সেই সমস্ত গাছ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থাকতো সম্পূর্ণভাবে নানকারদের ওপর। নানকাররা জমিদারের বাড়ীতে শ্রম দান করার পর যেটুকু সময় তাদের থাকতো সেই সময়ে নিজেদের নির্দিষ্ট জমিতে ধান, পাট, ডাল, তরিতরকারী ইত্যাদি ফসলের চাষ করে তারা জীবিকনির্বাহ করতেন। অনেক সময় হাল, বীজ, সার ইত্যাদির জন্যে প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে চাষাবাদও ঠিক মতো তাদের দ্বারা সম্ভব হতো না। এ সবের ফলে নানকারদের জীবন যে এক চরম দারিদ্র্য দুর্দশা ও লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে অভিবাহিত হতো সে কথা বলাই বাহুল্য। এই নানকারদের ভূস্বামীরা ‘গোলাম’ হিসেবেই বর্ণনা ও সম্বোধন করতো এবং প্রকৃতপক্ষে তাদের জীবন ছিলো মধ্যযুগীয় ভূমিদাসদের জীবনের মতোই শোষিত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত। জমিদারের নির্দেশ ও ইচ্ছানুযায়ী যে কোন কাজ করতেই তারা দিবারাত্রির যে কোন সময়ে বাধ্য থাকতেন। তাদের বাড়ীর স্ত্রীলোকেরাও এই একই গোলামীর শৃঙ্খলে বাঁধা থাকতেন ও তাদের দৈহিক শ্রম এমনকি তাঁদের দেহের ওপরও জমিদারের অধিকার ছিলো অবাধ ও সীমাহীন 

বংশগত পেশাভিত্তিক বহু খণ্ড সমাজের ভাঙ্গা ভাঙ্গা অংশের সমন্বয়েই গঠিত হয়েছিলো সমগ্র নানকার সমাজ। এই খণ্ড সমাজগুলি হলো নিম্নরূপ: 

(১) কিরাণ (বোধহয় কৃষাণ শব্দের অপভ্রংশ) মুসলমান সম্প্রদায়ের গৃহকর্মী; (২) ভাণ্ডারী হিন্দু সম্প্রদয়ের গৃহকর্মী; (৩) নমঃশূদ্র-হিন্দু সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবী, বাঁশ বেতের গৃহনির্মাণ ও অন্যান্য বাঁশ-বেতের কাজও এদের পেশা; (৪) পাটনী (পরবর্তীকালে যারা মাহিষ্য দাস বলে পরিচয় গ্রহণ করে)-হিন্দু সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবী, নৌকা চালনা প্রভৃতিও এদের পেশা; (৫) মাইমল-মুসলমান সম্প্রদায়ের মৎস্যজীবী, নৌকাচালনা প্রভৃতিও এদের পেশা; (৬) মালাকার (মালী)-হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক, মাটি কাটা, পাল্কী বহন প্রভৃতি এদের পেশা; (৭) ঢুলী-হিন্দু সম্প্রদায়ের বাদ্যকার; (৮) বাজনী-মুসলমান সম্প্রদায়ের বাদ্যকার; (৯) ধোপা-হিন্দু সম্প্রদায়ের রজক; (১০) নাপিত-হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষৌরকার; (১১) হাজাম-মুসলমান সম্প্রদায়ের সাবেক ক্ষৌরকার প্রভৃতি। তাছাড়া বাংলার বাইরে থেকে আগত হিন্দি বা অন্যান্য ভাষা-ভাষী মুচি ও চা বাগানের সাবেক শ্রমিক যারা জমিদারের আশ্রয়ে এসে বসবাস করতেন; তারা সংখ্যায় খুব বেশী না হলেও তাদের সবাই নানকার পর্যায়ভুক্ত হয়ে থাকেন। [২৬] 

নানকারদের ওপর জমিদারদের ক্ষমতা এবং অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্যে জমিদাররা নানকারদের অন্যান্য প্রজাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্যবহার করতো। নানকারদের একাংশ ‘পেয়াদা’ নামে পরিচিত ছিলো। এই ‘পেয়াদা’রাই ছিলো অন্যান্য প্রজাদের ওপর জমিদারী নির্যাতনের মূল হাতিয়ার। এদেরকে ব্যবহার করেই জমিদার নিজের এলাকায় অবাধ্যতা, খণ্ড বিদ্রোহ ইত্যাদির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতো। 

নানকার এলাকায় জমিদারী শাসনব্যবস্থা কি ধরনের ছিলো তার একটা চিত্র নীচের বর্ণনা থেকে পাওয়া যাবে: 

জমিদারী শাসন-ব্যবস্থায় সরকারী কোর্ট-কাছারীর কোন স্থান ছিলো না। তার স্থানে জমিদারী কাছারীগুলিই ছিলো কোর্ট-কাছারী, আর জমিদার ও তার নায়েব মুন্সীরাই ছিলো জজ ম্যাজিস্ট্রেট-হাকিম-সুধা। তাই তাঁদের মুখের কথাই ছিল আইন। তাঁদের মুখের কথায়ই মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যেতো। এমন নিষ্পত্তির বিরুদ্ধে কোন আপিল বা ওজর আপত্তি চলতো না। জমিদারের রায়ের বিরুদ্ধে কেউ কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারতো না। একমাত্র জমিদারের মর্জির পরিবর্তন না হলে তা কখনো পরিবর্তিত হতো না। জমিদারী কাছারীগুলিতে প্রতিদিন এমন সহস্র বিচারের অভিনয় চলতো আর তার ভিতর দিয়ে সাধারণভাবে প্রজা শাসন ও বিশেষভাবে নানকার শাসনের প্রহসন হতো। এই বিচার প্রহসনে লোমহর্ষক কাণ্ড কারখানা দেখা যেতো। নানকারদের সাজা শাস্তির ব্যাপারে সাধারণ কিল চড়, জরিমানা থেকে আরম্ভ করে বেত মারা, জুতা পেটা, হাত পা বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা, সময় সময় তার সাথে আবার বেত মারা, দুটি আস্ত বাঁশের ফাঁকে বা তক্তার তলায় হাত, পা, বা আস্ত দেহটা ফেলে দুপাশে চেপে চেপে নাকে মুখে রক্ত বের করা, লোহার শিক পুড়ে দাগ দেওয়া, বন্ধ ঘরে অভুক্ত অবস্থায় সপ্তাহাধিককাল আটক করে রাখা প্রভৃতি কোন কিছুই বাদ দেওয়া হতো না।[২৭] 

এছাড়া জমিদার কাছারীগুলিতে আর একটি অভিনব ব্যবস্থা ছিলো। প্রজারা যে কোন ব্যাপারে জমিদারের অথবা তার কর্মচারীর বিরাগভাজন হলে প্রজাদেরকে দুই হাত লম্বা জুতো দিয়ে প্রহার করা হতো। এই জুতাকে বলা হতো ‘শাস্তিরাম’।[২৮] সিলেটের এইসব জমিদারী এলাকায় ভূস্বামীদের (যাদের অধিকাংশই ছোট ছোট)[২৯] প্রতাপ ও প্রভুত্ব এত প্রবল ছিলো যে তাঁদের আশ্রিত না হয়ে এবং তাঁদেরকে উপযুক্ত সালামী না দিয়ে কারও পক্ষে চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, গান-বাজনা, বৈঠক বিয়ে-শাদী কোন কিছুই সম্ভব ছিলো না। এক কথায় এই ধরনের জমিদারী এলাকায় যে স্বেচ্ছাচার প্রচলিত ছিলো সেটা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাঙলাদেশের অন্য কোন এলাকায় প্রচলিত ছিলো না। 

বাঙলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে কৃষক আন্দোলন আসামের তুলনায় অনেক বেশী ঘন ঘন, ব্যাপক এবং সংগঠিত হওয়ার ফলে বিভিন্ন পর্যায়ে একের পর এক প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে জমিতে কৃষকদের অধিকার অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং ভূস্বামীদের শোষণ নির্যাতনও পূর্বের তুলনায় অনেক কমে এসেছিলো। কিন্তু জমিদারী ও নানকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে খণ্ড খণ্ড বিদ্রোহ মাঝে মাঝে দেখা দিলেও সিলেটের সেই সব বিদ্রোহ ছিলো অসংগঠিত এবং অল্পকাল স্থায়ী। এজন্যে সেই সব বিদ্রোহ বিক্ষোভ কোন সত্যিকার ভূমি সংস্কার এই অঞ্চলে প্রবর্তন করতে পারেনি। ‘সিলেট জেলা প্রজাস্বত্ব আইন’ নামে যে আইনটি প্রচলিত ছিলো তার মধ্যে প্রজাদের কোন অধিকারই প্রকৃতপক্ষে স্বীকৃত বা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সে আইন প্রকৃতপক্ষে ছিল জমিদারীস্বত্ব আইন। কারণ সেই আইন অনুযায়ী জমিদাররা প্রজাদেরকে খাজনার রশিদ দিতে বাধ্য ছিলো না, জমি বিক্রী অথবা হস্তান্তরের কোন অধিকার প্রজাদের ছিলো না, জমির ওপর গাছপালা ও উৎপন্ন ফসলের ওপর জমিদারের অধিকার ছিলো, জমিতে পাকা ঘর তোলা অথবা পুকুর খননের কোন অধিকার প্রজাদের ছিলো না, জমিদার কর্তৃক প্রজা উচ্ছেদের অধিকার তাতে স্বীকৃত ছিলো এবং আইনগতভাবে প্রজা হিসেবে তাতে নানকারদের কোন স্বীকৃতি ছিলো না।[৩০] ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন এবং সারা ভারত কৃষক সভার প্রতিষ্ঠার সময় থেকে সিলেট জেলায় কৃষক আন্দোলন কিছুটা সংগঠিত রূপ নেয়। ১৯৩৭ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে করুণাসিন্ধু রায় আসামে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন। কংগ্রেস দলভুক্ত হলেও তিনি ছিলেন উদারনীতিক ও ভূমি সংস্কারের পক্ষপাতী।[৩১] আসাম প্রাদেশিক পরিষদে তিনি সিলেট প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনের প্রস্তাব আনেন কিন্তু তৎকালীন আইন অনুযায়ী গভর্নরের অনুমতি না পাওয়ায় প্রস্তাবটি পরিষদে বিতর্কের জন্যে উপস্থাপিত করাও সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে তৎকালীন বামপন্থী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলে, এমনকি কংগ্রেসী মহলেও অনেক হৈচৈ হয়। 

পরিষদের আইনগত সংস্কারের মাধ্যম প্রজাস্বত্ব আন্দোলনের কোন সাফল্যের সম্ভাবনা না থাকায় সেই আন্দোলন কিষাণ সভার হাতে পড়ে একটা ব্যাপকতার রূপ পরিগ্রহ করে। এতে কিষাণ সভার সুবিধেই হয়। সুরমা উপত্যকা কিষাণ সভা প্রজাস্বত্বকেই মূলতঃ অবলম্বন করে কৃষকদেরকে সমবেত ও সংগঠিত করতে অনেকাংশে সফল হন। কিন্তু কিষাণ সভার এই আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো আন্দোলনের মাধ্যমে প্রাদেশিক পরিষদকে প্রজাস্বত্ব আইনের সংস্কারে বাধ্য করা। অন্য কোন উপায়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার কোন চিন্তা সে সময় কিষাণ সভার ছিলো না। 

সিলেট জেলায় ১৯৩৮-৩৯ সালে কৃষক সভার নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের একটা নোতুন পর্যায় শুরু হয়। এ সময়েই এই অঞ্চলের কৃষক আন্দোলন অনেকটা সংগঠিত রূপ পরিগ্রহ করে। যে সমস্ত এলাকায় এই সময় আন্দোলনগুলি সৃষ্টি হয়েছিলো সেগুলি হলো: সুনামগঞ্জ মহকুমার বংশীকুণ্ডা, ভাটিপাড়া, শাফেলা, বৈঠাখালি; সদর মহকুমার রনিকেলী, ভাদেশ্বর, গোলাপগঞ্জ; করিমগঞ্জ মহকুমার দাসের বাজার, বিয়ানীবাজার, বাহাদুরপুর। এর মধ্যে সদর মহকুমার রনিকেলী ও ভাদেশ্বর এবং করিমগঞ্জ মহকুমার বাহাদুরপুর ছিলো নানকার আন্দোলনের কেন্দ্র।[৩২] এই শেষোক্ত তিনটি এলাকার আন্দোলন এক একটি গ্রামকে কেন্দ্ৰ করে গড়ে উঠলেও এবং আন্দোলনগুলির মধ্যে অনেক কাঠামোগত ও পদ্ধতিগত (বিশেষতঃ সংস্কারমূলক) দুর্বলতা সত্ত্বেও সমগ্র সিলেট জেলার প্রায় দুই লক্ষ নানকারদের হৃদ বেগারী উচ্ছেদ এবং জমি স্বত্বের দাবীর আন্দোলনে তা এক নোতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর, বিশেষতঃ ১৯৪২ সালে জার্মানী কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টির যুদ্ধকে সমর্থন দানের সিদ্ধান্তের পর কৃষক আন্দোলন অন্যান্য এলাকার মতো এই এলাকাতেও স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু যুদ্ধের পর আন্দোলন আবার নোতুনভাবে শুরু হয়।[৩৩] 

যুদ্ধের সময় আন্দোলনে ভাটা পড়ার ফলে জমিদার, মীরাসদার, তালুকদারদের নির্যাতন অনেক বৃদ্ধি পায় এবং তার ফলে আন্দোলন প্রথম পর্যায়ে সংগঠিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দুজন নানকারও এক সাথে বসে নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করার মতো অবস্থাও তখন ছিলো না। জমিদারদের বিভেদনীতি, নানকারদেরকে দিয়েই নানকারদের ওপর নির্যাতন, বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, জমি থেকে উচ্ছেদ, নানকারদেরকে গোয়েন্দাগিরিতে নিযুক্তি ইত্যাদি কারণে নানকাররা নিজেরাই পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। এই পরিস্থিতিতে সদর মহকুমায় অন্তরীণ থাকার সময় ১৯৪৫ সালে অজয় ভট্টাচার্য ধীরে ধীরে নিজেদের গ্রাম বাহাদুরপুর এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য এলাকায় নানকার আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। 

একজন একজন করে নানকারদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ শুরু করার পর পাঠশালার সহপাঠী দুজন নানকারের সাথে বন্ধুত্বের মাধ্যমে অজয় ভট্টাচার্য সংগঠনের কাজে কিছুটা অগ্রসর হন। জোয়াদ আলী ও আবদুশ সোভান (পটল) নামক এই দুজন নানকার ১৯৪৬-এর গোড়া থেকে গ্রুপ গঠন করে বৈঠক করেন। এই সময় লাউতা বাহাদুরপুরের এক সভায় একজন বয়স্ক নানকার প্রশ্ন তোলেন “জমিদার বাড়ী আমরা ধ্বংস করবো। কিন্তু জমিতে আমাদের স্বত্ব নেই। সেই স্বত্ত্ব কিভাবে আসবে?” এটা একটা খুব বাস্তব সমস্যা হিসেবেই দেখা দিলো এবং এই প্রজাস্বত্বের দাবীকে কেন্দ্র করেই নানকার আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত হলো। নানকারদেরকে ভূস্বামীরা নিজেদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে অন্য প্রজারদেরকে দমন করতো। কাজেই নানকার আন্দোলন জোরদার হলে সামগ্রিকভাবে জমিদারদের শক্তি যে কমে যাবে এবং কৃষকের সংগঠিত শক্তি বৃদ্ধি পাবে এই চিন্তাও নানকার আন্দোলনকে সাধারণ প্রজাস্বত্ব আন্দোলনের সাথে এক সূত্রে গ্রথিত করতে সাহায্য করলো।[৩৪] 

এই সময় উপরোক্ত দুজন নানকার কর্মী ছাড়াও নৈমুল্লা নামে আর একজন জাহাজীকে নানকার আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক হিসেবে পাওয়া যায়। ইনি পরবর্তীকালের আন্দোলনের খুব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বিশ বৎসর জাহাজে পৃথিবীর বিভিন্ন বন্দরে তিনি ঘুরেছিলেন। এগুলির মধ্যে সোভিয়েত বন্দরও ছিলো। ১৯৪৬ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি আন্দোলনে নামেন এবং বিশ বৎসরের জাহাজী জীবনের অভিজ্ঞতার ফলে তিনি খুব সোচ্চারভাবে আন্দোলনের বক্তব্যসমূহ নানকারদের সামনে উপস্থিত করতে থাকেন। দুই এক বৎসর কৃষক আন্দোলনে থেকে তিনি নিজেকে এতখানি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং কোন প্রতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না থাকলেও অস্ট্রেলীয়ান প্রতিনিধি শার্কীর সাথেও ইংরেজীতে আলাপ-আলোচনা করতে তাঁর অসুবিধা হয়নি।[৩৫] 

সে সময় কনট্রোল দরে যে কাপড় ইত্যাদি দেওয়া হতো সেগুলো নানকাররা পেতেন না। কারণ ঐ একই কাপড় কনট্রোল দরে ভূস্বামীরাও পেতো। নানকার ও ভূস্বামী, ‘গোলাম ও ‘মুনিব’-এর কাপড় একই রকম হয়ে যাবে এটা ভূস্বামীরা বরদাশত করতে প্রস্তুত ছিলো না। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে করিমগঞ্জে গিয়ে নৈমুল্লা কো-অপারেটিভ ডিপার্টমেন্টে নালিশ ও প্রতিবাদ করেন। এর ফলে কো-অপারেটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে এ বিষয়ে তদন্ত হয় এবং তাঁরা জমিদারদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দান করে। এই সাফল্যে নানকারদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহের সঞ্চার হয় এবং জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিবাদ জানালে তার ফল পাওয়া যায় এই বিশ্বাস তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হয়। নানকাররা এর পর থেকে পরস্পরকে সন্দেহ করা থেকে অনেকখানি বিরত হন এবং নানকার প্রথার অবসান, টাকায় খাজনা দান, বেগারী বন্ধ ইত্যাদির দাবীতে পূর্বের থেকে অনেক বেশী সংগঠিত ও সোচ্চার হন। জমিদারদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হতেও তাঁরা অস্বীকৃতি জানান।[৩৬] বাহাদুরপুর অঞ্চলে প্রথম প্রকাশ্য আন্দোলন হয় ১৯৪৬-এর অগাস্ট মাসে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। রাত্রে বিক্ষোভ মিছিল হয় এবং নানকাররা জমিদারদের বাড়ীর নিকটেই সভা [৩৭] এই বিক্ষোভ মিছিলের দ্বারা জমিদাররা প্রত্যক্ষভাবে আঘাত না পাওয়ায় তাঁরা করেন। নানকারদের বিরুদ্ধে কিছু না করলেও এই সভা মিছিল সেই পর্যায়ে ঐ এলাকায় একটা অগ্রসর পদক্ষেপ ছিলো। 

১৯৪৭ সালের জানুয়ারী মাসে বাহাদুরপুরে কৃষক সভা এলাকায় অফিস স্থাপন করেছে এবং অফিসে কর্মীদের ও লোকজনের ভীড় হচ্ছে। এই সময় সেখানে একটা ঘটনা ঘটে। জমিদারের বিরুদ্ধে সামান্য অপরাধের জন্যে একজন পাটনীকে খাটের তলায় ঢুকিয়ে রাখা হয়। জমিদারের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কি করা যায় এই চিন্তা হচ্ছে এমন সময় কৃষক সভার একজন কর্মী নিজে গিয়ে খাটের তলা থেকে তাকে টেনে বের করে কৃষক সভার অফিসে এনে হাজির করেন। এতে কৃষকদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং জমিদাররাও কিছু করতে সাহস করে না। এই ঘটনার দুই একদিন পরই, ১৯৪৭ সালের ১৬ই জানুয়ারী দুতিনশো স্থানীয় নানকার ‘হদ বেগারী বন্ধ করো’ এই ধ্বনি তুলে বাহাদুরপুরে মিছিল বের করেন। [৩৮] 

প্রকাশ্যে এই সভা মিছিলে যোগদান করার পর নানকাররা জমিদার বাড়ীর দিকে যাওয়া বাদ দিলেন এবং বেগারী বন্ধ করলেন। এতে দুই দল জমিদারের মধ্যে দুই রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। একদল কোন কিছু করতে রাজী হলো না কিন্তু অন্য দল মিথ্যা মামলা ইত্যাদির বেড়াজালে নানকারদেরকে বাঁধার ব্যবস্থা করলো। প্রথম দিকে তিন চারজন গ্রেফতার হলো। পরে তাঁরা দুই তিনশো কৃষক কর্মী ও নানকারকে আসামী করলো। এর ফলে বহু সংখ্যক লোক ফেরারী অবস্থায় দূরে পাহাড়ীয়া অঞ্চলের জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন। স্থানীয় মধ্যবিত্তও (এদের মধ্যে তালুক চলে যাওয়া অনেক তালুকদারও ছিলেন) নানকারদেরকে সমর্থন করলেন। কারণ জমিদাররা নানকারদেরকে দিয়ে তাঁদের উপরও নানা অত্যাচার করতো। কৃষক ও মধ্যবিত্তের মধ্যে বেশ কিছুটা সমর্থনের ফলে এর পর সানেশ্বর, দাসের বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষকরা ঘোষণা করলেন যে যারা নানকারদের বিরুদ্ধে মামলা করবে তাঁদের খাজনা বন্ধ। এইভাবে কিছু জমিদারের খাজনা বন্ধ হলো। কোন কোন জায়গায় তাঁরা জমিদারের হাল পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন। এবং এই আন্দোলনের সমর্থনে একটা দাবী সনদ তৈরী হলো যাতে নানকার প্রথা উচ্ছেদ থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রজাদের দাবীও অন্তর্ভুক্ত হলো। অবস্থা এমন পর্যন্ত পৌঁছালো যে জমিদারদের বাড়ীর রান্নার মশলা, ফরমায়েসী কাজের লোক ইত্যাদি সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলো। বেগারী বন্ধ, জমিদার বাড়ী যাওয়া বন্ধ, নানকারদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করলে হাট বাজার বন্ধ, খাজনা বন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে এক বলিষ্ঠ ও ব্যাপক আন্দোলন সমগ্র এলাকাটিতে গড়ে উঠলো।[৩৯] আসামে তখন কুখ্যাত সাদুল্লাহ মন্ত্রীসভার (মুসলিম লীগ) পতন ঘটে গোপীনাথ বরলুই- এর কুখ্যাত মন্ত্রীসভা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং বসন্তকুমার দাস সেই মন্ত্রীসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে সমস্ত জমিদার নানকারদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা ও প্রতিরোধ চালায় তাঁদের মধ্যে দুটি পরিবার ছিলো মুসলমান এবং একটি হিন্দু। এই হিন্দু জমিদার শ্যামাপদ ছিলো বসন্তকুমার দাসের আত্মীয়। শ্যামাপদর বাড়ীতেই এই সমস্ত ঘটনার সময় পুলিশ ক্যাম্প বসে। [৪০] 

এই পরিস্থিতিতেই বাহাদুরপুরের কৃষক আন্দোলন দেশ বিভাগের ঠিক পূর্বকালে আরও ব্যাপক ও সংগঠিতভাবে শুরু হয়। অজয় ভট্টাচার্য এখানকার কমিটির সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। অন্যান্যদের মধ্যে থাকেন জোয়াদ আলীর পিতা নজীব আলী (দরবারী নজুই), সভাপতি লাউতা বাহাদুরপুর কৃষক সমিতি; নৈমুল্লা, সহ-সভাপতি এবং তফজ্জল আলী (তকন মোল্লা)। এঁদের সকলের ভূমিকাই উল্লেখযোগ্য হলেও মূল সংগঠক হিসেবে নৈমুল্লার ভূমিকাই ছিলো সব থেকে উল্লেখযোগ্য। [৪১] 

লাউতা বাহাদুরপুরের ও সেখান থেকে ছয় মাইল দূরবর্তী কার্নিশালী গ্রামের নানকারদের মধ্যে আত্মীয় কুটুম্বিতার সম্পর্ক ছিলো। আত্মীয়তা ও কুটুম্বিতার সূত্রে বাহাদুরপুরের আন্দোলন সেখানেও বিস্তার লাভ করে এবং কার্নিশালীকে কেন্দ্র করে সমগ্র ঢাকা দক্ষিণ পরগণায় হাজার হাজার নানকার আন্দোলনে যোগদান করেন। এখানকার নেতা ছিলেন বীরেশ্বর মিশ্র। ঢাকা দক্ষিণ ছিলো তারই গ্রাম। বীরেশ্বর মিশ্র ব্যতীত অন্য দুজন উল্লেখযোগ্য স্থানীয় নেতার নাম ইসমাইল আলী (তালুকদার) এবং সুধন্যা দেব (নানকার)। ঢাকা দক্ষিণ অঞ্চল থেকে ছয়-সাত মাইল দূরবর্তী ফুলবাড়ী গ্রামেও আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। অন্যান্য এলাকাতেও আন্দোলনের ঢেউ কিছুটা পৌঁছালেও স্থানীয় নেতৃত্বের অভাবে সেগুলিতে আন্দোলন জোরদার হয়নি। বেগার বন্ধ, খাজনা বন্ধ, পুলিশ ক্যাম্প ও মামলা প্রত্যাহার ইত্যাদি ছিলো এই আন্দোলনের মূল দাবী।[৪২] সিলেটের পাকিস্তানভুক্তির পর মুসলিম লীগ নানকারদেরকে কমিউনিস্টদের প্রভাব থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নানকার আন্দোলনকে নিজেদের মতো করে পরিচালনার প্রচেষ্টা করে। সিলেট রেফারেন্ডামের সময় কিষাণ সভার কর্মী ইসমাইল আলী কৃষক সভা পরিত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করে। মাহমুদ আলী দেশভাগের পূর্বে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিলেন। ইসমাইলের সহায়তায় তিনি, নূরুর রহমান প্রভৃতি এই উদ্যোগের পুরোভাগে থাকেন। গোপালগঞ্জে (সদর সিলেট) এই উদ্দেশ্যে তাঁরা এক সম্মেলন আহ্বান করেন এবং একটি ইস্তাহার প্রচার করে তাতে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও সে সময় নানকারদের মধ্যে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণার কোন স্থান ছিলো না। কাজেই মুসলিম লীগের সেই সম্মেলন শেষ পর্যন্ত হতে পারেনি।[৪৩] 

পাকিস্তানোত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিলেট জেলা পার্টি কমিটি মুসলিম লীগের লোকদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নানকারদের দাবী কিছু কিছু আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে ইসমাইলের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এবং মাহমুদ আলী, নূরুর রহমান, ইসমাইল প্রভৃতির সাথে কমিউনিস্ট পার্টির আলাপ-আলোচনা চলে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরেই অজয় ভট্টাচার্য আসাম সরকারের পূর্ব ঘোষিত গ্রেফতারী পরোয়ানায় গ্রেফতার হন। সে সময়ে পার্টি থেকে সুরত পালকে বাহাদুরপুর এলাকায় দেওয়া হয়। বারীন দত্ত, রোহিনী দাস (জেলা কৃষক সম্পাদক), সুরত পাল ও চিত্তরঞ্জন দাস মুসলিম লীগের সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।[৪৪] 

ঠিক এই সময়ে এক ঘটনা ঘটে। গোলাপগঞ্জ থানার কার্নিশালী গ্রামের মুখলেস আলী নামে একজন নানকার স্থানীয় জমিদারদের একজনকে জুতো মারেন। এই ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে জমিদাররা নিজেদের পক্ষ থেকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের[৪৫] কাছে একটা ডেপুটেশন পাঠায়। মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি বিষয়টি নিয়ে তাঁদের সাথে আলোচনার পর সৈয়দ মোয়াজ্জমউদ্দীন হোসেন (যুক্ত বাঙলায় সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রী সভার সদস্য), আওলাদ হোসেন এমএলএ এবং আব্দুর বারী এমএলএ এই তিনজনকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গোলাপগঞ্জ, ঢাকা দক্ষিণ, বাহাদুরপুর ইত্যাদি জায়গায় জমিদারদের হাতী চড়ে গিয়ে তাঁরা স্থানীয় নানকারদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেন।[৪৬] 

১৯৪৭ সালের ১৩ই ডিসেম্বর তদন্ত কমিটি গোলাপগঞ্জ ও ঢাকা দক্ষিণ পরিদর্শন করে বিবাদমান পক্ষদ্বয়ের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। জমিদার পক্ষ সিলেটের খ্যাতনামা আইনজ্ঞ ও জেলার বিভিন্ন স্থানের জমিদারদের প্রতিনিধিদের সহায়তায় নিজেদের বক্তব্য পেশ করেন। অন্যদিকে আন্দোলনকারী নানকার প্রজারা সরাসরি কমিটির নিকট নিজেদের বক্তব্য এবং দুর্দশার কাহিনী বর্ণনা করেন।[৪৭] এই দেখাসাক্ষাৎ আলাপ-আলোচনার সময় মুসলিম লীগের এ. জেড. আব্দুল্লাহ এবং নূরুর রহমানও উপস্থিত থাকেন। উত্তর সিলেট জেলা লীগও এই আলোচনায় নিজেদের প্রতিনিধি প্রেরণ করে।[৪৮] 

তদন্ত কমিটি জমিদার ও নানকার উভয় পক্ষের কাছে আপসের আবেদন জানায়। ফুলবাড়ীর জমিদার এই শর্তে আপসে সম্মত হয় যে, যে সকল নানকার প্রজার ভিটা তাঁদের বাড়ীর এলাকার মধ্যে পড়েছে তারা সেখান থেকে অন্যত্র সরে যাবে এবং তার জন্যে ভূস্বামীরা ঐ গ্রামে অথবা তার নিকটবর্তী গ্রামে তাদেরকে উপযুক্ত জমি ও গৃহ স্থানান্তরের খরচ প্ৰদান করবে। ঢাকা দক্ষিণ ডাক বাঙলায় কমিটির আপস প্রস্তাবে কানিশাইলের জমিদাররা বসতবাড়ীর ব্যাপারে গোলাপগঞ্জের প্রস্তাবকেই গ্রহণ করে কিন্তু জমির ওপর নানকারদের কোন জোত স্বত্ব স্বীকার করতে তারা সম্মত হয় না।[৪৯] 

ঢাকা দক্ষিণ থেকে আব্দুল বারী চৌধুরী লাউতা বাহাদুরপুর যান এবং সেখানেও কমিটির পক্ষ থেকে দুই পক্ষের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করেন। মোয়াজ্জমউদ্দীন হোসেনও ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণে থাকেন এবং তদন্তের জন্যে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। আওলাদ হোসেন খানও কয়েকটি এলাকা ঘুরে ১৩ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সিলেটে ফিরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে তদন্তের বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেন। এর পর ১৫ই ডিসেম্বর তদন্ত কমিটির তিনজন সদস্য সিলেট সার্কিট হাউসে মিলিত হন। এ সময়ে আন্দোলনকারী প্রজাদের ওপর সরকারী কর্মচারীদের পক্ষপাতমূলক আচরণ ও জুলুমের প্রমাণ হিসেব এ.ডি.এম এর দস্তখতী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসের মোহরযুক্ত ১৪৪ ধারার এক নোটিশ মুসলিম লীগ কর্মীরা কমিটির সামনে উপস্থিত করেন।[৫০] এই ধরনের বহু নোটিশ ঢাকা দক্ষিণে অবস্থানকালে মোয়াজ্জমউদ্দীন হোসেনের সামনেও উপস্থিত করা হয়।[৫১] 

জমিদার ও নানকার পক্ষের বক্তব্যসমূহ শোনা এবং পর্যালোচনার পর তদন্ত কমিটি মুসলিম লীগ এবং সরকারের কাছে নিম্নলিখিত সুপারিশ প্রদান করে: 

(১) যে সব ভূম্যধিকারীর খাজনা, খাস-খামার অথবা উভয় সূত্রে আয় ছয় হাজার টাকার 

ঊর্ধ্বে তাহাদেরকে তাহাদের অধীনস্থ নানকার প্রজাদের নিকট হইতে পরিবর্তন ফি স্বরূপ এক বৎসরের খাজনা গ্রহণ করিয়া প্রচলিত খাজনার হারে তাহাদের জোত জমি খাজনায়ী জোত জমিতে পরিবর্তন করিতে হইবে।

(২) ছয় হাজার টাকা বা তন্নিন্ম আয় বিশিষ্ট ভূম্যধিকারীগণকে নিম্নোক্ত শর্তে তাঁহাদের অধীনস্থ নানকার প্রজাকে খাজনায়ী প্রজায় পরিবর্তিত করিতে হইবে (ক) ৬০০০ টাকা হইতে ৩০০১ টাকা আয় বিশিষ্ট ভূম্যধিকারীগণের জমি জমিদারের খাসে ছাড়িয়া দিতে হইবে। (খ) ৩০০০ টাকা হইতে ১০০১ টাকা আয় বিশিষ্ট জমিদারগণের ১/৪ অংশ ভূমি জমিদারের খাসে ছাড়িয়া দিতে হইবে। (গ) ১০০১ হইতে ৫০১ টাকা আয় বিশিষ্ট জমিদারগণের ১/৩ অংশ ভূমি জমিদারের খাসে ফিরত দিতে হইবে। (ঘ) ৫০০ অথবা তন্নিম্ন আয় বিশিষ্ট জমিদারগণের ১/২ অংশ ভূমি জমিদার সরকারের ছাড়িয়া দিতে হইবে। 

অবশ্য যদি কোন নানকার প্রজার সর্বপ্রকার জোত জমি দুই কেদারের ঊর্ধ্বে না হয় তাহা হইলে তাহার দখলীয় সমস্ত নানকার জমি বিনা প্রত্যার্পণে খাজনায়ী জমিতে পরিবর্তিত করিতে হইবে। এবং যদি কোন নানকার প্রজার সর্বপ্রকার জোত দুই কেদারের ঊর্ধ্বে ও তিন কেদারের নিম্নে হয় তাহা হইলে সে সাধারণভাবে ১ কেদার নানকার জমি খাজনায়ী রূপে পাইবেই। এতাধিক অন্যান্য জমির যে অংশ উপরোক্ত শর্তানুযায়ী ছাড়িয়া দিবার কথা প্রচলিত বাজার দরে তাহার জোত মূল্য ৫ হইতে ১০ কিস্তিতে আদায় করিলে ঐ ভূমিও খাজনায়ী জমিতে রূপান্তরিত করিতে হইবে।

(৩) ভূম্যধিকারীগণের বাড়ীর মধ্যস্থিত সংলগ্ন নানকার প্রজার বাড়ীর পরিবর্তে ঐ গ্রাম বা নিকটবর্তী গ্রামে ভূম্যধিকারীগণ বাড়ী দিতে পারিলে এবং স্থানান্তরের খরচা দিলে নানকার প্রজাকে সরিয়া যাইতে হইবে। 

(৪) কোন বিশেষ কারণে কোন ভূম্যধিকারী যদি তাহার বাড়ীর মধ্যস্থিত নহে এরূপ কোন নানকার প্রজার বাড়ী নিজের অথবা পরিবারের লোকের জন্য খাস দখলে আনিবার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করিতে পারেন, তাহা হইলে অনুরূপ ভূমি এবং স্থানান্তরের খরচ দিলে ঐ বাড়ীতে তাহার খাস দখল দেওয়া যাইতে পারে। 

(৫) আবাদী জমির বিনিময় করিতে পারিলে কেবল মাত্র ভূম্যধিকারীগণ তাহাদের ফেরত পাওয়ার দাবী পরিত্যাগ করিলেই তবে বিনিময় করিতে দেওয়া যাইবে। 

(৬) কোন নানকার প্রজা ‘কনসেশন’ হারে জমি ভোগ করিলে তাহার জমিতে পূর্ণ খাজনা প্রবর্তিত হইবে; এবং নানকার প্রজা সকল প্রকার ‘হৃদবেগারী’ হইতে মুক্তি পাইবে।

(৭) ভূমি সংক্রান্ত সকল প্রকার বিবাদ এবং বার্ষিক খাজনা ইত্যাদির মীমাংসা গভর্নমেন্টর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোন রাজস্ব বিভাগীয় কর্মচারী দ্বারা সম্পন্ন হইবে, এবং তাহার রায়ের বিরুদ্ধে রাজস্ব বিভাগীয় কোন গেজেটেড অফিসারের নিকট আপীল করা চলিবে। এবং ঐ অফিসারের রায়ই চূড়ান্ত, এবং কেবলমাত্র দেওয়ান আদালতে পরিবর্তিত হইবে। 

(৮) নানকার আন্দোলন উদ্ভূত সকল প্রকার চালু মামলা মোকদ্দমা ডিক্রী এবং উচ্ছেদ 

উপরোক্ত শর্তানুযায়ী চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রহিবে। 

(৯) তিন বৎসরের উৎপন্ন ফসলের কনট্রোল মূল্য ভূমির বাজার দর বলিয়া ধরিতে হইবে। [৫২] 

উপরোক্ত আপস প্রস্তাবে নানকার পক্ষের অনেক আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কিন্তু জমিদাররা প্রস্তাবটি গ্রহণের ব্যাপারে তাঁদের অসম্মতি জানায়। [৫৩] এর পর জমিদাররা ঢাকাতে একটি সম্মেলন আহ্বান করে সেখানে এ বিষয়ে নিষ্পত্তির দাবী জানায়। তাঁদের সেই দাবী অনুযায়ী ১৯৪৭ এর ডিসেম্বর মাসেই ঢাকাতে নানকার, জমিদার ও সরকারী প্রতিনিধিদের একটি ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন হয় এবং তা বেশ কয়েকদিন স্থায়ী হয়। সম্মেলনে যে সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় সেগুলি মোটামুটিভাবে হলো এই: 

(১) নানকারদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে শতাধিক বন্দী আছেন তাঁদের সকলের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে তাঁদেরকে মুক্তি দিতে হবে (কমিউনিস্টদেরকে মুক্তি দেওয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক হলে শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ) 

(২) যে সমস্ত নানকার বাড়ী জমিদার বাড়ীর সংলগ্ন সেগুলিকে জমিদার ইচ্ছে করলে উচ্ছেদ করতে পারবে কিন্তু তার পরিবর্তে জমিদার কর্তৃক নানকারকে অন্য জায়গা দিতে হবে। নানকার বাড়ী স্থানান্তরের ব্যয়ও এক্ষেত্রে জমিদারকেই বহন করতে হবে। 

(৩) যে সমস্ত জমি নানকারদের দখলে আছে তার অর্ধেক জমিদারকে ছেড়ে দিতে হবে এবং বাকী অর্ধেকে নানকারদের জোতস্বত্ব স্বীকৃত হবে। যে জমিতে নানকারদের জোতস্বত্ব স্বীকৃত হবে সেগুলি খাজনায়ী জমিতে রূপান্তরিত হবে। 

(৪) জমি হস্তান্তর ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাজ দেখাশোনার জন্যে সেটেলমেন্টের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন অফিসার নিয়োগ করা হবে। এই অফিসার জমিদারদের আবেদন বিবেচনায় নানকারদের ঘরের মূল্য নির্ধারণ, খাজনার রেট নির্ধারণ ইত্যাদি করবে। [৫৪] 

এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে যে চুক্তি হয় তাতে ফুলবাড়ী ও ঢাকা দক্ষিণ নানকারদের প্রতিনিধি হিসেবে যথাক্রমে ইসমাইল আলী এবং ডক্টর মজিদ স্বাক্ষর করেন। লাউতা বাহাদুরপুরের প্রতিনিধি হলেও চিত্তরঞ্জন দাস স্বাক্ষর দানে বিরত থাকেন। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি নানকারদের অর্ধেক জমি হস্তান্তরের বিপক্ষে থাকে এবং পার্টির লোক হিসেবে তাকে চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার নির্দেশ দেয়। এই সম্মেলনে নানকারদের পক্ষে পরামর্শ দানের জন্য বারীন দত্ত উপস্থিত থাকেন। চুক্তিতে প্রাদেশিক লীগের (সরকারের) পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেন হামিদুল হক চৌধুরী, হাবিবুল্লা বাহার, সৈয়দ মোয়াজ্জমউদ্দীন হোসেন এবং আবদুল হামিদ। জমিদারদের পক্ষে স্বাক্ষর দেন কালী সদয় চৌধুরী (ঢাকা দক্ষিণ), আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী (বাহাদুরপুর) ও খান বাহাদুর গউসউদ্দীন চৌধুরী (দাউদপুর সদর থানা)।[৫৫] উপরোক্ত চুক্তিটির ফলে নানকার আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অনেক রাজবন্দীসহ অজয় ভট্টাচার্য ১৯৪৮-এর ৭ই জানুয়ারী মুক্তি লাভ করেন।[৫৬] 

এই চুক্তির ফলে কিন্তু সিলেটের নানকার এলাকাগুলিতে সামগ্রিকভাবে কোন পরিবর্তন হলো না। কারণ যে তিনটি এলাকায় আন্দোলন হয়েছিলো চুক্তিটি কেবলমাত্র সেই সেই এলাকার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিলো অন্যান্য জায়গায় নয়। তাছাড়া ঐ তিনটি এলাকারও অন্যান্য যে সমস্ত প্রজারা নানকারদের সমর্থনে এসেছিলেন তাঁদেরও অবস্থার কোন পরিবর্তন হলো না। খাজনার হার কমানো, উচ্ছেদ বন্ধ করা ইত্যাদি সম্পর্কে কোন আইন সরকার প্রণয়ন করলো না। 

নানকারদেরকে অল্প কিছু অধিকার প্রদান করে উপরোক্ত সরকারী সিদ্ধান্তের পরও সেই সব সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে পুলিশ ও সরকারী প্রশাসন যন্ত্রের ভূমিকা ১৯৪৮-এর পয়লা জানুয়ারীর একটি ঘটনা থেকে অনেকখানি বোঝা যাবে। ঐ দিন সন্ধ্যা ৮টার সময় ফুলবাড়ী বৈটিঘর বাজারে ইসমাইল আলী (যিনি তখন কৃষক সভা পরিত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন) স্থানীয় নানকারদের একত্রিত করে নানকার মীরাসদার বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত হয়েছিলো সেগুলি তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করছিলেন। সেই সময় তিন চার জন পুলিশ ও মিলিটারী এসে তাঁকে ঘেরাও করে এবং গ্রেফতার করে এনে গোলাপগঞ্জ থানায় লকআপে আটক রাখে। থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা সেখানে ইসমাইল আলীকে সম্বোধন করে বলে, “এই শালার বাচ্চা ইসমাইল, তুই যে ডালে ডালে ঘুরে বেড়াস আমি সেই ডালের পাতায় পাতায় বেড়াই। তুই ঢাকায় গিয়ে মন্ত্রীদের কাছে আমার বিরুদ্ধে অনেক কথা লাগিয়েছিস, এখন যাবি কোথায়?” পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুশমন ইত্যাদি বলে ইসমাইলকে আরও অনেক গালাগালি করার সময় প্রতিবাদ জানালে দারোগা তাঁকে হান্টার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করার হুমকি দেখায়। কৃষক সমিতির নৈমুল্লা তখন সেখানে উপস্থিত হয়ে ইসমাইলের পক্ষে জামিন দাবী করলে দারোগা রুদ্র মূর্তি হয়ে “কোন শুয়োরের বাচ্চা জামিন নিতে আইবি” বলে তাঁকেও ধাক্কা দিয়ে লকআপে ঢোকায়। নৈমুল্লাকে পরে ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি ইসমাইলের জামা কাপড় লকআপের বাইরে রেখে চলে যান। পর দিন সিলেটে ইসমাইলকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হলেও তার জামা কাপড় এবং অন্যান্য মূল্যবান কাগজপত্রের কোন সন্ধান তিনি আর পাননি।[৫৭] 

মাত্র তিনটি এলাকার নানকারদের সাথে জমিদার ও সরকার পক্ষের একটা অসন্তোষজনক চুক্তি হলেও তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে অনেক গাফিলতী দেখা দিলো এবং চুক্তিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চললো।[৫৮] তাছাড়া অন্যান্য এলাকার নানকার এবং সাধারণ জমিদারীর প্রজাদের কোন সমস্যারই বিন্দুমাত্র সমাধান হলো না। এর ফলে সিলেট জেলায় কৃষক আন্দোলনও বন্ধ না হয়ে অব্যাহত থাকলো। জমিদারের খাজনা বন্ধ হলো এবং নানকারসহ অন্যান্য প্রজাদের সাথে ভূস্বামীদের ছোটখাটো সংঘর্ষও বন্ধ হলো না। জায়গায় জায়গায় পুলিশ ক্যাম্পগুলি তুলে না নিয়ে সরকার শান্তি রক্ষার নামে সেগুলিকে বসিয়ে রাখলো। ইতিপূর্বে লাউতা বাহাদুরপুরে করম আলী নামে এক ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছিলো। সে আসামে মুসলমান কৃষকদেরকে উচ্ছেদের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলো এবং দেশভাগের পর এই অঞ্চলে এসে জমিদারদের পক্ষে কৃষকদের ওপর নানান নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিলো 

এই অত্যাচারের ফলে তার বিরুদ্ধে কৃষকরা সাধারণভাবে ভয়ানক বিক্ষুব্ধ ছিলেন। ১৯৪৮ এর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে রাত্রিতে বাহাদুরপুরের নদীর অপর পারে অজয় ভট্টাচার্য কৃষক কর্মীদেরকে নিয়ে সভা করছেন এমন সময় করম আলী গ্রামে এসে উপস্থিত হলো। তার উপস্থিতির সংবাদ পেয়ে গ্রামবাসীরা তাকে ধরে ফেলেন এবং প্রচণ্ড প্রহারের পর তাকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে যান। কাছাকাছি যে সমস্ত পুলিশ ছিলো তাঁরা সে সময় ফাঁকা আওয়াজ করতে করতে পলায়ন করে। করম আলী কিন্তু মারা যায়নি। পরে থানা থেকে পুলিশ এসে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।[৫৯] 

পরদিনই পুলিশ অধিক সংখ্যায় বাগ প্রচণ্ড খাঁ লাউতা বাহাদুরপুর অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং ব্যাপকভাবে লুটতরাজ, মারপিট, ধর্ষণ ইত্যাদি চালায়। এর ফলে পাশাপাশি পাঁচটি গ্রামের লোকজন গরু ছাগল ইত্যাদি ফেলে হাওড় ও জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যায় এবং গ্রামগুলি সম্পূর্ণভাবে জনশূন্য হয়ে পড়ে। প্রায় পাঁচ হাজার লোক এইভাবে ঘরবাড়ি থেকে উদ্বাস্তু হলেন এবং তাঁদের খাওয়া, থাকা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থাই হয়ে দাঁড়ালো এক বিরাট সমস্যা। এই সময় কৃষক সভার কর্মীদেরকে নিয়ে অজয় ভট্টাচার্য গ্রামে ঘুরবার সময় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তাঁর বাড়ীতে পুলিশ ঢুকে ভাঙচুর করে এবং কাঁথা বালিশ ইত্যাদিসহ সমস্ত কিছু লুট করে নিয়ে যায়।[৬০] 

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের এই ঘটনাটির অতি সংক্ষিপ্ত নিম্নলিখিত রিপোর্টটি নওবেলালে প্রকাশিত হয়: 

লাউতা বাহাদুরপুর হইতে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে-পুলিশের সঙ্গে সেখানকার জনতার এক ভীষণ সংঘর্ষ হইয়া গিয়াছে। উভয় পক্ষেই কয়েকজন লোক গুরুতরভাবে আহত হইয়াছেন। প্রকাশ, কয়েকজন লোককে ধরিবার জন্য বিয়ানীবাজারে দারোগা বাহাদুরপুর গেলে সেখানকার লোকের সঙ্গে তাহার বচসা হয় তার ফলেই এই সংঘর্ষের সূচনা হয়। [৬১]

পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রে উপরোক্ত ঘটনার এই একমাত্র রিপোর্টটিতে যে প্রকৃত ঘটনার কোন উল্লেখই নেই তা বলাই বাহুল্য। শুধু এই একটি মাত্র ঘটনা নয়, এই ধরনের সমস্ত ঘটনাই তৎকালীন মুসলিম লীগ সমর্থক ও সরকারী সংবাদপত্রে এর বেশী স্থান পেতো না এবং স্থান পেলেও ঘটনাগুলিকে যথাসাধ্য এভাবেই বিকৃত করে জনগণের সামনে উপস্থিত করা হতো। 

একদিকে হাজার হাজার নানকার ও কৃষক উদ্বাস্তু হয়ে নিদারুণ দুর্দশার মধ্যে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জঙ্গলে ঘুরতে থাকলেন এবং অন্যদিকে জমিদার মুয়ীদ চৌধুরীর পরিচালনায় ভূস্বামীদের দালালরা তাদের কাছে প্রস্তাব করতে থাকলো যে জমিদারদেরকে টাকা দিলেই সব কিছু মিটমাট হয়ে যাবে এবং তারা আবার গ্রামে তাদের ভিটে বাড়ীতে ফিরতে পারবেন। এই পরিস্থিতিতে নানকাররা ঘরে ফেরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন এবং শেষ পর্যন্ত জমিদারদের প্রস্তাব মতো তাঁদেরকে টাকা দিয়ে গ্রামে ফিরলেন। কেবলমাত্র নানকারদের মধ্যে যারা কৃষক সভা ও কমিউনিস্ট পার্টির অগ্রসর কর্মী ছিলেন তাঁরা আর নিজেদের গ্রামে এইভাবে না ফিরে সানেশ্বর অঞ্চলে চলে গেলেন। এর পর নানকার আন্দোলনের মূল কেন্দ্রও সানেশ্বের স্থানান্তরিত হলো। কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচী অনুযায়ী সেখানে কাজ শুরু হলো। পূর্ব বাঙলা সরকার ১৯৪৭-এর ১লা ডিসেম্বর সিলেটের মুনছুর আলী এমএলএ এর সভাপতিত্বে ‘চাকরান প্রথা তদন্ত কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির অন্যান্য সদস্যদের নাম : ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী (জমিদার), যোগেন্দ্র দাস এমএলএ, ইদরিস আলী এমএলএ, আবদুর লতিফ এমএলএ, আবদুল মোমেন এমএলএ, মির্জা আবদুল হাফিজ এমএলএ। আসাম সরকারের অবসরপ্রাপ্ত এডিএল আর খান সাহেব আজিজুর রহমানকে এই কমিটির সদস্য ও সেক্রেটারী নিযুক্ত করা হয়। জানুয়ারী, ১৯৪৮-এর মাঝামাঝি এই কমিটি তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্নাবলী প্রচার করেন তার মূল উদ্দেশ্য হলো : 

(১) এই কমিটি পূর্ববঙ্গে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকার চাকরান প্রথা সম্পর্কে পরীক্ষা করিয়া দেখিবেন। 

(২) বিভিন্ন প্রকার চাকরান প্রজাদের অধিকার ও তাহার বিনিময় সম্পর্কে তদন্ত করিবেন।

(৩) ইহাদের অবস্থার উন্নতির জন্য কোন সুবিধা ও অধিকার দেওয়া যায় কিনা এবং দিলে ন্যায়সঙ্গতভাবে কি ও কতখানি অধিকার ও সুবিধা দেওয়া যাইতে পারে তদন্ত করিবেন। বিশেষ করিয়া সিলেটের নানকার এবং অন্যান্য চাকরাণ প্রজাদের সম্বন্ধে অভিমত জ্ঞাপন করিবেন। [৬২] 

ঊর্ধ্বমুখী নানকার আন্দোলনের মুখে এবং পূর্বোক্ত মুসলিম লীগ তদন্ত কমিটির নানকার প্রথা সম্পর্কিত বিস্তৃত রিপোর্টের ও ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানতঃ সিলেটের জমিদারদের দ্বারা গঠিত এই কমিটির প্রশ্নাবলী বিলির এই ব্যবস্থা যে নানকার আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে নানকার প্রথা উচ্ছেদের প্রশ্নটি ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই পূর্ব বাঙলা সরকার কর্তৃক হয়েছিলো এ কথা মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রিকা নওবেলালের পক্ষেও অস্বীকার করার উপায় ছিলো না। তাই ‘নানকার প্রথা বিলোপ সাধনে ধামাচাপা নীতি অবলম্বন’ এই শীর্ষক একটি রিপোর্টে নওবেলাল বলে: 

মধ্যযুগীয় নানকার প্রথার অবিলম্বে অবসান ঘটাইবার জন্য যখন চারিদিক হইতে শোরগোল শুরু হইয়াছে – বর্বর যুগের ধ্বংসাবশেষ এই অমানুষিক প্রথার বিরুদ্ধে যখন প্রবল জনমত গঠিত হইয়া উঠিয়াছে – সুস্থ মানসিক অবস্থার ব্যক্তি মাত্রেই যখন এই প্রথাকে জাতির পক্ষে দেশের পক্ষে অসম্মানজনক বলিয়া তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করিতেছেন সেই যুগসন্ধিক্ষণে আমলাতন্ত্রীয় মনোভাবাপন্ন পূর্ববঙ্গ সরকার বিগত ১লা ডিসেম্বর তারিখে পূর্ববঙ্গ চাকরান প্রথা তদন্ত নামে কমিটি গঠন করিয়া জনমত সংগ্রহ করিবার উদ্দেশ্যে কতকগুলি প্রশ্নাবলী জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করিতেছেন। [৬৩] 

এই কমিটি গঠিত হওয়ার ছয় মাস পর সভাপতিসহ ছয়জন সদস্য নানকারদেরকে দখলী জমিতে স্বত্ব দানের সুপারিশ করেন। কিন্তু সেক্রেটারী আজিজুর রহমান চৌধুরী, ইদরিস আলী এমএলএ এবং ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী একটি স্বতন্ত্র রিপোর্ট দাখিল করে নানকারদের অবস্থার কোন প্রতিকার না করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার স্বপক্ষে নিজেদের মত প্রকাশ করেন। [৬৪] 

জনমত সংগ্রহ করতে গিয়ে নানকার প্রথা উচ্ছেদের স্বপক্ষে যে প্রবল জনমত সারা দেশে বিশেষতঃ সিলেট জেলায় বিদ্যমান ছিলো তার চাপে এবং নানকার আন্দোলনকে কমিউনিস্টদের প্রভাব ও নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই যে কমিটির অধিকাংশ সদস্য নানকার প্রথাকে সরাসরি বিলোপের সুপারিশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই সব সুপারিশ সত্ত্বেও পূর্ব বাঙলা সরকার নানকার প্রথা উচ্ছেদের ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রিতা ও ধামাচাপা নীতি অবলম্বন করেছিলো তার ফলে নানকারদের অবস্থার কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনই সারা সিলেটে ঘটেনি এবং নানকার আন্দোলনের তীব্রতাও কমে আসেনি। শুধু তাই নয়, একদিকে আন্দোলনের মূল এলাকাগুলিতে পুলিশ ক্যাম্প বসিয়ে রেখে সরকার নানকারদের ওপর নিদারুণ নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিলো এবং অন্যদিকে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণার দ্বারা নানকারদের ‘দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলে তাদেরকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টায় ব্যাপৃত ছিলো। সরকারের এই কমিউনিস্টবিরোধী প্রচারণার প্রকৃত স্বরূপও যে কি ছিলো তা জনগণের কাছেও আর অজানা থাকছিলো না এবং এর ফলে জনগণ সরকারের প্রতি অধিকতর বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়ছিলেন। এ বিষয়ে সরকারকে সাবধান করে ‘বাঁচিবার পথ’ নামক একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে নওবেলাল বলে: কমিউনিজমভীতি প্রচারে সরকার আজ এমনই মাতিয়া উঠিয়াছেন যে, ইহা দ্বারা কমিউনিস্ট ভীতিকে জনমন হইতে পরিপূর্ণভাবে মুছিয়া ফেলা হইতেছে। দেশবাসী যখন খোলা চোখেই দেখিতে পাইতেছে যে, যে সকল দেশকর্মী পাকিস্তানের জন্য সত্যিকারের ত্যাগস্বীকার করিয়াছে, সরকারী অব্যবস্থা এবং জনসাধারণের দুঃখদৈন্যের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাহিবার অপরাধেই যখন তাহারা কমিউনিস্ট আখ্যায় আখ্যায়িত হইতেছে, তখনই তাহারা ভাবিতে শিখিয়াছে যে স্বার্থবাদী লোকের বিরুদ্ধে মতবাদকে দমন করার এক সহজ অস্ত্র এই কমিউনিজমভীতি প্রচারের ফলে প্রচারের এই ধারা স্বাভাবিকভাবে বিরুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি করিতে বাধ্য। 

এই সরকারী নীতিকে আমরা গোড়া কাটিয়া আগায় জল ঢালার মতোই মনে করি এবং বিশ্বাস করি যে দ্রুত বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ না করিতে পারিলে সমগ্র পাকিস্তানের উপর বিপদ ডাকিয়া আনাও অসম্ভব নহে। [৬৫] 

সিলেট জেলা কৃষক সভার কর্মী শৈলেন্দ্র ভট্টাচার্য গ্রেফতার হয়ে সিলেট জেলে আটক থাকার সময় ১৯৪৮-এর মে মাসের মাঝামাঝি এই মর্মে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় যে, জেলের মধ্যে জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তিনি অমানুষিকভাবে প্রহৃত হয়েছেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সভা সমর্থকদের একটি প্রতিবাদ সভা সিলেটে আহ্বান করা হয় এবং ৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫৫ তারিখে (২২শে মে, ১৯৪৮) এই ঘটনার বিবরণসম্বলিত সংহতির একটি ক্রোড়পত্রও প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই সমস্ত রিপোর্টকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচারণা হিসেবে আখ্যায়িত করে মাহমুদ আলী নওবেলালে একটি বিবৃতির মাধ্যমে বলেন যে, শৈলেন্দ্র ভট্টাচার্য অমানুষিকভাবে প্রহৃত হয়েছিলেন বলে যে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে তা নিজে প্রত্যক্ষভাবে তদন্ত করে দেখেছেন যে তা মিথ্যা। আসলে শৈলেন্দ্র বাবুই হঠাৎ সবেগে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে ধাওয়া করলে তাঁর আক্রমণকে প্রতিহত করতে যাওয়ার ফলেই তিনি সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হন।[৬৬] 

সেই বৎসরই ডিসেম্বর মাসে অনশনরত বিচারাধীন বন্দী শৈলেন্দ্র ভট্টাচার্য ও শিশিরকুমার ভট্টাচার্যের মুক্তির দাবীতে কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে সিলেটের গোবিন্দ পার্কে একটি সভা আহ্বান করা হয়। সেই সভায় কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক গুণ্ডা চেয়ার টেবিল ভাঙচুর করে সভা ভঙ্গ করে। এই সংবাদ পাওয়ার পর পুলিশ সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে গুণ্ডামীতে অংশ গ্রহণকারীদের পরিবর্তে সভার উদ্যোক্তাদের মধ্যে সিলেট ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক বরুণ রায় ও কমিউনিস্ট কর্মী ভূপতি চক্রবর্তীকে বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুযায়ী গ্রেফতার করে। পুলিশের এই আচরণে জনগণ তাঁদের বিরুদ্ধে খুব বিক্ষুব্ধ হন। [৬৭] 

প্রত্যক্ষ বৃটিশ শাসনের অবসানের পরও সামন্ত নির্যাতন যে মধ্যযুগীয় কায়দায় সিলেটের অনেক জায়গাতেই জারী ছিলো ১৯৪৮-এর ডিসেম্বর মাসের একটি ঘটনার নিম্নলিখিত সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে তার একটা চিত্র পাওয়া যাবে: 

বিগত ডিসেম্বর মাসের প্রথমভাগে পৃথিমপাশার প্রবল প্রতাপশালী জমিদার সাহেবান[৬৮] সদলবলে স্থানীয় জঙ্গলে ব্যাঘ্র নিধনের জন্য একটি বিরাট অভিযান আরম্ভ করেন। এই অভিযানের সাহায্যের জন্যে তাঁরা প্রজা সাধারণের উপর এরূপ একটি হুকুমনামা জারী করেন যে, প্রত্যেককে অবশ্যই অনির্দিষ্টকালের জন্যে সংশ্লিষ্ট জঙ্গলে হাজির থাকিতে হইবে। কিন্তু ধান মাড়াই ও ধান কাটা প্রভৃতি ক্ষেত্রের বিভিন্ন কাজের মওসুম থাকায় তখন অধিকাংশ প্রজার পক্ষে জমিদার সাহেবানের হুকুম তামিল করা সম্ভবপর হইয়া উঠে নাই। তবে জনৈক হতভাগ্য প্রজা নিজের প্রয়োজনীয় কাজে জলাঞ্জলী দিয়াও জুলুমের ভয়ে শিকারে যাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। অবরুদ্ধ বাঘের টিকিটির নাগাল না পাইয়া জমিদার সাহেবান যখন খাসমহলে ফিরিয়া আসিলেন তখন তাহাদের সম্পূর্ণ আক্রোশ গিয়া পড়িলো হতভাগ্য প্রজাদের উপর। যাহারা শিকারে না যাওয়ার মতো অমার্জনীয় অপরাধে অপরাধী তাহাদের উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করার জন্য জমিদার সাহেবান তাহাদের সুযোগ্য নায়েবের উপর আদেশ জারী করেন। তদনুযায়ী অপরাধী প্রজাদেরকে ডাকিয়া পাঠান হইল। বিক্রমের মূর্ত প্রতীক নায়েব বাহাদুরের আদেশে তারপর হতভাগ্য প্রজাদের উপর যেরূপ বর্বর অত্যাচার চলিয়াছিলো – তাহা যে কোন সভ্যব্যক্তির বিস্ময় উদ্রেক করিবে। জমিদার সাহেবানের নিকট শত ক্ষমা ভিক্ষা ও হাতে পায়ে ধরা সত্ত্বেও কেহ এই রোমাঞ্চকর লাঞ্ছনার হাত হইতে রেহাই পায় নাই। প্রহৃতদের মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি রহিয়াছেন যাহাদের সামাজিক মর্যাদাও নেহাত কম নয়। এই সব ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথমেই দেওগাঁও নিবাসী মোঃ তুরাবউল্লাহ ও শ্রী বংকনাথের নাম করা যাইতে পারে।[৬৯] 

এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় মন্তব্য করা হয় : ‘এই বিংশ শতাব্দীতেও পাকিস্তানে মধ্যযুগীয় বর্বর প্রথায় প্রজাপীড়ন হইতে পারে তাহা আমরা কল্পনাও করিতে পারি না। [৭০] 

এই ধরনের জমিদারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সিলেট জেলায় বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিলো এবং সাধারণভাবে পুলিশের নির্যাতন অন্যান্য অনেক জায়গার তুলনায় যথেষ্ট বেপরোয়া ছিলো। সাধারণ গ্রামবাসী কৃষকরা পুলিশের ক্রমবর্ধমান নির্যাতন, ঘুষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে আদালতে বা ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের কাছে নালিশ করার কোন চিন্তাই করতেন না। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যে দুই একজন সেরকম দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিতেন তাঁদের অবস্থা পুলিশের হাতে কি হতো সেটা ফেব্রুয়ারী ১৯৪৯-এর নিম্নলিখিত সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে বোঝা যাবে: 

কিছুদিন পূর্বে সাল্লা থানার অধিবাসী এবাদউল্লা নামক জনৈক ব্যক্তি দিরাই থানার দারোগা আবদুর রহিমের উপর এক ঘুষের মামলা আনয়ন করে। বিগত ১৯৪৯ ইংরেজী তারিখে সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ারিস আলী সাহেবের এজলাসে তাহার শুনানী ছিলো। মোকদ্দমা শুনানীর পর বাদী এবাদউল্লা যখন কোর্ট হইতে বাহির হইয়া আসে তখন কোর্টের সম্মুখেই অভিযুক্ত দারোগা আবদুর রহিম এবাদউল্লাকে সুনামগঞ্জ পুলিশের সাহায্যে গ্রেফতার করে এবং অত্যধিক মারপিটের ফলে অজ্ঞান করিয়া ফেলে। 

জানা গেল থানায় লইয়া যাইবার পথে পুলিশ বিশেষতঃ দারোগা মনিরুদ্দীন এবাদউল্লাকে ভীষণভাবে প্রহার করে। উক্ত দারোগা এবং অন্যান্য পুলিশ হাতলের রোল দ্বারা এবাদউল্লার মাথা ও শরীরে যখম করে। দারোগা মনিরুদ্দীন তাহার বুকে অসংখ্য সবুট লাথি মারে বলিয়া প্রকাশ। এবাদউল্লা থানার সিঁড়ির উপর অজ্ঞান হইয়া যায়, তখন কয়েকজন পুলিশ অজ্ঞান এবাদউল্লাকে টানিয়া ও হেঁচড়াইয়া থানা লকআপে আবদ্ধ করিয়া রাখে। তখন বিকাল প্রায় ৬ ঘটিকা। জনাব ওয়ারিস আলী সাহেব তখনও কোর্টে ছিলেন। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী উক্ত অমানুষিক অত্যাচার তাঁহার গোচর করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ এবাদউল্লাকে তাঁহার সম্মুখে হাজির করিবার জন্য থানায় আদেশ দেন। বারবার তাগিদের পর অনেক গড়িমসি করিয়া পুলিশ ধরাধরি করিয়া অবচেতন এবাদউল্লাকে হাকিমের সম্মুখে উপস্থিত করে। তখন এবাদউল্লা আবার বেঁহুশ হইয়া যায়। সুনামগঞ্জ সরকারী হাসপাতালের এসিস্ট্যান্ট ও সাব-এসিস্ট্যান্ট সার্জনদ্বয় মুমূর্ষ এবাদউল্লাকে এজলাসেই পরীক্ষা করেন এবং প্রাথমিক সাহায্য প্রদান করেন। কিছু সময় পরে এবাদউল্লার হুঁশ হইলে পর ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথায় ও ঘেগরামী সুরে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তাহার উপর পুলিশের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করে। তাহার জবানবন্দীতে প্রকাশ, থানা লক আপে যখন তাহার হুঁশ হয়, তখন সে পানি চাহিলে পানি তো দেওয়া হয়ই নাই, বরং তাহাকে অত্যন্ত অভদ্র ভাষায় গালাগালি শুনিতে হয়। 

কোর্ট হইতে স্ট্রেচারযোগে অর্ধমৃত এবাদউল্লাকে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই ঘটনায় সুনামগঞ্জ শহর ও শহরতলীতে ভীষণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে।[৭১] 

কিন্তু শহর ও শহরতলীর জনগণের মধ্যে ভীষণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি এবং সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেটের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও দারোগা ও পুলিশদের কোন শাস্তি না হওয়ায় এর তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থাও অবলম্বিত না হওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে নওবেলালের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত মন্তব্য করা হয়: 

সুনামগঞ্জে পুলিশী উৎপীড়ন সীমা ছাড়াইয়া গিয়াছে। বিগত ৩রা ফেব্রুয়ারীর ‘নওবেলালে’ প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায় এবাদউল্লা নামক জনৈক ব্যক্তিকে পুলিশ যেরূপ অমানুষিকভাবে উৎপীড়ন করিয়াছে তাহা ব্রিটিশ আমলেও কদাচিৎ সংগঠিত হইয়াছে কিনা সন্দেহ। সুনামগঞ্জে পুলিশের এবপ্রকার আচরণের সংবাদ আমরা আরও পাইয়াছি। পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ সম্বন্ধে কোনই খবর রাখেন না তাহা আমরা বলিতে চাই না। কিন্তু এই প্রকার অত্যাচারমূলক স্বেচ্ছাচারীতার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোন কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বিত না হওয়ায় আমরা বলিতে বাধ্য যে, সুনামগঞ্জে পুলিশী রাজকায়েম হওয়ার সুযোগ সরকার করিয়া দিতেছেন। [৭২] 

পূর্ব বাঙলায় তৎকালে আইনের শাসন কতখানি কায়েম ছিলো উপরোক্ত ঘটনা থেকে তা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। এই শাসনের আর একটি দিক রাজবন্দীদেরকে বিনা বিচারে আটক রাখা এবং তাঁদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে সরকারী স্বেচ্ছাচারীতা। এ প্রসঙ্গে কৃষক নেতা রমানাথ ভট্টাচার্যকে জেল হাজতে আটক রাখা সম্পর্কে সিলেট জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি করুণাসিন্ধু রায় কর্তৃক নওবেলালের সম্পাদককে লেখা নিম্নোক্ত পত্রটি উল্লেখযোগ্য: 

আজ প্রায় এক বৎসর হইতে চলিলো বাহাদুরপুরের নানকার আন্দোলন উপলক্ষ্যে ধৃত হইয়া সিলেটের প্রবীণ কৃষক নেতা রমানাথ ভট্টাচার্য জেল হাজতে আটক আছেন। তাঁহার বিরুদ্ধে যে সব মামলা দায়ের হইয়াছে, সেই মামলাগুলি আজ পর্যন্ত আরম্ভ করাই হয় নাই। মামলার অন্যান্য অভিযুক্ত আসামীরা জামিনে মুক্তিলাভ করিয়াছেন। রমানাথ বাবুরও জামানত মঞ্জুর হইয়াছে। কিন্তু বারবার উপযুক্ত জামিনদার উপস্থিত করা সত্ত্বেও জামিন নাকচ করা হইতেছে। ১১ মাসের উপর জেল হাজতে থাকার ফলে রমানাথবাবু ভীষণ অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন। সামান্য জল খাইলেও তাঁহার পেটে বেদনা উপস্থিত হয়। সর্বদা পেট ফাঁপে। তাঁহার ওজন দিন দিন কমিতেছে। জামানত মঞ্জুর হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁহাকে বেআইনীভাবে জেলে আটক রাখা হইতেছে তাহার কারণ সরকার জানাইবেন কি? রমানাথবাবু গত ১৯২১ সাল হইতে স্বাধীনতার লড়াইয়ে সর্বক্ষণ কর্মী হিসাবে বহুবার কারাবরণ করিয়াছেন। তাঁহার এই কারাভোগকালে তিনি যদি মৃত্যুমুখে পতিত হন তাহা হইলেও তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিবেন না ইহা আমরা জানি। 

কিন্তু অত্যাচারীদের ষড়যন্ত্রের ফলে আটক রমানাথবাবুর জীবন রক্ষার দায়িত্ব কি আমাদের নয়? এই জন্য উদ্যোগী হইতে জেলার এমএলএগণও বিভিন্ন গণপ্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানাইতেছি।[৭৩] 

পূর্ব বাঙলার অন্যান্য অনেক জায়গার মতোই জমিদার, পুলিশ ও জেল নির্যাতনের উপরোক্ত ঘটনাসমূহ সিলেটেও কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার ছিলো না। এই বেপরোয়া নির্যাতনে ব্যাপক জনগণ জমিদার, পুলিশ ও সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং মাঝে মাঝে স্থানীয় গণবিক্ষোভ ও কতকগুলি এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠিত আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁরা তা প্রতিরোধের প্রচেষ্টা করেন। 

এই সময় সরকারী খাদ্যসংগ্রহ নীতিকে কার্যকর করতে গিয়ে চারিদিকে কৃষকদের ওপর লেভীর অত্যাচারও শুরু হয়। কৃষকদেরকে নিজ খরচায় সরকারী গুদামে ধান পৌঁছে দেওয়ার আদেশ, বাজারদরের থেকে লেভীকৃত ধানের অনেক নিম্নমূল্য, সংগ্রহের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারমূলক ব্যবহার এবং পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে কিছু কিছু প্রতিবাদ সভা ও সমাবেশের সংবাদ প্রকাশিত হয়।[৭৪] এই সভা সমাবেশ এবং আন্দোলনের ফলে জমিদার শ্রেণী ও মুসলিম লীগের নেতারাও মাঝে মাঝে সভা সমাবেশের মাধ্যমে কমিউনিস্ট বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচার করে কৃষক আন্দোলনকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার চেষ্টা করে। এই ধরনের সভার বিবরণও সিলেটের স্থানীয় পত্রিকা নওবেলালে কিছু কিছু প্রকাশিত হয়। [৭৫] 

সিলেট জেলার নানকার আন্দোলন কেন্দ্রগুলিতে আন্দোলনের বিবরণ তৎকালীন পত্রিকাগুলিতে তেমন প্রকাশিত না হলেও পুলিশ ক্যাম্প-এর অবস্থান এবং পুলিশ ক্যাম্পের সহযোগিতায় জমিদারদের অত্যাচারের কিছু কিছু বিবরণ সেগুলিতে প্রকাশিত হয়। এই বিবরণ থেকেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় আন্দোলনের অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা করা যেতে পারে। ‘জনৈক নানকার প্রজা’ এই নামে ২০শে চৈত্র, ১৩৫৫, (৩রা এপ্রিল, ১৯৪৯) তারিখে লিখিত এই ধরনের একটি চিঠিতে লাউতা বাহাদুরপুর অঞ্চলে ১৯৪৯-এর এপ্রিল মাসের অবস্থার একটা উল্লেখযোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায়: 

গত ৯ই মার্চ রেলওয়ে স্ট্রাইক হওয়ার সম্ভাবনায় তাহার ২/৩ দিন পূর্বে নানকার আন্দোলনের কেন্দ্র লাউতা বাহাদুরপুর হইতে পুলিশ পার্টি তুলিয়া নেওয়া হয়। এই পার্টি তোলার পরদিন হইতেই বাহাদুরপুরের জমিদারেরা আবার পার্টি ফিরাইয়া আনিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন। পার্টি উঠার পরদিনই জমিদারদের নেতা মইদ মিঞা সাহেব (আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এমএলএ – ব.উ.) ঢাকায় উজির সভার নিকট দরবার করিতে ছুটিয়াছেন। অন্যদিকে পার্টি বসাইবার পক্ষে অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য তাহারা পার্টির অভাবে নিজেদের জানমাল, জমিজমা সবই গেল বলিয়া মিথ্যা আর্তনাদ শুরু করিয়াছেন। নিজেরা স্বইচ্ছায় মামলার তারিখে কোর্টে হাজির না হইয়া কোর্টে সরকারের নিকট মিথ্যা টেলী পাঠাইতেছেন যে তাহারা নানকার প্রজাদের অত্যাচারে বাড়ী হইতে বাহির হইতে পারিতেছেন না। প্রজার জোতের জমি ছিনাইয়া আনার উদ্দেশ্যে লাঠিঝাঁটাসহ সংঘবদ্ধভাবে প্রজার জমিতে নিজেরা হামলা করিয়া সরকারের নিকট টেলী পাঠাইতেছেন যে, প্রজারা জোর করিয়া তাহাদের জমি চাষ করিয়া নিতেছে এবং এই সব মিথ্যা ঘটনায় জড়াইয়া জামিনে মুক্ত কিষাণ কর্মী ডাঃ শিশির চক্রবর্তী ও শৈলেন্দ্র ভট্টাচার্যের জামিন নাকচের এবং অন্যান্য কর্মীদের জেলে পুরিবার হীন প্রচেষ্টা চালাইয়াছেন। 

অথচ পুলিশ ক্যাম্প উঠিয়া যাওয়ার পরও জমিদারেরা লাউতা বাহাদুরপুরের কুটু, ভ্রমর, নবীন, জনৈক মুচি, সানেশ্বরের জনৈক কৃষক প্রভৃতির জমি জোরে ছিনাইয়া নেওয়ার চেষ্টা করিয়াছেন। কালাই বিবির ঘর ভাঙিয়া তাহার বাড়ীতে অন্য লোক দেওয়ার চেষ্টা করিতেছেন। গোলাবকে নিজ বাড়িতে ডাকাইয়া নিয়া সোয়াব মিয়া নিজে তাহাকে মারিয়া মাথা ফাটাইয়াছেন। থানা হইতে পুলিশ আনিয়া অনবরত নানকার প্রজাদের অনর্থক ধরাইয়া মারপিট ও ঘুষ আদায় করিয়া সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছেন। 

নানকার আন্দোলনের শুরু হইতে, আজ পর্যন্ত দীর্ঘ আড়াই বৎসরের মধ্যে আমাদের উপর হইতে জমিদারী জুলুম ও পুলিশ জুলুম কখনই বন্ধ হয় নাই – সে পুলিশ পার্টি থাকুক আর নাই থাকুক। তথাকথিত আপস রফায় পুলিশ পার্টি উঠাইয়া নেওয়ার শর্ত অন্যতম প্রধান শর্ত হিসাবে থাকা সত্ত্বেও সরকার বাহাদুরপুর হইতে পুলিশ পার্টি উঠাইয়া নেন নাই। যদিও অন্য প্রয়োজনে সাময়িকভাবে পুলিশ পার্টি উঠাইয়া নেওয়া হইয়াছে, কিন্তু পুলিশী জুলুম বন্ধ হয় নাই। আবার পুলিশ পার্টি বসাইবার তোড়জোড় চলিয়াছে। আরও নূতন নূতন গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করিয়া বেপরোয়া গ্রেফতার ও মারপিট চালাইবার চেষ্টা চলিয়াছে। যাঁহারা জামিনে মুক্ত আছেন, তাহাদিগকেও আবার জেলে পুরিবার ষড়যন্ত্র চলিয়াছে। [৭৬]

‘জনৈক নানকার প্রজা’র নামে এই পত্রটি প্রকাশিত হলেও তা যে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেই প্রচারিত হয়েছিলো সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ সে সময়ে লাউতা-বাহাদুরপুর অঞ্চলে নানকার প্রজাদের পক্ষে এবং মুসলিম লীগ সরকার, পুলিশ ও জমিদারদের বিপক্ষে এই ধরনের বক্তব্য পেশ করার মতো অন্য কোনো সংগঠন ও শক্তি সেখানে ছিলো না। এবং যে ধরনের ব্যক্তিরা উপরোক্ত বক্তব্য প্রচার করার উপযুক্ত ছিলেন তাঁরা সকলেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য অথবা তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট।

ওপরে উদ্ধৃত পত্রটির বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, উল্লিখিত অঞ্চলে নানকার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠার ফলে নানকাররা আর পূর্বের মতো জমিদার-মীরাসদারদের ভূমি দাস হিসেবে নিজেদের শ্রমশক্তি ও ইজ্জত দান করতে প্রস্তুত ছিলেন না এবং নানকার প্রথার শত সহস্র বেড়াজাল ছিন্ন করে সচেতনভাবে তাঁরা এই নির্যাতমূলক প্রথাকে উচ্ছেদ করার সংগ্রামকে উত্তরোত্তরভাবে শক্তিশালী করে চলেছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে সরকারের সহায়তায় জমিদাররাও নিজেদের শোষণ ও নির্যাতন ব্যবস্থাকে যথাসাধ্য টিকিয়ে রাখার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো এবং পুলিশের সহায়তায় আন্দোলন ধ্বংস করার সর্বপ্রকার চক্রান্তে লিপ্ত ছিলো। 

১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে এই পত্রটি প্রকাশিত হওয়ার অল্পকাল পরই লাউতা-বাহাদুরপুর অঞ্চলে আবার পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয় ও নানকার প্রজা এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে পুলিশের সহায়তায় জমিদার মীরাসদারদের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করে। এই অবস্থায় ১৯৪৯ সালের অগাস্ট মাসে সানেশ্বরে নানকার এবং অন্যান্য কৃষকদের সাথে পুলিশের এক বিরাট সংঘর্ষ বাধে এবং সংঘর্ষের পরবর্তী পর্যায়ে সানেশ্বর সহ সমগ্র পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। 

১৮ই আগস্ট সানেশ্বরের সংঘর্ষটি ঘটার পূর্বে লাউতা-বাহাদুরপুর-সানেশ্বর অঞ্চলে কৃষকরা শাস্তিতে এক রাত্রি যাপন করতে পারছিলেন না, কারণ প্রতিদিনই পুলিশ ক্যাম্প থেকে পুলিশেরা গ্রামে গ্রামে প্রবেশ করে অবাধ লুটতরাজ, তল্লাশী, মারপিট এবং ঘরের আসবাবপত্র নষ্ট করছিলো। পুরুষ কৃষকদের পক্ষে বাড়ীতে থাকাই সে সময় অসম্ভব হয়ে পড়ায় তাঁরা পার্শ্ববর্তী এলাকার ঝোপে জঙ্গলে রাত্রি যাপন করছিলেন। সেই সুযোগে মহিলা ও শিশুদের ওপরও পুলিশের নির্যাতন শুরু হলে মেয়েদের ইজ্জত রক্ষাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। পুলিশী নির্যাতন এই চরম পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পর তা গ্রামের সাধারণ লোকের সহ্যের সীমা অতিক্রম করলো। তাঁরা স্থির করলেন গ্রামে আর পুলিশ কিছুতেই প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না, যেমন করে হোক পুলিশকে এর পর প্রতিরোধ করতেই হবে।[৭৭] 

সানেশ্বরের সংঘর্ষের পর ঘটনা সম্পর্কে ১লা সেপ্টেম্বর একটি বিবৃতি দান করতে গিয়ে উত্তর সিলেট জেলা লীগের সহ-সভাপতি আরজদ আলী ১৮ই অগাস্টের পূর্বাবস্থা নিম্নলিখিতভাবে বর্ণনা করেন: 

‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্ব হইতে বড়লিখা এলাকাস্থ দাসের বাজার প্রভৃতি গ্রামে কম্যুনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ দৃষ্টিগোচর হয়। সম্প্রতি তাহাদের আন্দোলন সানেশ্বর, নিহারী, উলরী ইত্যাদি ৬/৭টি গ্রামে খুব জোরেশোরে চলিতে থাকে। এই গ্রামসমূহের বাসিন্দা শুধু দাস, নমঃশুদ্র গোত্রের লোক। গ্রামগুলো বড়লিখা বিয়ানীবাজার থানা হইতে ৭/৮ মাইল দূরে অবস্থিত। কোন রাস্তাঘাটের সুবিধা নাই এবং ইহা হইতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। গ্রামগুলা এক সম্প্রদায় এবং এক মতবাদের লোক অধ্যুষিত হওয়ার কারণেই তাহাদের আন্দোলন এত প্রকটরূপে দেখা দেয়। খবর পাওয়া যাইতে থাকে তাহারা গ্রামে সভা সমিতি করিয়া লাল ঝাণ্ডা উড়াইয়া রাষ্ট্রবিরোধী বক্তৃতা দ্বারা লোকদিগকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতেছে এবং পলাতক লীডার সুরত পাল ও তকন মুল্লা প্রভৃতি এই গ্রামসমূহে থাকিয়া লোকগুলাকে চালিত করিতেছে। স্বাধীনতা দিবসে তাহারা লাল ঝাণ্ডা উড়াইয়া এইরূপ বক্তৃতা দিতেছে এই অবস্থা দেখিয়া মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে এক উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। বিয়ানী বাজারের পুলিশ সরজমিনে গিয়া গ্রামে নিরাপদে ঢুকিবারও সুযোগ আর থাকে না। পুলিশও ব্যর্থ মনোরথ হইয়া ফিরিয়া আসিলে আমাদের ও জনসাধারণের মনে দারুণ ভাবনার সৃষ্টি হয়। অবশ্য আইনের মর্যাদার খাতিরে জনসাধারণ এই কার্যের বিরুদ্ধে কোনরূপ একশন নিতে বিরত থাকে। 

স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতার এই বিবৃতিতে বাহাদুরপুর-সানেশ্বর অঞ্চলে অবাধ পুলিশী ও জমিদারী নির্যাতনের কোন উল্লেখই নেই। উপরন্তু সেই অঞ্চলের স্থানীয় অমুসলমান কৃষকরা যে রাষ্ট্রদ্রোহী তা প্রমাণের যথেষ্ট ব্যগ্রতা আছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও বিবৃতিটিতে একটি বিষয়ের স্বীকৃতি খুব পরিষ্কার এবং তা হলো এই যে, তৎকালে সানেশ্বর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কৃষক আন্দোলন যথেষ্ট জোরদার এবং সংগঠিত ছিলো। এবং কৃষক নির্যাতন ব্যতীত কোন এলাকাতেই যে কৃষক আন্দোলন জোরদার, সংগঠিত ও শক্তিশালী হতে পারে না তা বলাই বাহুল্য। 

আগাস্ট মাসের দিকে কৃষকরা যখন পুলিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে সংগঠিত করতে সংকল্পবদ্ধ হলেন ঠিক সেই সময়ে ১২ই অগাস্ট বিকালের দিকে একটি লঞ্চে পুলিশী লোকেরা গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিলো। তাদেরকে এইভাবে এগিয়ে আসতে দেখে গ্রামের কিছু সংখ্যক লোক দলবদ্ধভাবে তাদের তাড়া করেন। এর ফলে তারা আর গ্রামে প্রবেশ করার সাহস না পেয়ে ফিরে যায় এবং সিলেটের জেলা কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে রিপোর্ট দিয়ে বলে যে, সানেশ্বর একটি বিদ্রোহী এলাকায় পরিণত হয়েছে। সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনী তাদেরকে আক্রমণ করায় তারা আর সেই গ্রামে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি। [৭৯] 

১৮ই অগাস্টের সংঘর্ষের অব্যবহিত পূর্বে সরকারী প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় মুসলিম লীগের তৎপরতা এবং ১৮ই অগাস্ট তারিখের ঘটনা সম্পর্কে আরজাদ আলীর উপরোক্ত বিবৃতিতে বলা হয়: 

গত ১৬ই তারিখে সিলেট হইতে সশস্ত্র পুলিশসহ ডিএসপি ও ম্যাজিস্ট্রেট খান সাহেব আবদুল লতিফ সাহেব ঘটনার স্থানে যাইতেছেন সংবাদ পাইয়া বিয়ানীবাজারের লীগ কর্মীগণসহ তথায় যাইতে রওয়ানা হই। সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম জনসাধারণ ও আনসার বাহিনীও রওয়ানা হইয়া বাহাদুর ক্যাম্পে গিয়া উপস্থিত হই। তথা হইতে রওয়ানা হইয়া সানেশ্বর বাজারে পৌঁছিয়া দেখিতে পাই বাজারের সামান্য পশ্চিমের মাঠে কতেক লোক লাঠি হাতে জমা অবস্থায় আছে। দেখিতে দেখিতে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহ হইতে লোক লাঠি হাতে আসিতে থাকে এবং সামান্য সময়ের মধ্যে বড়ো এক জনতা সারিবদ্ধভাবে খাড়া হইতে থাকে এবং অনেক লোক নদীর অপর পাড়ে জমা হইতে দেখা যায়। তাদের এই অবস্থা দেখিয়া আমাদের লোক আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনা আছে বলিয়া সন্দেহ করিবার যথেষ্ট কারণ দেখা দেয়। যাহা হউক এই অবস্থায় আমাদের লোকেরা ধীর স্থিরভাবে বাজারে খাড়া হইয়া অবস্থা নিরীক্ষণ করিতে থাকে। তৎপর পুলিশ বাহিনী রাইফেল হাতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে থাকে। বিদ্রোহী লাইন হইতে ঘন ঘন “ইনক্লাব জিন্দাবাদ” “পাকিস্তান ধ্বংস হউক” প্রভৃতি ধ্বনি শোনা যাইতে থাকে। পুলিশ বাহিনী তাহাদের মোকাবেলা হইয়া সামান্য তফাত থাকিতে ডিএসপি সাহেব বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। পরে জানিতে পারিলাম ডিএসপি সাহেব তাহাদিগকে হাতের লাঠি ইত্যাদি ফেলিয়া আত্মসমর্পণ করাইবার চেষ্টা করেন কিন্তু তাহারা প্রত্যুত্তরে পুলিশকে রাইফেল ফেলিয়া দিবার দাবী করে। এইভাবে অনেকক্ষণ কাটিয়া যায়। তৎপর পুলিশ গুলি ছুড়ে। তখন বিদ্রোহীরা আরও অগ্রসর হইতে থাকে। তখন পুলিশের ছোট একদল হইতে গুলি ছোড়া হয় ইহার পর জনতা পলাইতে আরম্ভ করে। [৮০] 

ঘটনার সময় কোন পুরুষ নেতা সানেশ্বরে উপস্থিত ছিলেন না। নেতৃস্থানীয় যে মহিলারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে সুষমা দে অন্যতম। একটি লিখিত বিবরণীতে তিনি নিম্নলিখিতভাবে ১৮ই তারিখে সানেশ্বরের ঘটনার বর্ণনা দান করেন: 

তারপর ১৭ই অগাস্ট ১৯৪৯ ইং। ঘরে ঘরে মনসাদেবীর পূজা হইতেছে। শুনা গেল লাউতার জমিদার বাড়ীতে সিলেটের DC, SP এবং DSP বহু সংখ্যক Armed Police নিয়া জমায়েত হইয়াছেন এই গ্রামগুলিকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে। সবাই চিন্তিত। ঐ দিন রাত্রেই আশেপাশের সমস্ত গ্রামের লোকেরা একত্র জড়ো হইল। তাহাদের এক কথা। তাহারা আর গ্রামে সিপাহী ঢুকিতে দিবে না। এই বিরাট বাহিনী গ্রামে ঢুকিলে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে। চোখের সামনে নীরব দর্শক হইয়া আর তাহারা এই বীভৎস অত্যাচার দেখিতে পারিবে না। তাই তাহারা ঠিক করিলো পরদিন ভোরে মেয়ে পুরুষ নির্বিশেষে সবাই একটি নির্দিষ্ট ধান ক্ষেতকে ঘেরাও করিয়া বাহির হইয়া পড়িবে যাহাতে গ্রামে আর সিপাহী ঢুকিতে না পারে। তাহাদিগকে অনেক রাত্রি পর্যন্ত বুঝানো গেল সশস্ত্র বাহিনীর সম্মুখে শুধু হাতে যাওয়ার অর্থ অনিবার্য মৃত্যু। তাহাদের এক কথা “আমাদের ঘরে বসিয়াও মৃত্যু। তাই আজ সামনাসামনি দুই একটা কথা বলিয়া না হয় মরিবো। চোখের সামনে তো আর এই বীভৎস অত্যাচার দেখিবো না।” চরিত্র নামক একজন কৃষকের কথা আজও কানে ভাসে। ও বলিয়াছিলো “কাল ভোরে আমরা মরিতে যাইব।” কৃষকদের উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়াছিলো “তোমরা কি ভয় পাও? তোমরা কি আমাদের সঙ্গে যাইবে না?” 

ঐ দিন গ্রামে কোন পুরুষ কৃষক নেতা ছিলেন না। কমরেড অপর্ণা পাল, অমিতা পাল ও সুষমা দে উপস্থিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কৃষকরা বলিতে লাগিলো, “আপনারা ভয় পাইতে পারেন, আমরা মরিতে ভয় পাই নাই। তাহাদের এই মরণপণ দৃঢ়তার কাছে সমস্ত যুক্তি হার মানিলো। পরদিন অন্ধকার থাকিতেই আশেপাশের সমস্ত গ্রাম হইতে হাজার হাজার লোক বাহির হইয়া আসিলো। একদিকে ছিলো নদী, নদীর অপর পারেও বহুলোকের জমায়েত। নির্দিষ্ট পথে স্বয়ং DC, SP এবং DSP তাহাদের সশস্ত্র বাহিনী নিয়া জনতা হইতে ৭০/৮০ গজ দূরবর্তী স্থানে সমস্ত সিপাহাদিগকে লাইন করাইয়া দাঁড় করাইয়া জনতাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন কেন তাহারা এখানে জমায়েত হইয়াছে? তখন জনতা হইতে উত্তর আসে যে, গ্রামে সিপাহী ঢুকিলে গ্রাম তাহারা একেবারে ধ্বংস করিয়া দেয়। তাই তাহারা স্বয়ং জেলাধিকর্তার নিকট তাহাদের বক্তব্য পেশ করিতে চায়। পুলিশ কর্তৃক বিধ্বস্ত ঘর দরজা শুধু স্বয়ং DC, SP এবং DSP আসিয়া দেখিয়া যাইতে পারেন; কিন্তু সিপাহী ঢুকিতে দেওয়া যাইবে না। এইরূপ আলোচনা চলাকালে সরকার পক্ষ হইতে বলা হয়, “তোমরা কি পাকিস্তান চাও না? যদি চাও তবে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি উঠাও।” তখন জনতা হইতে উত্তর আসে আমরা পাকিস্তান চাই। এবং আওয়াজ উঠে, “গরীবের পাকিস্তান জিন্দাবাদ।” 

এই আওয়াজ শোনার পর DC জনতাকে বে-আইনী ঘোষণা করেন। ১৪৪ ধারা জারী করিয়া এবং মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া গুলীবর্ষণের আদেশ দেন। DC-র Oder-এর সঙ্গে সঙ্গেই অপর্ণা পাল সিপাহীদের উদ্দেশ্য করিয়া বলেন, “তোমরা আজ সিপাহী, কিন্তু তোমাদের রক্ত কৃষকের। তোমরা আজ কাহার উপর গুলি করিতেছ।’ কিছু সংখ্যক সিপাহীর মনে দাগ কাটিলেও কার্যতঃ গুলিবর্ষণ চলিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তরফ হইতে মাটিতে শুইয়া পড়িতে বলায় অনেকে বাঁচিয়া পলায়ন করিতে পারিলো। কিন্তু প্রথম গুলির আঘাতে শহীদ হন সেই চরিত্র দাস। ৪/৫ জন নিহত হন। একজনের নাম কুটুমনি। ১৮/১৯ বৎসরের ছেলে অমূল্য। তার আঘাত লাগে সামান্যই। কিন্তু এই নরপিশাচরা পৈশাচিকভাবে হত্যা করিয়াছে। 

গুলী করার পরই সিপাহীরা মাঠে ছড়াইয়া পড়ে। সে কি বীভৎস তাণ্ডব নৃত্য। যাহাকেই ধরিয়াছে তাহাকেই অত্যাচার করিয়াছে প্রচুর। কয়েকজন মহিলা কৃষকসহ অপর্ণা পাল, অসিতা পাল ও সুষমা দে এদের চুলের মুঠি ধরিয়া লাথি মারিয়া মাটিতে ফেলিয়া দেয়। বুট জুতার আঘাতে এদের প্রত্যেকের শরীরের রক্ত জমিয়া নীলাভ হইয়া যায়। অপর্ণা পাল অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গর্ভ নষ্ট হইয়া যায়। যাহাদের ধরিলো সবাইকে নৌকায় করিয়া জমিদার বাড়ীতে আনা হইলো। নৌকায় উঠানো এবং নামানো সে এক বিসদৃশ্য ব্যাপার। আহত অবস্থায় যাহাদের চলাফেরার ক্ষমতা নাই তাহাদিগকে টানিয়া ছেঁচড়াইয়া নামানো ও উঠানো হইলো। তাহাতে শরীরের ছাল চামড়া উঠিয়া যে অবস্থা হইলো তাহা ভাষায় বর্ণনাতীত। জমিদার ঘাটে নৌকা লাগিলো সেখানে হাজার গুণ্ডার সমাবেশ। তাহাদের অশ্লীল শ্লোগান। এবং মেয়েদের তাহারা টানিয়া নিতে প্রস্তুত। এই mob সরানোর ক্ষমতা সেইদিন এই সরকারের নাই। এই পরিবেশে মেয়েরা নৌকা হইতে নামিতে নারাজ হওয়ায় জনতা ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর জমিদার বাড়ীতে উঠান হইলো। ধৃত ছেলেরা এবং লাশের খবর এখন জানাই। 

পরের দিন লাশের নৌকায় সমস্ত ধৃত কৃষক। তাহার মধ্যে চরিত্র দাসের ৯৫ বৎসরের বাবাও আছেন। পাশাপাশি আরও একটি নৌকা চলিয়াছে তাহাতে মেয়েরা। মরার পচাগন্ধ ভাসিয়া আসিতেছে। ঐ নৌকায়ই ১৮/১৯ বৎসরের অমূল্য। এই বীভৎস দৃশ্যে ছেলে জ্ঞানহারা। পাশের নৌকা হইতে তাহার কাতর গোঙানি শোনা যাইতেছিল। অনেক বলার পর মেয়েদের নৌকায় তাহাকে আনা হয়। সিলেট জেল গেটে আসিলে পর অমূল্যকে জেল সিপাহীরা ধাক্কা মারে নামার জন্য; কিন্তু তাহার কোন সম্বিত নাই। তারপর টানিয়া তাহাকে নামানো হয়। ঐ রাত্রেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। [৮১]

সানেশ্বরে কৃষক-পুলিশ সংঘর্ষের পরবর্তী পর্যায়ে ধৃত মহিলা ও অন্যান্যদের প্রতি পুলিশ ও মুসলিম লীগের লোকেরা কিরূপ আচরণ করে সুষমা দের উপরোক্ত বিবরণ থেকে তা সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। কিন্তু এ প্রসঙ্গে মুসলিম লীগের আরজদ আলী (যিনি নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন) মিথ্যায় পরিপূর্ণ এক বিবরণ দিয়ে তাঁর বিবৃতিতে বলেন: 

তখন (অর্থাৎ গুলি চালনার পর – ব.উ.) পুলিশ দল ও জনসাধারণের কতেক লোক অগ্রসর হইয়া আহতদিগকে উঠাইয়া ও পলায়মান ব্যক্তিদের মধ্য হইতে পাঁচজন মহিলাকে গ্রেফতার করিয়া নিয়া আসে এবং আহতদিগকে নৌকায় উঠাইয়া নিয়া আসা হয়। পুরুষ লীডারদের মধ্যে কেহ ধরা পড়ে নাই। বিদ্রোহী জনতার একজন দৌড়িয়া গিয়া পাশের গ্রামের স্কুলে ও একদল নদীর অপর পারে জড়ো হইতে থাকে। ইহার পর ধৃত লোকগুলোকে নৌকায় উঠাইয়া বাহাদুরপুর ক্যাম্পে চলিয়া আসা হয়। মহিলাদের হেফাজতের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হইয়াছিলো। ধৃত মহিলাদের বাচনীক জানা যায় ইহার পর কমিউনিস্টদের ব্যাপক আক্রমণ করার ব্যবস্থা আছে। গুলির বদলা তাহারা লইবে। [৮২] 

মুসলিম লীগের এই ধরনের পাণ্ডা ব্যক্তি ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের রিপোর্টকেই ভিত্তি করে ১৯৪৯ এর ১৮ই নভেম্বর পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন ব্যবস্থা পরিষদে সমগ্র ঘটনাটি সম্পর্কে এক বিকৃত ও মিথ্যায় পরিপূর্ণ বিবরণ প্রদান করেন। 

১৯শে অগাস্ট ই.পি.আর-এর সিপাইরা ধৃত ব্যক্তিদেরকে নিয়ে বাহাদুরপুর ক্যাম্পে উপস্থিত হলে আরজদ আলী বিয়ানী বাজারের মুসলিম লীগ নেতাদেরকে সাথে নিয়ে সেখানে যান এবং পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতিফের সাথে আলোচনা করেন। এই আলোচনায় বিদ্রোহীদেরকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। লাউতার জমিদার শ্যামাপদ, আরজদ আলী প্রভৃতি ২০শে অগাস্ট গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদেরকে আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব দেন এবং তার ফলে তারা শান্তভাবে আত্মসমর্পণ করতে থাকেন। এই সময় আত্মসমর্পণকারীদের দুই লাইনে দাঁড় করিয়ে কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে নির্দোষী বলে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং অন্যদেরকে গ্রেফতার করে পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।[৮৩] 

এ ব্যাপারে জমিদার শ্যামাপদ এবং মুসলিম লীগ নেতাদের প্রশংসা করে আরজদ আলীর বিবৃতিতে বলা হয়: 

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই ব্যাপারে মুসলিম লীগ ও জনসাধারণ যে কর্তব্য নিষ্ঠার পরিচয় দিয়াছেন তাহার ফল সুদূরপ্রসারী বলিয়াই মনে হয়। শ্যামাপদবাবু যেভাবে অক্লান্ত প্ররিশ্রম করিয়া এই শান্তির কাজে সাহায্য করিয়াছেন তাহাও প্রশংসীয়। [৮৪] 

ঘটনাটির পর স্থানীয় মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দাবী জানানো হয়: 

(১) বড়লিখা থানায় যোগ্য ও শিক্ষিত পুলিশ অফিসারের দরকার। কোন পুলিশ অফিসার কমিউনিস্টদের নিকট হইতে কোন ঘুষ না লইতে পারে কিম্বা কোন গ্রাম্য টাউট এ কাজে সাহায্য করিতে না পারে তৎপ্রতি সতর্কতা ও কঠোরতা অবলম্বন করা দরকার। (২) পুলিশ ক্যাম্প বাহাদুরপুর হইতে উঠাইয়া অন্যত্র সরাইয়া নেওয়া দরকার। (৩) বিদ্রোহীদের গ্রামের এলাকায় শক্তিশালী ক্যাম্প বসানো দরকার। [৮৫] 

আরজদ আলীর বিবৃতি নওবেলালে প্রকাশিত হয় ১লা সেপেটম্বর। কিন্তু ১৮ই অগাস্টের পর থেকে প্রায় দশ দিন সানেশ্বর-লাউতা বাহাদুরপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে ব্যাপক, প্রচণ্ড, অবাধ ও নির্বিচার পুলিশী ও ইপিআর বাহিনীর নির্যাতন চলে সে বিষয়ে বিবৃতিটিতে কোন উল্লেখই নেই। তবে একটি বিষয় বিবৃতিটিতে লক্ষণীয়। ১৮ই অগাস্টের পর ২০ তারিখের মধ্যে যে সংশ্লিষ্ট এলাকায় শান্তি স্থাপিত হয়েছিলো অর্থাৎ কৃষকদের পক্ষ থেকে কোন প্রতি আক্রমণ অথবা প্রতিরোধ হয়নি তার স্বীকৃতি বিবৃতিটির মধ্যে আছে। অথচ তা সত্ত্বেও ২১শে থেকে শুরু করে বিশেষতঃ ২৪শে অগাস্ট সমগ্র অঞ্চলে জমিদার ও পুলিশের নির্যাতন সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে অবাধ ও বেপরোয়াভাবে চালানো হয়। 

শুধু আরজদ আলীর বিবৃতিই নয়, ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৯-এর নওবেলালে ‘সানেশ্বরের প্রতিক্রিয়া নামে যে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় তার মধ্যেও এসব ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ থাকে না। উপরন্ত তাতে স্থানীয় মুসলিম লীগের পক্ষে সরকারের কাছে আরজদ আলীর সুপারিশকেই সমর্থন জানিয়ে কমিউনিস্ট ও স্থানীয় অমুসলমান কৃষকদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করতে গিয়ে বলা হয়: 

সানেশ্বর ঘটনার পর সাধারণ পাকিস্তানীর মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হইয়াছে যে কম্যুনিজমের নামে সিলেট পাকিস্তানভুক্তির যাহারা বিরোধিতা করিয়াছিলেন তাহাদেরই একাংশ আজ পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত করিয়া দিতে তৎপর হইয়া উঠিয়াছেন। বিয়ানী বাজার এলাকার জনগণের স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ছুটিয়া যাওয়ার একমাত্র কারণ ইহাই। সমস্ত সিলেট জেলাব্যাপী পুলিশের গুলিতে হতাহত ব্যক্তিদের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি না থাকার কারণও ইহাই।[৮৬] 

১৮ই অগাস্টের ঘটনার পর সানেশ্বর-লাউতা বাহাদুরপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার হিন্দু সুলমান জমিদাররা মুসলিম লীগ, পূর্ব বাঙলা সরকারের পুলিশ, আনসার বাহিনী ও ইপিআর বাহিনীর সহায়তায় সমগ্র অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার এক চক্রান্তমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এবং সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ঐসব এলাকায় শান্তি বিরাজ করা সত্ত্বেও তাঁরা পরিকল্পিতভাবে গ্রামবাসীদের ওপর চড়াও হয়ে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এইসব গ্রামের অধিবাসীরা অধিকাংশ নমঃশূদ্র হওয়ায় স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার তুফান তুলে তাদেরকেও নিজেদের চক্রান্তমূলক পরিকল্পনায় সামিল করতে সে সময়ে তারা অনেকাংশে সফল হয়। 

সানেশ্বরের ঘটনার ওপর পূর্ব বাঙলা পরিষদে ১৮ই নভেম্বর, ১৯৪৯ তারিখে যে বিতর্কমূলক আলোচনা হয় তাতে সেই সময়কার অনেক ঘটনার তথ্য বিবরণ পাওয়া যায়। [৮৭] 

আলোচনাকালে নরেন্দ্রনাথ দেব ১৯৪৯-এর গোড়ার দিকের একটি ঘটনার উল্লেখ করেন।[৮৮] তিনি বলেন যে, এই সময় বাহাদুরপুরে পুলিশ ক্যাম্প বসানোর পর নানকার জমিদার পুলিশ সম্পর্কের এত বেশী অবনতি ঘটে এবং উত্তেজনা সে সময় এমন বৃদ্ধি পায় যে, সরকার বিবাদের মীমাংসার জন্যে একটা তদন্ত কমিটি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তার ফলে পরিস্থিতির বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটে না। এই সময়ে জমিদারদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় যে, গ্রামের ভিতর দিয়ে নৌকা করে আসার সময় প্রজাদের একটা দল কোন এক জমিদার পরিবারের জনৈক সদস্যকে অপমান করেছে। এই কাহিনী প্রচারের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সানেশ্বরের কাছে একটি ফেরী নৌকায় জুন মাসের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় এক জন কৃষক নিহত হয়।[৮৯] দুই দিন পরে কিছুদূরে নদীর নিম্নপ্রবাহে তার দেহ আবিষ্কৃত হয়। প্রজারা ব্যাপারটি পুলিশে রিপোর্ট করেন এবং পোস্ট মর্টেম পরীক্ষার জন্যে দেহ সিলেট নিয়ে যান। এই ঘটনার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রজারা খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং ঘটনার যথোপযুক্ত তদন্ত দাবী করতে থাকেন। সানেশ্বর বাজারে এই ঘটনাকে কেন্দ্ৰ করে সভার পর সভা হতে থাকে এবং এই পর্যায়েই সামরিক বাহিনী এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারদেরকে ঘটনাস্থলে প্রেরণ করা হয়।[৯০] ১৮ তারিখে সংঘর্ষের পর সানেশ্বর, মেহারী, উলূরী, কান্তিগাঁও ও সানেশ্বর বাজারের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পুলিশ, ইপিআর বাহিনী যথেচ্ছভাবে লুটতরাজ, মারপিট, ধর্ষণ ইত্যাদি চালায়। কিন্তু তারপর ঐ অঞ্চলে কৃষকরা কোন প্রতিরোধের চেষ্টা করেন না এবং সংঘর্ষমূলক কোন ঘটনাও সেখানে ঘটে না। সমস্ত অঞ্চলে এক ব্যাপক ও গভীর আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে। ঠিক সেই সময় ২১শে তারিখে ইপিআর বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঐ অঞ্চলে আবার উপস্থিত হয়। তাদের এই উপস্থিতিতে শুধু কৃষকরাই নন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকরাও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তারা একত্রিত হয়ে বাহাদুরপুরের জমিদার ও সিপাইদের নায়েকের সাথে পরামর্শ করে সানেশ্বর, মেহারী প্রভৃতি গ্রামবাসীদেরকে দরজা বন্ধ করে নিজ নিজ ঘরে থাকতে এবং তারা গিয়ে যখন ডাক দেবেন একমাত্র তখনই বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করতে পরামর্শ দান করেন। সেই অনুযায়ী কৃষকরা ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকেন ও স্থানীয় মাতব্বরদের কথামতো আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু এই আত্মসমর্পণের পর তাদের প্রতি ভালো ব্যবহারের পরিবর্তে শুরু হয় নির্মম অত্যাচার। সানেশ্বর, মেহারী, উজিরপুর প্রভৃতি গ্রামে শুরু হয় অবাধ লুটতরাজ, মারপিট, ধর্ষণ ও গ্রেপ্তার। এর পরও জমিদাররা সশস্ত্র পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় অবস্থাপন্ন লোকদেরকে মামলার আসামী করবে বলে ভয় দেখিয়ে অনেক টাকা আদায় করে। রাস্তাঘাটে লোক আটক করে তারা বেপরোয়াভাবে তাদের থেকেও টাকা আদায় করতে দ্বিধাবোধ করে না।[৯১] 

এর পর ঐ অঞ্চলে ঘটনা ঘটে ২৪শে অগাস্ট। সানেশ্বর বাজার থেকে তিন মাইল দূরবর্তী স্থানে হরকুঞ্জী নামে একটি গ্রাম আছে তার পার্শ্ববর্তী দুটি গ্রামের নাম যুগীরকুনা ও পানিসাইল। হরকুঞ্জী গ্রামে ৪৫ ঘর নমঃশূদ্রের বাস এবং তারা সকলেই বাহাদুরপুরের মুসলমান জমিদারদের প্রজা। প্রায় বারো বৎসর ধরে খাজনার হার নিয়ে জমিদারদের সাথে এই প্রজাদের মামলা চলছিল। ঘটনার অল্প কিছুকাল পূর্বে হাইকোর্ট প্রজাদের পক্ষেই রায় দেন এবং ২ টাকা ১২ আনা হারে খাজনা নির্দিষ্ট হয়। এই হাইকোর্ট রায়ের পর প্রজারা বকেয়া খাজনা পরিশোধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নানকার আন্দোলনের সাথে তাঁদের কোন সম্পর্ক না থাকলেও একদল ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলের লোকসহ বাহাদুরপুরের জমিদাররা তাদের ওপর ২৪শে অগাস্ট এক বর্বর আক্রমণ চালায়। সানেশ্বর বাজার থেকে মাইল তিনেক দূরবর্তী হরকুঞ্জী গ্রামটিকে পার্শ্ববর্তী এলাকার তিন-চার শত মুসলমান অধিবাসীসহ ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলের ২৫/৩০ জন লোক ঘেরাও করে। গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই এই বাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রাণভয়ে মাঠের মধ্যে পলায়ন করলো। যারা সেভাবে পলায়ন করতে পারলো না তাদেরকে অমানুষিকভাবে মারপিট এবং মেয়েদেরকে ধর্ষণ করা হলো। গ্রামবাসীর যা কিছু অস্থাবর সম্পত্তি গরু ছাগল, ধান চাল, কাপড় চোপড়, ঘটিবাটি সবকিছুই তারা লুণ্ঠন করলো। সোনার গহনা এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্রের আশায় তারা কাঠের বাক্স হাঁড়ি পাতিল ভেঙে তছনছ করে দিলো।[৯২] 

মহেন্দ্র নমঃশূদ্রের বাড়ীতে তারা বিশাহরির মূর্তি চূর্ণ করলো, নবরাম নমঃশূদ্রকে এমনভাবে মারা হলো যে ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার হাত ফুলে ছিলো। নবরামের স্ত্রীকে ধর্ষণ করার সময় তার গালে সিপাইরা এমনভাবে কামড় দিয়েছিলো যে তার গালে দাতের দাগ বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত ছিলো। এই বাড়ীতে ইপিআর এর সৈনিকটি তার ব্যাজ ফেলে গিয়েছিলো এবং সেটি সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট-এর কাছে জমা দেওয়া হয়েছিলো। ধানীরাম নমঃশূদ্র নামে খুব অসুস্থ একজনকে এমন প্রহার করা হয়েছিলো যে সেই আঘাতের ফলে তার চার দিন পর তার মৃত্যু ঘটে। এই ধানীরামের বৃদ্ধা মাতাকেও মারপিট করা হয় এবং তার কাছে টাকা দাবী করা হয়। তাকে টেনে হিঁচড়ে এ বাড়ী থেকে ও বাড়ী নিয়ে গিয়ে শেষে উলঙ্গ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঈশ্বর নমঃশূদ্রের পুত্রবধূকে তার স্বামী এবং শ্বশুরের সামনেই ধর্ষণ করা হয়।[৯৩] 

দুই ঘণ্টা ধরে হরকুঞ্জী গ্রামে লুটতরাজ করার পর তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম যুগীরকুনা এবং পানিসাইল গ্রামে প্রবেশ করে। এই দুই গ্রামের লোকেরা বাহাদুরপুর জমিদারদের প্রজা ছিলেন না কিন্তু তা সত্ত্বেও বাহাদুরপুর জমিদাররা পূর্ব বাঙলা সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় তাদের ওপরেও নির্বিচারে নির্যাতন চালায়।[৯৪] 

যুগীরকুনা গ্রামের আটটি বাড়ী লুট করা হয়েছিলো। এই গ্রামের অধিকাংশ লোকই ছিলো নাথ সম্প্রদায়ের। তাদের বাড়ী থেকে প্রচুর পরিমাণ সুতো, তাঁতের কাপড়, তাঁতের জিনিসপত্র ইত্যাদি লুট করা হয়েছিলো। এই গ্রামের লোকজনও প্রাণভয়ে মাঠের দিকে পালায়ন করে। কিন্তু যারা পলায়ন করতে সক্ষম হয় না তাদের মধ্যে পুরুষদের মারপিট এবং মেয়েদেরকে মারপিট ও ধর্ষণ করা হয়। বয়স্কা মহিলারাও এই নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পান না। পানিসাইলের দুলাল ও কাতান নমঃশূদ্রের বাড়ী লুট করা হলো, অভিরাম নমঃশূদ্রের স্ত্রী ধর্ষিতা হলেন, নরেন্দ্র চৌধুরীর বাড়ীতে একজন সৈনিক প্রবেশ করে বিশাহরির মূর্তি চূর্ণ করলো। এই সব কর্মকাণ্ডের পর পর সন্ধ্যা নামার অল্প একটু পূর্বেই হুইসেল বাজিয়ে তারা লুণ্ঠিত জিনিসপত্র নৌকায় তুলে নিয়ে গ্রাম পরিত্যাগ করে গেলো।[৯৫] বিয়ানীবাজার থেকে দশ মাইল দূরবর্তী গোলাপগঞ্জ থানার অধীনে ৩৪ নম্বর সার্কেল সারাপাঞ্চ মৌলভী মুকাদ্দাস আলী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশের কর্তাদেরকে জানান যে, ২৭শে অগাস্ট দুপুরের পূর্বে কয়েকজন স্থানীয় মুসলমানকে সাথে নিয়ে হাতে বন্দুকসহ ইউনিফরম পরিহিত তিনজন সিপাহী রাংঝিআইল, আনন্দপুর ও সুপাতক গ্রামে প্রবেশ করে গুলি করার ভয় দেখিয়ে পনেরোটি বাড়ী লুট করে, কয়েকজন লুটতরাজ প্রতিরোধ করতে গেলে তাদেরকে প্রহার করে এবং তাদের ধানচাল, কাপড় চোপড় ইত্যাদি নিয়ে যায়। গরু ছাগল পর্যন্ত তারা দখল করে কিন্তু পরে টাকার বিনিময়ে তারা সেগুলি মালিকদেরকে ফেরৎ দেয়।[৯৬] 

১৮ই নভেম্বর পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে সানেশ্বর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ঘটনাবলী সম্পর্কে যে আলোচনা হয় তাতে কংগ্রেস দলীয় সদস্যদের রিপোর্ট থেকে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের দ্বারা সমগ্র ঘটনাবলীর সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা দানের প্রচেষ্টার ফলে তার মূল্য অনেকখানি কমে যায় এবং সিলেটের মঈনুদ্দীন আহমেদ চৌধুরীর মতো সদস্যের পক্ষে পরিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীতে সমগ্র ঘটনাটিকে বিকৃত করে পরিষদে বক্তৃতা দানের পথ প্রশস্ত হয়। শুধু তাই নয়। এদিক দিয়ে নূরুল আমীনেরও অনেক সুবিধা হয়। তিনি একদিকে হিন্দু এবং অন্যদিকে কমিউনিস্টদের ওপর একতরফা দোষারোপ করে লুণ্ঠন, মারপিট, ধর্ষণ ইত্যাদির কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। 

বিরোধী দলের কয়েকজন সিলেটি সদস্য ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট দান করেন এবং ঘটনাবলীর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করেন। কিন্তু নূরুল আমীন বিচার বিভাগীয় তদন্তের পুঁথিগত ব্যাখ্যা উপস্থিত করে পরিষদকে বলেন যে, যে কোন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা কমিশনার দ্বারা অনুষ্ঠিত তদন্তকেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত বলা চলে। চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার নিজে সিলেটে গিয়ে তদন্ত করেছেন। এবং নিজের রিপোর্ট তাদের কাছে প্রদান করেছেন। কমিশনারের সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই নূরুল আমীন ঘটনা সম্পর্কে পরিষদে নিজের রিপোর্ট পেশ করেন।[৯৭] 

১৯৪৯-এর অগাস্ট মাসে সানেশ্বরের ঘটনাবলী এবং তার পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে সরকারী বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে নূরুল আমীন তাঁর পরিষদ বিবৃতিতে বলেন: 

যদিও এই এলাকা কংগ্রেসের একটা শক্তিশালী এলাকা ছিলো তথাপি দেশভাগের পূর্ব থেকেই সেখানে কমিউনিস্টদেরও তৎপরতা ছিলো। ১৯৩৭ সালে বীরেশচন্দ্র মিশ্র নামক জনৈক সক্রিয় কমিউনিস্ট এলাকাটিতে আবির্ভূত হয়ে যথেষ্ট আলোড়নের সৃষ্টি করেন। তিনি আসাম ব্যবস্থা পরিষদের নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী বাবু রবীন্দ্রনাথ আদিত্যের বিরুদ্ধে এই এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বাহাদুরপুরের মুসলমান জমিদারদের সহায়তায় কংগ্রেস প্রার্থী বীরেশচন্দ্র মিশ্রকে বিপুল ভোটাধিক্যে পরাজিত করেন।[৯৮] কিন্তু তার পরও শরৎপাল চৌধুরী (সুরত পাল-ব. উ.), অজয় ভট্টাচার্য ও শিশির ভট্টাচার্য প্রভৃতি কিছু সংখ্যক স্থানীয় লোকদের সহায়তায় বীরেশের তৎপরতা অব্যাহত থাকে। আমি এই সব লোকদের নাম উল্লেখ করছি এজন্যে যে, এদের পরিবারের স্ত্রীলোকেরাই এখন এই ঘটনায় নেতৃত্ব দান করছে। ১৯৪০ সালে কয়েকজন সহচরসহ বীরেশ মিশ্র আসাম সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং কমিউনিস্টরা যুদ্ধে সহায়তা দানের পক্ষে থাকার জন্যে একটা সাধারণ নীতি হিসেবে ১৯৪২ সালে তাদেরকে মুক্তি দান করা হয়। স্বাভাবিকভাবে এই সুযোগের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার তারা করে। বিগত যুদ্ধ সাফল্যের সাথে পরিচালনার জন্যে মিত্রশক্তির সাথে সহযোগিতার কথা প্রচারের সাথে সাথে তারা কমিউনিস্ট ভাবধারাও প্রচার করতে থাকে এবং বিয়ানীবাজার, বড়লেখা ও পার্শ্ববর্তী থানাসমূহের মেহারী, সানেশ্বর, দাসেরবাজার, ভাটশী, উরী, সিলকুরা, চাঁদপুর, উজিরপুর, উকির কুঞ্জী, নাজিরপুর, ফারিংগা, ছাংগুন প্রভৃতি গ্রামে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বীরেশ আবার আদিত্যবাবুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তিনি জয়লাভে সমর্থ হলেও এই এলাকার অধিকাংশ ভোটে বীরেশ মিশ্রের পক্ষেই প্রদান করা হয়। কংগ্রেসের প্রভাব যে দোদুল্যমান এর থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো। জমিদারী ও নানকার প্রথা উচ্ছেদের আবরণে এই কমিউনিস্টরা কিছু সংখ্যক মুসলমান নানকার প্রজারও সমর্থন লাভ করে। কিন্তু তাদের প্রধান কাজকর্ম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং জনগণের আইন ও শৃঙ্খলা বিরোধী ধ্বংসাত্মক কাজে প্ররোচিত করাতেই নিয়োজিত ছিলো। যেহেতু জমিদাররা ছিলো মুসলমান সেজন্যে আসামের কংগ্রেসী সরকার এবং কংগ্রেসী কর্মীরা এ ব্যাপারের দিকে কোন খেয়াল করেনি এবং আন্দোলনের মোকাবেলার কোন সক্রিয় ব্যবস্থাও তারা গ্রহণ করেনি। সচরাচর কমিউনিস্টরা জমিদারদেরকে বয়কট, খাজনা বন্ধ, লুট, হিংসাত্মক কার্যকলাপ এবং অন্যান্য যে কাজগুলি তাদের প্রধান উদ্দেশ্য অসন্তোষ সৃষ্টি ও আইনানুগ কর্তৃপক্ষকে ধিকৃত ও দুর্নামগ্রস্ত করার জন্যে ব্যবহার করে থাকে এই আন্দোলনেও তাই করতো। আসাম সরকার এখানে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করে। ২৬টি অপরাধমূলক মামলাসহ বহুসংখ্যক মামলা দেশভাগের পূর্বে দায়ের করা হয়েছিলো। [৯৯] কিন্তু গণভোটের সময় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সাথে কমিউনিস্টদের সহযোগিতার সময় সেগুলি তুলে নেওয়া হয়। সিলেটের পাকিস্তানভুক্তির পর বীরেশচন্দ্র মিশ্র সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং পাকিস্তানে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে নিজের অনুচরদের অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। মুসলিম লীগ কর্মীগণ কর্তৃক নানকার সমস্যার একটা সন্তোষজনক সমাধানের প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে তারা গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রচারণা চালায় যে, পূর্ব পাকিস্তান দুর্বল এবং তার পক্ষে কোন সুসংগঠিত ঘোরতর আন্দোলন ঠেকানো সম্ভব নয়। নৈরাজ্য বিস্তার এবং কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচরণকেও তারা উৎসাহ প্রদন করে। জনগণকে আরও বলা হয় যে, চীন ও বার্মার মতো পূর্ব পাকিস্তানও কমিউনিস্টদের কর্তৃত্বে এসে যাবে। চীন ও বার্মায় কমিউনিস্টদের সাফল্য উদযাপনের উদ্দেশ্যে এই এলাকায় তারা অনেকগুলি অনুষ্ঠান করে। হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্যে জনগণকে তারা উত্তেজিত করে। এর ফলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল লোকদেরকে ভীতিপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তাঁরা অনেক অপরাধমূলক কাজ করে। আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে তারা পুলিশকে আক্রমণ করে তাদেরকে আইনসঙ্গত কর্তব্য কাজ থেকে বিরত করতে থাকে। এবার আমি কতকগুলি কেসের উল্লেখ করবো। 

১৯৪৭ সালের ২০শে নভেম্বর ৪ জন আসামীকে উদ্ধার করার চেষ্টায় ৫০০ সশস্ত্র ব্যক্তি কর্তৃক বাহাদুরপুরের পুলিশ ক্যাম্পে আক্রমণ করা হয়। দাঙ্গা ও খুন খারাবীর সাথে জড়িত কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার জন্যে ১৯৪৮ সালের ২৭শে মার্চ বাহাদুরপুর ক্যাম্পের নিকটের বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগাকে আক্রমণ করা হয়। দাঙ্গা ও বেআইনী আটকের দায়ে অভিযুক্ত কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সময় ১৯৪৮ সালের অগাস্ট মাসের প্রথম দিকে কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল একটি সশস্ত্র দলের দ্বারা আক্রান্ত ও আহত হয়। এর ফলে গুলি চালাতে হয় এবং তাতে এক ব্যক্তি (মুসলমান) নিহত হয়। 

গুলি চালনায় প্রধানতঃ মুসলমানরা জড়িত থাকায় তাঁদের ওপর ঘটনাটির একটা স্বাস্থ্যকর প্রভাব পড়ে। কিন্তু সরকার ও পাকিস্তান রাষ্ট্রকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে অমুসলমানদের মধ্যে কমিউনিস্ট অনুপ্রাণিত পাকিস্তানবিরোধী কার্যকলাপ অব্যাহত থাকে। যারা খোলাখুলিভাবে ধ্বংসাত্মক এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলো ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে তাদের কিছু সংখ্যককে গ্রেফতার এবং কিছু সংখ্যকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এরপর অল্প কিছুকালের জন্যে এলাকাটি শান্ত থাকে। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে বড়লেখা থানায় পাকিস্তানবিরোধী কার্যকলাপ আবার শুরু হয়। অধিকতর সশস্ত্রভাবে তৎপর কমিউনিস্ট কর্মীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা শুরু করা হলেও স্থানীয় ব্যক্তিরা তাদেরকে আশ্রয় দান করার এবং তাদের পক্ষে সীমান্ত পার হয়ে আসামে পলায়ন সহজ হওয়ার কারণে তাদেরকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না। এলাকাটিতে নানকিং ও সাংহাইয়ের পতন ব্যাপকভাবে উদযাপন করা হয় এবং সানেশ্বরে জনসভা ও মিছিল হয়। ব্যাঙ্গাত্মক পাকিস্তানবিরোধী ধ্বনি অতীব উৎসাহের সাথে সচীৎকারে প্রদান করা হয় এবং জনগণকে বলা হয় যে, পাকিস্তানেরও পরিণতি চীন ও বার্মার মতো হবে এবং তা আগতপ্রায় কমিউনিস্ট মহাপ্রবাহে নিমজ্জিত হবে। কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তার কোন ফল দেখা যায় না। কারণ এর পরই একটি মিছিল বের হয় এবং তাতে মেহারী, উলুরী, চাঁদপুর, সিনকুরিয়া ও সানেশ্বরের গ্রামবাসীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। এখানেও পাকিস্তানবিরোধী ধ্বনি উচ্চারিত হয় এবং কর্তৃপক্ষের অবমাননা ও সশস্ত্র সংগ্রামের কথা খোলাখুলিভাবে প্রচার করা হয়। 

মাননীয় স্পীকার মহোদয়, এবার আমি আসছি ১৯৪৯ সালের ১২ই থেকে ১৮ই অগাস্টের মধ্যবর্তী ঘটনাসমূহে। ১২ই অগাস্ট, ১৯৪৯ কমিউনিস্টরা সানেশ্বরে একটি বিরাট সভার আয়োজন করে। এই সভাতে আসাম থেকে আগত কিছুসংখ্যক কমিউনিস্ট কর্মীও উপস্থিত ছিলো। এই সমস্ত সভার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো ১৯৪৯-এর ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে পাকিস্তানবিরোধী মিছিল সংগঠিত করা (সরকারী বেঞ্চের দিক থেকে একজনের চীৎকার : Shame, shame)। যারা তাদের সাথে যোগদান করেনি অথবা তাদের প্রতি অনুগত নয় বলে যাদের প্রতি সন্দেহ ছিলো তাদের বাড়ীঘর লুণ্ঠন করার জন্যে কমিউনিস্টরা জনগণকে প্ররোচিত করেছিলো। সেই অনুযায়ী এন্থনী নামে একজন খ্রীস্টান এবং রাজেন্দ্র পাতনী নামে সানেশ্বরের একজন হিন্দুর বাড়ী লুণ্ঠন করা হয়েছিলো। তাদের মাধ্যমে পুলিশের কাছে সংবাদ পৌঁছাতে পারে এই সন্দেহে কয়েকজন হিন্দুকে বেআইনীভাবে আটক রাখা হয়েছিলো এবং যে পর্যন্ত না তারা কমিউনিস্টদের পক্ষে যাবে এই মর্মে তাদের থেকে জোরপূর্বক মুচলেকা আদায় হয়েছিলো সে পর্যন্ত তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ১৯৪৯ সালের ১৪ই অগাস্ট সানেশ্বর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পাকিস্তানবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়েছিলো, বাড়ীর ছাদে কালো পতাকা ওড়ানো হয়েছিলো এবং “পাকিস্তান ধ্বংস হোক”-এর মতো পাকিস্তানবিরোধী ধ্বনি উৎসাহের সাথে দেওয়া হয়েছিলো। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ১৯৪৯-এর ১৫ই অগাস্ট তারা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছিলো এবং সেই উদ্দেশ্যে লাল পতাকার নীচে সানেশ্বর বাজারে বহুসংখ্যক লোকের একটি সভা হয়েছিলো। পরবর্তী দুই দিনই বিভিন্ন জায়গায় ঐ একই ধরনের সভা সমিতি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো এবং জ্বালাময়ী বক্তৃতার দ্বারা তাদেরকে হিংসার পথে প্ররোচিত করে জনগণের উত্তেজনাকে একটা উচ্চপর্যায়ে তোলা হয়েছিলো। মহিলা কর্মীদের মধ্যে কয়েকজন মিছিলে খুব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। এই আন্দোলনের দ্বারা বিয়ানীবাজার ও বড়লেখা থানার ১৫টি গ্রাম খুব গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। সেখানে মারপিট ও লুণ্ঠন হয়েছিলো। জনতা কর্তৃক যাদের বাড়ীঘর লুণ্ঠিত হয়েছিলো সে রকম কিছু সংখ্যক ব্যক্তি পুলিশের কাছে নালিশ জানিয়েছিলো। হত্যা প্রচেষ্টা এবং বেআইনী আটকের কেসও রেজিস্ট্রী করা হয়েছিলো 

১২ই অগাস্ট, ১৯৪৯-এর সভা ও মিছিলের ব্যাপারটির প্রতি লক্ষ্য রাখার এবং কয়েকটি ক্রিমিনাল কেসের জনকয়েক পলাতক আসামীকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে ঐ দিন একটি পুলিশ পার্টি অগ্রসর হলে জাঠা, শুলপি, দা ও লাঠি দ্বারা সশস্ত্রভাবে সজ্জিত প্রায় এক হাজার লোক তাদের দিকে এগিয়ে এসে তাদেরকে বাধা দেয়। এই জনতাকে নেতৃত্ব দান করে অসিতা পাল চৌধুরী নামে এক মহিলা। 

এই এলাকায় নৈরাজ্য এবং সন্ত্রাসের রাজত্বের সংবাদ পেয়ে একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটকে সাথে নিয়ে হেড কোয়ার্টার থেকে একদল পুলিশ এই জায়গার দিকে রওয়ানা হয়। ১৬ই অগাস্ট, ১৯৪৯ তারিখে পুলিশ সুপারিন্ডেন্টেও বিয়ানীবাজার যান। তাঁর মতে এই অঞ্চলে নৈরাজ্য এত ব্যাপক ছিলো এবং তা এত বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছিলো যার ফলে তিনি সশস্ত্র বাহিনীকে তলব করেছিলেন। একজন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ও দুইজন ডেপুটি পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেটকে সাথে নিয়ে এই বাহিনী ১৮ই অগাস্ট, ১৯৪৯ তারিখে সানেশ্বরের দিকে রওয়ানা হয়ে সেদিনই সেখানে উপস্থিত হয়। তাঁরা বন্দুকসহ সব রকমের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দুই হাজারেরও অধিক লোকের এক জনতাকে দেখতে পায়। সুষমা দে, অপর্ণা পাল ও অসিতা পাল চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন এই জনতা কমিউনিস্ট ও পাকিস্তানবিরোধী ধ্বনি দিচ্ছিলো। তারপর পুলিশ পার্টি তাদের দিকে অগ্রসর হয়ে কথা বলা যায় এমন দূরত্বে দাঁড়ালো। বিভিন্ন দিক থেকে জনতা পুলিশ পার্টিকে আক্রমণ করার জন্যে হুমকির মনোভাব নিয়ে সবেগে ধাওয়া করতে শুরু করলো। ম্যাজিষ্ট্রেট বৃথাই তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন এবং পরিশেষে তাদেরকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে নির্দেশ দিলেন। তারা তাতে সম্মত না হওয়ায় তিনি সেই সমাবেশকে বেআইনী ঘোষণা করে আবার তাদেরকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে নির্দেশ দিলেন। এক রাউন্ড ফাঁকা আওয়াজে কোনই ফল হলো না। বিপরীত পক্ষে জনতা ক্ষেপে গেলো এবং অসিতা পাল চীৎকার করে বলতে থাকলো যে এর দ্বারা তার এই কথাই প্রমাণিত হচ্ছে যে পুলিশের কাছে কোন গুলি নেই। এই বলে সে পুলিশকে আক্রমণ করার জন্যে তাড়া দিতে থাকলো। এই সময়ে একটা বন্দুকের গুলি ছোঁড়া হলো মেহারী গ্রামের দিক থেকে। এক বিরাট জনতা সেদিক থেকে লাল পতাকা উড়িয়ে আক্রমণের উদ্দেশ্যে পুলিশ পার্টির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। পুলিশ পার্টিকে ঘেরাও হতে দেখে এবং পরাজয়ের বিপদ আশঙ্কা করে ম্যাজিষ্ট্রেট সেই বেআইনী সমাবেশ ভঙ্গের জন্যে তাদেরকে আর একবার সতর্ক করলেন কিন্তু এবারও তা কেউ গ্রাহ্য করলো না। ম্যাজিস্ট্রেট তখন পুলিশকে গুলির আদেশ দিলেন যার ফলে এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে জনতা দুবার গুলি ছুঁড়লো এবং পাশ ও পেছনে থেকে পুলিশ পার্টিকে আর একবার আক্রমণের দৃঢ় প্রচেষ্টা নেওয়া হলো। ম্যাজিস্ট্রেট তখন আর এক রাউন্ড গুলির আদেশ দিলেন। এই গুলির ফলে ঘটনাস্থলে দুই ব্যক্তির মৃত্যু ঘটলো। পরে আরও দুইজন আহত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। কাজেই মৃতের সংখ্যা মোট দাঁড়ায় পাঁচ। মেয়েদের মধ্যে কাউকেই আঘাত করা হয়নি এবং কেউ আহতও হয়নি। এর পর জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং ছয়জন মহিলাসহ দশজনকে গ্রেফতার করা হয়। 

মাননীয় স্পীকার মহোদয়, সরকার নামের যোগ্য কেউই নিকটে অথবা দূরে, মুসলমান অথবা অমুসলমান অধ্যুষিত কোন এলাকায়, এই ধরনের পরিস্থিতিকে চলতে দিতে পারে না। যত সংক্ষিপ্ত সময়ে সম্ভব আইনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা দরকার ছিলো। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে স্থানীয় লোকদের স্বার্থেই তার প্রয়োজন ছিলো। যারা সক্রিয়ভাবে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ও সাধারণত খুবই উচ্চকণ্ঠ তাঁরা যে এ নিয়ে মহা চীৎকার শুরু করবে তাতে আর বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অতীতের হাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে স্থানীয় পুলিশকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন ছিলো। সুতরাং সরকারকে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের একটি কনটিনজেন্টসহ অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স মোতায়েন করতে হয়েছিলো। এই এলাকায় অতীতে ক্রমাগত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচরণের ইতিহাসের কথা বিবেচনা করে একথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র কোন দ্বিধা নেই যে, এই এলাকায় পরিপূর্ণ শান্তির কারণে স্থানীয় লোকদের আইন মেনে চলার ইচ্ছা নয়। তার কারণ যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি ও গতিবিধি। কমিউনিস্টদের এবং এই এলাকার ও ভারতীয় ডোমিনিয়নের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আগত নাশকতামূলক কার্যে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে যারা আশ্রয় দান করেছে ও সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছে সে রকম বিপুল সংখ্যক লোকদের ভয়ে আইনের প্রতি অনুগত যে সমস্ত লোকেরা দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রস্ত থেকেছেন তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তার মনোভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দায়িত্বশীল অফিসারদের নেতৃত্বে পুলিশকে সমগ্র এলাকায় ঘুরতে হয়েছিলো। এই এলাকাটি কিয়দংশে কমিউনিস্টদের ঘাঁটি এলাকায় পরিণত হয়েছিলো এবং এটা এভাবে চলতে দেওয়া যেতো না।[১০০] 

সানেশ্বরে ঘটনার প্রায় একমাস পর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা সরকারী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ‘সিলেট জেলায় কমিউনিস্টদের অশান্তি সৃষ্টি” এই শিরোনামায় এই রিপোর্টটিতে বলা হয়: 

যে সকল কমিউনিস্ট নেতা সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার এবং বড়লেখা থানার কতকগুলি গ্রামে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করিয়াছিলো, তাহারা পলায়ন করিয়া নিকটবর্তী ভারতীয় এলাকায় আশ্রয় লইয়াছে বলিয়া সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। 

চট্টগ্রাম বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং কমিশনার ১২ই সেপ্টেম্বর তারিখে উপদ্রুত এলাকা সফর করিয়া জানান যে, পরিস্থিতি এখন শান্ত রহিয়াছে। গ্রামবাসীগণ বিপুল সংখ্যায় সমবেত হইয়া আনুগত্য জ্ঞাপন করে এবং অশান্তি সৃষ্টিকারী কমিউনিস্টদের দমনে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। 

জানা গিয়াছে যে, সিলেটে গণভোটের সময় এই এলাকার যথেষ্ট সংখ্যক অধিবাসী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়াছিলো। অতএব তাহারা সহজেই অশান্তি সৃষ্টিতে সহযোগিতা করিবে বলিয়া কমিউনিস্টগণ মনে করিয়াছিল। যে সব লোক তাহাদের আন্দোলন প্রতিরোধের চেষ্টা করিয়াছিলো তাহাদিগকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়। 

ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং কমিশনার ইহা সুস্পষ্টভাবে জানাইয়াছেন যে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে ব্যাপৃত হওয়ার পর আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়া কোন লাভ হইবে না। [১০১] 

১২ই সেপ্টেম্বর তারিখে সংশ্লিষ্ট এলাকার দুইটি থানার বহুসংখ্যক গ্রাম কয়েক ঘণ্টার সফরকালে শাসক-শোষক শ্রেণীর আজ্ঞাবাহী চট্টগ্রামের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ও কমিশনার স্থানীয় পুলিশ ও ইপিআর অফিসার, জেলা কর্তৃক এবং জমিদারদের থেকে সংগৃহীত “তথ্যের” ভিত্তিতে ঢাকায় সাংবাদিকদের কাছে উপরোক্ত রিপোর্ট পেশ করে। এদের এই ধরনের তথ্য সংগ্রহ অভিযানকেই আবার “বিচার বিভাগীয় তদন্ত” আখ্যা দিয়ে সেই “তদন্তের” ভিত্তিতে পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন ব্যবস্থা পরিষদে তাঁর উপরোক্ত বিবৃতি প্রদান করেন। 

সানেশ্বরের ঘটনার পর নানকার আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে বিয়ানীবাজার ও বড়লেখা থানায় বিপুলভাবে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করে পূর্ব বাঙলা সরকার এক পরিপূর্ণ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। অমানুষিক মারপিট, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, জেল, জরিমানা, মামলা ইত্যাদির মাধ্যমে সৃষ্ট এক নৈরাজ্যিক পরিস্থিতিতে সমগ্র এলাকা নেতৃস্থানীয় কর্মীশূন্য হয়ে পড়ে এবং বাইরে থেকে কারও প্রবেশ সেখানে হয় একেবারেই অসম্ভব। এই সুযোগে ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালিয়ে স্থানীয় মুসলমান জনগণের মধ্যেও তারা আন্দোলনবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করতে অনেকাংশ সমর্থ হয়। এরপর সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষতঃ বিয়ানীবাজার ও বড়লেখা থানায় মুসলিম লীগ সভা সমাবেশের অনুষ্ঠান করতে থাকে এবং নানকারদের হিতাকাঙ্ক্ষী সেজে, সরকারের কাছে নানকার প্রথা উচ্ছেদের দাবী তোলে। এই ধরনের সভা সমিতি সরকারী সহায়তাতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। এগুলিতে মাহমুদ আলী, নূরুর রহমান, আরজাদ আলী প্রভৃতি মুসলিম লীগের জেলা ও মহকুমা নেতৃবৃন্দ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছিলেন।[১০২] 

সিলেটের নানকার আন্দোলনের অবস্থা এবং হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে নানকারদের মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রভাব লক্ষ্য করে মুসলিম লীগ সরকার নানকার প্রথা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। আন্দোলন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জমিদাররাও এক্ষেত্রে কোন কঠিন বিরোধিতা করতে সাহস না করে এবং মন্দের ভালো হিসেবে যতদূর সম্ভব তাদের দিকে তাকিয়ে নানকার প্রথা উচ্ছেদ আইন প্রণয়ন সম্পর্কে সরকারী সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। শুধু তা-ই নয়। যে সমস্ত জমিদার মীরাসদাররা পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সহায়তায় নানকার এলাকাসমূহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিলো তারাই আবির্ভূত হয় নানকার প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলনের নেতৃত্বের ভূমিকায়। 

এইভাবে একদিকে সন্ত্রাসের ফলে ১৯৪৯ সালের অগাস্টের পর থেকে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে নানকার আন্দোলনের বিপর্যয় ও ১৯৫০-এর প্রথম দিকে কমিনফর্মের থিসিস অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক সশস্ত্র আন্দোলন প্রত্যাহার এবং অন্যদিকে ১৯৫০ সালে পূর্ব বাঙলার মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক নানকার প্রথা উচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের পর সিলেটের নানকার আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। 

৬. ময়মনসিংহ জেলায় জমিদারী ও টঙ্ক প্রথা বিরোধী আন্দোলন 

১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পূর্বেই ময়মনসিংহ জেলা জমিদারী প্রথাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিলো। আন্দোলনের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহের এই অগ্রগতির জন্যে ১৯৪৫ সালে সারা ভারত কিষাণ সভার বার্ষিক সম্মেলন নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬-৪৭ সালে বাঙলাদেশের ১৯টি জেলাব্যাপী যে ব্যাপক ও তুমুল তে-ভাগা আন্দোলন চলে সারা ময়মনসিংহ জেলায় তা কৃষকদের মধ্যে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ‘আধি নাই, তেভাগা চাই, জান দেবো তবু ধান দেবো না, লাঙল যার জমি তার’ ইত্যাদি ধ্বনি তুলে কৃষকরা কিষাণ সভার পতাকাতলে দলে দলে সমবেত হতে থাকেন। এই জেলায় তেভাগার দাবী ছাড়া নেত্রকোনার পাহাড়ীয়া অঞ্চলে ফসলে খাজনা দেওয়ার প্রথা বা টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধেও ব্যাপক ও জঙ্গী আন্দোলন হয়। [১০৩] 

১৯৪৭ সালে আগস্ট মাসে দেশভাগের পর কৃষক আন্দোলনের অবস্থা পরিবর্তিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ও কিষাণ সভা এই পরিবর্তিত অবস্থায় নোতুন সরকারকে কিছু সময় ও সুযোগদানের পক্ষপাতী হন এবং সরকারের সাথে কিছুটা সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেন। এসবের ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী পর্যায়ে আন্দোলন মোটামুটি বন্ধ থাকে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি ও কিষাণ সভা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলেও তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার তাদের থেকে সহযোগিতা না নেওয়ারই সিদ্ধান্ত করে। যে সমস্ত কমিউনিস্ট কর্মী ও নেতারা ইংরেজ আমলের জেলখানায় বন্দী ছিলেন তাদেরকে মুক্তি দান করতেও সরকার অস্বীকার করে। এ ব্যাপারে পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৪৮ এর মার্চ মাসেই এক পরিষদ বক্তৃতায় সুস্পষ্টভাবে রাজবন্দীদের সম্পর্কে তার নীতি ঘোষণা করে বলেন যে, ময়মনসিংহে অল্প কিছু সংখ্যক ব্যতীত প্রায় সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দান করা হয়েছে। আমি যতদূর জানি কতকগুলি বিশেষ কারণে – কারণ তারা খুবই গুরুতর ধরনের অপরাধ করেছিলো – তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। ঐ বিশেষ এলাকাতে পরিস্থিতি এমন ছিলো না যাতে করে তাদেরকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারতো। কিন্তু একথা আমি আপনাদেরকে বলতে পারি যে, তাঁরা সকলেই হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। [১০৪] 

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে সারা ভারত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি নোতুনভাবে কৃষক আন্দোলনকে সংগঠিত করার চিন্তাভাবনা শুরু করে। কিন্তু পাকিস্তান-উত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সে সময় কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টি সরাসরিভাবে বেআইনী ঘোষিত না হলেও মুসলিম লীগ তাদেরকে খোলাখুলি কাজ করতে দেওয়ার, বিশেষতঃ কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে দেওয়ার তীব্র বিরোধী ছিলো। এ জন্যে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা তো বটেই, এমনকি কৃষক সমিতির অধিকাংশ কর্মীকেই তখন আত্মগোপন করে থাকতে হচ্ছিলো। 

এই পরিস্থিতিতেই ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রংপুরের লালমনিরহাট অঞ্চলের একটি গ্রামে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত জেলা কৃষক প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনের পর মণি সিংহ, খোকা রায়, নগেন সরকার, প্রমথ গুপ্ত প্রভৃতি ময়মনসিংহ জেলার নেতৃবৃন্দ নিজেদের এলাকায় ফিরে আসেন এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমার সরারচর গ্রামে জেলা কৃষক প্রতিনিধিদের এক গোপন সভা করেন। সেই সভায় লালমনিরহাট সম্মেলনের প্রস্তাবসমূহের ওপর আলাপ-আলোচনা হয় এবং প্রথমে তে-ভাগা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান এলাকা কিশোরগঞ্জ থেকেই আন্দেলনের ঢেউ তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।[১০৫] 

দ্বিতীয় কংগ্রেসের নতুন লাইন অনুযায়ী কিশোরগঞ্জের কৃষকদের মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠনের উদ্দেশ্যে কৃষক সমিতির নেতারা যখন সভা সমিতি ও বৈঠক শুরু করেন তখন তে-ভাগা এলাকার একদল কৃষক বলেন : “আমরা কি করে আপনাদেরকে বিশ্বাস করবো? তে-ভাগা আন্দোলন করলাম, জেলে গেলাম, মার খেলাম। সরকার জোতদার দুর্বল হয়ে এলো। তখন আপনারা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেন।” অন্যদল বলেন : “আপনারা বলছেন মুসলিম লীগ সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক। তারা কিছু করবে না। কিন্তু তাদের সময় দেন। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া আপনারা বলছেন লড়াই করতে হবে। এদের পেছনে আপনারা বলছেন সাম্রাজ্যবাদ। এদের মোকাবেলার জন্য অস্ত্র ও প্রস্তুতি দরকার। কোথায় পাবেন?” কৃষকদের এইসব বক্তব্যের কারণ ১৯৪৭ সালে কিশোরগঞ্জে তে-ভাগা আন্দোলন জমিদার জোতদার ও সরকারকে দুর্বল করে যখন দাবী আদায়ের পর্যায়ে এসে গিয়েছিলো, কৃষকরা নিজেরাও যখন স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলেন যে তাদের দাবীর আইনগত স্বীকৃতির আর দেরী নেই, তখন আকস্মিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি কর্তৃক আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এই প্রত্যাহারের ফলে কৃষকদের এত সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ তাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা না করে জোতদারদেরকে তাদের পূর্ব অধিকার বহাল থাকতেই শক্তি ও সাহায্য যুগিয়েছিলো। আন্দোলনের এই পরিণতিও সেক্ষেত্রে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সভার ভূমিকা রাতারাতি কৃষকদের ভুলে যাওয়ার কথা ছিলো না। [১০৬] 

পাকিস্তান-উত্তরকালে ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত কৃষক আন্দোলনের মূল ধ্বনি তে-ভাগা অঞ্চলে ছিলো জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ। এই আন্দোলনের সপক্ষে কৃষকদের সম্মতি নেওয়া এবং কৃষক সমিতির পতাকাতলে তাঁদেরকে সমবেত করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালের জুন-জুলাই মাসে কৃষক সমিতি কিশোরগঞ্জ মহকুমার করিমগঞ্জ বাজার থানায় একটি সভার আয়োজন করার সময় সরকার সেখানে ১৪৪ ধারা জারী করলো। কৃষক সমিতি সিদ্ধান্ত নিলো ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার এবং পুলিশ বাধা দিতে এলে তাদের সাথে লড়াই করার। কৃষকদেরকে বলা হলো পুলিশ আক্রমণ করতে এলে তাদেরকেও আক্রমণ করে তাদের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিতে হবে। [১০৭] 

সভার উদ্দেশ্যে সকলে যে সময় দলে দলে সভাস্থলের দিকে যাচ্ছেন তখন পুলিশ সেখানে এসে ১৪৪ ধারা জারীর নোটিশ দিলো। ঠিক হলো বেশী লোককে সেই সভার ব্যাপারে জড়িত না করে যতদূর সম্ভব অল্প সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি দিয়ে সভার কাজ পরিচালনা করা। কাজেই সেই সভায় সভাপতি ও বক্তা হলেন একই ব্যক্তি – কিশোরগঞ্জ মহকুমা কৃষক সমিতির সভাপতি নগেন সরকার। পুলিশের প্রতি কোনরূপ ভ্রূক্ষেপ না করে সভার কাজ চললো। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ এবং “লাঙ্গল যার জমি তার” এই নীতির উপর ভিত্তি করে কৃষকের জমি দখলের পক্ষে ধ্বনি উঠলো। পুলিশ সেদিনকার সেই সভায় কোন বাধা দিলো না, কাউকে গ্রেফতারও করলো না। [১০৮] 

এর ফলে কৃষক সমিতির নেতাদের ধারণা জন্মালো যে জনতার সামনে পুলিশ দাঁড়াতে সক্ষম হবে না। রণদীভের রাজনৈতিক সংগ্রামের লাইনও যে সঠিক একে তার একটা প্রমাণ হিসেবে তাঁরা মনে করলেন। কাজেই প্রাথমিক এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তাঁরা এর পর জেলা কৃষক সম্মেলন আহ্বান করলেন কিশোরগঞ্জ শহর থেকে মাইল দুই দূরবর্তী যশোদল বাজারে।[১০৯] 

সম্মেলনের জায়গায় ১৯৪৮-এর সেপ্টম্বরে সমগ্র জেলার কর্মীদেরকে জমায়েত করা হলো। সম্মেলন যাতে না হতে পারে তার জন্যে সরকারও ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করলো। তারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় ১৪৪ ধারা জারী করলো এবং কৃষক নেতৃবৃন্দকে জানালো যে তাঁরা এবার কিছুতেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে দেবে না। তারা এবারের ১৪৪ ধারাকে যদি করিমগঞ্জের মতো মনে করেন তাহলে ভুল করবেন। কিন্তু এই সরকারী হুমকী সত্ত্বেও কৃষক সমিতি স্থির করলো সম্মেলন বাদ দেওয়া যাবে না। সম্মেলনের তিনদিন পূর্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল্স্ এলো। পরিস্থিতি রীতিমতো গুরুতর আকার ধারণ করলো।[১১০] 

সম্মেলনের ঠিক পূর্বদিন বিরাট এক সশস্ত্র বাহিনী যশোদল মাঠে উপস্থিত হয়ে সেখানে ছাউনী ফেললো। তরাইল, করিমগঞ্জ, নীলগঞ্জ, মুসুলী, রশিদাবাদ, চৌদ্দশ, বাজিতপুর, বানীগ্রাম প্রভৃতি গ্রাম থেকে যশোদল আসার সমস্ত পথ তাঁরা অবরোধ করলো। কোন সংগঠিত জাঠা যাতে সভাস্থলে পৌঁছাতে না পারে তার জন্যে গৌরীপুর জংশন ভৈরব রেল স্টেশন থেকে আসার পথে সমস্ত রেল স্টেশনগুলিতে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হলো। [১১১] 

করিমগঞ্জের সভার মতো এক্ষেত্রের সিদ্ধান্ত হলো পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও জটিলতার জন্যে বেশী লোককে সম্মেলনে জড়িত না করে নগেন সরকারকেই সভাপতি ও বক্তা হিসেবে দাঁড় করানো। সে সময়ে কৃষক সমিতিকে সম্পূর্ণ একটি গুপ্ত প্রতিষ্ঠান যাতে সরকার না বলতে পারে তার জন্যে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো অল্প কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে প্রকাশ্যভাবে কাজ করতে দেওয়া। নগেন সরকার এঁদেরই একজন ছিলেন। সম্মেলনের পূর্বদিন কিশোরগঞ্জ থেকে তিনি যশোদলের দিকে রওয়ানা হওয়ার পর শহরের কাছাকাছি জায়গাতেই একদল পুলিশ তাঁর দিকে এগিয়ে এসে তাকে আদাব জানিয়ে বললো, “আপনাকে থানায় যেতে হবে।” নগেন সরকার তাদেরকে বললেন যে, তিনি কাজে যাচ্ছেন কাজেই তখন তার থানায় যাওয়ার সময় নেই। কিন্তু পুলিশের সংখ্যা বাড়লো এবং বোঝা গেলো তিনি স্বেচ্ছায় না গেলে তাকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাবে। পুলিশ বললো, “মাত্র দুই তিন মিনিটের ব্যাপার। সম্মেলনের ব্যাপারেই আলাপ।” থানায় যাওয়ার পর মহকুমা হাকিম ও ময়মনসিংহের পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট অনুরোধ জানালেন যাতে কৃষক সমিতির যশোদল সম্মেলন করা না হয়। কারণ সরকারী নির্দেশ আছে সম্মেলন হলে বাধা দিতে হবে এবং তার ফলে রক্তারক্তি হবে। নগেন সরকার তাদের সেই প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে বললেন, সম্মেলন বাদ দেওয়া যাবে না, কৃষক সমিতির সিদ্ধান্ত হয়েছে সম্মেলন করার এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে। নগেন সরকারের এই জবাবের পর তারা সেখানেই তাঁকে গ্রেফতার করে জেলখানায় পাঠিয়ে দিলো। [১১২] 

এর পর ‘ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্’ ব্যাপক গ্রেফতার ও ফাঁকা গুলির আওয়াজ করে চারিদিকে ত্রাসের সঞ্চার করলো। প্রায় ৩০ জন কর্মীসহ ময়মনসিংহ জেলার কৃষক নেতা ধরণী বণিক এবং ওয়ালী নেওয়াজও গ্রেফতার হলেন এবং সম্মেলনে যে সমস্ত কৃষকরা দূর দূরান্ত থেকে পূর্বেই জমায়েত হয়েছিলেন তাঁরা চারিদিকে পলায়ন করতে শুরু করলেন। কোথাও কোথাও তাঁদের সাথে সশস্ত্র পুলিশের ছোটখাটো সংঘর্ষও হলো। এর ফলে সম্মেলন শেষ পর্যন্ত আর অনুষ্ঠিত হতে পারলো না। মণি সিংহ এ সময়ে কিশোরগঞ্জেই আত্মগোপন করে ছিলেন। এর পর তিনি অন্যত্র চলে যান। [১১৩] 

সম্মেলনের ব্যাপারে কৃষক জনগণের পক্ষ থেকে আবার সমালোচনা হলো : “তোমরা সিদ্ধান্ত করো, তারপর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করো। তে-ভাগার সময়েও তাই করেছিলে। এখানে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স্ এলো, তোমরা ঠিক করলে তা সত্ত্বেও সম্মেলন করবে। কিন্তু তারপর আর সভা হলো না।” যশোদলের এই ঘটনার পর স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে একটা নৈরাশ্য এবং হতাশার ভাব এসে গেলো। কৃষক সমিতির নেতৃত্বের ওপর আস্থাও অনেকখানি কমে এলো। অনেক নেতৃস্থানীয় কর্মী এবং নেতাও এর পর এলাকা পরিত্যাগ করে পশ্চিম বাঙলায় চলে গেলেন। যারা থাকলেন তাঁরাও অল্প কিছুদিন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় থেকে পরবর্তীকালে পশ্চিম বাংলা চলে গেলেন। কিন্তু তাঁদের স্থান পূরণ করার জন্যে পশ্চিম বাংলা থেকে কেউ এলেন না। এই সমস্ত কারণে কিশোরগঞ্জে আন্দোলন দ্রুতগতিতে স্তিমিত হয়ে এলো।[১১৪]

কিন্তু কিশোরগঞ্জে এই অবস্থা দাঁড়ালেও এর পর জেলার কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল স্থানান্তরিত হলো নেত্রকোনা মহকুমা হাজং অধ্যুষিত অঞ্চলে। সেখানে সরকারী ‘লেভীর’ বিরুদ্ধে এবং টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকদের এক ব্যাপক সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলো।

সারা পূর্ব বাঙলায় ১৯৪৭-৪৯ সালে এক বিরাট খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তার ফলে সরকার লেভীর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়।[১১৫] এই লেভী আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারী কর্মচারীরা কৃষকদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন শুরু করে। তাছাড়া লেভী ধানের সরকার প্রদত্ত দর তৎকালীন বাজারদর থেকে অনেক কম হওয়া এবং লেভী ধানের টাকা সরকারের থেকে পাওয়ার জন্যে চালান বা চেক জমা দেওয়া ইত্যাদি নিয়মের জন্যে শহরে যাওয়ার হয়রানীর কারণে কৃষকরা লেভীর বিরুদ্ধে খুব বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কিন্তু কৃষকদের কোন আপত্তির প্রতি কোনরূপ সহানুভূতি জ্ঞাপন না করে যান্ত্রিক এবং আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারী কর্মচারীরা সর্বত্র লেভী ধান আদায় করতে কৃতসংকল্প হয়। কৃষকরা সাধারণভাবে লেভীর বিরুদ্ধে ছিলেন না। তাঁদের দাবী ছিলো সারা বৎসরের খোরাকী না রেখে ধান নেওয়া চলবে না, বাজারদরের থেকে অল্প দরে ধান নেওয়া চলবে না, চালান বা চেকের পরিবর্তে নগদ মূল্যে ধানের দাম পরিশোধ করতে হবে। এইসব দাবীর ভিত্তিতে নেত্রকোণা মহকুমার হাজং এলাকায় ১৯৪৮ সালেই ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। 

এই অবস্থায় ১৯৪৮ সালের নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে নাগের পাড়া (হালুয়া ঘাট) গ্রামে জেলা কৃষক সমিতির নেতাদের এক গোপন সভা হয়। সেই সভায় জমিদারী প্রথাবিরোধী ও আমলাতান্ত্রিক উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। কোন প্রকার সাম্প্রদায়িক প্রশ্নকেই সামন্তবাদবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে যুক্তি হিসেবে গ্রহণ না করারও সিদ্ধান্ত তাঁরা গ্রহণ করেন। এই সভায় জেলা নেতৃত্বের মধ্যে কতকগুলি দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও প্রশ্ন দেখা দেয়। সুনির্মল সেন বলেন, ‘সদ্য স্বাধীনতা লব্ধ পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃষকদেরকে আন্দোলনে নিক্ষেপ করা এখনই ঠিক হইবে না। লীগ সরকার সাধারণ মুসলমান জনতাকে ভুল বুঝাইতে সুযোগ পাইবে।’ প্ৰমথ গুপ্ত বলেন, এই মুহূর্তে শুধুমাত্র সুসংগঠিত হাজং অঞ্চল হইতে সংগ্রাম শুরু করিলে “ভ্যানগর্ডিজম” করা হইবে। জলধর পাল বলেন, “কোন কঠিন দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম করার বাস্তব সংগঠন নাই। এই জন্য সময় ও প্রস্তুতির প্রয়োজন।’ এই সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও প্রশ্ন সত্ত্বেও আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত হয় এবং সমগ্র হাজং অধ্যুষিত এলাকায় লেভী ও টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র ও ব্যাপক কৃষক আন্দোলন প্রায় দেড় বৎসর পর্যন্ত জারী থাকে। 

টঙ্ক প্ৰথা 

আসাম ও বাঙলাদেশ সীমান্তে ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাংশ ঘেঁষে গারো পাহাড়। এই পাহাড়ীয়া অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে সুসং দুর্গাপুরের জমিদারীর অন্তর্গত। এই অঞ্চলে তেমন কোন চাষ আবাদ না হলেও জমিদাররা ছিলো এখানকার বিপুল অরণ্য সম্পদের মালিক। এছাড়া হাতীর ব্যবসা করেও তাঁরা প্রভূত ধনসম্পদ উপার্জন করতো। এখানকার আদিবাসী হাজংরা সমতল অঞ্চলের মতো চাষ আবাদ জানতো না। তাঁরা প্রতি বৎসর একই জমি আবাদ না করে ‘ঝুম’ প্রথায় চাষাবাদ করতো। জমিদারকে তাঁদের কোন নির্দিষ্ট খাজনা দিতে হতো না কিন্তু তার পরিবর্তে হাতি খেদার সময় তাঁদের ডাক পড়লে বিনা পারিশ্রমিকে তাঁদেরকে কায়িক শ্রম দান করতে হতো। এছাড়া জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে সে সময়ে ফসল অথবা টাকা-পয়সার কোন আদান-প্রদান ছিলো না। 

এই হাতি খেদাকে কেন্দ্র করেই এই অঞ্চলে প্রথম কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। হাতি বিক্রয় করে জমিদাররা প্রভূত ধন উপার্জন করতো এবং কৃষকদেরকে উপরোক্তভাবে এ কাজে শ্রম নিয়োগ করতে বাধ্য করতো। যারা এ ব্যাপারে অবাধ্য হতো তাদের ওপর অমানুষিক উৎপীড়ন চালানো হতো। এর ফলে উত্তরোত্তরভাবে জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ১৮৩০-এর দিকে হাজং কৃষকরা জঙ্গলের মধ্যে স্থানীয় খেদাগুলি নষ্ট করে দিয়ে জমিদারদের এই ব্যবস্থা উচ্ছেদ করেন। 

উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই অঞ্চলের প্রতি বৃটিশ বণিকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং তাঁর এলাকাটিকে জমিদারদের হাত থেকে নিজেদের দখলে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। মোগল আমলের কাগজপত্র নিয়ে জমিদাররা প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত মামলা চালায় এবং তাদের পক্ষেই রায় হয়। কিন্তু পরে ১৮৬৯ সালে ‘গারো পাহাড় এ্যাক্ট” প্রণয়ন করে বৃটিশ ভারতীয় সরকার সমস্ত গারো পাহাড় অঞ্চলকে বৃটিশ ভারতীয় সরকারের অধিকারভুক্ত করেন। এর পরবর্তী পর্যায়ে জমিদাররা নিজেদের আয়ের অন্য কোন পথ না দেখে আদিবাসী গারো হাজং ইত্যাদি প্রজাদের থেকে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করলো। স্থির হলো প্রত্যেক পরিবারের থেকে পৃথকভাবে খাজনা আদায় না করে গ্রাম ভিত্তিতে খাজনা আদায় হবে। গ্রামের মোড়লরা কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করে জমিদারের পাওনা মিটিয়ে দেবে। এই আকস্মিক খাজনা ধার্যের বিরুদ্ধে প্রজারা ক্ষিপ্ত হলো এবং বিদ্রোহ করলো। ১৮৯০ এর দিকে সংগঠিত এই সশস্ত্র বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে জমিদাররা সমগ্র অঞ্চলে হাজং রক্তের বন্যা বইয়ে দিলো। হাজংরা জমিদারের খাজনার দাবীকে বাধ্য হয়েই স্বীকার করলেন। 

এই অঞ্চলে জমিদারদের খাজনার দাবী স্বীকৃত হওয়ার পর পতিত জমিতে তাঁরা নোতুন নোতুন প্রজা পত্তন করতে থাকে। এই সব জমির খাজনা অল্প হলেও জমি নেওয়ার সময় প্রজাদেরকে মোটা সালামী দিতে হতো। এই মোটা সালামী দিতে অধিকাংশ কৃষকই অক্ষম হওয়ার ফলে তাঁদের সাথে জমিদারদের ব্যবস্থা হয় যে, জমির জন্যে কৃষককে টাকায় খাজনা দিতে হবে না। তাঁরা ফসলে খাজনা দান করবে কিন্তু সেই খাজনা টাকায় খাজনার মতো নির্দিষ্ট হতে হবে। অর্থাৎ ফসলের উৎপাদনের ওপর তা নির্ভরশীল না থেকে জমি বিলির সময়তেই নির্দিষ্টভাবে ধার্য হবে। অনাবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদির জন্য জমিতে যদি ফসল নাও হয় তাহলেও কৃষকরা প্রজা হিসেবে জমিদারকে খাজনা দিতে বাধ্য থাকবেন। নির্দিষ্ট ফসলে দেয় এই খাজনা প্রথাকেই বলা হয় টঙ্ক প্রথা। 

কিন্তু টঙ্ক খাজনা দানকারী বা টঙ্কাদারের কোন জোত স্বত্ব এর দ্বারা স্বীকৃতি হয়নি। তার ফলে জমিদার প্রতি বৎসরই নোতুন নোতুন কৃষককে ইচ্ছেমতো হারে খাজনা নির্দিষ্ট করে জমি বিলি করতে পারতো এবং কার্যতঃ করতোও তাই। কিন্তু এই টঙ্ক প্রথায় জমির ওপর পুরুষানুক্রমিক তো নয়ই, এক পুরুষেরও কোন জোতস্বত্ব না থাকলেও টঙ্ক ধানের ঋণের বোঝা মৃত কৃষকদের সন্তানদেরকে বইতে হতো। কৃষকদের জমির কোন স্বত্ব না থাকলেও তাই তাঁদের ঋণের দায়িত্ব ছিলো পুরুষানুক্রমিক। 

টঙ্ক প্রথায় নির্দিষ্ট ফসলে যেভাবে কৃষককে খাজনা দিতে হতো তাতে খাজনার আন্দোলনের পর ১৯৪০ সালের ফজলুল হক মন্ত্রীসভার আমলে টঙ্কাদারদেরকে জমিতে স্বত্ত্ব কিছুটা দান করা হয় এবং তার ফলে টঙ্ক খাজনার হারও কিছুটা কমে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের হিসেবে একর প্রতি টঙ্ক খাজনা যেখানে পড়তো ৪০ টাকা হইতে ৭০ টাকা, সেখানে সাধারণ প্রজাদের খাজনা দাঁড়াতো ৬ টাকা মাত্র। ১৯৫০ সালে পূর্ব বাঙলার রাজস্ব মন্ত্রী তফজ্জল আলী পরিষদে যে হিসেবে দেন তাতে টঙ্কাদারদের একর প্রতি ধানী খাজনা দেখা যায় ৩ মণ ৩৩ সের, নগদ অর্থে যার পরিমাণ তৎকালীন মূল্য অনুযায়ী দাঁড়ায় ঐ অঞ্চলে অন্যান্য প্রজাদের দেয় রাজস্বের ৮ গুণ। [১১৬] 

হাজং অধ্যুষিত এলাকায় টঙ্কবিরোধী আন্দোলনের সূচনা ও বিকাশ 

১৯৩৭ সালের শেষ দিকে সুসং-দুর্গাপুরের জমিদারদের ভাগ্নে মণি সিংহ জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তাকে দুর্গাপুরে অন্তরীণ রাখা হয়। মণি সিংহ ইতিপূর্বে মেটিয়াবুরুজে কেনারাম সুতাকলের শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতেন, কৃষক আন্দোলনের কোনরূপ অভিজ্ঞতা তার ছিলো না। কিন্তু এই অন্তরীণ অবস্থায় তিনি দুর্গাপুরের পার্শ্ববর্তী দশাল গ্রামের কয়েকজন কৃষকের সাহচর্য লাভ করেন এবং তাদের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকদের বহুবিধ সমস্যা, বিশেষতঃ টঙ্ক প্রথার উৎপীড়নের সাথে পরিচিত হন। স্থানীয় কৃষকদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায় এবং তাঁরা তাকে সুসং-দুর্গাপুর অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন সংগঠন ও পরিচালনার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। কৃষক আন্দোলনের কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় মণি সিংহ প্রথমে কৃষকদের এই প্রস্তাবে সম্মত হতে দ্বিধাবোধ করলেও তাদের উপর্যুপরি অনুরোধে তিনি শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নিয়ে জমিদারী ও টঙ্ক প্রথা বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে সম্মত হন। [১১৭] 

১৯৩৭ সালে নেত্রকোণার অন্যান্য অঞ্চলে নগেন সরকার, জ্যোতিষ রায়, ক্ষীরোদ রায় প্রভৃতিও টঙ্কাপ্রথাবিরোধী আন্দোলনে নামেন এবং মণি সিংহসহ তাঁরা কয়েকজন তিনটি মূল দাবীকে কেন্দ্র করে সুসং-দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা থানায় আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই তিনটি দাবি হলো : টঙ্ক প্রথা উচ্ছেদ করে তার পরিবর্তে টাকায় খাজনা চালু করতে হবে, খাজনার হার কমাতে হবে এবং জোত-স্বত্ব দিতে হবে।[১১৮] প্রায় দুই বৎসর উপরোক্ত এলাকায় সংগঠনের প্রাথমিক কাজ চলার পর ১৯৩৯ সালে কিশোরগঞ্জে ময়মনসিংহ জেলা কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে হাজার হাজার হাজং কৃষক সুদূর পাহাড় অঞ্চল থেকে দলে দলে মিছিল সহকারে যোগদান করেন। কৃষক সমিতির একটানা কাজের মধ্যে দিয়ে কলমাকান্দা, সুসং-দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নলিতাবাড়ী ও শ্রীবর্দী — এই পাঁচটি হাজং অধ্যুষিত থানার টঙ্কপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের অনেকখানি অগ্রগতি হয়। এই সব এলাকায় প্রধানতঃ হাজংদের বাস হলেও হিন্দু-মুসলমান বাঙালী কৃষকদেরও এখানে বসবাস ছিলো এবং তারাও এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে কৃষক সমিতি কর্তৃক সংগঠিত হন। [১১৯] 

এই অঞ্চলের গারো অধিবাসীরা আদিবাসী হলেও তাঁদের মধ্যে টঙ্ক প্রথাবিরোধী আন্দোলন প্রসার লাভ করেনি। তার মূল কারণ গারোদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো খৃস্টান এবং খৃস্টান পাদ্রীদের প্রভাব তাঁদের ওপর ভয়ানক কার্যকর ছিলো। এই পাদ্রীরা সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে গারোদেরকে সর্বপ্রকার আন্দোলন থেকে সরিয়ে রেখে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে সারা অঞ্চলে অক্ষুণ্ণ রাখতে অবিরাম সচেষ্ট থাকতো এবং সেই অনুযায়ী প্রচারণা চালাতো। [১২০]

১৯৪৩ সালের মে মাসে নলিতাবাড়ীতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার অধিবেশন হয়। তারপর ১৯৪৫ সালের ৮-৯ই এপ্রিল নেত্রকোণায় অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন। এই সম্মেলনকে সফল করার জন্যে কয়েক শত হাজং কর্মী কয়েক সপ্তাহ অবিরাম পরিশ্রম করেন এবং পাহাড়ীয়া অঞ্চল থেকে প্রবল জলধারার মতো মিছিল করে নেমে এসে তারা সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলন একদিকে যেমন হাজং কৃষকদের মধ্যে জাগিয়েছিলো অভূতপূর্ব উৎসাহ উদ্দীপনা তেমনি সম্মেলনে আগত দূর-দূরান্তের কৃষক কর্মী ও নেতারা আদিবাসী হাজংদের রাজনৈতিক চেতনার মান লক্ষ্য করে হয়েছিলেন বিস্মিত এবং উদ্দীপ্ত। [১২১] 

১৯৪৬ সালের গোড়ার দিকে ময়মনসিংহ জেলায় কৃষক আন্দোলন যথেষ্ট সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং সেই সময় ব্যাস্টিনকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট করে সেখানে পাঠানো হয়। নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর মহকুমার সংগঠিত কৃষক অঞ্চলগুলিতে, বিশেষতঃ সীমান্তের পাহাড় অঞ্চলগুলিতে, ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে ব্যাস্টিন সামরিক ও পুলিশ বাহিনীকে মোতায়েন করে। এইসব অঞ্চলে কিষাণ সভার পরিচালানাধীনে জনগণের যে সেব নির্বাচিত কমিটির মাধ্যমে ইউনিয়ন ট্যাক্স, জমিদারদের টঙ্ক ধান, বকেয়া খাজনা, মহাজনদের ঋণ ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো সেগুলিকে ধ্বংস করবার জন্যে ব্যাস্টিন স্থানীয় ক্যাথলিক মিশনগুলির সাহায্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করলো এবং কৃষকদেরকে নানাভাবে ভীতিপ্রদর্শন শুরু করলো। অসংখ্য কৃষক কর্মী ও নেতাদের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হলো এবং কৃষকদেরকে জমিদারদের টঙ্ক ধান, মহাজনের ঋণ, ইউনিয়ন ট্যাক্স ইত্যাদি পরিশোধের হুকুম জারী করলো। কৃষকরা কিন্তু ব্যাস্টিনের সমস্ত দাবী প্রত্যাখ্যান করে তাকে জানালেন যে, যে টঙ্ক প্রথাকে তারা ইতিমধ্যে উচ্ছেদ করে দিয়েছেন, নোতুন করে তা প্রবর্তন করতে তারা দেবেন না। তাছাড়া খাজনা, ঋণ ইত্যাদি ব্যাপারেও তাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত এবং কর্মসূচীই বহাল থাকবে। তবে টঙ্ক ধানের পরিবর্তে অনুমোদিত ব্যবস্থা অনুযায়ী নোতুন হারে টাকায় খাজনা দিতে তাদের আপত্তি নেই।

এই প্রতিরোধের মুখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাস্টিন সামরিক বাহিনী ও পুলিশের সাহায্যে ১৯৪৭-এর জানুয়ারী মাসে এই এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজ, মারপিট ও ধর্ষণ চালায়। কৃষকদের টঙ্ক ধান তাদের নিজেদের খামার থেকে জোরপূর্বক লুণ্ঠন করে তারা আন্দোলনের মেরুদণ্ড চূর্ণ করার প্রচেষ্টা করে। কিন্তু আন্দোলনের পরিস্থিতি তখন এমনই ছিলো যে, কোন প্রকার নির্যাতনই তৎকালীন কৃষক কর্মী ও সংগ্রামী কৃষক জনতাকে দমন করতে সক্ষম হয়নি। উপরন্তু কৃষকরা নিজেদের ক্ষেত ও খামারের ধান এবং নিজেদের ইজ্জত রক্ষার সংগ্রামে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং প্রাণপণ করে আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখেন ও সম্প্রসারিত করেন। ১৯৪৭-এর ৩১শে জানুয়ারী ইস্টার্ণ ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস’-এর একটি বাহিনী সোমেশ্বরী নদীর তীরে বাহেরাতলী গ্রামে প্রবেশ করে মারপিট, ধর্ষণ ইত্যাদি শুরু করে। স্থানীয় নেতৃত্ব সে সময় চিন্তা করছিলেন প্রকাশ্য দিবালোকে বাহিনীটিকে আক্রমণ করা সঠিক হবে কিনা। কিন্তু স্থানীয় কৃষকদের সংগ্রামী চেতনা ও প্রতিরোধের স্পৃহা তখন এমন এক পর্যায়ে ছিলো যে, নেতাদের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে মহিলা কৃষক বাহিনীর রাসিমনি ও তার সাথীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই সামরিক বাহিনীর দিকে দা, কুড়ল ইত্যাদি হাতে নিয়ে অগ্রসর হন এবং সৈনিকদের সাথে হাতাহাতি লড়াই শুরু করেন। যে সৈনিকটি স্থানীয় কৃষক বধূ কুমুদিনী (সরস্বতী)কে ধর্ষণ করেছিলো রাসিমনি স্বহস্তে দার আঘাতে তার মুণ্ডচ্ছেদ করেন। এর সঙ্গে অপর একটি সৈনিকের গুলিতে ঘটনাস্থলেই রাসিমনি নিহত হন। রাসিমনির সাথী সুরেন্দ্র হাজং তখন সেই ঘাতক সৈনিকটির বক্ষদেশ বর্শাবিদ্ধ করে তাকে হত্যা করেন। কিন্তু পরক্ষণেই অপর একজন সৈনিকের গুলিতে সুরেন্দ্রের মৃত্যু ঘটে। সামরিক বাহিনীর নির্যাতন সত্ত্বেও এই দুই আত্মত্যাগী কৃষক কর্মীর মৃত্যু সমগ্র এলাকায় আন্দোলনকে পরাস্ত না করে তাকে আরও ব্যাপক, দৃঢ় এবং গভীর করে। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারী মাসে ব্যাস্টিনের পরিচালনায় সাম্রাজ্যবাদী নির্যাতন এক চরম আকার ধারণ করা সত্ত্বেও সোমেশ্বরীর তীরে তীরে জমিদারী ও টঙ্ক প্রথা বিরোধী আন্দোলন অদমিত থাকে। শুধু সোমেশ্বরীর তীরবর্তী অঞ্চল নয়, সমগ্ৰ ময়মনসিংহ জেলায় ধান ও জমির লড়াই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত থেকে কৃষক সংগ্রামের এক নোতুন দিগন্ত রচনা করে।[১২২] 

এর পর ১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসে ভারত বিভক্ত হয়ে উত্তরের পাহাড়ী অঞ্চলসহ ময়মনসিংহ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে এই এলাকার আন্দোলন কিছুদিনের জন্যে স্তিমিত থাকলো। কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। মুসলিম লীগের নির্যাতনমূলক শাসন শোষণ এবং এই এলাকায় টঙ্ক প্রথা, লেভী ও সাধারণভাবে জমিদারী অত্যাচার এত বৃদ্ধি লাভ করলো যে, ১৯৪৯ সালের গোড়া থেকে কৃষক আন্দোলনের এই এলাকায় দ্রুতগতিতে এক সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো। 

পাকিস্তানোত্তরকালে হাজং অধ্যুষিত অঞ্চলে লেভীর জুলুম এবং জমিদারী ও টঙ্ক প্রথা বিরোধী আন্দোলন 

১৯৪৯ সালের জানুয়ারী মাস থেকেই হাজং অঞ্চলে লেভীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঊর্ধ্বগতি লাভ করলো। কৃষকদের সম্মিলিত জাঠা মার্চ শুরু হলো এবং দিকে দিকে আওয়াজ উঠলো : ‘জান দিবো তবু ধান দিবো না’, ‘কৃষকদের উদ্বৃত্ত ধান নগদ মূল্যে ক্রয় করো” ‘লেভীর জুলুম বন্ধ করো’, টঙ্ক ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করো।’ পূর্ব বাঙলা সরকার এই পরিস্থিতিতে আনসার বাহিনী ও পুলিশের সাহায্যে লেভী ধান আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের বাহিনীকে সেখানে প্রেরণ করলো এবং সেই বাহিনী তাদের অভ্যস্ত পদ্ধতিতে সমগ্র এলাকায় জোর জুলুম, মারপিট, ধর্ষণ ইত্যাদির সাহায্যে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলো। এই সন্ত্রাস কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৃষকদেরকে দমিত না করে তাদের মধ্যে বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিলো, প্রতিরোধের সংকল্পকে দৃঢ়তর করলো। 

১৯৪৯ সালের ৮ই জানুয়ারী জমিদারের লোকেরা কলমাকান্দা থানার চৈতন্যনগরের নীল চাঁদ হাজং-এর বিশ মণ টঙ্ক ধান নিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীরা তাদেরকে বাধা দিয়ে ধান ছিনিয়ে নিলেন এবং তা আবার নীল চাঁদের গোলায় তুলে দিলেন। ধান রক্ষার সংগ্রামে এই সাফল্যপ্রচার বাহিনীর মাধ্যমে চারিদিকে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়লো এবং সমগ্র এলাকায় এক অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সৃষ্টি করলো।[১২৩] 

এর পর ১৫ই জানুয়ারী বটতলা গ্রামে টঙ্ক ধান নেওয়ার সময় সেখানেও বাধা পড়লো। জমিদারের লোকেদের এইভাবে পর্যুদস্ত ও ব্যর্থ হওয়ার সংবাদ পেয়ে কলমাকান্দা থানার দারোগা ৬জন সশস্ত্র পুলিশ, কয়েকজন চৌকিদার ও আনসার বাহিনীসহ বটতলা উপস্থিত হয়ে ৫ জন কৃষককে গ্রেফতার করে নির্মম প্রহার শুরু করলো। প্রহারে জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁদের একজন পুলিশকে ধানের সন্ধান বলে দেওয়ার পর দারোগা ২৫ মণ টঙ্ক ধান গরুর গাড়ী বোঝাই করে রওয়ানা হলো। কিন্তু গাড়ী অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই কৃষকরা তা ঘেরাও করে ধান ফেরৎ চাইলেন। জবাবে আনসাররা লাঠি চালনা করে কয়েকজন কৃষককে আহত করলো। এই আক্রমণের ফলে গ্রামবাসীরাও উত্তেজিত হয়ে আনসারদেরকে আক্রমণ করলেন এবং পরস্পরের মধ্যে হাতাহাতি লড়াই শুরু হলো। এর পর পুলিশ ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে গুলি চালনা করলো কিন্তু কৃষকরা মাটিতে শুয়ে কোন রকমে আত্মরক্ষা করলেন। এর পর তারা আওয়াজ তুললেন ‘জান দিবো। তবু ধান দিবো না।’ পুলিশ দুইজন কৃষককে গুলি করে আহত করলো। কিন্তু তবু সংগ্রামী কৃষকরা গাড়ীর ধান বেহাত হতে দিলেন না। রাত্রির অন্ধকার ঘনায়মান দেখে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ ও আনসার বাহিনী দ্রুতগতিতে ঘটনাস্থল পরিত্যাগ করলো। ধানের গাড়ী টানা-হেঁচড়ার মধ্যে গ্রাম অতিক্রম করে মাঠের মধ্যে এসে পড়েছিলো। কৃষকরা তখনকার মতো ধানের গাড়ী মাঠের মধ্যে রেখে আহত দু’জন সাথীকে নিয়ে গ্রামে ফিরলেন। বটতলার এই গুলিবর্ষণের খবর দাবানলের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লো। পরদিন কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে ৪০ জন জঙ্গী কৃষকের একটি বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য হাতিয়ার এবং ঔষধপত্র নিয়ে বটতলায় উপস্থিত হলেন এবং মাঠ থেকে ধানের গাড়ি গ্রামে ফিরিয়া আনলেন। আহত কৃষক দুজনকে তাঁরা পাঠিয়ে দিলেন নিরাপদ আশ্রয়ে।[১২৪] 

চৈতন্যগড়ে সুসং জমিদারের কোর্ট অব ওয়ার্ডসের একটা নোতুন কাছারীবাড়ী বসানো হয়েছিলো। ২৬শে জানুয়ারী, ১৯৪৯ তারিখে সেই কাছারীবাড়ী মৌজার কৃষকরা দখল করেন। ২৭শে জানুয়ারী সকালে কাছারী প্রাঙ্গণে এক বিরাট কৃষক সমাবেশ হয় এবং সেখানে গণআদালত প্রতিষ্ঠা করে একজন তহশীলদার ও পাঁচজন বন্দী পেয়াদা ও পিয়নের বিচার হয়। কাছারীর যাবতীয় আসবাব পত্র আটক করা এবং কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার পর সমগ্র মৌজার টঙ্ক ধান ও বকেয়া খাজনা রহিত ঘোষণা করা হয়। কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ম্যানেজার পুলিশের সাহায্যে কাছারী দখল করার চেষ্টা করলেও কাছারীর দখল কৃষকদের হাতেই থাকে। শুধু এই কাছারী বাড়ীই নয়। এর ফলে সমগ্র লেঙ্গুরা ইউনিয়নে কৃষকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় কালিকাপুরে বিশ জন হাজং রমণী জমিদারদের দুই গাড়ী টঙ্ক ধান আটক করেন। গাড়ীর গাড়োয়ান ছিলেন একজন সহানুভূতিশীল বিহারী। তিনি কোন প্রকার আপত্তি না করে তাদের নির্দেশিত স্থানে ধান তুলে দেন। সুসং-দুর্গাপুর থানার মাইজপাড়া ইউনিয়নের চারুপাড়া গ্রামে বিশ্বেশ্বর সরকারের ১০০ মণ লেভী ধান সরকারী কর্মচারীরা জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়ার সময় কৃষকরা সম্মিলিতভাবে বাধা দেন এবং বিশ্বেশ্বরের কথা মতো তা স্থানীয় গরীব হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করেন। জানুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে এবং প্রায় প্রতিদিনই গোড়াশাও, গৌরীপুর, কালীকাপুর, গোপালপুর, ছনগাড়া, ভেদীকুড়া, বগাঝোরা, জাঙ্গালিয়া, কমলপুর, বাগপাড়া, কাশীপুর, কালিকাবাড়ি প্রভৃতি গ্রামে মহাজনদের ধান, টঙ্ক ধান ও লেভী ধান কৃষকরা আটক করতে থাকেন। ফলে এই এলাকায় সরকার ও জমিদার মহাজনদের সর্ব প্রকার আদায় বন্ধ হয়ে যায়। [১২৫] লেঙ্গুরা পুলিশ ক্যাম্পের সামনের ময়দানে ২৮শে জানুয়ারী, ১৯৪৯ তারিখে ৫ হাজার কৃষকের এক বিরাট সভা হয়। শুধু পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে নয়, দূর দূরান্ত থেকেও কৃষকরা এই সভায় যোগদান করেন। সভায় বক্তারা বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ, টঙ্কপ্ৰথা রদ, সরকারের রাজস্ব ও কর আদায় এবং খাদ্য সংগ্রহের কাজে স্থানীয় কমিটিগুলির সহযোগিতা গ্রহণ ইত্যাদির দাবী জানান এবং সেই মর্মে প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয় এবং লিখিতভাবে সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। এইভাবে বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক জমিদারী ও টঙ্ক প্রথা বিরোধী সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এই সময় সারা ময়মনসিংহ জেলার হিন্দু মুসলমান কৃষকরা জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দাবীতে যশোদলে এক সভা করেন। এর পর করিমগঞ্জ, তরাইল, যশোদল, নিয়ামতপুর, ঝাউগড়া, বালী, বাংলা প্রভৃতি স্থানের কৃষকরাও উপরোক্ত দাবীর ভিত্তিতে সংগ্রাম ঘোষণা করেন।[১২৬]

১৯৪৭ সাল থেকে রাসিমণি ও সুরেন্দ্রের স্মৃতি উদযাপনের উদ্দেশ্যে ৩১শে জানুয়ারীকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। ১৯৪৯-এর ৩১শে জানুয়ারীও শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। বর্শার মাথায় লাল ঝাণ্ডা বেঁধে সেদিন বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে কৃষকরা চারুয়াপাড়ায় রাসিমণি ও সুরেন্দ্রের সমাধিক্ষেত্রে সমবেত হয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং তার পর বিভিন্ন এলাকায় প্রচারের জন্যে তারা দলবদ্ধভাবে বের হন। ঘোষগাঁও হাটের দিকে রওয়ানা হওয়া এই রকম একটি কৃষক প্রচার বাহিনী হাটের দেড় মাইল দক্ষিণে ভালুকাপাড়া গীর্জার সামনে পথ অতিক্রমের সময় একদল সরকারী সিপাহী তাদের পথ রোধ করে এবং কৃষক বাহিনীর কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করে কলসিন্ধুর পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্যে জবরদস্তি করতে থাকে। শান্তিপূর্ণ প্রচার দলটির পক্ষ থেকে তখন সিপাহীদেরকে বলা হয়, “আজ আমরা কোন বিরোধ করিতে আসি নাই, শান্তিপূর্ণভাবে শহীদ দিবস প্রচার করিতে আসিয়াছি।” কিন্তু কৃষক বাহিনীকে নিরস্ত্র ও দুর্বল মনে করে সিপাহীরা তাঁদেরকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিজেদের বন্দুকে বেয়নেট পরাতে শুরু করলো। 

এই পরিস্থিতিতে হাজং কৃষক নেতা নয়ান হাজং সাথীদেরকে ঝাণ্ডা খুলে বর্শা ধরতে নির্দেশ দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে গেলো। একজন সিপাহীর হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে তাঁরা তার বুকে বেয়নেট বসিয়ে দিলেন। কৃষক ও সিপাহীদের মধ্যে হাতাহাতি লড়াই শুরু হলো। এর পর অন্য দুইজন সিপাহীও কৃষকদের হাতে নিহত হলো কিন্তু কৃষক পক্ষে কোন ক্ষয়ক্ষতি হলো না। দুটি রাইফেল তারা সিপাহীদের থেকে হস্তগত করলেন। এই ঘটনা সমগ্র এলাকায় আন্দোলনের ঊর্ধ্বগতি নির্ণয়ে সহায়ক হলো, কৃষকদের সংগ্রামী উদ্দীপনা অনেক বাড়লো। আন্দোলনের ঢেউ সারা এলাকাকে প্লাবিত করলো। কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নলিতাবাড়ী থানার উত্তরে অসংখ্য গ্রাম কৃষক সংগ্রামের শক্তিশালী দুর্গে পরিণত হলো। সমগ্র পাহাড় অঞ্চল কৃষক জনতার রাজনৈতিক কর্তৃত্বে চলে এলো। [১২৭] 

১লা ফেব্রুয়ারী কৃষক কর্মীদের একটি দল কলসিন্ধু পুলিশ ক্যাম্পের নিকটবর্তী নিতাই নদীর পাড়ে তাদের প্রচার কার্য চালাবার সময় প্রায় ৩০ জন সিপাহী ও ৫০ জন আনসারের এক বিরাট বাহিনীর দ্বারা আকস্মিকভাবে ঘেরাও হন। কৃষকরা সঙ্গে সঙ্গে ঝোপঝাড়, নদীর বাঁক ও আলের আড়ালে আশ্রয় গ্রহণ করে আক্রমণের প্রস্তুতি নিলেন। কৃষকদের এই ক্ষিপ্রগতি প্রস্তুতি দেখে সিপাহীরা তাঁদের অস্ত্রের জোর এবং সংখ্যাধিক্য সত্ত্বেও আর অগ্রসর হতে সাহস না পেয়ে দূর থেকেই তাঁদের প্রতি গুলিবর্ষণ শুরু করলো। সেই গুলিতে দলের কারও কোন ক্ষতি না হলেও কলসিন্ধুর হাট থেকে ফেরার পথে জাঙ্গালিয়া পাড়ার রামদয়াল ও রামচরণ নামে দুজন কৃষক সিপাহীদের গুলিতে নিহত হন।[১২৮] 

২৮শে জানুয়ারী লেঙ্গুরা পুলিশ ক্যাম্পের সামনের ময়দানে কয়েক হাজার কৃষক এক সভা করেছিলেন। এর সাতদিন পর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী এখানেই হাজং আন্দোলনের ইতিহাসে সব থেকে বিখ্যাত কৃষক-সিপাহী সংঘর্ষ ঘটে। লেঙ্গুরার যে স্থানটিতে হাট বসে ঠিক তার পাশেই পরিখা ব্যারিকেড ইত্যাদি রচনা করে আগ্নেয়াস্ত্রে সুসজ্জিত ১৫ জন পাঞ্জাবী সিপাহীসহ ৩০ জন সিপাহীর ক্যাম্প। এই সিপাহীরা তাঁদের ক্যাম্পের সামনে অনুষ্ঠিত সভার সমস্ত ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করলেও ২৮শে জানুয়ারী তারা কৃষকদেরকে আক্রমণ করে না এবং কৃষকরাও তাদের প্রতি কোন দৃষ্টি দেন না। দুই পক্ষই নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান এইভাবে রক্ষা করার জন্যে সেদিন কোন সংঘর্ষ ছাড়াই সেই কৃষক সভার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু ৪ঠা জানুয়ারী হাটের দিন পরিস্থিতি পরিবর্তিত হলো। সেদিন খুব ভোরে স্থানীয় দুজন দালাল ক্যাম্পের সুবেদারকে এই মর্মে মিথ্যা সংবাদ দেয় যে, পূর্ব রাত্রে টঙ্ক চাষীরা দলবদ্ধভাবে ক্যাম্প আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে এবং হাট বসার পর সুবিধামতো কোন এক সময়ে তাঁরা সেই আক্রমণ চালিয়ে ক্যাম্পের অস্ত্রশস্ত্র লুণ্ঠন করবে। এই সংবাদ পুলিশ ক্যাম্পে যথেষ্ট উত্তেজনা সৃষ্টি করলো এবং যে কোন মুহূর্তে আক্রমণ হতে পারে—এই আশঙ্কা করে তারপর থেকেই পাঞ্জাবী সুবেদারের নেতৃত্বে সিপাহীরা সশস্ত্রভাবে প্রস্তুত থাকলো। 

প্রতি হাটবারের মতো ৪ঠা ফেব্রুয়ারীও বেলা ১১টার দিকে হাট বসলো। এই সময় ২৫ জন টঙ্ক চাষীর একটি প্রচার বাহিনী উত্তর দিক থেকে ধীরে ধীরে হাটের নিকটবর্তী হতে শুরু করলো। দা, ভেজালী ইত্যাদিতে সজ্জিত এই কৃষকরা হাতে লাল ঝাণ্ডা, পোস্টার ড্রাম, বিউগল ইত্যাদি নিয়ে হাটের কাছাকাছি এসে আওয়াজ তুললো: জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ কর’, ‘ধান সিজ বন্ধ করো’, ‘জান দিবো তবু ধান দিবো না’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। হাটের কৃষক জনসাধারণও প্রচার দলটির এই আওয়াজের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রচার দলটির সাথে নিজেদের একাত্মতা ঘোষণা করলেন। এর পর হাটের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রচার বাহিনীটির অধিনায়ক মঙ্গলচান এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, “ভাইসব! স্বাধীনতা লাভের পরও আমরা অতীতের দুই শত বৎসরের মতোই পরাধীনতার জ্বালা যন্ত্রণা, অত্যাচার, অবিচার ভোগ করিতেছি। আজও জমিদারী উচ্ছেদ হইল না। শুধু তাহাই নহে, ৭ বৎসর আগে আমরা যে জমিদারী জুলুম গ্রাম হইতে দূর করিয়াছিলাম, আজ তাহাই আবার দেখা দিয়াছে। আবার নতুন করিয়া পুলিশ ক্যাম্প বসানো হইয়াছে। জুলুম করিয়া লেভী ধান আদায় করা হইতেছে। তাই আসুন আমরা আওয়াজ তুলি – জমিদারী প্রথার অবসান হোক, গরীব চাষীর ধানে লেভী নেই, এলাকার উদ্বৃত্ত নগদ মূল্যে ক্রয় কর।” 

বক্তৃতা শেষ করে মঙ্গল চান হাট পরিত্যাগের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। যে পথ ধরে তাঁরা অগ্রসর হবেন সেটি পুলিশ ক্যাম্পের ধার ঘেঁষে, প্রায় ২০/২৫ গজ দূর দিয়ে। প্রচার বাহিনীটি যখন ঠিক সেই পরিমাণ দূরত্বে উপস্থিত হলো ঠিক তখনই পুলিশ ক্যাম্পে থেকে তাঁদের ওপর গুলি বর্ষিত হলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হাটের লোকেরা যে যেদিকে পারলো পালাতে শুরু করলো। মাঠের মধ্যে কোন আড়াল না থাকায় অন্য উপায় না দেখে প্রচারবাহিনীর লোকেরা মাটির ওপর শুয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করলেন। বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে মঙ্গলচান সাথীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বললেন, ভাইসব! আজ আমাদের বিপ্লবী জীবনের কঠিন পরীক্ষা, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষার একমাত্র উপায় শত্রুকে প্রতি আক্রমণ করা। সুতরাং চলো আমরা বুকে হাঁটিয়া অগ্রসর হই।” বুকে হেঁটে এবং হামাগুড়ি দিয়ে মঙ্গলচান ক্যাম্পের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছাতেই এক ঝাঁক গুলি এসে তাঁর সারা শরীরে বিদ্ধ হলো। তিনি চীৎকার করে একবার আহ্বান জানালেন, “অগ্রসর হও।” তার পরই সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু ঘটলো। মঙ্গলচানের মৃত্যুর পর অগেন্দ্র অন্যান্য সাথীদেরকে চীৎকার করে বললেন, “মঙ্গলদার রক্তের প্রতিশোধ নিতে অগ্রসর হও।” সকলেই সেই নির্দেশ মতো অগ্রসর হয়ে ক্যাম্পের খুবই কাছাকাছি পৌঁছালেন। কিন্তু ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে সিপাহীদের সাথে হাতাহাতি লড়াই তাঁদের পক্ষে সম্ভব হলো না। অগেন্দ্র অল্পক্ষণের মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি সাথীদের প্রতি আহ্বান জানালেন: “আমাদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিও, লাল ঝাণ্ডা তুলিয়া ধর।”[১২৯] 

হাটের মধ্যেও অনেক সিপাহীদের এলোপাথাড়ী গুলিতে আহত হলেন। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে হাটের লোকদের পক্ষে সমবেতভাবে পুলিশ ক্যাম্পে চড়াও করা সম্ভব হলো না। প্রচার বাহিনীর জঙ্গী কৃষকরাও ক্যাম্পের দিকে আর অগ্রসর হতে না পেরে মাটিতে মাথা নীচু করে কোনমতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে থাকলেন। 

ইতিমধ্যে মঙ্গলচান ও অগেন্দ্রের মৃত্যু সংবাদ ও লড়াইয়ের সংবাদ বিদ্যুৎদ্বেগে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রচারিত হলো। দলে দলে জঙ্গী কৃষকরা লাঠি, জাঠা, দা, কুড়াল, বর্শা ইত্যাদি হাতে নিয়ে হাটের দিকে দৌড়ে আসতে শুরু করলেন। তাঁরা আওয়াজ তুললেন: “হত্যার প্রতিশোধ চাই।” বেলা তিনটার দিকে সমগ্র পুলিশ ক্যাম্পটি চতুর্দিক থেকে জঙ্গী কৃষকদের দ্বারা অবরুদ্ধ হলো। এই পরিস্থিতিতে সিপাহীরা স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ হওয়ার জন্যে পলায়নের চেষ্টা শুরু করলো। ৩০/৪০ জন কৃষক তাঁদের সামনাসামনি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষার আর কোন উপায় না দেখে পুলিশ ক্যাম্পটির ওপর দা, কুডুল, বর্শা, ইত্যাদি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সিপাহীরাও আত্মরক্ষার জন্যে মরিয়া হয়ে অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করে চললো। অতুলনীয় সাহস ও বীরত্বের সাথে সেই সম্মুখযুদ্ধে একে একে কৃষক বাহিনীর লোকেরা মৃত্যু বরণ করতে থাকলেন, কিন্তু পলায়ন অথবা পশ্চাদপসরণের চিন্তা কেউ করলেন না। হাজং মেয়েরাও এই লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করছিলেন। সংঘর্ষে শঙ্খমণি নামক এক হাজং বধূ আহত হলে তাঁর স্বামী তাঁকে তাড়াতাড়ি সাহায্য করতে অগ্রসর হলে তিনি স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মোকে না চা, শত্রুকে, মারো, ওলা রক্ত লা” (আমার দিকে তাকাইও না, শত্রুকে মারো, তাহার রক্ত লও)। তিন চার ঘণ্টা এইভাবে লড়াই চলার পর শঙ্খমণি, রেবতী, সারথী, যোগেন, বদক, স্বরাজ প্রভৃতি ১৫ জন বিপ্লবী কৃষক একে একে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু বরণ করলেন। কিন্তু এত ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও কৃষকরা পিছু হটলেন না। সিপাহীরা পুলিশ ক্যাম্পে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়েই থাকলো। সন্ধ্যা নামার পর লড়াই থামলো এবং সেই সুযোগে অন্ধকারের মধ্যে সিপাহীরা পলায়ন করে সুসং-দুর্গাপুরের পথে রওয়ানা হলো। ১২ জন দুর্ধর্ষ গেরিলা দুই দলে বিভক্ত হয়ে তাঁদের পলায়নের পথে ওৎ পেতে বসে ছিলেন। জিগাতলার মাঠ অতিক্রম করে কলিকাপুরের মাঠে এসে পৌঁছাতেই তাঁরা বোমার সাহায্যে সিপাহীদের ওপর আক্রমণ চালালেন। এই আক্রমণের ফলে একজন সিপাহী নিহত হলো, আহত হলো ছয় জন। গেরিলা দলটির কোন ক্ষয়ক্ষতি হলো না। এ সিপাহীরা অন্ধকারের মধ্যে পলায়ন করলো। পরদিনই সমগ্র সুসং পরগণায় শতাধিক সিপাহীর সমাবেশ করা হলো। 

ময়মনসিংহের হাজং অঞ্চলের জমিদারী ও টঙ্কবিরোধী আন্দোলন এবং কৃষকদের সাথে পুলিশ ও সৈন্যবাহিনীর সংঘর্ষের কোন সংবাদই প্রকৃতপক্ষে পুর্ব বাঙলার তৎকালীন সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশিত হতো না। কাজেই এই অঞ্চলের ঘটনাসমূহের সাথে দেশের জনগণের কোন পরিচয়ই তৎকালে ছিলো না বলা চলে। মাঝে মাঝে অবশ্য দুই একটি ঘটনা লোকমুখে রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে সরকারী মহল এবং জমিদার জোতদার মহাজনদের অনুগত পত্রপত্রিকায় বিকৃতভাবে সেগুলি সম্পর্কে সংবাদ প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত এবং আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা করা হতো। ৪ঠা ফেব্রুয়ারীতে লেঙ্গুরা হাটের সামনে যে কৃষক-সিপাহী সংঘর্ষ হয় সে বিষয়ে ময়মনসিংহ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারী প্রেরিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত নিম্নলিখিত বিবরণটি এদিক থেকে উল্লেখযোগ্য: 

জানা গিয়াছে যে, গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারী মোমেনশাহী জেলার আসাম পূর্ববঙ্গ সীমান্তবর্তী এলাকাবাসী হাজং ও আদিবাসীগণ লাঠি, তীর, ধনুক, বর্শা ও রামদা লইয়া লেঙ্গুরাস্থিত পুলিশ ক্যাম্প আক্রমণ করে। হাজংদের মধ্যে কম্যুনিস্ট প্রভাব বলিয়া প্রকাশ। তাহারা দুই দলে বিভক্ত হইয়া পুলিশদিগকে আক্রমণ করে, কিন্তু পুলিশের পাল্টা আক্রমণ ও গুলিচালনার পরে হটিয়া যায়। গুলিবর্ষণের ফলে ১০ জন হাজং নিহত ও আরও কয়েকজন আহত হইয়াছে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী প্রেরণ করা হয় এবং অবস্থা আয়ত্তাধীনে আসিয়াছে বলিয়া প্ৰকাশ। 

পুলিশ হাজংদের কয়েকটি গ্রামে হানা দিয়া ২৮ জনকে গ্রেফতার করিয়াছে এবং বহু তীর, ধনুক ও বর্শা উদ্ধার করিয়াছে। জানা গিয়াছে যে হাজংরা কিছুকাল যাবৎ সরকারের টঙ্ক ও কর সংগ্রহ পরিচালনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিয়া আসিতেছে। টঙ্ক’ ব্যবস্থা অনুসারে নগদ টাকার পরিবর্তে উৎপন্ন শস্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ জমিদারগণকে দিতে হয়। 

প্রকাশ যে, গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারীর ঘটনার পূর্বে উক্ত একই এলাকার অন্তর্গত বালিগঞ্জে সীমান্ত বাহিনীর একজন সৈন্য নিহত হয়। [১৩০] 

৪ঠা ফেব্রুয়ারীর ঘটনার পর কৃষকরা উপলব্ধি করলেন যে সরকারী বাহিনীকে সশস্ত্রভাবে মোকাবেলা করতে হলে শুধুমাত্র দা, কুড়াল, বর্শা, তীর, ধনুক, ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র দ্বারা সেটা সম্ভব নয়। তার জন্যে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার অপরিহার্য। কাজেই এরপর থেকে তাঁরা পূর্ববর্তী সংগ্রামের সময় সংগৃহীত আগ্নেয়াস্ত্রগুলি ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুতি শুরু করলেন। লেঙ্গুরা হাটের ঘটনা দুর্গাপুর, নলিতাবাড়ী, শেরপুর ইত্যাদি কয়েকটি লাগাতার থানা অঞ্চলে কৃষক জনতার সংগ্রামী চেতনাকে আরও উচ্চপর্যায়ে নিয়ে গেলো এবং কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকেও প্রচারকার্যকে ব্যাপক ও গভীর করার উদ্যোগ গৃহীত হলো। এর ফলে চারিদিকে প্রচারবাহিনীর তৎপরতাও বৃদ্ধি পেলো। 

৯ই ফেব্রুয়ারী তারিখে একদল জঙ্গী কৃষক কাকরকান্দী, বন্নিবাড়ী, কাউকালারা প্রভৃতি গ্রামে প্রচারকার্য চালিয়ে শালমারা উপস্থিত হতেই আকস্মিকভাবে তারা সিপাহীদের একটি দলের মুখোমুখি পড়লেন। প্রচারবাহিনীকে দেখা মাত্রই বিনা প্ররোচনায় সিপাহীরা গুলি বর্ষণ শুরু করতেই কৃষকরা বিরাট বিরাট শাল গাছের আড়ালে চলে গিয়ে তীর ধনুক বর্শা ইত্যাদি তাদের দিকে নিক্ষেপ করতে থাকলেন। এই সংঘর্ষ চলাকালে আরও ১৫ জন সিপাহী বহু আনসার এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সিপাহীদের শক্তি বৃদ্ধি করলো। সেই অবস্থায় চতুর্দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখে কৃষকরা সংঘর্ষ বন্ধ রেখে আত্মরক্ষার জন্যে তাড়াতাড়ি স্থান ত্যাগ করলেন। এই লড়াইয়ে কৃষক দলের নেতা সতীন্দ্র ডালু মৃত্যু বরণ করলেন এবং চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্ধ অবস্থায় শচীন্দ্র ঘোষ সিপাহীদের হাতে বন্দী হলেন। [১৩১] 

ময়মনসিংহ থেকে ১২ই ফেব্রুয়ারী প্রেরিত এবং দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে ৯ই ফেব্রুয়ারীর দুটি ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়: 

জানা গিয়াছে গত ৯ই ফেব্রুয়ারী মোমেনশাহী জেলার পূর্ব পাক আসাম সীমান্তবর্তী উত্তর এলাকার গারো হাজং কমিউনিস্টগণ লাঠি, তীর ধনুক, বর্শা ইত্যাদি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া দুর্গাপুর থানার নিকটস্থ ‘সেঙ্গু’ এবং হালুয়াঘাট থানার উপকণ্ঠস্থ পুলিশ ক্যাম্প আক্রমণ করিলে, পুলিশ বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করিয়া গুলি চালায়। ফলে, হালুয়াঘাট থানার নিকটস্থ ঘটনাকেন্দ্রে কমিউনিস্ট পক্ষের ১ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হইয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। লেঙ্গুরাস্থ ঘটনাকেন্দ্রের হতাহতের খবর এখন পাওয়া যায় নাই। প্রকাশ পূর্ব প্রকাশিত সরকারের টঙ্ক ও খাদ্য সংগ্রহনীতির বিরুদ্ধাচরণই এই সমস্ত সংঘর্ষে মূল কারণ। আর এক খবরে প্রকাশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুপস্থিতিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হালুয়া ঘাট, নলিতাবাড়ী এবং শ্রীবর্দী থানাত্রয়ে ১৪৪ ধারা জারী করিয়াছেন। আরও প্রকাশ অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী এবং ইবি রেজিমেন্ট রাইফেল্স্ উক্ত অঞ্চলে প্রেরণ করা হইয়াছে। বর্তমান অবস্থা কিয়ৎ পরিমাণে শান্ত। [১৩২] 

ময়মনসিংহের হাজং অঞ্চলে কৃষক-সিপাহী সংঘর্ষ এবং সিপাহীদের কৃষক নির্যাতন সম্পর্কে এই সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ইত্যাদি পত্রিকায় মন্তব্যসহ কিছু কিছু সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই সব সংবাদের প্রতিবাদ করে পূর্ব বাঙলা সরকার ১৬ই ফেব্রুয়ারী ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিম্নলিখিত প্রেস নোট জারী করেন: 

গত ১৫ই ফেব্রুয়ারী আনন্দবাজার পত্রিকা ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশিত ইউনাইটেড প্রেস অব ইন্ডিয়ার একটি খবরের প্রতি পূর্ববঙ্গ সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। মোমেনশাহী জেলার আংশিক বহির্ভূত এলাকায় সাম্প্রতিক গোলযোগ সম্পর্কে উক্ত সংবাদে মিথ্যা বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। উহাতে বলা হইয়াছে যে, বাধ্যতামূলক ধান্য সংগ্রহ পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান দিতে অস্বীকার করায় প্রায় একশত জনেরও অধিকতর কৃষককে গুলি করিয়া নিহত করা হইয়াছে। প্রকৃত ঘটনাটি এইরূপ : 

উক্ত এলাকার হাজংদের আন্দোলন প্রায় স্থানীয় বৈশিষ্ট্যস্বরূপ ১৯৪৬ সালে একবার তাহাদের আন্দোলন এত ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী হইয়া ছিলো যে, অবস্থা আয়ত্তাধীনে আনিতে বাংলা সরকারকে পুলিশ প্রেরণ করিতে হইয়াছিলো। জনসাধারণের অনুন্নত অবস্থার সুযোগে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে পুরাতন আন্দোলন পুনরায় আরম্ভ করা হইয়াছে। 

কম্যুনিস্টদের নেতৃত্বে হাজংরা কয়েকটি সভা ও শোভাযাত্রায় টঙ্ক প্রথা, খাজনা ও ধান্য সংগ্রহের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। তাহারা বর্শা, দাও প্রভৃতি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিলো। কয়েকবার তাহারা ধানও লুট করে। ২৮শে জানুয়ারী সীমান্ত পুলিশ দলের জনৈক নায়েক তাহাদের হস্তে নিহত হয়। একজন পুলিশ কনস্টেবলকেও হাজংরা বেদম প্রহার করে। গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারী কম্যুনিস্ট হাজংদের একটি বিরাট জনতা বর্শা ও দাও প্ৰভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া লেঙ্গুরা থানার পুলিশ ক্যাম্পটি পরিবেষ্টন করিয়া ফেলে। পুলিশ তাহাদিগকে ছত্রভঙ্গ করিতে অসমর্থ হইয়া গুলি চালায়। 

দুই ঘণ্টা পর অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আরেকটি জনতা ঐ স্থানে জমায়েত হয়। পুলিশ তাহাদিগকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য আবার গুলি চালায়। ৯ই ফেব্রুয়ারী দুর্গাপুর ও হালুয়াঘাট থানায় দুইটি স্থানেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ বারবার সাবধান করে। জনতা যখন ভীতি প্রদর্শন করে এবং অবস্থা যখন আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যাওয়ার উপক্রম হয়, তখনই পুলিশ গুলি করে। এ পর্যন্ত মোট ১৩ জন নিহত হইয়াছে। বর্তমানে অবস্থা শান্ত।[১৩৩]

বেসরকারী অথবা সরকারবিরোধী সংবাদপত্রসমূহের কণ্ঠরোধ, সাংবাদিকদের ওপর যথেচ্ছ রাজনৈতিক কর্মীদেরকে অবাধে কারাগারে নিক্ষেপ ইত্যাদি বিবিধপ্রকার জোরজুলুমের মাধ্যমে ১৯৪৯-এর দিকে পূর্ব বাঙলা সরকার সব রকম বিরোধী শক্তিকে দমন করতে কৃতসংকল্প ছিলো। সেই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট নেতৃত্বে হাজংদের ওপর নির্যাতনের কোন প্রতিবাদ কারো পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এবং সে চেষ্টা কেউ করলে তাঁদেরকে সরকার ও সরকার প্রতিপালিত সংগঠনগুলির দ্বারা নির্যাতিত হতে হতো। ১৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৯ এ ধরনেরই একটি ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। 

১৪ই ফেব্রুয়ারী ছাত্র ফেডারেশনের[১৩৪] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ময়মনসিংহের হাজং কৃষকদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও কৃষক হত্যার প্রতিবাদে ১৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্র সভা আহ্বান করে। মোহাম্মদ বাহাউদ্দীনের সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হওয়ার পরই দেখা যায় একদল ছাত্র[১৩৫] জোরপূর্বক সভা ভেঙে দিতে বদ্ধপরিকর। এদের মধ্যে একজন ‘সভা কে আহ্বান করেছে’ সেটা জানতে চায় এবং সভাপতির হাত ধরে টেনে তাঁকে চেয়ার থেকে ফেলে দেয় এবং অন্য একজন সভাপতির চেয়ারটি পার্শ্ববর্তী পুকুরে নিক্ষেপ করে। এর পর সেই গুণ্ডা ছাত্রদল সভাটির উদ্যোক্তাদের উপর ইচ্ছেমতো কিল, চড়, ঘুষি ইত্যাদি চালাতে থাকে। ফলে সভাস্থলে এক দারুণ হট্টগোল গণ্ডগোলের সৃষ্টি হয় এবং সভার কাজ চালানো আর সম্ভব হয় না। এই গুণ্ডামীর বিরুদ্ধে অবশ্য সভাস্থলেই একদল ছাত্র তীব্র প্রতিবাদ জানান।[১৩৬] এঁদের একজনের একটি পত্র নওবেলালে প্রকাশিত হয় এবং তাতে তিনি বলেন: 

সবাই বুঝিতে পারেন, যাহারা গুণ্ডামী করিয়া সভা ভাঙ্গিয়া দেন তারা শুধু ছাত্র ফেডারেশনেরই নন, তারা প্রত্যেকটি গণতন্ত্রকামী ছাত্র আন্দোলনেরই দুশমন। এরাই বাংলা ভাষা আন্দোলনে সরকারের দালাল সাজিয়া ছিলেন। এরাই জমিদারী উচ্ছেদ ব্যাপারে সরকারের জমিদার পোষণ নীতির সমর্থন করেন। সর্বোপরি এরা হাজং চাষীদের উপর গুলি বর্ষণ নীতির দিক দিয়া সমর্থন করেন। [১৩৭] 

১৯৪৯-এর ফেব্রুয়ারী মাসেই সুসং দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট ও নীলতাবাড়ী থানায় সর্বমোট ২৫টি পুলিশ ক্যাম্পে সশস্ত্র সিপাহীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলো। এ ছাড়া আনসারেরা দরিদ্র কৃষক জনগণের ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করলো। এই পরিস্থিতিতে ১৫ই ফেব্রুয়ারী রাত্রি ১টার দিকে একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মচারী বহু সংখ্যক সিপাহী ও আনসার সাথে নিয়ে নলিতাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনের গোপন কেন্দ্রস্থল হলদিগ্রাম ঘেরাও করে সকালের দিকে আক্রমণের প্রতীক্ষায় থাকলো। গোপন কেন্দ্রে এই সংবাদ কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদবাহকদের মাধ্যমে রাত্রেই পৌঁছালো। সেখানে যে সমস্ত নেতারা উপস্থিত ছিলেন তারা তৎক্ষণাৎ স্থির করলেন যে, ভোরের জন্য অপেক্ষা না করে রাত্রিকালেই তারা তাদের গোপন কেন্দ্র পরিত্যাগ করে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবেন। দুই দলে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ীয়া পথে জঙ্গী এবং অভিজ্ঞ গেরিলাদের সামনে রেখে তারা শত্রুপক্ষের অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থান লক্ষ্য করে অগ্রসর হলেন। মেয়েরাও পুরুষদের ছদ্মবেশে দুই দলেই বিভক্ত থাকলেন। অল্প কিছুদূর অগ্রসর হতেই একজন স্থানীয় চৌকিদার তাদের গতিবিধি অনুমান করে সিপাহীদেরকে সতর্ক করার সাথে সাথে সিপাহীরা তাদের ওপর টর্চের আলো নিক্ষেপ করে গুলি ছুঁড়লো। বিদ্রোহীরাও তার পাল্টা জবাব দিলেন কিন্তু জবাব দিলেও তারা কোন সরাসরি সংঘর্ষের মধ্যে না গিয়ে অভিজ্ঞ স্থানীয় কৃষকদেরকে অনুসরণ করে পাহাড়ের আড়ালে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে সমর্থ হলেন। এই দলে ছিলেন নেতাদের মধ্যে জিতেন মৈত্র এবং মহিলা কর্মী কণা পাল। রবি নিয়োগী ও জলধর পালের নেতৃত্বাধীন দলটি সিপাহীদের ব্যূহ ভেদ করতে সমর্থ হলেন না। তাদের সাথে সিপাহীদের সংঘর্ষ হলো এবং রবি নিয়োগী ও জলধর পালসহ কৃষক পক্ষের অনেকেই আহত হলেন। সিপাহীরাও অনেকে আহত হলো। পরদিন পুলিশ সমগ্র গ্রামটি জ্বালিয়ে দিয়ে এলাকা পরিত্যাগ করলো।[১৩৮] এই সংঘর্ষ এবং জখম ও গ্রেফতারের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় জনগণের বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করলো এবং ১৬ই ফেব্রুয়ারী সকালে তারা নন্নী, বারোয়ামারী ও নলিতাবাড়ী সিপাহী ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন। গুলিবর্ষণের দ্বারা পুলিশবাহিনী এই বিক্ষুব্ধ জনতার মোকাবেলা করলো এবং গুলির সামনে আর অগ্রসর হতে অক্ষম হয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। ক্রোধোন্মত্ত জনতা তখন জীপ ট্রাক ইত্যাদির সাহায্যে সিপাহীদের গমনাগমনে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পথে সেতু চূর্ণবিচূর্ণ করলেন। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এই এলাকায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল ও পুলিশ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করে জনগণের ওপর অবাধ নির্যাতন শুরু হলো। ২৫ জন কৃষককে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হলো। লেঙ্গুরা হাটের ঘটনার পর থেকে প্রায় এক হাজার সিপাহীর এক সশস্ত্র বাহিনী সমগ্র অঞ্চলটিকে ঘেরাও করে রেখে কৃষকদের গৃহ লুণ্ঠন, তাদের ওপর সর্বপ্রকার শারীরিক নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, গৃহদাহ ইত্যাদির দ্বারা চারিদিকে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো। বিদ্রোহী কৃষকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্যে হাজং, গারো ও মুসলমান কৃষকদের নখের মধ্যে সূঁচ বিদ্ধ করে তাঁরা স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চালালো। টঙ্ক চাষীদের গবাদি পশু ও খাদ্যশস্য জোরপূর্বক দখল, ঘরদুয়ার ভেঙে তছনছ এবং পাইকারীভাবে জরিমানা আদায় করলো। সামান্য বকেয়া খাজনার দায়ে কৃষকদের অনেক টাকার সম্পত্তি ক্রোক করে তাদেরকে নিঃস্ব করলো। মার্চ মাসের এক ভোরে লক্ষ্মীকুড়া গ্রামে স্বয়ং ময়মনসিংহের পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট এক ট্রাক পুলিশ সাথে নিয়ে জীপে করে উপস্থিত হলেন এবং স্থানীয় নেতা চন্দ্র সরকারের বাড়ী ঘেরাও করলেন। চন্দ্র সরকার বাড়ীতে না থাকায় তিনি কোথায় আছেন সে বিষয়ে খবরাখবরের জন্যে তিনি বাড়ীর স্ত্রীলোকদের ওপর জোর জুলম শুরু করে আসবাপত্র চুরমার করলেন এবং চুলের মুঠি ধরে স্ত্রীলোকদেরকে টানতে টানতে ধান ক্ষেতের মধ্যে নিয়ে গেলেন। ক্রন্দনরত শিশুদেরকে সিপাহীরা বুটের লাথি মেরে শায়েস্তা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু এত নির্যাতন সত্ত্বেও চন্দ্র সরকারের কোন খবর তারা পেলো না।[১৩৯] 

১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকে এইভাবে গ্রামবাসীদের ওপর সরকারী পুলিশ ও সিপাহীদের নির্যাতন ব্যাপক ও চরম আকার ধারণ করার পর বিদ্রোহী কৃষকরা সংগ্রামের কৌশল পরিবর্তন করলেন। তারা আর গ্রামের জনসাধারণের মধ্যে না থেকে বিভিন্ন এলাকায় কতকগুলি গেরিলা ক্যাম্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত করলেন। দুর্গম পাহাড়ী এলাকার মধ্যে তারা সশস্ত্র প্রতিরোধের পক্ষে সুবিধাজনক স্থানগুলিতে পরিখা খনন ও শালের খুঁটির বেষ্টনী রচনা করে অম্বুলুকা, দাম্বুক, বেড়াখালি, মেলেং, পানিহাট, রাঙটিয়া, চান্দুভূঁই, হালচাটি প্রভৃতি স্থানে ৯টি গেরিলা ক্যাম্প স্থাপন করলেন। এইসব অঞ্চলে আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণের জন্যে তাঁরা তিনটি কারখানাও স্থাপন করলেন। এইসব কারখানাতে গাদা বন্দুক, দেশী পিস্তল, বড়ো বড়ো গাদা কামান এবং বিভিন্ন ধরনের হাত বোমা তৈরীর কাজ শুরু হলো। এই অঞ্চলের গেরিলাদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র শিক্ষক ছিলেন শচী রায়। তিনি নিজ হাতে গোপন কামারশালায় ও কারখানায় বোমা বন্দুক ইত্যাদিও তৈরী করতেন। একদিন এইভাবে বোমা তৈরীর সময় বিস্ফোরণের ফলে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তার সহকর্মী পূর্ণ হাজং আহত হয়ে পরে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েন। ডক্টর অমিয় দাসগুপ্তের নেতৃত্বে চিকিৎসার জন্যে সাজ সরঞ্জাম ঔষধপত্রাদিরও ব্যবস্থা যথাসম্ভব করা হলো। এ ছাড়া সারা বৎসরের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যও এই ক্যাম্পগুলিতে তাঁরা সংগ্রহ করলেন। গ্রামের সাধারণ কৃষকগণও যথাসম্ভব একত্রে বাস করার জন্যে কয়েকটি জনক্যাম্প গঠন করলেন। এই সময় দিবাভাগে তাঁরা চাষাবাদ করতেন এবং সিপাহীদের আগমন যথাসময়ে জানা ও তাঁদের অতির্কিত আক্রমণের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বনের জন্যে পাহারা ও সংকেতের ব্যবস্থা রাখতেন। এই সময় কৃষক সংগ্রাম সমগ্র এলাকাতে এমনভাবে সংগঠিত হয়েছিলো যে, গ্রামের ছোট ছোট শিশু ও বালকরাও সিপাহীদের আগমন লক্ষ্য করে গাছে চড়ে ও বাঁশি বাজিয়ে গ্রামবাসীদেরকে সতর্ক করে দিতো। ১৯৪৯ সালের মে মাসের দিকেই সংগ্রামী কৃষকদের প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষ হলো এবং তারপর তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন বিভিন্ন এলাকার পুলিশ ক্যাম্প ও দালালদের আস্তানাগুলি রাত্রিকালে অতর্কিতে আক্রমণ করার। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমেই তাঁরা সানখোলা, সারনৈ ও হাতি পাগারের তিনটি ক্যাম্প রাইফেল, স্টেনগান, গাদা বন্দুক ও বোমার সাহায্যে আক্রমণ করলেন এবং তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হলো। এরপর সিপাহীরা ক্যাম্পের চারিদিকে পেট্রোম্যাক্স লাইট জ্বালিয়ে ও সেন্ট্রিবক্স স্থাপন করে পাহারার ব্যবস্থা করলো। [১৪০]

১৯৪৯ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে কৃষকবাহিনী ও সিপাহীদের মধ্যে ছোট বড়ো অসংখ্য সংঘর্ষ হলো। সরকারী সিপাহী পুলিশদের নির্যাতন যেমন অধিকতর ব্যাপক ও তীব্র আকার ধারণ করলো তেমনি কৃষকদের প্রতিরোধও হলো পূর্বের থেকে অনেক বেশী সক্রিয় এবং সংগঠিত। আমীর খাঁ কুড়া থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে ধান আদায় করে নিয়ে যাওয়ার সময় দুজন আনসার কৃষকদের হাতে নিহত হলো। তাঁদের লাশ বস্তার মধ্যে পুরে সেই ধানের গাড়িতেই তাঁরা ফেরত পাঠালেন। খারনৈ, ঝালঝালিয়া, জামগড়া, সন্ধ্যাকুড়া, কাংসা প্রভৃতি গ্রামে ২৫টি মহাজনের খামারের ধান দখল করে সেগুলি দরিদ্র গারো ও মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হলো। বাগপাড়ায় মহাজনের খামারটিকে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করা হলো। খিলাগড়ার মাঠে হাল চাষ করার সময় সিপাহীদের সাথে লড়াইয়ে ভীম, বদক ও রহিম নামক তিন জন কৃষক নিহত হলেন। দুইজন সিপাহী আহত হলো। এইভাবে মাঠে, হাটে, পথে প্রায়ই কৃষক-সিপাহী সংঘর্ষ অব্যাহত থাকলো। কুমারগাতি কৃষক সমিতির সামনের মাঠে, ভূষণ-কুড়া গ্রামে, গড়োগাঁও-এ একের পর এক সংঘর্ষ হলো এবং উভয় পক্ষেই বহু লোক আহত হলেও অনেক কৃষককে সিপাহীরা গ্রেফতার করে জেলে পাঠালো। ভুবন কুড়া ইউনিয়নে সরকারী কর্তৃপক্ষ পাইকারী জরিমানা করলো। সেই জরিমানার ধান জোরপূর্বক আদায় করে নিয়ে যাওয়ার পথে গেরিলা নায়ক সুদর্শন মাত্র ৭ জন গেরিলা সাথী নিয়ে কড়ইতলা গ্রামের একটি ঝোপের আড়াল থেকে তিন-চারটি হাত বোমা নিক্ষেপ করে পাঁচ-সাত জন সিপাহীকে আহত করলেন। আনসার ও গাড়োয়ানেরা ভীত হয়ে দৌড় দিয়ে পালায়ন করলো কিন্তু ২০ জন সশস্ত্র সিপাহী ঝোপটি লক্ষ্য করে অজস্র গুলিবর্ষণ করতে থাকলো। গুলিবর্ষণের ফলে ঐ ঝোপের মধ্যেই সুদর্শন ও হরি সিং ডালু মৃত্যুবরণ করলেন। [১৪১] 

যে সমস্ত স্থানীয় দালালরা পুলিশ ক্যাম্পে খবরাখবর সরবরাহ করতো তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। প্রয়োজনবোধে তাঁদেরকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হতো। কালিকাপুর, মাইজপাড়া, খিলাবই, কাংসা, চারুয়াপাড়া, ঘোষাগাঁও, খারনৈ, রামচন্দ্র কড়া, ময়াঘাসী, বিক্রিকুড়া, ধানশাইল প্রভৃতি গ্রামের ৩০-৩৫ জন দালালকে এইভাবে গণআদালতের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের অস্থাবর সম্পত্তি জনগণের মধ্যে বিলি করা হয়, তাদের বাড়ী লুট করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র গেরিলারা দখল করেন। এইভাবে দালালদের নিকট থেকে গেরিলারা ২৫টির মতো বন্দুক দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু যে সমস্ত জমিদার জোতদাররা কৃষকদের সাথে তৎকালীন পরিস্থিতিতে শত্রুতামূলক আচরণ করতো না, তাদের কোন ক্ষতি করা হতো না। শেরপুরের এক জমিদার এইসব ঘটনার সময় একবার পাইক বরকন্দাজসহ বান্দরকাটা কাছারীতে খাজনা আদায়ের জন্য আসে। স্থানীয় প্রজারা কৌশলের সাথে তাকে বন্দী করে গেরিলা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। সেখানে গণআদালতের সামনে জমিদারটি প্রতিজ্ঞা করে যে, সে অথবা তার কোন বংশধর কোনদিনই আর সেই জমিদারীর উপর স্বত্ব ভোগ দখল করতে আসবে না। এই প্রতিজ্ঞার পর গেরিলারা জমিদারটিকে মুক্তি দান করেন এবং নিরাপদে তাকে নিজেদের এলাকার বাইরে পাঠিয়ে দেন। [১৪২] 

এই সংগ্রামের সময়কার জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটে কলমাকান্দা থানার জাগীরপাড়া গ্রামে। এক গভীর রাত্রে প্রায় ৫০০ শত সিপাহী, পুলিশ ও আনসার গ্রামটিকে ঘেরাও করে। অতর্কিতভাবে আক্রান্ত হওয়ার ফলে কৃষকেরা পলায়ন অথবা প্রতিরোধের কোন সুযোগ পেলেন না। এই অবস্থায় রাত্রির অন্ধকারে শিশু বৃদ্ধ নারী নির্বিশেষে ৪০ জন গ্রামবাসীকে ঘুমন্ত থাকাকালেই হত্যা করা হয়। এইভাবে হত্যা, লুটতরাজ ইত্যাদির দ্বারা সরকার যে শুধু গেরিলাদের মোকাবেলার চেষ্টা করছিলো তাই নয়, তারা গেরিলাদের আশ্রয়দাতা গ্রামবাসীদেরকে সমূলে একের পর এক গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করার অহরহ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলি দখল অথবা সেগুলির ওপর আক্রমণকে কেন্দ্রীভূত করতে অক্ষম হয়ে তারা সাধারণ গ্রামবাসীদেরকে আঘাত করে গেরিলাদেরকে দুর্বল করার নীতি গ্রহণ করেছিলো। এজন্যে দিনের পর দিন গ্রামবাসীদের লাঞ্ছনা অবমাননা ও নির্যাতনের অন্ত ছিলো না। সমগ্র এলাকায় এই অবস্থায় কৃষিকার্য প্রায় অচল অবস্থায় উপনীত হয়েছিলো এবং জনগণের অর্থনৈতিক জীবন পর্যুদস্ত ও বিপন্ন হয়ে পড়েছিলো। এই পরিস্থিতিতেই গ্রামবাসী ও গেরিলাদের ধৈর্যচ্যুতির ফলে রাণীপুরে সংঘটিত হয় এই এলাকায় সর্ববৃহৎ সংঘর্ষ। [১৪৩] 

চেরাখালির জনক্যাম্পটি পাহাড়ের বাঁকে খুব সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলো এবং তারই কাছাকাছি পাহাড়ের অভ্যন্তরে ছিলো গেরিলা ঘাঁটি। একদিন সিপাহীরা নলগড়া, কমলপুর, সোহাগীপুর প্রভৃতি গ্রাম এলাকা লুটতরাজ করে চেরাখালির নিকটেই মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে দূরবীনের সাহায্যে চেরাখালির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলো। সিপাহীদেরকে ঐ অবস্থায় দেখে গ্রামবাসীরাও কৌতূহলী হয়ে গ্রামের প্রান্তে এসে তাঁদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্যে দাঁড়াতেই সিপাহীরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করলো। গুলির দ্বারা কেউ আহত না হলেও বিনা প্ররোচনায় এই গুলিবর্ষণ কৃ ষকদের মধ্যে ভয়ানক উত্তেজনার সৃষ্টি করলো। গ্রামের পশ্চাদভাগে অবস্থিত গেরিলা ক্যাম্প থেকেও গুলির আওয়াজ শুনে বিশজন গেরিলা জঙ্গী কৃষকদের মধ্যে উপস্থিত হলেন। গেরিলা ও কৃষকদের এই গতিবিধি লক্ষ্য করে সিপাহীরা তাঁদের অবস্থান পরিবর্তন করে কিছুটা পিছু হটে রাণীপুরের খোলা মাঠে গিয়ে দাঁড়ালো। উত্তেজিত কৃষকরা এবং তাঁদের সাথে গেরিলারাও পরিণাম বিবেচনা না করেই খোলা মাঠে গিয়ে সিপাহীদের মুখোমুখি অবস্থান নিলেন। এই সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে সিপাহীরা কৃষক ও গেরিলাদের লক্ষ্য করে আবার গুলিবর্ষণ করলো। মাটিতে শুয়ে আত্মরক্ষা করলেও তাঁরা দেখলেন যে, সিপাহীরা তাঁদের দিকেই এগিয়ে আসছে। এরপর তাঁরা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই সিপাহীদের গুলি আবার বর্ষিত হলো। জঙ্গী কৃষকরা আবার মাটিতে শুয়ে আত্মরক্ষা করলেন। কিন্তু বেশীক্ষণ এইভাবে আত্মরক্ষা সম্ভব হলো না। বাধ্য হয়েই তাঁদেরকে বন্দুক, বোমা, তীর, বর্শা, দা ইত্যাদি নিয়ে সিপাহীদের মুখোমুখি হয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড়াতে হলো। দুই পক্ষে শুরু হলো তুমুল লড়াই। এইভাবে এক ঘণ্টাকাল লড়াইয়ের পর গেরিলাদের হাত বোমা ও বন্দুকের কার্তুজ প্রায় শেষ হয়ে এলে, পাঁচ সাত জন উভয় পক্ষে হতাহত হলো। দূরপাল্লার লড়াই ক্রমশঃ অসম্ভব হয়ে পড়ায় গেরিলারা দ্রুতগতিতে সিপাহীদের নিকটবর্তী হলেন। গেরিলা দলের নায়ক দুবরাজ ও ক্ষিরোদ সিপাহীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চার পাঁচ জন সিপাহীকে গুরুতরভাবে আহত করলেন। এরপর সুবেদার নিজ হাতে রিভলবারের গুলি ও বেয়নেটের দ্বারা তাদের উভয়কেই হত্যা করলো। এই সময়ে অনন্ত ও চন্দ্র উভয়ে মিলিতভাবে একজন সিপাহীকে হত্যা করলেন। অনন্ত মৃত সিপাহীর রাইফেলটি নিয়ে দৌড় দিতেই একজন সিপাহীর গুলিতে নিহত হলেন। রাজেন্দ্র এবং অনু সুবাদারকে আক্রমণ করলেন কিন্তু তাঁরা উভয়েই গুলিতে তৎক্ষণাৎ নিহত হলেন। এরপর একের পর এক নীরেন্দ্র, বীরঙ্গ, রমেশ ও অতুল অপূর্ব সাহস ও বীরত্বের সাথে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করলেন। সিপাহীদের মধ্যে নিহত হলো তিন জন। উভয় পক্ষে আহতের সংখ্যা দাঁড়ালো দশ পনেরো জন। [১৪৪] 

রাণীপুরের এই সংঘর্ষের পর এক বিপুল সংখ্যক সরকারী বাহিনী চেরাখালি জন-ক্যাম্প ও পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহ দখল করে সেখানকার বাসিন্দাদের ওপর তাঁদের অভ্যস্ত পদ্ধতিতে অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। গ্রামবাসীদের সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠন করে, তাঁদেরকে যথেচ্ছভাবে মারপিট করে, নারী ধর্ষণ করে তাঁরা সমগ্র অঞ্চলটিতে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পঞ্চাশ জন কৃষককে তারা গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ জেলে আটক রাখে এবং আটক অবস্থাতেই তাদের মধ্যে সাত জনের মৃত্যু ঘটে।[১৪৫]

১৯৪৯-এর অগাষ্ট মাসে ময়মনসিংহে বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্ট কর্মী গ্রেফতার হন। ৭ই অগাষ্ট রাত্রে কোতোয়ালী পুলিশ ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় মহম্মদ ওয়াদেজ আলী, বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, রমেশ আচার্য্য ও রতুরাম চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। এর পর দিন, ৮ই অগাস্ট সোমেশ আচার্য্য বেনীমাধব রায় ও সুবোধ রায় পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। এঁদের থেকে পুলিশ কিছু সরকার বিরোধী কমিউনিস্ট সাহিত্য, একটি ড্যাগার ও একটি ছুরি হস্তগত করে। [১৪৬] 

এর পরবর্তী পর্যায়ে আন্দোলন অনেকখানি স্তিমিত হয়ে এলেও সশস্ত্র সংগ্রামের কর্মসূচী ১৯৫০ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত বাতিল হয়নি। সে সময় ময়মনসিংহের উত্তর অঞ্চলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দলিল ও সংবাদ বহন করার সময় অশ্মমণি, ভদ্রা ও রাহেলা নামে তিনজন মহিলা কর্মী সোমেশ্বরী নদী পার হওয়ার সময় গ্রেফতার হন। পুলিশ তাঁদেরকে নিজেদের ক্যাম্পে আটক রেখে সর্বপ্রকার নির্যাতনের দ্বারা তাঁদের থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। পরে সেখান থেকে তাঁদেরকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারগারে নিয়ে গিয়ে বহুদিন পর্যন্ত আটক রাখা হয়। এই সময় এক গভীর রাত্রে গোপন সংবাদ ও আগ্নেয়াস্ত্রের রসদ বহন করার সময় রমণী কর কংস নদীর পাড়ে আকস্মিকভাবে সিপাহীদের হাতে ধরা পড়েন। সিপাহীরা তাঁর দেহ তল্লাশী করে পাঁচ হাজার নগদ টাকা পায়। সেই টাকা নিজেরা হস্তগত করার উদ্দেশ্যে রমণী করের গ্রেফতার সম্পর্কে কোন ডায়েরী না করে মাঠের মধ্যেই তাঁকে হত্যা করে তার মৃতদেহ গোয়াতলার হাওড়ে নিক্ষেপ করে।[১৪৭] 

৩১শে জানুয়ারী শহীদ রাসিমণি ও সুরেন্দ্রর মৃত্যু দিবস। ১৯৫০ সালে এই দিনটিকে পূর্ববর্তী কয়েক বৎসরের মতো আবার শহীদ দিবস হিসেবে পালনের ব্যবস্থা হলো। প্রথম শহীদ দিবস পালনের পর থেকে আরো অসংখ্য সংগ্রামী পার্টি কমরেড ও সাধারণ গরীব কৃষক ইতিমধ্যে শহীদ হয়েছেন। তাঁদের সকলেরই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে এবার শহীদ দিবস খুব বিরাট আকারে পালন করার কর্মসূচী গৃহীত হলো। এবং তার ফলেই ঘটলো এই অঞ্চলের সংগ্রামী কৃষকদের সর্ববৃহৎ সশস্ত্র সমাবেশ। 

সশস্ত্র বাহিনীর এই সমাবেশের স্থান নির্দিষ্ট হলো চান্দুড়ুই গ্রামের পাহাড় ঘেরা বিরাট উন্মুক্ত মাঠে। সমগ্র অঞ্চলের গেরিলা দলসমূহকে এই সমাবেশে সশস্ত্র অবস্থায় যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হলো। জঙ্গী কৃষক ও জনগণকেও নির্দেশ দান করা হলো যথা সম্ভব সশস্ত্র অবস্থায় সভায় যোগদান করতে। ৩১শে জানুয়ারী, ১৯৫০ তারিখে দশজন করে গঠিত ৩০টি গেরিলা দল সভাস্থলের চারিদিকে রাইফেল, স্টেনগান, কার্তুজ বন্দুক, গাদা বন্দুক, হাত বোমা ইত্যাদি নিয়ে সতর্কভাবে পাহারা দিলেন এবং সেই সতর্ক পাহারার মধ্যে দেড় হাজার কৃষক নিজ নিজ দেশীয় অস্ত্র ও হাতিয়ার নিয়ে অসংখ্য লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে সভায় যোগদান করলেন। দূরে থেকে এই অসংখ্য লাল ঝাণ্ডা দেখে সিপাহীরা দ্রুতগতিতে সভাস্থলের দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই গেরিলারা দূর পাল্লার রাইফেল, বন্দুক ও বোমার আওয়াজ করলেন। এই পরিস্থিতিতে সিপাহীরা আর অগ্রসর হতে সাহস করলো না। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা ধরে চান্দু ভুঁইয়ের মাঠে সমবেত কৃষকরা শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন এবং জমিদারী ও টঙ্ক প্রথার অবসান না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিলেন। সভা শেষ হওয়ার পর সাড়ে তিন শত আগ্নেয়াস্ত্র এক সাথে পরপর তিন তিনবার ফায়ার করা হলো এবং তার সাথে যুক্ত হলো বোমার আওয়াজ। দূর দূরান্ত থেকে যে সমস্ত কৃষক ও গেরিলারা এসেছিলেন তাঁরা সভাশেষে নিজ নিজ গ্রাম ও এলাকায় প্রত্যাবর্তন করলেন। এরপর সভার প্রস্তাবসমূহ বিভিন্ন স্থানে থেকে ডাক মারফৎ সরকারের কাছে পাঠানো হলো। [১৪৮] 

১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বনবিভাগের এক গোপন সূত্রে সংবাদ পেয়ে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর দুইশত সিপাই নালিতাবাড়ীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত রাংটিয়া পাহাড়ের শিখরে অবস্থিত একটি গেরিলা ঘাঁটি আক্রমণ করলো। দশজন গেরিলা এই ঘাঁটিটিকে রক্ষার জন্যে বহুক্ষণ সেই বিরাট সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গেরিলা নায়ক কালিয়া গুরুতরভাবে আহত ও কিশোর যোগেন্দ্র হাজং নিহত হওয়ার পর প্রতিরোধ অসম্ভব হয়ে পড়ায় তাঁরা পিছু হাঁটতে বাধ্য হন এবং সরকারী সৈন্যবাহিনী ঔষধপত্র ও খাদ্য সামগ্রীসহ গেরিলা ঘাঁটিটি দখল করে। ফেব্রুয়ারী মাসেই সুসং এর বগাউড়া পাহাড়ের ওপর থেকে গেরিলারা বোমা নিক্ষেপ করে সিপাহীদের একটি চলন্ত মোটর ট্র্যাক বিধ্বস্ত করেন। এই আক্রমণে আট দশজন সিপাই আহত হয়। সুসং এর উত্তরে অবস্থিত ভবানীপুর পাহাড় থেকে আকস্মিকভাবে রাইফেল ও স্টেনগান চালিয়ে গেরিলারা একদল টহলদারী সিপাইকে আক্রমণ করে তাদের দুইজনকে হত্যা করেন। এইভাবে ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ পর্যন্ত গেরিলারা নিজেদের অবস্থান রক্ষা করে সরকারী সিপাইদের বিরুদ্ধে খণ্ড খণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করেন। [১৪৯] 

এর পর তিনটি কারণে ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাঞ্চলের হাজং অধ্যুষিত এলাকার এই জমিদারী ও টঙ্ক প্রথা বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রথমত, সরকার কর্তৃক জমিদারী ক্রয় আইন পাস ও টঙ্ক প্রথার অবসান; দ্বিতীয়ত, ফেব্রুয়ারী ১৯৫০-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা[১৫০] এবং তৃতীয়ত কমিনফর্মের বক্তব্য অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক সশস্ত্র সংগ্রাম প্রত্যাহার। [১৫১] 

১৯৫০ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী পূর্ব বাঙলা সরকার ঢাকা গেজেটের একটি বিশেষ সংখ্যায় ময়মনসিংহ আংশিক বহির্ভূত এলাকায় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪৯ প্রকাশ করেন। এই আইনের মাধ্যমে টঙ্ক প্রথার উচ্ছেদ করা হয়। ১৯৫০ সালের ১০ই মার্চ এই মর্মে রাজস্বমন্ত্রী পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে নিম্নোক্ত বিবৃতি প্রদান করেন: 

“স্যার, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ সম্পর্কে ভুল ধারণা থেকে উদ্ভূত প্রজাদের একাংশের খাজনাবিরোধী মনোভাব এবং সেই ভুল ধারণা নিরসনের জন্যে সরকারী পদক্ষেপের বিষয় আমি গত বৎসর আমার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলাম। আমি আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে সরকারের সেই সতর্কবাণীর ফলাফল আশানুরূপ হয়েছে এবং যে বৎসর সম্পর্কে আমরা পর্যালোচনা করছি (১৯৪৯-৫০) সে বৎসরে এ বিষয়ে একমাত্র ময়মনসিংহের আংশিক বহির্ভূত এলাকার হাজং হাঙ্গামা ব্যতীত অন্য কোন এলাকা থেকে এ বিষয়ে কোন গণ্ডগোলের সংবাদ আসেনি। স্যার, এই পরিষদের জানা আছে যে, ময়মনসিংহের আংশিক বহির্ভূত এলাকায় কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ প্রধানতঃ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শত্রুদের দ্বারা সৃষ্টি এবং এই দুষ্কৃতির মোকাবেলার জন্যে সরকার কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন সে বিষয়ে আমি পরে পরিষদকে অবগত করছি। [১৫২] 

“স্যার, আমার এই বক্তৃতার গোড়ার দিকে আমি ময়মনসিংহ জেলার আংশিক বহির্ভূত এলাকায় হাজং হাঙ্গামার উল্লেখ করেছিলাম। টঙ্কাদার নামে সাধারণভাবে পরিচিত ফসলে খাজনাদানকারী এই অঞ্চলের প্রজারাই প্রধানতঃ এই হাঙ্গামার সাথে জড়িত ছিলো। এই হাঙ্গামা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলো কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রজাদের বিক্ষোভের কিছু কারণও আছে। ১৮৮৫ সালের বাঙলাদেশ প্রজাস্বত্ব আইনের আওতার মধ্যে ময়মনসিংহ আংশিক বর্হিভূত এলাকা প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪০-এর মাধ্যমে টঙ্কাদারদেরকে প্রজার মর্যাদা দান করা হয়েছিলো এবং সেই আইনের ১১২ ধারা অনুযায়ী বাঙলাদেশ সরকার একটি বিশেষ সংশোধনমূলক জরীপ কার্যের মাধ্যমে টঙ্কাদারদের দেয় ফসলে খাজনা কিছু পরিমাণে হ্রাস করা হয়েছিলো। কিন্তু এই হ্রাস সত্ত্বেও টঙ্কাদারদেরকে গড়ে একর প্রতি বাৎসরিক ৩ মণ ৩৩ সের হারে ধান ফসলে খাজনা হিসেবে দিতে হয় যার মুদ্রামূল্য দাঁড়ায় ঐ এলাকায় প্রচলিত টাকায় খাজনার প্রায় আট গুণ। এটা স্বাভাবিকভাবেই টঙ্কাদারদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে ও তাদের মধ্যে হাঙ্গামার উস্কানী দানের এবং অবাধ্যতার মনোভাব জাগিয়ে রাখার একটা তৈরী ক্ষেত্রে হিসেবে কাজ করে। এজন্যে সরকার টঙ্কাদারদের মধ্যে অসন্তোষের মূল উৎপাদনের প্রয়োজন বোধ করে তাদের ফসলে খাজনাকে ন্যায়ানুগ ও সঙ্গত টাকায় খাজনায় রূপান্তরিত করে সেই ধরনের হাঙ্গামার পুনরাবৃত্তি রোধের স্থায়ী ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। সেই অনুযায়ী ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনের ৯২ ধারার (২) উপধারা যেভাবে গৃহীত হয়েছে তার অধীনে ময়মনসিংহ আংশিক বহির্ভূত এলাকা প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪৯ জারী করা হয়েছে যাতে করে টঙ্কাদারদের দেয় ফসলে খাজনাকে এমনভাবে ন্যায়ানুগ ও সঙ্গত টাকায় খাজনাতে রূপান্তরিত করা যায় যাতে করে তা সংশ্লিষ্ট জমির বাৎসরিক মোট উৎপন্নের এক অষ্টমাংশের বেশী না হয়। এই আইন ১৩ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫০-এর বিশেষ ঢাকা গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে এবং এই আইন অনুযায়ী কাজ যথাশীঘ্র সম্ভব শুরু করা হবে।[১৫৩] 

৭. নাচোল কৃষক বিদ্রোহ 

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর নবাবগঞ্জ, ভোলাহাট, গোমস্তাপুর, শিবগঞ্জ ও নাচোল- মালদহ জেলার এই পাঁচটি থানা রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এগুলিকে নিয়েই গঠিত হয় নবাবগঞ্জ মহকুমা। ১৯৪৭ সালে সারা বাঙলাদেশে তেভাগা আন্দোলন শেষ হওয়ার পর কোন জায়গাতেই সেই আন্দোলন আর পুনর্গঠিত হয়নি। এদিক দিয়ে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো নাচোল। সমগ্ৰ নাচোল থানায় ছিলো বহুসংখ্যক সাঁওতাল কৃষকের বাস। প্রধানতঃ এই সাঁওতাল কৃষকদের মধ্যেই গড়ে উঠেছিলো ১৯৪৮-৫০ সালের নোতুন পর্যায়ে তে- ভাগা আন্দোলন। 

এই আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিলো নাচোল থানার চণ্ডীপুর – সাঁওতাল নেতা মাতলা সরদারের গ্রাম। মাতলা সরদারকে অবলম্বন করেই এই এলাকার কৃষক সংগঠন এবং আন্দোলন গড়ে ওঠে। তাঁর সহায়তায় অন্যান্য কর্মীরা সাঁওতাল কৃষকদের মধ্যে ঘরোয়া বৈঠক ও রাজনৈতিক সভাসমিতি করতেন। মাতলা সরদারও সাঁওতালী ভাষাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দাবী ও বক্তব্যকে জনগণের সামনে খুব স্পষ্ট এবং জোরালো ভাষায় প্রকাশ করতেন। নাচোলের সাঁওতাল কৃষকদের মধ্যেই তিনিই ছিলেন প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য। মাতলা সরদার ছাড়াও নবাবগঞ্জ মহাকুমা ও রাজশাহী জেলার অন্যান্য এলাকার যে কয়েকজন নেতা এই এলাকার কৃষক সংগঠন ও আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাঁরা হলেন রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, অনিমেষ লাহিড়ী, শিবু কোড়ামুদি, বৃন্দাবন সাহা, আজহার আসেন ও চিত্ত চক্রবর্তী। পূর্ব বাঙলার তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এদের সকলকেই আত্মগোপন করে থেকে সাংগঠনিক কাজ চালাতে হতো। কিন্তু তে-ভাগা আন্দোলনের সময় অঞ্চলটিতে কৃষক সমিতির আধিপত্য অতি অল্প সময়েই যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তার ফলে তাঁদের চলাফেরা ও রাজনৈতিক কাজের স্বাধীনতা অনেকখানি প্রসারিত হয়েছিলো। শুধুমাত্র সাঁওতালরাই নয়, হিন্দু মুসলমান সাধারণ কৃষকরাও এই আন্দোলনের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত থাকার ফলেই এই পরিস্থিতির উদ্ভব সম্ভব হতে পেরেছিলো। কৃষক ঐক্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা সমগ্র এলাকাতে কোন ফাটল সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। নাচোলের তে-ভাগা আন্দোলন যেভাবে দ্রুতগতিতে বিকাশ ও প্রসার লাভ করেছিলো এবং কৃষকরা যেভাবে শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতার সাথে সমগ্র অঞ্চলকে আলোড়িত করেছিলেন তার দ্বারা কৃষকের বিপ্লবী শক্তির একটা নির্ভুল পরিচয় পাওয়া যায়। হাজার হাজার কৃষক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজে যোগদান করেন। তীর, ধনুক, দা, বল্লম, সড়কি ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে তারা গ্রামে গ্রামে টহল দিয়ে বেড়ান, বিভিন্ন এলাকার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন, শান্তি যাতে অনর্থক বিঘ্নিত না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল চণ্ডীপুরে ভলান্টিয়ারদের প্রধান ক্যাম্পে প্রতিদিন তখন চার পাঁচ শত ভলান্টিয়ার দুই বেলা আহার করতেন। এই ব্যয়বহুল ক্যাম্প চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও প্রধানতঃ বহন করতেন কৃষক ভলান্টিয়াররাই। আন্দোলন ও সংগঠনের এই অবস্থার জন্যে সমগ্র এলাকাটিতেই বেসরকারীভাবে তেভাগার রাজত্ব কায়েম হয়ে গেলো। নাচোলের এই অঞ্চলটিতে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের কর্তৃত্ব বাস্তবতঃ অসম্ভব শিথিল হয়ে এলো। জোতদাররা তে-ভাগার বিরুদ্ধে কোন কথা বলা অথবা আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন বাধা সৃষ্টি করার সব রকম ক্ষমতাই হারিয়ে ফেললো।[১৫৪] 

এই অবস্থায় ১৯৫০ সালের জানুয়ারীর প্রথম দিকে কৃষক সমিতির নেতারা আমন ধান কাটার উদ্দেশ্যে সকলকে বিভিন্ন এলাকায় সমবেত হওয়ার জন্যে আহ্বান জানান। এই আহ্বান অনুযায়ী স্থানীয় কৃষকরা ৫ই জানুয়ারী দলে দলে সমবেত এবং ঐক্যবদ্ধভাবে ফসল তুলতে উদ্যোগী হন। [১৫৫] 

স্থানীয় জোতদাররা এই উদ্যোগে আতঙ্কিত হয়ে থানায় খবর পাঠানোর পর নাচোল থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা তফিজউদ্দীন তিনজন কনস্টেবলসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।[১৫৬] সমবেত সাঁওতাল কৃষক জনতা পুলিশের এই উপস্থিতিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে কিন্তু তৎক্ষণাৎ তাদেরকে সরাসরি আক্রমণ না করে কৃষকরা পিছু হটে তাদেরকে নিজেদের এলাকার মধ্যে আরও কিছুটা প্রবেশ করার সুযোগ দেন। এইভাবে সাঁওতাল কৃষক এলাকায় অনেকখানি ভিতরে প্রবেশ করার পর কৃষকরা পুলিশ দলটিকে চারিদিক থেকে ঘেরাও করে তাদের মোকাবেলার জন্যে অগ্রসর হন। পুলিশরা কৃষকদেরকে বাধাদানের চেষ্টা করলে উত্তেজনা ক্রমশঃ তীব্র আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত এই উত্তেজনা এত বেড়ে ওঠে যে কারো পক্ষেই জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না এবং পুলিশ তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে একজন সাঁওতালকে হত্যা করে।[১৫৭] এরপর কৃষকরা এএসআইসহ অন্য তিনজন কনস্টেবলকে বন্দী করে তাদের রাইফেল কেড়ে নেন এবং তাদেরকে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে ফেলেন।[১৫৮] 

থানার দারোগা এবং কনস্টেবলদের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর পেয়ে রাজশাহী জেলা শাসক এবং পুলিশ সুপার একদল সশস্ত্র সৈন্য ও পুলিশসহ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং স্থানীয় সাঁওতাল ও কৃষকদের উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে। মৃত চারজন পুলিশের লাশ তারা স্থানীয় কিছু লোকের সহায়তায় মাটি খুঁড়ে বের করে এবং রাজশাহী সদরে পাঠিয়ে দেয়।[১৫৯] নাচোল থেকে আট মাইল দূরে আমনূরা রেল স্টেশনে নামার পর থেকেই সৈন্য ও পুলিশ বাহিনী নাচোল পর্যন্ত সমস্ত গ্রামের ওপরই নির্মম-নির্যাতন চালিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু পুলিশদের লাশ রাজশাহীতে চালান দেওয়ার পরই শুরু হয় তাদের আসল অত্যাচার। গ্রামের পর গ্রাম নির্বিচারে জ্বালিয়ে দিয়ে, নির্মমভাবে কৃষকদেরকে মারপিট করে, সাঁওতাল নারীদেরকে যথেচ্ছভাবে ধর্ষণ করে, লুণ্ঠনকে অবাধ করে, তারা সমগ্র এলাকাটিতে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। পুলিশ হত্যার “উপযুক্ত” প্রতিশোধ নিতে তাঁরা মরীয়া হয়ে ওঠে। [১৬০] 

৫ই জানুয়ারীর এই ঘটনার সময় নেতাদের সকলে একই জায়গায় ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যারা নাচোলে তখন উপস্থিত ছিলেন তার মধ্যে ইলা মিত্র অন্যতম। রমেন মিত্র ছিলেন অন্যত্র। তিনি মাতলা সরদারসহ কয়েকশো জঙ্গী সাঁওতাল কৃষককে সাথে নিয়ে দ্রুত গতিতে সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় এলাকায় নিরাপদ হলেন। [১৬১] আজহার হোসেন এবং অনিমেষ লাহিড়ী কয়েকদিন পর আজহার হোসেনের বাড়ীতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।[১৬২] বদরপুর গ্রামে সাঁওতালদের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় চিত্ত চক্রবর্তীকে পুলিশ ৮ই জানুয়ারী গভীর রাত্রিতে গ্রেফতার করে।[১৬৩] ঐ একই দিন পুলিশের অত্যাচারে নাচোল এবং নবাবগঞ্জ পরিত্যাগ করে ট্রেনযোগে পলায়নের সময় একদল সাঁওতাল কৃষক রাজশাহীর কাছাকাছি গ্রেফতার হন।[১৬৪] 

কয়েকজন বিশিষ্ট নেতৃস্থানীয় কর্মীসহ তিন চারশো জঙ্গী সাঁওতাল কৃষকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ইলা মিত্র সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় এলাকার দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু পথ সম্পর্কে তার নিজের অথবা তার সঙ্গীদের কারও নির্দিষ্ট কোন ধারণা ছিলো না। এজন্যে তাঁরা সদলবলে রোহনপুর রেলস্টেশনের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানেই সৈন্যবাহিনীর এক বিরাট অস্থায়ী আস্তানা করা হয়েছিলো সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে। দলটিকে সহজেই চিনতে পেরে সৈন্যবাহিনী তাঁদের সকলকেই গ্রেফতার করলো। ইলা মিত্র নিজে সাঁওতাল রমণীর বেশে সজ্জিতা ছিলেন। কিন্তু তাকেও শনাক্ত করতে তাঁদের কোন অসুবিধা হলো না। [১৬৫] 

এইভাবে ইলা মিত্রকে সদলবলে গ্রেফতার করার পর তাঁদেরকে নাচোল থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশ তাঁদের ওপর কি নির্যাতন করেছিলো। ইলা মিত্র নিম্নোক্ত ভাষায় তার বর্ণনা দান করেন: 

“ওরা প্রথম থেকেই নির্দয়ভাবে মারতে শুরু করলো। শুধু আমাকে নয়, আমাদের সবাইকেই। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে এলো নাচোলে। আমি মারপিটের ফলে অবসন্ন হয়ে পড়েছিলাম, আমার সর্বাঙ্গে বেদনা। ওরা আমাকে একটা ঘরের বারান্দায় বসিয়ে রাখল। আমাদের সঙ্গে যে সকল সাঁওতাল কর্মীরা ছিল, আমার চোখের সামনে তাঁদের সবাইকে জড়ো করে তাঁদের উপর বর্বরের মত মারপিট করে চলল। আমি যাতে নিজের চোখে এই দৃশ্য দেখতে পাই, সেজন্যই আমাকে তাঁদের সামনে বসিয়ে রাখা হয়েছিলো। 

ওরা তাঁদের মারতে মারতে একটা কথাই বারবার বলছিলো, আমরা তোদের মুখ থেকে এই একটা কথাই শুনতে চাই, বল, ইলা মিত্র নিজেই পুলিশদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলো। এই কথাটুকু বললেই তোদের ছেড়ে দেবো। কিন্তু যতক্ষণ না বলবি, এই মার চলতেই থাকবে। মারতে মারতে মেরে ফেলবো, তার আগে আমরা থামবো না। কথাটা তারা যে শুধু ভয় দেখাবার জন্য বলছিলো, তা নয়, তারা মুখে যা বলছিলো, কাজেও করছিলো। ও সে কি দৃশ্য। আর সেই দৃশ্য আমাকে চোখ থেকে দেখতে হচ্ছিলো। একি শাস্তি। কিন্তু কি আশ্চর্য, সেই হিংস্র পশুর দল আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে। রক্তে ওদের গা ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু কারু মুখে কোন শব্দ নাই, একটু কাতরোক্তি পর্যন্ত না। ওরা নিঃশব্দ হয়েছিলো, কিন্তু দেখতে দেখতে কেঁদে ফেললাম আমি। এই দৃশ্য আমি আর সইতে পারছিলাম না। মনে মনে কামনা করছিলাম, আমি যেন অজ্ঞান হয়ে যাই। কিন্তু তা হলো না, আমাকে সজ্ঞান অবস্থাতেই সব কিছু দেখতে হচ্ছিলো, কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না, এত দুঃখের মধ্যেও আমাদের এই বীর কমরেডদের জন্য গর্বে ও গৌরবে আমার বুক ভরে উঠেছিলো। একজন নয়, দুজন নয়, প্রতিটি মানুষ মুখ বুজে নিঃশব্দ হয়ে আছে। এত মার মেরেও ওরা তাঁদের মুখ খোলাতে পারছে না। এমন কি করে হয়! এমন যে হতে পারতো এতো আমি কল্পনাও করতে পারিনি। … 

প্রচণ্ড তর্জন গর্জনের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম, চেয়ে দেখি, হয়েককে দলের মধ্যে থেকে মারতে মারতে বার করে নিয়ে আসছে। ওদের মুখে সেই একই প্রশ্ন, বল, ইলা মিত্র সেই পুলিশদের হত্যা করবার আদেশ দিয়েছিলো। না বললে মেরে ফেলবো, একদম মেরে ফেলব। আমি চেয়ে আছি হয়েকের মুখের দিকে। অদ্ভুত ভাববিকারহীন একখানি মুখ অর্থহীন দৃষ্টিতে শূন্যপানে তাকিয়ে আছে। ওদের এত সব কথা যেন তার কানেই যাচ্ছে না। ক্ষেপে উঠলো ওরা। কয়েক জন মিলে তাকে মাটিতে পেড়ে ফেললো। তারপর ওরা তাদের মিলিটারী বুট দিয়ে তার পেটে বুকে সজোরে লাথি মেরে চললো। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, হয়েকের মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার পর তার উপর ওরা আরও কতক্ষণ দাপাদাপি করলো। একটু বাদেই এক খণ্ড কাঠের মত স্থির হয়ে পড়ে রইলো হয়েক। ওদের মধ্যে একজন তাকে নেড়ে চেড়ে দেখে বললো, ছেড়ে দাও ওর হয়ে গেছে। এই বলে ওরা আর একজনকে নিয়ে পড়লো ।[১৬৬] 

খাদ্য এবং পানীয় ছাড়াই বন্দীদেরকে নাচোল থানা হাজতে আটকে রেখে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। বন্দীদের হাত পা বেঁধে রেখে পুলিশ কনস্টেবলরা প্রায় সারাক্ষণই স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যে তাঁদেরকে নির্মমভাবে মারপিট করতে থাকে। ক্ষুধা তৃষ্ণা এবং অমানুষিক প্রহারের ফলে ২৪ জন সাঁওতাল নাচোল থানা হাজতেই মৃত্যু মুখে পতিত হন।[১৬৭] নবাবগঞ্জে যখন তাঁদেরকে স্থানান্তরিত করা হয় তখনও তাঁদের ওপর অত্যাচার সমানে চলতে থাকে এবং সেখানেও বহুসংখ্যক সাঁওতাল মারা যান।[১৬৮] এর পর সাঁওতাল রাজবন্দীদের পুরোদলটিকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে অত্যাচার তাঁদের ওপর অব্যাহত থাকে। রাজশাহী জেলে একটি ছোট ঘরের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় রেখে, আধপেট খাইয়ে এবং ক্রমাগত অত্যাচার করে অনেককে তারা হত্যা করে। কিন্তু সাঁওতাল রাজবন্দীদেরকে মারপিট করে তাঁদের হাড় গুঁড়ো করে দিলেও তাঁদের মধ্যে একজনের থেকেও পুলিশ কোন স্বীকারোক্তি আদায় করতে সক্ষম হয় না।[১৬৯] এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে সাঁওতাল কমরেডদের এই অতীব বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা যে কতখানি গৌরবের বিষয় সে কথা বলাই বাহুল্য। 

নাচোল থেকে রাজশাহী জেলের অভ্যন্তর পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ইলা মিত্র এবং এই সাঁওতালেরা যে শুধু পুলিশের দ্বারা নির্যাতিত নিগৃহীত হয়েছেন তাই নয়, স্থানীয় জনসাধারণ এবং জেলের অন্যান্য সাধারণ কয়েদীরা পর্যন্ত তাঁদের প্রতি অত্যন্ত নির্দয় ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানবিরোধী, হিন্দুস্থানের বাহিনী এবং শত্রুপক্ষের লোক এই সরকারী প্রচারণার দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত এবং মুসলিম লীগের লোকজনদের দ্বারা উত্তেজিত হয়ে এই মৃত্যু পথযাত্রী দেশপ্রেমিক সাঁওতালদেরকে তারা খাওয়ার পানি পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে স্পর্শ করতে দেয়নি।[১৭০] নবাবগঞ্জ থেকে ইলা মিত্র এবং অন্যান্য রাজবন্দীদেরকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলো। এই সময় থেকে শুরু করে এগারো মাস ইলা মিত্রকে একটি নির্জন সেলে একাকী বন্দী রাখা হয়েছিলো। ইলা মিত্রসহ সমস্ত সাঁওতাল রাজবন্দীদের সপক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন কুমিল্লার উকিল ও রাজনৈতিক নেতা কামিনী দত্ত। মামলার দিন এগিয়ে আসছিলো কিন্তু আদালতের সামনে জবানবন্দী দিতে গিয়ে ঠিক কি বলবেন সে বিষয়ে ইলা মিত্র কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না। এই সময় অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি রাজশাহী জেলেরই জানান ফটকে আটক বরিশালের মনোরমা বসু, খুলনার ভানু দেবী প্রভৃতির কাছ থেকে গোপন পথে একটি যুক্ত চিঠি পেলেন যার মর্মার্থ হলো: 

‘পাকিস্তান সরকারের চরিত্র উদ্ঘাটন করে দেবার পক্ষে এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ। আপনি এই সুযোগ কিছুতেই নষ্ট করবেন না। আদালতে আপনার জবানবন্দী দেবার সময় আপনার ওপর যত কিছু অত্যাচার হয়েছে, আপনি তার সব কথা পরিষ্কারভাবে খুলে বলবেন। মেয়েদের সংস্কার এবং লজ্জা যেন আপনাকে সেই সত্য কথাগুলি স্পষ্ট ভাষায় বলতে কোন রকম বাধা না দিতে পারে। 

রোহনপুর স্টেশনে ইলা মিত্রকে গ্রেফতারের পর তাকে নাচোল থানা হাজতে নিয়ে গিয়ে তার ওপর ইসলামী রাষ্ট্রের নূরুল আমীন-লিয়াকত আলী সরকারের পুলিশ যে চরম নির্যাতন করে সেই নির্যাতনের চিত্র রাজশাহী আদালতের সামনে নিজের জবানবন্দীতে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে উপরোক্ত পত্রটি খুবই সহায়ক হয়। [১৭১] নীচে ইলা মিত্রের সেই জবানবন্দীটি হুবহু তুলে দেওয়া হলো: 

“কেসটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বিগত ৭/১/৫০ তারিখে আমি রোহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোল নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধোর করে এবং তারপর আমাকে একটা সেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সবকিছু স্বীকার না করলে আমাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হবে এই বলে এসআই আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলার মতো কিছু ছিলো না, কাজেই তাঁরা আমার সমস্ত কাপড় চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দী করে রাখে। 

আমাকে কোন খাবার দেওয়া হয়নি, একবিন্দু জল পর্যন্ত না। সেদিন সন্ধ্যেবেলাতে এসআই- এর উপস্থিতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময়ে আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এরপর আমার কাপড় চোপড় আমাকে ফেরত দেওয়া হয় এবং রাত্রি প্রায় বারোটার সময় সেল থেকে আমাকে বের করে সম্ভবতঃ এসআই-এর কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে এ ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম না। যে কামরাটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যে তারা নানারকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালালো। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছিলো এবং সে সময় চারিধারে যারা দাঁড়িয়েছিলো তারা বলছিলো যে আমাকে “পাকিস্তানী ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। এই নির্যাতন চলার সময় তারা একটা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিয়েছিলো। জোর করে আমাকে কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুলও উপড়ে তুলে ফেলছিলো। সিপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব ছিলো না। সেলের মধ্যে আবার এসআই সেপাইদেরকে চারটে গরম সিদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিলো এবং বললো, “এবার সে কথা বলবে।” তারপর চার পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চীৎ করে শুইয়ে রাখলো এবং একজন আমার যৌন অঙ্গের মধ্যে একটা গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিলো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। 

৯/০১/৫০ তারিখে সকালে যখন আমার জ্ঞান হলো তখন উপরোক্ত এসআই এবং কয়েকজন সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুট দিয়ে আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করলো। এর পর আমার ডান পায়ের গোড়ালীতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া হলো। সে সময় আধা সচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এসআইকে বিড় বিড় করে বলতে শুনলাম: আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করো তাহলে সিপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে এসআই এবং সিপাইরা ফিরে এলো এবং তারা আবার সেই হুমকি দিলো। কিন্তু আমি যেহেতু তখনো কিছু বলতে রাজী হলাম না তখন তিন চার জন আমাকে ধরে রাখলো এবং একজন সেপাই সত্যি সত্যি আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করলো। এর অল্পক্ষণ পরই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। 

পরদিন ১০/১/৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন আমি দেখলাম যে আমার দেহ থেকে দারুণভাবে রক্ত ঝরছে এবং আমার কাপড় চোপড় রক্তে সম্পূর্ণভাবে ভিজে গেছে। সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হলো। নবাবগঞ্জ জেল গেটের সিপাইরা জোের ঘুষি মেরে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো। সে সময় আমি একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলাম কাজেই কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন সিপাই আমাকে একটা সেলের মধ্যে বহন করে নিয়ে গেলো। তখনো আমার রক্তপাত হচ্ছিলো এবং খুব বেশী জ্বর ছিলো। সম্ভবতঃ নবাবগঞ্জ সরকারী হাসপাতালের একজন ডাক্তার সেই সময় আমার জ্বর দেখেছিলেন ১০৫ ডিগ্রী। যখন তিনি আমার কাছে আমার দারুণ রক্তপাতের কথা শুনলেন তখন তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে, একজন মহিলা নার্সের সাহায্যে আমার চিকিৎসা করা হবে। আমাকে কিছু ওষুধ এবং দুই টুকরো কম্বলও দেওয়া হলো। 

১১-১-৫০ তারিখে সরকারী হাসপাতালের নার্স আমাকে পরীক্ষা করলেন। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে কি রিপোর্ট দিয়েছেন সেটা আমি জানি না। তিনি আসার পর আমার পরনে যে রক্তমাখা কাপড় ছিলো সেটা পরিবর্তন করে একটা পরিষ্কার কাপড় দেওয়া হলো। এই পুরো সময়টা আমি নবাবগঞ্জ জেলের একটি সেলে একজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শরীরে খুব বেশি জ্বর ছিলো, তখনো আমার দারুণ রক্তপাত হচ্ছিলো এবং মাঝে মাঝে আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। 

১৬-১-৫০ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় আমার সেলে একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসা হলো এবং আমাকে বলা হলো যে পরীক্ষার জন্যে আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। খুব বেশী শরীর খারাপ থাকার জন্যে আমার পক্ষে নড়াচড়া সম্ভব নয় একথা বলায় লাঠি দিয়ে আমাকে একটা বাড়ি মারা হলো এবং স্ট্রেচারে উঠতে আমি বাধ্য হলাম। এর পর আমাকে অন্য এক বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি সেখানে কিছুই বলিনি কিন্তু সেপাইরা জোর করে একটা সাদা কাগজে আমার সই আদায় করলো। তখন আমি আধা-অচেতন অবস্থায় খুব বেশী জ্বরের মধ্যে ছিলাম। যেহেতু আমার অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিলো সেজন্যে পরদিন আমাকে নবাবগঞ্জ সরকারী হাসপাতালে পাঠানো হলো। এর পর যখন আমার শরীরের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হলো তখন আমাকে ২১/২/৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে সেখানকার জেল হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলো। 

কোন অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলিনি এবং উপরে যা বলেছি তার বেশী আমার আর বলার কিছুই নেই।[১৭২] 

ইলা মিত্র রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলী হওয়ার পরই খুলনার এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই বাঙলাতেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে[১৭৩] এবং রাজশাহী জেলের মধ্যে তার প্রভাব বিস্তৃত হয়। এর ওপর আর এক উপসর্গ জোটার ফলে জেলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অনেকখানি বেশি অবনতি ঘটে। 

নাচোলে সাঁওতাল কৃষকদের সাথে সংঘর্ষে যে দারোগাটি নিহত হয় তার স্ত্রী এই সময় প্রত্যেক দিন রাজশাহী জেল গেটে এসে বহুক্ষণ ধরে নিয়মিত বসে থাকতো এবং হিন্দু ও সাঁওতালদেরকে গালাগালি করে নাচোলের ঘটনা সম্পর্কে জেলের সেপাই এবং বিশেষ করে কয়েদী ও অন্যান্য কর্মচারীদের একথাই বোঝাতে চাইতো যে, হিন্দুরা একজোট হয়ে মুসলমান হত্যা করেছে। কাজেই তার প্রতিশোধ নেওয়া দরকার। এই সাম্প্রদায়িক প্রচারণা এবং উত্তেজনা বৃদ্ধির ব্যাপারে মান্নান নামে রাজশাহীর তৎকালীন জেলার সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করতো এবং নিহত দারোগার স্ত্রীটিকেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ দিতো।[১৭৪] 

ইলা মিত্রকেও এই সময় মাঝে মাঝে জেল গেটে নিয়ে গিয়ে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় হাজির করা হতো এবং সাধারণ কয়েদীদেরকে দেখিয়ে তাঁরা বলতো, “তোমরা রাণীকে দেখো। ইনি আবার রাণী হয়েছিলেন।”[১৭৫] 

এই সমস্ত কারণ মিলে জেলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটে যে হিন্দু নামধারী রাজবন্দীরা তখন নিজেদের ওয়ার্ডের বাইরে বের হতে পারতেন না। ঘরের সামনে সামান্য একটু বেড়ানোর যে সুযোগ ছিলো সেটাও তাঁদের জন্যে এইভাবে বন্ধ হয়ে গেলো। [১৭৬] 

এই অসহ্য অবস্থা পরিবর্তনের জন্যে রাজবন্দীরা তখন ১৫ দিনের নোটিশ দিয়ে পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের কাছে একটা মেমোরেন্ডাম দেন। তাতে বলা হয় যে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যদি বন্ধ করা না হয় তাহলে তাঁরা সেই অবস্থার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে অনশন ধর্মঘট করতে বাধ্য হবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নূরুল আমীনের কাছে থেকে কোন জবাব না পেয়ে ১৯৫০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের রাজবন্দীরা আবার অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সেই ধর্মঘট চলার নবম দিনে অর্থাৎ ১০ই ফেব্রুয়ারী রাজশাহীর জেলা শাসক রাজবন্দীদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁদেরকে বলেন, “আপনারা নিশ্চিন্ত হোন। আমরা অবস্থা পরিবর্তনের ব্যবস্থা করছি।” এর পর তাঁরা পূর্বোক্ত নিহত দারোগার স্ত্রীর জেল গেটে আসা বন্ধ করে দিলো এবং সেই সাথে জেলার মান্নানও তার বিকৃত সাম্প্রদায়িক বক্তব্য জাহির করা থেকে বিরত হলো।[১৭৭] 

নাচোলের ঘটনাবলীর এবং তার পরবর্তী নির্যাতনের কাহিনী তৎকালীন কোন সংবাদপত্রে তো প্রকাশিত হয়ইনি, এমনকি প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন সে সম্পর্কে কোন আলোচনা প্রাদেশিক বিধান পরিষদে পর্যন্ত হতে দেননি। 

প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, গোবিন্দলাল ব্যানার্জী এবং মনোহর ঢালী এ ব্যাপারে কতকগুলি মুলতুবী প্রস্তাবের নোটিশ স্পীকারকে দিয়েছিলেন। ৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৫০ বিধান পরিষদে তাঁরা এই মুলতুবী প্রস্তাবের নোটিশের সম্পর্কে স্পীকারকে প্রশ্ন করেন। স্পীকার এই মুলতুবী প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে দেওয়ার ব্যাপারে খুব বেশী গররাজী ছিলেন না কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন প্রবলভাবে সেটা উত্থাপনের বিরোধিতা করায় তিনি শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যান। [১৭৮] 

নূরুল আমীন তাঁর বিরোধিতার স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন যে, একজন ভারপ্রাপ্ত অফিসার এবং তিনজন কনস্টেবলের মৃত্যু সম্পর্কিত ব্যাপারটি আদালতের বিচারাধীন, কাজেই সে বিষয়ে কোন আলোচনা পরিষদে হতে পারে না। [১৭৯] 

এর জবাবে প্রভাস লাহিড়ী বলেন যে, তিনি পুলিশ অফিসারের হত্যার ব্যাপারে আলোচনা করতে চান না। তিনি আলোচনা করতে চান ঘটনার পরবর্তী পর্যায়ে ঐ এলাকায় পুলিশ ও মিলিটারীর নির্যাতনের ব্যাপারে। [১৮০] নূরুল আমীন কিন্তু তাঁর পূর্বোক্ত যুক্তি আঁকড়ে থেকে বলেন যে, মূল ঘটনাকে বাদ দিয়ে পরবর্তী ঘটনার আলোচনা সম্ভব নয়, কাজেই মূল ঘটনার প্রসঙ্গ আলোচনার মধ্যে এসেই পড়বে। কাজেই সে ধরনের কোন বিতর্ক সেই অবস্থায় পরিষদে সম্ভব নয়। [১৮১] 

বিরোধী দলের নেতা বসন্তকুমার দাস নূরুল আমীনের এই যুক্তির বিরোধিতা করে বলেন যে, হত্যার পর পুলিশ, মিলিটারী, ইপিআর এবং আনসারেরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে। তাদের অভিযোগ হলো এই যে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নামে তারা জনসাধারণের ওপর দারুণভাবে অত্যাচার করেছে। এটা মূল ঘটনা থেকে একটি পৃথক ব্যাপার এবং সেই হিসেবেই তারা সেটিকে আলোচনা করতে চান। [১৮২] 

এর পর পরিষদে স্পীকার, শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদ এবং অন্যান্যেরা নূরুল আমীনের সুরে সুর মিলিয়ে ক্রমাগতভাবে মুলতুবী প্রস্তাবগুলি আলোচনার বিপক্ষে নানারকম কুযুক্তি দিতে থাকেন এবং মূল ঘটনাকে বাদ দিয়ে কোন আলোচনা এ ব্যাপারে সম্ভব নয় এই যুক্তিকেই খুঁটি হিসেবে আঁকড়ে ধরেন। [১৮৩] 

আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে পরিষদ সদস্যেরা বিভাগপূর্ব ভারতীয় এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক বিধান পরিষদে এ ধরনের ঘটনা আলোচনার পূর্ব উদাহরণ উল্লেখ করেন কিন্তু সেগুলির কোনটিই নাচোলের ঘটনার সাথে তুলনীয় নয় বলে নূরুল আমীন এবং স্পীকার সুস্পষ্ট রায় দেন। [১৮৪] 

এক পর্যায়ে মনোরঞ্জন ধর প্রশ্ন তোলেন যে, পুলিশ অফিসার এবং কনস্টেবলদের মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনাটির ওপর পুলিশী তদন্ত এবং কোর্টের সামনে বিচার এক জিনিস নয়। ব্যাপারটি যে সত্যি সত্যিই কোর্টের বিচারাধীন— এর উপযুক্ত প্রমাণ দাখিলের জন্যে তিনি প্রধান মন্ত্রী নুরুল আমীনকে আহ্বান জানান। কিন্তু অনুগত স্পীকার নূরুল আমীনকে সে রকম কোন বিপদের মধ্যে না ফেলে সরাসরি বলেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে কোন প্রমাণ দাখিল করার কথা বলতে পারেন না। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে নূরুল আমীনের বক্তব্যই তাকে মানতে হবে।[১৮৫] এইভাবে কিছুক্ষণ বিতর্ক চলার পর অবশেষে স্পীকার রায় দেন যে, নাচোলের ঘটনা ও পুলিশী নির্যাতনের ব্যাপারে তিনি কোন মুলতুবী প্রস্তাব উত্থাপন করতে ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হতে দেবেন না।[১৮৬] 

এইভাবেই সংবাদপত্র, এমনকি প্রাদেশিক বিধান পরিষদেরও টুটি টিপে নূরুল আমীন সরকার নাচোলের অসংখ্য সাঁওতাল কৃষকের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, সমগ্র এলাকায় লুটতরাজ, ধর্ষণ, গৃহদাহ এবং নানা ধরনের নির্মম নির্যাতনের ঘটনাবলীকে জনসাধারণের থেকে লুকিয়ে রেখে নিজেদের “ভদ্র” চেহারাকে দেশের সামনে টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় কোন ত্রুটি রাখলো না। 

৮. অন্যান্য অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন 

১৯৪৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ও কিষাণ সভা কর্তৃক তে-ভাগা আন্দোলন প্রত্যাহার এবং দেশবিভাগের পর সিলেট, ময়মনসিংহ ও নাচোলের মত ব্যাপক ও সংগঠিত সশস্ত্র সংগ্রাম পূর্ব বাঙলার অন্য কোন অঞ্চলে সম্ভব হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি সারা পূর্ব বাঙলায় সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের যে কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলো তা বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি এলাকায় স্থানীয় জমিদার-জোতদারদের দালাল ও পুলিশের সাথে ছোটখাটো সংঘর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু সেই সব সংঘর্ষ কোন ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে কৃষকদেরকে আন্দোলনে শরীক করতে সমর্থ হয়নি। নোতুন রণনীতির দ্বারা কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হননি। 

উপরোক্ত তিনটি অঞ্চলের বাইরে খুলনা জেলার কয়েকটি এলাকাতে কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রাম অন্য জেলাগুলির বিভিন্ন এলাকার তুলনায় কিছুটা সংগঠিত ও ব্যাপক হয়েছিলো। ১৯৪৮-৫০ সালে খুলনার যে এলাকাগুলিতে এই আন্দোলন হয়েছিলো সেগুলি হলো : শোভনা, ধানিবুনিয়া, কালশিরা, মৌভাগ, ঘাটভোগ, ডোবা, চিতলমারী ও মোল্লা হাট।[১৮৭] এই এলাকাগুলির মধ্যে শোভনা, ধানিবুনিয়া, কালশিরা এলাকায় আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নিয়েছিলো।[১৮৮] 

এই আন্দোলনের মূল রাজনৈতিক ধ্বনি ছিলো ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’, রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। মূল অর্থনৈতিক সমস্যা ছিলো বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ, খাজনা হ্রাস, জোতদারী ও মহাজনী শোষণ অত্যাচার বন্ধ করা, খাস জমি কৃষকদের ফেরৎ দেওয়া, উল্টো তে-ভাগা[১৮৯] বন্ধ, অকৃষকদের হাত থেকে জমি কেড়ে নিয়ে খোদ কৃষকদের ভিতর সেই জমি বণ্টন করা। ‘লাঙল যার জমি তার’ – এই ধ্বনির মাধ্যমে কৃষকদেরকে সমবেত ও ঐক্যবদ্ধ করে জমি দখলের মাধ্যমে সংগ্রামকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলই এই সময়কার আন্দোলনের গৃহীত লাইন। [১৯০] 

কিন্তু আন্দোলনের নীতি, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য তা হলেও এই আন্দোলনের নেতৃত্ব মূলতঃ ছিলো মধ্যবিত্ত ও ধনী কৃষকদের হাতে। ব্যাপকভাবে ক্ষেতমজুর অথবা গরীব কৃষকরা এই আন্দোলনে সমবেত অথবা ঐক্যবদ্ধ হননি[১৯১]। শোভনা, ধানিবুনিয়া অঞ্চলে অবশ্য আন্দোলন খুব সাময়িকভাবে অপেক্ষাকৃত ব্যাপক আকার ধারণ করেছিলো এবং জোতদার জমিদার ও তাঁদের দালালরা ব্যতীত সাধারণভাবে তা জনগণের সমর্থন লাভ করেছিলো।[১৯২] 

তখনকার দিনে অকমিউনিস্ট কোন ব্যক্তি কৃষক সমিতির কাজে এগিয়ে আসতেন না। সেজন্যে বাস্তবক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির মধ্যে কোন তফাৎ লোকে করতো না এবং প্রকৃতপক্ষে সে রকম কোন তফাৎ ছিলোও না। কৃষক আন্দোলন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীদের দ্বারাই পরিচালিত হতো।[১৯৩]

প্রয়োজনীয় অর্থ মূলতঃ কৃষক দরদীদের থেকেই সংগৃহীত হতো। অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ ছিলো কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব। [১৯৪] 

আন্দোলনের এলাকাগুলিতে সরকার পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করে এবং শোভনা, ধানিবুনিয়া ও কালশিরা এলাকায় ব্যাপকভাবে গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, তল্লাশী, মারপিট ও নারী ধর্ষণ চালায়। এ ব্যাপারে স্থানীয় কিছু দালালও গোয়েন্দাগিরি ইত্যাদির দ্বারা পুলিশের সাথে সহযোগিতা করে। এই ধরনের দালালদেরকে অনেক জায়গায় খতম করা হয় এবং দালাল খতমের পর এলাকাগুলিতে পুলিশী নির্যাতন আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে।[১৯৫] রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো খুলনা জেলেও কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে রাজবন্দীদের ওপর হামলা চালায় এবং লাঠি চার্জের দ্বারা বিষ্ণু বৈরাগীকে হত্যা করে। [১৯৬] 

পুলিশের সাথে কৃষক কর্মীদের সরাসরি সংঘর্ষের ফলে শোভনায় হাজারী বালা এবং ধানিবুনিয়ায় সতীশ বাইন ও রমাকান্ত নিহত হন। [১৯৭] 

১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ডুমুরিয়া থানায় পুলিশ ও জনতার মধ্যে যে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয় খুলনা জেলার মধ্যে সেটা ছিলো বৃহত্তম। [১৯৮] ঘটনাটির সরকারী প্রদত্ত ও সংবাদপত্রের প্রকাশিত বিবরণ হলো নিম্নরূপ: 

সরকারী মহল হইতে প্রাপ্ত এক সংবাদে জানা গিয়াছে যে, গত ২৪শে এপ্রিল তারিখে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত কোনও এক স্থানে জনতা ও পুলিশের মধ্যে এক সংঘর্ষের ফলে পুলিশ গুলি চালাইতে বাধ্য হয়। ইহাতে জনতার মধ্য হইতে ৩ ব্যক্তি নিহত হইয়াছে এবং ৩ জন পুলিশ কর্মচারীসহ প্রায় দশ জন আহত হইয়াছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, গত ২৪শে এপ্রিল তারিখে পুলিশ ধানিবুনিয়া গ্রামে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করিয়া বেতবুনিয়া গ্রামে আরও দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করিবার সময় যখন সেদিকে যাইতেছিলো তখন প্রায় ৫-৬ শত লোক তাহাদিগকে বাধা দেয়। জনতার মধ্যে প্রায় ১০-১২টি বন্দুক ছিল বলিয়া প্রকাশ। তাহারা ধৃত ব্যক্তিদিগকে ছিনাইয়া লয়। এইভাবে সশস্ত্র জনতার নিকট বাধাপ্রাপ্ত হইয়া পুলিশ বল প্রয়োগ করিতে বাধ্য হয়, তথায় বহু রাউন্ড গুলি চলে। তিনজন আহত পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। তাহাদের দুইজনের অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক। ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা থানায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হইয়াছে। [১৯৯] 

২০শে ডিসেম্বর, ১৯৪৯ বাগেরহাট মহকুমার কালশিরা গ্রামে পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর তিনজন কনস্টেবলসহ জয়দেব ব্রহ্ম নামে একজন কমিউনিস্ট কর্মীর গৃহ তল্লাশী করতে গেলে তারা জনতার দ্বারা আক্রান্ত হয়। কনস্টেবলদের মধ্যে একজন ছিলো সশস্ত্র। সে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং অন্যান্য পুলিশেরাও আহত হয়। আনসার ও স্থানীয় কিছু লোকজনের সহায়তায় তারা প্রাণে রক্ষা পায় এবং পলায়ন করে। [২০০] 

অন্যান্য অঞ্চলের মতো খুলনা জেলাতেও সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন ১৯৫০-এর গোড়ার দিকেই সম্পূর্ণ শেষ হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্টের পর থেকে বহু সংখ্যক হিন্দু নামধারী কমিউনিস্টের দেশ ত্যাগ, কমিউনিস্ট পার্টির ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ রাজনৈতিক ধ্বনি ও হঠকারী রাজনৈতিক লাইনের ফলে কৃষক আন্দোলনকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও এই সময় বামপন্থী হঠকারী ও সংস্কারবাদী এই দুই চিন্তা কর্মী ও নেতাদেরকে বিভক্ত করে এবং সংস্কারবাদীরা পার্টিগতভাবে পৃথক না হলেও আন্দোলন থেকে দূরে থাকেন। ১৯৫০-এর গোড়ার দিক থেকে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ও ও সরকারী নির্যাতনের মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি একেবারে বিনষ্ট হয়। [২০১] 

ভূমি সমস্যা সম্পর্কে আসলে এ সময় কমিউনিস্ট পার্টিরও কোন সুনির্দিষ্ট ধারণা ও নীতি ছিলো না। খুলনা জেলায় ১৯৪৮-১৯৫০-এর মধ্যে কোন এলাকাতেই জোতদারদের খাস জমি দখলে আনা এবং ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বণ্টন ইত্যাদি কিছুই করা হয়নি।[২০২]

১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসের পর যশোর জেলায় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে নড়াইল মহকুমা কৃষক সম্মেলন হয়। এর পর ঐ বৎসরই জুন মাসে নড়াইলে একটি কৃষক সমাবেশ হয়। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে সশস্ত্র সংগ্রামের লাইন গৃহীত হওয়ার পর কৃষক সমিতির কার্যকলাপ বস্তুতঃপক্ষে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৬-৪৭ সালের তে-ভাগা আন্দোলনের সময় গ্রামে গ্রামে কৃষক সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছিলো এবং সেগুলিই ছিলো আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু রণদীভে লাইন অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সেরকম কোন গ্রাম কৃষক কমিটি গঠনের চিন্তা হয়নি এবং তৎকালীন অবস্থায় তা সম্ভবও ছিলো না। এজন্যে পূর্বে ছোট ছোট গ্রাম্য জমায়েতের মাধ্যমে কৃষকদেরকে যেভাবে রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়া হতো এবং সংগঠিত করা হতো সে সময় সেটা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক প্রচার ও সাংগঠনিক কাজ সব কিছুই অতি গোপনীয়তার মধ্যে করতে হওয়ায় কাজের এলাকা স্বাভাবিকভাবেই ভয়ানক সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক আন্দোলন কোন ব্যাপক ভিত্তি লাভ করতে সমর্থ হয় না। [২০৩] 

পুলিশী হামলা এই পর্যায়ে কমিউনিস্টদের ওপর এবং কৃষক আন্দোলনের কর্মীদের ওপর অব্যাহত থাকে কিন্তু তে-ভাগা আন্দোলনের সময় পুলিশী হামলার মোকাবেলা যেভাবে ব্যাপক গণ-প্রতিরোধের মাধ্যমে করা হতো সেটা ছিলো এক্ষেত্রে অচিন্তনীয়। পুলিশী হামলার মোকাবেলা করতে গিয়ে যশোর জেলায় পুলিশের সাথে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষ ঘটেনি। কিন্তু দালাল খতম কিছু কিছু হয়েছিলো। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চাঁদপুর গ্রামে পুলিশী হামলার সময় পুলিশের সহযোগী নূরুল হুদাকে কর্মীরা অপহরণ করে হত্যা করেন। নড়াইল এলাকার বাকড়ী গ্রামে আরও একজন পুলিশের সহযোগীকে খতম করা হয়। [২০৪] 

এই ধরনের রাজনৈতিক কাজ কৃষকদের ওপর পুলিশী নির্যাতনকে বৃদ্ধি করে এবং তা জনগণকে উৎসাহিত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। গণ-সংগঠন ও প্রচার আন্দোলন সক্রিয় না থাকায় কমিউনিস্ট ও কৃষক কর্মীরা জনগণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এর ফলে আশ্রয় ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতার অভাবে অধিকাংশ কর্মী ১৯৪৯ সালের মধ্যেই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ১৯৪৯ সালে কৃষক সমিতির পরিবর্তে ক্ষেতমজুরদের সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী ১৯৪৯ সালের ১৪-১৫ই সেপ্টেম্বর ঝিকরগাছা থানার পানিসরা গ্রামে একটি জেলা ক্ষেতমজুর সম্মেলন গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালে যশোর জেলার কৃষকদের মধ্যে কোন প্রকার সাংগঠনিক কার্যকলাপ চালাবার এটাই সর্বশেষ প্রচেষ্টা। [২০৫] 

ক্ষেতমজুরদের আন্দোলন কোন জায়গাতেই তেমন দানা বাঁধেনি। বিচ্ছিন্নভাবে পূর্ব বাঙলার কোন কোন ছোটখাটো এলাকায় কিছুটা হয়েছিলো। সাধারণভাবে এই আন্দোলনের মূল দাবী ছিলো দৈনিক তিন টাকা মজুরী ও তিন বেলা খোরাকী। কৃষকরা নিজেরা কিন্তু এ দাবীকে অবাস্তব এবং এই লক্ষ্য অর্জনকে অসম্ভব মনে করেছিলেন। এজন্যে এ দাবীর ভিত্তিতে তাদেরকে কিছুতেই আন্দোলনে টেনে আনা যায়নি। এই ধরনের দাবীকে কমিউনিস্ট পার্টিও অর্জনযোগ্য মনে করতো না। তাঁরা এটা উত্থাপন করেছিলো সম্পূর্ণ অন্য উদ্দেশ্যে। তাঁদের ধারণা ছিলো যে, এই ধরনের দাবীর মাধ্যমে কৃষকদেরকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা এবং দাবী আদায় না হলে আন্দোলনকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জমি ও তারপর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। কিন্তু কৃষকরা এ সবের জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। উপরন্তু এ ধরনের দাবীর ফলে জোতদাররা অক্ষমতার কারণে অনেক জায়গাতেই মজুর নেওয়া বন্ধ করলো এবং তার বিরোধিতা করতে শুরু করলেন।[২০৬] 

ফরিদপুর জেলায় কিন্তু পরিস্থিতি ততখানি খারাপ হয়নি। কারণ এখানে স্থানীয়ভাবে দৈনিক এক টাকা মজুরী এবং এক বেলা খোরাকীর দাবীতে ক্ষেতমজুর আন্দোলন করা হয়। এই লক্ষ্য অর্জন তৎকালীন পরিস্থিতিতে অসম্ভব ছিলো না এবং ক্ষেত মজুররাও তার বিরোধী ছিলেন না। ফলে ক্ষেতমজুরদের আন্দোলন এখানে কিছুটা সফল হয়। আন্দোলন ফরিদপুর 

জেলায় কোন ব্যাপক আকার ধারণ না করলেও অন্যান্য অনেক জেলা এবং অঞ্চলের মতো এখানকার মুসলমান এলাকাগুলিতে আন্দোলন উচ্ছেদ হয়ে ভয়ানক কোন বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি। [২০৭] 

ফরিদপুর জেলায় দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সংকটের সময় অবশ্য কৃষকদের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছিলো নৌকা থেকে ধান-চাল ইত্যাদি জোর করে নামিয়ে নিয়ে জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার। কিন্তু কৃষকরা তাতে সম্মত হননি। বস্তুতঃপক্ষে কোন রকম হঠকারী লাইনই কৃষকরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে সম্মত হননি। তাছাড়া ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ ধ্বনিটি আন্দোলনের ক্ষেত্রে খুবই মারাত্মক হয়েছিলো। কারণ সাধারণ কৃষকরা মুসলিম লীগ শাসনে দুঃখ কষ্ট পেলেও পাকিস্তান উচ্ছেদ করার জন্যে তৎকালে তাঁরা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। [২০৮] 

১৯৪৮-৪৯ সালের কর্ডন বিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি ফরিদপুরে কোন অংশগ্রহণ করেনি। শেখ মুজিবুর রহমান সে সময়ে গোপালগঞ্জ এলাকায় কৃষকদেরকে এই আন্দোলনে কিছুটা নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এই সময়েই এ অঞ্চলে তিনি কিছুটা খ্যাতি অর্জন করেন। [২০৯] 

দেশ বিভাগের সময় জলপাইগুড়ি জেলার তেঁতুলিয়া, বোদা ও পঞ্চগড় থানা পূর্ব দিনাজপুর (পূর্ব পাকিস্তান) জেলার এবং দেবীগঞ্জ পাটগ্রাম থানা রংপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই এলাকাগুলিসহ দিনাজপুর ও রংপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন কিছুটা হলেও ১৯৪৬-৪৭ এর তে-ভাগা আন্দোলনের মতো জোরদার আন্দোলন সেখানে সম্ভব হয়নি। পূর্ব বাঙলার অন্যান্য অঞ্চলগুলিতেও যে কারণে আন্দোলন সাধারণভাবে স্তিমিত হয়ে আসে এই সব অঞ্চলেও সেই একই কারণে আন্দোলন পূর্বের মতো আর দানা বাঁধতে পারেনি। ঢাকা ও বরিশালে ধান করাড়ী প্রথার[২১০] বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র আকারে কিছু কিছু আন্দোলন হয়। ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম জেলাতেও ক্ষুদ্র আকারে কোন কোন এলাকার কৃষক আন্দোলন হয়। মাদোরাশায় এই সময় ফসল রক্ষা করতে গিয়ে কৃষকদের সাথে পুলিশের এক সংঘর্ষ এবং পুলিশের গুলিতে ১২ জন কৃষক নিহত হন।[২১১] 

৯. পূর্ব বাঙলা সরকারের কমিউনিস্ট বিরোধী নীতি ও প্রচারণা 

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের তৎকালীন অনুসৃত নীতি অনুযায়ী পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলেও মুসলিম লীগ সরকার স্বাভাবিক কারণেই প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্টদেরকে কোন প্রকার সহযোগিতামূলক কাজে গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলো না উপরন্তু তারা প্রথম থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলিকে আক্রমণ ও ধ্বংস করার নীতিতেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলো। এজন্যে ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্টের পর বৃটিশ আমলে ধৃত অনেক রাজবন্দীকে তারা মুক্তি দান করলেও নাজিমুদ্দীন সরকার কমিউনিস্ট রাজবন্দীদেরকে মুক্তি দিতে অস্বীকার করে এবং এ ব্যাপারে তাদের নীতি সুস্পষ্টভাবেই ঘোষণা করে।[২১২] শুধু তাই নয়, ১৯৪৮-এর মার্চ, এপ্রিলের পর থেকে একদিকে কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র সংগ্রামের কর্মসূচী এবং অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যস্ত অবস্থা ও মুসলিম লীগের দ্রুত অপসৃয়মান জনপ্রিয়তার ফলে বিপ্লবের ভয়ে ভীত হয়ে নিজেদের শোষণমূলক শাসনের হাজার ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিয়ে জনগণের মধ্যে নিজেদের পূর্ব প্রভাবকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে তাঁরা উত্তরোত্তরভাবে কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিজম বিরোধী দমননীতি ও প্রচারণায় লিপ্ত হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের নীতি ও কর্মকাণ্ডের যে কোন বিরোধী ও কমিউনিস্ট প্ররোচিত আখ্যা দিয়ে এমনভাবে অহরহ প্রচারণা চালিয়ে যেতে থাকে যার ফলে মুসলিম লীগ মহলেও তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং সেই সব প্রতিক্রিয়া মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রপত্রিকাতেও প্রতিফলিত হয়। [২১৩] 

‘বাঁচিবার পথ’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে ১৯৪৮ সালের মে মাসে মুসলিম লীগ সমর্থক সাপ্তাহিক নওবেলাল দেশের পরিস্থিতি ও সরকারের কমিউনিজম বিরোধী প্রচারণার স্বরূপ সম্পর্কে নিম্নলিখিত মন্তব্যের মাধ্যমে সরকারকে সতর্ক করে: 

‘আন্তর্জাতিক অবস্থার চাপে এবং বিভাগের জন্য পাকিস্তানের আর্থিক কাঠামো ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে; মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সাধারণভাবে নীচে নামিয়া আসিতেছে, এবং দ্রব্যমূল্য দ্রুত বাড়িতে থাকিয়া দেশ জুড়িয়া এক অবিশ্বাস, ভয়, সন্দেহ এবং অসন্তোষের বিষ ছড়াইতেছে। এই অবস্থাকে অধিক দিন চলিতে দিলে দেশের অসন্তুষ্টি আত্মপ্রকাশ করিতে বাধ্য যাহা হয়ত বা গণবিপ্লবের পর্যায়েও নামিয়া আসিতে পারে। এই অবস্থা না দেশের পক্ষে না জনসাধারণের পক্ষে মঙ্গলজনক, বরং ইহাতে পাকিস্তানের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপদগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে। 

পাকিস্তান সরকারও যে অনুরূপ সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত নহেন তাহা নহে, বরং মধ্যে মধ্যে দায়িত্বশীল নেতৃবর্গের বিবৃতি এবং বক্তৃতা হইতে ইহা স্বাভাবিকভাবেই ধরিয়া লওয়া যায় যে দেশ দ্রুত এক গণবিপ্লবের দিকে অগ্রসর হইতেছে, এবং পাকিস্তান বিপন্নের ইসলাম বিপন্নের ধুয়া তুলিয়া সেই বিপ্লবের পথরোধের চেষ্টা চলিতেছে। ঘন ঘন কমিউনিস্ট বিরোধী বিবৃতির ইহাই সার কথা। [২১৪] 

আমরা প্রত্যক্ষ করিতেছি এই সকল বিবৃতি দেশের জনগণের মনে কোন ক্রিয়াই করিতে পারিতেছে না। বরং স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানীরা আজ প্রশ্ন করিতেছে বাঁচিয়া থাকিবার কোন ব্যবস্থা পাকিস্তানে সম্ভবপর কিনা? – 

কমিউনিজম ভীতি প্রচারে সরকার আজ এমনই মাতিয়া উঠিয়াছেন যে, ইহা দ্বারা কমিউনিস্ট ভীতিকে জনমত হইতে পরিপূর্ণভাবে মুছিয়া ফেলা হইতেছে।” 

কমিউনিস্ট বিরোধী দমননীতি ও প্রচারণা সম্পর্কে একটি সম্পাদকীয়তে ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় বলা হয়: 

আমাদের কর্তৃপক্ষকে জানাইয়া দিতে চাই যে, আতঙ্কগ্রস্ততা ও দমননীতির উপর একান্তভাবে নির্ভশীল না হইয়া তাঁরা দেশ হইতে দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সামাজিক ভেদ বৈষম্য দূর করিবার কাজকে ত্বরান্বিত করুন। ইহা করিতে পারিলেই পাকিস্তানে কমিউনিজমের দূরতম এবং ক্ষীণতম সম্ভাবনাও চিরদিনের জন্য দূর হইয়া যাইবে। 

১৯৪৯ সালের মার্চ মাসেই ‘দমননীতি’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে সাপ্তাহিক নওবেলাল একই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলে: 

আজ জনসাধারণের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক যাহারা কঠোর দমননীতি চালাইয়া যাইবার জন্য সরকারকে চাপ দিতেছেন তাহারা প্রকৃতপক্ষে কমিউনিজমের কাজ আগাইয়া দিতেছেন। তাঁহারা যদি সত্যসত্যই কমিউনিজম বিরোধী হইয়া থাকেন তাহা হইলে তাহাদের উচিত দেশের প্রধান প্রধান সমস্যা যথা – শিক্ষা সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, মানুষ মানুষের মত বাঁচিয়া থাকিবার সমস্যা ইত্যাদির আশু এবং উপযুক্ত সমাধান করিবার জন্য সরকারকে বাধ্য করা। [২১৫] 

১৯৪৯ সালের মে মাসে পূর্ব বাঙলা সরকার ‘কম্যুনিজমের স্বরূপ’ নামে একটি ইস্তাহার২১৬ পূর্ব বাঙলার সর্বত্র জনগণের মধ্যে প্রচার করেন। এই ইস্তাহারটিতে কৃষক শ্রমিক ছাত্র শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনগণের কাছে ‘কমিউনিজমের স্বরূপ’ উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে তাঁরা প্রধানতঃ সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় গ্রহণ করে। বিভিন্ন কারণে নিম্নোদ্ধৃত ইস্তাহারটি খুবই উল্লেখযোগ্য :

এই প্রদেশে কম্যুনিস্টদের প্রভাব ও কর্মতৎপরতা বর্তমানে প্রায় নাই বললেই চলে। কিন্তু প্রদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে কম্যুনিস্ট তৎপরতার ফলে পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটিয়াছে, বিশেষতঃ চীন ও ব্রহ্মদেশে কম্যুনিস্টদের কর্তৃক শাসন-ক্ষমতা হস্তগত করার প্রচেষ্টার পরিণাম ব্যাপকভাবে ও বহু বর্ষব্যাপী যে গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাত শুরু হইয়াছে এবং ভারতে গত কিছুদিন হইতে কম্যুনিস্টদের উপদ্রব যেরূপ বৃদ্ধি পাইয়াছে, তাহা বিবেচনা করিয়া এই প্রদেশের জনগণকে কম্যুনিস্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ ও এই সব প্রতিষ্ঠানের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সদস্যদের সম্ভাব্য অনাচার সম্বন্ধে সতর্ক করা প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে। ইহা সত্য যে, পাকিস্তানের মুসলিম জনসাধারণ কোনদিনই কমুনিস্টদের ইসলাম বিরোধী মতবাদ সমর্থন করিবে না। কিন্তু এই বিশ্বাসই পাকিস্তানের জনগণকে তাহাদের রাষ্ট্রের প্রতি কম্যুনিস্টদের সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে সতর্ক করিয়া দেওয়ারও সম্ভাবনা রহিয়াছে। 

এই প্রদেশের সীমান্তে সম্প্রতি যে সব ঘটনা সংঘটিত হইয়া গিয়াছে এবং প্রদেশের ভিতরেও বিচ্ছিন্নভাবে কোন কোন জায়গায় যে সব ব্যাপার অনুষ্ঠিত হইয়াছে, তাহা হইতেই রাষ্ট্রের এই সব শত্রুর প্রকৃত উদ্দেশ্যে ও কর্মপন্থার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। 

যেসব প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহা দ্বারা পরিষ্কারই বুঝা যায় যে প্রদেশের বাহির হইতেই কমুনিস্ট দল প্রেরণা ও নির্দেশ লাভ করিতেছে এবং পাকিস্তানকে ধ্বংস করিয়া দিয়া সমগ্র পাক-হিন্দ উপমহাদেশে মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তি একেবারে নষ্ট করিয়া দেওয়াই ইহাদের উদ্দেশ্য। যদিও বাহ্যতঃ কম্যুনিস্টরা হিন্দু মহাসভার বিরোধী, তথাপি প্রায় সকল কম্যুনিস্টই হিন্দু বলিয়া তাহারা তাহাদের মুসলিম বিরোধী মনোভাব বর্জন করিতে পারে নাই। এই জন্যই ভারত পাকিস্তানকে পুনরায় মিলিত করিয়া প্রকারান্তরে হিন্দুদের পদানত করিয়া দেওয়ার জন্য মহাসভার অনুসৃত নীতি এইসব কম্যুনিস্টও সমর্থন করিতেছে। পাকিস্তানের অন্যান্য শত্রুদের সহিত কম্যুনিস্টদের মতবিরোধ শুধুমাত্র কর্মপন্থা লইয়া। আমাদের অন্যান্য দুশমনরা পাকিস্তান ও ভারতের পুনর্মিলনে পাকিস্তানকে বাধ্য করার জন্য এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ কি আর্থিক অবরোধ জারী করার পক্ষপাতী; কিন্তু কম্যুনিস্টরা রাষ্ট্রের ভিতরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালাইয়াই এই উদ্দেশ্য সাধন করিতে চায়। জীবন ও সম্পত্তি বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা ছাড়াও কম্যুনিস্টরা রাষ্ট্রের ভিতরে যে ধ্বংসাত্মক নীতি কার্যকরী করিতে চায় তজ্জন্য প্রধানতঃ জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করিতেই তাহারা চেষ্টিত। ভারতে অবস্থিত কম্যুনিস্ট কর্মীদের প্রতি সহানুভূতি দেখাইতে গিয়া কিছুদিন পূর্বে পূর্ববঙ্গেও রেল-ধর্মঘট অনুষ্ঠানের যে হাস্যকর প্রচেষ্টা হইয়াছিলো এবং এই প্রদেশের মুসলমানগণ কম্যুনিস্টদের ফাঁদে পা দিতে রাজী না হওয়ায় যে প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত শোচনীয়ভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাহা হইতে কম্যুনিস্টদের বদ মতলবের বিশেষ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিলো। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে কম্যুনিস্টগণ প্রকৃত ঘটনার বিকৃত বর্ণনা প্রদান করিতে ও বেপরোয়া মিথ্যা প্রচারে একেবারে সিদ্ধহস্ত। জমিদারের খাজনা ও সরকারী ট্যাক্স প্রদান না করার জন্য এবং সর্বপ্রকার আইন ও কর্তৃত্ব অমান্য করার জন্য এই কম্যুনিস্টরা দেশের জনগণকে উস্কানী দিয়া থাকে। অশান্তি-উপদ্রব সৃষ্টি ও ধ্বংসাত্মক কার্য সাধনের জন্য ইহারা জনসাধারণকে উৎসাহ প্রদান করে এবং দলের অর্থ-ভাণ্ডার শক্তিশালী করার জন্য অপরের বাড়ীতে ডাকাতি করার পরামর্শ পর্যন্ত প্রদান করিতে কুষ্ঠিত হয় না। সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির জন্যও চেষ্টা করা হইয়া থাকে। অসম্ভব রকম বেতন বৃদ্ধির দাবী উত্থাপন করিতেই এইসব দুষ্টবুদ্ধি লোক সরকারী কর্মচারীদিগকে প্ররোচিত করিয়া থাকে – যদিও ইহারা নিজেরাই জানে যে এরূপ অসম্ভব দাবী পূর্ণ করা কিছুতেই সম্ভবপর হইবে না। সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করার যে উদ্দেশ্য, এরূপ অসম্ভব দাবীর দ্বারা তাহা সিদ্ধ হয় বলিয়াই কম্যুনিস্টরা জানিয়া শুনিয়া এরূপ দাবী উত্থাপনের প্ররোচনা যোগায়। অনুরূপভাবেই শ্রমিকদিগকেও অসম্ভব রকম মজুরী দাবী করিতে এবং দাবী পূর্ণ না হইলে ধর্মঘট করিতে উৎসাহ দেওয়া হইয়া থাকে। এখানেও প্রকৃত উদ্দেশ্য হইতেছে – শ্রমিকদের কল্যাণ নয়, বরং তাহাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করিয়া দেশের উৎপাদন হ্রাস করা, অথবা একান্ত জরুরী ব্যবস্থাসমূহকে নষ্ট করিয়া দিয়া দেশবাসীকে ব্যাপকভাবে অসুবিধার সম্মুখীন করা। 

কিন্তু ইহা অপেক্ষা মারাত্মক ধরনের আক্রমণ পরিচালনারও চেষ্টা চলিতেছে। ভাবপ্রবণ ছাত্র সমাজের মধ্যে ঢুকিয়া দেশের যুবশক্তির মানসিকতাকে বিষাক্ত করিয়া তোলার প্রচেষ্টাই এই আক্রমণের ধারা। পূর্ব পাকিস্তান মোসলেম ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন —এই উভয় প্রতিষ্ঠানেই এমন সব কম্যুনিস্ট রহিয়াছে, যাহারা ভারতের হিন্দু কম্যুনিস্টদের সহিত একযোগে কাজ করিতেছে। এখানেও কমুনিস্টদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাপকভাবে অসন্তোষ ও ব্যর্থতার ভাব আনিয়া দেওয়া। তাহাদের প্ররোচনায় ছাত্রগণ তাহাদের পিতামাতা ও শিক্ষকদের আদেশ অমান্য করিতে উৎসাহিত হইয়া থাকে। সমাজবিরোধী কার্যকলাপে যোগ দিয়া তাহাদের লেখাপড়ায় অবহেলা করিতেও তাহাদের উৎসাহ যোগানো হয়। তাহাদের অভিভাবকগণ তাহাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া থাকেন রাষ্ট্র গঠনের কার্যে যোগ্যতা অর্জনের জন্য উপযুক্ত জ্ঞান সঞ্চয় করিবার উদ্দেশ্যে কিন্তু তাহারা তাহাদের এই কর্তব্য ভুলিয়া গিয়া সময়ের অপব্যবহার করিতে ও রাষ্ট্রের ক্ষতিকর কার্যে লিপ্ত থাকিতে প্ররোচিত হইয়া থাকে। এইসব কার্যে উৎসাহ দিতে গিয়া কম্যুনিস্টরা যে কিরূপে সীমা ছাড়াইয়া পর্যন্ত যাইতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাম্প্রতিক ধর্মঘট[২১৭] তাহার একটি দৃষ্টান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নতম চাকুরীয়াদের ধর্মঘটের সঙ্গে ছাত্রদের পড়াশোনার কোনই সম্বন্ধই থাকিতে পারে না। কম্যুনিস্টরাই ছিল উক্ত ধর্মঘটের প্রকৃত উস্কানীদাতা। অধিকাংশ ছাত্রই এইরূপে অনর্থক সময় নষ্ট করার বিরোধী ছিলো। কিন্তু তাহাদিগকেও এই ধর্মঘট সমর্থন করিবার জনা বাধ্য করা হয়। আমাদের যুবকদের ভাগ্য লইয়া কম্যুনিস্টদের খেলা এরূপভাবেই চলিতেছে। 

জনগণের মধ্যে ত্রাস সঞ্চার করিবার ব্যাপারেও কম্যুনিস্টরা নির্মম। গত ২৬শে ফেব্রুয়ারী তারিখে পশ্চিম বাঙলার দমদমে অবস্থিত জেসপ কোম্পানীর কারখানায় কম্যুনিস্টরা যে আক্রমণ চালায়, তাহাতে তাহারা তিন জন কর্মচারীকে পোড়াইয়া মারে। গত ২২শে ফেব্রুয়ারী রংপুরেও অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটে। সুধীর মুখার্জী নামক এক ব্যক্তির পরিচালনায় একদল কম্যুনিস্ট কিশোরগঞ্জ থানার যোগেশ সরকারের ধান প্রভৃতি লুট করিবার উদ্দেশ্যে তাহার বাড়ী আক্রমণ করে। বহু মুসলমান গ্রামবাসী আক্রমণকারীদিগকে বাধা দেওয়ার জন্য সমবেত হয়। হাবু শেখ নামক এক ব্যক্তি আক্রমণকারী দলের নেতাকে আক্রমণ করে। তখন একজন কম্যুনিস্ট একরকমের রাসায়নিক দ্রব্যের সাহায্যে হাবুর চোখে আগুন ধরাইয়া দেয়। তাহাতেও খুশী না হইয়া উক্ত ব্যক্তি হাবুকে ছোরার আঘাতে হত্যা করে। 

৯ই মার্চ ভারতীয় কম্যুনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিতে এখানকার কম্যুনিস্টগণ রেল ধর্মঘট অনুষ্ঠানের ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে। এই সময়ে তাহারা পুবাইল টঙ্গি স্টেশনের মধ্যে রেল লাইন উপড়াইয়া ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে কোন দুর্ঘটনা ঘটিবার পূর্বেই ইহা কর্তৃপক্ষের নজরে আসে এবং আবশ্যকীয় মেরামত কার্য সারিয়া ফেলা হয়। এখন বিবেচ্য দুর্ঘটনা ঘটিলে কি হইতো? নিরীহ যাত্রীগণই প্রাণ হারাইত, সন্দেহ নাই। কম্যুনিস্ট আদর্শে মুসলিম জনগণ অনুপ্রাণিত হয় না দেখিয়া এক্ষণে কম্যুনিস্টদের অনেকেই মুসলমানের ছদ্মবেশ ধারণ করিতেছে। সম্প্রতি দিনাজপুর ও যশোহরে কয়েকজন মুসলমান নামধারী কম্যুনিস্ট ধৃত হইয়াছে। পরে পরিচয় লইয়া জানা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে তাহারা ছিল হিন্দু এবং এই প্রদেশের বাহিরের কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষ হইতেই তাহারা কাজ করিতেছিলো। কম্যুনিস্টদের কর্মপন্থা বিবেচনা করিলে মনে করা চলে যে, পাকিস্তানের দুশমনদের মধ্যে ইহারাই সর্বাপেক্ষা মারাত্মক। তাহারা হিতাহিত বিচারশূন্যও বটে। তাহারা যেসব ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করিয়া থাকে, তাহা মনোজ্ঞ বুলি দ্বারা সতর্কভাবে আবৃত করিয়া রাখা হয়। গরীব ও সরল প্রকৃতির লোকদিগকে এই প্রলোভনে ভুলানো হয় যে, যদি তাহারা তাহাদের উপদেশ অনুযায়ী কার্য করে তাহা হইলে তাহাদের সকল দুর্দশা ঘুচিয়া যাইবে। 

ইহার পর যখনই কোন কম্যুনিস্ট সহানুভূতিময় মিষ্টি বুলি লইয়া আপনার নিকট আসিবে এবং জানাইবে যে তাহার উপদেশমতো কার্য করিলে আপনার দুঃখ-কষ্ট দূর হইবে, তখনই এই কথা স্মরণ রাখিবেন যে, সে আপনার বা আপনার দেশের কাহারও বন্ধু নয়। আপনার রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা, পাকিস্তানকে ধ্বংস করা এবং এই দেশ হইতে ইসলামের প্রভাব নির্মূল করাই তাহার একমাত্র উদ্দেশ্য; কারণ সে খোদাতালার উপর বিশ্বাস করে না। বাহিরে যে যতই বন্ধুত্ব দেখাক, স্মরণ রাখিবেন যে, সে এমন একটি দলের সদস্য যাহা পাকিস্তানের সর্বনাশ সাধনের চেষ্টা করিতেছে এবং যে দল সাধারণ লোককে পোড়াইয়া মারিয়া থাকে, যাহারা দরিদ্র হাবুর চোখ পোড়াইয়া দিয়া ছিলো এবং যাহারা রাষ্ট্রনাশক কার্য করিতে গিয়া নিরীহ রেল যাত্রীদিগকে হত্যা করিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। 

পাকিস্তানের নাগরিকগণ এই সব দুষ্কৃতিকারী সম্বন্ধে সাবধান হউন। তাহারা আপনার রাষ্ট্রের শত্রু। যেখানেই তাহাদিগকে দেখুন না কেন, কোন রকমেই তাহাদের প্রশ্রয় দিবেন না। তাহাদের অধিকাংশই অমুসলমান। কিন্তু কতিপয় বিপথগামী ও স্বার্থান্বেষী মুসলমানও তাহাদের ফাঁদে পা দিয়াছে। কিন্তু মুসলমানই হউক, আর অমুসলমানই হউক, তাহারা রাষ্ট্রের দুশমন এবং তাহাদের প্রতি সেইরূপ ব্যবহার করা উচিত। 

কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সরকারী প্রচারণার একটি সামগ্রিক পরিচয় উপরোক্ত ইস্তাহারটির মধ্যে পাওয়া যায়। এই ধরনের প্রচারণা সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে সরকারের পক্ষে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলো তা বলা চলে না। উপরন্তু কমিউনিস্ট পার্টির নানান হঠকারিতার ফলে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা কমিউনিস্টবিরোধী হাতিয়ার হিসেবে অনেকাংশে কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়। 

পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় মধ্যশ্রেণীভুক্ত ছাত্র, শিক্ষক ও যুবকদের ওপর কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধি লাভ করছে এই আশঙ্কা করে ১৯৪৯ সালের অগাস্ট মাসে কমিউনিস্ট প্রভাব দমন ও দূরীভূত করার উদ্দেশ্যে সরকারী কর্তৃপক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ‘যথোপযুক্ত’ ব্যবস্থা অলম্বনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বিষয়ে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় নিম্নলিখিত রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়: 

যাহারা স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মারফত এছলাম বিরোধী কম্যুনিস্ট নীতি প্রচারের দ্বারা জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মন বিষাক্ত করিয়া জাতির মূলে কুঠারাঘাত করিবার চেষ্টা করিতেছে, এবং নানাপ্রকার ধ্বংসমূলক কার্যকলাপের দ্বারা সরকারকে ‘সাবোটাশ’ করিবার মতলবে আছে, পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাহাদিগকে দমন করিবার জন্য ব্যবস্থাবলম্বন করিতেছেন বলিয়া জানা গিয়াছে। 

আরও জানা গিয়াছে যে যাহাতে কোন ছাত্র শিক্ষক পাকিস্তানবিরোধী ধ্বংসমূলক কার্যে লিপ্ত হইতে না পারে তজ্জন্য সরকার অতঃপর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর কড়া নজর রাখিবেন। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত আছে, তাহা হইলে সেগুলির সরকারী সাহায্য বন্ধ করিয়া দেওয়া হইবে এবং সরকারী সাহায্য না পাইলে অনুমোদন বাতিল করিয়া দেওয়া হইবে। অপর পক্ষে সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষক বা ছাত্র অনুরূপ দোষে অভিযুক্ত হইলে তাহাদিগকে যথাক্রমে বরখাস্ত ও প্রতিষ্ঠান হইতে বহিষ্কার করিয়া দেওয়া হইবে। উপরন্তু যদি কোন ছাত্র ধ্বংসমূলক কার্যে লিপ্ত আছে বলিয়া জানা যায়, তবে তাহার সরকারী চাকুরী লাভের পথ বন্ধ হইবে। 

এই প্রসঙ্গে আরও জানা গিয়াছে যে, অতঃপর সরকারী চাকুরীর জন্য যদি কেহ আবেদন করেন, তবে তাহাকে অন্যান্য সার্টিফিকেটের সহিত এই মর্মে আরও সার্টিফিকেট দিতে হইবে যে তাহার পাঠ্যাবস্থায় রাষ্ট্রবিরোধী ধ্বংসমূলক কোন কার্যকলাপে তিনি লিপ্ত ছিলেন না। সার্টিফিকেটসমূহে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর থাকা চাই। রাজনীতির ছাত্র হিসাবে সরকারী কার্যকলাপের যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা করায় কোনরূপ নিরুৎসাহ প্রদান করা হইবে না, তবে কোন শিক্ষক বা ছাত্র ধ্বংসমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত কোন পার্টি বা সংঘের সদস্য হইলে, পাকিস্তান বিরোধী প্রচারণায় উৎসাহ যোগাইলে এবং প্রত্যক্ষভাবে ধ্বংসমূলক কার্যকলাপে উদ্যোগী হইলে তাহাদের বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে। [২১৮] 

কমিউনিস্টদের ভয়ে সরকার কতখানি ভীত ছিলো এবং কমিউনিস্টদেরকে দমনের ক্ষেত্রে তাঁরা কত কঠোর ও সুদূরপ্রসারী নীতি গ্রহণ করেছিলো এই সরকারী নির্দেশের মধ্যেও তার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। 

১০. সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের ব্যর্থতার কারণ 

১৯৪৮-৫০ সালে পূর্ব বাঙলায় সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম শুধু যে ব্যর্থ হয়েছিলো তাই নয়, তার ফলে পূর্ব বাঙলায় কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিলো। এই বিপর্যয়ের পরিণতিতে এদেশে পরবর্তী দশ বারো বৎসর কৃষক আন্দোলনের কোন অস্তিত্বই বস্তুতঃপক্ষে ছিলো না এবং পরবর্তীকালেও সে আন্দোলন কিছুটা সাংগঠনিক চরিত্র পরিগ্রহ করতে আরও কয়েক বৎসর সময় লেগেছিলো। এজন্যে এই ব্যর্থতার কতকগুলি কারণ এখানে উল্লেখ করা দরকার। 

প্রথমত, যে পর্যায়ে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ বলে পাকিস্তান রাষ্ট্র উৎখাতের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছিলো সে পর্যায়ে পূর্ব বাঙলার জনগণ স্বাধীনতাকে ‘ঝুটা’ মনে করতে এবং পাকিস্তানকে উৎখাত করতে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। উপরন্তু আজাদীকে ‘সাচ্চা’ মনে করে তাঁরা পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে তাকে আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে নিজেদের ভাগ্যের উন্নতির চিন্তা করছিলেন। এজন্যে মুসলিম লীগের নির্যাতন ও কুশাসনের বিরুদ্ধে তাঁদের অনেক বিক্ষোভ থাকলেও এবং মুসলিম লীগ সরকারের পরিবর্তন তাঁরা চাইলেও কমিউনিস্ট পার্টির পাকিস্তান উৎখাতের ধ্বনি তাঁদের মধ্যে ব্যাপকভাবে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো। সরকারও এই সুযোগের উপযুক্ত ব্যবহারকে অবহেলা না করে তাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছিলো। 

দ্বিতীয়ত, সশস্ত্র সংগ্রামের কর্মসূচী গৃহীত হয়েছিলো খুবই আকস্মিকভাবে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট সরকারের সাথে সীমাবদ্ধ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে যারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কথা বলেছিলেন তাঁরাই মাত্র ছয় মাসের মধ্যে যখন নিয়মতান্ত্রিক পথকে বর্জন করে সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানালেন তখন জনগণের চেতনার স্তরকে বিচার না করেই তাঁরা তা করলেন। এর ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র আন্দোলন প্রথম থেকেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই শুরু হলো এবং সেই বিচ্ছিন্নতার ক্রমাগত এবং দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করলো। 

তৃতীয়ত, এই বিচ্ছিন্নতা শুধু যে কমিউনিস্ট পার্টিকে জনগণ থেকেই বিচ্ছিন্ন করলো তাই নয়, পার্টি সংগঠনকেও তা দ্রুতগতিতে ধ্বংস করে দিলো। পূর্ব বাঙলার সর্বত্র মধ্যশ্রেণীভুক্ত হিন্দু সমাজ থেকে আগত পার্টি সদস্যেরা এই বিচ্ছিন্নতার ফলে দলে দলে দেশ ত্যাগ করে চলে গেলেন। শতকরা নব্বই ভাগেরও বেশী সদস্যেরা এই শ্রেণীগত ও ধর্মীয় পটভূমি থেকেই এসেছিলেন এবং তার ফলে ১৯৪৮ সালের মধ্যেই পার্টির সাংগঠনিক কাঠামো প্ৰায় চুরমার হয়ে গিয়েছিলো। 

চতুর্থত, কমিউনিস্ট পার্টির এই সশস্ত্র সংগ্রাম দেড় দুই বৎসর কেবলমাত্র অমুসলমান প্রধান এবং নমঃশূদ্র আদিবাসী অঞ্চলগুলিতেই হয়েছিলো। এর ফলে সরকার সমগ্র কৃষক আন্দোলনকে “হিন্দুদের আন্দোলন” হিসেবে চিত্রিত করে সাম্প্রদায়িকতাকে বিপ্লবী সংগ্রামের বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছিলো । পঞ্চমত, কতকগুলি সংগঠিত এলাকায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে তাকে সারা পূর্ব বাঙলায় ছড়িয়ে দেওয়ার যে চিন্তার ওপর ভিত্তি করে সংগ্রামের এই কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছিলো, সে চিন্তা ছিলো নিতান্তই ভ্রান্ত। ব্যাপক গণআন্দোলনের শীর্ষে সশস্ত্র সংগ্রামের চিন্তা না করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে গণআন্দোলন সৃষ্টির প্রচেষ্টা মূলতঃ সন্ত্রাসবাদী হওয়ার ফলে আন্দোলনের বিকাশ না ঘটে সংগঠিত এলাকাগুলিই স্বল্পকালের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো। ষষ্ঠত, কতকগুলি এলাকাতে সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে সারা দেশব্যাপী কৃষক সমাজের মৌলিক সমস্যাগুলিকে ভিত্তি করে তাঁরা এমন কোন নির্দিষ্ট ধ্বনি ও কর্মসূচী কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণভাবে শোষিত জনগণের সামনে রাখতে পারেননি যা তাঁদেরকে সংগ্রামের জন্যে উপযুক্তভাবে উদ্বুদ্ধ এবং উজ্জীবিত করতে পারে। 

তথ্যসূত্র 

১ Peoples Age (Supplement), February ৪, 194৪, P10

২ Peoples Age (Supplement ), February ৪, 194৪, P 10 

৩ এ সময় মণি সিংহ কৃষক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন, কৃষ্ণবিনোদ রায় নয় (নগেন সরকার), ১৪২ পৃষ্ঠায় ভুলক্রমে কৃষ্ণবিনোদ রায়ের নাম উল্লিখিত হয়েছে। 

৪ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের বিবরণের জন্য পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির প্রথম খণ্ড দ্রষ্টব্য। 

৫ এ সম্পর্কে Agrarian Struggle in Bengal by Sunil Sen এবং বদরুদ্দীন উমরের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক দ্রষ্টব্য। 

৬ Agrarian Struggle in Bengal by Sunil Sen, Peoples Publishing House, 1972, P 31. 

৭ যে সংগ্রামের শেষ নেই, প্রথম খণ্ড, কালান্তর প্রকাশনী, কলিকাতা, ১৩৭৮, পৃ ১০৯।

৮ পূর্বোক্ত, পৃ ১১১। 

৯ পূর্বোক্ত। 

১০ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি প্রথম খণ্ড দ্রষ্টব্য। 

১১ লালা শরদিন্দু দে। 

১২ অজয় ভট্টাচার্যের লিখিত নোট। 

১৩ পূর্বোক্ত, এবং লালা শরদিন্দু দে। 

১৪ পূর্বোক্ত। 

১৫ পূর্বোক্ত। 

১৬ পূর্বোক্ত। 

১৭ পূর্বোক্ত।

১৮ পূর্বোক্ত।

১৯ পূর্বোক্ত। 

২০ পূর্বোক্ত। 

২১ পূর্বোক্ত। 

২২ মণি সিংহ, লালা শরদিন্দু দে। 

২৩ অজয় ভট্টাচার্য (নোট), লালা শরদিন্দু দে। 

২৪ – এই ঘটনার এই বিস্তৃত বিবরণ প্রমোদ দাসের স্বলিখিত নোট থেকে গৃহীত 

২৫ অজয় ভট্টাচার্য, নানকার বিদ্রোহ, পুঁথিপত্র প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা ১, ১৩৮০, পৃ ১৩- ১৪। 

২৬ পূর্বোক্ত, পৃ ১৯-২০। 

২৭ পূর্বোক্ত, পৃ ২২-২৩। 

২৮ অজয় ভট্টাচার্য, লালা শরদিন্দু দে। 

২৯ ছোট বড়ো অনুযায়ী সিলেটে ভূস্বামীদেরকে সাধারণভাবে জমিদার, মীরাসদার ও তালুকদার এই তিন শ্রেণী বিভক্ত করা হতো। 

৩০ অজয় ভট্টাচার্য : নানকার বিদ্রোহ, পৃ ১০৭ 

৩১ করুণাসিন্ধু রায় পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি সিলেট জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। আত্মগোপন করে থাকা অবস্থায় ১৯৪৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। 

৩২ পূর্বোক্ত, পৃ ১১৩ এবং লালা শরদিন্দু দে। 

৩৩ এই অংশের অপেক্ষাকৃত বিশদ বিবরণের জন্যে দ্রষ্টব্য; অজয় ভট্টাচার্য, নানকার বিদ্রোহ (১৩৮০), পুঁথিপত্র প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা ১ 

৩৪ অজয় ভট্টাচার্য। 

৩৫ অজয় ভট্টাচার্য। 

৩৬ অজয় ভট্টাচার্য 

৩৭ অজয় ভট্টাচার্য।

৩৮ অজয় ভট্টাচার্য। 

৩৯ অজয় ভট্টাচার্য। 

৪০ অজয় ভট্টাচার্য।

৪১ অজয় ভট্টাচার্য। 

৪২ অজয় ভট্টাচার্য।

৪৩ অজয় ভট্টাচার্য। 

৪৪ অজয় ভট্টাচার্য। 

৪৫ তখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে পুনর্গঠিত না হওয়ার জন্য তার পূর্ব নাম ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ’ই ছিলো। 

৪৬ অজয় ভট্টাচার্য ৫২ 

৪৭ সিলেটে নানকার বিদ্রোহ নামে একটি পুস্তিকা ইতিপূর্বে রোহিনী দাসের নামে প্রকাশিত হয়। তার অংশ বিশেষ অজয় ভট্টাচার্যের দ্বারা লিখিত ছিলো। নানকার আন্দোলনের সমস্ত রিপোর্ট সংহতি নামক পত্রিকায় তৎকালে প্রকাশিত হয়েছিলো। অজয় ভট্টাচার্যের থেকে এই তথ্য পেলেও উপরোক্ত পুস্তিকা ও পত্রিকার কোন কপির সন্ধান আমি পাইনি।-ব.উ. 

৪৮ নওবেলাল, ১/১/১৯৪৮। 

৪৯ পূর্বোক্ত। 

৫০ নোটিশটির কপি : In the court of A.D.M 
মাং ছইদ বক্ত চৌগং-১ম পক্ষ 
১২। সেক মচলন-২য় পক্ষ 
যেহেতু কার্যবিধির ১৪৪ ধারার বিধানমতে তোমাকে জানানো যাইতেছে যে, তুমি বাঁশ, গাছ, ধান্য কাটিবাহ না, কাটিলে আইনতঃ আচরণ করা যাইবে। তোমার কোন আপত্তি থাকিলে আগামী-ইং তারিখে দশাইবায়। অপাঠ্য, A.D.M. 

৫১ নওবেলাল, ১/১/১৯৪৮। 

৫২ পূর্বোক্ত। 

৫৩ পূর্বোক্ত। 

৫৪ অজয় ভট্টাচার্য। 

৫৫ পূর্বোক্ত। 

৫৬ পূর্বোক্ত। 

৫৭ নওবেলাল, ৮/১/১৯৪৮। ৫৮ পূর্বোক্ত, ১৫/১/১৯৪৮। 

৫৯ অজয় ভট্টাচার্য। 

৬০ পূর্বোক্ত। 

৬১ নওবেলাল, ১/৪/৪৮। 

৬২ পূর্বোক্ত, ১৫/১/৪৮ 

৬৩ পূর্বোক্ত। 

৬৪ নওবেলাল, ৬/৫/১৯৪৮। 

৬৫ পূর্বোক্ত, ১৩/৫/৪৮। 

৬৬ পূর্বোক্ত, ২৭/৫/৪৮। 

৬৭ পূর্বোক্ত, ১৬/১২/৪৮। 

৬৮ আলী হায়দার খান এরএলএ-ব.উ. 

৬৯ পূর্বোক্ত, ২৭/৫/৪৮। 

৭০ পূর্বোক্ত। 

৭১ পূর্বোক্ত, ৩/২/৪৯। 

৭২ পূর্বোক্ত, ১৭/২/৪৯। 

৭৩ পূর্বোক্ত। [এই বৎসরই (১৯৪৯ সালে) সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ৫০ বৎসর বয়সে নিজ গ্রাম বেহেলীতে করুণাসিন্ধু রায়ের মৃত্যু ঘটে (নওবেলাল ৮/৯/৪৮)-ব উ]। 

৭৪ পূর্বোক্ত, ১০/১২/৪৯, ২/২/৪৯, ৩১/৩/৪৯ 

৭৫ পূর্বোক্ত, ১০/৩/৪৯। 

৭৬ পূর্বোক্ত, ২৮/৪/৪৯। 

৭৭ সুষমা দে (স্বলিখিত নোট)। 

৭৮ নওবেলাল, ১/৯/৪৯। 

৭৯ সুষমা দে (নোট )। 

৮০ নওবেলাল, ১/৯/৪৯। 

৮১ সুষমা দে (নোট) [লাউতা বাহাদুরপুরে নানকার আন্দোলনের নেতা : বীরেশ মিত্র, অজয় ভট্টাচার্য, বীরান দত্ত, নৈমুল্লা, তকন মোল্লা, জীতেন ভট্টাচার্য, সুধন্যা দে, ইসাক মিঞা, দেদার বখত, নীরেন দে, ইসমাইল আলী।] পরবর্তী পর্যায়ে সানশ্বের নানকার আন্দোলনের নেতা : সুরত পাল, স্বদেশ পাল, যজ্ঞেশ্বর, বিলঙ্গময়ী কর, ভারত নমঃশূদ্র, অপর্ণা পাল (স্ত্রী সুরত পাল), অমিত পাল (বোন সুরত পাল), সুষমা দে (স্ত্রী লালা শরদিন্দু দে), প্রফুল্ল দাস, পবিত্র দাস, অমূল্য দাস, চটুই দাস, কুটুমনি দাস-ব.উ.। 

৮২ নওবেলাল, ১.৯.৪৯। 

৮৩ লালা শরদিন্দু দে, অজয় ভট্টাচার্য। 

৮৪ নওবেলাল, ১/৯/৪৯। 

৮৫ পূর্বোক্ত। 

৮৬ পূর্বোক্ত। 

৮৭ ১৮ থেকে ২৪শে অগাস্ট সানেশ্বর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পুলিশের কৃষকবিরোধী ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের পর কংগ্রেসী পরিষদ সদস্য নরেন্দ্রনাথ দেব (হবিগঞ্জ দক্ষিণ) পূর্ণেন্দ্র কিশোর সেনগুপ্ত (দক্ষিণ সিলেট, পূর্ব), বলরাম সরকার (করিমগঞ্জ দক্ষিণ) ও যতীন্দ্রনাথ ভদ্র (সুনামগঞ্জ) সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করেন। 

৮৮ পূর্বোক্ত। 

৮৯ পূর্বোদ্ধৃত ‘জনৈক নানকার প্রজা’র পত্র যে সময় (২৮/৪/৪৯) নওবেলালে প্রকাশিত হয় তার অল্পকালের মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে’ পত্রটিতে জমিদারদের উস্কানীমূলক তৎপরতার যে উল্লেখ করা হয়েছিলো তা এক্ষেত্রে স্মর্তব্য। 

৯০ EB Assembly Proceedings, 1৪th November, 1949 Vol. IV-No. 1, P 151. ৯১ পূর্বোক্ত, পৃ ১৪৮-৪৯ (যতীন্দ্রনাথ ভদ্রের রিপোর্ট)। 

৯২ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫২ (নীরেন্দ্রনাথ ভদ্রের রিপোর্ট)। 

৯৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫০-৫১ (যতীন্দ্রনাথ ভদ্রের রিপোর্ট)।

৯৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫১, ১৫৩। 

৯৫ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫১ (নীরেন্দ্রনাথ ভদ্র)। 

৯৬ পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৩। 

৯৭ পূর্বোক্ত, পৃ ১৬৫। 

৯৮ কমিউনিস্ট বিরোধিতার ক্ষেত্রে কংগ্রেস লীগভুক্ত ও হিন্দু মুসলমান জমিদারদের ভ্রাতৃত্বমূলক ঐক্য এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। -ব.উ.। 

৯৯ এই এলাকাতে আসাম সরকার কর্তৃক সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন এবং বহু সংখ্যক মামলা কৃষকদের বিরুদ্ধে জমিদারশ্রেণী কর্তৃক সরকারী সহায়তায় দায়ের করাকে যথেষ্ট মনে না করে নূরুল আমীন ইতিপূর্বে তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন যে, আসামের কংগ্রেস সরকার কমিউনিস্টদেরকে দমনের ব্যাপারে উদাসীন ছিলো। -ব.উ.। 

১০০ পূর্বোক্ত, E.B. Assembly Proceedings, 1৪th November, 1949 vol. IV-No. 1, P 166-70. 

১০১ দৈনিক আজাদ, ১৪/৯/৪৯ 

১০২ নওবেলাল, ১৫/৯/৪৯, ১৩/10/৪9 

১০৩ প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ৪৮-৪০৭ 

১০৪ EB Legislative Assembly Proceedings, 24th March, 194৪, Vol. I. No. 2. P 49. 

১০৫ প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, কালান্তর প্রকাশনী কলিকাতা, প্রথম, প্ৰকাশ আশ্বিন, ১৩৭৮, পৃ ১১১-১২। 

১০৬ নগেন সরকার। 

১০৭ পূর্বোক্ত। 

১০৮ পূর্বোক্ত। 

১০৯ নগেন সরকার। প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ১১২। 

১১০ নগেন সরকার। 

১১১ প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ১১২। 

১১২ নগেন সরকার। 

১১৩ নগেন সরকার। প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ১১২। 

১১৪ নগেন সরকার। 

১১৫ প্রথম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। 

১১৬ EB Legislative Assembly Proceedings, 10th March 1950, Vol. IV. No. ৪. P 216-1৪. 

১১৭ সত্যেন সেন, বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম, কালিকলম প্রকাশনী, ১৯৭৩, পৃ ৮-১৭। 

১১৮ নগেন সরকার। 

১১৯ নগেন সরকার। সত্যেন সেন, বাংলাদেশের কৃষক সংগ্রাম, পৃ ৩০ । 

১২০ সত্যেন সেন, কৃষকের সংগ্রাম, পৃ ৩০। 

১২১ সত্যেন সেন, বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম, পৃ ৩৭-৪৪ এর প্রথম গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ৮৬-৯০। 

১২২ প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ৯৭-১০৪। 

১২৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১১৫। 

১২৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১১৫-১৬। 

১২৫ পূর্বোক্ত, পৃ ১১৬-১৭। 

১২৬ পূর্বোক্ত, পৃ ১১৭-১৮। 

১২৭ পূর্বোক্ত, পৃ ১১৮-১৯। 

১২৮ পূর্বোক্ত, পৃ ১১৯-২০। 

১২৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১২০-২৩। 

১৩০ দৈনিক আজাদ, ১১/২/১৯৪৯। 

১৩১ প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ১২৪। 

১৩২ দৈনিক আজাদ, ১৫/২/৪৯। 

১৩৩ পূর্বোক্ত, ১৬/২/৪৯। 

১৩৪ দেশ বিভাগের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট প্রভাবাধীন একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারী ও বেসরকারী প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণে এমনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে তার অস্তিত্ব রক্ষা করা আর সম্ভব হয় না এবং অল্পকাল পরেই তার বিলুপ্ত ঘটে।-বউ. I 

১৩৫ এই ধরনের ছাত্র প্রতিষ্ঠান তখন ঢাকাতে একটিই ছিলো। তার নাম নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। সরকার ও মুসলিম লীগের পৃষ্ঠাপোষকতায় এই সংগঠনের ছাত্ররাই বিরোধীদলের সভাগুলিতে সুপরিকল্পিতভাবে গুণ্ডামী করতো। এদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেই দবিরুদ্দীন নঈমুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান. আব্দুল মতিন প্রভৃতি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ’ নামে একটি নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। 

১৩৬ নওবেলাল, রাজধানী ঢাকার চিঠি পৃ ৬, ২৩/২/৪৯। 

১৩৭ পূর্বোক্ত। 

১৩৮ প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ১২৪-২৫। 

১৩৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১২৫-২৬। 

১৪০ পূর্বোক্ত, পৃ ১২৬-২৭। 

১৪১ পূর্বোক্ত, পৃ ১২৭-২৮। 

১৪২ পূর্বোক্ত, পৃ ১২৭-২৯।

১৪৩ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩০-৩১।

১৪৪ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩১-৩২। 

১৪৫ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩২। 

১৪৬ দৈনিক আজাদ, ১৩/৮/৪৯। 

১৪৭ প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ১৩২-৩৩। 

১৪৮ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৩। 

১৪৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১৩৪। 

১৫০ চতুর্থ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। 

১৫১ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির প্রথম খণ্ড, দশম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। 

১৫২ EBL Assembly Proceedings, 10th March, 194৪, Vol. IV. No. ৪. P 213 

১৫৩ P. 216-17. 

১৫৪ সত্যেন সেন, বাংলাদেশের কৃষকের আন্দোলন, পৃ ৯২-১০১ এবং আজহার হোসেন, রমেন মিত্র। 

১৫৫ আজহার হোসেন, রমেন মিত্র। 

১৫৬ দৈনিক আজাদ, ১২/১/১৯৫০। ১৫৭ পূর্বোক্ত আজহার হোসেন। 

১৫৮ আজহার হোসেন। 

১৫৯ দৈনিক আজাদ, ১২/১/১৯৫০। 

১৬০ আজহার হোসেন, এবং সত্যেন সেন, পূর্বোক্ত, পৃ ১০৩। 

১৬১ সত্যেন সেন, পূর্বোক্ত, পৃ ১০৪-৫ এবং আজহার হোসেন। 

১৬২ আজহার হোসেন। 

১৬৩ দৈনিক আজাদ, ১২/১/১৯৫০। 

১৬৪ পূর্বোক্ত। 

১৬৫ সত্যেন সেন, পূর্বোক্ত পৃ ১০৫-০৬। 

১৬৬ পূর্বোক্ত, পৃ ১০৬-০৮। 

১৬৭ সাঁওতালদের ওপর এই অত্যাচারের ব্যাপারে আমি নবাবগঞ্জের অনেক স্থানীয় লোকজনের সাথেও আলাপ করেছি। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রায় একইভাবে অত্যাচারের এই বর্ণনা দিয়েছেন। 

১৬৮ আজহার হোসেন, আবদুল হক, রনেশ দাশগুপ্ত। 

১৬৯ আব্দুল হক এবং সত্যেন সেন : পূর্বোক্ত, পৃ ১১০। 

১৭০ আজহার হোসেন, আবদুল হক। 

১৭১ সত্যেন সেন, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১১১-১২। 

১৭২ এই জবানবন্দীটি কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হওয়ায় ইস্তাহার আকারে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি সেটি ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন স্থানে বিলি করেছিলো। ইস্তাহারটির একটি ছবি এই বইয়ে দেওয়া হয়েছে।-ব.উ.। 

১৭৩ চতুর্থ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। 

১৭৪ আবদুল হক। 

১৭৫ পূর্বোক্ত, সাঁওতালরা ইলা মিত্রকে রাণী বলতো।-ব.উ.। 

১৭৬ পূর্বোক্ত। 

১৭৭ পূর্বোক্ত। 

১৭৮ EB Lgislative Assembly Proceeding, Fourth Session, 1949-50, Vol. IV, No. 6, P 12. 

১৭৯ পূর্বোক্ত। 

১৮০ পূর্বোক্ত। 

১৮১ পূর্বোক্ত। 

১৮২ পূর্বোক্ত। 

১৮৩ পূর্বোক্ত পৃ ১৩-১৯। 

১৮৪ পূর্বোক্ত পৃ ১৫। 

১৮৫ পূর্বোক্ত পৃ ১৬। 

১৮৬ পূর্বোক্ত পৃ ১৯। 

১৮৭ কামাখ্যা রায় চৌধুরী (লিখিত নোট), নগেন সরকার, খুলনা (লিখিত নোট)। 

১৮৮ পূর্বোক্ত। 

১৮৯ তে-ভাগা আন্দোলন প্রত্যাহার ও দেশ বিভাগের পর জোতদাররা অনেক এলাকায় উল্টো তে-ভাগা অর্থাৎ জমির মালিকের দুই ভাগ ও বর্গাদারের এক ভাগ চালু করেছিলো। 

১৯০ পূর্বোক্ত। 

১৯১ কামাখ্যা রায় চৌধুরী (লিখিত নোট)। 

১৯২ নগেন সরকার, খুলনা (লিখিত নোট)। 

১৯৩ তৎকালে খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলনের নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের মধ্যে নিম্নোক্তদের নাম উল্লেখযোগ্য : বিষ্ণু চ্যাটার্জী, শচীন বসু, কুমার মিত্র, সমর মিত্র, রতন সেন, কামাখ্যা রায় চৌধুরী, সুধম্ব রায়, অক্ষয় মণ্ডল, বিভূতি রায়, ডাঃ আব্দুর রহিম, নগেন সরকার, নকুল মল্লিক, নিখিল ঘোষ, আফসার মোড়ল, কেরামত মোড়ল, বিলায়েত মোড়ল, বীরেন বিশ্বাস, চাঁদমনি মণ্ডল, নলীনি মণ্ডল, বিষ্ণু বৈরাগী, নগেন বিশ্বাস, শরৎ সরকার, সুধীর চ্যাটার্জী, অনীল চক্রবর্তী, সরেশ বসু, সন্তোষ দাসগুপ্ত, ডাঃ অতুনেন্দ্র দাস, গোপীনাথ ব্যানার্জ্জী, ডাঃ জ্ঞানেন্দ্র কাঞ্জীলাল, সতীশ হালদার, নগেন মল্লিক। এঁদের প্রায় প্রত্যেকের ওপর সে সময় গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করা হয়। ১০ 

১৯৪ কামাখ্যা (নোট), নগেন (নোট)। 

১৯৫ নগেন (নোট )। 

১৯৬ কামাখ্যা (নোট )। 

১৯৭ পূর্বোক্ত। 

১৯৮ কামাখ্যা (নোট), নগেন (নোট)। 

১৯৯ দৈনিক আজাদ, খুলনা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতার রিপোর্ট, রবিবার ১/৫/৪৯। 

২০০ EB Assemly Proceedings 10th March, 1050, Vol. IV, No. ৪, P. 1৪3 [এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তান সরকার কিভাবে পশ্চিম বাঙলা ও পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে ব্যাপক হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিলো তার বিবরণের জন্যে চতুর্থ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।-ব.উ. 

২০১ কামাখ্যা (নোট), নগেন (নোট)। 

২০২ পূর্বোক্ত। 

২০৩ সাইফ-উদ-দাহার। 

২০৪ পূর্বোক্ত। 

২০৫ পূর্বোক্ত। 

২০৬ শান্তি সেন। 

২০৭ পূর্বোক্ত। 

২০৮ পূর্বোক্ত। 

২০৯ পূর্বোক্ত। 

২১০ নির্দিষ্ট ধানী খাজনায় জমির মালিকের প্রাপ্য পরিশোধ করার প্রথা। অনেকটা টঙ্ক প্রথার মতো। এই প্রথা বিচ্ছিন্নভাবে পূর্ব বাঙলার প্রায় সর্বত্রই কিছু কিছু ছিলো। 

২১১ প্রমথ গুপ্ত, যে সংগ্রামের শেষ নেই, পৃ ১৩৪; সুখেন্দু দস্তিদার, সুধাংশু বিমল দত্ত।

২১২ খাজা নাজিমুদ্দীন, EB Assemly Proceedings, 24 / 3 / 194৪ Vol. I. No. 2, P, 49. 

২১৩ নওবেলাল, ১৩/৫/১৯৪৮।

২১৪ দৈনিক আজাদ, ১১/৩/১৯৪৯। 

২১৫ নওবেলাল, ১৭/৩/১৯৪৯। 

২১৬ ইস্তাহারটির নম্বর : EBGP (wari) -49 / 50-96W1-0M. 

২১৭ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’র প্রথম খণ্ড দ্রষ্টব্য।-ব.উ.। 

২১৮ দৈনিক আজাদ, ২৬/৮/১৯৪৯ এবং নওবেলাল ১/৯/৪৯ পৃ ৫। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *