তৃতীয় অধ্যায় – কল্যাণ রাষ্ট্রের সংকট

তৃতীয় অধ্যায় – কল্যাণ রাষ্ট্রের সংকট

সামাজিক সুবিচারের বিষয়ে যারা অতিমাত্রায় সচেতন তারা প্রায়ই অনুভব করেন যে, তারা যেন বধিরের সাথে কথা বলছেন। -মাইকেল প্রাউজ

পুঁজিবাদী বিশ্বে কল্যাণ রাষ্ট্রের আবির্ভাব একটি ইতিবাচক ও শুভ ঘটনা। মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণায় গতিশীলতা সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ ও মন্দা এবং সমাজতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ ধারণা ব্যাপ্তি লাভ করে। কল্যাণ রাষ্ট্রের পুঁজিবাদের অতিরিক্ত কুফলগুলো প্রমাণিত করে সমাজতন্ত্রের আবেদন হ্রাস করা। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ, শ্রমিক, পুঁজিবাদী নিবিশেষে সবাই এ ধারণা দ্বারা আকৃষ্ট হয়। কল্যাণ রাষ্ট্রের অনেক সমালোচকের মতে কল্যাণ রাষ্ট্র হচ্ছে, ‘শাষক শ্রেনীর কাছ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষের কাছে ক্ষমতার হাত বদল না ঘটিয়ে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে একটি সামাজিক ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি’।

‘লেইজে ফেয়ার’ পুঁজিবাদে রয়েছে সামাজিক ডারউইনবাদের মমার্থ তথা শক্তিশালীদের টিকে থাকার দর্শন। অপরদিকে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার পশ্চাতে এ ব্যবস্থা থেকে সরে আসার কথা বলা হয়েছে। এ বিশ্বাস এতে জয়লাভ করল যে, ব্যক্তিমানুষের কল্যাণ বিধান বাজারব্যবস্থার শক্তিসমূহের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার খেয়ালের উপর ছেড়ে দেয়া যায় না।

মানুষের দারিদ্র্য ও স্বীয় প্রয়োজন পূরণের অবমতা শুধুমাত্র ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব ব্যর্থতা মাত্র নয়, বরং তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফল। এ ধারণা, বিশ্লেষণ ও বিশ্বাস অর্থনীতির মূল ধারায় স্বীকৃতি লাভ করল। নিজস্ব ত্রুটির কারণে মানুষ বেকার, অর্ধবেকার বা শ্রমের কম মূল্য পাচ্ছে না, বরং তার অন্য কারণ রয়েছে। তাই সীমিত সামর্থের মানুষদের আধুনিক সমাজে সুন্দর ও দক্ষভাবে বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ণ, যোগাযোগ প্রভৃতি সামাজিক সু্যোগ সুবিধা প্রদানের দ্বার উন্মোচন করা এবং শিল্প দুর্ঘটনা, অঙ্গহানি ও বেকারত্বের মতো সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে তাদের সামাজিক প্রতিরক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন। কল্যাণ রাষ্টের দর্শন রাষ্ট্রীয় নীতিমালার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসাবে পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং সম্পদ ও আয়ের সুষম বন্টনকে নির্ধারণ করেছে। এ দর্শন লেইজে-ফেয়ার পূঁজিবাদী বা কীনেসীয় অর্থনৈতিক মতবাদের বিপরীতে রাষ্ট্রের ব্যাপক ও সক্রিয় ভূমিকার তত্ত্ব প্রচার করল।

কল্যাণ রাষ্ট্রের ধরণ এবং কার্যাবলি সম্পর্কে নানা মত রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকগণ এ সম্পর্কে কোনো ঐক্যমত্যে পৌছুতে পারেননি। দশকের পর দশক যাবত এ বিষয়ে এত বেশি আলোচনা করা হয়েছে যে, টিটমাস কল্যাণ রাষ্ট্রের সংজ্ঞাকে ‘অবর্ণনীয় বিমূর্ততা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কল্যাণ রাষ্ট্রের নানা ধরনের বাস্তব উদাহরণ রয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুইডেন পর্যন্ত বিস্তৃত।

কল্যাণ রাষ্ট্র উদারনীতিবাদের দর্শন বা বাজার অর্থনীতির অলঙ্ঘনীয়তার পোশাক ছেড়ে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পারেনি। সেখানে মূল্যবোধ নিরপেক্ষ উদারনীতিবাদের মতাদর্শ অব্যাহত রইল। বাজারব্যবস্থার যে ত্রুটি রয়েছে তা সরকারি হস্তক্ষেপ দ্বারা দূর করা হলে গণতান্ত্রিক সমাজবাদ বিভিন্ন বঞ্চিত উৎপদান খাতে সম্পদের দক্ষ বণ্টন নিশ্চিত করতে সমর্থ হবে বলে ধরে নেয়া হলো। জনগণকে উপযোগিতামূরক দ্রব্য ও সেবা সরবরাহ করা হবে তথা বণ্টন খাতে সরকারের ভূমিকা অগ্রগণ্য হবে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল নাগরিক হবে সরকারি সুবিধার অংশীদার। সামাজিক অধিকার হিসেবে প্রথ্যেক ব্যক্তি মানুষের সরকারি সুবিধা প্রাপ্তির নীতি হবে সামাজিক ইনস্যুরেন্স কর্মসূচির ভিত্তি। এ নীতিমালা অনুসরণের যুক্তি হচ্ছে সাধারণ নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের যোগ্যতা ও প্রাপ্যতা যাচাই বাছাইয়ের জন্য ন্যায়সংগত ভিন্ন কোনো পথ খোলা নেই এবং এর ব্যত্যয় ঘটালে ‘প্যারিটো অপটিমালিটি’র মানদণ্ডই লঙ্ঘিত হবে।

কৌশল

কল্যাণ রাষ্ট্র তাই বাজারব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথা বলে না। বরং মনে করা হয় যে, রাষ্ট্রের বৃহত্তম ভূমিকা ‘লেইজে-ফেয়ার’ পুঁজিবাদ ত্রুটি দূরীকরণ এবং বাজারব্যবস্থার উন্নতি সাধনে সক্ষম হবে। কল্যাণ রাষ্ট্রের বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করে সে লক্ষ্য অর্জন করা যাবে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছয়টি প্রধান অস্ত্র হচ্ছেঃ

ক. নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবিধান,

খ. প্রধান শিল্পসমূহের জাতীয়করণ,

গ. শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন,

ঘ. রাজস্ব নীত,

ঙ. উচ্চ হারের অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধি ও

চ. পূর্ণ কর্মসংস্থান।

কল্যাণ রাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনে এ অস্ত্রগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।

(ক) নিয়ন্ত্রণমুলক বিধিবিধান

দ্রব্যসামগ্রীর মান, শৃঙ্খলা ও প্রতিযোগিতা বজায় রাখা এবং অন্যের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য বেসরকারি খাতকে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তনেরে জন্য কিছু মানদণ্ড বা ঐকমত্য প্রয়োজন যার ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়। যদি এ ধরনের সর্বজনস্বীকৃত মানদণ্ড বা ঐকমত্য না থাকে এবং এরূপ দ্বিধাবিভক্ত সমাজের প্রত্যেক শ্রেণী নিজস্ব স্বার্থে চালিত হতে থাকে, তবে রাষ্ট্রকে নানা স্বার্থের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করতে হয়। বিভিন্ন শ্রেনীর মাঝে রাজনৈতিক দরকষাকষির মধ্য দিয়ে সমঝোতামূলক যা কিছু সাব্যস্ত হয় তাই হয় রাষ্ট্রের কার্যাবলী। এ ক্ষেত্রে সর্বজনস্বীকৃত ঐকমত্য না থাকায় ভোটদানে প্রভাববিস্তার, সংবাদ মাধ্যমের উপর আধিপত্য, নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থবল, লবিং ক্ষমতা প্রভৃতি যে দল বা শ্রেণীর মধ্যে বেশি, সরকারি নীতি ও নিয়ন্ত্রণ তাদের অনুকূলে চলে যায়। আর্থিক ও সাংগঠনিক ক্ষমতা ও সম্পদ বিভিন্ন স্বার্থের শ্রেণীর মাঝে যেহেতু সমভাবে বণ্টিত নয়, তাই তাদের মাঝে আন্তঃশ্রেণী শক্তির ভারসাম্য বিরাজ করার কথা নয়। অবশ্য স্ট্রেচি, গলব্রেথ ও অন্যান্যের ধারণা বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থসমূহ একে অন্যকে প্রতিহত করে ন্যায়পরায়নতা আনয়ন করবে। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণীর মাঝে রাজনৈতিক দরকষাকষির মধ্য দিয়ে সমঝোতামৌলক যা কিছেু সাব্যস্ত হয় তাই হয় রাষ্ট্রের কার্যাবলী। এ ক্ষেত্রে সর্বজনস্বীকৃত ঐকমত্য না থাকায় ভোটদানে প্রভাববিস্তার, সংবাদ মাধ্যমের উপর আধিপত্য, নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থবল, লবিং ক্ষমতা প্রভৃতি যে দল বা শ্রেণীর মধ্যে বেশি, সরকারি নীতি ও নিয়ন্ত্রণ তাদের অনূকূলে চলে যায়। আর্থিক ও সাংগঠনিক ক্ষমতা ও সম্পদ বিভিন্ন স্বার্থের শ্রেণীল মাঝে যেহেতু সমভাবে বণ্টিত নয়, তাই তাদের মাঝে আন্তঃশ্রেণী শক্তির ভারসাম্য বিরাজ করার কথা নয়। অবশ্য স্ট্রেচি, গলব্রেথ ও অন্যান্যের ধারণা বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থসূহ এক অন্যকে প্রতিহত করে ন্যায়পরায়নতা আনয়ন করবে। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণীর মাঝে শক্তির দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, সরকারি নিয়ন্ত্রণ নীতি ধনী ও শক্তিশালীদের অনুকূলে চলে আসে। কেননা তাদের পক্ষে অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতার দ্বারা প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগানো, নির্বাচনী প্রচারণায় বিপুল অর্থব্যয় ও প্রভাবিত করার অন্যান্য পন্থা অবলম্বন করা সম্ভব হয়।

অধিকন্তু সঠিক আইন কাঠামো প্রণয়ন করা হলেও বিধিবিধানের কার্যকারিতার জন্য কেবল রাষ্ট্রীয় শক্তিই যথেষ্ট নয়। এর সাথে প্রয়োজন শক্তিশালী সামাজিক উদ্দীপনা শক্তি যা শুধু নৈতিক চেতনাসম্পন্ন সমাজেই আশা করা যায়। যদি বিধিবিধান মেনে চলার জন্য ব্যক্তি মানুষের মাঝে অভ্যন্তরীণ তাগিদ না থাকে, যত বাঁধনকষণ দিয়ে আইন রচনা করা হোক না কেন, আইনকানুন ফাঁকি দেবার বা ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্য মানুষ ছলেবলে চেষ্টা করে যাবে। সমাজের সামগ্রিক স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থকে ত্যাগ করার নৈতিক চেতনা ও মূল্যবোধ এবং লক্ষ্য সম্পর্কে ঐকমত্য ছাড়া আর্থ-সামাজিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুধুমাত্র রাষ্ট্র ও প্রশাসন যন্ত্রের শক্তির সাহায্যে আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন ও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যাবে বলে প্রত্যাশা করা আসলে একটি ভ্রান্তিবিলাস মাত্র। সেকুলার মতবাদ যা কল্যাণ রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি তাতে লক্ষ্য সম্পর্কে ঐকমত্য ও নৈতিক চেতনা- এ উভয় শক্তিকেই অস্বীকার করা হয়েছে।

পুঁজিবাদী সমাজের বিত্তশালী ও ক্ষমতাশালী শ্রেনীও সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রার মুখে বিকল্প হিসেবে কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাকে সমর্থন করে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে কল্যাণ রাষ্ট্র যখন রাজস্ব সংকটের মুখে পড়ল, তখন ব্যবসায়ী শ্রেণী রক্ষণশীল সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে বিধিবিধান শিথিলকরণের পক্ষে আওয়াজ তুলল। তারা যুক্তি দেখাল যে, বিধিবিধানের নিগড়ে অর্থনীতির স্বাচ্ছন্দ্য ও গতিশীলতা হ্রাস পায়, সরকারি ও বেসরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এতে সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, আর্থ-সামাজিক সুবিচারের প্রতি সুদৃঢ় সামাজিক অঙ্গীকার এবং ঐকমত্যসম্মত মূল্যবোধের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ন্যায়সংগত হিস্যা অন্যকে দেবার স্পৃহা ও প্ররণা ছাড়াই ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে য়িন্ত্রণমূলক বিধিবিধানের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক হাওয়া বদলের চাপে আইনকানুন যাই প্রবর্তন করা হোক না কেন, সময় ও ভিন্ন পরিস্থিতিতে ক্রমশ তা তার কার্যকারিতা হারাবে।

(খ) জাতীয়করণ

বড় বড় শিল্পসমূহ জাতীয়কাণের দাবিও ক্রমশ তার আবেদন হারিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহের অদক্ষতা এবং এসব প্রতিষ্ঠানের লোকসান কাটিয়ে ওঠার জন্যে বিপুল ভর্তুকি জাতীয়করণের প্রতি মোহমুক্তি ঘটিয়েছে। উপরস্তু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে বাজারব্যবস্থা দ্বারা নির্ণীত ও সংকটের কারণে সরকারি কোষাগারের পক্ষে এরূপ ভর্তুকির জন্যে অর্থ যোগান দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক পছন্দের চেয়েও সংকট কবলিত সরকারি অর্থব্যবস্থার প্রয়োজনেই বিশ্বব্যাপী ডান-বাম উবয় শিবিরেই বিরাষ্ট্রীয়করণের ধারা সূচিত হয়েছে। কোনো না কোনো বিরাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচি পশ্চিম ইউরোপে চালু হয়েছিল এবং এ ধারা জাপান, ভারত, লাতিন আমেরিকা, কানাডা, আফ্রিকা, এমনকি চীন, পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়েছে। স্পেনের প্রথম সমাজতান্ত্রিক সরকারের আমলেই বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে রক্ষণশীল সরকার বৃটেনে যে বিরাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচি শুরু করে, তাতে ১৯৮৮ সালের মধ্যে সরকারি কোষাগারে ১৭বিলিয়ন ডলারের অধিক জমা পড়ে। পরবর্তী ৩ বছরে এর পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হয়। ১৯৭৯ সালে জাতীয় আয়ে রাষ্ট্রীয়করণ নীতি ভবিষ্যতে আরো বেগবান হবে।

(গ) শ্রমিক আন্দোলন

ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, যাকে শ্রমিকের আয় বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের মহৌষধ মনে করা হতো, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকার সমস্যার উর্ধগতির কারণে তা গতি হারিয়ে ফেলল। ক্রমাগত মজুরি বৃদ্ধিকে ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী করা হলো। মজুরি হারের ক্ষেত্রে অনমনীয়তাকে বেকার সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। ফলে অনেক শিল্পোন্নত দেশে ট্রেড ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা বিপুলভাবে হ্রাস পেল। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকদের সম্পৃক্ততা হারিয়ে গেল। বৃটেনে যেখানে শ্রমিক আন্দোলন সবচেয়ে বেশি শক্তিশালীভাবে দানা বেধে উঠেছিল, সেখানে শ্রমিকদের বৃহদাংশ আর ট্রেড ইউনিয়নের সাথে সংযুক্ত রইল না। বৃটিশ শিল্প শ্রমিক ইউনিয়নে সদস্য পদ ২৪% কমে গেল, যখন চাকরির পরিমাণ কমলো ১৩%। বৃটিশ ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কনফেডারেশনের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৪০% এর কম; যারা সদস্য তারাও সক্রিয় নয়। তৃণমূল পর্যায়ে সম্পৃক্ততা শিথিল হয়ে গেছে। শ্রমিকরা ইউনিয়নের সাথে থাকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। দেখা যায়, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তার শক্তিশালী দুর্গের মধ্যেও দুর্বল হয়ে পড়েছে। পশ্চিম জার্মানী, জাপান ও ফ্রান্স যেখানে মাত্র ১৯% শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত সেখানকার অবস্থা আরো করুণ।

বর্তমান বেকার সমস্যার মুখে নিকট ভবিষ্যতে শ্রমিক ইউনিয়নের পুনরুদ্ধার সম্ভাবনা খুবই কম। শুধুমাত্র সরকারকেই দায়ী করা যথার্থ নয়। কেননা শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর বাড়াবাড়িও অনেকটা দায়ী। কিছু সংখ্যক শ্রমিক নেতার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা, তাদের অতিরিক্ত দাবিদাওয়ার ফলে সৃষ্ট সামাজিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া শিল্পপতিদের নিকট হতে সহযোগিতা ও জনসমর্থনের ভিতকে ধসিয়ে দিল।

আর্থ-সামাজিক ন্যায়নীতির প্রতি বিশ্বাসের কারণে শিল্পপতিগণ ট্রেড ইউনিয়নসমূহকে মেনে নেয়নি। বরং শ্রমিক ইউনিয়নগুলো স্থিতিশীল শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে অবদান রেখে শিল্পপতিদের উপকারে আসবে- এ বিশ্বাস থেকে তারা শ্রমিক ইউনিয়নকে মেনে নিয়েছিল। শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিক পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি উভয় পক্ষের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল, সমধর্মী শিল্পসমূহে একই ধরনের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে এ চুক্তি সহায়ক ছিল এবং এ চুক্তির মেয়াদের মধ্যে কোনোরূপ ধর্মঘটের কোনো অবকাশ ছিল না। ট্রেড ইউনিয়ন এভাবে অর্থনৈতিক গতি-প্রকৃতি ও স্থিতিশীলতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখল বা প্রকারান্তরে পুঁজি গঠন ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হলো। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বের দুর্নীতি এবং ধর্মঘটের সংখ্যাধিক্যে শিল্পপতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের মাঝে গড়ে ওঠা সমঝোতা ও সামাজিক চুক্তি ভেঙে পড়ল। ১৯৭৮-৭৯ সালের প্রবল অসন্তোষের সময় বৃটেনে এতবেশি ধর্মঘট সংঘটিত হলো যে, তাতে জনগণের দুর্দশা চরমে উঠল এবং ধর্মঘটের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠল। মিসেস থ্যাচারের রাজনৈতিক উত্থানের পশ্চাতে এটাও একটি কারণ। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধিতে কোনো অবদান রাখতে পেরেছিল কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। ১৯৪৭-১৯৬৭ এ দুই দশকে এ হার আর বাড়েনি। ১৯৮৭ সালে প্রকৃত মজুরির হার ছিল ১৯৬৮ সালের মজুরির অনুরূপ। ১৯৮১ সাল থেকে ঘন্টা প্রতি ন্যূনতম মজুরি হার ৩.৩৫ ডলারে অপরিবর্তিত রয়েছে। রক্ষণশীল নীতির প্রবল জোয়ার এবং নিম্নতম মজুরি হার নির্ধারণের আইনের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন হ্রাসের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক ইউনিয়ন মজুরি হারে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি আনয়নে সমর্থ হয়নি। মুদ্রাস্ফীতির ফলে গত এক দশকে মজুরি ৪.২৫ ডলারে বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত তা পুষিয়ে দিতে পারেনি, কারণ ন্যূনতম ৪.২৫ ডলার মজুরি বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। নিম্নতম মজুরির প্রকৃত মূল্য যদি এভাবে হ্রাস পেতে থাকে, তবে নিম্নতম মজুরির আইনের চেয়ে মুদ্রাস্ফীতির দাপটই অধিক প্রমাণিত হবে।

(ঘ) রাজস্বনীতি

সরকারি ব্যয়

রাজস্বনীতি কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠল। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজস্বনীতি অঙ্গ হিসেবে সরকারি ব্যয়, প্রগতিশীল করব্যবস্থা ও সরকারি ঋণকে ব্যবহার করা হলো। প্রতিরক্ষা, জনপ্রশাসন ও কতিপয় সেবা সরবরাহের মতো গতানুগতিক ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়কে লেইজে-ফেয়ার রাষ্ট্র ব্যবস্থাও স্বীকার করে নিয়েছে। কল্যাণ রাষ্ট্রে সরকারি ব্যয়ের পরিসীমাকে প্রসারিত করা হয়েছে, যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও অধিকতর আয়-ন্যায়পরায়নতা অর্জিত হতে পারে। এসব লক্ষ্য অর্জনে ক্রমবর্ধমান সরকারি দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চাশ বছরে সরকারি ব্যয় ও কর রাজস্বের মাত্রা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেকার ভাতার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা (Social Security Benefit), বয়স্ক ভাতা ও শিশু কল্যাণ ভাতার ন্যায় সামাজিক সাহায্য, অনুদান, খাদ্য ও জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ভর্তূকি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গৃহায়ন, যানবাহন প্রভৃতি গণসেবা সরবরাহের কারণে সরকারি ব্যয়ের মাত্রা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত উপযুক্ত সেবাসমূহ শুধুমাত্র গরীবদের প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সমাজের অন্যান্য শ্রেণীকেও বর্তমানে এগুলো সরবরাহ করতে হয়।

ওইসিডি দেশসমূহে ১৯৬০ সাল হতে ১৯৮২ সালের মধ্যে জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে সরকারি ব্যয় গড়ে ১৫% বৃদ্ধি পেয়ে ৪১.৩% এ দাঁড়য়েছে। ১৯৮৮ সালে তা ৪০% এ নেমে আসে। ১৯৮২ সালে নেদারল্যান্ডস ও সুইডেনে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে জাতীয় আয়ের ৭২% এবং ৬৬% এ পৌছে। ১৯৮৮ সালে তা ৫৮% এবং ৫৯% এ হ্রাস পায়। সরকারি ব্যয় ছিল সর্বনিম্ন পর্যায়ে সুইজারল্যান্ডে (জাতীয় আয়ের ৩০%)। যুক্তরাষ্ট্র সুইডেনের মতো কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার সাথে ততবেশি সম্পৃক্ত না হলেও সরকারি ব্যয় ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ১৯৪০ সালে সরকারি ব্যয়ের মাত্রা ছিল জাতীয় আয়ের ১০%, তা ১৯৮৬ সালে ৩৭% এ পরিণত হয়। ১৯৮৮ সালে সরকারি ব্যয় সামান্য কমে ৩৬.৩% এসে দাঁড়ায়। শুধুমাত্র মন্দা ও বেকারত্বের সময় সরকারি ব্যয় বেড়েছে তা নয়, বরং পূর্ণ কর্মসংস্থানের সময়েও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হয়। তাছাগা ভোগ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে যে প্রত্যাশার বিস্ফোরণ ঘটেছে, অধিকতর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া তা পূরণ করা সম্ভব নয়।

ওইসিডি দেশসমূহের সরকারি ব্যয় কাঠামোতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। একটি হচ্ছে প্রতিরক্ষা খাত ও কল্যাণমূলক সামাজিক সেবা দানের ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি এবং সরকারি বিনিয়োগ ব্যয় হ্রাস। অপরটি হচ্ছে সামগ্রিক ব্যয় হ্রাসের ক্ষেত্রে অস্থিতিস্থাপকতা। যেহেতু অধিকাংশ দেশে প্রবৃদ্ধির হার বেকরত্বের হারের চেয়ে বেশি নয়, সরকারি ব্যয় হ্রাসের যে কোনো পদক্ষেপ সামাজিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতা জন্ন দেবে। এসব কারণে সরকারি ব্যয় সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। অবশ্য সরকার ব্যয় হ্রাসের জন্য চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক লক্ষ্যসমূহের আলোকে অগ্রাধিকার নির্ধারণ ছাড়াই সরকার যখন যেখানে সুবিধা সেখানে সরকারি ব্যয় কাটছাঁটের নীতি অনুসরণ করেছে। তবে তাও বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আসল জায়গায় কাটছাঁট না করে কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাটঁছাটের প্রবণতাটাই লক্ষণীয়। সরকারি ব্যয় হ্রাসের খাত নির্ধারণ করতে গেলে সরকারি বিনিয়োগ ব্যয় এবং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে কল্যাণ খাতে ব্যয় হ্রাস করার প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত হয়ে পড়ে। তবে দেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সমর্থন ব্যাহত না করে এরূপ সরকারি ব্যয় হ্রাসের কর্মসূচি দীর্ঘমেয়াদে অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। তাই দেখা যায় বিপরীতটাই ঘটেছে। এসব কারণে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অনেক দেশের সরকারের পক্ষে বিশাল সরকারি ব্যয় হ্রাস করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

পূর্ব-পশ্চিমের উত্তেজনা হ্রাসের ফলে শান্তির ফসল হিসেবে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, সম্পদের অবমুক্তি ঘটেছে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সেই অবমুক্ত সম্পদের সঞ্চালনের ফলে উৎপাদন দক্ষতা ও ন্যায়পরায়নতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সাধারণভাবে সবাই যা অনুভব করেছে নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক সম্পাদকীয় ভাষায় তা হচ্ছে, ‘পেন্টাগণ ব্যয় হ্রাস সমীচীন বলে মনে করলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তা করতে অনীহা প্রকাশ করবে যতক্ষণ না তারা নিশ্চিত হবেন যে, এতে পেন্টাগণের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে না’। এতে দেখা যায়, পেন্টাগণের বিশাল বাজেটের ব্যয় হ্রাস চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর স্বার্থেই করা হয় না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা, অবকাঠামো পরিবেশ প্রভৃতি খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দের মাধ্যমেও সামগ্রিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা সম্পাদন করা সম্ভব। কিন্তু কতিপয় বিশাল কর্পোরেশন যারা প্রভূত রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী তারা অধিকতর সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার পক্ষপাতী।

কৃষি খাতে ভর্তুকি কৃষি পণ্যের দাম উর্ধমুখী রাখার মাধ্যমে বৃহৎ কৃষকদের সহায়তা করে এবং খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্যের দ্বারা দরিদ্র জনগণকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। কৃষিতে এ ভর্তুকির মাত্রা হ্রাস করা হলে সার্বিক অর্থনীতি লাভবান হবে। কিন্তু ওইসিডি দেশসমূহে ভর্তূকির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি ভর্তূকি ১৪.৭% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৫.৪%, ইউরোপীয়ান কমিউনিটিতে ৪৪.৩% থেকে ৪৯.৩% এবং জাপানে ৬৪.৩% থেকে ৭৫%। ফলে করদাতাদের উপর যে বিপুল চাপ সৃষ্টি হয়েছে তার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জাপানে ভর্তূকির পরিমাণও প্রায় সমপরিমাণ। সম্প্রতি কৃষি সেক্টরে সংস্কার সত্ত্বেও ইইসিতে কৃষি ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। খাদ্যদ্রব্যের উচ্চ মূল্য এবং উৎপাদনে অদক্ষতা বিবেচনা করলে এ খাতে পরোক্ষ ব্যয় আরো বেশি দাঁড়াবে। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান হতে দেখা যায়, ওইসিডি দেশসমূহের করদাতা ও ভোক্তাদের কৃষি খাতে ভর্তুকি হিসেবে প্রতি বছর ২৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে হচ্ছে। ফাইন্যানসিয়াল টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে দুঃখ করে বলা হয়েছে যে, কতিপয় বিশালাকৃতির কৃষি খামারের জন্য অগণিত মানুষকে বিশাল ভর্তুকির ভার বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু শিল্পোন্নত দেশেসমূহের রাজনীতিবিদগণ বৃহৎ কৃষি খামারসমূহের রাজনৈতিক আধিপত্যের কাছে এমনভাবে বন্দী যে, কৃষি ভর্তুকি সম্পর্কে উদ্বেগ ও আশংকার কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য ফলাফল আশা করা যায় না।

উচ্চমাত্রার কর এবং ঘাটতি

সরকার কর্তৃক কর আদায় বা ঋণ গ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমেই সরকারি ব্যয় বাড়ানো যেতে পারে। ওইসিডি দেশসমূহে করের পরিমাণ ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়ছে। এ দেশসমূহে ১৯৬০ সালে যে করের পরিমাণ ছিল জাতীয় আয়ের ২৭.৭%, তা ১৯৮৮ সালে ৩৮.৪% এ পরিণত হয়েছে। সর্বোচ্চ মাত্রা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ২৯.৮% ও তুরস্ক ২২.৯%। ফলে ‘Welfare State Backlash’ অভিধায় অভিষিক্ত কর-বিরোধী এক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

যেহেতু এ Backlash এর কারণে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সাথে কর বৃদ্ধি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই ঘাটতি পূরণের জন্য ঋণ গ্রহণের উপর সরকারকে অধিকতর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। ১৯৬০ সালে ওইসিডি দেশসমূহের বাজেট উদ্বৃত্ত ছিল জিডিপির ১.৩%। ১৯৮৪ সালে বাজেট ঘাটতি দাঁড়ায় জিডিপি’র ২%। বড় বাজেট ঘাটতির নানা প্রতিক্রিয়া রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ সুদের হার এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহ বাজেট ঘাটতির অন্যতম বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বাজেট ঘাটতি সরকারি সুদ পরিশোধের পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭৫ সালে সরকারি সুদের পরিমাণ ছিল সরকারি ব্যয়ের ৫%, যা ১৯৮২ সালে ১০% এ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেহেতু সরকারি ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, তাই সুদের হার যদি হ্রাস পেত তবে ঋণের ভার কিছুটা লঘব হতো। কিন্তু ১৯৮৮ সাল হতে সুদের হার বেড়েই চলেছে।

ক্রমবর্ধমান সরকারি ব্যয় যোগান দেবার জন্য উচ্চহারের কর ও ঋণের দ্বারস্থ হওয়া তাই সকল কল্যাণ রাষ্ট্রে সরকারি ব্যয়-ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের একটি সমস্যাকীর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর দিক হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ ঘাটতি আরো বেসরকারি খাতের সঞ্চয়কেই শুধু শুষে নেয়া হয়নি, বরং বৈদেশিক ঋণেরও দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এর ফলে শুধুমাত্র বেসরকারি খাতের বিনিয়োগই ব্যাহত হয়নি, প্রথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে ঋণগ্রস্থ দেশে পরিণত হয়েছে। যদি ঘাটতি অব্যাহত থাকে তবে বিদেশী পুঁজি আকর্ষণের জন্য সুদের উচ্চ হার বজায় রাখতে হবে যা শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও চলতি হিসেবকেই ক্ষতিগ্রস্থ করবে না, অন্যান্য দেশসমূহ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশকেও ক্ষতিগ্রস্থ করবে। সুদের হার বৃদ্ধির ফলে এদর ঋণের সুদ পরিশোধের বোঝা বেড়ে যাবে এবং অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় হতে উন্নয়নের অর্থ যোগান দেয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।

অসম ভর্তুকি

সরকারি ব্যয়, করের বোঝা ও ঘাটরিত পরিমাণ লাফিয়ে বেড়ে চললেও কল্যাণ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য-আয় ও সম্পদের বৈষম্য হ্রাস পেল না। বস্তুত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সকল প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে অক্ষুন্ন রেখে, সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে বৈষম্য হ্রাস সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিচালিত সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা সবার প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবহারের নীতির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। মানুষের আচরণ, প্রয়োজন, লক্ষ্য ও মূল্যবোধ কী হওয়া উচিত সমাজে তা নির্ধারিত না থাকার ফলে কল্যাণ রাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদী সরকারি ব্যয়ের পরিকল্পনা রচনা সম্ভব হয় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভর্তুকি প্রাপ্ত বিভিন্ন দ্রব্য ও সেবা খাতে সরকারি ব্যয় হতে যে সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি হয়, ধনী ও গরীবের তা হতে সমান ফায়দা আদায়ের সুযাগকে ইনসাফপূর্ণ নীতি বলঅ যায় না। ধনীর মোকাবিলায় গরীবকে সাহায্যের মাধ্যমে বৈষম্য হ্রাসের যে লক্ষ্য অর্জন সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে হওয়ার কথা, তা সাধিত হয়নি। অথচ সরকারি ব্যয়ের বোঝা সাধ্যের অতিরিক্ত হারে বেড়ে চলেছে। কল্যাণ সুবিধা পাওয়ার প্রকৃত যোগ্যতা এবং সরকারি খরচে ধনীদের কল্যাণ সুবিধা প্রদানের সামাজিক ব্যয় যদি সঠিকবাবে বিবেচনা ও নির্ধারণ করা হতো, তবে সম্ভবত একই বা কম সরকারি ব্যয় হতে গরীবদের জন্য অধিকতর সুবিধা সরবরাহ করা সম্ভব হতো। সুতরাং, দেখা যায় পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যে বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যে যেসব এডহক ভিত্তিক কল্যাণধর্মী কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, সেসবের কিছু কিছু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

জুলিয়ান লি গ্রান্ড সমাজের সামগ্রিক বৈষম্য কাঠামোর উপর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহায়ন ও যানবাহন খাতে সরকারি ব্যয়ের ফলাফল পরীক্ষা করে দেখেছেন। তাতে সরকারি ব্যয়ের প্রতি চারটির মাঝে একটি দ্বারা গরীবের চেয়ে ধনীরাই অধিক উপকৃত হয়েছে বলে দেখা গেছে। ফলে সরকারি ব্যয়ে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে তারতম্যমূলক সুবিধা গ্রহণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি। জুলিয়ান গ্র্যান্ড উপসংহারে উপনীত হন যে, কল্যাণ রাষ্ট্রের গৃহীত বৈষম্য হ্রাসের কর্মসূচিসমূহ ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং জোড়াতালি দেয়া কোনো কর্মসূচির সাহায্যে অবস্থার আর উন্নয়ন সম্ভব নয়। সার্বজনীন সুবিধা প্রদানের প্রবক্তা রিচার্ড লিটমাস বিনামূল্যে প্রদত্ত বৃটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচির ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মন্তব্য করেছেন যে, উচ্চ আয়ের লোকেরাই জানে এ সুবিধার সর্বোচ্চ সুযোগ কীভাবে নিতে হবে। ধনীরা বিশেষজ্ঞদের নিকট হতে পরামর্শ ও সেবা বেশি পেয়ে থাকে এবং উন্নত যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সমৃদ্ধ হাসপাতালের অধিকাংশ সিট তারাই পায়। মোটকথা বিশেষজ্ঞ শল্যচিকিৎসা, মাতৃসেবা ,মনোবিজ্ঞান চিকিৎসা ক্ষেত্রের সকল বিষয়ে দরিদ্র শ্রেণী থেকে ধনিক শ্রেণীই অধিক সুবিধা আদায় করতে পারে। গরীব মানুষেরা নিম্নমানের চিকিৎসা সুবিধা পায় এবং লাইনের শেষ মাথায় এসে তাদের দাঁড়াতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রেও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে শ্রেণী বৈষম্য হ্রাস পায়নি। সমাজের নিম্নশ্রেণীর অবস্থার কোনো উন্নয়ন ঘটেনি, বরং সুবিধাভোগী উচ্চ শ্রেণীর অবস্থার আরো উন্নতি ঘটেছে। বেশ কিছু সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ হতে দেখা গেছে, সাধারণ ভর্তুকি গরীবদের চেয়ে ধনীদের ভাগেই বেশি সুবিধা বয়ে আনে। ১৯৭৪ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর বৃটেনে শ্রমিকদল রুটি, দুধ, মাখন,পনির ময়দা ও চায়ের উপর যে ভর্তুকি প্রদানের প্রথা চালু করে তা পর্যবেক্ষণ করে উইট এবং নিউবোল্ড দেখিয়েছেন যে, এ খাদ্য ভর্তুকি নিম্নবিত্তদের চেয়ে উচ্চ বিত্তশালীদেরই বেশি সুবিধা প্রদান করেছে। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে খাদ্য ভর্তুকি নিম্নবিত্তদের চেয়ে উচ্চ বিত্তশালীদেরই বেশি সুবিধা প্রদান করেছে। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে খাদ্য ভর্তুকি ব্যাপক। গিয়র্গী ঝাকোলঝাই সরবরাহে হাংগেরীয় ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন যে, খাদ্য ভর্তুকির পরিমাণ বিশাল হলেও তার সামগ্রিক প্রভাব তুলনামূলকভাবে গরীবের স্বার্থের প্রতিকূলে।

রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহের দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য কম রাখায়ও একই অসম ফল পাওয়া গেছে। লি গ্রান্ড দেখিয়েছেন, যেহেতু ধনীরা গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, কয়লা, ডাক ও টেলিফোন অধিক ব্যবহার করে, বৃটেনে সত্তর দশকে মুদ্রাস্ফীতি রোধের জন্য এসবের উপর প্রদত্ত ভর্তুকির মাধ্যমে গরীবের চেয়ে ধনীরাই বেশি উপকৃত হয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে, কল্যাণ রাষ্ট্রে বিনামূল্যে বা ভর্তুকির মাধ্যমে কম মূল্যে দ্রব্য সামগ্রী সরবরাহ সম্প্রসারণ দরিদ্রের চেয়ে ধনীদেরই বেশি লাভবান করেছে। বৈষম্য তাই বরং বেড়েছে।

প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা

কল্যাণ রাষ্ট্রের রাজনীতির অপর অঙ্গ প্রগতিশীল করব্যবস্থাও অধিকতর কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি। প্রথম দিকে বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রগতিশীল করের প্রতি বিশ্বাস এত প্রবল ছিল যে, হেনরি সীমনস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ‘তাই আমি বলব…. বৈষম্য হ্রাসের জন্য প্রগতিশীল করব্যবস্থা শুধুমাত্র কার্যকর ও সক্ষম পদ্ধতিই নয়, বরং এটিই একমাত্র উপযুক্ত ব্যবস্থা যা এ যাবত প্রণয়ন করা হয়েছে। যে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা আমাদের কাম্য, অন্য সব ব্যবস্থা তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’। প্রগতিশীল করব্যবস্থা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হলো, কেননা এটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে মৌলিক কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, তা প্রগতিশীল কর বৈষম্য হ্রাস করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সমীক্ষা হতে দেখা যায় যে, কর কাঠামোয় প্রগতিশীলতার একটি আবরণ থাকলেও নানা ছাড়, রেয়াত, অব্যাহতি ও সুবিধা প্রদান এ ব্যবস্থার কার্যকারিতাকে ভোতা করে দিয়েছে। কর হতে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর অব্যাহতি প্রদানের ব্যবস্থা রাজস্ব হ্রাস করে এবং সম্ভবত কর ব্যবস্থাকেও ন্যায়নীতির পরিপন্থী করে তোলে। স্ট্রেয়ার অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সাধারণভাবে আয়করকে আয় পুনর্বণ্টনের হাতিয়ার হিসেবে যেরূপ কার্যকর মনে করা হয়, আয়কর বর্তমানে যেভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তাতে তার সেই কার্যকারিতা থাকছে না। অন্যান্য অনেক সমীক্ষা অনুরূপ উপসংতারে উপনীত হয়েছে। পেচম্যান আরো অগ্রসর হয়ে বলেছেন যে, কর্পোরেট ট্যাক্সের উপর কম এবং বেতন ও মজুরির উপর অধিক আয়কর আরোপের নির্ভরশীলতার কারণে গত ২০ বছরে করব্যবস্থা অধিক নিপীড়নমূলক হয়ে পড়েছে। British Institute of Fiscal Studies এর এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা হতে দেখা যায় যে, ১৯৭৯ সাল হতে বৃটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য কর-ভার লাঘবের জন্য রেয়াত পাবার এক জটিল পদ্ধতি উদ্ভাবন করে নিয়েছে। করব্যবস্থার নানা ফাঁকফোকর ও অসামঞ্জস্যতাকে ব্যবহার করে ধনীরা ধনীই থেকে যায়। ফলে সাধারণভাবে এ ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছে যে, প্রগতিশীল কর কোনো কোনো দেশে তা উল্টো দিকে চালিত হয়েছে।

যথাযথভাবে প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হলে করব্যবস্থার আয়ের পুনর্বণ্টন ন্যায়পরায়নতা আনয়নে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও কল্যাণ রাষ্ট্রের ব্যয় বৃদ্ধির চাপে আয় ন্যায়পরায়নতামুখী সংস্কারের পরিবর্তে আয়কর ও কর্পোরেট কর হার হ্রাসের দাবি উঠল। পুনর্বণ্টন করব্যবস্থা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্থ করে মর্মে দাবি করা হলো। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮৬ সালের কর সংস্কার আয়কর হারকে হ্রাস করে এমন পর্যায়ে নামিয়ে আনলো যা ১৯২০ সালের পর আর এরকম দেখা যায়নি। ফল দাঁড়াল এই যে, যখন পূর্বে অন্তত বাহ্যিক আবরণ হতে আয়-ন্যায়পরায়নতা অর্জন করব্যবস্থার লক্ষ্যস্বরূপে মনে হতো, কর হার হ্রাসের পর সে ধারণাও অবলুপ্ত হয়ে গেল।

অব্যাহত বৈষম্য

তিক্ত সত্য এই যে, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ও দৃশ্যত প্রগতিশীল করব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সম্পদ বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে গরীব আরো গরীব এবং ধনী আরো ধনী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব মতে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৮ সালে দারিদ্র্য রেখার নিচে জনসংখ্যা ছিল ১১.৪%, যা ১৯৮৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৩.৬%। ধনী দরিদ্রের মাঝে আয়ের ব্যবধানও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালের আয় সিঁড়ির নিম্নধাপের এক পঞ্চমাংশ পরিবার জাতীয় আয়ের ৫.৩% লাভ করত।

অপরদিকে উপরের সিঁড়ির এক পঞ্চমাংশ পরিবার পেত জাতীয় আয়ের ৩৮.২%। ১৯৮৬ সালে মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে নিচের এক পঞ্চমাংশ জনগণের হিস্যা ৪.৬% এ নেমে আসে। অপর দিকে উপরের এক পঞ্চমাংশ জনগণের হিস্যা ৪৩.৭% এ বৃদ্ধি পায়। মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অর্থনৈতিক কমিটির সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে ডেমোক্রেট দলের সদস্যগণ মন্তব্য করেছেন যে, গত দুই দশকে সম্পদের কেন্দ্রীভূতকরণ আরো বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৬২ সালে ০.৫% জনগণ সম্পদের ২৫.৬% নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৮৩ সালে তারা সম্পদের ৩৫.১% নিয়ন্ত্রণ করে। ৯০% মার্কিন জনগণের গৃহস্থালী সম্পদের হিস্যা গত ২১ বছরে ৩৪.৯% হতে ২৮% এ হ্রাস পেয়েছে। যৌথ অর্থনৈতিক কমিটির সভাপতি কংগ্রেস সদস্য ডেভিড আর ওবে রিপোর্টের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ধনী অধিকতর ধনী হয়েছে। তিনি আরো মন্তব্য করেন, যদি সম্পদ ক্ষমতা হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয় ১৯৬০ এর দশকের চেয়ে অধিকাংশ মার্কিন জনগণ বর্তমানে কম ক্ষমতার অধিকারী। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের অবস্থার তেমন কোনো হেরফের নেই। সুইডেন যাকে দৃশ্যত আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র বিবেচনা করা হয়, সেখানে উপরের ১০% পরিবারের জাতীয় আয়ে অংশ ছিল ১৯৭২ সালে ২১.৩%। ১৯৮১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৮.১% এ পরিণত হয়েছে। নিচের দিকের এক-পঞ্চমাংশ পরিবারের হিস্যা জাতীয় আয়েল ৬.৬% হতে ৭.৪% এ বৃদ্ধি পেলেও এ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।

(ঙ) উচ্চ প্রবৃদ্ধি

কল্যাণ রাষ্ট্রের ইতঃপূর্বে আলোচিত ব্যবস্থাসমূহ আয় ও সম্পদের বৈষম্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য কোনো ভুমিকা রাখতে পারেনি। তেমনি উচ্চ প্রবৃদ্ধির কৌশলও অধিকতর কোনো অগ্রগতি সাধন করতে সমর্থ হয়নি। কল্যাণ রাষ্ট্রের কর্মকৌশলে উচ্চ প্রবৃদ্ধিই হচ্ছে একমাত্র অস্ত্র, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, ফলে তা সার্বজনীন সমর্থন লাভ করে। যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাটি গতি লাভ করেছিল, তাই প্রবৃদ্ধিই শেষতক শ্রেণীহীন সমাজ রচনায় সক্ষম হবে মর্মে গভীর আস্থা প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এডহক অঙ্গ হিসেবে সামাজিক কর্মসূচিগুলো কাজ করছিল। কিছু কিছু লেখক প্রবৃদ্ধি ছাড়া পুনর্বণ্টনকে সামঞ্জস্যহী বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি এস্থনি ক্রশল্যাল্ড এর মতো বিখ্যাত সমাজতন্ত্রীও অনুভব করেছেন যে, প্রবৃদ্ধি অর্জনই পুনর্বণ্টনের জন্য একমাত্র কার্যকর পন্থা। কেননা আয়ের যে কোনো উল্লেখযোগ্য হস্তান্তরের ফলে জনসংখ্যার অধিকতর স্বচ্ছল অংশের প্রকৃত আয় হ্রাস পাবে এবং এর ফলে তাদের মাঝে হতাশার সঞ্চার হবে। কিছু বিখ্যাত নীতি নির্ধারক উপদেষ্টা আরো দ্রুততর প্রবৃদ্ধিকেই উন্নয়নশীল ও উন্নত নির্বিশেষে সকল দেশের সকল সমস্যার সমাধান বলে মনে করেন।

যাই হোক, দু’দশক যাবত উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার এবং ক্রমবর্ধমান সম্পদ দারিদ্র্য দূরীকরণ, প্রয়োজন পূরণ ও বৈষম্য হ্রাসে ব্যর্থ হয়েছে। অধিকতর কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বলে পরিচিত পশ্চিম জাম্রআনী, যুক্তরাজ্য ও জাপান নির্বিশেষে বিশ্বের সকল ধনী রাষ্ট্রে দরিদ্র জনগণের কিছু অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গৃহায়ন চাহিদা পূরণ হয়নি। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রব্যসামগ্রীর যে সয়লাব বয়ে এনেছে, তা মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধিতে কোনো অবদান রাখতে পারেনি। একটি সামগ্রিক বিশৃঙ্খলার লক্ষণসমূহ ক্রমবর্ধমান প্রকাশ লাভ করছে। মিশান এর ভাষায় সর্বত্র স্থিতি ও পরিমিতির বদলে অস্থিরতা ও অপরিমিতি বিরাজ করছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি এরূপ ক্রমাগত ধেয়ে চলা পুনর্বণ্টন লক্ষ্য অর্জনে যেমন সহায়তা করেনি, তেমনি অপরদিকে প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি ও বেসরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে সুদের হার ও মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উচ্চহারের প্রবৃদ্ধির ধারণাটি সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। World Commission on Environment and Development (ব্রান্ড-ল্যান্ড কমিশন) ১৯৮৭ সাল থেকে ‘টেকসই’ উন্নয়নের ধারণাটি জনপ্রিয় করে তুলেছে। টেকসই উন্নয়নের ধারণা আন্তঃপ্রজন্ম ও অন্তঃপ্রজন্ম ন্যায়পরতাকে ক্ষুণ্ণ না করে উন্নয়নের উপর জোর প্রদান করে। তবে ন্যায়পরতা ক্ষুণ্ণকারী কিছু উপাদান, যেমন উচ্চমাত্রার মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার, ঋণ পরিশোধের পরিমাণ, দূষণ ও অনবায়নযোগ্য সম্পদের ক্ষয় যদি বিবেচনায় আনা হয়, তবে ‘টেকসই’ উন্নয়নের কোনো উজ্জ্বল ছবির পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়।

অদূর ভবিষ্যতে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো সম্ভব নয়। আইএমএফ এর হিসেব অনুযায়ী ৯০ দশকের প্রথমার্ধে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৩% হতে পারে। এ ধরনের অবস্থার প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর নির্ভর করে সামষ্টিক ও বৈদেশিক অন্যায়পরায়নতা ও পুনর্বণ্টন সমস্যার সমাধান আশা করা যায় না। তাই সময়ের দাবি হচ্ছে কার্যকর নতুন কোনো কৌশল উদ্ভাবন।

(চ) পূর্ণ কর্মসংস্থান

দরিদ্র মানুষের অবস্থা উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উপায় কর্মসংস্থানের হার উচ্চমাত্রায় বৃদ্ধির লক্ষ্যও তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছে। পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশসমূহে বেকারত্ব পরিণত হয়েছে এক অমোচনীয় সমস্যায়। ১৯৭০ সালে ইউরোপের ওইসিডি দেশসমূহে বেকারত্বের পরিমাণ ছিল জনসংখ্যার ২.৭%। ১৯৯০ সালে বেকারত্বের পরিমাণ ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৮.১% এ এসে দাঁড়ায়। মধ্যবর্তী পর্যায়ে ১৯৮৬ সালে বেকারত্বে ৯.৯% এর শিখরে পৌঁছায়। নিকট ভবিষ্যতে এ হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে মনে হয় না। ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিক থেকে সকল বড় শিল্পোন্নত দেশে Non-accelerating Inflation Rate of Unemployment (NAIRU) তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে যুব সমাজের অস্বাভাবিক বেকারত্বের হার। কেননা বেকারত্ব বেকার যুবকদের আত্মসম্মানবোধকে আহত করে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিরাশা সৃষ্টি করে, সমাজ বিদ্বেষী করে তোলে এবং তাদের সম্ভাবনা ও ক্ষমতাকে তিলে তিলে ক্ষয় করে দেয়।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য কল্যাণ রাষ্ট্রের হাতে একমাত্র বড় যে হাতিয়ারটি রয়েছে তা হচ্ছে উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জন। ইউরোপে বেকারত্ব বৃদ্ধি রোধের জন্য ৩.৫% প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার অর্জন প্রয়োজন। কিন্তু ১৯৭৬ সাল হতে এক দশকের বেশি সময় ইউরোপের প্রবৃদ্ধির হার এ বেঞ্চমার্ক হারের কম। ১৯৭৮-৭৯ অর্থ বছরে অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু মধ্যবর্তী মেয়াদের জন্য প্রত্যাশা আশাব্যঞ্জক নয়। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বৃদ্ধি রোধের জন্য ২.৫%-৩% প্রবৃদ্ধি ও প্রয়োজন। কিন্তু ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রেরর প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ১.৭%। ১৯৯১ সালে এ হার আরো কম হবে বলে মনে হচ্ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র যদি তার বাজেট ঘাটতি হ্রাসে অধিকতর দৃঢ় সংকল্প হয়, তবে প্রবৃদ্ধির হার আরো কমে বেকার-সমস্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে। নিকট ভবিষ্যতে স্বল্প প্রবৃদ্ধি পূর্ণ কর্মসংস্থান অর্জনের সম্ভাবনা খুব উজ্জ্বল নয়। এরূপ হতাশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে লুইস ইম্মেরিজের কন্ঠে-“স্বল্প প্রবৃদ্ধির হার এবং ক্রমবর্ধমান শ্রমিক সংখ্যা- এ সমীকরণের দু’দিককে মিলিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাই পূর্ণ কর্মসংস্থানের লক্ষ্য পুরণ বলতে গেলে এ এক অসম্ভব আশা”।

কৌশলের ব্যর্থতা

পুঁজিবাদের সামাজিক-ডারউইনবাদী দর্শন হতে কল্যাণ রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে একটি শুভ উত্তরণ। অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে মানবত্তা স্বাভাবিকভাবে পুঁজিবাদ সৃষ্ট বৈষম্যকে স্বীকার করে নিতে পারেনি। তিনশত বছরের সেকুলার মতবাদও বস্তুত মানবসত্তার মৌলিক মূল্যবো ও চেতনাকে ধ্বংস করতে পারেনি। যাই হোক, কল্যাণ রাষ্ট্রের লক্ষ্য মানবতাবাদ হলেও ও অর্জনে কার্যকর কৌশল উদ্ভাবনে এ মতাদর্শ ব্যর্থ হয়েছে। বস্তুত পুঁজিবাদী দর্শন বা বিশ্বদৃষ্টিতে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনয়ন করেনি। এ মতাদর্শের এমন কোনো কার্যকর কর্মসূচি বা প্রেরণা নেই, যা ইনসাফ অভিমুখী লক্ষ্যের পরিপন্থী সম্পদের অপচয়মূলক প্রেরণা নেই, যা ইনসাফ অভিমুখী লক্ষ্যের পরিপন্থী সম্পদের অপচয়মূলক ব্যবহার রোধ করতে পারে। কল্যাণ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় একই পুঁজিবাদী জীবনব্যবস্থা, উৎপাদন পদ্ধতি এবং প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো বজায় রাখা হয়েছে যা ধনী দরিদ্রের মধ্যে দুস্তর ব্যবধার সৃষ্টির জন্য দায়ী। অর্থনৈতিক মৌলিক পুনর্গঠন ও কোনো সামাজিক দর্শন ব্যতিরেকেই মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বাজারব্যবস্থার সৃষ্ট বৈষম্যসমূহ সরকারের সক্রিয় ভূমিকা দ্বারা অপসারণ করা সম্ভব হবে- এ মর্মে যে ধারণা পোষণ করা হয়েছিল তা এক কল্পনাবিলাসের পর্যসবিত হয়েছে।

শিল্পোন্নত দেশসমূহে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দরিদ্র মানুষের দুঃখ- দুদর্শা কিছুটা প্রশমিত করলেও সামগ্রিক দরিদ্র মানুষের মৌলিক প্রয়োজনও পূরণ হলো না। বিত্তশালী ও বিত্তহীনের ব্যবধান শুধু প্রকৃত আয়ের দিকেই নয়, বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও গৃহায়ন সুবিধার প্রাপ্যতার দিকেও বাড়ছে। অবাক করার বিষয় হলো, জিডিপি’র উল্লেখযোগ্য অংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা সত্ত্বেও (সুইডেনে ৯% এর উপর) গরীব ও বৃদ্ধরা ত্বরিৎ ও উপযুক্ত চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছে না। হৃৎপিণ্ডের শল্যচিকিৎসা থেকে চোখের অপারেশনসহ অনেক গুরুতর ক্ষেত্রে তাদের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ঔষধপত্রের দুর্মূল্য সত্ত্বেও ঔষধপত্র তৈরির বৃহৎ কোম্পানীসমূহের চাপের মুখে সরকার ট্রেডমার্ক ঔষধের স্থলে সমমানের অথচ স্বল্প মূল্যের জেনেরিক ঔষধ বাজারে প্রচলন করতে পারছে না।

যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে স্বাস্থ্যসেবা মূলত বেসরকারি খাত দ্বারা পরিচালিত, সেখানে জনসংখ্যার ১৩.৩% তথা ৩১.৩ মিলিয়ন আমেরিকান নাগরিকের কোনো স্বাস্থ্যবীমা নেই। এদের মধ্যে ৮.৬ মিলিয়ন হচ্ছে শিশু। দেশের প্রতি ছয়জন শিশুর একজন হচ্ছে এই শিশুরা। গৃহায়ন সুবিদা সবার জন্য বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণীর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত গরীবদের নাগালে বস্তুত কোনো বাসস্থান সুবিধা নেই। অধিকাংশ গরীব মানুষ বাস করে ভাড়া বাড়িতে। গত দশকগুলোতে আয়ের চেয়ে বাড়ি ভাড়া দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কলেজ শিক্ষার ব্যয় আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তথাকথিত সমান সুযোগের অর্থনীতিকে তামাশায় পরিণত করেছে। আরো নির্মম পরিহাস হচ্ছে যে, প্রচলিত আর্থ-সামাজিক অবস্থা শুধু দরিদ্রকে দরিদ্রই রাখছে না, বরং দারিদ্রকে চিরস্থায়ীত্ব প্রদান করেছে। খুব নগণ্য সংখ্যক লোকই এ সর্বগ্রাসী কৃষ্ণবৃত্ত অনেক দেশের লক্ষ-নিযুত মানবসন্তান পুঁতিগন্ধময় বস্তির অন্ধ গলিতে বন্দী হয়ে আছে। কল্যাণ রাষ্ট্রের কথিত ছত্রচ্ছায়া সত্ত্বেও তাদের অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে। মাতৃপিতৃ পরিচয়হীন শিশু, অপরাধ, মাদক, গ্যাং এবং হতাশা মিলিয়ে এ হচ্ছে এক দুঃস্বপ্নের জগৎ। কল্যাণ রাষ্ট্রসমূহের সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ন্যায়পরায়নতাপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন স্বপনই রয়ে গেছে। বর্তমান বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, কল্যাণ রাষ্ট্র সম্পদের দক্ষ ও সুষম বিলিবণ্টনে ব্যর্থ হয়েছে। তা সত্ত্বেও যুক্তি দেখানো হয় যে, যদি কল্যাণ রাষ্ট্রের আবির্ভাব না হতো তবে নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা সামাজিক বৈষম্যকে আরো তীব্রতর করে তুলত। এ কথা স্বীকার করে নিলেও কল্যাণ রাষ্ট্রকে তার বহুল স্বীকৃত ব্যর্থতার দায়ভার হতে অব্যাহতি দেয়া যায় না। কল্যাণ রাষ্ট্রের কল্যাণকর সমাজের স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেলেও তার সকল কর্মসূচিই নিঃশেষিত হয়ে গেছে।

নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবিধিান, রাষ্ট্রায়করণ, ট্রেড ইউনিয়ন, রাজস্বনীতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পূর্ণ কর্মসংস্থানসহ কল্যাণমুখী সেবা সরবরাহে কল্যাণ রাষ্ট্রের সক্ষমতার বিষয়ে ব্যাপক আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। আলবার্ট হির্চম্যান বলিষ্ঠভাবে স্বীকার করেছেন যে, কল্যাণ রাষ্ট্র যে সংকটাপন্ন এ বিষয়ে আর কোনো বিতর্ক নেই।

১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে ওইসিডি দেশসমূহের উচ্চহারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে সামাজিক কল্যাণমূলক খাতে অধিক হারে সরকারি ব্যয় সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭০ এর দশকের প্রথম দিক হতে নিম্নহারের প্রবৃদ্ধি ও উচ্চহারের বাজেট ঘাটতি কল্যাণমূলক কর্মসূচিকে ব্যাহত করে। ফলে নতুন হাসপাতাল, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মানের অর্থায়নে ভাটা পড়ে। বর্তমান সুযোগ সুবিধার উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ায় তা অদক্ষ হয়ে ওঠে এবং বাড়তি চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়ে। কল্যাণ রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষিতে অধিক অর্থের যোগানই সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান হিসেবে দেখা দেয়। এমনকি বৃটিশ লেবার পার্টির মতেও অধিক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য অধিক সরকারি ঋণ ও ব্যয় অত্যাবশ্যক হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু ট্যাক্স বা মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি না করে তা কী করে করা সম্ভব সেটা দেখাতে তারা ব্যর্থ হয়। বিশাল বাজেট ঘাটতি এবং তজ্জনিত মুদ্রাস্ফীতি প্রতিক্রিয়ার দরুণ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অধিক অর্থের যোগান দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত সত্তর দশকের দুই অংকের মুদ্রাস্ফীতি পরিহারের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন ছিল নিম্নমাত্রার সরকারি বাজেট ঘাটতি এবং ঋণ সংকোচন। কিন্তু ট্যাক্সের বিরুদ্ধে বিরূপ জনমতের প্রেক্ষিতে সরকারি ব্যয় হ্রাস ব্যতিরেকে ঘাটতি কমানো সম্ভব ছিল না।

শক্তিশালী কায়েমী স্বার্থবাদী মহল জাতীয় স্বার্থের নামে প্রতিরক্ষা ও তাদের স্বার্থের অনুকূল অন্যান্য খাতে ব্যয় হ্রাসে বাধা প্রদান করে। ফলে বেকার ভাতা, ন্যূনতম মজুরি, চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য কল্যাণ সুবিধার মতো বহু সংখ্যক সামাজিক নীতি পুনর্বিবেচনার সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতির এ দ্বন্দ্ব কল্যাণ রাষ্ট্রকে সংকটে নিক্ষেপ করেছে। ‘আজকের হালনাগাদ চিন্তাধারাটি হচ্ছে কল্যাণ রাষ্ট্রের ক্রমপ্রসার ও প্রবৃদ্ধি সম্ভবত আর সম্ভব নয়, বা বলা যায় কাঙ্ক্ষিতও নয়’। বস্তুত ৬৪টি দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রণীত হ্যারল্ড ইউলেনস্কির রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে, ৭০ দশকে অনেক ধনী দেশে রাষ্টীয় সেবা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে।

রক্ষণশীল চিন্তার এ জোয়ার প্রায় সবগুলো কল্যাণ রাষ্ট্রকে প্লাবিত করে। তবে অবশ্যই এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অনাকাঙ্ক্ষিত। কেননা অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ব্যতিরেকে কোনো বড় মানবগোষ্ঠীর পক্ষেই তার মানবতাবাদী লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এমনকি পশ্চিমের পরিকল্পিত বাজার অর্থনীতির যে সাফল্য, তাও গড়ে উঠছে সেই কল্যাণমূলক সমাজের স্বপ্নের ভিতরে উপর ,যা কল্যাণ রাষ্ট্র সরবরাহ করেছে। তাই কল্যাণ রাষ্ট্রের চাকাকে দীর্ঘদিনের জন্য পেছন দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। যদি জনপ্রতিনিধিদের সময়ান্তরে বারবার নির্বাচনের জন্য জনতার মুখোমুখি হতে হয়, তবে তারা জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ না করে পারবে না। আর রাষ্ট্রের সক্রিয় কল্যাণমূখী ভূমিকা ছাড়া এসব প্রতিশ্রুতি পালন সম্ভব নয়। কল্যাণ রাষ্ট্র তাই উভয় সংকটে। তাহলে কি বলতে হবে, কোথাও কোনো ভুল রয়ে গেছে?

যুক্তি ভ্রান্তি

সমস্যা দেখা দেয়ার কারন হলো অন্যান্য যে কোনো দেশের মতোই কল্যাণ রাষ্ট্রকেও একই ধরনের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যদি কল্যাণমূলক খাতে অধিক সম্পদ ব্যয় করা হয়, তবে অন্যান্য উন্নয়নমূলক খাতে কল্যাণ রাষ্ট্র যে বন্ধনের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে তা হতে পরত্রাণ পাওয়া দুষ্কর। শুধুমাত্র বাজার মূল্যব্যবস্থার উপর নির্ভর করে সম্পদের অর্থনৈতিক উপকরণ বা সম্পদের উপর বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতের দাবিকে এমনভাবে হ্রাস করা সম্ভব নয়, যাতে সামাজিক লক্ষ্যসমূহ পূরণ অবিঘ্নিত থেকে যাবে। তার জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন অগ্রাধিকার নির্ধারণের অনুপ্রাণিত করা। উক্ত সামাজিক ঐকমত্য সৃষ্টি এবং তদানুযায়ী জনমত ও দাবিকে সেভাবে অনুপ্রাণিত করা। উক্ত সামাজিক ঐকমত্যর আলোকেই তখন বিভিন্ন খাতে কী হারে অর্থনৈতিক সম্পদ ব্যবহৃত হবে তা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। কিন্তু কল্যাণ রাষ্ট্র কাজ করে নৈতিক মূল্যবোধের বগ্লাহীন পুঁজিবাদী কাঠামোর আওতায়, যেখানে সামাজিক প্রয়োজন পূরণের অগ্রাধিকার নির্ণয়ের কোনো নৈতিক ঐকমত্য ভিত্তিক পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া নেই। অথবা সামাজিক ন্যায়নীতি, সামষ্টিক অর্থনীতি ও বৈদেশিক ভারসম্যের সাথে সংগতি রেখে ব্যক্তি ও দলসমূহকে তাদের দাবদাওয়াকে সংযত ও বিন্যস্ত করার জন্য অনুপ্রাণিত করার কোনো নৈতিক ব্যবস্থাপনা নেই। পক্ষান্তরে, উচিত-অনুচিত এর মানদণ্ড নির্ধারণ না করার সেকুলার মতাদর্শ ও ‘পেরিটো অপটিমালিটি’র কাঠামোর মধ্যে নীতি নির্ধারণ করার ফলে সীমিত সম্পদের উপর সরকারি ও বেসরকারি খাতের চাহিদার বিপুল ও অপ্রতিহত চাপ সৃষ্টি হয়। দেদার বিজ্ঞাপন প্রচার এবং লোভনীয় কনজুমার ঋণের লভ্যতা সমাজের প্রতিপত্তি অর্জনের যে ইঁদুর দৌড় চলছে তাতে আরো ইন্ধন যুগিয়েছে। সর্বোচ্চ সুযোগ, বৈষয়িক সুবিধা ও ভোগ অর্জন জীবনের চরম লক্ষ্য হওয়ায় কল্যাণ রাষ্ট্রের সেকুলার সমাজে জনগণের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি খাতে কল্যাণমূলক কর্মসূচির জন্য ব্যাপক ব্যয়ের কারণে যে বিশাল রাজস্ব ঘাটতির সৃষ্টি হয়, তাতে সীমিত সম্পদের উপর চাপ আরো জটিল আকার ধারণ করে।

সীমিত সম্পদের উপর সরকারি ও বেসরকারি খাতের চাহিদার বিপুল চাপে কল্যাণ রাষ্ট্র ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। যদিও এরূপ দ্বিমুখী চাহিদা প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করল, কিন্তু পরবর্তীতে তা সম্পদের ও চাহিদার মাঝে বিরাট ব্যবধান গড়ে তুলল। অনেক দেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতার মধ্য দিয়ে এ ব্যবধান প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ যেখানে বেইনসাফী অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে বাজেট ঘাটতি হ্রাস করা প্রয়োজন বলে অনুভূত হয়। রিগ্যান ও থ্যাচারের অর্থনৈতিক চিন্তাধার মোতাবেক বাজারব্যবস্থার উপর অধিক নির্ভরশীলতার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। জনপ্রিয়তার নিরিখে এটা মিসেস থ্যাচারের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ নীতি গুরুত্বের সাথে অনুসরণ করে এবং জনগণের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সরকারি আর্থিক ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি লাথ করেনি।

সুইডেনের মতো দেশ যেখানে জনগণের কল্যাণমুখী সেবার জন্য অধিকতর সুনাম রয়েছে, সেখানে উচ্চমাত্রার ট্যাক্স ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির দরুণ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে ,অতিরিক্ত মাত্রার ট্যাক্স জনগণের কর্মসংস্থান, সঞ্চয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করে। অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় সুইডেনে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার দ্বিগুণ। সুইডিস ক্রোনারের বিপুল অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে সুইডেনের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ শেয়ার মার্কেট সংকুচিত হচ্ছে এবং চলতি হিসাব ঘাটতি বেড়ে চলছে। বিশাল কর বেসরকারি সঞ্চয়কে দারুণভাবে ব্যাহত করছে। সুইডেনে বেসরকারি সঞ্চয়ের হার ছিল জাতীয় আয়ের মাত্র ০.৮%। তার তুলনায় অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশে এর হার ছিল ৯.৩%। ফলে সুদের হার বেড়ে যেতে বাধ্য, যা বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিকে আরো হ্রাস করে ভবিষ্যৎ সমস্যাকে তীব্রতর করে তুলবে। কিন্তু সরকারি ব্যয় হ্রাস ছাড়া ট্যাক্স কমানো সম্ভব নয়। অন্যথায় বাজেট ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা আরো বৃদ্ধি পাবে। তাই সবার কাছে সহজতম পন্থাটি হচ্ছে কল্যাণমুখী কর্মসূচিতগুলোতে সরকারি ব্যয় হ্রাস করা। তাই দেখা যায় নৈতিকতা নিরপেক্ষ কার্যপরিধির মধ্যে থেকে কর হার হ্রাস করা মূলত রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ভূমিকাসমূহ হ্রাসের নামান্তর মাত্র।

পশ্চিম জার্মানী ও জাপানের মতো দেশ যাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার মতো সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়নি, কিন্তু যারা কল্যাণ রাষ্ট্রের লক্ষ্য পূরণে বিভিন্ন মাত্রায় ব্যর্থ হয়েছে, তাদের সমস্যা ভিন্নতর। সমধর্মী আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের প্রয়োজনে তারা ঘাটতিবহুল দেশগুলোর চাপের সম্মুখীন হলো। এ চাপ উদ্বৃত্ত দেশসমূহকে দীর্ঘমেয়াদে তাদের সবল মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি অনুসরণে বাধা সৃষ্টি করল। প্রবল চাপের মুখে পশ্চিম জার্মানী ও জাপান উভয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডিসকাউন্ট হার ১৯৮৭ সালে সর্বনিম্ন ২.৫% এ নামিয়ে আনতে হলো, যা ছিল ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে যথাক্রমে ৪.৫% এবং ৫%। ফলে উভয় দেশই অনাকাঙ্ক্ষিত মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও ফটকাবাজারী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। উভয় দেশকে তাই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে (পশ্চিম জার্মানী) এবং ১৯৯০ সালের আগষ্টে (জাপান) ডিসকাউন্ট হার ৬.০% এ বৃদ্ধি করতে হলো। সুদের স্বল্প হারের এ সময়ে জাপানে স্টক ও রিয়েল এস্টেট বাজার শীর্ষে উঠে গেল যা দীর্ঘকাল ধরে রাখা সম্ভব হলো না। ঘাটতি দেশসমূহের অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং সবল মুদ্রা ও রাজস্বনীতি প্রয়োগ না করে শুধুমাত্র উদ্বৃত্ত দেশসমূহকে চাপের মুখে রাখার মাধ্যমে ঘাটতি দেশগুলোর তেমন কোনো উপকার তো হবেই না, বরং উদ্বৃত্ত দেশগুলোর সংকট বাড়বে। যেহেতু এ পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, তাই সমৃদ্ধ অর্থনীতিসমূহও অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হলো। স্বল্পমেয়াদী ফটকাবাজারী লগ্নী পুঁজির স্থান্ন্তর তীব্রতা লাভ করল। ফলে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও মুদ্রাবাজার পরিবেশ বিপন্ন হয়ে উঠল। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, পণ্য ও স্টক মার্কেটে অসিথরতার সৃষ্টি হলো।

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় চাহিদার নৈতিকতা-অনৈতিকতার বালাই না থাকায় একদিকে সার্বিক চাহিদার বিস্ফোরণ ঘটল, অন্যদিকে ঐ কাঠামোর মধ্যে থেকে কল্যাণ রাষ্ট্রে গরীবের অবস্থার যথার্থ উন্নয়ন করতে না পরার সমস্যা আরো জটিলতর হলো। পুঁজিবাদের অগ্রহণযোগ্য ত্রুটিগুলো সংশোধন করতে যেয়ে কল্যাণ রাষ্ট্রে সমভাবে অসমাধানযোগ্য নতুন সমস্যার জন্ম দিলো। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মাঝে সবচেয়ে কম স্বার্থ ত্যাগ করে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ের যে প্রতিযোগিতা তারই নাম হলো সেকুলার পুঁজিবাদের সামাজিক-ডারউইনীয় দর্শন বা ব্যবস্থা। জোড়াতালি দিয়ে এ ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণের প্রচেষ্টার কারণে কল্যাণ রাষ্ট্রের কর্মসূচি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। একদিকে কল্যাণ রাষ্ট্র কতিপয় মানবতাবাদী লক্ষ্য স্বীকার করে নিয়েছে, অন্যদিকে এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে সামাজিক ডারউইনবাদ ও ভোগবাদ। আশার সঞ্চার করে পুনঃ নিরাশ করা কতিপয় আর্থ-সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়া ব্যতীত কল্যাণ রাষ্ট্রের উপযুক্ত দুটি দিক দীর্ঘদিন পারস্পরিকভাবে সহাবস্থান করতে পারে না। এ ধরনের সমন্বয় ব্যবস্থা কতিপয় সমস্যার সমাধান করে, আবার অন্য কতকগুলো সমস্যার জন্ম দেয়। তাই সমাজ ও অর্থনীতির এমন মৌলিক পুনর্গঠন প্রয়োজন যাতে সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কল্যাণ রাষ্ট্রের মানবতাবাদী লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।

অনেক চিন্তাবিদ বর্তমানে এ বাস্তবতাকে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। মরিস ব্রুসের ভাষায়, কল্যাণ রষ্ট্রের ধারণা কোনো রাজনৈতিক সামাজিক চিন্তাভাবনা বা দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে জন্ম লাভ করেনি, কল্যাণ রাষ্ট্র কোনো সুপরিকল্পিত চিন্তার ফসল নয়। বস্ত্তত বিশেষ কতগুলো সমস্যার নিরসনে বছরের পর বছর ধরে যেসব প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তারই স্তূপীকৃত রূপ ব্যতীত কল্যাণ রাষ্ট্র আর কিছুই নয়। কল্যাণ রাষ্ট্রের দর্শন সম্পর্কে একই ধরনের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পিয়ীট থিয়োনেস, ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কারো পক্ষে সম্পূর্ণ ও যথার্থভবে এর প্রচার প্রচারণায় লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। কেননা একজন সমাজতন্ত্রীর কছে কল্যাণ রাষ্ট্র অর্ধসমাজতন্ত্র ব্যতীত আর কিছু নয়। আবার লিবারেলদের নিকটও এটি অর্ধ-লিবারেলিজম মাত্র’। সিডনী হুকের মন্তব্য হচ্ছে, “কল্যাণ রাষ্ট্রের পশ্চাতে যে সামাজিক দর্শন তা অপরিণত ও অস্পষ্ট”। বেরিংটনের ভাষায়, কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রবক্তাগণ এমনকি মৌলিক প্রশ্নগুলোরও অস্মপূর্ণ ও নেতিবাচক জবাব ছাড়া অন্য কিছু দিতে সক্ষম নয়। যেমন, কল্যাণ রাষ্ট্রের লক্ষ্যসমূহ কী? কল্যাণ রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে কল্যাণের সংজ্ঞা কী? তিনি পর্যবেক্ষণ করে যে, ‘একটি বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বসংকটের পর কল্যাণ রাষ্ট্র জন্মলাভ করেছে এমন অভাব বা দুর্ভিক্ষের সময় যখন সবার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ,যে অবস্থা বিরাজমান তা কারো কাম্য নয়; তা হচ্ছে সংকট, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শীত, বেকারত্ব, একনায়কত্ব, খাদ্য বা প্রতিভার অপচয়। তাই দেখা যায়, নেতিবাচক লক্ষ্যসমূহই কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে’। মিরডাল তাই বলেন, ‘কল্যাণ রাষ্ট্রের কর্মসূচিতে সরকারি হস্তক্ষেপের যে ব্যবস্থা দেখা যায় তা মতাদর্শ নয় বরং ঘটনাচক্রেরই ফলশ্রুতি’। সম্ভবত এ কারণেই কল্যাণ রাষ্ট্র আর্থ-সামাজিক সংস্কারে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। কল্যাণ রাষ্ট্রের সুসংবদ্ধ ও সামাজিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ সমন্বিত একক কোনো দর্শন নেই, যার ভিত্তিতে কার্যকর কর্মবূচি প্রণয়ন করা যেতে পারে, যে কর্মসূচির প্রতিটি উপাদান ক্রমঃসামঞ্জস্যময় যা মানবতাবাদী লক্ষ্যসমূহ অর্জনে সক্ষম।

যে শক্তিসূহ দারিদ্র্য ও বৈষম্যের জন্ম দেয় ও তাকে অব্যাহত রাখে তা এতই শক্তিশালী যে, কল্যাণ রাষ্ট্রের সামাজিক কর্মসূচির জোড়াতালি দেয়া ব্যবস্থা দ্বারা তার অপনোদন সম্ভব নয়। কল্যাণ রাষ্ট্র দরিদ্রের পক্ষে আয়ের পুর্নবন্টনের জন্য পেছনের দরজা দিয়ে যে পরোক্ষ ব্যবস্থা রেখেছে, তা দারিদ্র্য বৈষম্য সৃষ্টিকারী আর্থ-সামাজিক শক্তিসমূহকে অতিক্রম করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। দারিদ্র্যের জন্য দায়ী এসব শক্তিসমূহকে সরাসরি মোকাবিলা করা প্রয়োজন; লক্ষণসমূহের বদলে সমস্যঅর মূল্যে আঘাত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন আর্থ-সামাজিক কাঠামোর আমূল সংস্কার এবং পুঁজিবাদ বা তার উন্নত সংস্করণ কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিতে যে জীবনবোধ তার আমূল পরিবর্তন। এর ফলে বেকারত্ব, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধের মতো সামাজিক সমস্যাগুলো যা সমাজতন্ত্র ও কল্যাণ রাষ্ট্রের আবির্ভাব সত্ত্বেও ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে তার সমাধান করা সহায়ক হবে।

সত্যিকারভাবে বলতে গেলে, চিন্তাবিদগণ চাইলেও কল্যাণ রাষ্ট্রের স্ববিরোধিতামুক্ত এক সুসংবদ্ধ দর্শন রচনা করতে পারতেন না। কেননা উপযোগবাদ বা ন্যায়নীতির সামাজিক চুক্তির মতবাদের উপর ভিত্তি করে একটি সামাজিক কল্যাণ দর্শন গড়ে তোলা কী সম্ভব? বিচার-বুদ্ধি, ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক চুক্তির ধারণা কী আমাদের পেরিটো অপটিমালিটির অতিরিক্ত কিছু এনে দিতে পারে? এসব দর্শন সামাজিক ঐকমত্যভিত্তিক মূল্যবোধের বিজয় পতাকা তুলে ধরার জন্য মানুষকে জীবনমরণ পণ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের রক্তবীজ বপন করে কল্যাণ রাষ্ট্রের সংকট পারস্পরিক সহযোগিতা ও অন্যের কল্যাণে স্বার্থ ত্যাগে অনুপ্রাণিত করতে পারে না। এসব গুণাবলীর উন্মেষ দাবি করে মানুষের ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে ওঠার তাগিদ এবং নিজের স্বার্থকে কেঁটেছেটে সীমিত সম্পদের উপর চাপ কমানোর মানসিক প্রবণতা।

ব্যক্তিস্বার্থ ও উপযোগবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যে মূল্যবোধ ব্যবস্থা, তাতে দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের অবকাশ অনস্বীকার্য। তাই মানব সমাজের মূল্যবোধের ভিত্তি হওয়া উচিত ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’,’অশুদ্ধ’ বা ‘ভুল’ এরূপ সুস্পষ্ট সত্যের উপর ,যাতে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। এরূপ হলে ধনীদের স্বার্থহানি করে দরিদ্রের উপকার ঘটলেও কেউ কোনো প্রতিবাদ করবে না। একটি সেকুলার সমাজ সামাজিক ব্যবস্থাপনার কোনো প্রতিবাদ করবে না। একটি সেকুলার সমাজ সামাজিক ব্যবস্থাপনার কোনো সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়। মাইকেল নোভাকের ভাষায়, ‘বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থময় একটি সমাজের মাথার উপর কোনো পবিত্র আচ্ছাদন নেই। এ ধরনের সমাজে এ ধরনের কোনো মনোগত ইচ্ছাই নেই। আধ্যাত্মিকভাবে এটা একটি শূন্য মন্দির। এ মন্দির এমনই অন্তঃসারশূন্য যে, কোনো শব্দ, প্রতিবিম্ব বা প্রতীকই আমাদের সবার কাঙ্ক্ষিত কোনো বিষয়কে মূর্ত করে তোলে না’। কেবলমাত্র ঐমী নির্দেশনাই যদি না থাকে, তবে বিলাস পরিহার ও সবার প্রয়োজন মিটাবার স্বার্থে ব্যবহারে ছাড় দেয়ার জন্য ধনীদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করার জন্য আর কিছু আছে কী?

আশার আলো

কালো মেঘের আড়ালেও থাকে আশার রজত রেখা। পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও কল্যাণ রাষ্ট্রের সমালোচনামূলক ব্যবচ্ছেদে অর্থনৈতিক কালো মেঘের প্রান্তে আশারসে কিরণ দৃশ্যমান করে তুলছে। একমাত্র স্বার্থপরতাই মানবীয় কর্মকাণ্ডের পশ্চাতে ক্রিয়াশীল নয়- এ সত্য ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণের সাথে সাথে মানব সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অনিবর্যতা ক্রমশ গুরুত্ব লাভ করছে। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির মূলধারার সীমা ছাড়িয়ে তাই নানা চিন্তাধারা বিকশিত হয়ে উঠছে। এ সকল মতাদর্শ অবশ্যই প্রায় সমধর্মী, পার্থক্য হচ্ছে গুরুত্ব প্রদানের বিষয়গুলোর বিভিন্নতায়। এ ধরনের তিনটি মতাদর্শ উল্লেখের দাবি রাখে।

একটি মতাদর্শের নাম হচ্ছে Grants Economics। স্বার্থহীনভাবে কাজ করা ব্যক্তিমানুষের যৌক্তিক আচরণ হতে একটি বিচ্যুতি-এ মতাদর্শ তা মনে করে না। ‘শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থে মানুষ কাজ করে’- এ ধরনের যুক্তি বাস্তব অবস্থার সামগ্রিক চিত্র নয় মর্মে কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন। অর্থনীতিবিদ হান এর মতে, যৌক্তিক আচরণের সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রচলিত অর্থনীতিশাস্ত্র সম্ভবত ভুল করেছে। একজন মানুষ শুধুমাত্র পাই পাই আর্থিক লাভক্ষতির চুলচেরা হিসাব করেই চলবে এটা সম্ভবত ঠিক নয়। সুতরাং এ কথাও বলা যায় না। প্রচলিত অর্থনীতিতে মানুষের আচরণের বিষয়ে ফ্রীডম্যান এর সাফাই সত্ত্বেও কিছু অর্থনীতিবিদ ভিন্ন ধারণা পোষণ করেন। এটা বলা সম্ভবত যথৃর্থ হবে যে ,যদি অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও সূত্রের কাজ হয় মানুষের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে সঠিক ও অর্থপূর্ণ অনুমানে উপনীত হওয়া, তবে মানুষ স্বার্থপরতা নয়, পরার্থবাদের কাঠামোর মধ্যে থেকে অধিক যুক্তিযুক্ত আচরণ করবে-এ ধারণা করে নিলেই বরং অর্থনৈতিক আচরণ সম্পর্কে অধিক অর্থবহ পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব হবে। তাই মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিজ্ঞানের নামে অথনৈতিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে যে মানবিক আচরণের উপাদানকে অস্বীকার করা হয়েছে, তাকে যথাযথ স্থান দেবার জন্য Pareto Optimum-এর বিকল্প হিসেবে Boulding Optimum তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে।

দ্বিতীয় চিন্তাধারাটি হচ্ছে, প্রয়োজন পূরণভিত্তিক মানবতাবাদী অর্থনীতি। এটি সকল মৌলিক মানবিক মূল্যবোধের স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মানবকল্যাণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে।

শুধুমাত্র সম্পদের উপর প্রচলিত অর্থনৈতিক তত্ত্বের মতো গুরুত্ব মতো গুরুত্ব আরোপের বদলে মানবতাবাদী অর্থনীতি প্রয়োজন পূরণে সন্তোষ ও মানবিক চেতনার উন্নয়নের উপর জোর প্রদান করে। যার লক্ষ্য হচ্ছে আব্রাহাম মাসলো এর ভাষায় ‘আত্ম-উপলদ্ধি’ বা ‘আত্ম-সম্পূর্ণতা’।

তৃতীয় মতাদর্শ সামাজিক অর্থনীতি মতাদর্শ হিসেবে অভিহিত। এ চিন্তাধারা নৈতিক বিবেচনার ছাঁচে অর্থনৈতিক তত্ত্বের পুনর্বিন্যাসে বিশ্বাসী। উদারনীতিবাদী দর্শন হতে অর্থনীতিবিদগণ নৈর্ব্যক্তিক বিজ্ঞানমনস্কতার প্রতি অঙ্গীকারের যে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয়েছেন, তা প্রকৃত যুক্তির ধোপেও টেকে না এবং প্রত্যাশার প্রয়োজনীয়তার মানদণ্ডেও উতরে যায় না। এটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়, কেননা অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ তথাকথিত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ভিত রচিত কতকগুলো প্রাক-পক্ষপাতিত্ত্বমূলক অনুমানের উপর। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, কেননা এ কথিত অনুসন্ধান সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয়তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে না। মূল্যবোধ নিরপেক্ষ একটি শাস্ত্র কখনো জনগণের পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে নীতিমালা ও সুপারিশ প্রণয়নে সফলতা লাভ করতে পারে না। অধ্যাপক সেন তাই যথাযথভাবেই মন্তব্য করেছেন, ‘অর্থনীতিকে নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্নকরণের ফলে কল্যাণ অর্থনীতির সমৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে এবং একই সাথে তা বর্ণনামূলক ও পুর্বাভাসমূলক অর্থনীতির ভিতকে দুর্বল করে দিয়েছে। উপসংতারে তিনি বলেছেন যে, মানুষের আচার আচরণ ও বিচারবোধে যে নৈতিক বিবেচনা চালিত হয়, তার প্রতি যদি অধিকতর সক্রিয় মনোযোগ প্রদান করা হতো, তবে অর্থনীতিকে অধিকতর সমৃদ্ধশালী, দক্ষ ও কল্যাণকর শাস্ত্রে পরিণত করা যেত। সমস্যা হলো মূল্যবোধ হচ্ছে এমন চেতনাময় একটি প্রপঞ্চ যা বস্তুগত প্রকরণের মতো বিজ্ঞান দ্বারা প্রস্তুত বা নির্ণয় করা যায় না। আর্নল্ড ব্রেখটস এর ভাষায়, ‘মূল্যবোধের ক্ষেত্রে যারা বৈজ্ঞানিক কর্তৃত্বের দাবি করেন, তারা যে ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত তা বিজ্ঞানসম্মতভাবেই দেখানো যায়’। যদি মূল্যবোধকে ‘বৈজ্ঞানিক পন্থায়’ নির্ণয় করা সম্ভব না হয়, যদি ‘বিচারবোধ’কে প্রয়োগ করতে হয়, সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায় এ বিচারকের ভূমিকা কে পালন করবে?

এ ক্ষেত্রে কী কোনরূপ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব? এমন একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে তা সামাজিক স্বীকৃতি লাভের জন্য হবে যথেষ্ঠ শক্তিশালী এবং যে কেউ প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে কাজ করলে নিন্দিত হবে।

‘আত্মস্বার্থ’ ও ‘অর্থনৈতিক মানুষ’ সংশ্লিষ্ট ধারণার বিলোপ সাধিত হচ্ছে এবং চাহিদা পূরণ ও মূল্যবোধ বিচার সংক্রান্ত ধারণার বিকাশ ঘটছে। এতে দেখানো হচ্ছে যে, মানুষ বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করবে না। মানুষ তার যুক্তিবোধ উন্নত করতে, সমস্যার বিশ্লেষণ করতে এবং ভ্রান্তি আবিষ্কার করতে সক্ষম; যেটি সহজ নয়-সেটি হচ্ছে সমস্যার সমাধান। কোনো প্রকার জোড়াতালি বা কৃত্রিম পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়। সমাধান নিহিত রয়েছে সার্বিকভাবে সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এরূপ পুনর্গঠনের মধ্যে, যাতে একদিকে ‘অর্থনেতিক মানুষ’ পরিণত হবে ‘নৈতিকভাবে সচেতন’ মানুষে, যিনি ভ্রাতৃত্ববোধ এবং আর্থ-সামাজিক সুবিচারের মাধ্যমে জীবনযাপনে আগ্রহী; অপরদিকে তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে সকলের চাহিদা পূরণ হবে, অথচ আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা ও বৈষম্য বৃদ্ধি করবে না, বরং তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকবে।

যদিও মূল্যবোধের প্রতি গুরুত্বারোপের পুনর্জাগরণের বিষয়টি প্রশংসনীয়, কিন্তু পাশ্চাত্যের অর্থনীতিতে তার প্রয়োগ একটি দুরূহ কাজ। প্রধান কথা হচ্ছে, গলব্রেইথ এর মতে, ‘প্রচলিত ধারণার প্রতি রয়েছে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গীকার’- যাতে অর্থনীতিকে দেখা হয় একটি বিজ্ঞান হিসেবে এবং তারা বৈজ্ঞানিক ধারণায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিশুদ্ধতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। ধর্ম প্রদত্ত ঐকমত্য ব্যতীত মূলে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে গত দু’দশকে পাশ্চাত্যে নিরপেক্ষ মূল্যবোধ ব্যবস্থার প্রত অঙ্গীকারের ধাণা বহুদূর এগিয়ে গেছে। স্কাডউচ যথার্থই বলেছেন, সামাজিক নৈতিকতা ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত মানদণ্ডের উপর নির্ভরশীল, যা স্বতঃসিদ্ধ বলে বিবেচিত বিধায় খুব একটা বিতর্কের অবকাশ রাখে না। ব্যতিক্রমধর্মী কিছু লোক ছাড়া মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে নৈতিকতা কখনোই ধর্ম থেকে আলাদা করে দেখা হয়নি। উপযোগবাদ ও সামাজিক চুক্তি মতবাদ সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য কোনো মূল্যবোধ সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারেনি। পাশ্চাত্য জগত সম্পর্কে মিনস্কি মজার কথা বলেছেন, ‘আমাদের কী করা উচিত সে সম্পর্কে আমাদের ঐকমত্য নেই, কোনো প্রকার সম্মত মূল্যবোধ ছাড়া এরূপ ঐকমত্যে পৌঁছান কঠিন’।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *