প্রাচীন আরব ভূখণ্ডের ভৌগোলিক ও গোত্রীয় প্রথার বিবরণ
(ক) ভৌগোলিক বিবরণ
এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উপদ্বীপ আরব ভূখণ্ড হচ্ছে ইসলামের লীলাভূমি। ‘জাজিরাতুল আরব’ নামে সুপরিচিত এই ভূখণ্ডটি তিন দিকে পানি এবং এক দিকে মরুভূমি দ্বারা বেষ্টিত। এর উত্তরে সিরিয়া মরুভূমি, পূর্বে পারস্য উপসাগর, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিমে লোহিত সাগর। ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হবে যে, আরব ভূমি ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা আবিষ্কৃত হবার পূর্বে প্রাচীন আরবী মানচিত্র অনুযায়ী এটি পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল বলে পরিগণিত হত।
ভূ-তাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিচার করলে আরব ভূখণ্ডকে সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার মরু অঞ্চলের অংশ বলে ধরা যেতে পারে। মনে করা হয় যে, প্রাচীনকালে এটি সাহারা মরুভূমির অন্তর্গত ছিল এবং মধ্য-পারস্যের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে গোবী মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত বালুকাময় ভূ-ভাগের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। আরবদের ভূ-গঠন হতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, প্রাচীনকালে ভূমধ্যসাগরের স্রোতধারা আরব উপদ্বীপকে বিধৌত করে তৃণময় ভূখণ্ডে পরিণত করে বাসোপযোগী করে তোলে। লোহিত সাগরের তীরব্যাপী একটানা পর্বতমালাকে আরব দেশের ‘মেরুদণ্ড’ বলা হয়ে থাকে। উত্তরে ১২০০০ ফুট হতে দক্ষিণে ১০০০০ ফুট পর্যন্ত এর উচ্চতা। পশ্চিম প্রান্ত হতে উপদ্বীপটি ক্রমশ পূর্ব দিকে ঢালু হয়ে গিয়েছে; পূর্ব দিকের তীরাঞ্চলে কেবল ওমানে ৯৯০০ ফুট উচ্চ একটি পর্বতশ্রেণী রয়েছে। দক্ষিণ অঞ্চল নিচু ও কিয়দংশ ঢালু (তিহামা), উত্তরের নেদ একটি উচ্চ মালভূমি।
আরব ভূখণ্ডের বর্তমান আয়তন ১০২৭০০০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ১ কোটি ২০ লক্ষ। আয়তনে এটি ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ এবং আমেরিকার এক-তৃতীয়াংশ। পর্বতমালা এবং মরুভূমি ব্যতীত সমগ্র উপদ্বীপটি মরু অঞ্চল এবং অনুর্বর ভূমি বা স্তেপ। ভূ-প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে সমগ্র অঞ্চল তিন ভাগে বিভক্ত : নুফুদ, দনা ও হাররাহ। শ্বেত ও লোহিত বালুকাপূর্ণ আরবের উত্তর অঞ্চল ‘নুফুদ’ নামে পরিচিত। শীতকালে যৎসামান্য বৃষ্টিপাত ছাড়া এই অঞ্চল শুষ্ক থাকে। সময় তৃণগুল্মাদি আচ্ছাদিত থাকায় এই অঞ্চল পশুচারণের উপযোগী হয়। উত্তরে নুফুদ প্রদেশ থেকে যে লাল বালুকাময় অঞ্চলটি দক্ষিণে হাজরামাউত এবং পশ্চিমে ইয়েমেন হতে পূর্বে ওমান পর্যন্ত বিস্তৃত তাকে ‘দা’ বলে। উষ্ণতার জন্য গ্রীষ্মকালে এটি বাসের অনুপযোগী কিন্তু সাময়িক বৃষ্টিপাতে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেলে বেদুঈনগণ কিছুকালের জন্য এখানে বসবাস করেন। ‘দহনার’ দক্ষিণ ভাগটি বার্ট্রান্ড থমাসের অতিক্রান্ত ‘আল-রব আল- খালী’ অর্থাৎ ‘জনপদবিহীন অঞ্চল’ নামে পরিচিত। অসমতল, লাভা আচ্ছাদিত ফাটলযুক্ত প্রস্তরময় আগ্নেয়গিরি অঞ্চলকে আল-হাররাহ্ বলা হয়। পশ্চিমের উপকূলভাগে, উপদ্বীপের মধ্যভাগে ও উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এই ধরনের হাররাহর কথা ইয়াকুত উল্লেখ করেছেন।
গ্রিক ভৌগোলিকদের মতে, আরব দেশ তিন ভাগে বিভক্ত ছিল— মরু অঞ্চল (Arabia Deserta), পাহাড় অঞ্চল ( Arabia Petraea) ও উর্বর অঞ্চল (Arabia Felix)। মরু ও পার্বত্য এলাকা ব্যতীত আরবের উর্বর তৃণ অঞ্চল কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত : হেজাজ, নেজদ, ইয়েমেন, হাজরামাউত এবং ওমান। ইসলামের জন্মভূমি হেজাজ আরব দেশের মধ্যভাগে অবস্থিত এবং মক্কা, মাদনা ও তারেক এর।তপাত পা শহর। দক্ষিণ আরবে অবস্থিত হাজরামাউত, ওমান ও ইয়েমেন অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকার্যের জন্য খুবই বিখ্যাত। ইয়েমেন শব্দের অর্থ সুখী বা পরিতৃপ্ত এবং এর নাম হতেই দক্ষিণ আরবের ‘সুখী আরব-ভূমি’ (Arabia Felix) নামকরণ হয়েছে। স্ট্রাবো দক্ষিণ আরব অঞ্চলকে খুবই সমৃদ্ধ এবং সুগন্ধি দ্রব্যে ভরপুর দেশ বলে উল্লেখ করেন।
সাধারণত আরব-ভূমির আবহাওয়া অত্যন্ত শুষ্ক ও গরম। অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর অভাবে উত্তপ্ত মরু অঞ্চল শুষ্ক, রৌদ্রদগ্ধ, বৃক্ষলতাদি শূন্য এবং ‘লুহ’ হাওয়া প্রবাহিত এলাকায় পরিণত হয়েছে। মৌসুমী বায়ুর আওতাভুক্ত হলে এই উপদ্বীপের জলবায়ু আর্দ্র হতে পারত। যাহউক, ইয়েমেন, ওমান, হাজরামাউত ও হেজাজ প্রভৃতি উপকূলবর্তী অঞ্চল এবং পানিবিধৌত উপত্যকায় সামান্য বৃষ্টিপাত হয়। দুই-তিন বৎসর ধরে হেজাজে অনাবৃষ্টি চলতে থাকে এবং মাঝে মাঝে ঝটিকা বৃষ্টি হয়ে জান-মালের খুব ক্ষতি করে। হেজাজের উত্তরাঞ্চলের কতিপয় মরূদ্যান শুধু বাসোপযোগী। এই দেশের অধিকাংশ অধিবাসীই বেদুঈন এবং মদিনা সর্বাপেক্ষা স্বাস্থ্যকর নগরী। আরব দেশে নৌ- চলাচলের উপযোগী কোন নদ-নদী না থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উষ্ট্রই প্রধান বাহন। বৃষ্টির পানি মরুভূমিতে সঞ্চালিত হয়ে স্থানে স্থানে যে ঝর্ণা অথবা ‘ওয়াদীর’ (Wadis) সৃষ্টি করেছে, তা পর্যবেক্ষণ করে প্রাচীন আরবের বাণিজ্যিক ও তীর্থযাত্রার পথের সন্ধান পাওয়া যায়।
শুষ্ক আবহাওয়া ও জমির লবণাক্ততার ফলে আরব দেশে পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না। খেজুর আরব দেশের সর্বাপেক্ষা প্রিয় খাদ্য। প্রধান খাদ্য ছাড়াও খেজুরের রস পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়; এর বীজ উটের আহার্য। মদিনায় রাসূলুল্লাহ্ (স)-এর মসজিদ খেজুর গাছের কাণ্ড ও পাতার ছাদ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। হিট্টির মতে, “মেসোপটেমিয়া হতে আরব দেশে প্রথম খেজুর আমদানি হয়।” এর প্রমাণ পাওয়া যায় অ্যাসিরীয় প্রস্তর-গাত্রে উৎকীর্ণ খেজুর গাছের নক্সাবলীতে। হেজাজই খেজুর উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। খেজুর ব্যতীত ওমান ও হাসায় কিঞ্চিৎ পরিমাণ ধান, ইয়েমেনে কফি ও গম অত্যাধিক ফলে থাকে। এছাড়া কোথাও কোথাও আঙ্গুর, জোয়ার, ডালিম, আপেল, কমলালেবু, তরমুজ, ইক্ষু প্রভৃতির চাষ হয়।
আরব দেশের ঘোড়া পৃথিবী বিখ্যাত হলেও প্রকৃতপক্ষে সিরিয়া হতে সর্বপ্রথম আরব দেশে ঘোড়া আমদানি করা হয়। পশ্চিম এশিয়ায় ঘোড়া প্রচলনের প্রধান কৃতিত্ব ছিল কায়সাইটস (Kaissites) ও হিট্টাইটসদের (Hittites)। কাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব দিকে ইন্দো-ইউরোপীয় বেদুঈনগণ সর্বপ্রথম ঘোড়াকে গৃহপালিত জন্তুরূপে ব্যবহার করে। খ্রিস্টের জন্মের দুই হাজার বৎসর পূর্বে ঘোড়া পশ্চিম এশিয়ায় প্রচলিত হয় এবং খ্রিস্টের জন্মের গাড়ার দিকে সিরিয়া হতে আরব দেশে ঘোড়া আমদানি করা হয়। শিকার, খেলাধুলা, যুদ্ধ-বিগ্রহে ঘোড়ার প্রতি আরবদের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে।
উট আরবদের সর্বাধিক প্রিয় গৃহপালিত জন্তু। দুর্ধর্ষ আরব বেদুঈনের একমাত্র বাহন উটকে যথার্থই ‘মরুভূমির জাহাজ’ (The Ship of the Desert) বলা হয়। যানবাহন ছাড়া উটই আহার্য ও পানীয় যোগায় এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর চামড়া দ্বারা বেদুঈনগণ শরীর আবৃত করত; লোম দ্বারা তাঁবু নির্মাণ, মল রক্তপাতের মুল্য প্রভৃতি উটের বিনিময়ে প্রদত্ত হত। যুদ্ধে উটের ব্যবহারের কথা ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন। প্রাচীন মিসরীয়, অ্যাসিরীয়, ব্যবিলনীয় এবং পারস্যের নথিপত্রে আরবদের অশ্বারোহীর পরিবর্তে উষ্ট্রারোহী রূপেই চিত্রিত করা হয়। এছাড়া গ্রীস অভিযানে পারস্যের সম্রাট জারেস্কেস আরব উষ্ট্রারোহীর একটি বিশাল বাহিনী গঠন করেন। অ্যাসিরীয় ভাস্কর্যে সম্রাটকে রাজস্বের পরিবর্তে আরবদের দ্বারা উট প্রদানের নজির দেখা যায়। কুর’আন শরীফে উটকে আরবদের জন্য একটি বিশেষ অবদান বলে বর্ণনা করা হয়। বেদুঈন শেখের ঐশ্বর্য উট দ্বারা পরিমাপ করা হয়। উট মরুর বেদুঈনদের নিত্য সহচর ও তাদের জীবনে অপরিহার্য অঙ্গ। শীতকালে ২৫ দিন এবং গ্রীষ্মকালে ৫ দিন উট পানি পান না করেও চলতে পারে। উত্তপ্ত মরুর মধ্যে পানির প্রয়োজনীয়তাও উট মিটাতে পারে। কারণ পানি সংরক্ষন করবার বিশেষ ব্যবস্থা তাদের আছে। সম্ভবত এ কারণে হযরত ওমর (রা) বলেছেন, “উটের যেখানে উন্নতি, আরবদের সেখানে উন্নতি।”
(খ) আরব জাতি
আরব উপদ্বীপের আদিম অধিবাসীদের সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য নিরূপণ করা এখনও সম্ভব হয় নি। স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্যবোধে উদ্দীপ্ত আরব জাতি প্রধানত দুভাগে বিভক্ত; যথা— অধুনালুপ্ত ‘বায়দা’ (Baidah) ও ‘বাকিয়া’ (Baqiyah)। কুরআন শরীফে বর্ণিত প্রখ্যাত প্রাচীন বংশ ‘আদ’ (Ad) ও ‘সামুদ’ (Shamud) এবং ‘তাসম’ (Tasm) ও ‘জাদীস’ (Jadis) প্রভৃতি প্রাচীন আরব গোত্র প্রথম শ্রেণীভুক্ত ছিল। পরবর্তী জাতিগুলোর অভ্যুত্থানে প্রাচীন ‘বায়দা’ গোত্রগুলো বিলুপ্ত হয়।
অধুনালুপ্ত বায়দা গোত্রের উত্তরাধিকারী বাকিয়া জাতি বর্তমান আরব ভূখণ্ডের প্রধান অধিবাসী! এই বাকিয়া শ্রেণীভুক্ত আরবদের দু ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা- ‘প্রকৃত আরব বা ‘আরিবা’ (Arabian Arabs) ও আরবীকৃত আরব বা ‘মুস্তারিবা’ (Arabicized Arabs)। সর্বাপেক্ষা আদিম ও নিষ্কলুষ রক্তের অধিকারী আরিবা গোত্ৰ কাহতানের (পুরাতন টেস্টামেন্টের যোকতান) বংশসম্ভূত। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন অঞ্চলের অধিবাসী ছিল বলে তারা ইয়েমেনীয় বা হিমারীয় ( Himayarites) বলে পরিচিত ছিল। কাহতান বংশের অভ্যুত্থান হতেই আরব জাতির প্রকৃত ইতিহাসের সূত্রপাত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, রক্তের পবিত্রতার জন্য আরিবা অথবা ইয়েমেনীয়রা মুস্তারিবা গোত্রের তুলনায় অধিক ক্ষমতাশালী ছিল এবং মদিনায় হিজরত করবার পর প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (স) তাদের নিকট হতে সাহায্য লাভ করেন। ঈসমাইলের একজন বংশধর আদনান মোস্তারিবা গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। হেজাজ, নেজদ, পেত্রা, পালমিরা অঞ্চলে বসবাসকারী মুস্তারিবা গোত্রের নিযারী (Nizari) হতে হযরত মুহম্মদ (স)-এর কুরাইশ বংশের উদ্ভব হয়।
ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক যুগ উত্তর ও দক্ষিণ আরব গোত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে কলুষিত হয়ে রয়েছে। এর প্রধান কারণ জাতি, কৃষ্টি, ভাষার দিক হতে এ দুই গোত্রের বৈষম্য। উত্তর আরব গোত্র সাধারণভাবে নিযারী অথবা মুদারী নামে অভিহিত এবং সাধারণত তারা যাযাবরের ন্যায় জীবনযাপন করত, অপরদিকে দক্ষিণ আরব অথবা ইয়েমেনীরা নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত। কারণ, তারা সাবেয়ী ও হিমাইয়ারী রাজ্যের অধিবাসী ছিল। উত্তর আরবের সম্প্রদায় কুরআন শরীফের ভাষা অর্থাৎ আরবিতে কথা বলত, দক্ষিণ আরবের লোকেরা প্রাচীন সেমিটিক ভাষা, সাবেয়ী ও হিমাইয়ারী ভাষা ব্যবহার করত। কৃষ্টির দিক হতে বিচার করলে দক্ষিণ আরবে সভ্যতার উন্মেষ ঘটে খ্রিস্টের জন্মের ১২ শত বৎসর পূর্বে, পক্ষান্তরে ইসলামের আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত উত্তর আরব ইতিহাসে কোন বলিষ্ঠ অধ্যায়ের সুচনা করতে পারে নি।
(গ) আরবের অধিবাসী
ভূ-প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে আরবের অধিবাসীদের দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়— শহরের স্থায়ী বাসিন্দা ও যাযাবর বেদুঈন। এই দুই শ্রেণীর আচার-ব্যবহার, জীবনযাত্রা প্রণালী, ধ্যান-ধারণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। উর্বর তৃণ- অঞ্চলগুলো স্থায়ীভাবে বসবাসের উপযোগী বলে অসংখ্য জনপদ গড়ে উঠেছে এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের কৃষিকার্য, ব্যবসা-বানিজ্য প্রভৃতি ছিল প্রধান জীবিকা। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে এরা মরুবাসী বেদুঈনদের তুলনায় অধিকতর রুচিসম্পন্ন ও মার্জিত। স্থায়ী শহরবাসী ও যাযাবর বেদুঈনদের মধ্যে একটি সীমারেখা টেনে দেওয়া অসম্ভব। কারণ, অনেক মরুবাসী আরব বেদুঈন জীবন ত্যাগ করে শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। অপরদিকে দারিদ্র্যের কশাঘাত সহ্য করতে না পেরে কিছু সংখ্যক স্থায়ী বাসিন্দা বাধ্য হয়ে যাযাবর বৃত্তি গ্রহণ করে।
আরবের অধিবাসীদের অধিকাংশই স্বাধীনচেতা ও বেপরোয়া দুর্ধর্ষ মরুবাসী বেদুঈন। সমাজের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে স্থায়ীভাবে শহরে বসবাস করবার পরিবর্তে বেদুঈনগণ জীবন ধারণের জন্য মরুভূমিতে সর্বত্র ঘুরে বেড়াত এবং তৃণের সন্ধানে এক পশুচারণ হতে অন্য পশুচারণে গমন করত। তাদের গৃহ ছিল তাঁবু; আহার্য উটের মাংস; পানীয় উট ও ছাগলের দুগ্ধ; প্রধান জীবিকা লুঠতরাজ। শহরবাসী ও বেদুঈনদের মধ্যে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কঠোর জীবন সংগ্রামের পথে তারা ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করতে বাধ্য হত। কখনও আবার শাস্তিপূর্ণ উপায়ে বিত্তশালীদের নিকট থেকে বেদুঈনগণ অর্থ সংগ্রহ করত। হিট্টি বলেন যে, “যাযাবর প্রথা একটি বিজ্ঞানসম্মত জীবনব্যবস্থা। লুণ্ঠনবৃত্তির জন্য আরব বেদুঈনদের স্থলদস্যু বলা যেতে পারে।”
মরুভূমির নিরবচ্ছিন্ন শুষ্কতা ও একঘেঁয়েমি দুরন্ত আরব বেদুঈনদের শারীরিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠনে অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করে। প্রগতি ও পরিবর্তনকে তারা উপেক্ষা করে পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি ও জীবনযাত্রার প্রণালী মনেপ্রাণে অনুসরণ করে। ইতিহাসের গতিধারা, রাজ্যের উত্থান-পতন যাযাবর বেদুঈনদের সাবলীল ও স্বাধীন জীবন পদ্ধতিতে ব্যাহত করতে পারে নি। খেজুর, গম ও অন্যান্য অগ্নিদগ্ধ শস্য তাদের প্রধান আহার্য যা তারা দুগ্ধ অথবা পানির সাহায্যে ভক্ষণ করে। আলখাল্লা, কোমরবন্ধ, ফিতা দ্বারা বাঁধা শিরস্ত্রাণ তাদের পোশাক, পাদুকা ব্যবহারে তারা অভ্যস্ত নয়। দুরন্ত যাযাবর বেদুঈনদের নিকট মরুভূমিই প্রধান বাসস্থান, তাদের ধ্যান-ধারণা, ভাষা ও রক্তের পবিত্রতার রক্ষক।
বেদুঈন সমাজের মূল ভিত্তি গোত্র-প্রথা। তাঁবুতে বসবাসকারী কয়েকটি যাযাবর পরিবার একটি গোত্র (Hayy) এবং কয়েকটি গোত্র নিয়ে একটি বংশ (Qabilah অথবা Tribe) গঠিত হয়। রক্ত সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়দের নিয়ে একই গোত্রের লোকদের বানু (Banu) বলে অভিহিত করা হয়। এই গোত্রের অধিনায়ক একজন বয়োজ্যেষ্ঠ বেদুঈন। কোন কোন গোত্রের নাম স্ত্রী-বাচক বলে মনে হয়। প্রাচীনকালে আরবদের সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। তাঁবু এবং গৃহস্থালীর দ্রব্যাদি ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলেও পশুচারণ, তৃণভূমিতে পানি এবং যৎসামান্য ভূমি গোত্রের সম্পত্তি বলে পরিগণিত হত। একই গোত্রের মধ্যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে কেহ অপরাধীকে সাহায্য করত না; কিন্তু অপর কোন গোত্র যদি নরহত্যা করত তা হলে সমগ্র গোত্র হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সংঘর্ষে লিপ্ত হত। এক্ষেত্রে রক্তের পরিবর্তে রক্তপাতের দাবি জানান হত। আন্তগোত্রীয় সংঘর্ষ দীর্ঘস্থায়ী ছিল; যেমন- বানু বকরের সঙ্গে বানু তাঘলিবের মধ্যে সংঘটিত বাসুস যুদ্ধ চল্লিশ বৎসর যাবৎ চলে। এক পাত্রে আহার অথবা গোত্রের কোন সদস্যে রক্ত চুষিলে এক গোত্রের কোন ব্যক্তি অপর গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হতে পারত।
আরব যাযাবর গোত্রের প্রধানকে শেখ বলা হত। গোত্রপতি বয়স, জ্ঞান-বুদ্ধি, সাহস ও বীরত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত হত। পারিবারিক প্রধানদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিলের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতেন। সামরিক, বিচার-সংক্রান্ত ও জনমঙ্গলকর ব্যাপারে শেখ-এর বিশেষ কোন কর্তৃত্ব ছিল না।
বেদুঈনদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হবে যে, একদিকে যেমন লুঠতরাজ, জিঘাংসা, পণ্যদ্রব্য অপহরণ, যুদ্ধবিগ্রহে তারা লিপ্ত ছিল, অপরদিকে তেমনি মহত্ত্বের সুকুমার গুণাবলীও তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। একজন প্রখ্যাত উমাইয়া কবি বলেন, “শত্রুকে বা শত্রুর প্রতিবেশীকে আক্রমণই আমাদের প্রধান কাজ। কাকেও না পাওয়া গেলে আমরা সহোদর ভ্রাতাকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করি না। যাযাবর বেদুঈনদের স্বজনপ্রীতি ও গণতন্ত্রপ্রীতি সর্বজনবিদিত। গোত্র-কেন্দ্রিক মরুবাসী বেদুঈনদের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য কৌম-চেতনা ‘আসাবিয়াহ’। গোত্র-প্রীতি ও রক্ত সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট এই কৌম-চেতনা পরবর্তীকালে আরব জাতি-গঠন এবং ইসলামের বিস্তৃতির সহায়ক ছিল। প্রাচীন আরব কবির ভাষায়, “গোত্রের প্রতি আনুগত্যশীল থাকা, সদস্যদের উপর এই গোত্র প্রীতি এত প্রকট যে, স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারে।” আঞ্চলিকতা, হীনমন্যতা বা জাতীয়তাবোধ বেদুঈনদের স্পর্শ করতে পারে না। ব্যক্তি- স্বাতন্ত্র, গোত্র-মানসিকতা, অতিথিপরায়ণতা (Diyafay), সহিষ্ণুতা ( Hamasah), পৌরুষত্ব (Muru’ah) প্রভৃতি তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রক্তে পরিত্রতা, পূর্ব-পুরুষদের আভিজাত্য ও বীরত্ব, প্রাচীন আরবি কবিতা ও বাগ্মিতা, আরবি অশ্ব ও তরবারি তাদের গর্বের বস্তু ছিল। আরব বেদুইনদের অতিথিপরায়ণতা সর্বজনস্বীকৃত; কারণ, অতিথি- শত্রুকেও তারা আদর-আপ্যায়ন করতে দ্বিধা করে না। কেবল পানি ও পশুচারণের জন্য উপযুক্ত তৃণভূমিকে উপলক্ষ করে তারা নির্মম ও হৃদয়হীন হয়ে উঠে। শহরবাসী মহিলাদের তুলনায় বেদুঈন নারী অপেক্ষাকৃত স্বাধীন ছিল এবং পুরুষপ্রধান সমাজব্যবস্থায় তারা দুর্ব্যবহারের জন্য স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারত।
বিচিত্র ভৌগোলিক অবস্থা আরব উপদ্বীপের অধিবাসীদের দেহ, মন, জীবনযাত্রা ও চরিত্রে অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছে। শুষ্ক আবহাওয়া, অনাবৃষ্টি, ভূমির লবণাক্ততা, অনুর্বরতার মত প্রতিকূল ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে অহরহ সংগ্রাম করে মরুবাসী বেদুঈনগণ একদিকে যেরূপ রুক্ষ, দুঃসাহসিক, দুর্ধর্ষ ও সৈনিক জাতিতে পরিণত হয়েছে; অপরদিকে তারা ধৈর্যশীল, কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী হয়েছে। মরুভূরিম প্রচণ্ড সাইমুম ঝড়, প্রখর উত্তাপ, রৌদ্র দগ্ধ বালুকা, উন্মত্ত লু হাওয়া, রুদ্র পর্বতমালা ও কণ্টকাকীর্ণ বৃক্ষাদি যেন তাদেরকে সংগ্রামশীল করে তুলেছে। আহার ও পানীয়ের অভাবে মরুবাসী বেদুঈন যাযাবর বৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। গতিই তাদের জীবনের ধারা; কারণ, তারা চিরস্থায়ীভাবে কোথাও বসবাস করতে পারে না। পশুচারণ ও পালনই তাদের প্রধান পেশা। প্রতিকূল ভৌগোলিক পরিবেশই তাদের গোত্রানুগত্যশীলতার উন্মেষ ঘটিয়েছে। মরুভূমির মুক্ত ও বন্ধনহীন পরিবেশে বসবাস করে স্বভাবত তারা স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। হিট্টি যথার্থই মন্তব্য করেন, “শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরবরা বৈদেশিক আধিপত্য হতে মুক্ত ছিল।” বিজাতীয় শত্রুর পদচিহ্নে আরব-ভূমি অপবিত্র হয় নি; কারণ, খাদ্য ও পানীয়ের দুষ্প্রাপ্যতা, অত্যাধিক তাপ, নির্দিষ্ট পথের অভাব বৈদেশিক আক্রমণ হতে আরব দেশকে রক্ষা করেছে। স্ট্রাবোর মতে, “একমাত্র আরবরাই আলেকজাণ্ডারের নিকট তাদের কোন দূত প্রেরন করে নি; যদিও আরবদেশকে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন।” আরবের নৈসর্গিক দৃশ্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশে মরুবাসী বেদুঈনদের মনে গভীর আত্মচেতনা ও কাব্যিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করে। হযরত ওমর (রা)-এর ভাষায়, “বেদুঈনগণই ইসলামের মাল-মশলা (Raw materials) সরবরাহ করেছিল।
(ঘ) আরবের প্রাচীন রাজ্যসমূহ
দক্ষিণ আরব : আরব দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সেমিটিক জাতিভুক্ত সাবিয়ানগণই সর্বপ্রথম আরব উপদ্বীপে সভ্যতার উন্মেষ ঘটায়। গ্রিক সাহিত্যিক থিওফ্রাসটাস সার্বিয়ানদের সভ্যতার কথা উল্লেখ করেন। বৃষ্টিধারায় ধৌত ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের অনুকূল সাবিয়ান রাজ্যের প্রতিষ্ঠার কথা প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত শিলালিপির পাঠোদ্বার হতে জানা যায়। ফনেসীয়দের মত সাবিয়ানগণ সামুদ্রিক বাণিজ্যে অসীম কৃতিত্ব প্রদর্শন করে এবং খ্রিস্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বৎসর পূর্ব থেকে তারা দক্ষিণের সমুদ্রের উপর একাধিপত্য বিস্তার করে। স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার করবার উদ্দেশ্যে ইয়েমেন হতে সিরিয়া পর্যন্ত মক্কা, পেত্রা, মিসর, সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী কাফেলার রাস্তা (Caravan route) নির্মাণ করা হয়। হাজরামাউত ও ইয়েমেন অঞ্চলই প্রধানত সাবিয়ান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, এই অঞ্চল সুগন্ধি দ্রব্য উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং প্রাচীন মিসরের মন্দিরে যে সমস্ত সুগন্ধি দ্রব্য (aromata) ব্যবহৃত হত তা সাবিয়ান রাজ্য হতে সংগৃহীত হত। মা’রিব ছিল এর রাজধানী। মিনাই ও সাবিয়ান ছিল তাদের ভাষা এবং তাদের বর্ণমালা ছিল সিনিয়াটিক। হার্ভে ও গ্লাসারের অক্লান্ত চেষ্টায় অসংখ্য আরবীয় শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। মিনাই ও সাবিয়ান বর্ণমালাই মিসরীয় ও ফনেসীয় বর্ণমালার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেছে।
দক্ষিণ আরবের কুহেলিকাপূর্ণ প্রাচীন ইতিহাসে স্পষ্টরূপে প্রথম যে রাজ্যের পরিচয় পাওয়া যায়, তা মিনাইয়ান নামে পরিচিত। নাজরান ও হাজরামাউতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এই রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ হতে ৬৫০ অব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে হার্ভে মিনাইয়ান রাজ্যের রাজধানী কারনাও পরিদর্শন করেন; বর্তমানে এর আরবি নাম মা’য়ীন অর্থাৎ “ঝর্ণাধারা”। পার্শ্ববর্তী সাবিয়ান রাজ্যের অনুরূপ ছিল এর ভাষা এবং বর্ণমালা ছিল সিনিয়াটিক। মূলার শিলালিপির পাঠোদ্ধার করে ২৬ জন মিনাইয়ান রাজার নাম উল্লেখ করেন।
প্রথম সাবিয়ান যুগের রাজাগণ মিনাইয়ান নৃপতিদের সমসাময়িক রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০ হতে ১১৫ অব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রথম যুগের রাজাদের উপাধি ‘মুকাররিব’ : তিনি একাধারে শাসক ও পুরোহিত ছিলেন। প্রাচীন সিবওয়াহ ছিল প্রথম সাবিয়ান রাজধানী; এর বর্তমান নাম যারিবাহ। অ্যাসিরীয় রাজা দ্বিতীয় সারগণকে প্রথম সাবিয়ান যুগের নৃপতিগণ উপঢৌকন পাঠান। মা’রিব ছিল প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র এবং তিনটি বাণিজ্যপথের সঙ্গমস্থলে এটি অবস্থিত ছিল। প্রকৌশলীদের নৈপুণ্যের পরিচায়ক মা’রিব-বাঁধ শুধু একটি অপূর্ব কীর্তিই ছিল না, বরং কৃষিকার্যের সুব্যবস্থা ও নাগরিকদের উহা শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার প্রতীক ছিল। দ্বিতীয় সাবিয়ান যুগ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ হতে। এ যুগের নৃপতিদের ‘মাল্ল্কস্ববা’ উপাধি গ্রহণে মনে করা হয় যে, তারা পৌরহিত্যের কার্যকলাপ হতে নিজেদের নিবৃত্ত রাখতেন। দক্ষিণ আরবের রাজবংশের মধ্যে দ্বিতীয় সাবিয়ানগণই সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধিশালী ছিল। স্থাপত্যশিল্প, ভাস্কর্য ও শিলালিপি প্রভৃতি দক্ষিণ আরব সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে।
সাবিয়ানদের বংশসম্ভূত ও মিনাইয়ান-সাবিয়ান সভ্যতার উপযুক্ত উত্তরাধিকারী হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ অব্দ হতে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম আরবে হিমাইয়ারী রাজবংশ রাজত্ব করে। The Periplus of the Erythraean Sea নামক গ্রন্থে এবং Pliny-এর রচনায় ‘Homerita’ নামে যে শব্দ পাওয়া যায় সম্ভবত উহা হিমাইয়ারী বংশকেই নির্দেশ করে। Pliny বলেন যে, হিমাইয়ারী সভ্যতা কৃষিভিত্তিক এবং বিভিন্ন বাঁধ, কূপ, সেচ-ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ হতে এর কৃষিকার্যের অগ্রগতি সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। বর্তমান ইয়ারিম শহরের নিকট হিমাইয়ারী রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী জাফর-এর ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টিগোচর হয়। এই শক্তিশালী রাজ্যে রোমানগণ সুষ্ঠুভাবে অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হয় নি। হিমাইয়ারী রাজত্বের প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনা আবিসিনিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন। এর ফলে একটি নতুন রাজ্য ও সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়। আল-হামদানী ও ইয়াকুতের রচনাবলিতে হিমাইয়ারী রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বিশ তলাবিশিষ্ট সুরক্ষিত গুমদান দুর্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত শহরবাসী হিমাইয়ারিগণ যাযাবর বেদুঈনদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য এই দুর্গ তৈরি করে। তখন স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন ছিল। এর একদিকে রাজার ও অপরদিকে একটি ষাঁড় অথবা পেঁচার প্রতিকৃতি অঙ্কিত থাকত।
হিমাইয়ারী সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক। রাজা সামন্ততন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। সমাজ ব্যবস্থা শ্রেণীবিভাগ, গোত্র-প্রথা, সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। ভারত মহাসাগরে রোমান বাণিজ্যপোত আগমনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ আরববাসীদের সামুদ্রিক- বাণিজ্য মারাত্মক ব্যাহত হয়। ৩০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে হিমাইয়ারিগণ হাজরামাউতসহ সমগ্র উপকূল ও লোহিত সাগরের তীরস্থ অঞ্চলের অংশবিশেষ করায়ত্ত করে। আবিসিনিয়গণ হিমাইয়ারী রাজ্য দখল করে ৩৪০ হতে ৩৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করে। এর পর দ্বিতীয় হিমাইয়ারী রাজত্বের সূচনা হয় এবং ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তারা নির্বিঘ্নে রাজত্ব করতে থাকে। ‘তুব্বা’ (Tubba) ছিল রাজার উপাধি। শিলালিপি হতে এই যুগের নয়জন নৃপতির নাম উদ্ধার করা হয়। দ্বিতীয় হিমাইয়ারী যুগে সর্বপ্রথম ইয়েমেনে খ্রিস্টান ও ইহুদী ধর্ম বিস্তার রাভ করে। দক্ষিণ আরবের অধিবাসীরা গ্রহ-উপগ্রহের উপাসনা করত। চন্দ্র ছিল প্রধান দেবতা, সূর্যকে চন্দ্রের ভার্যা মনে করা হত। ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়ানগণ হিমাইয়ারী রাজ্য জয় করে ৫৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করতে থাকে। এই আমলের রাজধানী সানায় আবরাহা ৫৭০ বা ৪৭১ খ্রিস্টাব্দে মক্কা নগরী আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়। কুর’আন শরীফে (৩৪ : ১৫) এরউল্লেখ আছে।[১] মারি’বের বাঁধ ধ্বংস আবরাহার অপর একটি দুষ্কর্ম। এর ফলে বানু ঘাসসান সিরিয়ার হাওরান এলাকায় এবং বানু লাখম হীরায় গমন করে উত্তর আরবে নতুন রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করে। পারস্যের সম্রাট নওশেরওয়ার সাহায্য হিমাইয়ারী বংশের জনৈক সাইফ-ইবন-জিইয়াযান ইয়েমেনকে আবিসিনিয়ান শাসন হতে মুক্ত করেন। এই ঘটনাটি সংঘটিত হয় ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে; কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই পারস্যের প্রভুত্ব দক্ষিণ আরবে কায়েম হয়। এর ফলে ইসলামের ইতিহাসের গতিধারা ইয়েমেনের পরিবর্তে হেজাজে নির্ধারিত হতে থাকে।
[১. হস্তীবাহিনী নিয়ে আবরাহা মক্কা অবরোধ করলে আবিসিনিয়ান সৈন্যদল “ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর বর্ষণে” সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়।]
উত্তর আরব : প্রাক-ইসলামী যুগে দক্ষিণ আরবের বিভিন্ন রাজ্যের মত উত্তর ও মধ্য আরবে কতিপয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের অভ্যুত্থান ঘটে। সামরিক বৈশিষ্ট্যবর্জিত এই সমস্ত রাজ্য প্রধানত ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠে।
উত্তর আরবের রাজ্যগুলোর মধ্যে সর্বপ্রধান ছিল নাবাতিয়ান; এর রাজধানী ছিল ‘রক্ত-গোলাপ শহর’ (Red-rose city ) পেত্রা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে যাযাবর নাবাতিয়ানগণ ট্রান্সজর্দান হতে উত্তর আরব অঞ্চলে আগমন করে এডোমাইটদের রাজ্য দখল করে। পেত্রাকে কেন্দ্র করে যে রাজ্য স্থাপিত হয়, তা ১০৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট ট্র্যজনের আক্রমণ অবধি স্থায়ী ছিল। ভূমধ্যসাগর হতে দক্ষিণ আরবের সবা পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্যপথের (Caravan route) মধ্যস্থলে পেত্রা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩১২ অব্দে নাবতিয়ানগণ পর পর দু’টি রোমান অভিযান প্রতিহত করলেও পরবর্তীকালে তারা মিসরের টলেমী ও রোমানদের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে। খ্রিস্টের জন্মের সময় নাবাতিয়ানদের রাজ্য দামেস্ক পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তাদের সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য ১০৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট ট্র্যজনের আক্রমণে লোপ পায়। আরবী ভাষায় কথোপকথন চললেও নাবাতিয়ানগণের সাহিত্যে আরামাইক লিপির ব্যবহার দেখা যায়। আরামাইক হতে গৃহীত নাবাতিয়ান বক্র হস্তলিপি (Cursive Script) তৃতীয় খ্রিস্টাব্দে উত্তর আরব অর্থাৎ কুরআনের ভাষার রূপ পরিগ্রহ করে। খ্রিস্টের জন্মের সময়কালে নাবাতিয়ান সভ্যতা চরম বিকাশ লাভ করে। ১০৬ খ্রিস্টাব্দে ইহা রোমান প্রদেশে পরিনত হয় এবং বাণিজ্যপথ উত্তর দিকে পালমিরা হয়ে অতিবাহিত হবার ফলে পেত্রার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিলুপ্ত হয়। স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন হতে বুঝা যায় যে, পাথর কেটে বিভিন্ন সৌধ রোমান স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত হয়েছে। বস্তুত রোমান শাসনকালে পেত্রা সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধিশালী ছিল।
পার্থিয়ান ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যস্থলে অবস্থিত পালমিরা রাজ্য নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে নিজস্ব নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা বজায় রাখবার চেষ্টা করত। এর ভৌগোলিক অবস্থান, মিঠা ও খনিজ পানির সরবরাহ, মরূদ্যান নগরী পালমিরাকে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে বাণিজ্যপথের সঙ্গমস্থলে পরিণত করে। পালমিরা আরবদের নিকট ‘তাদমুর’ নামে অধিক পরিচিত এবং খ্রিস্টপূর্ব ১০০ অব্দের একটি শিলালিপিতে ‘তাদমুর’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। যা হউক, আরবগণ এই অঞ্চল কখন অধিকার করে তা বলা দুষ্কর। ঘনবসতিপূর্ণ এই প্রাচীন সমৃদ্ধি শালী রাজা ১৩০ হতে ২৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়। এটি অবিসংবাদিত সত্য যে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে পালমিরা রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তৃতীয় শতাব্দীতে এটি একটি রোমান উপনিবেশে পরিণত হয়। পালমিরার পরাক্রমশালী নৃপতি উজায়নাহ পার্থিয়ান রাজা প্রথম শাহপুরের আক্রমণ প্রতিহত করেন। পরবর্তীকালে রোমান ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিলে উজায়নাহ রোমানদের পক্ষ অবলম্বন করেন। তার প্রধান কৃতিত্ব ছিল এশিয়া মাইনর, উত্তর আরব, সিরিয়া, মিসর ও আর্মেনিয়ায় স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করা। ২৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিহত হলে তাঁর রাজী জেনোবিয়া অসীম দক্ষতা ও বীরত্বের সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। রোম-অধিকৃত আলেকজান্দ্রিয়াও তিনি দখল করতে সমর্থ হয়। রোম সম্রাট অরেলিয়ান (Aurelian) ২৭২ খ্রিস্টাব্দে জেনোবিয়াকে যুদ্ধে পরাজিত করে পালমিরাকে ধূলিসাৎ করে দেন। গ্রিক, পার্থিয়ান ও সিরিয়ান উপকরণের সমন্বয়ে পালমিরান সভ্যতার উন্মেষ হয়। শিলালিপিতে নৃপতিদের নাম লক্ষ্য করলে প্রতীয়মান হয় যে, তারা জাতিতে আরব, যদিও তাদের কথ্য ভাষা পশ্চিম দেশীয় আরামাইক। সৌরজগতের উপাসনা পালমিরানদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
পালমিরা রাজ্যের পতনের পর হাউরানের বুসরা ও অন্যান্য ঘাসানীয় শহর বাণিজ্য-কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে প্রাচীন দক্ষিণ আরব হতে একটি জাতি সিরিয়ায় আগমন করে শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। সম্ভবত জাফনা-ইবন-আমর এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ঘাসানি সিরিয়া আরব রাজ্য পঞ্চম শতকে বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের প্রভাবে একটি মধ্যবর্তী রাজ্যে (Buffer State) পরিণত হয়। তাদের ভাষা ছিল আরামাইক, সংস্কৃতি সিরিয়ান ও ধর্ম খ্রিস্টান। লাখমিদ রাজবংশের মত ঘাসানি-শাসন ষষ্ঠ শতকে সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ছিল, এর ফলে এই দুই পার্শ্ববর্তী রাজ্যের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষ বাধে। আল-হারিস ও তদীয় পুত্র আলমুনজীর ঘাসসানি বংশের শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর এই বংশের অধঃপতন ঘটে। ৬১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে সাসানীয় রাজা খসরু পারভেজ দামেস্ক অধিকার করলে ঘাসসানি রাজশক্তির অবসান ঘটে। পালমিরার মত ঘাসসানি সভ্যতা আরব, সিরিয়ান ও গ্রিক উপকরণে গঠিত ছিল। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, প্রখ্যাত প্রাচীন আরবী কবি ও মোয়াল্লাকার অন্যতম স্রষ্টা লাবিদ এবং হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সমসাময়িক কবি হাসান-ইবন-সাবেত গাসসানি রাজ-দরবারকে সমুজ্জ্বল করেন। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস উপত্যকায় খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে ইয়েমেনের তানুখ গোত্র বসবাস করতে শুরু করে। একটি সমৃদ্ধিশালী রাজ্য স্থাপন করে লাখমিদ বংশ এই অঞ্চলে সপ্তম শতকের শেষভাগ পর্যন্ত আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখে। এই নব-গঠিত রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল হীরা। আমর-ইবন-আ’দি সম্ভবত এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা; কিন্তু বিশজন রাজার তালিকায় ইমরুল কায়েসের (৩২৮ খ্রিস্টাব্দ) নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত দীপ্তিমান। ইমরুল কায়েসের সমাধি-স্তম্ভের লিপিতে সর্বপ্রথম মূল আরবি শিলালিপি ব্যবহৃত হয়েছে। কায়েসের পুত্র প্রথম নুমান বিখ্যাত খাওয়ারনাক দুর্গ নির্মাণ করে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আমর-ইবন-হিন্দ লাখমিদ সভ্যতাকে সুদূরপ্রসারী করেন। কারণ, তাঁর রাজদরবারে তারাফা-ইবন-আল- আদ, হারস্,-ইবন-হিল্লিজা ও আমর ইবন-কুলসুম নামে তিনজন প্রখ্যাত মোয়াল্লাকা রচয়িতা বসবাস করতেন। সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে হীরার অধঃপতন ঘটে। লাখমিদগণ আরবি ভাষায় কথা বলত এবং সিরিয়াক ভাষায় লেখাপড়ার কাজ চালাত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, লামিদ রাজ্য পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যের অর্ন্তভুক্তির ফলে হীরা পারস্য সভ্যতায় প্রভাবান্বিত হয়। এর মাধ্যমে আরব উপদ্বীপে পারস্য প্রভাব বিস্তার লাভ করে।
দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন অঞ্চল হতে আগমন করে কিন্দা গোত্র মধ্য-আরবে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হুজ্ (Hujr) অথবা আকিল আল-মুরাদ। পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি এই বংশের উদ্ভব হয়। আকিলের পুত্র ছিলেন আমর এবং আমরের পুত্র আল-হারেস এই বংশের প্রখ্যাত রাজা ছিলেন। ৫২০ খ্রিস্টাব্দে লাখমিদ নৃপতি তৃতীয় আল-মুনজির কর্তৃক কিন্দা রাজবংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বিখ্যাত কবি ও ‘মোয়াল্লাকা’র অন্যতম প্রণেতা ইমরুল কায়েস সম্ভবত কিন্দা রাজপরিবারভুক্ত ছিলেন। তাঁর কবিতায় কিনদা পরিবারের কলহ-দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়।