রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ
রাজমালা চতুৰ্থ ভাগ

তৃতীয় অধ্যায় – জেলা ত্রিপুরা (পূর্বের অনুবৃত্তি)

তৃতীয় অধ্যায় – জেলা ত্রিপুরা (পূর্বের অনুবৃত্তি)

অধিবাসী :-

ত্রিপুরার সমতলক্ষেত্র মনুষ্যের বাসোপযোগী হইলে কোন্ জাতীয় মানব সর্বপ্রথম এস্থানে বাসভবন নির্মাণ করিয়াছিলেন, তাহা এক্ষণ নির্ণয় করা সুকঠিন। অনুসন্ধান দ্বারা এরূপ অনুমিত হইয়াছে যে, কোচগণ এ প্রদেশের আদিম নিবাসী। এ জেলার কোন কোন স্থানের প্রাচীন পরিত্যক্ত বাস্তু ভূমি ও পুষ্করিণীকে অদ্যাপি লোকে কোচের বাটি ও কোচের পুকুর” বলিয়া থাকে। আমাদের বিবেচনায় চণ্ডালগণ কোচদিগকে উত্তরবাহিনী করিয়াছিল।[১] বলা বাহুল্য যে, কোচ এবং চণ্ডাল উভয়ই লৌহিত্য বংশের এক শাখা হইতে উদ্ভুত। মুসলমানদিগকে পরিত্যাগ করিয়া “আদম সুমারি” দৃষ্টি করিলে প্রতীতি হইবে যে ত্রিপুরাবাসী হিন্দুদিগের মধ্যে চণ্ডাল জাতির সংখ্যা সবর্বাধিক। দ্রাবিড় বংশীয় কৈবর্ত্ততগণ চণ্ডালদিগকে উত্তরবাহিনী করিয়াছিল। “আদম সুমারি দৃষ্টি করিলে প্রতীতি হইবে যে, চণ্ডালদিগের সংখ্যা চট্টগ্রাম হইতে নওয়াখালী জেলাতে অধিক এবং ত্রিপুরা ॥৪৬০॥ জেলাতে সবর্বাধিক। এজন্যই বলিতেছিলাম যে, জলবিহারী কৈবর্ত্তগণ, চণ্ডালদিগকে দক্ষিণ হইতে উত্তরদিকে প্রেরণ করিয়াছিল। উল্লেখিত ঘটনা সমূহের পর, লৌহিত্য বংশের অন্যান্য শাখা উত্তর পূর্ব সীমান্ত হইতে ত্রিপুরায় উপনীত হয়। কিন্তু ইহারা পর্বত শ্রেণী পরিত্যাগ পূর্বক সমতল ক্ষেত্রে বাস ভব নির্মাণ করিয়াছিল কি না তপক্ষে আমাদের বিশেষ সন্দেহ আছে। পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, ত্রিপুরা রাজবংশ শ্যানজাতি হইতে উদ্ভুত এবং ইহারা কামরূপের পূবর্বপ্রান্ত হইতে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণদিকে অগ্রসর হইয়াছিলেন। আরাকানী মগেরা চট্টগ্রামের নিকট তাঁহাদের গতিরোধ না করিলে তাঁহারা যে, দক্ষিণদিকে কতদূর অগ্রসর হইতেন তাহা কে বলিতে পারে। ত্রিপুরাজাতির গতি পরিবর্ত্তন করতে মগেরা স্বয়ং উত্তরবাহিনী হইয়াছিল। চট্টগ্রাম মগে পরিপূর্ণ। নোয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলাতেও মগ দেখিতে পাওয়া যায়।

আর্য্যগণ কোন সময় ত্রিপুরায় পদার্পণ করিয়াছিলেন, তাহা নির্ণয় করা সুকঠিন। ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্ট জেলায় যে কয়েক খণ্ড তাম্রশাসন প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে, তাহার এক খণ্ডও শকাব্দের দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ববর্ত্তী নহে;[২] কিন্তু ইহার বহুকাল পূর্বে যে আর্য্যগণ ত্রিপুরায় উপনিবিষ্ট হইয়াছিলেন, তাহার কতকগুলি প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া ॥৪৬১॥ গিয়াছে। বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রবল উন্নতির সময়ে ব্রাহ্মণগণ আর্য্যাবর্ত্ত পরিত্যাগ পূর্বক অনার্য্য ভূমিতে আপনাদের আধিপত্য বিস্তার করিবার জন্য অগ্রসর হইয়াছিল। ত্রিপুরায় বৈদিক ধর্ম প্রচারিত হয় নাই। শৈবধর্ম ত্রিপুরার আদি ধর্ম।[৩] পৌরাণিক ব্রাহ্মণগণ কিরাতদিগকে শৈব বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। প্রাচীন ত্রিপুরেশ্বরগণ যে শৈব ছিলেন, রাজমালায় তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। শৈবধর্মের পর আগমোক্ত ধর্ম ত্রিপুরায় প্রচারিত হইয়াছিল। কামরূপে তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের একটি প্রধান আড্ডা ছিল; আমাদের বোধহয় তথা হইতে একদল ব্রাহ্মণ পঞ্চমকারের বীজ লইয়া ত্রিপুরায় প্রবেশ করিয়াছিলেন। চট্টলাচলের চন্দ্রশেখর এবং ত্রিপুরার ত্রিপুরাসুন্দরী বহুকালের প্রাচীন না হইতে পারেন, কিন্তু ‘দেবতামুড়ার’ পবর্বত গাত্রে খোদিত দেবী ভগবতীর দশভূজা- মহিসাসুর মর্দ্দিনী মূর্ত্তি, যাহা উৎকীর্ণ রহিয়াছে, তাহাকে অবশ্যই প্রাচীন বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। ইলোরা কিম্বা ধউলীর পর্বত গাত্র খোদিত গুহা এবং মূর্ত্তি সমূহের ন্যায় দেবতামুড়ায় পর্বত গাত্র খোদিত দেবমূৰ্ত্তি সমূহ প্রাচীন কিম্বা উৎকৃষ্ট না হইতে পারে; কিন্তু ইহাতে প্রাচীন আর্য্যদিগের সূক্ষ্মশিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সকল ভাস্কর কার্য্যের বয়ঃক্রম দেড় সহস্র বৎসরের ন্যূন বলিয়া আমরা স্বীকার করিতে ॥৪৬২॥ পারি না।[৪] সুতরাং ইহার পূর্বে আর্য্যগণ তান্ত্রিক ধর্মের বীজ লইয়া ত্রিপুরায় প্রবেশ করিয়াছিলেন, এইরূপ অনুমান নিতান্ত অসঙ্গত নহে। তান্ত্রিক ধর্মের পর ভাগবদুক্ত বৈষ্ণব ধর্ম ত্রিপুরায় প্রবেশ করে। চট্টগ্রামের তাম্র শাসনে ইহার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সকল ঘটনায় দীর্ঘকাল পরে চৈতন্যের শিষ্যগণ তাঁহাদের ধর্ম বীজ ত্রিপুরার উবর্বর ক্ষেত্রে বপন করিয়াছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, বৈষ্ণবধর্ম ত্রিপুরায় প্রাধান্য লাভ করিতে পারে নাই। উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুগণ প্রায় সকলেই শাক্ত। গোস্বামী মহাশয়গণ নিম্ন শ্রেণীতে কিঞ্চিৎ আধিপত্য বিস্তার করিয়া থাকিলেও তাহাদের ছবির স্রোত প্রবাহকারী কালী ও দুর্গাপূজা বন্ধ করিতে পারেন নাই। ত্রিপুরার রাজবংশ অল্পকাল যাবৎ বৈষ্ণবধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছেন সত্য, কিন্তু আমরা তাঁহাদিগকে ঘোর শাক্ত শ্রেণীতে স্থান প্রদান না করিয়া বিরত হইতে পারি না।

১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার “ইছলাম” ধর্মের বীজ সংরোপিত হয়। খ্রিস্টাব্দের ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে সুলতান নছরদ্দিন নছরৎ সাহ দ্বারা ত্রিপুরা প্রদেশে সেই ধর্মের পূর্ণ উন্নতি সংসাধিত হইয়াছিল। সেই সময় নিম্ন শ্রেণীর বহুসংখ্যক হিন্দু মাহাম্মদীয় ধর্ম গ্রহণ করে। এই প্রদেশের জমিদার ও তালুকদার শ্রেণীতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হিন্দু সন্ত ানের সংখ্যা নিতান্ত বিরল নহে, ৪৬৩॥

ব্রাহ্মণ :- ত্রিপুরা জেলায় ব্রাহ্মণের সংখ্যা প্রায় ৩১ সহস্র হইবে[৫]। বল্লালের শ্রেণী বিভাগের বহুকাল পূর্বে ব্রাহ্মণগণ ত্রিপুরায় উপনীত হইয়াছিলেন, এজন্য আমরা তাঁহাদিগের মধ্যে রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বৈদিক প্রভৃতি শ্রেণীবিভাগ দেখিতে পাইতেছি না। দুই তিন শতাব্দী মধ্যে যাঁহারা ত্রিপুরায় উপনিবিষ্ট হইয়াছেন, সেই সকল ব্রাহ্মণগণ যদিচ পরিচয় প্রদান কালে রাঢ়ী, বারেন্দ্র কিম্বা বৈদিক প্রভৃতি বাক্য উচ্চারণ করিয়া থাকেন, কিন্তু অন্যান্য ব্রাহ্মণ পরিবারের সহিত বিবাহ সম্বন্ধ করিতে তাঁহারা বিরত নহেন[৬]। ত্রিপুরাবাসী ব্রাহ্মণগণ মধ্যে যাহারা সম্পত্তি ও শাস্ত্র অধ্যয়ন দ্বারা সম্মানিত হইয়াছেন, তাঁহারাই সম্ভ্রান্ত বা কুলীন। সবর্ববিদ্যা ঠাকুরের সন্তানগণ তাঁহাদের পূবর্বপুরুষ- সেই চিরস্মরণীয় মহাপুরুষের নামে সম্মানিত হইয়াছেন। মহীচাল ও শ্যামগ্রামের রায় মহাশয়গণ জমিদারি দ্বারা সম্মানিত। কালীগচ্ছের রায় ও তলাপাত্র মহাশয়গণ বিষয় কর্ম্মদ্বারা সম্মানিত। চাপীতলা (কাশ্যপ), (কালীকচ্ছ) মৌদ্‌গুল্য ও অগ্নিবশ, বুড়িচঙ্গ (ভরদ্বাজ) এবং বিদ্যাকুট (কাশ্যপ) প্রভৃতি স্থানের ভট্টাচার্য্য ॥৪৬৪॥ মহাশয়গণ শাস্ত্রালোচনা দ্বারা সম্মানিত হইয়াছেন। ইহারা সকলেই রাঢ়ী বলিয়া পরিচিত, কিন্তু এইবাক্য সম্পূর্ণ সঙ্গত কিনা তাহা আমরা বলিতে অক্ষম। উল্লিখিত ভট্টাচাৰ্য্য বংশ সমুহে অনেকানেক মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।

খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে কালীকচ্ছের মৌদ্‌গুল্য বংশে দয়ারাম ন্যায়ালঙ্কার, হরিহর তর্কবাগীশ, কৃষ্ণজীবন বিদ্যাভূষণ ও চুন্টার সাবর্ণ বংশে শ্রীকান্ত বিশারদ জন্মগ্রহণ করেন। উক্ত শতাব্দীর শেষভাগে ভাদুঘর গ্রামে শঙ্কর তর্কালঙ্কার ও কালীকচ্ছে (অগ্নিবশ্য) রামধন শিরোমণি এবং বুড়ীশ্বর গ্রামে (কাশ্যপ) শিবকিঙ্কর বিদ্যাভূষণ আবির্ভূত হন। ইহারা সকলেই অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন।

উল্লিখিত শঙ্কর তর্কালঙ্কার জনৈক মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত ছিলেন। ন্যায়, ব্যাকরণ ও কাব্যে শঙ্করের অসাধারণ অধিকার ছিল। তিনি একজন বিখ্যাত গ্রন্থকার। এস্থলে তৎপ্রণীত বৈষ্ণব নির্ণয়’ একখানা চমৎকার কাব্য। আমরা এই কাব্য পাঠ করিয়াছি। জয়দেবের পর অন্য কোন বাঙ্গালির লেখনী এরূপ মধুর পদাবলী গ্রহণ করেন নাই। দুঃখের বিষয় এই যে কবির সম্পূর্ণ শক্তি সম্প্রদায় বিশেষের কুৎসায় পর্যবসিত হইয়াছে। নেড়া ॥৪৬৫॥ নেড়ী সম্প্রদায়ের ঘৃণিত চরিত্র অবলম্বন করিয়া ‘বৈষ্ণব নির্ণয়’ লিখিত হইয়াছে। এই কাব্যের আদ্যোপান্ত শ্লেষ ও অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ। জনৈক বৈষ্ণব ভক্ত এবং শাক্ত বিদ্বেষী জমিদারের আচরণে মর্মপীড়িত হইয়া শঙ্কর এই কাব্য রচনা করেন এবং অবশেষে তর্কযুদ্ধে বৈষ্ণব দিগকে জয় করিয়া সেই জমিদারকে শক্তি মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়াছিলেন।

তিনি কলাপ পরিশিষ্টের গোপীনাথ কৃত টীকার “প্রবোধ-চন্দ্রিকা” নামক ভাষ্য রচনা করিয়া গিয়াছেন।[৭]

পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, খাণ্ডব ঘোষের সহিত তাঁহার পুরোহিত সাবর্ণ গোত্রজ তরণী মিশ্র ত্রিপুরার উপনিবিষ্ট হন। সরাইল ও নুরনগর পরগণার সাবর্ণ ব্রাহ্মণগণ অধিকাংশই তাঁহার সন্তান সন্ততি। সেই সাবর্ণ বংশে চুন্টাগ্রামের ॥৪৬৬॥ শ্রীনন্দন তর্কবাগীশ জন্মগ্রহণ করেন। ইনি একজন অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন নৈয়ায়িক পণ্ডিত ছিলেন। তিনি নবদ্বীপে পাঠ সমাপন পূর্বক তথায়ই অধ্যাপনা করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি অকালে কালকবলিত হইয়াছেন।[৮]

চাপিতলা ভট্টাচার্য্য বংশে নরসিংহ বাচস্পতি এবং তৎপুত্র হরিনারায়ণ তর্কবাগীশ প্রাচীন কালের বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। বিগত শতাব্দীতে উক্ত বংশে স্মার্ত্ত রুক্মিনীকান্ত বিদ্যালঙ্কার, তৎপুত্র কৃষ্ণচন্দ্র তর্কালঙ্কার এবং তৎপুত্র কালীদাস সিদ্ধান্ত পঞ্চানন জন্মগ্রহণ করেন। উক্ত বংশে রঘুদেব তর্কবাগীশ ও বৈদ্যনাথ তর্কভূষণ প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক পণ্ডিত ছিলেন।

বুড়িচঙ্গ নিবাসী গঙ্গাধর পঞ্চানন একজন অসাধারণ নৈয়ায়িক পণ্ডিত ছিলেন। তন্ত্রশাস্ত্রে তাঁহার বিশেষ অধিকার ছিল; তিনি বিগত শতাব্দীর প্রথম ভাগে জীবিত ছিলেন।

বিদ্যকুটের (বশিষ্ট গোত্রজ) কাশীনাথ ভট্টাচাৰ্য শতাধিক বৎসর পূর্বে জীবিত ছিলেন। তিনি চণ্ডীর এক খণ্ড উৎকৃষ্ট টীকা রচনা করিয়া গিয়াছিলেন। তৎকৃত ॥৪৬৭॥ কলাপের টীকাও সর্বত্র সুপরিচিত। ইহা “কাশী নাথী পাত্রা” বলিয়া আখ্যাত হয়।

মাইজখার নিবাসী (পাকড়াসী) বিশ্বনাথ তর্কবাচস্পতি এবং বাউরখার নিবাসী বিশ্বনাথ ন্যায়ালঙ্কার বর্তমান শতাব্দীর প্রারম্ভে মানবলীলা সম্বরণ করেন। ইহারা উভয়েই প্রথম শ্রেণীর নৈয়ায়িক পণ্ডিত ছিলেন। তদনন্তর আমরা লেসীয়ারা নিবাসী পণ্ডিত প্রবর তারানাথ সিদ্ধান্তবাগীশের নাম উল্লেখ করিতে পারি। অল্পকাল হইল তিনি মানবলীলা সম্বরণ করিয়াছেন।

ত্রিপুরা নিবাসী জীবিত পণ্ডিতদিগকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। প্রাচীন সম্প্রদায়ের মধ্যে নাটাই নিবাসী পীতাম্বর তর্কভূষণ অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন। নয়াদৈল নিবাসী স্মার্ত্ত পণ্ডিত রাম দুলাল বিদ্যাভূষণ সর্বত্র সুপরিচিত। প্রাচীন স্মৃতি শাস্ত্র হইতে সার সংগ্রহ করিয়া তিনি ব্যবহার তত্ত্ব প্রকাশিকা (দেওয়ানী ও ফৌজদারী কার্যবিধি) এবং রাজধর্ম্ম সংগ্রহ নামে দুই খানা সংস্কৃত গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। তন্মধ্যে ব্যবহারতত্ত্ব প্রকাশিকা মুদ্রিত হইয়াছে, দ্বিতীয় পুস্তক অমুদ্রিত অবস্থায় আছে।[৯] ।।৪৬৮।।

বুড়ীশ্বর নিবাসী কৃষ্ণকিশোর বিদ্যাসাগর[১০] এবং ইছাপুর নিবাসী কৃষ্ণসুন্দর দর্শন শিরোরত্ন সুপরিচিত দার্শনিক পণ্ডিত। অন্যান্য শাস্ত্রেও ইহাদের অধিকার আছে। আমরা প্রধান পণ্ডিত সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখ করিব না। ভবিষ্যত লেখক তাহা সম্পাদন করিবেন। ইহাদিগের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি সংস্কৃত কলেজের উপাধি পরীক্ষায় গৌরবের সহিত উত্তীর্ণ হইয়া নানা প্রকার পুরস্কার প্রাপ্ত হইয়াছেন।

ত্রিপুরা নিবাসী ব্রাহ্মণগণ ইংরাজী শিক্ষা বিষয়ে কায়স্থ এবং বৈদ্যের পশ্চাৎগামী হইয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় তাঁহার কায়স্থ ও বৈদ্যের সমশ্রেণীতে দণ্ডায়মান হইতে পারিতেছেন না। ॥৪৬৯।।

উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণীর সবর্বপ্রকার হিন্দুর পুরোহিত একমূল হইতে উদ্ভুত; কিন্তু যুগী জাতির পুরোহিত তাহাদের স্বজাতি হইতে সমুৎপন্ন।

কায়স্থ ও বৈদ্য : -১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের আদম সুমারিতে দৃষ্ট হইবে যে, ত্রিপুরা জেলায় ৭২৫৫৪ কায়স্থ এবং ৪৭২৩ বৈদ্য বাস করিতেছেন। আমরা এই গণনাকে বিশুদ্ধ বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না। আমাদের বিবেচনায় ত্রিপুরা জেলায় প্রকৃত কায়স্থ ও বৈদ্যের সংখ্যা ইহার অর্দ্ধেকের অধিক হইবে না। পূর্ববঙ্গে নবশাখ বংশীয় অনেকেই কায়স্থ আখ্যায় পরিচিত হইবার জন্য লালায়িত হইয়াছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেজেষ্ট্রেট ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের, সেই সেই জেলায় আদম সুমারির বিজ্ঞাপনীতে ইহা বিশেষভাবে বর্ণনা করিয়াছেন।[১১] বিশেষত পূর্ববঙ্গের আর একটি শ্রেণী, (যাহারা ভদ্রলোকদিগের “সেবক” বা “ভাণ্ডার” বলিয়া পরিচিত এবং ইহারা শূদ্র আখ্যায় আখ্যাত হইয়া থাকে।) তাহারা মুক্তকণ্ঠে আপনাদিগকে কায়স্থ বলিয়া পরিচয় প্রদান করে। আদম সুমারির কর্তাগণ ইহাদিগকেও কায়স্থ শ্রেণীতে স্থান প্রদান করিয়াছেন। ত্রিপুরা জেলায় ইহাদের সংখ্যা প্রকৃত কায়স্থ অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক হইবে। চৌদ্দগ্রামের পাল্কী বাহক বেহারাগণও কায়স্থ বলিয়া পরিচয় প্রদান করে। ॥৪৭০।

আমরা ইহা বিশেষভাবে প্রদর্শন করিয়াছি যে, বঙ্গীয় কায়স্থ এবং বৈদ্য এক বর্ণ বৃক্ষের দুইটিশাখা মাত্র।[১২] প্রকৃত বঙ্গদেশে ইহারা দুই শাখায় বিভক্ত হওয়ার পূর্বে, কতকগুলি কায়স্থ এই জেলায় উপনিবিষ্ট হইয়াছিলেন। এজন্যই ত্রিপুরার অধিকাংশ স্থানে কায়স্থ ও বৈদ্যদিগের মধ্যে কন্যা আদান প্রদান হইতেছে। চাঁদপুর উপবিভাগের কায়স্থ ও বৈদ্যগণ অল্পকাল হইল প্রকৃত বঙ্গদেশ হইতে আগমন করত পরস্পরের মধ্যে কিয়ৎ পরিমাণ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে পারেন নাই। তাঁহারা তাঁহাদের পূর্বাগত কায়স্থ ও বৈদ্যদিগের সহিত মিশিয়া গিয়াছেন। চাঁদপুরের কায়স্থ কিম্বা বৈদ্যগণ এজন্য গৌরবের ভান করিতে পারেন, কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপবিভাগ নিবাসী কায়স্থ ও বৈদ্যগণ বিদ্যাশিক্ষার দ্বারা এইরূপ উন্নত হইয়াছেন যে, তাঁহাদিগকে পরিত্যাগ করিলে ত্রিপুরা জেলা অন্ধকার হইয়া পড়ে। সেই প্রাচীন কাল হইতে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপবিভাগের কায়স্থ ও বৈদ্যগণ বিদ্যালোচনায় আত্ম প্রাধান্য রক্ষা করিয়া আসিতেছেন। সদর ও চাঁদপুর চিরকাল তাহাদের পশ্চাদগামী। সুন্দরবনের প্রথম কমিসনর সেন বাহাদুর (উমাকান্ত সেন) সর্বত্র সুপরিচিত। কেবল তিনিই সদর ॥৪৭১॥ উপবিভাগের অন্তর্গত চৌদ্দগ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তদ্ব্যতিত সুশিক্ষিত ও ক্ষমতাশালী অন্যান্য ব্যক্তিগণ সকলেই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপবিভাগে জন্মগ্রহণ করিয়ছেন।[১৩] ত্রিপুরা নিবাসী কলিকাতা হাইকোর্টের এবং জেলা কোর্টের প্রধান উকিলগণ প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপবিভাগ নিবাসী। যে সকল ত্রিপুরাবাসী প্রতিযোগী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া প্রভিন্সিয়াল সিভিল সাবির্বসে প্রবিষ্ট হইয়াছেন, তাঁহারা সকলেই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপবিভাগ নিবাসী কায়স্থ ও বৈদ্য বংশজাত। সমগ্র সরাইল ও নুরনগর পরগণা এবং বলদাখাল পরগণার কিয়দংশ লইয়া ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপবিভাগ গঠিত হইয়াছে। তন্মধ্যে সরাইলবাসী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যগণ সংস্কৃত ও ইংরেজী শিক্ষা দ্বারা চিরকাল ত্রিপুরায় শীর্ষস্থানে বিরাজ করিতেছেন। বল্লাল ও দেবীবর তাঁহাদের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়াছেন।

ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও সদর উপবিভাগ নিবাসী কতকগুলি কায়স্থ আপনাকে কায়স্থ বলিয়া পরিচয় প্রদান করেন এবং তদ্রূপ কতকগুলি বৈদ্য বংশজাত ব্যক্তি ও বৈদ্য বলিয়া আত্ম পরিচয় প্রদান করিয়া থাকেন। আর কতকগুলি ভদ্রলোক সুবিধা ॥৪৭২॥ ও প্রয়োজন অনুসারে কখন বা কায়স্থ এবং কখনও বৈদ্য বলিয়া ঘোষণা করেন।[১৪] আমরা নামোল্লেখ করিয়া তাঁহাদিগকে মর্মপীড়া প্রদান করিতে ইচ্ছা করি না।

ত্রিপুরা ও নওয়াখালী জেলার ভদ্রলোকের মূল অনুসন্ধান করিতে যাইয়া আমরা “কৃষ্ণপক্ষ” আখ্যা বিশিষ্ট একটি ॥৪৭৩॥ প্রাচীন প্রবাদ বাক্য প্রাপ্ত হইয়াছি। প্রাচীন কৰ্ত্তাগণ শূদ্র জাতীয় বালিকাদিগকে দাসীরূপে গ্রহণ করত তাহাদের সহিত স্বামী স্ত্রীবৎ ব্যবহার করিতেন। সেই সকল রমণীর গর্ভজাত সন্তানদিগকে “কৃষ্ণপক্ষ” এবং পাণিগৃহীতা পত্নীর গর্ভজাত সন্তানদিগকে “শুক্লপক্ষ” বলা হইত। “কৃষ্ণপক্ষের” সন্তানগণও তাঁহাদের পিতার উপাধি প্রাপ্ত হইতেন। কালক্রমে অবস্থার উন্নতির দ্বারা কোন কোন বংশের কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষকে ম্লান করিয়া ফেলিয়াছে। ভুলুয়ার একটি প্রধান বংশ শুক্ল ও কৃষ্ণ দুই শাখায় বিভক্ত। সরাইল ও নুরনগর পরগণায় আমরা কতকগুলি নামজাদা কৃষ্ণপক্ষের দর্শন প্রাপ্ত হইয়াছি। নামোল্লেখ দ্বারা তাহাদিগকে মর্ম পীড়িত করা ইতিহাস লেখকের অভিপ্রেত নহে।

ত্রিপুরা নিবাসী কায়স্থ ও বৈদ্য জাতীয় মানবগণ সকলেরই (ন্যূন কিম্বা অধিক পরিমাণ) কিঞ্চিৎ ভূমি সম্পত্তি আছে। পূর্বে ইহাদ্বারা তাঁহাদের কথঞ্চিৎ জীবিকা নির্বাহ হইত, কিন্তু এখন আর তাহা হইতেছে না এজন্য তাঁহারা বিদ্যাভ্যাস দ্বারা বিষয় কর্ম করিবার জন্য লালায়িত হইয়াছেন।

ক্ষত্রিয় ও ভাট :- ত্রিপুরা জেলায় ক্ষত্রিয়ের সংখ্যা নিতান্ত অল্প। বোধহয় দুই সহস্রের অধিক হইবে না। অত্র জেলাবাসী ভাটগণ “বৰ্মণ” আখ্যা দ্বারা আত্ম পরিচয় ॥৪৭৪॥ প্রধান করত ক্ষত্রিয় শ্রেণীতে অনুপ্রবিষ্ট হইয়াছেন। সুতরাং আদমসুমারি কর্তাগণের পক্ষে ক্ষত্রিয় ও ভাটদিগকে পৃথক করা অসাধ্য কর্ম হইয়াছে। জমিদারি ও তালুকদারি হইতে সামান্য পেয়াদার কার্য্য ক্ষত্রিয়দিগের অধিকৃত। ছত্র ও পাটি বিক্রেতা কতকগুলি লোক আপনাদিগকে ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতেছে। সাধারণে ইহারা ভাট বলিয়া আখ্যাত। কিন্তু ইহারা স্বয়ং নামের অন্তে “বর্মণ” শব্দ সংযুক্ত করত ক্ষত্রিয় বলিয়া আত্ম পরিচয় প্রদান করিতেছেন। চট্টগ্রাম নিবাসী ছত্র ও পাটি বিক্রেতাগণ তথাকার আদমসুমারির কর্তাগণ দ্বারা ভাট আখ্যায় আখ্যাত হইয়াছেন। আর ত্রিপুরার অন্তর্গত “ভাটপাড়া” গ্রাম নিবাসী ব্যক্তিগণ ও ক্ষত্রিয় সমাজে অনুপ্রবিষ্ট হইয়াছেন। ইহারা ক্ষত্রিয় কি ভাট কুলোদ্ভব তাহা পাঠকগণ বিচার করিবেন।

বৈশ্য :- ত্রিপুরা জেলায় বৈশ্য আছে বলিয়া আমরা অবগত নহি, কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের যে সকল জাতি বৈশ্য বলিয়া পরিচিত হইবার জন্য লালায়িত, ত্রিপুরায় সেই সকল জাতি নিতান্ত বিরল নহে। অবশিষ্ট হিন্দুদিগকে আমরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করিতে পারি। ১— জলাচরণীয় হিন্দু। ২- জল-অনাচরণীয় হিন্দু। জলাচরণীয় হিন্দুদিগকে আমরা শূদ্র আখ্যায় পরিচিত করিব। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুগণ ॥৪৭৫॥ যাহাদের স্পৃষ্ট জলপান করেন তাহারা পবিত্র শূদ্র। যাহাদের স্পৃষ্ট জল উচ্চ শ্রেণীর অপেয়, তাহারা অনাচরণীয় শ্রেণীতে নিবিষ্ট হইয়াছে।

শূদ্র :- ইহাদিগকে নিম্নলিখিত প্রশাখায় বিভক্ত করা যাইতে পারে। ১— শূদ্র, ২– নাপিত, ৩—– গোপ, ৪– কর্মকার, ৫– কুম্ভকার, ৬— তৈলপাল, ৭— গন্ধবণিক, ৮- তন্তুবায়, ৯— লতাবৈদ্য বা বারুই, ১০— মোদক (হাউলাই কুড়ি প্রভৃতি।) ১১– শঙ্খকার, ১২– কাংস্যকার, ১৩– স্বর্ণকার, ১৪– মালাকার।

শূদ্র :- উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদিগের ক্রীতদাস দাসী১৫ হইতে এত শ্রেণীর লোক উদ্ভুত হইয়াছে। ইহাদের সংখ্যা ত্রিপুরা জেলায় বোধ হয় ২৫।৩০ হাজারের ন্যূন হইবে না। আমরা ইহাদিগকেই বিশেষভাবে শূদ্র বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া ॥৪৭৬। থাকি[১৬]। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের আদমসুমারিতে ইহাদের সংখ্যা ২৫১৩ মাত্র দৃষ্ট হইতেছে। কিন্তু ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের আদমসুমারিতে ৮১৬২ জন শূদ্র গণিত হইয়াছে। এই বিংশতি বৎসর মধ্যে ইহাদের বংশ কখনই এরূপভাবে বর্দ্ধিত হয় নাই। আমাদের বিবেচনায় আরও বহুসংখ্যক শূদ্র কায়স্থ ও বৈদ্যদিগের বসনাভ্যন্তরে লুকায়িত রহিয়াছে। উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদিগের দাস্যতা ইহাদের জীবিকা ছিল। বিবাহকালে বর ও পাত্রীকে পাটে উঠান এবং কুটুম্বালয়ে সন্দেশ (তত্ত্ব) লইয়া যাওয়া ইহাদের দুইটি প্রধান কাৰ্য্য ছিল। কিন্তু অধুনা ইহা নিতান্ত অপমানজনক বোধে শূদ্রগণ এই কার্য্য পরিত্যাগ করিতেছে এবং এই জন্য তাহাদের চিরপ্রতিপালক কায়স্থ ও বৈদ্যের সহিত তাহাদের বিষম কলহ চলিতেছে। শূদ্রগণ তাহাদের প্রভুগণ হইতে নিষ্কর কিম্বা অল্প করে জায়গীর স্বরূপ কিঞ্চিৎ ভূমি প্রাপ্ত হইত। এক্ষণ তাহারা তাহাদের কর্ত্তব্য কর্ম হইতে বিরত হইতেছে বলিয়া তাহাদের প্রভুগণও সেই সকল জায়গীর ভূমি বাজেয়াপ্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। একপ্রকার দুই একটি ঘটনা আদালত পৰ্য্যন্ত গড়াইয়াছে। শূদ্রগণ নূতন প্রজাস্বত্ব বিষয়ক আইনের আশ্রয় গ্রহণ করিতে চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু আদালত তাহাদের এই অন্যায় আবদার শ্রুতিযোগ্য বলিয়া বিবেচনা ॥৪৭৭॥ করেন নাই। সুখের বিষয় এই যে, শূদ্রগণ ইংরেজী শিক্ষা দ্বারা, তাহাদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য যত্নবান হইয়াছে। আমরা ভরসা করি তাহারা এই পন্থাবলম্বন পূর্বক উন্নতির সোপানে আরোহণ করিবে। কিন্তু জাতীয় আখ্যাটি পরিত্যাগ করা তাহাদের কর্তব্য নহে।

পশ্চিমবঙ্গে নানা প্রকার গোপ দৃষ্ট হয়। উত্তপ্ত লৌহশলাকা দ্বারা যাহারা রোগাক্রান্ত গোকুলের চিকিৎসা করিয়া থাকে, তাহারা গোপকুলে ঘৃণার্হ। তাহাদের জন্যই পশ্চিমবঙ্গে গোপকুলের শ্রেণীবিভাগ হইয়াছে। ত্রিপুরা কিম্বা তৎপার্শ্ববর্তী অন্য কোন জেলাতে উল্লেখিত চিকিৎসক সম্প্রদায়ের গোপ নাই। ত্রিপুরাবাসী গোপ বা গোয়ালাদিগকে আমরা সদ্‌গোপ শ্রেণীতে স্থান প্রদান করিতে পারি। পশ্চিম বঙ্গের সদ্‌গোপ জাতি গব্যরস বিক্রেতা নহে সত্য, কিন্তু ত্রিপুরা জেলাবাসী গোপগণ তাহাদের ন্যায় উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু গণের সামান্য ভৃত্যের কার্য্য নির্বাহ করে না। ইহা তাহাদের পক্ষে নিতান্ত ঘৃণা কাৰ্য্য।

অন্যান্য শূদ্রগণ সম্বন্ধে কোন বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় ত্রিপুরাবাসী গন্ধবণিকগণ বৈশ্য আখ্যায় পরিচিত হইবার জন্য লালায়িত হইয়াছে। তন্তুবায়গণ আপনাদের জাতীয় ব্যবসা প্রায় পরিত্যাগ করিয়াছে, কিন্তু তাহারা কলিকাতা ও ঢাকা নিবাসী বসাক দিগের ন্যায় বিদ্যাশিক্ষা দ্বারা উন্নতি লাভ করিতে পারে নাই। লতাবৈদ্য ও তেলীপাল (কুণ্ড) দিগের মধ্যে সামাজিক অত্যাচার নিতান্ত যন্ত্রণাদায়ক ও ঘৃণার্হ তেলীপালগণ ব্যবসা বাণিজ্য দ্বারা আপনাদের অবস্থা কিঞ্চিৎ উন্নত করিয়াছে। লতাবৈদ্যগণ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। এক “জাতিবারুই” দ্বিতীয় “শিক্ষাবারুই”। জাতিবারুইগণ বলেন, তাহারা এবং বঙ্গীয় বৈদ্যগণ এক মূল হইতে উদ্ভুত, এজন্য তাহারা পানের ব্যবসা করিয়া লতাবৈদ্য আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে। বৈদ্যদিগের কুল-পদবি তাহাদের মধ্যে আছে। শিক্ষাবারুই শূদ্রজাতীয়। মোটের উপর আমরা এই মাত্র বলিতে পারি যে ত্রিপুরাবাসী শূদ্রগণের অবস্থা অনুন্নত

