তৃতীয় পরিচ্ছেদ : দুষ্ট চক্র

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – দুষ্ট চক্র

‘দশ চক্রে ভগবান ভূত’—প্রাচীন প্রবাদ।

‘চক্রান্ত করিলা চক্রী চক্র আচ্ছাদনে’—দ্বিজ বংশীদাস, বিষহরি ও পদ্মাবতীর পাঁচালী।

রানী ভবানী—‘এ চক্রান্ত কৃষ্ণনগরাধিপের উপযুক্ত নয়’—নবীনচন্দ্র সেন, পলাশীর যুদ্ধ।

মুর্শিদকুলী খানের আমল থেকে সমাজের উপরিস্থিত অনেকগুলি ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীবিন্যস্ত স্বার্থ নবাব দরবারে প্রবিষ্ট হয়েছিল। আগের অধ্যায়ে তা আমরা দেখেছি। আলিবর্দি খানের আমলে ঐ সামাজিক শক্তিগুলি যে আকার ধারণ করেছিল, তারও পর্যালোচনা হয়েছে। এবার চক্রের প্রধান প্রধান উদ্যোক্তাদের আদি কর্মজীবন লক্ষ্য করলে বিভিন্ন দরবারী শক্তিগুলি ষড়যন্ত্রের প্রাক্কালে কি ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মূলত তিনটি আলাদা আলাদা বৈষয়িক স্বার্থ দরবারে প্রবিষ্ট হয়েছিল তা দেখা গেছে— মোগল রাজপুরুষবৃন্দ, হিন্দু জমিদারবর্গ ও নানাদেশী শেঠ সওদাগর প্রমুখ। এঁদের মধ্যে হিন্দু জমিদাররা সমষ্টিগতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এমন অনেক জনশ্রুতি থাকলেও তার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। মূলত রাজপুরুষ ও বণিকবৃন্দের সঙ্গে ইংরেজদের চক্র গঠিত হয়েছিল। দরবারের প্রধান প্রধান ব্যক্তি—মীরজাফর, রায় দুর্ল্লভ, জগৎশেঠ এবং সেই সঙ্গে আমীরচাঁদ আদি কয়েকজন বণিক এবং কৃষ্ণচন্দ্র ইত্যাদি কয়েকজন জমিদারের কার্যকলাপের দিকে লক্ষ্য রাখলে পলাশীর ষড়যন্ত্রের প্রকৃতি এবং জনমানসে তার প্রতিফলন সম্যকভাবে অনুধাবন করা যাবে।

বাংলা নাটকে দেশদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকরূপে মীর জাফরের স্থান সুনির্দিষ্ট আছে। এমনকি স্কুলের ছেলেদের মধ্যেও খেলার সূত্রে ঝগড়ার সময় দলত্যাগীকে ‘বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর’ বলে সম্বোধন করতে দেখা যায়। এই নাটকীয় চরিত্রের পেছনে যে ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন তাঁর প্রকৃত স্বরূপ ধরতে হলে একটু পুর্বানুবৃত্তি দরকার। সে যুগের লোকে তাঁকে দেশদ্রোহী বলে ভাবতে অভ্যস্ত ছিল না। তাদের চোখে মীর জাফর বিশ্বাসঘাতক। কারণ তিনি নিমকহারাম—আলিবর্দির নুন খেয়ে তিনি আলিবর্দির নাতির সর্বনাশ করেছিলেন। সে অর্থে আলিবর্দিও বিশ্বাসঘাতক ছিলেন—সুজাউদ্দিনের নুন খেয়ে তিনি তাঁর ছেলেকে হত্যা করে মসনদ দখল করেন। মীর জাফরের অপর অখ্যাতি—তিনি কাপুরুষ ও অকর্মণ্য। সেকালের বিচারে কাপুরুষতা দেশদ্রোহিতার মতো অলীক নয় বটে। বর্গিবিভ্রাটের মাঝামাঝি সময় থেকে ধরলে মীর জাফরের বিরুদ্ধে এই দ্বিতীয় অভিযোগটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু তিনি বরাবর কাপুরুষ এবং সম্পূর্ণ অকর্মণ্য হলে দুই দুইবার সুবাহ্ বাংলা-বিহার-ওড়িশার মোগল সওয়ার বাহিনীর বক্শী হতে পারতেন না। কিভাবে ঐ পদ পেলেন তা বিচার করে দেখা উচিত। মীর জাফরের পদোন্নতি অনুসরণ করলে তদানীন্তন মোগল মনসবদাররা কেমন ধাপে ধাপে উঠতেন তার কিছু আন্দাজ পাওয়া যাবে। যেহেতু মীর জাফর বক্শী হয়েছিলেন, সেই সূত্রে মোগল সওয়ার বাহিনীর ক্রমহ্রাসমান সমরক্ষমতার পরিচয়ও কতক পরিমাণে মিলবে।

মীর জাফর উচ্চবংশীয় অশিক্ষিত আরব সৈনিক ছিলেন। তাঁর বাবা আরবের নজফ প্রদেশের সৈয়দ। তাঁর নাম সৈয়দ আহমদ নজফি। তিনি কি করতেন এবং এই পরিবার ভারতবর্ষে কবে কি ভাবে এল তা জানা যায় না। ১৭৩৪ খ্রীস্টাব্দে প্রথম মীর জাফরকে ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাওয়া যায়। তখন তিনি নবাব সুজাউদ্দিন খানের একজন নিম্নপদস্থ সেনানী। ঐ বছর নবাবের হুকুমে তিনি রীতিমতো লড়াই করে বাঁকি বাজারের কেল্লা থেকে উদ্ধত ওলন্দাজদের তাড়িয়ে দেন। এতে তাঁর বীরত্বের খ্যাতি হয়। গিরিয়ার লড়াইয়ে তিনি সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে আলিবর্দি খানের দলে লড়াই করেন। সেই থেকে তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। এতদিন তিনি মোগল সওয়ার বাহিনীর জমাদার ছিলেন—তন্খা ছিল মাসে ১০০ টাকা। আলিবর্দি খান মুর্শিদাবাদে নবাব হয়ে বসার পর মীর জাফর পুরাদস্তুর মনসবদার বনে যান। তাঁর তন্খা নির্দিষ্ট হয় মাসে ৫০০ টাকা। আলিবর্দির সৎবোনের সঙ্গে বিয়ে হয়। এরপর তিনি দুঃসাহসিকভাবে নবাবের জামাই সৈয়দ আহমদ খানকে ওড়িশার বিদ্রোহীদের হাত থেকে উদ্ধার করেন। ওড়িশার এই লড়াইয়ের সময় তিনি হাজারী মনসবদার ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ বর্গিরা বাংলা আক্রমণ করে। নবাব বন্দী হতে হতে কোনোমতে বেঁচে যান। বর্গিদের সঙ্গে গোড়ার দিকের লড়াইয়ে মীর জাফর বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করে নবাবের আস্থাভাজন হন। ১৭৪৫ খ্রীস্টাব্দে দেখা যায় মুস্তফা খান, আতাউল্লাহ্ খান, শামসের খান ইত্যাদি প্রধান প্রধান ছয় জন দামামা বিশিষ্ট সেনানীর মধ্যে মীর জাফরও একজন দামামার অধিকারী সেনানীরূপে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন। সেবার সওয়ার বাহিনীর প্রথম সারিতে লড়াই করে তিনি রঘুজী ভোঁসলেকে এমন বিধ্বস্ত করে ফেলেন যে কোনোমতে রঘুজী প্রাণ নিয়ে পালান। সেই থেকে নবাবের ধারণা হয় মীর জাফর একজন বিশ্বস্ত ও সাহসী সেনাপতি। এই সময় থেকে সুবাহ বাংলার বক্শী (Paymaster-General) পদে নিযুক্ত হয়ে তিনি নবাবের দক্ষিণ হস্ত ও প্রধান সেনাপতিরূপে দরবারে প্রতিপত্তি লাভ করেন।

অকস্মাৎ কাপুরুষতা ও বিশ্বাসঘাতকতার দোষে দরবারে মীর জাফরের প্রতিপত্তি নড়ে গেল। ওড়িশাতে স্থানীয় শাসনকর্তা রায় দুর্লভ মারাঠাদের হাতে বন্দী হবার পর সেখানে মোগল শাসন প্রায় লোপ পেতে চলেছিল। ঐ অঞ্চলের মারাঠা ঘাঁটিগুলি ভেঙে দেবার জন্য নবাব মীর জাফরকে দক্ষিণ দিকে যুদ্ধ করতে পাঠালেন। তখন ওড়িশার নায়েব নাজিম নবাবের জামাই সৈয়দ আহমদ খান। তাঁর অধীনে মীর জাফর নায়েব নিযুক্ত হলেন। নবাবের জামাই মুর্শিদাবাদে রইলেন, যুদ্ধে গেলেন মীর জাফর। ওড়িশার নায়েব পদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মেদিনীপুর ও হিজলীর ফৌজদার পদেও নিযুক্ত করা হল। নতুন পদের মর্যাদা অনুযায়ী নবাবের কাছ থেকে তিনি বহুমূল্য খেলাৎ পেলেন— একটি হাতি, একটি ঘোড়া, একখানা বাঁকা তলোয়ার, একখানা ছুঁচোল তলোয়ার, একটা চওড়া সরপেচ এবং এক বাক্স মণিমুক্তা। যুদ্ধযাত্রার আগে মীর জাফর মামাতো ভাই মীর ইসমাইলকে দরবারে বক্শীর কাজ চালাবার জন্য উকিল নিযুক্ত করে রেখে গেলেন। হিজলীর ফৌজদারী কার্য পরিচালনার জন্য কর্মদক্ষ সুজন সিংহকে সেখানে পাঠালেন। তারপর সাত হাজার ঘোড়সওয়ার ও বারো হাজার পদাতিক নিয়ে কটক রওনা দিলেন। পথে মেদিনীপুরে মারাঠাদের দেখা পেয়ে তাদের জলেশ্বর পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে নিজে কাঁসাই নদীর এপারে তাঁবু ফেললেন। এমন সময় খবর এল রঘুজীর ছেলে জানোজী আসছেন, সঙ্গে নাকি বিরাট এক দল। মীর জাফরের সঙ্গে ষোল-সতের হাজার লোক, তবু তাঁর হৃৎকম্প হল। শত্রুরা দলে কত ভারি সে খবর না নিয়েই তিনি পড়ি মরি করে বর্ধমানের দিকে দৌড়লেন। তাঁর পেছন পেছন ছুটলেন জানোজী। আলিবর্দি খান চরের মারফৎ সব খবর রাখতেন। মীর জাফরকে সাহায্য করবার জন্য নবাব আতাউল্লাহ্ খানকে পাঠালেন। বর্ধমানে দুই সেনাপতির দেখা হল। এখানে দূর দেশ থেকে আগত আতাউল্লাহ্ খানের আশ্রিত এক লড়াকু ফকির এসে এঁদের সঙ্গে জুটলেন।

এই ফকিরের নাম মীর আলি আসগর, তার সঙ্গে নিজের খেতাব জুড়েছেন ‘কোবরা’। সঙ্গে ভক্ত আতাউল্লাহ্ খানের টাকায় ছয়-সাতশো ঘোড়ায় চড়া অনুচর, সবাই তাঁর মুরিদ বা রিশ্তাদার। মনসবদার মহলে মীর আলি আসগর কোবরার দারুণ নামডাক। অনেকের বিশ্বাস, একবার তিনি কুয়োয় পড়ে গেছিলেন, তাঁর তল্লাশ করতে গিয়ে লোকে দেখল তিনি জলের উপর শূন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। ফকির সাহেব মুরিদবর্গপরিবৃত হয়ে কথার মধ্যে মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞানের জানা অজানা আরবী পরিশব্দ ব্যবহার করে এই সব ধারণায় তা দিতেন, আর ভক্তরা জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘হ্যাঁ, এ সবই শিখেছিলাম মনিবের (অর্থাৎ হজরৎ মহম্মদের) দুই নাতির সঙ্গে— নবীজী, যখন তাঁদের তালিম দিতেন তখন।’ ফকির বুজুর্‌গ (জ্ঞানী) ছিলেন কি না বলা যায় না, কিন্তু বীর ছিলেন। আতাউল্লাহ্ খানের সঙ্গে তিনি সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বর্গিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলেন। মারাঠারা হটে গেল। মীর জাফর হাঁপ ছাড়লেন।

তখন ফকির সাহেব আতাউল্লাহ্ খানের কানে কানে মন্ত্র দিতে শুরু করলেন— নবাব এখানে পৌঁছলে মীর জাফরের সাহায্যে তাঁকে খতম করুন আর নিজে মসনদ দখল করুন। মীর মোগলি খান নামে মীর জাফরের আস্থাবান এক অবিমৃষ্যকারী অনুচরের মারফৎ দুই সেনাপতি চক্রান্ত করলেন—আতাউল্লাহ্ খান হবেন মুর্শিদাবাদের নবাব আর মীর জাফর পাটনার নবাব। কিন্তু কথাটা এক কান দু-কান হয়ে মীর জাফরের বন্ধু আবদুল আজিজের কানে উঠলে তিনি ও অন্যান্য বন্ধুরা মীর জাফরকে খুব করে তিরস্কার করলেন। বিপদের সম্যক গুরুত্ব বুঝতে পেরে মীর জাফর পিছিয়ে গেলেন, আর কথাটা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় মীর মোগলি খান প্রাণ নিয়ে পালালেন। গোয়েন্দা মারফৎ খবর পেয়ে নবাব বিলক্ষণ ক্রুদ্ধ হলেন। কিন্তু আতাউল্লাহ্ খান ও মীর জাফর দুজনেই বিবাহসূত্রে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, তাই বিচক্ষণ ও দয়ালু আলিবর্দি খান গুরু পাপে লঘুদণ্ড বিধান করলেন। আতাউল্লাহ্ খান মনসব চ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করলেন। মীর জাফরকে পদচ্যুত করে নবাব নূরুল্লাহ্ বেগ খানকে বকশী এবং মীর জাফরের অধস্তন কর্মচারী সুজন সিংহকে হিজলীর ফৌজদার নিযুক্ত করলেন। মীর জাফরের রিসালা ভেঙে দেওয়া হল। হুকুম হল, যারা চায় তারা নবাবের নাতি সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র রিসালায় যেতে পারে। অনেকে তাই করল।

মীর জাফর মুর্শিদাবাদ গিয়ে নওয়াজিশ মুহম্মদ খানের পায়ে পড়লেন। নবাবের প্রিয় জামাই আশ্বাস দিলেন, কিছু দিন সবুর করুন, জলদি দরবারে জায়গা হয়ে যাবে। হলও তাই। কয়েক মাস বাদেই পাটনায় আফগানরা বিদ্রোহ করে বসল (১৭৪৮)। এই বিপদে বৃদ্ধ নবাব ভগ্নীপতিকে ডেকে এনে আবার বক্শী পদে বসিয়ে দিলেন। আলিবর্দির সব চেয়ে বড়ো সেনাপতি দুর্ধর্ষ পাঠান বীর মুস্তফা খান বিদ্রোহে নষ্ট হলেন। বিদ্রোহীরা ছত্রখান হয়ে গেল। কিন্তু পুনরায় মীর জাফরের বক্‌শীগিরিতে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ঘুণ ধরল। কিছুদিন যেতে না যেতেই খাজা আবদুল হাদি খান নামে ঘোড়সওয়ারদের এক নিম্নপদস্থ কাবুলী সেনানী নিজের এক দেশোয়ালীর সঙ্গে দরবারে হাজির হয়ে সর্বসমক্ষে নবাবের কাছে জাহির করলেন— ‘হুজুর, দেওয়ানের সঙ্গে বকশীর সাজস রয়েছে। সওয়ারদের হাজিরা জেয়াদা দেখিয়ে গাদা গাদা টাকা তছরূপ হচ্ছে। খাতায় যত সওয়ারের নাম উঠছে আসলে তার সিকিও নেই। সাবুদ চান তো আমাদের নিজেদের রিসালার হিসাবটাই খতিয়ে দেখুন। খালি আমাদের নয়, সব কটা রিসালারই এক হাল। এত্‌বার না হয়, স্রেফ এক দিনের জন্য সওয়ার হাজিরার নিকাশ আমাদের হাতে তুলে দিন।’ শুনে নবাব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। দেওয়ানীর কর্মচারীদের উপর হুকুম হল তারা যেন ঐ দুই কাবুলীর সঙ্গে গিয়ে সব হাজিরার হিসাবের তদারকি করে। হুকুম শুনে দরবারের প্রত্যেক মনসবদারের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। দুই কাবুলী সত্যান্বেষী দরবারের আমীর ওমরাওদের কারো মান মর্যাদা মনসব খেতাব গ্রাহ্য না করে প্রত্যেকের খাতা খুলে দেখিয়ে দিলেন— ‘চলছে যা জুয়াচুরী নাহি তার তুলনা।’ হাজিরার তদারকিতে দেখা গেল, যে মনসবদার মাসে মাসে সতেরশ ঘোড়সওয়ারের মাইনে টানছে, তার তাঁবে সত্তর-আশিটা আহাদিও নেই। আর খাতায় যাদের এক হাজার সওয়ার দেখান আছে, আসলে তারা একশো ঘোড়াও হাজির করতে পারে না। ঠক বাছতে গাঁ উজাড়। কিন্তু দায়িত্ব বর্তাল বকশীর উপর, কারণ হাজিরা আর মাইনে তাঁর জিম্মায়। মীর জাফরের উপর বিশেষ অসন্তুষ্ট হয়ে নবাব হুকুম দিলেন, খৃাজা হাদি খানকে নায়েব বক্শী করা হোক। ঐ পদে ছিলেন মীর জাফরের মামাতো ভাই মীর ইসমাইল। বিশেষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেনাপতি মামাতো ভাইকে বরখাস্ত করে তার জায়গায় কোথাকার এক কাবুলীকে বহাল করতে বাধ্য হলেন।

ক্রমাগত যুদ্ধ করে নবাব ও বর্গি দু দলই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বর্গিদের দিক থেকে এই সময় মীর জাফরের কাছে সন্ধির প্রস্তাব এল। মীর জাফর বুড়া নবাবকে সে প্রস্তাব জানালেন। তাঁরই মধ্যস্থতায় দু দলে অবশেষে সন্ধি হয়ে গেল। তখন দরবারে নানান দল চাড়া দিয়ে উঠল। নিজেদের মধ্যে রেষারেষি থাকলেও সব কটা দল নবাবের নাতির বিপক্ষে। একদিকে রমণীরঞ্জন হোসেন কুলী খান, আর একদিকে বকশীপদালঙ্কৃত মীর জাফর। নাতির পথ নিষ্কণ্টক করতে নবাব দুই আমীরের বিরোধে তা দিতে লাগলেন। হোসেন কুলী খান সিরাজের হাতে নিহত হবার পর মীর জাফরের রিসালা থেকে অনেক সওয়ার বরখাস্ত হল। ততদিনে নবাবের জামাই নওয়াজিশ মুহম্মদ খান মারা গেছেন। তাঁর দলটাই দরবারে ভারি ছিল। তাঁর নায়েব হোসেন কুলী খান ছিলেন ঐ দলের আসল চালনাকারী। মনিব ও নায়েবের অবর্তমানে এই দলের কর্তৃত্ব গিয়ে পড়ল নওয়াজিশ পত্নী গহসেটি বেগম এবং তাঁর সেনাপতি মীর নজর আলি ও নায়েব রাজবল্লভের হাতে। এঁদের দখলে ঢাকার নিয়াবতি এবং ঐ নিয়াবতের বিপুল দৌলত। অন্য দিকে মীর জাফর, তাঁর হাতে বক্শীর দফতর। এদিকে পূর্ণিয়াতে বসে আছেন শওকত জঙ্গ, তিনিও নবাবের নাতি এবং সেখানকার ফৌজদার। বুড়া নবাব মীর জাফরকে দিয়ে কোরান হাতে শপথ করালেন, তাঁর মৃত্যুর পর তিনি সিরাজউদ্দৌলাহ্‌কে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। উদরী রোগে বুড়া নবাবের ইন্তিকাল হল। সেনাপতি কথা রাখলেন—কসমের খেলাপ করলেন না। কারণ গহসেটি বেগম—নজর আলি—রাজবল্লভের দলের হাতে ক্ষমতা যাক এটা তাঁর পক্ষে কাম্য ছিল না। ঐ সময় মীর জাফর যদি সিরাজের বিরোধিতা করতেন, তা হলে তরুণ নবাব চট করে গহসেটি বেগমকে বন্দী করতে পারতেন না।

তার পরই চাকা ঘুরে গেল। গহসেটি বেগমের চক্রান্ত যদি সফল হত, তাহলে নওয়াজিশ মুহম্মদ খানের পালিত শিশু পৌত্রকে (এই শিশু সিরাজের ছোট ভাইয়ের ছেলে) মসনদে চাপিয়ে মীর নজর আলি রাজত্ব করতেন, সেটা মীর জাফরের পক্ষে মোটেই সুবিধার হত না। মীর নজর আলি দুজন বড়ো বড়ো মনসবদার রহিম খান ও দোস্ত মুহম্মদ খানের হাতে প্রচুর টাকা গুঁজে দিয়ে কোনোমতে ছাড়া পেয়ে দিল্লী চলে গেলেন। এবং সেখানে দল পাকাবার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন।১০ আপাতদৃষ্টিতে মীর জাফর নিষ্কন্টক হলেন। কিন্তু এখন আর তরুণ নবাব ও প্রৌঢ় সেনাপতির পরস্পরকে দরকার রইল না। যে মুহূর্তে মীর জাফর দেখলেন বিরুদ্ধ দলটা ঘায়েল হয়ে গেছে, সেই মুহূর্তে তাঁর নিজের আসনটাও টলে গেল। ক্ষমতা হাতে পেয়ে সিরাজ নিজমূর্তি ধরলেন। গহসেটি বেগমের মোতিঝিল প্রাসাদ ধূলিসাৎ করে মুর্শিদাবাদ দরবারে ফিরে এসেই নতুন নবাব পুরোন সেনাপতির উপর রুষ্ট হয়ে উঠলেন। মীর মদন নামে এক অখ্যাত সেনানীকে ঢাকার নিয়াবত থেকে জরুরী তলব করে আনানো হল এবং তাঁর উপর নবাবের খাস রিসালার ভার পড়ল। দেওয়ান বা প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হলেন তরুণ নবাবের সহচর আর এক ভুঁইফোঁড়—কাশ্মীরী মোহনলাল। রাতারাতি মোহনলাল পাঁচ হাজারী মনসবদার বনে গেলেন। সব দরবারী মনসবদারদের মোহনলালকে সেলাম জানাবার জন্য তলব করা হল। অনেক ওমরাও সেলাম বাজাতে গেলেন, কিন্তু মীর জাফর গেলেন না। এদিকে দরবারে নবাবের ব্যবহার দেখে সেনাপতি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। একদিকে আমীর ওমরাওদের সামনে পেলেই চক্ষু রক্তবর্ণ করে নবাব অশ্রাব্য গালিগালাজ বর্ষণ করতে থাকেন, আর একদিকে ইয়ার দোস্ত পরিবৃত হয়ে মস্করার মজলিসে আলিবর্দি খানের সম্মানিত পুরোন মনসবদারদের প্রত্যেককে ধরে ধরে এমন এক-একটা নামকরণ করেন যা শুনলে হাসি সম্বরণ করা কঠিন হয়ে ওঠে। মোট কথা দরবারে আলিবর্দির প্রধান প্রধান সেনাপতিদের পক্ষে আত্মসম্মান বোধ বজায় রেখে চলা অসম্ভব হয়ে উঠল। মীর জাফর, রহিম খান এবং বুড়া ওমর খান প্রকাশ্য দরবারে অপমানিত হলেন।১২

কিন্তু এদের অসন্তোষ দানা বাঁধবার আগেই সবাইকে নিয়ে নবাব যুদ্ধযাত্রায় বেরোলেন। কলকাতা ফতেহ্ করে তার নাম রাখলেন আলিনগর। মীর জাফরের রিসালায় ছিলেন মীর্জা ওমর বেগ নামে একজন সাহসী ও উন্নতচেতা সেনানী। ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণের সময় ইংরেজদের কয়েকজন বিবি তাঁর হাতে পড়ায় তিনি তাঁদের অঙ্গস্পর্শ না করে সযত্নে রাত পর্যন্ত লুকিয়ে রাখলেন। রাত্রিবেলা খবর পেয়ে মীর জাফর দ্রুতগামী দাঁড়ে টানা নৌকায় বিবিদের ওমর বেগের সঙ্গে ড্রেকের জাহাজে পাঠিয়ে দিলেন। বিবিদের খসমরা মীর্জা ওমর বেগের সদাচরণের কথা শুনে কৃতজ্ঞচিত্তে কুড়িয়ে বাড়িয়ে তাঁর হাতে কিছু জহরত তুলে দিতে গেলে তিনি বাধা দিয়ে বললেন, ‘সাহেবান্, আমি যা করেছি তা কোনো বক্‌শিশের জন্য নয়। আপনার কওমে আপনি যেমন খানদানি আদমি, আমার কওমে আমিও তেমনি একজন রইস ইমানদার লোক। ইমান থাকলে কেউ যা করবে আমি তার বেশি কিছু করিনি। যা করেছি তার জন্য আপনাদের ইয়াদ থাকা ছাড়া আর কিছু আমার পাওনা নেই।’১৩ এই বলে নৌকায় লাফিয়ে পড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন এবং তীরে উঠে মীর জাফরের সঙ্গে মিলিত হলেন। মীর্জা ওমর বেগের মাধ্যমে ভবিষ্যতের গর্ভমুখে ইংরাজদের সঙ্গে মীর জাফরের একটি যোগসূত্র স্থাপিত হল।

আপাতত মীর জাফর যুদ্ধে বিধ্বস্ত ইংরেজদের ধর্তব্যের মধ্যে আনলেন না। তাঁর নজর গেল শওকৎ জঙ্গের দরবারে। মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে তিনি গোপনে পূর্ণিয়া দরবারের সঙ্গে যোগসাজস করলেন। খুব সন্তর্পণে সেনাপতি রাজধানী থেকে পূর্ণিয়ায় চিঠি দিলেন— ‘এখানকার সব আমীর ওমরাও মনসবদারান্, আমি নিজে, সৈয়দ আহমদ খানের বেটার দিকে (শওকৎ জঙ্গের দিকে) চেয়ে আছি। সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র জুলুম রোজ রোজ বেড়ে উঠছে, তা থেকে আপনিই সবাইকে খালাস করতে পারেন। আপনাকে কিছু করতে হবে না, খালি মসনদে একজনের বসার দরকার। কয়েক শর্তে আমরা সবাই নিজের হাতে আপনাকে মসনদে বসাবো।’১৪ শওকৎ জঙ্গের ঘটে যদি কিছুমাত্র বুদ্ধি থাকত তাহলে এই ষড়যন্ত্র সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়াত। আইনত শওকৎ জঙ্গেরই নবাব হবার কথা। তিনি এক কোটি টাকা খাজনা দেবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লী দরবার থেকে নিজের নামে ফারমান আনিয়েছিলেন। অতএব আইনের চোখে বাংলার শাসনকর্তা শওকৎ জঙ্গ, সিরাজউদ্দৌলাহ্ নন।

কিন্তু হঠাৎ সৌভাগ্যে অস্থিরমতি শওকৎ জঙ্গের মাথা ঘুরে গেল। একজন দরবারী তাঁকে ‘আলমপনাহ্’ সম্বোধন করায় তিনি খুশিতে এমন অভিভূত হয়ে গেলেন যে দিল্লীতে দরবারে লিখে পাঠালেন, এখন থেকে আলমপনাহ্ বলে সম্বোধন না করে তাঁকে যেন কোনো চিঠি লেখা না হয়। খামখেয়ালি হবু নবাব দরবারে বলতে লাগলেন ‘বাংলা ফতেহ্ করে আগে আবু মনসুর খানের বেটার উপর [অর্থাৎ অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাহ্‌র উপর] গিয়ে পড়বো, তারপর গাজিউদ্দিন খানের ছেলেটাকে [অথাৎ দিল্লীর উজির শিহাবুদ্দিন ইমাদ-উল-মুল্ক্] শায়েস্তা করবো। তখ্তে নিজের পছন্দমতো একজন বাদশাহ্কে বসিয়ে আমি বরাবর লাহোর আর কাবুল যাবো, সেখান থেকে কান্দাহার আর খোরাসান। ঐখানেই থাকবো কেন না বাংলা মুল্লুকের হাওয়াপানি আমার বরদাস্ত হয় না।’১৫

দরবারের আমীর ওমরাওদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার এমন বে-তমীজ হয়ে উঠল যে তাঁর পরামর্শদাতা সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তাবতাবায়ী১৬ বাধ্য হয়ে তাঁকে সাদা কথায় বললেন— ‘সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র ওমরাও মনসবদারান্ যেই বুঝবেন আপনি তাঁর চেয়ে একটুও বেহতর নন, অমনি বেজার হয়ে তমাম আমীর তাঁর কাছে ফিরে যাবেন।’ হলও তাই। শওকৎ জঙ্গের নির্বুদ্ধিতায় মুর্শিদাবাদের সঙ্গে পূর্ণিয়ার ষড়যন্ত্র দানা বাধল না। নবাব সসৈন্যে পূর্ণিয়ায় চড়াও হলেন। পাটনা থেকে সেখানকার নায়েব রামনারায়ণ এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। এতে মীর জাফর বেকায়দায় পড়লেন। তাঁর যুদ্ধ করার মতলব ছিল না। কিন্তু পাটনার ফৌজ এসে পড়ায় যুদ্ধ করতে হল। লড়াই যখন করতেই হবে তখন রীতিমতো লড়াই করে মীর জাফর শওকৎ জঙ্গের দলবলকে কাবু করে ফেললেন। একটা গুলি চোখে ঢুকে শওকৎ জঙ্গের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেল।

পূর্ণিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্র বরবাদ হয়ে যাওয়ায় কলকাতার সঙ্গে দরবারে চক্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিল। ইংরেজরা যে লড়াইয়ে উড়িয়ে দেবার মতো লোক নয় তা ক্লাইভ ও ওয়াটসন কর্তৃক কলকাতা দখলের পর বোঝা গেল। আলিনগর উদ্ধার করতে নবাব আবার অভিযানে বেরোলেন। সঙ্গে রইলেন ফৌজের বকশী মীর জাফর। আলিনগরের উপকণ্ঠে সকালের কুয়াশার মধ্যে সাবিৎ জঙ্গ নবাবের শিবিরের ভিতর দিয়ে অকস্মাৎ অভিযান চালিয়ে যেসব মনসবদারদের ভড়কে দিলেন তাদের মধ্যে মীর জাফরও ছিলেন। বস্তুত নবাবের দুই প্রধান সেনাপতি মীর জাফর ও রায় দুর্লভ কোনো যুদ্ধই করলেন না। তাঁদের দুজনের স্বাক্ষরেই আলিনগরের সুলেনামা সম্পাদিত হল। মওকা পেয়ে ইংরেজরা ফরাসীদের হটিয়ে দিয়ে চন্দননগর দখল করে বসল। তখন মীর জাফর, রায় দুর্লভ ইত্যাদি মনসবদারদের বিশ্বাস জন্মাল, এই বাহাদুর ইংরেজদের দিয়ে কার্যসিদ্ধি হবে।

এবার রায় দুর্লভের কথায় আসা যাক।১৭ এঁর পিতা প্রসিদ্ধ জানকীরাম, —রামনারায়ণের আগে যিনি বিহারের নায়েব ছিলেন। নবাবী আমলের শেষ দিকে যে দুজন বাঙালি হিন্দু মনসবদারদের উচ্চতম ধাপে উঠতে পেরেছিলেন, তাঁদের একজন জানকীরাম, অন্যজন রাজবল্লভ। দুজনেই বিহারের নায়েব হয়েছিলেন।১৮ দুর্লভরাম, ওরফে রায় দুর্লভ, ওরফে রাজা মহেন্দ্র, পিতার মতোই উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিলেন। সুবাহ্ বাংলার নিজামত দেওয়ান হয়েছিলেন। দুর্লভরামের বাবা জানকীরাম দক্ষিণরাঢ়ী কায়স্থ ছিলেন। এঁদের বাড়ি হুগলি জেলার জেজুড় গ্রামে। সেখান থেকে দুর্লভরামের ঠাকুরদাদা কৃষ্ণবল্লভ ওড়িশার নায়েব নাজিমের অধীনে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তখন মুর্শিদকুলী খানের জামাই সুজাউদ্দিন খান ওড়িশার নায়েব নাজিম। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর আলিবর্দি খান। জানকীরাম ঐ সময় আলিবর্দি খানের পেশকার রূপে নবাবী শাসনযন্ত্রের নিম্নতর কোঠায় প্রবিষ্ট হন এবং আলিবর্দি খানের পিছন পিছন ধাপে ধাপে উঠতে থাকেন।

সুজাউদ্দিন খান মুর্শিদাবাদের নবাব হলেন। তখন আলিবর্দি খান রাজমহলের ফৌজদার নিযুক্ত হলেন এবং জানকীরাম তাঁর জায়গীরের তত্ত্বাবধায়ক হলেন। এরপর আলিবর্দি খান বিহারের নায়েব নাজিম হলেন, তখন জানকীরাম তাঁর দেওয়ান হলেন। পরবর্তী নবাব সরফরাজ খানকে হত্যা করে আলিবর্দি খান মুর্শিদাবাদের নবাব হয়ে বসলেন। তখন জানকীরাম ‘রাজা’ উপাধি পেয়ে দেওয়ান-ই-তন্ পদে নিযুক্ত করলেন। প্রসঙ্গত বলা যায় ঐ সময় নবাবের বড়ো জামাই নওয়াজিশ মুহম্মদ খান বাংলার দেওয়ান সুবাহ্ এবং জাহাঙ্গীরনগর-পাটনার নায়েব নাজিম হন। নবাবের মধ্যম জামাই সৈয়দ আহমদ খান (শওকৎ জঙ্গের বাবা) ওড়িশার নায়েব নাজিম হন। আর নবাবের কনিষ্ঠ জামাই জয়নুদ্দিন আহমদ খান (সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র বাবা) বিহারের নায়েব নাজিম হন। ঐ সময়ের অন্যান্য পদোন্নতির তালিকা নিম্নরূপ:

মীর জাফর— বক্শী

চিন রায়— রায় রায়ান বা দেওয়ান খালিসাহ্

আতাউল্লাহ্‌ খান— রাজমহল-ভাগলপুরের ফৌজদার

সিরাজউদ্দৌলাহ্— ঢাকা জাহাঙ্গীরনগরের নওয়ারার অধিনায়ক।

ওড়িশাতে ভীষণ অন্তর্বিদ্রোহের জন্য সৈয়দ আহমদ খান সেখানে টিকতে পারলেন না। তিনি নামেই নায়েব নাজিম রইলেন। ওড়িশার শাসনভার আসলে পেলেন তাঁর অধীনস্থ একজন নায়েব। তাঁর নাম মুখলিস আলি খান। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় মারাঠাদের রুখতে তাঁর জায়গায় শেখ মুহম্মদ মাসুম নামে এক বীর সেনাপতিকে নায়েব করে পাঠানো হল, আর তাঁকে সাহায্য করবার জন্য জানকীরামের ছেলে দুর্লভরাম পেশকার নিযুক্ত হলেন। ওড়িশার নায়েবের পেশকার পদ রায় দুর্লভের প্রথম রাজপদ। বর্গি আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় শেখ মুহম্মদ মাসুম নিহত হলেন। রায় দুর্লভ মারাঠাদের হাতে বন্দী হলেন। তাঁর বাবা জানকীরাম নবাবকে পরামর্শ দিলেন— এক কোটি টাকা দিয়ে ভাস্কর পণ্ডিতকে বিদায় করুন। কিন্তু চারদিক থেকে আক্রান্ত হয়েও আলিবর্দি খান সিংহের মতো বিপুল বিক্রমে লড়াই করতে লাগলেন। মারাঠারা মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে জগৎশেঠের কুঠি লুটে নিল। রায় দুর্লভ তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ঐ সময় নিতান্ত দুরবস্থায় রাজধানীতে বসবাস করছিলেন। অন্যান্য প্রধান প্রধান নাগরিকদের সঙ্গে তিনি আবার বন্দী হলেন। মারাঠাদের হটিয়ে দিয়ে নবাব তাঁর সবচেয়ে বড়ো সেনাপতি দুঃসাহসী আফগান বীর মুস্তফা খানের পরামর্শে আবদুল নবী খানকে ওড়িশায় পাঠালেন। আবদুল নবী খান মুস্তফা খানের চাচা। তিনি তিন হাজারী মনসবদার হয়ে ওড়িশার নায়েব পদে যোগ দিলেন। মূর্খ পাঠান বীর সৈনিক হলেও শাসনকর্মের কিছু জানতেন না। ততদিনে রায় দুর্লভ ছাড়া পেয়েছেন। শাসনকার্য চালাবার জন্য তিনি ওড়িশার পেশকার পদে ফিরে গেলেন। বর্গিদের চিরতরে নিকেশ করবার মতলবে মুস্তফা খান এবং রাজা জানকীরাম ভুলিয়ে ভালিয়ে ভাস্কর পণ্ডিতকে সন্ধি করবার জন্য তাঁবুতে ডেকে আনলেন। নবাবের হুকুমে বর্গিরা কচুকাটা হল। এদিকে ওড়িশাতে আবদুল নবী খানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আবদুল রসুল খান নায়েব হলেন। রায় দুর্লভ আগের মতো পেশকার পদে বহাল রইলেন। এই সময় হঠাৎ মুস্তফা খান বিদ্রোহ করে বসলেন। তাঁর সঙ্গে বহু পাঠান সমবেত হয়ে পাটনা দখল করল। আবদুল রসুল খান তাঁর চাচা মুস্তফা খানের দলে যোগ দিলেন। এমতাবস্থায় আলিবর্দি খান রায় দুর্লভকেই ওড়িশার নায়েব পদে নিযুক্ত করে তাঁকে রাজকার্য চালাবার হুকুম দিলেন।

বাবা জানকীরামের খুঁটির জোরে দুর্লভরাম এত দূর উঠলেন, কিন্তু ঐ গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদের যোগ্যতা তাঁর ছিল না। ওড়িশার, নায়েব নিযুক্তকালে তিনি তিন হাজারী মনসবদারের পদ পেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে দামামা, ঝালর যুক্ত পালকী এবং ‘রাজা’ উপাধি। রাজা দুর্লভরাম দেখলেন, পরিস্থিতি ঘোরালো। মুস্তফা খান মারাঠাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিহার তছনছ করে বেড়াচ্ছেন। তাঁর পেছন পেছন ধাওয়া করেছেন আলিবর্দি খান। এদিকে রঘুজী ভোঁসলে সহসা অরণ্য পর্বত ভেদ করে নাগপুর থেকে সটান কটকে হাজির হলেন। রাজা দুর্লভরাম তখন একদল সন্ন্যাসী পরিবৃত হয়ে মহানদীর তীরে যাগযজ্ঞ করেছিলেন। ঐ সন্ন্যাসী ছিল রঘুজীর চর। বর্গিরা আসছে শুনে দুর্লভরাম উষ্ণীষহীন অনাবৃত মস্তকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঘুম থেকে উঠে পালকীতে চড়ে বড়বাটি দুর্গের দিকে ছুটলেন। পথে কটকের রাস্তায় রাস্তায় বর্গিরা লোকেদের কাপড় খুলে লুঠ করছে দেখে তিনি ভয়ে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একটা পোড়ো বাড়িতে লুকোবার চেষ্টা করলেন। তাই দেখে মীর আবদুল আজিজ নামে এক সাহসী সেনানী ছুটে গিয়ে তাঁর হাত ধরে টেনে বললেন, ‘আপনি ভয় খেয়ে কেন নিজেকে বেইজ্জত করছেন? ঘোড়ায় চড়ে আমার পেছন পেছন আসুন। এই লোকগুলি খালি লুঠ করতে ব্যস্ত। বিশ্বাস করুন এখনো কেল্লায় ঢুকবার সময় আছে। ভয় পাবেন না আমি আপনার সাথে আছি।’১৯ এইভাবে ঘোড়ায় চড়ে দুর্লভরাম দুর্গে পৌঁছলেন। বর্গিরা দুর্গ ঘেরাও করল। মীর আবদুল আজিজের মানা না শুনে সন্ন্যাসীদের পরামর্শ মতো দুর্গের বাইরে মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি করতে গিয়ে তিনি তাদের হাতে বন্দী হলেন।

বর্গিরা রাজা দুর্লভরামকে নাগপুরে ধরে নিয়ে গেল।২০ সেখানে তিনি বঢ়ারের সর্দার রঘুজীর হাতে এক বছর বন্দী রইলেন। কি করে তিনি ছাড়া পান সে সম্বন্ধে কায়স্থ সমাজে একটা গল্প প্রচলিত আছে। রায় দুর্লভ ভালো গান করতেন। রোজ কারাগার থেকে তাঁর সেই মনোহর সংগীত শুনে এক সম্ভ্রান্ত মহারাষ্ট্র রমণী তাঁকে ছাড়িয়ে আনবার জন্য নিজের স্বামীকে ধরলেন। তাঁর স্বামী একজন উচ্চপদস্থ মারাঠা রাজপুরুষ, তাঁর অনুগ্রহে দুর্লভরাম ছাড়া পেলেন। বিপুল সমারোহে তাঁর অভ্যর্থনা করে বর্গিরা তাঁকে দেশে পাঠিয়ে দিল। আসল ব্যাপার অন্যরকম। নাগপুরে বন্দী অবস্থায় তিনি পেশোয়ার অনুচর বিশজী ভিকজীকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে পেশোয়া তাঁর হয়ে অধীনস্থ বঢ়ার সর্দার রঘুজীকে কিছু বলে দেন। কিন্তু মিষ্টি কথায় চিড়ে ভেজে না। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন সাহুকর দুর্লভরামকে ছাড়িয়ে আনবার জন্য তিন লক্ষ টাকা ধার দিতে রাজি হলেন। পেশোয়ার কাছে বিশজী ভিকজীর ২৯ ডিসেম্বর ১৭৪৫-এর চিঠিতে দেখা যায় সাহুকরদের মাধ্যমে তিন লক্ষ টাকা খেসারত দিয়ে দুর্লভরাম ছাড়া পেয়েছেন। তিনি মুর্শিদাবাদে পোঁছলে জানকীরামের মুখ চেয়ে আলিবর্দি খান ঐ তিন লক্ষ টাকা মিটিয়ে দিলেন।২১ কিন্তু রায় দুর্লভকে ওড়িশার নায়েবের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদে রাখা যুক্তিযুক্ত নয় বুঝে নবাব মীর জাফরকে ঐ পদে নিয়োগ করলেন।

মীর জাফরের কাপুরুষতায় ওড়িশা আবার মারাঠাদের কবলে চলে গেল তা আমরা এর আগে দেখেছি। নবাব নিজে মীর জাফর ও রায় দুর্লভকে নিয়ে কুচ করে কটক পৌঁছলেন, তাঁর হুকুমে দুই সেনাপতি বড়বাটি দুর্গে বর্গিদের অবরোধ করলেন। শেষ পর্যন্ত অবরুদ্ধ বর্গিরা খালাস পাবার কড়ারে মীর জাফর ও রায় দুর্লভের হাতে আত্মসমর্পণ করল। ওড়িশা আবার মোগল শাসনে এল। কিন্তু সবাই বুঝল এখানে মারাঠাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। নবাব স্থির করলেন কটকে একজন নায়েব রেখে মুর্শিদাবাদে ফিরে যাবেন। তিনি আবার রায় দুর্লভকে নায়েব হতে বললেন। জানকীরামের বুদ্ধিমান পুত্র রাজি হলেন না। তখন নবাব মীর জাফরকে নবাব হতে বললেন। তিনিও রাজি হলেন না। দুজনেরই মাথায় এই চিন্তা ঘুরছে যে বর্ষা পেরোতে না পেরোতেই আবার বর্গিরা হাজির হবে। তখন নিরুপায় নবাব ওড়িশার নায়েব কে হবে তাই নিয়ে জনে জনে অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন। একে একে সব আমীর নারাজ হলেন। শেষে রাজা দুর্লভরামের রিসালার এক খুদে জমাদার শেখ আবদুস সোবহান খান বললেন তিনি রাজি আছেন। এই গরিব রিসালা-দারের নাম আগে কেউ শোনেনি। শেখজাদা বোধহয় ভাবলেন, একদিনের জন্য হাকিম হয়েও বড়ো সুখ। প্রবাদ আছে, পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে। নবাব কটক থেকে ফিরতি পথে বালেশ্বর পৌঁছতে না পৌঁছতে বর্গিরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল। নতুন নায়েব কাটা পড়লেন। রায় দুর্লভ ও মীর জাফর নবাবের হুকুমে মেদিনীপুরে রয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য ওড়িশার মারাঠাদের গতিবিধির উপর নজর রাখা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ওড়িশা হাতে রাখা সম্ভব নয় বুঝে নবাব সন্ধি করে ঐ প্রদেশ বর্গিদের হাতে ছেড়ে দিলেন।

সোম পরিবারের অগ্রগতি এতে আটকাল না। জানকীরাম ইতোমধ্যেই বিহারের নায়েব হয়ে গেছিলেন। সে বৃত্তান্ত এই। পাটনায় নবাবের জামাই সৈয়দ আহমদ খান বিদ্রোহ করবার ফিকির খুঁজছিলেন। অকস্মাৎ মুস্তফা খানের নেতৃত্বে পাঠানদের অভ্যুত্থানে তিনি নিজেই ফৌত হলেন। সৈয়দ আহমদ খানের ছেলে সিরাজউদ্দৌলাহ্ নবাবের চোখের মণি। তিনি ঐ বালককে নিহত পিতার স্থলে বিহারের নায়েব নাজিম নিযুক্ত করলেন। কিন্তু অত বড়ো সুবাহ্‌য় যাতে আর বেবন্দোবস্ত না হয় তা দেখা দরকার। নবাব সঙ্কল্প করলেন পাটনায় আর কোনো মুসলমান হাকিম রাখবেন না—সেখানে থাকবে একজন হিন্দু। হিন্দু নায়েব হাঙ্গামা বাধাবার জোর পাবে না। নবাবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত হিন্দু মুতাসেদ্দী রাজা জানকীরাম। মুস্তফা খান নিহত হবার পর তাঁকেই বিহারের নায়েব নিযুক্ত করা হল। বালক সিরাজ তাঁর প্রভু। বালক হলে কি হয়; একটু বয়স বাড়তেই সিরাজউদ্দৌলাহ্ সিংহনাদ করে সদলবলে পাটনা দখল করতে এগিয়ে এলেন। বিশ্বস্ত নায়েব জানকীরাম ভারি ফাঁপরে পড়লেন। হামলাকারীদের হাতে পাটনা ছেড়ে দেওয়া যায় না। অথচ নবাবের প্রিয় নাতির কেশাগ্র যাতে স্পর্শ না হয় তাও দেখতে হবে। কায়স্থের বুদ্ধিতে জানকীরাম নবাবের নাতিকে নিজ আশ্রয়ে টেনে এনে নবাবের স্নেহকম্পিত হাতে তুলে দিলেন। আলিবর্দি খান কৃতজ্ঞতায় গলে গেলেন। জানকীরামের প্রশংসা নবাবের মুখে আর ধরে না। মেদিনীপুর থেকে মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে রায় দুর্লভ নিজামতের ঘোড়সওয়ার সংক্রান্ত হাজিরা ও হিসাব-নিকাশ বিভাগের দেওয়ানের নায়েব নিযুক্ত হলেন। বিশ্বাসী বলে ঐ কাজে তাঁর সুনাম হল। ১৭৫৩ খ্রীস্টাব্দে জানকীরাম মারা গেলেন। তাঁর পেশকার ছিলেন একজন বিহারী কায়স্থ রামনারায়ণ। মারা যাবার আগে জানকীরাম নবাবকে লিখে গেলেন রামনারায়ণকেই তাঁর জায়গায় আনা হোক, কারণ ‘তাঁর নিজের ছেলেরা অপদার্থ এবং কার্যভার নির্বাহ করতে অক্ষম।’২২ জানকীরামের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তাঁর চার ছেলেকে নবাব খিলাত পাঠালেন। তার কয়েক দিন বাদে রায় দুর্লভের নামে নতুন আর এক খিলাত এল— তাতে তাঁকে নিজামত দেওয়ান পদে নিযুক্ত করা হয়েছে। রামনারায়ণও পাটনা থেকে দুর্লভরামকে অনুরোধ করে পাঠালেন যেন মুর্শিদাবাদে পাটনার নিয়াত সংক্রান্ত সব কাজেকর্মে তিনি তাঁর প্রতিনিধি থাকেন। রায় দুর্লভ এখন থেকে দরবারের প্রথম সারির আমীরদের মধ্যে জায়গা পেলেন।

দুর্লভরামের কপালে এ সুখ বেশিদিন টিকল না। তিন বছর যেতে না যেতে নবাবের নাতি মসনদে বসলেন। নবাব হয়ে তিনি তাঁর ইয়ার মোহনলালকে দেওয়ান সুবাহ্ প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী পদে এনে বসালেন। নতুন দেওয়ানের উপাধি হল মহারাজা এবং পদমর্যাদা একেবারে পঞ্চ হাজারী মনসবদার। হঠাৎ সৌভাগ্যে পার্শ্বচরের মাথা ঘুরে গেল। তিনি আলিবর্দির মনসবদারদের ডেকে ডেকে অপমান করে তাঁদের উপর নিজের কর্তৃত্ব ফলাতে লাগলেন। ভুঁইফোড় কাশ্মীরীর মদমত্ত অহংকারবোধ যাদের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠল তাঁদের মধ্যে সৈয়দ বংশজাত মীর জাফর ছাড়া কায়স্থতনয় রায় দুর্লভও ছিলেন। নিজামত দেওয়ান হিসাবে তিনি দেওয়ান সুবাহ্‌র কর্তৃত্বাধীন।২৩ দুর্লভরামকে হাজিরা দিতে ডেকে এনে মোহনলাল তাঁকে অপমান করলেন। মীর জাফর হাজিরা দিতে গেলেন না। মীর জাফরের মতো রায় দুর্লভও স্থির করলেন কিছুতেই তিনি আর এই উদ্ধত ভুঁইফোড়ের কর্তৃত্ব সহ্য করবেন না।২৪ অবশ্য গোড়াতেই যে তিনি নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে হাত দিলেন তা নয়। শওকৎ জঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযানের আগে নবাব রায় দুর্লভের ভাই রাসবিহারীকে বীরনগর ও গোণ্ডওয়াড়ার ফৌজদার করে পূর্ণিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। আশায় আশায় রায় দুর্লভ পূর্ণিয়ার লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল পূর্ণিয়াতে ছোট ভাইয়ের কিছু হয়ে যাবে। কিন্তু যুদ্ধের পর দেখা গেল পূর্ণিয়ার জমি ও হিসাব সংক্রান্ত কাজের ভার মোহনলালের উপর বর্তেছে। মোহনলাল পূর্ণিয়াতে নিজের এক নায়েব রেখে মুর্শিদাবাদ ফিরে গেলেন। রায় দুর্লভ ফিরলেন শূন্য হাতে।

এরপর নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্ কর্নেল ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে রুখতে দ্বিতীয় বার কলকাতা অভিযানে বেরোলেন। সঙ্গে গেলেন দুই প্রধান সেনাপতি মীর জাফর ও রায় দুর্লভ। যে সুলেনামা দ্বারা ঐ অভিযান সাঙ্গ হল তাতে নবাবের শীলমোহরের ঠিক নীচে দুই প্রধান সেনাপতির স্বাক্ষর রইল। অভিযান কালে নবাবের শিবিরে ক্লাইভের আচমকা হামলায় উভয়ের ধারণা জন্মাল সাবিৎ জঙ্গ একজন ভারি জবরদস্ত জঙ্গবাজ। ইংরেজরা যাতে ফরাসীদের হাত থেকে চন্দননগর ছিনিয়ে না নেয় সেই জন্য হুগলীর ফৌজদার নন্দকুমার এবং দেওয়ান রায় দুর্লভের উপর নবাবের কড়া নির্দেশ ছিল। ফৌজ নিয়ে রায় দুর্লভ মুর্শিদাবাদ থেকে চন্দননগরের দিকে অগ্রসর হলেন। কাশিমবাজারের ফরাসী কুঠির প্রধান মঁসিয়ে ল’ তাঁকে দু-লক্ষ টাকার লোভ দেখালেন যাতে তিনি সত্যি সত্যি ইংরেজদের হাত থেকে ফরাসীদের রক্ষা করেন। কিন্তু কার্যকালে দেখা গেল রায় দুর্লভ ভয়ে জবুথবু। নন্দকুমার ইংরেজদের উৎকোচে বশীভূত হলেন! নন্দকুমার ও রায় দুর্লভ কেউ কিছু না করায় ইংরেজরা চন্দননগর দখল করল। তখন মীর জাফর ও রায় দুর্লভ দুজনেরই ধারণা হল এমন বাহাদুর জঙ্গবাজদের নবাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লাগানো যাবে।

এই ষড়যন্ত্রে অন্যান্য যেসব মনসবদার ছিলেন তাঁদের পুরো তালিকা কোথাও মেলে না। অনেক সূত্রে আবার ভুল লোকের নাম করা হয়।২৫ সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র মসনদে ওঠার সময় আলিবর্দি খানের প্রধান প্রধান সেনাপতিদের অনেকেই আর ছিলেন না। পাঠান মুস্তফা খান বিদ্রোহে নিহত হয়েছিলেন। আতাউল্লাহ্ খান দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। বাকি যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রধান মীর জাফর, রায় দুর্লভ, উমর খান, দোস্ত মুহম্মদ খান, রহিম খান ও বাহাদুর আলি খান। চক্রে যোগ দেন মীর জাফর, দুর্লভরাম, রহিম খান ও বাহাদুর আলি খান! কলকাতার লড়াইয়ে দোস্ত মুহম্মদ খান আহত হয়েছিলেন। সেই মওকায় ছুটি পেয়ে তিনি দরবারে অপমান এড়ানোর জন্য স্ত্রীপুত্র সহ সাসারাম চলে যান। মহাবতজঙ্গের সবচেয়ে সাহসী ও বিশ্বস্ত সেনাপতিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। পলাশীর যুদ্ধের সময় এই বিশ্বস্ত সেনাপতি উপস্থিত ছিলেন না।২৬ অন্যরা সকলেই ক্ষুব্ধ। সিয়ার-উল-মুতাখ্খিরীনের বিবরণ অনুযায়ী মীর জাফর, রায় দুর্লভ, রহিম খান এবং অন্যান্য সেনাপতি বিশেষ করে বুড়া উমর খান, নবাবের হাতে প্রকাশ্য দরবারে অপমানিত হয়েছিলেন। শওকৎ জঙ্গ নিহত হবার পর বিজয়ী নবাব উমর খানকে দেশ থেকে দূর করে দেন।২৭ ইংরেজদের কাগজপত্রে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মীর জাফর ও রায় দুর্লভ ছাড়া রহিম খান ও বাহাদুর আলি খানের নাম পাওয়া যায়।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখা দরকার। ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে যেসব মনসবদার আলিবর্দি খানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে মুর্শিদাবাদ দরবারে প্রধান প্রধান আমীররূপে উপস্থিত ছিলেন। রিয়াজ-উস-সলাতীনে ১৭৪০-এর চক্রান্তকারীদের একটা লম্বা তালিকা আছে: ‘মুস্তফা খান, শমসের খান, সরদার খান, উমর খান, রহিম খান, করম খান, সিরান্দাজ খান, শেখ মুহম্মদ মাসুম, শেখ জাহাঙ্গীর খান, মুহম্মদ জুলফিকার খান, চিদান হাজারী, বখতাওয়ার সিংহ এবং সৈন্যবাহিনীর অন্যান্য সেনাপতি।’২৮ জগৎশেঠ, মীর জাফরও ঐ চক্রান্তে ছিলেন। এঁদের প্রায় সকলেই আলিবর্দির আমলে উচ্চপদ লাভ করেন এবং বর্গিযুদ্ধের প্রথম দিকে কার কত মনসব ছিল তারও তালিকা সিয়ারে পাওয়া যায়:

নামমনসব
মুস্তফা খান৫০০০
শমসের খান, উমর খান৩০০০
সরদার খান, আতাউল্লাহ্ খান২০০০
আমানত খান১৫০০
মীর জাফর, হায়দরকুলী খান, ফাকরুল্লাহ্ বেগ খান১০০০
মীর শরিফউদ্দিন, মীর মুহম্মদ মাসুম, বাহাদুর আলি খান৫০০
মীর কাজেম খান২০০

এই তালিকায় রহিম খানের মনসবের উল্লেখ নেই। কিন্তু সরফরাজ খানের দল থেকে যাঁরা প্রথমে মহাবৎজঙ্গের দলে চলে যান তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন। বর্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে তাঁকে প্রথম দিক থেকেই রীতিমতো উঁচুপদে থেকে যুদ্ধ করতে দেখা যায়। আলিবর্দি স্বয়ং যে যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন সেখানে হাতির পিঠে রহিম খান নবাবের পতাকা নিশান বহন করেছিলেন।২৯ পূর্ববর্তী তালিকায় বাহাদুর আলি খান ৫০০ ঘোড়ার মনসবদার এবং ভারি তোপের দারোগা বলে উল্লিখিত হয়েছেন। ১৭৫৭-তে তাঁর পদমর্যাদা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল তা নিশ্চিত, তবে রিয়াজ-উস-সলাতীন অনুযায়ী তখন তোপখানার দারোগা ছিলেন মীর মদন। রহিম খানও দরবারে এই সময় একজন বড়ো সেনাপতি ছিলেন, কারণ তাঁর এবং দোস্ত মুহম্মদ খানের কৃপায় গহসেটি বেগমের প্রেমিক মীর নজর আলি প্রাণ নিয়ে দিল্লী পালাতে পেরেছিলেন। কিন্তু রহিম খানের মনসব কত ছিল, জানা যায় না। মীর জাফর ও রায় দুর্লভ অনেকদিন থেকেই তিন হাজারী মনসবদার ছিলেন। এঁরা ছাড়া আর এক নতুন সেনাপতি ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এঁর নাম খুদাদাদ খান বা ইয়ার লতিফ খান। মহাবৎজঙ্গের পুরোন মনসবদারদের মধ্যে মীর খুদা ইয়ার খান লতিফের উল্লেখ নেই কোথাও। মঁসিয় ল’র বিবৃতিতে জানা যায় খুদাদাদ খানকে কোনোও বিদেশ থেকে জগৎশেঠরা আনিয়েছিলেন।৩০ জগৎশেঠ তাঁকে মাসে মাসে টাকা দিতেন বলে তিনি জগৎ শেঠের প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। কিন্তু তিনি নিজেও উঁচু পদে ছিলেন কারণ ইংরেজদের কাগজপত্র থেকে জানা যায় যে পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত আগে তিনি দুই হাজারী মনসবদার ছিলেন। এ ছাড়া আর একজন অপেক্ষাকৃত নবীন মনসবদার পলাশীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এঁর নাম খাদেম হোসেন খান। করম আলির ‘মুজাফ্ফরনামা’-তে দেখা যায় ইংরেজদের কলকাতা পুনর্দখলের পরে ইনি উঁচু পদ থেকে বরখাস্ত হন। সিরাজ হুকুম দেন এঁর রিসালায় সত্যি সত্যি কত সওয়ার আছে গুণে দেখা হোক। তখন থেকেই মীর জাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খাদেম হোসেন খান ইংরেজদের কাছে গোপন বার্তা পাঠাতে শুরু করেন। পলাশীর যুদ্ধের ঠিক আগে মীর জাফরের সঙ্গে খাদেম হোসেন খানকেও সিরাজ নিতান্ত নির্বুদ্ধির মতো সেনাপতি পদে নিযুক্ত করেন।৩১

মনসবদারদের মোটামুটি এক রকম হিসাব নেওয়া গেল। এবার ষড়যন্ত্রের আগে শেঠ সওদাগররা কোথায় ছিলেন তার একটু পূর্বানুসরণ করা যাক। যাঁর নাম নিঃসন্দেহে প্রথমে আসে তিনি জগৎশেঠ। এই সময় জগৎশেঠ পরিবারের কর্তা জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজা স্বরূপচন্দ। মরুভূমি মারওয়াড়ের মধ্যস্থিত মরূদ্যান শহর নাগৌর। সেখান থেকে শেঠ পরিবারের পূর্বপুরুষ হীরানন্দ সাহ বাদশাহ শাহজাহানের আমলে পাটনায় এসেছিলেন। তিনি জাতিতেও ওসওয়াল, ধর্মে জৈন। তাঁর কীর্তিমান পুত্র, তৎকালীন ভারতবর্ষের সর্বাগ্রগণ্য মহাজন শেঠ মানিকচন্দ, জগৎশেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। পাটনা থেকে তখনকার সুবাহ্ বাংলার রাজধানী ঢাকা জাহাঙ্গীরনগরে উপস্থিত হয়ে তিনি সেখানে মহাজনী কারবার শুরু করেন, এবং পরে মুর্শিদকুলি খানের পিছন পিছন নতুন রাজধানী মুর্শিদাবাদে এসে বসতি করেন। কালক্রমে তাঁর কারবার পাটনা, ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের আদি কুঠিগুলি থেকে বানারস, ইলাহাবাদ, কোরা জাহানাবাদ হয়ে দিল্লি-আগ্রা পর্যন্ত প্রসারিত হয়।৩২ তাঁর স্ত্রী (বাল্য নাম কিশোর কুমারী) রূপে লক্ষ্মী ছিলেন। স্বামীগৃহে লক্ষ্মীর অবতারের মতো উদয় হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম বদলে মানিক দেবী রাখা হয়। শেঠ গৃহে তাঁর পদার্পণের পর থেকেই সোনা, রূপা, জহরত, হাতি, ঘোড়া, পালকি, রথ ও দাস-দাসীর সমাগমে মহিমাপুর কুঠির জৌলুষ দিন দিন বাড়তে লাগল। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ২৬ বছর বেঁচেছিলেন এবং ঐ সময় পরিবারের কর্তৃত্ব তাঁর উপরে বর্তায়। জীবনের বাকি সময়টুকু তিনি তিনদিনে একদিন আহার করতেন এবং কঠোর ব্রতচারণ, জপতপ, পূজা-আর্চা ও অজস্র দান ও পরোপকার সাধনে তার দিন কাটত। এই মহীয়সী নারী সম্বন্ধে জৈন সম্প্রদায়ের যতি শ্রীনিহাল চন্দ মুনি গুজরাটি ভাষায় একটি কবিতা রচনা করেন, যা থেকে শেঠ পরিবারের একটি নির্ভরযোগ্য সমকালীন ছবি (১৭৪০খ্রীঃ) মেলে:

‘রাজসদৃশ মানিকচন্দ সোনার বাংলায় মুর্শিদাবাদ নগরীতে এসে সেখানে কুঠি নির্মাণ করেন। দিল্লীর বাদশাহের কৃপায় উচ্চপদে আসীন হয়ে তিনি আমীর ওমরাও সৈন্য সামন্ত সকলের মধ্যে মাননীয় পুরুষরূপে প্রতিষ্ঠিত হন। বাদশাহ ফারুকশিয়র তাঁকে শেঠ খেতাব দেন। সারা মোগল সাম্রাজ্য জুড়ে খেতাব চালু হয়। সুবাহ বাংলার সমগ্র ধনরাশি তাঁর হস্তগত হয়েছিল। স্বর্গের ইন্দ্রের মতো ফতেহ্চন্দ নামে তাঁর এক পুত্র জন্মাল। দিল্লীর বাদশাহ তাঁকে জগৎশেঠ খেতাব দিলেন, যার অর্থ জগতের পতি। তিনি রিয়াসতের অলংকার এবং স্বীয় পরিবারের স্তম্ভ। অতঃপর কে কুলের রক্ষক জগৎশেঠ হলেন? তাঁর দুই সূর্য ও চন্দ্র সদৃশ পুত্র ছিল। একজন শেঠ আনন্দ চন্দ, অন্য জন দয়াচন্দ, যেন ইন্দ্র ও কামদেবের অবতার। শেঠ আনন্দ চন্দের ছেলে মহতাব রাও এবং দয়াচন্দের ছেলে রূপ চন্দ— দুজনেই সর্বগুণান্বিত। মানিক দেবীর ভাগ্যের সীমা পরিসীমা রইল না—কারণ তাঁর পুত্র ও পৌত্ররা প্রত্যেকে যেন সাগর থেকে ছেঁচে আনা মুক্তা। ⋯স্বর্গের ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবদেবীর মতো ভাইয়েরা ও বধুরা একসঙ্গে মিলেমিশে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাতে লাগল। তাদের পারিবারিক সমৃদ্ধি দিনে দিনে বাড়তে লাগল। ⋯জৈনধর্মের সাতটি অনুমোদিত উপায়ে তারা অর্থব্যয় করত। দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তরাও তাদের কৃপা থেকে বঞ্চিত হল না। মাতাজী [মানিক দেবী] মুনিদের প্রবর্তিত সব পূজা মেনে চলতেন। তাঁর দেখাদেখি তাঁর পুত্র পৌত্ররাও কর্তব্য থেকে এক চুল বিচ্যুত হত না। তারা সকলেই সম্পন্ন, উদারচেতা, পরকে দিয়ে তারা সুখানুভব করত। জগতে বিপুল গৌরব অর্জন করে ১৭৭১ সম্বতের মাঘ মাসে শুক্লপক্ষের দশম দিনে মানিক চন্দ স্বর্গারোহণ করলেন। অশৌচের সমস্ত দিনগুলি সতী অগ্রগণ্যা মাতাজী অনশনে মালাজপ করতে করতে এমন কঠোর তপশ্চর্যায় কাটালেন যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সমস্ত জগৎ তাঁকে ধন্য ধন্য করতে লাগল। তাঁর বড়ো ইচ্ছা হল পার্শ্বনাথের পাহাড়ে গিয়ে দেবতাকে প্রত্যক্ষ করেন, যাতে তাঁর হৃদয়ের বেদনার উপশম হয়। তাঁর ছেলে [প্রকৃতপক্ষে নাতি আনন্দ চন্দ] তা অবগত হয়ে সংঘ নিয়ে যাত্রা করলেন। ⋯সে সংঘের চুরাশী জাতির মধ্যে ওসওয়াল, শ্রীমালি ও পুরওয়াড়রা অগ্রগণ্য ছিল। তাদের মধ্যে এমন অনেক বিপুল ধনবান ছিলেন যাঁদের সকলকে সংঘের নায়ক [আনন্দ চন্দ] যথোচিত সম্মানিত করলেন। ⋯তারপর পর্বতে আরোহণ করে সকলে জিনেশ্বরকে দর্শন করলেন। ⋯মাতাজীর হৃদয়ের বাসনা পূর্ণ হল। ⋯তীর্থ থেকে ফিরে আসার আনন্দে তিনি সংকল্প করলেন গৃহের জৈন মন্দিরে রূপার আসনে মণিমাণিক্যখচিত সুবর্ণগঠিত দেবতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই প্রকল্প কার্যে পরিণত করলেন। সকালে তিনি তিন ঘণ্টা পূজা করতেন এবং তারপর নানকর মন্ত্র৩৩ উচ্চারণ করতেন। মন্ত্রোচ্চারণের পর দান করে জলগ্রহণ করতেন। তিনি দুই দিন অনাহারে থেকে তৃতীয় দিন অনশন ভঙ্গ করতেন কিন্তু সেদিনও ব্রত পড়লে সানন্দে, প্রায়োবেশন করে তারপর ভোজ্যবস্তু গ্রহণ করতেন। এই নিয়মটি তিনি আমরণ মেনে চলেছিলেন, একবারও বিচ্যুত হননি। ⋯সত্য যুগে কর্ণ, বিক্রম ও ভোজ দাতারূপে খ্যাত ছিলেন, কিন্তু কলিযুগে মানিকদেবীকে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ⋯তিনি এত বড়ো দাত্রী ছিলেন যে, যে তাঁর কাছে একশ চাইত তাকে তিনি হাজার দিতেন, যে হাজার চাইত তাকে লক্ষ। মানুষ যেন তাঁর কাছে ভগবান। দানে ও গুণে তাঁর প্রত্যেকটি দিন উজ্জ্বল ছিল, কিন্তু তাঁর জীবনের শেষ বছরে তাঁর দান আরো বেড়ে গিয়েছিল। ⋯[মৃত্যুর পূর্বে] তিনি পুত্র-পৌত্র পরিজনদের সকলকে দীর্ঘায়ু, সুখশান্তি ও সাফল্য কামনা করে আশীর্বাদ করলেন। মন্দিরে দেবতার সামনে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন আর ভোজ্যবস্তু গ্রহণ করবেন না। কিন্তু দানধ্যান, পূজাপাঠ থেকে বিরত হলেন না। মনের সকল ভাবনা তাঁর স্বধর্মের দেবতায় আরোপ করে তিনি সকল প্রাণীর কাছে ক্ষমাভিক্ষা করলেন। ১৭৯৮ সম্বতের পৌষ মাসের প্রথম পূর্ণিমার দিন পুষ্যনক্ষত্রে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।’৩৪

আজকাল রাজপুতানার ওসওয়াল, আগরওয়াল, শ্রীমালি ইত্যাদি চুরাশী কুলের হিন্দু ও জৈন ধর্মাবলম্বী বানিয়ারা বাংলায় এসে নিজেদের ‘মারওয়াড়ী’ নামে পরিচয় দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু তখনো মারোয়াড়ী নাম (সম্ভবত বাঙালিদের দেওয়া) চালু হয়নি। উপরোক্ত গুজরাটি কবিতাতে সর্বত্র জৈন ওসওয়াল এবং চুরাশী কুলের উল্লেখ আছে, মারোয়াড়ী নাম কোথাও নেই। মানিক দেবী বাংলার স্থানে স্থানে জৈন মন্দির, ধর্মশালা, পোশাল৩৫ নির্মাণ করেন। তাঁর আগে মুর্শিদাবাদে মোটে কয়েক ঘর জৈন ছিল। তাঁর সহায়তায় সেখানে ওসওয়াল কুলের হাজার ঘর জৈনের বসতি হয়, যারা আজও আজিমগঞ্জে, বালুচর ইত্যাদি অঞ্চলে ফলাও ব্যবসা করছে (এঁরা এত বাঙালিভাবাপন্ন হয়ে গেছেন যে পরবর্তীকালের আগন্তুক মারোয়াড়ীদের থেকে এঁদের আলাদা করে দেখা হয়)। যে সময়ের কথা বলছি তখন হিন্দুস্থান, রাজপুতানা ও গুজরাটের চুরাশী বণিক কুলের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত ঘনিষ্ঠতর থাকায় তাদের আলাদা আলাদা করে মারোয়াড়ী, গুজরাটি নাম দেওয়ায় প্রশ্ন ওঠেনি।

গুর্জর ভাষার কবি৩৬ বলেন, মানিক দেবীর সৌভাগ্যের সীমা ছিল না, কারণ তিনি নিজের গর্ভে একজন জগৎশেঠকে ধারণ করেছিলেন। এ কথাটা কাব্যের অলংকার বলে ধরতে হবে, কারণ প্রথম জগৎশেঠ ফতেহ্ চন্দ শেঠ মানিক চন্দের ঔরসজাত পুত্র ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী মানিক দেবীর গর্ভে কোনো সন্তান হয়নি বলে তিনি রায় উদয় চন্দের পুত্র ফতেহ্ চন্দকে দত্তক গ্রহণ করেছিলেন। জগৎশেঠ পরিবারে রক্ষিত একটি বংশাবলী মূলক হিন্দী পুঁথি থেকে একথা নিঃসন্দেহে জানা যায়। গর্ভজাত সন্তান না হলেও ফতেহ্চন্দ মাকে কি রকম শ্রদ্ধা করতেন তা নিহালচন্দ মুনি স্বচক্ষে দেখে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। কঠোর অনশনে তাঁর বিধবা মার শরীর কংকালসার হয়ে গিয়েছিল। তিনি দিনে তিনবার মার সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁর প্রত্যেকটি ইচ্ছা সসম্মানে পালন করতেন। বিশাল পরিবারের সর্বময়ী কর্ত্রী হলেও সংসারে তাঁর কোনো মোহ ছিল না, হৃদয়েও কোনও ঈর্ষাবোধ ছিল না। তাঁর দয়া ও ক্ষমায় গঠিত ক্ষীণ শরীরে সুখের বোধ ছিল না, দুঃখের বোধও ছিল না। স্বয়ং বাদশাহর হাত থেকে স্বর্ণালংকার প্রাপ্তা হয়েও তিনি এসব কিছুর উর্ধ্বে ছিলেন।

