প্ৰথম পৰ্ব - ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি
দ্বিতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মক্কা জীবন
তৃতীয় পৰ্ব - হযরত মুহাম্মদের (স) মদিনা জীবন
চতুর্থ পর্ব - খোলাফায়ে রাশেদূন (৬৩২-৬৬৩ খ্রি.)
পঞ্চম পর্ব - উমাইয়া রাজবংশ (৬৬১-৭৫০ খ্রি.)
ষষ্ঠ পর্ব - আব্বাসীয় সাম্রাজ্য (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.)
পরিশিষ্ট

তৃতীয় অধ্যায় : প্রাথমিক প্রত্যাদেশ

প্রাথমিক প্রত্যাদেশ

১. পবিত্র কুরআনের (প্রত্যাদেশের) তারিখ

যখনই আমরা প্রশ্ন করি, পবিত্র কুরআনের মূল ও অকৃত্রিম বাণী বা শিক্ষা কি? তখনই আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হই তা হচ্ছে, ধর্মগ্রন্থের কোন অংশ প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল? এ প্রশ্ন খুঁজতে হলে ইসলামের প্রথম যুগের হাদিসবেত্তাগণের বর্ণিত তথ্যাবলি অনুসন্ধান করতে হয়। যখন বিভিন্ন সূরা অবতীর্ণ হয়েছিল তখনকার পরিস্থিতি ও অবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায় ঐতিহাসিকদের বর্ণিত গ্রন্থে। বিশেষ করে ইবন ইসহাক, ইবন হিশাম, সা’দ এবং তাবারীর রচনাবলিতে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে তাঁদের বর্ণনার মধ্যে বৈপরীত্য ও অসংগতিতে। ওয়াট এখানে দুটি অসুবিধার কথা বলেন- এক, বর্ণনা অসম্পূর্ণ। দ্বিতীয়, তাঁদের বর্ণিত তথ্যাবলি পরস্পরবিরোধী। প্রথমে কোন সূরা অবতীর্ণ হয়েছিল তা নিয়েও মতবিরোধ ছিল, সূরা আল-আলাক (৯৬), না সূরা মুদ্দাছির (৭৪)। প্রথম সূরায় পড়তে বলা হয়েছে এবং দ্বিতীয় সূরায় নবীকে ‘বস্ত্রাচ্ছাদিত’ বলা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, উভয় সূরাই মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। ধর্মবেত্তাগণ কুরআনের সূরাগুলো মক্কা ও মদিনা পর্বে ভাগ করেছেন; কিন্তু প্রত্যাদেশ লাভের পর্যায়ে মক্কার সূরাগুলোর প্রেক্ষাপট বা শান-ই-নুজুল স্পষ্টবাবে উল্লেখ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, ৬১০ থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে, অর্থাৎ মদিনা হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত মক্কায় যে সমস্ত ঐশীবাণী হযরত মুহাম্মদ (স) পেয়েছিলেন তাঁর কালাক্রমও জানা যায় না। হযরত ওসমানের সময় কুরআন যখন সংকলিত হয় তখন বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ১১৪ সূরার মধ্যে ৯০টি মক্কায় এবং বাকি ২৪টি মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছিল। সুতরাং ইসলামের গঠনমূলক যুগে, ধর্মপ্রচারের সময় এবং নানারকম বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য মদিনার চেয়ে মক্কায় অধিক সংখ্যক সূরা নাযিল হয়েছিল।

প্রখ্যাত জার্মান পণ্ডিত থিওডোর নলডেকে তাঁর History of the Quran ( Leipzig, 1880 ) গ্রন্থে কুরআনের সূরাগুলোকে তাদের দীর্ঘতার ওপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিভাগ করেছেন। অর্থাৎ তিনি মনে করেন যে, যে সমস্ত সূরা ছোট সেগুলো প্রথমে নাযিল হয়েছিল; এবং যেগুলো বড় সেগুলো পরে অবতীর্ণ হয়। এভাবে নলডেকে সূরাগুলোকে চারভাগে ভাগ করেন। তিনটি মক্কা পর্বে এবং একটি মদিনা পর্বে। নলঙ্কেকে অনুসরণ করে ইংরেজ পণ্ডিত রিচার্ড বেন তাঁর Translation of the Quran (Glasgow, 1937–39) কুরআনের বিভিন্ন সূরার সংকলনে যে মন্তব্য করেন তা গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন যে, সূরাগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ইসলামের মূলমন্ত্র প্রচারের জন্য অবতীর্ণ হয়। তিনি কোন কোন সূরা কখন নাজিল হয়েছিল তার তারিখ নির্ধারণের চেষ্টা করেন। তিনি বিষয়বস্তুর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। ওয়ার্ট তাঁর নিজস্ব পদ্ধতিতে কুরআনের সূরাগুলো বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি যে সমস্ত সূরাগুলোর প্রাধান্য দিয়েছেন যেগুলোতে ইসলাম, একেশ্বরবাদ (তাওহীদ) বিদ্যমান।