অনাচরণীয় হিন্দু :- ইহাদিগকে নিম্নলিখিত উপশাখায় বিভক্ত করা যাইতে পারে ১ চণ্ডাল, ২ কৈবর্ত্ত, ৩ পাটনি, ৪ সাহা, ৫ যোগী, ৬ যুগী ৭ করাসী, ৮ সূত্রধর, ৯ রজক, ১০ নট্ট, ১১ মালী, ১২ চামার ইত্যাদি। এই সকল জাতির মধ্যে অনেক প্রকার শাখা প্রশাখা আছে। তন্মধ্যে যে গুলি ব্যবসা দ্বারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হইয়াছে তাহাই প্রদর্শিত হইবে।

১। চণ্ডাল :- আমাদের ধর্মশাস্ত্রে লিখিত আছে শূদ্র পুরুষ ও ব্রাহ্মণ রমণীর সংযোগে এই জাতির উৎপত্তি। ॥৪৭৯॥

ওই বাক্য যে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অপ্রামাণ্য তাহা আমরা বিশেষ ভাবে প্রদর্শন করিয়াছি।[১৭] শ্রীযুক্ত রমেশ চন্দ্র দত্ত (সি, এস) মহাশয়ের বর্ণনা দ্বারা ও আমাদের মত সমর্থিত হইতেছে। আমাদিগের বিবেচনায় চণ্ডালগণ ভারতের আদিম নিবাসী। নবজাতি তত্ত্বাবিৎ-পণ্ডিতগণ তাহাদিগকে লৌহিত্য বংশের একটি শাখা বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ত্রিপুরাবাসী চণ্ডালদিগকে দুইটি প্রশাখায় বিভক্ত করা যাইতেছে। (১) নমশূদ্র। কৃষিকার্য্য ও নৌকাবাহন দ্বারা ইহারা জীবিকা নির্বাহ করে। (২)— চণ্ডাল (বেহারা বা পাখীয়া) ইহারা প্রধানত পাল্কী বাহক, প্রয়োজন অনুসারে ইহারা কৃষি এবং অন্যান্য কার্য্য দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। হিন্দু জাতির মধ্যে চণ্ডালই ত্রিপুরায় প্রধান অধিবাসী।

২। কৈবর্ত্ত (ধীবর) :- স্মৃতি ও পুরাণে ইহাদের উৎপত্তি বৃত্তান্ত দুই প্রকার বর্ণিত আছে। নিষাদ পুরুষ ও বৈদেয় রমণী সংযোগে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাহার কৈবর্ত্ত দাস। মতান্তরে গোপ পুরুষ ও শূদ্রারমণীর গর্ভে ধীবর জাতির উৎপত্তি; কিন্তু নরজাতি- তত্ত্ববিদ- পণ্ডিতদিগের মতে কৈবর্ত্তগণ ভারতের আদিম নিবাসী, দ্রাবিড় বংশের ॥৪৮০॥ একটি প্রধান শাখা। ইহারা অনেকগুলি প্রশাখায় বিভক্ত। (১) হালুয়া দাস :- পশ্চিমবঙ্গে ইহারাই জলাচরণীয় কৈবর্ত। ত্রিপুরায় হালুয়া দাসদিগের অবস্থা পূর্বে অপেক্ষাকৃত উন্নত ছিল। নুরনগর পরগনার হালুয়াদাসগণ তালুকদার শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন। তন্মধ্যে মুনি- অন্ধের চৌধুরীগণ বিশেষ ধনাঢ্য ও পরাক্রমশালী ছিলেন। অধুনা হালুয়াদাসগণ ক্রমে অবনতি প্রাপ্ত হইতেছে। (২) জালজীবিদাস :- ইহারা পূবর্ববঙ্গে প্রকৃত কৈবর্ত্ত বলিয়া পরিচিত। জালদ্বারা মৎস্য ধৃত করা ইহাদিগের প্রধান কার্য্য নৌকাবাহন এবং শুকনা মৎস্য প্রস্তুত করিয়া, জীবিত ও শুক্‌না মৎস্য বিক্রয় করা ইহাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায়। হালুয়া এবং জালজীবিদাস উভয়ই পরাশর দাস বলিয়া আত্ম পরিচয় প্রদান করে। ইহা সুখের বিষয় যে, বিদ্যালোচনার দ্বারা ইহারা উন্নতির পন্থা অনুসন্ধান করিতেছে। (৩) ঝাল ঝল্প (৪) মাল (মল্ল), ১৮ (৫) তিয়র। ৪৮১ (তবর) ইহারা সকলেই মৎস্যজীবী। অধুনা ইহারা সকলেই কৃষিকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে।

৩। পাটনিঃ- আমাদের বিবেচনায় পাটনিগণ কৈবর্ত্ত বংশের একটি স্বতন্ত্র শাখা। ইহারা প্রধানত নৌকাজীবী। ত্রিপুরায় পাটনিগণ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। (১) মাঝি, ইহারা খেয়া নৌকা বাহিয়া থাকে বলিয়া মাঝি উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছে। (২) বাদ্যকারক, ইহারা ঢোল, কাড়া প্রভৃতি বাদ্য দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। (৩) শিকারি, ইহারা টেঁটা, বর্ষা প্রভৃতি বাদ্য দ্বারা নানা প্রকার মৎস্য কুম্ভীরাদি সুকৌশলে শিকার করিয়া থাকে। আমরা দুঃখের সহিত উল্লেখ করিতেছি যে, চুরি ডাকাতি পাটনি মাঝিদিগের একটি প্রধান ব্যবসায় ছিল। ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের সুশাসনে ক্রমে ইহারা এই ব্যবসায়টি পরিত্যাগ করিতেছে।

৪। সাহাঃ- সাহাগণ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত, (১) সাহাবা সৌ। (২) শুঁড়ি। স্মৃতি শাস্ত্রানুসারে গোপ পুরুষের ঔরসে ও শূদ্রা রমণীর গর্ভে শৌন্তিক জাতির উৎপত্তি। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণের মতে বৈশ্য পুরুষ এবং তিবর রমণীর সংযোগে শুণ্ডিজাতির উৎপত্তি। শুঁড়ি সেই শৌণ্ডিক বা শুণ্ডি শব্দের অপভ্রংশ। আকৃতির দ্বারা ইহাদিগকে অনাৰ্য্য বংশ সম্ভুত বলিয়া বোধ হয় না। অধুনা যাহারা মদ্য প্রস্তুত করে, তাহারাই শুঁড়ি। যাহারা সেই ঘৃণিত ব্যবসায়। ৪৮২ পরিত্যাগ করিয়া পবিত্র স্বভাব হইয়াছে, তাহারাই সাহা বা সৌ। ত্রিপুরা জেলাবাসী সহাগণ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত যথাঃ- আঠারচূড়া (বারেন্দ্র), ছকুলিয়া এবং পাঁচফুলিয়া (রাঢ়ী)। সাহাগণ নানা প্রকার উপাধি গ্রহণ করেন। ত্রিপুরা জেলার মধ্যে সাহা জাতি ধনে সর্বশ্রেষ্ট। লৌহাগাড়ায় দ্বিতীয় “জগৎশেঠ” পরিবারের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। অধুনা ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার অধীন হরিপুরের সাহাগণ ত্রিপুরা জেলায় তাঁহাদের স্থান অধিকার করিয়াছেন। অন্যান্য বিবিধ স্থানে ধনবান সাহা জাতি বৰ্ত্তমান রহিয়াছেন। “বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মীঃ” এই প্রাচীন বাক্যের ইহারাই সার্থকতা সম্পাদন করিয়াছেন।

অর্থদ্বারা দরিদ্র কায়স্থ, বৈদ্য কিম্বা শূদ্র ক্রয় করিয়া সেই কন্যাকে বিবাহ করিবার রোগ শ্রীহট্ট হইতে ত্রিপুরার সাহাদিগের মধ্যে সংক্রামিত হইতেছে। কিন্তু ত্রিপুরাবাসী কায়স্থ, বৈদ্য কিম্বা কণ্যা শূদ্রগণ উল্লিখিত কন্যা বিক্রয় কাৰ্য্যে সম্মত নহেন, বলিয়া এই আশ্চার্য্য রোগক্রান্ত সাহাগণ শ্রীহট্ট হইতে কন্যা ক্রয় করিয়া আনয়ন করেন। উচ্চশ্রেণীর হিন্দু। ৪৮৩॥ হইতে কণ্য ক্রয় করিয়া কিম্বা উচ্চশ্রেণীর হিন্দু বালককে নানা প্রকার প্রলোভনে বাধ্য করিয়া তাহার সহিত নিজ কন্যার বিবাহ দেওয়া শ্রীহট্টের সাহাদিগের একটি আশ্চর্য্য রোগ।১৯ ইহা দ্বারা তাহাদের কিছু মাত্র লাভ হইতেছে না, কারণ সেই কন্যা ও বালক উভয়ই জাতি চ্যূত হইয়া সাহা জাতি প্রাপ্ত হয়।

৪। যোগী :- ইহারা খেলান্ত-যোগী (কৃত্রিম-যোগী) বা সন্ন্যাসী বলিয়া আখ্যাত। আদমসুমারীর কর্ত্তাগণ যে ইহাদিগকে কোন শ্রেনীতে সন্নিবেশিত করিয়াছেন, তাহা আমরা স্থির করিতে পারিলাম না। সন্ন্যাসী বেশে ভিক্ষা করিয়া জীবিকা নির্বাহ করা ইহাদের জাতীয় কার্য্য। দূর দেশে ইহারা প্রকৃত সাধু বলিয়া আত্নপরিচয় প্রদান করত অর্থোপার্জ্জন করিয়া থাকে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সাবডিবিসনের কাশীরামপুর ও মুনি অন্ধ প্রভৃতি গ্রামে ইহাদের বাস আছে। ইহাদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প।॥৪৮৪॥

৫। যুগী :-পুরাণে ইহারা যুঙ্গী বলিয়া পরিচিত। ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে লিখিত আছে যে বেশধারীর (খেলান্ত যোগীর) ঔরসে গঙ্গাপুত্র(মুদাফরাস) রমণীয় গর্ভে এই জাতীয় উৎপত্তি। এই সকল পৌরাণিক বর্ণনা আমরা সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে প্ৰস্তুত নহি। যুগী জাতির উৎপত্তি যে রূপই হউক না কেন, চণ্ডাল এবং কৈবর্ত্যদিগকে পরিত্যাগ করিলে ত্রিপুরা জেলায় ইহাদের সংখ্যা অন্যান্য জাতি হইতে অধিক। ইহাদের আচার ব্যবহার সকলই হিন্দু ধর্মানুমোদিত কিন্তু ইহারা মৃত দেহ দাহ না করিয়া নাম মাত্র অগ্নিসংস্কার করত কবরস্থ করিয়া ফেলে। হিন্দুর ব্রাহ্মণগণ ইহাদের পৌরহিত্য স্বীকার না করায় ইহারা আপনাদের স্বজাতি হইতে কতকগুলি লোককে পুরোহিত করিয়া লইয়াছে। সেই সকল পুরোহিতগণ “মহত্ত”বলিয়া আতু পরিচয় পরদান করে। অধুনা কোন কোন মহত্ত “গোস্বামী” আখ্যা ধারণ করিবার জন্য লালায়িত হইয়াছে।

প্রাচীন কাল হইতে যুগীগণ বস্ত্ৰ বয়ন কাৰ্য্যে নিযুক্ত ছিল; তন্তুবায় ও যুগীগণ আমাদের বহির্বাণিজ্যের প্রধান সহায় ছিল। কিন্তু বিলাতী শিল্পীগণ ইহাদের সর্বর্বনাশ করিতে সমুদ্যত হইয়াছে। এজন্য যুগীগণ অন্যান্য প্রকার ব্যবসায় বাণিজ্য দ্বারা তাহাদের অবস্থার উন্নতি সাধনে যত্নবান হইয়াছে। ত্রিপুরাবাসী কোন কোন যুগী। ৪৮৫ জমিদারি ও তালুক ক্রয় করিয়াছে; কিন্তু সাধারণ যুগীগণ বস্ত্রবয়ন বিলাতী বস্ত্রের বাণিজ্য এবং কৃষিকার্য্য দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিতেছে।

৭। কপালী :- ইহারা সাধারণত কাওয়ালী বলিয়া পরিচিত। পাট দ্বারা ছালা, চট প্রভৃতি নির্মাণ করা ইহাদের জাতীয় ব্যবসায়। কিন্তু অধুনা ইহারা কৃষিকার্য্য দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিতে বাধ্য হইয়াছে। বিলাতী শিল্পগণ ইহাদের ও সর্বনাশ করিয়াছে।

৮। সূত্রধর :- ত্রিপুরা বাসী সূত্রধরদিগের মধ্যে অল্প সংখ্যক সুনিপুণ কারু আছে। ইহারা গজদন্ত দ্বার গোলদান,চেয়ার, দেবতার আসন প্রভৃতি নানা প্রকার বহুমূল্য বস্তু প্রস্তুত করিতে পারে।

৯। রজক দিগের কথা উল্লেখ করা নিস্প্রয়োজন।

১০। নট :- ইহারা প্রাচীন আর্য্যদিগের গায়ক, বাদক ও নাট্যকার। ত্রিপুরাবাসী নটদিগের মধ্যে অনেক সুগায়ক ও কলাবৎ জন্ম গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু ইহা দুঃখের বিষয় যে, এই জাতিটি ক্রমেই বিলুপ্ত হইতেছে। পুরুষ পরীক্ষা গ্রন্থে লিখিত আছে যে, মহারাজ লক্ষণসেনের মন্ত্রী উমাপতি ধর রাজসভার প্রধান নটকে “জায়াজীবী” বলিয়া ভৎর্সনা করিয়াছিলেন। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, ইহারা নিতান্ত ঘৃণিত ব্যবসায় দ্বারা অর্থোপার্জ্জন করিত।॥৪৮৬।।

১১। মালী :-মালীগণ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত যথা, ভূইমালী অর্থাৎ মাটির কার্য্য করে, দ্বিতীয়ত হাড়ি অর্থাৎ মেথর।

১২। পোদ :- অনার্য্য পৌণ্ড্র। ইহারা উত্তর বঙ্গের আদিম অধিবাসী। ইহাদের নাম অনুসারে প্রাচীন কালে বরেন্দ্র ভূমি পৌণ্ড্র আখ্যা প্রাপ্ত হয়।

১৩। চামার। ইহারা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত (১) চামার, (২) মুচি। উভয়ই চর্ম ব্যবসায়ী। মুচিগণ শ্রেষ্ঠ চামার নিকৃষ্ট।

অনাচারণীয় জাতি সমুহের পুরোহিতদিগের মধ্যে সাহাদিগের পুরোহিতগণ সবর্বাপেক্ষা উন্নত অবস্থাপন্ন। ইহাদের মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি বিশেষরূপে শাস্ত্রলোচনা দ্বারা উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছেন তন্মধ্যে কালীকণ্ঠনিবাসী পণ্ডিত মাধবচন্দ্র তর্কচূড়ামণি সবর্বপ্রধান। তিনি ভগবৎগীতার একটি সুন্দর গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন। সূত্রধরদিগের পুরোহিত লগ্নাচার্য্যের নাম তদনন্তর উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইহারা কলাপ অধ্যায়ন পূর্বক জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত মৃত রামজীবন (রামজী) বিদ্যাসাগর ত্রিপুরেশ্বরের মহারাজ ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের সভাপণ্ডিত ছিলেন। অন্যান্য বর্ণের॥৪৮৭॥ ব্রাহ্মণগণ অধিকাংশই মুর্খ, ইহারা যজমানদিগের রক্ত শোষণ করিয়া আত্ন উদর পরিপূর্ণ করেন।

ত্রিপুরায় জাত বৈষ্ণবের সংখ্যা ৩০৪৬, তন্মধ্যে পুরুষ ১৩৩১ এবং স্ত্রী ১৭২৫। এই স্ত্রী বৈষ্ণবের অর্দ্ধাংশই বোধ হয় প্রকৃত বেশ্যা হইবে। প্রেমাবতার চৈতন্যের ধর্মের ঈদৃশ বিকৃতি নিতান্তই কষ্টকর।

ত্রিপুরা জেলায় ত্রিপুরা জাতির সংখ্যা প্রায় সার্দ্ধ তিন সহস্র হইবে। তাহার তৃতীয়াংশ বোধ হয় খাটি ত্রিপুরা। ইহারা প্রধানত কুকির অত্যাচারে পর্বত পরিত্যাগ পূর্বক সমতল ক্ষেত্রে স্থিত বনজঙ্গল পরিপূর্ণ স্থানে ও লালময়ী পর্বতে বাস ভবন নির্মাণ করিয়াছে। অবশিষ্ট ত্রিপুরাগণ জাতিচ্যূত হিন্দু। ইহারা প্রধানত ত্রিপুরা দাস ও রাজবংশী বলিয়া পরিচয় প্রদান করে। নুর নগরের জনৈক (কায়স্থ) দাস বংশীয় তালুকদার ঘটনাক্রমে জাতিচ্যুত হইয়া উক্ত সমাজে প্রবিষ্ট হইয়াছেন। তদ্ব্যতীত অধিকাংশই শূদ্র ও নবশাখা শ্রেণী হইতে পতিত।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের আদমসুমারিতে ত্রিপুরাবাসী ব্রাহ্মর সংখ্যা ১১১ দেখা যাইতেছে। ইহাদের অধিকাংশ উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু কুলজাত।

১৮৯১খ্রিস্টাব্দের আদমসুমারি দৃষ্টে কতকগুলি হিন্দু জাতির লোক সংখ্যা নিন্মে প্রদত্ত হইল।৪৮৮॥

হিন্দু জাতির লোক সংখ্যা
হিন্দু জাতির লোক সংখ্যা

এই সকল ব্যতীত অন্য জাতির সংখ্যা এক সহস্ৰ অধিক নহে। সবর্বপ্রকার কৈবর্ত্তের সংখ্যা ৭০৮৪২হইবে তন্মধ্যে তিবর (তিয়র) চারি শতের অধিক হইবে না। বোধ হয় তিয়রগণ জেলে কৈবর্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।

ত্রিপুরা জেলায় সর্বপ্রকার হিন্দুর সংখ্যা (১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের আদমসুমারি অনুসারে) ৫৫৭০৭৯ নির্ণীত হইয়াছে। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের গণনা অনুযায়ী ৫০৯০৬৬ হিন্দু। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে দশ বৎসরে ৪৮০১৩ জন হিন্দু বৃদ্ধি হইয়াছে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপবিভাগে হিন্দুর সংখ্যা তদনুপাতে নিতান্ত ন্যূন। সদরের ॥৪৯০। অন্তর্গত লাকসাম থানার মুসলমানদের পঞ্চমাংশ হিন্দু চাঁদপুরের অন্তর্গত স্থানে প্রায় তৃতীয়াংশ হিন্দু।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের আদম সুমারি অনুসারে ত্রিপুরা জেলায় মুসলমানের সংখ্যা ১২২৪৩৩৬ নির্ণীত হইয়াছে। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের গণনানুসারে এই জেলায় মুসলমানের সংখ্যা ১০০৭৪২২ ছিল। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, দশ বৎসরে ত্রিপুরা জেলায় ২১৯৬১৪ জন মুসলমান বৰ্দ্ধিত হইয়াছে। আদমসুমারির কর্তাগণ এই বৃদ্ধি সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে, “নওয়াখালী, ঢাকা ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ হইতে অনেক মুসলমান মেঘনাদের নূতন চরে বাস ভবন নির্মাণ করিয়াছে।” এই বর্ণনা আংশিক সত্য হইলেও সম্পূর্ণ সত্য হইতে পারে না। কারণ সেই সকল জেলাতেও মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি ব্যতীত হ্রাস দেখা যাইতেছে না। আমাদের বিবেচনায় বিধবা বিবাহই ইহার প্রধান কারণ। পূর্বে চণ্ডাল, মালী প্রভৃতি নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদিগের মধ্যে কোন কোন শ্রেণীর পুরুষগণ অর্থের অভাবে দার পরিগ্রহ করিতে পারিতেছে না। হিন্দু বাল-বিধবাগণের সন্ত ান উৎপাদিকা॥৪৯১॥ শক্তি সামাজিক অত্যাচারে নিরুদ্ধ হইয়াছে। অপর পক্ষে পুত্ৰ কন্যাবতী মুসলমান বিধবাগণ দ্বিতীয়, তৃতীয় কিম্বা চতুর্থবার স্বামী গ্রহণ করত সৃষ্টি বৃদ্ধি করিতেছে। সুতরাং হিন্দুর হ্রাস মুসলমানের বৃদ্ধি অনিবার্য্য।

আদমসুমারির কর্তাগণ ত্রিপুরাবাসী মুসলানদিগকে ছৈয়দ, পাঠান, সেখ, এবং অনিদ্দিষ্ট এই ৪শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন। তন্মধ্যে ছৈয়দ, পাঠান ও সেখের সংখ্যা বোধ হয় ৪.৫ সহস্রের অধিক হইবে না, অবশিষ্ট অনিদ্দিষ্ট। আমরা মুসলমানিদগকে তিনটী শ্রেণীতে বিভক্ত করিতে পারি যথা উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন। উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানগণ যে বংশ মর্য্যাদায় কেবল ত্রিপুরা জেলায়ই শ্রেষ্ঠ বলিয়া আখ্যাত এমত নহে, বাঙ্গালা ও বিহার দেশে যে স্থানে যে সকল সম্ভ্রান্ত মুসলমান বংশ আছে, তাঁহারা সকলই ত্রিপুরাবাসী উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদিগের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করিয়া থাকেন। আমরা যথা স্থানে ত্রিপুরায় প্রাচীন মুসলমান জমিদার দিগের কথা উল্লেখ করিয়াছি। সেই সকল জমিদার বংশ ব্যতীত আরও কতকগুলি সম্ভ্রান্ত মুসলমান বংশ ত্রিপুরায় বাস করিতেছেন। ব্রিটিশাধিকার কালে তাহারা বিদ্যাশিক্ষা দ্বারা আপনাদের গৌরব ও সম্মান রক্ষা করিবার জন্য যত্নবান হইয়াছেন। ত্রিপুরায় সম্ভান্ত মুসলমানগণ ইংরেজী শিক্ষাদ্বারা কায়স্থ ও বৈদ্যের সম শ্রেণীতে॥৪৯২॥ দন্ডায়মান হইয়াছেন। যদিচ ত্রিপুরায় তিনটি উপবিভাগেই সম্ভ্রান্ত বা উচ্চ শ্রেণীর মুসলমান বাস করিতেছেন; কিন্তু ইহা নিতান্ত আশ্চর্য্যের বিষয় যে, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যের ন্যায় তথাকার সম্ভ্রান্ত মুসলমানগণও ইংরেজী শিক্ষাদ্বারা সেই উপবিভাগের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছেন। পূর্বে যে রূপ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া উপবিভাগের সম্ভ্রান্ত ও সুপণ্ডিত মুসলমানগণ সদর-আমিন-আলা-সদর আমিন ও ডেপুটী কালেক্টরের পদে নিযুক্ত হইয়াছেন। সদর উপবিভাগের দুই একটি সম্ভ্রান্ত মুসলমান কদাচিত তাঁহাদের পার্শ্বে উপবেশন করিয়াছেন।

মধ্যশ্রেণী :- সামান্য তালুকদার, ইজারাদার ও গ্রাম্য পাটওয়ারীদিগকে, আমরা মধ্য শ্রেণীতে স্থান প্রদান করিলাম ইহাদের মধ্যে সময় দুই একটি প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি জন্ম গ্রহন করিয়াছেন। তাঁহারা উচ্চ রাজকার্য্যে নিযুক্ত হইয়া সমাজে সম্মানিত হইয়াছেন।

তৃতীয় শ্রেণী :- সাধারণ কৃষক ও শ্রমজীবী সম্প্রদায়। ইহারা অবশ্যই আফগানিস্থান, কিম্বা তুরস্ক দেশ হইতে ত্রিপুরার উপনিবিষ্ট হয় নাই। নানা প্রকার অবস্থার পরিবর্তনে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুগণ “ইছলাম” ধর্ম গ্রহণ করিয়াছে।৪৯৩। ফলত ত্রিপুরাবাসী উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন এই তিন শ্রেণীর মুসলমানের বহুসংখ্যক হিন্দু সন্তান রহিয়াছে I

ত্রিপুরাবাসীগণ অধিকাংশ সুন্নি; সিয়া সম্প্রদায় ত্রিপুরায় বিশেষ প্রবল। “ওহেবি” সম্প্রদায় নিতান্ত অল্প। ত্রিপুরায় মুসলামনগণ হিন্দুবিদ্বেষ্টা নহেন। প্রাচীন মুসলমান জমিদারগণ অকাতরে দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর ও মহাত্মরাণ প্রভৃতি দান করিয়া গিয়াছেন। আর নবী (ক্রেতা) জমিদার (হিন্দু) গণ সেই সকল বাজেয়াপ্ত করিবার জন্য ফাঁক তল্লাস করিয়া বেড়াইতেছেন? ত্রিপুরায় তান্ত্রিক ব্রাহ্মণগণ যে কেবল হিন্দুদিগকে করায়ত্ত করিয়াছিলেন, এমত নহে; অনেক মুসলমানকেও তাঁহারা শন্তি মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়াছিলেন। অদ্যাপি অনেক মুসলমান কালীর মন্দিরে পাঁঠা বলি প্রদান করিয়া থাকে। মেহার কালীবাড়ীর মেলা উপলক্ষে যাঁহারা তথায় গমন করিয়াছেন, তাঁহারা ইহা বিশেষ রূপে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। প্রসিদ্ধ শক্তি উপাসক জমিদার মির্জা হুসনআলীর কথা পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি। সরাইলের মুসলমান জমিদার দেওয়ান সাহেবগণ বৃষ্টির জন্য প্রতি বৎসর কালীকচ্ছের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদিগের দ্বার ইন্দ্রযজ্ঞ করাইতেন। প্রাচীন মুসলমান জমিদারগণ সকলেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদিগের টোলের ব্যয় নির্বাহ জন্য ভূমি ও বৃত্তি দান করিতেন। ফলন্ত॥৪৯৪॥ ত্রিপুরার ন্যায় হিন্দু মুসলমানে এরূপ ভ্রাতৃভাব অন্য কোন স্থানে দৃষ্ট হয় না।

.

টীকা

১. ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের আদমসুমারিতে দৃষ্ট হইবে যে অদ্যাপি প্রায় ৩০০ কোচ এই জেলায় বাস করিতেছে।

২. ত্রিপুরা জেলার (আধুনিক কুমিল্লা জেলা, বাংলাদেশ) গুণাইঘর গ্রামে প্রাপ্ত মহারাজ বৈন্যগুপ্তের তাম্র শাসনের তারিখ১৮৮ গুপ্তাব্দ (৫০৬-৭ খ্রিস্টাব্দ)।

৩. ত্রিপুরায় প্রাপ্ত বুদ্ধ ও বৌদ্ধ দেবদেবীর বিভিন্ন মূর্ত্তির কাল নির্ণয়ে এই কথাই জানা যায় যে খৃষ্টীয় নবম শতকে বৌদ্ধ ধর্ম ত্রিপুরায় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছিল। শৈব যে সমস্ত দেব মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়েছে তাহারা সমস্তই একাদশ শতক পরবর্ত্তী।

৪. নির্মাণ শৈলী ও সমকালীন ত্রিপুরা মুদ্রায় খোদিত চিত্ররূপের নিরিখে বিচার করিলে দেবতামুড়ায় ভাস্কর্য্য রাশীকে ব্রিষ্টীঢ ষোড়শ শতকের পূর্ববর্তী বলিয়া মনে হয় না।

৫. নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদিগের পুরোহিত, যাঁহারা বর্ণের ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচিত, উক্ত গণনায় তাহাদিগকে পরিত্যাগ করা হইয়াছে।

৬. শ্যামগ্রামের রায় মহাশয়গণ বটব্যাল বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়া থাকেন।

৭. শঙ্কর কৃত প্রবোধ চন্দ্রিকার প্রথম দুইটি শ্লোক এস্থলে উদ্ধৃত হইলঃ-

প্রণম্য মাতা পিতরৌ শিয়া শঙ্কর শর্ম্মণা।
গোপীনাথস্য কিয়তী বাক্ প্ৰণালী প্রকাশ্যতে॥১॥
অন্তং গবতী গুরুতরণৌ
গ্রন্থাথৌ পদেশ ভানুনা সহিতে।
অকলঙ্ক প্রবোদ চন্দ্রি কেয়
সময়তু তমঃ কলাপ চারাণাম্ ॥২॥

৮. সংস্কৃত কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপক মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত চন্দ্ৰকান্ত তর্কালঙ্কার মহাশয়, শ্রীনন্দন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের ছাত্র।

৯. পরিহিতাব্রত পরায়ণ নলডাঙ্গার রাজা বাহাদুর যৎকালে বিধবা প্রচলনের চেষ্টা করেন, নড়াইলের জমিদারগণ তৎকালে তাঁহার প্রতিকুলে দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন।

১০. ইনি পূর্বোল্লিখিত শিরকিঙ্কর বিদ্যাভূষণের পৌত্র। বাদুগড় নিবাসী শঙ্গরের সহিত ভিন্ন জেলাবাসী লোকনাথ নামক অন্য একজন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতের বিচারকালের শিবকিঙ্কর বলিলেন:-

শঙ্কর শঙ্করঃ সাক্ষাৎ লোকনাথ স্বয়ং হরি।
ত্বকেবির্বাদয়োমধ্যে কিঙ্করঃ কিং করিষ্যাতি॥

১১. Census of India, 1891 Vol III. P 267

১২. নব্য ভারত, ৬ষ্ঠ খন্ড ৬০পৃঃ

১৩. The most Educated and influential men in the district hail From Brahmanbaria, (Census Report of Tiperah 1891, page 17,)

১৪. ইহার তিনটি দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিতেছিঃ-

(১) দুই খণ্ড রেজেষ্টরী দলিলে আমরা এইরূপ একটি আশ্চর্য্য দর্শন করিয়াছি। প্রথম দলিলের বয়ঃক্রম ৪৩ বৎসর। ইহাতে দত্ত বংশীয় এক ব্যক্তি দলিলদাতার সনাক্তকারী ছিলেন। তিনি স্বয়ংকায়স্থ বলিয়া পরিচয় প্রদান করেন। দ্বিতীয় দলিলের বয়ঃক্রম ৫ বৎসর। এই দলিলদাতা পূর্বোক্ত সনাক্তকারীর পুত্র। তিনি বৈদ্য বর্ণনা করিয়াছেন।

(২) প্রায় ৩০ বৎসর অতীত হইল দত্ত বংশীয় জনৈক অশীতিপর বৃদ্ধ পরলোক গমন করিয়াছেন। ৪৩ বৎসর হইল তিনি কিঞ্চিৎ ভূমি বিক্রয় করেন। সেই কালে উক্ত দত্ত মহাশয় স্বয়ং কায়স্থ বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার সপিণ্ডজ্ঞাতিগণ গোত্র পরিবর্তন করেন নাই।

(৩) দাস বংশীয় জনৈক কায়স্থ ভিন্ন জেলাবাসী এক বৈদ্য পুত্রের সহিত স্বীয় কন্যার সম্বন্ধ স্থির করিলেন। বিবাহকালে গোত্রদ্বারা জানা গেল তিনি কায়স্থ, সুতরাং দাস মহাশয় গোত্রটি পরিবর্তন করিলেন, কিন্তু তাঁহার সপিণ্ড জ্ঞাতিগণ গোত্র পরিবর্তন করেন নাই।

১৫. নবশাখ বংশ হইতে এই সকল দাস দাসী ক্রয় করা হইত। প্রায় ৬০ বৎসর গত হইল জনৈক ভদ্রলোক দময়ন্তী নামক এক বালিকাকে ক্রয় করেন। তাহার খরিদা কবালা আমরা দর্শন করিয়াছি। সেই বালিকা দময়ন্তী অদ্যাপি জীবিত আছে। তাঁহার বয়ঃক্রম প্রায় ৭০ বৎসর হইবে। কিঞ্চিদূন অর্দ্ধ শতাব্দী অতীত হইল ইতিহাস লেখকের পিতৃ দেবতা মহাশয় শ্রীহট্ট হইতে একটি দাস ও একটি দাসী ক্রয় করিয়া আনেন। এই প্রথা অধুনা বন্ধ হইয়া গিয়াছে।

১৬. উড়িষ্যার ইহারা “সাকরেৎপেসা” বলিয়া পরিচিত।

১৭. বর্ণভেদ শীর্ষক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য। (নব্য ভারত, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩৬৪ পৃঃ)

১৮. মানব ধর্ম শাস্ত্রের বর্ণিত ঝল্প মল্ল ব্রাত্য ক্ষত্রিয়। মহাভারতে মল্ল ক্ষত্রিয়দিগের উল্লেখ আছে। ভগবান শাক্য সিংহের অভ্যুদয় কালে মল্লরাজগণ বিশেষ পরাক্রমশালী ছিলেন। বিষ্ণুপুরের প্রাচীন নরপরিগণ মল্ল বংশীয় ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতেন।

১৯. শ্রীযুক্তা রামাবাই এর স্বামী বাবু বিপিন চন্দ্র দাস কলিকাতা নিবাসী একটি কুলীন কায়স্থ যুবককে কৌশলে ও প্রলোভনে বাধ্য করিয়া স্বীয় পরিবারের একটি বালিকার সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। শ্রীহট্টের সাহাগণ পূর্বে শ্রীহট্ট ও তৎপার্শ্বপর্তী জেলা হইতে আরকাটিদিগের কুলি ধরার ন্যায় পাত্র সংগ্রহ করিত, এক্ষণ ইহারা কলিকাতা পর্যন্ত ধাবিত হইয়াছে।

২০. কায়স্থ বৈদ্য এবং শূদ্রের সংখ্যা কিরূপ অবিশুদ্ধ তাহা পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে।

২১. মালাকারদিগের মধ্যে ভূইমালী প্রবিষ্ট হইয়াছে, বলিয়া আমাদের সন্দেহ হইতেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *