তৃতীয় দৃশ্য – চীনেপাড়া

তৃতীয় দৃশ্য – চীনেপাড়া৩.১

এই যে চীনেপাড়া, কলকাতার এটি মস্ত একটি দ্রষ্টব্য স্থান। বড়োবাজারের মাড়োয়ারিদের, মেছোবাজারে মুসলমানদের ও চৌরঙ্গিতে ইউরোপীয়দের জাতীয় বিশেষত্বের ছাপ আছে খুব স্পষ্ট— তবু সেসব পাড়াতেও কলকাতা আপনাকে একেবারে হারিয়ে ফেলেনি। কিন্তু আপনি চীনেপাড়ার ভিতরে একবার ঢুকুন, আপনার আর মনে হবে না আপনি সত্যই কলকাতাতেই আছেন! রাত্রে এখানকার আলোছায়া, লোকজন, কথাবার্তা, ঘরবাড়ি সবই সুদূর চীনের বিচিত্র স্মৃতি আপনার মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলবে।

সরু রাস্তা, সাপের মতো এঁকে বেঁকে দু-ধারের বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। আপনি চলতে চলতে দু-পাশেই দেখবেন, কোথাও কোনো একতলা বাড়ির পথের ধারের খোলা ঘরে বসে চীনে-মা পথিকদের সামনেই প্রকাশ্যে বুক খুলে অসংকোচে শিশুকে স্তন্যপান করাচ্ছে, কোথাও বাড়ির দরজার ওপরে দুর্বোধ্য চিত্রবৎ চীনে ভাষায় রঙিন বিজ্ঞাপন ঝুলছে, কোথাও এক চীনে তানসেন অচিন সুরের অদ্ভুত গান জুড়ে দিয়েছে, কোথাও-বা তিন চার জন্য চীনেম্যান তাদের অনুস্বর বহুল ভাষায় কী এক প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করছে। প্রতি পদেই প্রায় দেখবেন, একটা চীনে সরাই বা একেলে ধরনের হোটেল, কিংবা জুয়াখানা ও চণ্ডুখোরের আড্ডা৩.২ অথবা চৈনিক ধর্মমন্দির। আবহাওয়া একেবারে নতুনতরো।

চীনেপাড়া সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ দুই বন্ধু আমাকে একদিন নিমন্ত্রণ করলেন— চীনে হোটেলে খাওয়াবেন বলে।… তাঁদের সঙ্গে প্রথমে এক খাঁটি চীনে সরাইয়ে গিয়ে ঢুকলুম। দুটি ঘর— একটি রান্নার ঘর ও আর একটি খরিদ্দারের জন্যে, কিন্তু রান্নাঘরটি বড়ো। সেখানে মেঝের ওপরে নানান রকমের খাবার সাজানো রয়েছে, উপরে কতগুলো ছালছাড়ানো কাঁচা মুরগি ঝুলছে। আহার গৃহে তিনকোণে তিনটি ছোটো ছোটো কাঠের টেবিল। প্রত্যেক টেবিলের দুই পাশে অত্যন্ত বিশীর্ণ প্রায় দাঁড়ের মতো দু-খানা করে বেঞ্চি— শুনলুম এ-রকম আসন নাকি চীনে সরাইয়েরই বিশেষত্ব। দরজার পাশের এককোণে একটা উঁচু টেবিল, তাতেও নানারকম খাবার, বোতল ও পাত্রাদি সাজানো এবং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে দোকানের মালিক।

আমরা একটা টেবিলের ধারে গিয়ে বসলুম। নাকে যেন কেমন একটা অজানা গন্ধ পেতে লাগলুম, সে গন্ধ ঘৃণাকরও নয়, উপভোগ্যও নয়। পাশের টেবিলে দু-জন চীনেম্যান মাঝে মাঝে মুখের সামনে বাটি তুলে, দুটো কাঠি দিয়ে৩.৩ কী খাবার নিয়ে খাচ্ছে, মাঝে মাঝে কথা কইছে, মাঝে মাঝে অবাক হয়ে আমাদের মুখের পানে চেয়ে দেখছে— খাঁটি চীনে সরাইয়ে আমাদের মতো নব্য বঙ্গের হাল ফ্যাশানের নমুনার আবির্ভাব যে প্রায়ই ঘটে না, তাদের ভাব দেখে তা স্পষ্ট বুঝতে পারলুম। আহারকালে চীনেম্যানদের মুখের অদ্ভুত ভাবও দর্শনীয়— কিন্তু কলমে তা অবর্ণনীয়।

বন্ধুর ফরমাশে একটি ছোকরা চীনে বেয়ারা আমাদের ক-জনের জন্যে একখানা মাত্র ছোটো সানকিতে খানিকটা মাংসের তরকারি, এক বাটি ভাতের ফেন, ঝুরি ভাজার মতো একথালা আলু না ময়দার তৈরি কী একটা জিনিস এবং প্রত্যেকের জন্য দুটো করে কাঠি রেখে গেল। এই কাঠি হচ্ছে চীনেম্যানদের ছুরি কাঁটা। খাবারগুলি খেতে নেহাত মন্দ লাগল না।

শুনলুম, এখানে খুব সস্তায় মদ বিক্রি হয়। অন্য অন্য জায়গায় যে মদের এক এক ‘পেগে’র দাম পাঁচসিকা৩.৪, এখানে তাই-ই পাওয়া যায় মাত্রে সাড়ে পাঁচ আনায়। এত সস্তার কারণ, এখানে মদ আনা হয় আবগারি বিভাগ ফাঁকি দিয়ে। এখানে চীনে মদও পাওয়া যায়, তার দাম কিন্তু বেশি। এই সুসংবাদ বোধ করি বাঙালি মাতালদের কানে গিয়ে এখনও ওঠেনি— নইলে এতক্ষণে এ স্থানটা নিশ্চয়ই লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকত। এমন প্রকাশ্যভাবে এরা কোন সাহসে মদ বিক্রি করে, বলা যায় না। খুব সম্ভব অচেনা মাতাল এখানে এসে আবদার করলে দোকানের মালিক তাকে গলাধাক্কা দেয়।

তারপরে গেলুম আর একটা দোকানে। সে দোকানের মালিক কে তা জানি না, কিন্তু মালিকের স্ত্রী নিজেই এসে একগাল হেসে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন ও নিজের হাতেই আমাদের জন্য ‘কোকো’৩.৫ তৈরি করে দিলেন। এ-ঘরেও দু-দিকে দুটো টেবিল। একটার উপরে কতকগুলো চীনে মিষ্টান্ন সাজানো। —আর একটা টেবিল খুব উঁচু— তার ওপরে তিন চারটি হৃষ্টপুষ্ট শিশু কখনো গড়াগড়ি দিচ্ছে ও কখনো পরস্পরের সঙ্গে আঁচড়া-আঁচড়ি কামড়া-কামড়ি করছে। টেবিলের সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে লাগল— মালিকের জামাই ও তার বালিকা স্ত্রী। মেয়েটি এই বয়সে মা হয়েছে— আমাদের বাঙালি বালিকার মতো। আমরা যখন বিদায় নিলুম মালিকের স্ত্রী তখন দরজা পর্যন্ত এসে আমাদের এগিয়ে দিয়ে সেলাম করলেন। এই বিদেশিনির ভদ্রতায় মুগ্ধ হলুম।

তারপরে আর একটি চীনে সরাইয়ে ঢুকলুম। এটি আকারে মস্ত বড়ো ও খুব সাজানো গুছানো। ভেতরে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলছে, হরেকরকম গোলমাল শোনা যাচ্ছে, ব্যস্তভাবে লোক আনাগোনা করছে, চীনেম্যানরা চেয়ারের ওপরে উবু হয়ে খেতে বসেছে। একটি লোক পরিবেশন করছে— উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে! আমরা একটি কোণের ঘরে গিয়ে বসলুম— বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা। টেবিলের ওপর হরেকরকমের চীনে খাবার সাজানো আছে— যার যা খুশি নিজেই নিয়ে খেতে পারে। দু-চারটে খাবার খেয়ে আমরা চীনে চায়ের ফরমাশ করলুম। একটি চৈনিক যুবতী এসে হাতলহীন চীনে বাটিতে খানিকটা করে চা রেখে গরম জল ঢেলে, তার ওপরে আর একটি বাটি চাপা দিয়ে গেল। খানিকবাদে চায়ের পাতা সিদ্ধ হল। কিন্তু উপুড় করা বাটিটা এমনি তেতে উঠল যে সেটি নামানো অসম্ভব— কারণ তাতেও হাতল নেই। —চা খোর চীনেম্যানদের চা তৈরির এই ব্যবস্থাটি মোটেই সুবিধাজনক বলে মনে হল না।

এক বন্ধু বাহাদুরি করে বাটিটা নামাতে গেলেন— কিন্তু পারবেন কেন? খানিকটা চা চলকে টেবিলের উপরে এসে পড়ল, তার পর আমাদের দুরবস্থা দেখে সেই চীনে যুবতীটি এসে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। চীনে চায়ে দুধও নেই, চিনিও নেই— তবু আমার বড়ো মন্দ লাগল না, যদিও তার গন্ধটা চিরতার মতো। …খানিক পরে দেখি, অনেকে এসে উঁকি মেরে আমাদের দেখে যাচ্ছে! চৈনিক সুন্দরীটি নিশ্চয়ই বাইরে গিয়ে প্রচার করে দিয়েছেন এ-ঘরে এমন একদল জানোয়ার এসেছে যারা কীরকম করে চা খেতে হয়, তা পর্যন্ত জানে না! যা হোক, আমরাও অপ্রস্তুত হবার পাত্র নই— দিব্য গম্ভীর মুখে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে লাগলুম— যেন কিছুই হয়নি।

… আমি লক্ষ করলুম, যতক্ষণ এখানে আছি ততক্ষণ ধরেই একজন চীনেম্যান পাশের ঘর থেকে গম্ভীরভাবে আমার মুখের পানে চেয়ে আছে। আমার সঙ্গে বারংবার চোখাচোখি হলেও একবারও সে চোখ নাবালে না, টেবিলের ওপর দুই কনুই রেখে তেমনই নিষ্পলক নেত্রেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল! আমি তার দিকে চেয়ে দু-একবার হাসলুম, কিন্তু তবু তার মুখোশের মতন মুখ স্থির মুখের একটিমাত্র মাংসপেশিও সংকুচিত হল না। তার চাউনি দেখলে মনে হয়, আমি যেন তার পূর্বজন্মের পরিচিত! …কী চায় সে? আমাকে সম্মোহিত করবে নাকি? এমন অস্বস্তি হতে লাগল! …ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসে তবে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।

যেতে যেতে দেখলুম, এক জায়গায় একটা আলোকজ্জ্বল লম্বা ঘর থেকে টাকার আওয়াজ ও বহু কণ্ঠের মৃদুধ্বনি উঠছে। উঁকি মেরে দেখলুম, সত্যিই সে ঘরে অনেক লোক, সবাই চীনেম্যান। তারপর শুনলুম, এটা জুয়াখেলা। এটা নাকি চীনেদের ধর্মানুমোদিত, জুয়া না খেললে তাদের ধর্মহানি হয়! তাই প্রকাশ্যভাবে জুয়া খেললেও গভর্নমেন্ট তাদের বাধা দেয় না। অধিকাংশ চীনেম্যানই নিয়মিতভাবে জুয়া খেলে। সম্প্রতি কিন্তু সরকারি হুকুমে চীনেপাড়ার প্রধান বিশেষত্ব— প্রকাশ্য জুয়াখেলা বন্ধ হয়ে গেছে।

মগ, ফিরিঙ্গি, চীনেম্যান ও নিম্নশ্রেণির মুসলমানে পরিপূর্ণ, সংকীর্ণ ও মলিন গলির ভেতরে এগিয়ে আমরা আর দুটি হোটেল দেখলুম— এ দুটি হোটেল একেবারে ইউরোপীয় ধরনে সাজানো গুছানো। একটির নাম ‘ক্যান্টন’ অন্যটি ‘চাঙ্গুয়া’৩.৬ (এখন ‘ন্যানকিন’ নামে আর একটি নতুন হোটেল হয়েছে)। আমরা শেষোক্ত হোটেলে প্রবেশ করলুম। ঢুকবামাত্রই এক বুড়ো ও রোগা চীনেম্যান শুষ্ক ভাবহীন মুখে আমাদের অভিবাদন করলে— তার পরই এল এক ছিপছিপে যুবক, তার মুখ হাসিখুশিতে ভরা।

বার্নিস করা কাঠের দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি কোণের ঘরে গিয়ে আমরা বসে পড়লুম— দু-জন খিদমৎগার এল, তারা চীনে নয়, মুসলমান। চারিদিকে চেয়ে দেখলুম, চীনেপাড়ার এই চীনে হোটেলে চীনে আবহাওয়া একটুও নেই।

ওপাশের একটা ঘরের পর্দা খোলা ছিল— একটি যুবতী মেম হাতে মদের গেলাস নিয়ে একবার লীলাভরে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, একবার আসনে বসেই পুলকে নেচে নেচে উঠছে, একবার ঘরের অদৃশ্য অংশে কোনো সাহেবের সঙ্গে সুরাজড়িত স্বরে ইয়ার্কি করছে। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে আমার কালো চেহারা চোখে পড়তেই সে উত্তেজিত স্বরে ডাকলে— ম্যানেজার! আমি ভাবলুম, ব্যাপার কী? …ম্যানেজার আসবামাত্র সে তার ঘরের পর্দা টেনে দিতে বললেন— আমার কালো মুখ বোধ হয় তার স্ফূর্তির রং ময়লা করে দিচ্ছিল। —অথচ এ শ্রেণির মেমদের আমি খুব চিনি। আজ কোনো শ্বেতাঙ্গের ঘাড় ভেঙে সে হোটেলের খরচ চালিয়ে নিচ্ছে বলেই কালো চেহারার ওপর মৌখিক রাগ দেখাচ্ছে, কিন্তু কাল আমার পকেটে টাকার আওয়াজ শুনলে এই সুন্দরীটিই আমার পাশে এসে বসে অমনি ভঙ্গিভরেই হেসে মুচকে পড়বে।

এখানকার এই দুটি হোটেলে রাত্রিবেলায় সুরা ও নারীর মহিমা নগ্নরূপে আত্মপ্রকাশ করে। এটি বেপাড়া— চেনা লোকের সঙ্গে চোখাচোখি হবার ভয় নেই, তাই অনেক ইংরেজ ও বাঙালি এখানে এসে রাত্রির খানিক অংশ বেপরোয়া স্ফূর্তিতে কাটিয়ে দেয়। এখানকার লোকগুলো অনেক যুবক ও যুবতীকেই টেবিলের তলায় নেশায় বেসামাল হয়ে গড়াগড়ি দিতে দেখেছে! সুরা ও নারী চর্চার অবশ্যম্ভাবী ফল— মারামারি, তাও এখানে নতুন দৃশ্য নয়। খালি আহার করতে খুব কম ইংরেজ ও বাঙালিই আসে, কারণ চীনেপাড়ার বাইরে ইউরোপীয় ধরনের হোটেলের কোনো অভাব নেই!

‘চাঙ্গুয়া’র পাশে একটি জুয়াখানা ও চণ্ডুখোরের আস্তানা আছে। (আজকাল আর নেই)। চীনে জুয়াখানায় আমাদের প্রবেশ নিষেধ— কারণ সে কেবল চীনেদের জন্যেই। ভিন্নজাতীয় লোকদের মধ্যে জুয়াখেলা তো পবিত্র বা ধর্মের অঙ্গ নয়, তাই তারা এখানে এসে জুটলেই সেটা বেআইনি হয় এবং পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু আমার বন্ধুদের প্রভাব এখানে যথেষ্ট। তাই আমি চীনে জুয়াখানার ভেতরে একবার দৃষ্টিপাত করবার দুর্লভ সুযোগ পেলুম। …ঘরের ভিতরে ঢুকেই দেখলুম, মাঝখানে একটা বড়ো মেঝের চারপাশে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন লোক দাঁড়িয়ে বা চেয়ারের উপর বসে রয়েছে। জুয়াখেলার কিছুই আমি জানি না, তারা কোন শ্রেণির জুয়া খেলছিল তা বলতে পারি না। তবে এটা আমার চোখে পড়ল যে, মেঝের উপরে থাকে টাকা ও পয়সা সাজানো রয়েছে। সেই টাকা-পয়সার থাকগুলো মাঝে মাঝে এ, ওর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে— হার-জিত অনুসারে। শুনেছি জুয়াখেলায় জয়লাভের চেয়ে যে অনিশ্চয়তার প্রবল উত্তেজনা আছে, সেই উত্তেজনাই ভূতের মতো জুয়াড়িদের পেয়ে বসে এবং সেইজন্যেই তারা জুয়া না খেলে থাকতে পারে না— এমনকী সর্বস্ব পণ করেও। ঘোড়দৌড়ের উত্তেজনায় খেলোয়াড়দের আমি পাগলের মতো হয়ে উঠতে দেখেছি। ভেবেছিলুম এখানেও সেই উত্তেজনা দেখতে পাব। কিন্তু বৈদ্যুতিক বাতির প্রখর আলোকেও, এই চীনেম্যানগুলির কারোর মুখেই উত্তেজনার আভাসমাত্র আমি পেলুম না। অধিকাংশ লোকই ভাগ্যদেবীর চঞ্চল লীলা প্রশান্ত মুখে, স্থির নেত্রে নিরীক্ষণ করছে— কেবল কেউ কেউ মৃদু মৃদু হাসছে এইমাত্র! তারা কথাও কইছে খুব আস্তে আস্তে —গলার আওয়াজেও উত্তেজনার কোনো সাড়া নেই। মনে মনে ভাবলুম, হ্যাঁ, জুয়াখেলা সত্যই চিনাদের ধর্ম বটে। তাদের খেলা একমনে দেখছি —হঠাৎ একটা লোক ফিরে বললে, ‘বাবু এ জায়গা তোমাদের জন্য নয়!’ আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম।

ঠিক পাশের ঘরেই চণ্ডুখানা। সকলেই জানেন বোধ হয়, চীনে চণ্ডু আর দেশি গুলি একজাতীয় নেশা! তবে চিনারা চণ্ডু খায় সাইকেলের ‘পাম্পে’র মতো একরকম পাইপে, আর গুলিখোরেরা খায় ছোটো একটা হুঁকায় নল লাগিয়ে। চণ্ডুখানায় তখন একজন চীনেম্যান একখানা সোফার উপর শুয়েছিল, তার দেহের কোমর থেকে পা পর্যন্ত সোফার নীচে ঝুলে পড়েছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, একটা মৃতদেহ! —তার শরীরে কোথাও প্রাণের লক্ষণ নেই! নেশার ফলে সে এখন সংসারের দুঃখঝঞ্ঝাটের মধ্যে বাঞ্ছিত ও দুর্লভ বিস্মৃতিকে লাভ করেছে। চণ্ডু নাকি শুয়ে শুয়েই টানতে হয়— নইলে আফিমের ধোঁয়া এত শীঘ্র মস্তিষ্কের ভেতরে গিয়ে পৌঁছায় যে, উপভোগে বাধা উপস্থিত হয়। খানিকক্ষণ চণ্ডুর সেবন করার পরেই চণ্ডুখোর আর উঠতে বা নড়তে পারে না, তখন সে সদ্যোজাত শিশুর চেয়েও অসহায়, একটা মাছি পর্যন্ত মারা তার পক্ষে অসম্ভব! এমন নেশাও মানুষ করে!

তারপর আমরা রাস্তায় এসে, এই আলো-আঁধারির রহস্যে ভরা, গুন্ডার বিচরণক্ষেত্র, সরু সরু গলি, জুয়াখানা, চণ্ডুর আড্ডা, মন্দির-হোটেল ও পানাগারে এবং চীনে ছেলে-মেয়ে বুড়োর জটলাতে বিচিত্র ‘চায়না টাউন’-এর কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করলুম। এইরকম চীনেপাড়া পৃথিবীর সব দেশেই আছে— কারণ চীনেরা ভবঘুরে জাতি, বাঙালির মতো ঘরমুখো নয়। শুনেছি পৃথিবীর সর্বত্রই চীনেপাড়া দেখতে নাকি একইরকম। আমেরিকা ও বিলাতের চীনেপাড়া নেশা, নানা পাপ ও অশান্তির জন্যে বিখ্যাত। কলকাতার চীনেপাড়া ততটা ভয়ানক না হলেও সাধারণের পক্ষে রাত্রে এখানে যাওয়াটা বিশেষ নিরাপদ নয়! অন্ধকার আনাচকানাচ থেকে যে-কোনো মুহূর্তেই ছোরা-ছুরির মতো বিদ্যুৎচমক জ্বলে উঠতে পারে।

***

টীকা

৩.১ চীনেপাড়া—

“যাহারা কলিকাতা শহরের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, তাঁহাদের মধ্যেও অনেকে হয়তো জানেন না যে, এই শহরের কেন্দ্রস্থলে এমন একটি পল্লী আছে, যাহার একদিকে দুঃস্থ ভাটিয়া-মাড়ওয়ারী সম্প্রদায়ের বাস, অন্যদিকে খোলার বস্তি, ও তৃতীয় দিকে তীর্যকচক্ষু পিতবর্ণ চীনাদের উপনিবেশ।”— সত্যান্বেষী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে কথা। ইটালিয়ান সাহিত্যিক ক্যাসানোভার প্রিয় বন্ধু ছিলেন এদোয়ার্দো তেরিত্তি। কিন্তু বিধি বাম, তাঁকে দেশছাড়া হতে হল রাজনৈতিক কারণে। নানান জায়গাতে ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকলেন এই কলকাতায়। সুপারিন্টেনডেন্ট অফ স্ট্রিটস অ্যান্ড বিল্ডিং-এর চাকরি জুটিয়ে ফেললেন তিনি! আর সেই টাকায় কিনে ফেললেন একটা গোটা বাজার। নাম দিলেন তেরিত্তিবাজার, যা আজকের টেরিটিবাজার। আর বিয়ে করে ফেললেন এক ফরাসি কাউন্টের মেয়ে, পরমাসুন্দরী এঞ্জেলিকাকে। অগাধ পয়সা আর সঙ্গে সুন্দরী স্ত্রী… আর কী চাই!

কিন্তু এখানেও বিধি বাম! দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেল বাজার, আর ১৭৯৬ সালে মারা গেলেন এঞ্জেলিকা। প্রথমে শিয়ালদা বৈঠকখানার এক পর্তুগিজ কবরখানায় ওঁকে কবর দেবার পরে, ওখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তেরিত্তির বিবাদ হওয়ায়, সেই কবর তিনি তুলে নিয়ে আসেন, নিজের কেনা জমিতে কবর দেন। প্রতিষ্ঠা হয় তেরিত্তি কবরখানা বা ফ্রেঞ্চ বেরিয়াল গ্রাউন্ডের। সাউথ পার্ক কবরখানার কোনাকুনি ছিল এই কবরখানা, যা সবার জন্য খোলা ছিল। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত ছিল প্রায় একশো আটজন। আজকের তারিখে, সেই কবরখানার কোনও অস্তিত্ব নেই। বহুদিন আগেই তার লিজ শেষ হয়ে যাওয়ায়, সেখানে আজ দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু বাড়ি। এরপর থেকে তেরিত্তি সাহেবের আর-কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। সম্ভবত তিনি দেশে চলে গেছিলেন।

একসময় ব্রিটিশরা এখান থেকে প্রচুর আফিম রপ্তানি করত চিনে। সেই সূত্র, আর বাণিজ্যের সূত্রে কলকাতায় চিনেরা আসতে শুরু করে। এদের মধ্যে টং আছু-র নাম উল্লেখযোগ্য, যাকে কলকাতার একজন চীনে শিল্পপতি বলে অভিহিত করা যেতে পারে। বজবজের কাছের যে অছিপুর জায়গাটা, সেটা তো ওঁর নামেই! ধীরে ধীরে তারা ছড়িয়ে পড়ে ট্যাংরা, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ আর এই টেরিটিবাজারের অঞ্চলে।

সেকালের টেরিটি আর একালের টেরিটির মধ্যে অনেক তফাত। এখন এই জায়গাটা একটা ট্রান্সপোর্ট হাব হয়ে উঠেছে। কিন্তু আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে, এখানে হিন্দু মুসলিম ও চীনারা মিলেমিশে থাকত। বেশির ভাগ বাড়িগুলোর মালিকানা ছিল বাঙালিদের। আর এই পাড়াতে বাঙালি মেস ছিল অনেক। এরকম একটা মেস থেকেই তো সূত্রপাত ব্যোমকেশের প্রথম গল্পের! রাস্তার ধারে প্রচুর চিনে দোকান, অনেক চীনে রেস্তোরাঁ, আর সকালে রাস্তার ধারে বসা চীনে ব্রেকফাস্ট! এখন সেই বাড়িগুলোর মালিকানা বেশির ভাগ চলে গেছে অবাঙালি মুসলিমদের হাতে, আর ট্রান্সপোর্ট হাব হবার জন্য রাস্তাঘাট হয়ে উঠেছে নোংরা। এ পাড়ায় এখন নতুন প্রজন্মের চীনেদের দেখাই যায় না। হয় তারা কলকাতার অন্য জায়গায় চলে গেছে, নাহয় পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে। এখানে রয়েছে শুধু কিছু চীনে বুড়ো-বুড়ি, তাদের পুরোনো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে। হাতে গোনা কয়েকটা চীনে দোকান আর রেস্তোরাঁ দেখা যায় এখন। তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস এখনও রয়েছে, সেটা হল চীনে ব্রেকফাস্ট। সকাল পাঁচটা থেকে আটটা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সংখ্যাতে অনেক কমে গেলেও, নিজেদের এই ব্রেকফাস্টের কালচারটা তারা ধরে রেখেছে।

৩.২ চণ্ডুখোরের আস্তানা— চণ্ডু হল আফিং থেকে প্রস্তুত মাদকবিশেষ। হুতোমের আমলে যুবকরা বেশ্যাসক্ত ছিলেন, কিন্তু মদ্যপান করতেন না, গাঁজা, চরস বা আফিম খেতেন। ইংরেজি শিক্ষার ফলে পুরোনো নেশা চণ্ডু, গুলি, আফিম বা কালাচাঁদ, তড়িতানন্দ বা গাঁজা বিদায় নিল নতুন জাতে ওঠা অভিজাতদের কাছ থেকে। আগে নেশাখোর বোঝাতে ‘গুলিখোর’, ‘গাঁজাখোর’, ‘চণ্ডুখোর’, ‘আফিমখোর’, প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হত। ইংরেজিশিক্ষিতদের কল্যাণে জন্ম হল নতুন শব্দ ‘মদখোর’।

চণ্ডু তৈরি করতে দুখানা চকচকে মাজা সরা লাগত। মিঠে আঁচে সরা চড়িয়ে তাতে আফিম গলিয়ে নিতে হত। আফিম টলটলে হয়ে গেলে আর-একখানা মাজা সরায় ফরসা ন্যাকড়া দিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। সেই ছাঁকা তরলের সঙ্গে কচি পেয়ারাপাতা মিশিয়ে যখন বেশ ঘন কাই হয়ে যাবে, সেটিকে আবার ছেঁকে ছোটো ছোটো গুলি পাকাতে হবে অল্প গরম থাকতে থাকতে। এরপর সেটা চলে যেত আড্ডায়। আড্ডায় আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী চণ্ডুখোরদের সুবিধার তারতম্য হত। যারা কম পয়সার খাবে, তাদের বসার একটা পিঁড়ে আর ঠেস দেবার একটা পিঁড়ে। একটু বেশি পয়সা হলে ঠেস দিতে বালিশ। আরও বেশি হলে বসার জন্য তুলোভরা তোশক আর ঠেস দেবার জন্য বড়ো মাথার বালিশ। সবটাই তেলচিটচিটে।

চণ্ডু টানতে হত পাইপ দিয়ে। পাইপের একটা দিক লম্বা আর অন্যদিক তিনটে প্যাঁচ খেয়ে সোজা দাঁড়িয়ে আছে। এই মুখটা একটা ছোটো কলকের মতো। এখানে চণ্ডুর গুলি পুরে আগুন ধরিয়ে দিতে হবে। যিনি গুলি খাবেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে টান মেরেই ঘুরে পড়বেন। তখন আড্ডার লোকেরা চিনির জলে ভেজানো শোলার টুকরো তাঁর মুখে গুঁজে দেবেন। একটু বেশি পয়সা দিলে তিনি পাবেন বাতাসা, আর সবচেয়ে বেশি পয়সার খদ্দেররা পাবেন রসমুন্ডি। নেশা করে উঠে দাঁড়াতে দেড় দুই ঘণ্টা তো লাগতই। সঙ্গের ছবিতে ১৮৯২ সালে তোলা চণ্ডুখোরের আস্তানা।

৩.৩ দুটো কাঠি দিয়ে— চপস্টিক। চিনের এক উপকথা থেকে জানা যায়, গরম খাবার সহজে মুখে পুরে দেওয়ার জন্যই নাকি প্রাচীন এক ব্যক্তির মাথা থেকে এসেছিল এই চপস্টিকের ধারণা। উপকথা অনুযায়ী, একবার একজন লোকের নাকি খুব খিদে পেয়েছিল। অথচ, তাঁর জন্য রান্না করা মাংস ছিল বেজায় গরম। কাজেই, গরম পাত্র থেকে মাংস তুলে মুখে দেওয়ার জন্য তিনি বেছে নেন সরু দুটো কাঠি। তারপর সেই কাঠি দিয়ে মাংস তুলে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে খুব দ্রুত খাওয়া শেষ করেন তিনি। আর এ থেকেই এতদঞ্চলের লোকেদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে চপস্টিক।

আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টাব্দে এই চপস্টিকের ব্যবহার পরিচিত হয়ে ওঠে বৃহত্তর চিন থেকে শুরু করে মঙ্গোলিয়া এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। মজার বিষয় হলে, আমাদের কাছে কিংবা ইংরেজিতে যে বস্তুটি চপস্টিক নামে পরিচিত, জাপানে সেই চপস্টিককেই বলা হয় ‘হাসি’, যার অর্থ হল সাঁকো। চপস্টিক খাবার পেট আর মুখের মাঝে সাঁকোর মতো কাজ করে বলেই এমন নাম। অন্যদিকে চিনে এর প্রচলিত নাম হল ‘কু আই-জি’ বা চটপটে বন্ধু। চপস্টিকের মাধ্যমে খাওয়া দ্রুত শেষ করা যায় বলেই সম্ভবত এর এমন একটি নাম দিয়েছিল চিনারা। অন্যদিকে, নামের প্রকারভেদের মতো দেশে দেশে চপস্টিক দিয়ে খাবার গ্রহণকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা সংস্কারও। উদাহরণস্বরূপ, জাপানে চপস্টিক দিয়ে খাবার পাশের জনকে দেওয়া বারণ। কেন-না, দেশটিতে মৃতদেহের সৎকারের সময় চপস্টিক দিয়ে মৃতের অস্থি-ভস্ম আত্মীয়দের মাঝে দেওয়া হয়। অন্যদিকে, চিনে যেমন হোস্ট যতক্ষণ না তাঁর চপস্টিক ভাতের প্লেটে রাখছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অতিথিরা চপস্টিকে হাত দেন না। একইভাবে খাওয়া শেষে প্লেটের উপর পাশাপাশি চপস্টিক দুটি শুইয়ে দেওয়াও চিনা রীতি।

৩.৪ পাঁচ সিকা— ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বোধোদয় বইতে লিখছেন, “সকল দেশেই নানাবিধ মুদ্রা প্রচলিত আছে। আমাদের দেশে যে সকল মুদ্রা প্রচলিত, তন্মধ্যে পয়সা তাম্রনিৰ্ম্মিত; দুআনি, সিকি, আধুলি, টাকা রৌপ্যনিৰ্ম্মিত। আর, ঐরূপ সিকি, আধুলি, টাকা স্বর্ণনিৰ্ম্মিতও আছে। স্বর্ণনিৰ্ম্মিত টাকাকে স্বর্ণ ও মোহর বলে।

৪ পয়সায় ১ আনা ;

৮ পয়সায় ১ দুআনি ;

8 আনায় ১ সিকি;

৮ আনায় ১ আধুলি ;

১৬ আনায় ১ টাকা।

সিকি, পয়সা অপেক্ষা অনেক ছোট, কিন্তু এক সিকির মূল্য ১৬ পয়সা ; ইহার কারণ এই যে, রৌপ্য তাম্র অপেক্ষা দুষ্প্রাপ্য ; এজন্য রৌপ্যের মূল্য তাম্র অপেক্ষা এত অধিক। স্বর্ণ সৰ্ব্বাপেক্ষা দুষ্প্রাপ্য ; এজন্য স্বর্ণের মূল্য সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক। পূর্বে এক মোহরের মূল্য ১৬ টাকা অথবা ১০২৪ পয়সা ছিল ; কিন্তু এক্ষণে উহার মূল্য তদপেক্ষা অনেক অধিক হইয়াছে।”

৩.৫ কোকো— কোকো বা কোকোয়া দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন উপত্যকার উদ্ভিদ। যার বীজ থেকে চকোলেট তৈরি হয়। মধ্য আমেরিকার আরও কয়েকটি দেশে এর চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে ক্রমান্বয়ে। তারপর আফ্রিকার ঘানা, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট ও ক্যামেরুনে এর চাষ শুরু হয়। এরপর এশিয়ার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও নিউগিনিতে সূচনা হয় এর চাষ। দক্ষিণ ভারত ও উড়িষ্যা রাজ্যেও এর চাষ দেখা যায়। ১৮৯০ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৫০ সালের দিকে এর চাষের বেশি প্রসার ঘটে। বর্তমানে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি কোকোয়া উৎপাদিত হয় আইভরি কোস্ট, ব্রাজিল ও ঘানা থেকে।

আমাদের দেশেও অনেক ভেষজ বা শৌখিন বাগানে কোকোয়ার গাছ দেখা যায়। এই কোকোয়া ফলের বীজ থেকেই তৈরি হয় আমাদের অতি প্রিয় চকলেট। ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়, কোকোয়া ফল কলম্বাস ১৪৯৫ সালে মধ্য আমেরিকা থেকে ইউরোপে নিয়ে এসেছিলেন। তবে স্প্যানিশ জেনারেল কোরেটজ্ ১৫২০ সালের মাঝামাঝি এই স্বর্গীয় ফল স্পেনে আমদানি করেন। পরে ফরাসিরা এই গাছের সন্ধান পায়। ১৬৫৭ সালে এক ফরাসি নাগরিক লন্ডনে ‘চকোলেট হাউস’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চকোলেট জনপ্রিয় করে তোলেন। কোকোয়ার বৈজ্ঞানিক নাম Theobroma cacao। গ্রিক ভাষায় Theos মানে ভগবান আর broma মানে খাদ্য, অর্থাৎ ভগবানের খাদ্য।

এখানে কোকো মানে হট চকোলেট- এর কথা বলা হয়েছে। শক্ত চকোলেট, গলানো চকোলেট বা কোকো, উত্তপ্ত দুধ বা জল এবং চিনির সমন্বয়ে তৈরি এক ধরনের উত্তপ্ত পানীয়। গলানো চকোলেট দিয়ে তৈরি এই হট চকোলেটকে কখনও কখনও বেভারেজ চকোলেট বা পানীয় চকোলেটও বলা হয়।

৩.৬ ক্যান্টন, চাঙ্গুয়া— দুটি চিনা রেস্তোরাঁই প্রায় ১২৫ বছরের পুরোনো। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর উপরে অবস্থিত চাঙ্গুয়া কলকাতার প্রাচীনতম বার। সেই উত্তমকুমারের যুগের বাংলা সিনেমার ‘কেবিন’-কালচার বজায় রয়েছে এখনও। বাংলার দিকপাল কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের প্রিয় ঠেক ছিল চাংওয়া। শিবরাম চক্রবর্তী থেকে জহর রায়, সবার প্রিয় ছিল এই খাবার জায়গাটি। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, “একদিন দেশ পত্রিকার অফিসে একজন লেখক এসে জানালেন, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর ফুটপাথে শিবরামবাবু চিত হয়ে শুয়ে আছেন। সম্পাদক শ্রদ্ধেয় সাগরদা আমাকে ডেকে বললেন, ওর তো আজ লেখা দিতে আসার কথা। ফুটপাথে শুয়ে আছে কেন! দেখে এসো তো।আমি গিয়ে দেখি, ‘চাংওয়া’র সামনে তিনি আরামে শুয়ে আছেন। একটা হাত কপালে, আর একটা হাত সিল্কের পাঞ্জাবির পকেটে। একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি। ডান হাতটা পাঞ্জাবির পকেটে। পকেট থেকে তেলেভাজা বের করে মাঝে মাঝে মুখে দিচ্ছেন। এই বার আমি গিয়ে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলুম, এইখানে এইভাবে শুয়ে আছেন কেন! আমাকে নিচু হতে ইশারা করলেন। ফিসফিস করে বললেন, চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে কোঁচা জড়িয়ে পড়ে গেছি। একটা ধেড়ে মানুষের পড়ে যাওয়াটা লজ্জার, না শুয়ে থাকাটা লজ্জার! আমি বললুম, এর উত্তর দেবেন সাগরদা। আপনি এখন উঠুন। সিল্কের পাঞ্জাবির পিছনে ধুলো। মাথার পিছনে ধুলো। আমি ঝাড়ার চেষ্টা করতেই বললেন, তুমি কিছুই জানো না। একসময় কলকাতার বাবুরা ভোরবেলায় খানা থেকে উঠে প্রাসাদে প্রবেশ করত। পাঞ্জাবির পিছনে ধুলো এটা একটা অ্যারিস্টোক্রেসি।”

ক্যান্টন রেস্টুরেন্টটি অবশ্য এখন আর নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *