তৃতীয় দিন – সন্ধ্যা

সন্ধ্যা ৬টা 

ডুরেস্টিয়ে রোড। ভাটিগ অ্যান্ড শুইন্ডেল কোম্পানির হেডকোয়ার্টার নিচতলা দুইভাগে বিভক্ত। ডানপাশে লবি আর অফিসে যাওয়ার লিফট। বামে একটা ট্রাভেল এজেন্সি। এরকম পুরোনো ধাঁচের ভবনে লবিটা বেশ বড়সড় হয়। রিসেপশনের পাশেই কফি টেবিল দেখা যাচ্ছে। 

সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ক্যামিল। কল্পনা করছে রিসেপশনের একটা চেয়ারে বসে আছে অ্যানি, বারবার ঘড়ি দেখছে। অপেক্ষার প্রহর গুণছে, কখন ছাড়া পাবে আর ক্যামিলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। 

ক্যামিলের কাছে এলেই চাঙা হয়ে উঠতো সে। বরাবরের মত দেরি করার জন্য ক্ষমা চাইতো। সরি, আগে বের হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি—এরপরেই যে হাসিটা দিতো, তাতে যে কোনো পুরুষ বলতে বাধ্য হবে; ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার না। 

কল্পনার লাগাম টেনে ধরলো ক্যামিল। 

হুট করেই লিফটের পাশে কাউকে চোখে পড়লো তার। লোকটার হাতে একটা হেলমেট। সাথে সাথেই বুঝতে পারলো, যা ভেবেছিল তার চেয়েও ধূর্ত পরিকল্পনার শিকার সে। একটু এগুতেই ভেতরে ঢোকার আরেকটা রাস্তা দেখতে পেল। তার মানে কখনো যদি তার পরেও আসতো অ্যানি, তাহলে এদিক দিয়ে ঢুকে ক্যামিলকে স্বাগতম জানাতো। 

আর এদিকে, তাকে দেখেই খুশি হয়ে যেতো ক্যামিল। 

*** 

মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটা চেয়ারে বসলো ক্যামিল। কোনো খবর আসলে এক মুহূর্তও সে নষ্ট করতে চায় না। 

অফিসের লোকজন একে একে বাড়ি ফিরছে। কফিতে চুমুক দিলো ও। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত লোকজন সহকর্মীদের হাসিমুখে বিদায় জানাচ্ছে। হুট করে এক বালকের চেহারা তার নজরে পড়লো, মুখটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। চোখের সামনে একে একে অনেকগুলো ছবি ভেসে উঠলো। কিন্তু কারো সাথে মেলাতে পারলো না সে। 

তবে যার জন্য এখানে এসেছে, কিছুক্ষণ পর দেখা পেল তার। পরনে নেভি ব্লু কোর্ট। তার পিছু পিছু এগিয়ে গেল ক্যামিল। ক্যামিলের দিকে একইসাথে কৌতুহলী আর সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো সে। এমন দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে অবশ্য ক্যামিলের উচ্চতার বেশ বড় একটা ভূমিকা আছে। 

“একটু শুনবেন…” 

পেছনে ঘুরে, ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। সাথে সাথে তার উচ্চতা মেপে নিলো ক্যামিল। পাঁচ ফুট সাতের কাছাকাছি হবে। 

“আমি দুঃখিত,” বলল ক্যামিল। “আমাকে চিনবেন না আপনি…”

কিছু না বলে চুপ করে রইলো সে। 

“ম্যাডাম…সাহোই?” 

“না,” স্বস্তির হাসি দিলো সে, “আপনি বোধহয় ভুল করছেন…”

কিন্তু, সে নড়লো না। বুঝতে পারছে, কথাবার্তা এখানেই শেষ নয়।

“এর আগেও দুই একবার দেখা হয়েছিল আমাদের…” বলল ক্যামিল এরপর এগিয়ে যাওয়ার ইশারা করলো সে। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাবে। কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে মোবাইলটা বের করলো ক্যামিল। 

লুইসের মেসেজ, তার চোখে পড়েনি। মেসেজের সারমর্ম : ফিংগারপ্রিন্ট : এন.ও.এফ.” ।

এন.ও.এফ : নট অন ফাইল। তার মানে পুলিশের খাতায় নাম নেই অ্যানির। 

একের পর এক পথগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর এক কিংবা দেড় ঘণ্টা পর শেষ পথটাও বন্ধ হয়ে যাবে। এই পথটা যে এতো দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে, তা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি ক্যামিল। 

অপমানজনক এক বিদায় অপেক্ষা করছে তার জন্য। দীর্ঘ সময়ে অর্জন করা সুনাম এক নিমিষে নিঃশেষ হয়ে যাবে। 

এখনো দাঁড়িয়ে আছে ওই নারী। 

“একটা ছবি দেখাচ্ছি…” 

দ্রুততার সাথে মোবাইল ঘেটে, অ্যানির ছবিটা বের করলো ক্যামিল। 

“আপনি তো ছবির এই ভদ্রমহিলার সাথে কাজ করেন, তাই না?”

ছবিটা দেখেই মহিলার মুখটা কেমন জ্বলজ্বল করে উঠলো। 

“না, কিন্তু এই মহিলাকে চিনি আমি।” 

বাকিটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লো ক্যামিল। 

“একদিন রাস্তা পার হওয়ার সময় দেখা হয়েছিল। এরপর দেখা হলেই হাই, হ্যালো বলতাম। কিন্তু সেভাবে কখনো পরিচয় হয়ে উঠেনি।” 

“সাক্ষাৎ শয়তান,” এর সম্পর্কে এমনটাই বলেছিল অ্যানি। 

.

সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ 

অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘায়িত না করার সিদ্ধান্ত নিলো অ্যানি। যা হওয়ার হবে। হয় এসপার, নয় ওসপার। রাত বাড়ার সাথে সাথে ভয়টাও সমানতালে বাড়ছে। বনের অন্ধকার যেন আরো চেপে ধরছে তাকে। 

দুজন একসাথে থাকাকালীন সময়ে ক্যামিলের কিছু অস্বাভাবিক আচরণ তার নজর কেড়েছে; দুজনেই কুসংস্কারে প্রবলভাবে বিশ্বাস করে। আজ রাতের কথাই ধরা যাক। লাইট জ্বালালেই আরো ভয়াবহ কিছু হবে, এই ভয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারেই বসে আছে সে। 

কখন ফিরে আসবে ক্যামিল? আর আমার মুখে থুতু মারবে? নিজেকে প্রশ্ন করলো অ্যানি। 

আর তর সইছে না অ্যানির। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আর পৌঁছানো হলো না 

তার। এবার যেতে হবে। আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না এখানে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ট্যাক্সির জন্য ফোন করলো সে। 

*** 

দুদুশে মুখ গোমরা করে আছে। তবে মনমরা ভাব শীঘ্রই কাটিয়ে উঠবে। যখনি বুঝতে পারলো ক্যামিলের মন খারাপ, সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল। 

একবার গৃহকর্মী নেয়ার কথা ভেবেছিল ক্যামিল। যে প্রতিদিন এসে তার ঘরবাড়ি পরিস্কার করবে আর রান্নাবান্নার ব্যাপারটা দেখবে। কিন্তু তার বদলে একটা বিড়াল কিনে আনে ক্যামিল। দুদুশেকে বেশ আদর করে সে। একটা বাটিতে খাবার দিয়ে, দুদুশেকে বসিয়ে দিলো ক্যামিল। 

এরপর বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে পৌঁছে ধুলোবালিমাখা প্লাস্টিকের ব্যাগটা বের করলো। পরিস্কার করে শোবার ঘরে চলে এলো। তারপর ফাইলটা কফি টেবিলের দিকে ছুঁড়ে দিলো। 

ফাইলটা খুলে একটা খাম বের করলো সে। ওই খামের ভেতরেই ছবিগুলো রাখা আছে। 

প্রথম ছবিটা বেশ বড়, তবে মাত্রাতিরিক্ত আলোর কারণে ঝলসে গেছে। ছবিটায় নাড়িভুড়ি বের হওয়া একটা লাশ দেখা যাচ্ছে। রক্তবর্ণের একটা থলি থেকে পাঁজরের ভাঙা হাড় বেরিয়ে এসেছে; সম্ভবত পাকস্থলি হবে। আর কামড়ের দাগযুক্ত ছিন্নভিন্ন স্তন। দ্বিতীয় ছবিটায় দেখা যাচ্ছে এক নারীর কাটা মাথা দেয়ালে ঠুকে দেয়া … 

বিছানা ছেড়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেল ক্যামিল। এতো বীভৎস ছবি দেখার পর তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পেশাগত কারণে এমন বীভত্তা কম চোখে পড়েনি। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা। এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি। 

অনেক বছর পর ফাইলটা খুলেছে ক্যামিল। 

শুরুটা হয়েছিল ক্যুবেভুয়াতে দুই নারীর লাশ পাওয়ার মাধ্যমে। আইরিনের মৃত্যু দিয়ে যার সমাপ্তি ঘটে। টেবিলে ফিরে গেল ক্যামিল। ।

যত দ্রুত সম্ভব, ফাইলটা পড়ে ফেলতে হবে তার। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেলেই রেখে দেবে এই ফাইল। তবে এবার মন্টফর্টের স্টুডিওতে রাখবে না। শোবার ঘরে অনেকদিন পড়ে ছিল ফাইলটা। কত রাত সেখানে কাটিয়েছে ক্যামিল। কিন্তু ভুলেও একবার খুলে দেখার কথা ভাবেনি সে। 

আবারো, ছবিতে মনোযোগ দিলো ক্যামিল। এবারের ছবিটায় যে নারীকে দেখা যাচ্ছে, তার শরীরের নিম্নাংশ একদম ক্ষতবিক্ষত। বাম উরুর বেশ বড় একটা অংশ কেটে নেয়া হয়েছে, কালচে রক্তের দাগ স্পষ্ট। লাশের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে, প্রথমে দুই হাঁটু ভেঙে ফেলা হয়েছিল। পায়ের একটা আঙুলে রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে যত্ন করে আঙুলের ছাপ বসানো ছিল। 

এই লাশ দুটোর মাধ্যমেই, ফিলিপ বুসনের অসুস্থ মানসিকতার সাথে পরিচয় হয়েছিল ক্যামিলের। 

অনিবার্যভাবে, এই ধারাবাহিক খুনগুলোই পরবর্তীতে আইরিনের মৃত্যুর পথ ত্বরান্বিত করে। প্রথম লাশ দুটো দেখার সময় ঘুণাক্ষরেও এমন পরিণতির কথা চিন্তাও করেনি ক্যামিল। 

পরবর্তী ছবির নারী, ম্যারিসে পেরিন-যার কথা ভালোভাবেই মনে আছে ক্যামিলের। তাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল বুসন। 

পরের ছবিটা হাতে নিলো ক্যামিল। বিদেশী এক যুবতী নারীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। লাশের পরিচয় খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগে যায়। ব্ল্যানচেট কিংবা ব্ল্যানচার্ড নামের একজন লাশ খুঁজে পেয়েছিল। লোকটার চেহারা এখনো মনে আছে ক্যামিলের। ধূসর বর্ণের চুল, টকটকে লাল চোখ, একদম পাতলা ঠোঁট। মেয়েটার শরীরের অর্ধেকাংশ, কাঁদায় ডেবে ছিল। ওপরের ব্রিজে শত শত লোক দাঁড়িয়ে দেখছিল এই দৃশ্য-এর মাঝে বুসনও ছিল, নিজের শিল্পকর্ম দেখার লোভ সামলাতে পারেনি সে। হুট করেই আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজের কোট দিয়ে মেয়েটার নগ্ন শরীর ঢেকে দেয়। ছবিটা থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না ক্যামিল। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে টেনে ধরে রাখছে। দ্রুতবেগে মেয়েটার একটা স্কেচ এঁকে ফেলল। 

এবার থামো, নিজেই নিজেকে বলল ক্যামিল। যা খুঁজছো, সেদিকে মনোযোগ দাও। 

এলোমেলোভাবে একটা ছবি তুলে নিলো ক্যামিল। কিন্তু ভাগ্য বরাবরই মানুষকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। গেস হবসনের ছবি এলো তার হাতে। বিগত কয়েক বছরে এই কেস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করলেও, সবকিছুই দাঁড়ি কমা সহ মনে আছে তার। “গাছের পাতা দিয়ে ঢাকা ছিল তার শরীর… াড়ের সাথে খুব অদ্ভুত কোণে বেঁকে ছিল মাথাটা, যেন কোনো কিছু শোনার চেষ্টা করছিল সে…বাম গালে একটা জন্মদাগ, যা সবসময়ই অলক্ষুণে মনে হতো তার।” উইলিয়াম ম্যাকলাভ্যানির উপন্যাসের এক পরিচ্ছেদের অংশ এটা। যুবতীকে ধর্ষণের পর লাশ বিকৃত করা হয়েছিল। গায়ের সব জামাকাপড় থাকলেও শুধু একটা জিনিস পাওয়া যায়নি। 

এবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ক্যামিল। দুই হাতে ফাইলটা তুলে উল্টো করে রাখলো। এবার উল্টো দিক থেকে কাজ শুরু করবে। 

কোনোভাবেই আইরিনের ছবির মুখোমুখি হতে চায় না সে। কখনোই সেই সাহস তার হয়ে উঠেনি। ঘটনার দিন অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে, আইরিনের মৃতদেহ এক ঝলক দেখেছিল। এর বাইরে আর কিছুই মনে নেই তার। ওই দৃশ্য তাকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। এই ফাইলে আইরিনের অন্যান্য ছবিও আছে। ফরেনসিক টিমের তোলা আর অটোপসির সময়ের ছবি। কিন্তু কখনোই তা খুলে দেখেনি সে। কখনোই না। 

আর সেই ধারায় এবারও কোনো পরিবর্তন আনার ইচ্ছা নেই তার। 

একের পর এক খুন করে গেলেও কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেয়নি বুসন। মারাত্মক রকমের দক্ষ ছিল সে। কিন্তু আইরিনকে খুন করার সময়, নিজের তথাকথিত মাস্টারপিসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যের প্রয়োজন ছিল তার। যার কিছু পেয়েছে স্বয়ং ক্যামিলের কাছ থেকেই। আর বাকিটার জন্য ক্যামিলের কাছের লোকজনের দারস্ত হয়েছিল। 

স্বয়ং ক্রিমিনাল ব্রিগেডের কাছেই। 

বাস্তবতায় ফিরে এলো ক্যামিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই মোবাইল হাতে নিলো। 

“এখনো অফিসে তুমি?” 

“অবশ্যই…” 

“আমি কোনো অন্যায় সুবিধা নিতে চাই না লুইস।” 

“কী দরকার আপনার?” 

“ম্যালেভালের ফাইল।” 

“ম্যালেভাল… জন-ক্লদ ম্যালেভাল?” 

“এই নামের অন্য কাউকে চেনো তুমি?” 

কফি টেবিলের উপরে থাকা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে ক্যামিল। 

জেন ক্লদ ম্যালেভাল। আকৃতিতে বিশাল, তবে পেটানো শরীর। 

“ওর সম্পর্কে যা যা পাও, সব পাঠাবে আমাকে। আমার ব্যাক্তিগত ইমেইলে।” 

ম্যালেভালকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন তোলা হয়েছিল ছবিটা। চেহারায় কমনীয়তা আছে, বয়স পয়ত্রিশের কাছাকাছি, এর কমও হতে পারে। কারো বয়স আন্দাজে বরাবরই অপটু ক্যামিল। 

“এর সাথে ম্যালেভালের কী সম্পর্ক জানতে পারি?” বলল লুইস। 

আইরিনের মৃত্যুর পর বুসনকে তথ্য সরবরাহের অভিযোগে পুলিশের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় ম্যালেভালকে। তবে জেল খাটতে হয়নি তার। বুসন যে খুনি, এ ব্যাপারে জানতো না সে। তাই খুনের সহযোগী হিসেবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। আদালতের রায় এমনটাই ছিল। কিন্তু, তাতে তো আর সত্যিটা বদলে যায় না। বুসন আর ম্যালেভাল দুজনকেই খুন করার কথা ভেবেছিল ক্যামিল। কিন্তু, এখন পর্যন্ত তা হয়ে উঠেনি। 

সবকিছুর পেছনে নাটের গুরু ম্যালেভাল। এ ব্যাপারে নিশ্চিত ক্যামিল। জানুয়ারির ডাকাতি থেকে শুরু করে গ্যালারি মনিয়েরে হামলা, প্রতিটা ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে, এই সিদ্ধান্তে এসেছে হয়েছে সে। শুধু একটা বিষয়েই খটকা লেগে আছে। এর মাঝে অ্যানির ভূমিকা নিয়ে এখনো সন্দেহ আছে তার। 

“সবকিছু একত্রিত করতে কি বেশি সময় লাগবে তোমার?” 

“না, আধাঘণ্টার মতো। সবকিছুই ডাটাবেজে আছে।” 

“ঠিক আছে…মোবাইল সাথে রাখতে পারবে? যদি আরো কিছু প্রয়োজন হয়?” 

“অবশ্যই। কোনো সমস্যা নেই।” 

“আর ডিউটি রোস্টারও দেখে নিয়ো। অন্য কারো সাহায্য যদি লাগে।”

“আমার?” 

“তো? আর কার, লুইস?” 

এরমাঝে, চতুর্থ তলায় মিটিং রুমের অবস্থা কল্পনা করা খুব একটা কঠিন নয়। আর্মচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে লা গুয়েন। তার ডান পাশে কমিশনার মিচার্ড। একের পর ফাইলে স্বাক্ষর করে যাচ্ছে। যেন নিজের ব্যস্ততার প্রমাণ দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ… 

*** 

“এবার রাখতে হবে লুইস …” 

বাকিটা সময় দুদুশের সাথে সোফায় বসে কাটিয়ে দিলো ক্যামিল।

ফাইলটা আপাতত বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। 

মোবাইলে ম্যালেভালের একটা ছবি তুলে ফাইলটা বন্ধ করে ক্যামিল।

মন্টফোর্ট আর প্যারিস, আলাদা আলাদা জায়গায় আলাদা দুজন মানুষ, কিন্তু দুজনেই অপেক্ষার প্রহর গুণছে। 

ট্যাক্সি ডাকেনি অ্যানি। ওপাশ থেকে রিসিভ করার সাথে সাথে কল কেটে দেয় সে। 

ভেতরে ভেতরে অ্যানি ঠিকই জানতো, এই মুহূর্তে সে পালাবে না। আশার আলো এখনো টিমটিম করে জ্বলছে। হাত পা ছড়িয়ে, সোফায় শুয়ে আছে অ্যানি। একটু পর পরই মোবাইলটা চেক করছে। চার্জ আছে কি না, কোনো কল এলো কি না। 

*** 

পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে লা গুয়েন। কমিশনার মিচার্ডের দিকে তার চোখ পড়লো। এখন, ই-মেইল নিয়ে ব্যস্ত কমিশনার। 

ক্যামিলের আচরণে বেশ হতাশ লা গুয়েন। এই অনুভূতি অন্য কারো কাছে প্রকাশ করার মতো না। ছয় ছয়টা বিয়ে করে কী লাভ, যদি এমন অনুভূতি ভাগ করে নেয়ার মত কেউ না থাকে? 

কেউ আর ফোন দিয়ে ক্যামিলকে দেরি করার কারন জিজ্ঞেস করবে না। তাকে আর সাহায্য করার মত কেউ রইলো না। সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হলো। 

.

সন্ধ্যা ৭টা 

“ঈশ্বরের দোহাই লাগে, এসব বন্ধ করো!” 

ক্ষমা চেয়ে দৌড়ে গিয়ে লাইট বন্ধ করলো ফারনান্ড। মিনমিন করে আরো কিছু বলল, তবে ওইসবে পাত্তা দেই না আমি। 

ছোট একটা রুমে বসে আছি। একটু আগে এখানেই কার্ড খেলছিলাম। অন্ধকার বরাবরই পছন্দ আমার। এতে চিন্তা করতে বেশ সুবিধা হয়। 

কোনো কাজ না করে শুধু শুধু অপেক্ষা করতে মোটেও ভালো লাগে না আমার। সবসময় কিছু না কিছুর মাঝে থাকতে পারলে জীবনের আসল মজাটা পাওয়া যায়। অলস বসে থাকলে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই এমন স্বভাব আমার। বয়স বাড়ার সাথে সাথে, রাগের পরিমাণটাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। হয়তো আমার হাতে বেশি সময় নেই। 

*** 

হুট করে একটা শব্দে ক্যামিলের চিন্তায় ছেদ পড়লো। কম্পিউটারের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, নতুন মেইল এসেছে। 

লুইস পাঠিয়েছে। 

ম্যালেভালের ফাইল। 

চশমাটা চোখে দিয়েই বড় করে একটা শ্বাস নিলো ক্যামিল। 

জেন-ক্লদ ম্যালেভালের প্রশিক্ষণের রেকর্ড অসাধারণ। পুলিশ একাডেমির প্রশিক্ষণে বিশেষ নজর কাড়ে সে। কয়েক বছরের মাঝেই কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেনের নেতৃত্বাধীন ক্রিমিনাল ব্রিগেডে যোগদান করে। 

গুরুত্বপূর্ণ সব কেসে কাজ করার সুবাদে বেশ সুনাম কুড়ায়। 

তবে ক্যামিলের যা মনে আছে, তা এই ফাইলে নেই। নিরলসভাবে কাজ করা ম্যালেভাল সবসময়ই নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হতো। উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ার দরুণ কাজের ক্ষেত্রে শতভাগ উজাড় করে দিতো। একটা সময় তার মদ খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেল। নারীতে আসক্ত হয়ে পড়লো। এমন না যে সবাইকে ভালোবাসতো সে। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিছানায় নিয়ে যাওয়া। ম্যালেভাল পাকা খেলোয়াড়, একের পর এক নারীকে প্রলুব্ধ করেছে। একইসাথে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এ ব্যাপারে কিছু করার ছিল না ক্যামিলের; প্রথমত, এটা তার দায়িত্ব না, দ্বিতীয়ত, দুজনের মাঝে সম্পর্কটাও তেমন ছিল না। সারাজীবন নারীর পেছনে দৌড়েছে ম্যালেভাল। এমনকি কমবয়স্ক সাক্ষীদেরকেও বাদ দেয়নি। সারারাত না ঘুমিয়ে, টকটকে লাল চোখ নিয়ে অফিসে ঢুকতো সে। এমন অনিয়ন্ত্রিত জীবন নিয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল ক্যামিল। লুইসের কাছ থেকে ধার করা অর্থ কখনোই ফেরত দিতো না ম্যালেভাল। এরপরেই শুরু হলো আরেক কাহিনী। একটু বেশি পরিমাণেই মাদক চোরাচালানকারীদের পেছনে ছুটতে শুরু করলো সে। উদ্ধারকৃত মাদকের হিসাবেও কিছু কারচুপি করছিল। এক বেশ্যা, তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনলো। কেউ পাত্তা দেয়নি, তবে ক্যামিলের কানে ঠিকই পৌঁছেছিল। ওই রাতেই ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়ে, ব্যাপারটা নিয়ে ম্যালেভালের সাথে কথা বলেছিল ক্যামিল।

বেশিরভাগ অফিসার টুকটাক ভুল করলে, শোধরানোর সুযোগ দেয়া হয় তাদের। 

ম্যালেভালও সেই সুযোগ পেয়েছিল। বুসনকে সহযোগিতা ও তথ্য পাচারের কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেই বুসন, যার বিরুদ্ধে সাত সাতটা খুনের অভিযোগ প্রমাণিত। তবে কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে চেপে রাখতে সক্ষম হয়। বুসনের ঘটনা এতোটাই লোমহর্ষক আর বীভৎস যে এদিকে সাংবাদিকদের নজরই পড়েনি। এভাবেই চাপা পড়ে যায় ম্যালেভালের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা। 

আইরিনের মৃত্যুর পরপর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ক্যামিলকে। কয়েকমাস মানসিক হাসপাতালে কাটিয়েছে সে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জানালার পাশে বসে স্কেচ করেছে। কারো সাথে দেখা করেনি। সবাই ধরে নিয়েছিল, ক্রিমিনাল ব্রিগেডে আর ফিরবে না ক্যামিল ভেরহোভেন। 

আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয় ম্যালেভাল। তবে অনেকদিন রিমান্ডে থাকায়, সাথে সাথেই ছেড়ে দেয়া হয় তাকে। ব্যাপারটা জানে না ক্যামিল। তাকে বলার সাহসই পায়নি কেউ। যেদিন জানতে পেরেছে ক্যামিল, কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি সে, যেন প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়টাও পার হয়ে গিয়েছে। 

প্যারোলে মুক্তি পেয়ে একদম গায়েব হয়ে যায় ম্যালেভাল। এরপর হুট করে দুই এক জায়গায় দেখা যায় তাকে। লুইসের ফাইল থেকে এই তথ্য জানতে পারলো ক্যামিল 

এদিকে, পুলিশের চাকরির থেকে অব্যাহতির পর নতুন আরেক জীবন শুরু করে ম্যালেভাল। সরাসরি অপরাধ জগতে প্রবেশ করে সে। 

ফাইল ঘাটতে ঘাটতে পুরো ব্যাপারে একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয় ক্যামিলের। ম্যালেভালের প্রথম চার্জশিট : ছোটখাটো অপকর্ম। তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাওয়া যায়নি। কিন্তু জীবনে নতুন পথ যে বেছে নিয়েছে তা স্পষ্ট। তাকে তিনবার জেরা করা হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় ছেড়ে দেয়া হয়। গত গ্রীষ্মের কথা মনে পড়লো ক্যামিলের। 

এবার আরেকটা কেসে পাওয়া গেল ম্যালেভালের নাম। 

নাথান মনেস্টিয়ে। 

এবার প্যাঁচ খুলতে শুরু করেছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যামিল। মনেস্টিয়ে/ ফরেস্টিয়ে, খুব একটা পার্থক্য নেই। এটা বেশ পুরোনো কৌশল : মিথ্যার সাথে সত্য মিশিয়ে দেয়া। এখন ক্যামিলের খুঁজে দেখতে হবে, ভাইয়ের মত অ্যানির নামের শেষাংশও মনেস্টিয়ে কিনা। অ্যানি মনেস্টিয়ে? এমনটা হতেই পারে। 

পড়া চালিয়ে গেল ক্যামিল। বেশ অবাক হলো সে। সত্য মিথ্যার অবিমিশ্র এক মিশ্রণ : অ্যানির ভাই সত্যিকারেই নামকরা বিজ্ঞানী। 

ত্রিশ গ্রাম কোকেন রাখার দায়ে প্রথম ধরা খায় নাথান। শুরুতে সব অস্বীকার করে সে। কিন্তু হালকা ডলা খেতেই সব সত্য উগড়ে দেয়। সেখানে সরবরাহকারী হিসেবে উঠে আসে জেন-ক্লদ ম্যালেভালের নাম। পরক্ষণেই তা অস্বীকার করে সে। এই ধরনের অস্পষ্ট আর অসংলগ্ন কথাবার্তার কারণে জামিন পেয়ে যায়। ঠিক তার পরপরই, নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করে নাথান। আশ্চর্যজনকভাবে, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা থেকেও বিরত থাকে সে। যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য পেশিশক্তিই ম্যালেভালের একমাত্র ভরসা, তা সুস্পষ্ট। হিংস্রতার প্রতি ম্যালেভালের অমোঘ আকর্ষণ যেন সশস্ত্র ডাকাতির প্রতি তার ভালোবাসারই পূর্বাভাস দিচ্ছিল। 

বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই ক্যামিলের কাছে। তবে সে আন্দাজ করতে পারছে। ম্যালেভাল আর নাথান মনেস্টিয়ে একসাথে ব্যবসা করেছে। কিন্তু ম্যালেভালের কাছে কীভাবে দায়বদ্ধ হয়ে পড়লো নাথান? আর ম্যালেভালই বা কীভাবে ব্ল্যাকমেইল করেছে নাথানকে? 

ম্যালেভালের অতীত ঘাটতে গিয়ে আরো কয়েকজনের নাম বেরিয়ে এলো। এরমাঝে, কুখ্যাত কয়েকজনও আছে। যেমন, গিডো গার্নিয়েরি। এর কৃতকর্মের কথা ভালোমতোই জানে ক্যামিল। ঋণ আদায়ে সিদ্ধহস্ত গার্নিয়েরি। এক বছর আগে এক বাড়ির পাশ থেকে পাওয়া লাশের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল তাকে। ফরেনসিক ডাক্তারের ভাষ্যমতে, ভিক্টিমকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয়েছিল। বর্ণণাতীত কষ্টের মাধ্যমে তার জীবনাবসান হয়। নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে কোনো ছাড় দেয় না গার্নিয়েরি। নাথানকে কি গার্নিয়েরির ভয় দেখিয়েছিল ম্যালেভাল? 

এতে অবশ্য ক্যামিলের কিছু যায় আসে না। নাথানের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই তার। 

এর সাথে কোনো না কোনোভাবেজড়িত অ্যানি। এটাই এখন ভাবার বিষয়। 

ম্যালেভালের কাছে যে ব্যাপারেই দায়বদ্ধ থাকুক নাথান, তা শোধ করতে হচ্ছে অ্যানির। 

সবসময় ভাইকে আগলে রেখেছে অ্যানি। 

*** 

মাঝে মাঝে দরকারী কিছু জিনিস হুট করেই যেন উদয় হয়। 

“মঁসিয়ে বার্জিও?” 

ওপাশ থেকে এক নারীর কণ্ঠ শোনা গেল। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি।

“আপনি ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন,” জবাব দিলো ক্যামিল 

“সত্যি?”

ওপাশে থাকা নারী বেশ অবাক হলো। পত্রিকার একটা লেখা বেশ জোরে জোরে পড়লো সে। 

“এখানে তো তাই লেখা আছে, ‘মঁসিয়ে এরিক বার্জিও। ১৫, স্কুদিয়ে সড়ক, গ্যাগনি’।” 

“যেমনটা বললাম, আপনি ভুল নাম্বারে ফোন করেছেন।” 

“ওহ…আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” 

মিনমিন করে কিছু একটা বলল সে। 

শেষমেশ ঘটনা ঘটেই গেল। ক্যামিলের কাজ করে দিয়েছে বুসন। এবার সময় সুযোগ বুঝে চাইলেই বুসনকে মেরে ফেলতে পারে ক্যামিল । 

কিন্তু এখন অন্যদিকে মনোযোগ দিতে হবে। আপাতত এই তথ্য ক্যামিলের জন্য নতুন এক দরজা খুলে দিয়েছে। নিজের নাম বদলে ফেলেছে হ্যাফনার। এখন সে, মঁসিয়ে বার্জিও। সাবেক জালিয়াতের জন্য নামটা মন্দ না। 

প্রতিটা সিদ্ধান্তের পেছনে আরেকটা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অপেক্ষায় তৈরি থাকে। মোবাইলের দিকে চোখ ফেরালো ক্যামিল। 

চাইলে এখন কমিশনার মিচার্ড আর লা গুয়েনের মিটিঙয়ে ছুটে গিয়ে সে বলতে পারে : এই হলো হ্যাফনারের ঠিকানা যদি এখানেই থাকে, তাহলে সকালের মাঝেই গ্রেফতার করা সম্ভব। পুরো ব্যাপারটা খুলে বলছি। ক্যামিলকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল লা গুয়েন। তবে সতর্কতা বজায় রাখলো যেন কমিশনারের মিচার্ডের চোখে না পড়ে। এরপর ক্যামিলের তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো, যেন বলতে চাইছে-অসাধারণ কাজ করেছো, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম—এরপর ধীরে সুস্থে বলল : “এতে তো পুরো ব্যাপারটা খোলাসা হলো না, ক্যামিল, আমি দুঃখিত।”

কিন্তু মনে থেকে এই কথা বলেনি সে। আর উপস্থিত মানুষজন এতোটাও বোকা না। প্রতারিত বোধ করলো কমিশনার মিচার্ড। কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেনকে তুলোধোনা করার যে খায়েশ নিয়ে এসেছিল তা মাঠে মারা গেল। এবার তার মুখ খোলার সময় এসেছে। গুছিয়ে কথা বলায়, তার সুখ্যাতি আছে। “তুমি যাই বলো না কেনো, কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন, তোমাকে আগেই সতর্ক করে দিচ্ছি, আমি কিন্তু হাত পা গুটিয়ে থাকবো না…যত যাই হোক।” 

হাত জোড় করলো ক্যামিল। কোনো সমস্যা নেই। পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল সে। 

একদম শুরু থেকে। কিছুই বাদ দিলো না। 

গ্যালারি মনিয়েরের ভিক্টিমের সাথে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে, তা স্বীকার করলো। এরপরেই তার দিকে ছুটে এলো একঝাঁক প্রশ্নবাণ : এই নারীকে কীভাবে চেনো তুমি? তার সাথে কী সম্পর্ক? ডাকাতির সাথে এই নারীও কি জড়িত? ঘটনার সাথে সাথে তুমি কেন …? 

বাকিটা আন্দাজ করাই যায়। হ্যাফনার ওরফে মঁসিয়ে বার্জিওকে তুলে আনাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ভেরহোভেনের পুরো ঘটনা শুনতে যেয়ে রাত পার করা যাবে না। এর জন্য পরেও সময় পাওয়া যাবে। আপাতত মিচার্ডও এই ব্যাপারে সম্মতি জানালো। তার ভাষ্যমতে এখন বাস্তবতা নিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু, কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেনকে অফিসেই থাকতে হবে, এমনটা জানালো কমিশনার। 

এর সাথে আর জড়ানো হবে না ক্যামিলকে। আপাতত দর্শক হিসেবেই থাকতে হবে তার। এমনিতেই অনেক কাণ্ড ঘটিয়েছে সে। লা গুয়েন আর মিচার্ড ফিরে এসে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। 

এর বাইরে আর কিছুই করতে পারবে না সে। কিন্তু ক্যামিল বেশ ভালোমতোই জানে, ঘটনাপ্রবাহ মোটেও এমন হবে না। 

ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে, যদিও সময়ের ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত না। 

এর সাথে জড়িয়ে আছে অ্যানি, তার জীবন। অন্য কেউ তার কাজ করতে পারবে না। 

ভাগ্যের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকর্তা আমরা নিজেরাই। 

.

সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ 

রাস্তার এক পাশে গাড়ি রাখলো ক্যামিল। এক কোণায় ছোট একটা দোকান। আশেপাশে আর কিছুই নেই ।

ঠিক ৭টা ৩৫ মিনিটে ইঞ্জিন বন্ধ করে ক্যামিল। দোকানের মালিক স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে তার দিকে হাত নাড়ে। ক্যামিলও তাতে সাড়া দেয়। স্কুদিয়ে সড়কের পাশ দিয়ে এগিয়ে যায় সে। পাশাপাশি অনেকগুলো বাড়ি। সবগুলো দেখতে একইরকম। দুই একটা বাড়ি থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। কয়েকটা কুকুর ডাস্টবিনের ময়লা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। 

১৫ নাম্বার বাড়ির সামনে আসতেই দোতলার লাইট বন্ধ হয়ে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপলো ক্যামিল। দরজাটা হালকা খুলতেই এক নারীকে দেখা গেল। স্বল্প আলোর কারণে তার চেহারা একদমই বোঝা যাচ্ছে না। তবে কণ্ঠ শুনে কম বয়সিই মনে হলো ক্যামিলের। 

“আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি?” 

যেন এই তরুণী কিছুই জানে না, যেন বারবার যে লাইট জ্বলছে আর নিভছে, তা খেয়ালই করেনি ক্যামিল। কখনো সুযোগ পেলে, তাকে বলতো, মিথ্যা বলায় তুমি একেবারেই কাঁচা। বেশিদূর এগুতে পারবে না। পেছনে থাকা কারো দিকে ঘুরলো তরুণী। এরপর হুট করেই যেন গায়েব হয়ে গেল সে। একটু পরে ফিরে এলো। 

“এক্ষুণি আসছি আমি।” 

সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো সে। বয়স কম হলেও, বয়স্ক মহিলার মত ভুড়ি বানিয়েছে। মুখটাও বেশ ফোলা। দরজা খুলে দিলো সে। “ওই বেশ্যা তো উনিশ বছরের মাঝেই নিজের রূপ আর শরীর দিয়ে পুরো শহর কব্জা করে ফেলেছে,” এই তরুণী সম্পর্কে এমনটাই বলেছিল বুসন। তবে এই তরুণীর ধূর্ততা ক্যামিলের মনে ধরেছে। চলাচলের ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে, জীবন গেলেও মাথা নত করবে না সে। যে কোনো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে। মুহূর্তেই মাঝে প্রতিপক্ষের বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে এক সেকেন্ডও দ্বিধায় ভুগবে না এই তরুণী। 

কোনো কথা না বলে এগিয়ে গেল সে। প্রতিটা পদক্ষেপ তার দৃঢ়তার সাক্ষ্য বহন করছে। তার পিছু পিছু এগিয়ে চলল ক্যামিল। হলওয়ে প্রায় খালি বললেই চলে। শুধু কোট রাখার জন্য একটা র‍্যাক দেখা যাচ্ছে দেয়ালে। ডান দিয়ে শোবার ঘর। সেখানে রোগাটে এক লোক বসে আছে। তার চোখ যেন কোটরে বসে গেছে। ঘরের ভেতরেই মাথায় একটা টুপি দিয়ে রেখেছে, তাতে গোলাকার মাথাটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে তার। সাথে সাথে লোকটার সাথে আরম্যান্ডের অদ্ভুত মিলের ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো ক্যামিল। 

ক্যামিলের পেছনে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে তরুণী। দেখে বোঝা যাচ্ছে, লম্বা সময় অপেক্ষা করার অভ্যাস নেই তার। ‘মারধোর করেই নিচে পাঠিয়েছে এই মেয়েকে, এছাড়া নিচে নামার আর কোনো কারণে দেখি না…. 

হুট করে হ্যাফনারের সামনে উপস্থিত হলো ক্যামিল।। সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে হ্যাফনার। 

“এবার যে একটু বসতে হয়, কম্যান্ড্যান্ট…” নিচু স্বরে বলল হ্যাফনার। 

আরো কয়েক কদম এগিয়ে গেল ক্যামিল। তবে এক মুহূর্তের জন্যেও হ্যাফনারের দিক থেকে চোখ ফেরালো না। পুলিশের রিপোর্টে হ্যাফনারের যে বর্ণনা পড়েছিল, বাস্তবে তার কিছুই দেখতে পেল না ক্যামিল। এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু না। ক্ষণিকের হিংস্রতা বাদ দিলে বেশিরভাগ অপরাধীই আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই থাকে। খুনিরাও দেখতে একদম আপনার আর আমার মতই হয়। 

ঘরের দিকে আরেক কদম এগিয়ে গেল ক্যামিল। ঘর জুড়ে নীলাভ বর্ণের মৃদু আলো। এক পাশের দেয়ালে বড় একটা এলসিডি টিভি, চাদরে ঢাকা একটা সোফা, আর অয়েলক্লথে মোড়ানো একটা টেবিল ছাড়া আর কিছু নেই ঘরে। এই অবস্থা দেখে সংঘবদ্ধ অপরাধীদের খুব একটা রুচিশীল বলা সম্ভব নয়। 

হুট করেই গায়েব হয়ে গেল তরুণী; রুম থেকে কখন বেরিয়েছে, তা খেয়াল করেনি ক্যামিল। হয়তো শটগান হাতে সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করছে, মনে মনে কল্পনা করলো ক্যামিল। চেয়ার থেকে একটুও নড়লো না হ্যাফনার। কোন দিকের পানি কোন দিকে গড়ায়, সেই অপেক্ষায় আছে সে। হুট করেই ক্যামিলের মনে হলো, লোকটার হাতে কোনো অস্ত্র নেই তো! ব্যাপারটা আগে মাথায় আসেনি ক্যামিলের। এখন আর এই নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। তবুও সতর্কতা বজায় রেখে এগিয়ে গেল সে। কখন কী হয়ে যায়, তা তো আর বলা যায় না। 

পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে ম্যালেভালের ছবি বের করলো সে। এরপর মোবাইলটা হ্যাফনারের দিকে বাড়িয়ে দিলো। হালকা কাশি দিলো হ্যাফনার বুঝতে পেরেছি। সোফার দিকে ইশারা করলো সে। সোফায় না বসে একটা চেয়ার টেনে নিলো ক্যামিল। হ্যাটটা টেবিলের উপর রাখলো। দুজন মুখোমুখি বসে আছে, যেন একটু পরেই খাবার পরিবেশন হবে। 

“আমি যে আসবো, এ ব্যাপারে কেউ জানিয়েছে তোকে… 

“এক অর্থে তাই…” 

বুসন যার কাছ থেকে ঠিকানা আদায় করেছে, সেই লোকই হয়তো নিজের জীবনের স্বার্থে হ্যাফনারকেও জানিয়ে দিয়েছে। এতে অবশ্য কিছুই যায় আসে না। 

“পুরোটা কি শুরু থেকে বলতে হবে?” বলল ক্যামিল। 

বাড়ির অন্য পাশ থেকে, উঁচু স্বরের চিৎকার শোনা গেল। এরপর দ্রুত বেগে ছোটাছুটির শব্দ। ক্যামিল দ্বিধায় পড়ে গেল। ব্যাপারটা কি ক্রমশই জটিলতার দিয়ে মোড় নিচ্ছে, না কি আরো সহজতর হচ্ছে। 

“বয়স কত?” 

“ছয় মাস।” 

“ছেলে?”

“না, মেয়ে।” 

অন্য কেউ হলে হয়তো মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করতো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির সাথে তা মোটেও খাপ খায় না। 

“তো, গত জানুয়ারিতে তোর স্ত্রী ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল।”

“সাত।” 

“তাহলে তো পালানোর সময় বেশ অসুবিধা হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় জানার ছিল, তোর কেমো কোথায় চলছিল?” 

এক মুহূর্তের জন্য বিরতি নিলো হ্যাফনার। “বেলজিয়ামে, কিন্তু তারপর চিকিৎসা বন্ধ করে দেই।” 

“খরচ বেশি?” 

“না, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।” 

“আবার খরচও বেশি। 

তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিলো হ্যাফনার। 

“তো, জানুয়ারিতে ফিরে যাই,” কথা চালিয়ে গেল ক্যামিল, “তোর হাতে বেশি সময় ছিল না। এদিকে পরিবারের জন্যে একটা ব্যবস্থা করা দরকার। আর তাই বড় দান মারার পরিকল্পনা করলি। এক দিনে চার চারটা সশস্ত্র ডাকাতি। পুরোই লালে লাল অবস্থা। পুরোনো সহযোগির কারো কোনো খবর ছিল না-হয়তো ওদেরও বিশ্বাস করতে পারছিলি না-তাই রাভিচ আর ম্যালেভালকে ভাড়া করলি। ম্যালেভালকে দিয়ে যে ডাকাতিও সম্ভব, এমনটা আমার কখনোই মনে হয়নি।” 

কথাগুলো হজম করার জন্য সময় নিলো হ্যাফনার। 

“যখন ম্যালেভালকে ছুড়ে ফেলে দিলি, এরপর নতুন রাস্তা বের করার জন্য অনেক ফন্দিফিকির করেছে সে,” এই বলে দম নিলো ক্যামিল, “একসময় তো কোকেনের ব্যবসাই শুরু করলো।” 

“আমিও শুনেছি…” 

“কিন্তু, সশস্ত্র ডাকাতিকে যেন ভালোবেসে ফেলল।” 

ক্যামিলের কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলো হ্যাফনার। উপর থেকে কান্নাকাটির শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। হয়তো বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেছে। 

“জানুয়ারিতে,” বলল ক্যামিল, “সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক চলছিল-শুধু হত্যাকাণ্ডটা বাদে। (এই কথার পর হ্যাফনারের কাছ থেকে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া আশা করার মত বোকা না ক্যামিল।) সবাইকে ঘোল খাইয়ে, সব অর্থ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তোর। একদম পুরোটাই। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার মত কিছু নেই। যে কোনো দায়িত্ববান পুরুষই তার পরিবারের যেন কষ্টে না থাকে, সেই ব্যবস্থা করতে চায়। ডাকাতি চারটা থেকে যা অর্জন করলি তাতে তো বাকি জীবন ঠিকঠাক মতো চলার কথা। তবে একটা প্রশ্ন। যদিও আমি কোনো আইনজীবী না, ট্যাক্স দিয়েছিলি?” 

চোখের পাতাও ফেলল না হ্যাফনার। কোনো কিছুই তার পরিকল্পনা থেকে তাকে দমাতে পারবে না। 

“আমি বুঝতে পারছি হাত পা বাঁধা ছিল তোর। যে কোনো আদর্শ পিতাই সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য যে কোনো কিছুই করতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যে কারণেই হোক, তোর সহযোগিদের কাছে ব্যাপারটা এমন ছিল না। এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। পুরো পরিকল্পনাই সাজানো ছিল তোর। হয়তো তোকে খোঁজার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু ওদের দৌড় কদ্দুর, তা ভালোমতোই জানা ছিল তোর। পুরোনো জীবনের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন এক জীবন শুরু করেছিস। অন্য কোনো দেশে পালিয়ে যাসনি, এতে কিছুটা অবাক হয়েছি আমি।” 

শুরুতে কিছুই বলল না হ্যাফনার। কিন্তু, মুহূর্তের মাঝেই বুঝতে পারলো, ভবিষ্যতে ক্যামিলের সাহায্য লাগতে পারে তার। তাই মুখ খুলল সে। 

“ওর জন্য থেকে গেলাম…” বিড়বিড় করে বলল সে। 

স্ত্রী না কি বাচ্চার কথা বলল হ্যাফনার, তা বুঝতে পারলো না ক্যামিল। 

বাইরের দিকে তাকালো ক্যামিল। রাস্তার বাতিগুলো হুট করে নিভে গেছে। হয়তো কারেন্ট চলে গিয়েছে। এদিকে বাচ্চাটা আবারো কান্না শুরু করলো। আবারো দ্রুত পদক্ষেপের শব্দ। এরপরেই কান্না থেমে গেল। বদ্ধ ঘরে বসে থাকতে খুব একটা ভালো লাগছে না ক্যামিলের। কিন্তু এছাড়া আর উপায় কী। হুট করেই অ্যানির কথা মনে পড়লো তার। 

“রাভিচ…” ক্যামিলের গলার স্বর অনেকটা নেমে গেছে। নামটা উচ্চারণের সাথে সাথে বুঝতে পারলো সে। 

“ব্যক্তিগতভাবে রাভিচকে চিনি না আমি। কিন্তু আন্দাজ করতে পারছি, প্রতারণাকে খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি সে। বিশেষ করে ডাকাতির সাথে হত্যার অভিযোগ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল ও। আমি জানি, ভালোমতোই জানি, দোষটা আসলে ওর নিজেরই। রাগটা ধরে রাখা উচিত ছিল। তবুও, নিজের ভাগটা তো পায়নি। সব নিয়ে পালিয়েছিলি তুই। রাভিচের কী হয়েছিল, জানিস কিছু?” 

চোখ মুখ শক্ত করে ফেলল হ্যাফনার। 

“মারা গেছে রাভিচ। ওর গার্লফ্রেন্ড কিংবা যেই হোক হালকার উপর দিয়ে গেছে। মাথায় একটা গুলিতেই ভবলীলা সাঙ্গ। কিন্তু মৃত্যুর আগে নিজের আঙুল বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছে রাভিচ। হান্টিং নাইফ দিয়ে কাজটা সেরেছে। আমার মনে হয় এমন হিংস্রতা খুব বেশি মানুষের পক্ষে দেখানো সম্ভব না। আমি জানি রাভিচ সার্বিয়ান ছিল। কিন্তু ফ্রান্স বরাবরই উদ্বাস্তুদের দুই হাতে বরণ করে নিয়েছে। আর, বিদেশীদের আঙুল কেটে ফেলা আমাদের পর্যটন শিল্পের জন্যেই হুমকি, তাই না?” 

“তোমার মতো বিরক্তিকর মানুষ আমি খুব কম দেখেছি, ভেরহোভেন।”

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ক্যামিল। হ্যাফনারের মৌনব্রত ভাঙতে না পারলে কোনো তথ্যই জানতে পারবে না। 

“একদম ঠিক,” বলল সে। “এখন তর্ক বিতর্কের সময় নয়। পর্যটন এক জিনিস, আর সশস্ত্র ডাকাতি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। কিন্তু…ঠিক আছে, তাহলে ম্যালেভালকে নিয়ে কথা বলা যাক। একটা সময় ছিল, যখন খুব ভালোমতোই চিনতাম ম্যালেভালকে, এসবে জড়ানোর আগে।” 

“তোমার জায়গায় আমি হলে এই জারজটাকে অনেক আগেই খুন করে ফেলতাম।” 

“এই কাজে তো তুই বেশ পারদর্শী, তাই না?” ম্যালেভাল যতোটা হিংস্র, ঠিক ততোটাই ধূর্ত। তোর প্রতারণাকে মোটেও ভালোভাবে নেয়নি ও। এর জন্য তোকে খুঁজে বের করতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে…” 

মাথা নাড়লো হ্যাফনার। নিজস্ব ইনফর্মার আছে তার। তাই ম্যালেভালের ব্যাপারে প্রতিনিয়ত খোঁজ খবর রাখতে পারছে। 

“কিন্তু নিজের পরিচয় বদলে ফেললি। নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিলি। যারা তোকে এখনো সম্মান করে কিংবা ভয় করে, ওদেরও সাহায্য পেয়েছিস। এজন্যেই আকাশ পাতাল তন্নতন্ন করে ফেললেও তোর খোঁজ পায়নি ম্যালেভাল। একসময় ধরেই নেয়, তোকে আর খুঁজে পাবে না। কিন্তু তার পরপরই দারুণ এক বুদ্ধি বের করে ফেলে…” 

কৌতুহলী চোখে ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে রইলো হ্যাফনার। বাকিটা শোনার অপেক্ষায় আছে। 

“পুলিশকে দিয়ে তোকে খুঁজে বের করার বুদ্ধি।” হাতদুটো দুইদিকে প্রসারিত করে ক্যামিল। “তোর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বান্দার কাঁধে দায়িত্ব সঁপে দেয়। ম্যালেভালের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়, আমার দক্ষতা তো প্রশ্নাতীত। চাইলে তোর মতো যে কাউকে চব্বিশ ঘণ্টার মাঝেই খুঁজে বের করতে পারি। আর কোনো পুরুষকে জাগিয়ে তুলতে নারীর চেয়ে ভালো অস্ত্র আর কী হতে পারে? আর সেই নারী যদি ভালোবাসার মানুষ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার কোনো সুযোগই নেই।” 

এবারও সায় জানালো হ্যাফনার। যদিও সে বুঝতে পারছে, তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। হয়তো খুব দ্রুতই নিজের জীবনের জন্য লড়তে হবে তার। তবুও ম্যালেভালের ধূর্ততা আর কূটকৌশনের প্রশংসা না করে পারলো না। 

“আমি যাতে তোকে খুঁজে বের করতে উদ্যত হই, এজন্য সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা সাজিয়েছে ম্যালেভাল। আর কাজও করেছে একদম তোর মতোই : একটা জুয়েলার্স, কাটা শটগান আর পেশি শক্তির ব্যবহার। তাই, গ্যালারি মনিয়েরের কাজটা যে তোর, একথা ক্রিমিনাল ব্রিগেডের সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছিল। এদিকে, আমিও ভড়কে গিয়েছিলাম। অবশ্য, তাই হওয়ার কথা কেন না যে নারীকে আমি জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি, তাকে একদম আধমরা করা হলো। আর এই সবকিছুর পেছনে একটাই উদ্দেশ্য। আমি যেন উঠেপড়ে লাগি। এই কেস যাতে আমার হাতেই আসে। এজন্য যা করা লাগে, করেছি। আর দেখতে যতোটা বোকা মনে হয়, ততোটাও বোকা নই আমি। আমার সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হয় যখন ঘটনার একমাত্র সাক্ষী, ছবি দেখে তোকে আর রাভিচকে চিহ্নিত করে। ততোক্ষণে আমরা নিশ্চিত, গ্যালারি মনিয়েরের কাজটা তোরাই করেছিস। সন্দেহের আর কোনো অবকাশ ছিল না।” 

এতো নিখুঁত পরিকল্পনায় বেশ অভিভূত মনে হলো হ্যাফনারকে। সাথে এটাও বুঝতে পারছে, ম্যালেভালের সাথে ভয়ংকর শত্রুতা বাঁধিয়ে ফেলেছে। 

“আর তাই ম্যালেভালের পক্ষে তোর পিছু নেই আমি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, একসময় ওর ব্যক্তিগত গোয়েন্দা বনে যাই। এরপরে, আরো দুই একবার সাক্ষীকে হত্যার চেষ্টা করে ম্যালেভাল। এতে করে আমার উপর চাপ বেড়ে যায়। দ্বিগুণ উদ্যমে কাজ শুরু করি। যত যাই হোক, এটা স্বীকার করতেই হবে, একদম সঠিক পথটাই বেছে নিয়েছিল ম্যালেভাল। আর তোকে খুঁজে বের করতে গিয়ে, আমারও বলিদান দিতে হয়েছে নিজের…” 

“কিসের বলিদান?” জানতে চাইলো হ্যাফনার। 

হ্যাফনারের দিকে তাকালো ক্যামিল। বলিদানের কথা, ভাষায় প্রকাশ করবে কীভাবে? চিন্তা করার জন্য, এক মুহূর্ত সময় নিলো সে-বুসন, আইরিন, ম্যালেভাল-এরপর চিন্তা করা বাদ দিলো। 

“আমার…” নিজেকে নিজে বলল ক্যামিল, “কারো সাথে পুরোনো শত্রুতা নেই।” 

“তা তো হতে পারে না। সবারই তো…” 

“হুম, ঠিক। আমার সাথে পুরোনো এক শত্রুতা আছে ম্যালেভালের। বুসনকে সাহায্য করার কারণে ওর চাকরি যায়। এরপর গ্রেফতার, অপমান, তাড়িয়ে দেয়া সহ আরো কত কী হলো। প্রায় সব পত্রিকা ওর কুকর্মের কথা ছেপেছিল। জেলেও কাটিয়েছে কিছুদিন, তবে খুব বেশি সময় না। তবুও, একজন পুলিশ অফিসারের জেলের জীবন কেমন হতে পারে, তা তো বোঝাই যায়। তাই প্রতিশোধ নেয়ার এটাই মোক্ষম সুযোগ। এক ঢিলে দুই পাখি মারা। তোকে যাতে খুঁজে বের করি, আর তা করতে গিয়ে আমার চাকরিটাও যেন যায়।” 

“কাজটা তুমি স্বেচ্ছায় করেছো।” 

“হতে পারে…কিন্তু, ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা কঠিন।” 

“তাতে, আমার কিচ্ছু যায় আসে না।”

“আচ্ছা, এটাইতো তোর ভুল ধারণা। কেন না, তোকে যেহেতু পেয়েই গেছি, ম্যালেভালও দেখা করতে চলে আসবে। আর, এবার শুধু নিজের ভাগেরটা চাইবে না। পুরোটাই দাবি করবে।” 

“আমার কাছে কিছুই নেই।” 

“ঠিক আছে। এটা বলে দেখতে পারিস। মানে, বলতে চাইছি, একটু ঝুঁকি না হলে কী আর খেলা জমে…যদ্দুর মনে হয়, রাভিচও একই কথা বলেছিল : কিছুই নেই আমার কাছে, সব খরচ করে ফেলেছি, অল্প কিছু থাকতেও পারে, তবে খুব বেশি না…” এই বলে চওড়া এক হাসি দিলো ক্যামিল। “যাই হোক, কাজের কথায় আসি। পরিবারের জন্য, কিছু তো অবশ্যই আলাদা করে রেখেছিস। তা এখনো থাকার কথা। একবার তোর খোঁজ পেলে, তোর সঞ্চয় খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগবে না ম্যালেভালের। তথ্য বের করার জন্য ম্যালেভাল কী পদ্ধতি ব্যবহার করে, আশা করি তা জানা আছে তোর।” 

জানালার দিকে তাকিয়ে আছে হ্যাফনার। যেন ম্যালেভালের অপেক্ষায়, প্রহর গুণছে সে। কোনো জবাব দিলো না হ্যাফনার। 

“তোর সাথে দেখা করতে আসবেই ম্যালেভাল। তবে তা নির্ভর করে আমার উপর। আমার কাজ শুধু ঠিকানাটা দেয়া। বাকিটা ম্যালেভালই বুঝে নেবে। এরপর মসবার্গ হাতে তোর দরজায় পৌঁছাতে এক ঘণ্টার বেশি লাগার কথা না।” 

এখনো হ্যাফনারের মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। 

“আমি জানি, তুই কী চিন্তা করছিস। তুই ভাবছিস, ম্যালেভাস তোর দরজায় পৌঁছানোর আগেই খুঁজে বের করবি ওকে। মানলাম, কিন্তু তোর অবস্থা তো খুব একটা সুবিধার না। এদিকে ম্যালেভালের বয়স তোর চেয়ে বিশ বছর কম। তার ক্ষীপ্রতা আর ধূর্ততার সাথে পেরে উঠবি বলে মনে হয় না। এমনিতেই ওকে ছোট করে দেখার মত ভুল করেছিস একবার। হয়তো, এরপরে একটা সুযোগ আসলেও আসতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে কোনো ভুল না করার পরামর্শ থাকবে। কেন না ভুল করলে পস্তাতে হবেই। তোকে খুন করার পর তোর স্ত্রীর কপালের মাঝে একটা বুলেট ঠুকে দেবে। এরপর হান্টিং নাইফ হাতে তোর বাচ্চাকে নিয়ে….” 

“এইসব গাঁজাখুরি কথা বাদ দাও ভেরহোভেন। ওর মতো অনেক ম্যালেভালকে দেখা আছে আমার।”

“ওসব সুদূর অতীত, হ্যাফনার। এসব ভেবে লাভ নেই। চাইলে তোর পরিবারকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারিস। যদি আমি সময় দেই-কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই। যদি তোর মতো কাউকে খুঁজে বের করতে পারে ম্যালেভাল, তাহলে পরিবারকে বের করা তো ওর বাম হাতের কাজ। তোর শেষ ভরসা, একমাত্র আমি।” 

“নিজের চরকায় তেল দাও!” 

মাথা নাড়লো ক্যামিল। এরপরেই হ্যাট হাতে উঠে দাঁড়ালো সে। 

হ্যাফনারের মাঝে নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। 

“ঠিক আছে। আমি চলে যাচ্ছি। বাকি সময়টা পরিবারের সাথে কাটাও। খুব বেশি সময় নেই আর।” 

হলওয়ের দিকে এগিয়ে গেল ক্যামিল 

ঠিক পথেই যে এগুচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই ক্যামিলের। কিছুক্ষণের মাঝে তার পিছুপিছু আসবে হ্যাফনার 

দরজার সামনে একটু দাঁড়ালো ক্যামিল। জনমানব শূন্য রাস্তার নিরবতা 

বেশ ভালো লাগছে তার। এরপরেই, ঘুরে দাঁড়ালো সে। 

 “মেয়েটার নাম কী?” 

“ইভ।” 

মাথা নাড়লো ক্যামিল। সুন্দর নাম। 

“আশা করি, পরিবারের সাথে বাকি সময়টা ভালো কাটবে।” 

এই বলে বেরিয়ে গেল সে। 

“ভেরহোভেন!” 

চোখ বন্ধ করে ফেলল ক্যামিল। 

নিজের সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় একটু প্রশান্তি অনুভব করলো সে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *