তৃতীয় অধ্যায় – শ্রীহট্টের প্রাচীন ও আধুনিক বিবরণ
সংস্কৃত গ্রন্থ সমুহে এই প্রদেশ “শিলহট্ট” এবং শ্রীহট্ট উভয় আখ্যায় পরিচিত হইয়াছে। শিলহট্ট শব্দ হইতে শিলট, শিলট হইতে ইংরেজি “ছিলেট” নামের উৎপত্তি।
চীন পরিব্রাজক হিয়োন সাঙ বলেন, সমতট (বঙ্গ) রাজ্যের উত্তর পূর্বদিকে শিলহট্ট রাজ্য অবস্থিত। এই রাজ্য সমুদ্র (হ্রদ) তীরবর্তী। শ্রীহট্ট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ, ॥২৮৫॥ ময়মনসিংহের পূর্বাংশে ত্রিপুরা জেলার উত্তর পশ্চিমাংশ দর্শনে বোধ হয় এই স্থানে পূর্বে একটি বৃহৎ হ্রদ ছিল। ব্রহ্মপুত্র নদে প্রবাহিত কদম দ্বারা ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরার সন্ধিস্থল সমতল ক্ষেত্রে পরিণত হইলে, এই হ্রদ বিশেষ রূপে মানব মণ্ডলির দৃষ্টি পথে পতিত হইয়াছিল। এজন্যই দ্বাদশ শতাব্দী পূর্বে হিয়োনসাঙ শিলহট্ট রাজ্যটি সমুদ্র তীরবর্ত্তী বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। বড়বক্র প্রভৃতি নদী সমূহ এই হ্রদের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইত। নদী প্রবাহে আনীত কদম রাশি দ্বারা এই হ্রদ ক্রমে শুষ্ক হইয়া অসংখ্য বিল সৃষ্ট হইয়াছে। এই সকল বিলের কান্দি বা উচ্চস্থানস্থিত গ্রামগুলি অদ্যাপি বর্ষাকালে সমুদ্রমধ্যস্থিত দ্বীপ বলিয়া বোধ হয়। অনুনিক শ্রীহট্ট জেলার প্রায় চতুর্থাংশ বিল ও নিম্নভূমি, ইহার সহিত ময়মনসিংহ জেলার পূর্ব প্রান্তস্থিত নিম্নভূমি, ইহার সহিত ময়মনসিঙহ জেলার পূর্ব প্রান্তস্থিত নিম্নভূমি ও ত্রিপুরা জেলার উত্তর পশ্চিম প্রান্তস্থিত নিম্নভূমি সংযুক্ত করিলে বোধ হয় উল্লিখিত হ্রদের পরিমাণ ফল দুই সহস্র বর্গ মাইল হইতেও অধিক ছিল।
আধুনিক শ্রীহট্ট জেলার দক্ষিণ পশ্চিমাংশ সাক্ষাৎ সম্বন্ধে ত্রিপুর-রাজ-ছত্রের অধীন ছিল এবং পূর্বাংশ কাছাড়ের অধিকারভূক্ত ছিল। সুতরাং এক্ষণে যে বিস্তৃত প্রদেশকে জেলা শ্রীহট্ট বলা যায়, তাহার প্রায় অৰ্দ্ধাংশ প্রাচীন কালে ত্রিপুরা ও কাছাড় নরপতিবৃন্দের দণ্ডাধীন ছিল। ক্রমে ক্রমে ॥২৮৬ মুসলমান শাসন কর্তাদিগদ্বারা সেই সেই অংশ শ্রীহট্ট জেলার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। প্রাচীনকালে শ্রীহট্ট তিনটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ১-গৌড় বা শ্রীহট্ট। ২-লাউর-৩-জয়ন্তীয়াপুর। এই তিনটি রাজ্যের মধ্যে গৌড় বা শ্রীহট্টের অধিপতি অধিক বলশালী ছিলেন। কিন্তু সকলকেই ত্রিপুররাজদণ্ডের নিকট মস্তক অবনত করিতে হইত। ত্রিপুরেশ্বর এই তিনটি রাজ্যের অধিপতিগণকে আপনাদিগের সামন্ত শ্রেণীতে স্থান প্রদান করিতেন। কালবশে মুসলমানগণ বাঙ্গালার পূর্ব প্রান্তে উপনীত হইয়া ত্রিপুরার সেই গর্ব খর্ব করিল। মুসলমানদিগের বাঙ্গালায় প্রবেশ কালে যাঁহারা শ্রীহট্টের সিংহাসনে বিরাজ করিতেছিলেন সেই সকল নরপতিগণ আপনাদিগকে চন্দ্রবংশজ বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন। শকান্দের ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে গোবিন্দদেব নামক নরপতি শ্রীহট্টের রাজদণ্ড পরিচালন করিতেছিলেন[১]। রাজা গোবিন্দদেব বোরাহেনদ্দিস নামক জনৈক মুসলমান পীরকে গোহত্যা অপরাধে অপমানিত করিয়াছিলেন। সেই সূত্রে ॥২৮৭॥ বাঙ্গালার মুসলমান শাসনকর্তার সহিত তাঁহার বিরোধ উপস্থিত হয়। মুসলমান ইতিহাস লেখকগণ, গোবিন্দদেবকে “যাদুকর” অর্থাৎ ঐন্দ্রজালিক বিদ্যা-বিশারদ লিখিয়াছেন। সমস-উদ্দিন ইলিয়স সাহর পুত্র সুলতান সেকেন্দর গোবিন্দদেবের বিরুদ্ধে প্রেরিত হন। কিন্তু যাদুবিদ্যার প্রভাবে গোবিন্দদেব প্রথমবার সেকেন্দরকে পরাজিত করেন। দ্বিতীয়বার সেকেন্দর সাহজালাল নামক “দরবেশের” সাহায্যে গোবিন্দদেবকে জয় করিয়া শ্রীহট্ট অধিকার করেন। গোবিন্দদেব রাজ্যচুত হইয়া পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু গোবিন্দদেবের পুত্র ঈশানদেবের তাম্রশাসন পাঠে অনুমিত হয় যে, পিতার মৃত্যুর পর, তিনি শ্রীহট্টের রাজদণ্ড ধারণ করিয়াছিলেন[২]। সুতরাং মুসলমানদিগের শ্রীহট্ট অধিকারের সময় সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ গণ্ডগোল দৃষ্ট হইতেছে। সুবিখ্যাত মূর পরিব্রাজক ইবন বতোতা ১২৭৩-৭৪ শকাব্দে কামরূপের পার্বত্য প্রদেশে (শ্রীহট্টে) গমন করত পীর সাহ জালালকে দর্শন করিয়াছিলেন। ঐতিহাসিক গণনা অনুসারে ১২৭৩-১৩০৬ শকাব্দের মধ্যবর্তী কালে মুসলমানগণ শ্রীহট্ট অধিকার॥২৮৮॥ করেন। কিন্তু দৃঢ়ভাবে তথায় রাজদণ্ড সংস্থাপন করিতে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হইয়াছিল। কারণ মুসলমানকৃত অত্যাচারের প্রতিশোধ লইবার মানসে আসাম ও ত্রিপুরাপতিগণ বারংবার শ্রীহট্ট প্রদেশ আক্রমণ ও লুণ্ঠন করিতে বিরত হন নাই। লাউরপতিগণ অবশেষে মহম্মদীয় ধর্ম গ্রহণ করত মুসলমানদিগের অত্যাচার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু মুসলমানদিগের সৌভাগ্য-সূৰ্য্য অস্তমিত হইবার সময়েও জয়ন্তীয়াপতিগণ আপনাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।
প্রাচীনকালে শ্রীহট্ট প্রদেশ হইতে ভারতের সর্বত্র দাস, দাসী ও খোজা প্রেরিত হইত। বিনীস দেশীয় বিখ্যাত ভ্রমণকারী মার্ক পোলোর[৩] ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘আইন আকবরী’[৪] ও ‘তজক জাহাংগিরী’ গ্রন্থে খোজা ব্যবসায়ের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। আবুল ফজল বলেন, খোজাদিগকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হইয়া থাকে, যথা— ছান্দলী, বাদামী ও কাফুরী। শৈশবে যাহাদের উপস্থ ও মুষ্ক আমূল ছেদিত হয়, তাহাদিগকে ছান্দলী বা আতলছি বলে। কেবলমাত্র যাহাদের মুগ্ধ ছেদিত হয় তাহাদের নাম বাদামী এবং যাহাদের উপস্থ মাত্র ছেদন।২৮৯ করা হয় তাহাদিগকে কাফুরী বলে। সম্রাট জাহাংগীর ঘোষণাপত্র দ্বারা বালকদিগের মুষ্ক উপস্থ ছেদন করিতে দৃঢ়রূপে নিষেধাজ্ঞা প্রচার করিয়াছিলেন; কিন্তু দাসদাসী ক্রয়বিক্রয়ের প্রথা দীর্ঘকাল প্রচলিত ছিল ২৫/৩০ বৎসর পূর্বে ও শ্রীহট্ট প্রদেশে দাসদাসী ক্রয় বিক্রয় হইত, কিন্তু অস্মদ্দেশীয় দাসত্ব প্রথা পাশ্চাত্য দাসত্ব প্রথার ন্যায় ভীষণ ছিল না। কারণ আমাদের দাসদাসীগণ পরিবারের লোক বলিয়া গণ্য হইত। যাহা হউক এই প্রথাও ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট দ্বারা তিরোহিত হইয়াছে।
আবুল ফজল বলেন:-
শ্রীহট্ট সকার পর্ব্বত দ্বারা বেষ্টিত। এখানে সোমতারা (কমলালেবু) নামক সুবর্ণ, সুমিষ্ট ও সুখাদ্য ফল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এবং চোবচিনী নামক ঔষধ উৎপন্ন হইয়া থাকে। “বিহঙ্গরাজ” পক্ষী এই সরকারে পাওয়া যায়।
এই সরকরে সৈন্যসংখ্যা-১১০০ অশ্বারোহী, ১৯০টি হস্তী এবং ৪২৯২০ পদাতিক। রাজস্ব ১৬৭০৩২ টাকা ১৮ দাম৫। ৮টি মহাল যথা—
১। প্রতাপগড় ও পঞ্চখণ্ড। রাজস্ব ৩৭০০০০ দাম। দুইটি স্বতন্ত্র পরগণা। প্রতাপগড়ের পরিমাণ ১৩১॥০ বর্গ মাইল। ॥২৯০॥ পঞ্চখণ্ডের অন্তর্গত দীঘির পার গ্রামবাসী বৈদিক ব্রাহ্মণ কুলেই প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য দেবের আবির্ভাব হয়।
২। বানিয়াচুং। রাজস্ব ১৬৭২০৮০ দাম। এই বৃহৎ মহাল অধুনা বহু খণ্ডে বিভক্ত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। কিন্তু যে অংশ “বানিয়াচুং” নামে পরিচিত হইয়া থাকে, তাহার পরিমাণ ৫৩৫ বর্গ মাইল। এই মহল লাউরের রাজাদিগের অধিকারভুক্ত ছিল। লাউরের যে হিন্দু নরপতি মুসলমান ধর্মগ্রহণ করেন তাঁহার পৌত্র আবিদরেজা লাউর পরিত্যাগ পূবর্বক এই মহালের অন্তর্গত কসবা- বানিয়াচুং নামক গ্রামে বাসস্থান নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। এই গ্রামের আধুনিক লোক সংখ্যা প্রায় পঞ্চবিংশতি সহস্র নদীয়ার অন্তর্গত শান্তিপুর ব্যতীত বাঙ্গালার অন্য কোন গ্রামের লোকসংখ্যা একাধিক নহে।
৩। জয়ন্তীয়া। রাজস্ব ২৭২০০ দাম। জয়ন্তীয়া রাজ্যের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। রাজা টোডড়মল যে কিরূপে ইহাকে একটি মহাল বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন তাহা আমরা বুঝিতে পারি না। প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে ডাক্তার বকনন লিখিয়াছেন যে, বিস্তৃত আধিপত্য ও ক্ষমতা অনুসারে জয়ন্তীয়াপতি রাজা[৬] উপাধি ধারণ করিবার উপযুক্ত পাত্র বটেন। মুসলমানগণ জয়ন্তীয়ারাজের প্রতি অত্যাচার করিতে ॥২৯১॥ ত্রুটি করেন নাই, কিন্তু তাহারা কখনো জয়ন্তীয়ার স্বাধীনতারত্ন হরণ করিতে সক্ষম হন নাই। চেরাপুঞ্জীর এসিষ্টান্ট কমিসনর মৃত হিরি ইংলিশ সাহেবের যত্নে জয়ন্তীয়া রাজবংশ হৃতসর্বস্ব হইয়াছেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে জয়ন্তীয়া রাজ্য ব্রিটনয়িার লোহিত রেখায় রঞ্জিত হইয়াছে[৭]। জয়ন্তীয়াপতিগণ খসবংশ সম্ভূত হইলেও ব্রাহ্মণগণ তাহাদিগকে বিশুদ্ধ আৰ্য বংশজ করিয়া লইবার জন্য বিশেষ যত্ন ও পরিশ্রম করিয়াছিলেন। তন্ত্রে জয়ন্তীপুর একটি পীঠস্থান বলিয়া প্রচার করা হইয়াছে। এক সময় এই জয়ন্তীয়া রাজ্য উত্তর দক্ষিণে ৮০ মাইল দীর্ঘ ও পূবর্ব পশ্চিমে ৪০ মাইল পরিসর ছিল। জয়ন্তীয়াপতি রাজেন্দ্র সিংহকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া ব্রিটিশ গবর্ণমেন্ট ৩৮৫০ বর্গমাইল বিস্তৃত একটি রাজ্য প্রাপ্ত হইয়াছেন। ॥২৯২॥
৪। বাজিয়া ব্যাজু। রাজস্ব ৮০৪০৮০ দাম। অধুনা একটি ক্ষুদ্র মহাল, পরিমাণ ৪॥ বর্গমাইল।
৫। হাবিল শ্রীহট্ট। রাজস্ব ২২৯০৭১৭ দাম। আধুনিক কসবা -শ্রীহট্ট ও তদন্তর্গত মহাল। পীর সাহজালালের সমাধি মন্দির শ্রীহট্টনগরে একটি কীৰ্ত্তি চিহ্নস্বরূপ অদ্যাপি বর্তমান রহিয়াছে। কিন্তু সেই সাহজালাল এবং আমাদের পূর্বোল্লিখিত সাহজালাল এক ব্যক্তি কিনা তৎপক্ষে বিলক্ষণ সন্দেহ রহিয়াছে। ৯১১ হিঃ অব্দের (১৪২৭ শকাব্দের একটি মসজিদের দ্বারস্থ প্রস্তর লিপি পাঠে জ্ঞাত হওযা যায় যে, যাঁহার সমাধি মন্দির অদ্যাপি বর্ত্তমান রহিয়াছে, সেই পীর শেখ জালাল আরবের অন্তর্গত কনয়া নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু মূর পরিব্রাজক ইবন বতোতা যাঁহাকে দর্শন করিয়াছিলেন, তিনি তাব্রিজ দেশ জাত। খানবালিক (পিকিন) নিবাসী পীর বোরাহেন-উদ্দিনকে উপহার প্রদান ॥২৯৩॥ জন্য পীর জালাল উদ্দীন, ইবন বতোতাকে একটি খিল্কাপ্রদান করিয়াছিলেন। যদিচ শ্রীহট্টের সাহাজালাল বিখ্যাত মুসলমান পীরদিগের তালিকাভুক্ত নহেন; তথাপি শ্রীহট্ট প্রদেশে তাঁহার অসাধারণ প্রভুত্ব ও সম্মান রহিয়াছে। তথায় তিনি তিনি “তিনলাখ পীরের” শ্রেষ্ঠ বলিয়া কথিত হইয়া থাকেন[৮]।
৬। সতরখণ্ডল। রাজস্ব ৩৯০৪৭২ দাম। ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত সরাইল পরগণার কিয়দংশ অদ্যাপি সতরখণ্ডল নামে পরিচিত রহিয়াছে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া নগর এই অংশ মধ্যে অবস্থিত। এতদ্বারা অনুমিত হয় যে, জেলা ত্রিপুরার অন্তর্গত সর্বাপেক্ষা বৃহৎ পরগণা সরাইলের কিয়দংশ তৎকালে শ্রীহট্টের মুসলমান শাসনকর্তাদিগের অধিকারভুক্ত ও অবশিষ্টাংশ ত্রিপুরেশ্বরদিগের করতলস্থ ছিল। শ্রীহট্টের শাসনকৰ্ত্তাগণ ক্রমে ক্রমে সমগ্র সরাইল ও ময়মনসিংহের অন্তর্গত জোয়ানসাহি পরগণা ॥২৯৪॥ অধিকার করেন। মুরশিদকুলি খাঁর শাসনকালে সরাইল (সতরখণ্ডল সহ) ও জোয়ানসাহি শ্রীহট্ট হইতে খারিজ হইয়া ঢাকা নেয়াবতের “নাউরা” সেরেস্তার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল।
৭। লাউর। রাজস্ব ২৪৬২০২ দাম। লাউর নগরী অদ্যাপি বর্তমান আছে। এই নগর খস পর্বতের মূলদেশে অবস্থিত। খস পর্বতের কিয়দংশ ও আধুনিক সুনামগঞ্জ উপবিভাগের অধিকাংশ এবং হবিগঞ্জ উপবিভাগের কিয়দংশ লাউর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। লাউরের অধিপতিগণ ব্রাহ্মণ বংশজ ছিলেন। লাউরের রাজা গোবিন্দদেব একজন বিখ্যাত নরপতি। তিনি মুসলমানদিগের সহিত অবিরত যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তদন্তে তাঁহার উত্তরাধিকারিগণ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করত আত্মরক্ষা করিতে সক্ষম এবং রাজার পরিবর্তে “রেজা” উপাধি প্রাপ্ত হন। অদ্যাপি এই রেজাবংশ বানিয়াচুং গ্রামে বাস করিতেছেন। কিন্তু সৌভাগ্য লক্ষ্মী তাঁহাদের ॥২৯৫॥ প্রতি বিমুখ হইয়াছেন। আধুনিক লাউর পরগণার পরিমাণ ১০৬ বর্গমাইল।
৮। হরিনগর রাজস্ব ১০১৮৫৭ দাম। অধুনা ক্ষুদ্র একটি পরগণা, পরিমাণ ১২ বর্গমাইল।
মোগল শাসনকালে শ্রীহট্টের শাসনকর্তাগণ পশ্চিমে ময়মনসিংহের অধীন নেত্রকোণা মহকুমার অন্তর্গত অধিকাংশ ভূমি এবং জোয়ানসাহি পরগণা; দক্ষিণদিকে ত্রিপুরার অন্তর্গত সরাইল বজোরা, তরপ, প্রভৃতি অনেকগুলি পরগণা অধিকারভুক্ত করিয়াছিলেন। পূর্বদিকে শ্রীহট্টের সীমারেখা বদরপুরের নিকটবর্ত্তী হইয়াছিল।
১৬২৪ শকাব্দে (১৭২২ খ্রিঃ অঃ) নবাব মুরশিদ কুলি খাঁ “জমা কমালে তুমারি” নামক যে রাজস্বের হিসাব প্রস্তুত করেন তাহাতে সুবে বাঙ্গালা ত্রয়োদশ চাকলায় বিভক্ত হইয়াছে। তন্মধ্যে চাকলে শিলহট ১৪৮টী মহাল ও পরগণায় বিভক্ত হইয়াছে এবং তাহার রাজস্ব ৫৩১৪৫৫ টাকা লিখিত হইয়াছে। ইহার সতরবৎসর অন্তে (১১৩৫ বঙ্গাব্দে) নবাব সুজাউদ্দিন “দমা তুমারি তকছিছি” নামক যে রাজস্বের হিসাব প্রস্তুত করেন, তাহাতে শিলহট্ট ফৌজদারির অন্তর্গত কেবল মাত্র ৩৬টী পরগণা খালিসা ও তাহার রাজস্ব ৭০০১৬ টাকা লিখিত আছে, অবশিষ্ট সমস্তই জায়গীর ও নানা প্রকার বৃত্তিতে বিভক্ত দৃষ্ট হয়। ॥২৯৬॥
মোগল সম্রাট আওরংজেবের শাসনকালে মগ ও পর্তুগিজ দস্যু দিগের আক্রমণ হইতে বাঙ্গালা দেশ রক্ষা করিবার জন্য ঢাকায় “নাওরা বিভাগ[৯] সংস্থাপিত হয়। উক্ত বিভাগের ব্যয় নির্বাহ জন্য পূর্ববঙ্গের অনেকগুলি পরগণা ক্রমে ক্রমে ঢাকার নেজামত সেরেস্তায় অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। ১১৬৯ বঙ্গাব্দে সরাইল, জোয়ানসাহি ও তরপ নামক তিনটী বৃহৎ পরগণা চাকলে শ্রীহট্ট হইতে খারিজ হইয়া ঢাকার নাওরা বিভাগ ভুক্ত হইয়াছিল। তৎকালে এই তিনটী পরগণার রাজস্ব ১৫৬৭৪০ টাকা শ্রীহট্ট হইতে খারিজ হইয়া ঢাকার নেজামত সেরেস্তায় দাখিল হইয়াছিল।[১০]
বানিয়াচুং মহাল যদিচ তৎকালে শ্রীহট্ট হইতে খারিজ হয় নাই কিন্তু বানিয়াচংয়ের অধিপতি ৪৮ খানা কোষ নৌকা যুদ্ধ কালে নবাবের আদেশানুসারে উপস্থিত রাখিতে বাধ্য ছিলেন এবং তাহার রাজস্ব ৬১৯৪১ টাকা নাওরা জায়গীর উল্লেখ বাদ পাইতেন। দিল্লীর রাজদরবারে শীতলপাটী ॥২৯৭॥ ও মোগা তসর প্রেরণ জন্য (৩১ টি মহালের রাজস্ব) ২৮৯৬৪ টাকা। হস্তীধৃত করার খরচ (এগারশতী প্রভৃতি ১৫ পরগণার রাজস্ব) ২৮৯৮৮ টাকা এবং হস্তীর খোরাকী (৩০টি পরগণার রাজস্ব) ১৮০৪৪ টাকা জায়গীর স্বরূপ নির্দিষ্ট ছিল। সুশং ও কাছাড়ের বার্ষিক ৪৮৪৫ টাকা লিখিত আছে। এইরূপ চাকলে শ্রীহট্টের অধিকাংশ রাজস্ব জায়গীর ও বৃত্তিতে ব্যয়িত হইত।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে আগষ্ট মাসে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বাঙ্গালা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী পদ প্রাপ্ত হন। সেই সূত্রে শ্রীহট্ট ব্রিটনিয়ার লোহিত রেখায় রঞ্জিত হইয়াছে। তৎকালে শ্রীহট্ট জেলার পরিমাণ ২৮৬১ বর্গমাইল ছিল। টেকরী সাহেব শ্রীহট্টের প্রথম ইংরেজ শাসনকর্তা। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট লেগুছে সাহেব জেলা শ্রীহট্টের কালেক্টরের পদে নিযুক্ত হন। তিনি লিখিয়াছেন :-
“আমি শ্রীহট্টে উপনীত হইয়া নিয়মানুসারে প্রথমেই সাহজালালের দরগায় গমন করি। ৫টী স্বর্ণ মোহর দরগায় “নজর” প্রদান পূর্বক স্বীয় বাস ভবনে প্রত্যাবর্তন করিলে শ্রীহট্টবাসীগণ দলে দলে উপস্থিত হইয়া আমাকে “নজর” প্রদান করেন। সেই নজরের টাকায় আমার টেবল পরিপূর্ণ হইয়া গেল। রাজস্ব আদায় করাই আমার কার্য্য ছিল। দেওয়ানী কার্য্যের প্রতিও দৃষ্টি রাখিতাম। ফৌজদারী ॥২৯৮ নবাবের কর্তৃত্বাধীনে ছিল। এখানকার রাজস্ব অধিকাংশ কড়ি দ্বারা আদায় হইয়া থাকে।
“এই জেলায় অতি উত্তম চুন প্রস্তুত হইয়া বিদেশে প্রেরিত হয়। গ্রিক ও আরমানিগণ চুনের ব্যবসায় বসিয়া থাকে”।
“এক বৎসর মহরমের সময় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কলহ উপস্থিত হয়। শান্তি রক্ষার জন্য আমি ৫০ জন সৈন্য লইয়া বিবাদ স্থলে গমন করি। আমি মুসলমানদিগকে অনেক বুঝাইলাম, তাহাদের খালিফা উত্তর করিল, অদ্য আমাদের মরিবার এবং মারিবার দিন, এই সময়ে একজন মুসলমান আমাকে আক্রমণ করে, তাহার আঘাতে আমার তরবারী দ্বিখণ্ড হইল। কিন্তু আমি শীঘ্রহস্তে পিস্তল দ্বারা খলিফাকে বধ করিলাম এবং আমার সঙ্গীয় সৈন্যগণকে বন্দুক চালাইতে অনুমতি দিলাম, বন্দুকগুলিতে খলিফার দুই ভাই হত ও অনেকগুলি মুসলমান আহত হইলে তাহারা পলায়ন করিল। আমাদের পক্ষে একজন সৈন্য হত ও ৬ জন আহত হইয়াছিল। আমি এই সংবাদ গবর্ণমেন্টে প্রেরণ করিলাম”।
“১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে এবং তৎপূর্ব বৎসর শ্রীহট্ট জেলায় প্রচুর পরিমাণে ধান্য উৎপন্ন হয়। তদ্বারা ধান্য ও চাউলের মূল্য অত্যন্ত হ্রাস হইয়া যায়। রাজস্ব আদায় সুকঠিন হইয়া উঠে। খাজানা মাপের জন্য আমি গবর্ণমেন্টে রিপোর্ট করি, ॥২৯৯॥ সরকারি গুদামে ধান্য মজুত রাখিয়া গবর্ণমেন্ট কিছুকালের জন্য রাজস্ব আদায় বন্ধ রাখিতে আদেশ করেন। নদীতীরে গুদাম প্রস্তুত করিয়া তাহাতে ধান্য নদীর স্রোতে ভাসিয়া গেল, সহস্রাধিক মনুষ্য ও পশু পক্ষী জল প্লাবন বিনষ্ট হইয়াছিল। ভীষণ দুর্ভিক্ষের সূচনা দর্শনে চাউল প্রেরণ করিবার জন্য গবর্ণমেন্টে রিপোর্ট করিলাম। গবর্ণমেন্ট চাউল পাঠাইলেন বটে কিন্তু ইহার তত্ত্বানুসন্ধান জন্য গবর্ণমেন্ট অন্য একজন অফিসার প্রেরণ করিয়াছিলেন। দুর্ভিক্ষ ও তৎসহচর নানা প্রকার পীড়ায় তৎকালে শ্রীহট্টে তৃতীয়াংশ অধিবাসী বিনষ্ট হয়।”[১১]
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিস বাঙ্গালার জমিদারগণ সহিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন। তদনুসারে শ্রীহট্ট জেলার ভূম্যধিকারিগণ সহিতও “দশশালা” বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইয়াছিল। শ্রীহট্টের মঙ্গল ও উন্নতির প্রধান কারণ এই যে, এই জেলার ভূম্যধিকারিগণ সকলেই রাজকীয় ধনাগরে স্ব স্ব অধিকৃত ভূমির রাজস্ব পরিশোধ করিয়া থাকেন। শ্রীহট্ট জেলায় “মারফতদার” বৃহৎ জমিদার নাই বলিলে নিতান্ত অত্যুক্তি হয় না। লর্ড কর্ণওয়ালিসের ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি মন্তব্য লিপির মঙ্গলময় ফল শ্রীহট্ট প্রদেশে সম্পূর্ণরূপে ফলবতী হইয়াছে। বাঙ্গালার অন্য কোন জেলায় ৩০০॥ তদ্রূপ হয় নাই। এখানে জমিদার ও তালুকদার এক শ্রেণীতে দণ্ডায়মান, সকলেই গৌরবের সহিত আত্মসম্মান রক্ষা করিতে সক্ষম। শ্রীহট্টের ভূম্যধিকারিগণ সাধারণত “মিরাসদার” আখ্যায় আখ্যাত হইয়া থাকেন।
গবর্ণমেন্টের বন্দোবস্ত অনুসারে জেলা শ্রীহট্টের অন্তর্গত মহালগুলি নিম্নলিখিত আখ্যায় পরিচিত হইয়া থাকে।
১: দশশালা বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী মহাল। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিসের বিধি অনুসারে যে সকল মহাল বন্দোবস্ত হইয়াছিল।
২: হালাবাদী মুদামী। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে যে সকল নূতন আবাদী মহাল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইয়াছে।
৩: খাস হালাবাদী। যে সকল হালাবাদী মুদামী মহাল বাকী খাজনার জন্য নিলাম হইলে গবর্ণমেন্ট ক্রয় করিয়া পুনর্বার অন্যের নিকট বিক্রয় করিয়াছেন।
৪: খাস মুদামী। দশশালা বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী মহাল বাকী খাজানার জন্য নিলাম হইলে গবর্ণমেন্ট ক্রয় করিয়া সাবেক জমায় অন্যের নিকট বিক্রয় করিয়াছেন।
৫: জৈন্তা মুদামী। জয়ন্তীয়ার রাজার দত্ত ভূমি বাজেয়াপ্ত হইয়া যাহা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইয়াছে।
৬: এলাম মুদামী। গবর্ণমেন্ট ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ৩০১ ৩৭১ নং চিঠির মর্মানুসারে ৫ বছরের রাজস্ব গ্রহণ পূর্বক যে সকল মহাল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইয়াছে।
৭: বাজেয়াপ্তি মুদামী মহাল। দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, চেরাগী, শিন্নি, রুজিনা মদদামা বা দরসসফা, তখামুজরাই; নাকার, খানেবাড়ী, তোপখানা, হুড়মহাল, ইজাত, সাফি, খুসবাস ও অন্যান্য বিবিধ প্রকার নিষ্কর ও জায়গরি ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের দুই আইন মতে বাজেয়াপ্ত হইয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইয়াছে।
৮: মেয়াদী বন্দোবস্ত মহাল। এই সকল মহাল এলাম, ওয়েষ্টলেন্ড, চড়ভরট, বিলভরট জলকর, নান্কর পাটওয়ারী জৈন্তা রায়তওয়ারি ও খাস মেয়াদী প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত। তন্মধ্যে ওয়েষ্টলেন্ড সমস্তই চাকর কোম্পানির সহিত ২৩ এবং ৩০ বৎসর মেয়াদে বন্দোবস্ত হইয়াছে। এলাম মহাল পূর্ব মালিক সহিত ২০ বৎসর মেয়াদে বন্দোবস্ত হইয়াছে।
অধুনা শ্রীহট্ট জেলার পরিমাণ ৫৩৮৩ বর্গমাইল। অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় বিশ লক্ষ। এই জেলা ৫টি মহকুমায় বিভক্ত যথা— সদর, মৌলবিবাজার, করিমগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ। শ্রীহট্ট জেলা সবর্বদা ঢাকা বিভাগের অধীন ছিল। ১৭৯৪ শকাব্দে আসামের চিফ কমিশনের অধীন হইয়াছিল। শ্রীহট্ট হিন্দুগণ মধ্যে কায়েস্থ জাতীয় দাসবংশীয় দস্তি দারগণ ॥৩০২॥ বিশেষ সম্মানিত। মোগল শাসনকালে এই বংশের স্থাপনকর্তা হরেকৃষ্ণ দাস শ্রীহট্টের শাসন কর্তৃত্বে (আমিলের পদে) নিযুক্ত হইয়াছিলেন। প্রবাদ অনুসারে “মজুমদার” উপাধি প্রাপ্ত সম্মানিত মুসলমান পরিবার উল্লিখিত দস্তিদারবংশ হইতে উদ্ভুত। এই প্রবাদ বাক্য সত্য হউক আর না হউক, প্রোক্ত মুসলমান বংশের স্থাপনকৰ্ত্তা চাকলে শ্রীহট্টের কাননগুই পদ লাভ করত “মজুমদার” উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। মুসলমান শাসনকালে প্রত্যেক চাকলায় রাজস্ব সংক্রান্ত প্রধান কর্মচারী “কাননগুই” উপাধি প্রাপ্ত হইতেন। কাননগুইদিগের সাধারণ উপাধি মজুমদার। এই পদটি মুসলমান শাসনকালেও হিন্দুগণের একচেটিয়া ছিল। সুতরাং উল্লিখিত প্রবাদ বাক্য সত্য বলিয়া বোধ হইতেছে।
ভূম্যধিকারিগণ মধ্যে বানিয়াচুংয়ের জমিদার বংশ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও সম্মানিত। পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, লাউরের রাজবংশ হইতে এই জমিদার বংশ উদ্ভুত। লাউর রাজগণ কাত্যায়ণ গোত্রজ ব্রাহ্মণ ছিলেন। পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে যে লাউরপতি মুসলমানদিগের অত্যাচারে মহম্মদীয় ধর্ম গ্রহণ করত “রাজার” পরিবর্তে “রেজা” আখ্যা ধারণ করেন। তদ্বংশধরগণ অদ্যাপি নামের সহিত সেই “রেজা” শব্দ সংযুক্ত করিয়া থাকেন।
শ্রীহট্টের ব্রাহ্মণগণমধ্যে বৈদিক সম্প্রদায় বিশেষ ॥৩০৩॥ সম্মানিত। শ্রীহট্টের বৈদিককুলে প্রেমাবতার চৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেন। এই বৈদিককুলে বিখ্যাত পণ্ডিত গদাধর ন্যায়সিদ্ধান্তবাগীশ আবির্ভূত হন। অদ্যাপি সংস্কৃত ব্যবসায়ী পণ্ডিতগণ ঘোষণা করিয়া থাকেন যে, “ছিলটিয়া গদা সোনার গদা।” যে রঘুনাথ শিরোমণি বাঙ্গালায় ন্যায়শাস্ত্রের প্রাধান্য সংস্থাপন পূর্বক অমরত্ব লাভ করিয়াছেন; গদাধর সেই মহাত্মার প্রিয়তম ছাত্র এবং জগদীশ তর্কালঙ্কারের গুরু। গদাধর স্বীয় গুরুর নিকট পাঠ সমাপন পূর্বক নবদ্বীপে টোল করিয়া তথায় শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। শিরোমণির মৃত্যুর পর গদাধরই বঙ্গীয় নৈয়ায়িক পণ্ডিত সমাজের শিরোভূষণ বলিয়া কীৰ্ত্তিতে হইয়াছিলেন। তিনি “চিন্তামণি আলোক” ও “দীধিতির” যে টীকা রচনা করেন তাহা অদ্যাপি “গাদাধরী” বলিয়া সর্বত্র পরিচিত রহিয়াছে। তাঁহার সর্বপ্রধান ছাত্র জগদীশ তর্কালঙ্কার ন্যায় শাস্ত্রের বিখ্যাত ভাষ্যকার। পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ জগদীশ “শব্দশক্তি প্রকাশিকা” (বাদার্থ) ও “তর্কামৃত” (বৈশেষিক) নামক দুইখানি গ্রন্থ রচনা করিয়া স্বীয় অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। গদাধরের মৃত্যুর পর অন্যান্য পণ্ডিতগণ শ্রীহট্টের ব্রাহ্মণ সমাজের মুখোজ্জ্বল করিয়া গিয়াছেন। তন্মধ্যে রাধাকান্ত সিদ্ধান্তবাগীশ নবদ্বীপে পাঠ সমাপনপূর্বক নবদ্বীপেই অধ্যাপনা ॥৩০৪॥ করিয়াছিলেন। সম্প্রতি সংস্কৃত কলেজের উপাধি পরীক্ষায় শ্রীহট্টের দুইটি ব্রাহ্মণ ছাত্র ন্যায় ও সাঙ্খ্যদর্শনের পরীক্ষায় বিশেষ সম্মানের সহিত উত্তীর্ণ হইয়া নানা প্রকার পুরস্কার লাভ করিয়াছেন।
শ্রীহট্টের “সাহাগণ” স্বজাতীয় সমাজে বিশেষ সম্মানিত। শ্রীহট্টের উচ্চ শ্রেণীতে হিন্দুগণ অধিকাংশ শাক্ত এবং নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুগণ অধিকাংশ বৈষ্ণব। শ্রীহট্ট প্রদেশে শাক্ত অপেক্ষা বৈষ্ণবের সংখ্যা অধিক। বৈষ্ণবদিগের অনেকগুলি আখড়া আছে, তন্মধ্যে বিথঙ্গলের আখড়াই সৰ্বপ্ৰধান।
শ্রীহট্টবাসিগণ শিল্পকার্য্যে সুনিপুণ২২। শ্রীহট্টের কারুগণ গজদন্তদ্বারা পাটি, পাখা, চুড়ি ও চেইন প্রস্তুত করিতে পারে। চুয়াল্লিশ পরগণার শীতল পাটি সর্বোৎকৃষ্ট; তরপ পরগণার কোপ্তের কার্য্য ও ইটা পরগণায় উৎকৃষ্ট লৌহকার্য হইয়া থাকে। পাথারিয়া পরগণায় আগর দ্বারা আতর প্রস্তুত হয়। আরব ও শ্যাম দেশীয়গণ এই আতর বিশেষ আগ্রহের সহিত গ্রহণ করে। নাগেশ্বর ফুল হইতেও আতর প্রস্তুত হইয়া থাকে।
শ্রীহট্ট প্রদেশে নানা প্রকার উৎকৃষ্ট ফল জন্মিয়া থাকে। খসিয়া পর্বতজাত কমলালেবু শ্রীহট্ট হইতে সর্বত্র প্রেরিত হয়। বাহাদুরপুর পরগণার অন্তর্গত জলঢুপ নামক স্থানে অতি উৎকৃষ্ট আনারস উৎপন্ন হয়। ইতিহাস লেখক ॥৩০৫॥ বিবিধ স্থান ভ্রমণ করিয়াছেন, কিন্তু এইরূপ আনারস অন্য কোনও স্থানে তিনি প্রাপ্ত হন নাই। জনৈক গ্রন্থকার লিখিয়াছেন, “ইহার তুল্য ফল ভারতবর্ষের আর কোনও স্থানে নাই।” লঙ্গরা পরগণায় এলাচি- সুবাসিত উৎকৃষ্ট লেবু প্রচুর পরিমাণে প্রাপ্ত হওয়া যায়। কলা সমূহের মধ্যে “অমৃত সাগর” বা “ডিঙ্গমাণিক” অতি বৃহৎ, সুখাদ্য ও সুমিষ্ট। “থৈফল” (অম্লবেতস ) নামক একপ্রকার অম্লরসাত্মক ফল কেবল শ্রীহট্টের পার্বত্য প্রদেশে উৎপন্ন হইয়া থাকে। অল্পকাল মধ্যে শ্রীহট্ট জেলায় অনেকগুলি চা বাগান হইয়াছে। তন্মধ্যে পাঁচটি মাত্র দেশীয় লোকের, অন্যগুলি ইউরোপীয় ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির অধিকৃত।
শ্রীহট্টের প্রধান পণ্য দ্রব্য-ধান্য, তণ্ডুল, চুণ; আলু, কমলা, গালা, মম, মধু, কমলা মধু, চা, হস্তী ও হস্তীদন্ত, এবং তেজপত্র।
শ্রীহট্ট জেলার দক্ষিণদিকে ত্রিপুরা ও ত্রিপুরার দক্ষিণাংশে নওয়াখালী এবং নওয়াখালীর দক্ষিণদিক চট্টগ্রাম জেলা অবস্থিত। গ্রন্থের শেষভাগে ত্রিপুরা ও নওয়াখালী জিলার বিবরণ লিখিতে ইচ্ছা করি, এজন্য পরবর্ত্তী অধ্যায়ে চট্টগ্রামের বিবরণ লিখিত হইতেছে ॥৩৬০॥
.
টীকা
১. গোবিন্দদেবের তাম্রশাসন পাঠে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, ইনি নারায়ণ দেবের পুত্র, গোকুল দেবের পৌত্র ও খরবান দেবের প্রপৌত্র। রাজা গোবিন্দদেব ভট্টপাঠক (ভাটপাড়া) গ্রামে একটি মন্দির নির্মাণ করিয়া তাহাতে শ্রীহট্টনাথ শিব স্থাপন করেন। সেই দেবতার সেবাপূজার ব্যয় নির্বাহ জন্য ৩৭৫ হল ভূমি ও ২৯৬ খানা বাস্তু দান করিয়াছিলেন।
২. ঈশানদেবের তাম্র শাসনে লিখিত আছে যে, রাজা ঈশানদেব একটি উচ্চ শীর্ষ মন্দির নির্মাণ করিয়া তাহাতে মধুসূদন মূৰ্ত্তি স্থাপন করেন। সেই দেবতার সেবা পূজার ব্যয় নির্বাহ জন্য ২ হল ভূমি দান করা হইয়াছিল।
৩. Wright’s Marco Polo P. 280
Yule’s Marco Polo Vol. II P. 79
৪. ব্লকমান প্রকাশিত মূল আইন আকবরী ৩৮৯ পৃঃ
৫. দাম, আধুনিক ডবল পয়সার ন্যায় এক প্রকার তাম্রমুদ্রা। চল্লিশ দামে সেরসাহি এক টাকা। তুডর মল্লের ওয়াশীল তোমরজমা সেরসাহের রাজস্ব হিসাবের নকল মাত্র।
৬. এ স্থলে রাজা King বুঝিতে হইবে।
৭. In 1892, four subjects of the British Government were Seized by Chutter Sing, The Raja of Goba, one of the petty Chieftains depen- dant on Jynteeah, to whom the order was coveyed from the heir apparent (the present Raja) by the chief of Nurthing; They were carried to a temple within the boundaries of Goba, where three were barbarously immolated at the shrine of Kali; the fourth prov- identially effected his escape into the British territories and gave intimation of the horrible Sacrifice which had been accomplished. (Mackenzie’s North East Froniters of Bengal P. 210)
এই নরবলির অপরাধেই জয়ন্তীয়ারাজ ব্রিটিস গবর্ণমেন্টের দ্বারা রাজ্যচ্যুত হইয়াছিলেন। এই ঘটনাটি সত্য হইলে জয়ন্তীয়াপতির উপযুক্ত দণ্ডই হইয়াছিল। কিন্তু ইতিহাস লেখকের পিতৃস্বসাপতি বাবু রামশরণ দত্ত চেরাপুঞ্জির এসিসটেন্ট কমিশন হেরি ইংলিশ সাহেবের অফিসে সেরেস্তদার ও পিতৃব্য বাবু কালীনাথ সিংহ তাহার অধীনে ‘জেইলার’ ছিলেন; তাহাদের দ্বারা যেরূপ অবগত হইয়াছি তদ্বারা এই ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে আমরা বিশেষ সন্দিহান রহিয়াছি।
৮. পারসি ভাষায় সাহজালালের একখানা ইতিহাস আছে। শ্রীহট্ট নিবাসী মৌলবী নছরউল্লা সেই গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া বাঙ্গালা (মুসলমানী) ভাষায় ‘তত্তারিখে জালালি’ নামক ইতিহাস রচনা করিয়াছেন। এই গ্রন্থের ৫ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে যে,
“সাহজালাল নামে ছিল চারিজন অলি।
জারজে লকব আছে জানিবে সকলি।।”
প্রথম সাহজালাল বোখলা দেশে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় সাহজালাল তাব্রিজ দেশবাসী ছিলেন। তৃতীয় সাহজালাল কোরেসী নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম মহাম্মদ, পিতামহের নাম এব্রাহিম, ইনিই শ্রীহট্ট জয় করেন। চতুর্থ সাহজালাল তাব্রিজ গঞ্জেরয়াবাসী ছিলেন। সুতরাং দেখা যাইতেছে ইবন বাতোতা দ্বিতীয় সাহজালালের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন যাঁহার সমাধি মন্দির শ্রীহট্ট নগরীর গৌরব স্তম্ভ স্বরূপ অদ্যাপি বর্তমান রহিয়াছে, ‘তত্তারিখে জালালি’ লেখক কনয়া নিবাসী সেই সাহজালালের উল্লেখ করেন নাই বোধ হয় কনযা কোরেসী অভিন্ন নগরী।
৯. Naval Establishment.
১০. চাকলে শ্রীখণ্ড হইতে খারিজ :-
সরাইল সতরখণ্ডল (অধুনা ত্রিপুরা জেলার অধীনে) – ১১১০৮৪
জোয়ানসাহি (অধুনা ময়মনসিংহের অধীনে) – ৩৩৮২০
তরপ (অধুনা শ্রীহট্টের অধীনে) ১১২১৭ টাকার মধ্যে – ১১৮৩৫
মোট – ১৫৬৭৪