তৃতীয় অধ্যায়: কৃষি অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা (খ্রীঃ পূঃ ১০০০-খ্রীঃ পূঃ ৬০০)

তৃতীয় অধ্যায় – কৃষি অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা (খ্রীঃ পূঃ ১০০০-৬০০)

পশুচারণের অর্থনীতি প্রায় পাঁচশ বছর ধরে ভারত উপমহাদেশের উত্তর ও উত্তরপশ্চিম দিকে বিরাজ করেছিল ঠিকই; তবে ঐ কাল সীমার মধ্যেই পশুচারণ থেকে কৃষি প্রধান অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটছিল। ঋগ্বেদের বেশ কিছু সূক্তে এই রূপান্তরের ছাপ স্পষ্ট। পশুচারণ থেকে স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজে রূপান্তরের সম্ভাবনা ও লক্ষণগুলি ক্রমে পরিণতি লাভ করছিল; তার পরিচয় অনেক ক্ষেত্রে সাহিত্যগত সাক্ষ্যে বিধৃত। এই সাহিত্য নিঃসন্দেহে ঋগ্বেদের পরবর্তী ও সাধারণভাবে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য বলে অভিহিত। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বিভিন্ন প্রকার গ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত: এইগুলি হল (ক) তিনটি পরবর্তী বৈদিক সংহিতা–—সাম যজুঃ ও অথর্ব। এর মধ্যে সামবেদের অধিকাংশ সূক্ত ও শ্লোকই হুবহু ঋগ্বেদের অনুকৃতি; পার্থক্য এই যে সামবেদের শ্লোকগুলি সুরে গাওয়ার উদ্দেশ্যে সংকলিত হয়েছিল। যজুর্বেদে মূলত পুরোহিত সম্প্রদায়ের ক্রিয়াকলাপ ও যাগযজ্ঞ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা সন্নিবিষ্ট। অথর্ববেদ প্রকৃতপক্ষে যাদুবিদ্যা ও যাদুমন্ত্র সংক্রান্ত গ্রন্থ। এই গ্রন্থের আদি নাম ছিল অর্থবাঙ্গিরস; কারণ এই গ্রন্থের মূল উপজীব্য দুটি: কল্যাণকামী যাদুবিদ্যা (‘অথর্বন্‌’) ও অনিষ্ট প্রত্যাশী যাদুমন্ত্র (‘অঙ্গিরস’)। বৈদিক সংহিতার তুলনায় অথর্ববেদ বা অথর্বাঙ্গিরস চরিত্রে অনেকটাই আলাদা। তাই দীর্ঘদিন অবধি অথর্বাঙ্গিরস বৈদিক সংহিতার মর্যাদা পায় নি। সেই কারণে অনেক প্রাচীন গ্রন্থে বৈদিক সংহিতা সংখ্যায় তিন বা ‘ত্রয়ী’ (ঋক, সাম ও যজুঃ) বলে উল্লিখিত। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রেও ‘অথর্বাঙ্গিরস’ বৈদিক সংহিতা বলে স্বীকৃত হয়নি এবং কৌটিলা বেদকে ‘ত্রয়ী’ অভিধাই দিয়েছেন। কিন্তু অথর্ববেদের তাৎপর্যের একটি প্রধান কারণ এই যে আলোচ্য গ্রন্থটির অন্তর্গত যাদুবিদ্যা বিষয়ক মন্ত্রগুলির বড় অংশ সম্ভবত আদিম যুগে রচিত; এই মন্ত্রে প্রাগার্য মানসিকতার প্রকাশ দুর্লভ নয়। অথর্বাঙ্গিরস গ্রন্থটিকে যে কালে বৈদিক সংহিতার মর্যাদা দেওয়া হল, তা সম্ভবত ইঙ্গিত করে যে ইন্দো-ইওরোপীয়রা ধীরে ধীরে ভারতের আদিম অধিবাসীদের ধ্যান ধারণা, বিশ্বাস ও ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছিলেন। ‘ব্রাহ্মণ’ পর্যায়ের গ্রন্থগুলির উপজীব্য যাগযজ্ঞ ও তৎসংশ্লিষ্ট আচার অনুষ্ঠান ও বিধিবিধান। (গ) আরণ্যক সাহিত্য নামটির মধ্যেই এই ব্যঞ্জনা রয়েছে যে এই সাহিত্য সম্ভবত অরণ্যচারী ঋষিদের দ্বারা সৃষ্ট; এমনটা ঘটা অসম্ভব নয় যে আচারসর্বস্ব, আড়ম্বরপূর্ণ, যাগযজ্ঞপ্রধান ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কিছু সংখ্যক চিন্তাবিদ অরণ্যবাসী হয়েছিলেন ও রচনা করেছিলেন ‘আরণ্যক’ সাহিত্য।

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচিত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের তথ্যাদি কেবলমাত্র ঋগ্বেদ থেকে পাওয়া গিয়েছিল; প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ প্রায় অনুপস্থিত ছিল। আলোচ্য অধ্যায়ে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের সাক্ষ্যের পাশাপাশি কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যও উপস্থাপন করা সম্ভব। পুরাতাত্ত্বিক তথ্যগুলি উৎখনন ও অনুসন্ধান থেকে পাওয়া গিয়েছে। এই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি মোটামুটিভাবে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের সমকালীন। আগেই বলা হয়েছে, পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের কালসীমা খ্রীঃ পূঃ ১০০০ থেকে খ্রীঃ পূঃ ৬০০ পর্যন্ত বলে নির্ধারিত হয়েছে।

॥ ২ ॥

ঋগ্বেদের মানুষ মূলত সিন্ধু ও তার (পূর্ব ও পশ্চিমের) উপনদীগুলির উপত্যকায় বাস করতেন; ঋগ্বেদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ অঞ্চল ‘সপ্তসিন্ধব’ নিঃসন্দেহে এক নদীমাতৃক দেশ। তবে ঋগ্বেদের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর ভৌগোলিক গণ্ডী ক্রমশ এই আমলে প্রসারিত হতে থাকে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পাঁচটি প্রধান এলাকার উল্লেখ রয়েছে: উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম এবং পঞ্চমটি হ’ল মধ্যাঞ্চল। পঞ্চম ও শেষ বিভাগটি ‘ধ্রুবামধ্যমাপ্রতিষ্ঠাদিশ্‌’ নামে পরিচিত ছিল। এই ভৌগোলিক বিভাগটি থেকেই পরবর্তীকালের প্রসিদ্ধ ‘মধ্যদেশ’ নামের উদ্ভব ঘটে। ঋগ্বেদের তুলনায় পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ভৌগোলিক পরিচয়ের পরিধি বৃহত্তর। উত্তর ভারতের দুই প্রধান নদী গঙ্গা ও যমুনার সম্বন্ধে যেখানে গোটা ঋগ্বেদে মাত্র একবারই উল্লেখ আছে, সেখানে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে নদীদুটি অনেক বেশীবার ও অধিকতর গুরুত্ব সহ বর্ণিত। পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের দেশ ও জনগোষ্ঠী সম্বন্ধে উল্লেখ প্রমাণ করে যে এই অঞ্চলের বিষয়ে ক্রমে ভৌগোলিক জ্ঞান বাড়ছিল। যে সব অঞ্চল পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে, তার মধ্যে প্রধান গাঙ্গেয় উপত্যকা। তবে একথা বলে নেওয়া ভালো যে গাঙ্গেয় উপত্যকার উত্তর ও পশ্চিম অংশের সঙ্গেই পরবর্তী বৈদিক গ্রন্থের নিবিড়তর পরিচয় ছিল। অন্য যে দুটি নদী পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে গৌরবময় ও উজ্জ্বল ভূমিকায় অবতীর্ণ তারা হল সরস্বতী ও দৃষদ্বতী। সরস্বতী নদীর কথা ঋগ্বেদেও উল্লিখিত। এই নদী বর্তমান আর দেখা যায় না; রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চলে তার জলধারা বিশুষ্ক হয়ে গিয়েছে। মধ্যদেশ বা ‘ধ্রুবামধ্যমাপ্রতিষ্ঠাদিশে’র মধ্যে অগ্রগণ্য এলাকা ছিল ব্রহ্মর্ষিদেশ বা শিষ্টদেশ। এই ভূখণ্ড সরস্বতী ও দৃষদ্বতী এই দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। ঋগ্বেদের অগ্রগণ্য জনবসতি ছিল সপ্তসিন্ধব অঞ্চলে, যা বর্তমান পাঞ্জাব (ভারত ও পাকিস্তানের দুই পাঞ্জাবের মিলিত ভূখণ্ড)-এর সন্নিহিত অঞ্চলে দেখা যায়। কিন্তু সরস্বতী-দৃষদ্বতী নদী বিধৌত ‘ব্রহ্মর্যিদেশ’ হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত ছিল। বৈদিক যুগের শ্রেষ্ঠ বসতির ক্ষেত্রে স্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়া যায়, যেখানে পঞ্জাব থেকে জনবসতি পূর্ব দিকে প্রসারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তার ফলে সপ্তসিন্ধব অঞ্চলের পূর্বগৌরব বোধহয় কিছুটা অস্তমিত হয়ে পড়েছিল।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ শতপথব্রাহ্মণ। শতপথ ব্রাহ্মণের তথ্যাদি আঃ ৮০০ খ্রীঃ পূঃ-তে নির্দেশ করা যেতে পারে। এই গ্রন্থে বিদেঘ মাঠব নামে এক ব্যক্তির আকর্ষক কাহিনী পাওয়া যায় (১. ৪. ১.)। অগ্নি বৈশ্বানর সরস্বতী নদীর তীর থেকে যখন পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করেন, তখন মাঠব ও তাঁর পুরোহিত গোতম রাহুগণ তাঁকে অনুসরণ করে বহু পথ অতিক্রমণের পর শেষপর্যন্ত উত্তরের পর্বতমালা (=অর্থাৎ হিমালয়) থেকে বিনির্গত সদানীরা নদীর পূর্বতীর পর্যন্ত পৌঁছন। বৈশ্বানরের আদেশে সদানীরা নদীর পূর্বতীর পার হয়ে আরও পূর্বদিকে তাঁরা এগোন নি। সদানীরা নামের নদটি আজকার গণ্ডক নদীর সঙ্গে অভিন্ন। এই নদী উত্তর বিহারের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ বিহারের পাটলিপুত্রের কাছে গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে। বিদেঘ মাঠব সদানীরা নদীর পূর্বতীরস্থ যে দেশে গিয়ে তাঁর যাত্রা সমাপ্ত করলেন, তা প্রচীন বিদেহ বা মিথিলা, অর্থাৎ বর্তমান বিহারের উত্তরভাগ। হরিয়ানা থেকে উত্তর বিহার অঞ্চল পর্যন্ত একজন ব্রাহ্মণের ভ্রমণের মধ্যে কার্যত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ভৌগোলিক প্রসারের ইঙ্গিতই দেখা যায়। শতপথ ব্রাহ্মণের কাহিনীটি প্রমাণ করে যে গাঙ্গেয় উপত্যকার সঙ্গে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের যোগ ও পরিচয় আগের তুলনায় অনেক বেশী নিয়মিত ও ঘনিষ্ঠতর। সিন্ধু নদ বিধৌত এলাকার তুলনায় গাঙ্গেয় উপত্যকাই ইতিহাসে প্রাধান্য পেতে শুরু করে।

॥ ৩ ॥

সিন্ধু নদের অববাহিকা থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকার উপরাংশে এবং ক্রমে গাঙ্গেয় উপত্যকার মধ্যভাগের সঙ্গে নিয়মিত পরিচয় কেবলমাত্র পরবর্তী বৈদিক আমলে ভৌগোলিক জ্ঞানের প্রসারকে চিহ্নিত করে না, তার গুরুত্ব অর্থনৈতিক জীবনেও গভীরভাবে অনুভূত হতে থাকে।

সিন্ধু অববাহিকার তুলনায় গাঙ্গেয় উপত্যকা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশী, জলবায়ু অধিকতর আর্দ্র, নদনদীর সংখ্যাও সুপ্রচুর। অধিকাংশ নদী হিমালয়ের হিমবাহ থেকে উদ্ভূত বলে সেগুলিতে সারা বছর অন্তত কিছু পরিমাণ জল পাবার সম্ভাবনা রয়ে যায়। তাছাড়া উত্তরভারতের বিস্তীর্ণ সমতলভূমি–—যার বেশীরভাগই গাঙ্গেয় উপত্যকার অন্তর্গত–—মূলত পলিমাটি দ্বারা গঠিত। পলিমাটির আধিক্য থাকার দরুন এই বিস্তীর্ণ সমতলভূমির উর্বরতা যথেষ্ট এবং স্বভাবতই সমগ্র এলাকাটি কৃষির পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল ফলে ঋগ্বেদের অন্তিম পর্বে পশুচারণ থেকে স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজে রূপান্তরের যে প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তা পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের আমলে বাস্তবায়িত হতে থাকে। কৃষির পক্ষে সহায়ক প্রাকৃতিক পরিবেশে কৃষি অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটা স্বাভাবিক। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে যে সমাজের ছবি দেখতে পাওয়া যায়, তা সন্দেহাতীতভাবে স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজ। কৃষিকর্মই অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে অগ্রগণ্য; পশুচারণের গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েও বলা চলে যে স্থায়ী কৃষি অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা হওয়ায় আগের পর্বের যাযাবর সুলভ পশুচারণের অর্থনীতি ধীরে ধীরে কৃষির তুলনায় গৌণ হয়ে পড়ছে।

অথর্ববেদ অনুযায়ী কৃষিকর্ম প্রবর্তন করার কৃতিত্ব পৃথু বৈন্যের। পৃথু বৈন্য ঐতিহাসিক চরিত্র কি না এ বিষয়ে সন্দেহ থাকতে পারে; ঘটনাটি কত দূর সত্য তা-ও নিশ্চিত নয়। কারণ প্রাক-বৈদিক আমলে হরপ্পীয়রা কৃষির সম্যক ব্যবহার অবশ্যই জানতেন। কাহিনীটির তাৎপর্য এই যে ব্রাহ্মণ্য ধারণা অনুযায়ী পৃথু বৈন্য এক অতি আদিম পুরুষ; তিনি যখন কৃষিকর্মের প্রবর্তক, তখন অথর্ববেদে এমন একটি ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা রয়েছে যে বৈদিক সমাজ যেন প্রথমাবধিই কৃষিজীবী। অথর্ববেদে মানুষের কাছে পশুচারণের উপর পূর্ববর্তী নির্ভরতার স্মৃতি কি ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছিল? পৃথু বৈন্যের কাহিনী প্রসঙ্গেই আরও বলা হয়েছে, আর্যরা কৃষিজীবী, ‘ব্রাত্য’জনরা (অর্থাৎ সামাজিক দিক দিয়ে পতিত গোষ্ঠী) বৈদিক ধর্মের বিরোধী ও কৃষিকর্মে যুক্ত থাকে না। ‘আর্য’ কথাটি এখানে ভদ্র ব্যক্তি অর্থে ব্যবহৃত। ভদ্রজনের পক্ষে শ্ৰেয় জীবিকা যে কৃষিকর্ম এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গীই এখানে প্রকট। অন্যদিকে কৃষিজীবী নয় এমন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের একাধারে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধী ও ভদ্রসমাজে অপাংক্তেয় বলে চিহ্নিত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অথর্ববেদের থেকে পাওয়া আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্রটি যে ঋগ্বেদে বর্ণিত অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে অনেকাংশেই পৃথক, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে পশুচারণে অভ্যস্ত আদি বৈদিক আমলের মানুষ কৃষি অর্থনীতিজাত স্বাচ্ছন্দ্য ও সুরক্ষার প্রতি ক্রমে আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষির অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সম্পদের অস্তিত্ব থাকায় কৃষির অর্থনৈতিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে পরবর্তী বৈদিক যুগের অধিকাংশ মানুষের বোধহয় অসুবিধে হয়নি। তবে যে যে গোষ্ঠী স্থায়ী কৃষিজীবি সমাজের নিশ্চিতি ও নিরাপত্তার দ্বারা আকৃষ্ট হল না, তারা তাদের প্রাক্তন বৃত্তি পশুচারণকেই আঁকড়ে ধরে থাকল। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর চোখে পশুচারণকারীরা ক্রমে হেয় হতে লাগল ও কালক্রমে ব্রাত্যস্তরে অবনীত হল।

গাঙ্গেয় উপত্যকায় ১০০০ খ্রীঃ পূঃ নাগাদ কৃষির পত্তন হবার পর থেকে কৃষি অর্থনীতির আর পশ্চাদপসরণ ঘটেনি। ভারতীয় ইতিহাসে তা ধারাবাহিকভাবে সবচেয়ে প্রধান জীবিকা হয়ে দেখা দেয়। আধুনিক আমলেও ভারতে কৃষিকর্মের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গাঙ্গেয় উপত্যকা। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ঋগ্বেদের তুলনায় ফসলের উল্লেখ বেশী, ফসলের বৈচিত্র্যও বেশী। যবের কথা ঋগ্বেদের পর্বে পশুচারণকারী মানুষরা জানতেন; পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে তা অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে পরিগণিত। ‘গোধূম’ বা গমের সম্বন্ধেও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে সম্যক ধারণা ছিল। কৃষি অর্থনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ধান বা ‘ব্রীহি’ উৎপাদনের সূচনা। ‘ব্রীহি’ কথাটি ঋগ্বেদে পাওয়া যায়, তবে তার অর্থ ছিল যে কোনও শস্য। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকেই ‘ব্রীহি’ কথাটিকে সুনিশ্চিতভাবে ধান বোঝাতে ব্যবহার শুরু হল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে যে ‘ব্রীহি’ ও ‘গোধূম’কে পৃথক ফসল হিসেবে বিচার করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে এই আমলে কৃষি অর্থনীতির বিকাশের পরিচায়ক। রামশরণ শর্মা ‘ব্রীহি’র অন্যতম প্রতিশব্দ ‘ষষ্ঠী’-র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন; যে ধরণের ধান ষাট দিনে পাকত, তাকেই ‘ষষ্ঠী’ বলে অভিহিত করা হত। গাঙ্গেয় উপত্যকার অধিকতর আর্দ্র জলবায়ু, বৃষ্টিপাতের প্রাচুর্য পলিমাটির কারণে বেশী উর্বর জমি প্রভৃতি কারণে পাঞ্জাব বা সিন্ধু উপত্যকার তুলনায় ধানের চাষ হওয়া গাঙ্গেয় উপত্যকায় সহজ ছিল। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ধান চাষের উল্লেখ সাম্প্রতিক পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন দ্বারা সমর্থিত। গাঙ্গেয় উপত্যকার অন্যতম প্রধান প্রত্নক্ষেত্র হস্তিনাপুরে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের স্তর থেকে (আঃ ৮৫০ খ্রীঃ পূঃ–—৬০০ খ্রীঃ পূঃ; এই প্রত্নতাত্ত্বিক পরিভাষার ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য পরে আলোচিত হয়েছে) ধানের অবশেষ পাওয়া গিয়েছে। যব বা গম থেকে ‘সক্তবঃ’ বা ছাতু তৈরী করার উল্লেখ মিলবে তৈত্তিরীয় সংহিতায়; এটিও কৃষির বিকাশের প্রতি ইঙ্গিত দেয়।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ফসলের, বৈচিত্রের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় ঋতুগুলির বৈচিত্র্য সম্বন্ধে সচেতনতা। তৈত্তিরীয় সংহিতায় বলা হয়েছে যবের বীজ বপন করা হয় শীতকালে, আর ফসল পাকে গ্রীষ্মে; আবার ধানের বীজ বপনের অনুকূল ঋতু বর্ষাকাল ও ফসল পাকার সময় হেমন্ত; তিলের বীজ বপণ করা হবে গ্রীষ্মে ও ফসল কাটা হবে শীতে। কৃষি অর্থনীতির গুরুত্ব যে সম্যক ভাবে উপলব্ধি করা হয়েছিল তাতে কোনও সংশয় নেই; কৃষিকর্মের জন্য প্রয়োজনীয় নানা কলাকৌশলের ধারণাও ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। ঋতু বদলের ব্যাপারে সচেতনতা অবশ্যই কৃষির অগ্রগতি ঘটাতে সাহায্য করেছিল। সারের ব্যবহারও শুরু হয়েছিল; দুই প্রকার সারের কথা জানা যায়: ‘সকৃৎ’ বা গোময় ও ‘করীষ’ বা শুল্ক গোময়। শতপথ ব্রাহ্মণে কৃষিকর্মের চার প্রধান পর্যায়ের উল্লেখ করা হয়েছে: জমিতে হলচালনা, বীজবপন, ফসল কাটা ও পাকা ফসল ঝাড়াই-মাড়াই ও বাছা। চাষের জন্য জমিকে উপযুক্ত করে তোলার জন্য লাঙ্গলের ব্যবহার অপরিহার্য ছিল। ঋগ্বেদে যেখানে লাঙ্গলের কথা ক্বচিৎ কখনও পাওয়া যায়, পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে তার তুলনায় লাঙ্গলের উল্লেখ ও বর্ণনা সংখ্যায় অনেক বেশী। লাঙ্গলের ফলা ‘খদির’ বা উদুম্বর (ডুমুর) গাছের কাঠ দিয়ে তৈরী হত; তবে তামার তৈরী লাঙ্গলও ব্যবহৃত হত। কিন্তু লৌহনির্মিত ফলা দিয়ে লাঙ্গল চালানো এই আমলে অজানা ছিল। লাঙ্গলের ফলার যে দাগ কৃষিক্ষেত্রে পড়ত, তা ঋগ্বেদের মতই পরবর্তী দৈক সাহিত্যে ‘সীতা’ নামে অভিহিত। কৃষিক্ষেত্রে ‘কীনাশ’ বা কৃষক হালের সঙ্গে বৃষগুলি বেঁধে নিয়ে হলচালনা করছে ও হাতে ধরা দণ্ড দিয়ে বৃষগুলির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে–—পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে এই জাতীয় বর্ণনা ভূরিপরিমাণ আছে। কৃষিকর্ম যে অর্থনৈতিক জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছে, তা সন্দেহাতীত। অথর্ববেদ, বাজসনেয়ী সংহিতা, মৈত্রায়নী সংহিতা, কাঠক সংহিতা, শতপথ ব্রাহ্মণ ও তৈত্তিরীয় সংহিতা-তে বর্ণনা আছে যে লাঙ্গল চালাবার জন্য ছয়, আট, বারো এমনকি চব্বিশটি বলদের প্রয়োজন হত। এতগুলি বলদের দরকার লাগত কেন? বৈদিক সংস্কৃতি প্রসারের আগে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের স্থায়ী বসতি বোধহয় বিশেষ ছিল না; সেক্ষেত্রে চাষের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জমি পাবার বিশেষ অসুবিধা ছিল না। হয়তো কৃষিক্ষেত্রগুলি আয়তনে এত বড় হত যে বহুসংখ্যক বৃষ হলচালনার কাজে লাগত। আর একটি সম্ভাব্য কারণের প্রতিও মনোযোগ দেওয়া দরকার: গাঙ্গেয় উপত্যকার পলিপ্রধান কৃষিজমির মাটী পাঞ্জাবের জমির তুলনায় অনেক বেশী ঘন ও আঠালো। তামা বা কাঠের ফলা দিয়ে অপেক্ষাকৃত ঘন ও আঠালো জমিতে লাঙ্গল চালাতে গেলে প্রচুর বলদের বোধহয় প্রয়োজন পড়ত। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের বর্ণনানুযায়ী আদর্শ লাঙ্গলের হাতল হবে মসৃণ, তাকে সহজে জমিতে চালানো যাবে আর তার ফলা হবে সুতীক্ষ্ণ (‘পবীরবৎ’)।

যথেষ্ট উন্নতি সত্ত্বেও কয়েকটি সমস্যা বোধহয় কৃষিকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করত। তার অন্যতম ছিল কৃষিক্ষেত্রে পোকামাকড় ও ইঁদুরের উপদ্রব। সাহিত্যগত বর্ণনায় পাওয়া যায় যে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাবে ছোট চারাগাছের কোমল শিকড়গুলি নষ্ট হত; আর ইঁদুরের দৌরাত্ম্যে নষ্ট হত সদ্য উপ্ত বীজ। অথর্ববেদে অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য অনেকগুলি যাদুমন্ত্র স্থান পেয়েছে। ঋতুপর্যায় সম্বন্ধে ধারণা এই যুগে স্পষ্টতর হওয়া হত্ত্বেও প্রকৃতির খামখেয়ালীপনা সদ্য প্রতিষ্ঠিত কৃষি অর্থনীতির সামনে বিপর্যয় নিয়ে আসত। অবশ্য আজ অবধি পর্জন্যদেবতার উপর পরম নির্ভরতা ও ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করা ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির অন্যতম ধারাবাহিক লক্ষণ। সেচব্যবস্থা খুব উন্নত না হওয়ার দরুণ বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা প্রয়োজনের সময় সেচের কাজে লাগাবার কোনও উত্তম প্রক্রিয়া ও কৌশল বোধ হয় জানা ছিল না। তাই যাদুবিদ্যা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রই ছিল অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির অভিশাপকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য অগতির গতি।

গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি অর্থনীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পিছনে প্রাকৃতিক পরিবেশের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তার সঙ্গে আরও দুটি উপাদানের কথা না বললে বক্তব্য অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। এই প্রসঙ্গে শতপথ ব্রাহ্মণে উল্লিখিত বিদেঘ মাঠবের কাহিনীটির আরও একবার পর্যালোচনা হওয়া দরকার। সরস্বতী নদীর তীর থেকে পূর্বে সদানীরা নদীর তীর পর্যন্ত (অর্থাৎ মিথিলা অবধি) বিদেঘ মাঠব যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিলেন, শতপথ ব্রাহ্মণ অনুযায়ী তিনি গোটা পথটিই অগ্নি বৈশ্বানরকে অনুসরণ করছিলেন। সদানীরা নদী পর্যন্ত যাবার পর যাত্রা স্থগিত রাখার কারণ এই যে তার পূর্বদিকের ভূখণ্ড অগ্নির সংস্পর্শে আসেনি। কাহিনীটিতে এমন ইঙ্গিত ও আছে যে বিদেঘ-র আবির্ভাবের আগে ঐ অঞ্চলে চাষাবাদ হত না। অগ্নি বৈশ্বানরের অনুগামী হিসেবে বিদেঘ-র যাত্রার পরই বহু ব্রাহ্মণ মিথিলা অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলেনা। ব্রাহ্মণ বসতি গড়ে ওঠার কাহিনী প্রকৃতপক্ষে স্থায়ী কৃষিজীবী অর্থনৈতিক জীবনের সূত্রপাতের প্রতি ইঙ্গিত করে। কৃষিপ্রধান স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠার আগে গাঙ্গেয় উপত্যকার বৃহদংশে বোধহয় গহন অরণ্য ছিল। অগ্নি বৈশ্বানরের কাহিনী ও তাঁর সক্রিয় ভূমিকাটি সম্ভবত রূপকাশ্রয়ী। হরিয়ানা থেকে পূর্বদিকে অর্থাৎ গাঙ্গেয় উপত্যকায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি তথা কৃষি অর্থনীতির প্রসার বাস্তবায়িত হয়েছিল ঘন অরণ্য আগুন জ্বালিয়ে পরিষ্কার করে। কৃষিকর্ম চালাবার জন্য বহু পরিমাণ অরণ্য ধ্বংস করে ঐ অঞ্চলকে আবাদী ও বাসযোগ্য করে তোলা ছাড়া উপায় ছিল না।

বন পোড়ানোর পাশাপাশি জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিকাজ চালাবার আরও একটি পদ্ধতি বোধহয় অজানা ছিল না। সেটি হচ্ছে বন কেটে বসত বানাবার পদ্ধতি। দহনের দ্বারা অরণ্য ধ্বংস করার বদলে দা, কুড়াল, কুঠার ইত্যাদি দ্বারা বহু বৃক্ষচ্ছেদন করে আরণ্যক পরিবেশকে ক্রমে বসবাসের ও চাষের উপযোগী এলাকা করে নেওয়া নিতান্ত অসম্ভব ছিল না। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে দা কুড়াল জাতীয় হাতিয়ার ও উপকরণের কথা নিয়মিতভাবে আছে। তবে হাতিয়ারগুলি কেবলমাত্র তামার তৈরী নয়, অনেকক্ষেত্রেই তা লৌহ নির্মিত। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য যে ধাতুকে ‘শ্যামায়স’ ও ‘কৃষ্ণায়স্‌’ নামে অভিহিত করে তাকে অধিকাংশ পণ্ডিতই লোহা বলে অনুমান করেছেন। লোহার ব্যবহারের সূচনা প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। গাঙ্গেয় উপত্যকায় ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে তামার তুলনায় লোহার তৈরী উপকরণের কার্যকারিতা অবশ্যই বেশী ছিল। লোহার আবিষ্কার, তথা অর্থনৈতিক জীবনে তার ব্যবহার যদিও কারিগরী শিল্পের সঙ্গেই যুক্ত, কিন্তু লোহা ব্যবহারের সঙ্গে গাঙ্গেয় উপত্যকায় স্থায়ী বসতি নির্মাণ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। লোহার ব্যবহার কবে নিয়মিতভাবে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে বিতর্ক আছে। অত্রঞ্জিখেড়ার উৎখনন থেকে পাওয়া নিদর্শনটি খ্রীঃ পূঃ ১০০০ বলে যে ধারণা আছে, তা সম্ভবত সন্দেহাতীত নয়। পুরাতাত্ত্বিকদের বিচারে অর্থনৈতিক জীবনে লোহার নিয়মিত ব্যবহার ৮০০ বা ৮৫০ খ্রীঃ পূঃ-এর আগে হওয়া প্রায় অসম্ভব।

॥ ৪ ॥

সৌভাগ্যের কথা, লোহার ক্রমবর্দ্ধমান প্রয়োগের চাক্ষুষ প্রমাণ এখন সুলভ। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন ও অনুসন্ধানের ফলে লৌহনির্মিত উপকরণাদি পাওয়া গিয়েছে। বেশীরভাগ উপকরণই অবশ্য নানা রকম হাতিয়ার; কৃষির প্রয়োজনীয় লোহার উপকরণ মুষ্টিমেয়, বিশেষত লোহার ফলাওয়ালা লাঙ্গল নেই বললেই চলে। অবশ্য জাখেডা নামক প্রত্নক্ষেত্রে (উত্তর প্রদেশ অবস্থিত) এর ব্যতিক্রম উপস্থিত: এখানে লোহার ফলাযুক্ত লাঙ্গল পাওয়া গিয়েছে। লোহার তৈরী সবচেয়ে পুরনো অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে উত্তরপ্রদেশের নোহ্‌-তে উৎখনন চালিযে: এখানে আবিষ্কৃত হাতিয়ারগুলি সম্ভবতঃ খ্রীঃ পূঃ ১১০০ থেকে খ্রীঃ পূঃ ৯০০-র মধ্যে প্রস্তুত। তবে লোহার অস্ত্রশস্ত্র সবচেয়ে বেশী পরিমাণে আবিষ্কৃত হয়েছে উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্র অত্রঞ্জিখেড়াতে। এখানকার লোহার হাতিয়ারের মধ্যে আছে তীরের ফলা–—তার আকার দুই রকম: কাঁটা ও পাতার মত। লোহার বর্শা ফলকও আবিষ্কৃত; এগুলির মুখ অনেক সময় চেরা থাকত। লোহার কুড়ালের মধ্যভাগে বড় ছিদ্র দেখা যায়, যার মধ্যে কাঠের বা হাড়ের হাতল লাগানো সুবিধাজনক ছিল। অতি প্রাচীন পদ্ধতিতে কিভাবে আকরিক লোহা থেকে পরিস্রুত লৌহপিণ্ড তৈরী হত, তার পুনরুদ্ধার করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদ কে. টি. এম. হেগড়ে। এই পদ্ধতিতে হেগড়ে সম্প্রতি লোহা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন–—অবশ্যই এই উৎপাদন ছিল পরীক্ষামূলক। লোহার ব্যবহার শিল্পক্ষেত্রে তো বটেই, অরণ্য পরিষ্কার করে আবাদী জমি প্রস্তুত করার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

লোহার ব্যবহারের প্রসার কতটা ছিল, তার পরিচয় অপর এক জাতীয় সাক্ষ্য দিয়েও বোঝানোনা যায়। আঃ খ্রীঃ পূঃ ৮০০ থেকে সমাজে যখন লোহার ব্যবহার অপেক্ষাকৃত বেশী হল তখন একই সঙ্গে এক বিশেষ ধরণের মৃৎপাত্র আত্মপ্রকাশ করে। অনুসন্ধান ও উৎখনন থেকে এই জাতীয় মৃৎপাত্রের সন্ধান বহুল পরিমাণে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এই মৃৎপাত্র ধূসর রঙের, তার ওপর থাকত চিত্রিত নকশা; মৃৎপাত্রগুলি কুমোরের চাকায় তৈরী; তাদের পরিমাপ ও গুণগত উৎকর্ষ একটি নির্দিষ্ট মান বজায় রাখত। পুরাতত্ত্বের পরিভাষায় এই মৃৎপাত্রগুলি ‘চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র’ বা ‘পেন্টেড গ্রে ওয়ার’ নামে অভিহিত। পাত্র তৈরীর কারিগরী কৌশল ও দক্ষতায় যে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল, মৃৎপাত্রগুলি পরীক্ষা করলে সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। পুরাতাত্ত্বিকরা মোটামুটি সহমত যে, প্রাচীনতম লোহার অস্ত্র ও চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের স্রষ্টা ও ব্যবহারকারীরা প্রায় সমসাময়িক মানুষ। আবার লোহার উপকরণ ব্যবহারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সঙ্গে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের কালগত ও বিষয়গত নৈকট্য আছে। অর্থাৎ লোহার অস্ত্রশস্ত্র তৈরী, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের আবির্ভাব ও প্রসার এবং পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের সৃষ্টি মোটামুটি সমকালীন ঘটনা। এর ফলে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকে পাওয়া তথ্যাদি পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে যাচাই করা চলে। তা ছাড়া যেহেতু লৌহ উপকরণাদি ও চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সমকালীন অতএব কোনও প্রত্নক্ষেত্রে একটির উপস্থিতি অপরটির অস্তিত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে; অপর উপাদানটির চাক্ষুষ প্রমাণ না থাকলেও তার ব্যবহার অনুমান করে নেওয়া যায়।

চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৪৬ সালে যখন উত্তরপ্রদেশের বেরিলীর কাছে অহিচ্ছত্র-তে উৎখনন চলছিল। কিন্তু ঐ সময় অন্যান্য প্রত্নবস্তুর যথার্থ বিচার না হওয়ায় তার প্রকৃত তাৎপর্য ধরা পড়েনি। হরিয়ানার রোপার-এ চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র পাওয়া গেল এমন এক স্তর থেকে যেটি হরপ্পা (২৩০০-১৭৫০ খ্রীঃ পূঃ) ও আদি ঐতিহাসিক পর্বের (খ্রীঃ পূঃ ৬০০- খ্রীঃ ২০০) মধ্যবর্তী পর্যায়ে ছিল। অর্থাৎ চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের আবির্ভাব ও ব্যবহার নিঃসন্দেহে হরপ্পা সংস্কৃতির পরে ও খ্রীঃ পূঃ ৬০০-এর আগে। এই সময়টিই সাধারণভাবে বৈদিক যুগ বলে প্রসিদ্ধ। আগেই বলা হয়েছে ঋগ্বেদের সমকালীন প্রত্নবস্তু সংখ্যায় অল্প ও ঐ প্রত্নবস্তুর মধ্যে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র দেখা যায় না। অর্থাৎ চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র মূলত ঋগ্বেদের পরবর্তী; অতএব তা পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের সমকালীন।

নোহ্‌-তে যে স্তর থেকে প্রাচীনতম লৌহ অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কৃত হয়, সেই স্তরেই (খ্রীঃ পূঃ ১১০০-৯০০) চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের অস্তিত্ব লক্ষিত হয়। তবে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের প্রকৃত ব্যাপকতা ও বিস্তার ঘটে কিছুটা পরবর্তীকালে, খ্রীঃ পূঃ ৯০০ থেকে খ্রীঃ পূঃ ৫০০ অবধি। এই পর্বের মৃৎপাত্রগুলি নিন্মোক্ত প্রত্নক্ষেত্র থেকে পাওয়া গিয়েছে: নোহ্‌, যোধপুর, ভগবানপুর, দাধেরী, হস্তিনাপুর, অত্রঞ্জিখেড়া, লালকেল্লা, জাখেড়া, পানিপথ, ইন্দ্রপ্রস্থ, মথুরা, বৈরাট, সোণপুর ও আলমগীরপুরে। অর্থাৎ চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র ও সংশ্লিষ্ট বস্তুগত সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান (উত্তরাংশ), গঙ্গা-যমুনার বিভাজন রেখা ও গঙ্গা-যমুনা দোয়াব এলাকায়। চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, এমন প্রত্নক্ষেত্র এখন অবধি সংখ্যায় সাতশ’: এগুলি প্রধানত শতদ্রু ও উত্তরগাঙ্গেয় উপত্যকায় ছড়িয়ে আছে। কেবল সরস্বতী-দৃষদ্বতী দ্বারা বিধৌত এলাকাতেই–—এর মুখ্য অংশ বর্তমান হরিয়ানার অন্তর্গত–—আছে এ জাতীয় দুইশ পঁচাশিটি প্রত্নক্ষেত্র। বেশ কয়েকটি প্রত্নক্ষেত্রে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের স্তরটি তিন থেকে চার মিটার গভীর। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ঐ মৃৎপাত্রের স্রষ্টা তথা ব্যবহারকারীরা হরিয়ানা-তে দীর্ঘস্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছিলেন। এই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের সঙ্গে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া বসতি স্থাপনের তথ্য চমৎকার খাপ খেয়ে যায়। ইতিপূর্বেই দেখানো হয়েছে যে সরস্বতী-দৃষদ্বতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলই ‘ব্রহ্মাবর্ত’ বা ‘ব্রহ্মর্ষি দেশ’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। সেখানে যে ব্যায়ী কৃষিজীবী সমাজের পত্তন ঘটেছিল, তা-ও আগেই বলা হয়েছে।

চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রগুলির গড়ন ও চুল্লীতে পোড়াবার কারিগরী কৌশল যথেষ্ট উন্নতমানের। মূলতঃ বাটি থালা জাতীয় পাত্র ও তৈজসপত্র পাওয়া গিয়েছে। বাটিগুলি কম বা বেশী গর্তযুক্ত, দুরকমই দেখা যায়। ধূসর গাত্রবর্ণের উপর বিচিত্র রঙের নানা নকশা আঁকা হত: খাড়াখাড়ি ও আড়াআড়ি রেখা, প্যাঁচানো ও বৃত্তাকার রেখা, বক্ররেখা ও সারি সারি বিন্দু দিয়ে পাত্রগুলি অলঙ্কৃত।

কষিজীবী সমাজের পত্তন ঘটায় কারিগরী দক্ষতার বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল একথা মানতে দ্বিধা নেই: লোহার ব্যবহার ও ধূসর চিত্রিত মৃৎপাত্রের নির্মাণ সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। এই দুই শিল্প ছাড়াও আরও নানা রকম শিল্পের কথা পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যাবে। ঋগ্বেদে বর্ণিত শিল্পের তুলনায় পরবর্তী বৈদিক আমলের শিল্প সংখ্যায় ও বৈচিত্র্যে উভয়তই এগিয়ে গিয়েছিল।

অন্যতম মুখ্য শিল্প বস্ত্রনির্মাণের ক্ষেত্রে ঋগ্বেদের কাল থেকে ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। ‘বাস’ ও ‘অধিবাস’ ছাড়া (যা ঋগ্বেদেও উল্লিখিত) ব্যবহৃত হত ‘নীবি’ (অন্তর্বাস)। শতপথ ব্রাহ্মণ থেকে মনে হয় পশম আগের মতই বস্ত্রশিল্পের প্রধান উপকরণ ছিল। তাই ‘ঊর্ণসূত্র’ বা পশমের সুতোর কথা অনেকবার সংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে জানা যায়। পশমের পোষাক রঞ্জিত ও রঙবিহীন, দুভাবেই তৈরী হত। যজ্ঞের সময়ে পরিধেয় পোষাকের মধ্যে ছিল ‘তার্প্য’ (যা পরে তর্পণ করা হয়) ও উষ্ণীষ।

পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে কারিগরী শিল্পের বিস্তৃততম তালিকাটি পাওয়া যাবে যজুর্বেদের অন্তর্গত বাজসনেয়ী সংহিতায় (অধ্যায় ৩০)। এই তালিকার মধ্যে আছে: (১) ‘কৌলাল’ (=কুমোর), (২) ‘কর্মার’ (=কামার), (৩) ‘মণিকার’ (=গহনা নির্মাতা) ‘ইষুকার’ (=তীরনির্মাতা), (৫) ‘ধনুকার’ (ধনুক নিমার্তা) (৬) ‘জ্যাকার’ (=ধনুকের ছিলা তৈরীর কারিগর), (৭) ‘রজ্জ্বসর্জ’ (রঞ্জু বা দড়ি বানাবার কারিগর), (৮) ‘সুরাকার’ (=সুরাপ্রস্তুতকারী), (৯) “বাসঃপল্লূলী’ (=রজক), (১০) ‘রঞ্জয়িত্রী’ (কাপড় রঙ করার কাজে নিযুক্ত নারী), (১১) ‘চৰ্ম্মম্ন’ (চর্মকার), (১২) ‘হিরণ্যকার’ (=স্বর্ণকার) (১৩) ‘ধীবর’ (=জেলে), (১৪) ‘হস্তিপ’ (হস্তী পালক), (১৫) ‘অশ্বপ’ (অশ্বপালক), (১৬) ‘গোপালক’ (=রাখাল), (১৭) ‘সূত’ (নট), (১৮) ‘শৈলুষ’ (=গায়ক) ও (১৯) ‘মৃগায়ুমন্তক’ (=ব্যাধ/শিকারী)। এই তালিকায় যেমন আছে বিভিন্ন কারিগরের কথা, তেমনই দেখা যাবে বিভিন্ন পেশাদারী বৃত্তির কথা–—ঋগ্বেদে যার দেখা পাওয়া দুর্লভ। এই শিল্পগুলির মধ্যে কর্মকার ও কুম্ভকারের ক্রিয়াকলাপের চাক্ষুষ পরিচয় লোহার হাতিয়ার ও চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র থেকে জানা যায়। একটি উল্লেখযোগ্য পেশা হিসেবে চিকিৎসক বা ‘ভিষক’কে বাজসনেয়ী সংহিতা ও তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে (৩. ৪. ৪. ১.) উল্লেখ করা হয়েছে। অথর্ববেদে ‘পৌষ্টিকানি সূত্রানি’-তে বহুরকম ব্যাধি ও তার নিরাময়ের কথা আলোচিত। মনে হয়, চিকিৎসা সংক্রান্ত ধারণায় ক্রমোন্নতি ঘটছিল; তার ফলে সমাজে চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বও বোধহয় বাড়ছিল।

॥ ৫ ॥

কৃষি অর্থনীতির পত্তন, কারিগরী শিল্প ও বিবিধ পেশার বিকাশের মধ্যে যে অর্থনৈতিক উন্নতির চিত্রটি দেখা যায়, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাণিজ্যের অগ্রগতিও আমাদের নজর এড়ায় না। ব্যবসায় বাণিজ্য সাধারণভাবে বৈশ্যের বৃত্তি বলে চিহ্নিত। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যেই শ্রেষ্ঠী শব্দটি প্রথম দেখা যায় তার অর্থ অত্যন্ত ধনী বণিক। বাণিজ্যকর্ম থেকে যে প্রচুর ধনলাভ সম্ভব, এমত ধারণা বোধহয় আলোচ্য যুগে গড়ে উঠেছিল। যজুর্বেদে ‘বাণিজ’ কথাটি বণিজের (=বণিক) পুত্র হিসেবে ব্যবহৃত। কথাটির তাৎপর্য এই যে বণিকের বৃত্তি সম্ভবত বংশানুক্রমিক হবার দিকে ঝুঁকছিল। বাণিজ্যের প্রসার না ঘটলে ঐ বৃত্তি বংশানুক্রমিক হয়ে ওঠা কঠিন। অথর্ববেদে একটি মন্ত্রতে বলা হয়েছে কিভাবে বাজারে দরদাম করে সুলভে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হবে। ঋগ্বেদে ‘সমুদ্র’ কথার অর্থ নিয়ে ও সমুদ্রযাত্রার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক মহলে যত বিতর্কই থাক না কেন, পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে সমুদ্র কথাটি যে সাগরকে বোঝাত, এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। শতপথ ব্রাহ্মণে ‘পূর্ব’ ও ‘পশ্চিম’ সাগর (বঙ্গোপসার ও আরব সাগর?) পৃথক জলরাশি হিসেবে বর্ণিত। বাণিজ্যের জন্য সমুদ্র পাড়ি দেবার উল্লেখ ও সম্ভাবনা পরবর্তী বৈদিক আমলে অল্পই; তবে ঋগ্বেদের তুলনায় লেনদেন বেশী হবার দরুন সমুদ্রযাত্রার প্রয়োজন অনুভব করা একেবারে অসম্ভব না-ও হতে পারে। যাতায়াতের পথ যে সর্বদা সুগম ছিল না, অথর্ববেদে ‘বি-পথ’ (=বন্ধুর পথ) কথাটি তারই ইঙ্গিতবাহী।

বাণিজ্যের বিকাশের আর একটি লক্ষণ ‘কুসীদ’ ও ‘কুসীদিন’ শব্দের প্রয়োগ (শতপথ ব্রাহ্মণ ও তৈত্তিরীয় সংহিতা)। কুসীদ’ কথার অর্থ ঋণ ও ‘কুসীদিন’ বলতে সুদের ব্যবসায়ীকে (উত্তমর্ণ) বোঝায়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘কৃষ্ণল’, ‘শতমান’ প্রভৃতি শব্দের প্রতি পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। ‘কৃষ্ণল’ ওজনের একটি একক বিশেষ। একশত কৃষ্ণল ওজনের স্বর্ণখণ্ডকে ‘শতমান’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে ‘কৃষ্ণল’ ও ‘শতমান দুই প্রকার মুদ্রার নাম। কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্যের প্রয়োজনে বিনিময় প্রথার বদলে ধাতব মুদ্রার প্রচলন ছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ও বিতর্ক থাকা স্বাভাবিক। কারণ ভারতে এতাবৎ আবিষ্কৃত প্রাচীনতম ধাতব মুদ্রাগুলি কোনওক্রমেই খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতকের আগে নয়। তা ঋণদানের কথা মেনে নিলেও এই ঋণ প্রথা যে ধাতব মুদ্রাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তা প্রমাণ করা দুরূহ।

॥ ৬ ॥

পশুচারণের অর্থনীতি থেকে স্থায়ী কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটায় বস্তুগত সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি দেখা দিল। সেই সঙ্গে আর্থ-সামাজিক জটিলতাও বাড়ল। পশুচারণকারী মানুষ কৌম-গোষ্ঠী শাসিত সমাজে মোটামুটি আর্থিক ও সামাজিক সমতা লাভ করে। কিন্তু কৃষিজীবী সমাজে সমানাধিকারের ধারণা সাধারণত জনপ্রিয় হয় না; অর্থনৈতিক বৈষম্য কৃষিজীবী সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য সামাজিক বিভাজন ও বিভেদের রেখাকে স্পষ্ট করে তোলে। ঋগ্বেদে বর্ণব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল কি না সন্দেহের বিষয়, কিন্তু পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বর্ণ কথাটি সামাজিক ভাগ বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়েছে; চতুর্বর্ণের অস্তিত্বও প্রকট। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণের উপস্থিতি ও পারস্পরিক তারতম্য সম্বন্ধে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য অধিকমাত্রায় সচেতন। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে সামগ্রিকভাবে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়কে সামাজিক অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে; আর বৈশ্য ও শূদ্রের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। উচ্চ-নীচ ভেদ সমাজে প্রকট হলে সামাজিক সুস্থিতি বজায় রাখার জন্য সাধারণত রাজনৈতিক কর্ত্তৃত্বের হাতে অধিকতর ক্ষমতা জমতে থাকে। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রাজার ক্ষমতাবৃদ্ধির নিশ্চিত প্রমাণ রয়েছে। সাধারণ রাজা ও সম্রাটের মধ্যে পার্থক্য বিষয়ে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে সচেতন দৃষ্টিভঙ্গী দেখা যায়। সম্রাট যে রাজার তুলনায় অনেক বেশী ক্ষমতাবান এই ধারণাও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে সমর্থিত। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতেও যজুর্বেদে রাজসূয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ, ঐন্দ্রমহাভিষেক প্রভৃতি যাগযজ্ঞের যে বিস্তৃত বর্ণনা ও বিধিনিষেধ লিপিবদ্ধ আছে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজকীয় ক্ষমতা ও প্রতাপ বৃদ্ধির প্রতি জোরালো মদত দেওয়া। রাজা তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যেমন তাঁর সামরিক সাফল্যের উপর নির্ভর করতেন, তেমনই তাঁর অন্যতম সহায় ছিলেন ব্রাহ্মণ তথা পুরোহিত সম্প্রদায়। সমগ্র ব্রাহ্মণ ও সংহিতা সাহিত্যে রাজা ও পুরোহিতের ভিতর পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভূরিপরিমাণ দৃষ্টান্ত আছে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের ভিতর সম্পর্ক মূলত পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর আশ্রয় করে ছিল। ক্ষত্রিয় তাঁর রাজনৈতিক প্রতাপ দৃঢ় ও স্থায়ী করার জন্য পুরোহিত শ্রেণীর কাছ থেকে ভাবাদর্শগত সমর্থন আদায় করতেন; আবার পুরোহিত শ্রেণী রাজ অনুগ্রহ লাভ করেই তাদের সামাজিক প্রাধান্য বজায় রাখতে পারত। তবে এই দুই উচ্চবর্ণের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক থাকলেও, কখনও কখনও রেষারেষি দেখা দিত। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ তো স্পষ্টতই ক্ষত্রিয়কে বর্ণশ্রেষ্ঠ বলে মনে করে: যদিও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যের অধিকাংশ গ্রন্থে ব্রাহ্মণের সামাজিক মর্যাদা সর্বোচ্চ বলে স্বীকৃত।

বর্ণবিভক্ত সমাজে বৈষম্য ও ক্ষমতার বিন্যাস বুঝতে গেলে উদ্বৃত্ত সম্পদ সংগ্রহের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা দরকার। এতে সন্দেহ নেই যে, ঋগ্বেদের তুলনায় পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছাপ দেখা যায়। কৃষিজীবী সমাজে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সামর্থ্যও স্বাভাবিক ঘটনা। রাজকীয় প্রতাপ ক্রমবর্দ্ধমান হওয়ায় উদ্বৃত্ত সামাজিক ধনসম্পদ আহরণ করার প্রথম প্রয়াস এই যুগে প্রকট হয়। পশুচারণের অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সম্ভাবনা বিরল, তাই কর মারফৎ ঐ উদ্বৃত্ত উৎপাদন রাজনৈতিক শক্তির হস্তগত হওয়া অত্যন্ত কঠিন। তাই ঋগ্বেদে রাজা নিয়মিত কর আদায়ে অধিকারী নন। তিনি যে ‘বলি’ পেতেন, তা কোনও নির্দিষ্ট কর নয়; কৌমের মানুষ স্বেচ্ছায় তাঁদের লুণ্ঠিত বা অর্জিত সম্পদের একাংশ রাজাকে দিতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রাজার অন্যতম অভিধা হল ‘বলিহৃৎ’, অর্থাৎ বলি আহরণকারী ব্যক্তি। ‘বলি’ আহরণ সীমিত হওয়ায় তার চরিত্রে বদল ঘটল, যা ছিল প্রজাদের তরফ থেকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দান, তা কালক্রমে হয়ে উঠল বাধ্যতামূলক ও আবশ্যিক কর। উদ্বৃত্ত সম্পদের উদ্ভব ‘বলি’-র চরিত্র পাল্টানোর অন্যতম প্রধান কারণ।

যেহেতু ব্রাহ্মণ পেশাদারী পুরোহিত বৃত্তিতে নিযুক্ত ফলে ব্রাহ্মণ সরাসরি উৎপাদনে যুক্ত নন: ক্ষত্রিয় যুদ্ধ ও দেশরক্ষায় ব্যাপৃত থাকেন বলে তিনিও উৎপাদনে অংশ নেন না। ফলে প্রধান ধনোৎপাদক সম্প্রদায় হিসেবে উদ্ভূত বৈশ্য বর্ণ ও কিছু পরিমানে শূদ্ররা। রাজকীয় প্রতাপ এই ধনোৎপাদক সম্প্রদায়ের উপরই সবার্ধিক অনুভূত হত। পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ অনুযায়ী রাজা মানুষের: উপর আধিপত্য করেন (‘মনুষ্যানামধিপতি’)। সেই কারণে বৈশ্য-এর উপর কর দাবি করা হতে থাকে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বৈশ্যের বর্ণনাটি এইরকম: বৈশ্য অন্যের জন্য বলি প্রদান করে। তাকে অপরে ভক্ষণ করে, তাকে যথেচ্ছ অত্যাচার করে যায় (‘অন্যস্য বলিকৃদন্যসাদ্যো যথাকামজ্যেয়ঃ’)। এই বলি আহরণের অধিকারী রাজা বা ক্ষত্র। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘রাজ্য’, ‘রাষ্ট্র’, ‘ক্ষত্র’ শব্দ তিনটি পৃথকভাবে উল্লিখত হলেও তারা প্রায় সমার্থক হিসেবেই বিবেচিত। ক্ষত্রিয় তথা রাজার ব্যাপক ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে বৈশ্যের কাছ থেকে শুধু উদ্বৃত্ত সম্পদই আহৃত হচ্ছে না, রাজন্য (রাজা ও শাসকগোষ্ঠী) ও বৈশ্যের মধ্যে সামাজিক ব্যবধানও বাড়ছে। তৈত্তিরীয় সংহিতায় বৈশ্যের উপর রাজন্যের আধিপত্যের পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। শতপথ ব্রাহ্মণে ‘বিশ্‌’-এর উপর ক্ষত্রিয়ের আধিপত্য ও অত্যাচার এবং পীড়নের প্রতি সমর্থন লক্ষ্যণীয়! রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নানা প্রকার যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় এই প্রার্থনা উচ্চারিত যে তিনি যেন অধিক পরিমাণে ‘বলি’ লাভ করেন। অথর্ববেদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে রাজাকে যেন তাঁর প্রাপ্য গ্রাম, অশ্ব, গবাদি পশুর অংশ দেওয়া হয়। এই অংশ দাবী করার ঘটনাটি রাজস্ব আদায়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। গ্রামের উপর প্রাপ্য অংশের তাৎপর্য হল গ্রামে উৎপন্ন কৃষিজাত বস্তুর উপর রাজস্ব দাবী করার সূচনা ঘটেছে। ঋগ্বেদে রাজা এইরকম রাজস্ব আদায়ের অধিকারী নন; গ্রামাঞ্চল থেকে কৃষিজাত উদ্বৃত্ত সংগ্রহের উল্লেখ নেই বললেই চলে। উদ্বৃত্ত সংগ্রহের জন্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর অস্তিত্বও পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে জানা যায়: রাজস্ব সংগ্রহকারীকে ‘সংগ্রাহীতৃ’ বলা হয়েছে। রাজকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য অধিকসংখ্যক কর্মচারীর প্রয়োজন দেখা দেয়। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে রাজকর্মচারীর তালিকা মূলত পাওয়া যাবে রাজকীয় যজ্ঞানুষ্ঠানের বর্ণনার সময়। কৃষিজাত উদ্বৃত্তের উপর রাজকীয় অধিকার তো ছিলই, ঐ উদ্বৃত্ত দিয়ে রাজকর্মচারী/প্রশাসকদের ভরণপোষণ তথা ব্যয়নির্বাহ বোধহয় সম্ভব হত। উদ্বৃত্ত সম্পদ সংগ্রহকারীরূপে রাজার আগ্রাসী ভূমিকা এই আমলে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে ওঠায় রাজার অন্যতম অভিধা ছিল বিশামত্তা অর্থাৎ যিনি ‘বিশ’ বা প্রজাকুলকে ভক্ষণ করেন; অপরদিকে বৈশ্যকে রাজার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে খাদ্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ রাজশক্তি ও প্রজার ভিতর খাদ্য-খাদক সম্পর্ক দেখা দিচ্ছিল। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য আরও বেশী করে দেখা যায় শূদ্রের ক্ষেত্রে। যজ্ঞানুষ্ঠান থেকে শূদ্রকে দূরে রাখার সযত্ন প্রয়াস পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বারবার দেখা যাবে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে শূদ্রের অবস্থা বৈশ্যের তুলনায় অনেক হীন; তাকে অপরে পীড়ন করতে পারে (‘অন্যস্য প্ৰেষ্যঃ’); তাকে জমি থেকে যে কোনও সময় উৎখাত করা যাবে (যথাকামোত্থাপ্যঃ) এমনকি তাকে যথেচ্ছ হত্যাও করা যায় (‘যথাকামবধ্যঃ’)। এই যুগ থেকেই কায়িক শ্রম দ্বারা ধনোৎপাদনে নিযুক্ত সামাজিক গোষ্ঠীগুলির প্রতি তাচ্ছিল্য বাড়তে থাকে; অন্যদিকে উদ্বৃত্ত ধনের উপর দাবী যে গোষ্ঠীগুলি জানত বা উদ্বৃত্ত ধনের দ্বারা জীবন নির্বাহ করত, সেই ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ বর্ণের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমশই ব্যাপক হচ্ছিল।

কৃষিজীবী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের বহু সুযোগ দেখা দিল। কৃষির প্রতিষ্ঠা এই যুগে হওয়ার পর থেকে ভারত ইতিহাসে আরও কখনওই তার স্থান গৌণ হয়ে যায়নি। স্থায়ী কৃষিপ্রধান সমাজে জীবিকার নিরাপত্তা ও নিশ্চিতিক্রমে পেশাদারী ও কারিগরী বৃত্তির উদ্ভব ঘটাতে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যের বৃদ্ধি ঘটায় সামাজিক তারতম্য ও রাষ্ট্রশক্তির বিকাশের সুযোগও পাশাপাশি দেখা দিল। খ্রীঃ পূঃ ১০০০ থেকে খ্রীঃ ৬০০ অবধি গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষি অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী ঘটনা, যার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হয়ে দেখা দেয় ও যা পরবর্তী আমলের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাস্রোতকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *