তৃতীয় অধ্যায় – আল-আমীন [৮০৯-৮১৩ খ্রি.]
ক্ষমতা লাভ
খোরাসানে অভিযানকালে তুস নামক স্থানে খলিফা হারুন-আর-রশীদ ৮০৯ খ্রিস্টাব্দে যখন পরলোকগমন করেন তখন আমীন রাজধানী বাগদাদে, মামুন মার্ভে, কাশিম কিনিসিরিনে এবং সম্রাজ্ঞী জুবাইদা রাক্কায় ছিলেন। ডাক-বিভাগের প্রধান হামা- ওয়াইহ খলিফার মৃত্যু সংবাদ রাজধানীতে দ্রুত প্রেরণ করেন এবং পরের দিন আমীনের ভ্রাতা সালেহ আমীনের নিকট রাজকীয় সীলমোহর, তরবারি এবং খিলাত পাঠান। পিতার মৃত্যু সংবাদে আমীন কাসরুল খুলদ হতে কাসরুল খিলাফতে গমন করে পিতার মনোনয়নক্রমে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি আমীর, উমরাহ, সৈন্যবাহিনী এবং জনসাধারণের নিকট হতে আনুগত্য লাভ করেন। ভ্রাতা মামুনও আনুগত্য স্বীকার করে আমীনের নিকট উপঢৌকন প্রেরণ করেন। আমীনের মাতা জুবাইদা সসম্মানে রাক্কা হতে বাগদাদে আগমন করে রাজধানীতে বসবাস করতে থাকেন।
আমীন ও মামুনের মধ্যে গৃহযুদ্ধ
আল-আমীনের চার বছর রাজত্বকাল ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে কলুষিত হয়ে রয়েছে। আল-আমীন এবং মামুনের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধে আব্বাসীয় খিলাফতে বিপুল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই গৃহযুদ্ধের কয়েকটি বিশেষ কারণ ছিল।
গৃহযুদ্ধের কারণ : সম্রাজ্ঞী জুবাইদা এবং তাঁর ভ্রাতা ঈসা-ইবন জাফরের চাপে খলিফা হারুন ৭৯১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পাঁচ বছর বয়স্ক পুত্র মুহাম্মদকে ‘আল-আমীন (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এর সাত বছর পরে ৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে হারুন পুনরায় তাঁর পারস্য দেশীয় স্ত্রী মারাজিলের দ্বিতীয় পুত্র আবদুল্লাহকে ‘আল-মামুন’ (বিশ্বস্ত) উপাধিতে ভূষিত করে দ্বিতীয় মনোনয়ন দান করেন। উপরন্তু, খলিফা তাঁর তৃতীয় পুত্র কাশিমকে মামুনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন এবং স্থির হয় যে, অযোগ্যতার অজুহাতে মামুন প্রয়োজনহলে কাশিমকে অপসারণ করতে পারবেন। গিলমানের মতে, “বার্মেকীদের অভ্যুত্থানে পারস্য সম্প্রদায় ক্ষমতালাভ করে এবং তাদের পতনে আরব গোষ্ঠীর উত্থান হয়। এই দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেস্টায় হারুন তাঁর সাম্রাজ্যকে তাঁর জীবিতাবস্থায় তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত করে দেন।” আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয় : রাজধানীসহ পশ্চিমাঞ্চল আল-আমীনের অধীনে থাকবে; আল-মামুন মার্ভ হতে সমগ্ৰ পূর্বাঞ্চলে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন এবং মেসোপটেমিয়া ও কিন্নিসিরিনের শাসনভার কাশিমের উপর ন্যস্ত হবে। ৮০২ খ্রিস্টাব্দে হজ্বব্রত পালনকালে আল-আমীন এবং আল-মামুনের দ্বারা সম্পাদিত দুটি দলিল হারুন দুই পুত্রকে মনোনয়নের পবিত্র শর্ত পালনের জন্য বাধ্য করেন এবং দলিল দুটি পবিত্র কা’বাগৃহে সংরক্ষিত করেন। দলিল সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা খলিফা হারুন নিশ্চয় উপলব্ধি করেন। কারণ তিনি দুই পুত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রভেদ লক্ষ করে থাকবেন। সুতরাং বলা যায় যে, গৃহযুদ্ধের জন্য খলিফা হারুনই আংশিক দায়ী। গিলমান বলেন, “বিভেদ দূরীকরণের জন্য যে পরিকল্পনা করা হল পক্ষান্তরে তাই নিশ্চিতরূপে ব্যাপক আকার ধারণ করে।
ইবন আতীর বলেন, “খলিফা হারুনের পুত্র আমীনের দুর্বলতা এবং অনিশ্চিত চরিত্রের উপর আস্থা স্থাপন করতে না পেরে তাঁকে ভ্রাতা মামুনের সাথে শপথ করিয়ে একটি দলিলের বন্দোবস্ত (Covenant) করেন।” আমীন এবং মামুনের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ তাঁদের জন্ম ও শিক্ষাগত পার্থক্য; আল-আমীন সম্রাজ্ঞী জুবাইদার গর্ভজাত সন্তান এবং মামুন ছিলেন হারুনের পারস্য দেশীয় বেগম মারাজিলের গর্ভজাত সন্তান। খলিফা তাঁর ভাবী উত্তরাধিকারীদের যোগ্য শাসকরূপে গড়বার নিমিত্ত সেই যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা দেন! আমীন মাতা জুবাইদা এবং মাতুল ঈশা-বিন-জাফরের নিকট শিক্ষালাভ করেন। অপরদিকে মামুন মাতৃহারা হয়ে বার্মেকী উজির জাফরের যত্নে লালিত-পালিত হতে থাকেন। উভয় ভ্রাতা তৎকালীন প্রচলিত শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুগুলো গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে পাঠ করে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন সত্য কিন্তু উভয়ের চরিত্রে তার প্রতিফলন ভিন্নতর হয়। পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের ফলে আমীনের চারিত্রিক পরিস্ফুরণ হয় নি। অপরদিকে মামুন প্রকৃত বিদ্যাশিক্ষা লাভ করে গভীর অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হন। জ্ঞানপিপাসু মন তাঁকে উদার, কৃষ্টিমনা এবং চরিত্রবান হতে সাহায্য করে। উপরন্তু, শপথ গ্রহণের মধ্যে আমীনের প্রতি খলিফা হারুনের অনাস্থা প্রকাশ পায়। অপরদিকে মামুনের ধী-শক্তি, ব্যুৎপত্তি-জ্ঞান, বিচক্ষণতা এবং সাংঘঠনিক ক্ষমতার প্রতি পিতা হারুন সত্যই আকৃষ্ট হন। পরবর্তীকালে মামুন পিতার আশা বাস্তবে পরিণত করেন। বাগ্মীতায় উভয়ে পারদর্শী হলেও মামুন উত্তরকালে একজন আইনজ্ঞ ও দার্শনিকে পরিণত হন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে প্রমাণিত হবে যে, আমীন এবং মামুন দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। মামুনের চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ এবং তিনি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। উভয়ে উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করলেও আমীন অপেক্ষা মামুনের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা অধিক ছিল; কারণ, ৮০২ খ্রিস্টাব্দে হজ্বব্রত পালন উপলক্ষে মক্কায় গমন করে দলিলের মাধ্যমে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবার পর মামুনকে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। প্রাদেশিক রাজধানী মার্ভ হতে তিনি বিচক্ষণতা এবং অসামান্য দক্ষতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। অপরদিকে আমীন পিতার জীবদ্দশায় তাঁর উপর ন্যস্ত অঞ্চলের শাসনকার্য স্বীয় হস্তে গ্রহণ না করে ভোগ-বিলাসে আত্মনিয়োগ করেন। হারুনের মৃত্যুর পর পিতার মনোনয়নক্রমে খিলাফত লাভ করেও মদ্যপান এবং লালসা হতে তিনি নিবৃত্ত থাকতে পারেন নি। মামুনের তুলনায় তিনি ছিলেন অযোগ্য, দায়িত্বহীন এবং বিলাসপ্রিয়। টাইগ্রীস নদীতে প্রমোদ-বিহারের জন্য আমীনের সিংহ, হস্তী, সর্প, ঈগল এবং অশ্বের আকৃতিবিশিষ্ট পাঁচটি সুসজ্জিত বজরা ছিল। শতাধিক গায়িকা তাঁকে সঙ্গীত পরিবেশন করত। তাঁর ভোজনাগার অতি মুল্যবান গালিচা, কৌচ এবং আচ্ছাদনে সুসজ্জিত ছিল। নৃত্যপটিয়সীদের দ্বারা গঠিত সর্বপ্রথম আরব ব্যালে নৃত্যগোষ্ঠীর নৃত্য ও গীত খলিফা আমীনের ব্যক্তিগত পরিচালনায় কখনও কখনও সমস্ত রাত্রিব্যাপী রাজদরবারে চলত এবং আমীন এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। সঙ্গীতে আমীনের দুর্বলতা তাঁর অধঃপতনের সূচনা করে। একদিন সন্ধ্যায় আবু নুওয়াসের কবিতার কিছু অংশ আবৃত্তি করবার জন্য তাঁর পিতৃব্য প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ইব্রাহিম-আল-মাহদীকে তিনি ৩ লক্ষ দিনার উপহার দেন। মামুনের সৈন্য বাগদাদ আক্রমণ করবার সময়ও আমীন টাইগ্রিসের তীরে নিস্পৃহ অবস্থায় বসে গায়িকার সঙ্গীতে বিভোর ছিলেন।
হিট্টি বলেন, “খিলাফত অথবা উজির পর্যায়ে দুটি ব্যক্তিবিশেষের দ্বন্দ্ব অপেক্ষা এর (গৃহযুদ্ধ) গুরুত্ব অধিক ছিল। আপাতদৃষ্টিতে এটি বংশগত হলেও ইহা জাতীয, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়ের পরস্পর বিরোধী সংঘাতকেই জড়িত করে।” আমীনই একমাত্র আব্বাসীয় খলিফা যাঁর ধমনীতে অনারব রক্ত প্রবাহিত হয় নি এবং পিতা হারুন এবং মাতা জুবাইদার দিক হতে উভয়েই কুরাইশ বংশদর বলে দাবি করেন। অপরদিকে মামুনের মাতা ছিলেন মারাজিল (Marajil) নামে একজন পারস্যদেশীয় ক্রীতদাসী। সুতরাং হারুনের মৃত্যুর পর আরব-পারস্য দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। আমীনের সমর্থক ছিলেন রাজমাতা জুবাইদা, পিতৃব্য ইব্রাহিম, উজির ফজল- ইবন-রাবী এবং সভাসদবর্গ। পারস্য মাতার সন্তান মামুনের প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল পারস্যের খোরাসান অঞ্চলে এবং পারস্যবাদী তাঁকে ‘ভগিনীর পুত্র’ হিসেবে সমর্থন করত। মামুনের প্রধান উপদেষ্টাও ছিলেন পারস্যবাসী ফজল-ইবন-সহল। আরব-পারস্য দ্বন্দ্ব বার্মেকীদের পতনকে ত্বরান্বিত করে এবং পারস্য শাসকগোষ্ঠীর পতনে আরব প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। হারুন স্বয়ং উপলব্ধি করেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর পারস্য প্রভাবের বিরোধিতা আরব প্রজাদের মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করবে। তাঁর আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হয় এবং আমীনের রাজত্বে সাম্রাজ্য সম্পূর্ণরূপে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিদ্বেষভাবাপন্ন শিবিরে পরিণত হয়। হিট্টি বলেন, “এই ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব পরিশেষে নব-দীক্ষিত মুসলমানদের বিশেষ করে জাতীয়তাবোধ এবং কৃষ্টিসম্পন্ন পারস্যবাসীদের সাথে আরবীয় মুসলমানদের সংঘাত অনিবার্য রূপ ধারণ করে। এই বিভেদ-বিদ্বেষ একদিকে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত পারস্যবাসী, আলী-সমর্থক আরববাসী এবং ইয়েমেনবাসী, অপরদিকে সুন্নী সম্প্রদায়কে জড়িত করে।”
হারুন তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে সাম্রাজ্য বণ্টন করে যে শপথ-দলিল ( Covenant) সম্পাদিত করেন তাতে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ ছিল যে, আমীন তার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মামুনের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার অথবা খণ্ডন করলে সিংহাসন লাভের অধিকার হারাবেন; অপরদিকে মামুন আমীনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করলে তাঁর উত্তরাধিকারী হবার যোগ্যতা হারাবেন। তিন পুত্র স্ব স্ব শাসনাধীন প্রদেশের অর্থভাণ্ডার ও সৈন্যবাহিনী লাভ করবেন। ৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তুসে হারুন আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করলে দেহত্যাগের পূর্বে তাঁর সঙ্গের কোষাগার ও সেনাবাহিনীকে মামুনের নিকট অর্পন করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু আমীন খিলাফতে অধিষ্ঠিত হয়ে পিতার অন্তিম ইচ্ছা লঙ্ঘন করে হারুনের সৈন্যবাহিনী এবং ধনসম্পদ বাগদাদে ফিরিয়ে দিবার জন্য হুকুমনামা জারি করেন। তিনি গুপ্তচর এবং প্ররোচনা দ্বারা সৈন্যদের স্বপক্ষে আনেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হারুন তাঁর ধনসম্পদ এবং সৈন্যবাহিনী মামুনকে প্রদান করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু ঈর্ষাবশে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করে আমীন পিতার আদেশ অমান্য করলে এবং উস্কানিমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হলে মামুন তাঁর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, সিংহাসনের উত্তরাধিকারকে উপলক্ষ করে সংঘটিত গৃহযুদ্ধ ছিল বিলাসপ্রিয় ভ্রাতার সাথে ধর্মপ্রাণ ও বিচক্ষণ ভ্রাতার সংঘাত, কিন্তু বস্তুত এই যুদ্ধ আমীনের উজির ফজল ইবন-রাবীর সাথে মামুনের উজির ফজল-ইবন- সহলের মতানৈক্য, ঈর্ষাপরায়ণতা এবং স্বার্থ-সংঘাতের ফলেই সংঘটিত হয়। এই দুইজন উজির রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা ছিলেন এবং তারা তাদের স্ব স্ব প্রভুর ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারে তৎপর হন। হারুনের রাজত্বে উজির পদ হতে বঞ্চিত হয়ে হাজীব নিযুক্ত হলে উচ্চাভিলাসী ফজল-ইবন-রাবী বার্মেকীদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হন। বার্মেকীদের পতনের পর তিনি উজির পদে অধিষ্টিত হন এবং তুসে খলিফার মৃত্যুকালে তিনি খলিফার সঙ্গে অবস্থান করতেছিলেন। খলিফার মৃত্যুতে আমীন সিংহাসন লাভ করলে ফজল-ইবন- রাবী তাঁর নির্দেশক্রমে উৎকোচ এবং দুই বছরের অগ্রিম বেতন প্রদান করে হারুনের সৈন্যবাহিনী এবং কোষাগার আমীনের সপক্ষে আনেন। উচ্চাভিলাসী এবং ক্ষমতালিপ্সু রাবী বুঝতে পারেন যে, অযোগ্য এবং লালসাগ্রস্ত আমীনের খিলাফতে উজির হিসেবে তিনি সাম্রাজ্যে সর্বময় কর্তার মর্যাদা লাভ করবেন। এমনকি তিনি সিংহাসন লাভের দুরাশাও মনে মনে পোষণ করতেন। অপরদিকে মামুনের উপদেষ্টা এবং উজির ছিলেন সুযোগ্য শাসক ফজল-ইবন-সহল। একদিকে আমীনের চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে আরব-সমর্থক গোষ্ঠীর প্রধান রাবী রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেষ্টা করেন; অপরদিকে পারস্যবাসী আমীরগণের নেতৃত্ব দান করে সহল তাদের ভাগিনেয় মামুনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করবার প্রয়াস পান। সিরিয়াবাসী ক্রীতদাস রাবী হযরত ওসমানের খিলাফতে ইসলামে দীক্ষিত হন এবং খলিফা হারুন এবং আমীনের রাজত্বে বার্মেকীদের বিরোধিতা করেন এবং পারস্য প্রাধান্য খর্ব করে আরব প্রভুত্ব কায়েমের চেষ্টা করেন। সহল একজন অগ্নি উপাসক ছিলেন কিন্তু ধর্মান্তরিত হলেও তিনি পারস্যের জাতীয়তাবোধ, কৃষ্টি, রীতি-নীতি বর্জন করতে পারেন নি। রাবী এবং সহল উভয়েই বিচক্ষণ কূটনীতিবিদ ছিলেন; কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ, জ্ঞানদীপ্ত পারস্যবাসী সহল ক্ষমতালিপ্সু, অযোগ্য, ঈর্ষাপরায়ণ এবং কুচক্রী রাবী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। মামুনের কর্মদক্ষতা, বিচক্ষণতা, জনপ্রিয়তা এবং জ্ঞান-গরিমা বিলাসপ্রিয় আমীনকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে। এছাড়া মামুনের শাসনে পরাস্যবাসী তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে এবং প্রবীণ ও প্রখ্যাত সেনাপতি হারসামা ও উদীয়মান সৈনিক তাহির-ইবন-হুসাইনও মামুনের পক্ষে যোগদান করেন। রাজ্যকর হতে অব্যাহতি দিয়ে মামুন প্রাচ্যদেশীয় জনসাধারণের সমর্থন লাভ করেন। মামুনের উত্তরোত্তর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কুচক্রী রাবী এবং আলী-বিন-ঈশা নামক জনৈক সভাসদের কুমন্ত্রণায় খলিফা আমীন ভ্রাতা মামুনকে বাগদাদে ডেকে পাঠান। কিন্তু পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার অজুহাতে মামুন মার্ভ ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। আদেশ অমান্য করবার অভিযোগে খলিফা তাঁকে খোরাসানের শাসনকর্তার পদ হতে অপসারণের আদেশ জারি করেন এবং তাঁর নামে খুৎবা পাঠ নিষিদ্ধ করেন। সাম্রাজ্যের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করবার মানসে রাবীর পরামর্শে আমীন পিতার মনোনয়ন লঙ্ঘন করে ভ্রাতা কাশিমকেও মেসোপটেমিয়া ও সীমান্ত অঞ্চলের শাসনকর্তার পদ হতে অপসারিত করেন।
আমীন ও মামুনকে কেন্দ্র করে আবর-পারস্য দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত ক্রমশ প্রকট আকার ধারণ করে। অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে আমীন ৮১০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুসাকে ‘নাতিক-বিল-হক’ বা ‘সত্য বিঘোষক’ উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিছুদিন পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্রকে ‘কায়িস-বিল-হক’ বা ‘সত্য নিষ্ঠাবান’ উপাধি দান করে তৎপরবর্তী উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। মামুন খিলাফত লাভ করলে ক্ষমতাচ্যুত এবং বিশ্বাসঘাতকরূপে চিহ্নিত হবার আশঙ্কায় রাবী আমীনকে এই ‘মারাত্মক পদক্ষেপ’ (Fatal step) গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেন। পিতার মনোনয়নকে অবজ্ঞা এবং লঙ্ঘন করে আমীন তাঁর এবং পক্ষান্তরে সাম্রাজ্যের সঙ্কটকে ত্বরান্বিত করেন। রাবীর পরামর্শে কা’বাগৃহে রক্ষিত প্রতিজ্ঞাপত্র দুটি এনে আমীন সেগুলো টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলেন। এর ফলে আমীন ও মামুনের মধ্যে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। প্রধান উজির রাবী খলিফা হারুন কর্তৃক মামুনকে প্রদত্ত ১০,০০,০০০ দিরহাম এবং তাঁর ব্যক্তিগত সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। মামুনের সমর প্রস্তুতিতে বিচলিত হয়ে রাবী জনৈক নওফেলের তত্ত্বাবধানে অবস্থানরত মামুনের দুই পুত্রকে বন্দী এবং হত্যা করবার পরামর্শ দেন। অবশ্য খলিফা আমীন এতে কর্ণপাত করেন নি।
গৃহযুদ্ধ : ৮১২ খ্রিস্টাব্দে জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা আমীনের সঙ্গে কনিষ্ঠ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা মামুনের সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে মামুন তাঁর রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে প্রহরী মোতায়েন করেন এবং যাতায়াতের উপর কড়া বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। খলিফা আমীন আলী-ইবন-ঈশার নেতৃত্বে ৫০,০০০ সৈন্যের একটি বিশাল সেনাবাহিনী রায়ের দিকে প্রেরণ করেন। রায়ের তাহির-বিন-হুসাইনের সেনাপতিত্বে মামুনের একটি বিশাল সৈন্যদল আমীনের বাহিনীকে প্রতিরোধ করে এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। যুদ্ধে ঈশার পরাজিত হওয়ার সংবাদ পেয়ে আমীন সেনাপতি আবদুর রহমানের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বাহিনী প্রেরণ করেন। মামুনের সেনাধ্যক্ষ তাহির ঈশাকে পরাজিত ও নিহত করে হামাদানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং আবদুর রহমান-বিন-জাবালা ও কাতির-ইবন- কাদিয়ার নেতৃত্বে খলিফার দুটি বাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন। অতপর তিনি কাযউইন দখল করে হুলওয়ান অভিমুখে যাত্রা করেন। ইত্যবসরে প্রধান সেনাপতি হারসাম মার্ভ থেকে বিশাল পারস্য-বাহিনী নিয়ে হুলওয়ানে ঘাঁটি স্থাপন করেন এবং তাহিরকে আহওয়াজ এবং সুসার দিকে প্রেরণ করেন। এদিকে মামুন কর্তৃক বাগদাদ অবরোধ অবশ্যম্ভাবী দেখে আমীনের সেনাপতি হুসাইন-বিন-আলী-ইবন-ঈশা সিরীয় সৈন্যদের প্ররোচিত করে ৮১২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ দখল করেন। ৮১২ খ্রিস্টাব্দে মামুন ‘আমীর-উল-মুমেনীন’ উপাধি গ্রহণ করে সমগ্র পারস্যে স্বীয় প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন।
মামুন খলিফার পদমর্যাদা লাভ করলেও সমস্ত আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার সুযোগ হতে বঞ্চিত ছিলেন। তাঁর সুদক্ষ সেনাপতিগণ ধীরে ধীরে সমগ্র পূর্বাঞ্চল ও আরব ভূখণ্ড দখল করে বাগদাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তাহির টাইগ্রীসদের পূর্বাঞ্চল অধিকার করে আহওয়াজে প্রধান কার্যালয় স্থান করেন। এরূপে ইয়ামামা, বাহরাইন, ওমান এবং ওয়াসিত অধিকৃত হয়। কুফার শাসনকর্তা হাদির পুত্ৰ আব্বাস, সরার শাসনকর্তা মাহদীর পুত্র মনসুর, মক্কা-মদিনার শাসনকর্তা দাউদ-বিন- ঈশা-বিন-মুসা মামুনের বশ্যতা স্বীকার করেন। ইত্যবসরে তাহির মা’দাইন দখল করে বাগদাদ অবরোধ করেন এবং আনবার ফটকে ঘাঁটি স্থাপন করেন। উত্তরাঞ্চল হতে প্রধান সৈন্যবাহিনী নিয়ে হারসামা এবং জুহাইর-ইবন-নুসাইর বাগদাদ অভিমুখে রওয়ানা হয়ে তাহিরের সাথে মিলিত হন এবং তাঁর শক্তি বৃদ্ধি করেন। এক বছর বাগদাদ অবরুদ্ধ থাকাকালীন এই সুরম্য নগরীর যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়। তাহির, হারসামা ও জুহাইর তিন দিক হতে আক্রমণ করে বাগদাদ অবরোধ করলে নগরবাসিগণ আমীনকে ত্যাগ করে মামুনের পক্ষাবলম্বন করে। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা হতে জানা যায় যে, বাগদাদ অবরোধকালে বিলাসপ্রিয় আমীন নৃত্য ও সঙ্গীতে মগ্ন ছিলেন। কিন্তু সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে ভীত ও শঙ্কিত হয়ে খলিফা তাঁর মাতা জুবাইদা এবং পরিবারবর্গসহ ইউফ্রেটিসের পশ্চিম তীরে মদিনা আল-মনসুর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিশ্বাসঘাতক হুসাইন-বিন-আলী বাগদাদের জনসাধারণকে প্ররোচিত করে এবং খলিফাকে নজরবন্দী করে ক্ষমতা গ্রাসের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলে তিনি করারুদ্ধ হন। খলিফা তাঁকে ক্ষমা করে তাহিরের বিরুদ্ধে হুলওয়ানে প্রেরণ করেন। কিন্তু দলত্যাগ করলে তিনি ধৃত ও নিহত হন। উজির ফজল-ইবন-রাবী হুসাইনের ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যোগান বলে মামুনের বাহিনী কর্তৃক বাগদাদ অবরুদ্ধ হলে তিনি আত্মগোপন করেন। সুষমামণ্ডিত নগরী বিধ্বস্ত হলে আমীনের পক্ষে দুটি পথই খোলা ছিল : আত্মসমর্পণ করা; অপরটি সিরিয়ায় পলায়ন করা। আমীন শেষেরটি বেছে নিলে তাহির আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। আমীন তাহিরের পরিবর্তে হারসামার নিকট আত্মসমর্পণ করলেও সীলমোহর এবং রাজকীয় পোশাক তাহিরের নিকট অর্পণ করা হবে। কিন্তু আল-আমীন এই চুক্তি ভঙ্গ করে গোপনে তাহিরের অগোচরে হারসামার নিকট আত্মসমর্পণ করবার জন্য রওয়ানা হন। নদী পার হবার সময় তাহিরের সৈন্য কর্তৃক আক্রান্ত হলে তিনি টাইগ্রীসে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাত্রির অন্ধকারে একদল উগ্রপন্থী হতভাগ্য আমীনকে ৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ভ্রাতার হত্যার সংবাদে মামুন খুবই মর্মাহত ও শোকাভিভূত হয়ে হত্যাকারিগণকে উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেন এবং তিনি আমীনের পরিবার-পরিজন ও রাজমাতা জুবাইদাকে সসম্মানে রাজদরবারে স্থান দেন। আমীন চার বছর আট মাস সন্ত্রাসমূলক রাজত্ব করে মাত্র ২৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
গৃহযুদ্ধের ফলাফল : খলিফা আমীনের সাথে বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ও পূর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা মামুনের গৃহযুদ্ধকে আরব ও পারস্যের জাতীয় সংঘর্ষ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সামাজিক দৃষ্টিকোণ হতে সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী আরবদের প্রতি নিপীড়িত ও বঞ্চিত অনাবর পারস্যবাসীর বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠে। ধর্মীয় দিক দিয়ে বিচার করলে এই গৃহযুদ্ধ সুন্নী এবং শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি মারাত্মক সংঘাত বলে মনে করা হয়। বলা বাহুল্য যে, খোরাসান অঞ্চলই আব্বাসীয় প্রধান প্রচারক ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আবু মুসলিমের কর্মক্ষেত্র। পরিশেষে এই অঞ্চলই আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে প্রাধান্য লাভ করে। ইমামুদ্দিন বলেন, “উমাইয়াদের ক্ষমতাচ্যুত করে আরবদের উপর পারস্যবাসিগণ আংশিক বিজয় লাভ করে; কিন্তু আমীনের উপর মামুনের প্রভুত্ব বিস্তার আরবদের উপর তাদের সম্পূর্ণ বিজয় সূচিত করে।”
মামুনের সফলতার কারণসমূহ
(১) আমীন ও মামুনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, উভয়ের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ প্রভেদ রয়েছে। মামুন ছিলেন সৎ, ধৈর্যশীল, ন্যায়নিষ্ঠ, ধর্মভীরু, জ্ঞানী ও চরিত্রবান। অন্যদিকে আমীন ছিলেন অলস, অকর্মণ্য, কৃতঘ্ন এবং লালসাগ্রস্ত। দর্শন, আইন, কুরআনের ব্যাখ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মামুন যেরূপ খ্যাতি অর্জন করেন, তদীয় ভ্রাতা আমীন সুরা, নারী ও সঙ্গীতে মগ্ন থেকে ততোধিক কুখ্যাতি অর্জন করেন। প্রমোদ-বিহার, ব্যালে-নৃত্য, মৃগয়া এবং সঙ্গীত আমীনের প্রধান আকর্ষণ ছিল আর মামুনের প্রধান আকর্ষণ ছিল জ্ঞানের চর্চা। নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের নিমিত্ত আমীনের অনৈসলামিক কার্যকলাপে সুন্নী জামাত তাঁর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে, পারস্যে মামুন স্বীয় প্রতিভার পরিস্ফুরণ দ্বারা প্রতিপত্তি সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
(২) আমিনের অযোগ্যতা : দুর্ভাগ্যবশত বৈমাত্রেয় ভ্রাতা আমীন অপেক্ষা মামুন যোগ্য, কর্মঠ ও সুদক্ষ শাসক ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্রের কর্মক্ষমতা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রতি সন্দেহ থাকায় হারুন তাঁর সাথে মামুনকে প্রতিজ্ঞাচুক্তিতে আবদ্ধ করতে চাহেন। স্বার্থান্বেষী ফজল-ইবন-রাবী আমীনের রাজকার্যে নিস্পৃহতার জন্য সাম্রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতা লাভ করেন; কিন্তু তাঁর কুশাসনে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অপরদিকে যোগ্য শাসক মামুনের ততোধিক যোগ্য ও কর্মক্ষম উজির অত্যধিক বিলাস-বাসন আমীনের অধঃপতনের এবং মামুনের সাফল্যের প্রধান কারণ।
(৩) মামুনের অভিজ্ঞ সেনাপতিবৃন্দ : হারুনের বিশাল সাম্রাজ্য তিন অঞ্চলে বিভক্ত হওয়ায় রাজধানী বাগদাদ আমীনের আওতাভুক্ত করা সত্ত্বেও তাঁর সামরিক ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। অপরদিকে, আব্বাসীয় ক্ষমতার উৎস খোরাসান এবং মার্ভ অঞ্চল রণদক্ষ পারস্যবাসী মামুনের পতাকাতলে আসলে তাঁর সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। বলা বাহুল্য যে, আমীনের সেনাপতি আলী-ইবন-ঈশা অপেক্ষা মামুনের সেনাধ্যক্ষ তাহির-বিন-হুসাইন, হারসামা এবং জুহাইর সুদক্ষ রণকুশলী ছিলেন। মামুনের সুযোগ্য সেনাপতিদের বীরত্বপূর্ণ অভিযানে বাগদাদ অবরুদ্ধ এবং অধিকৃত হয়। মামুন বিচক্ষণতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সর্বপ্রথম পূর্বাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চল (মক্কা- মদিনাসহ) দখল করে রাজধানীতে অভিযোগ প্রেরণ করেন।
(৪) পারস্যবাসীদের সমর্থন : পারস্য মহিলার সন্তান বলে পারস্যবাসিগণ মামুনকে ‘ভগ্নীর পুত্র’ অথবা ভাগিনেয় মনে করত। এই পারস্যবাসীদের সক্রিয় সহযোগিতা এবং সমর্থন ব্যতীত মামুন কখনই খিলাফত লাভ করতে পারতেন না। অপরদিকে, আরব গোষ্ঠীর নেতা হয়েও অযোগ্যতা, অসাধুতা, অমিতব্যয়িতা এবং অশালীন ব্যবহারের জন্য আমীন প্রজাদের সমর্থন লাভ করতে পারেন নি। এ কারণে বাগদাদবাসিগণ প্রথমে হুসাইন-ইবন-আলীর প্ররোচনায় এবং পরে বাগদাদ অবরোধের প্রাক্কালে আমীনের বিরোধিতা করে। দুর্গ হতে পলায়নকালে স্বর্ণ ও রৌপ্য পাত্র গলিয়ে নগরবাসীদের মধ্যে বিতরণ করেও আমীন তাদের সমর্থন ও সাহচর্য লাভ করতে পারেন নি। অপরদিকে পারস্য উজির ফজল-ইবন-সহলের পরামর্শে মামুন একটি সুসজ্জিত এবং সুসংঘবদ্ধ বাহিনী গঠন করে। ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব প্রকৃতপক্ষে আরবদের উপর পারস্যবাসীর প্রধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করে।
(৫) আমীনের সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতা : রায়ের সন্নিকটে আমীনের সেনাপতি আলী-ইবন-ঈশা মামুনের সেনাধ্যক্ষ তাহিরের নিকট পরাজিত ও নিহত হলে তার পুত্র হুসাইন খলিফার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন। ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপে তিনি সিরীয় বাহিনীকে খলিফার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেন এবং বাগদাদে অভিযান করে আমীন এবং রাজমাতা জুবাইদাকে বন্দী করেন। পরবর্তীকালে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাঁকে হত্যা করা হয়। উপরন্তু, স্বার্থান্বেষী ও ক্ষমতালিপ্সু রাবী আমীনের পতনের পূর্ব মুহূর্তে পলায়ন করেন। আমীনের কর্মচারী এবং সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতা তাঁকে ক্ষমতাহীন করে। অপরদিকে মামুনের সুশাসনে তাঁর সামরিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা সুসংহত হয়। অমিতব্যয়িতার ফলে আমীনের রাজকোষ শূন্য হতে থাকে। সঙ্গীতপ্রিয় আমীন আবু নুওয়াসের কবিতার কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করায় তাঁর পিতৃব্য বিখ্যাত সঙ্গীত বিশারদ ইব্রাহিম ইবন-আল-মাহদীকে তিন লক্ষ দিনার উপহার দেন। নৌ-বিহারের জন্য তিনি জন্তুর আকৃতিতে যে পাঁচটি বজরা নির্মাণ করেন তার প্রত্যেকটি নির্মাণে তিরিশ লক্ষ দিরহাম খরচ হয়। এহেন অমিতব্যয়িতা আমীনের রাজত্বে অভিশাপস্বরূপ ছিল। সুতরাং ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে আমীনের পরাজয় এবং মামুনের সফলতা অনিবার্য ছিল।
আল-আমীনের চরিত্র
আল-আমীন তদীয় মাতা অর্থাৎ তারুন পত্নী জুবাইদা ও মামা ঈশার নিকট লালিত-পালিত হন। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তিনি বিলাসপ্রিয় ও চপলমতি ছিলেন। তিনি দায়িত্বশীল ছিলেন কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক ছিলেন না। তিনি সর্বপ্রথম হারেমে মহিলা পরিচালক নিযুক্ত করেন এবং তাদের পুরুষের মত পোশাক পরিধান করতে হত। তিনি আমোদ-প্রমোদে অধিক সময় ব্যয় করতেন। রাজ্যের বিভিন্ন স্থান হতে তিনি সুন্দরী নারী ও গায়িকা সংগ্রহ করে নাচ ও গানের মাত্রাধিক পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। টাইগ্রীস নদীতে জলবিহারের জন্য তিনি সিংহ, হস্তী, ঈগল, সর্প ও অশ্বের আকারে পাঁচটি সুন্দর ও নক্সাকৃতি বজরা তৈরি করেন।