২. সমসাময়িক অবস্থার সাথে প্রত্যাদেশের প্রাসঙ্গিকতা

প্রাক-ইসলামী যুগে বা আইয়ামে জাহেলিয়াতে মক্কায় বিরাজমান অবস্থার সাথে মক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলোতে বর্ণিত বিভিন্ন তথ্যের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্যায়ে সামাজিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তি এবং ধর্মীয় প্রেক্ষিতে আলোচনা করা যায়।

ক. সামাজিক : ইসলাম আবির্ভাবের পর মক্কার সামাজিক প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তিত হলেও পূর্বে গোত্র প্রথা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় ছিল। গোত্র প্রথা সুদৃঢ় মনে হলেও গোত্রীয় সদস্যদের মধ্যে পূর্বের মত মৈত্রী, সখ্যতা ও সদ্ভাব ছিল না। এর মূল কারণ, একেশ্বরবাদ প্রচারের ফলে গোত্রীয় রক্তের পবিত্রতার তুলনায় ইসলাম ধর্ম সামাজিক বন্ধন হিসেবে প্রাধান্য লাভ করে। অন্য কথায়, ধর্ম গোত্র, কৌলিন্যকে পরাভূত করে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে মক্কা স্বীকৃতি পেলে, আস্তে আস্তে গোত্রীয় সংহতি ও ঐক্যের ভাঙ্গন ধরে। ধনাঢ্য মক্কার ব্যবসায়ীগণ গোত্রীয় কৌলিন্য (রক্তের ভিত্তিকে) অপেক্ষা অর্থনৈতিক যোগসূত্র বা বন্ধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। বাণিজ্যিক সাফল্যে একদিকে যেমন স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধের উন্মেষ হয়, তেমনি তারা গোত্রের বাইরে অন্যান্য আরবদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে। মক্কাবাসীদের ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্যের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সূরা কলমের (৬৮) ১৭ নম্বর আয়াতে সুস্বাদু ফলবিশিষ্ট উদ্যানের উল্লেখ আছে। এই বিশাল উদ্যানের একজন মালিক ছিলেন না, কয়েকজন মিলিত হয়ে কৃষিভিত্তিক সিন্ডিকেট গঠন করেন। এর ফলে, এক ধরনের একচেটিয়া (monopoly) ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হয়, যার ফলে ক্ষুদ্র চাষী বা ব্যবসায়ীগণ মুনাফা থেকে বঞ্চিত হন। অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্টিত এই সিন্ডিকেটের সদস্যগণ যে একই কৌলিন্যভুক্ত ছিলেন- তা বলা যাবে না।

ইসলাম আবির্ভাবের অর্ধ শতাব্দী পূর্বে (ষষ্ঠ শতাব্দী) মক্কা নগরীতে দারিদ্র্য ব্যাপক আকারে দেখা না দিলেও ধনী ও গরিবদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। এ কারণে, কোন কোন সূরায় বিশেষ করে উপরে বর্ণিত সূরাসমূহে (আবাসা, আল-ফাজর, যারিয়াত, আল-আদিয়াত) ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের উল্লেখ আছে। শুধু তাই নয়, হযরত মুহাম্মদ (স) সাময়িকভাবে বিত্তশালীদের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সূরা আবাসার (৮০) ১ থেকে ১১ নম্বর আয়াতে, যা পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে, প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) দারিদ্র্য-পীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি ধনাঢ্য কুরাইশদের প্রভাবে সাময়িকভাবে অনুদার ছিলেন। অবশ্য এই সূরা অবতীর্ণ হলে তিনি সাবধান হয়ে যান। মহান আল্লাহই তাকে বলেন, “এ প্রকার আচরণ অনুচিত; এটি উপদেশ বাণী।“

গোত্র প্রথা, কৌলিন্য ও রক্তভিত্তিক সমাজের জন্য অর্থনৈতিক কাঠামো বিশেষ কার্যকরী ছিল না। কারণ, ইসলামের আবির্ভাবে একদিকে যেমন কৌলিন্য প্রথার অবসান হতে থাকে, অন্য দিকে বাণিজ্য সম্পর্কভিত্তিক সমাজও সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এমতাবস্থায় সামাজিক জোট, বন্ধন, মৈত্রী ও সখ্যতা স্থাপনে একমাত্র মূল সূত্র হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। বিভিন্ন সূরায় অভাবগ্রস্তদের দান-খয়রাত সমাজের ধনী গরিবদের বৈষম্য কিছুটা দূর করলেও সামাজিক অনাচারের সমাধান দিতে পারে নি; (সাম্যবাদের ধ্যান- ধারণা তখনও প্রচলিত হয় নি)। যাহোক, আল্লাহর নির্দেশে ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ (যাকাত ছাড়াও) সাদাকা হিসেবে গরিব দুঃখীদের ধন বিতরণ করেন। ধনীর সম্পদ ধনীর নয়, সম্প্রদায়ের। এই মতবাদ সূরা মা’আরিজের (৭০) ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে :

“তাদের (ধনবান বিশ্বাসীদের) সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে গরিব ও বঞ্চিতদের।” অপরদিকে কুরআনের কোথাও কৌলিন্যভিত্তিক গোত্রীয় প্রথা বা সমাজ গঠনের কথা বলা হয় নি। ইসলামী যুগে প্রাক-ইসলামী যুগের সমাজ ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। গোত্রের স্থলে ব্যক্তিবিশেষ প্রাধান্য পেতে থাকে। অন্যথায় রোজ কিয়ামতে ব্যক্তিবিশেষের পাপ-পুণ্যের কথা বলা হত না। ব্যক্তি সচেতনতা ইসলামের আবির্ভাবের পর বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সূরা ইনফিতারের (৮২) ১৯ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে :

“সেদিন একে অপরের জন্য কিছু করবার সামর্থ থাকবে না এবং সেই দিন (রোজ কিয়ামত) সমস্ত কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর।”

ব্যক্তির সাথে তার আত্মীয়-স্বজনের যে কোনই সম্পর্ক থাকবে না- তাও স্পষ্ট ভাষায় সূরা ফাতিরের (৩৫) ১৮ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে-

“কেউ কারও ভার বহন করবে না; কারও পাপের বোঝা গুরুভার হলে সে যদি অন্যকে তা বহন করতে আহ্বান করে, কেউ তা বহন করবে না- নিকট আত্মীয় হলেও।”

ওয়াট বলেন যে, এই সূরা রোজ কিয়ামতের সাথে সম্পর্কিত নয়। কিন্তু পাপ- পুণ্যের উল্লেখ থাকায় রোজ কিয়ামতের প্রসঙ্গেই এ কথা বলা হয়েছে।

খ. নৈতিক : প্রাক-ইসলামী যুগের যাযাবর আরব গোত্রপ্রীতি বা মুরায়া’ মক্কার ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ে ছিল অপ্রাসঙ্গিক। মুরুয়ার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘যুদ্ধে বীরত্ব, বিপদে ধৈর্য, প্রতিহিংসায় তৎপরতা, দুর্বলদের রক্ষণাবেক্ষণ, শক্তিশালী লোকদের মোকাবেলা।” মক্কার আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরিবেশে ‘বেদুঈনদের অপরিহার্য’ গুণাবলি ‘মুরুয়া’ কতটুকু প্রযোজ্য তা বিবেচনার বিষয়। প্রথম দুটি গুণাবলি, অর্থাৎ ‘যুদ্ধে বীরত্ব’ এবং ‘বিপদে ধৈর্য’ কার্যকরী হলেও, অন্যান্য গুণাবলি প্রযোজ্য হবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ‘প্রতিহিংসায় তৎপরতা’ ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতিকর হবে। ব্যবসায়িক সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করে দুর্বলকে শোষণ সেক্ষেত্রে ‘দুর্বলদের রক্ষণাবেক্ষণ’ ব্যবসায়ীদের মনঃপুত হবে না। সবশেষে, মুরুয়ার প্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে বলা যায় যে, দুর্বলরা শক্তিশালী লোকদের মোকাবেলায় সফলকাম হবে না, উপরন্তু সবলোকেরা নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য সৃষ্টি করবে। বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যই এক অপরিহার্য বেদুঈন চারিত্রিক গুণ; যা ছাড়া কোন ব্যবসায় হতে পারে না। ব্যবসায়িক অসাধুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদই ফুজুলের যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। উচ্চ পর্যায়ের আর্থিক লেনদেন ব্যবসায়ের মোক্ষম উদ্দেশ্য এবং প্রায় ক্ষেত্রে অসাধুতা দেখা যাবে। এর মূল কারণ এই যে, ব্যবসায় মুনাফা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা। অবশ্য অর্থকরী ব্যবসা হলেই যে বদান্যতা দেখা যাবে না-এমন নয়। আসল কথা, কুরআনের ভাষায় কেবলমাত্র মরুভূমিতেই নয়, মক্কা নগরীতেও গরিব, দুস্থ, অনাথ অভাবগ্রস্ত, এতিম, নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের দান-খয়রাত করার প্রয়োজন দেখা দেয়।

আরব বেদুঈনদের মধ্যে ‘মুরুয়া’ বা গোত্রপ্রীতি তাদের গোত্রের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করত; কখনো কখনো গোত্রীয় সদস্যদেরও। এই গোত্রপ্রীতির মূল ভিত্তি ছিল সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাক-ইসলাম যুগের কবিদের বিশেষ অবদান ছিল। মরুভূমির বড় বড় গোত্রের মধ্যে মরুয়ার আদর্শ যতা তাদের কবিদের দ্বারা প্রতিভাত হয়েছে ছোট ছোট গোত্রদের মধ্যে তা হয় নি। কিন্তু মক্কার আন্তর্জাতিক পরিবেশে মুরুয়ার কোন স্থান ছিল না। অর্থের বিনিময়ে কবিদের দ্বারা প্রশংসা সম্বলিত কাব্য রচিত হতে পারে কিন্তু মক্কায় কবিতা বিশেষ প্রাধান্য পায় নি।” এর মূল কারণ এই যে, মক্কার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বা গোত্র প্রধানদের মধ্যে ঐক্য ছিল না।

বদান্যতা একটি মহৎ গুণ এবং কুরআনে ধনাঢ্য মক্কাবাসীদের কৃপণতাকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। অবশ্য মরুবাসী আরবদের মধ্যে বদান্যতা এক মহৎ গুণ হিসেবে স্বীকৃত। মাত্রাধিক ধনসম্পদ আহরণ ও গচ্ছিত করার বিরুদ্দে কুরআনে হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে “যে অর্থ জমায় ও তা বারবার গণনা করে, সে ধারণা করে যে, তার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে।” (১০৪ : ৩) আর্থিক বৈষম্য বেদুঈন ও শহরবাসী আরবদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। যাহোক, মক্কার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কৃপণতা ও বদান্যতার প্রতি অনিহা মরুবাসী আরবদের কাছে এক নিকৃষ্ট আচারণ বলে মনে হত। কিন্তু মক্কার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবেশে কুরাইশদের সম্পদ ও বৈভব তাদেরকে হীনমন্য করে নি I

বদান্যতা প্রাচীন আরবদের যে মহৎ গুণ ছিল পবিত্র কুরআনের অনেক সূরায় তার উল্লেখ আছে। সম্ভবত, প্রাচীন আরবদের এই অসাধারণ গুণকে প্রাধান্য দিবার জন্য সাদাকা, দান-খয়রাত (charity) ইসলামের বিশেষ স্থান পেয়েছে। এটি শ্রেণী বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করে। দান খয়রাতের সাথে শাস্তি এবং পুরস্কার জড়িত করা হয়। সেদিক থেকে চিন্তা করলে ইসলামী যুগে মক্কায় দান খয়রাতকে ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা হয়। যারা দানবীর তারা পুরষ্কৃত হবে এবং যারা কৃপণ, পাষাণ- হৃদয়, যারা অর্থলিপ্সু, সম্পদ গচ্ছিত করে যারা আনন্দ পায় তাদের জন্য রোজ কিয়ামতে শাস্তি রয়েছে, অবশ্য যদি সে মুসলমান হয়-তাহলে নয়। সূরা মা’আরিজের (৭০) ১৭ থেকে ১৮ নম্বব আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে (পূর্বে উদ্ধৃত)। ১৯ থেকে ২১ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে।

“মানুষ তো স্বভাবতই সৃজিত হয়েছে অতিশয় অস্তির চিত্তরূপে। যখন বিপদ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয় হা-হুতাশকারী। আর যখন কল্যাণ তাকে স্পর্শ করে তখন সে হয় অতি কৃপণ।”

প্রাক-ইসলামী যুগে বদান্যতা ছিল বেদুঈনদের একটি অন্যতম গুণ। ইসলাম দান- খয়রাতকে ধর্মীয় কার্যক্রমের মধ্যে সম্পৃক্ত করেছে। এই নৈতিক দায়িত্বের সাথে সংযোজিত হয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস, যার মূল ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ বা একেশ্বরবাদ এবং নবুওয়াত। পবিত্র কুরআন আল্লাহর কাছ থেকে জিবরাঈল বার্তাবাহক হিসেবে নবী করীমের কাছে নাজেল করেন। আমরা নবীর কাছ থেকে ধর্মগ্রন্থ লাভ করি, যে ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হেদায়েত করেন। ভালমন্দের বিচার, রোজ কেয়ামত সম্বন্ধে কুরআনে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সূরা আবাসার (৮০) ৩ নম্বর আয়াতে তাযাকীরের কথা বলা হয়েছে। এই শব্দের প্রকৃত অর্থ করা কঠিন। অনেকে বলেছেন ‘পরিশুদ্ধ’, আবার অন্যরা বলেন, ধর্মপরায়ণতা বা ঈশ্বর ভক্তি ও প্রেম। যেহেতু এই শব্দটি আরবী শব্দকোষ থেকে গ্রহণ করা হয় নি; হিব্রু আরামায়েক এবং সিরিয়াক থেকে গৃহীত, সেহেতু কুরআনে এই শব্দটি পরিহার করা হয়েছে। এর স্থান দখল করে ইসলাম শব্দটি, যার উৎস সালাম বা শান্তি। ইসলাম শব্দটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয় ‘আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ তাওয়াক্কাল বা নির্ভরশীলতা।”

গ. বুদ্ধিবৃত্তি : হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াত লাভের সময় পৌত্তলিক মক্কাবাসীদের মন-মানসিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা সম্বন্ধে আলোচনা প্রয়োজন। ওয়ার্ট এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় আলোচনা করেন।

প্রথমত, ইসলাম প্রবর্তিত হলে মক্কাবাসীদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন হতে থাকে। তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, আল্লাহ প্রদত্ত ধর্ম, আসমানী কিতাব এবং আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বা নবী সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে প্রচণ্ড আলোড়ন আনতে পারে। তারা ভাগ্যে বিশ্বাস করতে থাকে। পূর্বে দেব-দেবীর ভবিষ্যৎ বাণীর (যা অলীক) ওপর নির্ভরশীল ছিল। জাহেলিয়া যুগের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, ইসলামের আবির্ভাবের ফলে অন্তত চারটি বিষয়ে মানুষের কোনই নিয়ন্ত্রণ নেই, একমাত্র আল্লাহর বিধান ও তাঁর মহিমা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রথম, রিকজ যা আহার; দ্বিতীয়, মৃত্যু; তৃতীয়, মানুষের সুখ অথবা দুঃখ-কষ্ট; চতুর্থ, নব জাতকের লিঙ্গ ‘ছেলে অথবা মেয়ে’। বেদুঈনগণ ইসলাম-পূর্ব যুগে এই চারট বিষয়ে তারা তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি স্থির করে এবং এর ওপর তাদের গোত্রপ্রীতি বা ‘মরুয়া’ নির্ভরশীল ছিল। উপরোক্ত চারটি বিষয়ে তাদের বিশ্বাস নির্ভর করত তাদের ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণার ওপর, অবশ্য তাদের বংশপরম্পরায় ঐতিহ্য ও কাজ করত। মরুবাসী বেদুঈনদের এই মনমানসিকতার সাথে শহরবাসী মক্কার লোকদের যথেষ্ট প্রভেদ দেখা যাবে। যে চারটি বিষয় মানুষের আওতার বাইরে বলা হয়েছে তার মধ্যে দুটিতে- যথা, মৃত্যুর সময় ও শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে— মানুষের কোন হাত নেই। কিন্তু ধনাঢ্য মক্কাবাসীদের খাদ্যাভাব দেখা দিলে তারা আরবদেশের বাইরে থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে পারে এবং এভাবে দুর্ভিক্ষ এড়াতে পারে। এভাবে তারা দুঃখ-কষ্ট লাঘব করে সুখ, প্রাচুর্য ও শান্তি পেতে পারে। দুঃখ-কষ্টকে আরবীতে ‘আজল’ বলা হয়। এভাবে মরুবাসী আরব বেদুঈনের তুলনায় মক্কাবাসীগণ সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল।

দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন তা হচ্ছে গোত্রপ্রীতি বা ‘মুরুয়া’। মরুবাসী বেদুঈনদের মধ্যে গোত্রপ্রীতি যত গভীরভাবে রেখাপাত করে শহরবাসী মক্কার অধিবাসেিদর মধ্যে ততটা ছিল না। মক্কার অভিজাত সম্প্রদায় যাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল তারা গোত্রপ্রীতি এবং বংশানুক্রমিক গোত্র প্রথায় বিশ্বাসী ছিল না। অপরদিকে, তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রাধান্য দেয়। মানুষের আহার বা রিজিকের মালিক আল্লাহ। তাঁর ইচ্ছায় বীজ থেকে গাছ, গাছ থেকে শস্য বা ফল হয়। আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ করে। তিনি নবজাতক শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করেন। কোন সৃষ্টজীবের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। জন্ম ও মৃত্যুর ওপর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিয়ন্ত্রণ নেই।

ঘ. ধর্মীয় : প্রাক-ইসলামী যুগে মক্কার ধর্মীয় অবস্থা কেমন ছিল? তা জানতে হলে যে পরিবেশে আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তি মক্কাবাসীর জীবনে গড়ে উঠেছে তার মূল্যায়ন প্রয়োজন। প্রাচীন ধর্মীয় মতবাদ গড়ে উঠেছিল গোত্রের নামে কোন দেব- দেবীকে উপলক্ষ করে; কিন্তু মক্কায় এ ধরনের ধর্মীয় মতবাদ প্রচলিত থাকলেও ‘কা’বাঘরে’ ৩৬০টি বিগ্রহ ছিল। বাণিজ্যিক পরিবেশ ব্যক্তিস্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য এবং মরুয়ার অবর্তমানে তা বিশেষ ফলদায়ক ছিল না। এমনও দেখা গেছে যে, মক্কায় ধনতন্ত্রের প্রভাবে ধর্মীয় ভাবধারার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এটি একটি নতুন চিন্তাধারা, যা মরুয়ার পরিপন্থী। এই ভাবধারা গুটি কয়েক লোককে, যারা অর্থলিপ্সু ব্যবসায়ী, সন্তুষ্ট করে, বৃহৎ জনগোষ্ঠী নয়। সমাজের বুদ্ধিজীবী উপলব্ধি করলেন যে, পৃথিবীতে অর্থই সবকিছু নয়। সাময়িকভাবে অর্থ, প্রাচুর্য ও সুখ দিতে পারে, কিন্তু জীবনের সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না। সম্পদ, মহামারী (প্লেগ) ও মৃত্যুর সমাধান দিতে পারে না। এর ফলে বিত্তশালী মক্কাবাসীদের বৃহত্তর গোষ্ঠী আরও বিত্তের সন্ধানে থাকলেও বুদ্ধিবৃত্তিরসম্পন্ন ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে অর্থের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে সে সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা চলতে থাকে। এই গোষ্ঠীর মধ্যেই ধর্মীয় চেতনাবোধ গড়ে উঠে।

পবিত্র কুরআনের যে সমস্ত সূরায় মক্কার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অর্থলিপ্সা, কৃপণতা ও জাগতিক বিষয়ে মাত্রাধিক মোহের কথা বলা হয়েছে, তা কুরাইশদের ঘৃণ্য পাপাচার বলে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থলিপ্সা, মাত্রাধিক অর্থ সঞ্চয় অথবা অর্থ পূজা (worship of wealth) মানুষের বিবেক, আত্ম-সচেতনতাকে নষ্ট করে ফেলে, যার ফলে, সে সৃষ্টিকর্তাকে অবজ্ঞা করে এবং তার ওপর নির্ভরশীলতায় উদাসীন হয়ে পড়ে। বহু সূরায় তাদের সচেতন করে সাবধান করা হয়েছে; একথা বলে যে, মানুষ আল্লাহর সৃষ্ট জীব, তার আহার (রিজিক) আল্লাহর দান, মৃত্যু, মানুষের কর্মফল, পাপ-পুণ্য সমস্তই আল্লাহর বিচারে ও বিধানে হয়ে থাকে। এতে মানুষের কোন ইঙ্গিত থাকে না। পানি যাদ্বারা কৃষিকাজ হয়, সুস্বাদু ফলের বাগান-সবই আল্লাহর নিয়ামত; কিন্তু পাষাণ হৃদয় বস্তুবাদী (materialist) মানুষ তা ভুলে যায়। সৃষ্ট জীব মানুষ দুনিয়াদারীতে এত ব্যস্ত থাকে যে, সে ভুলে যায় একদিন তার মৃত্যু হবে এবং তার কৃতকর্মের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে রোজ কিয়ামতের দিন। শুধু তাই নয়, সাধারণ আদালতে যেমন বিচার হয় তেমনি ভাল কাজের জন্য বেহেস্ত এবং পাপ কাজের জন্য দোজখ লাভ করবে (সাধারণ আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হলে আসামী মুক্তি পায়)। কুরআনে ‘তাওয়াক্কুল’ বা নির্ভরশীলতার ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। এর কারণ এর মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ইবাদত। যারা মুত্তাকী, ঈমানদার ও ধর্মভীরু মুসলমান তারা মাত্রাধিক ধনলিপ্সা থেকে দূরে থেকে অল্পে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর বন্দেগী করে। রোজ কিয়ামতের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ কারণে যে, মানুষ যে মরণশীল তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। শুধু তাই নয়, রোজ কিয়ামতের ধারণা মানুষকে সংযমী করে।

প্রাক-ইসলামী যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাহেলিয়া যুগের মানুষের মধ্যে বদান্যতা বিচার করা যায়। ওয়াটের মতে, এ ধরনের বদান্যতা মরুয়ার অংশ। শুধু তাই নয়, ধনলিপ্সা রোধে দান-খয়রাতকে উৎসাহ দেয়া হয়। কখনো কখনো বদান্যতার সাথে বলিপ্রথা (sacrifice) জড়িত থাকে। প্রাক- ইসলামী যুগে দেব-দেবীর প্রচণ্ড ক্রোধ ও অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য পৌত্তলিকগণ মন্দিরে পশুবলি দিত (অবশ্য এই পশুবলির সাথে কুরবানির পশুবলির কোন সম্পর্ক নেই, যদিও জবেহকৃত পশুর এক-তৃতীয়াংশ গরিব দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ বাধ্যতামূলক)। ইসলামের আবির্ভাবের পর পৌত্তলিকতার অবসান, দেব-দেবীর মন্দির ধ্বংসের সাথে সাথে পশুবলি প্রথাও বন্ধ হয়ে যায়। ওয়াট প্রাক-ইসলামী যুগের পশুবলির সাথে কুরবাণির পশু জবেহের সাদৃশ্য দেখাতে চেয়েছেন, যা ভিত্তিহীন (বস্তুত কুরবানির প্রথা ইসলামের আবির্ভাবের বহু পূর্বে হযরত ইব্রাহিমের সময়ে প্রচলিত ছিল এবং ইব্রাহিমকে আল্লাহ তাঁর সন্তান ইসমাঈলকে জবেহ করে আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস ও ভক্তি প্ৰমাণ করতে বলেছেন। ইব্রাহিম তাই করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু জবেহ করার সময় তিনি তাঁর ছেলের স্থানে একটি দুম্বা দেখতে পেলেন)। কুরবানি সকলের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, কেবল যাদের সামর্থ্য আছে তারাই কুরবানি দেন এবং কুরবানি ‘এহসান’ বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পালন করা হয়। এটি মহান শক্তিশালী আল্লাহর প্রতি সৃষ্ট জীবের নির্ভরশীলতাকে প্রমাণ করে।

ঙ. অর্থনৈতিক অবস্থা ও ধর্ম : কুরআনে বর্ণিত মক্কার যে সমস্ত প্রাথমিক পর্যায়ে অবতীর্ণ সূরাসমূহ বর্ণিত রয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এ সময়ে সর্বাধিক অনাচার সৃষ্টি হয়েছে ধর্মীয় ক্ষেত্রে। অন্যদিকে পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ইসলামের আবির্ভাবের সাথে যাযাবর বেদুঈন জাতির জীবনধারা মক্কার ব্যবসায়িক অর্থনীতিতে উত্তোরণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দুটি ভাবধারা পরস্পর বিরোধী হলেও একেশ্বরবাদী মতবাদ প্রচারের মূলে নিশ্চয় কোন কারণ ছিল। কোন সমাজ বা সম্প্রদায়ে হঠাৎ করে অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসে না, যদি সে সমাজে কোন না কোন ধরনের সামাজিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তি এবং ধর্মীয় কাঠামো না থাকে। সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তৎকালীন ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার বৈপরীত্য। মক্কার বাণিজ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি মানুষের ধনলিপ্সাকে বাড়িয়েছে কিন্তু তার নিজের সৃষ্টি, সৃষ্টিকর্তা, জীব জগত, ভবিষ্যৎ, মৃত্যু, পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে কোন ধারণা দিতে পারে নি। ধনলিপ্সা ধনাঢ্য মক্কাবাসীদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বাড়াতে পারে নি।

মক্কার পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিবেশে সাধারণ মানুষের সমঝোতা করা ছিল খুবই কঠিন। সাধারণ মানুষ আত্মসচেতন হয়ে চিন্তা করে, কিভাবে বোঝাপড়া করা যায়? যখন অর্থনীতির জটিল পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না, তখন সে আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার দিকে ধাবিত হয়; কুরআনে বর্ণিত সমাধানে তারা আগ্রহী হয় এবং কুরআনকে তাদের কর্মকাণ্ডের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধরে। সমাজে উচ্চ-নীচ, ধনী- নির্ধন, বিত্তশালী-বঞ্চিতের যে শ্রেণী আছে তা শোষণ নীতির ফলশ্রুতি। স্বার্থান্বেষী শ্ৰেণী দুর্বলদের শোষণ করে বিত্তাশালী হচ্ছে। সম্পদশালীরা অর্থলিপ্সায় জ্ঞানশূন্য হয়ে টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে বৈষয়িক মনোবৃত্তি দিয়ে, এর মধ্যে কোন আধ্যাত্মিকতা নেই। তারা দাম্ভিক ও গর্বিত সম্প্রদায়, যারা মহান আল্লাহকে অস্বীকার করে এবং তার বিধান লঙ্ঘন করে। কুরআনে যে আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার (তাওয়াক্কাল) কথা বলা হয়েছে, তাতে তারা বিস্মৃত হয়। তারা ভুলে যায় কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর মহান শক্তির কথা, যিনি জীবন ও মৃত্যুর মালিক, শেষ বিচারের দিনের বিচারক, যার নির্দেশে পুণ্যবান জান্নাতে এবং পাপিষ্ঠগণ জাহান্নামে যাবে। কুরআনে সামাজিক অনাচার, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিক অবক্ষয়ের কথা বলা হলেও ধর্মীয় কলুষতার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় অনাচার, পৌত্তলিকতা এবং এর সাথে জড়িত সকল প্রকার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে হযরত মুহাম্মদ (স) কুরআনকে মূলধন করে সংস্কার আন্দোলন শুরু করে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন যা আজও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এক প্রগতিশীল একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে স্বীকৃত (দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *