দুপুর ১২টা
বাথরুমের আয়নায় নিজের মাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে অ্যানি। মাড়ির এক পাশে বিশ্রি রকমের এক গর্ত। হাসপাতালে যেহেতু ভুয়া পরিচয়ে ভর্তি হয়েছিল, তাই চাইলেও নিজের মেডিকেল ফাইল দেখতে পারবে না। এক্সরে থেকে শুরু করে যাবতীয় পরীক্ষা আরেকদফা করতে হবে তার।
লোকটার ভাষ্যমতে, অ্যানিকে খুন করার কোনো ইচ্ছাই নেই তার তবে ওই লোকের একটা কথাও বিশ্বাস করেনি অ্যানি। যতই বলুক না কেন সবার চোখে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যই এমন নির্মমভাবে মেরেছে… কিন্তু অ্যানি ভালোমতোই জানে, আসল উদ্দেশ্য কী ছিল।
ঔষধ রাখার তাকে ছোট একটা কাঁচি আর চিমটা খুঁজে পেল অ্যানি। গালের ক্ষতটা খুব একটা গভীর না বলেই তাকে আশ্বস্ত করেছিল ডাক্তার। দশদিন পরেই সেলাই খোলা যাবে এমনটা বলেছিল। কিন্তু সেটা এখনই করতে চায় অ্যানি। ক্যামিলের ডেস্কে, একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস খুঁজে পেল সে। এমনিতেই তার হাতে ঠেকার কাজ চালানোর মত যন্ত্রপাতি। এর মাঝে বাথরুমে আলোও বেশ কম। জায়গাটা মোটেও আদর্শ নয়। কিন্তু এই দশায় আর এক মুহূর্তও থাকতে চায় না সে।
জামার হাতা দিয়ে চোখটা মুছলো অ্যানি। সেলাই খোলার কাজটা বেশ কষ্টসাধ্য; আর ভেঁজা চোখ নিয়ে, অ্যানির জন্য তো প্রায় অসম্ভব…
মোট এগারোটা সেলাই। বাম হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস আর কাঁচিটা ডান হাতে নিলো সে। ম্যাগনিফাইং গ্লাসে সেলাইগুলো ছোট পোকার মত দেখাচ্ছে। প্রথম গিঁটে কাঁচি চালাতেই তার সারা শরীরে অসহ্য এক ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো। মনে হচ্ছে নিজেই নিজেকে ছুরি মেরেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো ব্যথা পাওয়ার কথা না। ক্ষত এখনো শুকিয়ে ওঠেনি। কিংবা, ইনফেকশন হয়ে গেছে। এসব না ভেবে অ্যানি কাজ চালিয়ে গেল। ব্যথায় তার চোখ মুখ বিকৃত হয়ে আসছে। কিন্তু সে থামলো না। প্রথম সেলাই কাটা শেষ। এখন টান দিয়ে বের আনা বাকি। তার হাত কাঁপছে। চিমটা দিয়ে টেনে বের করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। ঠোঁট কামড়ে ধরে হ্যাঁচকা এক টান দিলো অ্যানি। শেষমেশ সফল হলো সে। পরের সেলাইটা কাটার আগে একটু থামলো অ্যানি। এখনো তার হাত কাঁপছে। বড় করে একটা শ্বাস নিলো…
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে দুই আর তিন নাম্বার সেলাই খুলে ফেলল সে। ম্যাগনিফাইং গ্লাসে ক্ষতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। টকটকে লাল হয়ে আছে। এখনো ঠিকমতো জোড়া লাগেনি। চতুর্থ সেলাইটা বেশ ঝামেলাদায়ক। মনে হচ্ছে, তার ত্বকের সাথে একদম মিশে আছে। কিন্তু অ্যানি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দাঁতে দাঁত চেপে কাঁচি চালালো। সেলাই কাটার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। উল্টো আরো রক্ত বেরিয়ে এলো। বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় সফল হলেও ক্ষত থেকে রক্তের প্রবাহ আরো বেড়ে গিয়েছে। পরের সেলাইগুলো তুলনামূলক তাড়াতাড়িই কেটে ফেলল সে। এদিকে রক্ত প্রবাহও যেন সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। দেরি না করে, সার্জিকাল স্পিরিটের খোঁজে ঔষধ রাখার তাক তছনছ করে ফেলল। কিছুক্ষণ পর স্পিরিট খুঁজে পেল সে। হাতের তালুতে নিয়ে ক্ষতস্থানে ঘষতে তার দেরি হলো না।
ব্যথার তীব্রতা বেড়েই চলছে। চিৎকার করে উঠলো অ্যানি।
এবার সরাসরি ক্ষতস্থানে ঢালল স্পিরিট। এরপর দুই হাতে শক্ত করে ধরলো বেসিনটা। মনে হচ্ছে এক্ষুণি জ্ঞান হারাবে সে। কিন্তু ওভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যথা একটু কমতেই টুকরো একটা কাপড় নিলো অ্যানি। কাপড়টা স্পিরিটে ডুবিয়ে তার গালে চেপে ধরলো।
গালের ক্ষতস্থানে যে স্থায়ী দাগ বসে যাবে, তা ভালোমতোই বুঝতে পারছে অ্যানি। লম্বা একটা দাগ থাকবে তার গালে। দাগটা কত বড় হবে, এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়। তবে কোনো পুরুষের গালে এমন ক্ষত থাকলে তাকে যোদ্ধা ভাবতো লোকজন।
এতে কোনো সমস্যা নেই অ্যানির। সে চায়, এই দাগ চিরজীবনের জন্য থাকুক। সারাজীবনের যেন বয়ে বেড়াতে পারে।
.
দুপুর ১২টা ৩০
ক্যাজুয়ালটি বিভাগের সামনে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাটা কোনো সময়ই খালি থাকে না। নিজের আইডি কার্ড দেখিয়ে জায়গার ব্যবস্থা করলো ক্যামিল।
রিসেপশনিস্ট আজকে বেশ সেজেগুজে আছে। টকটকে লাল গোলাপের মত লাগছে তাকে।
“শুনলাম, রোগি নাকি পালিয়েছে?”
কথাটা বলেই মুখটা এমন করলো, যেন ভেরহোভেনের কষ্ট সে অনুভব করতে পারছে। কোনো জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো ক্যামিল। এখন, রিসেপশনিস্টের খপ্পরে পড়তে চাচ্ছে না। কিন্তু যতোটা সহজ ভেবেছিল, ততোটা সহজে পার পেল না।
“ওই অ্যাডমিশনের ফর্মের কী খবর?”
পিছিয়ে এলো ক্যামিল।
“এমনিতে, অ্যাডমিশন ফর্ম দেখাশোনার দায়িত্ব আমার না কিন্তু কোনো রোগি পালিয়ে গেলে উপর থেকে নানা ধরনের চাপ আসে। এর মাঝে রোগির সোশ্যাল সিকিউরিটি নাম্বারও নেই। আর আপনি তো জানেন, উপরের মহলের লোকজন কারো ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারলেই বাঁচে। এমন ঝামেলায় আমি আগেও পড়েছি। একারণেই জিজ্ঞেস করছি।”
মাথা নাড়লো ক্যামিল। যেন বলতে চাইছে, সে বুঝতে পেরেছে। যেহেতু মিথ্যা পরিচয়ে ভর্তি হয়েছিল অ্যানি, সেহেতু সোশ্যাল সিকিউরিটি নাম্বার থাকার প্রশ্নই উঠে না। একারণে তার বাসায় কোনো কাগজপত্র পায়নি ক্যামিল। ওই নামে কোনো কাগজই নেই।
হুট করেই অ্যানিকে ফোন করার তাড়না অনুভব করলো ক্যামিল। তার মনে হচ্ছে এই সংকটময় মুহূর্ত অ্যানিকে ছাড়া পাড়ি দেয়া সম্ভব না।
সাথে সাথেই তার মনে পড়লো, অ্যানি নামে তো কেউ নেই। এতোদিন যা জেনে এসেছে, সবকিছু মিথ্যা। হতাশ হয়ে পড়লো ক্যামিল। চারপাশটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে তার। অদ্ভুত এক একাকীত্ব গ্রাস করলো তাকে।
“আপনি ঠিক আছেন?”
“হ্যাঁ, কোনো সমস্যা নেই,” একটু ব্যস্ততার ভান করলো ক্যামিল। কারো পিছু ছোটানোর জন্য এর চেয়ে মোক্ষম উপায় আর নেই।
“ওর ফাইলটা কোথায়?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
যেহেতু রাতের বেলায় পালিয়েছে অ্যানি, ফাইলটা এখনো ওয়ার্ডে থাকার কথা।
রিসেপশনিস্টকে ধন্যবাদ জানালো ক্যামিল। কীভাবে কী করা যায়, তা ভাবার জন্য একটু থামলো সে। এরপর সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। করিডোরের একদম শেষ মাথায়, দাঁড়িয়ে আছে সে। ঠিক এখানেই কেস নিয়ে আলোচনা হয়েছিল লুইসের সাথে। ওয়েটিং রুমের দরজা এমনভাবে খুলল, যেন কোনো ভীতসন্ত্রস্ত বাচ্চা বেরিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে।
দরজা খুলতেই প্রাপ্তবয়স্ক এক লোকের দেখা মিলল। হিউবার্ট ডেইনভিল, ট্রমা ইউনিটের প্রধান।
“আপনি এখানে কী করছেন?” জানতে চাইলো ডাক্তার।
আমিও একই প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে। এই কথাটা ঠোঁটের আগায় আসলেও, চেপে গেল ক্যামিল। সে ভালোমতোই জানে, এখন এসব বলায় সময় না। চারপাশে এমনভাবে তাকালো, যেন সে দিক হারিয়ে ফেলেছে।
“আসলে, আমি চিনতে পারছি না…ভুল করে এই করিডোরে চলে এসেছি।”
মুখটা শক্ত করে ফেলল সার্জন। উঠে দাঁড়িয়ে এমন একটা ভঙ্গি করলো, যেন জরুরি কাজ আছে তার।
“এখানে, আপনার কোনো কাজ নেই, কম্যান্ড্যান্ট।”
তার পিছু পিছু ছুটলো ক্যামিল।
“আপনার সাক্ষী, গতরাতে হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে!” গর্জন করে বলল ডেইনভিল। এমনভাবে তাকালো যেন সব দোষ ক্যামিলের।
“আমিও তাই শুনেছি।”
আরো কোনো উপায় না পেয়ে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইল ফেলে দিলো ক্যামিল। মোবাইলটা টাইলসের মেঝেতে পড়ার সাথে সাথে হালকা শব্দ হলো।
“ধ্যাত্তেরি!”
ইতোমধ্যে লিফটের সামনে পৌঁছে গেছে ডেইনভিল। হুট করেই শব্দ শুনে পেছনে তাকালো। কম্যান্ড্যান্টের এই অবস্থা দেখে হাসি পেল তার। শালা বলদ। লিফটের দরজা খুলতেই, ভেতরে ঢুকলো ডেইনভিল।
মোবাইল তুলে নিলো ক্যামিল। আসলে মোবাইল এখনো অক্ষত আছে। তবে ভাবখানা এমন করলো, যেন কয়েক টুকরো জোড়া দিচ্ছে। এই করতে করতে ওয়েটিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল সে।
প্রায় এক মিনিট চেষ্টা করেও দরজা খুলতে ব্যর্থ হলো। কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে গেল। কিছু একটা ভুল হচ্ছে তার। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সে। কিন্তু কিছুই হলো না। ফিরে যাবার কথা চিন্তা করলেও পরক্ষণেই তা বাদ দিলো।
দরজার হাতল নড়ছে।
ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলো নার্স ফ্লোরেন্স। ক্যামিলকে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো সে। একটু দ্বিধায় ভুগলো ক্যামিল। কিন্তু ততক্ষণে পাশ কাটানোর সুযোগ হারিয়ে ফেলেছে। লজ্জাবনত অবস্থায় ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিলো ফ্লোরেন্স। ইচ্ছা করেই দরজাটা লাগিয়ে দিলো সে-আমি খুব ব্যস্ত, কাজ ব্যতীত অন্য কোনো দিকে মনোযোগ নেই আমার, লজ্জা পাওয়ার মত কিছু হয়নি। তার এই অভিনয় কার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। এমনকি নিজের কাছেও না। অন্যায় সুযোগ নেয়াটা মোটেও পছন্দ না ক্যামিলের। এমনটা তার স্বভাবেও নেই। কাজটা অপছন্দনীয় হলেও, এখন তাই করতে হবে তার। ফ্লোরেন্সের দিকে তাকিয়ে মাথাটা এমনভাবে নাড়লো, যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ভাবখানা এমন, যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল ক্যামিল।
“ম্যাডাম ফরেস্টিয়ে ফাইলটা লাগবে আমার,” বলল সে।
তাকে পাশ কাটিয়ে, হাঁটতে শুরু করলো ফ্লোরেন্স। তবে এমনভাবে হাঁটলো, যেন দ্রুতই তাল মেলাতে পারে ক্যামিল।
“আমি ঠিক জানি না…”
চোখ বন্ধ করে ফেলল ক্যামিল। ফ্লোরেন্সকে যেন বোঝাতে চাইলো: তাহলে হয়তো ডা : ডেইনভিলের সাথে কথা বলতে হবে। আশা করি সে…
নার্স স্টেশনের কাছাকাছি চলে এলো দুজন।
“আমি আসলে জানি না ফাইলটা এখনো আছে কিনা।”
ক্যামিলের দিকে, একবারও মুখ ফিরে তাকালো না সে। রোগিদের ফাইল রাখার ড্রয়ারটা খুলে ‘ফরেস্টিয়ে’ নামের ফাইলটা বের করলো। বেশ বড় আকারের ফাইলে সি.এ.টি. স্ক্যান, এক্স-রে, আর ডাক্তারের নোট পাওয়া গেল। সাধারণ মানুষ তো দূরে থাক, কোনো পুলিশ অফিসারের হাতেও এই ফাইল দেয়ার কোনো নিয়ম নেই। এই কাজ নার্সদের রীতিনীতির চূড়ান্ত লঙ্ঘন…
“বিকালে এসে, ওয়ারেন্ট দিয়ে যাবো,” বলল ক্যামিল। “আপাতত, একটা রিসিট দিতে পারি।”
“তার আর দরকার হবে না,” তাড়াহুড়ো করে বলল ফ্লোরেন্স, “মানে বলতে চাচ্ছি, পরবর্তীতে কোনো ঝামেলা না হলেই হলো…”
ফাইলটা হাতে নিলো ক্যামিল। ধন্যবাদ। দুজনেই কৃতজ্ঞতা বিনিময় করলো।
.
দুপুর ১টা
লোহার দরজা পেরিয়ে বিস্তৃত এক রাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আপনি। একটু এগুলেই চোখে পড়বে বিশাল গাছের সারি আর গোলাপি বিল্ডিং। আপনি হয়তো ভাববেন, রাজকীয় এক বাড়িতে চলে এসেছেন। তবে এমন ভাবনার জন্য আপনাকে ক্ষমা করা যায়; কেন না এর ভেতরেই যে লাশের সারি পড়ে থাকে আর তা ব্যবচ্ছেদ করা হয়, তা বিশ্বাস করা বেশ কঠিন হাতের তালুর মত জায়গাটা চেনে ক্যামিল। এখানে আসার জন্য প্রায়ই মুখিয়ে থাকে। এখানকার মানুষগুলো তার খুব পছন্দের। তবে, সবচেয়ে কাছের মানুষ হচ্ছে নগুয়েন। এক অদ্ভুত বন্ধনে আবদ্ধ দুজন। একসাথে হাজারো স্মৃতি আছে দুজনের, তবে বেশিরভাগই কষ্টের।
নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, ভেতরে প্রবেশ করলো ক্যামিল। ঠাণ্ডা পরিবেশ বেশ ভালোমতোই অনুভব করলো সে।
এদিকে নগুয়েন, বরাবরের মতই গম্ভীরমুখে আমন্ত্রণ জানালো তাকে। ক্যামিলের চেয়ে খুব বেশি লম্বা না সে। সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে তার মুখে হাসি দেখা গিয়েছিল। ক্যামিলের সাথে হাত মিলালো সে। এরপর সমস্ত কথা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে অ্যানির ফাইলটা নিলো। সতর্কতার সাথে পুরো ফাইলটা পড়লো।
“একবার চোখ বুলালেই হবে,” বলল ক্যামিল, “তোমার অবসর সময়ে একটু দেখে নিও।”
ক্যামিলের ‘একবার চোখ বুলালেই হবে’ বলা মানে : তোমার পরামর্শ দরকার, কোনো একটা সমস্যা আছে এটায়। তোমার নিরপেক্ষ মতামত দরকার। আর কিছুই বলতে চাচ্ছি না। তোমার নিরপেক্ষ মতামত প্ৰয়োজন। আর যত দ্রুত সম্ভব কাজটা করতে হবে।
আর ‘তোমার অবসর সময়ে একটু দেখে নিও’ মানে, কাজটা একান্ত ব্যক্তিগত।
মাথা নাড়লো নগুয়েন। ক্যামিলকে কখনো খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি সে। এছাড়াও কাজটায় তেমন কোনো বিপদ নেই, উল্টো রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে সে। রহস্যজনক ব্যাপার তার পক্ষে কোনোভাবেই ছাতছাড়া করা সম্ভব না।
“বিকাল পাঁচটায় একটা কল দিয়ো আমাকে,” এই বলে ফাইলটা ড্রয়ারে রাখলো নগুয়েন।
.
দুপুর ১টা ৩০
এবার অফিসে যাবার সময় হয়েছে। অফিসে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা বেশ ভালোমতোই জানে ক্যামিল। তাই অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু কোনো উপায় নেই।
অফিসে ঢোকার পথে বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সাথে দেখা হলো ক্যামিলের। তার দিকে কেমন করুণ চোখে তাকালো সবাই। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ার জন্য তিন দিন সময়ই যথেষ্ট। আর ঘটনা যতো অস্পষ্ট, তা বিকৃতি হওয়ার হার ততো বেশি।
যদি কেউ সরাসরি জিজ্ঞেস করে তাহলেও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই ক্যামিলের। তাছাড়া কী বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে,
তাও সে জানে না। সৌভাগ্যক্রমে তার টিমের মাত্র দুজন সদস্য এখন উপস্থিত। বাকিরা অন্যান্য কেসে কাজ করছে। সরাসরি নিজের রুমে ঢুকলো ক্যামিল।
কয়েক মিনিট পর নক না করেই রুমে ঢুকলো লুইস।
“আপনাকে তো অনেকেই খুঁজছে…”
ডেস্কের দিকে চোখ পড়লো ক্যামিলের। কমিশনার মিচার্ডের সাথে দেখা করার আদেশ সম্বলিত একটা কাগজ দেখতে পেল।
“বুঝতে পেরেছি…”
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মিটিং শুরু হবে। তবে কে কে উপস্থিত থাকবে তা লেখা নেই আদেশনামায়। ব্যাপারটা খুব একটা স্বাভাবিক মনে হলো না তার কাছে। সাধারণত, অসদাচরণের অভিযোগে সন্দেহভাজন কোনো অফিসার সরাসরি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ পায় না। তার মানে, মিটিঙে যেই উপস্থিত থাকুক না কেন তাতে কিছুই যায় আসে না। অর্থাৎ, যথোপযুক্ত প্রমাণ হাতে নিয়েই তাকে ধরবে কমিশনার মিচার্ড। এবার আর পাশ কাটানোর কোনো উপায় থাকবে না ক্যামিলের।
কী হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাদ দিলো ক্যামিল। এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না।
পরনের কোটটা সে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলো। এরপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে প্লাস্টিকের একটা ব্যাগ বের করলো। ব্যাগটা এমনভাবে ধরলো, যেন ওর ভেতরে নাইট্রোগ্লিসারিন আছে। মগটা টেবিলের উপর রাখলো। সামনে এগিয়ে এসে একটু নিচু হলো লুইস। মগের গায়ে থাকা দুর্বোধ্য লেখা তার নজর এড়ালো না।
“এটা তো ‘ইউজিন ওনেগিন’র প্রথম লাইন, তাই না?”
জীবনে একবারের জন্য হলেও উত্তরটা জানে ক্যামিল। হ্যাঁ। মগটা ছিল আইরিনের। তবে লুইসকে তা জানালো না।
“এই মগে থাকা আঙুলের ছাপ দরকার আমার। যত দ্রুত সম্ভব।”
মাথা নাড়লো লুইস। এরপর প্লাস্টিকের ব্যাগটার মুখ আটকে দিলো সে।
“তাহলে, নথিতে কি পেরগোলিন কেসের নমুনা হিসেবে দেখাবো?” ক্লড পেরগোলিন, নিজ বাড়িতে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
“হ্যাঁ, তোমার যেটা ভালো মনে হয়।
আসল ঘটনা গোপন করে লুইসের সাথে কাজকর্ম চালিয়ে যেতে বেশ কষ্ট হচ্ছে ক্যামিলের। কিন্তু এ ব্যাপারে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর পেছনে অবশ্য দুটি কারন আছে। প্রথমত ঘটনাটা যেমন বড় তেমন প্যাঁচানো। দ্বিতীয়ত, কিছু না জানার কারণে বিপদে পড়ার সম্ভাবনাও নেই লুইসের।
“ঠিক আছে,” বলল লুইস। “আর রিপোর্ট তো তাড়াতাড়ি লাগবে আপনার। এদিকে ম্যাডাম ল্যামবার্ট, এখনো ল্যাবেই আছে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।”
লুইসকে বেশ পছন্দ করে ম্যাডাম ল্যামবার্ট; নিজের ছেলের মত আদর করে। আটষট্টি বছর বয়সি নারী, এখনো নিরলসভাবে কাজ করছেন।
জরুরি কাজ হলেও এখনো দাঁড়িয়ে আছে লুইস। তার হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ।
“মূল ঘটনার কিছু অংশ হয়তো এখনো জানার বাকি আছে আমার…”
“চিন্তা কোরো না,” হাসলো ক্যামিল। “আমারও একই দশা…”
“আমাকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনি…(আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে হাত তুলল লুইস) আপনার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছি না।”
“ওহ! কিন্তু এটা তো সমালোচনা বৈ কিছু না। আর তোমার সেই অধিকারও আছে। কিন্তু এখন…”
“অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে?”
“ঠিক তাই।”
“কোনো ক্ষেত্রে দেরি হয়েছে? সমালোচনা নাকি ব্যাখ্যার?”
“এর চেয়েও বাজে অবস্থা, লুইস। সবকিছুর জন্যেই দেরি হয়ে গিয়েছে। ব্যাখ্যার কথা বলো আর বোঝানোর কথাই বলো…কোনোকিছুরই সময় নেই আর। হয়তো মানসম্মানও হারাতে হবে এবার। সামনে শুধুই অন্ধকার। কোনো পথ খোলা নেই।”
মাথা নাড়লো লুইস।
“আমার মত এতো ধৈর্য সবার আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।”
“তোমাকে কথা দিচ্ছি, লুইস, সবই জানতে পারবে,” বলল ক্যামিল। “অন্তত এইটুকু অধিকার তোমার আছে। আর সবকিছু যদি পরিকল্পনামাফিক চলে, তাহলে তোমার জন্যেও বিশেষ কিছু আছে আমার কাছে। এমন এক সম্মাননা, যা একজন অফিসারের জীবনে স্বপ্নের নায়।”
“সম্মাননা…”
“ওহ, লুইস! কী বলতে চাও বলো! চাইলে বিখ্যাত কোনো উক্তি ঝাড়তে পারো!”
হাসলো লুইস।
“না, থামো, দেখি আমি বলতে পারি কি না,” উত্তেজনার যেন ঠগবগ করে ফুটছে ক্যামিল। “সেইন্ট-জন পার্স! না কি, নোয়াম চমস্কি!”
যাওয়ার জন্য ঘুরলো লুইস।
“ওহ, আরেকটা কথা…” থামলো লুইস। “ডেস্কের নিচে একটা কাগজ রাখা আছে আপনার জন্য।”
আচ্ছা, ঠিক আছে।
লা গুয়েনের একটা নোট : ‘বাস্তিল মেট্রো স্টেশন, দুপুর ৩ টা।’ বোঝাই যাচ্ছে, এমনি এমনি দেখা করার জন্য ডাকেনি সে।
সরাসরি ফোন না করে কন্ট্রোলার জেনারেলের এভাবে কোনো নোট রেখে যাওয়া মোটেও শুভলক্ষণ নয়। লা গুয়েন আস্পষ্টভাবে বলতে চাইছে, যথাযম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করছি আমি। বন্ধু হিসেবে, তোমার ভালো চাই আমি। কিন্তু এই মুহূর্তে, তোমার সাথে দেখা করার খবর জানাজানি হলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হবে। তাই সর্বোচ্চ গোপনীয়তা অবলম্বন করাই শ্রেয়।
উচ্চতাজনিত সমস্যার কারণে, গণপরিবহন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে ক্যামিল। মাঝে মাঝে উপায় না থাকলে মেট্রোতে চড়ে…
.
দুপুর ২টা
ফারনান্ডকে বেশ পছন্দ করি আমি। এমনিতে হারামীপনায় কম যায় না। কিন্তু সব আদেশ মাথা নিচু করে পালন করে। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আমার জন্য আবারো খুলেছে। বেশ খিদে পেয়েছে আমার। তাই একটা ডিম ভাজি আর মাশরুম দিলো আমাকে। রাঁধুনি হিসেবেও বেশ ভালো ও। ওর আসলে রান্নাঘরেই থাকা উচিত ছিল। কিন্তু কী বা করার আছে, যদি কেউ ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে। এখন আকণ্ঠ ঋণে জর্জরিত হয়ে আছে। কী কারণে? শুধুমাত্র ‘রাজা’ হওয়ার স্বপ্ন দেখার জন্য। শালা বলদ। এতে অবশ্য আমার কোনো সমস্যা নেই; বলদরা মাঝে মাঝে বেশ কাজে দেয়। ওর জন্য যে গলাকাটা সুদের হার বেঁধে দিয়েছি, সারাজীবনে যা কামাবে তার চেয়ে বেশি টাকা পাবো আমি। প্রথম দেড় বছর এই ব্যবসার যাবতীয় মূলধন আমিই দিয়েছি। হয়তো ও জানে না, এই রেস্টুরেস্টের আসল মালিক আমি। এক চুটকিতেই বলদটাকে পথে বসিয়ে দিতে পারি। তার মানে এই না যে, এই কথা ওকে বলেছি। সোনার ডিম পাড়া হাঁস কে হারাতে চায়। কত কাজে যে ওকে ব্যবহার করেছি তা হয়তো নিজেও জানে না। কখনো অ্যালিবাই, কখনো সাক্ষী কিংবা জামিনদার। দরকার হলেই ওয়াইন সেলার থেকে কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে যাই। গত বসন্তে যখন ক্যামিল ভেরহোভেনের মুখোমুখি হয়েছিলাম, দারুণ কাজ দেখিয়েছিল ফারনান্ড। সত্যি বলতে, সবাই নিজ দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেছিল। কোনো ঝামেলা ছাড়াই পার পেয়েছি।
এখন এইসব নিয়ে ভাবছি কারণ করার মত কিছুই নেই। আর এখান থেকেই তো সবকিছুর শুরু।
মোবাইলটা টেবিলের ওপর। কিন্তু পাঁচ মিনিট পর পর চেক না করলে ভালো লাগে না। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়েছে, তাতে বেশ সন্তুষ্ট আমি। আশা করছি ফলাফলও মনমতো হবে। মাথায় রক্ত উঠে গেলে আবার অন্য সমস্যা। সামনে যাকেই পাবো, তাকেই টুকরো টুকরো করে ফেলবো।
এর মাঝে, আমার নাকে এলো ওয়াইনের স্বর্গীয় ঘ্রাণ। গত তিনদিন এই ঘ্রাণটার খুব অভাব বোধ করেছি। ঈশ্বরও জানে, এখন আমার কী দরকার।
কাউকে বশ করা আর সশস্ত্র ডাকাতির মাঝে বেশ মিল আছে। ব্যাপক প্রস্তুতি আর দক্ষ দল ব্যতীত, কোনোটাতেই সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। হাসপাতাল ছাড়ার ব্যাপারে কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেনকে কীভাবে মানিয়েছে ওই বেশ্যা, তা নিজেও বুঝতে পারছি না। যেভাবেই হোক, কাজটা তো ঠিকঠাক করতে পেরেছে। এতেই চলবে আমার।
হয়তো ন্যাকা কান্না দিয়ে কাজ চালিয়েছে। একটু আবেগী পুরুষদের ক্ষেত্রে এই কৌশল সবসময়ই কার্যকরী।
মোবাইলটা চেক করলাম আমি।
কল আসলেই কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে যাবো।
হয়, এতো পরিশ্রম সব মাঠে মারা যাবে-সেক্ষেত্রে খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হবে আমার
অথবা, বাজিমাত করে ফেলবো। কত যে আমার পকেটে ঢুকবে, তা নিজেও জানি না। তবে পরিমাণে খুব বেশিও হবে না। দ্রুত কাজ গোছাতে হবে আমার। শেষ সময়ে এসে শিকারকে হারাতে চাই না। ফারনান্ডের কাছে এক বোতল পানি চাইলাম। এখন ওর সাথে ঝামেলা করার সময় নেই।
***
ঔষধের ড্রয়ারে কিছু প্লাস্টার খুঁজে পেল অ্যানি। গালের দাগ ঢাকার জন্য লাগবে তার। ব্যথার পরিমাণ একটুও কমেনি। তবে সেলাই খোলা নিয়ে কোনো আফসোস নেই তার।
এরপর, ওই লোকের ছুঁড়ে দেয়া খামটা তুলে নিলো সে। সতর্কতার সাথে খামটা খুলল।
ভেতরে বেশ কয়েকটা কাগজ, দু শ’ ইউরো, স্থানীয় কয়েকটা ট্যাক্সি কোম্পানির ফোন নাম্বার, একটা ম্যাপ আর ক্যামিলের বাড়ির একটা ছবি।
পরিকল্পনার শেষাংশ কার্যকর করা বাকি ।
মোবাইলটা পাশে রেখে সোফায় বসলো সে।
অপেক্ষার প্রহর শুরু।
.
দুপুর ৩টা
ক্যামিল আশা করছিল কথা বলতে বলতে, মুখে ফেনা তুলে ফেলবে লা গুয়েন। কিন্তু একদম চুপচাপ হয়ে আছে লা গুয়েন। কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভাঙ্গলো সে।
“আমার কাছে তো অন্তত আসতে পারতে…”
বাক্যে অতীতকালের ব্যবহার, ক্যামিলের নজর এড়ালো না। তার মানে লা গুয়েনের কাছে এই কেসের কিছু অংশ মীমাংসার অতীত।
“তুমি যথেষ্ট বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন একজন অফিসার,” থামলো না সে, “তুমি তো ভালোমতোই জানো, কীভাবে কী করা উচিত।”
কোনো জবাব দিলো না ক্যামিল।
“এই কেসের দায়িত্ব নিতে চাওয়ার ব্যাপারটাই ছিল সন্দেহজনক। ইনফর্মারের যে আষাড়ে গল্প সাজিয়েছো, তা আমার কাছে মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, একদম ফালতু …”
ঘটনা এখানেই শেষ না। ক্যামিল যে প্রধান সাক্ষীকে পালাতে সাহায্য করেছে, সেই খবরও পেয়ে যাবে লা গুয়েন।
সাক্ষীর আসল পরিচয়ও জানে না ক্যামিল। পরবর্তীতে যদি দেখা যায়, ‘অ্যানি’ কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত, তাহলে অপরাধীকে সাহায্য করার অভিযোগ উঠবে তার বিরুদ্ধে। সেক্ষেত্রে আরো কয়েকটা মামলা হবে। সশস্ত্র ডাকাতি, অপহরণ, হত্যাচেষ্টার…আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে কালোঘাম ছুটে যাবে তার।
ঢোক গিলল ক্যামিল।
“আর জুজ পেরেইরার সাথেই বা কী করলে,” কথা চালিয়ে গেল লা গুয়েন, “একদম গাধার মত কাজ করেছো : ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার কী দরকার ছিল। নিজ উদ্যোগে অভিযান চালালে। তুমি তো ভালোমতোই জানো, পেরেইরার সাথে কথা বললে কোনো ঝামেলাই হতো না।”
লা গুয়েন খুব শীঘ্রই জানতে পারবে, এরচেয়েও ভয়াবহ কাজ করে বসে আছে ক্যামিল। সাক্ষীর হাসপাতালের কাগজপত্রও বেআইনিভাবে নিয়ে এসেছে সে।
“তোমার গতকালকের অভিযান তো পুরো পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে ফেলেছে! এমন কিছু যে হবে, তা তোমারও জানার কথা! এসব করার আগে একবারও ভাবলে না? পুরোপুরি দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত আচরণ করেছো তুমি!”
ক্যামিলের নামে একটা ইনভয়েস আছে। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রমাণ জুয়েলার্সের দোকান থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে। এই খবরও জানে না কন্ট্রোলার জেনারেল লা গুয়েন। এখন আর কিছু করারও নেই। সময়ের স্রোত অনেক দূর পাড়ি দিয়েছে।
“কমিশনার মিচার্ডের সাথেও কথা হয়েছে আমার। তার ধারণা এক প্রকার জোর করেই এই কেসের দায়িত্ব নিয়েছো তুমি। সাক্ষীকে রক্ষা করারও আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছো।”
“মোটেও না!” জোড় দিয়ে বলল ক্যামিল ।
“এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। গত তিনদিন ধরে তুমি অসংযত আচরণ করছো। তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে…”
“তা ঠিক,” সায় জানালো ক্যামিল।
নারীদের বিষয়ে লা গুয়েনের অভিজ্ঞতা সমীহ করার মত। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই ক্যামিলের। তাই সায় জানানো ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না তার।
“কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই কেসটা তুমি ব্যক্তিগতভাবে কেন নিচ্ছো!”
“ব্যাপারটা তো ভিন্ন দিক থেকেও দেখা যায়। আমার ব্যক্তিগত বিষয়ই হয়তো এই কেসের সাথে জড়িয়ে আছে।”
কথাটা বলার সাথে সাথেই বুঝতে পারলো, এতোদিন এই ব্যাপারটাই মনের মাঝে লালন করছিল ক্যামিল। যে টালমাটাল অবস্থায় এখন আছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। কথাগুলো মনের মাঝে গেঁথে নিলো সে।
ক্যামিলের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়লো লা গুয়েন।
“ব্যক্তিগত বিষয়! এই কেসে তোমার পরিচিত মানুষটা কে?”
একদম উপযুক্ত প্রশ্ন। কয়েক ঘণ্টা আগে হলেও নির্দ্বিধায় অ্যানির নাম বলে দিতো ক্যামিল। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। পরিস্থিতি কত দ্রুত বদলে যায়।
“ডাকাত দলের প্রধান,” কোনো কিছু না ভাবেই বলে দিলো ক্যামিল।
লা গুয়েনের হতভম্ব ভাবটা কেটে গেল। এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে চাপা আতঙ্ক।
“এর সাথে তোমার কী সম্পর্ক? সশস্ত্র এক ডাকাত, যার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগও আছে, এর সাথে কীভাবে পরিচয় হলো? (তার কণ্ঠে উদ্বেগের সুর।) হ্যাফনারকে ব্যাক্তিগতভাবেভাবেচেনো তুমি?”
ডানে বামে মাথা নাড়লো ক্যামিল। না। যেন বলতে চাইছে, ব্যাপারটা এতো সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না।
“পুরোপুরি নিশ্চিত না আমি,” কিছু একটা এড়িয়ে যাচ্ছে ক্যামিল । “আপাতত, আমি কিছুই বলতে পারবো না…”
তর্জনী ঠোঁটের কাছে নিয়ে এলো লা গুয়েন। সাধারণত গভীর চিন্তায় মগ্ন হলে এমনটা করে সে।
“পরিস্থিতি যে কতোটা ঘোলাটে, তা বোধহয় এখনো বুঝতে পারছো না তুমি।”
“অবশ্যই খুব ভালোমতোই বুঝতে পারছি।”
“মিচার্ড তো পাবলিক প্রসিকিউটরকে ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ক্ষমতাও আছে তার। তুমি যা করছো, তা দেখেও না দেখার ভান সে করবে না। নিজের চাকরির প্রতি মায়া আছে তার। আর এতে দোষের কিছু দেখছি না আমি। এই যে, তোমাকে এইসব কথা বলছি। তার মানে, আমিও অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছি।”
“আমি জানি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা জানা নেই আমার…”
“এখানে আসার উদ্দেশ্য এটা না, ক্যামিল! তোমার কৃতজ্ঞতাবোধে আমার বালটাও আসে যায় না! এখনো আই.জি.এস. এর কাছে ডাক পড়েনি তোমার। কিন্তু বিশ্বাস করো, সেই দিন খুব বেশি দূরে নেই। তোমার ফোন ট্যাপ করা হবে। কে জানে, হয়তো এখনই করছে। তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ নজরে রাখা হবে। আর তুমি যা বললে ক্যামিল, এখন শুধু তোমার চাকরি না, ভবিষ্যতও সংশয়ের মাঝে আছে!”
এই বলে চুপ হয়ে গেল লা গুয়েন। আশা করছে, এই সময়ে সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবে ক্যামিল। কিন্তু বন্ধুর কাছে থেকে কোনো না জবাব পেয়ে, কিছুটা হতাশ হলো লা গুয়েন।
“শোনো,” বলল সে, “আমার মনে হয় না আমাকে না জানিয়েই কিছু করবে মিচার্ড। কেবলই পদোন্নতি পাওয়ায় আমার সহায়তার প্রয়োজন আছে তার। কিন্তু তোমার এইসব দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের কারণেই সুযোগ পেয়েছে সে। এজন্যেই প্রথম চালটা, আমারই দিতে হলো। মিচার্ডের সাথে তোমার মিটিংয়ের ব্যবস্থা আমিই করেছি।”
দুঃখ যখন আসে, ঝাঁক বেধেই আসে…জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে তার দিকে তাকিয়ে রইলো ক্যামিল।
“আর এটাই তোমার শেষ সুযোগ, ক্যামিল। পুরো ঘটনা খুলে বলবে আমাদের। তারপর কীভাবে কী করা যায়, তা দেখবো আমরা। তবে ব্যাপারটা যে ওখানেই শেষ হবে, এই কথা দিতে পারবো না আমি। সবকিছুই তোমার জবাবের ওপর নির্ভর করবে। তাহলে কী বলবে বলে ঠিক করেছো, ক্যামিল?”
“এখনও জানি না।”
তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, কিন্তু কীভাবে ব্যাখ্যা করবে তা বুঝে উঠতে পারছে না; প্রথমে তার যাবতীয় সন্দেহ ঝেড়ে ফেলতে হবে। লা গুয়েন বেশ বিরক্ত।
“আমি আর পারছি না ক্যামিল। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আমার। আমাদের বন্ধুত্বের কোনো মূল্যই নেই তোমার কাছে।”
বন্ধুর হাঁটুতে হাত রাখলো ক্যামিল। যেন লা গুয়েনকে সমবেদনা জানাচ্ছে।
আজ যেন পুরো দুনিয়া উল্টে গেছে। সচরাচর এর বিপরীত ঘটনাই ঘটে।
.