তৃতীয় অধ্যায় – হযরত ওসমান যুন্নুরাইন (রা) [৬৪৪-৬৫৬ খ্রি.]
হযরত ওসমান (রা)-এর প্রাথমিক জীবন
ইসলামের ইতিহাসের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা) সম্ভবত ৫৭৩ অথবা ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মক্কার প্রভাবশালী কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আফফান ও মাতা আরওয়াহ কুরাইশ বংশের উমাইয়া গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং এই গোত্রের আবু সুফিয়ান নবী করীম (স)-কে অসহ্য উৎপীড়ন করেছিল। হযরত ওসমান (রা) আবু সুফিয়ান অপেক্ষা উদার, অমায়িক, নম্র ও চরিত্রবান ছিলেন। মহানবীর পূর্বপুরুষের সঙ্গে হযরত ওসমান (রা)-এর পঞ্চম পুরুষের যোগসূত্র ছিল। হযরত ওসমান (রা)-এর ইসলাম-পূর্ব জীবনে ডাক নাম ছিল আবু আমর এবং আবদুল্লাহ।
হযরত ওসমান (রা) বাল্যকাল হতেই নম্র, সৎ, চরিত্রবান ও পরোপকারী ছিলেন। আরব দেশের সম্পদশালী ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ইসলামের আবির্ভাব এবং রাসূলের উদাত্ত আহ্বানে যে কয়েক ব্যক্তি সাড়া দিয়েছিলেন হযরত ওসমান (রা) তাঁদের নেতৃস্থানীয়। ৩৪ বছর বয়সে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে মহানবীর নিকট দীক্ষিত হয়ে তিনি ইসলামের সেবায় তাঁর ধনসম্পত্তি উৎসর্গ করেন। তাঁর চাচা হাকাম রজ্জু দ্বারা খুঁটিতে বেঁধে প্রহার করলেও তিনি তাঁর বিশ্বাসে অটল ছিলেন। নবুয়তের পূর্বে রাসূলে করীম (স)-এর দুই কন্যা বিবি রোকাইয়া ও বিবি উম্মে কুলসুমের অন্যত্র বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু ইসলাম ধর্ম প্রচারকালে তাঁরা স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্তা হলে হযরত ওসমান (রা) বিবি রোকাইয়াকে বিবাহ করেন। বিবি রোকাইয়ার ইন্তেকালের পর তিনি বিবি উম্মে কুলসুমকে বিবাহ করেন। রাসূলে করীম (স)-এর এই দুই দুহিতাকে বিবাহ করেন বলে তাকে ‘যুনুরাইন’ বা ‘দুটি জ্যোতির অধিকারী’ খেতাব প্রদান করা হয়। হযরত ওসমানকে রাসূলে করীম (স) এত বেশি স্নেহ করতেন যে, বিবি উম্মে কুলসুম ইন্তেকাল করলে নবী করীম (স) বলেন যে, তাঁর যদি অপর একটি কন্যা থাকত তা হলে তাকেও তিনি হযরত ওসমানের সঙ্গে বিবাহ দিতেন।
ইসলামের খেদমত
ইসলামের আবির্ভাব কুরাইশদের নির্যাতন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে নবী করীম (স) তাঁর সাহাবীদের আবিসিনিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। হযরত ওসমান তাঁর স্ত্রী বিবি রোকাইয়া এবং একদল মোহাজের সঙ্গে নিয়ে আবিসিনিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে দুই বৎসর থাকার পর তিনি মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করে নবী করিমের সঙ্গে মিলিত হন। মদিনায় তিনি মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য স্থায়ী ধন-সম্পত্তি ইসলামের সেবায় উৎসর্গ করেন। মদিনায় পানীয় জলের অভাব দূর করবার জন্য মহানবীর ইঙ্গিতে তিনি কূপ খননের জন্য অর্থ দান করেন। বীর রুমা নামে এই কূপটি খনন করতে ২০,০০০ দিরহাম খরচ পড়ে। স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় রাসূলে করীম (স) মদিনা মসজিদের সম্প্রসারণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে হযরত ওসমান (রা) স্বতঃস্ফূর্তভাবে মসজিদ সংলগ্ন স্থান ক্রয় করে এর সম্প্রসারণ করেন। তাবুক যুদ্ধে তিনি ১০,০০০ দিরহামযুদ্ধ তহবিলে দান করেন এবং মুসলিম বাহিনীকে শক্তিশালী করবার উদ্দেশ্যে তিনি রোমীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে এক হাজার উষ্ট্র প্রদান করেন। বদরের যুদ্ধ ব্যতীত তিনি কুরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতিটি যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বিবি রোকাইয়া অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূলের নির্দেশে হযরত ওসমান বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদনের জন্য তিনি নিজ জীবন বিপন্ন করে। কুরাইশদের সাথে শান্তির আলোচনা করতে যান। কুরাইশগণ তাঁকে বন্দী করে রাখায় তিনি বিখ্যাত হুদায়বিয়ার সন্ধিতে স্বাক্ষর করতে পারেন নি। তাঁর বিচক্ষণতা ও নির্ভীকতা ব্যতীত কুরাইশ এবং মুসলমানদের মধ্যে সন্ধি স্থাপন সুদূর পরাহত ছিল। হযরত আবুবকর এবং হযরত ওমরের খিলাফতে হযরত ওসমান রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হযরত আবুবকর (রা) হযরত ওমর (রা)-কে মনোনীত করবার পূর্বে আবদুর রহমান-ইবন-আউফ এবং হযরত ওসমানের সঙ্গে পরামর্শ করেন। হযরত ওমরের খিলাফতে তিনি মজলিস-উস-শূরার একজন উপদেষ্টা ছিলেন।
হযরত ওসমানের নির্বাচন
ইন্তেকালের পূর্বে হযরত ওমর (রা) তাঁর উত্তরাধিকারী নির্ধারণের জন্য ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি নির্বাচনী পরিষদ গঠন করেন। এই পরিষদের সদস্য ছিলেন হযরত ওসমান, হযরত আলী, তালহা, যুবাইর, আবদুর রহমান-বিন-আউফ ও সা’দ-বিন- আবি-ওয়াক্কাস। হযরত ওমর (রা) অন্তিম শয্যায় এই পরিষদকে তাঁর মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে যোগ্যতম ব্যক্তিকে খলিফা নির্বাচিত করবার দায়িত্ব দেন। এই ছয় জনের সকলেই রাসূলে করীমের প্রিয়পাত্র ও অনুগামী ছিলেন এবং প্রত্যেকেই ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। তালহা মদিনায় উপস্থিত না থাকায় বাকি পাঁচজন হযরত ওমর (রা)-এর মৃত্যুর পর বিবি আয়েশার প্রকোষ্ঠ সংলগ্ন কোষাগারে নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনার জন্য মিলিত হন। হযরত আবুবকর (রা) এবং হযরত ওমর (রা) অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন খলিফা ছিলেন এবং এই কারণে তাঁদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোন প্রকার মতানৈক্য প্রকাশ পায় নাই। তৃতীয় খলিফা নির্বাচনে প্রার্থীদের সকলেই সম- ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও প্রভাবশালী হওয়ায় নির্বাচন একটি জটিল আকার ধারণ করে। আবু উবায়দা জীবিত থাকলে তিনি খলিফার উত্তরাধিকারী হতেন কিন্তু তিনি জীবিত নেই। আবদুর রহমান তৎকালীন আরবে শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন এবং বিচক্ষণতা ও দানশীলতার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু তিনি খলিফার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে স্বীকৃত হলেন না; হযরত আলী (রা) রাসূলে করীমের চাচাত ভাই ও জামাতা ছিলেন এবং শৌর্যে- বীর্যে, শিক্ষায়-দীক্ষায় তিনিই প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। সা’দ-বিন-আবি-ওয়াক্কাস পারস্য বিজয় করে খ্যাতি এবং প্রতিপত্তি অর্জন করেন। অপরদিকে তালহা ও যুবাইর রাসূলুল্লাহর অনুগত সাহাবী ছিলেন এবং জান্নাতবাসী দশ ব্যক্তিদের (Blessed Ten ) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
খিলাফতকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির সম্ভাবনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আবদুর রহমান স্বীয় দাবি প্রত্যাহার করে অপরাপর প্রার্থীদের মধ্যে আপোষ- মীমাংসার চেষ্টা করেন। যুবাইর, হযরত ওসমান ও হযরত আলী উভয়কেই সমর্থন করেন; সা’দ ওসমানকে, ওসমান আলীকে এবং আলীও ওসমানকে সমর্থন করেন। বয়োজ্যেষ্ঠতায়, ইসলামের সেবায় নিঃসংকোচে অর্থদান এবং রাসূলের দুই কন্যাকে বিবাহ করে ‘যুনুরাইন’ খেতাব লাভের ফলে হযরত ওসমানের পক্ষে দুইটি এবং হযরত আলীর পক্ষে একটি ভোট পড়ে এর ফলে সর্বসম্মতিক্রমে আবদুর রহমান হযরত ওসমানকে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত বলে ঘোষণা করেন। জনমত যাচাইয়ের জন্য তিনি প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি যেতেও কুণ্ঠিত হন নি। খলিফা ওমরের মৃত্যুর চতুর্থ দিবসে আনসার, মোহাজেরগণ হযরত ওসমানের আনুগত্য স্বীকার করেন। পরবর্তী সময়ে তালহা মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলে হযরত ওসমান তাঁকে খলিফা পদ গ্রহণের অনুরোধ করেন কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচিত খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
তৃতীয় খলিফার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। আমীর আলী বলেন, “তার নির্বাচন পরিশেষে ইসলামের ধ্বংস আনে… ওসমানের শাসনকালে বনু হাশিম এবং বনু উমাইয়ার মধ্যে যে শত্রুতা আরম্ভ হল, তা শতাব্দীরও অধিককাল স্থায়ী হয়েছিল।” হযরত ওসমানের খলিফা নিযুক্তিতে হযরত আলী ও তাঁর সমর্থকগণ সন্তুষ্ট হতে পারেননি। অপরদিকে হাশেমীয়দের উপর উমাইয়া গোত্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে কুরাইশ বংশের এই দুই শত্রুভাবাপন্ন গোত্রদ্বয়ের মধ্যে স্বার্থ-সংঘাত নতুন রূপ ধারণ করে। মূইর যথার্থই বলেন, “পরবর্তীকালে এটি নানা কলহ-বিবাদের সৃষ্টি করে যার ফলে সমগ্র মুসলিম জগতে বছরের পর বছর রক্তপাত হয়।
ইসলামের বিজয়
পূর্বাঞ্চলে অভিযান : বিশাল মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হযরত ওমর (রা) সুখ্যাতি অর্জন করেন। খলিফা ওসমান (রা) শাসনভার গ্রহণ করে বিজিত অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন এবং পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ইসলামের সম্প্রসারণ করেন হযরত ওমর (রা)- এর মৃত্যুর পর পারস্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে হযরত ওসমান (রা) সেখানে মুসলিম আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি সৈন্যদল প্রেলন করেন। বসরার শাসনকর্তা ইবনে আমীর পারস্য সংলগ্ন প্রদেশগুলো হস্তগত করে উত্তর দিকে ও পূর্ব দিকে এক বিরাট অভিযান পরিচালিত করেন।
এরূপে নিশাপুর, মার্ভ, বলখ, তুখারিস্তান প্রভৃতি অঞ্চল খলিফার শাসনাধীনে আসে। ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে সাসানীয় বংশের শেষ সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদিগার্দ শোচনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মুসলিম অভিযান অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে ইরান, কাবুল, গজনী, কিরমান, মাকরান, সিজিস্তান মুসলমানদের দখলে আসে। কাস্পিয়ান সাগরের পশ্চিম তীরস্থ তুর্কী এবং খাজারদিগের বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক অভিযান প্রেরণ করলে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। এই পরাজয়ের গ্লানি মোচনের জন্য মুসলিম বাহিনী সুসংঘবদ্ধ হয়ে প্রবল বিক্রমে অভিযান পরিচালিত করে ইসলামের আধিপত্য পূর্ব ও উত্তরে বহুদূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে।
পশ্চিমাঞ্চলে অভিযান
হযরত ওমর (রা)-এর খিলাফতকালে মুয়াবিয়া সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং খলিফা ওসমানের সময় তিনি তাঁর পূর্বের পদে বহাল ছিলেন। ৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে এশিয়া মাইনর হতে একটি বিশাল বায়জানটাইন সৈন্যবাহিনী সিরিয়া আক্রমণ করে। নিয়মিত মুসলিম বাহিনীর সাথে খলিফার প্রেরিত ৮০০ সৈন্য যোগদান করলে মুয়াবিয়া এর সাহায্যে বায়জানটাইন আক্রমণ প্রতিহত করেন। শত্রুর পশ্চাদ্ধাবন করে তারা এশিয়া মাইনর দখল করেন এবং আর্মেনিয়ার মধ্য দিয়ে তাজাকিস্তান পৌঁছে এবং কাম্পিয়ান সাগরের পূর্বতীরস্থ মুসলিম বাহিনীর সাথে মিলিত হন। এর পর মুসলিম বাহিনী উত্তর দিকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এইভাবে হযরত ওসমানের মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে মুয়াবিয়া কনস্টান্টিনোপলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ দখল করতে সক্ষম হন।
হযরত ওমরের মৃত্যুর পর বায়জানটাইন সম্রাট আলেকজান্দ্রিয়া পুনর্দখলের জন্য এক বিরাট নৌ-বাহিনী প্রেরণ করেন। আলেকজান্দ্রিয়া বায়জানটাইনদের হস্তগত হলে মিসরের শাসনকর্তা আমর-বিন-আল-আস এটি পুনর্দখলের চেষ্টা করেন। ইবন-আবি- সারাহ মিসর ও আফ্রিকার কাফেলাগুলো হতে বাছাই করা সৈন্য নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় অভিযান পরিচালনা করেন। বায়জানটাইন সৈন্য মুসলমানদের তীব্র আক্রমণে পশ্চাদগমনে বাধ্য হয় এবং সেনাপতি সেরাফুজে পলায়ন করেন। আবদুল্লাহ ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার অধিবাসীদিগের সাথে সন্ধি করে সেখানে আরব প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেন। এই ঘটনার পর আমরকে মিসরের শাসনভার হতে অব্যাহতি দিয়ে খলিফা তাঁর পালিত ভ্রাতা আবদুল্লাহ-ইবন-সা’দকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
পশ্চিমাঞ্চলে গোলযোগ শুরু হলে আবদুল্লাহ-ইবন-সা’দ এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে উত্তর আফ্রিকার বারকা ও ত্রিপলীর দিকে অভিযান করেন। ত্রিপলীর বায়জানটাইন শাসনকর্তা গ্রেগরী মুসলমানদের বিরুদ্ধে কার্থেজে এক প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুসলিম বাহিনীর কার্থেজ বিজয়ের পর গ্রেগরী নিহত হন এবং ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপলী মুসলমানদের অধিকারে আসে। খলিফা ওমর ভুমধ্যসাগরে নৌ-অভিযান প্রেরণে প্রতিকূল অবস্থার কথা চিন্তা করে অনুমতি দিতে দ্বিধা করেন। হযরত ওসমান (রা) খিলাফত লাভ করে মুয়াবিয়াকে সাইপ্রাস অভিযানে অনুমতি প্রদান করেন। ৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে আবদুল্লাহ বিন-কায়েসের নেতৃত্বে প্রথম মুসলিম নৌ-বহর সাইপ্রাস অভিমুখে যাত্রা করে। মিসরবাসী এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় আরব যোদ্ধাদের একত্র করে আবদুল্লাহ- বিন-কায়েস নৌ-অভিযান পরিচালনা করে সাইপ্রাস দখল করেন। কায়েস যুদ্ধে নিহত হলে সাফওয়ান-বিন-আউফ নৌ-বহরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। সাইপ্রাসবাসীরা বাৎসরিক ৭,০০০ দিনার কর প্রদানের অঙ্গীকার করে কিন্তু নিরাপত্তা বিধানের অসুবিধা থাকায় পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং ৬৫৩-৬৫৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে তারা মুসলিম শাসনাধীনে আসেনি। এর পর রোডস দ্বীপ মুসলমানগণ বিজয় করে সিসিলি দ্বীপে আক্রমণ পরিচালনা করে। হযরত ওসমানের শাসনকালে মুসলিম শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তাঁর খিলাফতেই সর্বপ্রথম নৌ-বাহিনী গঠিত হলে ভূমধ্যসাগরীয় কতিপয় দ্বীপপুঞ্জে মুসলিম আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
হযরত ওসমানের খিলাফতে অসন্তোষ ও বিদ্রোহ
হযরত ওসমান (রা)-এর বিরুদ্ধে তথাকথিত অভিযোগ : হযরত ওসমান (রা) – এর বার বছরের খিলাফতকে মোটামুটিভাবে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে : প্রথম ছয় বছর (৬৪৪-৬৫০ খ্রি.) শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, বিজয় ও গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে শেষ ছয় বৎসর (৬৫০-৬৫৬ খ্রি.) তাঁর শাসনকাল অসন্তোষ, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, বিদ্রোহ ও পরিশেষে রক্তপাতের করুন ও মর্মঅন্তিক কাহিনীতে কলুষিত। অস্থিরমতি, বিদ্রোহীভাবাপন্ন কতিপয় মুসলমান হযরত ওসমানের সরলতা, অকৃত্রিম মানবপ্রেম, উদারতা ও ধর্মভীরুতার সুযোগ গ্রহণ করে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি তথাকথিত অভিযোগ আনয়ন করেন; যথা- (ক) স্বজনপ্রীতি, (খ) কুরআন শরীফ দগ্ধীকরণ, (গ) চারণভূমির রক্ষণাবেক্ষণ, (ঘ) আবু-জর-গিফারীর ন্যায় বিশিষ্ট সাহাবীর অসম্মান ও (ঙ) আত্মীয়-স্বজনদিগকে বায়তুল মাল হতে অর্থ দান।
(ক) স্বজনপ্রীতি : হযরত ওসমান (রা)-এর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ আরব বেদুঈন এবং অনারব মুসলমানদের প্রধান অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি রাসূলে করীম (স)-এর ঘনিষ্ঠ সহচর ও অনুগামীদের অপসারণ করে স্বীয় আত্মীয়-স্বজনকে প্রাদেশিক গভর্নরের পদে নিযুক্ত করেন। বিদ্রোহীরা দাবি করে যে, খলিফা অভিজ্ঞ, বয়স্ক, যোগ্য এবং ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত শাসনকর্তাদের পদচ্যুত করে পক্ষপাতিত্ব ও স্বজন-প্রীতি নীতির প্রভাবে অপেক্ষাকৃত অযোগ্য, অনভিজ্ঞ, ইসলামের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন নিকট-আত্মীয়, গোত্রের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের সেই সমস্ত পদে নিযুক্ত করেন। উল্লেখযোগ্য যে, হিট্টি, মূইর, ভনক্রেমার এমনকি মাসুদী এবং আমীর আলীও এই ভ্রান্তমত পোষণ করেন। কিন্তু যুক্তি দ্বারা বিচার করলে প্রমাণিত হবে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এবং এর গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধির প্রয়োজনেই হযরত ওসমানকে নতুন শাসনকর্তা নিযুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছিল। নিরপেক্ষ বিচারে আরও প্রমাণিত হবে যে, কুফা, বসরা ও মিসরের বিদ্রোহীদের আনীত অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন ছিল।
হযরত ওসমান (রা)-এর বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি স্বার্থ-প্রণোদিত হয়ে হযরত ওমর (রা) কর্তৃক নিযুক্ত পারস্য বিজয়ী সা’দ-বিন-আবি- ওয়াক্কাসকে অপসারণ করে তাঁর দুধভাই (Uterine brother) ওয়ালিদ-বিন-ওকবাকে কুফায়, হযরত ওমর কর্তৃক নিযুক্ত আমর-ইবন-আল-আসকে পদচ্যুত করে তাঁর পালিত ভাই (Foster brother) আবদুল্লাহ ইবন আবি সা’দকে মিসরে; হযরত ওমর কর্তৃক নিযুক্ত আবু-মুসা-আল-আসারীকে অপসারিত করে খলিফার পিতৃব্য আবদুল্লাহ-ইবন- আমীরকে বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এছাড়া হযরত ওসমান সিরিয়ায় উমাইয়া বংশের প্রভাবশালী ও যোগ্য ব্যক্তি মুয়াবিয়াকে শাসনকর্তারূপে প্রতিষ্ঠিত করলে বিদ্রোহীগণ তথাকথিত পক্ষাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি নীতির সমালোচনা করে; কারন, মুয়াবিয়া খলিফার গোত্রভুক্ত ছিলেন।
বিভিন্ন প্রদেশের শাসনব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন রাষ্ট্রের সংহতি এবং মঙ্গলের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। শাসনকর্তা নিযুক্তি এবং তার অপসারণের মূল ঘটনাবলি যাচাই করলে প্রতীয়মান হবে যে, খলিফা ওসমান পক্ষপাতনীতিতে দুষ্ট ছিলেন না। নিরপেক্ষ বিচারে প্রমাণিত হবে যে, প্রথম হযরত ওসমান সা’দকে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন নি, হযরত ওমরই পারস্য বিজয়ী সা’দকে নিযুক্ত করেন এবং হযরত ওসমান কর্তৃক অপসারিত হবার পূর্বেই হযরত ওমর তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ পেয়ে তাঁকে পদচ্যুত করেন এবং তাঁর স্থলে মুগীরাকে নিযুক্ত করেন। মুগীরা-বিন- শায়বার উদ্ধত স্বভাব ও রূঢ় ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে কুফাবাসী মুগীরাকে অপসারণের জন্য ঘন ঘন আবেদন করতে থাকলে হযরত ওসমান হযরত ওমরের মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে তাঁকে অপসারণ করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, সাদ-এর পদচ্যুতি সত্ত্বেও তাঁকে পুনরায় কুফার শাসনকর্তারূপে বহাল করা হয়। খলিফা এ ক্ষেত্রে সা’দ-এর স্থলে স্বীয় দুধ ভাই ওয়ালিদ-বিন-ওকবাকে মুগীরার উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সা’দের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ সম্পর্কিত কোন অভিযোগ ছিল না- একথা খলিফা ওমর বলে গিয়েছেন। কিন্তু পারস্য সেনাদের বৈভব ও ঐশ্বর্যে তিনি এতই প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন যে, কখনও বিলাসিতা ও অমিতব্যয়িতা পরিহার করতে পারেননি। সা’দ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বায়তুল মাল থেকে অর্থ ঋণ গ্রহণ করেন কিন্তু পুনঃ পুনঃ তাগিদ সত্ত্বেও তিনি ঋণ পরিশোধ না করলে তাঁর সাথে কোষাধ্যক্ষ আবদুল্লাহ-বিন-মাসুদের মনোমালিন্য ও বচসার সৃষ্টি হয়। সাদকে দোষী সাব্যস্ত করে পদচ্যুত করা হয় এবং তাঁর শূন্যপদে ওয়ালিদ-বিন-ওকবাকে নিযুক্ত করা হয়। ন্যায়বান, সুশাসক ও বিশ্বাসী সাহাবী সা’দ পদচ্যুত হয়েও খলিফা ওসমানের বিরোধিতা করেননি। দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে বলা যেতে পারে যে, স্বীয় উমাইয়া গোত্রীয় ও দুধ ভ্রাতা হয়েও খলিফা ওসমান তাঁর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, মদ্যপান ও সহিষ্ণুতার অভিযোগে তাকে পদচ্যুত করতে এবং ইসলামের বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট শাস্তি বেত্রাঘাত প্রদান করতে দ্বিধা করেননি। ওয়ালিদের পরে জনগণের ইচ্ছায় সাঈদ-আল-আসকে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সুতরাং নিকট-আত্মীয়দের দায়িত্বসম্পন্ন পদে অধিষ্ঠিত করে তিনি যে স্বজনপ্রীতির দোষে অভিযুক্ত ছিলেন- একথা একেবারেই ভিত্তিহীন। তিনি যদি পক্ষপাতনীতি অবলম্বন করতেন তা হলে সহজেই ওয়ালিদের দোষ চাপা দিয়ে তাকে কুফার শাসনকর্তার পদে বহাল রাখতেন। খলিফার অপর একজন আত্মীয় সাঈদ-ইবন- আস ওয়ালিদের স্থলাভিষিক্ত হলে কুফার বিদ্রোহীরা খলিফার বিরুদ্ধে প্ররোচনা জোরদার করে। এ থেকে প্রতীয়মান হবে যে, সাঈদ আত্মীয় হয়েও খলিফার বিরুদ্ধাচরণ করতে ইতস্তত করেন নি। রাষ্ট্রের স্বার্থে ও নিরাপত্তার জন্য তিনি শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন-ব্যক্তিস্বার্থে নয়। খলিফা ওসমানের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রমাণ পাওয়া যায় চক্রান্তকারী, অসৎ ও বিলাস-বাসনে মগ্ন গভর্নরদের অপসারণে। ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহী এবং অযোগ্য সাঈদকে পদচ্যুত করে তিনি আবু মুসা আল- আসারীকে কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। খলিফার সাথে তাঁর কোনরূপ রক্তের সম্পর্ক ছিল না।
হযরত ওসমান (রা) আবু মুসা-আল-আসয়ারীকে কুফা ও বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত করবার পর ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বসরার অধিবাসিগণ তাঁর বিরুদ্ধে কুরাইশদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ করলে খলিফা তাঁকে অপসারণ করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন তাঁর পিতৃব্য আবদুল্লাহ ইবন-আমীর। পারস্যে বিদ্রোহ দমন করে মার্ভ, নিশাপুর প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে তিনি সামরিক দক্ষতা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। তাঁর যোগ্যতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও বিচার ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে খলিফা তাঁকে গভর্নরের মত দায়িত্বসম্পন্ন পদে অভিষিক্ত করেন- তাঁর পিতৃব্য বলে নহে। কিন্তু অস্থিরমতিত্ব ও আবেগপ্রবণ বসরাবাসীরা আবদুল্লাহর সাথে খলিফার আত্মীয়তা থাকার কারণে নানারূপ মিথ্যা অভিযোগ করতে থাকে। এর ফলে তাঁকেও পদচ্যুত করে বসরাবাসীদের মনোনীত ব্যক্তি মুহাম্মদ-ইবন-আবুবকরকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
মিসর বিজয়ী আমর ইবন-আল-আস হযরত ওমরের শাসনকালেই মিসরের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং হযরত ওসমানের খিলাফতের চতুর্থ বছর (৬৪৮ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু মিসরের রাজস্ব-সচিব আবদুল্লাহ-ইবন-আবি-সা’দ- এর সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলে খলিফা ওসমান আমরের মত সুযোগ্য শাসক ও দক্ষ যোদ্ধাকেও পদচ্যুত করতে দ্বিধা করেননি। তাঁর দক্ষতা ও বীরত্বপূর্ণ অভিযান ইসলামের আধিপত্যকে উত্তর আফ্রিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত করে। তিনি একটি শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গঠন করে পশ্চিমাঞ্চলে ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন করেন। প্রেগরীর বিশাল বাহিনীর পরাজয় এবং বায়জানটাইন নৌবহরের বিপর্যয়ের, রোডস্ ও সাইপ্রাস অধিকারে প্রমাণিত হয়েছে যে, খলিফা আবদুল্লাহকে যোগ্যতার ভিত্তিতে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। পক্ষপাতনীতি তাঁর সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধিকে প্রভাবান্বিত করেনি। তাঁর স্বজনপ্রীতি প্রকট হলে তিনি বিদ্রোহীদের দাবিতে আবদুল্লাহকে পদচ্যুত এবং বিদ্রোহীদের মনোনীত প্রার্থী মুহাম্মদ-ইবন-আবুবকরকে তার স্থলাভিষিক্ত করতেন না।
হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনয়ন করে অনারব মুসলিম অধিবাসীগণ প্ররোচনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তারা বলেন যে, উমাইয়া বংশের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে সিরিয়ায় শাসনকর্তা নিযুক্ত করে আরব মুসলিমের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রখ্যাত যোদ্ধা, সুদক্ষ শাসক এবং বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ মুয়াবিয়া সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের একমাত্র অভিযোগ ছিল এই যে, মুয়াবিয়া খলিফার গোত্র-সম্ভূত ছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ হতে বিচার করলে প্রমাণিত হবে যে, মুয়াবিয়া হযরত ওমরের সময় মিসরের গভর্নরের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং হযরত ওসমান তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা, প্রশাসনিক দক্ষতা, ন্যায়বিচার ও সামরিক প্রজ্ঞার জন্য তাঁকে উক্ত পদে বহাল রাখেন মাত্র।
বিভিন্ন প্রদেশের শাসন ব্যবস্থায় হযরত ওসমানের খিলাফতে যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় তার ভিত্তিতেই আরবের বিদ্রোহী মুসলমানগণ তাঁর বিরুদ্ধে স্বজন-প্রীতি ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনয়ন করে বিশৃঙ্খলা এবং চক্রান্তমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। আমীর আলী বলেন, “হযরত ওসমান হযরত ওমর কর্তৃক নিয়োজিত প্রায় সমস্ত শাসনকর্তা, সমরকুশলীকে পদচ্যুত করেন এবং তাঁদের স্থলে তাঁর নিজস্ব পরিবারের অযোগ্য এবং অপদার্থ সদস্যদের নিযুক্ত করেন।” এই মন্তব্য ভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। হযরত ওসমান যে স্বীয় আত্মীয়দের প্রতি দুর্বলতা, পক্ষপাত-নীতি ও স্বজনপ্রীতির মনোভাব প্রকাশ করেননি তা কয়েকটি যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করা যায়। প্রথমত, নবনিযুক্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সকলেই হযরত ওসমানের অতি নিকট ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন না; কেহ ছিলেন পালিত ভ্রাতা, কেহ দুধভাই এবং মুয়াবিয়ার সঙ্গে তাঁর গোত্রীয় সম্বন্ধ ছিল মাত্র। দ্বিতীয়ত, মৌলানা মুহাম্মদ আলী যথার্থই বলেছিলেন, “যদি তিনি আত্মীয়দের নিযুক্ত করে থাকেন তা হলে একইভাবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনীত হবার পর তাদের অপসারিতও করেন। তথাকথিত নিকট-আত্মীয় হলেও তিনি বিন্দুমাত্র দুর্বলতা প্রকাশ করেননি। তৃতীয়ত, সাধারণত বলা হয় যে, প্রথম ছয় বছর হযরত ওসমান শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন এবং শেষের ছয় বছরে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে রদবদলের জন্য অরাকতা ও বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, খিলাফতের শেষভাগে বিদ্রোহ ও অসন্তোষ শুরু হবার পূর্বেই তিনি তাঁর কয়েকজন আত্মীয়কে যোগ্যতার ভিত্তিতে শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। মুয়াবিয়া হযরত ওমরের শাসনকাল হতে সিরিয়া শাসন করছিলেন। সুতরাং যে সময়ে তারা নিযুক্ত হয়েছিলেন তখন কেহই তাদের বিরুদ্ধাচরণ করেন নি। পরবর্তীকালে মিসর, কুফা ও বসরায় অনারব মুসলমানগণ স্বার্থ-প্রণোদিত হয়ে খলিফার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনয়ন করে। চতুর্থত, একথা অনস্বীকার্য যে, নিকট-আত্মীয় হলেও হযরত ওসমান যে সমস্ত ব্যক্তিকে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন তারা অভিজ্ঞ শাসক, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, অসাধারণ রণ-কুশলী ছিলেন। তাঁদের কার্যকলাপে তা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী বিদ্রোহীরা খলিফার সাথে তাঁদের আত্মীয়তাকে মূলধন করে তাঁর বিরুদ্ধে মারণাস্ত্ররূপে তা ব্যবহার করে। পঞ্চমত, বার্নাড লুইস বলেন, “তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ধর্মীয় অথবা ব্যক্তিগত বিদ্রোহ ছিল না। এটি ছিল কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বেদুঈনদের বিদ্রোহ- কেবল হযরত ওসমানের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নহে, যে কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।”
(খ) কুরআন শরীফ দগ্ধীকরণ : হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুতর ছিল কুরআন শরীফের দগ্ধীকরণ। হযরত ওমর এবং হযরত ওসমানের খিলাফতে ইসলামের প্রাধান্য সুদূর মধ্য এশিয়া হতে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হলে দূরাঞ্চলসমূহে কুরআন শরীফ পাঠ, আবৃত্তি ও উচ্চারণ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই বিশাল নবীন ইসলামী রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতির বাস ছিল এবং নব-দীক্ষিত বিভিন্ন জাতি হতে উদ্ভূত মুসলমানগণ তাদের চলিত ও স্থানীয় ভাষায় আবৃত্তি ও উচ্চারণ করে কুরআন শরীফের পাঠ ও উচ্চারণের মধ্যে কোন মিল থাকত না। উচ্চারণের প্রভেদ ছাড়া কখনও কখনও কুরআনের ভাষা ও (Script) ভিন্নতর হতে লাগল। বিশেষ করে অনারব অঞ্চলের জনসাধারণ নিজেদের সুবিধার জন্য উচ্চারণের পরিবর্তন করে কুরআন পাঠ করত। এমন কি হযরত ওমরের খিলাফতে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহেও কুরআনের আবৃত্তি একই ধরনের করা হত না। উপরন্তু, মুসলমানদের ব্যবহারের জন্য সংকলন ও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত কোন কুরআন শরীফ সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। এই অসুবিধার জন্য চক্রান্তকারী ও বিভ্রান্তকারীরা কুরআনের বাণী বিকৃত করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে দ্বিধা করত না। হযরত আবুবকর এবং হযরত ওমরের সময়ে কুরআনের একটি কপি বিবি হাফসার নিকট সংরক্ষিত ছিল। খলিফা ওসমান হাফিজ এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিয়ে একটি সংকলন কমিটি গঠন করেন। হুযায়ফা নামক জনৈক ব্যক্তি আজারবাইযান এলাকায় বিভিন্ন প্রকারে কুরআন পাঠ করছে- এই সংবাদ খলিফার নিকট জানালে খলিফা তা রোধকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে গঠিত এই কমিটি কর্তক যায়েদ-বিন-ছাবিতের পরিচালনায় কুরআনকে ভ্রান্তিমুক্ত করবার সুপরিকল্পিত কার্যক্রম গ্রহণ করে। এই কমিটি বিবি হাফসার নিকট সংরক্ষিত কুরআন শরীফের পাণ্ডুলিপি সর্বসম্মতিক্রমে অভ্রান্ত এবং রাসূলে করীম (স) কর্তৃক বর্ণিত মূল আয়াতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। খলিফা ওসমানের নির্দেশে ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহৃত ভ্রান্তিপূর্ণ কুরআন শরীফের পাণ্ডুলিপিগুলো সংগ্রহ করা হয় এবং সংগতিহীন ও অপ্রমাণিত বলে সেগুলো দগ্ধীভূত করা হয়। সে সঙ্গে গৃহীত ও নির্ভুল কুরআন শরীফের সংকলিত কপিগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে বিতরণ করা হয়। কুরআনের নির্ভুল সংস্কার সাধন খলিফা ওসমানের একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি। কিন্তু চক্রান্তকারী, স্বার্থান্বেষী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা খলিফা ওসমান (রা)-এর বিরুদ্ধে ধর্মগ্রন্থ অবমাননার অভিযোগ আনয়ন করে। গোঁড়া ও ধর্মভীরু মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবার জন্য এই সমস্ত বিদ্রোহীরা প্রচারণা করতে থাকে যে খলিফা পবিত্র কুরআনের অমর্যাদা করেছেন এবং এটি তাঁর অমার্জনীয় ও গর্হিত কার্য বলে চিহ্নিত করা হয়।
হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে আনীত কুরআন শরীফ দগ্ধীকরণের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিকর। প্রথমত, হযরতও ওসমানকে ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে না। কারণ তিনি স্বয়ং তা করেন নি। মৌলানা মুহাম্মদ আলী যথার্থই বলেন, “ধর্মীয় অথবা অপবিত্রকরণ যাই হউক না কেন, এটি হযরত ওসমানের নিজস্ব কার্য ছিল না; এটি একটি পরিষদের দায়িত্বসম্পন্ন মুসলমানদের সম্মিলিত কাজ ছিল।” দ্বিতীয়ত, কুরআন শরীফ ভস্মীভূত করার অভিযোগ অযৌক্তিক; কারণ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ও সুসামঞ্জস্যভাবে সংকলিত বিবি হাফসার নিকট সংরক্ষিত কুরআন শরীফই আসল ( Authentic) মুসলিম ধর্মগ্রন্থ বলে স্বীকৃত এবং ভ্রান্তিপূর্ণ কপিগুলো দগ্ধীভূত না হলে পরবর্তীকালে এটি সঠিক কপি হিসেবে মুসলমানদের নিকট মর্যাদা লাভ করত না। বিকৃত, ভ্রান্তিকর, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও সংগতিহীন কুরআনের কপিগুলো ধ্বংস করবার নির্দেশ দেওয়া হয় যাতে ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বত্র একই ধরনের (Standard text) গ্রন্থ, ভাষা, উচ্চারণ, আবৃত্তি প্রচলিত হতে পারে। তৃতীয়ত, খলিফা ওসমান ভ্রান্তিপূর্ণ কুরআনের কপিগুলো ভস্মীভূত করার আদেশ দেন। ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্রের স্বার্থে— নিজস্ব স্বার্থে নহে। সংহতি ও শান্তি বজায় রাখবার জন্য ধর্মগ্রন্থকে মূলধন করে যাতে মুসলমানগণ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তিনি ধর্মের অবমাননা করেন নি বরং সংকলিত কুরআন লিপিবদ্ধ করে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করেন। তাঁর দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া হযরত আলীর বিরুদ্ধে সিফ্ফিনের যুদ্ধে কুরআনের পাতাগুলো তরবারির অগ্রে বিদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি করেন। চতুর্থত, হযরত ওসমান সংকলিত কুরআনের কয়েকটি কপি বসরা, কুফা, দামেস্ক, মক্কা, মদিনা প্রভৃতি শহরে প্রেরণ করে সরকারি হেফাযতে রাখার এবং বেসরকারি কুরআনের কপিগুলো ভস্মীভূত করবার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু কুফার অধিবাসী আবু মাসুদ দাবি করেন যে, তাঁর নিজস্ব হস্তে লিখিত সংকলন নির্ভুল এবং রাসূলে করীমের নিকট হতে শ্রবণ করে তিনি তা স্বয়ং লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি খলিফার কার্যকে ধর্ম-বিগর্হিত বলে প্রচালনা শুরু করেন এবং চঞ্চলমতি কুফাবাসী তাঁর ধর্মদ্রোহিতা ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে উত্তেজিত হয়ে খলিফার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে।
(গ) চারণভূমির রক্ষণাবেক্ষণ : বিদ্রোহীগণ হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে আরও বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আনয়ন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে। খলিফা হযরত ওসমান (রা) যখন ‘বাকী’ নামক চারণভূমিটি সরকারি খামাররূপে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন তখন চক্রান্তকারিগণ একে নিজস্ব চারণভূমিতে পরিণত করবার অভিযোগ আনে। তাদের মতে, জনসাধারণের অধিকার উপেক্ষা করে খাস চারণভূমি শুধু খলিফার নিজস্ব পশুপালনের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে না। খলিফা হযরত ওসমান সরকারি চারণভূমি ব্যবহার করেন সত্য তবে এর পক্ষে কয়েকটি যুক্তি আছে। প্রথমত, সরকারি চারণভূমিতে জনসাধারণের গবাদিপশুর চারণ রাসূলে করীম ও পরবর্তী দুই খলিফার সময়ে সীমাবদ্ধ ছিল। সুতরাং খলিফা ওসমান পূর্ব প্রচলিত নীতি অনুযায়ী যুদ্ধের জন্য রক্ষিত উট ও ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণ ও চারণের জন্য উক্ত ভূমি ব্যবহার করবার আদেশ দেন। এই সমস্ত পশু ছিল সরকারি সম্পত্তি এবং সেহেতু তাদের আহারে জন্য এই চারণভূমি সংরক্ষিত করতে হয়। উল্লেখযোগ্য যে, দুই হজ্বের জন্য মাত্র দুটি উট ব্যতীত খলিফার’ অপর কোন পশু ছিল না। সুতরাং সরকারি চারণভূমি তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহৃত হয় নি।
(ঘ) আবুজর আল-গিফারীর নির্বাসন : হযরত ওসমানের খিলাফতে বিশিষ্ট সাহাবী এবং সাধকপুরুষ আবুজর আল-গিফারী ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন পরিচালনা করেন। মুসলমানদের ঐশ্বর্য, আড়ম্বর ও অমিতব্যয়িতা রাসূল ও তাঁর সাহাবীদের আদর্শের পরিপন্থী ছিল এবং এটি ধর্মীয় অনুভূতিকে ধ্বংস করে বিলাসবাসনের পথকে সুগম করবে বুঝতে পেরে আবুজর ধন-সম্পত্তি সঞ্চয়ের পরিবর্তে জনহিতকর কার্যে তা ব্যয় করবার জন্য জনমত গঠন করতে থাকেন। কুরআন শরীফের বাণীর (১ : ৩৪) উপর ভিত্তি করে তিনি বলেন যে, সঞ্চিত ধন-সম্পদ দোজখের পথকেই সুদূরপ্রসারী করবে। সিরিয়ায় আবুজর গিফারী এই মতবাদ প্রচার করতে থাকলে গোলযোগের সম্ভাবনায় শাসনকর্তা মুয়াবিয়া কৌশলে তাঁকে মদিনায় খলিফার নিকট প্রেরণ করেন। খলিফা ওসমান তাঁকে এই বলে বুঝাইবার চেষ্টা করেন যে, তিনি কুরআনের যে ব্যাখ্যা দিয়াছেন তা ভ্রান্তিপূর্ণ; কারণ, সরকারকে যাকাত হতে বঞ্চিত করে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করা ইসলাম-বিরুদ্ধ; কিন্তু উপযুক্ত কর প্রদান করবার পর নিজ সম্পত্তি হতে কাকেও বঞ্চিত করা উচিত হবে না। কিন্তু আবুজর খলিফার সাথে একমত হতে পারলেন না; তবুও খলিফা তাঁকে মদিনায় তাঁর সঙ্গে বসবাসের অনুরোধ জানান। মদিনায় তাঁর সমাজতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক বাণী যথেষ্ট সমর্থন লাভ করলে শান্তি বিঘ্নিত হবার উপক্রম হয়। মদিনায় বসবাস করতে আরম্ভ করলে খলিফা বাধ্য হয়ে আবুজরকে ‘রাবাধা’ নামক স্থানে বসবাস করবার জন্য প্রেরণ করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে দুই বছর পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী ও রাষ্ট্রদ্রোহীরা আবুজর-গিফারীর মত একজন জ্ঞান তাপস ব্যক্তির প্রতি অবমাননা ও নির্বাসনের দ্বারা তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর জন্য খলিফার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে।
আবুজর কেবল একজন সাধক পুরুষ ও রাসূলুল্লাহর প্রিয় সাহাবীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইসলামী সমাজতন্ত্রের (Islamic Socialism) প্রতিষ্ঠাতা। পুঁজিবাদের (Capitalism) বিরুদ্ধে তিনি সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করে বলেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি সঞ্চয় (Hoard) করা চলবে না। কারণ, ধন-সম্পত্তির অসম বণ্টনের (Unequal distribution of wealth) ফলে সামাজিক স্তরের সৃষ্টি হবে এবং তা পরিশেষে সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংস করবে। নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র প্রাচীন ঐশ্বর্যশালী রাজ্যগুলো বিজয় করে অফুরন্ত ধন- সম্পদের অধিকারী হয় এবং মুসলিম শাসকগণ ভোগ-বিলাস, আড়ম্বর ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন প্রণালীতে আসক্ত হয়ে পড়ে। মুয়াবিয়া আবুজরের মতবাদে শঙ্কিত হয়ে পড়েন; কারণ, ইতিপূর্বে হযরত ওমরও সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, হযরত ওসমান (রা) অপেক্ষা সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া আবুজরের সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিচলিত হয়ে সর্বপ্রথম তাঁকে সিরিয়া হতে মদিনায় বিতাড়িত ও নির্বাসিত করেন। মুয়াবিয়া পরবর্তীকালে খোলাফায়ে রাশেদূনের আদর্শ হতে বিচ্যুত হয়ে গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ‘আরব সিজার’ (Arab Caesar) খেতাব লাভ করেন। তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান আবুজরের সাথে একমত হতে না পারলেও তিনি তাঁকে মদিনায় অবস্থান করবার অনুরোধ করেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি তাঁকে নির্বাসন দিতে চাননি। তৃতীয়ত, আবুজর স্বেচ্ছায় মদিনা ত্যাগ করে ‘রাবাধায়’ গমন করেন এবং খলিফার প্রস্তাবকে তিনি প্রত্যাখ্যান করলে তাঁর সেখানে গমনের ব্যবস্থা করা হয়। আবুজর খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন নি এবং খলিফা তাঁকে রাবাধায় অন্তরীণ করেও রাখেননি। এমনকি ধনলিপ্সা ও সঞ্চয়ের বিরুদ্ধে মদিনায় আবুজরকে সমালোচনা ও প্রতিবাদ করতে বাধা প্রদান করেননি। আবুজরের ইন্তেকাল খুবই স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা তাঁর স্ত্রীকে অর্থ সাহায্য দেন। সুতরাং আবুজরের প্রতি খলিফার অপমানজনক ব্যবহার একেবারেই কল্পনাপ্রসূত ও অবাস্তব।
(ঙ) বায়তুল মালের অর্থ অপব্যয় : আমীর আলী বলেন, “তিনি স্বভাবত নিজ আত্মীয়-স্বজনদের অর্থদান করতেন এবং বিভিন্ন সময়ে দুষ্টু প্রতিভাধর মারওয়ানকে বায়তুল মালের রাজস্ব বিভাগের কর্তব্য দান করেন, যা জনগণের মধ্যে তাঁকে অপ্রিয় করেছিল।” হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে অর্থ অপচয়, আত্মীয়-স্বজনদের অর্থদান ও অমিতব্যয়িতার অভিযোগ করা হয়। ঐতিহাসিক ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে এই অভিযোগও ভিত্তিহীন প্রমাণিত হবে। প্রথমত, হযরত ওসমান স্বয়ং কখনও অর্থ অপচয় অথবা আত্মসাৎ করেননি। উমাইয়া বংশের কতিপয় উচ্চাভিলাষী শাসনকর্তা বিশেষ করে সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া সরকারি ভূ-সম্পত্তি ও জাতীয় সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেন। মুয়াবিয়া হযরত ওসমানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন, কিন্তু হযরত ওমর তাকে উক্ত পদে নিয়োগ করেছিলেন। খলিফার সরলতা, ধর্মভীরুতা এবং উদারতার সুযোগ নিয়ে তাঁর কতিপয় আত্মীয়স্বজন অর্থ অপচয় ও আত্মসাৎ করে। পক্ষান্তরে, হযরত ওসমানের শাসনকালে এসব ঘটনা ঘটে; এ কারণেই খলিফাকে দোষারোপ করা হয়। দ্বিতীয়ত, খলিফা ওসমান ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিশাল সম্পত্তি ও ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিলেন এবং ইসলামে দীক্ষিত হবার পর তাঁর সমস্ত সম্পদই রাসূলে করীম (স)-এর খেদমতে উৎসর্গ করেন। মুসলমানদের পানীয় জলের অভাব দূরীকরণের জন্য তিনি কূপ খননের ব্যয়ভার বহন করেন; মদিনা মসজিদের সম্প্রসারণের জন্য জমি ক্রয় করেন। বিভিন্ন যুদ্ধ তহবিলে নিঃস্বার্থভাবে অর্থ দান করেন। এ থেকে প্রমানিত হয় যে, তিনি অর্থলোভী ছিলেন না বরং ইসলামের সেবায় অকাতরে দান করে গেছেন। তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অমায়িক এবং তিনি অতি সরল, সহজ ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তাবারীর মতে, সরকারি অর্থের অপচয় করা দূরের কথা খলিফা বায়তুল মাল হতে এক কপর্দকও গ্রহণ করতেন না। যৌবনে ইসলামের সেবায় যিনি মাত্র দুইটি উট রেখে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি, ধন-দৌলত প্রদান করতে পারেন তিনি কিভাবে বায়তুল মালের অর্থ অপচয় করবেন? বায়তুল মাল হতে তিনি কোন ভাতা গ্রহণ করতেন না এবং নিজস্ব ব্যবসায়িক আয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। চতুর্থত, যে মহান খলিফা নিজের জন্য সরকারি তহবিল হতে একটি কপর্দকও গ্রহণ করেননি তিনি কখনই কোষাগার হতে আত্মীয়-স্বজনকে অর্থ দান করে অপচয়ের ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন না। তাঁর নিজস্ব ভাষায়, “তাদের প্রতি আমার দানের কথা বলতে গেলে আমি তাদেরকে যা কিছু দান করি, আমার নিজস্ব সম্পত্তি থেকেই করি; সরকারি সম্পত্তির কথা বলতে গেলে আমি তা আমার নিজের অথবা অপর কারও জন্য হালাল মনে করি না।” পঞ্চমত, খলিফার ন্যায়বিচার কখনও স্বজনপ্রীতির দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়নি। একটি মাত্র ঘটনায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি ত্রিপলীর যুদ্ধের এক-পঞ্চমাংশ গনিমাহ (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) ) আবদুল্লাহ-বিন-আবি-সারাহকে প্রদান করেন; কিন্তু এই সম্পর্কে অভিযোগ উঠলে তিনি তাঁকে তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন।
(চ) অন্যান্য অভিযোগ : হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগ ছিল এই যে, কা’বা গৃহের সম্প্রসারণে দখলীকৃত জমির ক্ষতিপূরণ দিতে তিনি অস্বীকার করেন। খলিফা ওমর কা’বা শরীফের সম্প্রসারণ আরম্ভ করেন এবং ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হযরত ওসমান এই কার্য সুসম্পন্ন করেন। যাদের নিকট হতে জমি নিয়ে পবিত্র গৃহ সম্প্রসারিত করা হয়েছিল তারা ইসলামী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হযরত ওমরের নিকট হতে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। কিন্তু হযরত ওসমান খিলাফত লাভ করলে তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। খলিফা পরে তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে স্বীকৃত হলেও তারা গ্রহণ করতে অসম্মতি জানায়। এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই গোলযোগকারীরা রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যে লিপ্ত রয়েছে এবং রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য তাদের কারারুদ্ধ করা হয়। বিদ্রোহীগণ খলিফার রূঢ় আচরণের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত হয়। দক্ষ শাসক এবং দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হিসেবে খলিফা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কারারুদ্ধ করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং এজন্য তাঁকে দোষারোপ করা যায় না।
খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে অপর একটি অভিযোগ ছিল এই যে, মদিনার বাজারে কতিপয় দ্রব্যাদি ক্রয় ও বিক্রয়ে তাঁরা একচেটিয়া অধিকার ছিল। ইমামুদ্দিনের মতে, “মদিনার বাজারে অন্যান্যদের কতিপয় দ্রব্যাদি ক্রয় ও বিক্রয় তিনি নিষিদ্ধ করেন- এটি একটি ভিত্তিহীন অভিযোগ। তিনি রাষ্ট্রের উষ্ট্রসমূহের আহারের জন্য খেজুর বিক্রয়কে বাধ্যতামূলক করেন। ‘
হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি আক্রোশবশে আবদুল্লাহ-বিন-মাসুদের ভাতা (Pension) বন্ধ করে দেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, খলিফা ও মাসুদের মধ্যে একটু ভুল বুঝাবুঝির ফলেই হযরত ওসমান তাঁর ভাতা প্রদান স্থগিত রাখেন। কিন্তু খলিফা পরবর্তীকালে মাসুদের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারবর্গকে মাসুদের প্রাপ্য প্রায় পঁচিশ হাজার দিরহাম ভাতা প্রদান করেন।
বিপদ দূরীকরণের প্রচেষ্টা
প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে নানারূপ অভিযোগ আসতে থাকলে পরবর্তী হজ্ব মৌসুমে তিনি একটি মজলিস-উস-শূরার বৈঠক আহ্বান করেন এবং সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া, মিসরের শাসনকর্তা সাঈদ-ইবন-উল-আস, মিসরের প্রাক্তন শাসনকর্তা আমর-ইবন-উল-আস এবং কতিপয় প্রধান ব্যক্তিকে এই সভায় যোগদানের নির্দেশ দেন। অভিজ্ঞ শাসনকর্তাগণ নিজ নিজ বুদ্ধি বিবেচনা অনুযায়ী খলিফাকে বিদ্রোহাত্মক পরিস্থিতি মোকাবিলা করবার জন্য বিভিন্ন রকমের পরামর্শ দেন। ইতোপূর্বে রাষ্ট্রের প্রকৃত রাজনৈতিক অবস্থা জানবার জন্য তিনি দামেস্ক, কুফা, ফুসতাত ও বসরায় গুপ্তচর প্রেরণ করেন। কিন্তু গুপ্তচর বিশেষ কোন খবর সংগ্রহ করে আনতে পারে নি। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, খলিফা অভিযোগকারিগণকে তাদের অভিযোগসহ হজ্বের মৌসুমে হাজির হতে নির্দেশ দিলে অভিযোগকারিগণ কেহই উপস্থিত হয়নি। এতে অভিযোগের অসত্যতা ও অবাস্তবতা প্রমানীত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, খলিফা অনিষ্টকারীদের কঠোর হস্তে দমন করে বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় খলিফা ওসমান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে অহেতুক রক্তপাত করতে চাননি। এমনকি মুয়াবিয়া মদিনা পরিত্যাগ করবার পূর্বে খলিফাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে চান; কিন্তু বৃদ্ধ খলিফা মদিনা ত্যাগ করে স্বীয় নিরাপত্তার জন্য সিরিয়া যেতে অথবা ব্যক্তিগত দেহরক্ষী নিযুক্ত করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। খলিফার সরলতা, সহিষ্ণুতা, নিরীহ প্রকৃতিকে চক্রান্তকারীরা তাঁর দুর্বলতা ও অক্ষমতা মনে করে সমগ্র কুফা, বসরা ও মিসরে ষড়যন্ত্রের একটি দুর্ভেদ্য জাল পাতে। খলিফা যদি প্রথম হতে দৃঢ়ভাবে এই বিদ্রোহের মূলোৎপাটন করতেন তা হলে কখনই একটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ইসলামের সংহতি ধ্বংস করত না এবং পরিশেষে খলিফাকে হত্যার একটি ঘৃণ্য নজিরও সৃষ্টি হত না।
বিদ্রোহের কারণ
হযরত ওসমানের খিলাফতের শেষের দিকে বিভিন্ন কারণে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে প্রমাণিত হবে যে, খলিফা ওমরের মৃত্যুর পরেই হিংসা, বিদ্বেষ, বৈষম্য, স্বার্থপরতা, আত্মগরিমা, বিলাস-বাসন, গোত্রীয় স্থানীয় ও জাতীয় কোন্দল, অনৈসলামিক কার্যকলাপ, ব্যক্তিস্বার্থ, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি কারণে ইসলামের ইতিহাস একটি মর্মান্তিক অধ্যায়ের সূচানা করে। সূক্ষ্ম বিচারে খলিফা ওসমানের এতে কতটুকু দায়িত্ব ছিল তাও নিরূপণ করা যেতে পারে।
(ক) ইসলামের মূল আদর্শচ্যুতি : মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ বলেন, “হযরত ওসমানের দুর্ভাগ্য যে, যাঁরা নবী করীম (স)-এর সহকর্মী ছিলেন এবং যাঁর তাঁর জীবনাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই পৃথিবী হতে অন্তর্হিত হয়েছিলেন। হযরত আবুবকর (রা), হযরত ওমর (রা), আবু ওবায়দা, খালিদ, বেলাল প্রমুখ, যাঁরা মুসলিম রাষ্ট্রের শক্তিস্তম্ভস্বরূপ ছিলেন এবং যাঁদের বিরাট ব্যক্তিত্ব ও অপূর্ব ত্যাগ ইসলামের নব- দীক্ষিত জাতিসমূহের সম্মুখে বিস্ময়, সম্ভ্রম ও সমীহের কারণ ছিল, তাঁদের সহযোগিতা হতে হযরত ওসমান বঞ্চিত ছিলেন। এক নতুন নেতৃত্ব, নতুন সমাজ তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল। তাদের সাথে সত্তর বছর বয়স্ক প্রাচীন আদর্শবাদের ধ্বজাধারী খলিফা কিছুতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারতেন না।” নবী করীম (স)-এর তিরোধানের পর প্রায় বিশ বছর অতীতের গর্ভে বিলীন হয়েছে। ইতোমধ্যে আরব জাতির চরিত্র ও ধর্মীয় ঐক্যেও অনেক বিবর্তন ঘটেছে। ইসলামের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হলে মুসলমানগণ একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে পারত না।
(খ) বনু হাশিম ও বনু উমাইয়া গোত্রের মধ্যে বিরোধ : আমীর আলী বলেন, “হযরত ওসমানের সময়ে হাশিম এবং উমাইয়া গোত্রের মধ্যে যে চরম শত্রুতা আরম্ভ হয় তা এক শতাব্দীর অধিককাল চলে।” প্রকৃতপক্ষে মহানবীর জন্মের বহু পূর্ব থেকেই কুরাইশ বংশের এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রের মধ্যে কা’বার পৌরহিত্য এবং মক্কার শাসনব্যবস্থা নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের সূচনা হয়। উমাইয়া বংশের আবু সুফিয়ান প্রথম দিকে রাসূলে করীম (স)-এর বিরুদ্ধাচারণ করলেও মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মহানবীর জীবদ্দশায় এবং হযরত আবুবকর ও হযরত ওমরের খিলাফতে এই দুই গোত্রের বৈষম্য সাময়িকভাবে দূরীভূত হয় এবং ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে থাকে। হযরত ওসমানের খিলাফতে বনু হাশিম ও বনু উমাইয়াদের মধ্যে পুরাতন দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে উঠে। উমাইয়াদের অভ্যুত্থান, সরকারের দায়িত্বপূর্ণ পদে তাদের নিয়োগ এবং নানারূপ সুযোগ-সুবিধা ভোগ হাশিম গোত্রের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠে। বিদ্রোহীরা হযরত ওসমানের তথাকথিত স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব নীতির তীব্র নিন্দা করে বসরা ও কুফায় প্ররোচনা ও উত্তজনা সৃষ্টি করতে থাকে। ইমামুদ্দিন বলেন, “স্বভাবত বনু উমাইয়া গোত্রভুক্ত হযরত ওসমানের স্বগোত্রীয় লোকদের প্রতি আন্তরিকতাবোধ ছিল এবং সেহেতু তিনি তাদের নিজ তহবিলের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন, কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার করা হল যে, এসব অর্থ সরকারি কোষাগার হতে প্রদান করা হয়েছে।
(গ) হযরত আলীর সমর্থকদের প্ররোচনা : হযরত ওসমানের খিলাফতকালে ইসলামের প্রথম যে গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়েছিল তার মূলে অন্যতম কারণ ছিল হযরত আলীর সমর্থকদের প্ররোচনা এবং অবৈধ কার্যকলাপ। উল্লেখযোগ্য যে, নির্বাচনকালে হযরত ওসমান ও হযরত আলী উভয়েই সমর্থন লাভ করেন এবং আবদুর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রমে মতবিরোধ মিটিয়ে গেলে হযরত ওসমান খলিফা নির্বাচিত হলেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর গোত্রীয় ব্যক্তি ও জামাতাকে উপেক্ষা করে উমাইয়া গোত্রের একজন সদস্যকে খিলাফত প্রদানে হযরত আলীর সমর্থকরা দাবি জানায় যে, ন্যায়ত খিলাফত হযরত আলীরই প্রাপ্য। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “ইবন-সা’বা হযরত আলীকে রাসূলুল্লাহর ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী বলে প্রচারণা করতে থাকেন এবং আশা করেন যে, রাসূলুল্লাহর চাচাত ভাই তাদের প্রাণবন্ত সমর্থন দান করবেন।” স্বার্থান্ধ ইহুদী সম্পদ্রায়ভুক্ত ইবন-সা’বা হযরত আলীর সমর্থন লাভ করেন নি; কিন্তু তাঁর খিলাফতের ন্যায্যতাকে কেন্দ্র করে বিভেদ সৃষ্টিকারীরা গোলযোগ আরম্ভ করে।
(ঘ) অকুরাইশ এবং কুরাইশদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা : হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং প্রথম দুই খলিফার শাসনামলে আরবদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য ছিল না এবং তাঁরা ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধে অনুপ্রাণিত হয়ে বিজয় অভিযানকে সুদূরপ্রসারী করেন। কিন্তু হযরত ওসমানের আমলে কুরাইশ ও অকুরাইশদের মধ্যে ক্ষমতার বৈষম্য নিয়ে রেষারেষি দেখা দেয়। সাধারণ আরবগণ যুদ্ধের সময় আত্মত্যাগ করত অথচ শাসনকার্য পরিচালনায় দায়িত্ব প্রদান করা হত কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উপর। ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে এবং পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হযরত ওসমান খলিফা ওমরের নীতির ব্যতিক্রম করে কুরাইশদের আরবের বাইরে জমিজমা প্রদান করে বসবাসের সুযোগ দান করেন। হযরত ওমরের জাতীয়তাবাদী নীতির ফলপ্রসূত আরব ও অনারবদের মধ্যে যে বৈষম্য ছিল তা খলিফা ওসমান উপেক্ষা করেন এবং কুরাইশদের মধ্যে যারা মক্কা ত্যাগ করে সিরিয়া গিয়েছিল তিনি তাদেরকে ইরাকে ভূমি প্রদান করেন। প্রদেশগুলোতে নিযুক্ত কুরাইশ কর্মচারীদের ঔদ্ধত্য ও শান-শওকত অকুরাইশদের ক্ষোভের কারণ ছিল। যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের নিযুক্তিতে কুরাইশগণ হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে তথাকথিত পক্ষপাত-নীতির অভিযোগ আনে। বসরা ও কুফাতে (মিসর) কুরাইশ ও অকুরাইশদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও চরম সংঘর্ষ রাষ্ট্রের শান্তি ও শৃঙ্খলাকে ধ্বংস করে। এই সঙ্কটপূর্ণ সময়ে কুরাইশগণ হযরত ওসমানের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হত তা হলে ষড়যন্ত্রকারী অকুরাইশদের চক্রান্ত ধূলিসাৎ হয়ে যেত।
(ঙ) আনসার ও মোহাজেরদের মধ্যে বৈষম্য : রাসূলে করীম মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করলে মদিনাবাসী আনসারগণ মুহাজেরদের সঙ্গে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি বজায় রেখেছিল। হযরত আবুবকর ও হযরত ওমরের সময়েও তারা সংঘবদ্ধভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের মর্যাদা বৃদ্ধি ও স্বার্থরক্ষার প্রচেষ্টা করে। কিন্তু হযরত ওসমানের খিলাফতে আনসারদের তুলনায় মুহাজেরগণ অবহেলিত ছিল এবং তারা মজলিস-উস-শূরার খাস বা বিশেষ পরিষদের সদস্যপদ হতে বঞ্চিত হতেন। আনসার ও মুহাজেরদের মধ্যে বৈষম্য ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকে এবং হযরত ওসমানের শাসনামলে এটি আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।
(চ) অমুসলমানদের অসন্তোষ : হযরত ওমরের খিলাফতে ইসলামী রাষ্ট্র পূর্বদিকে সুদূর কাবুল হতে পশ্চিমে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করলে বিভিন্ন অমুসলমান জাতি- খ্রিস্টান, ইহুদী, অগ্নি-উপাসক প্রভৃতি ইসলামী শাসন-ব্যবস্থার আওতাভুক্ত হয়। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং উদার নীতির পরাকাষ্ঠা দেখে এই সমস্ত ধর্মাবলম্বী প্রজা স্বাধীনভাবে ধর্ম- কর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারত এবং তাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করা হত। এর জন্য তাদেরকে জিজিয়া নামে একটি কর প্রদান করতে হত। নানাপ্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেও তারা আরব কুরাইশদের প্রাধান্য স্বীকার করতে দ্বিধা করে এবং তাদের পদমর্যাদা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় ঈর্ষান্বিত হতে থাকে। এভাবে আরব-অনাবর মুসলমানদের এবং আরব কুরাইশ ও অনারব অমুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ ও কোন্দল ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরিশেষে খলিফা ওসমানের কোমল প্রকৃতি ও নিস্পৃহতার সুযোগ নিয়ে এই সমস্ত চক্রান্তকারী বিধর্মীগণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
(ছ) ইবনে-সা’বার অপপ্রচার : একথা অনস্বীকার্য যে, ইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক অমুসলমান ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়; কিন্তু ইসলামের তৌহিদ ও সাম্যবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত ও মুগ্ধ হয়ে তারা ইসলামের ছায়াতলে আসে নি। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য এক শ্রেণীর সুযোগসন্ধানী চক্রান্তকারী ইসলাম কবুল করেছিল। তাদের স্বার্থে আঘাত লাগলেই তারা খলিফার বিরুদ্ধাচরণ করতে দ্বিধা করত না। এরূপ একজন ইসলাম-বিদ্বেষী প্রতারক ও ভণ্ড মুসলমান ছিলেন আবদুল্লাহ-ইবন- সাবা। তিনি ইয়েমেনের জনৈক নিগ্রো মাতার ইহুদী সন্তান; তিনি স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নিগ্রো মাতার সন্তান বলে তাকে ‘ইবন-সওদা’ (কাল নারীর সন্তান) বলা হত। বসরার শাসনকর্তা আবদুল্লাহ বিন-আসিরের নিকট ইসলামে দীক্ষিত হয়ে তিনি ব্যক্তিস্বার্থে হযরত আলীর খিলাফত দাবির প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তাঁর মতে, রক্তের সম্পর্ক এবং বৈবাহিক দিক দিয়ে হযরত আলী রাসূলুল্লাহর একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন এবং প্রথম তিন খলিফা অবৈধভাবে তাঁকে খিলাফত হতে বঞ্চিত করেন।
কুফা ও বসরায় ইবনে সা’বার মতবাদ প্রচারিত হলে তার অনেক সমর্থক জুটে। ইহুদী মতবাদে প্রভাবান্বিত হয়ে এক নতুন ধর্মমতের উদ্ভব হয়। এটি পরবর্তীকালে সাবাইত (Sabaism) বা উগ্র শিয়া মতবাদ নামে পরিচিত হয়। তাবারী বলেন, “মুসলমানদিগকে ভুলপথে চালিত করবার জন্য তিনি স্থানান্তরে গমন করেন।” বসরা ও কুফা হতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়ে সা’বা মিসরে গমন করেন এবং সেখানে হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ এবং ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। স্বার্থান্বেষী ও চক্রান্তকারী বহুলোক সা’বার সঙ্গে যোগদান করে বিদ্রোহাগ্নি ছড়াতে থাকে। ইমামুদ্দিন বলেন, “তার প্রচারণা ধর্মীয় রূপ পরিগ্রহ করলে পারস্যভাবাপন্ন এবং উত্তরাধিকারসূত্রে রাজতন্ত্র নীতিতে বিশ্বাসী ইরাকে আরব গোত্রদের অনেকেই একে সমর্থন করে।” হাকিম বিন-জাবালা এবং মুহাম্মদ বিন-আবুবকরও ইবনে-সা’বার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগদান করেন।
(জ) হিমারাইট ও মুযহারাইটদের ঈর্ষাভাব : আমীর আলী বলেন, “মুযহারাইট ও হিমারাইটদের পুরাতন ঈর্ষাভাব সাময়িকভাবে দূরীভূত হলেও পুনরায় তা ইসলামে মারাত্মক পরিণতিসহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।” (এই দুই প্রাচীন আরব গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বহুযুগ ধরে চলছিল।) হযরত মুহাম্মদ (স) এবং পরবর্তী দুই খলিফা এই দুই গোষ্ঠীকে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম হন। বস্তুত মদিনা ব্যতীত আরবের অন্য কোথায় ও এই দুই জাতির লোক একত্র হতে পারেনি। বংশগৌরব ও কৌলীন্য প্রথা উত্তর আরব বা মুযহারাইট এবং দক্ষিণ আরব বা হিমারাইটদের মধ্যে একটি পর্বতপ্রমাণ ব্যবধানের সৃষ্টি করে। খলিফা ওসমানের খিলাফতে এসব কোলাহল ও অসন্তোষ মারাত্মক আকার ধারণ করে।
(ঝ) দ্বীন ও মুরুওয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব : এন. এ. ফারিসের মতে, “হযরত ওসমানের খিলাফতে প্রধান দুটি অভিজাত শ্রেণীর দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়— পৌত্তলিক মক্কার প্রাচীন অভিজাতবর্গ এবং ইসলামের নতুন অভিজাতবর্গ। পুরাতন অভিজাতবর্গ প্রাচীন ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং নতুন অভিজাতবর্গ ইসলামের ভ্রাতৃত্ব এবং সকল মুসলমানের সমতা রক্ষা করার জন্য তৎপর থাকে। কৃতিত্ব বজায়ের যে একটি মাত্র পথ ছিল তা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ভক্তি। হযরত ওমর কঠোর হস্তে প্রাচীন আভিজাত্যকে দমন করেছিলেন। কিন্তু কোমলমতি ওসমানের আমলে এটি ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। অপরদিকে নতুন আভিজাত্যের নেতৃত্ব দান করেন হযরত আলী, অর্থনৈতিক সমতার পুরোধা আবুজর এবং আমর ইবন- ইয়াসির। নিকলসন পৌত্তলিক আরবের ধর্মীয় সংস্থা মুরুওয়া (Muruwwa) এবং ইসলাম-এর মধ্যে মতভেদ দেখিয়েছেন। ইসলামের আর্বিভাবে কুরাইশদের মক্কায় অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রাধান্য বিলুপ্ত হয়। ইসলামের মূল আদর্শগুলো বেদুঈন আরবদের নিকট বিজাতীয় ও দুর্বোধ্য ছিল। তাদের মূর্তিগুলো ধ্বংস হওয়ায় তারা ইসলামের বিরোধিতা করে সত্য তবে তার চাইতে তাদের মূল আপত্তি ছিল ইসলামের ভক্তিভাব ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতি। নৈতিক ও ধর্মীয় চেতনার দ্বারা সুষ্ঠু শাস্ত্রীর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপনে আরব বেদুঈনগণ কোন দিনই অভ্যস্ত ছিল না। ‘আসাবিয়া’ বা গোত্রীয় বন্ধন ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধে ধূলিসাৎ হওয়ায় পদমর্যাদা, কৌলিন্য ও বৈষম্য ধর্মীয় বন্ধন-সেতুতে বিলুপ্ত হয়। এই প্রকার নৈতিক চাপের বিরুদ্ধে বেদুঈনগণ বিদ্রোহী হত; তাদের পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধিলিপ্স মরুচারী পুরাতনপন্থী অতৃপ্তচিত্তে স্বভাবতই বিদ্রোহ জাগরিত করত। তারা বেশির ভাগই মু’মীন ছিল না। কেবল সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশ পাবার জন্য তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং বিজয় অভিযানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ইসলাম তাদের ভাগ্যোন্নতি করবে এই আশায় তারা তৌহিদে বিশ্বাস করেছিল এবং তাদের স্বার্থে আঘাত লাগলেই তারা পূর্বপুরুষদের জীবনাদর্শে ফিরে যেতে দ্বিধা করত না। হযরত আবুবকরের খিলাফতে রিদ্দা যুদ্ধ ও খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী আন্দোলনই এর জাজ্বল্য প্রমাণ।
(ঞ) কেন্দ্রীয় শাসনের বিরোধিতা : ঐতিহাসিক বার্নার্ড লুইস বলেন, হযরত ওসমানের পতনের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র এবং নীতি দায়ী নহে। তাঁর মতে, “প্রকৃত কারণ আরও গভীর ছিল এবং তাঁর দোষ হচ্ছে যে, তিনি বিদ্রোহের কারণগুলো অনুধাবন, নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রতিকারে অসমর্থ ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কোন ধর্মীয় অথবা ব্যক্তিগত কারণে হয় নি। এই বিদ্রোহ ছিল কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে যাযাবরদের বিদ্রোহ। এটি শুধু ওসমানের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়-যে কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ।”
(ট) উমাইয়াদের প্রাধান্য ও মারওয়ানের ধ্বংসাত্মক নীতি : নবী করীম (স)-এর ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের মৃত্যুতে হযরত ওসমানের সময়ে স্বগোত্রীয় উমাইয়া বংশের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাত-নীতি ভিত্তিহীন হলেও বিদ্রোহীগণ উমাইয়া বংশের সদস্যদের উচ্চপদ এবং নানারূপ সুযোগ-সুবিধা লাভকে সুনজরে দেখে নি। খলিফা হযরত ওসমানের জামাতা ও চাচাত ভাই মারওয়ান তাঁর নিকটতম সহযোগী, প্রধান সচিব ও উপদেষ্টা ছিলেন। আমীর আলী বলেন, “তিনি (অনিচ্ছা সত্ত্বেও) পূর্ব ধারণা অনুযায়ী তাঁর পরিবারের প্রভাবাধীণ হলেন। রাসূলুল্লাহ কর্তৃক একবার বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কৃত এবং উমাইয়াদের মধ্যে অন্যতম নীতিজ্ঞানবর্জিত ব্যক্তি ও সচিব মারওয়ান কর্তৃক তিনি পরিচালিত হলেন।” এই ব্যক্তির দুর্নীতিপরায়ণতা ও কুটিলতাই হযরত ওসমান হত্যার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। কুচক্রী মারওয়ান উমাইয়া বংশের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য স্বগোত্রীয় লোকদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠীত করেন। তারা অপরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে দ্বিধা করতেন না। হযরত ওসমানের সরলতার সুযোগে মারওয়ান সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন এবং হাশিম গোত্রের লোকদের সকল প্রকার সুবিধা হতে বঞ্চিত করে তাদের শক্তিহীন করেন। ধূর্ত ও কপট মারওয়ানের পক্ষপাত-নীতিতে হাশেমিগণ খলিফার সাথে আন্তরিক সহেযাগিতা করেনি। এটি অপরদিকে খোলাফায়ে রাশেদূনের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করে উমাইয়া রাজত্ব কায়েমে সহায়তা করে। বিশ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করে মুয়াবিয়া সিরিয়ায় উমাইয়া প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এরূপ পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পদচ্যুত প্রাদেশিক শাসকগণ ও প্রতারিত সরলপ্রাণ মুসলমানগণ মারওয়ানের স্বার্থপরতা, চক্রান্তমূলক অভিসন্ধিতে খলিফাকে সাহায্য করতে ইতস্তত করেন।
(ঠ) নীতির পরিবর্তন : হযরত ওমর তাঁর খিলাফতকালে আরব অধিবাসীদের অনারব অঞ্চলে জমিজমা ক্রয় নিষিদ্ধ করেন এবং সৈন্যবাহিনীকেও জায়গীরের পরিবর্তে নিয়মিত বেতন দিতেন। ইসলামী রাষ্ট্র বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে হযরত ওসমান আরব দেশে ও আরবের বাইরে কুফা, বসরা প্রভৃতি অঞ্চলে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমতি দিলে একশ্রেণীর জায়গীরদার ও ভূস্বামীর সৃষ্টি হয়। তোয়াহা হোসাইন বলেন, “খলিফার এই ব্যবস্থায় যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্পত্তির মালিক হলেন তারা অন্যদের নিকট হতে সম্পত্তি খরিদ করবার সামর্থ্য অর্জন করলেন। এতে কেবল বড় বড় পুঁজিপতিগণই লাভবান হতে পেরেছিলেন। সুতরাং তালহা, যুবাইর, মারওয়ান, ইবনে হাকাম বহু সম্পত্তি খরিদ করলেন। এ বছর অর্থনৈতিক অবস্থা খুব চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হল। খুব ক্রয়-বিক্রয় হল, ঋণ আদান-প্রদান হল, সম্পত্তি বিনিময় হল, সমবায় এবং শরীকদারি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হল। এই চাঞ্চল্য কেবল হেজাজ এবং ইরাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না বরং সমগ্র আরব-ভূমি এবং বিজিত এলাকার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল। একদিকে বিরাট বিরাট ভূস্বামীর সৃষ্টি হল- অন্যদিকে সকল জমির চাষাবাদ ও বিধি- ব্যবস্থার জন্য বহু স্বাধীন দাসের কাজের সংস্থান হয়ে গেল। এভাবে ইসলামে এক নতুন শ্রেণীর উদ্ভব হল যাদের বৈশিষ্ট্যের উৎস হল ধনসম্পদ এবং অনুগত মজুর শ্রেণী।” বালাজুরীর মতে, “খলিফা হযরত ওসমানের আদেশক্রমে মুয়াবিয়া বনু-তামীমকে আর- রাবিয়ায় এবং কায়েস, আসাদ এবং অন্য লোকজনকে আলমুদায়বিরে বসবাস করতে দিলেন। ওসমান আবদুল্লাহ ইবন-মাসুদকে বাহরাইনে খানিকটা জমি, আম্মার ইবন- ইয়াসিরকে আসবিনা, খাব্বারকে সা’নাবা এবং সা’দকে হরজুম গ্রাম জায়গীরস্বরূপ দিয়েছিলেন।” এ ছাড়াও পাঁচজন সাহাবীকে জায়গীর দেওয়া হয়। এর ফলে কেবল আরব দেশেই নয়, অনারব অঞ্চলেও পুঁজিপতি শ্রেণীর উদ্ভবে বিলাস-বাসন, কর্মহীনতা, সৌখিনতা, কামনা-লালসা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ইসলামের মূল আদর্শ হতে মুসলমানগণ বিচ্যুত হতে থাকে। অনারব অঞ্চলে জায়গীর প্রথার প্রবর্তনে বৈবাহিক সম্পর্কজনিত যে সংমিশ্রণ হয় তা হযরত ওমরের আরব জাতীয়তাবাদী ও নিষ্কলুষ আরব সামরিক শক্তি গঠননীতির পরিপন্থী।
হযরত ওসমান কোষাগার হতে এক কপর্দক গ্রহণ না করেও বাণিজ্যিক সফলতার জন্য তিনি ধনাঢ্য ছিলেন। তাঁর খিলাফতে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়ে কোষাগার ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ হয়। ইবন-মাসুদ তৎকালীন ধনৈশ্বর্যের একটি বিবরণ রেখে গেছেন। “প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্যের যে ধারণা পাওয়া যায় তা এরূপ-মৃত্যুর দিবস কোষাগারে ছিল ২,৫০,০০০ দিনার এবং ১০,০০,০০০ দিরহাম।” এছাড়া সাহাবীরা অর্থ সঞ্চয় করে বিত্তশালী হয়েছিলেন। ইবনে খালদুনের মতে, “তাদের ধর্ম ধনসঞ্চয়ের জন্য তাদের প্রতি দোষারোপ করে নি; কেননা, গনিমাহ হিসেবে এগুলো ছিল আইনসিদ্ধ সম্পত্তি।” কিন্তু বিভেদ সৃষ্টিকারীরা হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে অমিতব্যয়িতা ও জাঁকজমকের ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে অসন্তোষের বিষবাষ্প সৃষ্টি করে।
(ঢ) খলিফার সরলতা, সহিষ্ণুতা ও উদারতা : “হযরত ওসমানের চারিত্রিক সরলতা, ধর্মভীরুতা, উদারতা ও সহনশীলতা তাঁর ভাগ্য বিপর্যয়ের অন্যতম প্ৰধান কারণ। হযরত ওমর এবং হযরত ওসমানের খিলাফতের মধ্যে প্রধান পার্থক্য এই যে, হযরত ওমর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ব্যক্তিগত কর্মপন্থার মাধ্যমে নব- প্রতিষ্ঠিত বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে সক্ষম হন; কিন্তু হযরত ওসমানের পক্ষে প্রধানত দুটি কারণে তা সম্ভবপর হয়নি। প্রথমত, তিনি ছিলেন সরল ও সাধু প্রকৃতির। আমীর আলীর মতে, “ধর্মপরায়ণ ও সৎ হলেও ওসমান খুবই বৃদ্ধ ও দুর্বল চরিত্রের লোক ছিলেন এবং প্রশাসনিক দায়িত্বের উপযুক্ত ছিলেন না।” হযরত ওসমানের চরিত্রিক দুর্বলতার কারণ এই যে, তিনি হযরত ওমরের মত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন না। অনর্থক দুঃখ-কষ্ট ও রক্তক্ষয়ের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। সত্তর বছর বয়সে খিলাফত পেয়ে তিনি তাঁর কুচক্রী জামাতা মারওয়ানের উপর সরল বিশ্বাসে সর্বকার্যে নির্ভর করতেন। খলিফার উদারতার সুযোগ গ্রহণ করে দুষ্কৃতকারীগণ অরাজকতার সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধপ্রবণ কুফা ও বসরার লোকেরা ছিল অস্থিরমতি; ক্ষমতালিপ্সু ও বিজয়ের গৌরবে তারা ছিল দিশাহারা। এর ফলে তারা উদ্ধত, অসংযত, লোভী হয়ে উঠে। বরকতুল্লাহ বলেন, “হযরত ওমরকেও এরা কম জ্বালাতন করেনি, কিন্তু ওমরের বজ্রকঠিন পৌরুষের মোকাবিলায় এদের সকল আস্ফালন ব্যর্থ হয়ে যেত। হযরত ওসমান ছিলেন স্বভাবতই লাজুক ও নম্র প্রকৃতির। কোন অবস্থায়ই তিনি কঠোর হতে পারতেন না; জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা ও বিরোধী দলের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে তিনি সবকিছুর মীমাংসা করতে চাইতেন।” খলিফাকে কখনই শাসনের অযোগ্য বলা যেতে পারে না; কারণ, তাঁর খিলাফতের প্রথম পর্যায়ে ইসলামের সম্পসারণ ও শাসন- ব্যবস্থা দৃঢ়করণ হয়। তাঁর পতনের জন্য তিনি শুধু নিজেই দায়ী নহেন, তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্রুত পট পরিবর্তন তাঁর পতনকে ত্বরান্বিত করে। প্রকৃতপক্ষে তিনি পরিস্থিতির শিকার (Victim of circumstances) ছিলেন।
হযরত ওসমানের হত্যা
উপরিল্লিখিত মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, অবাস্তব ও কল্পনাপ্রসূত অভিযোগসমূহ এবং বিদ্রোহের কারণসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রে সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠে। বিশেষ করে বসরা, কুফা ও ফুসতাত হতে প্রায় ৭০০ বিদ্রোহী ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মদিনার দিকে অগ্রসর হয়। তারা খলিফার নিযুক্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের দুর্নীতিপরায়ণতা, স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তীব্র প্রতিবাদ করে। উল্লেখযোগ্য যে, হজ্বের উদ্দেশ্যে কাফেলায় এই কুচক্রী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মদিনায় এসে তাঁবু ফেলে। মদিনায় তাদের উপস্থিতিতে খলিফা বিচলিত হয়ে পড়েন। মদিনাবাসী খলিফার নিরাপত্তার জন্য রক্ষীবাহিনী গঠন করেন। বিদ্রোহী নেতাগণ মদিনাবাসীদের নিকট হতে সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে যেতে থাকে। মদিনার অভ্যন্তরে প্রবেশের কোন উপায় দেখতে না পেয়ে তারা রাসূলে করীম (স)-এর বিধবা পত্নীদের নিকট একজন প্রতিনিধি প্রেরণের প্রস্তাব করে। বিদ্রোহীদের দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাও প্রত্যাখ্যান করা হয়। হযরত আলীর নিকট হতে সমর্থন লাভে অক্ষম হয়ে তারা অপর একটি ফন্দি বের করে। বসরাবাসিগণ তালহা এবং কুফাবাসিগণ যুবাইরকে খিলাফত প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু রাসূলে করিমের ঘনিষ্ঠ দুইজন সাহাবী উহা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। বিভ্রান্ত ও নীতিজ্ঞানহীন কুচক্রীদল অতঃপর খলিফার নিকট আবেদন করে যে, মুহাম্মদ-বিন-আবু বকরকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করতে হবে। সরলমনা এবং নম্র প্রকৃতির খলিফা রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন না করে তাদের দাবি মেনে নিলেন। এর প্রধান কারণ ছিল এই যে, তিনি অহেতুক রক্তপাতকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। সরল বিশ্বাসে খলিফা তাদের নিয়োগপত্র অর্পণ করায় তারা সাময়িকভাবে মদিনা ত্যাগ করে চলে যায়।
খলিফার বিচক্ষণতায় সাময়িকভাবে একটি মারাত্মক পরিস্থিতি হতে মুসলমানগণ রক্ষা পেলেও কয়েকদিন পরেই বিদ্রোহীদের তিনটি দল পুনরায় মদিনায় আগমন করে। হযরত আলী তাদের বিরুদ্ধাচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা মিসরের শাসনকর্তার নিকট লিখিত মোহরযুক্ত পত্র পেশ করে। তাতে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, পত্র নিয়ে মিসরের বিদ্রোহীরা দেশে পৌঁছলে তাদের যেন হত্যা করা হয় এবং মিসরের শাসনকর্তার পদচ্যুতির ফরমান বাতিল বলে গণ্য করা হয়। বিদ্রোহীগণ দাবি করে যে, মারওয়ান কর্তৃক এরূপ লিখিত এবং খলিফার সীলযুক্ত একটি চিঠি তারা এক অশ্বারোহীর নিকট হতে উদ্ধার করেছে। বিদ্রোহীগণ এই পত্র উদ্ধার করে মদিনায় ফিরে ঔদ্ধত্যের সীমা লংঘন করে খলিফার নিকট কৈফিয়ত দাবি করে। বৃদ্ধ খলিফা শপথ করে বললেন যে, তিনি এর বিন্দুবিসর্গও জানেন না। এর পর তারা বুঝতে পারল মারওয়ান কর্তৃক তারা প্রতারিত হয়েছে এবং এর প্রতিকারের জন্য তারা মারওয়ানকে তাদের হস্তে অর্পণ করবার জন্য খলিফার নিকট দাবি জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিদ্রোহীদের কথা অনুযায়ী, মিসরে গমনকারী বিদ্রোহী কাফেলা খলিফার প্রদত্ত পত্রখানি উদ্ধার করে, এর কথা কখনও বসরাগামী বিদ্রোহীদের পক্ষে জানা সম্ভবপর ছিল না; কারণ, বসরা, কুফা ও মিসরের পথ সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে, বিদ্রোহীগণ ইচ্ছাকৃতভাবে পত্রটি জাল করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিদ্রোহীরা যে জাল পত্র প্রস্তুত করেছিল তার যুক্তিতে বলা যায় যে, প্রথমত, খলিফা মিসরের শাসনকর্তার নিকট লিখিত পত্রটি সরল বিশ্বাসে বিদ্রোহীদের হাতে দেন; কিন্তু বিদ্রোহীরা মিথ্যা করে বলে যে, জাল পত্রটি তারা খলিফার একজন ভৃত্যের নিকট হতে উদ্ধার করে। দ্বিতীয়ত, খলিফা যখন ভৃত্যটিকে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করবার নির্দেশ দেন তখন বিদ্রোহীগণ তার দাবি পূরণ করতে সক্ষম হয় নি। তৃতীয়ত, মিসর, বসরা ও কুফার পথ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন; সুতরাং মিসরগামী বিদ্রোহীদের দ্বারা উদ্ধারকৃত খলিফার তথাকথিত পত্রটি কিভাবে বসরা ও কুফাগামী বিদ্রোহীগণ জানতে পারল তা চিন্তার বিষয়। এটি একমাত্র এইভাবে সম্ভব যে, তারা পত্রটিতে মারওয়ানের সহি জাল করে অথবা খলিফার অজ্ঞাতে মারওয়ান সহি করে খলিফার জাল সীলমোহর সংগ্রহ করেছিল। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “সমস্ত ব্যাপারটি একেবারেই সাজানো।”
বিদ্রোহীগণ ভ্রান্তিপূর্ণ ও জাল পত্রটিকে মূলধন করে মদিনায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করে। তারা দাবি করে যে, খলিফা শাসনকার্যের অনুপযুক্ত এবং তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে। খলিফা পদত্যাগ করতে অস্বীকার করলে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বিদ্রোহীগণ তার বাসগৃহ অবরোধ করে। এ সময় হজ্ব উপলক্ষে অনেক মদিনাবাসী মক্কায় চলে গিয়েছিলেন। আলী, তালহা, যুবাইর এবং হযরত (স)-এর স্ত্রী উম্মে হাবিবা বিদ্রোহীদের শান্ত করবার বৃথা চেষ্টা করেন। আলী, তালহা ও যুবাইরের পুত্রগণ দ্বারা গঠিত ১৮ জন দেহরক্ষী মারমুখী বিদ্রোহীদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, খলিফা রক্তপাতের ঘোর বিরোধী ছিলেন, নতুবা সৈন্য প্রেরণ করে মুষ্টিমেয় কয়েকজন চক্রান্তকারীকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করা তাঁর পক্ষে কষ্টকর ছিল না। কিন্তু তিনি স্বয়ং বলেন, “মৃত্যুকে আমি ভয় করি না এবং তাকে আমি সহজভাবে গ্রহণ করব। আমি তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব না; কারণ আমি যুদ্ধ করতে চাইলে আমার পক্ষে যুদ্ধ করবার জন্য হাজার হাজার লোক রয়েছে; মুসলিমের এক বিন্দু রক্তপাত করবার ইচ্ছা আমার নেই।” ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুন বিদ্রোহী ঘাতকগোষ্ঠী বলপূর্বক গৃহে প্রবেশ করে ৮২ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ খলিফাকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে। খলিফার স্ত্রী নাইলা খলিফাকে রক্ষা করতে গিয়ে তার হাতের আঙ্গুল হারালেন। হিট্টি বলেন, “এরূপে মুসলমানদের দ্বারা রক্তপাতে নিহত তিনিই প্রথম খলিফা।”
হযরত ওসমানের হত্যার ফলাফল
খলিফা ওসমানের শাহাদাত বরণ ইসলামের ইতহাসে একটি কলুষিত অধ্যায়ের সূচনা করে। এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী এবং মারাত্মক। প্রখ্যাত জার্মান ঐতিহাসিক ওয়েলহাউসেন বলেন, “ওসমানের হত্যাই ইসলামের যে কোন ঘটনা অপেক্ষা অধিকতর যুগান্তকারী।” এর বহুমুখী প্রতিক্রিয়া ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বত্র দেখা দেয় এবং রাষ্ট্রীয় সংহতি দূর করে অরাজকতার সূচনা করে।
হযরত ওসমানের শাহাদাতের ফলে খলিফা ও খিলাফতের প্রতি জনসাধারণের শ্রদ্ধা ও ভক্তি ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে। খোদাবক্স হযরত ওসমানের নৃশংস হত্যাকে একটি অভাবনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, “এটি সর্বকালের জন্য খলিফার ব্যক্তিগত পবিত্রতা বিনষ্ট করে।” একই কথার প্রতিধ্বনি করে বার্নার্ড লুইস বলেন, “বিদ্রোহী মুসলমানগণ কর্তৃক একজন খলিফার প্রাণহানির দ্বারা বেদনাবিধূর দৃষ্টান্তের সৃষ্টি হয় এবং তা ইসলামী ঐক্যের প্রতীক খিলাফতের ধর্মীয় ও নৈতিক মর্যাদাকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে।
জোসেফ হেল বলেন, “ওসমানের হত্যা ছিল গৃহযুদ্ধের বিপদসংকেতস্বরূপ।” মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট হয়ে রাসূলে করীমের মহান আদর্শগুলো ধুলিসাৎ হয়ে যায়। মুসলমান কর্তৃক মুসলমানের রক্তপাত হযরত ওসমানের মত নিরীহ, সরল প্রকৃতি অশীতিপর বৃদ্ধের হত্যা হতে শুরু করে ইসলামের ইতিহাসের প্রতি সংঘাতপূর্ণ অধ্যায়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। হযরত আলীর খিলাফতে সিফফিন ও উষ্ট্রের যুদ্ধ এবং বিশেষ করে কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিক ঘটনাবলি হযরত ওসমানের নির্মম হত্যারই প্রতিফলন। আরব ও অনারব, উত্তর আরব ও দক্ষিণ আরব, কুরাইশ ও অকুরাইশদের মধ্যে যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলতেছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটে এই মর্মস্পর্শী ঘটনায়। যুগ যুগ ধরে এর পুনরাবৃত্তি ঘটে। ওয়েলহাউসেন বলেন, “এর ফলে গৃহযুদ্ধের যে কপাট খুলে যায় তা আর কখনও বন্ধ হয়নি।”
হযরত ওসমানের পতন ও মর্মান্তিক মৃত্যু পক্ষান্তরে গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পতন। প্রথম দুই খলিফা ইসলামের মূল আদর্শ রক্ষা করতে সক্ষম হন, কিন্তু চক্রান্তমূলক অভিসন্ধির শিকার হয়ে খলিফা ওসমান শাহাদাত বরণ করলে খোদাবক্সের ভাষায়, “এটি ঈশ্বরতন্ত্রকে রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করে।” এই অচিন্তনীয় ঘটনা মুসলিম জাতিকে দুটি প্রধান দলে বিভক্ত করে— বনু হাশেম ও বনু উমাইয়া। ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ আরব গোত্রীয় কৌমচেতনাকে ধ্বংস করে ইসলামী রাষ্ট্রকে সুসংঘবদ্ধ করে; কিন্তু উমাইয়াদের প্ররোচনায় বনু হাশেম গোত্রের প্রাধান্য বিলূপ্ত হয় এবং পরিশেষে মুয়াবিয়া কর্তৃক উমাইয়া রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। মুয়াবিয়া হযরত ওসমানের রক্তাক্ত জামা ও তাঁর স্ত্রী নাইলার কর্তিত আঙ্গুল প্রদর্শন করে হযরত আলীর খিলাফতে বিদ্রোহ ঘোষণা করে খোলাফায়ে রাশেদূনকে চিরতরে ধ্বংস করেন।
হযরত ওসমানের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে বিভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। নিকলসন ও ওয়েলহাউসেনের মতে, শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় ইবন-সা’বার প্রচারণা হতে। হযরত আলীর সমর্থন না পেলেও ইহুদী মাতার সন্তান ইবন সা’বা স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য মৌখিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন। এই মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুন্নী ও খারিজী দলের উৎপত্তি হয়।
ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাজধানী মদিনার প্রাধান্য ও গৌরব খলিফার হত্যার পর লোপ পেতে থাকে। নব-প্রতিষ্ঠিত শহর কুফা, দামেস্ক, ফসতাত, বসরা ইসলামের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, হযরত আলী (রা) সাময়িকভাবে কুফায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং মুয়াবিয়া দামেস্ককে উমাইয়া সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। উমাইয়া খিলাফতে বনু হাশেম গোত্রকে যেভাবে বিকৃতরূপে চিত্রিত করা হয় পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খলিফাগণ ঈর্ষা ও বিদ্বেষবশত উমাইয়াদের সেভাবে বিকৃতরূপে চিত্রিত করে। এই প্রসঙ্গে মূইর বলেন, “অধিকাংশ প্রচলিত কাহিনীতে ফরমান লেখার ও মোহরযুক্ত করবার দায়িত্ব খলিফার সম্পর্কিত ভ্রাতা মারওয়ানের উপর ন্যস্ত ছিল। এসব কার্য ওসমানের যাবতীয় দুর্ভোগের কারণ বলে তাকে দোষারোপ করা হয়েছে। কিন্তু এর সকল কিছুতেই স্পষ্টত আব্বাসীয় বংশ কর্তৃক উমাইয়াবিরোধী সংস্কারের ছাপ রয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে হযরত ওসমান গনিমতের এক রাজকীয় অংশ তাঁর প্রাধানমন্ত্রী মারওয়ানকে উপহার দিয়েছেন এবং তাঁদের মতে এটি ছিল হযরত ওসমানের প্রতি আরোপিত কলঙ্কের অন্যতম কারণ।”
হযরত ওসমানের কৃতিত্ব
ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমানের শাসনকাল অশান্ত ও গোলযোগপূর্ণ হলেও তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন। হযরত ওমরের খিলাফতে ইসলামের যে সম্প্রসারণ শুরু হয় খলিফা ওসমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে তা পূর্ণোদ্যমে চলতে থাকে। মুসলিম পতাকা পূর্বে সুদূর কাবুল ও বেলুচিস্তান থেকে পশ্চিমে ত্রিপলী পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। নৌবাহিনী গঠন দ্বারা সাইপ্রাস ও রোডস দ্বীপপুঞ্জ দখল হযরত ওসমানের অন্যতম কৃতিত্ব। তাঁর সময়ে বায়জানটাইন ও পারস্য শক্তির বিরুদ্ধাচরণ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা হয়।
হযরত ওসমানের জনহিতকর কার্যাবলি তাঁর প্রজাবাৎসল্যেরই পরিচায়ক। ইসলামের খেদমতে তিনি প্রচুর অর্থদান করেন। জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য তিনি বাঁধ, পয়ঃপ্রণালী, রাস্তাঘাট, মসজিদ, খাল প্রভৃতি নির্মাণ করেন; মদিনার মসজিদটি সংস্কার করে তাতে কাঠের ছাদ ও প্রস্তরের স্তম্ভ সংযোজিত করেন। মাহরুজ বাঁধ নির্মাণ করে তিনি মদিনা নগরীকে প্লাবন হতে রক্ষা করেন। মদিনায় অবস্থিত বনাত লা’ইলাহ নামক খাল হতে আরমায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করে তিনি উক্ত স্থানকে চাষের উপযোগী করে তোলেন। অন্যান্য খলিফার মত তিনি ফিদাকের রাজস্ব পথচারীদের মধ্যে ব্যয় করতেন। সঙ্গত কারণে তিনি নাজরানের জিম্মীদের রাজস্ব হ্রাস করেন। হযরত ওসমান রা)-এর অন্যতম কৃতিত্ব ছিল কুরআন শরীফের ধারাবাহিক সংকলন। নির্ভুল কুরআনের সংকলন ও সংরক্ষণ ইসলামের ইতিহাসে একটি অক্ষয় কীর্তি। বিভিন্ন অঞ্চলে কুরআন পাঠে গরমিল ও পার্থক্য লক্ষ্য করে তিনি একটি উপযুক্ত কমিটি গঠন করেন এবং একটি নির্ভুল সংস্করণ প্রকাশ করে ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বত্র তা প্রেরণ করেন। অন্যথায় মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বিকৃত হয়ে যেত।
হযরত ওসমান দীর্ঘকাল হযরত ওমরের রাজস্ব-নীতি মেনে চলেন। কিন্তু খিলাফতের অষ্টম বছরে তিনি কুফার গভর্নর সাঈদের নিকট হতে একটি পত্র পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি দেখলেন, নাগরিক সভ্যতার শুচিতা রক্ষা যা হযরত ওমরের কাম্য ছিল, তা আর সম্ভবপর হচ্ছে না। শহরের লোকদিগকে গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে না দিলেও গ্রামীন লোকরাই শহরে চলে যাচ্ছে এবং শহরের শালীনতা বিনষ্ট করছে। সেক্ষেত্রে শহরের লোকদিগকে ঠেকিয়ে রাখা নিরর্থক প্রচেষ্টা এবং গ্রামীণ লোকেরা যাতে শহরে এসে বসবাস করতে উৎসাহিত না হয় সেই চেষ্টাই অধিকতর বাঞ্ছনীয়। তদনুসারে তিনি জমি হস্তান্তরের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দেন। নাগরিকদেরকে স্থানান্তরে গিয়ে বাড়িঘর নির্মাণ করতে ও বসতি স্থাপন করতেও তিনি অনুমতি দেন। জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ফলে অতি অল্প সময়ে মুসলিম রাষ্ট্রে জমিদারী ও জায়গীরদারী প্রথার উদ্ভব হয়। এর ফলে অভিজাত মালিক সম্প্রদায় এবং নির্যাতিত প্রজা শ্রেণীর সৃষ্টি হয়ে সমাজে একটি সংঘাত সৃষ্টি করে সত্য; কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, মুসলিম জাতির জীবনধারায় তখন যে বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয় তার ফলেই বিগত বিশ বছরে আরব জাতি যুদ্ধরত সেনানীরূপে, বিজিত প্রদেশের শাসকরূপে অথবা ব্যবসায়ী সওদাগররূপে পৃথিবীর নানা জাতির সাথে মিশেছে, নানা দেশের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে এবং নানা বিচিত্র সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে।
হযরত ওসমানের চরিত্র
৬৪৪ থেকে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খিলাফতে অধিষ্ঠিত থেকে ৮২ বছর বয়সে হযরত ওসমান (রা) শাহাদাৎ বরণ করেন। তিনি ছিলেন মধ্যমাকৃতির লম্বা ‘শ্মশ্রুযুক্ত ‘ গৌরবর্ণের অধিকারী। দানশীলতা, অমায়িকতা, ধর্মভীরুতার জন্য তিনি ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
রাসূলে করীমের দুই কন্যাকে বিবাহ করার জন্য তিনি ‘যুনুরায়েন’ বা দু’টি জ্যোতির অধিকারী বলে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ইসলামের জন্য মুক্তহস্তে দান করেন। বহু অর্থ ব্যয়ে তিনি প্রায় দুই হাজার ক্রীতদাসকে দাসত্ব হতে মুক্ত করেন। সততা, একনিষ্ঠতা এবং ধর্মপরায়ণতায় তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর প্রতিচ্ছবি। বিশাল মুসলিম রাষ্ট্রের খলিফা হয়েও তিনি দীন-দরিদ্রের ন্যায় সরল, অনাড়ম্ভর জীবন-যাপন করতেন। কথিত আছে যে, মাত্র দুটি উষ্ট্র ব্যতীত তিনি তাঁর ধন-সম্পদ ইসলামের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। বায়তুল মাল হতে তিনি এক কপর্দকও গ্রহণ করতেন না। তিনি ব্যবসায়ের লাভ হতে সংসার নির্বাহ করতেন।
মহাপ্রাণ, কর্তব্যপরায়ণ, কোমলমতি, নম্র স্বভাবের খলিফার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বহুগুণের সমাবেশ ছিল। নিরহঙ্কারী, সত্যবাদী, বিনয়ী খলিফা রাসূলুল্লাহর খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহর দুই কন্যার মৃত্যু হলে তিনি খলিফা ওসমানকে বলেন যে, যদি তাঁর অপর কোন কন্যা থাকত তবে তাকেও হযরত ওসমানের সঙ্গে বিবাহ দিতেন। সরল বিশ্বাস, ধৈর্য ও সহনশীলতা তাঁর চরিত্রের ভূষণ ছিল। হযরত ওমরের প্রকৃতি অপেক্ষা হযরত ওসমানের প্রকৃতি ছিল ভিন্নরূপ। ইসলামের সংকটময় যুগে নিজের জীবন বিপন্ন করেও তিনি রক্তপাতের দ্বারা বিদ্রোহ দমন করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তাঁর কোন দেহরক্ষী ছিল না বা মদিনা মসজিদে মাকসুরা নির্মাণ করে তিনি মুসলিমদের নিকট হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে নামাজ আদায় করেন নি। পরবর্তীকালে মুয়াবিয়া দেহরক্ষী ও মাকসুরার প্রচলন করেন। তাঁর মত সরলপ্রাণ, ধর্মভীরু, সহজে বিশ্বাসযোগ্য (docile) খলিফা মারওয়ানের মত ধূর্ত ও চক্রান্তকারীদের দ্বারা পরিচালিত হন। যদি তিনি অপরাধীকে অনুকম্পা প্রদর্শন না করতেন, বিশ্বাসঘাকততার অমোঘ দণ্ড দিতেন এবং বিদ্রোহীদের অন্যায় দাবি পূরণ না করতেন তা হলে ইসলামের ইতিহাসে সম্ভবত এরূপ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটত না। তিনি দেশপ্রেমিক ছিলেন কিন্তু বার্ধকজনিত কারণে তাঁর কার্যকলাপ সময়োপযোগী ছিল না। তাঁর স্নেহপ্রবণতা, পিতৃতুল্য আদর্শ, উদারতা, নিস্পৃহতা, মমত্ববোধ প্রভৃতি গুণ বিচ্ছিন্নতাকারীদের শক্তিশালী হতে সাহায্য করে এবং খোলাফায়ে রাশেদূনের পতনকে ত্বরান্বিত করে। ঐতিহাসিক আমীর আলী যথার্থই বলেন, “ধর্মপরায়ণতাই ছিল তাঁর প্রকৃত কৃতিত্ব।” (His chief merit lay in his piety)
মূইর বলেন, “দুর্বল ও অব্যবস্থিতচিত্ত হলেও তাঁর (হযরত ওসমান) হৃদয়বৃত্তি ছিল কোমল ও উদার। তা না হলে তিনি মুসলিম জাহানের একজন জনপ্রিয় শাসক হিসেবে সমাদৃত হতে পারতেন না।” বস্তুত তাঁর দ্বাদশ বর্ষব্যাপী শাসনামলের প্রথমার্ধে তিনি এরূপ ছিলেন না। কিন্তু তারপরই তাঁর জীবনে দুর্দিন ঘনিয়ে আসে। কুরাইশ ও অ- কুরাইশ আরব গোত্রসমূহের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরব জাতিকে অন্তর্বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের দিকে দ্রুত ঠেলে দেয়। ক্ষমতাসীন কুরাইশ গোত্র যদি তাদের সমগ্র শক্তি একত্র করে তাদের বিপক্ষের মোকাবিলা করত, তা হলে এই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের শোচনীয় পরিণাম হতে আরব জাতি ও খিলাফত রক্ষা পেত। কিন্তু শাসন পরিচালনায় স্বার্থপরায়ণতা এবং গোষ্ঠী কলহের তিক্ততা এমন প্রবল হয়ে উঠে যে, তদ্দরুন তাদের পুরুষানুক্রমিক প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার সৌধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। এভাবে তারা ক্ষমতাসীন থাকার সুবর্ণ সুযোগ হারিয়ে বসে এবং খলিফা আবদুল মালিকের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে এবং গোটা আরব জাতির বিজয়স্রোত রুদ্ধ হয়ে যায়।