কিরকম করে তাঁর ভাগ্যবান ছেলে জগৎশেঠ খেতাব লাভ করেন সে সম্বন্ধে উপরোক্ত হিন্দী পুঁথিতে একটি বংশানুক্রমিক শ্রুতি লিপিবদ্ধ আছে। সেই বৃত্তান্ত এই: ‘দিল্লীতে বড় আকাল পড়েছিল, বাদশাহ তাঁকে আকাল মোচনের আদেশ দিয়ে দুনা (পান) গ্রহণ করতে বলায় তিনি সসম্মানে আরজি পেশ করলেন, সকলের অবগতির জন্য হুকুম হোক অবাধে হাতে হাতে হুন্ডী চলবে। বাদশাহ রাজি হয়ে ঘোষণা করলেন যাদের টাকার দরকার তারা হুন্ডী লিখে টাকা সংগ্রহ করুক। এই ভাবে আকাল মিটল, শহরে টাকার ছড়াছড়ি হল। বাদশাহ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে ফতেহ্‌চন্দকে জগৎশেঠ উপাধি দিয়ে পুরস্কৃত করলেন।৩৭ বাদশাহ মহম্মদ শাহের রাজত্বের চতুর্থ বৎসরে (১৭২২-২৩) প্রদত্ত যে ফরমানে ফতেহ্চন্দকে ‘জগৎশেঠ’ ও তাঁর ছেলে আনন্দচন্দকে ‘শেঠ’ খেতাব দেওয়া হয়, তাতে হুকুম হয় যে জগৎশেঠ উপাধি ঐ পরিবারে বংশানুক্রমিক হবে এবং মোগল সাম্রাজ্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্ত দেওয়ানী কর্মচারী, রাজপুরুষ ও লিপিকররা ‘জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দ’ লিখবে। জগৎশেঠ, পরিবারের ঐতিহাসিক J. H. Little গবেষণা করে দেখিয়েছেন, ১৭২২ খ্রীস্টাব্দে দিল্লিতে কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি, কিন্তু ভয়ানক অর্থ সংকট ও মুদ্রাভাব ঘটেছিল। দুর্ভিক্ষে চাই খাদ্য সরবরাহ, হুণ্ডী চালাচালিতে সেখানে কোনও কাজ হবার কথা নয়। সম্ভবত ঐ সময়কার রৌপ্য ও রৌপ্যমুদ্রার অভাব বংশানুক্রমিক শ্রুতিতে ‘আকাল’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তা যদি হয়, তাহলে ফতেহ্চন্দ কর্তৃক অবাধ হুণ্ডী চলনের পরামর্শ দান কথাটার একটা মানে হয়। সপ্তদশ শতক থেকেই বহুল হুণ্ডী চলনের প্রমাণ আছে। সম্ভবত ফতেহ্চন্দ এমন কোনো পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে বাজারের সকল সাধারণ ব্যাপারী ও আম্ জনতা অবাধে হুন্ডী লিখে টাকা ধার করতে পারে এবং সে হুন্ডী এক হাত থেকে অপর হাতে বিনা বাধায় হস্তান্তরিত হতে হতে মোট সচল অর্থের পরিমাণ সম্প্রসারিত হয়ে ওঠে। গুজরাটের ফার্সী ইতিহাস ‘মির্-আতে আহ্‌মদী’ থেকে জানা যায় অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে সত্যি সত্যি অবাধ হুন্ডী হস্তান্তরের ব্যবসা চালু ছিল। জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দের কর্তৃত্বে হুন্ডীর ব্যবহার যে লক্ষণীয় ভাবে প্রসারিত হয়েছিল তার প্রমাণ আছে। মুর্শিদকুলী খান দিল্লীতে দেড় কোটি টাকার উপর খাজনা পাঠাতেন। প্রথম প্রথম সেই অর্থ মুর্শিদাবাদ থেকে রৌপ্য মুদ্রার আকারে প্রহরী বেষ্টিত বিরাট কাফিলায় দিল্লি যেত। কিন্তু ১৭২৮ খ্রীস্টাব্দ থেকে রৌপ্য মুদ্রায় খাজনা পাঠানো কমে আসতে থাকে। জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দ তাঁর দিল্লীর কুঠির উপর হুন্ডীর উপর লিখে দিতে শুরু করেন। ঐ হুন্ডীর মাধ্যমে সুবাহ্ বাংলার খাজনা নিরাপদে দিল্লীর মোগল দরবারে পৌঁছে যেত। বর্গি হাঙ্গামার সময় থেকে আলিবর্দি খান বাৎসরিক খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেন। ততদিন পর্যন্ত জগৎশেঠের কুঠির হুন্ডীর মাধ্যমেই মুর্শিদাবাদ ও দিল্লীর মধ্যেকার বিরাট খাজনা ও টাকাকড়ির লেনদেন সম্পন্ন হত। কি পরিমাণ টাকার জোর থাকলে সেকালে মুর্শিদাবাদ থেকে দেড় কোটি টাকার হুন্ডী লিখে দিল্লীতে ভাঙানো যায়, তা আজ কল্পনা করা শক্ত। সুবাহ বাংলার সমগ্র মুদ্রা চলাচল ও খাজনা সরবরাহের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে একাজ কখনোই সম্ভব হত না। একে শুধু টাকার জোর বললে কমিয়ে বলা হয়—এ প্রকারান্তরে দেশের সমগ্র মুদ্রা ব্যবস্থার উপর প্রভুত্ব। প্রধানত দুটি উপায়ে ফতেহ্চন্দের জীবৎকালে জগৎশেঠ পরিবারের এই প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম উপায় খাজনাখানার নিয়ন্ত্রণ, দ্বিতীয় উপায় টাঁকশালের কর্তৃত্ব।

মুর্শিদকুলী খানের আমল থেকে পুণ্যাহের সময় বাংলার সমস্ত জমিদার বা তাঁদের উকিলরা মুর্শিদাবাদে হাজির হতেন সে কথা আগে বলা হয়েছে। ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ A Statistical Account of Bengal লিখবার সময় উইলিয়াম উইলসন হান্টার জগৎশেঠ পরিবার থেকে যে বৃত্তান্ত সংগ্রহ করেন, তাতে দেখা যায় আগেকার কালে জমিদাররা নবাবের হুকুম অনুযায়ী জগৎশেঠের কুঠিতে সমবেত হতেন। ঐ সভায় প্রত্যেক জমিদারকে গত বছরের হিসাব-নিকাশ দিতে হত। তারপর বাটার হার দরাদরি করে জমিদাররা নতুন করে টাকা ধারের করার করতেন। সেই করারে জগৎশেঠ নবাব সরকারকে জমিদারের খাজনার খাতে টাকার ‘পাট’ দিতেন। এই নোট বা ড্রাফট-এর কাগজ টাকার সমান বিবেচনা করা হত এবং এর জন্য জমিদারের কাছ থেকে জগৎশেঠ শত করা দশ টাকা হারে ‘পাটওয়ান’ বা কমিশন পেতেন।৩৮ জগৎশেঠের সাহায্য ছাড়া জমিদাররা কখনো ঠিক সময়ে খাজনা মিটাতে পারতেন না। জগৎশেঠের ‘পাট’ না থাকলে গোটা সরকারি আয়-ব্যয় প্রণালী অবরুদ্ধ হয়ে যেত। এই জন্য নবাব সরকারের চোখে ‘জগৎশেঠের কুঠি বাদশাহের খাজাঞ্চীখানা’ বলে ধরা হত এবং এই কথা জানিয়ে ১৭৩০ খ্রীস্টাব্দে নবাব সুজাউদ্দিনের প্রধান আমীর হাজি আহমদ (আলিবর্দি খানের দাদা) ইংরেজ কোম্পানিকে স্পষ্ট বলে দেন তারা যেন জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দের বকেয়া টাকা অবিলম্বে মিটিয়ে দেয়। এ সত্ত্বেও জগৎশেঠের টাকা না মেটানোয় অবিলম্বে নতুন এক বিপদে পড়ে ইংরেজদের জগৎশেঠের হাতে পায়ে ধরে ৫০,০০০ টাকা খেসারত দিয়ে নবাব সরকারের কোপ থেকে রক্ষা পেতে হয়েছিল।

যতদিন মুর্শিদকুলী খানের বিশ্বস্ত টাঁকশাল দারোগা রঘুনন্দন বেঁচেছিলেন, ততদিন টাঁকশালে পুরো কর্তৃত্ব জগৎশেঠের উপর বর্তায়নি। ঐ সময় দিল্লী থেকে ফার্‌রুকশিয়রের ফারমান আনিয়ে ইংরেজরা নিজেদের টাঁকশাল খোলার জন্য নবাব দরবারে চাপাচাপি করছিল। রঘুনন্দন তখন মৃত্যুশয্যায়। নবাব সরকার থেকে স্পষ্ট ইংরেজদের বলে দেওয়া হল এখন কিছু হবে না। কিছু দিন বাদে রঘুনন্দনের মৃত্যু হলে দেখা গেল টাঁকশাল যাদের ইজারা দেওয়া হয়েছে সেই নতুন ইজারাদারদের আসল কর্তা জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দ। মাত্র ১/২ শতকরা হারে পুরানো মুদ্রা বা অন্য প্রদেশের মুদ্রা টাঁকশালে এনে ছাপ মেরে তিনি নতুন সিক্কা টাকা বানিয়ে নিচ্ছেন। হতাশ হয়ে কাশিমবাজার কুঠির সাহেবরা ১৭২১ খ্রীস্টাব্দে কলকাতায় জানালেন, ‘Fatehchand is so great with the Nawab, they can have no hopes of that grant, he alone having the sole use of the mint, nor dare any other Shroll or merchant buy or coin a rupee’s worth of silver.’৩৯

ইংরেজরা নিজেদের আমদানী সমস্ত সোনা রূপা জগৎশেঠের কাছে বেচতে বাধ্য হল। অন্য লোকের কাছে রূপা বিক্রী করার ফল কি হতে পারে সেটা জগৎশেঠ তাদের হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেওয়ায় পলাশীর যুদ্ধের আগে পর্যন্ত এই ব্যবস্থা ইংরেজরা মেনে নিতে বাধ্য হল।

অথচ এই যে হবে এমন কোনো কথা ছিল না। তখন ইংরাজরা টাঁকশাল বানাতে পারলে ব্যাপার সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে দাঁড়াত। ১৭১৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে শুরু করে সাত বছরের মধ্যে ইংরেজদের বাণিজ্য হু হু করে বেড়ে গিয়ে এমন পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল যা পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত সাত বছরের ইংরেজ বাণিজ্যের চেয়ে অন্তত দেড়গুণ বেশি।৪০ বলতে গেলে ঐ সময়েই লোকের অগোচরে কলকাতা গোটা বাংলার অদৃশ্য আর্থিক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দের পর সুরত বন্দর হয়ে বা হিন্দুকুশ পার হয়ে দেশী বণিকদের হাতে সোনা-রূপা আমদানী প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলপথে ইংরেজরা যা রূপা আমদানী করত তাই টাঁকশালে টাকা তৈরির বৃহত্তম উৎস হয়ে দাঁড়াল। তার উপর বেশির ভাগ জাহাজ ও ভিনদেশী আমদানী-রপ্তানী ইংরাজদের হাতে। এ অবস্থায় পলাশীর যুদ্ধের অনেক আগে দেশে টাকার সরবরাহের উপর ইংরাজ কোম্পানি নিজেদের দখল কায়েম করে নিতে পারত। তা যে হয়নি তার কারণ টাঁকশালের উপর জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দের একচ্ছত্র প্রভুত্ব।

ব্যাপারটা আর একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। মুর্শিদাবাদের নবাবরা পুরাতন বছরের মুদ্রায় খাজনা নিতেন না। সরকারি তোষাখানায় বর্তমান বছরের নতুন সিক্‌কা টাকা ছাড়া খাজনা নেওয়ার নিয়ম ছিল না। অর্থাৎ গত বছরে ছাপা রূপাইয়া বা মাদ্রাজ টাঁকশাল থেকে আনানো ইংরাজদের আর্কট রূপাইয়া আসলে আর টাকা ছিল না। অন্যান্য বাজারের পণ্যের মতো বা রূপার পাতের মতো ঐ মুদ্রাগুলিও পণ্যদ্রব্য হয়ে দাঁড়াত—টাকার বদলে (অর্থাৎ সিক্‌কা টাকার বদলে) যা বিক্রী করতে হয়। বাজারের অন্যান্য পণ্যের মতোই এই সনওয়ত (ভূতপূর্ব সিক্‌কা) ও আর্কট রূপাইয়া এমন এক ধরনের ‘ডিসকাউন্টে’ বেচা-কেনা হত যার নাম ‘বাটা’ এবং যা অন্যান্য পণ্যের দামের মতোই চড়ায় মন্দায় উঠত নামত। সিক্‌কার তুলনায় সনওয়ত ও আর্কটের বাটা ছিল প্রকারান্তরে জনতার উপর এবং বাণিজ্যের উপর একরকমের অদৃশ্য কর বা ইন্ডিরেক্ট ট্যাক্স। এইভাবে সন্ওয়াত ও আর্কটের দাম সিক্‌কার তুলনায় কমিয়ে দিয়ে এবং পরস্পরের এক্সচেঞ্জ বা বিনিময় হার নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে নবাব সরকার সিক্‌কা রূপাইয়া তৈরির একচেটিয়া সরকারি দোকানটাকে (অথাৎ টাঁকশাল) ইজারা দিতেন। জগৎশেঠের লোক টাঁকশাল ইজারা নিয়ে সরকারকে বছর বছর থোক টাকা দিত যা আসলে জনতার কাছ থেকে আদায় করা এক প্রকার ট্যাক্স। টাঁকশাল হাতে পেয়ে জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দ সমস্ত পুরাতন বা বিদেশী মুদ্রা কিনে নিয়ে প্রায় নিখর্চায় সেগুলিতে ছাপ মেরে নতুন সিক্‌কা টাকায় পরিণত করতেন এবং পুরো দামে বাজারে ছাড়তেন। ইংরাজদেরও অন্যান্য সাধারণ লোকের মতো বাটা দিয়ে আর্কট ও সনওয়ত বিক্রী করে বাণিজ্যের জন্য সিক্‌কা টাকা সংগ্রহ করতে হত। বাটার মুনাফা যেত জগৎশেঠের কুঠিতে। মুদ্রা বিনিময়ের হার বা এক্সচেঞ্জ নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ জগৎশেঠের হাতে ছিল বলে ইংরাজরা বছর বছর অদৃশ্যভাবে জগৎশেঠকে খাজনা যুগিয়ে চলত।

শুধু সরকারি খাজনা ও টাঁকশালের নিয়ন্ত্রণের উপরে ভিত্তি করে জগৎশেঠের ব্যবসা চলত এ কথা ভাবলে ভুল হবে। জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দ শুধু সরকারের সর্‌রাফ ছিলেন না। তিনি সাধারণ বণিক ও বিদেশী কোম্পানিগুলির মহাজন ছিলেন। ১৭৪০ পর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানি তাঁর কাছে শতকরা ১২ সুদে ধার করত। ১৭৪১-এ সুদ কমে শতকরা ৯ হয়৪১। তাঁর দেওয়া হুন্ডীতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের লেনদেন চলত। মধ্য এশিয়া থেকে আগত তুরাণী বণিক, বসরা, জিদ্দা, মোখায় রপ্তানীরত আরমানী, বণিক, ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসী কোম্পানি ইত্যাদি বড়ো বড়ো বণিকরা জগৎশেঠের ধারে ও হুন্ডীতে পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে বাণিজ্য চালাত।

মাঝে মাঝে বিবাদ বাধলেও লেনদেন সূত্রে জগৎশেঠের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। আর তারা এটাও বুঝেছিল যে জগৎশেঠকে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। ১৭২৩ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজদের নিজেদের কাগজপত্রে ফতেহ্‌চন্দকে ‘The Nabob’s chief favourite’ বলে উল্লিখিত হতে দেখা যায়। বস্তুতপক্ষে নবাব সুজাউদ্দিন খানের দরবারে হাজি আহমদ, রায় রায়ান আলমচাঁদ ও জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দ, এই ত্রয়ীর হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল। ঐ ত্রয়ীর ষড়যন্ত্রে ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজ খান নিহত হন। আলিবর্দি খান মসনদে আরোহণ করে দিল্লী থেকে যে ফারমান পান তাও জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দ আনিয়ে দিয়েছিলেন। যে কোনো জমিদারের চেয়ে জগৎশেঠের স্থান উচ্চতর ছিল এবং দরবারে নবাবের ঠিক বামপার্শ্বে তাঁর স্থান নির্দিষ্ট ছিল (মুর্শিদাবাদের নবাব বাড়ির চিত্রে তা দেখা যায়)।

জগৎশেঠের এত বড়ো প্রতিপত্তির অন্যতম কারণ দিল্লীর দরবারে তাঁর প্রভাব। ‘জগৎশেঠ’ খেতাব স্বয়ং বাদশাহ প্রদত্ত, তাই বাদশাহের প্রতিনিধি নবাব নাজিমের পাশে ফতেহ্চন্দের স্থান ছিল। ফতেহ্চন্দের জীবৎকালেই তাঁর পুত্র শেঠ আনন্দচন্দ মৃত্যুমুখে পতিত হন। ফতেহ্চন্দের পর কুঠির কর্তৃত্ব পান তাঁর দুই নাতি—কুঠির প্রধান জগৎশেঠ মহতাব রায় এবং তাঁর সহযোগী মহারাজ স্বরূপচন্দ। বাদশাহ আহমদ শাহ স্বয়ং মহতাব রায়ের জগৎশেঠ খেতাব অনুমোদন করেছিলেন। বড়ো বড়ো জমিদাররা যেমন মহারাজ উপাধি পেতেন, তাঁর খুড়তুতো ভাই স্বরূপচন্দও তেমন নবাবের দরবারে ‘মহারাজ’ নামে অভিহিত হতেন। কিন্তু কুঠির প্রধান মহতাব রায় বাদশাহ প্রদত্ত জগৎশেঠ খেতাব ভূষিত হয়ে দরবারে আরো উচ্চতর সম্মানের অধিকারী ছিলেন।

১৭৪৩ খ্রীস্টাব্দে জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজ স্বরূপচন্দ কুঠির অধিকারী হলেন। তখন বর্গি হাঙ্গামার সূচনা হয়েছে। কিন্তু জগৎশেঠ কুঠির প্রতিপত্তি সে সময় এত দীর্ঘকাল প্রতিষ্ঠিত যে চার দিকের গণ্ডগোলেও তাঁদের ব্যবসায়ে ভাঁটা পড়ল না। হাঙ্গামার মধ্যেই ক্যাপটেন ফেনউইক্ লিখলেন, লন্ডনের লমবার্ড স্ট্রীটের সব ব্যাঙ্কারকে একত্রে ধরলেও জগৎশেঠ মহতাব রায়ের মতো বড়ো ব্যাঙ্কার হয় না। ।৪২ বর্গি আক্রমণ শেষ হবার পর ওলন্দাজদের একটি চিঠিতে দেখা যায়৪৩ এই পুরাতন প্রতিষ্ঠিত কুঠির হাতে সমস্ত মুদ্রা ব্যবসায় একচেটিয়া হয়ে আছে। ওলন্দাজরা লক্ষ্য করেছিল যে ইওরোপের বড়ো বড়ো ব্যাঙ্কারদের মতো এই ভারতীয় শেঠরাও প্রসিদ্ধ পূর্বপুরুষদের নামে ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সময় জগৎশেঠদের মুর্শিদাবাদ কুঠির নাম ছিল মানিকচন্দজী আনন্দচন্দজী। ঢাকায় ও পাটনায় জগৎশেঠের কুঠিদ্বয়ের নাম ছিল যথাক্রমে শেঠ মানিকচন্দ জগৎশেঠ ফতেহ্চন্দজী এবং মানিকচন্দজী দয়াচন্দজী। ওলন্দাজদের ব্যবসায় কেন্দ্র চুঁচুড়াতেও শেঠরা এক কুঠি নির্মাণ করেছিলেন—তার নাম ফতেহ্চন্দ আনন্দচন্দজী। ওলন্দাজরা দেখল, সুবাহ্ বাংলা বিহারের সর্বত্র ছোট-বড়ো সর্‌রাফ বিভিন্ন মুদ্রার উপর যে বাটা নেয় তার বিনিময় হার বা এক্সচেঞ্জ রেট জগৎশেঠের কুঠিতে স্থির হয়। ওলন্দাজরা এও দেখল যে বাংলার সমস্ত সর্‌রাফ এবং বিহারের বহু সর্‌রাফ, যারা জগৎশেঠের কুঠির সঙ্গে যুক্ত ছিল না, তারা সকলেই লালবাতি জ্বেলে দিয়েছে বা জ্বেলে দিতে বসেছে। গোলাম হোসেন খানের সিয়ার-উল-মুতাখ্খিরীনে এ কথার সমর্থন আছে। তিনি অনেক বছর বাদে ইংরেজ আমল কায়েম হবার পর মহারাজ স্বরূপচন্দের সম্বন্ধে লিখেছিলেন:

‘আলিবর্দি খানের আমলে এঁদের বাংলায় এমন প্রতাপ ও প্রতিপত্তি ছিল যা আজ এতদিন বাদে আর বিশ্বাসই হয় না। তাঁদের এমন অগাধ ধনদৌলত যে কি হিন্দুস্তানে কি দক্‌কনে কেউ সেরকম সাহুকর দেখেনি। তাঁদের নজির মিলতে পারে এমন কোনো শেঠ বা সওদাগর তামাম হিন্দে ছিল না। এ কথাও নিশ্চিত যে তাঁদের আমলে বাংলায় যত সাহুকর ছিল তারা হয় তাঁদের মুনিম নয় তাঁদের রিশ্‌তাদার। তাঁদের দৌলতের আন্দাজ এই এককথায় মিলে যাবে: মারাঠাদের প্রথম হামলার সময় যখন মুর্শিদাবাদে কোনো দেওয়াল ছিল না তখন আলিবর্দি খান এসে পড়ার আগেই মীর হবীব বাছাই করা ঘোড়সওয়ার নিয়ে শহরে চড়াও হয়ে জগৎশেঠের কুঠি থেকে দুকোটি টাকার আরকট রূপাইয়া লুঠ করে নিয়ে যায়। এতে দুই ভাইয়ের যা লোকসান হল তা যেন দুই গাছা খড়। এর পরেও তাঁরা সরকারে এক এক বার দর্শনী হুন্ডীতে এক কোটি টাকা লিখে দিতে লাগলেন। এক কথায়, এঁদের ধনরত্নের কথা বলতে গেলে মনে হবে আষাঢ়ে গল্প বলা হচ্ছে। এঁদের চাকরিতে হাজার হাজার গুমশ্‌তাহ্ ও মুনিমের এমন রোজগার হয়েছিল যা দিয়ে তারা বিস্তর জমিজমা আর আজব জিনিসপত্র খরিদ করেছিল।’৪৪

গোলাম হোসেন খান কি নিজে কিস্সা ফেঁদেছিলেন? সম্ভবত না। পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পরে মুর্শিদাবাদ থেকে লিউক স্ক্র্যাফটন কর্নেল ক্লাইভকে জগৎশেঠদের বাৎসরিক আয়ের একটা হিসাব দিয়েছিলেন যাতে দেখা যায়:৪৫

On 2/3rd of Revenue at 10%Rs. 10,60,000
Interest from Zamindars at 12%Rs. 13,50,000
On recoining Rs. 50 lakhs at 7%Rs. 3,50,000
Interest on Rs. 40 lakhas at 371/2%Rs. 15,00,000
Interest from batta on exchange Rate Rs. 7 to 8 lakhs.Rs. 7,00,000
 Rs. 49,60,000

যাঁদের আয় বাৎসরিক আধ কোটি টাকা, তাঁদের মূলধন চার পাঁচ কোটি টাকা হওয়া অসম্ভব নয়।৪৬ ইংরেজরা দেওয়ান হওয়ার পর শেঠদের অবস্থা যখন পড়ে গেছে তখনও নিষ্ঠুর ভাবে নিহত জগৎশেঠ মহতাব রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র জগৎশেঠ খুশলচন্দ বাংলার গভর্নর ক্লাইভকে গর্বভরে বলেছিলেন—যে কাগজে আমাদের নামের মোহর আছে তা এক কোটি টাকার সমান।৪৭ জগৎশেঠ মহতাব রায়ের সৌভাগ্য রবি যখন শীর্ষে তখনকার দিনে সেই পরিবারের ‘ক্রেডিট’ বা বাজারে টাকা কর্জর জন্য যে নামডাক দরকার সেই সুনামের মূল্য আরো বেশি ছিল বলেই ধরতে হবে। গোটা বাংলার খাজনার দুই তৃতীয়াংশ জগৎশেঠের কুঠিতে জমা পড়ত এবং নবাব সরকার জগৎশেঠের কুঠির উপর বরাত বা ড্রাফট দিতেন।৪৮ ইংরেজরা দেওয়ানী লাভ করে জগৎশেঠের হাত থেকে তোষাখানা সরিয়ে নেবার আগে পর্যন্ত জগৎশেঠের হাতেই খাজাঞ্চীখানার চাবি থাকত।৪৯ নবাব সরকারে বরাবর এই কথা ধার্য ছিল যে ‘জগৎশেঠের দৌলত সরকারের তহবিল’; কিন্তু অপর পক্ষে সরকারি তহবিল জগৎশেঠের ব্যবসার মূলধনের মূল ছিল এ কথাও নিশ্চয় মানতে হবে। ইংরাজরা এই ব্যবস্থাকে ‘মনোপলি’ বলে নিন্দা করত। কিন্তু গোটা বাংলার সওদাগরী কর্জ সরবরাহ (কমার্শিয়াল ক্রেডিট) এবং সরকারি আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ (স্টেট ফিনান্স) জগৎশেঠের হাতে থাকায় যেখানে যেখানে মূলধন সরবরাহের প্রয়োজন হত সেখানে দ্রুত বিনিয়োগ সম্ভব হত।

যেখানে সরকারি আয়-ব্যয়ের সঙ্গে কারবারী মূলধনের সম্পর্ক এত নিবিড়, সেখানে তখ্তের দিকে তীক্ষ্ণ নজর না রেখে কুঠি চালানো যায় না। মসনদে অধিষ্ঠিত নবাব শত্রুতা করলে জগৎশেঠের কারবারের সমূহ অনিষ্ট হবার সম্ভাবনা। আলিবর্দি খান গত হওয়া মাত্র সেই সম্ভাবনা দেখা দিল। নতুন নবাব যে শুধু প্রধান প্রধান সেনাপতিদের অপমান করে ক্ষান্ত হলেন তা নয়, জগৎশেঠের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণাও গোপন রইল না। মহাবত জঙ্গের দরবারে তাঁদের কিরূপ সম্মান ছিল স্মরণ করে জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজ স্বরূপচন্দ বুঝলেন জমানা পালটেছে—গতিক সুবিধার নয়। মীরজাফর ও দরবারের অন্যান্য মহাবৎজঙ্গী ওমরাও৫০ ঐ সময় পূর্ণিয়া দরবারের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। শওকৎ জঙ্গের বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তাব্তাবায়ী গোপন পত্রালাপীদের মধ্যে জগৎশেঠকে সরাসরি না দেখলেও এটা তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হল যে গুপ্তচক্র থেকে জগৎশেঠ বাদ নেই।৫২ জগৎশেঠ মীরজাফরের মতো অসাবধানে আগ বাড়িয়ে কিছু করার পাত্র নন—তাঁর কলকাঠি নড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে! কিন্তু তাঁর সঙ্গে মীরজাফরের যোগাযোগ যে রীতিমতো ঘনিষ্ঠ এবং পূর্ণিয়ার দরবারের দিকে সেনাপতির পুনঃ পুনঃ আশাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপের পিছনে যে শেঠজীর ঘনিষ্ঠতা মদত যোগাচ্ছে, তা প্রকারান্তরে বোঝা গেল।

কলকাতা থেকে ফলতায় বিতাড়িত ইংরেজরা ওলন্দাজদের কাছ থেকে উদগ্রীব হয়ে শুনল, বাদশাহের তরফ থেকে শওকৎ জঙ্গ সুবাহ্ বাংলা-বিহার-ওড়িষার নাজিম নিযুক্ত হয়ে মুর্শিদাবাদ চড়াও হতে ২০০ নৌকা যোগাড় করে ফেলেছেন। সেই শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে সিরাজউদ্দৌলাহ্ সেনাপতি মীর জাফর ও অন্যান্য মনসবদারদের পূর্ণিয়ার দিকে কুচ করতে হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু রাজধানী থেকে রওনা দিয়ে সেনাপতিরা আর বেশি দূর যায় নি। জগৎশেঠকে নবাবের হাত থেকে বাঁচাতে আবার শহরে ফিরে এসেছেন। কেননা সেনাপতিদের পূর্ণিয়া রওনা করিয়ে দিয়েই ক্ষিপ্ত নবাব জগৎশেঠকে দরবারে ডেকে এনে গালিগালাজ করেছেন। নবাবের রাগের কারণ, জগৎশেঠ তাঁকে দিল্লীতে কোনো মদত করেননি। জগৎশেঠ যদি সত্যি সত্যি তাঁর হয়ে দিল্লী থেকে ফারমান আনানোর জন্য মেহনত করতেন, তাহলে কখনোই শওকৎ জঙ্গ নাজিম নিযুক্ত হতেন না। এখন সওয়ারদের খোরাকের জন্য জগৎশেঠকেই সওদাগরদের কাছ থেকে তিনকোটি টাকা তুলে দিতে হবে। এতে বিচলিত হয়ে জগৎশেঠ কেমন করে অত টাকা নিপীড়িত সওদাগরদের কাছ থেকে তোলা যাবে বলতে শুরু করায়, রুষ্ট নবাব প্রকাশ্য দরবারে মহতাব রায়কে চড় মেরে বসেছেন। এই চাঞ্চল্যকর খবর শুনে মীর জাফর ও অন্যান্য সেনাপতিরা তড়িঘড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে এসেছেন এবং নবাব তাঁদের কথা শুনে জগৎশেঠকে ছেড়ে দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেছেন দিল্লী থেকে ফারমান না আনানো পর্যন্ত তাঁরা কিছুতেই সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র হয়ে লড়বেন না।৫২

ফলতার ইংরেজরা এতদিন জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদের মারফত নবাবের কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করছিল। এ খবর শুনে আশান্বিত হয়ে তারা হাত গুটিয়ে বসে রইল। ইংরাজ, ওলন্দাজ, এমন কি ফরাসীরাও আশা করতে লাগল এবার তখৎ উল্টে যাবে। দুর্মদ অর্থগৃধ্নু সিরাজের আর বেশিদিন নেই। শওকৎ জঙ্গের নিজের নির্বুদ্ধিতায় সে আশায় ছাই পড়ল। আলিবর্দি খানের অনুগত সর্দার বিহারের নায়েব রামনারায়ণ অপ্রত্যাশিতভাবে ফৌজ নিয়ে সিরাজের সঙ্গে এসে যোগ না দিলে হয়তো ব্যাপারটা অন্যদিকে গড়াত। অকস্মাৎ গুলিতে শওকৎ জঙ্গ নিহত হওয়ায় চক্রান্তকারীদের চাল নষ্ট হয়ে গেল।

এদিকে মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভের ফৌজ ও ওয়াটসনের নওয়ারা ফলতায় এসে পৌঁছল। তারা এসে পড়ায় ইংরাজদের সুর পাল্টে গেল। নবাগত গোরা সৈন্যরা আলিনগর উদ্ধার করে হুগলী বন্দর জ্বালিয়ে দিল। সচকিত নবাব প্রথমে ফরাসীদের কাছে সৈন্য সাহায্য প্রার্থনা করলেন, তাতে তারা রাজি না হওয়ায় অনুরোধ করলেন অন্তত মধ্যস্থ হয়ে তারা ঝগড়াটা মিটিয়ে দিক। এতে ফরাসীরা রাজি ছিল, কিন্তু ইংরাজরা স্পষ্ট বলে দিল জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদ ছাড়া আর কাউকে তারা মধ্যস্থ বলে মানতে রাজি নয়। হুগলী প্রজ্জ্বলন কাণ্ডে জগৎশেঠ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি ক্লাইভকে লিখলেন:

আপনার চিঠি পেয়ে প্রীত হলাম। চিঠির বক্তব্য অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করেছি। আপনি লিখেছেন, নবাবকে আমি যে বক্তব্য পেশ করি তিনি তা মান্য করেন। আপনি এ আশাও প্রকাশ করেছেন যে আপনার ও রিয়াসতের মঙ্গলের জন্য আমি সচেষ্ট হব। আমি বৃত্তিতে বণিক, সম্ভব বটে যে আমার পরামর্শ নবাব মনোযোগ দিয়ে শোনেন। আপনারা সে বৃত্তির ঠিক বিপরীত পস্থাটি অবলম্বন করেছেন। আপনারা বলপূর্বক কলকাতা অধিকার করে হুগলী নগরীতে চড়াও হয়ে শহর ধ্বংস করেছেন এবং বাহ্যত যুদ্ধ ব্যতীত আপনাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে বোধ হয় না। এক্ষেত্রে আমি কি ভাবে নবাব এবং আপনাদের বিবাদে মধ্যস্থ হব? আপনাদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে আপনাদের মৎলব বোঝা ভার। আপনারা এ পন্থা পরিহার করুন এবং আমাকে জানান আপনাদের কি দাবি। তাহলে নবাবের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রে এ অশান্তি মিটিয়ে দেওয়া যাবে আপনি সে ভরসা রাখতে পারেন। বাদশাহ ও সুবাহ্‌র বিরুদ্ধে আপনার অস্ত্রধারণ করেছেন তা দেখেও নবাব দেখবেন না, এটা আপনারা কেমন করে ভাবতে পাবলেন? এ কথা স্বীয় অন্তঃকরণে বিচার করে দেখুন।’৫৩

নবাব কুচ করে আলিনগর রওনা দেবার সময় জগৎশেঠ নিজের এক দক্ষ কর্মচারী রণজিত রায়কে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে দিলেন। আলিনগরের উপকণ্ঠে কুয়াশার মধ্যে আক্রান্ত হয়ে ভীত নবাব রণজিত রায়ের পরামর্শ মতো ইংরেজদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেন। তাঁর বিলক্ষণ বোধ হল, জগৎশেঠকে ছাড়া নবাবী করা সম্ভব নয়। কুয়াশাভেদী ইংরেজ আক্রমণকারী দল জগৎশেঠ ছাড়া কোনো কথা বলে না। শুধু তাই নয়, দিল্লীতেও সেই এক ব্যাপার। সেখানে কাবুলের আহমদ শাহ আবদালী চড়াও হয়ে লুঠতরাজ করছেন, কিন্তু দেওয়ান-ই-আমের দরবারে কাবুলী নরপতির কাছে সব চেয়ে সম্মানিত লোক জগৎশেঠের উকীল, কেন না ওমরাওদের কাছ থেকে যে টাকা আদায় করা হচ্ছে তার জামিন হতে পারেন একমাত্র জগৎশেঠ স্বয়ং। ৫৪ গুজব রটেছে আহমদ শাহ আবদালি এবার মুর্শিদাবাদ আসছেন। ব্যাপার দেখেশুনে নবাবের সুর সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। তিনি দরবারে জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়কে তোয়াজ করতে লাগলেন।

কিন্তু জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয় অত সহজে ভুলবার লোক নন। নবাবের ঘনিষ্ঠ পার্শ্বচররা কেউ তাঁদের অনুকুল্য থেকে বঞ্চিত হয়নি। তাদের কাছ থেকে নবাবের মনে কি আছে তাঁরা সবই জানতে পারতেন। শেঠেরা যা জানলেন তাতে তাঁদের শরীর কাঁপতে লাগল।৫৫ তাঁরা বুঝলেন, হয় তাঁরা নবাবকে নিকেশ করবেন, নয় নবাব তাঁদের নিকেশ করবেন। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। ইংরেজদের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে তাদের প্রতি নবাবের অন্তরে যে বিদ্বেষবহি প্রজ্জ্বলিত হয়েছে, তাতে গোরা ভীতি একবার কেটে গেলে দরবারে তাদের প্রধান বন্ধু জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয় নিশ্চয় পুড়ে মরবেন। অতএব ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে নবাবকে তখৎ থেকে সরাতে হবে। শেঠেদের মনে আশা, নবাবের প্রতি সবাই এত বিরূপ যে ফরাসীরাও এমন সাধু প্রকল্পে বাদ সাধবে না। ৫৬ এমন সময় ইওরোপে যুদ্ধ বেধে গেছে খবর পেয়ে ক্লাইভ ও ওয়াটসন ফরাসডাঙা থেকে ফরাসীদের উৎখাত করবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। শেঠেরা বিপাকে পড়লেন। তাঁরা যেমন ইংরাজদের বন্ধু, তেমনি ফরাসীদের বন্ধু। ফরাসীদের ব্যবসায়ে তাঁদের অনেক টাকা লগ্নি। এখন তাঁরা কোন্ দিকে যাবেন? ইংরেজরা নিজেদের গোপন পরামর্শ সভায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে শেঠেরা ফরাসীদের পক্ষে, তাঁরা তাদের মদৎ দিতে চন্দননগরে নবাবী ফৌজ পাঠানোর চেষ্টায় আছেন। ৫৭ অন্যদিকে কাশিমবাজারের ফরাসী কুঠির প্রধান মঁসিয় ল’ বুঝলেন, শেঠেরা তলে তলে ইংরেজদেরই সাহায্য করছেন। তিনি রোজ দরবারে যেতেন। সেখানে চন্দননগরে নবাবী ফৌজ পাঠিয়ে ইংরেজদের আক্রমণ ঠেকানোর যা যা খুঁটি তিনি সাজাতেন পরের দিন দেখতেন শেঠেদের পাল্টা চালে তা ভেস্তে গেছে। আসলে শেঠেরা চেষ্টা করছিলেন, ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসীদের যাতে যুদ্ধ না বাধে। তাঁরা চাইছিলেন ইংরাজ ও ফরাসীদের মধ্যে নিরপেক্ষতা বজায় থাকুক, আর তা যদি নেহাৎ অসম্ভব হয় তা হলে অন্তত নবাবী ফৌজ যেন ফরাসীদের দিকে যোগ না দেয়। কেননা তাতে শুধু ইংরেজদের নয়, শেঠেদেরও সমূহ বিপদ হবে। সব চেয়ে ভালো হয়, যদি ইংরেজরা ফরাসডাঙা চড়াও না হয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে কুচ করে, আর ফরাসীরা তাদের মদৎ দেয় বা অন্তত সে ব্যাপার থেকে সরে থাকে। বার বার নবাবকে দলে টানবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মঁসিয় ল’ স্থির করলেন শেঠেদের কুঠি যাবেন। শেঠেদের কুঠির দৃশ্য তাঁর নিজের স্মৃতিকথা থেকে উদ্ধৃত করা যাক:

‘শেঠেদের সঙ্গে দেখা করা সাব্যস্ত করলাম। তাঁরা আমার দেখা পাওয়া মাত্র আমাদের দেনার কথা বলতে শুরু করলেন — কেন দেনা মেটাতে আমাদের এত গাফিলতি। আমি বাধা দিয়ে বললাম ওটা এখন বড়ো কথা নয়, আমি এসেছি তাঁদের এবং আমাদের দুদলের পক্ষেই আরো বেশি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে। যে দেনাগুলির শোধ ও জামিনের ব্যাপারে তাঁরা এত ব্যস্ত এই প্রসঙ্গে সেগুলিও আসবে। আমি শুধালাম, আপনারা কেন আমাদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সমর্থন করছেন? তাঁরা বললেন আদৌ তা নয়, এবং এ ব্যাপারে আমাকে অনেক বুঝিয়ে শেষে অঙ্গীকার করলেন যে আমার যা কিছু বলবার আছে তা নবাবকে জানাবেন। তাঁরা আরো বললেন, ইংরেজরা আমাদের আক্রমণ করবে না সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত, এবং আমিও নিশ্চিত থাকতে পারি। ইংরেজদের মতলব তাঁরা ভালো মতোই জানেন, তাই আমি বললাম, আপনারাও জানেন, আমিও জানি, ওদের কি মতলব। নবাব যে লোকলস্কর পাঠাবেন বলেছেন তাঁদের তাড়াতাড়ি রওনা করিয়ে দিতে না পারলে কখনোই ইংরেজদের চন্দননগর আক্রমণ করা থেকে নিরত করা যাবে না। শেঠেরা বললেন, নবাব চান না ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া বাঁধুক। তারা আরো অনেক কিছু বললেন যা থেকে আমি বুঝলাম যে আমাদের শুভাকাঙক্ষী হলেও তাঁরা আমাদের জন্য কিছু করবেন না। রণজিত রায়, যে লোকটা ওঁদের কার্যনির্বাহক এবং ইংরেজদের ধামাধরা, সে বিদ্রূপের সুরে আমাকে বলতে লাগল— ‘আপনি ফরাসী মর্দান, আপনি কি ইংরেজদের ভয় করেন? ওরা যদি চড়াও হয় আপনারা লড়বেন। সকলেই জানে দক্ষিণ উপকূলে আপনারা কেমন বাহাদুরী দেখিয়েছেন। আমাদের খুব কৌতূহল এবার আপনারা কেমন ভাবে ছাড়া পান দেখি।’ আমি বললাম বাঙালি বণিকের মধ্যে আমি এমন যুদ্ধং দেহি লোক দেখবো আশা করিনি। সময় সময় কৌতূহলী লোকেরা নিজেদের কৌতূহল নিয়ে পরে অনুতাপ করে। সে লোকটাকে চুপ করাবার পক্ষে এই যথেষ্ট হল। কিন্তু আমি বুঝলাম যা ঘটতে চলেছে তাতে আর যেই হাসুক আমার পক্ষে মোটেই হাসির কথা হবে না। শেঠেরা অবশ্য বড়ই অমায়িক ব্যবহার করলেন। আমি কুঠি ছেড়ে চলে এলাম।

‘…শেঠেদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে একটা অদ্ভুত ঘটনা মনে পড়ছে⋯। কথা বলতে বলতে সিরাজউদ্দৌলাহ্র প্রসঙ্গ উঠল। বিশেষ করে তাঁর হিংস্র স্বভাবের কথা। শেঠেদের ও আমাদের উভয়েরই তাঁর দিক থেকে কি কি কারণে শঙ্কা আছে সেই কথা উঠল। আমি বললাম, আপনারা কি চান তা ভালোই বুঝতে পারছি, আপনারা চান যে ভাবেই হোক নতুন নবাব বানাতে। শেঠেরা এ কথা অস্বীকার না করে নিম্নস্বরে বললেন, এসব আলোচনা করা ঠিক নয়। ইংরেজদের চর উমিচাঁদ, যে কথায় কথায় বলে উঠত ‘তফাৎ যাও’ সে সেখানে উপস্থিত ছিল। কথাটা যদি মিথ্যে হত, তাহলে শেঠেরা নিশ্চয় তা খণ্ডন করে আমাকে অমন ভাবে কথা বলার জন্য তিরস্কার করতেন। এমনকি তাঁরা যদি ভাবতেন আমি তাঁদের পরিকল্পনায় বাধা দেবো, তাহলেও তাঁরা কথাটা অস্বীকার করতেন। কিন্তু আগেকার ঘটনাবলী বিশেষ করে নবাবের হাতে আমাদের দুর্দশা এবং নবাবকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্য না করার ব্যাপারে আমাদের বদ্ধপরিকর ভাব স্মরণ করে তাঁদের ধারণা হয়েছিল, ইংরেজরা শুধু আমাদের না ঘাঁটালেই আমরাও নবাবকে বিতাড়িত হতে দেখলে খুশি হবো। আসলে শেঠরা তখনো আমাদের শত্রু বলে দেখতে শুরু করেননি—তাঁরা সাদা মনেই এ কথা বলেছিলেন যে ইংরেজরা আমাদের আক্রমণ করবে না। ⋯

শেঠেদের বাসায় যাবার পরের দিন সকালে লোক লস্কর পাঠাতে তাড়া দেবার জন্য দরবার গেলাম। ⋯নবাব বললেন ফৌজের এক অংশ রওনা হয়ে গেছে। সে কথা সত্যি। খোজা ওয়াজিদ সেখানে ছিলেন, তা সত্ত্বেও নবাবের বিরুদ্ধে কি চক্রান্ত হচ্ছে তা তাঁকে বলবার সুযোগ মিলে গেল। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিলাম, কিন্তু সেই হতভাগা যুবক হাসতে শুরু করল। সে ভাবতেই পারে না কেমন করে আমি এ সব কথা বিশ্বাস করে বোকা বনতে পারি। সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র ভাব দেখে মনে হল তিনি সত্যিই বিশ্বাস করেন না, কিন্তু সেটা ভান হতে পারে। শেঠদের তিনি ঘৃণা করতেন এবং তাঁর প্রতি তাদের এবং জাফর আলি খান [মীর জাফর] খোদাদাদ খান (খুদা ইয়ার লতিফ খান], রায় দুর্লভ রাম এবং আরো অনেকের কতটা বিদ্বেষ তাও নিশ্চয় জানতেন। তাহলে কেন তিনি তাদের দুরভিসন্ধি আটকাতে চেষ্টা করলেন না? আমি এই অর্থহীন ব্যবহারের একটা কারণ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাই না—সে হল মোহনলালের অসুস্থতা নিবন্ধন নবাবের একলা পড়ে যাওয়া, কাকে বিশ্বাস করবেন তা তিনি জানতেন না। কিংবা শত্রুদের ভুলাবার জন্য ভান করছিলেন যেন তাদের বিশ্বাস করেন⋯।’৫৮

সন্দেহ করা হয়, মোহনলালকে কেউ বিষ দিয়েছিল। মোহনলাল ফরাসীদের মদত দিতে পরামর্শ দেবেন, এই আশায় নবাবের সঙ্গে মঁসিয় ল’ রোগশয্যায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন মোহনলালের কথা বলবার মতো অবস্থা ছিল না। পরে অবশ্য তিনি বিপুল চেষ্টায় রোগশয্যা থেকে উঠে দরবারে হাজির হন। কিন্তু ততদিনে ফরাসীরা চন্দননগর থেকে উৎখাত হয়েছে। মোহনলাল শয্যাগত হওয়ায় নবাবের শত্রুরা মাথা চাড়া দিল। জগৎশেঠের দাবার ছক ততদিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এবার শেঠেরা চাল দিলেন। কাশিমবাজারে মঁসিয় ল’ থাকলে নবাবকে সম্পূর্ণ নিঃসহায় অবস্থায় পাওয়া যায় না। ইংরাজদের হুমকি শুনে জগৎশেঠের পরামর্শ মতো নবাব মঁসিয় ল’কে বাংলা থেকে অবিলম্বে চলে যেতে বললেন। তখনো মোহনলাল দরবারে যোগ দিতে পারেননি। জগৎশেঠের উকিল এবং দরবারের অন্যান্য ওমরাওরা এক রকম ঠেলে মঁসিয় ল’কে পাটনার পথে রওনা করিয়ে দিল। ৫৯ কিন্তু কথামালার নেকড়ের মতো ইংরেজরা এতেও সন্তুষ্ট হল না। জগৎশেঠ তাদের ঘন ঘন বলে পাঠাতে লাগলেন, নবাব সুযোগ পেলেই আপনাদের ঘায়েল করবেন। অন্য দিকে নবাবকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে, তাদের দিন দিন বেড়ে ওঠা দাবি-দাওয়ার বিরুদ্ধে, উত্তেজিত করতে লাগলেন। কোনোও বাহ্য কারণ না থাকা সত্ত্বেও আলিনগরের আহাদনামা ভেঙে গেল। জগৎশেঠের উসকানিতে এই ঘটনা ঘটল। মঁসিয় ল’ তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘শেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ই পলাশীর বিপ্লবের জন্মদাতা; তাঁদের ছাড়া ইংরেজরা কখনোই কিছু করতে পারত না। ’৬০

কি পদমর্যাদায়, কি ধনসম্পদে, কি বা দরবারে প্রভাব প্রতিপত্তিতে, জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ের পরেই যাঁর নাম আসে তিনি খোজা ওয়াজিদ। ক্লাইভের সুহৃদ রবার্ট অর্ম (ঐতিহাসিক Orme) পলাশীর যুদ্ধের কয়েক বছর আগে বাংলায় কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। তাঁর বিপুল কাগজপত্র ও সুবৃহৎ ইতিহাসে জগৎশেঠের এই বর্ণনা পাই— ‘The Greatest shroff and banker in the known world,’৬১ আর খোজা ওয়াজিদ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য—‘The Principal merchant of the province’।৬২ সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র নবাব হবার অব্যবহিত আগে ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে কাশিমবাজার থেকে ওয়াট্স্ ও কলেট লিখেছিলেন, ‘Coja Wazeed the greatest merchant in Bengal…resides in Hughley and has great influence with the Nabab.৬৩ খোজা ওয়াজিদ জাতিতে আরমানী ছিলেন। তাঁর বাবার নাম খোজা ফাজৈল। কেমন করে এই পরিবার ভারতে আসে তা জানা যায় না। সম্ভবত পিতাপুত্রের যুক্ত কারবার থেকে খোজা ওয়াজিদের উন্নতির সূত্রপাত হয়। হুগলী এদের ব্যবসার কেন্দ্র ছিল। কিন্তু পাটনার সঙ্গে এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। গোলাম হোসেন খান সিয়ারে এক জায়গায় ‘খ্বাজা আশরফ কাশ্মীরী’র উল্লেখ করে বলেছেন ইনি ‘নবাবের প্রিয়পাত্র ফকরুত্তুজ্জর খ্বাজা ওয়াজেদের ভাগিনেয়’। ৬৪ মীর আফজল ও মীর আশরফ পিতাপুত্র, এঁরা পাটনার সমৃদ্ধ সোরা-বিক্রেতা সওদাগর ছিলেন। কেমন করে কাশ্মীরী মুসলমান পরিবারের সঙ্গে আরমানী পরিবারের বৈবাহিক সূত্র স্থাপিত হয় সে সম্বন্ধে ইতিহাস নীরব। আর্মানিরা ধর্মে খ্রীস্টান, মুসলমানদের সঙ্গে তাদের বৈবাহিক আদান-প্রদান নেই। কিন্তু ইংরেজদের কাগজপত্রে দেখা যায় যে মীর আফজল ও খোজা ওয়াজিদ ব্যবসায় সূত্রে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং সোরা বেচাকেনার ব্যাপারে তাঁরা যুক্তভাবে আমীরচন্দ দীপচন্দর ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিলেন।৬৫ সম্ভবত মীর আফজল ও মীর আশরফ পাটনা থেকে খোজা ওয়াজিদের প্রয়োজন মতো হুগলীতে সোরা সরবরাহ করতেন এবং সে সোরা খোজা ওয়াজিদ হয় ওলন্দাজ বা ফরাসীদের কাছে বেচতেন নয় নিজেই জলপথে বিদেশে রপ্তানি করতেন। কিন্তু খোজা ওয়াজিদ ও তাঁর ভাগিনেয় মীর আশরফ বছরের অনেক সময় মুর্শিদাবাদে কাটাতেন। সেখানে মীর আশরফের হুন্ডির কারবার ছিল সে প্রমাণ আছে। ৬৬ ফরাসী ও ওলন্দাজদের সঙ্গেই খোজা ওয়াজিদের বিশেষভাবে কারবার ছিল বলে চন্দননগর ও চুঁচুড়ায় তাঁর কুঠি ছিল। তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই জুব্বো ব্যবসাসূত্রে চুঁচুড়াতেই বসবাস করতেন।৬৭

সমসাময়িক কাগজপত্র থেকে যতদূর বোঝা যায়, আলিবর্দি খানের আমলে খোজা ওয়াজিদের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে। অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে তিনি বাংলার প্রধান সওদাগর বলে পরিগণিত হন। ওলন্দাজদের কাগজপত্রে দেখা যায়, ১৭৫৫ নাগাদ খোজা ওয়াজিদ দরবার থেকে ‘ফকর-উৎ-তুজ্জর’ খেতাব লাভ করেন। পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদে হাজি মুস্তাফা শুনেছিলেন, এক নওরোজের সময়েই খোজা ওয়াজিদ নবাবকে পনের লক্ষ টাকা নজর দিয়েছিলেন।৬৮ খোজা ওয়াজিদ দায়ে পড়ে কষ্টেসৃষ্টে উপহার দিতেন না, নিজেই আগ্রহ ভরে নবাবকে নজর দিতেন। আলিবর্দি খানের দরবারের আমীর ওমরাওদের সমৃদ্ধির পেছনে তাঁর যথেষ্ট দান ছিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওলন্দাজদের নজর থেকে এর তাৎপর্য এড়োয়নি। তাদের কুঠির প্রধান মত প্রকাশ করেছিলেন, খোজা ওয়াজিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে পারলে অস্টেন্ড কোম্পানির উপকার হবে।৬৯ খোজা ওয়াজিদ যে ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন তাতে দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অপরিহার্য ছিল। দরবারে খুঁটির জোর না থাকলে সোরার ব্যবসা চলত না। সুবাহ্ বাংলার পান, তামাক ও নুনের মতো, সুবাহ্ বিহারের সোরা ও আফিম সরকারের একচেটিয়া ছিল। খোজা ওয়াজিদ বাংলার নুন এবং বিহারের সেরা উভয় ব্যবসায়েই বহু টাকা লগ্নি করেছিলেন। আগেকার কালে পাটনা দরবারের আমীর ওমরাওরা নিজেরাই সোরার একচেটিয়া ব্যবসা করতেন। অষ্টাদশ শতকে ওলন্দাজ ও ইংরেজরা ক্রমবর্ধমান পরিমাণে সোরা কিনতে শুরু করায় তাদের সরবরাহের জন্য এই ব্যবসায়ে দেশীয় সওদাগরদের আনাগোনা শুরু হল। নবাব সরকার সোরা ইজারা দিয়ে থোক টাকা পেতে লাগলেন, আর ইজারা নিয়ে দেশীয় সওদাগররা ওলন্দাজ ও ইংরেজ কোম্পানিকে সোরা সরবরাহ করতে লাগল। ইজারা পেতে হলে দরবারে যোগাযোগ চাই, তাই দেখা গেল ছোট ছোট ব্যাপারীদের হটিয়ে দিয়ে বড় বড় সওদাগররা এই ইজারাগুলি কব্জা করে নিচ্ছেন। ১৭৪৫ খ্রীস্টাব্দে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে আমীরচন্দ দীপচন্দ ভ্রাতৃদ্বয়, পাটনা দরবার থেকে হুকুম করিয়ে নিলেন, এখন থেকে ইংরেজ ও ওলন্দাজরা একমাত্র তাঁদের কাছ থেকেই সোরা কিনবেন। কিন্তু ঐ হুকুম টিকল না—ইংরেজ ও ওলন্দাজরা ঘুষ দিয়ে তখনকার মতো হুকুম রদ করিয়ে নিল। ১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে দেখা গেল সোরা নিয়ে একদিকে আমীরচন্দ দীপচন্দ, অন্যদিকে মীর আফজল-খোজা ওয়াজিদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। পরের বছর থেকে সোরার ব্যবসায়ে একচেটিয়া ব্যবসায়িক প্রভুত্ব স্থাপিত হল। ১৭৪৯ থেকে ১৭৫৩ পর্যন্ত নবাব সরকার একনাগাড়ে পাটনার প্রধান সোরার বণিক মীর আফজলকে একচেটিয়া সোরা বেচার ইজারা দিলেন। ১৭৫৩ থেকে ঐ ইজারা মীর আফজলের শ্যালক খোজা ওয়াজিদের হাতে গেল।৭০ খোজা ওয়াজিদ এর আগে থেকেই সোরার ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। এককালে ইংরেজ ও ওলন্দাজরা হুগলী থেকে সওদাগরদের কাছ থেকে সোরা কিনত। তাদের সরবরাহের জন্য খোজা ওয়াজিদ হুগলীতে সোরা আমদানি করতেন। পরবর্তীকালে কম দামের আশায় ইংরেজ ও ওলন্দাজরা সরাসরি পাটনা থেকে সোরা সংগ্রহ করতে শুরু করেছিল। অনুমান করা যায়, খোজা ওয়াজিদও ঐ একই টানে হুগলীর সোরা আমদানি ব্যবসায়ের গণ্ডি পেরিয়ে সরাসরি পাটনাতে সোরা ব্যবসায়ে নেমেছিলেন। সরাসরি ইজারা নেবার আগেই সোরা ব্যবসায়ের সূত্রে ১৭৪২ খ্রীস্টাব্দে তিনি পাটনার সওদাগর ও শেঠদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করেন।৭১ ১৭৪৯ থেকে মীর আফজলের একচেটিয়া ইজারার সঙ্গে তিনি পরোক্ষে যুক্ত ছিলেন অনুমান করা যায়। নিজের নামে সোরার ইজারা নেবার আগের বছর, অর্থাৎ ১৭৫২ খ্রীস্টাব্দে, তিনি বাংলার নুনের ইজারাও হস্তগত করেন। মাত্র ২৫০০০ থেকে ৩০০০০ টাকা দিয়ে তিনি নুনের একচেটিয়া ইজারা নেন এবং এতে তাঁর উপর মাত্র শতকরা ১ বা তারও কম মাশুল ধার্য করা হয়। বহু বছর তাঁর হাতে এই ইজারা ছিল। পলাশীর যুদ্ধের আগে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি নুন ও সোরার একচেটিয়া ব্যবসায়ী ছিলেন।

খোজা ওয়াজিদের ৫ খানা জাহাজ ও ২০০০ খানা নৌকা ছিল তা আগে বলা হয়েছে। নুন, সোরা ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্য নিয়ে তাঁর নৌকার সারি জলপথে নিম্নবঙ্গ থেকে পাটনা পর্যন্ত ওঠানামা করত। কিন্তু তিনি শুধু অন্তর্বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন না। তাঁর পাঁচখানা জাহাজ সমুদ্রপথে সুরত বন্দর এবং দেশের বাইরে যেত। যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন কলকাতার মারাত্মক প্রতিযোগিতায় মোগল বন্দর হুগলীর বহির্বাণিজ্য অনেক পড়ে গেছে। মুর্শিদকুলী খানের আমলে যেখানে বছরে ২৯ খানা জাহাজ হুগলী পর্যন্ত আসতে দেখা যেত আলিবর্দি খানের আমলে সেখানে বড়ো জোর ১২ খানা জাহাজ কলকাতা পেরিয়ে হুগলী পর্যন্ত আসত। হুগলীর এই পড়ন্ত দিনে খোজা ওয়াজিদই বাইরে জাহাজ পাঠানোর ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন। হুগলিতে যে সব জাহাজ আনাগোনা করত, তার প্রায় অর্ধেক তাঁর সম্পত্তি ছিল বলে অনুমান করা যায়। সুরত বন্দরে তাঁর নিজের কুঠি ছিল।৭২ সুরতের কুঠি থেকে তাঁর গোমস্তারা পারস্য উপসাগর ও লোহিত সাগরের সঙ্গে বাণিজ্য চালাত।৭৩ এইভাবে দেশের অভ্যন্তরে পাটনা থেকে হুগলী হয়ে খোজা ওয়াজিদের বাণিজ্য সুরত বন্দর পর্যন্ত এবং সেখান থেকে বসরা, মোখা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পলাশীর আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যে প্রাচ্যের বণিকরা পাশ্চাত্যের বণিকদের হাতে মার খেলেও সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়নি।

লক্ষ্য করবার বস্তু এই যে, কলকাতা ও কাশিমবাজার উদীয়মান ইওরোপীয় কোম্পানিগুলির ঘাটি হয়ে উঠেছিল, কিন্তু হুগলী ও পাটনা তখনো ভগ্ন মোগল সাম্রাজ্যের বণিকদের ঘাঁটি ছিল। হুগলী ও পাটনার যিনি প্রধান সওদাগর, তিনি তাই পাশ্চাত্যের বণিকদের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদ ও লেনদেনের ব্যাপারে প্রাচ্যের বণিক সমাজের নেতৃত্বপদে বৃত হয়েছিলেন। মোগল সাম্রাজ্যের সওদাগরদের মধ্যে প্রথা ছিল, দুই বণিকের বিবাদে অন্যান্য বণিকরা পঞ্চায়েৎ বসিয়ে সালিশে নিষ্পত্তি করে দেবে। কিন্তু কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানি তা না করে মেয়র্স কোর্টে মামলা এনে বিবাদ নিষ্পত্তির চেষ্টায় ছিল। আলিবর্দি খানের আমল থেকে এ ব্যাপারে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বণিক সমাজের বিবাদ ঘনিয়ে ওঠায় খোজা ওয়াজিদ দেশীয় বণিকদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৭৪৪ খ্রীস্টাব্দে সোরা বেচাকেনার হিসাবপত্র নিয়ে আমীরচন্দ দীপচন্দের সঙ্গে ঝগড়া করে ইংরাজ কোম্পানী মেয়র্স কোর্টে ব্যাপারটা টেনে নিয়ে গেলে, খোজা ওয়াজিদ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। সালিশী না মানায় ইংরেজদের তিরস্কার করে তিনি লিখেছিলেন— ‘আপনারা সওদাগরদের রেওয়াজ উল্টে দিয়েছেন।’ মেয়র্স কোর্টের ফাঁদে দীপচন্দ কলকাতায় আটকে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত খোজা ওয়াজিদই আটাত্তর হাজার টাকার জামিন দিয়ে দীপচন্দ যাতে পাটনা ফিরে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করে দেন।৭৪

শুধু মোগল সাম্রাজ্যের সওদাগরদের হয়ে নয়, নবাব দরবারের পক্ষ থেকেও তিনিই ইংরাজ, ওলন্দাজ, ফরাসী ও দিনেমার কোম্পানিগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বজায় রাখতেন। ওলন্দাজ ও ফরাসীদের সঙ্গে তাঁর লেনদেন ছিল এবং দরবারে তিনি ফরাসীদের হয়ে ওকালতি করতেন। তাই থেকে দরবারে ধারণা হয়েছিল, ইংরেজদের সঙ্গে আদান-প্রদানের ব্যাপারেও তিনি যোগ্যতম প্রতিনিধি। বস্তুতঃপক্ষে আমীরচন্দের মাধ্যমে ইংরেজদের সঙ্গেও তাঁর লেনদেন ছিল। ১৭৫৩ খ্রীস্টাব্দে সোরার একচেটিয়া ইজারা ওয়াজিদের হাতে চলে যাওয়ায় ইংরেজরা ফাঁপরে পড়েছিল, এবার কার কাছ থেকে সোরার ইনভেস্টমেন্ট খরিদ করা যুক্তিযুক্ত—আমিরচন্দের কাছে না খোজা ওয়াজিদের কাছে? এই তর্ক সংক্রান্ত ইংরেজদের নিজেদের কাগজপত্রে দেখা যায়, কলকাতা কাউন্সিলের বেশির ভাগ সদস্য, দরবারের সঙ্গে খোজা ওয়াজিদের সম্পর্ক কত ঘনিষ্ঠ তা উপলব্ধি করে তাঁর সঙ্গে কারবার করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। অনেকে তাঁকে দরবারের ওমরাও বলে গণ্য করতেন। কিন্তু ইংরেজদের চেয়ে ফরাসীদের সঙ্গে তাঁর লেনদেন অনেক বেশি ছিল বলে খোজা ওয়াজিদ এই সময় ইংরেজ কোম্পানিকে তত পাত্তা দেননি।

আলিবর্দির মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলাহ্ নবাব হলে পর মুর্শিদাবাদ দরবারে খোজা ওয়াজিদের সম্মান ও প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। শুধু তাই নয়, ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে যুদ্ধ ঘনিয়ে আসায় তাঁর রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকার্য ও কূটনৈতিক তৎপরতার গুরুত্ব আরো বেড়ে উঠল। জগৎশেঠদের প্রতি তরুণ নবাবের বড়ো বিতৃষ্ণা, কিন্তু খোজা ওয়াজিদের উপর তাঁর বিপুল আস্থা। ইংরেজদের বাগে আনবার জন্য তাদের কেল্লা ধূলিসাৎ করবার হুকুম দিয়ে ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে সিরাজউদ্দৌলাহ্ খোজা ওয়াজিদকে পরপর যেসব চিঠি দিয়েছিলেন, তা আগে উদ্ধৃত করা হয়েছে। সে থেকেই বোঝা যাবে ওয়াজিদ নবাবের কতটা আস্থাভাজন ছিলেন। মুর্শিদাবাদের দরবারের রাজনীতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল মঁসিয় ল’র স্মৃতিকথায় দেখা যায় খোজা ওয়াজিদ দরবারে নবাবের ‘ফিরিঙ্গি-বিশারদ’ (Confidential agent with the Europeans’) নামে পরিচিত ছিলেন। ৭৫ ইংরেজরা মনে করত ওয়াজিদ ফরাসীদের পক্ষপাতী। ফরাসীরা নিজেরাও মনে করত খোজা ওয়াজিদ দরবারে ফরাসীদের সব চেয়ে বড়ো মিত্র। কিন্তু ইংরেজরা হুগলী লুঠ করার সময় খোজা ওয়াজিদের বোধোদয় হল যে এরা বড়ো সহজ পাত্র নয়। ঘর জ্বালানী ও লুঠতরাজে তাঁর অনেক ক্ষতি হয়েছিল। ভয়ের চোটে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদ যাতে চট করে মিটে যায় সেইজন্য তিনি ফরাসীদের সালিশ মানবার প্রস্তাব আনলেন। কিন্তু ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসীদের যুদ্ধ তখন বাধে বাধে, তাই ফরাসীদের সালিশ মানার প্রস্তাবে ক্লাইভ সম্মত হলেন না। তিনি বললেন, জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদ মিলে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিন। লুঠতরাজে ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াজিদ যাতে রাগ করে বিপক্ষ দলে না চলে যান সেই জন্য মিষ্ট সুরে ক্লাইভ আরো লিখলেন: ‘It was with great concern I heard of your losses at Hughley, which I think must be very considerable, but I do assure you what was done there was not meant against you, but against the city of Hughley for the ruin of Calcutta…I cannot upon many accounts approve of the intervention of the French in these affairs. Your integrity and frendship I can safely rely on, and beg that you and the Seats [Jagat Seths) will be mediators between the Nabab and us.’৭৬ বাংলা প্রবাদে আছে (বোধ করি তখনও ছিল):

মিষ্টি কথায় মন ভেজে, চিঁড়ে ভেজে কই
চিঁড়ে যদি ভেজাতে চাও, আগে আনো দই ॥৭৭

খোজা ওয়াজিদ ক্লাইভের কথায় কান না দিয়ে (বিশেষ করে ক্লাইভ যেখানে দইয়ের বিন্দুমাত্র উল্লেখ করেননি) ফরাসীদের মাধ্যমে তাঁর চিঠির উত্তর দিলেন। অর্থাৎ ফরাসীদের মধ্যস্থ রাখতে তিনি বদ্ধপরিকর। কলকাতায় ইংরেজদের টাঁকশাল খোলার কথাটা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিলেন।৭৮ কিন্তু ক্রমে ক্রমে লাঠ্যৌষধি কাজে লাগতে শুরু করল। কুয়াশায় খাবি খেয়ে আলিনগরের আহাদনামায় নবাব ক্লাইভের টাঁকশালের দাবিটা মেনে নিলেন। তার পরই ত্রস্ত হয়ে খোজা ওয়াজিদ দেখলেন ইংরেজরা ফরাসডাঙায় ফরাসীদের উপর চড়াও হয়েছে। ফরাসীদের মদত দিতে নবাবী ফৌজ পাঠানোর জন্য তিনি নবাবের সঙ্গে মঁসিয় ল’র দেখা করিয়ে দিলেন। নিভৃত সাক্ষাৎকারের সময় খোজা ওয়াজিদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। খোজা ওয়াজিদের সাক্ষাতে নবাব মঁসিয় ল’কে আশ্বাস দিলেন, তিনদিনের মধ্যে পাঁচ হাজার সওয়ার, পাইক ও বরকন্দাজ রওনা হয়ে যাবে। ৭৯ তা ছাড়া নবাব হাতে হাতে ফরাসীদের এক লক্ষ টাকা পাঠালেন (সে টাকায় ফরাসীরা বিপুল বিক্রমে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করেছিল) এবং আশ্বাস দিলেন, ইংরেজদের ঠেকাতে পারলে তারাও চন্দননগরে নিজেদের টাঁকশাল বসাতে পারবে।৮০ কিন্তু অনেক ধরাধরি করেও মঁসিয় ল’ কিছুতেই নবাবী সওয়ারদের রওনা করিয়ে দিতে পারলেন না। শেঠদের এ ব্যাপারে আপত্তি আছে দেখে ওয়াজিদ নবাবকে বলতে লাগলেন, ফরাসীরা এত মজবুত যে তারা সামিল ছাড়াই ইংরেজদের সঙ্গে খুব লড়াই করতে পারবে।৮১ বীতশ্রদ্ধ ল’ পরে খোজা ওয়াজিদের চরিত্রের নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছিলেন, ‘খোজা ওয়াজিদ⋯ছিলেন পুরুষ জাতির মধ্যে সব চেয়ে ভীতু লোক, যাঁর আগ্রহ সবার সঙ্গে দোস্তি রাখা এবং যিনি উদ্যত ছোরা দেখলে সিরাজউদ্দৌলাহ্কে আততায়ী আসছে বলে হুঁশিয়ার করাটা বেয়াদপি ঠাউরাতেন। হতে পারে তিনি শেঠদের ভালোবাসতেন না, কিন্তু তাদের এত ভয় পেতেন যে আমাদের পক্ষে তিনি একদম অকেজো হয়ে গিয়েছিলেন।’৮২

মঁসিয় ল’ একটা কথা জানতে পারেননি। তা এই যে কাশিমবাজার থেকে তিনি বিতাড়িত হবার পর তলে তলে খোজা ওয়াজিদ ইংরেজদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। আসলে ফরাসীরা পরাজিত হবার অব্যবহিত আগে এবং অব্যবহিত পরে, এই অল্প সময়ের ব্যবধানে দরবারের ভিতরকার চেহারাটা পাল্টে যাচ্ছিল। ইংরেজ ফরাসী উভয় পক্ষই টাকা দিয়ে দরবারের লোক হাতানোর চেষ্টায় ছিল। মঁসিয় ল’ উপস্থিত থাকাকালীন দরবারে দলগুলির যে রূপ ছিল, তিনি পাটনা রওনা দেওয়ার পর সেই আকার-প্রকার রইল না। তিনি যত দিন ছিলেন, ততদিন ফরাসীদের হয়ে কথা বলবার লোক ছিল চারজন—নবাব নিজে, শয্যাগত দেওয়ান সুবাহ্ মোহনলাল, ফকর-উৎ-তুজ্জর খোজা ওয়াজিদ এবং জগৎশেঠদের প্রভাব প্রতিপত্তিতে অসহিষ্ণু রায় দুর্লভ। অন্য দিকে ইংরেজদের ওকালতি করছিল দরবারের বেশির ভাগ লোক—জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়, মীর জাফর, খুদা ইয়ার লতিফ খান, ফৌজের অন্যান্য জমাদার, আলিবর্দি খানের আমলের অপমানিত মন্ত্রিবর্গ, দরবারের প্রায় সব মুনশী (অর্থাৎ এখনকার writer বা টাইপিস্ট), এমন কি হারেমের খোজারা। ৮৩ মঁসিয় ল’ বিতাড়িত হওয়া মাত্র মোহনলাল ও মীর মদন ছাড়া নবাবের সত্যকার মিত্র আর কেউ রইল না। দরবারের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে দেখে ইংরেজদের প্রতি যারা মৈত্রীভাবাপন্ন নয় তারাও ভয় পেয়ে নবাবের বিপক্ষে যোগ দিতে শুরু করল, এদের মধ্যে ছিলেন বণিকপ্রবর খোজা ওয়াজিদ।

১৬ এপ্রিল মঁসিয় ল’ মুর্শিদাবাদের বড়ো রাস্তা দিয়ে কুচ করে পাটনার দিকে বের হয়ে গেলেন। ওয়াজিদ বুঝলেন অবস্থা সঙ্গীন—ইংরেজদের সঙ্গে মিতালি না পাতাতে পারলে তাঁর দফা রফা। দরবারে ভয়ানক ষড়যন্ত্র চলছে, এ অবস্থায় একা পড়া নিতান্ত নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। নিজের প্রধান গোমস্তা শিববাবুকে তিনি মাসের শেষ দিকে কর্ণেল ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করতে পাঠালেন। লক্ষ্মী কুণ্ডু নামে কোনো এক বাঙালি দালালের মাধ্যমে শিববাবু, ক্লাইভের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করলেন। ক্লাইভ সাবধানে শিববাবুর সঙ্গে কথাবার্তা চালালেন, তখনকার মতো কিছু ভাঙলেন না। কিন্তু খুশি হয়ে মাদ্রাজের বড়ো সাহেব পিগটকে ৩০ এপ্রিল লিখলেন— নবাবের বিরুদ্ধে বহু বড়ো বড়ো লোক ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন, যাঁদের নেতা জগৎশেঠ নিজে, এবং সেই সঙ্গে খোজা ওয়াজিদ।৮৪ শিববাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সংবাদ শুনে মহা চিন্তিত হয়ে ৩ মে তারিখে কাশিমবাজার থেকে ওয়াট্স্ ক্লাইভকে লিখলেন—দরবারে ওয়াজিদ আমাদের প্রধান শত্রু এবং ফরাসীদের সবচেয়ে বড়ো সহায়। শিববাবু নিশ্চয় গুপ্তচর, তার মতলব আমাদের বেনিয়ান ও চাকরদের কাছ থেকে খবর হাঁটকে বের করে নবাবকে আমাদের বিরুদ্ধে লাগানো। ৮৫ ক্লাইভ আশ্বাস দিয়ে লিখলেন, তিনি শিববাবুকে কিছু ভাঙেন নি। সে মিস্টার ড্রেকের কাছ থেকে কিছু সংবাদ নিয়ে নবাবের হুকুমে মুর্শিদাবাদ ফিরছে, তার উপর নজর রাখুন।৮৬ এই সময় এমন একটা ব্যাপার ঘটল যাতে ওয়াজিদের উপর ওয়াট্সের বিশ্বাস জন্মাল। যে কারণেই হোক, নবাব হঠাৎ ওয়াজিদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমীরচন্দের মাধ্যমে ওয়াজিদ ওয়াট্সের কাছে খবর পাঠালেন, কোনো মতে কাশিমবাজারের কুঠিতে তাঁকে লুকিয়ে রাখা হোক। ওয়াজিদের কাছেই ওয়াট্স্ শুনলেন, যে সময় ওয়াজিদ নবাবের ঘনিষ্ঠ পরিষদ ছিলেন, তখন তিনি নিজের চোখে দেখেছেন নবাব দাক্ষিণাত্যের ফরাসী সেনাপতি বুসীকে বাংলায় আসতে বার বার চিঠি লিখেছেন।৮৭ দরবারের বিপদজনক পরিধি থেকে বেরিয়ে ওয়াজিদ হুগলীতে সরে পড়বার মতলব ভাঁজছিলেন। ৮৮ কিন্তু তিনি নজরবন্দী হয়ে পড়ায় এক পাও বেরোতে পারলেন না।৮৯ এ দিকে শিববাবুর সঙ্গে আর একবার কথাবার্তা বলে ক্লাইভ নিজেও তাঁর মনিবের অভিসন্ধি সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে ওয়াট্স্‌কে লিখলেন, ‘I heartily wish it were in my power to serve his master.’৯০ ক্লাইভ ওয়াজিদের কোন্ কাজে লেখেছিলেন ইতিহাসে তার কোনো সাক্ষ্য নেই, কিন্তু ওয়াজিদ ক্লাইভের কাজে লেগেছিলেন তার প্রমাণ আছে। ওয়াজিদের কাছ থেকেই ইংরেজদের কাছে খবর এল, বুসী নবাবকে লিখে জানিয়েছেন তিনি আসতে পারবেন না, এবং এই চিঠি পেয়ে নবাব মঁসিয় ল’কে টাকা পাঠিয়ে পত্রপাঠ মুর্শিদাবাদে ফিরে আসতে লিখেছেন। ৯১ এদিকে মঁসিয় ল’ দরবারের পরিবর্তিত হালচাল না জেনে ওয়াজিদের কাছে চিঠি লিখলেন, নবাবের পত্র পেয়ে তিনি পাটনা থেকে ফিরতি পথে ভাগলপুর এসে পৌঁছেছেন। বন্ধুত্বের অভ্রান্ত নিদর্শনরূপে ওয়াজিদ এই চিঠিও ইংরেজদের হাতে তুলে দিলেন।৯২

জগৎশেঠ মহতাবচন্দ ও ফকরুত্তুজ্জর ওয়াজিদ বিশিষ্ট সম্মানিত রঈস লোক ছিলেন, তাঁরা কেউ ইংরেজদের দূতিয়ালি করবার পাত্র নন। এ কাজের জন্য ইংরেজরা দুজন সওদাগরকে চর নিয়োগ করেছিল—একজন আমীরচন্দ, অন্যজন খোজা পেত্রস। আমীরচন্দের কার্যকলাপ অনুধাবন করবার আগে সংক্ষিপ্তভাবে পেত্ৰস সংবাদ নিয়ে রাখা দরকার। খোজা পেত্ৰসের পিতৃপরিচয় জানা নেই। তিনি জাতিতে আর্মানী ছিলেন এবং তাঁর নিজের হাতের সই থেকে প্রমাণ হয় তাঁর আসল নাম পেত্ৰস আরাতুন (Petross Arratoon)। ১৭৬৩ খ্রীস্টাব্দে মীর কাশিমের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় গুপ্তচর সন্দেহে ইংরেজরা যখন পেত্ৰস আরাতুনকে কলকাতা থেকে বের করে দিতে উদ্যত, তখন তিনি এক লিখিত আবেদনে জানান তিনি প্রায় চৌদ্দ পনের বছর ধরে কলকাতায় আছেন।৯৩ এ থেকে প্রমাণ হয় তিনি অন্তত ১৭৪৯ খ্রীস্টাব্দ থেকে কলকাতায় বসতি গেড়েছিলেন। তাঁর ভাই খোজা গ্রেগোর মীর কাশিমের গোলন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি হয়ে গুরগিন খান নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়েছিলেন (ঐ সময় ইংরেজরা ভ্রাতৃপরিচয়ে দাদার উপর সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে)। খোজা পেত্ৰস কি ব্যবসা করতেন জানা নেই। তবে গুরগিন খানের উপর বিরূপ গোলাম হোসেন খান বার বার উল্লেখ করেছেন কৈশোরে খোজা প্রোগোর গজ মেপে মেপে কাপড় বিক্রী করতেন। হয়তো তাঁর দাদা বস্ত্র বণিক ছিলেন এবং ইংরেজদের কাপড় সরবরাহ করতেন। পেত্রসের আর এক ভাই আগা বারসিক বা মিস্টার আরাতুন নুনের ব্যবসা করতেন। বিদেশী বলে আর্মানী ও ইহুদীদের মধ্যে বরাবর সদ্ভাব আছে—খোজা পেত্ৰসও এব্রাহাম জেকব্স্ নামে এক ইহুদীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ (সম্ভবত ব্যবসায় সূত্রে) ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলাহ্ কর্তৃক কলকাতা দখলের সময় ইংরেজদের ‘ফ্যাক্টরির’ মধ্যে সমবেত হয়ে যারা নবাবের ফৌজকে বাধা দান করেছিল, তাদের মধ্যে খোজা পেত্রস ছিলেন। ৯৪ তারপর কলকাতা থেকে বিতাড়িত হয়ে ইংরেজরা ফলতায় জাহাজের উপর অশেষ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে, এমন সময় খোজা পেত্ৰস আব্রাহাম জেকব্সের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইংরেজদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। এ কাজে বিপদের ঝুঁকি ছিল। সম্ভবত দুজনেই ইংরেজদের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে এই ঝুঁকি নেওয়া—‘মূর’ ৯৫ অধ্যুষিত আলিনগরে আর্মানি ও ইহুদী বন্ধুদ্বয় নিতান্ত ভয়ে ভয়ে ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের দেড় বছর বাদে স্থানীয় ইংরেজদের কাছে কিছু প্রাপ্তি না হওয়ায় পেত্রস লন্ডনের কোর্ট অফ ডিরেক্টর্স-এর কাছে পুরস্কারের আশায় পলাশীর ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকার সবিস্তার বর্ননা দেন। ৯৬ তার সংক্ষিপ্তসার এই:

‘ইংরেজদের দুঃখ দুর্দশা দেখে আব্রাহাম জেকব্স্ নামে এক ইহুদী ও আমি বিচলিত হলাম। তাদের উদ্ধারের জন্য উক্ত আব্রাহাম জেকব্স্ আমাকে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে অনুরোধ করলেন। এমন মানবোচিত দয়ামায়ার ব্যাপারে আমি সহজেই রাজি হয়ে তাঁর কাছে ইংরেজদের সহায় হবে বলে জীবনপণ করলাম। তখন মূরের ছদ্মবেশে আব্রাহম জেকব্স্ আমার বাড়িতে থাকতে লাগলেন। দুজনে পরামর্শ করে ঠিক করলাম, প্রথম কাজ হল মূরদের সঙ্গে যাঁর বিশেষ খাতির সেই উমিচাঁদকে দলে নেওয়া। এর আগে মিস্টার ড্রেক আর কাউন্সিল তাঁকে দুবার বলেও ফল পাননি, এমন কি একটা উত্তর পাননি, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমরা তাঁকে দলে টানতে সমর্থ হলাম এবং গাঁয়ের লোকদের ফলতার বাজারে পূর্বেকার বাধা নিষেধ এড়িয়ে খাবার-দাবার আনতে রাজি করালাম। ঐ ধান্দাবাজ হতচ্ছাড়াদের হাতে কিছু গুঁজে না দিয়ে কোনো কাজ করানোর উপায় ছিল না, তাই আমাদের বিধ্বস্ত সম্পত্তি থেকেই তাদের হাতে কিছু গুঁজে দিতে হল। তারপর আমরা মেজর কিলপ্যাট্রিককে কলকাতার গভর্নর মানিকচন্দকে লিখতে পরামর্শ দিলাম।৯৭ সে চিঠি পৌঁছে দিয়ে তার সদুত্তরও আমরাই আনলাম। এতে উৎসাহিত হয়ে আমরা মেজরকে পরামর্শ দিলাম খোজা ওয়াজিদ আর জগৎশেঠের কাছে চিঠি লিখুন। সে চিঠিও আমরাই হুগলীতে খোজা ওয়াজিদ ওজগৎশেঠের গোমস্তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তার সন্তোষজনক উত্তর নিয়ে ফিরলাম। এর সুফল স্বরূপ হিজ ম্যাজেস্টির স্কোয়াড্রন পৌঁছে যাবার আগেকার সময় অবধি মূরেরা ইংরেজদের উপর আর চোটপাট করল না। উক্ত আব্রাহাম জেকব্স্ এবং আমি নিরন্তর নদীর উপর নীচ করতে করতে যা সাহায্য বা খবরাখবর পারতাম সংগ্রহ করে আনতাম। এর জন্য চাকরবাকর, নৌকা ও মূরদের অধস্তন কর্মচারীদের হাতে নজর দেবার খাতে আমাদের অনেক খরচ হয়েছিল, তার উপর ধরা পড়বার আশঙ্কা তো ছিলই। ফলতায় মিস্টার ড্রেক আর মেজর কিলপ্যাট্রিকের কাছ থেকে আমরা যা টাকা পেয়েছিলাম তা মাত্র ১৫০ টাকা এবং ৩৮০ টাকা, এর মধ্যে শেষ টাকাটার সবই এতে খরচ হয়ে গিয়েছিল। আগেই ইঙ্গিত করেছি শহর লুঠের সময় আমাদের সম্পত্তির বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছিল এবং আমরা রীতিমতো দুরবস্থায় পড়েছিলাম। নবাবের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হলে হারিয়ে যাওয়া বাদশাহী ফারমান দরকার হবে বুঝে দৈবাৎ উইলিয়াম ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড এস্কোয়ারের কাগজপত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া ফারমানের কপি নিয়ে আমরা টাকা দিয়ে হুগলীর এক কাজীর কাছ থেকে মোগল সরকারি ছাপ দেওয়া পাকা অনুলিপি যোগাড় করে এনেছিলাম। ১৭৫৬-র অক্টোবরের গোড়ায় বোঝাপড়ার জন্য উমিচাঁদের মুক্সাদাবাদ যাত্রাকালে উক্ত আব্রাহাম জেকব্স্ চুঁচুড়াতে ক্লান্তিজনিত অসুস্থ হয়ে পড়ায়, সমস্ত ভার আমার উপরই এসে পড়ল। আমি উপরোক্ত ভাবে ক্রমাগত ফলতা আসা যাওয়া করতে লাগলাম, যত দিন না হিজ ম্যাজেস্টির স্কোয়াড্রনের সঙ্গে চিরস্মরণীয় অ্যাডমিরাল ওয়াটসন ও কর্নেল ক্লাইভ এসে স্থির করলেন সেরাজুৎদৌলার মতো বিশ্বাসঘাতক প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী নবাবের সঙ্গে ভালো ভাবে কিছু করা সম্ভব নয়। ফলে ইংরেজদের তরফ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করে কলকাতা পুনর্দখল করে কর্নেল তাঁর সৈন্য নিয়ে শহরের উপর দিকে ছাউনি ফেললেন। নবাবও মুর্শিদাবাদ থেকে কুচ করে এসে তাঁর সন্নিকটে ছাউনি গেড়ে বসলেন। ৯৮ যাই হোক, রব উঠল সন্ধি করা যাক এবং দুদলের মধ্যে কথাবার্তা চালানোর জন্য আমাকে নিয়োগ করা হল। পরে সন্ধিতে যে ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয় তা আদায়ের জন্য মিস্টার ওয়াট্স্‌কে ও আমাকে মুক্সাদাবাদ পাঠানো হল। ক্ষতিপূরণের বকেয়া অংশ আদায়ের জন্য মিস্টার ওয়াট্স্ ও আমি যেরকম বেগ পেয়েছিলাম তা বলে বোঝান যায় না। সে সাহেব যা খবর পেলেন তাতে স্পষ্টই বোঝা গেল নবাব ইংরেজদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফরাসীদের সঙ্গে গোপনে যোগসাজস করছেন। নবাবের ব্যবহারেও মিস্টার ওয়াট্স্ তার প্রমাণ পেলেন, কারণ তিনি যখন বকেয়া টাকার জন্য আমাকে নবাবের কাছে পাঠালেন, তখন নবাব তাঁকে জীবনহানির ভয় দেখালেন। ইতোমধ্যে কোম্পানির ও সর্বসাধারণের হিতৈষী মিস্টার ওয়াট্স্ আমাকে নবাবের এক অন্যতম আমীর যিনি নবাবের বিশ্বাসঘাতকতায় গুপ্তভাবে অসন্তুষ্ট ছিলেন সেই জাফর আলি খানের কাছে পাঠালেন। আমার দায়িত্ব ছিল একটা নতুন ফন্দী আঁটা। আমি তা করলাম। করতে গিয়ে যদি ধরা পড়তাম, তবে নিশ্চয় মিস্টার ওয়াট্স্ ও আমার প্রাণ যেত। সে যাই হোক, জাফর আলি খানকে রাজি করিয়ে চক্রান্তের মধ্যে টেনে এনে একটা দিন স্থির করলাম, যে দিন মিস্টার ওয়াট্স্ গোপনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। এজন্য আমি একটা ঘেরাটোপ পালকি তৈরি করে রেখেছিলাম যাতে মূর রমণীদের পরিবহণ করা হয় এবং যার পর্দা কেউ সরায় না—কারণ আগে থেকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে না জানলে কেউ সাহস করে তার ভেতরে দেখে না। যথা সময় পালকিতে জাফর আলি খানের বাড়ি গিয়ে মিস্টার ওয়াট্স্ চক্রান্ত ফেঁদে কলকাতার সিলেক্ট কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায় রইলেন। অনুমতি আসা মাত্র শহরের বাইরে একটা বাগানবাড়িতে তিন দিন কাটাবার জন্য মিস্টার ওয়াট্স্ ও আমার তরফ থেকে নবাবের কাছে ছুটি চাইলাম। ছুটি পাওয়া মাত্র কালবিলম্ব না করে আমরা সেখান থেকে মুক্সাদাবাদ অভিমুখে ফৌজী কুচ রত কর্ণেল ক্লাইভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য পালালাম। ভগবানের দয়ায় নিরাপদে পৌঁছলাম— সে যেন এক চুলের জন্য বেঁচে যাওয়া, কারণ যদিও আমরা বিচক্ষণভাবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অতি সঙ্গোপনে কার্যসাধন করেছিলাম, তবু আর তিন ঘণ্টার জন্য পালাতে দেরি করলেও আমরা দুজনেই ধৃত হয়ে অতি নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হতাম। হুজুর মহোদয়গণ অনুগ্রহ করে লক্ষ্য করবেন আপনাদের স্বার্থে মিস্টার ওয়াট্স্ ও আমি কি রকম ঝুঁকি নিয়েছিলাম। হুজুরে আমার নিবেদন এই যে, যদিও ইংরাজ পরিবারের গভীর দুর্দশার দিনে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা এত ছুটোছুটি, কষ্ট, শঙ্কাভোগ ও বিপদ বহন করেছিলাম, তবু হুজুরেরা আমার দিকে ও আমার সহকর্মী ক্লান্ত অসুস্থ আব্রাহাম জেকব্‌সের দিকে একটুও কৃপা দৃষ্টি করেননি, এমন কি আমাদের খরচপাতিও মেটানো হয়নি। বিনীতভাবে আমার এই নিবেদন, হুজুরেরা আমাকে আপনাদের যে কোনো চাকরিতে যোগ্য মনে করেন তাতে বহাল করবেন এবং আব্রাহাম জেকব্‌সের খিদমত ভুলবেন না।’

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কিছু হল না। ইংরেজরা পেত্রসকে নবাবের দূত বলে ভাবতেই অভ্যস্ত ছিল। যে ওয়াট্সের পাশে দাঁড়িয়ে ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে মুর্শিদাবাদের লোমহর্ষক পরিস্থিতির মধ্যে খোজা পেত্ৰস বিপজ্জনক কাজে সহায়তা করেছিলেন, সেই ওয়াট্স্ই ১৭৬৩ খ্রীস্টাব্দে মীর কাশিমের সঙ্গে যুদ্ধ বাধবার আগে মত দিলেন, খোজা পেত্রসকে কলকাতা থেকে বের করে দেওয়া হোক।৯৯ মোটের উপর, কুখ্যাত উমিচাঁদের মতোই খোজা পেত্ৰস ও আব্রাহাম জেকব্স্ ব্যবসায়ে টাকা না ঢেলে রাষ্ট্রীয় কলকাঠি নাড়ানোয় যে মূলধন নিয়োগ করেছিলেন, তার সমস্তটাই মারা গেল।

এবার আমীরচন্দ ওরফে উমিচাঁদের কথায় আসা যাক। আমীরচন্দ এবং গুলাবচন্দ (ইংরেজদের কাগজপত্রে দীপচন্দ), এই দুই ভাই আগ্রা থেকে এসে আজিমাবাদে (পাটনা) বসতি স্থাপন করেন, এবং দীপচন্দকে পাটনার ব্যবসায় বাণিজ্যের ভার দিয়ে আমীরচন্দ ইংরেজদের নতুন বসতি কলকাতায় কাপড়ের ব্যবসায়ে নেমে ধীরে ধীরে একজন প্রধান সওদাগর ও দাদনী বণিক রূপে পরিচিত হন। ১০০ এঁরা নানকপন্থী শিখ ছিলেন— নিজেদের ‘সিং’ বলতেন না, অর্থাৎ খালসা ভুক্ত শিখ ছিলেন না। মৃত্যুকালে উইল করে আমীরচন্দ নিজের বিপুল সম্পত্তি (৪২ লক্ষ টাকার) শ্রীগোবিন্দ নানকজীকে দেবোত্তর করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ভগ্নীপতি ছিলেন হাজারী (ওরফে হুজুরী) মল—ইনি কলকাতায় আমীরচন্দের সঙ্গে থাকতেন। নাম থেকে বোঝা যায়, হয় পাঞ্জাবী ক্ষেত্ৰী, নয় হিন্দুস্তানের বানিয়া। আমীরচন্দ পরিবার জাত মেনে চলতেন।১০১ অন্ততঃ ব্রাহ্মণের পা ছুঁয়ে আমীরচন্দ ডাহা মিথ্যে কথা বলতে পারতেন, তার প্রমাণ আছে। প্রথমে আমীরচন্দ কলকাতার বিখ্যাত দাদনী বণিক বোষ্টম দাস শেঠের সঙ্গে যুক্তভাবে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। শেঠ পরিবারের এক পুরাতন গোমস্তা পরবর্তীকালে আদালতের সাক্ষ্যে বলেছিলেন— ‘উমিচাঁদ আবার কে? তার ধন মান সব কিছু তো শেঠের দয়ায় হয়েছিল। শেঠ বলতে আমি বোষ্টম দাস শেঠের কথা বলছি।’ বৃদ্ধ বয়সে দুরবস্থায় পড়ে ঋণের বোঝা এড়াতে বৈষ্ণব দাস শেঠ আমীরচন্দের পরামর্শ চেয়েছিলেন। তখন আমীরচন্দ একজন প্রধান দাদনী বণিক। আমীরচন্দ উপকারী বৈষ্ণবচরণকে পরামর্শ দেন; আমার কাছে সমস্ত সম্পত্তি জাল করে বন্ধক দিয়ে রাখুন, তাহলে দেনদাররা সে সম্পত্তিতে হাত দিতে পারবে না। এতে বৈষ্ণব দাসের ছেলেরা ভয় পেয়ে গেল, হয়তো বা আমীরচন্দ সম্পত্তি হাত করার তালে আছেন। আমীরচন্দ তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, বন্ধকীতে কোনো সুদ থাকবে না, তমশুকে সম্পত্তির অর্ধেক মালিক পিতাম্বর শেঠের সই থাকবে না, এবং কোনো সাক্ষীও থাকবে না। ঐভাবে বন্ধকী দলিল প্রস্তুত করে বৈষ্ণব দাস ১৭৫২ খ্রীস্টাব্দে মারা যান। ১০২

ঐ বছর থেকেই ইংরেজরা স্বাধীন দাদনী বণিকের মাধ্যমে ব্যবসা করা তুলে দিয়ে নিজেদের গোমস্তাদের মাধ্যমে কাপড় কেনার সংকল্প করে। তার আগে পর্যন্ত কোম্পানির কাপড়ের সবচেয়ে বড়ো অংশ সরবরাহ করতেন আমীরচন্দ। অনেক ইংরেজের আপত্তি ছিল। ১৭৪৭ খ্রীস্টাব্দে আমীরচন্দ দাদনী না নিয়ে কেবল নগদ টাকায় কোম্পানির ইনভেস্টমেন্টের এক তৃতীয়াংশ সরবরাহ করবার প্রস্তাব দেন, তখন জ্যাক জনসন নামে কাউন্সিলের এক মেম্বার বাধা দিয়ে বলেছিলেন, অন্যান্য বণিকদের তুলনায় কোনো একজন বণিককে এতটা উপরে তুলে ধরা বিবেচনাপ্রসূত হবে না। তাতে জন ফর্স্টার বলেন, আমীরচন্দ আমাদের সঙ্গে কনট্রাক্ট করে অন্যদের তুলনায় উপরে উঠেছেন একথা ঠিক নয়, তাঁর উন্নতির আসল কারণ— his natural and acquired capacity for business, his extraordinary knowledge of the Inland trade and his greater command of money all which qualities I think render him a proper person to deal with for ready money’১০৩আমীরচন্দ সম্বন্ধে অর্ম নিম্নলিখিত মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন:

‘কলকাতার হিন্দু বণিকদের মধ্যে ওমিচাঁদ নামে এক বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন যিনি চল্লিশ বছর ধরে ক্রমাগত অধ্যবসায় সহকারে নিজের সম্পত্তি বৃদ্ধি করে চলেছিলেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সী থেকে যে কোনো অন্য কনট্রাক্টরের চেয়ে তাঁকে কোম্পানির ইনভেস্টমেন্টের বৃহত্তর অংশ সরবরাহ করতে দেওয়া হত। তাঁর বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত বাড়ি, নানা কাজে নিযুক্ত অসংখ্য চাকর, এবং সর্বক্ষণ ভাড়া করা দারোয়ান বাহিনী থেকে মনে হত তিনি যেন সওদাগর না হয়ে নবাবের মতো আছেন। বাংলা-বিহারের সর্বত্র তাঁর বাণিজ্য বিস্তৃত ছিল এবং মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারের প্রধান প্রধান রাজপুরুষদের উপহার দান ও উপকার সাধন করে তিনি এত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন যে বিপদের সময় নবাবের সঙ্গে মধ্যস্থতা করবার জন্য প্রেসিডেন্সী থেকে তাঁকে নিয়োগ করা হত। ⋯১৭৫৩ খ্রীস্টাব্দে কোম্পানি বণিকদের সঙ্গে চুক্তি করা ছেড়ে দিয়ে হিন্দু গোমস্তা লাগিয়ে আড়ং থেকে ইনভেস্টমেন্ট সংগ্রহ করায়, ঐ সময় কোম্পানির ব্যাপার থেকে ওমিচাঁদ বাদ পড়ে গেলেন এবং এর ফলে তাঁর বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়ায় তাঁর বিত্তবাসনায় আঘাত পড়ল, যদিও তখন তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ চল্লিশ লক্ষ টাকা। কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট ছাড়া তাঁর নিজের যে স্বাধীন বাণিজ্য ছিল তা তিনি চালিয়ে যেতে লাগলেন এবং দ্বিগুণ উৎসাহে মুর্শিদাবাদে নিজের গুরুত্ব বাড়াবার দিকে মন দিলেন ⋯ ।’১০৪

আগেই বলা হয়েছে কলকাতা ছাড়া পাটনাতেও আমীরচন্দের বড়ো ব্যবসা ছিল। পাটনাতে এবং অন্যান্য ব্যবসায়ের কেন্দ্রে তাঁকে বিভিন্ন রকমের বাণিজ্যে নিয়ত থাকতে দেখা যায়। পাটনার সোরার ব্যবসায়ে তিনি খোজা ওয়াজিদের আগেই ঢুকেছিলেন। এছাড়া আফিমের ব্যবসাতে তিনি অনেক টাকা ঢেলেছিলেন। ইওরোপীয় বণিকদের কাছ থেকে তামা কিনে তিনি একচেটিয়াভাবে পাটনায় তামা বেচতেন। ১৭৪১ খ্রীস্টাব্দে তিনি পাটনার টাঁকশাল ইজারা নিয়েছিলেন। এমন কি খাদ্যশস্য কেনাবেচার ব্যাপারেও তিনি লিপ্ত ছিলেন। ১০৫ কলকাতায় কাপড় ও পাটনায় সোরা—এই দুই ব্যবসায় আমীরচন্দের প্রধান কারবার ছিল। ইংরেজদের সঙ্গে সমঝোতা করে ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে আমীরচন্দ সোরা সরবরাহের বৃহৎ অংশ নিজের হস্তগত করে নেন। এতে মার খেয়ে ছোট ছোট সোরা ব্যবসায়ীরা ওলন্দাজদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে রাজপুরুষদের সুনজর আকৃষ্ট করার জন্য, সরকার সরণের ফৌজদারকে কুড়ি হাজার টাকা নগদ দিল। সেই টাকা খেয়ে ফৌজদার সাহেব আমীরচন্দ ও ইংরেজদের ব্যবসায়ে নানা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতে লাগলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছোট ব্যবসায়ীরা আমীরচন্দের মতো দরবারে প্রতিপত্তিশালী সওদাগরের সঙ্গে কায়দা করতে পারল না। আমীরচন্দের চালে সেই ফৌজদারই ঘায়েল হয়ে বেরিয়ে গেলেন। এতে ইংরেজদের সোরা কিনতে সুবিধে হল, কিন্তু বেশিদিনের জন্য নয়। ১৭৪৪ খ্রীস্টাব্দে সোরার বকেয়া হিসাব নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে আমীরচন্দ—দীপচন্দ ভ্রাতৃদ্বয়ের লাঠালাঠি শুরু হল। ইংরেজরা মেয়র্স কোর্টে বিবাদ টেনে নিয়ে গেল। মেয়র্স কোর্টে আমীরচন্দের বিশ্বাস ছিল না—তাঁর বক্তব্য ‘হিন্দুস্তানের সাধারণ লোকদের’ সালিশীতে বিবাদের মীমাংসা হোক। ইংরেজরা তাতে কান দিল না বটে, কিন্তু দীপচন্দকে নবাব নিজে সরকার সরণের ফৌজদার নিযুক্ত করায় তারা রীতিমতো বিপাকে পড়ল। আলিবর্দির দাদা হাজি আহমদকে দিয়ে আমীরচন্দ ইংরেজদের উপর রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করলেন যাতে তারা বকেয়া শোধ করে। দরবারের চাপে ইংরেজরা নতি স্বীকার করতে রাজি হল না কিন্তু তাদের ব্যবসায়ে একের পর এক অসুবিধা হতে লাগল। ১৭৪৭ খ্রীস্টাব্দে তারা পাটনার দরবারকে ভয় দেখাল যে এ রকম ঝামেলা চলতে থাকলে তারা পাটনার ব্যবসা গুটিয়ে নেবে। ঐ বছর তাদের কাগজপত্রে দেখা যায় তারা আমীরচন্দকে ‘পাটনার দরবারে ইংরেজদের সব চেয়ে বড়ো শত্রু’ বলে বর্ণনা করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, কলকাতার কাপড়ের ব্যবসায়ে ইংরেজরা যেমন আমীরচন্দের উপর ডাণ্ডা ঘোরাতে পারত, পাটনার সোরার ব্যবসায়ে তা চলত না। বরং আমীরচন্দই দরবারের সহায়তায় ইংরেজদের উপর ডাণ্ডা ঘোরাতেন। ১০৬ কিন্তু বুনো ওলেরও বাঘা তেঁতুল আছে। সোরার ব্যবসায়ে খোজা ওয়াজিদের উদয় হওয়ার (আগে বলা হয়েছে মেয়র্স কোর্টের হাত থেকে সোরার বিবাদে তিনিই দীপচন্দকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন) আমীরচন্দের প্রতিপত্তি টিকল না। ১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দে সোরার ইজারা ওয়াজিদের হাতে চলে যাওয়ায় ইংরেজরা তাঁর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ল। তাদের বড়ো কর্তা রজার ড্রেক ওয়াজিদের সঙ্গে সোরার কনট্রাক্ট করার জন্য ঝুলোঝুলি করতে লাগলেন। আমীরচন্দ দেখলেন সোরার কারবার ঘুচে যাবার যোগাড়। তিনি ড্রেককে লোভ দেখালেন, সাত হাজার টাকা দেবো, আপনি ওয়াজিদের সঙ্গে কড়ার করবার চেষ্টা ছাড়ুন। তখনকার দিনে ছোট-বড়ো নির্বিশেষে সমস্ত ইংরেজ সাহেব চুরি করতেন, ড্রেক নিজেও সাধুপুরুষ ছিলেন না। কিন্তু এ ব্যাপারে ড্রেককে রাজি করানো গেল না।১০৭

আমীরচন্দের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্বন্ধে নানা গুজব ড্রেকের কাছে পৌঁছত। আমীরচন্দ না কি পূর্ণিয়ার ফৌজদার হতে চলেছেন (পূর্ণিয়াতে তখন সবে ভালো সোরা উৎপন্ন হতে শুরু করেছে)। আলিবর্দির দরবারে না কি তাঁকে জগৎশেঠের মতো সম্মান ও সুযোগসুবিধা সূচক পরওয়ানা দেওয়া হয়েছে।১০৮ বলাবাহুল্য এগুলি নিছক কল্পনা। কার্যকালে দেখা গেল পূর্ণিয়ার ফৌজদার হলেন শওকৎ জঙ্গ। সেখানে আমীরচন্দের ফৌজদার হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। জগৎশেঠের সঙ্গেও আমীরচন্দের কোনও তুলনা চলতে পারে না। কিন্তু আলিবর্দির নবাবীর শেষ কয়েক বছর ধরে ইংরেজদের বেশ চোখে পড়ছিল যে দরবারে আমীরচন্দের প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে যাচ্ছে। আবার সেই সময় থেকেই আমীরচন্দের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক বিষিয়ে ওঠায় নিজেদের সব দুর্গতির জন্য তারা আমীরচন্দকেই দোষী করতে লাগল।

এই সময় কাশিমবাজারে ইংরেজদের চিকিৎসক ডাক্তার ফোর্থ বুড়া নবাবের চিকিৎসার জন্য মাঝে মাঝে মুর্শিদাবাদ যেতেন। তাঁর বিবৃতিতে দরবারে আমীরচন্দের স্থান সম্বন্ধে একটা মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য ছবি পাওয়া যায়। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে সিরাজের কলকাতা অধ্যুষনের পরে লিখিত এই বিবৃতিতে ডাক্তার ফোর্থ বলছেন— ‘কয়েক বছর থেকেই ওমিচাঁদ চেষ্টা করছিলেন, কি ভাবে নবাব ও তাঁর প্রধান প্রধান রাজপুরুষদের বন্ধুত্ব অর্জন করে দরবারে তাঁর প্রতিপত্তি বাড়ানো যায়। এ কাজে তিনি এতই সাফল্য লাভ করেছিলেন যে তিনি যা চাইতেন প্রায় তাই পেতেন। এর প্রমাণ সুরাজুদ দৌলত প্রদত্ত আমীরচন্দের পরওয়ানা যার বলে পাটনার সব আফিম তাঁর হাতে গিয়ে পড়ায় তাঁর মাধ্যমে কেনা-বেচা করা ছাড়া কারো কোনো উপায় রইল না। সেই হুকুম রদ করিয়ে আগেকার মতো আফিম কেনা চালু করবার জন্য ওলন্দাজ ও ফরাসীদের কি ঝামেলাই না পোয়াতে হয়েছিল। আমার এখন মনে পড়ছে না এজন্য তাদের কত টাকা দিতে হয়েছিল। দরবারের প্রধান প্রধান লোকরা তাঁর গোমস্তা বালকিষেণকে যেমন সম্মান করে চলত এবং যখন খুশি ঢুকতে দিত তার তুলনায় আমাদের উকিলদের দিকে ফিরেও চাইত না আর তারা ডাক না পড়লে দরবারে যেতেও পারত না। কোম্পানির কাজে দরবারে কোনো খবর পৌঁছতে হলে তাঁদের প্রথমে বড়ো বড়ো রাজপুরুষদের বাড়িতে ধর্না দিয়ে অনুমতি আদায় করতে হত— সহজে সে অনুমতি মিলত না। মনে হতে পারে যে ওমিচাঁদ বুঝি অনেক টাকা ঢেলেছিলেন, কিন্তু মোটেই তা নয়। আমি বিশ্বস্তসূত্রে জানি তাঁর দরবার খরচা কদাচিৎ পনের হাজারের উপরে উঠত—বড়ো জোর বছরে কুড়ি হাজার টাকা। নবাবের কাছে ছোট ছোট জিনিস নজর দেওয়াই ছিল তাঁর প্রধান পদ্ধতি—আর সেই সঙ্গে রাজপুরুষদের মধ্যে একটু একটু অর্থ বিতরণ করা। যে কোনো ছোট জিনিস—তা সে যতই বাজে হোক না কেন—যদি তা দৃষ্প্রাপ্য বা অদৃষ্টপূর্ব হত, তিনি কিনে আনতেন—এমন কি বিড়াল পর্যন্ত। হুজুরকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি যা আমি নিজের চোখে দেখেছি। প্রায় দু বছর আগে ইনি একটা বড়োসড়ো পারস্য বিড়াল এনে বুড়া নবাবের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর গোমস্তা যখন সেটা আনল সেদিন সকালে আমি দরবারে উপস্থিত ছিলাম। বুড়া নবাব ভারি খুশি হওয়ায় সে তখনি নিবেদন করল— বেগমের (বর্তমান নবাবের মা) ১০৯ আফিমের সঙ্গে ওমিচাঁদের অনেকখানি আফিম ও সোরা জলঙ্গীতে এসে আটকে আছে যা একসঙ্গে হুগলি যাবার কথা, কিন্তু এতদিন পড়ে থাকলে বেচবার সুযোগ চলে যাবে, তাই নবাব যদি হুকুম দেন, বেগমের থেকে আলাদা করে ওমিচাঁদের মাল তাঁর নিজের নৌকায় চলে যেতে পারে। তৎক্ষণাৎ সে হুকুম হয়ে গেল—আফিম আর সোরা আলাদা করে পাঠিয়ে দেওয়া হল। বেগম তখন আমার পেশেন্ট—দরবার থেকে আমি তাঁর কাছে গেলাম। ঢুকেই দেখলাম তিনি সেই মাত্র হুকুমের কথা শুনে ভীষণ রেগে আছেন। তিনি বললেন, ওমিচাঁদ যা চায় তাই পায়, এমন কি তা তাঁর নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেও। নবাবের হুকুম পেয়ে এখন সে তার মাল আগে পাঠিয়ে বিক্রি করবে, আর তাঁর বাজার নষ্ট হবে। তিনি চাইছিলেন বুড়া নবাব (তাঁর বাবা) হুকুম রদ করুন, কিন্তু কিছুতেই হল না। আফিম একচেটিয়া করবার পরওয়ানাখানা আমীরচাঁদ এখনকার নবাবকে১১০ একটা ঘোড়া আর একটা ঘড়ি দিয়ে বের করে এনেছিলেন—চাঁদ নামে ঘড়িওয়ালা আমাকে জানিয়েছিল সে ঘড়ির দাম দিতে হবে ২০০০ সিক্কা। বুড়া নবাবের মৃত্যুর দু মাস আগে আমি তাঁর সঙ্গে বসেছিলাম—সঙ্গে তাঁর আশান্বিত ছেলে।১১১ ইংরেজদের সম্বন্ধে কোনো অভিযোগ উঠেছিল—কি তা বলতে পারছি না—নবাব আমার দিকে ফিরে বললেন, ইংরেজরা যত ঝামেলা করে অন্য সমস্ত ইওরোপীয়ান মিলেও তা না। সুরাজুদ দৌলত বললেন, এটা খুব সত্য কথা, এবং কলকাতায় তাঁদের ওমিচাঁদ ছাড়া একজনও বন্ধু নেই। সেই একমাত্র লোক যে তাঁদের লোকেরা সেখানে গেলে তাদের দিকে ফিরে তাকায় আর দয়া দেখায়। এটা তিনি খুব রাগের সঙ্গে বললেন।’১১২

আলিবর্দি খানের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিবাদে রাজবল্লভের সঙ্গে আমীরচন্দের যোগসাজস ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সিরাজের দরবারে আমীরচন্দের প্রতিপত্তি অটুট থাকল। রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণদাস ঢাকার ধনসম্পত্তি সহ কলকাতায় পালিয়ে এসে প্রথমে আমীরচন্দের আশ্রয় নেন এবং আমীরচন্দের কথাতেই ইংরেজরা কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় বাস করার অনুমতি দেয়। আমীরচন্দ ও ড্রেক উভয়েরই ধারণা হয়েছিল বুড়া নবাবের মৃত্যুর পর তাঁর বড়ো মেয়ে গহসেটি বেগমের হাতে ক্ষমতা যাবে, অতএব রাজবল্লভকে হাতে রাখা দরকার। কিন্তু তা না হয়ে সিরাজের গুপ্তচর নারায়ণ সিংহ যখন কৃষ্ণদাসকে ধরতে কলকাতায় এসে হাজির হলেন, তখন গতিক ভালো নয় বুঝে আমীরচন্দ তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা করে হলওয়েল ও ড্রেকের কাছে নিয়ে গেলেন। নারায়ণ সিংহের দাদা রাজারাম ছিলেন গুপ্তচর বিভাগের প্রধান এবং মেদিনীপুরের ফৌজদার, তাঁর সঙ্গে আমীরচন্দের ভালো জানাশুনা ছিল। বিচক্ষণ আমীরচন্দের পরামর্শ না শুনে ড্রেক নির্বোধের মতো নারায়ণ সিংহকে তাড়িয়ে দিলেন। তার ফল যা হবার তাই হল। নবাবের ফৌজ এসে কলকাতা ঘিরে ফেলল। ইংরেজদের সন্দেহ হল আমীরচন্দই এর জন্য দায়ী। তারা কৃষ্ণদাসকেও সন্দেহ করতে লাগল। আমীরচন্দের প্রতি সন্দেহ অমূলক নয়। গত তিন-চার বছর ধরে ইংরেজরা তাঁকে আর পুছত না, তাঁর সঙ্গে কাপড়ের ব্যবসাও তারা বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ফলে মুর্শিদাবাদ দরবার ও কলকাতা কাউন্সিলের মধ্যস্থ হিসেবে আমীরচন্দের প্রতিপত্তি কমে যাচ্ছিল। নবাব দরবারে প্রতিপত্তি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আমীরচন্দ রাজারামের সঙ্গে চিঠি লেখালেখি করতে শুরু করেছিলেন। সে চিঠি ড্রেকের হাতে পড়ায় তিনি আমীরচন্দকে গ্রেপ্তারের হুকুম দিলেন। এতে হলওয়েলের আপত্তি ছিল, কারণ চিঠিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু ড্রেক সে কথা শুনলেন না। ইংরেজদের সৈন্য আমীরচন্দ ও কৃষ্ণদাস দুজনকেই ধরে নিয়ে গেল। ড্রেক ভুল করলেন। আমীরচন্দ এটা নিশ্চয় চাইছিলেন না যে নবাবের ফৌজ কলকাতায় চড়াও হয়ে লুঠপাট করুক, বরং তাঁর লক্ষ্য ছিল নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের মধ্যস্থ হয়ে নিজের প্রতিপত্তি ফিরিয়ে আনা। মধ্যস্থতার প্রচেষ্টায় তিনি খোজা ওয়াজিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।

আগেই বলা হয়েছে ইংরেজদের বশে আনবার জন্য নবাব খোজা ওয়াজিদের কাছে চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন। নবাবের বক্তব্য, ইংরেজদের কেল্লা ছাড়া বাণিজ্য করতে হবে, যেমন আর্মানিরা করে। নবাবের চিঠি ওয়াজিদ সরাসরি ইংরেজদের পাঠিয়ে দিতেন। চিঠি যিনি হুগলী থেকে কলকাতায় আনতেন তিনি ওয়াজিদের গোমস্তা শিববাবু। শিববাবুর কাছে ড্রেক শুনলেন, আমীরচন্দই ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবকে ক্ষেপিয়ে তুলছেন। কাউন্সিলে পরামর্শ করে ইংরেজরা ঠিক করল, তারা কেবল ওয়াজিদকেই নবাবের সঙ্গে মধ্যস্থ মানবে, আমীরচন্দকে নয়। হলওয়েলের আপত্তি সত্ত্বেও আমীরচন্দকে বন্দী করা হল। শিববাবু নতুন প্রস্তাব নিয়ে কলকাতায় আসছিলেন, এ খবর শুনে নিজেও গ্রেপ্তার হবার ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তিনি বরানগর থেকে হুগলী ফিরে গেলেন। শিববাবুর ভয় পাবার কারণ ছিল। শেষবার তিনি যখন ড্রেকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন নবাব আসছেন শুনে ড্রেক বাহাদুরী দেখিয়ে বলেছিলেন—আসুন না, আরো তাড়াতাড়ি আসুন, আমরাও দেখিয়ে দেবো, গদিতে নতুন নবাব বসিয়ে ছাড়ব ইত্যাদি। কিন্তু ড্রেকের বিক্রম নবাবের উপর না পড়ে বিশেষ করে আশ্রিত কৃষ্ণদাস এবং আমীরচন্দের শালা হুজুরী মলের উপরেই প্রকাশ পেল। আমীরচন্দ নিজে থেকে ধরা দিলেন। ইংরেজরা তাঁকে অনুচর শুদ্ধ জনাকীর্ণ জেলের মধ্যে পুরল। কিন্তু হুজুরী মল ও কৃষ্ণদাস বিনা বাধায় আত্মসমর্পণ করতে রাজি হলেন না। এর ফলে আমীরচন্দের পরিবারে এক নিদারুণ শোকাবহ ঘটনা ঘটে গেল। আমীরচন্দের গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে হুজুরী মল জেনানার মধ্যে লুকিয়েছিলেন। ইংরেজ সৈন্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করতে সেখানে ঢুকে পড়ায় বাড়ির দারোয়ানরা বাধা দিল। মারামারিতে হুজুরী মলের বাঁ হাত কাটা গেল। প্রভুর পরিবারের সম্মানহানির আশঙ্কায় দারোয়ানদের জমাদার জগন্নাথ কাটারি হাতে ছুটে গিয়ে তেরজন নারী ও তিনটি শিশুকে হত্যা করে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল এবং তারপর নিজের বুকে ছুরি বসাল। এদিকে কৃষ্ণদাস পালাবার চেষ্টায় ছিলেন। ইংরেজদের পিয়নরা তাঁকে ধরতে এলে তাঁর লোকেরা তাদের খুব উত্তম মধ্যম দিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সৈন্যদের হাতে তিনিও গ্রেপ্তার হলেন। এই করুণ ঘটনার পর আমীরচন্দের লোকেরাই নবাবের সৈন্যদের পথ দেখিয়ে কলকাতার মধ্যে নিয়ে আসল। এদিকে হুগলীতে রটে গেল, আমীরচন্দ তো বন্দী হয়েছেনই, সেই সঙ্গে শিববাবুকেও ইংরেজরা আটক করেছে। খোজা ওয়াজিদ দ্রুত এক কসিদ (সংবাদবাহক) পাঠালেন। তার সংবাদ সংক্ষিপ্ত: নবাবের সঙ্গে কথাবার্তার জন্য ইংরেজরা আমীরচন্দ বা অন্য কাউকে দূত পাঠাক। ইংরেজরা ভাবল, এটা স্রেফ আমীরচন্দকে ছাড়াবার চেষ্টা। তারা খবর পাঠাল, শুধু খোজা ওয়াজিদের হাতে সব ভার দিয়েই তারা নিশ্চিন্ত। পরে ড্রেক প্রচার করলেন, আমীরচন্দ নবাবের কাছে চিঠি দিয়েছেন, তিনি যেন সত্বর কলকাতা আক্রমণ করেন, নচেৎ চোলমণ্ডলম্ থেকে ইংরেজদের জাহাজ এসে পড়লে কেল্লা দখল করা যাবে না। আমীরচন্দ না কি এও লিখেছেন যে এ চিঠি যেন খোজা ওয়াজিদকে না দেখানো হয় কারণ তিনি ইংরেজদের মিত্র। কিন্তু নবাব ওয়াজিদকে বিশেষভাবে বিশ্বাস করেন বলে বারণ সত্ত্বেও সে চিঠি তাঁকে দেখিয়েছেন, এবং তাতেই খবরটা ফাঁস হয়ে গেছে। এ খবর কতটা সত্যি বলা যায় না।১১৪ অন্য সব ইংরেজদের মতো ড্রেক নিজেও মিথ্যাবাদী ছিলেন এবং নবাবের কলকাতা আক্রমণের জন্য সকলে তাঁকে দায়ি করায় তিনি আমীরচন্দের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে নিজের দোষ স্খালনের চেষ্টায় ছিলেন। যাই হোক, নবাব আকস্মিকভাবেই কলকাতায় এসে চড়াও হলেন। বাগবাজারে ইংরেজরা নবাবী ফৌজকে ঠেকাল। নবাব হাতি আর উটগুলিকে সামনে ঠেলে পথ পরিষ্কার করার চেষ্টায় আছেন, এমন সময় আমীরচন্দের আহত জমাদার জগন্নাথ ঘোড়ায় চেপে নবাবের শিবিরে এসে হাজির হল। বুকে ছুরি বিধিয়েও সে কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিল। তার কাছ থেকে নবাব খবর পেলেন, আমীরচন্দ ও কৃষ্ণদাস জেলে গেছেন, এবং ইংরেজদের লোকজন বেশি নেই। প্রভুভক্ত জমাদার পরামর্শ দিল, সরাসরি আক্রমণ না করে পূব দিক দিয়ে ঘুরে গেলে সুবিধা হবে এবং আহত অবস্থাতে সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। তার পিছন পিছন নবাবী ফৌজ কলকাতায় ঢুকে পড়ল। বিপদ দেখে হলওয়েলের পরামর্শ মতো ইংরেজরা জেলখানায় গিয়ে আমীরচন্দকে ধরাধরি করতে লাগল। কিন্তু ক্ষিপ্ত আমীরচন্দ ইংরেজদের হয়ে নবাবের কাছে একটা কথাও বলতে রাজি হলেন না। নবাবী ফৌজকে পথ দেখিয়ে এনে জগন্নাথ জমাদার জেলখানার ফাটক ভেঙে ফেলে সমস্ত কয়েদীসুদ্ধ নিজের মনিব আমীরচন্দ এবং রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণদাসকেও ছাড়িয়ে আনল। নবাবের কাছে দুজনকেই হাজির করা হল। ফ্যাক্টরীর ভিতর দরবারে বসে নবাব আমীরচন্দ ও কৃষ্ণদাসকে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে অভ্যর্থনা করলেন এবং তাঁরা দুজনেই ছাড়া পেলেন। নবাবী ফৌজ তখন শহরময় লুঠতরাজ করছে। আমীরচন্দের বাড়ি রক্ষার জন্য নবাবের হুকুমে সে বাড়িতে চৌকী বসল, এবং বাড়ির ছাদ থেকে নবাবের পতাকা উড়তে লাগল। তা সত্ত্বেও নবাবের কাছে প্রদত্ত আমীরচন্দের নিজের বিবরণ অনুযায়ী তাঁর তিরিশ লক্ষ টাকার মাল খোয়া গেল। ১১৫ ইংরেজরা বিতাড়িত হয়ে ফলতায় ধুঁকতে লাগল। মনিকচন্দ আলিনগরের ফৌজদার হয়ে বসলেন।

মানিকচন্দের সঙ্গে মিতালি পাতাতে আমীরচন্দের দেরি হল না। কিন্তু তিনি দেখলেন, চালে ভুল হয়েছে। ইংরেজদের মতো বড় ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে কখনোই বড়ো ব্যবসা চলতে পারে না। জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদও সেটা বিলক্ষণ উপলব্ধি করছিলেন। নবাব নিজেও যে ব্যাপারটা বুঝেছিলেন না তা নয়। কিন্তু তাঁর ঐ এক কথা, ইংরেজরা যদি আরমানীদের মতো ব্যবসা চালাতে রাজি থাকে তাহলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তিনি তাদের কেল্লা বসিয়ে শহর নিয়ন্ত্রণ করতে দেবেন না। ফলতার নিরুপায় ইংরেজরা তখন আমীরচন্দের কাছেই ধর্না দিতে বাধ্য হল। আমীরচন্দ দেখলেন, এদের ফিরিয়ে আনতে পারলে নবাব ও কোম্পানির মধ্যস্থ হিসেবে তাঁর গৌরব বৃদ্ধি হবে। মানিকচন্দকে বলে কয়ে তিনি ফলতায় শাকসবজী পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। আমীরচন্দের পরামর্শ মতো ইংরেজরা খোজা ওয়াজিদ, মানিকচন্দ, রায় দুর্লভ ও গোলাম হোসেন খানকে আর্জির পর আর্জি পাঠাতে লাগল। খোজা ওয়াজিদ শিববাবুর মারফৎ ওয়াট্স্‌কে জানালেন, এ সব করে কোনো লাভ নেই। নবাব কখনোই ইংরেজদের হাতে ফোর্ট উইলিয়াম ফিরিয়ে দেবেন না। তারা যদি কলকাতায় ফিরতে চায়, তাহলে আগে মাদ্রাজে গিয়ে সেখান থেকে যথেষ্ট দলবল নিয়ে ফিরে আসুক এবং আবার আর্জি করুক। তখন আর্জি কাজ দেবে, তার আগে নয়। ১১৬ আমীরচন্দের পরামর্শের চেয়ে ওয়াজিদের পরামর্শ নিঃসন্দেহে অধিকতর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন পরামর্শ ছিল। শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা ওয়াটসন ও ক্লাইভের নেতৃত্বে বাহুবলেই কলকাতা পুনর্দখল করল। আবার ইংরাজে নবাবে লড়াই বাধল, সেই সঙ্গে চলল আহাদনামার আয়োজন। এবারকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় জগৎশেঠের প্রতিনিধি রণজিৎ রায়ই সর্বেসর্বা হয়ে আমীরচন্দকে যতটা পারেন দূরে সরিয়ে রাখলেন। আলিনগরের সন্ধি স্থাপন করতে রণজিৎ রায় যাঁকে দূত রূপে ব্যবহার করলেন তিনি খোজা পেত্রস, কিন্তু আমীরচন্দকে সম্পূর্ণ ঠেকিয়ে রাখা গেল না। স্থির হল সন্ধি স্থাপনের জন্য নবাব রণজিৎ রায়কে দেবেন এক লক্ষ, আর আমীরচন্দকে পঁচিশ হাজার। বস্তুতপক্ষে, এ সময় আমীরচন্দের উপর ইংরেজদের কোনো বিশ্বাস ছিল না। তারা একথা ভুলতে পারছিল না যে আমীরচন্দের লোকেরাই গতবার নবাবের ফৌজকে পথ দেখিয়ে এনেছিল। তাই কলকাতায় ফিরেই তারা আমীরচন্দকে আবার আটক করেছিল। নবাগত ক্লাইভের কাছে আমীরচন্দ প্রাণপণে নিজের সাফাই গাইতে লাগলেন। তাঁর মতো বিচক্ষণ ব্যবসায়ী নিজের পরিবারের শোচনীয় দুর্ঘটনা জনিত ক্ষোভের বশে কাজ করবার পাত্র নন। তিনি লিখলেন— ‘শুনলাম কতকগুলি মন্দ লোকের কান ভাঙানিতে আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট আছেন। এই কলঙ্ক আমি অপনোদন করতে পারবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি বরাবর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে আসছি তিনি যেন আমার মনিবদের দেশে ফিরিয়ে আনেন। ভগবান আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আপনার কাছে যেয়ে দাঁড়ালেই দেখবেন আমার কোনো দোষ নেই, তখন সুবিচার হবে। যে লোক উপকারীর ক্ষতি করতে চায় তাকে সারা জগৎ দুর্নাম দেয়। তার কি কখনো সাফল্য বা সুখ হতে পারে? ভগবান করুন আমি যেন ছাড়া পেয়ে আপনার পায়ে পড়ে আমার কথা সব বলতে পারি, তখন আমার সমস্ত দুর্ভাগ্য থেকে আমি মুক্তি পাবো। ’১১৭ ক্লাইভ নতুন লোক, তিনি আমীরচন্দকে কৃপা করে ছেড়ে দিলেন।

ক্লাইভের কৃপায় নয়, নবাবের নির্বুদ্ধিতায় আমীরচন্দের নসিব খুলে গেল। নবাব আমীরচন্দকে ইংরেজদের মধ্যে নিজের লোক বলে ভাবতে শুরু করলেন। আলিনগরের সন্ধি অনুসারে ইংরাজদের ও কলকাতা নিবাসীদের যে ক্ষতিপূরণ পাবার কথা, সেই টাকা আদায়ের জন্য ও সন্ধির অন্যান্য চুক্তি যাতে ঠিকভাবে পালিত হয় তা দেখবার জন্য ইংরেজদের প্রতিনিধি রূপে ওয়াট্স্ যখন মুর্শিদাবাদ যাত্রা করবেন, তখন নবাব প্রস্তাব আনলেন, তাঁর সঙ্গে আমীরচন্দও চলুন। সিলেক্ট কমিটি থেকে ওয়াট্‌স্‌কে আদেশ দেওয়া হল: ‘As Omichand has in some measure been deputed by the Nabob to us, and designs accompanying you to Muxadavad, we leave it entirely to your discretion to follow or decline his advice in the applications to the Durbar…।’১১৮ আমীরচন্দের মতো বুদ্ধিমান ও করিতকর্মা লোকের শুধু একটা সুযোগের দরকার ছিল। সুযোগ পেয়ে তিনি এবার নিজের কেরামতি দেখিয়ে ইংরেজদের তাক লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করে ওয়াট্স্ খোজা পেত্রসকেও সঙ্গে নিয়ে গেলেন।

নন্দকুমারকে দলে টানার কায়দাতেই আমীরচন্দের কর্মকৌশল চমৎকার ভাবে দেখা গেল। নন্দকুমার তখন হুগলীর ফৌজদারের দেওয়ান, সেখানে ফৌজদারের পদ খালি। ব্রাহ্মণ সন্তান আশায় আশায় আছেন নব তাঁকেই ফৌজদার পদে নিযুক্ত করবেন। আমীরচন্দ হুগলী পৌঁছে নন্দকুমারের সঙ্গে গোপনে সলাপরামর্শ করলেন। নন্দকুমারের কাছ থেকে তিনি জানতে পারলেন, আগের দিনই নবাবের কাছ থেকে ফরাসীদের জন্য এক লক্ষ টাকা নিয়ে খোজা ওয়াজিদের দেওয়ান শিববাবু এবং গুপ্তচর নারায়ণ সিংহের ভ্রাতুষ্পুত্র মথুরা মল হুগলীতে হাজির হয়েছেন, আর নন্দকুমারের উপর হুকুম হয়েছে, ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করলে তিনি যেন ফরাসীদের সাহায্য করেন। নবাব দরবারে আলিনগর বিজেতা ইংরেজদের তখন দারুণ প্রতিপত্তি। আমীরচন্দ নন্দকুমারকে আশ্বাস দিলেন, তিনি যদি ফরাসীদের সাহায্য না করেন, তাহলে দরবারে ইংরেজদের সহায়তায় ফৌজদার পদ লাভ করতে পারবেন, আর সেই সঙ্গে তাঁকে দশ বারো হাজার টাকা দেওয়া হবে। ঠিক হল, একজন ব্রাহ্মণ হুগলীতে যাতায়াত করবে এবং ইংরেজরা যদি এই প্রস্তাবে সম্মত থাকে, তাহলে তার মারফৎ নন্দকুমারকে সংবাদ পাঠাবে—‘গুলাব কে ফুল’। ১১৯ তাহলেই নন্দকুমার বুঝবেন ইংরেজরা রাজি আছে। তাঁর পক্ষ থেকে তিনি তখন দেখবেন, যাতে অন্তত চৌদ্দ দিনের জন্য নবাবের তরফ থেকে চন্দননগরে কোনো সাহায্য না পৌঁছয়। ইংরেজরা সানন্দে আমীনচন্দের প্রস্তাবে সায় দিল। আমীরচন্দ সেই সুযোগে তাদের কাছে জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদের নামে লাগিয়ে দিলেন যে তাঁরা ফরাসীদের সহায়তা করছেন। মানিকচন্দও ইংরেজদের বিরুদ্ধ পক্ষ। মোট কথা, আমীরচন্দই ইংরেজদের প্রকৃত বন্ধু। ক্রমে দেখা গেল আমীরচন্দের ওষুধ ধরেছে। নন্দকুমার চুপচাপ নবাবের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে বসে রইলেন, ফরাসীদের সাহায্য করবার জন্য কোনো তোড়জোড় করলেন না।

নবাব নিজেও দ্বিধা করছিলেন। মীর জাফরকে ফরাসীদের মদত দিতে হুকুম দিয়ে আবার কয়েকদিন বাদেই আমীরচন্দের কথায় সে হুকুম ফিরিয়ে নিলেন। এ সময় আমীরচন্দের উপরে নবাবের আস্থা ছিল অপরিসীম। তাঁর পরামর্শ মতো তিনি ইংরেজদের প্রতি নীতি নির্ধারণ করছিলেন। দরবারে আমীরচন্দের অবাধ গতি। ক্লাইভ ফরাসডাঙার দিকে আসছেন শুনে নবাব আমীরচন্দকে ডেকে বললেন, শুনলাম ইংরেজরা কথার খেলাপ করে এদিকে কুচ করে আসছে। আমীরচন্দ জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর কার কাছ থেকে এই খবর পেয়েছেন, আর ইংরেজরা কোন কথার খেলাপ করেছে? নবাব বললেন, কেন, এর আগে তো কখনও শুনিনি যে ফিরিঙ্গিরা দরিয়ায় নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে? তাদের নামে ফরিয়াদ উঠলে আমি কি চুপ করে থাকবো? আমীরচন্দ নবাবকে বোঝালেন, ইংরেজরা শুনেছে নবাব ফরাসীদের লাখ টাকা, বড়ো বড়ো খেতাব আর টাঁকশাল বসানোর পরোয়ানা দিয়েছেন। তারা ভাবছে ফরাসীরা নবাবের জন্য কি এমন করেছে যার জন্য তাদের নসিব এত ভালো? তারা অবাক হয়ে ভাবছে, নবাব একবারও ভেবে দেখছেন না মঁসিয় বুসি কি মতলবে দক্ষিণ থেকে মস্ত ফৌজ নিয়ে এদিকে আসছেন! নবাবের কি মনে নেই যে দরকারের সময় ফরাসীরা নবাবকে একটুও সাহায্য করেনি, আর ইংরেজরাই নবাবকে সাহায্য করবার জন্য সব সময় তৈরি আছে? আমীরচন্দ নবাবকে আরো বললেন, হুজুর, আমি চল্লিশ বছর ধরে ইংরেজদের সঙ্গে আছি, কখনও দেখিনি যে তারা কথার খেলাপ করেছে। এই বলে ব্রাহ্মণের পা ছুঁয়ে আমীরচন্দ শপথ করলেন, এ কথা সত্য। ইংরেজদের দেশে কেউ মিথ্যে বললে সবাই তার গায়ে থুতু দেয়। নবাব শুনে খুশি হয়ে হুকুম দিলেন মীর জাফরকে ফরাসডাঙা যেতে হবে না। ১২০ এদিকে নন্দকুমারও হুগলী থেকে ফরাসডাঙার দিকে এক পা বাড়ালেন না। ইংরেজরা বিনা বাধায় চন্দননগর দখল করল। নন্দকুমারের কাজেকর্মে ভারি খুশি হতে তাঁকে হাতে রাখবার জন্য ইংরেজরা হুগলীতে খবর পাঠাল, ‘গুলাব কে ফুল তাজা আছে।’ কিন্তু কার্যসিদ্ধি হবার আগে নন্দকুমার যাতে গোলাপ ফুল না শুঁকতে পান, ওয়াট্স্ সেই ব্যবস্থাও করে রাখলেন। শেষ পর্যন্ত নন্দকুমারের কপালে হুগলীর ফৌজদারী লাভ হল না। নবাব নন্দকুমারকে সরিয়ে শেখ আমরুল্লাহ্কে হুগলী পাঠালেন। ওয়াট্স্ নির্বিকার চিত্তে ক্লাইভকে লিখলেন, নন্দকুমারকে সাহায্য করে আর কোনো লাভ নেই। ১২১

এদিকে আমীরচন্দ ছিলেন নিজের তালে। আলিনগরের সন্ধি সম্পাদিত হবার সময় নবাব গোপনে রাজি হয়েছিলেন যে কলকাতার বড়ো বড়ো সাহেবরা যাতে সুলেনামায় বাগড়া না দেন সেজন্য তাঁদের বিশ হাজার সোনার মোহর দেওয়া হবে। তা ছাড়া নবাব রণজিৎ রায়ের কাছে আরো দু লক্ষ টাকা দিতে অঙ্গীকার করেন। আমীরচন্দ সম্মত হন যে তার অর্ধেক রণজিৎ রায় পাবেন, পঁচিশ হাজার তিনি নিজে নেবেন, আর বাকি পঁচাত্তর হাজার যাকে দেওয়া সমীচীন মনে করেন তাকে দেবেন। মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে রণজিৎ রায় বিশ হাজার মোহর এবং নিজের লক্ষ টাকার জন্য নবাবকে ভীষণ তাগাদা দিতে লাগলেন। সুযোগ বুঝে আমীরচন্দ নবাবকে বললেন, রণজিৎ রায়কে দরবারে জায়গা দেবেন না হুজুর, নইলে হুজুরকে মোহর আর টাকা সব গুণে দিতে হবে। নবাব ভীষণ কুপিত হবার ভান করে রণজিৎ রায়কে দরবার থেকে বের করে দিলেন, আর আমীরচন্দের উপর খুশি হয়ে পরোয়ানা দিলেন, আড়ংএ আড়ংএ আমীরচন্দের যে টাকা আর মাল লুঠতরাজের সময় খোয়া গিয়েছিল, তা যেন তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বিশ হাজার মোহরের কথা জানতে পেরে ওয়াট্স্ আমীরচন্দকে জিজ্ঞাসা করলেন, দরবারে সেই সমস্ত মোহরের জন্য আবেদন করা সঙ্গত হবে কি না। আমীরচন্দ হাঁ হাঁ করে উঠলেন। বললেন, প্রকাশ্য দরবারে এ কথা তুলবেন না। সময়মতো আমিই মোহর আদায় করে আনব। ওয়াট্স্ নিজেও কম ধূর্ত নন। আমীরচন্দের মতিগতি পরখ করার জন্যই তিনি দরবারে মোহরের প্রসঙ্গ তোলার প্রস্তাব এনেছিলেন।১২২ খোজা পেত্রসের মারফৎ তিনি আমীরচন্দের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখছিলেন। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। আমীরচন্দ ভাবলেন, দরবারে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাবার কাজে তিনি খোজা পেত্রসের সঙ্গে মিলিত হয়ে ওয়াট্স্‌কে সব কিছু থেকে বাদ দিয়ে রাখতে পারবেন। এটা ভাবলেন না, যে তিনি যেমন নিজের খেলা খেলছেন, পেত্রসও তেমন নিজের খেলা খেলতে পারেন। তিনি পেত্ৰসক পত্র দিলেন:

পেত্রসকে আমীরচন্দের সেলাম। দরবার থেকে চিঠি গেছে মিস্টার ওয়াট্স্ যেন হুকুম ছাড়া বেরোতে না পারেন। আপনি আর আমি একাত্ম। আমাদের ভেবে দেখতে হবে কিসে আমাদের নিজেদের সুবিধা হয় আর এমন ভাবে কাজ করতে হবে যাতে এ ব্যাপারের সমস্তটাই আমাদের হাতে থাকে। আমাদের দোস্ত [ওয়াট্স্] যদি এখনও বেরিয়ে না থাকেন তাহলে তাঁকে কয়েকদিনের জন্য ধরে রাখুন। এখানে এখনও সব ঠিক হয়নি। আমি পরে আপনাকে বিশদভাবে জানাবো। আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনাকে বেশি কথা লেখার দরকার নেই। আমাদের সাফল্য পরস্পরের উপর নির্ভর করছে। আমার সব আশা-ভরসা আপনার উপর।’

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তুলে ওয়াট্স্ এই সময় খোজা পেত্রসের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের বাইরে এক বাগান-বাড়িতে বাস করছিলেন আর সেখান থেকে ইংরেজ শিবিরের দিকে কেটে পড়বার তালে ছিলেন। কিন্তু আমীরচন্দ তখনো নবাবের কাছ থেকে আশানুরূপ টাকা আদায় করতে পারেননি বলে মুর্শিদাবাদ থেকে সরে পড়বার ব্যাপারে দোনামোনা করছেন। খোজা পেত্ৰস ছোট ব্যবসায়ী হতে পারেন, কিন্তু তাঁর বুদ্ধি কিছু কম নয়। তিনি ওয়াট্স্‌কে আমীরচন্দের চিঠি দেখালেন। ইংরেজরা আমীরচন্দের উপর ক্ষেপে গেল, কিন্তু বাইরে কিছু প্রকাশ করল না। এদিকে জগৎশেঠও নিজের অনুচর রণজিৎ রায়ের বিপত্তিতে আমীরচন্দের উপর বিলক্ষণ ক্রুদ্ধ হয়ে রইলেন। আমীরচন্দ গভীর জলের মাছ। কিন্তু যাদের সঙ্গে তিনি এক হাত লড়ে যাবেন ভেবেছিলেন সেই ওয়াট্স্, ক্লাইভ, জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদ আরো কত গভীরে নামতে পারেন, তা নিরূপণ করার মতো অন্তর্দৃষ্টি তাঁর ছিল না।

জগৎশেঠ, খোজা ওয়াজিদ, আমীরচন্দ ও খোজা পেত্রসের বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হবে যে প্রধান প্রধান দেশীয় শেঠ ও সওদাগররা দরবারের রাজনীতির সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে একমাত্র ফিরিঙ্গী বণিকরাই রাজনীতির কলকাঠি নাড়াতে জানত, আর দেশীয় বণিকরা এ ব্যাপারে নিতান্ত অক্ষম ও অপটু ছিল। তবে তুলনা করে দেখলে ইংরেজ ওলন্দাজ ও ফরাসী কোম্পানির সঙ্গে জগৎশেঠ, খোজা ওয়াজিদ ও আমীরচন্দের একটা বড়ো তফাৎ চোখে পড়বে। দেশীয় শেঠ সওদাগররা যতই বড়ো হোন, কেল্লা বসিয়ে নৌবহর সাজিয়ে বাণিজ্য করার ফিরিঙ্গী রীতি তাঁরা আয়ত্ত করতে পারেননি। বস্তুতপক্ষে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র সঙ্গে ইংরেজদের যে সংঘর্ষ বাধল, তার মূলে ফিরিঙ্গীদের বাণিজ্য করার ভিন্ দেশী রীতি। সিরাজের বক্তব্য ছিল, আরমানীরাও বিদেশ থেকে আসে। তবু তারা কেল্লা না বানিয়ে নবাবের আশ্রয়ে থেকে সওদা করে। তবে কেন ইংরেজ ওলন্দাজ ও ফরাসীদের ঐ সুযোগ দেওয়া হবে? পোর্তুগীজ ও প্রাশিয়ানরাও ফিরিঙ্গি, তাদেরও ওই সুযোগ মেলেনি। উদ্ধত ইংরেজরা বিতাড়িত হবার পরেও যখন আবার ফিরে আসার বায়না ধরেছে, তখন তারা আগে অঙ্গীকার করুক যে কলকাতায় নবাবের ফৌজদার মোতায়েন থাকবেন, সেখানে যে আইন চলবে তা মেয়র্স কোর্টের আইন নয় পরন্তু বাদশাহী আইন, এবং ফোর্ট উইলিয়াম কখনোই তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। তারা বাদশাহী ফারমান দেখিয়ে বিনা মাশুলে সওদা করার বায়না তুলতে পারবে না। আরমানীরা যে হারে শুল্ক দেয় সেই হারে শুল্ক দিতে রাজি থাকলে ফৌজদারী শাসনের আওতায় থেকে তাদের বাণিজ্য করতে দেওয়া হবে। খোজা ওয়াজিদ বা আমীরচন্দের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির প্রভেদ এই যে কোম্পানি নবাবী শর্তে বাণিজ্য করতে রাজি ছিল না। নিজেদের দুর্গ, নিজেদের আইন আদালত, নিজেদের নৌবহরের আওতায় থেকে নিষ্কর বাণিজ্য চালাবার জন্য তারা যুদ্ধ করতে তৈরি ছিল। কোনো দেশীয় সওদাগরের পক্ষে এরকম কল্পনা করা সম্ভব ছিল না। রাজনীতির কলকাঠি নাড়ানোয় তাদের যথেষ্ট দক্ষতা থাকলেও রাষ্ট্রশক্তি আয়ত্ত করবার মনোবৃত্তি তাদের মধ্যে দানা বাধেনি। তাই দেখা যায়, খোজা ওয়াজিদ ইংরেজদের পরামর্শ দিচ্ছেন ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে থেকে বাণিজ্য করতে চাইলে তারা যেন মাদ্রাজ থেকে দলবল এনে তারপর নবাবের সঙ্গে কথাবার্তা চালায়। কিন্তু তাঁর মাথায় এই চিন্তা উদয় হয়নি যে তিনি নিজেও ঐ রকম জঙ্গি বাণিজ্য চালাতে পারেন।

শেঠ সওদাগরদের কথা হল। এবার পলাশীর ষড়যন্ত্রে জমিদারদের কি ভূমিকা ছিল তা একটু বিচার করা দরকার। পরবর্তীকালে ইংরেজদের ধারণা হয়েছিল যে নবাবী আমলের শেষ দিকে মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মধ্যে অসন্তোষ দানা পাকিয়ে ওঠায় পলাশীর ষড়যন্ত্র ঘনিয়ে উঠেছিল। এ ধারণা অমূলক, কারণ পলাশীর ষড়যন্ত্রে দরবারের হিন্দু ও মুসলমান উভয় শ্রেণীর আমীর ওমরাওরাই সমান ভাবে জড়িত ছিলেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে একটি দেশীয় কিংবদন্তী সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিংবদন্তী অনুযায়ী হিন্দু জমিদার ও রাজারা জগৎশেঠের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুসলমান শাসনের অবসান ঘটান এবং প্রয়োজনবোধে মীর জাফর নামক একজন মুসলমান আমীরকে ষড়যন্ত্রে ব্যবহার করেন। এই কিংবদন্তীও নিঃসন্দেহে অতিরঞ্জিত। মুখ্যত দরবারের ওমরাওরা ষড়যন্ত্র পাকিয়েছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রে জমিদার ও রাজা মহারাজাদেরও একটা ভূমিকা ছিল এই বদ্ধমূল দেশীয় ধারণার মধ্যে কিছু সত্য লুকিয়ে থাকা অসম্ভব নয়। অন্তত দেশীয় চেতনায় পলাশীর ষড়যন্ত্র কি রেখাপাত করেছিল তা বুঝতে হলে এই কিংবদন্তী আলোচনা হওয়া দরকার। ঘটনার অর্ধশতাব্দী পরে এবং আরো এক শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরে দেশীয় লোকেদের স্মৃতিপটে পলাশীর ষড়যন্ত্র কি আকার লাভ করেছিল তা যথাক্রমে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্র’ এবং কবি নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ পাঠ করলে বোঝা যায়।

তার আগে কিছু সমসাময়িক সাক্ষ্য নিয়ে রাখা দরকার। দেশীয় জমিদাররা একত্র হয়ে নবাবী শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন এমন কোনও জোরাল প্রমাণ নেই। তাই যদি হত তাহলে আলিবর্দি খান কখনোই বর্গিদের ঠেকাতে পারতেন না। বর্গিরাও হিন্দু, বেশির ভাগ জমিদার ও রাজা মহারাজারাও হিন্দু। কিন্তু বর্ধমান বিষ্ণুপুরের রাজারা এবং বীরভূমের পাঠান জমিদাররা বহু বছর ধরে খণ্ড খণ্ড ভাবে বর্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গিয়েছিলেন। নদীয়া, রাজশাহী এবং অন্যান্য নানা জমিদাররাও অর্থদান এবং অন্য প্রকার সাহায্য দান করে নবাবের হাত শক্ত করেছিলেন। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে। দেশীয় জমিদাররা যে প্রথম থেকেই দলবদ্ধ ভাবে আলিবর্দি খানকে এত সাহায্য করবেন এমন কোনো কথা ছিল না। বরং দেখা যায়, মীর হবীরের নেতৃত্বে বর্গিরা যখন প্রথম হুগলীতে চড়াও হয়, তখন আশেপাশের ক্ষুদে জমিদাররা তাদের সঙ্গে ভিড়েছিল এবং হুগলীর কিছু মোগল সওদাগররাও বিশ্বাসঘাতকতা করে শহরের দরজা খুলে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরেই বর্গিদের ব্যাপক লুঠতরাজের ফলে জমিদার সওদাগর রায়ত ইত্যাদি সকল শ্রেণীর লোক গঙ্গা পার হয়ে পালাতে শুরু করে এবং বর্গিদের সঙ্গে জমিদারদের মিলিত হবার সম্ভাবনা চূর্ণ হয়ে যায়। ১২৪

বর্গিরা বিদায় হবার পরে কর্নেল স্কট বাংলায় এসে দু-একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলেন যা থেকে তাঁর মনে হয়েছিল যে নবাব সরকারের প্রতি জমিদারদের আনুগত্য অবিচলিত নয়। তখন ১৭৫৪ খ্রীস্টাব্দ। আলিবর্দির মৃত্যু হতে আর দু বছর বাকি। ঐ সময় কর্নেল স্কট মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় বেড়াতে এসেছিলেন। দেশের অবস্থা এবং দরবারের হালচাল জানতে তিনি উৎসুক ছিলেন। আমীরচন্দের সঙ্গে তাঁর খাতির থাকায় তিনি সেই সুবাদে বর্ধমানের রাজা তিলকচন্দ এবং হুগলীর বণিকবর খোজা ওয়াজিদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা করেন। এই সব আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাঁর ধারণা হয় যে ‘মূর সরকারের’ প্রতি দেশের ‘জেন্টু রাজারা’ (অর্থাৎ হিন্দু জমিদাররা) বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ এবং সুযোগ পেলেই তাঁরা ঘাড় থেকে নবাবী শাসনের জোয়াল ফেলে দেবেন। গোপনে গোপনে তাঁরা সবাই সরকারের পরিবর্তন চাইছেন এবং কোনো ইওরোপীয় ফৌজ এসে পৌঁছলে তাঁরা একে একে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বাংলায় বিপ্লব ঘটাবার চেষ্টা করবেন। নিমু গোঁসাই নামে এক সন্ন্যাসী দলের নেতার সঙ্গেও কর্নেল স্কটের দেখা হয়েছিল। এই সন্ন্যাসীরা দল বেঁধে সশস্ত্র অবস্থায় সারা দেশে আনাগোনা করত। নিমু গোঁসাই ছিলেন তাদের নেতা এবং দেশের হিন্দু জমিদার ও রাজা-রাজড়ার কাছে তাঁর বিশেষ সম্মান ছিল। নিমু গোঁসাই কর্নেল স্কটকে দেশের হালচাল সম্বন্ধে অনেক খবর দেন এবং একথাও বলেন যে খবর পেলে চারদিনের মধ্যে এক হাজার সশস্ত্র সন্ন্যাসী নিয়ে তিনি কর্নেলের সঙ্গে যোগ দিতে পারবেন।১২৫

কর্ণেল স্কটের সাক্ষ্য একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বর্ধমান, কৃষ্ণনগর ইত্যাদি বড়ো বড়ো জমিদারদের মধ্যে বেশ কিছুটা অসন্তোষ দানা পাকিয়ে না উঠলে তাঁর কানে এ ধরনের সংবাদ এসে পৌঁছত না। জগৎশেঠের মতো আমীরচন্দও সময় সময় জমিদারদের, বিশেষ করে বর্ধমানের রাজাদের টাকা ধার দিতেন। এই সূত্রে শেঠ সওদাগরদের সঙ্গে রাজারাজড়াদের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ ছিল। মুর্শিদাবাদে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র যখন বেশ পাকিয়ে উঠেছে, তখন ক্লাইভের কাছে ওয়াট্সের এক চিঠি থেকে এই ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রের একটা লক্ষণীয় প্রমাণ মেলে। ওয়াট্স্ মে মাসের ১৪ তারিখের চিঠিতে মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের গোপন চুক্তি সম্বন্ধে জানাচ্ছেন: ‘I showed the Articles you sent up to Omichund who did not approve of them, but insisted on my demanding for him 5 percent. on all the Nabob’s treasure, which would amount to two crore of rupees, beside a quarter of all his wealth, and that Meir Jaffier should oblige himself to take from the Zamindars no more than they paid in JaflierCown’s time.’ আমীরচন্দের শতকরা পাঁচ ভাগের কথা পরে হবে। এখানে যেটা লক্ষ্য করবার বিষয় তা হল জমিদারদের পক্ষ থেকে এই দাবি যে নতুন নবাব মসনদে বসে মুর্শিদকুলী খানের আমলের তুমর জমা অনুযায়ী খাজনা আদায় করবেন, তার বেশি আদায় করতে পারবেন না। আমীরচন্দ নিঃস্বার্থ পরোপকারী ছিলেন না। জমিদারদের সঙ্গে কোনো একটা যোগাযোগ না থাকলে ষড়যন্ত্রের সময় তাঁদের পক্ষ হয়ে তিনি খাজনা হ্রাসের কথা তুলতেন না।১২৬

অতএব ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জমিদারদের কোথাও একটা যোগসূত্র ছিল, সে যতই ক্ষীণ হোক। কোথায় সেই যোগসূত্র তার সন্ধান করতে হবে। ফার্সী ইতিহাসগুলিতে এ বিষয়ে কিছু মেলে না। ইংরেজদের কাগজপত্রে যা আছে তা অসম্পূর্ণ, সে কথায় পরে আসছি। বাংলা গদ্যে রচিত দ্বিতীয় জীবন চরিত ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’১২৭ নামক গ্রন্থে পলাশীর ষড়যন্ত্র বিষয়ক বর্ণবহুল চিত্র আছে, তবে তা ঘটনার পঞ্চাশ বছর পরেকার লেখা। যদিও এর উপর নির্ভর করা যায় না তবু এই বর্ণনাই সব চেয়ে বিস্তৃত। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘ বিবরণের পুরোটাই উদ্ধৃত করা যুক্তিযুক্ত, উদ্ধৃতি যত দীর্ঘই হোক। সে কালের সমাজ মানসে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের চেহারা কি ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, পাঠক তদানীন্তন কালের ভাষাতেই অনুধাবন করুন। রাজীবলোচনের ধারণায় দেশের হিন্দু জমিদাররা সংঘবদ্ধ হয়ে দরবারের হিন্দু ওমরাওদের সহায়তায় ‘যবন’ রাজত্বের অবসান ঘটাতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। এর কারণ তরুণ সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র দৌরাত্ম্য।

‘স্রাজেরদৌলা নানা প্রকারে দৌরাত্ম্য করিতে আরম্ভ করিলেক নদী দিয়া নৌকা যায় সে নৌকা ডুবায় মনুষ্য সকল ডুবে মরে ইহাই দেখে এবং যাহার আলয়েতে শুনে পরমসুন্দরী কন্যা আছে বলক্রমে সে কন্যা হরণ করে ও গর্ভিণী স্ত্রী আনিয়া উদর চিরিয়া দেখে কোনখানে সন্তান থাকে এইরূপ অতিশয় দৌরাত্ম্য আরম্ভ করিল। সকল লোক বিবেচনা করিতে প্রর্বত্ত হইল পরস্পর বিবেচনা করিলেন এ দেশে আর থাকা পরামর্শ নহে নগরস্থ লোকসকল মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করিয়া পলায়নপর হইল হাহাকার উঠিল সকল লোকেই ঈশ্বরের আরাধনা করিতে প্রর্বও হইল যেন এ দেশে জবন অধিকারী না থাকে। কিছু দিন যায় নবাব আলাবৃদ্ধির [আলিবর্দি খান] লোকান্তর হইলে স্ৰাজেরদৌলা নবাব হইলেন যাবদীয় প্রধান ২ ভৃত্যবর্গেরা ভেট দিয়া করপুটে নিবেদন করিলেন আপনি যখন এ দেশের কর্ত্তা হইলেন যাহাতে রাজ্যের লোক সুখী হয় তাহা করিবেন ঈশ্বর আপনারে সর্বশ্রেষ্ঠ করিলেন এ দেশের লোককে সুখে রাখিলে বহুকাল রাজ্য করিতে পারিবেন এই প্রকার পাত্র মিত্র লোকে সর্ব্বদা বুঝান কিন্তু তিনি দুষ্ট প্রকৃতি ত্যাগ ও উত্তম বাক্য শ্রবণ করেন না সকল লোক এবং প্রধান ২ চাকরেরা বিবেচনা করিলেন স্রাজেরদৌলা নবাব থাকিলে কাহারো কল্যাণ নাই অতএব কি হইবে কোথা যাব ইহা ভাবিয়া স্থির করিতে পারেন না পরে যাবৎ দেশীয় রাজা ঐক্য হইয়া নবাবের প্রধান পাত্র মহারাজ মহেন্দ্রকে [রায় দুর্লভ] নিবেদন করিতে প্রবৰ্ত্ত হইলেন রাজাসকলের নাম বর্ধমানের রাজা ও নবদ্বীপের রাজা দিনাজপুরের রাজা বিষ্ণুপুরের রাজা মেদিনীপুরের রাজা বীরভূমের রাজা ইত্যাদি করিয়া সকল রাজগণ প্রধান পাত্রের নিকট যাত্রা করিয়া স্রাজেরদৌলার দৌরাত্ম্য নিবেদন করিলেন মহারাজ মহেন্দ্র সকলকে আশ্বাস দিয়া স্ব স্ব রাজ্যে প্রেরিত করিলেন।

‘পরে যাবদীয় মন্ত্রীরা নবাব স্ৰাজেরদৌলায় নীতি শিক্ষা করান যত উত্তম কথা কহেন স্রাজেরদৌলা ততোধিক মন্দ করে পরে মহারাজ মহেন্দ্র এবং রাজা রামনারায়ণ রাজা রাজবল্লভ রাজা কৃষ্ণদাস ও মীর জাফরালিখাঁ এই সকল লোক ঐক্য হইয়া এক দিবস জগৎশেঠ মহাশয়ের বাটীতে গমন করিয়া জগৎশেঠের সহিত বিরলে বসিয়া পরামর্শ করিতে লাগিলেন। মহারাজ মহেন্দ্র অগ্রে কহিলেন আমি যাহা কহি তাহা তোমরা শ্রবণ করহ আমরা এ দেশে অনেক কালাবধি আছি এবং নবাব সাহেবেরদিগের আজ্ঞানুবর্তী হইয়া প্রাধান্যরূপে পুরুষানুক্রমে কালক্ষেপন করিতেছি এখন যিনি নবাব হইলেন ইহার নিকট মানের লঘুতা দিন ২ হইতে লাগিল আর সকল লোকের উপর অতিশয় দৌরাত্ম্য কতরূপে নিষেধ করিলাম এবং বুঝাইলাম তাহা কদাচ শুনে না আর দৌরাত্ম্য করে অতএব ইহার উপায় কি সকলে বিবেচনা করহ রাজা রামনারায়ণ কহিলেন ইহার উপায় হস্তিনাপুরে [দিল্লীতে] জনেক গমন করিয়া এ নবাবকে তগির করিয়া অন্য এক নবাব না আনিলে এ রাজ্যের কল্যাণ নাই। রাজা রাজবল্লভ কহিলেন এ পরামর্শ কিছু নয় হস্তিনাপুরের বাদশা জবন তিনি আর একজন জবন দিবেন সেও জবন অতএব জবন অধিকারী থাকিলে হিন্দুর হিন্দুত্ব থাকিবে না এইরূপ কথোপকথন স্থির কিছুই হয় না। শেষে এই পরামর্শ হইল যাহাতে জবন দূর হয় তাহার চেষ্টা করহ ইহাতে জগৎসেঠ কহিলেন এক কাৰ্য্য করহ নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অতিবড় বুদ্ধিমান তাঁহাকে আনিতে দূত পাঠাও তিনি আইলেই যে পরামর্শ হয় তাহাই করিব। সকলে সত্য কহিয়া দূত প্রেরণ করিয়া নিজ ২ স্থানে প্রস্তান করিলেন।’১২৮ উপরোক্ত বিবরণ খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায় এর বেশির ভাগ কাল্পনিক, তবে এর মধ্যে কিছু কিছু সত্যি লুকিয়ে থাকা অসম্ভব নয়। আগে দেখা দরকার এর মধ্যে কি কি তথ্য ভ্রান্ত। প্রথম কথা, সিরাজউদ্দৌলাহ্ কৈশোরে যতই দুর্দাম হোন, গর্ভিণীর পেট চিরে কোথায় সন্তান থাকে তার অনুসন্ধান করার মতো লোক ছিলেন না। তিনি উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিষ্ঠুর ছিলেন না। স্ত্রী হরণের ব্যাপারটা অসম্ভব নয়, রানী ভবানীর কন্যা তারাসুন্দরীর প্রসঙ্গে সে কথা আর একটু আলোচনা করা যাবে। নৌকা ডুবানর কথা কিছু বলা যায় না। এ কথাও প্রণিধানযোগ্য যে, রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় যাঁকে মহারাজ মহেন্দ্র বলে উল্লেখ করেছেন, সেই রায় দুর্লভ দরবারে প্রধান মন্ত্রী ছিলেন না। অবশ্য উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারপর আসে জমিদারদের কথা। তাঁদের মধ্যে মেদিনীপুরের রাজা, ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারেন না, বরং তার বিপরীত প্রমাণ আছে। মেদিনীপুরের রাজা বলতে তখনকার দিনে সেখানকার ফৌজদার রাজারাম সিংহকে বুঝত। তিনি সিরাজের প্রধান গুপ্তচর ও বিশ্বস্ত পাত্র ছিলেন। সিরাজের মৃত্যুর পর তিনি মীরজাফরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অন্যান্য রাজপুরুষদের প্রসঙ্গে আর একটি কথা মনে রাখতে হবে। রাজা রামনারায়ণ বিহারের নায়েব ছিলেন, তাঁর পক্ষে যখন তখন পাটনা থেকে এসে জগৎশেঠের মুর্শিদাবাদ ভবনে বসে ষড়যন্ত্র করা সম্ভব নয়। তিনি সিরাজের বিশেষ অনুগত ছিলেন এবং সিরাজ পলাশীর যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে তাঁর আশ্রয় নেবার জন্য পাটনার দিকে পালাচ্ছিলেন। বিশ্বস্ত রামনারায়ণ প্রথম দিকে নতুন নবাব মীর জাফরকে মেনে নেননি। পরে ইংরেজরা মানতে বাধ্য করেছিল। শেষ কথা, মীরজাফরের সাক্ষাতে ষড়যন্ত্রীরা কি করে ‘যবন’ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ আলাপ আলোচনা চালিয়েছিলেন তা কোনোক্রমেই বোঝা যায় না।

একটি কথা লক্ষ্য করতে হবে। জমিদারদের সুদীর্ঘ তালিকা দিলেও রাজীবলোচন কোথাও রাজশাহীর জমিদার অর্থাৎ রানী ভবানীর কথা উল্লেখ করেননি। রানী ভবানী ও ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত কিংবদন্তী আরো পরবর্তীকালে জন্ম নিয়েছিল বলে মনে হয়। সে কথায় পরে আসছি। আপাতত পলাশীর ষড়যন্ত্রে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ভূমিকা সম্বন্ধে রাজীবলোচন যা বলেছেন তা দেখা যাক।

মুর্শিদাবাদ থেকে দূত এসে হাজির হলে বিচক্ষণ কৃষ্ণচন্দ্র নিজে না গিয়ে প্রথমে তাঁর প্রধান পাত্র কালীপ্রসাদ সিংহকে পাঠালেন। কালীপ্রসাদ রাজা মহেন্দ্রর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্বীয় প্রভুর সহায়তায় আশ্বাসবাণী জানিয়ে পরে নবাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নদীয়ার জমিদারের নামে দরবার সমীপে হাজির হবার হুকুমনামা যোগাড় করে আনলেন যাতে কৃষ্ণচন্দ্র কোনো সন্দেহ উদ্রেক না করে মুর্শিদাবাদে এসে সলাপরামর্শ করতে পারেন। দরবার করার অজুহাতে কৃষ্ণচন্দ্র মুর্শিদাবাদে এসে তত্রস্থ নিজ বাসভবনে উঠলেন এবং ‘মহারাজ মহেন্দ্র ও রাজা রামনারায়ণ ও রাজা রাজবল্লভ এবং জগৎ সেট ও মীর জাফরালি খাঁ’ এই কয়জন প্রধান ওমরাওদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করলেন।

‘পরে এক দিবস জগৎ সেটের বাটীতে রাজা মহেন্দ্র প্রভৃতি সকলে বসিয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে আহ্বান করিলেন দূত আসিয়া রাজাকে লইয়া গেল যথাযোগ্য স্থানে সকলে বসিলেন। ক্ষণেক পরে রাজা রামনারায়ণ প্রশ্ন করিলেন আপনারা সকলেই বিবেচনা করুণ দেশাধিকারী অতি দুর্বৃত্ত উত্তর ২ দৌরাত্ম্যের বৃদ্ধি হইতেছে অতএব কি করা যায় এই কথার পর মহারাজা মহেন্দ্র কহিলেন আমরা পুরুষানুক্রমে নবাবের চাকর যদি আমারদিগের হইতে কোনো ক্ষতি নবাব সাহেবের হয় তবে অধর্ম্ম এবং অখ্যাতি অতএব আমি কোনো মন্দ কর্মের মধ্যে থাকিব না তবে যে পূর্ব্বে এক আধ বাক্য কহিয়াছিলাম সে বড় উষ্মাপ্রযুক্ত এইক্ষণে বিবেচনা করিলাম এসব কার্য ভাল নয় এই কথার পর রাজা রামনারায়ণ ও রাজা রাজবল্লভ এবং জগৎ সেট ও মীর জাফরালি খাঁ কহিলেন যদ্যপি আপনি এ পরামর্শ হইতে ক্ষান্ত হইলেন কিন্তু দেশ রক্ষা পায় না এবং ভদ্র লোকের জাতি প্রাণ থাকা ভার হইল। অনেক কহিতে ২ মহারাজ মহেন্দ্র কহিলেন তোমরা কি প্রকার করিবা তখন রাজা রামনারায়ণ কহিলেন পূর্ব্বে এ কথার প্রস্তাব এক দিবস হইয়াছিল তাহাতে সকলে কহিয়াছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অতিবড় মন্ত্রী তাঁহাকে আনাইয়া জিজ্ঞাসা করা যাউক তিনি যেমন ২ পরামর্শ দিবেন সেইমত কাৰ্য্য করিব এখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এই সাক্ষাতে আছেন ইহাকে জিজ্ঞাসা করুন যে ২ পরামর্শ কহেন তাহাই শ্রবণ করিয়া যে হয় পশ্চা করিবেন। ইহার পর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি সকলি জ্ঞাত হইয়াছ এখন কি কর্ত্তব্য। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় হাস্য করিয়া নিবেদন করিলেন মহাশয়েরা সকলেই প্রধান মনুষ্য আপনারা আমাকে অনুমতি করিতেছেন পরামর্শ দিতে এ বড় আশ্চর্য সে যে হউক আম নিবেদন করি শ্রবণ করুন আমারদিগের দেশাধিকারী যিনি ইনি জবন ইহার দৌরাত্ম্যক্রমে আপনারা ব্যস্ত হইয়া উপায়ান্তর চিন্তা করিতেছেন। সমভিব্যাহৃত মীর জাফরালি খাঁ সাহেব ইনিও জাতে জবন অতএব আমার আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। এই কথার পর সকলে হাস্য করিয়া কহিলেন হাঁ ইনি জবন বটেন কিন্তু ইহার প্রতি অতিউত্তম আপনি ইহাকে সন্দেহ করিবেন না পশ্চাৎ কৃষ্ণচন্দ্র রায় নিবেদন করিলেন এ দেশের উপর বুঝি ঈশ্বরের নিগ্রহ হইয়াছে নতুবা এককালীন এত হয় না প্রথম যিনি দেশাধিকারী ইহার সর্ব্বদা পরানিষ্ট চিন্তা এবং যেখানে শুনেন সুন্দরী স্ত্রী আছে তাহা বলক্রমে গ্রহণ করেন এবং কিঞ্চিৎ অপরাধে জাতিপ্রাণ নষ্ট করেন দ্বিতীয় বরগী আসিয়া দেশ লুট করে তাহাতে মনোযোগ নাই তৃতীয় সন্যাসী আসিয়া যাহার উত্তম ঘর দেখে তাহাই ভাঙ্গিয়া কাষ্ঠ করে তাহা কেহ নিবারণ করে না অশেষ প্রকার এ দেশে উৎপাত হইয়াছে অতএব দেশের কর্ত্তা জবন থাকিলে কাহারু ধৰ্ম্ম থাকিবে না এবং জাতিও থাকিবে না এ কারণ অনেক ২ বিশিষ্ট লোককে কহিয়াছি তোমরা সকলে ঈশ্বরের আরাধনা বিশিষ্টরূপে কর যেন আর উৎপাত না হয় এবং জবন অধিকারী না থাকে আত্ম ২ জাতি ধৰ্ম্ম রক্ষা পায় এইরূপ ব্যবহার আমি সৰ্ব্বদাই করিতেছি অতএব নিবেদন করি ঈশ্বর সৃষ্টি করিয়াছেন নষ্ট করিবেন না কিন্তু এক সুপরামর্শ আছে আমি নিবেদন করি যদি সকলের পরামর্শ সিদ্ধ হয় তবে তাহার চেষ্টা পাইতে পারি। তখন সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন কি পরামর্শ কহ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কহিলেন সকলে মনোযোগ করিয়া শ্রবণ করুন।’

‘এ দেশের অধিকারী সৰ্ব্বপ্রকারে উত্তম হন এবং অন্য জাতি ও এ দেশীয় না হন তবেই মঙ্গল হয়। জগৎ সেট কহিলেন এমন কে তাহা বিস্তারিয়া কহ রাজা কহিলেন বিলাতে নিবাস জাতে ইঙ্গরাজ কলিকাতায় কোঠি করিয়া আছেন যদি তাঁহারা এ রাজ্যের রাজা হন তবে সকল মঙ্গল হবেক। ইহা শুনিয়া সকলেই কহিলেন তাঁহারদিগের কি ২ গুণ আছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কহিলেন তাঁহারদিগের গুণ এই ২ সকল সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় পরহিংসা করেন না যোদ্ধা অতিবড় প্রজাপতি যথেষ্ট দয়া এবং অত্যন্ত ক্ষমতাপন্ন বুদ্ধিতে বৃহস্পতির ন্যায় ধনেতে কুবের তুল্য ধাৰ্ম্মিক এবং অর্জুনের ন্যায় পরাক্রম প্রজাপালনে সাক্ষাৎ যুধিষ্ঠির এবং সকলে ঐক্যতাপন্ন শিষ্টের পালন দুষ্টের দমন রাজার সকল গুণ তাঁহারদিগের আছে অতএব যদি তাঁহারা দেশাধিকারী হন তবে সকলের নিস্তার নতুবা জবনে সকল নষ্ট করিবেক। এই কথার পর জগৎ সেট কহিলেন তাঁহারা উত্তম বটেন তাহা আমি জ্ঞাত আছি কিন্তু তাঁহারদিগের বাক্য আমরাও বুঝিতে পারি না ও আমাদিগের বাক্য তাঁহারাও বুঝিতে পারেন না ইহার পর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কহিলেন এখন তাঁহারা কলিকাতায় কোঠি করিয়া বাণিজ্য করিতেছেন সেই কলিকাতার দক্ষিণে কালীঘাট নামে এক স্থান আছে তাহাতে কালীঠাকুরাণী আছেন আমি মধ্যে ২ কালীপূজার কারণ গিয়া থাকি সেই কালে কলিকাতার কোঠির যিনি বড় সাহেব তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া থাকি ইহাতেই তাঁহার চরিত্র আমি সমস্তই জ্ঞাত আছি। এই কথার পর রাজা রামনারায়ণ কহিলেন আপনি মধ্যে ২ কলিকাতার কোঠির বড় সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কিন্তু তাঁহার বাক্য আপনি কি প্রকারে বুঝেন আর আপনার কথা তিনি বা কি প্রকারে জ্ঞাত হন। এই কথার উত্তর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় করিলেন কলিকাতায় অনেক ২ বিশিষ্ট লোকের বসতি আছে তাঁহারা সকলে ইঙ্গরাজী ভাষা অভ্যাস করিয়াছেন এবং সেই সকল বিশিষ্ট মনুষ্য সাহেবের চাকর আছেন তাঁহারাই বুঝাইয়া দেন। ইহা শুনিয়া সকলে কহিলেন ইহারা এ দেশের কর্ত্তা হইলে সকল রক্ষা পায় অতএব আপনি কলিকাতায় গমন করিয়া যে সকল কথা উপস্থিত হইল এই সকল বৃত্তান্ত কোঠির বড় সাহেবের নিকট জ্ঞাত করাইবা তিনি যেমন ২ কহেন বিস্তারিত আমারদের কহিবা এবং তিনি প্রতিজ্ঞা করিবেন তাঁহারা দেশাধিকারী হইলে আমারদিগের এ রাজ্যের প্রতুল করিবেন আর এখন যে ২ কাৰ্য্য আমারদিগের আছে ইহাতেই রাখিবেন। এই কথার পরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কহিলেন তাঁহারা দেশাধিকারী হইবেন রাজ্যের প্রতুল রাখিলেই রাজার প্রতুল হয় আপনাদের এ কহনে আবশ্যক নাই তবে যে কথা কহিলেন আপনারদিগের যে ২ কাৰ্য্য আছে ইহাতেই নিযুক্ত রাখিবেন তাহার কোনো সন্দেহ মহাশয়েরা করিবেন না তাঁহারদিগের রাজা হইলেই সুখী সকল লোক হইবেক কিন্তু আপনারা আমাকে নিতান্ত স্থির করিয়া আজ্ঞা করুন। পরে সকলেই কহিলেন এই স্থির হইল আপনি কলিকাতায় গমন করুন ইহা বলিয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে বিদায় করিয়া সকলে স্বস্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।’১২৯

রাজীবলোচনের বর্ণনানুযায়ী কৃষ্ণচন্দ্র কলকাতায় গিয়ে সাহেবদের সঙ্গে যোগসাজশ করলেন এবং তার ফলে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়ে মীর জাফরকে মসনদে স্থাপন করল। এই বর্ণনার কাল্পনিক চিত্র ও কথোপকথনগুলি বাদ দিয়ে ঐতিহাসিকের বিচার্য যে দুটি বস্তু বাকি থাকে তা হল জগৎশেঠের কুঠিতে জমিদারদের সঙ্গে প্রধান প্রধান ওমরাওদের গোপন মন্ত্রণা এবং নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে ইংরেজদের তলে তলে যোগসাজস। জগৎশেঠের কুঠিতে জমিদাররা পুণ্যাহের সময় প্রত্যেক বছর সমবেত হতেন এবং তাঁর সঙ্গে রাজা-রাজড়াদের ঘনিষ্ঠ বৈষয়িক যোগসূত্র ছিল। অতএব সমসাময়িক প্রমাণ না থাকলেও শেঠ ভবনে গোপন মন্ত্রণার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, বীরভূম ও নদীয়ার রাজারা মধ্যে মধ্যে নবাবের বিরুদ্ধতা করতেন তারও প্রমাণ আছে। মুর্শিদাবাদে ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে বার কয়েক রটে গিয়েছিল যে নতুন নবাব বন বিষ্ণুপুরের অবাধ্য রাজা চেতন্য সিংহের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় বের হতে চলেছেন। ইংরেজরাও এ কথা শুনেছিল। ১৩০ আমীরচন্দের মারফৎ কর্নেল স্কটের সঙ্গে বর্ধমানের রাজা তিলকচন্দের যোগাযোগ এবং সেই সূত্রে জমিদারদের চাপা অসন্তোষ প্রকাশের কথাও আগে বলা হয়েছে। এর আগে একবার ক্ষিপ্ত হয়ে তিলকচন্দ নিজের জমিদারীতে ইংরেজদের কুঠি অবরোধ করেছিলেন কিন্তু তাঁর এই স্বাতন্ত্র্যপরায়ণতার জন্য নবাবের নাতি তাঁকে বিলক্ষণ দাবড়ে দিয়েছিলেন। পলাশীর অভিমুখে ইংরেজদের যুদ্ধযাত্রা কালে বীরভূমের রাজা মুহম্মদ আসাদ-উজ-জামান খান ড্রেকের কাছে মদত দিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন এবং ক্লাইভের খুবই আশা ছিল তিনি সসৈন্যে ইংরেজদের সঙ্গে এসে যোগ দেবেন। যদিও ক্লাইভ বীরভূমের রাজাকে লোভ দেখিয়েছিলেন তাঁর রাজ্যের উপর কোনোও খাজনা সংগ্রাহক অর্থাৎ আমিল লাগানো হবে না, তবু শেষ পর্যন্ত পাঠান জমিদার ক্লাইভের প্রার্থিত দু’তিনশ ভালো ঘোড়সওয়ার পাঠাননি।১৩১

অতঃপর কৃষ্ণচন্দ্র কেমন ভাবে ইংরেজদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইংরেজদের কাগজপত্র থেকে তার কিছু প্রমাণ দাখিল করা যাক। ক্লাইভ যখন পলাশীর অভিমুখে কুচ করছেন সে সময় ড্রেক তাঁকে সংবাদবাহক মারফৎ এক গোপনীয় বার্তা পাঠান। তাতে দেখা যায় ড্রেকের একজন চর কৃষ্ণচন্দ্রের চাকরীতে ছিল (‘one of my emissaries from Muxadabad, and who was with Rajah_Kissenchund’)। সে জানিয়েছিল নবাবের রাজপুরুষদের মধ্যে অসন্তোষ দানা পাকিয়ে উঠেছে (‘confirms the discontent among the Nabob’s officers’)। ১৩২ এই অজ্ঞাত চর কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান কালীপ্রসাদ সিংহ হতে পারেন, কারণ রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় কালীপ্রসাদ সিংহ মারফৎ ইংরেজদের সঙ্গে দরবারের আমীরদের যোগাযোগ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৩৩ ক্লাইভের কাছে ড্রেকের উক্ত চিঠিতে আর একটি মন্তব্য তাৎপর্যময়— ‘Kissenchund the Nuddea Rajah has been long discontented and used ill by the Nabob.’ ড্রেকের পরবর্তী চিঠিতে এও স্পষ্ট বোঝা যায় যে তাঁর এবং ক্লাইভের গোপনীয় পত্রালাপে cypher ব্যবহার হচ্ছিল এবং এক একজন গুপ্ত ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে নামের বদলে কোনো সাংকেতিক শব্দ বা সাইফার বসানো হত। ক্লাইভ ভুল করে স্ক্র্যাফটনের সাইফারের পরিবর্তে কৃষ্ণচন্দ্রের সাইফার ব্যবহার করেছিলেন বলে এই চিঠিতে ড্রেক তাঁকে রীতিমতো তিরস্কার করেছিলেন। এ থেকে মনে হয় কৃষ্ণচন্দ্র ষড়যন্ত্রের গুপ্ত মন্ত্রণাদাতা ছিলেন, নইলে তাঁর নামের বদলে সাইফার ব্যবহার হবে কেন?১৩৪

হিন্দু জমিদাররা কেন সিরাজের বিপক্ষ অবলম্বন করেছিলেন তার কারণ দর্শাতে গিয়ে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় বার বার স্ত্রী হরণ ও জাতিধর্ম নাশের ভয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। সিরাজের মৃত্যুর পর অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তাঁর এই অখ্যাতি হিন্দু ভদ্র সমাজে বহুলভাবে প্রচলিত ছিল। শুধু রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় নন, তাঁর সমসাময়িক পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারও তাঁর ‘রাজাবলী’ পুস্তকে উল্লেখ করেছেন ‘বিশিষ্ট লোকেদের ভার্যা ও বধূ ও কন্যা প্রভৃতিকে জোর করিয়া আনাইয়া ও কৌতুক দেখিবার নিমিত্ত গর্ভিণী স্ত্রীদের উদর বিদারণ করাণেতে ও লোকেতে ভরা লৌকা ডুবাইয়া দেওয়ানেতে দিনে দিনে অধৰ্ম্মবৃদ্ধি হইতে লাগিল।’১৩৫ বিশিষ্ট লোকেদের স্ত্রীলোক হরণের অপবাদ যে অসত্য নয় তা মঁসিয় ল’র স্মৃতিকথা এবং গোলাম হোসেন খানের সিয়ার-উল-মুতাখখিরীন্ পাঠ করলেই অবগত হওয়া যায়। কোন বিশিষ্ট লোকের স্ত্রীকে নবাবের নাতি হরণ করায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন মঁসিয় ল’ বা গোলাম হোসেন খান তার নামোল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু বাঙালি হিন্দু ভদ্র সমাজে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ সমাজে, বহুদিন ধরে এ সম্বন্ধে একটা প্রবাদ চলে আসছে। নীলমণি বসাক কৃত ‘নর-নারী’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত রানী ভবানী চরিতে এই প্রবাদের প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতকের পূর্বভাগে বসে নীলমণি বসাক লিখেছেন, রানী ভবানীর বিধবা কন্যা তারার রূপে মোহিত হয়ে সিরাজউদ্দৌলাহ্ তাঁকে অপহরণ করার জন্য একদল নবাবী ফৌজ প্রেরণ করায় রানীর বৃত্তি পুষ্ট কৌপীনধারী মহান্তগণ এক হাতে ঢাল অপর হাতে তরবারি নিয়ে তারাসুন্দরীর ধর্ম রক্ষা করেন। ১৩৬ বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে রানী ভবানী সম্পর্কে যে দুইটি উপন্যাস রচিত হয়, সে দুইটিতেই এই কাহিনী পল্লবিত আকারে সমাবিষ্ট হয়েছে, তার মধ্যে দুর্গাদাস লাহিড়ী কৃত ‘রানী ভবানী’ গ্রন্থেই রাজশাহীর বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ সমাজে প্রচলিত কাহিনীগুলি সম্যকভাবে স্থান পেয়েছে।১৩৭ এ বিধবা অবস্থায় রানী তাঁর বিধবা মেয়েকে নিয়ে মুর্শিদাবাদের সমীপে গঙ্গাতীরস্থ বড়নগরের বাড়িতে থাকতেন। এই কাহিনী অনুসারে সিরাজ গঙ্গার বক্ষে বজরা থেকে ছাদের উপর আলুলায়িত কেশা পরমরূপসী তারাসুন্দরীকে দেখে উন্মত্ত হয়ে সৈন্য প্রেরণ করেন। নবাবের সৈন্যদের বাধা দিতে রুদ্রমূর্তি ত্রিশূলধারী সন্ন্যাসীরা আবির্ভূত হন, মস্তরাম বাবাজী তাঁদের চালনা করেন। ইনি ঐতিহাসিক ব্যক্তি, গঙ্গাতীরে এঁর আখড়ার ভিটে এই শতকের গোড়ার দিকে বিদ্যমান ছিল। মস্তরাম বাবাজী রানী ভবানীর অনুগৃহীত ছিলেন, এবং তাঁর দলবল রানীর গঙ্গাতীরস্থ অন্নসত্র থেকে তারাসুন্দরীকে রক্ষা করতে অবতীর্ণ হয়। পরে রটিয়ে দেওয়া হল তারাসুন্দরীর মৃত্যু হয়েছে এবং গোলমাল না মেটা পর্যন্ত মথুরায় জগৎশেঠ ভবনে রানী তাঁর মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন। সিয়ার-উল-মুতাখ্‌খিরীনে বিশিষ্ট লোকের কন্যাহরণের উল্লেখ রয়েছে, সুতরাং এই কাহিনী ভিত্তিহীন বলা চলে না। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কুলের বিশিষ্ট পণ্ডিত ও সিরাজের জীবনীকার ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রানী ভবানীর বড়নগরস্থ বংশধর রাজা উমেশচন্দ্রের সূত্রে প্রাপ্ত হয়ে এই কাহিনীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। ১৩৮ এ ঘটনা যদি সত্য হয়, স্বয়ং রানী ভবানীর বিধবা মেয়ের দিকে সিরাজ যদি লুব্ধ হাত বিস্তার করে থাকেন বা এ রকম কোনো গুজবও যদি রাষ্ট্র হয়ে থাকে, তবে হিন্দু জমিদার কুলের সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠা অসম্ভব নয় বটে।

পরবর্তীকালে পলাশীর ষড়যন্ত্রে রানী ভবানীর ভূমিকা নিয়ে আরো কাহিনী রচিত হয় যা রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় বা নীলমণি বসাক কৃত গ্রন্থে মেলে না। এই কাহিনীতে রানী ভবানী বঙ্গের বীরাঙ্গনা রূপে আবির্ভূত হয়েছেন এবং শেঠেদের গুপ্ত মন্ত্রণা কক্ষে অবরোধের আড়ালে উপস্থিত থেকে ষড়যন্ত্রীদের বিরোধিতা করেছেন। ‘আর্যনারী’ গ্রন্থে রানী ভবানী প্রসঙ্গে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে: ‘ইঁহাদের কাপুরুষোচিত আচরণে তিনি [রানী ভবানী] এত বিরক্ত হইয়াছিলেন যে, কথিত আছে, ইহাদের মধ্যে প্রধান এক ব্যক্তিকে, তিনি যে পুরুষ হইয়া স্ত্রীলোকের ন্যায় আচরণ করিতেছেন, ইহা বুঝাইবার জন্য বিদ্রূপছলে শাঁখা ও সিঁদুর পাঠাইয়া দিলেন।’ ১৩৯ যে যুগে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের চক্রান্ত নিয়ে গর্বভরে কাহিনী (১৮০৫) প্রচার করেছিলেন, সে যুগে, অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের একেবারে গোড়াতে, ইংরেজের সহায় হওয়া গর্বের বিষয় ছিল। পক্ষান্তরে রানী ভবানীকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে গল্প পরে প্রসার লাভ করে, তা নিঃসন্দেহে সেইকালে উদ্ভূত হয় যে ক্ষণে ইংরেজদের বাধাদান করা বাঙালি সমাজে গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কবি নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশির যুদ্ধ’ কাব্যে আমরা রানী ভবানীর দেশাত্মবোধ সংক্রান্ত মৌখিক জনশ্রুতি প্রথম লিপিবদ্ধ আকারে দেখতে পাই। নবীনচন্দ্রের দেশাত্মবোধকমূলক কাব্য ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দে রচিত হয়, তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের উন্মেষ হতে চলেছে। রাজীবলোচন ও নবীনচন্দ্রের কাহিনীর মধ্যে সত্তর বছরের ব্যবধান—সেই সত্তর বছরে বাঙালির মনোজগতে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে।

‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যের প্রথম দৃশ্য মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠ মন্ত্রভবন। বিশাল অন্ধকারময় প্রাসাদে একটি মাত্র আলোকরশ্মি অনুসরণ করে গুপ্ত কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে কবি দেখলেন:

রাখিয়া দক্ষিণ করে দক্ষিণ কপোল
বসি অবনত মুখে বীর পঞ্চজন।
বহে কি বহে না শ্বাস, চিন্তায় বিহ্বল,
কুটিল ভাবনাবেশে কুঞ্চিত নয়ন।

কে এই পাঁচজন? কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে একে একে প্রকাশ পেল— ‘বঙ্গের অদৃষ্ট ন্যস্ত যাঁহাদের করে’, এঁরা সেই রায় দুর্ল্লভ, মীর জাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ ও কৃষ্ণচন্দ্র রায়। আড়ালে বসে আছেন আর একজন—

একটি রমণীমূর্তি বসিয়া নীরবে,
গৌরাঙ্গিনী, দীর্ঘগ্রীবা, আকৰ্ণ-নয়ন,—১৪০
শুকতারা শোভে যেন আকাশের পটে,
শোভিছে উজলি জ্ঞান—গর্ব্বিত বদন।

নবীনচন্দ্রের কাব্যে কোনো প্রকৃত নায়ক যদি থাকেন তবে বোধ করি মোহনলাল। নায়িকা নিঃসন্দেহে রানী ভবানী—তাঁর মুখ দিয়েই কবির অন্তরের আসল ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবগুলি প্রকাশ পেয়েছে।

গুপ্ত মন্ত্রণাগৃহের নীরবতা প্রথমে ভঙ্গ করলেন মন্ত্রিবর দুর্ল্লভরাম:

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র!
অনেক চিন্তার পর করিলাম স্থির,
আমা হতে এই কৰ্ম্ম হবে না সাধন।
আজন্ম যাহার অন্নে বর্দ্ধিত শরীর;
কৃতঘ্নতা অসি—ধৰ্ম্মে দিয়া বিসর্জন—
কেমনে ধরিব আহা! বিপক্ষে তাহার?

পাঠকের স্মরণ থাকবে যে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় রায় দুর্ল্লভের মুখে এই কথা বসিয়েছিলেন শেঠভবনের দ্বিতীয় মন্ত্রণাসভায়, যেখানে কৃষ্ণচন্দ্র আহূত হয়ে যোগ দিয়েছিলেন। স্পষ্ট বোঝা যায় ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’ থেকে কবি এই উক্তি সংগ্রহ করেছেন। রায় দুর্ল্লভের কথায় মীর জাফর নিতান্ত নিরাশ হলেন।

মুহূর্ত্তেক নীরব সকল।
নিরাশ ভাবিয়া মনে যবন পামর,
প্রত্যেকের মুখপানে দেখিছে কেবল।

তখন মুখ তুলে জগৎশেঠ ক্রুদ্ধকণ্ঠে সিরাজের হাতে লাঞ্ছিত স্বীয় পরিবারের কলঙ্ক কাহিনী বলতে লাগলেন:

কি বলিব আর
বেগমের বেশে পাপী পশি অন্তঃপুরে
নিরমল কুল মম—প্রতিভা যাহার
মধ্যাহ্ন-ভাস্কর-সম ভূ-ভারত যুড়ে
প্রজ্জ্বলিত,—সেই কুলে দুষ্ট দুরাচার
করিয়াছে কলঙ্কের কালিমা-সঞ্চার।

জগৎশেঠের কুলে কলঙ্কলেপন করার অখ্যাতি যাঁর হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে তিনি নবাব সরফরাজ খান। আজ আর সে ঘটনার সত্য মিথ্যা নিরূপণ করার উপায় নেই, তবে তখনকার দিনের কোনো কোনো ইংরেজ কুঠিয়ালের ধারণা, এই জন্যই শেঠেরা চক্রান্ত করে সরফরাজ খানের মসনদে সিরাজের মাতামহ আলিবর্দি খানকে স্থাপন করেন। নবীনচন্দ্র সেনের কাব্য পড়ে বোঝা যায় তখনকার দিনের সমস্ত ইতিহাস থেকে মালমশলা সংগ্রহ করে তার সঙ্গে স্থানে স্থানে জনশ্রুতি মিশিয়ে তিনি তাঁর কাব্য রচনা করেছিলেন। সরফরাজের পিণ্ডি তিনি জেনে শুনে সিরাজের ঘাড়ে চাপিয়েছিলেন। অথচ সিরাজ কর্তৃক হিন্দু কুলে কলঙ্ক লেপন সংক্রান্ত যে জনশ্রুতি সত্যি সত্যি প্রচলিত ছিল, সেই তারাহরণ প্রচেষ্টা তিনি তাঁর কাব্যে কোথাও স্থান দেননি। অসম্ভব নয় যে বঙ্গজ বৈদ্য সন্তান বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ সমাজের জনশ্রুতির সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন। কিংবা এও হতে পারে যে ভবানী চরিত্র চিত্রণে এই উপাদান তাঁর কাছে উপযোগী মনে হয়নি। জগৎশেঠের কথা শুনে রাজা রাজবল্লভ বললেন:

যে অবধি সিংহাসনে বসিয়াছে হায়!
সে অবধি বিষদৃষ্টি উপরে আমার।
প্রিয় পুত্র কৃষ্ণদাস সহ পরিবার
হইয়াছে দেশান্তর; ইংরেজ বণিক
আশ্রয় না দিত যদি, কি দশা আমার
হতো এত দিনে!•••••
কলিকাতা-জয়-কালে যদিও পামর
পেয়ে গ্রাসে ছাড়িয়াছে পুত্র কৃষ্ণদাস,
যেদিন হইবে পাপী নির্ভয় অন্তর,
সেদিন আমার হবে সবংশে বিনাশ।

কলকাতা দখলকালে কৃষ্ণদাসকে হাতে পেয়ে সিরাজ যে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিলেন তা ঐতিহাসিক সত্য—তা থেকে তাঁর প্রসারিত হৃদয়ের একটি অপরিজ্ঞাত দিকের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ভয়ের বশে তিনি নিশ্চয় কৃষ্ণদাসকে ছেড়ে দেননি, কারণ ইংরেজরা তখন দেশ থেকে বিতাড়িত। অন্ধকূপ কাহিনী প্রচারক হলওয়েলকেও সিরাজ করুণাবশে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার পরে রাজবল্লভ নজরবন্দী অবস্থায় সন্তর্পণে ছিলেন—কিন্তু সুবিধা মতো তিনি ওয়াট্স্‌কে খবরাখবর দিয়ে চক্রান্তকারীদের সাহায্য করতেন। ১৪১ নবীনচন্দ্রের রাজবল্লভ কিন্তু আরো আগুয়ান হয়ে শেঠেদের মন্ত্রণাগৃহে স্পষ্ট বলছেন:

চিন্ত সদুপায়! মম এই অভিপ্রায়—
সহৃদয় ইংরেজের লইয়া আশ্রয়
রাজ্যভ্রষ্ট করি এই দুরন্ত যুবায়,
(কত দিনে বিধি বঙ্গে হইবে সদয়!)
সৈন্যাধ্যক্ষ সাধু মিরজাফরের করে
সমর্পি এ রাজ্যভার।

অতঃপর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও রাজবল্লভ নির্দিষ্ট সদুপায়ের সমর্থন করে বললেন—

মুহূর্ত্তে ক্লাইভ যুদ্ধে হলে সম্মুখীন,
উড়াইবে তৃণবৎ যুবা অর্ব্বাচীন।’
এ যুক্তিতে সমবেত সভ্য যত জন
কিছু তর্ক পরে, সবে হলেন সম্মত।
বলিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ফিরায়ে নয়ন,—
‘জানিতে বাসনা করি রানীর কি মত?

প্রশ্ন শুনে নিস্পন্দশরীর শূন্যদৃষ্টি রানী ভবানী সুপ্তোথিতার মতো ধীরে ধীরে বললেন—

আমার কি মত, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়!
শুনিতে বাসনা যদি, বলিব এখন।
সহজে অবলা আমি দুর্ব্বল-হৃদয়,
নৃপবর! কি বলিব? কিন্তু—এ চক্রান্ত
কৃষ্ণনগরাধিপের উপযুক্ত নয়। ••••
কাপুরুষযোগ্য এই হীন মন্ত্রণায়
কেমনে দিলেন সায় একবাক্যে সব
বুঝিতে না পারি আমি।

রানী ভবানীর উপরিউক্ত মত নবীনচন্দ্র সেন ঠিক কোনো সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিলেন তা বোঝার উপায় নেই। মৌখিক কোনো জনশ্রুতিই নিশ্চয় এর ভিত্তি। এতে সন্দেহ নেই যে নবীনচন্দ্রের কাব্যের মারফৎ পরবর্তীকালে এই জনশ্রুতি আরো প্রসারিত হয়ে পড়ে। রানী ভবানীর মুখ দিয়ে কবি দেশের ভবিষ্যৎ নিরূপণ করালেন:

ভেবে দেখ মনে
সেনাপতি সিংহাসনে বসিবেন যবে
তিনি যদি এতাধিক হন অত্যাচারী
ইংরাজ সহায় তাঁর কি করিবে তবে?
* * *
জ্ঞানহীনা নারী আমি, তবু মহারাজ!
দেখিতেছি দিব্য চক্ষে, সিরাজদ্দৌলায়
করি রাজ্যচ্যুত, শান্ত হবে না ইংরাজ
বরঞ্চ হইবে মত্ত রাজ্য পিপাসায়।

এরপর নবীনচন্দ্র ভারতবর্ষের ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসে পলাশীর ষড়যন্ত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন। রানী ভবানীর জবানীতে কবি লিখেছেন।

জানি আমি যবনেরা ইংরাজের মত
ভিন্ন জাতি; তবু ভেদ আকাশ পাতাল।
যবন ভারতবর্ষে আছে অবিরত
সার্দ্ধপঞ্চশত বর্ষ, এই দীর্ঘকাল
একত্রে বসতি হেতু, হয়ে বিদূরিত
জেতা জিত বিষভাব, আৰ্য্যসুত সনে
হইয়াছে পরিণয় প্রণয় স্থাপিত;
নাহি বৃথা দ্বন্দ্ব জাতি-ধৰ্ম্মের কারণে।
*
বিশেষ তাদের এই পতন সময়;
কি পাতশাহ, কি নবাব, আমাদের করে
পুতুলের মত;•••••
আমাদের করে রাজ্য শাসনের ভার!
কিবা সৈন্য রাজ্য, রাজকোষ, রাজমন্ত্রণায়,
কোথায় না হিন্দুদের আছে অধিকার?
সমরে শিবিরে, হিন্দু প্রধান সহায়।
অচিরে যবন রাজ্য টলিবে নিশ্চয়;
উপস্থিত ভারতের উদ্ধার সময়।
*
আমার কি মত? তবে শুন মহারাজ!
অসহ্য দাসত্ব যদি, নিষ্কোশিয়া অসি,
সাজিয়া সমর-সাজে নৃপতি-সমাজ
প্রবেশ সম্মুখরণে।

বাঙালি মানসে রাজীবলোচন থেকে নবীনচন্দ্রের যুগ পর্যন্ত পলাশীর ষড়যন্ত্রের যে রূপ প্রতিফলিত হয়েছিল তাতে হিন্দু জমিদারদের ভূমিকাই মুখ্য। এই জমিদাররা জগৎশেঠের সঙ্গে মিলিত হয়ে ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়িয়েছিলেন এবং প্রয়োজনবোধে একজন মুসলমান আমীর অর্থাৎ সেনাপতি মীর জাফরকে দলে টেনে এনেছিলেন। বাঙালির রাষ্ট্রীয় চেতনার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চক্রান্তের মনগড়া রূপটিও পরিবর্তিত হয়েছিল। তাই ১৮০৫ খ্রীস্টাব্দে ক্লাইভের ‘প্রধান সহায়’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাঙালির আদর্শ পুরুষ রূপে প্রভাব বিস্তার করেছেন আর সত্তর বছর পরে (১৮৭৫) ক্লাইভের ‘ঘোর বিরোধিনী’ রানী ভবানী স্বদেশপ্রীতির আদর্শরূপা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বলা বাহুল্য সঠিক ইতিহাসের সঙ্গে এই মানস প্রতিকৃতিগুলি এক নয়। পরবর্তী অধ্যায়ে ষড়যন্ত্রের একটি সঠিক ধারাবাহিক বিবরণ রচনার চেষ্টা করা হবে।

.

টীকা

১। এই প্রকার ঐতিহাসিক গবেষণা করেছেন Atul Chandra Roy. The Career of Mir Jafar Khan (1757-1766 A.D), (Calcutta 1953)

২। মীরজাফরের পরিচয় উপরোক্ত গ্রন্থ থেকে গৃহীত।

৩। Seir I P. 365.

৪। Seir II, p. 10.

৫। ‘মহান’। তার সঙ্গে আরো অদ্ভুত ও অর্থহীন খেতাব জুড়েছিলেন ‘মাসুম-আল-আরেফিন’—সে কথার মানে কি কেউ জানত না। অন্ততঃ গোলাম হোসেন খান বুঝতে পারেননি। Seir Mutaqherin II, p. 21.

৬। হাসান ও হোসেন

৭। হজরত মহম্মদ

৮। Seir Mutaqherin II p.88.

৯। এ ব্যাপারে মঁসিয় ল’র সাক্ষ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ: ‘… Alivardivardikhan…had recommended Sirajuddaula to him and made him swear on the Koran never to abandon him. I am certain he intended to keep this word…without his support Siraj-uddaula would never have been Nawab. He alone kept him on his throne. Bengal in 1756-57, III, p. 211.

১০। তাঁর সঙ্গে ছিল বারো থেকে পনের লক্ষ টাকার জহরত এবং বহু সঞ্চিত অর্থ। ১৭৮০-তে কপর্দকশূন্য অবস্থায় তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বুড়ো বয়সে এক নর্তকীর আশ্রয়ে দিন কাটান। বারানসীতে জুয়া খেলে তিনি সব খুইয়েছিলেন। seir II, p. 186, Bengal in 1756-57. III p. 217-৪,

১১। সিয়র অনুযায়ী মীরমদন এই সময় বকশী পদে নিযুক্ত হন। এই তথ্য ভুল। ইংরেজ ও ওলন্দাজ সূত্রে জানা যায় মীর মদন নবাবের General of the Husehold Troops ছিলেন। রিয়াজ অনুযায়ী মীর মদন তোপখানার দারোগা নিযুক্ত হন। মীরজাফর পূর্বপদে অধিষ্ঠিত থাকেন।

১২। seir II, p. 186-189; Riyaz p. 363-364.

১৩। seir II, p. 191

১৪। seir II. p. 196.

১৫। seir II. p. 197.

১৬। সিয়ার-উল-মুতাখ্‌খিরীন গ্রন্থকার।

১৭। এর সম্বন্ধে প্রামাণ্য বই Subhas Chandra Mukhopadhyay, The Career of Rajah Dulabh w Mahindra [Rai Rulabh/ Diwan of Bangal, 1710-1770(Varanasi 1974).

১৮। জানকীরাম বাঙালি কায়স্থ, রাজবল্লভ বাঙালি বৈদ্য। রামনারায়ণ বাঙালি ছিলেন না, তিনি বিহারের কায়স্থ। বিহারের নায়েব হন পর পর জানকীরাম (আলিবর্দি খান), রামনারায়ণ (আলিবর্দি, সিরাজ, মীরজাফর, মীর কাশিম) ও রাজবল্লভ (মীর কাশিম)।

১৯। seir II. p.3

২০। সুবোধ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় The Career of Rajah Durlabhram Mahindra বইতে ওড়িশার বর্গিদের দ্বারা রায় দুর্ল্লভের দুবার ধৃত হবার কথা লিখেছেন— প্রথমে শেখ মুহম্মদ মাসুমের সময়, দ্বিতীয় বার নিজে নায়েব থাকা কালে। প্রথম খবরটির উৎস করম আলির মুজাফফর নামা, দ্বিতীয়টির উৎস সিয়র। দ্বিতীয়টি নিঃসন্দেহে সত্য, কিন্তু প্রথমটি সম্বন্ধে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। করম আলি কি ভুল করে নায়েবরূপে দুর্ল্লভরামের বন্দী হওয়ার খবরটা পেশকার থাকার সময় চালিয়ে দিয়েছেন? তা যদি হয়, তবে দুর্ল্লভরাম ওড়িশায় থাকতে দুবার নন একবার বন্দী হন, তাছাড়া মুর্শিদাবাদেও একবার।

২১। S.C. Mukhopadhyay, The Career of Rajah Durlabhram. p 21.

২২। Karam Ali, Muzaffarnarma, tr. Jadunath Sarkar, Bengal Nawabs, p. 51.

২৩। বাংলার নবাবরা একাধারে সুবাহ্ বাংলার নাজিম ও দেওয়ান হয়ে ওঠার পর থেকে তাঁদের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে চার রকমের দেওয়ানের নিয়োগ দেখা যায়। এঁরা কেউ বাদশাহর দেওয়ান নন, নবাবের দেওয়ান। প্রথমত দেওয়ান সুবাহ্ যিনি প্রধান অমাত্য। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নবাব মুর্শিদাবাদে না থাকলে সেখানে দেওয়ান সুবাহ্‌র স্থলে একজন নায়েব নাজিমকে রাখা হচ্ছে। দ্বিতীয় সারিতে দেওয়ান বালিসা বা রায় রায়ান এবং নিজামত দেওয়ান। একজনের হাতে খাজনা আদায় অর্থাৎ মালগুজরি, আর একজনের হাতে নিজামতের সামরিক হিসাবপত্র। এঁরা ছাড়া একজন দেওয়ান-ই-তন্‌ ছিলেন যিনি নবাবের প্রাসাদের খরচপত্র দেখতেন।

২৪। Seir II, pp. 187, 193,225,

২৫। যেমন পাটনার নায়েব রামনারায়ণ।

২৬। Seir II, p. 223-224.

২৭। Bengal in 1756-57. II. Dr. Forth to Drake

২৮। Riyaz, p. 311.

২৯। Seir II, P. 10.

৩০। Bengal in 1756-57, Vol II, p. 210,

৩১। Karam Ali, ‘Muzaffar nana’, Bengal Nawabs, pp. 72.75.

৩২। Little, House of Jagatseth, pp. 22-23, 26.

৩৩। ণাণ কর? জ্ঞান—ণাণ। জৈন মুনিদের মধ্যে গাণ শব্দ প্রচলিত।

৩৪। House of Jagatseth, pp. 30-39.

৩৫। ‘পোসহশালা, পৌষধশালা। পৌষধং পর্বনিদানুষ্ঠানম্ উপবাসাদি, তস্য শালা গৃহবিশেষঃ পৌষধশালা।’ Vijayarajendra Suri, Abhidhana Rajendra Kosha Jain Encyclopoedia (1910-1925), reprint New Delhi 1985। পর্বদিনে উপবাস নিমিত্ত সাধারণ ধর্মিজনাকীর্ণ স্থান।

৩৬। রাজপুতানা থেকে আগত পরিবারের গৃহবধূর উপর গুজরাটি ভাষায় কবিতা রচনা করা হল কেন? মনে হয়, তখনো গুজরাট, রাজপুতানা ইত্যাদি ভিন্ন ভাষী অঞ্চলের ওসওয়াল আদি চুরাশী বণিক কুল সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে যায়নি। মূলত সব ওসওয়ালই রাজপুতানার ওসনগর বা ওসিয়াঁর লোক, আগরওয়ালারা হরিয়ানার অগ্রোহার লোক। জৈন বণিকদের যাজনা করতেন শ্রীমালি কুল। শ্রীমালিরা গুজরাটি হিন্দী দুই ভাষাতেই লিখতেন।

৩৭। Little, The House of Jagatseth, appendex II, Translation of the Hindi Note-book preserved in the family with additions to the present day, pp. 249-250.

৩৮। Little, House of Jagatseth, pp. XVI, 29.

৩৯। Sukumar Bhattacharya, The East India Company and the Economy of Bengal from 1707-1740 (Calcutta 1969), p. 25.

৪০। P.J. Marshall, East Indian Fortunes, p. 55, Table I.

৪১। Sushil Chaudhuri, ‘Merchants, Companies and Rulers, Bengal in the Eighteenth Century,’ in Journal of the Economic and Social History of the Orient, Vol XXXI. pp. 93-94.

৪২। Sushil Chaudhuri, ‘Merchants. Companies and Rulers’,

৪৩। Dutch trade letter, 14 February 1755, cited in J. II. Little, The House of Jagatsetht, p viii.

৪৪। Seir Mutaqherin II, pp. 457-458. লেখার ভুলে একটা শূন্য বেশি পড়ে গিয়েছে ধরলে দু-কোটি টাকা লুঠের জায়গায় ২০ লক্ষ টাকা ধরতে হবে। সেটা অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য কারণ জগৎশেঠ বছরে ৫০ লক্ষ টাকার আর্কট ও সনওয়ত সিক্কা টাকায় পরিণত করতেন। করম আলির মুজাফ্ফর নামা মতে, মাত্র ৩ লক্ষ টাকা লুঠ হয়। এটা সম্ভবত কমিয়ে বলা।

৪৫। Sushi Chaudhuri, ‘Merchants, Companies and Rulers,’ p. 96.

৪৬। মূলধনের উপর শতকরা ১০ আয় ধরে এই হিসাব। দেশীয় লোকেদের মুখে উইলিয়াম বোলট্স্ শুনেছিলেন জগৎশেঠের মূলধন সাত কোটি টাকা।

৪৭। The House of Jagatseth, p. 226.

৪৮। Luke Serafton to Clive, 17 December 1757, Orme Mss. cited in Sushil Chaudhuri. ‘Merchants, Companies and Rulers, 91.

৪৯। Long, Selections, no. 812.

৫০। আলিবর্দি খানের খেতাব মহাবৎজঙ্গ। আমীর বহুবচন উমরা। উমরা—ওমরাও।

৫১। Seir Mutaghenin II, p. 193.

৫২। Long, Selections, no. 198.

৫৩। Bengal in 1756-57, II. p. 104.

৫৪। The House of Jagatseth, p. xii.

৫৫। Memoir by Jean Law, Chief of the French Factory at Cossimbazar.

৫৬। Ibid. p. 194. Bengal in 1756-57, III pp. 185-186.

৫৭। Kumkum Banerjee, Indigenous Trade, Finance and Politics, p. 157.

৫৮। Memoir of Jean Law, Bengal in 1756-57, III, pp. 193-194

৫৯। Ibid, p. 204-6.

৬০। Ibid, p. 185.

৬১। Orme Mss. India, VI, F. 1455, cited in Sushil Chaudhuri, op. cit, p. 91.

৬২। Orme, Military Transactions in Indostan Vol II, p 58.

৬৩। Sushal Chaudhuri, op cit, p. 102.

৬৪। Seir II. p. 400

৬৫। Kumkum Banerjee, ‘Indigenous Trade, Finance and Politics,’chapter III. passim.

৬৬। Seir II p.400.

৬৭। Bengal in 1757-58, Vol II no. 167.

৬৮। Seir II. p. 400

৬৯। Sushil Chaudhuri, ‘Merchants, Companies and Rulers,’ p. 102

৭০। Kumkum Banerjee, ‘Indigenous Trade Finance and Politics’. p. 134, Sushil Chaudhuri. ‘Merchants, Companies and Rulers,’ p. 101.

৭১। Ibid.

৭২। সেখান থেকেই ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের গোড়ায় তাঁর কাছে প্রশ্ন খবর আসে, ইওরোপে ইংরেজ ও ফরাসীদের যুদ্ধ বেধেছে এবং বোম্বাইয়ে ইংরেজরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলায় দেশীয় লোকের এই প্রথম সে সংবাদ পায়। Bengal in 1756-57, Vol II, no. 144.

৭৩। Sushil Chaudhun, ‘Sirajuddaulah, the English company and the Plassey conspiracy.’ unpublished article

৭৪। Kumkum Banerjee, ‘Indigenous Fimance, Trade and politics, ’pp. II. 113

৭৫। Bengal in 1756-57, III, p. 187.

৭৬। Bengal in 1756-57, II, Nos. 175, 166.

৭৭। সুশীল দে, বাংলা প্রবাদ নং ৬৮০৩।

৭৮। Bengal in 1756-57. II. no. 177.

৭৯। Ibid. III. p. 187

৮০। Ibid, II, no. 309

৮১। Kumkun Banerjee, op. cit. p. 167.

৮২। Bengal in 1756-57, III, p. 190.

৮৩। Ibid, pp. 190-191.

৮৪। Ibid, II, no. 371.

৮৫। Ibid, no. 379.

৮৬। Ibid, no 386.

৮৭। Ibid. no. 389.

৮৮। Ibid, nos. 363, 379.

৮৯। Ibid, no. 397.

৯০। Ibid. no. 390.

৯১। Ibid, no. 408.

৯২। Ibid, no. 430.

৯৩। Long Selections, no. 687. Proceedings dated 21 Novenber 1763.

৯৪। Ibid-তাঁর পূর্ববর্তী ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দের আবেদনে এর উল্লেখ নেই।

৯৫। পেত্রসের নিজের ব্যবহৃত শব্দ। কতকগুলি বাড়ি ভেঙে ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে মুসলমানদের মসজিদ বানানো হয়েছিল। কিন্তু আলিনগরের শাসক নিযুক্ত হন বর্ধমান রাজার ভূতপূর্ব হিন্দু কর্মচারী মানিকচন্দ।

৯৬। Letter from Petras Arratoon to the Court of Directors, dated 25 January 1759. given in full in Bengal in 1756-57, III no 103.

৯৭। বস্তুতপক্ষে আমীরচন্দ দুই বন্ধুর মাধ্যমে মেজর লিপ্যাট্রিককে পরামর্শ দেন তিনি যেন মানিকচন্দ, খাজা ওয়াজিদ, জগৎশেঠ ও রায় দুর্ল্লভকে চিঠি লিখে ইংরেজদের পুনর্বাসনের আবেদন জানান।

৯৮। এই সময় খোজা পেত্রস নবাবের শিবিরের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা পর্যন্ত এসেছিলেন, সঙ্গে ছিলেন জগৎশেঠের কর্মচারী রণজিৎ রায়। নবাবের অনুমতি অনুসারে রণজিৎ রায় পথে দুবার বোঝাপড়ার জন্য চিঠি দিয়ে খোজা পেত্রসকে ক্লাইভের কাছে পাঠান। বলতে গেলে, পেত্রস এই সময় নবাব দরবারের দূতরূপে কাজ করছিলেন। কুয়াশার ভেতরে ক্লাইভের ‘অপ্রত্যাশিত হয় পিষ্ট হয়ে নবাব রণজিত রায়কে সন্ধির যে সব শর্ত জানাতে বলেন, সেগুলি লিখে রণজিৎ রায় খোজা পেত্রসকে দিয়ে ক্লাইভের সমীপে পাঠিয়ে আলিনগরের শান্তি স্থাপন করান। ইংরেজদের সঙ্গে পূর্ব পরিচিত ছিলেন বলে পেত্রস নবাবের শিবির থেকে ক্লাইভের শিবিরে সহজে যাতায়াত করতে পেরেছিলেন। Bengal in 1756-57Vol II, pp. 133, 214, 237, 238.

৯৯। Long, Selections no. 647.

১০০। Kumkum Banerjee, Indigenous Trade, p. 104 Sushu Chaudhuri. ‘Merchants Companies and Rulers,’p 97.

১০১। N. K. Sinha, Econonic History of Bengal I, pp. 244-6.

১০২। Ibid, p. 242.

১০৩। Sushil Chaudhuri, ‘Merchants, companies and Rulers,’ p. 98.

১০৪। Orme, Military Transactions in Indostan, pp. 50-51.

১০৫। Kumkum Banerjee, ‘Indigenous Trade, Finance and Politics,’pp. 104-105. Sushil Chaudhuri. ‘Merchants, companies and Rulers, ’ pp. 98-99.

১০৬। Kumkum Banerjec, op. cit, Chapter II Passim.

১০৭। Bengal in 1756-57,Vol I no. 186, p. 149.

১০৮। Bengal in 1756-57, Vol I, p. 141.

১০৯। সিরাজের মা আমিনা বেগম।

১১০। সিরাজউদ্দৌলাহ্।

১১২। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী দৌহিত্র সিরাজ।

১১৩। Bengal in 1756-57, II, pp. 63-64.

১১৪। উপরোক্ত বিবরণটি অনেকগুলি ভিন্ন ভিন্ন দলিলের ভিত্তিতে রচিত। সবই Hill, Bengal in 1756-57 গ্রন্থে পাওয়া যাবে, দ্রষ্টব্য, Vol I, p 21, 135, 141-146, vol II, pp 6, 21,174.

১১৫। Bengal in 1756-57, I PP. 145-146

১১৬। Bengal in 1756-57. Vol I, pp. 85, 154, 160, vol II, pp. 21-22 vol III, PP. 363-364

১১৭। Bengal in 1756-57, Vol I no. 64,

১১৮। Bengal in 1756-57,Vol II, no. 191.

১১৯। Bengal in 1756-57, II, no. 235.

১২০। Bengal in 1756-57, II, no. 237.

১২১। Bengal in 1756-57. II n০. 242

১২২। Ibid, no, 385,397.

১২৩। Ibid, no, 392.

১২৪। Ibid, vol 1. Pp. 117-118, 134, 154; vol II p. 19.

১২৫। Riyaz, pp. 342-343; সৈয়দ গোলাম হুসায়ন খান তাব্‌তবায়ী, সিয়ারে মুতাখ্‌খিরীন (এম আবদুল কাদের কর্তৃক বাংলায় অনুদিত), প্রথম খণ্ড (ঢাকা ১৯৭৮), ৪৭৫ -৬ পৃঃ।

১২৬। Bengal in 1756-57. III no. 86. এ কথা সুবিদিত যে পরবর্তীকালে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ন্যাসী দলের বার বার সংঘর্ষ হয়েছিল।

১২৭। Mr. Watts to Colonel Clive, 14 May 1757, Bengal in 1756-57, II, no. 392.

১২৮। প্রথম গদ্যে রচিত বাংলা জীবন চরিত রামরাম বসুর রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০১)।

১২৯। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স চরিত্রং (সম্পা; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়), দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাবলী ২, কলকাতা ১৩৪৩, ২৫-২৭ পৃঃ।

১৩০। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স চরিত্রং, ৩২-৩৭ পৃঃ।

১৩১। Bengal in 1756-57, II, p. 68,

১৩২। Bengal in 1756-57, II. pp. 418-419.

১৩৩। Bengal in 1756-57, II, p. 375.

১৩৪। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং, পৃঃ ৫২।

১৩৫। Bengal in 1756-57, II, p. 392.

১৩৬। মৃত্যুঞ্জয় শর্মা, রাজাবলী, ৫ম সং, কলিকাতা-১৮৮৯,১৫৬ পৃঃ।

১৩৭। নীলমণি বসাক, নব-নারী অর্থাৎ প্রাচীন ও আধুনিক নয় নারীর জীবন চরিত, কলকাতা, ৫ম সং, ১৮৭০, ৩০৫ -৬ পৃঃ। এই বইয়ের প্রথম সংস্করণ হিন্দু কলেজের পাঠ্য ছিল এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক সংশোধিত হয়েছিল।

১৩৮। দুর্গদাস লাহিড়ী, রানী ভবানী (১ম সং কলকাতা ১৩১৬); হারাণচন্দ্র রক্ষিত, রানী ভবানী, (কলকাতা ১৩২৪)।

১৩৯। মৈত্রেয়, সিরাজদ্দৌলা, পৃঃ ৭০।

১৪০। কালী প্রসন্ন দাসগুপ্ত ও দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, আর্য-নারী, (১ম সং কলকাতা ১৩১৬), ২৩৮-৯ পৃঃ।

১৪১। নীলমণি বসাক রানী ভবানী সম্পর্কে লিখেছেন— ‘যে সকল লোক তাঁহাকে প্রাচীনাবস্থাতে দেখিয়াছিলেন, তাঁহারা কেহ কেহ অদ্যাবধি বর্তমান আছেন। তাঁহারা কহেন তিনি অতি সুন্দরী ও সুলক্ষণা ছিলেন।

১৪২। Bengal in 1756-57, II, p. 403.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *