তৃতীয় চক্ষু

তৃতীয় চক্ষু

হল্যাণ্ডের অ্যামস্টারডাম শহরে আছে পৃথিবী বিখ্যাত হীরের বাজার। সেখানে সারি সারি দোকানে যে কত কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে তার ঠিক নেই।

সেই বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানটির সামনে একদিন দুপুরবেলা একটি কালো রঙের ভ্যান থামলো। তার পিছন দিকের দরজা খুলে লাফিয়ে নামলে চারজন অটোমেটিক রাইফেলধারী গার্ড। তারা দোকানটির দরজার দু’দিকে এমন ভাবে অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়ালো যে, মনে হলো তক্ষুনি কেউ সামনে এলেই তারা গুলি চালাবে।

সেই দোকানটির সামনেই মস্ত বড় একটা স্কোয়ার। সেখানে সারা বছরই টুরিস্টদের ভিড় লেগে থাকে। আজ বেশ সুন্দর ঝকঝকে রোদ উঠছে, বাতাস হালকা ধরনের ঠাণ্ডা, আজ সেখানে পৃথিবীর নানান দেশের প্রায় হাজার খানেক নারী—পুরুষ বেড়াতে এসেছে। অনেকেরই তো হীরে— জহরৎ কেনার সাধ্য নেই, তারা ওই সব দোকানের শো—উইণ্ডোর কাছে দাঁড়িয়ে দুর্লভ সব হীরে দেখে সাধ মেটায়। সাধারণতঃ পুলিশ টুলিশ সেখানে থাকে না। থাকলেও তারা দূরে দাঁড়িয়ে ছদ্মবেশে পাহারা দেয়।

আজ ওই বড় দোকানের সামনে অস্ত্রধারী গার্ডদের দেখে টুরিস্টর ভরে দূরে সরে গেল।

তখন সেই ভ্যান থেকে নামলো একটি রোগা, লম্বা লোক। তার হাতে একটি ছোট্ট মখমলের বাক্স। সে দ্রুত পায়ে ঢুকে গেল দোকানের মধ্যে।

আসলে এইসব দোকানে ছোটখাটো ও মাঝারি ধরনের হীরে থাকে প্রচুর। কিন্তু যে—সব হীরে পৃথিবী বিখ্যাত, সেগুলো ডাকাতদের ভয়ে দোকানে রাখা হয় না। সেগুলো থাকে ব্যাঙ্কের ভল্টে। খুব বড় ধরনের কোনো ক্রেতা এলে ওই সব হীরে ব্যাঙ্ক থেকে আনালো হয় কিছুক্ষণের জন্য। অনেক সময় যে—সব বিখ্যাত হীরে উধাও হয়ে গেছে, অনেকদিন কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি, সেরকমও দু’—একটি হীরে হঠাৎ পাওয়া যায় অ্যামস্টারডামের এইসব দোকানে। এই তো মাস দেড়েক আগেই স্টার অফ সাউথ নামে বহুকাল ধরে হারিয়ে যাওয়া একটি দারুণ দামী হীরে একটা দোকানে ফিরে এসেছিল। সেটা বিক্রি হলো সাতাশ লক্ষ ডলারে, সারা পৃথিবীতে সেই খবর ছাপা হয়েছিল।

আজও বোধহয় সেই রকমই কোনো হীরে এসেছে, তাই এত পাহারার ব্যবস্থা!

দোকানটির একেবারে ভেতরের দিকে, মালিকের ঘরে বসে আছেন এক আমেরিকান দম্পতি। পুরুষটির বয়েস পঞ্চাশের কিছু বেশি, ছ’—ফুটেরও বেশি লম্ব চেহারা, সেই রকমই সুগঠিত স্বাস্থ্য। ইনি টেক্সাসের একটা মস্ত বড় তেল কোম্পানির মালিক, মিঃ টম শেফার্ড। ওদের দেশে তেল মানে অবশ্য পেট্রোল। টম শেফার্ডের স্ত্রীর বয়েস মোটে বাইশ বছর, ছিপছিপে তরুণী, অসাধারণ সুন্দরী। এর নাম গ্লোবিয়া।

এই দু’জন মালিকের ঘরে অধীরভাবে অপেক্ষা করছিলেন, এক সময় এসে পৌঁছলো মখমলের বাক্সটি। দোকানের মালিকটিও মধ্যবয়সী, মাথায় চকচকে টাক, মুখ দেখলেই বোঝা যায় খুব ধূর্ত।

দোকানের মালিক এবারে একটা দেরাজ খুলে দু’হাতে দুটি সাদা দস্তানা পরে নিলেন। তারপর মখমলের বাক্সটির ওপর হাত রেখে বললেন, এক্ষুনি আপনারা যে হীরেটি দেখবেন, সেই বিশ্বের একটি বিস্ময়। লোকে কোহিনূর হীরের কথাই বেশি বলে। তারপর রাশিয়ার জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথরিনের ‘অরলভ’ নামের হীরেও খুব বিখ্যাত। ইণ্ডিয়ার বিখ্যাত হীরে ‘হোপ’, যেটা এখন আছে অ্যামেরিকার স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে, সেটার কথাও সবাই জানে। কিন্তু এই যে হীরেটি, ‘ইভনিং স্টার’, এর কোনো তুলনা নেই। প্রথমে এটা পাওয়া যায় ইন্ডিয়ায়। এক মহারাজার সম্পত্তি ছিল। এটা সেখান থেকে যায় ইজিপ্টে। নেপোলিয়ান ইজিপ্ট জয় করে এটা নিয়ে যান ফ্রান্সে। তিনি এটা মাদাম মেরি ওয়ালেউস্কা নামে একটি মহিলাকে উপহার দিয়েছিলেন। তারপর বেশ কিছুদিন হীরেটা ছিল পোলাণ্ডে। আবার সেটিকে কিনে নেন ইজিপ্টের রাজা ফারুক। সেই ফারুকের সিংহাসন চলে যাবাব পর হীরেটার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না বহুদিন। তারপর সম্প্রতি রোমে এই ‘ইভিনিং স্টার’ দেখতে পাওয়া গেল। সেখান থেকেই আমাদের হাতে এসেছে।

টম শেফার্ড জিজ্ঞেস করলেন, রোম থেকে কে আপনাদের এটা বিক্রি করলো?

দোকানের মালিক বললো, সেটা আমাদের গোপন রাখতে বলা হয়েছে। তবে এটাই যে সেই আসল ‘ইভনিং স্টার’ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনারা জানেন নিশ্চয়ই, আমাদের দোকানের এমনই সুনাম যে, আমরা যে হীরেকে খাঁটি বললো, সারা পৃথিবী তা বিশ্বাস করবে।

দোকানের মালিক কিন্তু বাক্সটা এখনো খুলছেন না।

টম শেফার্ডের স্ত্রী গ্লোরিয়া উৎসুক ভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাক্সটির দিকে।

টম শেফার্ড জিজ্ঞেস করলেন, এই ‘ইভনিং স্টার’—এর ওজন কত?

দোকানের মালিক বললেন, হীরেটা ইন্ডিয়ায় যখন পাওয়া যায়, তখন এর ওজন ছিল একশো ষোল ক্যারাট। কিন্তু ভালো ভাবে কাটা ছিল না। ইন্ডিয়াতে আগেকার ধনী লোকেরা হীরের ওজনের ওপরেই বেশি গুরুত্ব দিত। কিন্তু হীরের আসল দাম হয় ঠিক মতন কাটার ওপরে। এটাকে ঠিক মতন কেটে এখন ওজন হয়েছে বিরাশি ক্যারাট।

টম শেফার্ড বললেন, তাও তো যথেষ্ট বড়। কোহিনূরের এখন ওজন একশো নয় ক্যারাট, আর ‘হোপ’ নামে যে হীরেটির কথা আপনি বললেন তার ওজন, অনেক কাটাকাটির পর চুয়াল্লিশ পয়েন্ট পাঁচ ক্যারাটা। আর সাউথ আফ্রিকার একসেলশিয়র নামে যে বিরাট হীরেটি পাওয়া গিয়েছিল, সেটা এখন অনেকগুলো টুকরো হয়ে গেছে, সবচেয়ে বড় টুকরোটির ওজন ৬৯° ৮০ ক্যারাট, তাই না?

দোকানের মালিক চোখ বড় বড় করে বললেন, আপনি হীরে সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন দেখছি। তা হলেই বুঝুন, ‘ইভনিং স্টার’ কেন এত বিখ্যাত।

গ্লোরিয়া অধীর ভাবে জিজ্ঞেস করলো, আমরা হীরেটা দেখবো না?

দোকানের মালিক বললেন, নিশ্চয়ই ম্যাডাম, নিশ্চয়ই। এবার দেখাচ্ছি। তার আগে আপনি দুটি গ্লাভস পরে নেবেন। আমার কাছে নতুন গ্রাভস আছে। খালি হাতে এই হীরে ধরা ঠিক নয়।

গ্লোরিয়া নিজের হাত ব্যাগ খুলতে খুলতে বললো, আমার সঙ্গেই নিজের গ্লাভস আছে। ধন্যবাদ। গ্লোরিয়া দু’হাতে পরে নিল দুটি সাদা দস্তানা।

দোকানের মালিক ম্যাজিক দেখাবার ভঙ্গি করে মখমলের বাক্সটি আস্তে আস্তে খুললেন।

সঙ্গে সঙ্গে যেন ঘরের মধ্যে আকাশের একটা নতুন তারা ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

প্রথম দেখলে মনে হয়, হীরেটি নীল রঙের। আসলে নীল নয়। কিন্তু ভেতর থেকে একটা নীল আভা বেরিয়ে আসছে। সেই নীল রঙটা কোথা থেকে আসছে সেটা বোঝা যায় না। সেইটাই হীরেটার বৈশিষ্ট্য!

হীরেটার মাঝখানটা চওড়া, দু’দিক সরু হয়ে এসেছে। অনেকটা যেন চোখের গড়ন।

দোকানের মালিক টেবিলের তলার সুইচ টিপে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেন এক মিনিটের জন্য। তখন হীরেটাকে আরও উজ্জ্বল দেখালো। গ্লোরিয়া আঃ, কী সুন্দর! কী অপূর্ব! করতে লাগলো।

আলো আবার জ্বলে ওঠার পর গ্লোরিয়া টপ করে হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। তারপর স্বামীর দিকে ফিরে বললো, টম, এই হীরেটা আমার চাই।

টম শেফার্ড বললেন, এটা তোমার এবারের জন্মদিনের উপহার। তারপর তিনি দোকানের মালিককে জিজ্ঞেস করলেন, এটার দাম কত? দোকানের মালিক বললেন, এটার দাম এখন উঠেছে দশ লক্ষ ব্রিটিশ পাউন্ড।

অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় আড়াই কোটি টাকা।

এই দাম শুনেও টম শেফার্ডের একটুও ভুরু কাঁপলো না। তিনি উঠে গিয়ে দরজা খুলে তাঁর সেক্রেটারিকে ডাকলেন। এই সব ধনী লোকদের পকেটে কোনো টাকা কড়ি থাকে না। অনেক সময় একটা টাকাও থাকে না সঙ্গে।

টম শেফার্ডের সেক্রেটারির নাম ফিলিপ লমবার্ড। সে ঘরের দরজার’পরে দাঁড়াতেই টম শেফার্ড বললেন, ফিলিপ; এঁদের দশ লক্ষ ব্রিটিশ পাউণ্ড দেবার ব্যবস্থা করে দাও।

দোকানের মালিককে তিনি বললেন, আপনি হীরেটা আজ বিকেলের মধ্যে আমাদের হোটেলে পাঠিয়ে দেবেন।

তারপর গ্লোরিয়াকে নিয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

ঠিক সেই সময় দোকানের গেটের সামনে একটা হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল!

একজন ভারতীয় যুবক জোর করে সেই দোকানের মধ্যে ঢোকবার চেষ্টা করছিল, দু’জন রক্ষী তাকে ধরে ফেলেছে। লোকটি তবু জোর করে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতেই একজন রক্ষী তার রাইফেলের মুখটা ঠেকালো লোকটির মাথায়।

দোকানের মালিক বেরিয়ে এসে বললেন, ওকে মেরো না। ওকে পুলিশের হাতে তুলে দাও। রক্ষী দু’জন লোকটিকে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। তারই মধ্যে সে একবার মুখ ঘুরিয়ে টম শেফার্ডকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, মিঃ শেফার্ড। ওই হীরেটা কিনবেন না। আপনার বিপদ হবে। ওটা অপয়া। ওটা অভিশপ্ত। মিঃ শেফার্ড, আমার কথা শুনুন……

রক্ষী দু’জন লোকটির মুখ হাত চাপা দিয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। আর কিছু শোনা গেল না।

গ্লোরিয়া দারুণ অবাক হয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলো, ওই লোকটা কে? ও ওই কথা বললো কেন?

টম শেফার্ড ব্যাপারটা গ্রাহ্য করলেন না। তিনি বললেন, ও কিছু না। চলো, আমাদের লাঞ্চের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

দোকানের বাইরে এসে ওঁরা একটা রোলস রয়েস গাড়িতে উঠলেন। তারপর চলে এলেন পাঁচতারা হোটেলে।

ঠিক বিকেল পাঁচটার সময় হোটেলে এসে পৌঁছে গেল ভেলভেটের বাক্সটি। গ্লোরিয়া এবং টম শেফার্ড নিজেদের সুইটে বসে বাক্সাটি খুলে দেখলেন। দোকান থেকে একটি বেশ ভারি ধরনের সোনার হারের মাঝখানে লকেট করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে হীরেটা।

সোনার এই হারের জন্য দোকান থেকে কোনো দাম চাওয়া হয়নি! অবশ্য দশ লক্ষ পাউণ্ড হীরেটার দাম শুনেও দরাদরি করেননি টম শেফার্ড।

গ্লোরিয়া বললো, আমার জন্মদিন তো দেড় মাস বাদে। তার আগে আমি এটা গলায় দিয়ে লোককে দেখাতে পারবো না?

টম শেফার্ড হেসে ফেললেন। তিনি হাসেন খুব কম।

তিনি বললেন, অতদিন ধৈর্য ধরতে পারবে না, তাই না। ঠিক আছে, কালকেই তুমি বড় করে একটা পার্টি দাও এই হোটেলে। অন্তত একশো জন অতিথি ডাকো। সেখানে তুমি গলায় এই হীরের গয়নাটা পরে বেরুবে, সবাই জানবে যে ‘ইভনিং স্টার’—কে আবার বহুকাল পরে খুঁজে পাওয়া গেছে।

তখন দু’জনে বসে বসে অতিথিদের তালিকা বানাতে লাগলেন। শুধু অ্যামস্টারডাম নয়, লন্ডন—প্যারিস—রোম থেকেও বন্ধুবান্ধবরা আসবে। প্লেনে উড়ে আসতে আর কতক্ষণহ বা লাগে।

সন্ধের সময় শেফার্ড দম্পতি আবার নামলেন হোটেলের একতলার লবিতে। তাঁদের এক জায়গায় নেমন্তন্ন আছে।

টম শেফার্ড গাড়ির জন্য হোটেলের দারোয়ানকে বলতে যাবেন, এমন সময় হঠাৎ একটি ভারতীয় যুবক তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, মিঃ শেফার্ড, আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই। কয়েক মিনিট সময় দেবেন?

টম শেফার্ড মানুষের মুখ খুব মনে রাখতে পারেন। তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার? আজ দুপুরে হীরের দোকানের সামনে তোমাকেই দেখেছিলাম না? পুলিশ তোমাকে এরই মধ্যে ছেড়ে দিল?

ভারতীয় যুবকটি বললো, আপনি একটু আড়ালে চলুন। আপনার সঙ্গে আমি পাঁচ মিনিট কথা বলতে চাই।

টম শেফার্ড বললেন, দুঃখিত। আমার হাতে সময় নেই।

গ্লোরিয়া টম শেফার্ডের হাত ধরে বললেন, আমি শুনতে চাই, টম। আমার কৌতূহল হচ্ছে।

টম শেফার্ড গম্ভীর ভাবে বললেন, ঠিক পাঁচ মিনিট!

ভারতীয় যুবকটি বললো, মিঃ শেফার্ড, আমার নাম অমল ভট্টাচার্য। আমি আপনাকে শুধু একটাই কথা জানাতে চাই। আপনি আজ যে হীরেটা কিনেছেন, সেটা ‘ইভনিং স্টার’ নয়। ওটার নাম আসলে ‘থার্ড আই’!

টম শেফার্ড ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘থার্ড আই’? এরকম একটা হীরের নাম শুনেছি বটে। কিন্তু ‘থার্ড আই’ তো টাইটানিক জাহাজের সঙ্গে সমুদ্রে ডুবে গেছে।

অমল ভট্টাচার্য বললো, না। লোকে তাই জানে বটে। কিন্তু টাইটানিক জাহাজ থেকে কয়েকজন বেঁচে গিয়েছিল। তাদের আরও দুটো দেশ ঘুরে হীরেটা এখানে ফিরে এসেছে। ‘ইভনিং স্টার’—এর দাম দিয়ে আপনি ‘থার্ড আই’ কিনলে ঠকে যাবেন।

টম শেফার্ড রীতিমত বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি। আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আমি যে কোন হীরে কিনছি, তা—ও অন্য কারুর জানার কথা নয়।

অমল বললো, আমি স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন দেখে জেনেছি!

গ্লোরিয়া খিলখিল করে হেসে উঠলো। টম শেফার্ড হাসলেন না। তিনি একই রকম বিরক্ত ভাবে বললেন, স্বপ্ন দেখেছেন? আমাকে? আমি হীরে কিনে ঠকবো কিনা সেজন্য আপনার এত মাথাব্যথা কেন?

অমল বললো, মিঃ শেফার্ড, আপনাকে আমি ‘থার্ড আই’ হীরেটার ইতিহাস সংক্ষেপে বলছি। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত হীরের মতন এই হীরেটাও এসেছে ভারতবর্ষ থেকে।

টম শেফার্ড বললেন, আমি সেকথা জানি!

অমল বললো, ভারতের কোন জায়গায় থেকে এসেছে, তা জানেন কি? ভারতের ওয়েস্ট বেঙ্গলে মুর্শিদাবাদ জেলায় মহেশপুর নামে একটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামে একটা খুব পুরোনো শিবমন্দির আছে এখনো। সেখানে শিবলিঙ্গের ওপরে গাঁথা ছিল এই হীরেটা। শিবের তৃতীয় নয়ন। সেইজন্যই এর নাম ‘থার্ড আই’। ফুর্নিয়ের নামে একজন বিদেশী পরিব্রাজক এই হীরেটা চুরি করে। মন্দিরের পুরোহিতকে সে নানা কথায় ভুলিয়ে এক রাতে বাইরে পাঠিয়ে দিল। ফুর্নিয়ের হীরেটা নিয়ে কালিকট বন্দর পর্যন্ত পৌঁছেছিল, সেখানে সে খুন হয়। তারপর হীরেটা যায় এক আরব ব্যবসায়ীর কাছে। এক বছরের মধ্যে সে মারা যায় মাথায় বাজ পড়ে। হীরেটা তারপর দু’—এক হাত ঘুরে চলে যায় পারস্যের সম্রাটের কাছে। তিনি আড়াই মাসের মধ্যে রাজ্য হারালেন। তারপর হীরেটা ইস্তামবুলে যায়। সেখান থেকে গ্রীসে।

যে যে এই হীরেটার মালিক হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই দুর্ঘটনায় মরেছে কিংবা খুন হয়েছে। এক ইংরেজ এটা নিয়ে টাইটানিক জাহাজে করে যাচ্ছিল, সেই টাইটানিক জাহাজ ডুবেই গেল। সেইজন্যই বলছিলাম এটা অপয়া।

টম শেফার্ড অতিকষ্টে একটুখানি দামি হাসি খরচ করে বললেন, হীরে সম্পর্কে ওইসব গাঁজাখুরি গল্প আমি বিশ্বাস করি না।

গ্লোরিয়া বললেন, দারুণ! দারুণ! হীরেটার পেছনে এরকম লম্বা ইতিহাস আছে?

টম শেফার্ড বললেন, ওটা আমাদের হীরে সম্পর্কে নয় ডার্লিং। আমরা কিনেছি ‘ইভিনিং স্টার’। ‘থার্ড আই’ হীরের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

অমল বললো, মিঃ শেফার্ড, আমি স্বপ্ন দেখেছি, ‘থার্ড আই’ আপনি কিনতে যাচ্ছেন। কিনবেন না, কিনবেন না, আপনার সর্বনাশ হয়ে যাবে! ফেরৎ দিয়ে দিন!

টম শেফার্ড বললেন, স্বপ্নে আপনি আমার নামও জেনে ফেললেন? পৃথিবীর এত লোক থাকতে আপনিই বা এই স্বপ্ন দেখতে গেলেন কেন?

অমল বললো, মহেশপুরের যে শিবমন্দির, আমি সেখানকারই পুরোহিতদের বংশধর। আমার কাকা এখনো সেখানে পুজো করেন। আমি এখানে চাকরি নিয়ে এসেছি। কাল রাত্তিরে আমাদের দেবতা মহাদেব স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, ফেরৎ দিতে বল! ফেরৎ দিতে বল! আমার চোখ নেই! ওই শেফার্ড নামে লোকটাকে ফেরত দিতে বল, না হলে ওর সর্বনাশ হয়ে যাবে!

টম শেফার্ড উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, একটি হিন্দু দেবতার চোখ আমার স্ত্রীর গলায় সুন্দর মানাবে। দশ লক্ষ পাউণ্ড দামের জিনিস কেউ এমনি ফেরৎ দেয় না! চলো, ডার্লিং!

তিনি স্ত্রী হাত ধরে গট গট করে বেরিয়ে গেলেন।

সেদিন রাত্তিরে শুতে যাবার সময় গ্লোরিয়া মখমলের বাক্স খুলে হীরেটা অনেকবার ধরে দেখলো।

এক সময় সে বললো, দ্যাখো, টম। হীরেটা ঠিক একটা চোখের মতনই দেখতে। স্টার হলে অন্যরকম হতো না?

টম শেফার্ড দাঁড়িয়ে আছে জানালার কাছে। হোটেলে সবচেয়ে উঁচু তলায় তাদের এই ঘর। জানালা দিয়ে পুরো অ্যামস্টারডাম শহর আর নদী দেখা যায়। আজ জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে।

টম শেফার্ড মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘ইভনিং স্টার’ হীরেটার আকারটাও চোখের মতন। বহু বইতে এর বর্ণনা আছে। তাছাড়া, এটা যাদি ‘থার্ড আই’ হয়ও, তাতেও কোনো আপত্তি নেই। ‘থার্ড আই’ আরও বিখ্যাত হীরে, তার দাম বেশি ছাড়া কম নয়।

গ্লোরিয়া সেই হীরে সমেত টপ করে একবার গলায় পরেই আবার খুলে রেখে দিল।

একটু পরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো দু’জনে।

টম শেফার্ড শোওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁর ঘুম খুব গাঢ়।

আনন্দে, উত্তেজনায় গ্লোরিয়া জেগে রইলো অনেকক্ষণ। কিছুতেই ঘুম আসছে না। হঠাৎ একবার একটা জানালায় ঠক করে শব্দ হতেই সে চমকে উঠলো। সেদিকে চেয়ে দেখলো, কাচের জানালার বাইরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।

গ্লোরিয়া আঁতকে উঠে স্বামীকে ঠেলা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, টম! টম! দু’—তিনবার ডাকার পর টম শেফার্ড জেগে উঠলেন। তখন জানলার কাছে কেউ নেই। গ্লোরিয়া বললো, আমি স্পষ্ট দেখলাম একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, অনেকটা অরিয়েন্টাল বলে মনে হল! গায়ের রং ছাই ছাই রঙের।

টম শেফার্ড বললো, ধ্যাৎ, কী বাজে কথা বলছো? ওখানে জানালার ধারে লোক আসবে কী করে? এটা চোদ্দতলা,সেটা খেয়াল আছে?

গ্লোরিয়া বললো, আমি পরিষ্কার দেখেছি!

টম শেফার্ড বললেন, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ো।

তিনি নিজেও তাই করলেন! এক মিনিট বাদেই তাঁর নাক ডাকতে লাগলো। গ্লোরিয়ার তবু ঘুম এলো না।

আর একবার জানলার দিকে তাকাতেই তার দম বন্ধ হয়ে এলো। এবার মুখ দিয়ে শব্দও বেরুলো না। সাধারণ মানুষের চেয়েও বড় চেহারার একজন লোক, খালি গা, মাথায় অদ্ভুত চুল, দাঁড়িয়ে আছে জানালার ওপাশে। হাতছানি দিয়ে যেন গ্লোরিয়াকে ডাকছে।

গ্লোরিয়া কোনো রকমে একটা ধাক্কা দিল স্বামীকে।

টম শেফার্ড বিরক্তভাবে বললো, আবার কী? গ্লোরিয়া বললো, ওই যে! ওই যে! আমায় ডাকছে! হিন্দু দেবতা!

টম শেফার্ড তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলেন না। তিনি উঠে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বললেন, তুমি জ্যোৎস্নায় চোখে ভুল দেখছো। এইবার ভালো করে ঘুমোও।

গ্লোরিয়া বললো, না, টম, পর্দা খুলে রাখো। আমি যদি চোখে ভুল দেখি, তা হলে আমাকে ভুলটা ভাঙাতে দাও! ঘরের মধ্যে বেশ গরম, তুমি বরং কাচের জানলাটাও খুলে দাও!

টম শেফার্ড এক মিনিট চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে। জানলা খোলাই থাক।

তিনি এসে আবার শুয়ে পড়লেন এবং নাক ডাকতে লাগলেন।

ঠিক দু’মিনিট পরে গ্লোরিয়া আর্ত চিৎকার করে উঠলো, টম, জাগো! জাগো! আবার এসেছে, ঘরের মধ্যে ঢুকবে!

টম শেফার্ড এবার ঘুমোননি, নাক ডাকার ভান করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে দেখলেন, সত্যিই জানলার বাইরে একটা অদ্ভুত চেহারার মানুষ। প্রাচ্য দেশীয়। মাথার ওপর একটা সাপ ফণা তুলে আছে।

কিন্তু মানুষটা ঘরে ঢুকছে না, জানলা বেয়ে যেন ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে।

চোখের নিমেষে বালিশের তলা থেকে রিভলভার বার করে টম শেফার্ড পর পর দুটি গুলি চালালেন।

নিঁখুত টিপ। দু’টি গুলিই লাগলো ঠিক জায়গায়।

কিন্তু তারপরেই একটা দৃশ্য দেখা গেল। গুলির আঘাতেও কেউ কাতর শব্দ করলো না। বরং সেই লোকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়ে তুলো বেরুতে লাগলো তার গায়ের ভেতর থেকে।

আসলে ওটা মানুষ নয়। অলৌকিক কোনো দেবতাও নয়। কাগজ আর তুলো দিয়ে তৈরি একটা পুতুল!

টম শেফার্ড সেটাও সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলেন। পা—জামা পরা অবস্থাতেই তিনি ঘরের দরজা খুলে দৌড় মারলেন ছাদের দিকে। এর ওপরেই ছাদ। একজন কেউ নিশ্চয়ই ওপর থেকে সুতোয় করে এই পুতুলটা ঝোলাচ্ছিল!

শব্দ পেয়ে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ফিলিপ মলবার্ড। গ্লোরিয়াও স্বামীর সঙ্গ ছাড়লো না।

টম শেফার্ডই আগে উঠে এসে দেখলেন অন্য একটা দরজা দিয়ে একজন লোক পালাবার চেষ্টা করছে। টম শেফার্ড রিভালভার তুলে চেঁচিয়ে বললেন, থামো। না হলে আমি তোমার মাথায় খুলি উড়িয়ে দেবো! হাত তেলো মাথার ওপরে।

লোকটি দু’হাত তুলে ঘুরে দাঁড়ালো।

অমল ভট্টাচার্য!

টম শেফার্ড কাছে এসে বললেন, তুমি ওই খেলনা পুতুল ঝুলিয়ে আমাদের ভয় দেখাবে ভেবেছিলে?

অমল ভট্টচার্য গ্লেরিয়ার দিকে তাকিয়ে ভয় দেখানো বিকৃত কণ্ঠে বললো, ম্যাডাম, ওই হীরে গলায় দেবেন না, দেবতার অভিশাপ লাগবে! সাবধান!

ফিলিপ লমবার্ড ওর টুঁটি চেপে ধরে বললো, একে এক্ষুণি পুলিশে দিতে হবে!

টম শেফার্ড বললেন, না ওকে ছেড়ে দাও। ও হাজার চেষ্টা করেও আমাদের ভয় দেখাতে পারবে না। ওকে পুলিশে দিতে চাই না, কারণ তাতে বড্ড লোক জানাজানি হবে। আমি পাবলিসিটি ঘৃণা করি। ওহে ভারতীয়, আমি জীবনে কখনো যেন তোমাকে চোখের সামনে না দেখি! তাহলে সেবার ঠিক গুলি করবো!

গল্প কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

সে রাত্তিরে তো আর কিছু ঘটলো না।

পরদিন সকালে গ্লোরিয়া আর টম শেফার্ড নেমে এলেন নীচে। হোটেলের কাউন্টারের একপাশে সেদিন একটা নতুন ব্রোঞ্জের মূর্তি দেখা গেল।

গ্লোরিয়া চমকে উঠে বললো, এটা কী?

ম্যানেজার বললো, একজন এটা আমাদের উপহার দিয়ে গেছে। এটা একটা ভারতীয় দেবতার মূর্তি। নটরাজ। খুব সুন্দর না? দেখুন, এর তিনটে চোখ। অনেক ভারতীয় দেবতার কপালে চোখ থাকে।

গ্লোরিয়ার মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বললো, থার্ড আই!

টম সেফার্ড বললেন, এখন এরকম জিনিস তুমি মাঝে মাঝে দেখবে। কোনো একটা নতুন জিনিস দেখলে কিংবা কোনো নতুন কথা শুনলে তারপর প্রায়ই সেটা দেখতে বা শুনতে পাওয়া যায়।

সেদিন সন্ধেবেলা বিরাট পার্টি হল। বন্ধুরা এসেছিল সবাই। অমন সুন্দর, দুর্লভ, হীরে গলায় দিয়ে গ্লোরিয়াকে দেখাচ্ছিল রানীর মতন। কিন্তু তার মুখখানা ম্লান। কেমন যেন ভয় পাওয়া ভাব। এক সময় হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সে।

তারপর আর পার্টি জমে না। গ্লোরিয়াকে ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দেওয়া হলো। নিজের বিছানায়। একটু পরেই তার জ্ঞান ফিরে এলো বটে, কিন্তু মাঝে মাঝেই সে চেঁচিয়ে উঠতে লাগলো, ওই যে! ওই যে! ভারতীয় দেবতা।

টম শেফার্ড খুব ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে জানলেন যে অমল ভট্টচার্য নামে ভারতীয় সেই যুবক সন্ধেবেলা হোটেলের ধারে কাছেও আসেনি। কোনো ভারতীয়কেই কেউ দেখেনি!

পরদিনই টম শেফার্ড গ্লোরিয়াকে নিয়ে চলে গেলেন লন্ডনে। সেখানেও হোটেলের জানালার গ্লোরিয়া দেখতে পেল শিব ঠাকুরের মূর্তি। টম শেফার্ড হাজার বুঝিয়েও তাকে ঠাণ্ডা করতে পারলেন না। সে মাঝে মাঝেই চিৎকার করে ওঠে।

টম শেফার্ড স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে গেলেন আমেরিকায়।

নিউ ইয়র্কে থাকলেন কিছুদিন। লং আয়র্ল্যান্ডে তাঁর বাড়ি আছে। গ্লোরিয়া এখানে দু’সপ্তাহ বেশ ভালোই রইল। তারপর আবার সে একদিন একটা কিউরিয়োর দোকানে মস্ত বড় একটা পেতলের নটরাজ মূর্তি দেখতে পেল। সেইদিন রাত্তিরে সে তার জানালায় আবার শিব ঠাকুরের ছায়ামূর্তি দেখে আঁৎকে উঠল।

টম শেফার্ড এবার চলে এলেন টেক্সাসে। হস্টন শহর থেকে খানিকটা দূরে রয়েছে তাঁর বাগানবাড়ি। এখানকার ভাষায় র‌্যাঞ্চ। এই বাড়ির কাছাকাছি কোনো ভারতীয়কে দেখতে পাবার সম্ভাবনা নেই, কোনো ভারতীয় দেবতার মূর্তি নেই। তাছাড়া টম শেফার্ড তাঁর প্রহরীদের বলে দিলেন, ধারে কাছে কোন ভারতীয়কে দেখলেই তাঁকে খবর দিতে। রাত্রিতেও বাড়ির চারপাশে পাহারা রইলো।

তবু সাতদিন পরেই দিনের বেলা গ্লোরিয়া আবার দেখতে পেল সেই ভারতীয় দেবতার মূর্তি। খুব স্পষ্ট। পরনে বাঘের ছাল, সারা গায়ে ছাই মাখা। মাথার চুলে জটা, তাতে একটা চাঁদ আর গায়ে কিল কিল করছে একটা সাপ। সেই ভারতীয় দেবতা তার দিকে তাকিয়ে বলছে, দে : দে : আমার চোখটা দে :

গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লো গ্লোরিয়া। বড় বড় ডাক্তাররা এসেও তার চিকিৎসার সুবিধে করতে পারলেন না। অমন সুন্দর তার চেহারা শুকিয়ে একেবারে দড়ির মতন হয়ে গেল প্রায়।

একদিন সে তার স্বামীকে ফিস ফিল করে বললো, ওই হীরেটা আমার কাছে থাকলে আমি ঠিক মরে যাবো!

টম শেফার্ড বললেন, ঠিক আছে, ওটা এবারে বিক্রিই করে দেবো। তোমাকে কিনে দেবো আর একটা!

গ্লেরিয়া বললো, বিক্রি করে দিলে কোনো লাভ হবে না। ভারতীয় দেবতা ওটা আমাদের কাছে ফেরৎ চাইছে। টম, ওটা আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না?

টম শেফার্ড বললেন, কাকে ফিরিয়ে দেবো?

গ্লোরিয়া বললো, কেন, ইন্ডিয়াতে সেই মহেশপুরের শিব মন্দিরে। চলো না, টম চলো। আমার খুব ইচ্ছে করছে!

টম শেফার্ড একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, চলো!

এরপরেই যেন গ্লোরিয়ার শরীর অনেকটা ভালো হয়ে গেল! পরের সপ্তাহেই ভারতে যাবার জন্য প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেল তাদের।

কে—এল—এম—এর প্লেন। মাঝপথে থামলো অ্যামস্টারডামে। সেখানে সেই প্লেনেই চাপলো অমল ভট্টাচার্য!

অমল টম শেফার্ডকে দেখে ইয়ার্কির সুরে বললো, আপনি আপনার চোখের সামনে আমাকে আসতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু আমি এখন ছুটিতে দেশে ফিরছি, এই প্লেনে গেলে নিশ্চয়ই আপনি আপত্তি করবেন না?

টম শেফার্ড বললেন, আমরা যে এই প্লেনে যাবো, আপনি জানতেন?

অমল দারুণ অবাক হয়ে বললো, কী করে জানবো? আপনারা কোথা থেকে আসছেন, তাই তো জানি না!

টম শেফার্ড বুঝলেন, অমল এটা মিথ্যে বলছে না। ওর সঙ্গে দেখা হওয়াটা হঠাৎ একটা যোগাযোগ।

গ্লোরিয়া বললো, ভালোই হলো। আমরা তোমার গ্রামেই যাচ্ছি। তুমি ইন্ডিয়ায় আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা তোমাদের দেবতার চোখ ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি!

এই কথা শুনে অমল কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে তাকিয়ে রইলো গ্লোরিয়ার দিকে। কথাটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।

কলকাতায় নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে ওরা এলো বহরমপুর। সেখানে সার্কিট হাউসে সাহেব মেমের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে অমল বললো, আপনারা এখানে বিশ্রাম করুন। আমাদের গ্রাম আরও মাইল দশেক দূরে। আমি দেখে আসি রাস্তা কী রকম আছে। তাছাড়া গ্রামের লোকদের খবর দিই, তারা একটা মিটিং—এর ব্যবস্থা করুক। এতবড় একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে, একটা বেশ উৎসব করা উচিত।

তাড়াতাড়ি একা গ্রামে চলে এলে অমল।

সেখানে তার কাকা আর দু’—তিনজন গণ্যমান্য লোককে বলেলা, শুনুন, একটা মজা হয়েছে।

অ্যামস্টারডামের ফার্স্ট ন্যাশনাল সিটি ব্যাংকে কাজ করে অমল। সেই ব্যাংকেই রাখা ছিল ‘ইভনিং স্টার’ নামে হীরেটা। ব্যাংকের যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট, তিনিই হীরেটা কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন শোনা গেল, টম শেফার্ড নামে বিশাল ধনী এক আমেরিকান ওই হীরেটা কিনতে চায়। হীরের দোকানদার অনেক দাম বাড়ালেও টম সেফার্ড ঠিকই কিনবেন। ভাইস প্রেসিডেন্টের আর আশা নেই।

তখন অমলের মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি এসেছিল। ‘থার্ড আই’ নামে আর একটা হীরে সম্পর্কে সে গল্প শুনেছিল আগে। কিন্তু সেই হীরের সঙ্গে মহেশপুরের কোনো সম্পর্কে নেই। মহেশপুরে কস্মিনকালেও অমন দামী হীরে ছিল না। সে ভেবেছিল, টম শেফার্ড গ্লোরিয়াকে ওই ‘থার্ড আই’ হীরের সঙ্গে ‘ইভনিং স্টার’কে গুলিয়ে দিয়ে, আরও গল্প বানিয়ে ও ভয় দেখিয়ে হীরেটা দু’—একদিনের মধ্যেই বিক্রি করতে বাধ্য করবে। এই ভাবে বিক্রি করলেই হীরের দাম অনেক কমে যায়।

কিন্তু টম শেফার্ড ভয় পেলেন না, উল্টো অমলকেই ভয় দেখালেন। তখন অমল হাল ছেড়ে দিল। কিন্তু তারপরেও গ্লোরিয়াকে ভয় দেখালো কে?

মহেশপুরে এখন আর কোনো শিব মন্দির নেই। গ্রামের বাইরের দিকে একটা ভাঙা মন্দির আছে বটে, কিন্তু কোনো ঠাকুর দেবতার মূর্তি নেই সেখানে। গ্রামের লোক ঠিক করলো, এতবড় একটা সুযোগ এসেছে যখন, তখন এই সুযোগে একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেই তো হয়!

সেই রাত্তিরেই ভাঙা মন্দিরটা যতদূর সম্ভব পরিষ্কার করা হয়ে গেল। দু’জন চলে গেল কৃষ্ণনগরে। সেখান থেকে একটা বেশ বড়সড় মহাদেবের মূর্তি নিয়ে আসা হলো। তার কপালে অবশ্য তিন নম্বর চোখ ছিল না, কুমোরকে বলে স্পেশাল ভাবে সেখানে একটা চোখ বসানোর মতন গর্তও রাখা হলো ঠিকঠাক।

পরদিন সকাল দশটায় বহু লোক জমা হলো সেই মন্দিরের সামনে। সবাই শুনেছে যে বহুদূর থেকে এক সাহেব—মেম এসেছে মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য।

গলায় ফুলের মালা পরে, মখমলের বাক্সাটি হাতে নিয়ে ধীর পায়ে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেল গ্লোরিয়া। ভেতরে এসে শিবঠাকুরের মূর্তিটা দেখে কয়েক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

তারপর ধরা গলায় গলায় বললো, ঠিক এই মূর্তিই বারবার দেখা দিয়েছেন আমায় জানালার ধারে। আমাকে বলেছেন, দে, দে, ফিরিযে দে। এই আমি ফিরিয়ে দিলাম। আশা করি, এবার এই দেবতা আমার ওপর প্রসন্ন হবেন।

অমল ভট্টাচার্য নিজে হাততালি দিতে দিতে বললো, সবাই হাততালি দাও! সবাই হাততালি দাও! বলো, জয় মেমসাহেবের জয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *