তৃতীয় অধ্যায়—মহিষাসুর বধ
ঋষি কহিলেন, সেই সৈন্য সকল নিহত হইতেছে দেখিয়া সেনাপতি মহাসুর চিক্ষুর, যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত ক্রোধে অম্বিকার নিকট আগমন করিল। জলধর (মেঘ) যেরূপ সুমেরু পর্ব্বতের শৃঙ্গে জলবৃষ্টি করে, সেই অসুরও সেইরূপ দেবীর উপর শরবৃষ্টি করিতে লাগিল। তৎপরে দেবী অবলীলাক্রমে তাহার শরনিকর (শরসমূহ) ছেদন করিয়া তাহার রথের অশ্বগণ ও সারথিকে বাণ দ্বারা বিনাশ করিলেন। দেবী, তখনি আবার তাহার ধনু ও অতি উন্নত ধ্বজ ছেদন করত ছিন্নধন্বা (যার ধনুক ভেঙে গেছে) সেই চিক্ষুরের গাত্রসমূহ বাণনিকর দ্বারা বিদ্ধ করিলেন। তখন ছিন্নধন্বা, রথহীন, অশ্বহীন ও সারথি-রহিত সেই অসুর খড়্গ ও চর্ম্ম ধারণপূর্ব্বক দেবীর দিকে ধাবিত হইল এবং অতিবেগে তীক্ষ্ণধার খড়্গ দ্বারা সিংহের মস্তকে আঘাত পূর্ব্বক দেবীরও বাম বাহুতে প্রহার করিল। হে নৃপনন্দন! সেই অসুরের খড়্গ দেবীর বাহুস্পর্শে ভগ্ন হইয়া গেল। তৎপরে রোষভরে অরুণীকৃতলোচন (রক্তবর্ণ চোখ) সেই মহাসুর শূল গ্রহণ করিয়া ভদ্রকালীকে লক্ষ্য করত নিক্ষেপ করিল। আকাশ হইতে পতনোন্মুখ সূর্য্যবিম্বের ন্যায় তেজোরাশি দ্বারা সাতিশয় জাজ্বল্যমান পতনোন্মুখ সেই শূল দেখিয়া দেবী স্বীয় শূল মোচন করিলেন। সেই দেবী-পরিত্যক্ত শূল অসুর-প্রক্ষিপ্ত শূলকে শত খণ্ড করত মহাসুর চিক্ষুরকেও শত খণ্ড করিয়া ফেলিল। ১-৯
মহিষাসুর-সেনাপতি সেই মহাবীর্য্য চিক্ষুর নামে অসুর নিহত হইলে, চামর নামক অসুর গজারূঢ় হইয়া (হাতিতে চড়ে) যুদ্ধার্থ দেবীর সম্মুখে আগমন করিল। সেই চামরাসুর দেবীকে লক্ষ্য করিয়া শক্তি পরিত্যাগ করিল (ছুঁড়লো); কিন্তু সেই শক্তি দেবীর হূঙ্কারশব্দে অভিহত (আঘাতপ্রাপ্ত বা প্রতিহত) ও নিস্প্রভ হইয়া ভূমিতলে পতিত হইল। স্বকীয় শক্তিকে ভগ্ন ও নিপতিত দেখিয়া চামরাসুর ক্রোধপুরঃসর শূল নিক্ষেপ করিল; দেবী স্বীয় বাণ দ্বারা সেই শূলকে ছেদন করিলেন। অনন্তর দেবীর বাহন সিংহ লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক গজকুম্ভমধ্যে (হাতির মাথার উপরে মাংসপিণ্ডাকার স্থানের মধ্যে) আরোহণ করিয়া হস্তিপৃষ্ঠে সেই অসুরের সহিত বাহুযুদ্ধ করিতে লাগিল। সিংহ ও চামরাসুর, উভয়ে যুদ্ধ করিতে করিতে সেই হস্তিপৃষ্ঠ হইতে ভূমিতে পতিত হইল এবং পরস্পর সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া নিদারুণ প্রহার দ্বারা যুদ্ধ আরম্ভ করিল। কিয়ৎকাল (কিছুক্ষণ) পরেই সিংহ আকাশে লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক পতিত হইয়া করপ্রহার দ্বারা (লাফ মেরে অসুরের উপর পড়ে থাবার আঘাতে) চামরাসুরের মস্তককে দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিল। ১০-১৫
দেবী, উদগ্র নামে অসুরকে প্রস্তর ও বৃক্ষবৃষ্টি দ্বারা হনন করিলেন। দন্ত ও মুষ্টিতল প্রহারে করাল নামে অসুরকে বিনাশ করিলেন। ক্রুদ্ধা দেবী গদাপাত দ্বারা উদ্ধত নামে অসুরকে চূর্ণ করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে বাস্কল নামক অসুরকে ভিন্দিপাল দ্বারা এবং তাম্র ও অন্ধক নামক অসুরদ্বয়কে বাণ দ্বারা বিনাশ করিলেন। ত্রিনেত্রা পরমেশ্বরী দেবী ত্রিশূল দ্বারা উগ্রাস্য, উগ্রবীর্য্য ও মহাহনু নামক অসুরত্রয়কে বিনাশ করিলেন। অসি দ্বারা বিড়ালনামা অসুরের মস্তক দেহ হইতে নিপাতিত করিলেন। দুর্দ্ধর ও দুর্ম্মুখ নামে অসুরদ্বয়কে শরনিকর দ্বারা যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। ১৬-১৯
এই প্রকারে স্বকীয় সৈন্য ক্ষয় হইতেছে দেখিয়া মহিষাসুর স্বীয় মহীষরূপ ধারণ করিয়া দেবীর সেই গণসমূহকে সর্ব্বতোভাবে ত্রাসিত করিতে আরম্ভ করিল। কাহাকেও আস্যপ্রহার দ্বারা (তুণ্ড বা মোষের লম্বাটে ছুঁচালো মুখ দিয়ে আঘাত করে), কাহাকেও ক্ষুরবিক্ষেপ দ্বারা (পায়ের খুর দিয়ে আঘাত করে), কাহাকেও লাঙ্গুল-তাড়ন দ্বারা (লেজের ঝাপ্টায়), কাহাকেও শৃঙ্গদ্বয়ে বিদারণ দ্বারা (শিং দিয়ে গুঁতিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া), কাহাকেও বেগ দ্বারা, কাহাকেও গর্জ্জন দ্বারা, কাহাকেও ভ্রমণ দ্বারা, আর কাহাকেও বা নিশ্বাস-পবন দ্বারা নিপাতিত করিতে লাগিল। এইরূপে প্রমথসৈন্য (শিবের অনুচরদের নিয়ে তৈরী সেনা) নিপাতন করত সেই অসুর মহাদেবীর সিংহের হননেচ্ছায় ধাবিত হইল; তখন অম্বিকা, কুপিত হইলেন। ২০-২৩
মহাবীর্য্য মহিষাসুরও অতি কোপে ক্ষুরাঘাতে পৃথিবীকে বিদীর্ণ করত শৃঙ্গদ্বয় দ্বারা উচ্চ পর্ব্বত সকল নিক্ষেপ করিতে লাগিল এবং গর্জ্জন করিতে লাগিল। তাহার সবেগ ভ্রমণে পৃথিবী বিশীর্ণ (কৃশ, জীর্ণ, দুর্বল) হইল; লাঙ্গুলতাড়িত সমুদ্র পৃথিবীকে প্লাবিত করিল। কম্পিত শৃঙ্গের আঘাতে বিভিন্ন মেঘগণ খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল এবং শ্বাসপবন-ক্ষিপ্ত হইয়া শত শত পর্ব্বত আকাশ হইতে পতিত হইতে লাগিল। এই প্রকারে কোপপরিপূর্ণ অসুরকে নিকটে আসিতে দেখিয়া চণ্ডিকা দেবী সেই সময় তাহার বধের নিমিত্ত ইচ্ছা করিলেন। তখন দেবী পাশক্ষেপ করিয়া সেই মহাসুরকে বন্ধন করিলেন। বদ্ধ হইয়া মহিষাসুরও তৎক্ষণাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে মহিষরূপ-পরিত্যাগপূর্ব্বক সিংহরূপ ধারণ করিল। দেবী অম্বিকা তাহার মস্তকচ্ছেদ করিবামাত্র সেই মহিষাসুর খড়্গপাণি (যার হাতে খড়্গ) পুরুষরূপে দৃশ্যমান হইল। দেবী তৎপরে বাণসমূহ দ্বারা খড়্গ ও চর্ম্মের (ঢালের) সহিত সেই পুরুষকে ছেদন করিলেন। তখন সে প্রকাণ্ড হস্তীর রূপ ধারণ করিয়া শুণ্ড দ্বারা দেবীর বাহন সেই মহাসিংহকে আকর্ষণ করত গর্জ্জন করিতে লাগিল। দেবী খড়্গ দ্বারা সেই আকর্ষণকারী হস্তীর শুণ্ড ছেদন করিলেন। তখন মহাসুর পুনর্ব্বার মহিষরূপ ধারণ করিয়া পূর্ব্বোক্ত প্রকারে সচরাচর (স্থাবর জঙ্গমাত্মক বা স্থির এবং গতিশীল অর্থাৎ জড় ও জীব, চেতন ও অচেতন সব মিলিয়ে) ত্রৈলোক্য (স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাল) ক্ষোভিত করিতে লাগিল। ২৪-৩২
অনন্তর জগন্মাতা চণ্ডিকা ক্রুদ্ধা হইয়া উত্তম মধুপান করিতে লাগিলেন এবং অরুণনয়না হইয়া বারংবার হাস্য করিতে লাগিলেন। তখন সেই বলবীর্য্য-মদোদ্ধত অসুরও গর্জ্জন করত শৃঙ্গদ্বয় দ্বারা চণ্ডিকার প্রতি পর্ব্বত সকল নিক্ষেপ করিতে লাগিল। দেবী চণ্ডিকা শরসমূহ দ্বারা তৎপ্রক্ষিপ্ত পর্ব্বত সকল চূর্ণ করিয়া সেই অসুরকে বলিতে লাগিলেন; কিন্তু মদ দ্বারা চণ্ডিকার বদন তখন রক্তবর্ণ হইল এবং অক্ষর সকল স্পষ্ট উচ্চারিত হইল না। দেবী কহিলেন,— অরে মূঢ়! যতক্ষণ আমি মধুপান করিতেছি, তুই ততক্ষণ পর্য্যন্ত গর্জ্জন কর্, গর্জ্জন কর্। আমি তোকে শীঘ্র বিনাশ করিলে দেবতাগণ এইখানেই গর্জ্জন করিবেন। ঋষি কহিলেন,— দেবী এই বলিয়া লম্ফপ্রদান করত (লাফ দিয়ে) সেই মহাসুরের উপর আরোহণ করিলেন এবং পদদ্বারা আক্রমণপূর্ব্বক শূলদ্বারা সেই অসুরকে তাড়না করিতে লাগিলেন। তখন দেবীকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া নিজ মুখ হইতে অর্দ্ধনিষ্ক্রান্ত হইতে না-হইতেই সেই অসুর দেবীবীর্য্যে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল। অর্দ্ধনিষ্ক্রান্ত হইয়াই যুধ্যমান (যুদ্ধরত) সেই মহাসুরকে দেবী সেই মহা অসি দ্বারা শিরচ্ছেদপূর্ব্বক বিনাশ করিলেন। তখন দৈত্য-সৈন্যগণ হাহাকার করিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। দেবতাগণ সাতিশয় (অত্যন্ত) হর্ষ প্রাপ্ত (আনন্দিত) হইলেন। দেবগণ ও দিব্য মহর্ষিগণ দেবীকে স্তব করিতে লাগিলেন। গন্ধর্ব্বপতিগণ (এক ধরণের উপদেবতা, স্বর্গের গায়ক) গান করিতে লাগিল এবং অপ্সরোগণ (আরেক ধরণের উপদেবতা—মোট দশ ধরণের উপদেবতা আছে—এরা স্বর্গে নৃত্য পরিবেশন করেন) নৃত্য করিতে লাগিল। ৩৩-৪১
তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত॥৩॥
—