তৃতীয় অধ্যায় – মক্কাবাসীদের ওপর মহাবিজয়
১. মদিনা অবরোধের পর অভিযানসমূহ
মদিনা অবরোধ বা খন্দকের যুদ্ধ থেকে (৬২৭) থেকে হুদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদনের (৬২৮) মধ্যবর্তী সময়কালে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছিল তাতে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শিতা প্রতিফলিত হয়। সম্পূর্ণ নতুন দিক দর্শন বললে অত্যুক্তি হতে পারে অথবা বলা যেতে পারে যে তাঁর কূটনীতি ও অনুসৃত রাষ্ট্রীয় পদ্ধতিসমূহের প্রকৃত মুল্যায়ন করা হয় নি। প্রকাশ্যে ধর্ম প্রচারের পর থেকে (৬১৩) এতকাল হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অনুসৃত নীতিসমূহ পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হবে যে তিনি তাঁর জন্মভূমি মক্কার বিধর্মী কুরাইশদের পরাজিত করে শহরটি পুনরুদ্ধার করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেন। কিন্তু খন্দকের যুদ্ধের পর মুসলিম বিজয় তাঁকে বৃহত্তর কর্মকাণ্ডে জড়িত করে এবং তাঁর কর্মপদ্ধতি অধিকতর ব্যাপক এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত। যদি পূর্ববর্তী ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে প্রতীয়মান হবে যে, ধর্ম প্রচারের গোড়া থেকেই হযরত মুহাম্মদ (স)-এর দূরদর্শিতা প্রমাণিত হয়, বিশেষ করে বদরের যুদ্ধের পরেই। খন্দকের যুদ্ধ থেকে হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদন পর্যন্ত সময়কালে সংঘটিত ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে হজরত মুহাম্মদ (স)-এর কার্যাবলি মূল উদ্দেশ্যসমূহ প্রমাণিত হবে।
এ ধরনের বিষয়বস্তুর আলোচনায় স্বাভাবিকভাবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চিন্তাধারার অন্তঃনিহিত ও বিশ্লেষনাত্মক কারণগুলোর সন্ধান করতে হবে। মদিনা অবরোধের পর কি কারণে তিনি হঠাৎ হজ্জব্রত পালন করতে চাইলেন এবং কি পরিস্থিতিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদিত হয়েছিল তার কারণ সন্ধানে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও পরিস্থিতির মূল্যায়নে তাঁর অন্তঃদৃষ্টির কথা বলতে হয়। তিনি ঘটনাবলি বিশ্লেষণাত্মকভাবে না করে তাঁর গভীর মননশীলতা দ্বারা পর্যালোচনা করেন। এ সময়ে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছিল তা তিনি ভালভাবেই মোকাবেলা করেন এবং এ সমস্ত ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে পরবর্তী কর্মকাণ্ডে নির্ধারণ করেন। এ সমস্ত ঘটনাবলির রাজনৈতিক অপেক্ষা ধর্মীয় দিকসমূহ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নিকট অধিক প্রাধান্য পায়। এ সময় তিনি তার ধর্ম প্রচারের নিমিত্তে আরব ভূখণ্ডের সকল অধিবাসীদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি দ্বারা সমগ্র আরবদের সুসংঘবদ্ধ করা। এ সময়ে এ ধরনের প্রয়োজনীয়তার প্রতি তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং এই রাজনৈতিক ঐক্য পর্যায়ক্রমে অর্জিত হয়।
উল্লিখিত সময়কালে ইসলাম সমগ্র আরব ভূখণ্ডে যে বিস্তার লাভ করেছিল তা বলা যায় না। কারণ এ সময়ে মক্কা এবং মদিনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে বসবাসকারী গোত্রসমূহে ইসলাম প্রচারিত হয়। কিন্তু হযরত মুহাম্মদের মক্কা ও মদিনার বাইরে সমগ্র আরব উপদ্বীপে ইসলাম প্রচারের যে দূরদর্শিতা ছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, আরব ভূখণ্ডের সর্বত্র ইসলাম প্রচারকে তিনি তাঁর বৃহত্তর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে অন্তর্ভুক্ত করবেন তা বলাই বাহুল্য। শুধু তাই নয় তিনি আরব ভাষাভাষী গোত্রসমূহে ইসলাম প্রচারেও ব্রতী হন। অপরদিকে কতিপয় মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতানুসারে হজরত মুহাম্মদ (স) বায়জানটাইন এবং পারস্য সম্রাটদের সার্বজনীন ধর্ম হিসেবে ইসলামগ্রহণ করার যে আহ্বান জানান তা কতটুকু সত্য তা বলা যায় না। মুসলিম ঐতিহাসিকদের তথ্যাবলী খুব প্রাচীন ছিল না। তবুও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, প্রথম থেকেই ধর্ম হিসেবে ইসলাম সার্বজনীনতা লাভ করেছিল, যদিও এর প্রচারে নানা ধরনের বিঘ্ন দেখা দেয়। অবশ্য একথা বলা যায় যে বিধর্মী পার্শ্ববর্তী সম্রাটগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলেও তারা যে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নিকট থেকে দূতের মাধ্যমে পত্র বা দাওয়াত পেয়েছিলেন তা সঠিক। তবে এ কথা বলা যাবে না যে ইসলামী রাষ্ট্র সম্প্রসারণের সাথে সাথে ধর্ম হিসেবে ইসলাম সার্বজনীনতা লাভ করেছিল। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মতো, একজন বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক তাঁর কর্মজীবনের এই পর্যায় (হুদায়বিয়ার সন্ধির পর ৬২৮) পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের অধিপতিদের প্রতি ইসলাম গ্রহণের জন্য পত্র দিবেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং বিভিন্ন রাজদরবারে প্রেরিত প্রতিনিধিদের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে এ সমস্ত তথ্যাদিতে যথেষ্ট অসঙ্গতি রয়েছে।[১]
[১. ওয়ার্টের এ ধরনের মন্তব্য বোধগম্য নয়, কারণ তিনি পরবর্তী পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন যে তিনি ছয়টি প্রতিনিধি দল বিভিন্ন রাজদরবার এবং গোত্র প্রধানদের নিকট পাঠিয়েছিলেন। একথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে তিনি ৬২৮ সালে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন।]
ইতিহাসে বর্ণিত তথ্য থেকে জানা যায় যে হুদায়বিয়া সন্ধি সম্পাদনার পর মদিনায় ফিরে এসে পরের দিন তিনি ছয়জন দূতকে বিভিন্ন রাজ্যের সম্রাট, রাজা এবং গোত্র প্রধানের নিকট তাঁর স্বহস্তে লিখিত পত্রসহ পাঠান। যে সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও গোত্র নেতার কাছে চিঠি পাঠান হয় তারা হচ্ছেন আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাসী বা নেগাস, বায়জানটাইন সম্রাটের নিকট হস্তান্তরের জন্য বসরার গভর্নর, পারস্য সম্রাট, মিশরের কপটিক শাসক মুকাউকাস, গাসসানী শাসক আল-হারিস বিন আবি শামীর এবং হানিফা গোত্রের প্রধান হাউদা বিন আলী। নবী করিম ছয় জন দূতকে কূটনৈতিক মিশনে পাঠাবার জন্য নিযুক্ত করেন এবং তাদেরকে তাদের মিশন সম্বন্ধে অবহিত করা হয়। প্রত্যেক দূতের সাথে পত্র এবং উপঢৌকন দেয়া হয়। সাধারণভাবে ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন যে, নবী করিম তাদের কাছে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে কূটনৈতিক মিশনে পাঠান- তাহচ্ছে বিধর্মী শাসকদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা। অবশ্য অনেক ঐতিহাসিক এ ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেন। মন্টোগোমারী ওয়াটের মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ তৎকালীন সময়ে ছিল খুবই উচ্চাভিলাসপূর্ণ। কারণ বিশাল রোমীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি দৌদণ্ডপ্রতাপশালী সম্রাট অথবা সামানীয় সাম্রাজ্যের শাসন খসরু নবী করিমের আহ্বানে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হবেন তার সম্ভাবনা ছিল খুব কম। ঘটনাচক্রে তাই হয়েছিল। যদিও বৈদেশিক শাসকগণ পারস্যের সম্রাট ব্যতীত নবী করিমের দূতবর্গকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান কিন্তু ধর্মান্তরীতের ঘটনা তখনকার পরিস্থিতিতে ছিল অবাস্তব। এ কারণে বলা যেতে পারে যে কূটনৈতিক মিশন ছিল মূলত রাজনৈতিক। কারণ সপ্তম শতাব্দীতে বিভিন্ন রাজ্যের প্রতাপশালী সম্রাটদের সমকক্ষ মর্যাদাসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নবী করিম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। কূটনৈতিক মিশন পাঠাবার মূলে সামরিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্যও ছিল। নবী করিম পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সাথে সখ্যতা ও মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান করতে চান, যদিও তা সম্ভব হয় নি; কারণ, রোমীয় বায়জানটাইন সাম্রাজ্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ক্রমাগত অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। এর প্রমাণ মূতা অভিযান। নবী করিমের দূরদর্শিতার জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে যাতে বিধর্মী কুরাইশগণ নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য বৈদেশিক সাহায্য লাভ করতে না পারে এ কারণে তিনি পূর্ব থেকেই বৈদেশিক শাসকদের সাথে পত্রালাপ এবং দূত প্রেরণের বিনিময়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সুতরাং একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, দূত প্রেরণের মুখ্য উদ্দেশ্য ধর্মান্তরীত করা নয় বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, রোমীয় পারস্য মিশরীয় শাসকগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। এমন কি অনেক গোত্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় যারা খ্রিস্টান ছিলেন।
৬২৭ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত খন্দকের যুদ্ধ থেকে ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত হুদায়বিয়ার সন্ধির মধ্যবর্তী সময়ে নবী করিমকে (স) নানাধরনের সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হয়। আল-ওয়াকিদির মতে, ষড়যন্ত্রকারী ইহুদী গোত্র মদিনা সনদের স্বাক্ষরদানকারী দল হওয়া সত্ত্বেও ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য নানা ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়। তারা মক্কার বিধর্মী কুরাইশদের সাথে যোগসাজসে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। যে তিনটি ইহুদী গোত্র এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে তারা হচ্ছে বনু কাইনুকা, বনু নাজির এবং বনু কুরাইজ। শুধু তাই নয় বিধর্মী গোত্রগুলো নবী করিমের (স) ব্যক্তিগত উটের পাল আক্রমণ করে লুট করে নিয়ে যায়। এই অপকর্মের নায়ক ছিলেন উয়াইনা বিন হিসন আল-ফাজারী। চল্লিশজন অপহরণকারী অশ্বারোহী নবী করিমের বিশটি দুগ্ধবর্তী উট অপহরণ করে নিয়ে যায়। নবী করিম আট জন অশ্বারোহী পাঠিয়ে অর্ধেক উট উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এ ধরনের লুঠতরাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামের ভিত্তিমূলে আঘাত করা। ইসলামের বিরুদ্ধে যাতে মক্কার বিধর্মী কুরাইশ, মদীনার দুষ্কৃতকারী ইহুদী সম্প্রদায় ও বেদুঈন গোত্রসমূহ আঘাত হানতে না পারে সেজন্য নবী করিম আসাদ, থালাবা, বানু বকর, বানু উয়াইনার বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান। তিনি ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বানু লিহওয়ান গোত্রের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করেন। ইহুদী সম্প্রদায় বনু সা’দ বিন বকরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক অভিযান প্রেরিত হয়। এই অভিযান শত্রুপক্ষের ৫০০টি উট এবং ২০০০ মেষ মুসলিম বাহিনীর দখল করে। বৈরী মনোভাবাপন্ন গোত্রদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে সাবধান করা যাতে তারা ভবিষ্যতে ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করে। এ সমস্ত অভিযানে নেতৃত্ব দেন জায়েদ বিন হারিস এবং নবী করিমের জামাতা হযরত আলী (রা)। নবী করিম দু’মাত আল-জান্দালের আমিরের বিরুদ্ধে আবদুর রহমান বিন আউফকে প্রেরণ করেন। দু’মাত আল-জান্দালের আমির নবী করিমের সাথে শান্তি চুক্তি করে আব্দুর রহমানের সাথে তার কন্যাকে বিবাহ দেন। নবী করিম উত্তর দিকে অভিযান প্রেরণ করে মদিনার সমৃদ্ধির জন্য সিরিয়ার সাথে বাণিজ্য পথকে নিরাপদ করতে চান। সিরিয়া থেকে মক্কা পর্যন্ত যে মশলা পথ প্রসারিত ছিল তার উপর নবী করিম কর্তৃত্ব স্থাপন করে মক্কায় বিধর্মী কুরাইশদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে চান। উত্তরাঞ্চলে কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করে তিনি ইসলামের প্রভাব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পান। উত্তরাঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রগুলো যেমন আসজা, ইসলামের ছায়াতলে আসতে থাকে। এর ফলে একদিকে ইসলামের যেমন শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে অন্যদিকে ইসলাম বিরোধী চক্রসমূহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। নবী করিম অর্থনৈতিক বুনিয়াদ জোরদার করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
২. হুদায়বিয়ায় অভিযান ও সন্ধি
হুদায়বিয়ায় ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে অভিযান ও সন্ধি চুক্তি সম্পাদনার পটপ্রেক্ষিত ছিল খুবই চমকপ্রদ। হুদায়বিয়ায় গমনের উদ্দেশ্য ছিল হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কায় নবী করিম তাঁর সাহাবীদের সাথে নিয়ে যাত্রা কিন্তু তিনি বিধর্মী কুরাইশদের দ্বারা বাধাগ্রস্থ হন। পবিত্র জন্মভূমি মক্কা থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করার পর নবী করিম ওমরাহ হজ্জ পালনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এ কারণে তিনি তাঁর সাহাবীদের প্রতি আহ্বান জনান। তিনি ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ১,৪০০ থেকে ১,৬০০ জন সাহাবী এবং কোরবানীর জন্য অসংখ্য পশু নিয়ে মক্কার দিকে যাত্রা করেন। বিভিন্ন গোত্র থেকে, যাদের মধ্যে খুজাত ছিল, তিনি হুদায়বিয়ায় এসে উপস্থিত হন। বিধর্মী মক্কাবাসী কুরাইশদের নবী করিমের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সঠিক ধারণা না থাকায় তারা ২০০ শত অশ্বারোহী পাঠিয়ে তাঁর গতিরোধ করে। নবী করিম তাঁর সাহাবীদের নিয়ে সহজ পথে অগ্রসর না হয়ে দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চল পার হয়ে হুদায়বিয়া নামক স্থানে এসে পৌঁছান। এখানে পৌছে তিনি তাঁর উটকে অগ্রসর হতে বললে উট জমিতে বসে পড়ে। এর ফলে নবী করিমের ধারণা হলো যে, আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা যে তিনি এ স্থানে তাঁবু ফেলে অবস্থান করেন।
বিধর্মী কুরাইশদের বিরোধিতার ফলে মুসলিম এবং বিধর্মীদের মধ্যে দূত বিনিময় হয়। বিধর্মীগণ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, বলপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করে হজ্ব পালন করলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হবে। আলাপ-আলোচনার পর উভয় পক্ষ একটি সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত করে। স্থির হয় যে, এ বছর অর্থাৎ ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানগণ হজ্জব্রত পালন করতে পারবেন না। তাদের মদিনায় ফিরে যেতে হবে। তারা পরের বছর অর্থাৎ ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে হজ্জ পালন করতে পারবেন। আরও সিদ্ধান্ত হয় যে তিন দিন ব্যাপী হজ্জ পালন উপলক্ষ্যে মক্কাবাসী পবিত্র নগরী ছেড়ে চলে যাবে। এক পর্যায়ে বিধর্মী কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের সংঘর্ষ বেঁধে যাবার উপক্রম হয়। কিন্তু রক্তপাতহীন চুক্তি সম্পাদিত হলে এটি ‘বায় আতুর রিযওয়ান’ বা শুভ চুক্তি নামে পরিচিত হয়। একটি বৃক্ষের নিচে শপথ গ্রহণ করা হয়। এ কারণে এটি ‘বায় আতুসা শাজারা’ বা বৃক্ষের নিচে সম্পাদিত শপথ নামেও অভিহিত করা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নবী করিম একটি পশু কোরবানী দিলেন এবং মাথার চুল কামিয়ে নফল নামাজ পড়লেন। এরপর হুদায়বিয়া থেকে তিনি তাঁর সাহাবীদের নিয়ে মদিনায় ফিরে গেলেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধির তাৎপর্য ছিল ব্যাপক। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে হজ্ব পালন করতে না পারলেও হুদায়ইবিয়ার সন্ধিকে পবিত্র কুর’আন শরিফে ‘ফতেহুম মুবিন’ বা মহাবিজয় বলা হয়েছে। এর ফলে রসূল করিমের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। অত্যাচারিত ও ষড়যন্ত্রকারী স্বীয় কুরাইশ গোত্র তাদের পরম শত্রু নবী করিমের সাথে সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষরিত করে শুধুমাত্র নবী করিমকে আল্লাহ প্রেরিত নবী হিসেবেই স্বীকৃত দেয়নি বরঞ্চ মক্কা বিজয়ের পথ সুগম করে। এই চুক্তির ফলে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে মদিনা প্রজাতন্ত্র এবং একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে ইসলাম সার্বজনীন স্বীকৃতি পায়। মন্টোগোমারী ওয়াট যথার্থই বলেন, ‘His primary intention was no doubt simply what he said to perform the pilgrimage but this had certain political implications and it was probably in these that he was chiefly interested.” “তাঁর প্রধান ইচ্ছা ছিল তাই যা তিনি ব্যক্ত করেন, অর্থাৎ হজ্বব্রত পালন করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর অর্ন্তঃনিহীত কারণ ছিল রাজনৈতিক এবং এর জন্যই তিনি অধিকতর আগ্রহী ছিলেন।” নবী করিম উপলব্ধি করেন যে, তখনও বিধর্মী কুরাইশদের মনবল ও জনবল ছিল অধিক এবং মুসলমানদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। এ কারণে তিনি হুদাইবিয়ার সন্ধি করেন বিধর্মীদের সাথে। যদি তিনি সে বছর হজ্বব্রত পালন করতেন তাহলে প্রমাণিত হত যে ইসলাম কোন বৈদেশিক বা আমদানিকৃত ধর্ম নয়। বরঞ্চ আরব ভূখণ্ডে প্রবর্তিত একেশ্বরবাদী ধর্ম, যার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল মক্কা। হুদাইবিয়ার সন্ধি প্রমাণিত করে যে, কুরাইশদের প্রতি নবী করিমের কোন বৈরী মনোভাব ছিল না। তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ভবিষ্যতে ইসলাম প্রচারে সহায়তা করে।
হুদাইবিয়ার সন্ধি শর্তাবলী ছিল নিম্নরূপ :
মহান আল্লাহর নামে মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহর (স) সাথে সুহাইল বিন আমরের চুক্তি সম্পাদিত হলো। দশ বছরের জন্য উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বন্ধ থাকবে। এই সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি বজায় থাকবে এবং কোন প্রকার রক্তপাত ঘটানো যাবে না। কুরাইশদের তরফ থেকে যদি কেউ বিনা অনুমতিতে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে আসেন তা হলে তাকে ফেরৎ পাঠাতে হবে। অপর দিকে হযরত মুহাম্মদ (স) সে তরফ থেকে যদি কোন ব্যক্তি কুরাইশদের কাছে মক্কায় যায় তা হলে তাকে ফেরৎ পাঠাতে হবে না। উভয় পক্ষের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব, রেশারেশী, লুঠতরাজ বা অভিযান করা যাবে না। এ সময়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি হযরত মুহাম্মদ (স) অথবা কুরাইশদের সাথে সখ্যতা স্থাপন করতে চায় তা হলে তাতে কোন বাধা থাকবে না। এ বছর (৬২৮) মুসলমানদের মদিনায় ফিরে যেতে হবে এবং তারা মক্কায় প্রবেশ করতে পারবেন না। পরের বছর কুরাইশগণ শহর ছেড়ে চলে যাবে এবং মুসলমানগণ মক্কা নগরীতে প্রবেশ করে হজ্জ উপলক্ষে তিন দিন অবস্থান করতে পারবে। মক্কায় আগমনকালে মুসলমানগণ শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত অন্যকোন মরণাস্ত্র সঙ্গে আনতে পারবে না।
হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্তাবলি পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হবে যে, দশ বছরের মেয়াদী শান্তচুক্তি নবী করিমের রাজনৈতিক দূরদর্শিতাকেই প্রমাণিত করেন বরঞ্চ বিধর্মী কুরাইশদেরকেও মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখে। এই চুক্তি বিধর্মী কুরাইশদের মান মর্যাদা রক্ষা করলেও এটিকে নবী করিমের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলা হয়েছে (‘ফতহুম মুবিন’)। কুরাইশদের কোন সদস্য মদিনায় গমন করলে তাকে ফেরৎ পাঠাবার যে শর্ত ছিল তাতে মুসলমানদের কোন স্বার্থ লঙ্ঘিত হয় নি। বরঞ্চ কোন মুসলমান কুরাইশদের কাছে মক্কায় অবস্থান করলে তাকে মদিনা ফেরৎ পাঠানো হবে না- এরূপ চুক্তির শর্ত পক্ষান্তরে ইসলাম প্রচারে সহায়ক হয়েছিল। ওয়াটের মতে, এই শর্ত ইসলামের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষন বৃদ্ধি করে এবং নবী করিমের প্রতি আস্থা গভীরতর হয়। (“ an expression of Muhammad’s belief in the superior attractiveness of Islam”) হুদাইবিয়ার সন্ধির দশ বছর মেয়াদ নবী করিমকে একজন শান্তিকামী রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রমাণিত করে। এর ফলে বৈরী মনোভাবাপন্ন আরব গোত্রগুলো ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তারা ধর্মান্তরীত হতে থাকে।
হুদাইবিয়া সন্ধি চুক্তি সম্পাদনে একটি ঘটনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের তরফ থেকে নবী করিম কুরাইশ বংশোদ্ভূত বনু উমাইয়ার উসমান বিন আফফানকে (রা) বিধর্মী কুরাইশদের সাথে আলাপ-আলোচনার জন্য পাঠান। এর প্রধান কারণ ছিল এই যে হযরত ওসমান (রা) আবদ শামস গোত্রের সদস্য হওয়ায় কুরাইশদের নিকট থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত ছিল। কিন্তু হযরত উসমানের (রা) প্রত্যাবর্তনে বিলম্ব হলে মুসলিম শিবিরে রব উঠল যে, বিধর্মীরা হযরত ওসমানকে (রা) হত্যা করেছে। এর ফলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে এবং নিরস্ত্র হলেও একটি গাছের নিচে তারা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের সংকল্প করে। এ কারণে এই শপথকে ‘বায়তুস সাজারা’ বা ‘বৃক্ষের নিচে শপথ’ অথবা “বায়াত-আল-মাওত’ বা ‘আমরণ সংঘর্ষের শপথ’ নামেও পরিচিত। যাহোক, মুসলমানদের দৃঢ় শপথে শঙ্কিত হয়ে কুরাইশগণ হযরত ওসমানকে (রা) মুক্তি দিয়ে সুহাইল বিন আমরকে নবী করিমের কাছে পাঠায়। এর ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পাদিত হয়। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পটপ্রেক্ষিতে নবী করিম অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন।
৩. হুদাইবিয়ার সন্ধির পরবর্তী ঘটনাবলি (৬২৮-৬৩০)
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত চুক্তির পর থেকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয় পর্যন্ত দুই বছর নবী করিমকে নানা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। ওয়াটের মতে, এ সময়ে সতেরোটি সমরাভিযান পরিচালিত হয়। এই সশস্ত্র সংঘর্ষগুলো ওয়ার্ট তিন ভাগে ভাগ করেছেন।
প্রথমত, নবী করিম (স) সে সমস্ত গোত্রদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন যারা ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করলেও তাঁর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পন করেন নি। তিনি গালিব বিন আবদুল্লাহর নেতৃত্বে গাতাফান গোত্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পাঠান। গাতাফান প্রধান উযাইনা রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। ইবন আবি আল আওজার নেতৃত্বে প্রেরিত অভিযানটি বিদ্রোহী ও ইসলামের পরম শত্রু সুলাইমের বিরুদ্ধে পাঠানো হয়। সুলাইম বশ্যতা স্বীকার করে ইসলাম কবুল করেন এবং পরবর্তীকালে মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন। গালিব বিন আবদুল্লাহকে নবী করিম মুলাযী উপগোত্রের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন।
দ্বিতীয়ত, হাওয়াযীন গোত্রের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করে নবী করিম তাঁর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে এই অভিযান হুনায়েনের যুদ্ধে পরিসমাপ্তি ঘটে।
তৃতীয়ত, নবী করিম উত্তরাঞ্চলে সমরাভিযান প্রেরণ করে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করেন। তিনটি পর্যায়ে এই অভিযান পরিচালিত হয়— কা’ব আল-গিফারীর নেতৃত্বে যাত-আতলায়, কা’বের নেতৃত্বে মুতায় এবং আমর ইবনে আল-আসের নেতৃত্বে যাত আস-সালাসিতে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ইহুদী সম্প্রদায় বনু নাজির এবং বনু কুরাইজার ষড়যন্ত্র উৎখাত করার জন্য নবী করিমের নির্দেশে একটি বাহিনী মদিনার উত্তরে খাইবারে প্রেরিত হয়। হযরত আলীর (রা) নেতৃত্বে প্রেরিত এই বাহিনীতে ২০০ অশ্বারোহীসহ ১,৬০০ যোদ্ধা অংশগ্রহণ করে। ফলে ইহুদী সম্প্রদায় বিদ্ধস্ত হয়। কিন্তু উত্তরে প্রেরিত সর্বাপেক্ষ উল্লেখযোগ্য অভিযান প্রেরিত হয় মুতায়। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে রোমীয় সাম্রাজ্যের অধিনস্ত সিরিয়ার সীমান্তবর্তী মৃতায় নবী করিম সোহরাবিল বিন আমর গাচ্ছানীকে পাঠিয়ে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। কিন্তু ষড়যন্ত্রমূলক আচরণ করে রোমীয়গণ সোহরাবিলকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নবী করিম ৩০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী গঠন করে স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু শারিরীক অসুস্থতার জন্য তা সম্ভব হয়নি। এ কারণে তিনি তাঁর দত্তকপুত্র জায়েদ বিন হারিসকে সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। বায়জানটাইন (রোমীয়) এবং উপজাতীয়দের দ্বারা গঠিত লক্ষাধিক বাহিনীর মোকাবেলা করতে গিয়ে মুসলিম বাহিনী বিপর্যস্ত হয়। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জায়েদ, জাফর এবং আবদুল্লাহর মত বীরশ্রেষ্ঠ সেনাপতিগণ শাহাদাত বরণ করেন। এ সময় বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাবিত বিন আকরাম এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ। খালিদ অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে বায়জানটাইন বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। তিনি মদিনায় ফিরে গেলে নবী করিম তাকে ‘সাইফুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর তরবারি উপাধি দেন। মৃতায় সন্তোষজনক অভিযানের ফলে উত্তরাঞ্চলে ইসলামের প্রভাব সুদৃঢ় হয় এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নবী করিমের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
৪. মক্কা বিজয়ের পূর্বাভাস
৬২৯ খ্রিস্টাব্দে নবী করিম তাঁর ২০০০ জন সাহাবীসহ মূলতুবী হজ্ব পালন করেন। তিনি মক্কায় তিন দিন অবস্থান করে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। উইলিয়াম মূইর বলেন, “মক্কার উপত্যকায়ে সংঘটিত এই হজ্বব্রত পালন ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এক অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি সত্যই অভূতপূর্ব ঘটনা। মক্কার উচ্চ ও নীচ সমস্ত নাগরিক তাদের বাসস্থান ত্যাগ করে তিন দিনের জন্য প্রাচীন শহরের বাইরে অবস্থান করে। অন্যদিকে স্বদেশত্যাগী নবদীক্ষিতেরা বহুদিন নির্বাসনের পর দলে দলে স্বদেশভূমিতে আসতে থাকেন, শৈশবের বেলাভূমি পরিদর্শন করেন এবং নির্ধারিত স্থানে হজ্বব্রত পালন করলেন।”
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় মুসলিম অভিযান এবং বিজয় ইসলামের ইতিহাসে একটি যুগসন্ধিক্ষণকারী ঘটনা। মক্কা বিজয়ের পটপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হবে যে, ৬২২ থেকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ দীর্ঘ আট বছর নবী করিম এ দিনক্ষণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কারণ মক্কা বিজয় ছিল তার নবুয়তের ‘climax’ বা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বদরের যুদ্ধের পর থেকে মক্কার বিধর্মী কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের বৈরিতা বন্ধ হয় নি। মক্কার কনফেডারেসীর প্রধান আবু সুফিয়ান উমাইয়া গোত্রীয় দ্বন্দ্বকে সম্প্রসারিত করতে চান এবং নবী করিমের গোত্র বানু হাশেমের প্রতি নির্যাতন-উৎপীড়ন পরিচালিত করেন তাকে পুজি করে মক্কা বিজয়ের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। কিন্তু আট বছরে মক্কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ইসলাম মদিনায় সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হলে মক্কার বিধর্মী কুরাইশগণ ধর্মীয়, সামাজিক, সামরিক ও রাজনেতিক দিক থেকে দুর্বল ও অপাংতেয় হয়ে পড়ে। উপরন্তু, তাদের মধ্যে বদর ও উহুদের যুদ্ধের পর রাজনৈতিক ও গোত্রীয় ঐক্যের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে প্রভাবশালী আবু জেহেলের সাথে আবু সুফিয়ানের কোন্দল অব্যহত ছিল। মাখজুম গোত্র প্রধান আবু জেহেলের যুদ্ধ নীতি ছিল খুব উগ্র এবং এ কারণে আবু সুফিয়ানের সাথে তার প্রায় মতবিরোধ দেখা দেয়। বদরের যুদ্ধে অসংখ্য বিধর্মী কুরাইশদের মৃত্যু মক্কাবাসী গোত্রদের মধ্যে বিরাজমান বিভেদকে আরও তিক্ত করে তোলে। উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের পূর্বে কতিপয় প্রতাপশালী বিধর্ম কুরাইশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এর ফলে একদিকে যেমন নবী করিমের বাহিনী আরও সুগঠিত ও শক্তিশালী হয়, তেমনি অন্যদিকে বিধর্মী কুরাইশদের বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ ইসলামের শ্রেষ্ঠ সেনাপতিদ্বয় খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং আমর ইবন আল-আসের নাম বলা যায়। ইসলামের ঘোর শত্রুগণ বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায় হুদাইয়বিয়ার সন্ধির পর মনে করেন যে, ক্রমবর্দ্ধমান ইসলামের প্রভাবে মক্কায় তাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। এ কারণে সোহায়েল বিন আমরের পুত্র আবু জানদাল মদিনায় গিয়ে নবী করিমের কাছে বায়েত গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, সোহায়েল কুরাইশদের পক্ষে হুদাইবিয়ার সন্ধি স্বাক্ষর করেন। আবু জানদালকে অনুসরণ করেন আমর ইবন আল- আস, যিনি সহম গোত্রের প্রধান ছিলেন এবং মাখজুন গোত্রের খালিদ বিন ওয়ালিদ। তারা ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় এসে বায়েত গ্রহণ করেন। অপরাপর তরুন বিধর্ম মক্কাবাসীদের মধ্যে যারা ইসলাম কবুল করেন তারা হচ্ছেন ওসমান বিন তালহা, আবান বিন সাঈদ, যুবাইর বিন আল মু’তিম। শুধুমাত্র পুরুষই নয়, অনেক বিধর্মী মহিলা মক্কা বিজয়ের পূর্বে মদিনায় গিয়ে নবী করিমের (স) কাছে বায়েত গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, মক্কা থেকে মদিনায় কোন বিধর্মী কুরাইশ গেলে তাকে মক্কায় ফেরৎ পাঠানো বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে তা ছিলনা। এ কারণে বিধর্মী মহিলাগণ ধর্মান্তরীত হয়ে মদিনায় অবস্থান করতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবার, যিনি নবী করিমের নিকট ইসলাম কবুল করে তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁকে বিয়ে করেন, কথা বলা যায়। উম্মে হাবিবা ছাড়াও নবী করিমের চাচা আল-আব্বাস, যিনি তার দাদা আব্দুল মোতালিবের সন্তান এবং তাঁর পিতা আবদুল্লাহর ভ্রাতা ছিলেন, মক্কায় অবস্থান করেন এবং তার স্ত্রীর ভগ্নী মায়মুনার সাথে নবী করিম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মায়মুনা মক্কা থেকে মদিনায় গমন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নবীজীর স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেন। তাকে উম্মে হাবিবার মত মক্কায় ফিরে যেতে হয়নি। মক্কা বিজয়ের পূর্বে নবী করিমের চাচা আমীর হামজার, যিনি উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন, কন্যা আম্মারা বা উমামা মদিনায় গিয়ে নবী করিমের কাছে বায়েত গ্রহণ করেন।
মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে মক্কার বিধর্মী কনফেডারেসীর প্রভাবশালী নেতা বানু উমাইয়া গোত্রের আবু সুফিয়ান মক্কা থেকে মদিনায় গমনকারী এক বিধর্মী কুরাইশকে ফিরিয়ে আনার জন্য মদিনায় যান। তিনি নবী করিমের সাথে যোগাযোগ করতে বাধ্য হন। এ প্রসঙ্গে ওয়াট বলেন, “It was a sign of how the mighty Quraish had fallen that they now had to go to Muhammad (sm) and ask him humbly for a favour.” (“আবু সুফিয়ানের মদিনায় গিয়ে নবী করিমের কাছে থেকে অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা মূলত কুরাইশ গোষ্ঠীর দুর্বলতাকে প্রকাশ করে।”) ঐতিহাসিক বিবরণীতে উল্লেখ আছে যে, ক্ষমতাধর বিধর্মী কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মদিনায় গিয়ে প্রথমে তার কন্যা এবং নবী করিমের স্ত্রী উম্মে হাবিবার সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন। উম্মে হাবিবা তার পিতাকে তার ঘরে আমন্ত্রণ জনান কিন্তু তিনি তাকে তার খাটে বসতে দেন নি। এর কারণ এই যে নবী করিম যে খাটে বসতেন বিধর্মীকে ঐ খাটে বসতে দিলে খাটটি অপবিত্র হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। আবু সুফিয়ানের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের কথা চিন্তা করে নবী করিম প্রথমে তার সাথে দেখা করতে রাজী হননি। অতঃপর তিনি পরবর্তীকালের পরপর চার খলিফা হযরত আবু বকর (রা), হযরত ওমর (রা), হযরত ওসমান (রা) এবং হযরত আলী (রা)-এর সাথে দেখা করেন। অবশ্য হযরত আলী (রা) আবু সুফিয়ানকে পরামর্শ দান করেন। আবু সুফিয়ান কুরাইশদের তরফ থেকে মদিনাবাসীদের রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রস্তাব দেন। এর ফলে নবী করিমের কাছে আবু সুফিয়ানের পদমর্যাদার হানী হয়। এই ঘটনার ফলে মূলত আবু সুফিয়ান মক্কা বিজয়ের পূর্বেই নবী করিমের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বস্তুত, মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ান মুসলিম বাহিনীকে প্রতিহত করেননি, মুসলিম বাহিনী অতি সহজে মক্কা বিজয় করে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন নবী করিম এক বিশাল বাহিনীসহ মদিনা থেকে মক্কায় অভিযান করেন তখন। মুসলিম বাহিনী মক্কার অদূরে এসে উপস্থিত হলে সাফওয়ান, ইকরামা এবং সুহায়েলের নেতৃত্বে কুরাইশ গোত্রের মাখযুম গোষ্ঠী প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অপরদিকে বিধর্মী কুরাইশদের মক্কা কনফেডারেসীর নেতা আবু সুফিয়ান আসাদ গোত্রের হাকিম বিন হিযাম এবং বুদাইল বিন ওয়ারাকাকে সঙ্গে নিয়ে নবী করিমের সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। নবী করিম মক্কায় অবস্থানকালে আবু সুফিয়ানের জিওয়ার অর্থাৎ রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বলেন যে, তিনি রক্তপাতহীন বিজয় চান। এ কারণে তিনি নির্দেশ দেন যে, যারা আবু সুফিয়ানের গৃহে অবস্থান করে তার জিওয়াব গ্রহণ করবে এবং কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে নিজ নিজ গৃহে থাকবে তাদের কোন ক্ষতি হবে না। এর ফলে মক্কায় বসবাসরত বিধর্মী গোত্রের অনেকে আবু সুফিয়ানের তত্ত্বাবধানে থাকায় রক্ষা পেল। খন্দকের যুদ্ধে মক্কাবাসীদের বিপর্যয়ের ফলে আবু সুফিয়ান উপলব্ধি করেন যে, কনফেডারেসী শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। এ কারণে তিনি মুসলিমদের মক্কা অভিযানে কোন বাধা দেন নি। এর ফলে বিধর্মীদের দৃষ্টিতে কা’বাগৃহের প্রধান সেবায়েতের মান-মর্যাদা হ্রাস পায়। তবুও আবু সুফিয়ান রক্তপাত বন্ধ করার যে শান্তিপূর্ণ ও সমঝোতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা ছিল সময়োপযোগী এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত। মক্কা বিজয়ের পর বাধাদানকারী দলপতিরা প্রাণভয়ে আত্মগোপন করে এবং অনেকে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে ইসলাম কবুল করে। ওয়ার্ট বলেন যে, বিধর্মী কুরাইশদের মধ্যে অনেকের আত্মগরিমা ও দম্ভ এরূপ ছিল যে তারা বশ্যতা স্বীকার না করে নির্বাসিত জীবন বেছে নিয়েছিল। মাখযুম গোত্রের একরোখা নেতা হুরাইরা বিন আবি ওয়াহাব তাদের মধ্যে একজন।
৫. মক্কা বিজয়
ইসলামের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (স) সমগ্র আরব জাতিকে একতাবদ্ধ করার প্রয়াস পান। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মুতা অভিযানের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল আরব ভূখণ্ডের উত্তরাঞ্চলে মদিনা প্রজাতন্ত্রের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এই দুরূহ কাজে সফল হবার পর নবী করিম মক্কায় অভিযান প্রেরণের পরিকল্পনা করেন। তার বদ্ধমুল ধারণা ছিল যে, ইসলামের প্রধান প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মক্কা বিজয় অনিবার্য। এ কারণে তিনি ভৌগোলিক, কৌশলগত, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মক্কা বিজয় ছিল অপরিহার্য। প্রথমত মক্কাবাসী আরবগণ ইসলামে দীক্ষা লাভ করে জন্মভূমি ছেড়ে মদিনায় নির্বাসনে থাকার ফলে স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর প্রতিক্ষায় ছিলেন। দ্বিতীয়ত, নবী করিমের উপর আল্লাহর আরোপিত মিশনের চূড়ান্ত পর্যায়ে মক্কায় অবস্থিত কা’বা গৃহের উপর মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ডে মক্কার ভুমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মক্কার বিজয় ছাড়া, ওয়াটের মতে, নবী করিমের মান-মর্যাদা, ক্ষমতা-প্রভাব কখনই সুপ্রতিষ্ঠিত হতো না। অন্যকথায় মক্কা ছাড়া নবী করিমের ক্ষমতা শুধু সীমিতই হতো না, বিশ্ব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে হয়ে যেত খুবই দুর্বল ও অকার্যকর। ইসলামের সম্প্রসারণে শুধুমাত্র মদিনাই নয় মক্কার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। মক্কাবাসী নব-দীক্ষিত আরবগণই ভবিষ্যতে ইসলামের কর্ণধার হয়েছিলেন। তারাই সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। উপরন্তু, মদিনা এবং মক্কা দুটি পৃথক ও বিভক্ত শহর হিসেবে অবস্থান করলে নিঃসন্দেহে ইসলাম একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারত না। এ কারণে মদিনা ও মক্কার যৌথ শহর (twin city) ইসলামের ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখে। মদিনা রাজধানী হলেও ঐতিহ্যবাহী মক্কার হারাম শরিফ ইসলামের অনেক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। একথা নিশ্চিতকরে বলা যায় যে, মক্কায় অভিযান প্রেরণের পূর্বে নবী করিম (স) যে দূরদর্শিতার পরিচয় দেন তা অসাধারণ। তিনি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিশ্বের রাজাদের দরবারে দূত প্রেরণ করে ইসলামের বাণী প্রচারের প্রয়াস পান। আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে এটি ছিল এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ কারণ তার ইসলাম প্রচার কেবলমাত্র আরব ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ ছাড়া মক্কা বিজয়ের পূর্বে তিনি আরব ভূখণ্ডের বিভিন্ন বিধর্মী গোত্রের নিকট দূত পাঠান এবং ইসলাম সমগ্র আরব দেশে বিস্তার লাভ করে। সে দিক থেকে বিচার করলে প্রতীয়মান হয় যে মক্কায় অভিযান ও বিজয় গৌরব তাঁর নবুয়তের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
হুদাইবিয়ার সন্ধির (৬২৮) পর মাত্র বাইশ মাসের মধ্যে মক্কায় অভিযান প্রেরিত হয়। এই সন্ধি নবী করিমকে ধর্ম প্রচার এবং আরব গোত্রগুলোকে একতাবদ্ধ করার সুযোগ দেয়। এই সময়ে মুতা, হুনায়েন ও খাইবারে অভিযান প্রেরিত হলেও তা উত্তরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। কূটনৈতিক মেধাসম্পন্ন নবী করিম সহজেই উপলব্ধি করেন যে, মক্কার বিভিন্ন গোত্রসমূহের সাথে সমঝোতা না করে অভিযান প্রেরণ সমীচিন হবে না। খুজা গোত্র নবীর সাথে মৈত্রী স্থাপন করলেও বৈরী মনোভাবাপন্ন মাখযুম গোত্র ইসলামের ঘোর শত্রু ছিল। আবু সুফিয়ানের মদিনায় আগমন বানু উমাইয়া গোত্রের দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ বদরের যুদ্ধের পর থেকে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয় পর্যন্ত মক্কার আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটে। বদরের যুদ্ধেই কুরাইশ গোত্র দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি দলের নেতৃত্ব দেন ইসলামের পরম শত্রু আবু জেহেল এবং অপরটি মক্কা কনফেডারেসীর প্রধান ও হারাম শরীফের সেবায়েৎ আবু সুফিয়ান, যিনি নবী করিমের শ্বশুর ছিলেন। আরবদের কোন কোন গোত্র আবু জেহেলকে, আবার কোন কোন দল আবু সুফিয়ানকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দান করে। বদরের যুদ্ধে মখজুম গোত্রের সাফওয়ানের সাথে আবদুস শামস গোত্রের আবু সুফিয়ানের যে বৈরীভাব দেখা দেয় তা উহুদের যুদ্ধে প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। সাফওয়ান গোত্র মনে করত যে, উহুদের প্রান্তরে মুসলমানদের বিপর্যয়ই যথেষ্ট কিন্তু আবু সুফিয়ান এবং আমর বিন আল-আসের অভিপ্রায় ছিল মুসলমানদের পশ্চাদ্বাবন করে মদিনা নগরী অধিকার করা। গোত্র কোন্দল, স্বার্থ, বিভেদ ও রাজনৈতিক অনৈক্য বিধর্মীদের শক্তি হ্রাস করে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পাদনে আবু সুফিয়ানের কোন ভূমিকা ছিল না; বরঞ্চ বিপক্ষ দলের নেতা সাফওয়ান, সুহাইল এবং আবু জেহেলের পুত্র ইকরামা হুদাইবিয়ায় মুসলমানদের হজ্বব্রত পালনে বাধাদান করে এবং নবী করিমের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন। আবু সুফিয়ানের নিষ্ক্রিয়তার মূলে ছিল তাঁর কন্যা উম্মে হাবিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও নবী করিমের সাথে তার বিবাহ এবং নবী করিমের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও প্রভাব। একথা ঐতিহাসিকগণ এক বাক্যে বলেছেন যে, হুদাইবিয়ার সন্ধি শুধু ওমরা হজ্ব পালনের নিশ্চয়তা দান করে নি বরং মক্কা বিজয়ের সূচনা করে। বয়োঃবৃদ্ধ এবং ধর্মান্ধ মক্কার পৌত্তলিকগণ পিতৃ ধর্ম পরিত্যাগ করতে পারেননি। কিন্তু অপেক্ষাকৃত তরুন মক্কাবাসীগণ হযরতের সত্য প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন, বিশেষ করে খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবন আল-আস ও উসমান বিন তালহার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ বিধর্মীদের মনে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে। মক্কা বিজয়ের অপর একটি কারণ ছিল হুদাইবিয়া সন্ধি চুক্তির অবমাননা। হযরতের সাথে মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ গোত্র বনু খোজার প্রতি কুরাইশদের অনুগত বনু বকরের নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচার মক্কা অভিযান এবং বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। বনু বকর গোত্রের একজন কবি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করে নবী করিমকে অবমাননা করলে বানু খোজার লোকেরা তাকে হত্যা করে। এর ফলে নওফল বিন মুয়াবিয়া গোপনে কুরাইশদের সাহায্যে বনু খোজাকে আক্রমণ করে। হুদাইবিয়ার সন্ধিতে স্বাক্ষরদানকারী সাফওয়ান, সুহাইল ও ইকরামা প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্যেভাবে বানু বকরকে সহায়তা করলে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ হয়। নবী করিম এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে সন্ধির শর্তানুযায়ী বনু খোজাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নবী করিম মক্কায় অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। তিনি এমন এক বাহিনী গঠন করেন যা অতর্কিত আক্রমণে বিধর্মী কুরাইশদের বিভ্রান্ত করে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করবে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মাখজুমসহ কতিপয় ইসলাম বিরোধী গোত্রদের কট্টরপন্থী (diehand) নেতাদের পরাস্থ করে মক্কা দখল করা। এজন্য তিনি গোপনে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। এর কারণ তাঁর পরিকল্পনা বিধর্মী মক্কাবাসীদের কাছে যাতে পৌছতে না পারে। নবী করিম উত্তরে সিরিয়ার দিকে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী পাঠিয়ে তার মূখ্য উদ্দেশ্য গোপন রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন যোদ্ধা একটি গোপন চিঠিতে কুরাইশদের কাছে নবী করিমের অভিযানের পরিকল্পনা ফাঁস করে দিবার চেষ্টা করে। সৌভাগ্যক্রমে চিঠিটি উদ্ধার করা হলে অভিযান সম্পর্কে মক্কাবাসীরা কিছুই জানতে পারেনি।
মক্কায় অভিযানের পূর্বে নবী করিম শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা দখল করতে চান। এ জন্য তিনি কুরাইশদের কাছে তিনটি প্রস্তাব পাঠান। শান্তিদূত একটি চিঠির মাধ্যমে বিধর্মীদের কাছে প্রস্তাবগুলো পেশ করে। এ প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- (১) অন্যায়ভাবে নিহত বনু খোজা গোত্রের লোকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, (২) বনু বকর সম্প্রদায়কে সকল প্রকার সাহায্য প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে, (৩) যদি উপরোক্ত শর্ত দু’টি না মানা হয় তাহলে হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি বাতিল ঘোষিত হবে অর্থাৎ যে কোন সময় নবী করিম মক্কায় অভিযান করতে পারবেন। শান্তিদূত মদিনায় ফিরে এসে নবী করিমকে জানালো যে, বিধর্মী কুরাইশগণ তৃতীয় শর্ত অর্থাৎ হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি বাতিল বলে গণ্য করেছে। এর ফলে নবী করিম তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত মক্কা অভিযানের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি বাতিল হলে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ১লা জানুয়ারি নবী করিম স্বয়ং মক্কা অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তিনি বিভিন্ন গোত্র থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে মোট ১০,০০০ যোদ্ধাসহ অভিযান করেন। যে সমস্ত গোত্র সৈন্য সরবরাহ করে তারা হচ্ছে; মুযাইনা ১,০০০, সুলাইম ১,০০০ অযরা ৭০০, আসলাম ৪০০, গিফার ৪০০। এ ছাড়া অন্যান্য যে সমস্ত গোত্র মক্কা অভিযানে অংশগ্রহণ করে তারা হচ্ছে যুহাইনা, আসমা, খোজা, দামরো, লায়েথ, সা’দ বিন বকর, তামিম, কায়েস এবং আসাদ। নবী করিম বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য তাঁর বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে মক্কার চারপাশে অবস্থান করতে থাকেন। তিনি প্রথমে মক্কার অদূরে অবস্থিত মার আযযাহবান নামক স্থানে তাঁবু ফেলেন। রাতে অবস্থান করে সেখানে নবী করিম ১০,০০০ মশাল জ্বালাবার হুকুম দেন। আলোর শিখা আকাশে গেলে বিধর্মীগণ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ল। এ দৃশ্য দেখে আবু সুফিয়ান নবী করিমের কাছে এসে শান্তির প্রস্তাব করেন। তিনি নবী করিমকে মক্কায় জিওয়ার বা নিরাপত্তা বিধানের অঙ্গিকার করেন; অন্যদিকে তিনি বলেন যে, মক্কায় যারা আবু সুফিয়ানের গৃহে অবস্থান করবে অথবা অস্ত্র ধারণ না করে নিজ নিজ গৃহে থাকবে তাদের কোন ক্ষতি হবে না এবং তাদেরকে ক্ষমা করা হবে। এ কথায় আস্বস্ত হয়ে আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে যান। পরের দিন নবী করিম মক্কার সন্নিকটে জুতুয়া নামক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাত্রি যাপনের পর ১১ই জানুয়ারি নবী করিম তাঁর বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে মক্কার দিকে অভিযান করেন। আবু সুফিয়ান মুসলিম বাহিনীকে স্বাগত অভ্যর্থনা জানালেও কট্টরপন্থী মাখযুম গোত্রের সাফওয়ান, ইকরামা ও সুহাইল সংঘবদ্ধ হয়ে মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেয়। পথিমধ্যে হযরত আব্বাস, যিনি নবী করিমের চাচা ছিলেন, রসূলের কাছে ইসলাম গ্রহণ করে মক্কায় ফিরে মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে সাবধানবানী উচ্চারণ করে বলেন, অবরুদ্ধ মক্কা নগরীর দক্ষিণাংশে খালিদ, উত্তরাংশে জুবাইর এবং আল্লাহর রসূল স্বয়ং আনসার মোহাজেরিন ও বানু খোজা গোত্রের দ্বারা গঠিত সৈন্য বাহিনী পরিচালনা করছেন। আবু সুফিয়ানও আত্মসর্ম্পনের জন্য কুরাইশদের উদ্বুদ্ধ করেন। মুসলমানগণ মক্কায় প্রবেশের পথে মূলত বাধাপ্রাপ্ত হয় নি। কেবলমাত্র দক্ষিণ দিকে ইকরামার নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক কুরাইশ বিক্ষিতভাবে বাধা দেয়। কিন্তু বীর শ্রেষ্ঠ খালিদ বিন ওয়ালিদ এই প্রতিবন্ধকতা দূর করে অগ্রসর হতে থাকেন। মক্কা অভিযান এবং দখলে শত্রুপক্ষের ২৩ অথবা ২৪ জন কুরাইশ এবং হুদায়েল গোত্রের চারজন নিহত হয়। অপরদিকে ভুলবশত শত্রু শিবিরে প্রবেশ করায় বনু খোজা গোত্রের দুজন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। ন্যূনতম রক্তপাতে মক্কা বিজয় ছিল এক অসাধারণ ঘটনা। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জানুয়ারি মক্কা অবরোধ ও দখলকে ঐতিহাসিকগণ ‘মহাবিজয়’ বলে অভিহিত করেছেন। আরবীতে এটি ‘ফতেহ’ বা শুভ বিজয় (conquest par excellence) বলা হয়েছে। আর একটি নিগূঢ় অর্থ হচ্ছে পরিষ্কার করা অর্থাৎ পৌত্তলিকতা, অবিশ্বাস ও একেশ্বরবাদবিরোধী মতবাদের স্থলে ‘তৌহিদ’ প্রতিষ্ঠা। হিট্টির ভাষায় “মক্কা বিজয় ছিল প্রাচীন ইতিহাসে একটি তুলনাবিহীন মহাবিজয়।”
মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এ ধরনের মহানুভবতা ইতিহাসে বিরল। দীর্ঘ তের বছর (৬১৭-৬৩০ খ্রি.) বর্বর কুরাইশগণ নবী করিম এবং তাঁর সাহাবীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করে। তবুও নবী করিম মক্কা বিজয়ের পর তাদের উপর কোন প্রকার প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। বাধাদানকারী বিধর্মী মক্কাবাসীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুহায়েল, ইকরামা এবং সাফওয়ান। মক্কার পতন হলে সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হলে বিধর্মীগণ নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করেন। সুহায়েল বিন আমর তার গৃহে অবস্থান করে তার বন্ধু হুয়াইতিবের মধ্যস্থতায় নবী করিমের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সাফওয়ান বিন উমাইয়া মক্কা বিজয়ের পর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লোহিত সাগর অঞ্চলে আত্মগোপন করেন। পরে তিনি জুমা গোত্রের মধ্যস্থতায় নবী করিমের কাছে ক্ষমা চান। নবী করিম আবদুল্লাহ বিন আর রাবিয়া, আল হারিস বিন হিশাম এবং হুরাইরা বিন আবি ওয়াহাবকেও ক্ষমা করেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের পর তিনি লুটতরাজ সম্পূরূপে নিষিদ্ধ করেন। এর মূল কারণ ছিল এই যে এর ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে মক্কা বিজয়ের মূল উদ্দেশ্য-পৌত্তলিকতার স্থলে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা ব্যহত হতে পারে। তিনি অবশ্য প্রয়োজনে ক্ষমাপ্রাপ্ত ধনাঢ্য বিধর্মীদের নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে দুস্থদের মধ্যে দান করেন। সাফওয়ান ৫০,০০০, আবদুল্লাহ এবং হুয়াইরিথের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৪০,০০০ দিরহাম ঋণ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ঋণ গ্রহণের পূর্বে ধর্মান্তরিত হওয়ার কোন শর্ত তাদের উপর আরোপ করা হয়নি। তারা বিধর্মী বা অবিশ্বাসী হিসেবেই মক্কায় অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে আল-জিবানা নামক স্থানে হুনায়েনের যুদ্ধের (৬৩০ খ্রি.) পর তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। আবু জেহেলের পুত্র কট্টরপন্থী বিধর্মী নেতা ইকরামা মক্কা বিজয়ের পর প্রাণভয়ে ইয়েমেনে পালিয়ে যান। তার স্ত্রী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নবী করিমের কাছে তাঁর স্বামীর জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চান। নবী করিম ইকরামাকে ক্ষমা করলে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। এ প্রসঙ্গে মূইর বলেন যে, যে মক্কাবাসী এতদিনযাবৎ হযরত মুহাম্মদ (স)কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে সেই মক্কাবাসীদের প্রতি তাঁর মহানুভবতা সত্যই প্ৰশংসনীয়।
মক্কা বিজয়ের ফলে ইসলাম সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অভিযানে মাত্র কতিপয় বিধর্মীকে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তিদান করা হয়। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আবদুল্লাহ ইবনে আবি সার। তিনি মদিনায় হিজরত করে নবী করিমের লেখক (scribe) হিসেবে কাজ করতে থাকেন। নবী করিম একদিন ‘ওহী’ লাভ করে আবদুল্লাহকে লিখতে বলেন, ‘সামি আল-আলীম’ বা ‘সর্বজ্ঞানী ও বিচক্ষণ’। কিন্তু ভুলক্রমে আবদুল্লাহ লিখেন ‘আলীম আল-হাকিম’ বা ‘বিচক্ষণ ও সর্বজ্ঞানী’। নবী করিম এই পরিবর্তন প্রথমে লক্ষ করেন নি। এর ফলে আবদুল্লাহ ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআনের বাণী পরিবর্তন করায় ধর্মচ্যুত (apostate) হন। তিনি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মদিনা থেকে মক্কায় পলায়ন করেন। নবী করিম এই অপরাধ জানতে পেরে তাকে ক্ষমা করে দেন এবং কুর’আনের বাণী শুদ্ধ করেন। এটি নবী করিমের মহানুভবতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তারপর একটি ঘটনা হচ্ছে আবদুল্লাহ বিন আল-খাটালকে কেন্দ্র করে। নবী করিম তাকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ‘সাদাকা আদায়ের জন্য পাঠান। আবদুল্লাহর ভৃত্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সাদাকা আদায়ে ব্যর্থ হলে তিনি তাকে এমনভাবে প্রহার করেন যে সে মৃত্যুবরণ করে। এরপর প্রাণভয়ে তিনি সংগৃহিত সাদাকা নিয়ে মক্কায় পালিয়ে যান। চুরির অপরাধ ছাড়াও আবদুল্লাহ নবী করিমকে ব্যাঙ্গ করে কবিতা রচনা করেন। শুধু তাই নয়, এ সমস্ত ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা জনসমক্ষে আবৃতি করার জন্য দুজন গায়িকাকে নির্দেশ দেন। নবী করিমের অবমাননার জন্য আবদুল্লাহ এবং দুজন গায়িকার একজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সারা নামের অপর গায়িকাকে, ইবন হিশামের মতে, ক্ষমা করা হয় এবং আল-ওয়াকিদির মতে, ক্ষমা লাভ করার পর পুনরায় ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা আবৃত্তির জন্য তাকে হত্যা করা হয়। নবী করিমের সহিষ্ণুতা ও মহানুভবতা কিংবদন্তির সমতুল্য কিন্তু রাজনৈতিক, ধর্মীয় মর্যাদা এবং পারিবারিক সূচিতা রক্ষার জন্য কতিপয় দুষ্কৃতকারীকে তিনি প্রাণদণ্ড দিতে বাধ্য হন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন মিকয়াস বিন দুরাবা আল-লাইথি। আল-মুরাইশীর যুদ্ধে ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে ভুলবশত মিকয়াসের ভাই নিহত হন। এ কারণে নবী করিম মিয়াসকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ (blood money) দান করেন। কিন্তু অর্থ লাভ করার পর মিকয়াস তার ভাই-এর হত্যাকারীকে খুন করে। তিনি প্রাণভয়ে মক্কায় চলে যান। তাকে হত্যার আদেশ দেয়া হয়। রসূলের চাচা আল-আব্বাস যখন নবী করিমের কন্যাদের মক্কা থেকে মদিনায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন হুয়াইরিথ ধাক্কা মেরে তাদের মাটিতে ফেলে দেয়। নবী করিমের পারিবারিক মর্যাদাহানী হলে হুয়াইরিথকে হত্যা করা হয়। অনুরূপভাবে হাব্বাব বিন আল-আসওয়াদ নামে এক ব্যক্তি নবী করিমের কন্যা জয়নবকে অসৌজন্যমূলকভাবে ধাক্কা দিলে জয়নবের গর্ভস্রাব হলে গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। অনুতপ্ত হয়ে হাব্বাব নবী করিমের কাছে উপস্থিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং কালেমা শাহাদাত পাঠ করেন। মহানুভব নবী করিম হাব্বাবকে মাফ করে দেন নতুবা সেও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতো আল হুয়াইরিথের মতো। অপর যে ব্যক্তিকে মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম ক্ষমা করেন তিনি হচ্ছেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা। উল্লেখ্য, উহুদের রণক্ষেত্রে তিনি তার অনুচর ওয়াহসীকে নবী করিমের চাচা আমির হামজাকে হত্যা করে তার কলিজা বের করতে বলেন, যাতে তিনি এর অংশ চিবিয়ে খেতে পারেন। ঘটনাটি সত্য। এতদস্বত্ত্বেও হিন্দা নবী করিমের সামনে এসে উপস্থিত হলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। সুতরাং কয়েকজন, সম্ভবত চার দোষীব্যক্তি ব্যতিরেকে নবী করিম অপর কাউকে শাস্তি দেননি। মক্কা বিজয় ছিল একটি দৃষ্টান্তমূলক শান্তিপূর্ণ মহাবিজয়। সীজার আলেকজান্ডার, হুলাকু খানের মত বিজয়োল্মাত্ত বীরের যুদ্ধ জয়ের পর যে উম্মাদনাপূর্ণ লুটতরাজ হয় মক্কা বিজয়ের পর তা হয় নি, কোন মহিলার শালীনতা হরণ করা হয় নি, বিধর্মীদের বলপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয় নি। প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা অব্যহত ছিল। নবী করিম পনের থেকে বিশ দিন মক্কায় অবস্থান করেন এবং মক্কার শাসনভার তাঁর প্রতিনিধি আত্তার বিন আসিদের উপর ন্যস্ত করে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
মক্কায় অবস্থানকালে নবী করিম পৌত্তলিকতা নিমূল করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, মক্কার নেতৃত্ব ছাড়া কেবলমাত্র মদিনা ভিত্তিক ইসলাম চিরস্থায়ী হবে না। এর প্রধান কারণ এই যে, প্রাক-ইসলামী যুগে মদিনাতুন নবীর (ইয়াসরিব) কোন অস্তিত্ব ছিল না। অপর দিক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, মানবিক ও সামরিক ও প্রশাসনিক (মালা) দিক থেকে মক্কার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। নবী করিম সহজেই বুঝতে পারেন যে, নব-প্রতিষ্ঠিত ধর্মের শক্তি বৃদ্ধি করতে হলে মক্কার সামরিক শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে এবং মক্কা আয়ত্তে আসলে বহির্বিশ্বেও তাঁর ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। মক্কা বিজয় আরবদেশের একীকরণে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়। উদারতা, মহানুভবতা ও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি ভঙ্গি দ্বারা হযরত বিধর্মী কুরাইশদের মন জয় করেন। পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করে প্রথমেই তিনি হেরেম শরীফে যান। সেখানে তিনি কা’বা ঘরের চার দিকে সাতবার প্রদক্ষিণ বা তাওয়াফ করেন। এরপর তিনি সেখানে প্রধান দেবতা হুবালসহ ৩৬০টি দেব-দেবীর মূর্তি ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। আরব ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক এবং ইবনে হিশামের মতে, মহানবী একটি ষষ্টি নিয়ে মূর্তিগুলোর কাছে উপস্থিত হয়ে ষষ্টির অগ্রভাগ দিয়ে সেগুলো আঘাত করলে মূর্তিগুলো ভূপতিত হতে থাকে। এ সময় একটি ওহী নাজেল হয়। সূরা ইসরা (স), ৮১-৮৩ আয়াতে বলা হয়েছে,
“এবং বল (হে মুহাম্মদ) সত্য উপস্থিত হয়েছে এবং অসত্য লোপ পেয়েছে, মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবেই।”
“আমি অবতীর্ণ করি কুরআন, যা বিশ্বাসীদের জন্য শান্তি ও দয়া; কিন্তু তা সীমালংঘনকারীদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।“
“মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অহংকারে দূরে সরে যায় এবং তাকে অনিষ্ট স্পর্শ করলে সে একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে।”
উপরোক্ত, আয়াতে বিধর্মী, সত্যপ্রত্যাখ্যানকারী কুরাইশদের অহংকার ও দম্ভের কথা বলা হয়েছে; অন্যদিকে আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের মহানুভবতা, উদারতা, অনুগ্রহ ও অপরিসীম ক্ষমাশীলতাকে প্রকাশ করেছে।
নবী করিম কেবলমাত্র কা’বা গৃহে রক্ষিত প্রতিমাগুলো ধ্বংস করারই নির্দেশ দেন নি বরঞ্চ সমগ্র আরব দেশে পৌত্তলিকতার কেন্দ্রসমূহ নিশ্চিহ্ন করার আদেশ দেন। নবী করিম তাঁর সাহাবীদের নিয়ে পবিত্র কা’বা গৃহে নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি আল্লাহর তথাকথিত তিন কন্যা নামে প্রাক-ইসলামি আরবে পরিচিত তিন দেবী মূর্তি, আল-লাত, আল-মানত এবং আল-উজ্জার মন্দির ধ্বংস করার জন্য সেনা বাহিনী পাঠান। মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী অঞ্চল কুয়ায়েদে নামক স্থানে আল-মানাত নামের ভাগ্যদেবী মন্দির ছিল। আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা বলি প্রদান করে কৃষ্ণপাথরের আল-মানাত দেবীকে পূজা করতো। হেরোডোটাস বলেন, আল-লাত ছিল তায়েফের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। প্রকৃতপক্ষে আল-লাত ছিল চতুষ্কোণাকার একটি পাথরের খণ্ড। নাখলায় আল উজ্জা দেবীর মূর্তি মক্কাবাসী কুরাইশগণ পূজা করতো। মক্কা বিজয়ের পর আরব ভূখণ্ড থেকে পৌত্তলিকতার সর্বশেষ চিহ্ন ধূলিসাৎ করার জন্য নবী করিম নির্দেশ দেন। এর ফলে দূরবর্তী অঞ্চলের কয়েকটি স্থান ব্যতীত সমগ্র আরবদেশে মিথ্যার উপর সত্যের, অর্ধেমের উপর ধর্মের, অন্যায়ের উপর ন্যায়ের, অন্ধকারের উপর আলোকের বিজয় ঘোষিত হয়। মক্কা বিজয় সামগ্রিকভাবে ধর্ম প্রবর্তক হিসেবে নবী করিমের অসামান্য সাফল্যকে প্রমাণিত করে। এই সাফল্যের পশ্চাতে, ওয়াটের মতে, প্রাক-ইসলামি যুগের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক কাঠামোর তুলনায় ইসলাম প্রবর্তিত একেশ্বরবাদ এবং সাম্যবাদের মহৎ গুণাবলি অনেক কার্যকরী ছিল। বিধর্মী কুরাইশগণ ক্রমশ উপলব্ধি করতে থাকেন যে, ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থা ও প্রস্তর নির্মিত নিষ্প্রাণ দেব- দেবী ভিত্তিক পৌত্তলিকতার কার্যকারিতা ও প্রভাব শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে বিধৰ্মী পৌত্তলিক কুরাইশগণ তাদের বংশ পরম্পরায় ধর্ম বিশ্বাসকে আকড়ে ধরে থাকলেও তরুনসমাজ সহজেই বুঝতে পারে যে গোত্র ভিত্তিক সমাজ ও পৌত্তলিকতার দিন শেষ হয়ে এসেছে। এ কারণে তারা দলে দলে স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। এমন কি আবু সুফিয়ানও ইসলাম কবুল করেন। ইসলামে চরম বিরোধিতা দানকারী মাখযুম গোষ্ঠীর যে ক্ষমতা ছিল তাও মক্কা বিজয়ের ফলে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। নবী করিমের দূরদর্শিতা ও মহানুভবতার ফলে মক্কা ও মদিনা একীভূত হলো এবং এটি ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে অসামান্য মর্যাদা লাভ করলো। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তিনি মক্কাবাসীদের সাথে মৈত্রী সখ্যতা যেমন স্থাপন করেন তেমন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে মক্কা বিজয়ের সুফল অর্জন করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর চাচা আল-আব্বাসের স্ত্রীর ভগ্নি মায়মুনা এবং আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রকাশ পায়। একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, মক্কা বিজয়ের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ আরব গোত্রের বেদুঈনগণ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ধর্মীয় অপেক্ষা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং অর্থনৈতিক সুবিধাভোগের জন্যই বেদুঈনগণ ইসলামের ছায়াতলে আসে। নিকলসন বলেন, “পবিত্র নগরীর আত্মসমর্পণে আরব দেশে হযরত মুহাম্মদ (স) এর অপর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী রহিল না। তাঁর কার্য সমাধান হল। বিভিন্ন বেদুঈন গোত্রের প্রতিনিধিগণ কুরাইশদের বিজেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করল এবং কেবল শত্রুপক্ষকে লুটতরাজ করবার অভিপ্রায়েই নিস্পৃহভাবেই ইসলামের প্রতি আস্থাভাজন হল।” এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম সর্বপ্রকার লুটতরাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই বহু বিধর্মী বেদুঈন সম্প্রদায় ইসলাম কবুল করে এবং পরবর্তীকালে এই দুর্ধর্ষ বেদুঈনগণ ইসলামের জন্য জেহাদ করে। ওয়াট এ প্রসঙ্গে বলেন, “The success of Muhammad was the attractiveness of Islam and its relevance as a religious and social system to the religious and social needs of the Arabs” “নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাফল্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে ইসলামের প্রতি প্রচন্ড আকর্ষণবোধ এবং আরব সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার সম্বন্বয়।” ওয়াট নবী করিমের দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার (his vision and far-reaching wisdom) প্রশংসা করেন।
৬. হুনাইনের যুদ্ধ (৬৩০ খ্রি.)
মক্কা বিজয়ের ফলে পৌত্তলিকতার অবসান হয় সত্য কিন্তু সমগ্র আরব ভূখণ্ড ইসলামের ছায়াতলে আসেনি। মক্কায় অবস্থানকালে নবী করিম বিভিন্ন অঞ্চলে সমরাভিযান পাঠান। তিনি সংবাদ পেলেন যে, মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী অঞ্চলে হাওয়াজিন ও সকিফ গোত্রদ্বয় ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের জন্য বিদ্রোহী করে সৈন্য সমাবেশ করছে। এর দু’টি বিদ্রোহী গোত্র পৌত্তলিকতার প্রধান কেন্দ্র কা’বা মুসলমানদের দখলে গেলে তৌহিদবাদকে উচ্ছেদ করে পুনরায় মূর্তিপূজা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এবং বায়তুল্লাহ দখল করার পরিকল্পনা করে। বেদুঈনদের সহযোগিতায় এই দুই বিধর্মী গোত্র মুসলমানদের তুলনায় দ্বিগুণ সেনা সমাবেশ করে হুনাইন উপত্যকায়। শত্রুপক্ষের সৈন্যসংখ্যা ছিল ২০,০০০। অপর দিকে নবী করিম ১২,০০০ মুসলিম যোদ্ধা সংগ্রহ করে বিদ্রোহী গোত্রদ্বয়ের মোকাবেলা করেন। উল্লেখ্য যে, হাওয়াজীন এবং সকিফ গোত্রদ্বয় মক্কার কুরাইশ গোত্রের ক্রমবর্দ্ধমান শক্তি বৃদ্ধিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। মক্কা থেকে তায়েফ পর্যন্ত বাণিজ্য পথ কুরাইশদের দখলে থাকায় হাওয়াজীন এবং সফিক গোত্রদ্বয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মক্কা বিজয়ের পর বিধর্মী কুরাইশদের ক্ষমতা হ্রাস পেলে বনু মালিক, বনু হাওয়াজীন এবং বনু সাকিফ সম্মিলিতভাবে মক্কা নগরী দখল করে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে এবং সে সাথে পূর্বপুরুষদের পৌত্তলিকতাকে পুনপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস পায়। নবী করিম এই বিধর্মী গোত্রদের নির্মূল করার জন্য ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি এক সমরাভিযান পাঠান। এই সমরাভিযানের নেতৃত্ব দেয়া হয় বীর শ্রেষ্ঠ সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের উপর। শত্রুপক্ষের লোকেরা মহিলা, শিশুসন্তান ও পশুসহ যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়। উল্লেখ যে, মুসলিম বাহিনীতে বিধর্মী কুরাইশগণ অংশই গ্রহণ করেন নি। অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল। নবী করিম মক্কা থেকে মদিনায় যাবার পথে হুনায়েনের উপত্যকায় অবস্থান করেন। তাঁর নির্দেশে খালিদ মুসলিম বাহিনী নিয়ে এক পাহাড়ের সংকীর্ণ পথে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাহাড়ের উপরে অবস্থানরত বিধর্মী বেদুঈন তীরন্দাজগণ শর নিক্ষেপ করে মুসলিম বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় বিধর্মী কুরাইশ সম্প্রদায়ের নেতা সুলাইম রণক্ষেত্র ত্যাগ করে চলে যায়। খালিদ অসীম সাহসিকতার সাথে শত্রুপক্ষের আক্রমণ মোকাবেলা করেন। মুসলিম বাহিনীর দৃঢ় মনোবল দেখে শত্রুপক্ষের সকিফ গোত্র পলায়ন করে। শত্রুপক্ষের সেনাপতি মালিক বিন আউফ পরাস্ত হন এবং শত্রু সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। হুনাইনের যুদ্ধে প্রায় ৬,০০০ শত্রু সৈন্য বন্দী হয় এবং ২৪,০০০ ভেড়া, ২৮,০০০, উট ৪,০০০ তোলা রূপা এবং অন্যান্য মাল-ই-গণিমত মুসলমানদের হস্তগত হয়। শত্রু পক্ষের অসংখ্য সৈন্য নিহত অথবা বন্দী হয়। উল্লেখ্য যে এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর মাত্র চার অথবা পাঁচজন সৈন্য শাহাদাৎ বরণ করে।
৭. তায়েফ বিজয় (৬৩০ খ্রি.)
হুনাইনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিধর্মী হাওয়াজিন গোত্রের লোকেরা তায়েফের সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় গ্রহণকরে। নবী করিম স্বয়ং তায়েফে আগমন করে তার সৈন্য নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে পনের দিন থেকে আবু মুসার অধিনায়কত্বে একটি বিশাল বাহিনীকে তায়েফ দখলের নির্দেশ দেন। যে তায়েফবাসী একদিন মহানবী (স) কে পাথর দিয়ে আঘাত করেছিল তারা মুসলিম বাহিনীর আক্রমনে ভীত ও জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তায়েফবাসী নবী করিমের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য হয় এবং ইসলাম ধমে দীক্ষিত হয়।
মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের সার্বভৌমত্ব সুদৃঢ়রূপ প্রতিষ্ঠিত হলেও আরব ভূখণ্ডের প্রত্যান্ত অঞ্চলে বিধর্মীগণ প্রচণ্ড বিঘ্ন সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু হুনাইনের যুদ্ধে বিধর্মীদের পরাজয় এবং শত্রুশিবির নামে পরিচিত তায়েফ অধিকৃত হলে নবী করিমের বিরুদ্ধে অপর কোন গোত্র অস্ত্র ধারণ করে নি। পক্ষান্তরে, তারা ইসলাম কবুল করে নবী করিমের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। নবী করিমের বিচক্ষণতা নমোনীয় মনভাব, উদারতা, ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি বিধর্মীদের ইসলামে প্রতি আকৃষ্ট করে। তারা “আল মুয়াল্মফা কুলুবুহুম” অর্থাৎ ‘যাদের অন্ত:করণ (নবী করিমের প্রতি) অনুকূল হয়ে একতাবদ্ধ হয়েছিল নামে অভিহিত হয়েছিলেন। বিরোধিতার অবসানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মদিনা একটি আন্তর্জাতিক নগরীতে পরিণত হলো। মক্কা থেকে মদিনায় ফিরে আসার পূর্বে নবী করিম মক্কার শাসনভার তিরিশ বছর বয়স্ক উমাইয়া বিন আবদ শামস গোত্রীয় আত্তার বিন আসিদের উপর ন্যস্ত করেন। তিনি আবু সুফিয়ানকে নাজরানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।